দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মনোবিজ্ঞানের শিক্ষা
ফ্রয়েডীয় মতবাদ
অষ্ট্রিয়ার বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানবিদ ফ্রয়েডের কামসর্বস্ববাদ২০ বা সর্বকামিতা আজ দুনিয়ার সকল জ্ঞানী লোকের নিকট পরিচিত। তাঁর মতে মানুষ তার আদি কাম দ্বারা পরিচালিত। মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা,সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূলে রয়েছে শুধুমাত্র কাম। এ সত্যটি প্রমাণ করাই ছিল ফ্রয়েডের জীবনের লক্ষ্য। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মনস্তত্ত্ববিদ মহলে ফ্রয়েড ছিলেন রাজাধিরাজ। বর্তমানে কার্ল জুঙ২১ ও এ্যাডলারের২২ বিশ্লেষণে তাঁর মতবাদে নানা ত্রুটি ধরা গেলেও আমাদের কাব্য ও সাহিত্য তাঁর মতবাদের ছাপ রয়ে গেছে অম্লান। তাই তাঁর মতবাদ নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন।
তাঁর ধারণা, সজ্ঞান মনে যেসব কামনা-বাসনা দূষণীয় বলে পরিত্যাক্ত হয় সেগুলো অচেতন মনে গিয়ে বাসা বাঁধে। সেখানে প্রক্ষোভের২৩ রয়েছে প্রাধান্য। সজ্ঞান মনে বাসনাগুলোকে করা হয় অবদমিত; তাই তারা অচেতন মনেই এই অন্ধকারে এসে জড়ো হয়। এতে সজ্ঞান মনের শান্তির পক্ষেই হয় সুরাহা। তবে উদ্ধায়ুজ২৪ লক্ষণ দেখা দিলে নানাভাবে মনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। অবদমিত বাসনার সর্বজনীনতা আবিস্কার করে ফ্রয়েড তাদের প্রকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আবিস্কারে মনোনিবেশ করেন। সর্বপ্রথমে স্বপ্নের মধ্যে তিনি তার সন্ধান পান। তাঁর মতে স্বপ্নও অচেতন মনের ক্রিয়ার ফল। সজ্ঞান মনের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে স্বপ্নে আমাদের আকাংক্ষিত বস্তু দেখা দেয়। যদিও দিনের বেলায় জাগ্রত অবস্থায় চৈতন্যের রয়েছে প্রাধান্য,নিদ্রাতে কোন প্রহরী বা মনোদ্ধারী না থাকায় অচেতনের পক্ষে যেন দুয়ার খুলে দেওয়া হয়।
অবদমনের শক্তিগুলোকে ফ্রয়েড প্রহরী২৫ বলেছেন। তাঁর মতে আমাদের মনের অনেকগুলো বাসনাই অবদমিত। আমরা সে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নই। বাইরে থেকে নানাবিধ পুলিশী শক্তি আমাদের বাসনাগুলোকে অবদম করে, আমরা নিজেরাও পুলিশী ভাব নিয়ে তাদের রুদ্ধ করি। নিদ্রায় সে পুলিশের হুকুমবরদারী থাকে না বলেই আমাদের বাসনাগুলো হুড়হুড় করে স্বপ্নে রুপায়িত হয়ে থাকে। কেবল স্বপ্নে নয়, লক্ষণ সংক্রান্ত কার্যাবলি থেকেও ফ্রয়েড উদাহরণ সংগ্রহ করে তাঁর মতবাদ প্রমাণ করেছেন। আমরা সকলেই জানি, অনেক সময় অনবধানতাবশত আমরা অনেক কাজ করি। যেমন লিখতে বসেছি, টেবিলের একপাশে এক গ্লাস পানি রয়েছে। হটাৎ কনুই লেগে গ্লাসটা পড়ে গেল। এক আমরা অনবধানতাবশত কাজ বলে থাকি। ভাবনাবিহীন কাজও করি। যেমন পথ চলতে যেয়ে একটা লাঠি পথিমধ্যে পেয়ে লাথি দিয়ে তাকে ফেলে দিই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে লেনদেনের ব্যাপারে অথবা এক কাজ করতে অন্য কাজ করাতে সজ্ঞান মনের স্রোতে কিভাবে এসব কার্যাবলি প্রকাশ পায় তার সন্ধান পাই। যদিও আপাতত এসব কার্যকে আপতিক২৬ মনে হয়, আসলে তারা অবদমিত বাসনার২৭ প্রকাশ ব্যতীত আর কিছুই নয়। যেসব কার্যের মাধ্যমে এভাবে আমাদের গুপ্ত বাসনা অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ পায় ফ্রয়েড তার সহজ নাম দিয়েছেন ত্রুটি। প্রচলিত ভাষায় তারা ভুল-ভ্রান্তি নামে পরিচিত। এসব ভুল-ভ্রান্তি ত্রুটি-বিচ্যুতির উহ্য অর্থ আবিস্কারের মধ্যে রয়েছে ফ্রয়েডের কৃতিত্ব। স্বপ্নের মতই তাদের মধ্যে রয়েছে একটা বাহ্যিক অর্থ,একটা গূঢ় অর্থ। সেই গূঢ় অর্থই আমাদের মনের অন্তর্নিহিত উত্তেজনার প্রাবল্যে বা প্রহরীর অনুপস্থিতিতে আমাদের পেশিগুলোকে ক্রিয়াশীল করে তোলে; আমরা ভাষায় তাদের প্রকাশ করি।
আমাদের মনের সে সব অবদমিত বাসনার জন্ম কাম থেকে। জীবনের সকল স্তরের আলোচনা করে ফ্রয়েড প্রমাণ করতে চেয়েছেন কামপ্রবৃত্তির দ্বারা মানব-মন সর্বত্রই পরিচালিত। তাঁর ধারণা, মানবজীবনের মূলে রয়েছে লিবিডো২৮ বা বিরাট কামশক্তি। ছোট ছোট শিশুরা ফ্রয়েডের মতে আত্মকামী২৯। তাদের মধ্যে স্বতঃপ্রণোদিত কামের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাদের আদর-সোহাগ করাতে তারা আংশিকভাবে কামতৃপ্তি লাভ করে। ছোট ছোট বাচ্চাদের শরীরের নানাস্থানে কামকেন্দ্র রয়েছে। বাইরে থেকে এসব কামকেন্দ্র উত্তেজনার সৃষ্টি করলে তারা কামসুখ ভোগ করে। ফ্রয়েডের ধারণা, শৈশবের এই কামাবস্থা জন্ম থেকে পাঁচ বৎসর বয়স পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এ সময়কে ফ্রয়েড বলছেন শৈশবাবস্থা। দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হয় অস্ফুটচিত্ততার কাল৩০। তার সময় তিনি নির্দিষ্ট করেছেন, পাঁচ থেকে বারো বৎসর পর্যন্ত। এ সময় লিবিডো হয়ে পড়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। শৈশব ও কৈশোরের মধ্যবর্তী এ অবস্থায় কাম-নদীতে কিছুটা ভাটার টান দেখা যায়। বারো বছর থেকে আঠারো বছর পর্যন্ত কৈশোরের সীমা। এটি যেন কামজীবনে এক ঝটিকাবিক্ষুব্ধ অবস্থা। এর সূচনায় জীবনে যেন লণ্ডভণ্ড কাণ্ড আরম্ভ হয়। ফ্রয়েডের মতে,শৈশবে মানুষ থাকে আত্মকামী, অস্ফুটচিত্ততার সময় তার কাম ধাবিত হয় একই লিঙ্গের বা বিপরীত লিঙ্গের কোন লোকের প্রতি। কৈশোরের সমাগমে সম্পূর্ণ বিপরীত লিঙ্গের লোকের প্রতি তা হয় কেন্দ্রীভূত।
জীবনের কোন পর্যায়ে কামের বিষয়বস্তুরূপে কোন কিছুকে গ্রহণ করলে, পরবর্তী পর্যায়ে তা অপরিবর্তিত থেকে যায়, তা হলে তাকে বৈকল্য৩১ বলা যায়। যেমন শৈশবের আত্মকাম যদি অস্ফুটচিত্ততার সময় আত্মকাম থেকে কোন ব্যক্তিমুখী না হয় তা হলে বুঝতে হবে সে ব্যক্তির জীবনে বৈকল্য দেখা দিয়েছে অথবা তার কাম শৈশবের পর্যায়ে স্থায়ী হয়ে রয়েছে। একে বলা হয় স্থিতাবস্থা৩২। এমনও হতে পারে যে, এক ধাপ ডিঙ্গিয়ে গিয়ে কাম আবার নিচের ধাপে ফিরে যেতে পারে যেমন কৈশোরের বিপরীত লিঙ্গের লোকের প্রতি ধাবিত না হয়ে আবার ফিরে গিয়ে শৈশবের আত্মকামে পরিণত হতে পারে। একে বলা হয় প্রতিসরণ৩৩। এরূপ বৈকল্য দেহকা দিলে বুঝতে হবে হয় স্থায়ী হয়ে, না হয় উল্টো দিকে কাম-নদীর স্রোত বইতে শুরু করেছে।
