ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ইসলামী নীতির রূপায়ণ-ব্যক্তিগত জীবনে সমাজে ও রাষ্ট্রে
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র
ইসলামের ব্যক্তি-জীবন ও সমাজ-জীবনের জন্য কোন পৃথক আইন নেই। আদেশ রয়েছে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই আল্লাহ্র আদর্শে জীবন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। জনাব রাসূলে আকরাম (সঃ) বলেছেন- ‘তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহ’। আল্লাহ্র গুনে গুণান্বিত হও। সে আদেশ ব্যক্তি-জীবনের পক্ষে যেমন প্রযোজ্য, সমাজ-জীবনে ও রাষ্ট্র-জীবনের পক্ষেও তেমনই সমানভাবে প্রযোজ্য। সোজা কথায় ব্যক্তি যেমন আল্লাহ্র আদর্শে জীবন গঠন করবে, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্র ও গঠিত হবে আল্লাহ্র আদর্শেই। ইসলামের নানাবিধ প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত জীবনে, সমাজে ও রাষ্ট্রে আদর্শরুপে গড়ে তোলা। সমাজকে রাষ্ট্রের মধ্যে বিলীন করে দেওয়ার জন্য ইসলামের কোন আদর্শ না থাকলেও ইসলামের শাসন-অনুশাসন যাতে সর্বদা সহজভাবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়জীবনে চালু হতে পারে, তার জন্য রয়েছে পরিস্কার নির্দেশ। সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত জীবনের বিশুদ্ধি, দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ব্যক্তি-জীবনকে সংঘ-জীবনের পক্ষে সম্পূর্ণ উপযোগী করে তোলা।
ইসলামী নীতির প্রয়োগ-ব্যক্তিগত জীবনেঃ সালাত
আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে- আমারা আমাদের বাংলা ভাষায় ‘সালাত’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে ‘নামায’ শব্দ ব্যবহার করি। কুরআন-উল-করীমে যে ‘সালাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রতিশব্দ হিসেবে ফারসি ‘নামায’ শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে না। ‘নামায’ শব্দের উৎপত্তিগত অর্থ উপাসনা। এ উপাসনা অগ্নিউপাসক পার্সিদের মধ্যে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেও প্রচলিত ছিল। সে উপাসনার বিষয়বস্তু ছিল অগ্নি। কুরআন-উল-করীমে ব্যবহৃত ‘সালাত’ শব্দের অর্থ শুধু উপাসনা নয়। তার অর্থ হচ্ছে যে সর্বশক্তিমান ও সার্বভৌম সৃষ্টিকর্তার আদেশ-নির্দেশের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা স্থাপন করে তার কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ।
সালাতের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একদিকে জীবনকে নানান রিপু এবং অসৎ প্রবৃত্তির প্ররোচনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র ওপর নির্ভরশীল হওয়ার জন্য প্রস্তুতি এবং সঙ্গে সঙ্গে তার গুণাবলী এ জগতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া।
এ সালাতের মধ্যে ইসলামের অপরাপর কর্তব্যের মত দুটো দিক রয়েছে। একটিকে বলা যায় তার পারমার্থিক দিক, অপরটিকে বলা যায় তার সামাজিক দিক। সামাজিক দিকের আলোচনা করলে দেখা যায় এতে দিনে পাঁচবার সকল মুমিন-মুসলিমকে একত্রিত হওয়ার জন্য তাগিদ রয়েছে। আল্লাহ্র রসূল (সঃ) নির্দেশ নিয়েছিলেন, ‘যদি কেউ মসজিদে সালাত আদায় না করে বাড়িতে আদায় করে তা হলে তার ঘর পুড়িয়ে দাও’। এতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সালাতের উদ্দেশ্যে মুমিন মুসলিমদের একত্রিত হওয়াও তার একটা লক্ষ্য ছিল। মুসলিমদের জীবনে ঐক্য,প্রেম,মৈত্রী,সৌহার্দ্য প্রভৃতি সৃষ্টির জন্য তাদের প্রত্যেক দিবারাত্রিতে অন্ততপক্ষে পাচঁবার একত্রিত হওয়ার সুযোগ দান করে বলে সালাতের রয়েছে এক সামাজিক গুরুত্ব। প্রকৃতপক্ষে হযরত রসূল-ই-আকরাম (সঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে মসজিদ ছিল একাধারে মুসলিমদের পার্লিয়ামেন্ট, সুপ্রীম কোর্ট, গবেষণাগার ও বিশ্ববিদ্যালয়। মসজিদকে কেন্দ্র করেই জীবনবিকাশের ধারাগুলো চালু ছিল। এজন্য আল্লাহ্র আদেশ পালন করার জন্যতো বটেই, পরোক্ষে মুসলিম জীবনের নানাবিধ আইন-কানুন প্রণয়ন করার জন্য বা বিচার লাভের জন্য মসজিদে জমায়েত হওয়া ছিল অবশ্য প্রয়োজনীয়। এ মসজিদে অবস্থান করেই মুসলিমরা এ সৃষ্টিতত্ত্ব বা এ দুনিয়ার বিকাশের আদি কারণ সম্বন্ধে গবেষণা করতেন। এ মসজিদে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে শিক্ষালাভ করতেন। কাজেই এ দুনিয়ার নানা বিষয়ে খাঁটি জ্ঞান লাভের জন্য সালাত সম্পাদন উপলক্ষে মসজিদে সমবেত হওয়া মুসলিমদের জীবনে অবশ্য কর্তব্য ছিল।
অপরদিকে সালাতের মধ্যে মানব-জীবনের যে পূর্ণ আত্মসমর্পণের ভার রয়েছে সে সূত্রে মানুষের পক্ষে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভেরও সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই আল্লাহ্র প্রকৃতরূপের পরিচয় পাওয়া যায় বলে মানব-জীবনে রয়েছে দৃঢ় প্রত্যয়। ইসলামের অপর দিক হচ্ছে মারিফত। তাতে বলা হয় সালাতের মাধ্যমে সালাত আদায়কারীর দিলের মধ্যে রোশনী বা জ্যোতির আবির্ভাব হয় এবং সে জ্যোতির আলোকে আল্লাহ্র স্বরূপ সম্বন্ধে মানুষের পক্ষে উপলব্ধি করার সুযোগ দেখা দেয়।
যেহেতু ইসলামের মধ্যে ইহলৌকিক অথবা পারলৌকিক বলে এমন কোন স্পষ্ট ভেদরেখা নেই, এজন্য সালাতের মধ্যে যদিও এরূপ কোন ভাগ করা হয়নি তবুও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সালাতের মধ্যে আধ্যাত্মিক জীবন বিকাশেও পদ্ধতি রয়েছে।
সিয়াম ও রমযানের তাৎপর্য
আমরা সওমের পরিবর্তে ‘রোযা’ শব্দ ব্যবহার করি। ‘রোযা’ ফারসি ভাষার একটি শব্দ। তার সোজা অর্থ উপবাস বা যাকে ইংরেজিতে বলে fasting। কুরআনুল কারীমের ভাষায় যাকে মুসলিমদের জীবনে আমল করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে তা কেবল উপবাস নয়, তার নাম সওম। তার অভিধানগত অর্থ নিবৃত্তি। কিসের নিবৃত্তি? এ সম্বন্ধে শাহ ওয়ালী উল্লাহ্ দেহলভী বলেছেন, ‘যেহেতু পাশবিক কামনার প্রাবল্য ফেরেশতাসুলভ চরিত্র অর্জনের পক্ষে অন্তরায়, সুতরাং উহার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা পরিহার্য। যেহেতু পাশবিক শক্তির প্রাবল্য উহার উত্তেজনা ও উহার প্রতিরোধ কঠিন হওয়ার কারণ অথবা পানাহার এবং জৈবিক আসক্তি পূত চরিত্র অর্জনের পক্ষে একটি পর্দা বা অন্তরায় যে, শুধু পানাহারে স্বাধীনতা এতবড় অন্তরায় নয়। সুতরাং এই সকল উপকরণকে পরাভূত করে পাশবিক শক্তিকে আওয়ত্তাধীন করা হইতেছে সওমের সূক্ষতম তাৎপর্য। এতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় সওমের প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে পাশবিক প্রবৃত্তির দমন ও উন্নততর প্রকৃতির বিকাশ।
এজন্য দেখা যায়, এ দুনিয়ার যারা সত্যিকার মনুষ্যত্ব লাভ করেছেন অর্থাৎ নবী-মুরসালগণ তাঁর আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ পাওয়ার পূর্বে দীর্ঘকাল সওমের সাধনা করেছেন। মরহুম মাওলানা সুলেমান নদভীর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় হযরত মূসা আলায়হি ওয়া সাল্লাম তুর পাহাড়ে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ হিসেবে তওরাত গ্রহণ করার সময় দীর্ঘ চল্লিশ দিন পর্যন্ত আহার পানীয় ত্যাগ করে মানবিক জীবনের বহু উর্ধ্বে আরোহণ করেছিলেন। হযরত ঈসা আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইনজীল প্রাপ্ত হওয়ার লগ্নে দীর্ঘ চল্লিশ দিন অনুরূপ সাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। কুরআনুল করীম নাযিল হওয়ার পূর্বে হযরত রাসূলে আকরম (সঃ)- ও দীর্ঘ একমাস কাল হেরার গুহার সাধনায় জীবন যাপন করেছেন। এ পুণ্য সময়েই লায়লাতুল কদরের মহীয়ান রাত্রে তাঁর প্রতি কুরআন নাযিল হয়েছিল। এতে সিয়ামের গুরুত্ব সম্বন্ধে এ প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ আল্লাহ্র তরফ থেকে তার বাণী বা নির্দেশপ্রাপ্তির পূর্বে নবী ও মুরসালদের পক্ষে চিত্তশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে চিত্তশুদ্ধি হয় এবং সে চিত্তশুদ্ধির মূল অর্থ কি? তার উত্তরে সৈয়দ সুলেমান নদভী বলেছেন- ‘এতে সর্বপ্রথম শিক্ষা হচ্ছেঃ মানবজীবন ভোগের জন্য নয়—মানবজীবন ত্যাগের জন্য। ত্যাগের ফলে মানবজীবনে যে তৃপ্তি দেখা দেয়- ভোগের ফলে সে তৃপ্তি দেখা দেয় না’।
সে সওমের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আল্লামা ইকবাল বড় চমৎকার ভাষায় বলেছেন, ‘সওমকে ব্যক্তিগতজীবনে পালন করাও সম্ভব। অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধির জন্য এক ব্যক্তি হয়ত বৈশাখ মাসে অথবা মহররম মাসে সওমের নীতি পালন করবেন। অপর ব্যক্তি জ্যৈষ্ঠ মাসে বা সফর মাসে সে নীতি পালন করবেন, তাতে আপত্তি হওয়ার কারণ কি? তার উত্তরে বলা যায়-এক্ষেত্রে আল্লাহ্ সুবহানা তা’আলার উদ্দেশ্য- কেবল ব্যষ্টি জীবনের সংশোধন নয়। এক্ষেত্রে আল্লাহ্র উদ্দেশ্য গোটা মানবজাতির আত্মার শুদ্ধি। এজন্য একটা নির্দিষ্ট চান্দ্রমাসে আল্লাহ্র কালামে প্রত্যয়শীল সকল মানুষের জন্যই ‘সওম’কে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হিসেবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বিশুদ্ধ মানবজীবন তথা মুসলিম জীবনে সাম্য-ঐক্যের নীতি প্রতিষ্ঠার প্রতিও ইঙ্গিত রয়েছে। সকল মানুষ যাতে একই আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে তাদের পাশবিক প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ দমন করে, প্রকৃত মানবিক চরিত্রের বিকাশের জন্য একসঙ্গে সাধনায় লিপ্ত হয়, তার জন্য একটা বিশেষ মাসে সকলকেই তার অনুশীলনে তাগিদ দেয়া হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে সালাত(নামায) বা সিয়াম ইসলামী জীবনধারার কোন খাপছাড়া অনুশীলন নয়। ইসলামের মূল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহ্র রব নামক গুণ ও সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যয়। আল্লাহ্কে এক, অদ্বিতীয় স্রষ্টা, প্রতিপালক ও বিবর্তনকারী হিসেবে গ্রহণ করলে এবং তাকেই এ বিশ্বজগতের একমাত্র মালিক বলে স্বীকার করলে সওম বা সালাত অপরিহার্য রূপে দেখা দেয়। আল্লাহ্ যদি এ জগতের স্রষ্টা হন এবং তিনি যদি এ জগতের সকল জীবকে প্রতিপালন করেন এবং তিনিই যদি এ দুনিয়াকে অবনত পর্যায় থেকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যান এবং এ বিশ্ব বিধানে যা কিছু রয়েছে তার মালিকানা একমাত্র তাঁরই হয়-তাহলে তাঁর সেসব গুণের আলোকে এ দুনিয়াকে ঢালাই করে সাজানো-গোছানো প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়ে। এ দুনিয়ায় জন্মগত তারতম্য রয়েছে কেউ বা সুন্দর, কেউ বা কুৎসিত, কেউ বা কালো, কেউ বা সাদা, কেউ বা ধনী, কেউ বা নির্ধন, কেউ শক্তিশালী, কেউ বা নিতান্তই দুর্বল। সকলের স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহ্র সকলের প্রতিই রয়েছে সমান স্নেহ, সমান করুণা, সমান সহানুভূতি। অথচ মানুষ তার নিজ সম্বন্ধে এতো বেশি কেন্দ্রিক যে, সে তার নিজের সম্বন্ধে ভাবনায় সবসময়ই লিপ্ত। এজন্য যাতে সে দরিদ্র জনসাধারণের অর্থাৎ যারা সারা মাসে একবেলাও পেট ভরে আহার করতে পারে না, তাদের দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি যাতে অপরাপর সকল মানুষের হয়, তার জন্য ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই যাতে ক্ষুধার যাতনা বুঝতে পারে, তার জন্য রমযান মাসে দিনের বেলা সকলের জন্যই পানাহার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এতে ‘রব’ হিসেবে আল্লাহ্ কেবল এ দুনিয়াকে নয়- দুনিয়ার মানুষকে বিবর্তনকারী হিসেবে উন্নততর মানসিকতার পর্যায়ে উত্তোলন করতে প্রয়াসী।
