দশম পরিচ্ছেদ
অনাগত বিশ্ব-সংস্থা ও ইসলাম
দুনিয়া আজ শতধা-বিচ্ছিন্ন। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, ব্যক্তিতে রাষ্ট্রে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে চলছে অবিরাম সংগ্রাম। এ সংগ্রাম আপাতত বিভিন্ন মানুষের জাতীয় সংগ্রাম বলে মনে হলেও আসলে তা মতবাদেরই সংগ্রাম-মানব জীবনকে বিভিন্ন সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ফলে যে একদেশদর্শী মতবাদের সৃষ্টি হয়, তার ফলে ভিন্নমত পোষণকারী লোকদের মধ্যে শুরু হয় ভীষণ যুদ্ধ।
আধুনিক কালে ধনতন্ত্র ও বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রের সংঘর্ষে দুনিয়ার আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠেছে। ধনতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদে। তার গোড়ার কথা প্রত্যেক মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমষ্টি থেকে তার পার্থক্য। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদের মূলে রয়েছে ব্যষ্টির স্বার্থপরতার স্বীকৃতি। সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি পরার্থপরতা। ধনতন্র স্বার্থপরতাকেই মানুষের আদি ও কৃত্রিম মনোবৃত্তি বলে মেনে নিয়েছে। সমাজতন্ত্র তার স্বার্থপরতাকে স্বাভাবিক প্রধান বৃত্তি বলে গ্রহণ করেছে। বর্তমান জগতের এ সংগ্রামের মূলে রয়েছে মানুষের এক বৃত্তির সঙ্গে অপর বৃত্তির সংগ্রাম। বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টই বোঝা যায়, এই দ্বন্দ্বের মূলে (১) মানব জীবন সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা, (২) তারই অবশ্যম্ভাবী ফল ভুয়া অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য দাবি, (৩) প্রকৃত মৌলিক অধিকারগুলোর মাঝে সমন্বয়ের ব্যর্থতা, (৪) জ্ঞানের রাজ্যে সামঞ্জস্যের অভাব।
১. ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদের সমাজের আদি-উপকরণরূপে ব্যষ্টির সত্তাকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়ছে। মতের সামান্য ভিন্নতা সত্ত্বেও ইংরেজ দার্শনিক লক থেকে শুরু করে এ্যাডাম স্মিথ পর্যন্ত যে চিন্তাধারা পাওয়া যায়, তার সারসংক্ষেপ এই বলা যায়ঃ মানুষের চিন্তারাজ্যে চলেছে অণুর খেলা। একটা সংবেদন অন্য একটা সংবেদন২২৪ থেকে ভিন্ন। একটা ধারণা অপর ধারণা থেকে ভিন্ন। একটা অণু অন্য একটা অণু থেকে ভিন্ন। অনেকগুলো ধারণার কার্যকারিতার ফলে গড়ে ওঠে মনোজগৎ। আবার অনেকগুলো অণুর সমবায়ে সৃষ্টি হয় জড়জগৎ। তেমনি সমাজে বা রাষ্ট্রে চলেছে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের বা প্রাধান্যের চেষ্টা। মানুষ সর্বদাই একক। সেই একক মানুষের সঙ্গে অন্যান্য মানুষের সংস্পর্শে গড়ে ওঠে তার সমাজ, জাতি বা রাষ্ট্র। মানুষের আদি সত্তায় রয়েছে অহংবোধ ও স্বার্থপরতা।
তাই সেই আদি মানুষের চলাফেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিন্তাধারায় অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে। তার কাজ-কর্ম বা গতিবিধিতে যাতে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না হয়, তার প্রতি লক্ষ্য রেখেই রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। ফরাসি দার্শনিক রুশো এ মতবাদের বিরোধিতা করলেও তাঁর মতবাদও ব্যষ্টিকেন্দ্রিক। শুধু পার্থক্য এই যে, লক প্রমুখ ইংরেজ দার্শনিক মানবমনের মননশীলতার ওপর জোর দিয়েছেন, রুশো গুরুত্ব আরোপ করেছেন তার প্রক্ষোভের ওপর। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, ‘মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু সে সর্বত্রই শিকলাবদ্ধ থাকে’। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের ওপর কোন আইন-কানুন চাপানো যায় না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নানা আইন মেনে চলতে হয় এবং তার ফলে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। রুশো মানুষকে আবার তার স্বাভাবিক ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আহ্বান করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, প্রকৃতির কোলে স্বাভাবিক পরিবেশে মানুষের প্রক্ষোভ পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারে। অপ্রাকৃত মানব-সৃষ্ট পরিবেশে তা হওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতিতে পশু, পাখি কারো কোন দুঃখ-দৈন্য নেই। তারা অবাধে বিহার করে। তাদের অভাবেরও কোন তাড়না নেই, কারণ অভাবের উৎপত্তি হলেই তারা নিবৃত্তির উপায়ও তার পক্ষে সহজলভ্য। মানুষ তার বুদ্ধির প্যাঁচে গড়ে তুলেছে তার সমাজ, তার রাষ্ট্র, নানবিধ আচার-অনুষ্ঠান। এতে মানবজীবনের পরিপূর্ণ স্ফূর্তি লাভ হয় না বলেই জীবনে দুঃখের হয় উৎপত্তি। তার ধারণা ছিল, প্রকৃতি থেকে বিকাশের ধারায় কোন এক সময়ে মানুষকে তার জন্মগত স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়। তার আত্মরক্ষার জন্য অন্য মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে সে গড়ে তোলে তার গোত্র, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্র। রুশোর জীবনে তাই সর্বপ্রধান সমস্যা ছিল অন্যান্য লোকের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্র গঠন করেও ব্যষ্টি কিভাবে তার স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে তার উপায় উদ্ভাবন।
মানুষের সত্যিকার স্বরূপ সম্বন্ধে এতে যে কল্পনা-প্রবণতা স্থান পেয়েছে তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। ইতিহাসের ধারার আলোচনা করলেই দেখা যায় মানুষ কোনকালেই একক ছিল না। তার উৎপত্তি যেভাবেই হোক না কেন সে স্বভাবতই যূথচারী জীব। অন্যের সংশ্রব ও সংস্পর্শ ব্যতিরেকে সে এক মুহূর্তেও তিষ্ঠাতে পারে না। শরীরের মধ্যে যেমন বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের একত্র সমাবেশের ফলে শরীরযন্ত্র কার্যক্ষম থাকে, তেমনি বিভিন্ন মানুষের সমবায়মূলক কার্যকারিতায় গড়ে ওঠে মানুষের সমাজ, তার রাষ্ট্র। তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারা যায়,মানুষের চিন্তাধারায় যুগ-যুগান্তর মননের রয়েছে স্পষ্ট ছাপ, বহু যুগের বিবর্তন। সে কোন সময়েই সম্পূর্ণ একা নয়।
আপাতদৃষ্টিতে ষড়রিপু মানুষকে সমষ্টি-চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কাম, ক্রোধ প্রভৃতি রিপু ব্যক্তিকে অন্য দশজন মানুষ থেকে পৃথক করে বলেই আমাদের ধারণা। বাস্তবিক পক্ষে তা নয়। কাম রিপু স্বভাবতই বহির্মুখী। একেবারে নিছক বিকল্প না হলে আপনার দেহেই কেউ মজে থাকতে পারে না। আত্মকাম সুস্থ মনের লক্ষণ নয়। কাম জাগৃতিক সময়২২৫ থেকেই বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গ কামনা মনের মাঝে স্ফুরিত হয়। সে ব্যক্তির সংশ্রবে যে তৃতীয় জীবের সৃষ্টি হয় তার উপর নারী, পুরুষ উভয়ের গরজ হয় কেন্দ্রীভূত।
যে কোন রিপু নিয়েই আলোচনা চলুক না কেন, আমাদের বাধ্য হয়েই স্বীকার করতে হয়, নিছক আত্মকেন্দ্রিক ভোগসর্বস্ববাদ বলে দুনিয়ায় কিছু নেই। ব্যক্তি নিয়ে রওয়ানা দিলে তার পরিণতি সমষ্টিতে এসে থামতে হয়। কাজেই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ যেমন ধরে নেয়া হয়, ব্যক্তিমাত্রেই একক২২৬ বাস্তবিক পক্ষে দুনিয়ার বুকে তেমন কোন ইউনিট নেই।
অপরদিকে বস্তুতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে যেভাবে ইউনিট হিসেবে শ্রেণীগুলোকে নেয়া হয়েছে, তাও এক মহাভ্রান্তির ফল। বস্তুতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রবাদের পিতা কার্ল মার্কস ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর শোষণের ভয়াবহ রূপ দেখে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূল উচ্ছেদ করার জন্য তিনি তাকে পুঁজিবাদের উৎস বলে ধরে নিয়েছেন।