এ লিবিডোর বা কামশক্তির পশ্চাৎপটে পরিবার রয়েছে। এ জন্যই ফ্রয়েড পারিবারিক রোমান্সের বিকাশ দেখিয়েছেন; এখানে সর্বপ্রধান কূটএষণা পিতৃ অথবা মাতৃকেন্দ্রিক। তাই স্বভাবতই ছেলেরা পিতৃ-বিদ্বেষী, কারণ পিতার স্থান সে অধিকার করতে চায়। আমাদের প্রত্যেকেরই এ পাপের পথে যাত্রার রয়েছে উত্তরাধিকার। তাই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হলে, এ ইদিপাস*(পৌরণিক যুগের এক নায়ক,ভ্রমবশত যে আপন মাতাকে বিবাহ করেছিল।) এষণাকে নির্মূল করতে হবে। শৈশব এ এষণা প্রবলভাবে দেখা দেয় সত্য, তবু দীর্ঘকাল স্থায়ী হওয়ার দরুন পরিণত বয়েসেও নানা বিপদের সৃষ্টি করতে পারে। যেমন কৈশোরের কাম স্বভাবতই স্বাধীনভাবে পরিতৃপ্ত লাভ করে কিন্তু পিতার প্রতি ভয়ের দরুন এ পর্যায়ে তা ধ্বজচ্ছেদ কুটেশায়৩৩ পরিণত হতে পারে। এ এষণায়গ্রস্ত ব্যক্তি ভয় করতে পারে যে যৌন জীবনে সে হবে অকৃতকার্য। কাজেই ফ্রয়েডের মতে এই ইদিপাস এষণাই যৌন জীবনের বিকাশে নানাদিকে দেখা দিয়ে হয় কার্যকরী।
শিশুমাত্রই অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক। এ আত্মকেন্দ্রিকতা লিবিডোর বিকাশে নানভাবে থাকে ক্রিয়াশীল। ছোট বাচ্চা মাত্রই অত্যন্ত জুলুমবাজ, সে সর্বেসর্বা হতে চায়। পরিণত জীবনে তার এ প্রবণতা ধর্ষকামে৩৪ রূপ নিয়ে দেখা দেয়, এতে কামের বস্তুর প্রতি একই সঙ্গে বাসনা ও নিষ্ঠুরতা থাকে পরস্পর সংযুক্ত এবং তাতে ধর্ষকামী সুখভোগ করে। এই যৌন মনোভাবে ঠিক উল্টো দিক হল মর্ষকাম৩৫। এতে যৌন পরিতৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কষ্ট পাওয়াতেও মর্ষকামী সুখ ভোগ করে। লিবিডোর বিকাশের এ পর্যায়েই পুরুষ ও নারীর ভাব হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সাধারণত পুরুষমাত্রেই ধর্ষকামী এবং নারীমাত্রই মর্ষকামী। সেরূপ ইদিপাসের নারীরূপ হল ইলেকট্র।** (শ্রীনৃপেন্দ্র কুমার বসু তাঁর ফ্রয়েডের ভালবাসার নাম দিয়েছেন শতরূপা কূটেশা।) ফ্রয়েডের মতে মেয়েদের শৈশবে পিতৃসঙ্গ কামনা থাকে স্বাভাবিক। পরে লিবিডোর বিকাশে তাকে বাধ্য হয়েই তা ত্যাগ করতে হয়।
ছেলে ও মেয়েদের ইন্দ্রিয়গুলোর পার্থক্যের দরুন মেয়েদের মনে উপস্থঈর্ষার৩৬ সৃষ্টি হয়। একে ছেলেদের ধ্বজচ্ছেদ কূটেশার নারীরূপ বলা যায়।