দ্বিতীয়ত, এ মাসে ‘সওমের’ অনুশীলনে রত মানুষ যাতে সর্বাবস্থায় বুঝতে পারে,তার অধিকারে ধন-দওলত থাকলেও সে দওলত যথেচ্ছ ব্যয় করার অধিকার বা ভোগ করার অধিকার তার নেই; তাকে ভোগ করতে হবে সে সার্বভৌম শক্তির নির্দেশমতো। তাকে বুঝতে হবে তার অধিকারভুক্ত সম্পদে তার মালিকানা নেই। মালিকানা রয়েছে সর্বতোভাবে আল্লাহ্ সুবহানা তা’আলার। তাই সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও এ মাসে সে সম্পদের ভোগ থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে।
তাই আমাদের পক্ষে রমযান মাসকে শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার মাস হিসেবে গণ্য করলে চলবে না। যাতে পাশবিক প্রবৃত্তিকে দমন করে প্রকৃত মনুষ্যত্ব আমরা লাভ করতে পারি এবং আল্লাহ্র ‘রব’ ও ‘ মালিক’ নামক গুণাবলির রুপায়নে সফল ও সার্থক হতে পারি সে-ই হবে রমযান মাসে আমার সাধনা।
হজ্জ ও কুরবানী
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ্জের একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। হজ্জ ও কুরবানী উভয়েই একই সূরার পাশাপাশি তিনটি আয়াতে অবতীর্ণ হয়েছে বলে তাদের মধ্যে যে পারস্পরিক যোগসূত্র রয়েছে সে সম্বন্ধেও আমাদের অবহিত হওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে তাদের মর্মও আমাদের উপলব্ধি করা কর্তব্য।
প্রত্যেক ধর্মেরই একটা রয়েছে প্রচারিত দিক, অপরটি হচ্ছে আনুষ্ঠানিক দিক। প্রত্যেক ধর্মেরই প্রত্যয়ের মূলে থাকে ঐতিহাসিক পটভূমি ও দার্শনিক তত্ত্ব। অনুষ্ঠানে সে প্রত্যয়েরই মূর্ত রূপ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠান প্রবল হয়ে উঠলে ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের ভিত্তিতে অবস্থিত ঐতিহাসিক ও দার্শনিক দিকের আলোচনাও আমাদের কর্তব্য।
কুরআন-উল-করীমের ‘হজ্জ’ নামক সূরার হজ্জ সমাপন সম্বন্ধে বলা হয়েছে-
“ এবং যখন আমি ইবরাহীমের জন্য সেই গৃহের স্থান নির্ধারণ করিয়া বলিয়াছিলাম যে, আমার সহিত কোন বিষয়কেই অংশীদার করিও না এবং প্রশিক্ষণকারীগণের জন্য ও দন্ডায়মানগণের জন্য এবং রুকু ও সিজদাকারীগণের জন্য আমাদের গৃহকে পবিত্র রাখিও”। (সূরা হজ্জ)
“ এবং মানবগণের মধ্যে হজ্জ সম্বন্ধে ঘোষণা কর, -তাহারা তোমার নিকট পদব্রজে ও ক্ষীণকায় উষ্ট্রোপরি সমস্ত সুদূর পথ অতিক্রম করিয়া আগমন করিবে”।(সূরা হজ্জ)
“যেহেতু তাহারা নিজেদের উপকারের জন্য উপস্থিত হয় এবং পরিজ্ঞাত দিনসমূহে তিনি তাহাদিগকে পালিত পশু হইতে যাহা দান করিয়াছেন যেন তদুপরি তাহারা আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করে”। (সূরা হজ্জ)
প্রথমোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ মক্কার পবিত্র কাবাগৃহের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র সঙ্গে যেন অন্য কোন কিছুকে অংশীদার না করা হয় এবং যারা মনোনীত উপাসনা, প্রার্থনা ও প্রদক্ষিণ করতে আসে তাদের জন্য এ ঘরকে পবিত্র রেখো। উপরোক্ত আয়াতের শানে নযুলে লিখা হয়েছে, আরবের অংশীবাদী পৌত্তলিকেরা এবং আরববাসী য়াহুদী ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় হযরত ইবরাহীম (আঃ)- কে একজন মহামান্য নবী বলে সম্মান প্রদর্শন করতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিমা পূজা থেকে বিরত হয়নি। জনাব রসূল-ই-আকরাম (সঃ) ও তাঁর অনুগামীগণ আল্লাহ্র অংশীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না বলে কুরায়শরা তাদের কা’বাগৃহে প্রবেশ করতে দিত না। তাদের অত্যাচার ও অনাচারের বিরুদ্ধে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। এতে ভ্রান্ত ও বিপথগামী আরবগণকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে—“ হে আরববাসী! আমরাই আদেশে ইবরাহীম (আঃ) নবী এ ঘর তৈরি করেছিলেন এবং আমারই আদেশে বিশ্ববাসীর কাছে হজ্জ ও কুরবানীর মর্ম ঘোষণা করেছিলেন। আমি তাকে আদেশ করেছিলাম অংশবাদিতা ও পৌত্তলিকতা থেকে আমার ঘরকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে আমার ইবাদত করতে। তোমরা এতই অকৃতজ্ঞ যে, ইবরাহীমের আদেশ লঙ্ঘন করেছো এবং তার উপদেশের বিরুদ্ধে এ পবিত্র গৃহে প্রতিমা স্থাপন করে তার উপাসনা করেছো।আমি আমার সত্য উপাসকগণের জন্যই এ পবিত্র গৃহ নির্ধারিত করেছি, তোমরা তাদের বাধা দিয়ে ধর্মদ্রোহিতার চরম নিদর্শন প্রকাশ করছো। শেষোক্ত আয়াতদ্বয়ে হযরত ইবরাহীম (আঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, “তুমি সমগ্র মানবজাতির জন্য হজ্জ সম্বন্ধে ঘোষণা করে দাও, তারা যেন নিজেদের কল্যাণ ও পাপ মুক্তির জন্য প্রতি বৎসরের নির্ধারিত দিনে এ পুণ্যধামে উপস্থিত হয় এবং তাদের জন্য আমি যে গৃহপালিত পশু বৈধ করেছি, তা থেকে যেন তারা তাদের মনোনীত ও নির্ধারিত পশু আমার নামে উৎসর্গ করে”।
এক্ষেত্রে মানুষের কল্যাণ কোথায়? নিশ্চয়ই এক বিশেষ কল্যাণ রয়েছে। কারণ হজ্জব্রত পালন উপলক্ষে দেশ-বিদেশের নানা ভাষাভাষী লোকেরা এখানে সমবেত হলে তাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হবে। এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের লোকের পরিচয় হবে এবং তাদের মধ্যে ইখওয়ান বা ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠবে। গৃহপালিত পশু উৎসর্গ করতে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য ও তার সৃষ্ট জীবকে তারই নামে উৎসর্গ করার রয়েছে মহান সুযোগ। প্রকৃতপক্ষে গৃহপালিত গরু,মহিষ,উট, দুম্বা বা বকরি মানুষের কাছে এমন প্রিয় হয়ে ওঠে যে, তাদের অনুপস্থিতিতে বা মৃতুতে মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। কুরবানীতে সেই সব মনোনীত ও প্রিয় পশুকে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করতে এ প্রথার লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন আল্লাহ্র বান্দা তার সবকিছুকে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হয়। প্রকৃতপক্ষে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কুরবানী প্রথার সৃষ্টি হয়েছে। কুরাবানীর ঐতিহ্যের মধ্যে হযরত ইবরাহীম খলিলউল্লাহ (আঃ) কর্তৃক তাঁর পুত্র ইসমাইল (আঃ) কে কুরবানী দেওয়ার ঘটনা। যে ক্ষেত্রে পিতা হয়েও আল্লাহ্র সন্তোষ লাভের জন্য নবী মুরসাল তার পুত্রের গর্দানে ছুরি চালাতে সবসময় প্রস্তুত ছিলেন-সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ গরু, উট,দুম্বা,বকরি প্রভৃতি পশুকে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হবে না কেন?
কাজেই ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হজ্জ ও কুরবানীর সার্থকতা সম্বন্ধে অনুধাবন করলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে পড়ে। হজ্জব্রত পালনের সঙ্গে রয়েছে হযরত ইবারাহীম (আঃ)- এর স্মৃতি বিজড়িত। আল্লাহ্ তাঁকে দিয়ে একমাত্র তাঁরই উপাসনার জন্য এ ঘর তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
অথচ তাঁরই বংশধর ও তাঁর স্বদেশবাসী লোকেরা সে ঘরেই করত প্রতিমা পূজা এবং প্রকৃতপক্ষে যারা একেশ্বরবাদী তাদের সে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দিতো না। আল্লাহ্র অভিপ্রায় অনুসারে যারা হজব্রত পালন করেন তারা একেশ্বরবাদের স্বাদ পাবেন এবং পরস্পরের সঙ্গে তারই মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের পর্যায়ে উন্নীত হবেন।
হজ্জ ও কুরবানীর দার্শনিক দিকের আলোচনা করলে দেখা যায়, হজ্জের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ্র তওহীদবাদের প্রতিষ্ঠা। যাতে সে তওহীদের গোড়া পত্তনকারী হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ধ্যান-ধারণার সঙ্গে মানুষ পরিচিত হয় তার জন্যই মানুষকে একালে আহ্বান করা হয়েছে। তওহীদবাদের প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এত জোরালো দাবি কেন? তওহীদের সার্থকতা হচ্ছে মানুষে মানুষে প্রভেদের বিলোপ সাধন। একই আল্লাহ্র বান্দা হিসেবে এ দুনিয়ার মানুষ সকলেই সমান। ভাষা, বর্ণ, রক্ত, আর্থিক প্রভেদ যাতে এ দুনিয়ার মানুষের মধ্যে কোন ভেদবুদ্ধি সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য ভৌগোলিক পূজ্য দেবতাদের বা পিতৃপিতামহদের পূজ্য দেবতাদের বর্জন করে তওহীদের ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার জন্য কুরআনুল করীমে তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘ইবরাহীম (আঃ)- এর বংশধর বলে দাবি করা সত্ত্বেও তোমরা আমার আদেশ পালন করছো না- তাতে তোমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছো।
তওহীদের ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। তার মধ্যে সতত সচেতন, ক্রিয়াশীল সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, বিবর্তনকারী, এক সত্তার যেমন ধারণা রয়েছে তেমনি ন্যায়বিচারক ও সার্বভৌম সত্তার ধারণাও রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তওহীদপন্থীর কাছে আল্লাহ্র নিরানব্বইটা নাম এক একটি গুণও বটে এবং মানবজীবনের পক্ষে আল্লাহ্র পরিচয়েরও এক একটি মাধ্যম বটে। সঙ্গে সঙ্গে এগুলো মানবজীবনের আদর্শও বটে। মানুষ এদের মাধ্যমে আল্লাহ্র সর্বাঙ্গীণ পরিচয় না পাক, এগুলোর অনুসরণ করে নিজের জীবনকেও উন্নত করতে পারে। এদের মধ্যে আবার অঙ্গাঙ্গি সম্বন্ধ। রব হলে যেমন তাঁকে সৃষ্টিকর্তা, বিবর্তনকারী ও পালনকর্তা হতে হবে তেমনি তাঁকে বিচারপতিও হতে হবে, তাকে দয়ালুও হতে হবে। ন্যায়বিচারক হলে এ দুনিয়ার সকল জীবের প্রতি তাঁর সমদৃষ্টি থাকতে হবে, যাতে সকল জীবই আহার লাভ করতে পারে তার ব্যবস্থাও করতে হবে। মানুষের বেলায় শোষক ও শোষিত বলে কোন বিশেষ শ্রেণী থাকবে না। এ দুনিয়ার সম্পদ যাতে এ দুনিয়ার সকল মানুষই সমানভাবে ভাগ করে ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। কাজেই সমাজ ব্যবস্থা সাম্যবাদমূলক হওয়া উচিত।
কুরআনুল করীমে এ জন্যই তওহীদের ওপর এত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কারণ তওহীদ কেবল বিশুদ্ধ দার্শনিক ধারণা নয়, তওহীদ ও তার আনুষঙ্গিক নানাবিধ গুণের সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সংশ্রব বর্তমান।
কুরবানীর মূল তাৎপর্য কুরাআনুল-করীমের মধ্যেই বর্ণনা করা হয়েছে। “কুরবানীর পশুর গোশত অথবা উহাদের রক্ত আল্লাহ্র নিকট উপনীত হয় না বরং তোমাদের সংযমই উপনীত হয়ে থাকে”। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, কুরবানী একটা পশুহত্যার নিষ্ঠুর অনুষ্ঠান নয়। এতে প্রিয় পশুকে আল্লাহ্র পথে উৎসর্গ করাতে যে দৃঢ়চিত্ততা,কর্তব্যবোধ ও সংযমের প্রয়োজন তারই পরীক্ষার মূল।
যাকাত
স্বতঃপ্রণোদিত, উদ্ধৃত্ত অর্থ বা অন্য কোন সম্পদ আত্মার কল্যাণের জন্য দান করাই যাকাতের মূল উদ্দেশ্য। পূর্বেই বলা হয়েছে, আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নিলে এ দুনিয়ার কোন সম্পদের ওপরই মানুষের মালিকানা থাকতে পারে না।
মানুষ নিজেকে তার কাছে অর্পিত অথবা তার উপার্জিত সম্পদের হিফাজতকারি(Custodian) বলে গণ্য করে সে সম্পদকে আল্লাহ্র নির্দেশ মতে ভোগ করবে। তবে এ নীতি গ্রহণ করেও তার চিত্তের বা রূহের বিশুদ্ধির জন্য তার কাছে সঞ্চিত বা উপার্জনকৃত সম্পদের জন্য তাকে একটা নির্দিষ্ট অংশ প্রকৃতপক্ষে যারা হকদার তাদের উদ্দেশ্য দান করতে হবে। সেসব দেশের বায়তুলমালে সে সম্পদের অংশ দান করতে হবে।
