সন্তানের উপর পিতা-মাতার হক
****************************************
হযরত মুয়াবীয়া ইবনে হায়দাতা আল-কুশাইরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিন বলিয়াছেন, আমি বলিলামঃ ইয়া রাসূল! আমার নিকট কে অধিক ভাল ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী? তিনি বলিলেনঃ তোমার মা। আমি বলিলামঃ তাহার পর কে? বলিলেনঃ তোমার মা। ইহার পর আমি বলিলামঃ তাহার পর কে? বলিলেনঃ তোমার মা। ইহার পর আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলামঃ অতঃপর কে? বলিলেনঃ অতঃপর তোমার পিতা এবং তাহার পর যে অতি নিকটবর্তী, যে তাহার পর অতি নিকটবর্তী সে।
(তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ সাধারণভাবে সমাজের সমস্ত মানুষকে পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্কের দুচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধিয়া দেওয়ার খোদায়ী বিধান পর্যায়ে এই হাদীসটি অতীব গুরুত্বপুর্ণ। এই হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে। নাসায়ী ও দারেমী গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইতে। বায়হাকী ও বগাভী নিজ নিজি গ্রন্হে (এই হাদীসটি) উদ্ধৃত করিয়াছেন হযরত আয়েশা (রা) হইত এবং তিরমিযীর গ্রন্হে অপর একটি স্থানে উদ্ধৃত হইয়াছে হযরত আবুদ দারদা (রা) হইতে। আবূ দায়ূদ গ্রন্হেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে। হাদীসটির বর্ণণা যে কত ব্যাপক ও মজবুত সনদ ভিত্তিক, তাহা এই কথা হইতে সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায়।
মূল হাদীসের প্রশ্ন হইল ***** অর্থ **** অর্থ *** ‘ভাল ব্যবহার, সঠিক আচরণ, দয়া অনুগ্রহ ইত্যাদি। পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়ের হক বা অধিকার পর্যায়ে এই শব্দটি ***** এর বিপরীত অর্থ সম্পন্ন। আর **** শব্দের অর্থঃ পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের সহিত অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার বা দুর্ব্যবহার করা এবং তাহাদের অধিাকর বিনষ্ট করা।
***** শব্দের আর একটি অর্থ হইলঃ **** ‘ছিলায়ে রেহমী’ করা। রক্ত সম্পর্ক সম্পন্ন লোকদের পরস্পরের উপর যে অধিকার ও কর্তব্য-দায়িত্ব অর্পিত হয়, তাহা পুরাপুরি যথাযথভাবে ও মাত্রায় আধায় করা এবং এই সম্পর্কে লোদের সহিত সর্বাধিক ভাল ব্যবহার করা, নম্রতা, দয়া-দাক্ষিণ্য, আন্তরিকতা ও সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার গ্রহণই এই শব্দটির মৌলিক ভাবধারা। ইহার বিপরীত শব্দ **** রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দে সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করা, তাহাদের অধিকার আদায় না করা, তাহাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন, তাহাদে সহিত দুর্ব্যবহার ও অপমানকর ব্যবহার গ্রহণ। মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর বর্ণনায় এই প্রশ্নটি তিন প্রকারের শব্দ সংযোজন ও বাক্য গঠনের মাধ্যমে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
প্রথম বর্ণনাঃ
****************************************
লোকদের মধ্যে কোন লোক আমার উত্তম ও মহত সাহচর্য-সংস্পর্শ ও সহযোগিতা পাওয়ার অধিক অধিকার সম্পন্ন?