এভাবে জোড়া জোড়া বিভিন্ন ও প্রতিপক্ষীয় ধারণাগুলোকে ফ্রয়েড বলেছেন জোড়া দ্বি-মেরুত্ত৩৭। সুখ-দুখ, ভালবাসা ও ঘৃণা পুরুষালী ও মেয়েলী ভাব প্রভৃতি ব্যতীত আর কিছুই নয়। তেমনি, একই সঙ্গে ভীতি,ঘৃণা ও ভালবাসা, সৃজন করা ও ধ্বংস করার প্রভৃতির নাম উভয়বলতা। লিবিডো প্রসঙ্গে আমরা ফ্রয়েডের আর একটি ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। তাকে বলা হয় উদ্গতি৩৮। যে শক্তিমূলে মানুষ কোন বিষয়ের প্রতি হয় আসক্ত বা কর্মশক্তি ব্যয় করে, সে নিশ্চয়ই লিবিডো ছাড়া আর কিছু নয়। আত্মকেন্দ্রিক লিভিডোর শক্তি আত্মপ্রকাশ৩৯ বা জীবনে কোন বিশিষ্ট পদ অধিকার বা সামাজিক প্রতিপত্তি লাভ প্রভৃতিতে ব্যয়িত হয়। যখন লিবিডো কোন সমস্যার সমাধানে বা কারকর্মে ব্যয়িত হয় তখন তাকে ফ্রয়েড বলে বিষয়কেন্দ্রিক লিবিডো৪০।
এই যে আত্মকেন্দ্রিক থেকে বিষয়কেন্দ্রে লিবিডোর কার্যকারিতা, ফ্রয়েড তার নাম দিয়েছেন স্থানান্তর। যে ব্যক্তির আত্ম-উত্তেজনা ছিল তার মনের মধ্যেই স্থিত সে ব্যক্তিই যখন কাব্য রচনায় পেলো সত্যিকার আনন্দ তখন বুঝতে হবে তার লিবিডোর তার বিষয়বস্তু পেয়ছে এবং আত্মকেন্দ্রিক রূপ ত্যাগ করে সে বিষয়কেন্দ্রিক৪১ হয়ে পড়েছে।
লিবিডোর এবম্বিধ প্রকাশে বা স্থানান্তরের মধ্যে তার উদ্গতির কাজও হয়। কাব্য,নাটক,রোমান্স,শৌর্য,শালীনতা প্রভৃতি লিবিডোর উদ্গত রূপ। কোন বিষয়বস্তুতে আমাদের আসক্তি দেখা দিলে বুঝতে হবে তা কামবাসনা থেকে উদ্ভূত এবং তার মধ্যে কামের সে প্রখরতা রয়েছে।
লিবিডোর পরিভ্রমনের ফলেই নানাবিধ জটিল অবস্থার সৃষ্টি। উদ্ধায়ুর৪২ বেলা,লিবিডোর কার্যকারিতার নীতি প্রয়োগ করে ফ্রয়েড স্থির-নিশ্চিত হয়েছেন যে,উদ্ধায়ু কাম-জীবনের ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বাভাবিক যৌন-জীবনে উদ্ধায়ু সম্ভব নয়। ফ্রয়েডের ধারার অনুসরণ করলে জীবনের পক্ষে স্থায়ী অবস্থার৪৩ বদ্ধাবস্থায় অথবা প্রতিসরণে পৌঁছার রয়েছে আশঙ্কা। তার সোজা অর্থ এই যে, লিবিডো কোন এক বিশিষ্ট পর্যায়ে যেয়ে স্থায়ী হয়ে বসে থাকতে পারে। যেমন অস্ফুটচিত্ততার*( অস্ফুটচিত্ততার (Latency period) সময় উভয় লিঙ্গের লোকের আসক্তি স্বাভাবিক।) সময় যদি অন্য কোন ব্যক্তির প্রতি কাম ধাবিত না হয় তাহলে বুঝতে হবে এষণাগ্রস্ত হয়ে এ লিবিডো এ জায়গায়ই স্থির হয়ে পড়েছে। কৈশোরে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আসক্তি ধাবিত হতে পারে। ফ্রয়েড, মানব-মনের বিভিন্ন পর্যায়ে কতকগুলো বৈকল্প আবিস্কার করে ধরে নিয়েছেন, তারা শৈশবাবস্থায়ও বিদ্যমান। ইদিপাস-সমকামিতা বা আত্মকাম ইত্যাদি এষণা পরিণত বয়সেও মানবজীবনে দেখা দেয় বলেই তাদের অস্তিত্ব গোড়াতেই বর্তমান বলে কেমন করে প্রমাণিত হয়? পরিবেশগত ও পারিপার্শ্বিক নানাবিধ কারণের সমাবেশের ফলে তাদের উৎপত্তি হতে পারে, যেমন হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের একত্র সমাবেশ হলেই পানি হয় না, তার জন্য বিদ্যুতের দরকার। তেমনি হয়ত কেবল মাতৃকেন্দ্রিক ভালবাসার বীজ মানবমনে থাকলেই ইদিপাসের পরিণতি হতে পারে না। আরও অনেকগুলো ফ্যাকটারের প্রয়োজন। ফ্রয়েড সে ফ্যাকটারগুলোর ওপর কোন গুরুত্ব আরোপ করেননি। এতে বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে তার ত্রুটি সহজেই ধরা পড়ে। কেবল ইদিপাসের বেলায় নয়, অন্য সবগুলো এষণার বেলাতেও তিনি বাইরের ফ্যাকটারগুলোর উপর কোন গুরুত্ব আরোপ করেননি। উদাহরণস্বরূপ ইদিপাসকেই ধরা যাক। শুধু কামের দ্বারা মানবমন পরিচালিত হলে, পিতা বা সমাজের ভয়ে এ কামের পথে যাত্রায় ছেলে নিবৃত্ত হবে কেন? পিতার স্থান যদি সে অধিকার করতে চায় তাহলে তাতে ভয়ের কোন স্থান থাকতে পারে না। যদি পিতাকে তার বিরাট বপু বা আধিপত্যের জন্য ভয় করে তবে তার স্বাভাবিক কাম-বাসনার সঙ্গে সঙ্গে ভয়কে এক আদি প্রবৃত্তি বলে স্বীকার করে নিতে হবে।
ফ্রয়েড অবদমনের শক্তিগুলোকে বলেছেন প্রহরী। তারা প্রায়ই সামাজিক শক্তি। সে সামাজিক শক্তিগুলোর উৎপত্তি কোথা থেকে? যদি বলা হয় যে, সেই আদি কাম থেকেই, তাহলে আমরা একটা বিষাক্ত বৃত্তের মধ্যে পড়ে যাই। কামনা বাসনা থেকে প্রহরী৪৪ গুলোর উৎপত্তি আর পাপ থেকে জন্ম নিয়েই তার পাপ বাসনাগুলোকে করে অবদমন। আবার যদি বলা হয়, সেগুলোর জন্ম পাপ-বাসনা থেকে নয়, অর্থনৈতিক, পারিপার্শ্বিক বা জীবনযুদ্ধের প্রয়োজনে সেগুলোর উৎপত্তি তাহলে কাম ব্যতীত আরো নানাবিধ ফ্যাকটার মানবজীবনে কার্যকরী বলে স্বীকার করে নিতে হয়।
ফ্রয়েড বলতে চেয়েছেন-আমাদের জীবনে অতৃপ্ত বাসনাগুলো মগ্ন চৈতন্য কার্যকরী থাকে বলে স্বপ্নে লক্ষণ সংক্রান্ত কার্যাবলিতে, অনবধানতাবশত কার্যবলিতে বা ভাবনাহীন কার্যাবলিতে সে অবরুদ্ধ বাসনা আত্মতৃপ্তি লাভ করে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা হয়ত সত্য কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই যে তা সত্য তা কেমন করে বলা যায়? অনবধানতাবশত যদি একজন গভীর গর্তে পড়ে যায় তাহলে তার মনে ঐ পড়ে যাওয়ার বাসনা কার্যকরী ছিল বলে কি স্বীকার করতে হবে? তাতে তো মানুষের আদিম প্রবৃত্তিকেই অস্বীকার করা হয়।
রুদ্ধ বাসনামাত্রই সে কামজ তার প্রমাণও অত্যন্ত দুর্বল। কামজ না হয়েও আমাদের নানাবিধ বাসনা প্রকাশ পেতে পারে, এ সত্যটি অস্বীকার করেও ফ্রয়েড সত্যের অবমাননা করেছেন। মোটকথা, তার মতবাদের অনুকূল কতকগুলো তথ্যের উল্লেখ করে তাঁর বিরুদ্ধে মতের পোষণকারী তথ্যকে তিনি ধামাচাপা দিয়েছেন।
ম্যাকডুগাল
ফ্রয়েড ব্যতীত মানব-মানসের আদি রূপ নিয়ে অপর তিনজন মনস্তত্ত্ববিদও গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ম্যাকডুগাল, এ্যাডলার ও জুঙের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। ম্যাকডুগাল যুদ্ধস্পৃহা বা Pugnacity-কেই মানব-মানসের আদি প্রবৃত্তি বলে ধারণা করেছেন। সাধারণত দেখা যায় শিশুদের মধ্যে অযথা একে অপরকে পীড়ন করার প্রবৃত্তি প্রকাশ পায়। সুযোগ ও সুবিধা পেলেই শিশুরা একে অপরকে পীড়ন করতে চায়। যদি মনে করা হয়, অদূর ভবিষ্যতে সে আক্রান্ত হয়ে তার সঙ্গীর দ্বারা ভীষণভাবে নির্যাতিত হবে, এ আশঙ্কার দ্বারা প্রণোদিত হয়েই শিশুরা এভাবে সঙ্গী-সাথীদের