বাস্তবিক পক্ষে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধ শোষণের কোন কারণ হতে পারে না। দুনিয়ায় যাঁরা মনীষী, মননধর্মী, যাঁদের গবেষণার ফলে দুনিয়ার প্রগতি হয়েছে সম্ভবপর-তাঁরা সকলেই ছিলেন আত্মপ্রচারবাদী কিন্তু কেউই স্বার্থপর ছিলেন না। মননধর্মী মানুষমাত্রেরই স্রষ্টা হিসেবে বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাঁরা স্বার্থপর নন।
কাজেই বস্তুতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রবাদীরা যেভাবে মনে করেন ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধ, স্বার্থপরতা এক ও অবিভাজ্য- তা কোন মতেই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে টিকতে পারে না।
স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতার মধ্যে কোন মৌলিক প্রভেদ নেই। তাদের সবসময়ই আপেক্ষিকতার সূত্রে বিচার করতে হয় । কোন ব্যক্তি যখন কেবল তার নিজের সুখ-সুবিধার জন্যই মরিয়া হয়ে পরিশ্রম করে, তখন তাকে বলা হয় স্বার্থপর। আবার সেই ব্যক্তিই যখন তার পরিবারের জন্য পরিশ্রম করে তখন তাকে বলা হয় পরার্থপর। তার ঐ পরার্থপরতা ও কওমের পরার্থপরতার তুলনায় স্বার্থপর ও সংকীর্ণ, যে স্বদেশ-প্রেমিক স্বজাতি ও স্বদেশের মঙ্গলের জন্য হাসিমুখে আত্মোৎসর্গ করে, তাকে বলা হয় নিঃস্বার্থ ব্যক্তি, কিন্তু বিশ্বপ্রেম ও বিশ্বমৈত্রীর তুলনায় তাও অকিঞ্চিৎকর।
মানুষের জীবন এক ও অবিভাজ্য। মনে হয় স্বার্থপরতার সৃষ্টি সংস্কৃতি ও বৈদগ্ধের ফলে তারই হয় প্রসার। তখন আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে সে বৃহত্তর সত্তার মধ্যে তার আত্মার দোসর খুঁজে পায়। আমাদের সকল শিক্ষারই আসল লক্ষ্য মনের সম্প্রসারণ।
২. সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রাথমিক ইউনিট, না সমষ্টিই প্রাথমিক সংখ্যা- এ প্রশ্নের মীমাংসার পর রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্পূর্ণ নির্ভর করে। ব্যষ্টির দাবি অগ্রগণ্য হলে দুনিয়ার সমস্ত অধিকার ব্যষ্টির হাতেই ছেড়ে দিতে হয়। অপরপক্ষে সমষ্টির দাবি প্রধান হলে ব্যষ্টির অধিকার বলে কিছুই থাকে না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ব্যষ্টিকেই আদি সংখ্যা হিসেবে গণ্য করায় দুনিয়ার সম্পদের ওপর ব্যষ্টির অখন্ড অধিকার স্বীকার করে নিয়েছে। অপরদিকে সমাজতন্ত্রবাদে ব্যষ্টির কোন অস্তিত্বই স্বীকার করা হয় না। কাজেই সমাজতন্ত্রবাদের মতানুযায়ী রাষ্ট্র গঠিত হলে সেখানে ব্যষ্ট্রি স্বীকৃত অধিকার বলে কোন কিছু থাকে না। প্রকৃতপক্ষে ব্যষ্টি ব্যতীত সমষ্টি একটা সাধারণ ধারণা মাত্র, আবার সমষ্টি-জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যষ্টি-জীবন কল্পনাই করা যায় না। উভয়েই উভয়ের পরিপূরক ও পরিবর্ধক। আমরা পূর্বেই দেখেছি, ব্যক্তি-জীবনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যে স্থান, সমষ্টি-জীবনে ব্যষ্টিরও সেই স্থান। কাজেই ব্যষ্টি বা সমষ্টির স্বার্থ পরস্পরবিরোধী নয়। অথচ দুনিয়ার ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে ব্যষ্টি ও সমষ্টির দ্বন্দ্বের রক্তচিহ্ন।
ব্যষ্টি ও সমষ্টির বিরুদ্ধ ও বৈরীভাবের পরেই বর্তমানে চলছে দুনিয়ার হত্যাকাণ্ড। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় স্বীকৃত হয়েছে ব্যষ্টির একমাত্র অধিকার, অপরপক্ষে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যষ্টির অধিকার করা হয়েছে সম্পূর্ণ বিলোপ।
ব্যষ্টি ও সমষ্টির এ ভুয়ো দ্বন্দ্বের তখনই নিরসন হতে পারে, যখন তাদের প্রকৃত স্বরূপের আলোকে তাদের অধিকারের ব্যবস্থা করা হয়। ব্যষ্টি ও সমষ্টির স্বার্থ যদি প্রকৃতপক্ষে পরস্পরবিরোধী না হয়, তাহলে তাদের এ মৌলিক পার্থক্য অস্বীকার করার সঙ্গে তাদের ভুয়ো অধিকার বিলোপ করাও প্রয়োজন।