দ্বিতীয় বর্ণনায় এই বাক্যটি এই ভাষায় বর্ণিত ও উদ্ধৃতঃ
****************************************
ইহাতে **** শব্দটি নাই।
তৃতীয় বর্ণনায় আবার এই বাক্যের ভাষা হইলঃ
****************************************
এক হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর বর্ণনাটি একমাত্র মুসলিম শরীফেই এই রূপ বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য সংগঠনে উদ্ধৃত হইয়াছে।
হাদীসটিতে উদ্ধৃত প্রশ্নের জওয়াবে একবার নয়-পর-পর তিনবার নবী করীম (স) একটি শব্দই বলিয়াছেন, তাহা হইল **** ‘তোমার মা’।
ইমাম নববী বলিয়াছেন, এই হাদীসে রক্ত সম্পর্কে দিক দিয়া আনুপাতিকভাবে সর্বাধিক নিকটবর্তী ব্যক্তির হক ও অধিকার আদায় করার জন্য অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভংগীতে তাকীদ জানানো হইয়াছে। এই দিক দিয়া- আলোচ্য হাদীস অনুযায়ী- মা-ই সর্বাধিক ও সব্যগ্রগণ্য অধীকারের মালিক ইহার কান হইল, মা-ই সন্তান গর্ভে ধারণ, প্রসব, লালন- পালন, স্নেহ-মমতা ও আদর-যত্ন দান ইত্যাদির ব্যাপারে সর্বাধিক কষ্ট ভোগ করিয়া থাকে। মা সন্তানকে যতটা স্নেহ যত্ন ও মায়অ মমতা দেয় এবং যতবেশী খেদমত করে উহার সহিত অন্য কাহারও অবদানের কোন তুলনা হইতে পারে না। বস্তুত মা-ই যদি সন্তান গর্ভধারণ করিতে ও প্রসবের প্রাণান্তকর যন্ত্রণা সহ্য করিতে ও আদর যত্ন সহারে শিশুকে লালন পালন করিতে প্রস্তুত না হইতেন- বরং তাহা করিতে অস্বীকার করিতেন, তাহা হইলে এই দুনিয়ায় মানব বংশের রক্ষা পাওয়া ও লালিত পালিত হইয়া বড় হওয়া পরিণামে মানবংশের বিস্তার লাভ করা কখনই সম্ভবপর হইত না।
মা’র এই দুইটি বিরাট ও তুলনাহীন-দৃষ্টান্তহীন অবদানের কথা স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাও উদাত্ত ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেন। বলিয়াছেনঃ
****************************************
মা সন্তানকে অতিশয় কষ্ট সহকারে গর্ভে দারণ ও বহন করিয়াছে। তাহাকে প্রসব করিয়াছন প্রাণান্তকর কষ্ট সহকারে। এই গর্ভে ধারণ ও দুগ্ধ সেবন করানোর ত্রিশটি মাস অতিবাহিত হইয়াছে।
অপর এক আয়াতে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তাহার মা তাহাকে বহন করিয়াছে দুর্বলতার উপর দুর্বলতা সহ্য করিয়া।
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে পিতামাতার প্রতি ভাল ব্যবহারের কথা বলা প্রসঙ্গে মার কথাই বলা হইয়াছে সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে।
রাসূলে করীম (স) তিন তিন বারের প্রশ্নের জওয়াবে কেবল মার অধিকারের কথাই বলিয়াছেন। ইহার কাণ হইল, তিনটি কাজ কেবল মাত্র মার-ই অবদান। তাহা হইল, গর্ভধারণের কষ্ট, প্রসব যন্ত্রণা ভোগের কষ্ট এবং দুগ্ধ সেবন করানো- লালন-পালন করার কষ্ট। এই তিনওটি অত্যন্ত দুঃসহ ও প্রাণান্তর কষ্ট। কাজে যে কষ্ট মাকে ভোগ করিতে হয়, তাহা কোন ভাষা দিয়া প্রকাশ বা বর্ণণা করা সম্ভব নয় এবং এই তিনওটি বড় বড় কষ্ট কেবল মাকেই ভোগ করিতে হয়। এই কষ্ট ভোগে তাহার সহিত অন্য কেহ শরীক থাকেনা।
কিন্তু কেবল মার অধিকারের কথা বলিয়াই হাদীসটি শেষ করা হয় নাই। ইহার পর আরও দুইটি অধিকারের কথা বলা হইয়াছে। তাহা হইল মার পরে পরেই সর্বাধিক অধিকার হইতেছে পিতার। কেননা মা’র উপরোক্ত তিনওটি কাজ তিনও পর্যায়ের কষ্ট স্বীকার সম্ভব হয় পিতার বাস্তব সাহায্য সহযোগিতা ও আনুকূল্যের ফলে। এই ক্ষেত্রে পিতার অবদান কোন অংশে কম নয়। কেননা মা’র পক্ষে উক্ত কাজ সমূহের কোন একটি কাজও পিতা ছাড়া সম্ভত নয়। পিতা না হইলে মা’র গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও লালন-পালন, দুগ্ধ সেবন করানোর কোন প্রশ্ন উঠিতে পারে না। তাই আল্লাহ তাৱআলা মা’র বিশেষ অবদানের কথা স্বতন্ত্র গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করিলেও কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে সন্তানের প্রতি পিতা মাতার অধিকার ও পিতা মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য একটি শব্দে ও একই সঙ্গে বলিয়াছেন।