কুরআনুল-করীমের নির্দেশ ও আল্লাহ্র রসূলের ব্যাখ্যা মতে সোনারূপা যাদের কাছে সঞ্চিত তাদের পক্ষে শতকরা আড়াই ভাগ রূহের বিশুদ্ধির জন্য দিতে হবে।
তবে এ সর্বাবস্থায় এ দানকে ইনকাম ট্যাক্স বলে গণ্য করা যাবে না। এ ট্যাক্স হচ্ছে রূহের বা আত্মার বিশুদ্ধির জন্য। ইসলামী রাষ্ট্রের সকল সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহ্র। কাজেই সে রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য যখনই যা প্রয়োজন রাষ্ট্র ব্যক্তিবিশেষের কাছে রক্ষিত সম্পদ থেকে অবাধে আদায় করতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তিবিশেষকে উপার্জনের অধিকার দান করলেও সে উৎপাদিত সম্পদ ভোগের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এ সম্বন্ধে ইমাম ইবনে হাজম তাঁর ‘মুহাল্লা’য় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
জিহাদ
জিহাদের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম বা অবিরাম চেষ্টা বা সাধনাতে লিপ্ত হওয়া। তার সাধারণত ইসলামকে এ বিশ্বে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হওয়াকে জিহাদ নামে অভিহিত করা হয়। তবে এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, ইসলামের পরিভাষায় জিহাদ অত্যন্ত ব্যাপক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। মানবজীবনকে সুন্দর, সরল ও মঙ্গলময় পথে পরিচালনা করার যতগুলো প্রতিবন্ধক রয়েছে- তার বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করাই জিহাদের মূল লক্ষ্য-সংগ্রাম ব্যক্তিবিশেষের জীবনে (ক) প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে যেমন হতে পারে, (খ) তেমনি তার দৈহিক নিরাপত্তার জন্য আততায়ীর বিরুদ্ধেও হতে পারে, (গ) স্বীয় এবং সামাজিক আর্থিক বিধানের বিরুদ্ধেও হতে পারে, (ঘ) মানবজীবনের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধেও হতে পারে এবং (ঙ) নফস ও কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ। একে একে তার আলোচনা করা যাক।
(ক) ব্যক্তিগত কর্তব্য পালনে জিহাদের অর্থ হচ্ছে- সকল প্রতিকূল পরিবেশে-ঈমানকে বজায় রেখে কর্তব্য পালনে সচেষ্ট থাকা অর্থাৎ মানুষের পক্ষে আল্লাহ্ যেসব কর্তব্য নির্ধারণ করেছেন- সকল প্রকার প্রতিকূল পরিবেশেও সে কর্তব্য পালন করতে মানুষ যেন কোন অবস্থায়ই নিবৃত্ত না হয়। এ প্রকার জিহাদের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় মক্কার নবদীক্ষিত মুসলিমদের উৎসর্গীকৃত জীবনে। দীর্ঘ তেরো বৎসরকাল তাঁরা মক্কার কুরায়েশদের হাতে যে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছিলেন দুনিয়ার ইতিহাসে তার কোন দৃষ্টান্ত নেই। অথচ এসব মুমিন-মুসলিমগণ তাদের প্রত্যয় থেকে একবিন্দুও বিচলিত হননি। শত অত্যাচার সহ্য করেও স্বকীয় প্রত্যয় থেকে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে তাঁরা এ বিশ্বে জিহাদের এক আদর্শ স্থাপন করেছেন।
(খ) সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় ও প্রচারে প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধাচরণ যখন সীমা অতিক্রম করে এবং ন্যায়পন্থীদের জ্ঞান ও মালের নিরাপত্তার চরম সংকট দেখা দেয় তখন এ জিহাদ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আত্মরক্ষার জন্য আততায়ীকে যেমন মানুষ হত্যা করতে পারে,তেমনি ধর্মের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারীদের হাত থেকে ধর্ম রক্ষার্থে তাদের সাথে জিহাদ করাও অবশ্য কর্তব্য।
আত্মরক্ষায় সশস্ত্র যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়ে এই আয়াত নাযিল হয়। “ যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয় তারা অত্যাচারিত বলে তাদের (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া হলো। আর এ কথা নিশ্চিত যে, আল্লাহ্ তাদের জয়যুক্ত করতে সম্পূর্ণ ক্ষমতাবান। (যুদ্ধ দ্বারা অত্যাচারিত তারাই) যাদেরকে তাদের দেশ থেকে অন্যায়ভাবে বহিস্কার করা হয়েছে-শুধু এই কথা বলার অপরাধে যে, “আমাদের রব(প্রভু) আল্লাহ্”।
(গ) এই কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, আর্থিক সংস্থান ব্যতীত কোন মহৎ কর্মই সম্পাদিত হতে পারে না। এজন্য আর্থিক দিক থেকে জিহাদের প্রয়োজন রয়েছে। আর্থিক জিহাদের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্র রাজত্ব এ দুনিয়ার প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বপ্রকার আর্থিক সম্পদ ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি। মানুষ অন্যায়ভাবে ধনসম্পদকে জীবনযাত্রার মাধ্যম হিসেবে গণ্য না করে জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বলে জ্ঞান করে সকল সময়েই তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। তবে যারা এ জীবনে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বে সম্পূর্ণ প্রত্যয়শীল তাদের পক্ষে তাদের কাহচে সঞ্চিত ধন-দওলত গচ্ছিত সামগ্রীর মত। তারা অবাধেই আল্লাহ্র রাস্তায় সবকিছু বিলিয়ে দিতে পারে। তবে যেহেতু সকল মানুষই একই জীবনের অধিকারী তাই যাতে সকল মানুষই একইভাবে আল্লাহ্র পথে ধনসম্পদে বিতরণের জন্য প্রস্তুত হয়- এজন্যই এ আর্থিক জিহাদের জন্যও তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল-কারীমে বলা হয়েছে, “যুদ্ধোপকরণ অল্প হোক আর অধিক হোক-তোমরা বহির্গত হও এবং তোমাদের ধনসম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহ্র পথে জিহাদ কর। ইহা তোমাদের পক্ষে উত্তম যদি তোমরা বিজ্ঞ হয় (সূরা তওবাঃ ৬)”। অন্যত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তৎপর তারা এ বিষয়ে কোন সন্দেহ করেনি এবং ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করেছে, তারাই (ঈমানের দাবিতে) সত্যবাদী (হুজুরাতঃ ২)”।
(ঘ) এ কথা সর্ববাদীসম্মত যে, যখনই কোন জাতি জ্ঞানচর্চায় পরাংমুখ হয়েছে, তখনই সে জাতির জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, সত্য ও অসত্যের মধ্যে প্রভেদ করতে না পেরে তখনই সে জাতি তার জীবনে ডেকে এনেছে ঘোর অমঙ্গল। কথিত আছে- মিসরের সম্রাট যখন খোদায়ীর দাবি করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন তার পূর্বে সে তার রাজ্যে জ্ঞানচর্চা বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়-সবগুলো শিক্ষাকেন্দ্র ধ্বংস করে দিয়েছিল। তার ফলে সমগ্র দেশ অজ্ঞানতার অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হয়ে গেল তখনই তার পক্ষে খোদায়ী দাবি করা সহজ হয়ে পড়লো। এজন্য খাঁটি মুমিনের পক্ষে সর্বদা জ্ঞানের দীপশিখা প্রজ্বলিত করার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত হতে হবে। জ্ঞানের জন্য জিহাদের অর্থ হচ্ছে-সর্বপ্রকার অজ্ঞানতা ও আদর্শ বিচ্যুতির বিরুদ্ধে জিহাদ। ইসলাম মানবজীবনের আলোকেই এ জিহাদের নীতির প্রবর্তন করেছে। এ জিহাদের অর্থ হচ্ছে কোন অবস্থায়ই মানবজীবনের অজ্ঞানতার অন্ধকার ঘনীভূত হওয়ার সুযোগ দান না করা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সর্বদাই-সর্বাবস্থায় অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্ত রাখা।
(ঙ) নাফস বা কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ-মানব জীবনে প্রবৃত্তির স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতাই নৈতিক ও আত্মিক অবনতির একমাত্র কারণ। মানুষ যদি নাফসকে বল্গাহীন অশ্বের মত যথাতথা বিচরণ করতে ছেড়ে দেয়-তা’হলে সে প্রবৃত্তির দ্বারা তার ব্যক্তিগত জীবনের যেমন অমঙ্গল হতে পারে, তেমনি সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনেরও সর্বপ্রকার অকল্যাণ হতে পারে। বল্গাবিহীন অশ্বের দ্বারা যেমন অঘটন ঘটতে পারে তেমনি বল্গাবিহীন নাফসের দ্বারাও নানা সংকট দেখা দিতে পারে। এজন্য শুধু ইসলাম ধর্মে নয়, জগতের সকল ধর্মেই সংযত জীবন যাপন করার জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে। তবে ইসলামে এ নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদকে সর্বোত্তম জিহাদ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামে এ জিহাদকে বলা হয়েছে ‘জিহাদ-ই-আকবার’। ইসলামের ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে – একদা একদল সাহাবা যখন কোনও এক ধর্মযুদ্ধ থেকে ফিরে এলেন, তখন হযরত রসূলই আকরম (সঃ) তাঁদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “এইবার তোমার ছোট জিহাদ থেকে প্রত্যাবৃত্ত হলে”। অর্থাৎ নিজের নাফসের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য তোমাদের প্রস্তুতি নিতে হলো। এক হাদীসের বর্ণনায় রয়েছে- একদা হযরত নবী করীম (সঃ) সাহাবাগণকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা মল্লবীর বা পাহ্লোয়ান কাকে বলে থাকো-? সাহাবাগণ আরয করলেন- যাকে কুস্তিতে কেউ পরাভূত করতে পারে না আমার তাকেই পাহলোয়ান বলে থাকি। জনাব রসূলল্লাহ (সঃ) বললেন- না, তা নয়, বরং যে ব্যক্তি তীব্র ক্রোধের সময়ও নিজের নাফসকে সংযত রাখতে পারে সে-ই (প্রকৃত) পাহলোয়ান”।
এতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয়, ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের পাশবিক প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই প্রকৃষ্টতম জিহাদ।
সামাজিক জীবনে নর-নারী সম্পর্কঃ ইসলামী সমাজে নারীর মর্যাদা ও অধিকার
ইসলামের দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক জীবনের বিকাশের বেলা নরনারীর মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়নি। স্ত্রী-পুরুষের দাবী দাওয়াও পরস্পরের ওপর সমান। বরং দেনমোহর ইত্যাদি বাবত স্ত্রীর দাবি পুরুষের ওপর প্রবল। স্ত্রীর খোরপোশ প্রভৃতি সম্পূর্ণ বহন করা পুরুষের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়নি-যেমন উত্তরাধিকার, বহুবিবাহ ইত্যাদি নারীর অধিকার পুরুষের সমান নয়।
কেন নারীর অধিকার পুরুষের সমান নয়- এ সম্বন্ধে আলোচনা করলে দেখা যায় অনেকটা কারণ বর্তমান। সকল সমাজেই এবং সকল দেশেই মর্যাদা ও অধিকারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোন ব্যক্তিকে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দান করলে তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকার নাও দেওয়া যেতে পারে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকার দান করলেও সর্বোচ্চ মর্যাদা দান নাও করা হতে পারে। পুরাকালে সকল দেশেই রাজাকে সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকার দান করা হত। এখনও যেসব দেশে রাজতন্ত্র টিকে রয়েছে, সে সব দেশে রাজার অধিকার সর্বোচ্চ। তবে সেসব দেশের জনগণ আন্তরিকভাবে রাজাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দান করতে প্রস্তুত নাও হতে পারে। রাজার মর্যাদা নির্ভর করে তার কৃতকর্মের ওপর। তিনি মানবপ্রেমিক বা মানবদরদী হলে অবশ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হবেন। তবে তার আচার-ব্যবহার কুৎসিৎ এ জঘন্য হলে তাকে কেউই গুরুজনে মর্যাদা দান করতে প্রস্তুত হবে না।
মর্যাদা ও অধিকারের এ পার্থক্য আমাদের এ উপমহাদেশেই বিশেষভাবে ফলে উঠেছে। প্রায় সবসময়েই রাজন্যবর্গকে সকল রকমের অধিকার দেয়া হয়েছে। তবে রাজন্যবর্গ আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নত থেকে, সন্ন্যাসী বা পীর-দরবেশগণের নিকট সর্বদাই কৃতাঞ্জলিপুটে উপস্থিত হয়েছেন। অবদান শতকের একটা তরজমা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ
নৃপতি বিম্বিসার-
নামিয়া যুদ্ধে মাগিয়া লইয়া পদ-নখ-কণা তার-
এত বড় রাজা বিম্বিসার, যার অধিকারের কোন সীমা ছিল না, সেই রাজা বিম্বিসার মর্যাদার দিক থেকে মহাজ্ঞানী বুদ্ধের পদ নখ-কণা সংগ্রহের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন।
আমরা সাধারণত মর্যাদা ও অধিকারের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না বলে অনেক সময় আমাদের বিচারের মধ্যে ভ্রান্তি দেখা দেয়। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক নারীজাগরণের আলোকে ইসলামী সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ অধিকারের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে অনেকেই অধিকারের সঙ্গে মর্যাদাকে এক পর্যায়ভুক্ত করে এ সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলেছেন। তাই এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা উচিত। ইসলামী সমাজে নারীর মর্যাদা ও অধিকার সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করতে হলে আমাদের কুরআনুল-করীম ও হাদীসের উক্তিগুলোকে বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ কুরআন-উল-করীম ও হাদীস শাস্ত্র হচ্ছে ইসলামের বুনিয়াদ। ইসলাম এক কালে ( অর্থাৎ খুলাফায়ে রাশেদীনের সময়) এ দুই বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। বর্তমানে এ দুনিয়ার কোথাও ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই, তবে অদূর ভবিষ্যতে ইসলামী সমাজ গঠিত হলে এ দুটো মূল ভিত্তির ওপরই গঠিত হবে। পাক কুরআনুল-করীমে বলা হয়েছে, “তাদের জন্য তোমাদের ওপর সেই অধিকার তোমাদের জন্য যেমন তাদের ওপর রয়েছে। (সূরা নিসা)”
এ সূরা নিসাতেই আবার বলা হয়েছে,
“পুরুষ জাতির নেতৃত্ব রয়েছে নারীদের ওপর”।
আবার অপর এক সূরায় বলা হয়েছেঃ
“ তোমরা গৃহে অবস্থান কর এবং জাহিলী যুগের নারীদের মত উচ্ছৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করো না”। (সূরা আহযাব)
ইসলাম জগতে আল্লাহ্র রসূল (সঃ)-কে গণ্য করা হয় জীবন্ত কুরআন রূপে। কুরআনুল-করীমের প্রতিটি অক্ষর তাঁর জীবনে রূপায়িত হয়েছে বলে তিনি এ দুনিয়ার কুরআনুল-করীমের অতুলনীয় ভাষ্যকার। নারী জাতি সম্বন্ধে তাঁর উক্তির মধ্যে নিন্মলিখিত কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্যঃ
১. সন্তানের বেহেশ্ত মায়ের পদতলে।
২. পিতামাতার মধ্যে কাকে প্রথম সম্মান প্রদর্শন করবে, এ প্রসঙ্গে কোন এক ছেলের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ প্রথমে তোমার আম্মাকে, তারপর তোমার আম্মাকে, তারপরে তোমার আম্মাকে, তারপরে তোমার আব্বাকে।
৩. স্ত্রীলোকেরা পুরুষের যময অর্ধেক।
৪. একজন স্ত্রীলোকের চারটি গুণের জন্য বিয়ে হতে পারেঃ
(ক) সে ধনী হলে, (খ) কুল গৌরবে উচ্চস্থানীয় হলে, (গ) সুন্দরী হলে ও (ঘ) পুণ্যশীলা হলে। কাজেই যে স্ত্রীলোক পুণ্যশীলা তার সন্ধান কর; যদি তুমি অন্য চিন্তা দ্বারা প্রভাবান্বিত হও, তাহলে তোমার দু’হাত কর্দমাক্ত হবে।
৫.এ পৃথিবী ও তার অন্তর্গত সবকিছুই সম্পদ, তবে এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ ধার্মিক নারী।
৬. আরব দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ স্ত্রীলোক কুরায়েশদের মধ্যে সে নারীগণ যারা শিশুদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ ও তাদের স্বামীদের সম্পদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি।
৭.আল্লাহ্র আদেশ তোমরা তোমাদের নারীদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করবে। কারণ, তারা তোমাদের মাতা, কন্যা ও স্ত্রী।
৮. নারীদের অধিকার পবিত্র। যাতে তাদের অধিক কষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখো।
৯. তোমাদের নারীদের মসজিদে আসতে বাধা দিও না। তবে তাদের বাড়ি তাদের পক্ষে উত্তম স্থান।
কুরআনুল করীম ও হাদীসের এসব উক্তিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-নারীর মর্যাদা ও অধিকারের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। যখন বলা হয়েছে পুরুষের ওপর নারীর, নারীর ওপর পুরুষের অধিকার সমান তখন এ বিশ্বে নারীর অধিকার পুরুষের অধিকারের সমান বলে গণ্য হয়েছে। এ আয়াতের পোষকতায় রয়েছে আল্লাহ্র রসূল (সঃ)-এর হাদীসঃ স্ত্রীলোকেরা পুরুষের যময অর্ধেক। নারীদের অধিকার পবিত্র। যাতে তাদের অধিক কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে।
কাজেই অধিকারের বেলায় নারী, পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ ইসলামী সমাজে হতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে কিসের অধিকার? সে অধিকারের যখন কোন সীমার মধ্যে আবদ্ধ করা হয়, তখন তাকে জীবনের সকল খেত্রের অধিকার বলেই গণ্য করতে হবে। মানবজীবনের প্রাথমিক চাহিদা হচ্ছে অন্ন-বস্ত্রের সন্ধান। অন্ন-বস্ত্র বিতরণের সময় যেমন নারী-পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকতে পারে না, তেমনি শিক্ষা, সংস্কৃতি বা জীবনের অন্যান্য অধিকার লাভের ক্ষেত্রেও তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে না। বর্তমান কালের গনতন্রের যুগে প্রতিনিধি নির্বাচনেও নারীর অধিকারকে পুরুষের সমতুল্য অধিকার বলেই গণ্য করতে হবে। একথা অবশ্য সত্যি যে, আল্লাহ্র রসূলের ইন্তেকালের পরে খলীফা নির্বাচনে কোন নারী অংশগ্রহণ করেন নি। সে যুগে নারীরা রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি বলে তাতে তাঁরা অগ্রসর হননি। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবতীর্ণ হতেও দ্বিধাবোধ করেননি। হযরত উসমান (রাঃ)- এর শাহাদাতের পরে উমাইয়াদের প্রচারণার ফলে মুসলিম জননী হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁর এ কার্যকলাপে ইজতিহাদী গলদ থাকতে পারে, তবে এতে যে নারীর রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়েছে তা’অনায়াসেই বলা যায়। বর্তমান কালের রাজনীতিতে নারীরা ন্যায়-অন্যায়বোধে কেন সংগ্রামে অবতীর্ণ হবেন না তার কোন সদুত্তর নেই।
কেবল রাজনীতি নয়, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেখানে নারী ধর্মের বিপরীত কোন কাজকর্মে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, সেখানে নারীর অধিকারকে কোন অবস্থায়ই পুরুষের অধিকারের চেয়ে খাটো করা হয়নি।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে নারীর উত্তরাধিকার নিয়ে। নারীকে পুরুষের সমান উত্তরাধিকার দেয়া হয়নি। আম্মা অথবা আব্বার সম্পত্তিতে ছেলেরা যে অংশ পায়, মেয়েদের জন্য তার অর্ধেক নির্ধারিত রয়েছে। একজন পুরুষের স্ত্রী তার পরিত্যাজ্য সম্পত্তিতে সন্তান-সন্ততি থাকলে দুই আনা অংশের মালিক হয়। অথচ একজন নারী তার স্বামীর আগে মৃত্যুবরণ করলে, স্বামী তার সম্পত্তির চার আনার উত্তরাধিকার লাভ করবে।
সাক্ষীদানকালে শুধু নারীর সাক্ষ্য ইসলামী বিধানমতে গণ্য হয় না। শতাধিক নারী হলেও তার সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষের সাক্ষ্যের প্রয়োজন। বিয়ের বেলায় একজন পুরুষের চার স্ত্রী গ্রহণ করাও চলে। অপরদিকে নারীর পক্ষে একাধিক স্বামী একসঙ্গে গ্রহণ করার কোন উপায় নেই।
এ সব বিষয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলামী সমাজ পিতৃপ্রধান বা Patriarchal। সুদূর অতীতে এবং আমাদের রসূল-ই-আকরমের (সঃ) জন্মের একশত বৎসর পূর্বেও সারা আরব দেশে মাতৃপ্রধান (Matriarchal Society) সমাজ ছিল। এমনকি হযরতের জন্মের সময়ও ইয়েমেনে মাতৃপ্রধান সমাজ প্রচলিত ছিল। পুরুষেরা নানাবিধ সংগ্রামের মধ্যে তাদের স্বাধীনতা লাভ করেছিল এবং তারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ জাহিলিয়াতের যুগে মাতৃজাতির ওপর নানাবিধ নির্যাতন করা হত। জাহিলিয়াতের যুগে পর্যুদস্ত নারী সমাজকে পুরুষের বিলাসসামগ্রী বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হত। সে প্রতিক্রিয়াশীলতার যুগে জন্মগ্রহণ করেও হযরত রাসূল-ই-আকরাম (সঃ) নারীকে পরম মর্যাদা দান করেছেন।
উত্তরাধিকারের বেলায় নারীকে কেন পুরুষের সমান অধিকার দান করা হয়নি, তার উত্তরে বলা যায়-নারীদের পক্ষে পিতার সম্পত্তিতে অধিকার লাভ করার পরও স্বামীর কাছে তাদের নিরাপত্তার জন্য কাবিন লাভ করার সুযোগ রয়েছে। পুরুষের পক্ষে এরূপ সুযোগ নেই। তার ওপর নিজের স্ত্রীর ও সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য পরিবারের কর্তা হিসেবে পুরুষই সম্পূর্ণ দায়ী। নারীকে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করা হয়েছে। এমনকি সন্তানকে স্তন্য দান করাও নারীর পক্ষে অবশ্য কর্তব্য নয়। সে ইচ্ছা করলে সন্তানকে দুগ্ধ দান করতেও পারে, নাও করতে পারে। তার গর্ভজাত সকল সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার স্বামীর।
জাহিলিয়ার নারীদের মত মুসলিম নারীগণ ভবঘুরের বা আওয়ারার মত চলাফেরা করবে না বলে তারা যাতে তাদের বাড়িতেই অবস্থান করে এরূপ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নারীরা আদেশ পালন করুন বা অন্য কোন কাজে লিপ্ত থাকুন, তাদের চলাফেরা বা অভিজ্ঞতা পুরুষ মানুষের মত এতো ব্যাপক না হওয়ারই কথা। এ জন্য তাদের সাক্ষ্যের পরিপূরক হিসেবে একজন পুরুষের সাক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে ইসলামে ‘অধিকার’ শব্দটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ইসলামে ‘অধিকার’ শব্দের অর্থ কোন কিছুর ওপর ব্যক্তির মালিকানা নয়, তার হিফাজত মাত্র। যাকে ইংরাজীতে বলে Custodianship। ইসলামী সমাজে নর অথবা নারী কেউই তার ইচ্ছামত কোন সম্পদ ব্যয় বা ধ্বংস করতে পারে না। তাকে সে সম্পদের রক্ষক হিসেবে আল্লাহ্র পথে মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় করতে হবে।
বিবাহের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের অধিকারের তারতম্য সম্বন্ধে বলা যায়-ইসলামের দৃষ্টিতে যিনা বা ব্যভিচার হচ্ছে মহাপাপ। তাই যাতে কোন অবস্থায়ই নর অথবা নারী এ কাজে লিপ্ত না হয় সেজন্যই পুরুষকে বহুবিবাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ দুনিয়ার মানবজাতির সংখ্যা নিয়ে আলোচনাকালে দেখা গিয়েছে, প্রত্যেক দেশেই নারীর সংখ্যা থেকে পুরুষের সংখ্যা অধিক। সাধারণভাবে শীতপ্রধান দেশে বিবাহযোগ্য পুরুষের বয়স ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ এবং বিবাহযোগ্য নারীর বয়স পঁচিশ থেকে চল্লিশ এবং বিবাহযোগ্য নারীর বয়স পনের থেকে ত্রিশ বৎসর বলা যায়। শীতপ্রধান বা গ্রীষ্মপ্রধান উভয় অঞ্চলেই বিবাহযোগ্য পুরুষের সংখ্যা নারীর চেয়ে কম। কারণ এ বয়সে পুরুষেরা নানাবিধ কাজকর্মে লিপ্ত থেকে প্রাকৃতিক বা যান্ত্রিক গন্ডগোলের জন্য প্রাণ হারায়। জগৎব্যাপী মহাসমরের সময় যুদ্ধে লিপ্ত দেশসমূহের বিবাহযোগ্য পুরুষ মানুষের সংখ্যা গুরুতরভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। কাজেই এসব সংকটকালীন সময়ের ব্যবস্থার জন্য ইসলামে একাধিক বিবাহের অনুমতি বা provision রয়েছে। তবে এসব সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও কুরআনুল করীমে ঘোষণা করা হয়েছে, “তোমরা যদি আশঙ্কা কর যে, ইয়াতিমদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে, দু’তিন বা চার”। যেহেতু কোন ব্যক্তির পক্ষেই একাধিক স্ত্রীর সঙ্গে সমান ব্যবহার করা সম্ভব নয়, এজন্য প্রয়োজনে ব্যতীত প্রকারান্তরে তাতে নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
সমানভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম না হলে যে কোন পুরুষের পক্ষে একাধিক বিবাহ জায়েয নয় ইমাম আবু হানীফা (রঃ) বহু পুর্বেই রায় দিয়েছেন। তাঁর সমসাময়িক আব্বাসী বংশের তথাকথিত খলীফা আবু মনসুর প্রৌঢ় বয়সে এক কিশোরীর সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে তাকে বিয়ে করতে চাইলে তাঁর স্ত্রী তা সম্পূর্ণভাবে নাজায়েয বলে বাধা দেন। উভয়ের সম্মতিতে ইমাম আবু হানীফা (রঃ) কে রায় দানের জন্য আহ্বান করা হলে তিনি বলেন, “ এ সম্বন্ধে আপনি (অর্থাৎ আল-মনসুরও) রায় দিতে পারেন”। সূরা নিসার তৃতীয় আয়াতে রয়েছে- “তোমরা যদি আশংকা কর যে, ইয়াতিমদের প্রতি অবিচার করতে পারবে না, তবে বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাকে, তোমাদের ভাল লাগে দু’তিন বা চার”। এতটুকু পর্যন্ত শুনে আল-মনসুর উল্লসিত হয়ে বলেন – “শুনুন বেগম সাহেবা”। তার পরে ইমাম সাহেব বলেন,- “তবে যদি মনে কর, তাদের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতে পারবে না- তাহলে তাদের মধ্য থেকে একজনকে বিয়ে করবে। একথা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে বেগম সাহেবা উল্লসিত হয়ে বলেন- ‘শুনুন খলীফা’। তাহলে এ দুটো উক্তির মধ্যে কোনটা গ্রহণীয়-এ প্রশ্ন করা হলে ইমাম আবু হানীফা (রঃ) বলেন- যদি উভয়ের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতে না পারেন তাহলে পুনরায় বিবাহ আপনার পক্ষে জায়েয হবে না। আল-মনসুর স্বীকার করেন-তিনি উভয়ের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতে পারবেন না। কাজেই ইমাম সাহেব তার পক্ষে পুনরায় বিবহ নাজায়েয বলে ঘোষণা করেন। এতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয়, এক স্ত্রী উপস্থিত থাকাকালে পুনরায় বিবাহ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যদি উভয়ের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতে পারবে না বলে পূর্বেহ্নেই ওয়াকিফহাল হয়, তা হলে তার পক্ষে পুনরায় বিয়ে করা জায়েয হবে না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়- আমাদের সমাজে বিবাহের এ মূল সূত্রের প্রথম দিকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে শেষের দিকের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে বহুবিবাহের প্রচলন হয়েছে।
পুরুষের সঙ্গে স্ত্রী একই সমতলে বা একই কাজ করতে পারবে না-তার পক্ষে কুরআনুল-করীম ও হাদীস শরীফে কোন নির্দেশ নেই। শাসন বা বিচার বিভাগীয় কাজে, শিক্ষা ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক জীবনের নানা পর্যায়ে নারীরা কেন পুরুষের সমান মর্যাদা ভোগ করবেন না। বিপক্ষে কুরআনুল-করীম বা হাদীসে কোন উক্তি নেই। কাজেই জীবনে কোন ক্ষেত্রেই নারীর অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হয়নি। মর্যাদার বেলায় বলা হয়েছে-পুরুষ জাতির নেতৃত্ব রয়েছে নারীর ওপর। এ নেতৃত্ব ব্যাপক অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। বাস্তবজীবনে পুরুষের পক্ষে জীবনের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে অধিকতর অগ্রণী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে পুরুষদের পক্ষেই নেতৃত্ব গ্রহণ করার রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা। এ নেতৃত্বের অর্থ এ নয় যে, পুরুষেরা যা বলবে বা যা করবে তা’কুরআনুল করীম বা হাদীসের বিরুদ্ধে হলেও নারী তা অবনত মস্তকে স্বীকার করবে। আর সোজা অর্থ হচ্ছে শারীরিক দিক দিয়ে পুরুষেরা অধিকতর শক্তিশালী বলে এবং জীবনের চলার পথে পুরুষদের অধিকতর অভিজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় পুরুষের পক্ষে নেতৃত্ব গ্রহণ করা উচিত। তবে সর্বাবস্থায় সে নেতৃত্ব যেন নাসের (কুরআনুল-করীম ও হাদীসের) বিরুদ্ধে না হয়।
কুরআনুল-করীমের অপর যে আয়াতে নারীদের আপন গৃহে অবস্থার করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা এ আধুনিক বিশ্বেও নারীদের প্রতি প্রযোজ্য। জাহিলিয়া বা অন্ধকার যুগে নারীরা রাত্রিতে উচ্ছৃঙ্খলভাবে ঘোরাফেরা করতো এবং তাদের মধ্যে আবার বীরাঙ্গনা পেশারও প্রচলন ছিল। কাজেই মুসলিম মহিলা কেন, যে কোন নারীর পক্ষে তা সর্বক্ষণ পরিত্যাজ্য। এ স্থলে মর্যাদা বা অধিকারের প্রশ্ন তোলা হয়নি। নারীকে উপদেশ দেয়া হয়েছে। নারীদের পক্ষে যেমন সৎ জীবন যাপন করা কর্তব্য- পুরুষদের পক্ষেও তেমনি কর্তব্য। প্রশ্ন হচ্ছে, তা’হলে পুরুষদের উদ্দেশ না করে শুধু নারীদের সম্বোধন করে এ উপদেশ দেয়া হয়েছে কেন? তার উত্তরে বলা যায়-নারী চরিত্রকে যে কোন সমাজে সূচি বা (Index) বলা যায়। সে সমাজের নারী-জীবনে যৌন অভিশাপ দেখা দেয়, সে সমাজে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংস হয়। নারী-সমাজে যৌনকাতরতা ব্যাপকভবে দেখা না দিলে, পুরুষ সমাজ সহজে ধ্বংস হয় না। একথা এজ সর্বজনস্বীকৃত যে, যৌন- জীবনের আবেগে পুরুষ যেভাবে অস্থির হয় নারীরা সেভাবে হয় না। তাদের মধ্যে সংযম,ধৈর্য ও সহ্যক্ষমতা অনেক বেশি। যখন নারী-সমাজ থেকে এসব গুণ অন্তর্হিত হয়, তখন নারীরাই অগ্রসর হয়ে পুরুষের সঙ্গ কামনা করে। দুর্বলচিত্ত পুরুষ তাতে অতিসহজেই সাড়া দেয় এবং সমাজজীবনে ব্যভিচারের বন্যাস্রোত হইতে থাকে। এজন্য কেবল সূরা আহযাবের মধ্যে নয়, সূরা ইউসুফের মধ্যেও প্রকারান্তরে নারীদের সাবধান করে দেয়া হয়েছে। হযরত ইউসুফের (আঃ) রূপে মুগ্ধ ইসরাতুল আযীয বা আযীযের স্ত্রী মুসলিম সমাজে জোলায়খা নামে পরিচিত। সে যখন নানাভাবে হযরত ইউসুফকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করছিল, তখন মিসরের সম্ভ্রান্ত বংশীয়া নারীগণ তাকে ভৎর্সনা করে বলেছিল- ছি, ছি, তুমি এক গোলামের রূপে আসক্ত হয়ে আমাদের অর্থাৎ মিসরের সম্ভ্রান্ত বংশীয় নারীদের অপমান করেছো। ইসরাতুল আযীয তাঁর এ আকর্ষণ যে অনিবার্য তা প্রমাণ করার জন্য চল্লিশজন ভদ্র মহিলাকে দাওয়াত দিয়ে তাদের চল্লিশটি লেবু ও চল্লিশটি মেওয়াতরাশ হাতে দিয়ে লেবুগুলো কেটে খেতে অনুরোধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে হযরত ইউসুফকে নাম ধরে ডাকতে থাকেন। তিনি উপস্থিত হলে তাঁর সৌন্দর্য অভিভূত কামার্ত মহিলাগন লেবু না কেটে তাদের হাতের আঙ্গুল কাটতে শুরু করে। এতে প্রত্যক্ষে বলা হয়েছে- “হে মুমিনগণ, সাবধান হও, তোমরা তোমাদের নারীগণকে কামাতুরা হতে দিও না; যদি দাও, তা’হলে মিসরের আযীযের স্ত্রীর সখিগণের মতই তাদের দশা হবে”।
পূর্বেই বলা হয়েছে-নারী-জীবন হচ্ছে সমাজের সূচি। কাজেই তাকে পবিত্র রাখার দায়িত্ব কেবল নারীর নয়, পুরুষেরও। কারণ নারীরা পুরুষেরই মা, ভগ্নি, স্ত্রী ও কন্যা। এভাবে সরাসরি নারীদের উল্লেখ করে সূরা আহযাবে এবং পরোক্ষে সূরা ইউসুফে যে উপদেশ দেয়া হয়েছে- তা সর্বকালের এবং সর্বদেশের নারীদের পালন করা উচিত। এক্ষেত্রে নারীদের সহায়ক হিসেবে পুরুষদের সর্বতোভাবে সাহায্য করা উচিত।
মর্যাদা প্রসঙ্গে হাদীসে যেসব উক্তি রয়েছে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায়, নারীর স্থান পুরুষের ঊর্ধ্বে, মাতার সম্মান পিতার সম্মানের তিনগুণ। এ পৃথিবীর স্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ধার্মিক পুরুষকে নয়, ধার্মিক নারীকে গণ্য করা হয়েছে। সে ধার্মিক নারীকে যাতে কোন ধন-দওলতের মোহে আকৃষ্ট না হয়ে পুরুষেরা বিয়ে করে তার জন্য উপদেশ দান করা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে নারীকে এত ঊর্ধ্বে সম্মান দান করা সত্ত্বেও অধিকারের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়ে পুরুষের সমান আসন দেয়া হয়নি কেন? তার উত্তরে বলা যায়-নারীর শারীরিক ও মানসিক দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখেই তাকে কোন কোন অধিকারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে এ দুনিয়ার সবকিছুর একমাত্র মালিকানা আল্লাহ্ সুবহানাতা’আলার। মানুষকে তার কাছে গচ্ছিত বিষয়ের ভোগ-দখলের অধিকার দেয়া হয়েছে বটে, তবে সে ভোগ-দখলকে সে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারে না। সে ভোগ- দখলের জন্য যে নীতি নির্ধারিত হয়েছে তারই নির্দেশিত পথে তাকে ভোগ করতে হবে। এজন্য মুমিন মুসলিমদের অধীন সম্পদ ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির মত আল্লাহ্র আইন মুতাবিক পরিচালিত হবে। এ পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং এর দায়িত্ব ততোধিক কঠিন। নারীদের শারীরিক দুর্বলতা এবং সন্তান লালন-পালনে তাদের অধিক দায়িত্ব থাকায় তাদের কোন কোন বিষয়ের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাদের হিফাজতকারী বা (Custodian)-এর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তবে মর্যাদার দিক থেকে তাদের স্থান পুরুষের ঊর্ধ্বে নির্দেশিত হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে সুদপ্রথা
দুনিয়ার সবকিছুর স্বত্ব-স্বামিত্ব আল্লাহ্র ন্যস্ত করার ফলে যাতে মানুষের পক্ষে মানুষকে পীড়নের কোন সুবিধা না থাকে, তার জন্য রিবা বা সুদ প্রথাকে ইসলাম গোড়াতেই বাতিল করে দিয়েছে। কুরাআনুল-করীমের আল্লাহ্ আদেশ করেছেন, “যারা সুদ খায় তারা টিকে থাকতে পারে না, কেবল সে ব্যক্তির মতই টিকে থাকে, যাকে শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা পাগলামিতে ঠেলে দিয়েছে”। (সূরা বাকারা ২:৩৮:২৭৫)
অন্য এক স্থানে সুদের বিরুদ্ধে অভিসম্পাত বর্ষণ করা হয়েছে “আল্লাহ্ সুদকে সমস্ত নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করবেন, কিন্তু দান সংক্রান্ত কার্যাবলিকে বিশাল করবেন”। (সূরা বাকারা ১:৩৮:২৭৬)
কুরআনুল করীমের উপরোক্ত বাণীর মধ্যে ‘সে ব্যক্তির মতই টিকে থাকতে পারে-যাকে শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা পাগলামিতে ঠেলে দিয়েছে’-বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, মানুষের প্রবৃত্তির মধ্যে প্রেম,স্নেহ, দয়া, মায়া প্রভৃতি উচ্চ পর্যায়ের প্রবৃত্তি। এগুলো অনুশীলন ব্যতীত মানুষের মধ্যে সত্যিকার মনুষ্যত্বের বিকাশ হয় না। অথচ সুদ গ্রহণ ও সুদ দান দ্বারা মানুষের সেসব প্রবৃত্তির বিকাশে নানাবিধ অন্তরায় দেখা দেয়। মানুষ যখন নানাবিধ বিপদের সম্মুখীন হয় এবং তার পক্ষে তার কাছে রক্ষিত অর্থের দ্বারা তা সংকুলান হয়ে ওঠে না, তখনই সে ধার পাওয়ার জন্য অন্যের দ্বারস্থ হয়। মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে তখন তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা। তার এ দুর্বলতার সুযোগে তাকে ধার দিয়ে তা থেকে এক মোটা অংক আদায় করা কোন মানুষের কাজ হতে পারে না। তার একমাত্র কাজ হচ্ছে সে শয়তানের, যে মানুষকে সর্বাবস্থায় বিপথগামী করে। এক্ষেত্রে শয়তানের সে কাজকে সুদখোরকে পাগল করে দেয়া বলা হয়েছে। কারণ, পাগলামি মানুষের সাধারণ বা প্রকৃতিস্থ রূপ নয়। এ হচ্ছে মানুষের এক বিকৃত রূপ। সুদ গ্রহণ করা, এ জন্য বলা হয়েছে এতে মানুষ তার সত্যিকার রূপ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে মাংসাশী প্রাণীর মত অপরের রক্ত মোক্ষণে অগ্রসর হয়। যে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে মানুষকে ভালবাসা বা তাকে সাহায্য করা, এক্ষেত্রে সে মানুষই তার সে আদিম প্রবৃত্তির সম্পূর্ণভাবে অবমাননা করে তার বিপরীত দিকে ধাবিত হয় এবং রক্তলোলুপ প্রাণীর মত অপর মানুষের রক্ত শোষণ করতে চায়।