৩. ব্যষ্টি বা সমষ্টির অধিকার ভুয়ো হলে মানব জীবনে কতকগুলো মৌলিক অধিকার সর্বত্রই স্বীকৃত হয়েছে, যে সকল অধিকারের বলে মানুষ ব্যক্তিজীবনে বা সমাজজীবনে পূর্ণ বিকশিত হতে পারে তাদের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা সর্বপ্রধান। ফরাসী রাষ্ট্র-বিল্পবের পর থেকে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের মৌলিক অধিকার বলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। নিতান্ত দুঃখের বিষয়, আধুনিককালে দুনিয়ার বুকে এমন কোন রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হয়নি, যাতে মানবজীবনের এই তিনটি মৌলিক অধিকারের সমন্বয় সাধন সম্ভবপর হয়েছে। কোথাও স্বাধীনতার নামে সাম্য ও মৈত্রিকে দেয়া হয়েছে বলিদান-কুরবানী, সাম্য ও মৈত্রীর জন্য স্বাধীনতাকে দেয়া হয়েছে বিসর্জন।
একথা অবশ্য সত্য যে, রাষ্ট্র গঠিত হলে তার একটা নিজস্ব শক্তি সঞ্চিত হয় এবং তার নিজস্ব একটা অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়। গনতন্ত্রমূলক রাষ্ট্রেও রাষ্ট্রের একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়। সেখানে যে কোন ব্যক্তিকে যা’তা করতে দেবার অধিকার দেয়া হয় না। তার গতিবিধি কার্যকলাপ অনেক স্থলেই রাষ্ট্র কতৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। এমন যে অবাধ স্বাধীনতার মন্ত্র বা ‘একা থাকতে দাও’ নীতি সেখানেও ব্যষ্টিকে অবাধ উৎপাদন ও যদৃচ্ছ বণ্টনের স্বাধীনতা দেয়া আপাতত স্বীকৃত হলেও তার মধ্যে নানা শর্ত আরোপ করা হয়। পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও রাষ্ট্রের পক্ষে অকল্যাণকর কোন দ্রব্য কোন ব্যক্তিকে বা প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদন করবার স্বাধীনতা দেয়া হয় না।
কাজেই সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতাকে আপক্ষিকভাবেই গ্রহণ করতে হবে। যেসব দেশে মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে রয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশী স্বাধীনতার সুযোগ সেগুলোকে বলতে হবে- স্বাধীনতার সুযোগদানকারী। আর যেসব রাষ্ট্রে জীবনযাত্রার প্রাথমিক চাহিদা পূরণের ব্যাপারে ইতর-ভদ্র ভেদাভেদ নেই, সেখানে সাম্যবাদ বা মৈত্রী ফলে উঠেছে বলেই ধরে নিতে হবে।
বর্তমানকালে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে সাম্য ও মৈত্রী বলতে কিছুই নেই। অপরদিকে বস্তুতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীয় রাষ্ট্রে স্বাধীনতাকে অত্যন্ত সংকুচিত করা হয়েছে। দুনিয়ার বুকে আব্র শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে এমন কোন সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের দরকার যাতে সাম্য ও মৈত্রীর স্বাধীনতাও পাশাপাশি স্থান পায়।
৪.মানব জীবনের জ্ঞানের ক্ষেত্রগুলোকে পৃথকীকরণের ফলে মানব সভ্যতার ইতিহাসে হয়েছে একটা বিকট দ্বন্দ্বের উৎপত্তি। মধ্যযুগে যাজক সম্প্রদায় সর্বসাধারন মানুষের ওপর অকথ্য নির্যাতন করতো বলে রাষ্ট্রকে চার্চ থেকে পৃথক করার নীতি গৃহীত হয়। সে নীতি এখনও দুনিয়ার বুকে চালু রয়েছে। ইতালির রেনেসাঁয় তার সূচনা হয়। জার্মানিতে রিফরমেশন সে চিন্তাধারা আরো বিকাশ লাভ করে এবং ফরাসি রাষ্ট্রবিপ্লবে তা’ পূর্ণ পরিণতি লাভ করে।
এর ফলে যাজকের অন্তর্ধানে সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের প্রভাব থেকেও রাষ্ট্র মুক্তি পায়। মানব-মনের আদিম বৃত্তি ধর্মপ্রবণতা থেকে রাজনীতি বিচ্ছিন্ন হওয়ার রাজনৈতিক জীবনে নানাবিধ দুর্নীতি অবাধে প্রবেশ করে।
প্রত্যেক ধর্মের মধ্যেই রয়েছে কতকগুলো নৈতিক আইন, যেগুলোর প্রয়োগ নির্ভর করে প্রয়োগকারীর ব্যক্তিগত চরিত্রের ওপর। সে উন্নত চরিত্রের লোক হঁলে সেই নৈতিক আইনগুলো সমাজ-জীবনকে উচ্ছৃঙ্খলতার পঙ্কিল প্রবাহ থেকে মুক্ত রাখে। অপরদিকে প্রয়োগকারী স্বয়ং দুষ্কৃতকারী হলে সমাজজীবনে চলে অন্যায় ও অবিচারের বন্যা।