নানাভাবে পীড়ন করে, তা’হলে অবশ্য এ পীড়নের একটা সদুউত্তর পাওয়া যেতো। তবে যারা অত্যন্ত দুর্বল,যাদের দ্বারা কোন সময়েই কোন অত্যাচারের আশঙ্কা নেই, এরূপ ছেলেমেয়ের আক্রমণ করার কি কারণ থাকতে পারে? কাজেই এরূপ আক্রমণ করার প্রবৃত্তিকে ম্যাকডুগাল মানুষের আদি সহজাতপ্রবৃত্তি বলেছেন। তাঁর ধারণা মানুষ আজীবন এ প্রবৃত্তি দ্বারাই প্ররোচিত হয়ে নানাবিধ কাজকর্ম সম্পাদন করে। সাধারণত আমরা জীবনের নানা ক্ষেত্রে যে প্রতিযোগিতার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, ম্যাকডুগালের ধারণা- তা’ সেই আদি যুদ্ধস্পৃহারই এক পরিবর্তিত রূপ। বাল্যে,কৈশোরে ও যৌবনে এ প্রতিযোগিতার প্রবৃত্তি ভীষণভাবে দেখা দেয়। বিদ্যানিকেতন, খেলার মাঠ, ঘোড়া দৌড়, বল খেলা প্রভৃতিতে তা উৎকটভাবে দেখা দেয়। এগুলোকে আদিম হিংস্র প্রকৃতিরই রুপান্তর বলে গ্রহণ করতে হয়।
এ কথা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানবজীবনে হিংসা-বিদ্বেষ রয়েছে। হয়ত বা সেই হিংসা-বিদ্বেষই ভদ্রভাবে প্রতিযোগিতার রূপ নেয়, তবে মানুষের জীবনে প্রেম, মৈত্রী ও ভালবাসার যে ক্রিয়াশীলতা রয়েছে, তাকে কিভাবে অস্বীকার করা যায়? কেবল অপরকে পীড়ন করেই কি মানুষ সুখ পায়? অপরকে সাহায্য ও সহায়তা করার প্রবৃত্তিও মানবজীবনে রয়েছে। তাকে অস্বীকার করলে সত্যের একটা দিককে অস্বীকার করা হয়। কাজেই ম্যাকডুগালের এ মতবাদের মধ্যে আংশিক সত্য রয়েছে বলে স্বীকার করা যায়। মানবজীবনে অপরাপর অনেকগুলো দিককে তিনি প্রকারান্তরে অস্বীকার করেছেন।
এ্যাডলার
মানবজীবনের আদি প্রবৃত্তি সম্বন্ধে অতি আধুনিককালে এ্যাডলারের মতবাদ অত্যন্ত প্রাধান্য লাভ করেছে। কাজেই সে সম্বন্ধেও আলোচনা করা প্রয়োজন। এ্যাডলারের মতে মানবজীবনে শক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষাই আদি বৃত্তি। তাঁর মতবাদ অনুসারে এ আকাঙ্খার উৎপত্তির মূলে রয়েছে নেতিবাচক মনোবৃত্তি। মানুষ মনে করে যে কোন সময় সে বিরুদ্ধ পক্ষীয় শক্তি দ্বারা পর্যুদস্ত হতে পারে। এজন্য সে পূর্বাহ্নেই শক্তি সঞ্চয় করে আত্মরক্ষা করতে চায়।
এ মতবাদের মধ্যেও যে আংশিক সত্য রয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত এ জন্যই ছেলেবেলায় মানুষের যে যুদ্ধ-স্পৃহার মনোবৃত্তি দেখা দেয়, তাকে আত্মরক্ষারই এক সতর্ক সংস্করণ বলা যায়। তবে এ ব্যাখ্যার মধ্যেও ত্রুটি রয়েছে। কারণ অতি শৈশবেই মানুষের মনে যেমন অপর কোনও ব্যক্তির দ্বারা পর্যুদস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তেমনি অপর মানুষ কতৃক সাহায্য লাভের আশ্বাসও তার মানসে বর্তমান থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের সাময়িক সাহায্যের জন্য যার তার কাছে আবদার করে। হয়ত দু’ থেকে তিন চারজন একসঙ্গে একটা পথে রওয়ানা দিয়েছে- পথিমধ্যে একটা কুকুর যদি তাদের তাড়া করে, তখন তারা দৌড়ে যেয়ে সে কোন লোকের কাছে অথবা যে কোন বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে- মানুষ সব সময়ই অপরের সাহায্য ও সহায়তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে।