আল্লাহ্ মানুষকে ইনসান-ই-কামিল রূপে গড়ে তুলতে চান। সে ইনসান-ই-কামিল হবে মানুষের বন্ধু। কাজেই যে প্রথা দ্বারা মানুষ ইনসানের শত্রুতা করতে অভ্যস্ত হয়, তাকে কোন অবস্থায়ই আল্লাহ্ গ্রহণ করতে পারেন না। বরং সর্বাবস্থায় তাকে পরিহার করার জন্য তাগিদ দেন।
বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাতে দেখা যায়, সুদখোরের সন্তান-সন্ততির মধ্যে আলস্য ও বিলাসিতা আসে। কোন কাজকর্মে না করে ঘরে বসে বিনা পরিশ্রমে প্রচুর রোজগার হয় বলে সুদখোরের সন্তান-সন্ততি বিলাসী হতে বাধ্য। পরিণামে এসব পরিবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
সাম্যবাদমূলক দায়ভাগ প্রথার প্রবর্তন
মালিকানা সম্পূর্ণ আল্লাহ্র বলে স্বীকৃতি লাভ করার পরে এ বিশ্বের সম্পদের সংরক্ষণ এবং সে সম্পদের হস্তান্তর সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় প্রশ্ন দেখা দেয়। এ বিশ্বের সমস্ত সম্পদের মালিক আল্লাহ্ তা’আলা তো বটেনই। তবে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এ সম্পদকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত না হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে সম্পদ কোন না কোন ব্যক্তিবিশেষের করায়ত্ত থাকে। সে ব্যক্তির মৃত্যুর পরে, – এ সম্পদের কতটুকু কার দায়িত্বের মধ্যে অর্পিত হবে, সে সম্বন্ধে কুরআনুল করীমের পরিস্কার নির্দেশ রয়েছে।পুরুষ বা নারীর ইন্তেকালের পরে তার পুত্র, কন্যা ও স্বামী বা স্ত্রী সে সম্পদের কত অংশের হিফাজতকারী হবে তাতে কুরআনুল-করীমে নির্দেশ রয়েছে। সে নির্দেশকে সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যায়, ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে অর্থের সহজ ও অবাধ গতির পথ প্রশস্তকরণ। অর্থাৎ যাতে এ জগতের ধন-দওলতে, টাকা-কড়ি অতি সহজেই সকল স্তরের লোকের কাছে পৌঁছতে পারে, ইসলামে রয়েছে তারই বিধি ব্যবস্থা অর্থাৎ ইসলাম কোন অবস্থায়ই টাকা-পয়সা কোন ব্যক্তি-বিশেষের হতে সঞ্চিত হয়ে পুঞ্জিতে পরিণত হউক এরূপ কোন ব্যবস্থার প্রশ্রয় দেয় না। একদিকে যেমন ইসলাম অলস মূলধনের (Idle Capital) অস্তিত্ব বরদাশ্ত করে না, তেমনি তাকে সঞ্চিত হওয়ারও কোন সুযোগ দিতে চায় না। এজন্য ইসলামী সমাজের দায়ভাগে সম্পত্তিকে ছোট ছোট ভাগে বণ্টন করার জন্য রয়েছে বিধি ব্যবস্থা।
ইসলামী নীতির রুপায়ণ-রাষ্ট্রীয় জীবনেঃ মদীনার সনদের সারমর্ম
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনের অধিক ভাগই দুর্ধর্ষ কুরায়েশ জাতির সঙ্গে নানাবিধ যুদ্ধে অতিবাহিত হয়। কুরায়েশদের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় য়াহূদীদের বিশ্বাসঘাতকতা। তা সত্ত্বেও তিনি কোন জাতির বা ধর্মাবলম্বীর কোন মতামতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি। মদীনাতে হিজরত করার পরে তিনি যে রাষ্ট্র গঠন করেন, তাতে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার সে মর্মবাণীই ফুটে উঠেছে। মদীনা সনদের প্রথম কথাই হল-মদীনার য়াহূদী, পৌত্তলিক ও মুসলমান সকলেই এক দেশবাসী। য়াহূদী, পৌত্তলিক এবং মুসলমান সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না। এ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই- সে রাষ্ট্রে মুসলিমেরা সংখাগরিষ্ঠ হলেও সংখ্যালঘু য়াহূদী ও পৌত্তলিকদের নামই প্রথমে বলা হয়েছে। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়- তখনকার নানাবিধ অত্যাচার ও অনাচারের যুগে ইসলামী সমাজে বা রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা হত। দ্বিতীয়ত, সেই সনদে সংখ্যাগুরু সমাজের নেতা আল্লাহ্র রসূল (সঃ)-এর নির্দেশ পালন করার জন্য সংখ্যা
লঘু সমাজের লোকেরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অর্থাৎ গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করা হয়েছে। যদি য়াহূদী বা পৌত্তলিকেরা সংখ্যাগুরু হত তা হলে তাদের নেতার আদেশে সংখ্যালঘু মুসলিমদের পরিচালিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকতো। তবে যেহেতু মুসলিমেরাই সংখ্যাগুরু ছিল, এজন্য মুসলিমদের সর্বসম্মত জননেতা-হযরত রসূলই-আকরমের (সঃ) নেতৃত্বই স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল। তবে যাতে কোন অবস্থায়ই বর্তমান কালের তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অর্থের দওলতে নানাবিধ দুর্নীতির সৃষ্টি না হয়- সে দিকে ইসলামী রাষ্ট্রে প্রখন দৃষ্টি ছিল। ইসলামী রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের মধ্যে যাতে কোনকালে অর্থের দ্বারা কোন সুযোগ-সুবিধা আদায় করা না হয়, এজন্য খলীফা পদ প্রার্থীকে সাচ্চা মুসলিম হতে হবে। অর্থের প্রাধান্যের জন্য বর্তমান কালের গণতন্ত্রের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে-তা’ সত্যিই অসংস্কৃতব্য । মুখে গণতন্রের নামে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়ে, অর্থের জোরে নরপিশাচ শ্রেণীর মানুষেরাও সফলতা লাভ করে। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে যে সার্বভৌমত্বের সৃষ্টি হয়, তার সঙ্গে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের ভীষণ দ্বন্দ্ব দেখা দেয় বলে এ গনতন্ত্রকে অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন। অথচ বর্তমান কালের গনতন্রে এ দ্বন্দ্ব সর্বত্রই বর্তমান। এ গণতন্রের নির্বাচন প্রার্থীর চরিত্রকে বিচার করা হয় না, তার জনপ্রিয়তাকেই বিচার করা হয় বলে নিতান্ত চরিত্রহীন লোকের পক্ষেও নির্বাচিত হওয়ার সমূহ সুযোগ থাকে। ইসলামী গণতন্ত্রে নির্বাচন প্রার্থী লোকের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা প্রণালি, ইসলামের রীতিনীতির সঙ্গে তার যোগ প্রভৃতি বিষয় বিচার করা হয় বলে এ দ্বন্দ্ব দেখা দেয় না।
কাজেই দেখা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রে রয়েছে একদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা। যে ব্যক্তি-স্বাধীনতার জন্য এ যুগে এত হৈ চৈ শোনা যায়-চৌদ্দশত বৎসর পূর্বেই মানুষের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সে স্বাধীনতার চার্টার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলেই দান করেছেন। অপরদিকে এ গণতন্রে অর্থের মাধ্যমে যাতে কোন দুর্নীতি প্রশ্রয় না পায়- তার জন্য এ গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের চরিত্র সম্বন্ধেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
পুঁজি সৃষ্টির বিরুদ্ধে অর্ডিন্যান্স
ইসলামী নীতি অনুসারে জীবন যাপন করলে কোন অবস্থায়ই মানুষের হাতে পুঁজি সৃষ্টি হতে পারে না। যাকাত ব্যতীতও নানাবিধ দান সবসময়ই ধনী ব্যক্তিকে করতে হবে। জবিল কুরবা, ইয়াতামা, মাসাকিনা ও ইবলে সবিল অর্থাৎ পিতৃমাতৃকুলের আত্মীয়-স্বজন,অনাথ, পিতৃমাতৃহীন ছেলেমেয়ে, বিত্তহারা ও সহায়-সম্বলহীন পথিকের দাবি রয়েছে ধনীর মালের ওপর। কুরআনে শরীফে এদের প্রাপ্য প্রদান করার জন্য রয়েছে জেদ তাগিদ। কেবল কুরআন শরিফেই নয়, হাদীস শরীফেও দানের মাহাত্ম্য ঘোষণা করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন-
“ আল্লাহ্র রসূল (সঃ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ জিজ্ঞেস করবেন, ‘হে বনি আদম, আমি পীড়িত ছিলাম কিন্তু তুমি আমায় দেখো নি’। সে উত্তর করবে, ‘ হে আমার প্রভু, আমি তোমাকে কিভাবে দেখবো, তুমি যে নিখিল বিশ্বের প্রভু?’ তিনি (আল্লাহ্) বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা পীড়িত ছিল, কিন্তু তুমি তাকে দেখো নি, তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে দেখতে ( শুস্রষা করতে) তাহলে তার মাঝেই আমাকে পেতে? হে বনি আদম! আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমার আহার দাও নি’। সে উত্তর দেবে, ‘হে আমার প্রভু, আমি তোমাকে কিভাবে খেতে দিতে পারতাম- যেহেতু তুমি সমস্ত ভুবনের প্রভু?’ তিনি (আল্লাহ্) বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে চাওয়া সত্ত্বেও তুমি তাকে খেতে দাওনি-তুমি কি জানতে না যদি তুমি তাকে খেতে দিতে তাহলে আমাকেই খেতে দিতে?’* (Al-Muslim….Al-Hadis,Sec.p,35,273 Maulana Fazlul Karim.)
এতসব আইন-কানুন থাকা সত্ত্বেও যদি মানুষের মধ্যে অযথা সঞ্চয় করার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে তাহলে প্রয়োজনবোধে খলীফা বা আমির ধনীদিগকে দরিদ্রের দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করতে পারেন। ইবনে হাজম এ অর্ডিন্যান্সের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, “প্রত্যেক মহল্লার ধনীদের ওপর গরীব-দুঃখীদের জীবিকার জন্য দায়ী (জামিন) হওয়া ফরয (অবশ্য কর্তব্য)। যদি বায়তুলমালের আমদানি ঐ গরিবদের জীবিকার পক্ষে যথেষ্ট না হয়, তাহলে শাসক বা আমির ধনীদের এ কাজের জন্য বাধ্য করতে পারেন। অর্থাৎ তাদের অতিরিক্ত মাল বলপূর্বক গরিবদের প্রয়োজনে খরচ করতে পারেন। তাদের জীবিকার সংস্থানের জন্য আবশ্যক-ক্ষুধার অন্ন, পরিধানের বস্ত্র এবং ঝড়-বৃষ্টি, গরম রোদ ও প্লাবন থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে এমন বাসগৃহ’।* (মুহাল্লাঃ ৬ষ্ঠ খন্ড,পৃ,১৫৬;মিসলাঃপৃ,৭২৫,মওলানা হিফজুর রহমানঃ ‘ইসলাম কা ইক্ তেসাদি নিজাম’ থেকে গৃহীত।)
ইসলামী গনতন্রের ফলিত রূপ
হযরত রসূল আকরম (সঃ)-এর জীবিতকালে এবং পরবর্তী সময়ে সে আদর্শ রাষ্ট্রে স্বাধীনতা যে চরম বিকাশ লাভ করেছিল, তার নিদর্শনস্বরূপ বহু ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত মাত্র দুটি ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছে। ইসলামী গণতন্রের স্বরূপ বর্ণনা করতে যেয়ে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রাঃ)এক জনসভায় বক্তৃতায় বলেছিলেনঃ
“ আমি আপনাদের একজন খাদিম মাত্র। আমার কাছ থেকে আপনাদের সর্বপ্রকার মঙ্গলজনক কাজ আদায় করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে”।
হযরত উমর (রাঃ)আর একদিন জনসভায় বক্তৃতাকালে শ্রোতৃমন্ডলীর মধ্য থেকে হটাৎ এক ব্যক্তি বলে উঠলো, “ হে উমর,আল্লাহ্কে ভয় করো”। সমবেত জনতা চাইলো তাকে থামিয়ে দিতে কিন্তু হযরত উমর (রাঃ) বললেন, “না, না, একে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে দিন। নিজের মতামত ব্যক্ত না করলে ইসলাম প্রদত্ত স্বাধীনতা ভোগ ও সাম্যের সম্মান আপনারা কি প্রকারে করবেন? ইসলাম জননেতা ও জনগণের মধ্যে কোন ইতর-বিশেষ করেনি। শুধু পার্থক্য এই যে,জননেতার দায়িত্ব অধিক। সকলেরই সম্মতি ও আপত্তিতে কর্ণপাত করা রাষ্ট্রনেতা হিসেবে আমার কর্তব্য”।** (বিপ্লবী উমরঃ সম্পাদক-আবদুল গফুর।)
সে ব্যক্তি-স্বাধীনতা যাতে স্বেচ্ছাচার ও জুলুমে পরিণত না হয় তার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেই মুসলিম রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। সে আদর্শ সাম্যবাদে আমির-ফকিরে কোন পার্থক্য ছিল না।
খলীফার দায়িত্ব
সাধারণের অর্থ খলীফার তত্ত্বাবধানে থাকলেও তা থেকে যথেচ্ছ ব্যয় করার অধিকার খলীফার ছিল না। কোন কোন ক্ষেত্রে এরূপ সন্দেহের উদ্রেক হলে জনসাধারণের পক্ষে প্রকাশ্যে খলীফার সমালোচনা করার অধিকার ছিল। তাকে impeach করতে হলে অপসারণের প্রয়োজন হ’ত না। এর উদাহরণ রয়েছে ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাসে। খলীফা উসমানের (রাঃ) খিলাফতের সময় কয়েকজন দুষ্ট প্রকৃতির লোক তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থিত করলে তিনি মুসলিমদের এক সাধারণ সভা আহ্বান করে তাঁর ওপর আরোপিত অভিযোগ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে বলেনঃ