মধ্যযুগীয় যাজক সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির বাসনায় উন্মত্ত হয়ে পড়লে রাষ্ট্রকে তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করার অদম্য উৎসাহে ধর্মের প্রভাব থেকেও রাজনীতিকে মুক্ত করার হয়েছে। তার ফলে ব্যক্তিগত জীবনে যেসব নীতি অবশ্য পালনীয় বলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করে, রাজনীতিতে সে সব নীতি মোটেই গ্রহণীয় হয় না। অনেকেই রাজনীতিকে ধর্মের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করার উৎসাহে বলে থাকেন, “সীজারের যা প্রাপ্য সীজারকে দাও, খোদার প্রাপ্য খোদাকে দাও”। ভেবে দেখবার বিষয়-এভাবে মানব-মনকে কি দুটো কামরায় ভাগ করা যেতে পারে? যে ব্যক্তি সীজারের প্রাপ্য সীজারকে দিতে চাইবে, তার মনের নিভৃত কোণে কি এ প্রশ্ন জাগবে না? বাস্তবিকপক্ষে সীজারের প্রাপ্য কি আল্লাহ্কে বঞ্চিত করার ওপরই নির্ভর করে? কেবল রাষ্ট্র-জীবনকে ধর্ম-জীবন থেকে পৃথক করার ফলেই দুনিয়ার অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে না। জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত না হলেও তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে মানব-জীবন নানা অশান্তির সৃষ্টি হয়। ধর্মজতৎ, কর্মজগৎ, মনোজগৎ, বাইরের জগৎ, অন্তরের জগৎ- যে কোন জগতেই হোক না কেন সকল জগতে একই জীবন, একই মন থাকে ক্রিয়াশীল। জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে যোগসূত্র ও সামঞ্জস্যের সৃষ্টি না হলেও তাতে নানা সংঘর্ষ বাধে। তার ফলে ব্যক্তিজীবনে বা সমাজজীবনের ভারসাম্য হয় নষ্ট।
জ্ঞানের রাজ্যে সামঞ্জস্যের সৃষ্টি করতে হলে জ্ঞানের সবগুলো সিদ্ধান্তের মধ্যে সংহতি সৃষ্টি হওয়া দরকার। সেই সংহতির আলোকে জীবনের নানাবিধ সমস্যার সমাধান হলে তবেই মানবজীবনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসতে পারে।
কোন ব্যক্তির জীবনে পরস্পরবিরোধী ভাবধারা বর্তমান থাকলে বুঝতে হবে, তার জীবনে রয়েছে সংহতির অভাব। সেরূপ সমাজজীবনে নানাবিধ বিরোধী ভাবের সৃষ্টি হলেও সেই জীবনে জ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্যের সৃষ্টি হয় নাই বলে স্বীকার করতে হবে।
তাই মানবজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে মানবজীবনকে গভীরভাবে পাঠ করতে হবে সর্বপ্রথমে। খোলা মন নিয়ে তার জীবনের প্রতিটি দিককে তলিয়ে দেখতে হবে।
এ ব্যাপারে অবরোহ পদ্ধতিতে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। মানবজীবন সম্বন্ধে কোন এক স্বতঃসিদ্ধকে ধ্রুব সত্য বলে প্রথমে ধরে নিয়ে আরোহ পদ্ধতিতে কোন সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছলে পূর্বতন ভুলেরই পুনরাবৃত্তি হবে।
মানবজীবনের ছোটখাটো তুচ্ছ অভিজ্ঞতা ও উপকরণকে স্বীকার করে তারই ভিত্তিতে সঠিক সত্যে উপনীত হওয়াই জ্ঞানের চরম লক্ষ্য। মানবজীবনের বিভিন্ন জ্ঞানের ক্ষেত্রে এভাবে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত এসে পৌঁছে, সেগুলোর মধ্যে সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে যেসব নীতি বা সত্তাকে স্বীকার করে প্রয়োজন তাকে কার্যকরী সিদ্ধান্ত হিসেবে ধরে নিয়ে হতে হবে অগ্রসর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমানকালের পদার্থবিদ্যার সিদ্ধান্ত অনিশ্চয়তাবাদের সঙ্গে জীববিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের সামঞ্জস্য বিধান করতে গেলে কী পাওয়া যায়? অনিশ্চয়তাবাদের পরমাণুর মধ্যে এক সাশ্রয়ী লীলাই আবিষ্কৃত হয়েছে, অপরদিকে জীববিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত অনুসারে শক্তিমানের উদ্বর্তন ও জীবনযুদ্ধের সূত্র ধরেই জীবন চলছে তার বিকাশের পথে। এ দুটো মতবাদকে সুসমঞ্জস করে তুলতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে-বিশ্বের আদিতে রয়েছে এক সাশ্রয়ী শক্তির স্থিতি-সেই শক্তিই জড় পদার্থরূপে, জীবনরূপে ক্রমবিকাশের ধারায় নানাবিধ মান সৃষ্টি করে চলছে।