জুঙ
মনোবিজ্ঞানবিদ জুঙের অভিমত এই যে, মানব-মনকে তিন স্তরে বিভক্ত করা যেতে পারে- ১.চৈতন্য, ২.ব্যাক্তিগত নির্জ্ঞান মন ও ৩. সমষ্টিগত নির্জ্ঞান মন।
ব্যক্তিগত নির্জ্ঞান মন দ্বারা এই বুঝা যায়-কোন কালে যে সব ধারণা বা সংবেদন সজ্ঞান মনে বিরাজ করতো, কোন কারণবশত তারা অপ্রীতিকর প্রতিপন্ন হলে কার্যকরী জীবনের সুবিধার জন্য তাদের অবদমন অরা হয়। এই অবদমনের ফলে মনোজগতের নতুন গ্রুপের সৃষ্টি হয়। সেই নতুন গ্রুপ স্বপ্ন ও কল্পনা ব্যতীত স্বাভাবিক চেতনাতে দেখা দেয় না। সমষ্টিগত নির্জ্ঞান মন দ্বারা বোঝায় যে, অবদমিত চিন্তাগুলো ব্যষ্টির চেতনালব্ধ নয়; বরং সেগুলো জাতীয় অভিজ্ঞতার ফল এবং তাদের একেবারে অতি পূর্ববরতী পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতার ফল বলা যায়। জ্ঞানের এসব স্তর সব সময়েই মানব-মনে কার্যকরী এবং তারা সব সময়ই আমাদের কাজকর্মের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তবু নির্জ্ঞান মন গৌণভাবে আমাদের জীবনে কার্যকরী।
জুঙের মত এই যে, আমাদের মন চার পন্থায় কাজ করে। ১.মনন ২.অনুভূতি ৩.সংবেদন ৪.বোধি। তাঁর ধারণা, মনন, অনুভূতি যুদ্ধ দ্বারা চালিত এবং তাদের প্রকাশ হয় অবরোহ পদ্ধতিতে। অপরদিকে সংবেদন ও বোধির জ্ঞানের তিন স্তরেই সম্বন্ধ রয়েছে। জুঙ বোধির দু’টা সংজ্ঞা দিয়েছেনঃ
১.সেই মানসিক ক্রিয়াকেই বোধি বলা যায়, যার ফলে প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে নির্জ্ঞান মনের স্তরে প্রেরণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রেরণ করা নয়-প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও নির্জ্ঞান মানসের ব্যাপার। বোধি নিস্ক্রিয় ও সক্রিয় দুইই হতে পারে। নিস্ক্রিয় অবস্থায় বোধির কার্যকারিতার ফলে অমূল প্রত্যক্ষ বা কল্পনার সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে বোধি সৃষ্টিধর্মী শক্তির পরিচয় প্রদান করে। মানব মানসে বোধি প্রধান শক্তি হিসেবে কার্যকরী হলে একদিকে যেমন মরমি স্বপ্নদ্রষ্টা অথবা স্রষ্টার সৃষ্টি করতে পারে,অপরদিকে তেমনি কল্পনাপ্রবণ পাগলের অথবা শিল্পীর জন্মদাতা হতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে বাস্তব জীবনে অনন্ত বিরামহীন অন্বেষণকারীও জন্ম দিতে পারে। এ শ্রেণীর বিশেষত্ব এই যে, সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়িত হলেই এগুলোর প্রতি এই শ্রেণীর লোকের আর কোন মনযোগ থাকে না। জুঙের ধারণার অনুসরণ করলে আমাদের স্বীকার করতে হয় মানব মনের মধ্যেই এমন একটা শক্তি রয়েছে, যার কার্যকারিতার ফলে আমাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ঠিক পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা লাভ না করে অন্য উপায়েও লাভ করা যায়। সে জ্ঞান ঠিক সজ্ঞান মনের ব্যাপার নয়। তার মধ্যে রয়েছে নির্জ্ঞান মনের কাজ। অথচ স্বজ্ঞান মনে যে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে জ্ঞানের শক্তি রয়েছে প্রচুর। বোধি সে প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে নির্জ্ঞান মনের স্তরে প্রেরণ করে। এক্ষেত্রে এ প্রেরণ করা সজ্ঞান মনের ব্যাপার নয়। নির্জ্ঞান মন দ্বারাই তার কাজ সমাধা হয়। বোধি নিস্ক্রিয় অবস্থায় আমূল প্রত্যক্ষ বা কল্পনার সৃষ্টি করে। সক্রিয় অবস্থায় বোধির প্রভাবে একদিকে যেমন পাগল, অপরদিকে তেমনি প্রতিভাশালী শিল্পীরও সৃষ্টি হতে পারে।
জুঙের এবম্বিধ বিশ্লেষণ মানব জ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জুঙ মানবজীবনে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন বৃত্তি ও প্রবৃত্তির কোন আলোচনা করেননি। কাজেই তাঁর এ আলোচনাকে একদেশদর্শী বলেই অভিহিত করা যায়।তবে তাঁর এ আলোচনার একটা বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ পর্যন্ত বোধিলব্ধ জ্ঞান সম্পর্কে আমাদের বৈজ্ঞানিক জগতে কোন আলোচনাই হয়নি। সে জ্ঞান যেমন হটাৎ আলোর ঝলকানির মত দেখা দেয়, তেমনি হটাৎ আবার অন্ধকারের রহস্যময় লোকে আশ্রয় নেয়। আমরা প্রত্যাদেশ বা ওহীকে(revelation) সেরূপ জ্ঞান বলে এতদিন পর্যন্ত ধারণা করে এসেছি। তার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তির অনুসন্ধান করিনি। জুঙের ধারার অনুসরণ করলে দেখা যায়, প্রত্যাদেশ কোন অবৈজ্ঞানিক বা অলীক কোন জ্ঞান নয়। তাকে বিশ্লেষণ করলেও তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিস্কার করা যায়! এ কথা আজ সর্বজনবিদিত সত্য যে, হযরত মুহম্মদ মুস্তফা (সঃ) মানব সাধারণের মুক্তির জন্য দীর্ঘকাল যেসব চিন্তা করেছিলেন, তাঁকে তাঁর নির্জ্ঞান মনের স্তরে বোধি প্রেরণ করেছিল। সে নির্জ্ঞান মনের কার্যকারিতার ফলেই তিনি প্রত্যাদেশ লাভ করেছিলেন। এ কথার পরিপোষকতায় পাওয়া যায় একটা সর্বজনস্বীকৃত সত্য। তৎকালীন নানাবিধ সমস্যা সম্বন্ধে তাঁকে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে হযরত(সঃ) সরাসরি কোন উত্তর দিতেন না। প্রত্যাদেশ বা ওহী নাযিল হলেই তাদের সমাধান বলে দিতেন। এতে একথাই প্রমাণিত হয়, তার মানসে সে প্রশ্নের উত্তরগুলোর সমাধানের ক্রিয়াশীলতা থাকত বর্তমান। বোধি সে প্রশ্নগুলো তার নির্জ্ঞান মানসে ঠেলে দিতো এবং সেখানে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর তৈরি হলেই তিনি সেগুলো সম্বন্ধে তাঁর মতামত পরিস্কার ভাষায় বলে দিতেন।
এতে অবশ্য বোধির মানস সংক্রান্ত কার্যকারিতার ব্যাখ্যা হচ্ছে। তার মধ্যে যে বিষয়গত দিক (objective side) রয়েছে তা’ স্বীকার করা হচ্ছে। বোধির কার্যকারিতার ফলে বিষয়গত দিকে স্বয়ং কোন ফেরেশতার হাযির হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।