“ আল্লাহ্র নামে শপথ নিয়ে বলছি- আমি কোন শহরের উপর তার সাধ্যাতীত কর ধার্য করিনি, কাজেই আমার বিরুদ্ধে আনীত এ অভিযোগ নিছক মিথ্যা। আমি সর্বসাধারণের থেকে যা গ্রহণ করছি তাদেরই হিতের জন্যই ব্যয় করছি। যে লভ্যাংশের এক-পঞ্চমাংশ আমার নিকট এসেছে তাও আমার ব্যক্তিগত ভোগের জন্য ব্যয় করা আইনসঙ্গত নয়। তাই তার সমস্তই মুসলিমরা ব্যয় করেছে- আমি করিনি। সাধারণ ধনাগারের এক কপর্দকও তসরুফ করা হয়নি, আমি তা থেকে একটি পয়সাও নিইনি। আমি আমার নিজের উপার্জনের ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করি”।
তারপর তিনি আরও বলেন- “তোমরা জানো, খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে আরব দেশে আমি ছিলাম উট ও ছাগীর সবচেয়ে বড় মালিক। খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দু’টো উট ব্যতীত আমার আর কোন পশু নেই। সেগুলোও আমি হজ্জের সময় মক্কায় যাওয়ার জন্য ব্যবহার করি”।
ইসলাম ও ডিক্টেটরশিপ
হযরত রসূলে করীম (সঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁরই আদর্শের অনুসরণে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতেই রাষ্ট্র গঠিত হয়। নবনির্বাচিত খলীফা হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর ঘোষণাতে ন্যায়-বিচার ও খলীফার ক্ষমতা প্রয়োগের একটা স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায়। তিনি তাঁর নির্বাচনের পরে সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেনঃ “সঙ্গীগণ, আমি তোমাদের খলীফা নির্বাচিত হয়েছি। আমি তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করি না। তোমাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে শক্তিশালী তাকেই আমি দুর্বলতম মনে করব- যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে দখলকৃত (দুর্বলদের) সামান্যতম অধিকারকে আমি ফিরিয়ে আনতে পারি এবং যারা তোমাদের মধ্যে দুর্বলতম- তারাই আমার কাছে সবলতম- যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তাদের অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করি। ভাইগণ, আমাকে তোমাদের মতই আল্লাহ্র আইন মেনে চলতে হবে এবং আমি তোমাদের ওপর কোন নতুন আইন চাপাতে পারবো না। আমি তোমাদের উপদেশ ও সাহায্য চাই। যদি সৎপথে চলি, তোমরা আমার সহায়তা করবে, যদি ভুলপথে চলি তাহলে আমাকে সংশোধন করবে”।
কাজেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, খলীফার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ার ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা কর। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত খলীফা কোনদিনই জনমতকে উপেক্ষা করেননি। মানুষ হিসেবে তাঁদের ভুল-ভ্রান্তি সম্বন্ধে তাঁরা ছিলেন সততই সজাগ। ইসলামের উজ্জ্বল রত্ন খলীফা উমর (রাঃ) একদিন এক সাধারণ সভায় আদেশ করেছিলেন-মোহরানা যেন বেশি নেওয়া না হয়। তাঁর কথা শোনামাত্রই এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে কুরআন শরীফের এক আয়াতের উল্লেখ করে দেখিয়ে দেন যে, কুরআনে মোহরানার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়নি। খলীফা অম্লানে তাঁর ভুল স্বীকার করেন।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, বর্তমান যুগের রাষ্ট্র পরিচালকদের চরিত্রের সঙ্গে খলীফাদের চরিত্রের কোন তুলনাই চলে না। তাঁরা সবসময়েই নিজেদের সাধারণ মানুষ বলেই মনে করতেন-দুনিয়ার সব ত্রুটি-বিচ্যুতির উর্ধ্বে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ‘অতিমানব’ বলে তাঁরা নিজেদের কোনদিন ভাবতে পারতেন না।
সংখ্যালঘু সমস্যা
দুনিয়ার সকল দেশে সকল যুগেই সংখ্যালঘু সমস্যা ছিল ও রয়েছে। আধুনিককালে গণতন্ত্রমূলক রাষ্ট্র গঠিত হলেও তাতে সংখ্যালঘু একদল লোক থেকে যায় যারা বিরোধী দল নামে পরিচিত। ইসলামী রাষ্ট্রে চার্চ ও পার্লিয়ামেন্টের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বলে এ রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের দুদিক থেকে দেখা যেতে পারে। সংখ্যালঘু বলতে রাষ্ট্রের অধিকাংশ লোকদের মতাবলম্বী নয় এমন একদল লোককে যেমন বোঝা যায়- তেমনি অন্য ধর্মাবলম্বী লোককেও বোঝা যায়। ইসলামী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর স্থান কোথায়, তা-ই আমাদের বিবেচ্য। ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিমদের মধ্যে সংখ্যালঘু বলে কেউ থাকতে পারে না। কারণ, মুসলিমেরা সকলেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে ইসলামেরই অনুসারী ও ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের রুপায়ণে এক মতাবলম্বী হতে বাধ্য। ভিন্ন ধর্মের লোকদের ইসলামী রাষ্ট্রে বলা হয় যিম্মি। তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি অক্ষুণ্ন রাখতে ইসলামী রাষ্ট্র সর্বতোভাবে বাধ্য। এজন্যই ইসলামের শাসন বিধান অনুসারে ইসলামী রাষ্ট্রে এমন কোন আইন গৃহীত হতে পারে না- যা যিম্মির সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিকূল। তাই আধুনিক গণতন্ত্রের চেয়ে এক্ষেত্রে ইসলামী নীতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। কারণ, আধুনিক গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে কোন আইন জনমতের জোরে গৃহীত হয়ে যেতে পারে, যা সম্পূর্ণই সংখ্যালঘুর সংস্কৃতির প্রতিকূল। কাজেই শুধু ‘যিম্মি’ শব্দ শুনেই যাঁরা অস্থির হয়ে পড়েন তাঁদের প্রবোধের জন্য বলা যেতে পারে যিম্মি অর্থ রক্ষিত নয়- তার অর্থ ইসলামী শাসন বিধানে যাতে কোন অনিষ্ট বা অমঙ্গল না হয় তার জন্য রক্ষাকবচের ব্যবস্থা।
যিম্মি সম্বন্ধে হযরত আলীর উক্তি রয়েছে- যিম্মির রক্ত আমারই রক্ত। ইসলামী রাষ্ট্রে যিম্মির মুসলিমদের মত সমান অধিকার রয়েছে। প্রশ্ন ওঠে সংখ্যালঘু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কোন ব্যক্তি বা ভিন্ন মতাবলম্বী হয়েও ইসলামী রাষ্ট্রের আদর্শে বিশ্বাসী হতে পারে কিনা। এরূপ ক্ষেত্রে শাসন ব্যবস্থায় মুসলমানদের মত তার সমান অধিকার থাকতে পারে কিনা। তার উত্তরে বলা যায়, ইসলাম অবিভাজ্য মতবাদ বলে ধরে নেয়া হয়-ইসলামের আংশিক দিককে গ্রহণ করে ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ চালু করা কারো পক্ষে সহজ নয়। আল্লাহ্র ওয়াহদানীয়ত ও সার্বভৌমত্বের ওপর ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সে মৌলিক ভিত্তিকে অস্বীকার করে কোন ব্যক্তির পক্ষে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চালু করা অসম্ভব। তাই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তিকে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করার ভার ইসলামী সমাজে দেয়া হয়নি। তবে এতে সংখ্যালঘু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর পক্ষে অসুবিধার বিশেষ কারণ আছে বলে মনে হয় না। কারণ, রাষ্ট্রের পরিচালনা খুব সুখের বিষয় নয় এবং কোন রাষ্ট্রে বাস করে তার সকল অধিকার ভোগ করে কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে তাতে ব্যক্তিবিশেষের কোন ক্ষোভের কারণ থাকতে পারে না। আধুনিক কমিউনিষ্ট রাষ্ট্রগুলোতে কমিউনিষ্ট ব্যতীত অন্য কাউকে নির্বিঘ্নে বাস করতে দেয়া হয় না- পরিচালনা তো দূরের কথা।
খলীফার নিয়োগ
আল্লাহ্র রসূল (সঃ)-এর পরে আল্লাহ্র রাষ্ট্রে তাঁর প্রতিনিধির নিয়োগে কখনও বা নির্বাচন, কখনও – মনোনয়ন, কখনও বা নির্বাচনের জন্য প্যানেল মনোনয়ন করা হয়েছে। মুসলিমেরা প্রত্যেকেই আল্লাহ্র প্রতিনিধি বলে তাদের প্রত্যেকেরই আল্লাহ্র প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুকের নির্দেশ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় সর্বসাধারণ মুসলিমদের নির্বাচন হবে আল্লাহ্র রসূল (সঃ)-এর প্রতিনিধি বা খলীফা নির্বাচনের ভিত্তি। তিনি আদেশ করেছিলেন-
“ সর্বসাধারণ মুসলিমের সম্মতি ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি যদি কারো প্রভুত্ব স্বীকার করে তাহলে যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং যে আনুগত্য স্বীকার করে তাদের দুজনেরই মৃত্যুদন্ড হওয়া উচিত* (Shaik Mushir Hussain Kidwai-Pan Islamism & Bolshevism p 212-13)- তবে এক্ষেত্রেও ইসলামী গণতন্রের সঙ্গে আধুনিক গণতন্ত্রের পার্থক্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, কোন ব্যবস্থাপক সভা অথবা পরিষদে নির্বাচিত হতে হলে প্রার্থীর পক্ষে অধিক সংখ্যক ভোট সংগ্রহ করা প্রয়োজনীয়। প্রার্থীর জনপ্রিয়তার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত চরিত্রের কোন যোগ নেই। তার নির্বাচকমন্ডলীর লোকদের সে যে কোনভাবেই সন্তুষ্ট করেই জনপ্রিয় হতে পারে। সে হয়ত টাকা পয়সা ঘুষ দিয়ে অথবা নানাবিধ বিলাসের সামগ্রী সরবরাহ করে জনপ্রিয় হতে পারে। ইসলামী গণতন্ত্রে এরূপ লোকের কোন স্থান হতে পারে না। যাকে শর্তবিহীন অবাধ গণতন্ত্র বলে বর্তমানে সম্মান প্রদর্শন করা হয়, তাকে সুবিখ্যাত রাষ্ট্রনীতিবিদ হ্যারলড লাস্কি ঠাট্টা করে বলেছেন- এটা দ্বন্দ্বসংকুল গণতন্ত্র। এতে একদিকে সংখ্যার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থের সার্বভৌমত্বও স্বীকার করে নেওয়া হয়। এ গণতন্ত্রে সকল মানুষের সমান অধিকার স্বীকার করা হলেও কার্যক্ষেত্রে ধনীরা তাদের অর্থের মাধ্যমে গরিবদের কাছ থেকে অতি সহজে তার ভোট কিনে নিতে পারে। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা এ গণতন্রের মূলভিত্তি হলেও সংখ্যালঘু ধনীদের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয়। ইসলামী সমাজে এজন্য প্রার্থীর চরিত্রের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ইসলাম ধর্মের বিপরীত যে কোন কাজকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা পদের যেমন প্রার্থী হতে পারে না, তেমনি জনসাধারণও এরূপ ব্যক্তিকে ভোটদান করতে পারে না। ইসলামী গণতন্ত্রে মূল লক্ষ্য হচ্ছে-এ বিশ্বে আল্লাহ্র শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য যে ব্যক্তি আল্লাহ্র শাসন কামনা করে না অথবা আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধ মানতে চায় না, সে ব্যক্তি আল্লাহ্র খলীফা নির্বাচিত হতে পারে না।
ইসলামী জীবনধারার বিপরীতমুখী জীবন যাপন করাতে অভ্যস্ত ব্যক্তির খলীফাপদে নিয়োগের প্রতিবাদ করার ফলেই কারবালা প্রান্তরে সে হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
হযরত মু’আবিয়া তারই জীবনকালে তার পুত্র ইয়াযিদকে ইসলামী জগতের খলীফা মনোনীত করার প্রতিবাদকল্পেই শহীদরাজ হাসান, হোসেন কারবার প্রান্তরে এবং আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র মক্কাতে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে উমাইয়াদের শাসনকালে খলীফার পদে বংশানুক্রমিক হয়ে পড়লেও সে বংশেরই অতি ন্যায়বান ও পরম সত্যবাদী হযরত উমর ইবেনে আবদুল আযীয খানদানী সূত্রে খলীফার পদ লাভ করেও তাতে ইস্তফা দিয়ে জনগণের মত পরিক্ষা করে নিয়েছিলেন। সর্বসাধারণ মুসলিম একবাক্যে তাঁর নিয়োগ সমর্থন করার পরে তিনি সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হন। তবে তিনি দীর্ঘকাল তাঁর এ পদে টিকে থাকতে পারেন নি। তাঁরই বংশের লোকদের মত প্রচলিত নানাবিধ দুষ্কর্মের উচ্ছেদ করতে যেয়ে তিনি তাদের কারসাজির ফলে নিহত হন।