তার সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের বা সমাজবিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলো যুক্ত করলে সেই পূর্বেকার সার্বিক সিদ্ধান্তকে আরও ব্যাপক আকারে পরিবর্ধিত করতে গেলে এবং তাদের নিদ্দগিএ সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করলে, সে সিদ্ধান্তের আরও পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের প্রয়োজন হতে পারে।
মোটামুটি আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতাকে স্বীকার করে তার ব্যাখ্যার জন্য এমন একটি সার্বিক সত্যে এসে পৌঁছা দরকার, যাতে জীবনের সকল দিকের প্রতি সুবিচার করা হয় এবং জীবনের বিভিন্ন জ্ঞানের ক্ষেত্রে হয় সামঞ্জস্য সাধন।
ইসলামে মানবজীবনকে সূক্ষ্মভাবে অধ্যয়ন করার জন্য রয়েছে বিশেষ তাগিদ। দ্বিতীয়ত যে দ্বন্দ্বে আজকের দিনের দুনিয়া রক্তকলুষিত সে দ্বন্দ্বের নিরসনের উপায় উদ্ভাবনেরও চেষ্টা ইসলাম করেছে। জ্ঞানের রাজ্যে কৃত্রিম ভেদরেখা তুলে নিয়ে একই সূত্রে জীবনের সকল ক্ষেত্রের করা হয়েছে ব্যাখ্যা এবং মানবীয় বিভিন্ন অধিকারের করা হয়েছে সমন্বয় সাধন। ইসলাম গোড়াতেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে স্বার্থপরতার যোগ স্বীকার করেনি, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে ইসলাম সবসময়েই তার বিকাশের হেতু বলে ধরে নিয়েছে। সেই ব্যক্তিত্ব বিকাশের অর্থ এ নয় যে, অপরকে শোষণ করে সে তার উদর পূর্তি করবে। তার পরিস্কার অর্থ এই- জীবনের সবগুলো বৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশের পর তাদের আসল কর্তব্যে নিয়োগ করা। ইসলামী পরিভাষায় খুদীর অর্থ কোন কালের স্বার্থপরতা নয়। মরহুম আল্লামা ইকবাল যে খুদীর বিকাশের জন্য মানবতাকে আহ্বান করেছিলেন, তা স্বার্থপরতা তো নয়ই-বরং তার উল্টো বৃত্তি। সে খুদী বিকশিত হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, সে হয় ইনসান-ই-কামিল। তখন সে অপরকে শোষণ করতে চায় না বরং আপনারই মত বিকাশের পথে টেনে নেয়। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের যে সূত্রপাত লক থেকে হয়েছিল, তারই পূর্ণ পরিণতিতে পাওয়া যায় নীটশের অতিমানবকে। সে অতি-মানবকে অতিদানবও বলা যায়। কারণ তার মাঝে মানবীয় গুণের দেয়ে দানবীয় গুণেরই প্রাধান্য বেশি। ইনসান-ই-কামিলের মাঝে মানব-জীবনের সবগুলো বৃত্তির সুষ্ঠু বিকাশই তার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়। রাজনৈতিক জীবনে সে যেমন আপনার স্বার্থের জন্য নয় তৎপর, তেমনি আপনার সঙ্গে অপরের অচ্ছেদ্য যোগসূত্র স্বীকার করে বলে আপনার ও সমাজের স্বার্থে কোন তারতম্য দেখতে পায় না।
যে অধিকার নিয়ে ব্যষ্টি ও সমষ্টিতে চলছে অবিরাম সংগ্রাম, ব্যষ্টি ও সমষ্টির এরূপ পরস্পরবিরোধী পার্থক্য স্বীকার না করার ফলে ইসলামের মধ্যে এ সমস্যা এমন উগ্ররুপ ধারণ করেনি। ব্যষ্টি ও সমষ্টিকে একই ইউনিট হিসেবে ধরে নেয়ার জন্য তাদের তথাকথিত অধিকার লোপ করা হয়েছে। আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব স্বীকার করার ফলে ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনের দ্বন্দ্বের হয়েছে নিরসন।
অপরদিকে দুনিয়ার মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ্র –স্বীকার করে নিয়েও মানবজীবনে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার সমন্বয় সাধনের জন্য ইসলাম দিয়েছে পূর্ণ সুযোগ-ইসলামী জীবন দর্শনের মূল কথাঃ এ বিশ্বের আদি কারণ সব মঙ্গলময় পরম শক্তিশালী আল্লাহ্তা’আলা তাঁর সত্তা থেকে বিশ্বের সবকিছুর উৎপত্তি এবং তাঁর মাঝেই সবকিছুর লয়, মানবজাতির উৎপত্তিও তার থেকেই হওয়ায় তারা পরস্পর ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ। পবিত্র কুরআন শরীফে বলা হয়েছে এবং পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে-প্রকৃতপক্ষে তোমাদের এ ভ্রাতৃত্ব এক (অবিভাজ্য) এবং আমি তোমাদের প্রভু (আল-মুমিন ২৩-৩-৫২-৫৩)। আরও বলা হয়েছেঃ নিশ্চয়ই মানুষের ভ্রাতৃত্ব- একই ভ্রাতৃত্ব। (আম্বিয়া ২১-৬-৯২) কাজেই ইসলাম সর্বাবস্থায় সাম্য ও মৈত্রীর রুপায়নে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে। মানুষের মাঝে সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও যাতে তাদের মধ্যে কাজে-কর্মে বা উৎপাদন ব্যবস্থায় আপেক্ষিক স্বাধীনতা বজায় থাকে তার জন্য ইসলাম কোন অবস্থায়ই কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। ব্যক্তিগত বা সমাজগৎ জীবনে যাতে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে বা উৎপাদন ব্যবস্থায় স্বীয় অভিমত অনুসারে চলতে পারে, তার জন্য ইসলামী সমাজে রয়েছে প্রচুর সুযোগ। ব্যষ্টি ইচ্ছা করলেই যেমন একা উৎপাদন করতে পারে, তেমনি সংঘবদ্ধভাবে অপর দশজনের সঙ্গে মিলিত হয়েও সে উৎপাদন করতে পারে। ইসলামের মধ্যে এ সুযোগ থাকার দরুন মানব জীবনের বিকাশের পথের এক মস্ত বড় সুযোগ স্বাধীনতা ভোগ করার রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা।
জ্ঞানের রাজ্যে প্রয়োগ, যুক্তি ও স্বজ্ঞা, প্রত্যেক পন্থাকেই স্বীকার করে নেওয়ায় জগতের জ্ঞানের রাজ্যে ইসলাম কোন ভেদরেখা টেনে দেয়নি। যে কোন উপায়েই জ্ঞান লাভ হতে পারে এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে লব্ধ জ্ঞানরাজিকে সুসংবদ্ধ করা যায়, ইসলাম তা গোড়াতেই স্বীকার করে নিয়েছে। তার ফলে প্রায়োগিক, যুক্তিসর্বস্ব ও সজ্ঞালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে সার্বিক সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছার পক্ষে রয়েছে সুবিধা।
বর্তমান জগতে যেমন ক্ষেত্রগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তে পৌঁছার রয়েছে সুযোগ, ইসলাম মানব-মনকে এভাবে বিভক্ত করেনি বলে তার পক্ষে জ্ঞানের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের উৎপত্তি হয়নি।
বাস্তবিক পক্ষে ইহলোকিক, পারলৌকিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক বা নৈতিক-ইত্যাদিরূপ ভেদরেখা সৃষ্টির মূলে রয়েছে আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে কাল্পনিক বিভাগ। মানব মন সর্বদাই এক ও অবিভাজ্য। ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের মাধ্যমে কোন সত্যে উপনীত হলে তাতে যদি কোন ত্রুটি ধরা পড়ে, তা হলে আমরা অনতিবিলম্বে তাকে শুধরে নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সূর্য পূর্বদিকে ওঠে-এ অভিজ্ঞতা আমাদের নিত্যকার ব্যাপার। কিন্তু যখন এ অভিজ্ঞতাকে আমরা যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করি, তখন তাকে সংশোধিত আকারে গ্রহণ করতে হয়। বলতে হয় আমরা দেখি বটে সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে তবে প্রকৃতপক্ষে সূর্য ওঠে না। পৃথিবীর আবর্তনের ফলেই আমাদের এ ভ্রান্তি হয়।
যুক্তি ও লব্ধজ্ঞানেরও সংশোধন করা অনেক সময় প্রয়োজন হয়ে পড়ে। জগতে যা কিছু আমরা দেখতে পাই তাতে দেখি পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এক বিরাট পরিবর্তন চলছে দুনিয়ার বুকে। আজ যে শিশু,কাল সে যুবা। আবার দু’দিন যেতে না যেতে সে বৃদ্ধ হয়ে কবরের পথে অগ্রসর হয়। কাজেই মানবজীব অসার, অনিত্য। আজ আমি বেঁচে আছি, কাল হয়ত থাকবো না। কাল কেন, হয়ত পরমুহূর্তেই থাকবো না। আমার পক্ষে তা হলে কোন কিছু করার কি অর্থ থাকতে পারে? খাওয়া-পরা, ভোগ-বিলাস, আয়াস-আরাম সবকিছুই অনিত্ব ও অসার। তাই- হয় নিস্ক্রিয়, নিরস থেকে তিলে তিলে মরে যাওয়াই ভাল। না হয় যা খুশি তাই করে দু’দিনের এ ভবখেলা সাঙ্গ করে যাওয়াই ভালো। যুক্তিধারার এ প্রবল স্রোতে কিন্তু মানুষ ভেসে যেতে চায় না। কারণ এভাবে চিন্তা করলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তার বেঁচে থাকার ইচ্ছা তাকে এ সংকটজনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছে, সে তাকে অভয় দিচ্ছে- তোমাকে বাঁচতেই হবে। জীবনযুদ্ধে তোমাকে বুঝতেই হবে। তার জীবনধর্মই তাকে কর্মের পথে, প্রেরণার পথে এগিয়ে দিচ্ছে। এ জ্ঞান সে যুক্তি থেকে পাচ্ছে না, পাচ্ছে সহজাত জ্ঞান থেকে।