তারপরে মুসলিম সমাজে ইসলামী গণতন্ত্রে যে ছায়াটুকু মাত্র অবশিষ্ট থাকে তা’ সত্যিকার ঈমানদার কেন, অন্য মানুষের কাছেও হাস্যাস্পদ। তথাকথিত খলীফাগণ উত্তরাধিকারসূত্রে খিলাফত লাভ করে মুসলিম জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে তাদের কাছ থেকে পদপ্রাপ্তির পরে বায়’আত গ্রহণ করতেন। উমাইয়া ও আব্বাসীয় উভয় পক্ষের মধ্যে এ আচরণ প্রচলিত ছিল।
অর্থনীতি
এ রাষ্ট্রের অর্থনীতি পরিচালিত হয় সর্বসাধারণের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে। যুদ্ধলব্ধ বিত্ত (আল-গনীমাহ), যাকাত, সাদাকা, জিযিয়া, খিরাজ, আল-ফায়, আল-উশর প্রভৃতি বিভিন্ন কর ধার্য করে এ রাষ্ট্রের আর্থিক সৌধ গড়ে তুললেও পরিবর্তিত অবস্থায় সেগুলোর পরিবর্তনও স্বীকার করে নেওয়া হয়।
হযরত উমর (রাঃ)-এর লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের সমস্ত মুসলিম অধিবাসীকে রাষ্ট্রের অঙ্গ জ্ঞান করে রাষ্ট্রগতপ্রাণ করে তোলা। সে জন্য তিনি তাদের প্রত্যেকের বৃত্তি নির্ধারণ করেছিলেন এবং যাতে করে তারা জীবিকার সংস্থানের জন্য অন্য কোন কাজে লিপ্ত না হয় তার প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখতেন। তাঁর খিলাফতের সময় কোন অমুসলিম মুসলমান হয়ে গেলে তার সম্পত্তি দেশের লোকের মধ্যে বেঁটে দেয়া হতো।
এ রাষ্ট্রে যাতে কোন অবস্থায় কোন লোকের হাতে পুঁজি সঞ্চিত না হয় সেজন্য আদেশ করা হয়েছেঃ
“ এবং যারা সোনারূপা সঞ্চয় করে, আল্লাহ্র পথে (মানবতার কল্যাণের জন্য) ব্যয় করে না-তাদের নিকট এক কষ্টদায়ক শাস্তি ঘোষণা করে দাও”। (সূরা তওবা, আয়াত ৩৪)
এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রসূল আকরাম (সঃ) যা বলেছেন, সাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) তা’ বর্ণনা করে বলেন, “রোজ কিয়ামতে এ সকল লোকদের পার্শ্বদেশ, কপাল ও পিঠে দাগ দেয়া হবে”।
উমাইয়াদের আধিপত্য বিস্তারের সূচনায় এবং সিরিয়াতে মু’আবিয়া গভর্নর থাকাকালে এ আয়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করে হযরতের প্রিয় সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী* (রাঃ)(ইতিহাসে উপেক্ষিত একটি চরিত্রঃ মুহাম্মদ আজরফ ও এ. জেড. এম. শামসুল আলম) বিপ্লবের সূচনা করেন। তাঁর সুদৃঢ় অভিমত ছিল, প্রয়োজনে অতিরিক্ত কোন বিত্তই কেউ রাখতে পারে না।
সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবনে হাজম জাহেরী ‘মুহাল্লা’য় উল্লেখ করেছেন- হযরত আবু সাঈদ খুদরী বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহ্র রসূল বলেছেন, যে ব্যক্তির কাছে শক্তি ও সামর্থ্যের সরঞ্জাম নিজ আবশ্যকের অতিরিক্ত রয়েছে তার উচিত-ঐ অতিরিক্ত সামান-সরঞ্জাম দুর্বলকে দান করা। যে ব্যক্তির কাছে খাওয়া-পরার অতিরিক্ত উপাদান রয়েছে তার পক্ষে উচিত-অতিরিক্ত সামান দীন-দুঃখীকে দান করা”। আবু সাঈদ খুদরী আরও বলেছেন, “নবী করীম (সঃ) এভাবে নানা প্রকারের উল্লেখ করেছেন তাতে আমার এরূপ ধারণা জন্মেছে যে, আমাদের মধ্যে কারো কোন প্রকারের মালের দাবি থাকতে পারে না।
হযরত রসূল করীম (সঃ)- এর প্রধান সাহাবী ও ঘনিষ্ঠতম আত্মীয় হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ্ তা’আলা ধনীদের ওপর গরিবদের আবশ্যকীয় জীবিকা পরিপূর্নভাবে সরবরাহ করা ফরয করেছেন। যদি তারা (গরিবেরা) ভুখা, নগ্ন থাকে অথবা জীবিকার জন্য বিপদগ্রস্ত হয় তাহলে ধনীরা দায়িত্বশীল নয় বলেই বুঝতে হবে- এজন্য আল্লাহ্র কাছে তাদের কিয়ামতের দিন জবাবদিহি হতে হবে এবং সংকীর্ণতার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। এবং বিধ আরও হাদীস ও কুরআনের দলীলের দ্বারা মুহাদ্দিস ইবনে হাজম এ বিষয় ব্যাখ্যা করে বলেছেন-
“প্রত্যেক মহল্লার ধনীদের ওপর গরিব-দুঃখীদের জীবিকার জন্য দায়ী (জামিন) হওয়া ফরয (অবশ্য কর্তব্য) । যদি বায়তুলমালের আমদানি ঐ গরিবদের জীবিকার সরবরাহের জন্য যথেষ্ট না হয়, তাহলে শাসক বা আমীর ধনীদিগকে এ কাজের জন্য বাধ্য করতে পারেন অর্থাৎ তাদের মাল বলপূর্বক গরিবদের প্রয়োজনে খরচ করতে পারেন-তাদের জীবিকার সংস্থানের জন্য কমপক্ষে অত্যাবশ্যক প্রয়োজন অনুযায়ী ক্ষুধার অন্ন, পরিধানের বস্ত্র এবং ঝড়বৃষ্টি, গরম-রোদ ও প্লাবন থেকে রক্ষা করতে পারে এমন বাসগৃহ”।
এ রাষ্ট্রে তাহলে বিত্ত সঞ্চয় বা শোষণের কোন অবকাশই থাকতে পারে না। রাষ্ট্র ও জনসাধারণের মধ্যবর্তী কোন বিশেষ প্রাণীও রাষ্ট্রে থাকতে পারে না। ইরাক ও সিরিয়া বিজিত হওয়ার পর সাহাবীদের শত অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও হযরত উমর ফারুক (রাঃ) তাদের জায়গীর দান করেননি বরং সমস্ত ভূমি সরকারের অধীনে রেখে তার আয় সকল অধিবাসীর প্রয়োজন ও আবশ্যকাদির জন্য ওয়াকফ গণ্য করেছেন।
এমনকি, প্রয়োজনে অতিরিক্ত ভূমি যাতে কোন জোতদারের হাতে না থাকে তার জন্য হযরত বিলাল (রাঃ)-এর জায়গীর থেকেও অতিরিক্ত জমি ছিনিয়ে নিয়ে হযরত উমর ফারুক (রাঃ) চাষীদের মধ্যে বেঁটে দিয়েছেন।
কাজেই ব্যক্তি-স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে যাতে সর্ববস্থায় সমান অংশে দুনিয়ার সম্পদ মানুষ ভোগ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই মানবসমাজে সংঘ-চেতনার পথে এগিয়ে দেয়া হয়েছে।
উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা
অর্থনীতির সঙ্গে উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার গূঢ় সম্বন্ধ বর্তমান। উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যষ্টির একাধিপত্য স্বীকৃত হলে বন্টনের ব্যাপারে তার আধিপত্যের নীতি স্বীকার করে নিতে হয়। সকল যুগেই দেখা যায়, মানুষ একাকী উৎপাদনে কোনদিনই সক্ষম হয়নি । অথচ বন্টনের ব্যাপারে উৎপাদনকারী তার যথেচ্ছ স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে চায়। আধুনিক জগতে তাই দেখা দিয়েছে এক মহাদ্বন্দ্ব।
ইসলাম উৎপাদনের ব্যাপারে কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করেনি। মানুষ ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে উৎপাদন করতে পারে, তবে বন্টনের ব্যাপারে সব সময়েই তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছু সমাজের অথবা রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য ব্যয় করতে সে বাধ্য। এ নীতি ইসলামের জীবনদর্শন থেকেই পাওয়া যায়। কারণ, ইসলামী দর্শনে আসমান জমিনের সবকিছুরই মালিদ খোদ আল্লাহ্ তা’আলা। মানুষ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে যেমন উৎপাদন করবে,তেমনি তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর নিয়ামত সকল মানুষ সমান অংশে ভোগ করবে। আধুনিক জগতের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার অসামঞ্জস্য তাই ইসলামে দেখা দিতে পারে না। * (আধুনিক যুগের মত তখন শিল্প এতটা বিস্তৃত হয়নি। তবুও যাতে উৎপাদন ব্যবস্থায় সমষ্টির দায়িত্ব ও কতৃত্ব অব্যাহত থাকে তার নজিরস্বরূপ হযরত রসূলে আকরাম (সঃ)-এর এক সহীহ্ হাদীদ পাওয়া যায়। ইসলামের ইতিহাসের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁআরা জানেন, মদীনায় হিজরতের পরে মুহাজিরগণ আনসারদের কাছ থেকে আশাতিরিক্ত সাহায্য ও সহানুভূতি লাভে সমর্থ হন। আনসারদের প্রত্যেকেই তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মুহাজিরগণের সঙ্গে ভাগ করে ভোগ করতে প্রস্তুত হন। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে তাদের খেজুর গাছের ফল,উট, দুম্বা ও জমিজিরাতই বোঝাত। কোন এক আনসার রসূলে আকরাম (সঃ)-কে খেজুর গাছগুলো তাদের ও আনসারদের মধ্যে ভাগ করে নিতে অনুরোধ করলে তিনি বলেন, “আমরা যে এর উপস্বত্ব ভোগ করছি তাই যথেষ্ট এবং তোমাদের দান এ ফলের সঙ্গে তোমাদের (সহানুভূতিও) আমরা পাচ্ছি”। তারা তাঁর এ আদেশ শিরোধার্য করে। এতে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, ভ্রাতৃত্ববোধ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সমষ্টিগত উৎপাদন ব্যবস্থাই রসূলে আকরম (সঃ) প্রকৃষ্ট পন্থা বলে মনে করতেন। –Al-Hadis-BK 11 P 306-Fazlul Karim)
শাসন ও বিচার বিভাগ
অতি আধুনিক কালে শাসন বিভাগকে বিচার বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য প্রায় সকল দেশেই আন্দোলন দেখা দিয়েছে। একই ব্যক্তির হাতে শাসন ও বিচারের ক্ষমতা থাকলে তার হাতে সুবিচারের প্রত্যাশা কিছুতেই করা যায় না। কোন ব্যক্তির কোন দেশের বা জেলার শাসনকর্তার কোপে পতিত হলে সে শাসনকর্তা থেকে সে কোনমতেই সুবিচারের আশা করতে পারে না। এজন্য শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সকল দেশেই একান্ত কাম্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রেও আধুনিক শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বা বিচার ব্যবস্থার পার্থক্য বিশেষভাবেই লক্ষণীয়।
ইসলামী শাসন ও বিচারের মূল উৎস একই। এ দুনিয়ায় আল্লাহ্রই রয়েছে একমাত্র সার্বভৌমত্ব এবং তিনি তাঁর প্রেরিত পুস্তকে কুরআন উল-করীমের মাধ্যমে মানবজীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেসব নীতি নির্দেশ দিয়েছেন তারই আলোকে খলিফা শাসন পরিচালনা করেন। সে একই নীতির আলোকে খলীফা বা তাঁর প্রতিনিধিগণ বিচার করবেন। এজন্য যারা সত্যিকার মুসলিম তাদের পক্ষে একই সঙ্গে শাসন পরিচালনা ও বিচার করা সম্ভবপর। ইসলামের গৌরবের যুগে এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব হয়নি। কোনও এক জিহাদের সময় হযরত আলী এক য়াহূদীকে পর্যুদস্ত করে তার বুকের উপর সওয়ার হয়ে তার গর্দানে খঞ্জর হানতে উদ্যত হওয়াকালে, চতুর য়াহূদী তার মুখমন্ডলে থুথু ফেলে দেয়। তিনি তার এ আকস্মিক আচরণে নিতান্ত ক্রোধান্বিত হলেও তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দান করে মুক্তি দান করেন। তাঁর এ অস্বাভাবিক ব্যবহারে বিস্মিত হয়ে সে প্রশ্ন করল- “আপনি আমাকে হত্যা করেননি কেন?” তার উত্তরে হযরত আলী বলেন- “এখন যদি আমি তোমাকে হত্যা করি- তাহলে আমাকে যে তুমি অপমান করেছো- এ আক্রোশের জন্যই করবো- অথচ তোমাকে আমি আল্লাহ্র দুশমন বলেই পূর্বে হত্যা করতে চেয়েছিলাম”। তাঁর এ আচরণে অভিভূত হয়ে য়াহূদী তৎক্ষণাৎ তাঁর হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এতে বিচারের যে মহৎ দৃষ্টান্তের পরিচয় পাওয়া যায় এ দুনিয়ার ইতিহাসে তা সত্যিই বিরল।
এক্ষেত্রে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছেঃ বিচার করলে পূর্বে বিচারকের জীবনে কতকগুলো শর্ত পালনীয় হওয়া প্রয়োজন। তাকে খাঁটি মুসলিম হতে হবে। তার পক্ষে হককুল আল্লাহ্, হককুল এবাদ প্রভৃতি সম্বন্ধে পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে এবং সেসব পালন করার জন্য আল্লাহ্ যে বিধি ব্যবস্থা করেছেন- সে সম্বন্ধে তার সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সর্বোপরি বিচারকালে তাকে সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক মানস নিয়ে করতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে তার শত বিবাদ বিসম্বাদ থাক না কেন সে কোন অবস্থায়ই সে সব ব্যক্তিগত ব্যাপার দ্বারা প্রভাবান্বিত হবে না। বাস্তব জীবনে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই তা সম্ভবপর নয়। কারণ, যাদের হাতে শাসন বিভাগ রয়েছে-তারা তাদের ব্যক্তিগত আচরণের বিরোধী দলের লোকদের প্রতি প্রায়ই বিমুখ থাকেন। তারা বিচারে প্রবৃত্ত হলে তাদের ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে ন্যায়বিচার পরাঙ্মুখ হতে পারেন বলে শাসন বিভাগকে বিচার বিভাগ থেকে পৃথক করা সকল ক্ষেত্রেই বাঞ্ছনীয়।