ধর্মজগতে বা নৈতিক-জগতে স্বজ্ঞাজাত জ্ঞান সবসময়ই মানুষের হয়ে থাকে। সেজন্য যুক্তি-জ্ঞানকে ধর্মীয় ও নৈতিক জ্ঞান দ্বারা পরিশোধিত করে তোলা দরকার। সেই পরিশোধনের ফলে যে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়, সে জ্ঞানই মানব জীবনের চরম ও পরম জ্ঞান।
ইসলাম গোড়াতেই ইহলৌকিক, পারলৌকিক, ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় বলে জ্ঞানের কোন পৃথক জগৎ স্বীকার করেনি। সমগ্র জীবন দিয়ে সত্য লাভের চেষ্টা ইসলামের কাম্য। ইসলাম মানবজীবনকে পূর্ণ বিকাশের পথে এগিয়ে দিতে চায় বলে জ্ঞানের প্রত্যেকটি পদ্ধতি স্বীকার করে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবন সমস্যার সমাধান করতে চায়, তার ফলে ধর্ম-জীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় জীবনের, কর্ম জীবনের সঙ্গে নৈতিক জীবনের দ্বন্দ্বের হয় অবসান।
বিভিন্ন জ্ঞানের উপকরণকে সমন্বয় করে ইসলাম এসে উপনীত হয় এক সার্বিক সিদ্ধান্তে- যেখানে মানব মনের সবগুলো দাবি সন্তোষ লাভে হয় সমর্থ। বর্তমান কালে ধর্ম ও রাষ্ট্রের যে দ্বন্দ্ব তার মূলে রয়েছে আমাদের একদেশদর্শী জ্ঞানের কার্যকারিতা। যুক্তিসর্বস্ব জ্ঞানের আলোকে আমরা গড়ে তুলি রাষ্ট্র। তাতে কোথাও ব্যষ্টির, আবার কোথাও সমষ্টির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করি। ধর্ম-জীবনকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পৃথক করে দেখি বলে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয়জীবনে শুরু হয় ভীষণ দ্বন্দ্ব। ধর্মজীবনে যা ন্যায়-নীতি বলে সর্বত্র স্বীকৃত হয় রাষ্ট্রজীবনে তা অনেক স্থলেই উপহাসের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। তার প্রধান কারণ, আমরা একই সত্যকে কোথাও দেখি বিশুদ্ধ জ্ঞানের আলোকে, আবার কোথাও দেখি স্বজ্ঞার মাধ্যমে। সামগ্রিক দৃষ্টি নিয়ে একে বুঝবার চেষ্টা করলে একই সত্যের দুটো রূপ বলে ধরা পড়বে। রাষ্ট্রজীবনে জীবনকে দেখা হয় শুধু বুদ্ধির আলোকে। সে জন্য এখানে ধর্মীয় ও নৈতিক মানগুলো কোন স্থান পায় না। ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনের মানগুলো স্বজ্ঞার মাধ্যমেই পাওয়া যায়। বুদ্ধির সঙ্গেই বোধির যোগ হলে তবেই সত্যের সমগ্র রূপ ধরা পড়ে। সেই যোগসূত্র স্থাপনের জন্য রয়েছে তাগিদ। সে জন্যই ইসলাম রাজনীতিকে ধর্মনীতি থেকে পৃথক করে কোন কালেও দেখেনি। কেবল ধর্ম ও রাজনীতি নয় আধ্যাত্মিক বা জাগতিক বলে ইসলামের কোন বিভাগ নেই। আল্লামা ইকবাল সত্যিই বলেছেন- “ ইসলামে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক বলে দুটো ভিন্ন ক্ষেত্র নেই। যতই জাগতিক (উদ্দেশ্য প্রণোদিত) হোক না কেন, কর্তার মনের ভাবধারার আলোকেই কর্মের নির্ধারণ হয়ে থাকে। ইসলামে একই সত্যকে এক দৃষ্টিভঙ্গিতে চার্চ বলা হয়, অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় রাষ্ট্র। চার্চ ও রাষ্ট্রকে একটি বস্তুর দুটো দিক বললে ঠিক বলা হবে না। ইসলাম বিশ্লেষণের অতীত এক সত্য। আমাদের দৃষ্টিকোণের পরিবর্তনের ফলে তাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখায়। এই ভুলের কারণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ঐক্যকে দ্বিখণ্ডিত করে দুটো ভিন্ন সত্যের সৃষ্টির ফলেই এর উৎপত্তি। আসল সত্য হল জড় পদার্থ, স্থান-কালের সম্বন্ধে আত্মা বৈ কার কিছু নয়”।
কাজেই সব দেখে শুনে মনে হয়, অনাগত বিশ্ব সংস্থার জন্য যে কয়টি মৌলিক নীতির স্বীকৃতির প্রয়োজন এবং যে মানসিকতার অত্যন্ত প্রয়োজন- ইসলামের মধ্যে তার সমস্ত রয়েছে। তাই এ ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দুনিয়ার বুকে আবার শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে মানব-সভ্যতাকে ইসলামের নীতি গ্রহণ করতে হবে।