সূরা বনী ইসরাঈলে আল্লাহর বন্দেগী করার চূড়ান্ত ফরমান দেওয়ার পরই বলিয়াছেন পিতা-মাতার প্রতি ‘ইহসান’ করার কথা।
****************************************
তোমার রব ফরমান জারী করিয়াছেন যে, তোমরা কেবল মাত্র তাঁহারই বন্দেগী করিবে- তাঁহাকে ছাড়া আর কাহারও দাসত্ব করিবে না এবং পিতা-মাতার সহিত খুবই উত্তম ব্যবহার ও আচরণ অবলম্বন করিবে।
সূরা লূক্কমানএ আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে ও ভাষায় বলিয়াছেনঃ
****************************************
মানুষকে তাহার পিতা-মাতার ব্যাপারে শক্ত বিধান পালনের নির্দেশ দিয়াছি। অতএব তুমি শোকর করিবে আমার এবং তোমার পিতা-মাতার, শেষ পরিণতি তো আমার নিকটই হইবে।
এই আয়াতেও প্রথমে আল্লাহর শোকর আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হইয়ছে এবং ইহার পরই এক সঙ্গেই পিতা-মাতার শোকর আদায় করিতে বলা হইয়াছে। ইহাই আল্লাহ তা’আলার চূড়ান্ত ফরমান। কিন্তু এতদ্বসত্বেও মা’র অধিকার পিতার তুলনায় অধিক হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত থাকিতে পারে না। হারেস আল-মুহাসিবী বলিয়াছেনঃ
****************************************
পিতার তুলানয় মা’র ভাল ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী হওয়া সম্পর্কে সমস্ত শরীয়াতবিদ সম্পূর্ণ একমত। তেব কেহ কেহ দুইজনার অধিকার সমান বলিয়াছেন। কিন্তু আলোচ্য হাদীসের দৃষ্টিতে তাহা ঠিক নয়।
কিন্তু ব্যক্তির উপর কেবল পিতা-মাতারই হক থাকে না, হক থাকে অন্যান্য নিকটাত্মীয়দেরও। এই পর্যায়ে অধিকার আদায় ও কর্তব্য পালনে একটি মলূনীতি ও ফর্মূলা স্বয়ং নবী করীম (স) বলিয়াছেন। তাহা হইল ******* রক্ত সম্পর্কে যে প্রথম নিকটাবর্তী সে এই দিক দিয়াও নিকটবর্তী, যে তাহার পর নিকটবর্তি, সে এই দিক দিয়া অতঃপর নিকটবর্তী। এইভাবে সমাজের সমস্ত মানুষকে পরস্পরের সাথে আত্মীয়তা এবং অধিকার আদায় ও কর্তব্য পালনের বন্ধনে বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে। যে সমাজে এই সম্পর্ক পুরাপুরি রক্ষিত হয় এবং অধিকার আদায় ও কর্তব্য পালন যথাযথভাবে পালন করা হয়, সে সমাজ যে শান্তি ও সুখের সমাজ হইবে এবং এই সমাজের মানুষও যে সর্বাধিক সুখী মানুষ হইবে, তাহাতে কি একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ আছে?
বস্তুত ইসলামের পুর্ণাঙ্গ বিধানের মানসিকতা ও সর্বাধিক কল্যাণকরতার বৈশিষ্ট্য এই দৃষি।টতেই বিচার্য।
(***************)
পিতা-মাতার সন্তুষ্টি
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি হযরত নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেনঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি জন্মদাতার সন্তুষ্টিতে নিহিত এবং আল্লাহর ক্রোধ ও রোষ জন্মদাতার রোষ-অসন্তুষ্টিতে নিহিত।
(তিরমিযী, ইবনে হাব্বান, হাকেম)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির বক্তব্য সুস্পষ্ট। পিতা সন্তুষ্ট হইলে আল্লাহও সন্তুষ্ট হন এবং পিতা অসন্তুষ্ট হইলে আল্লাহও অসন্তুষ্ট হন, ইহাই হাদীসটির কথা ও ঘোষণা।
হাদীসের শব্দ ***** অর্থা সাধারণতঃ পিতা। এই হাদীসে শুধু পিতার কথা বলা হইয়াছে, অথচ মা’র অধিকার সর্বাগ্রগণ্য, ইহা কিরূপ কথা?
ইহার জওয়াবে বলা যায়, এই হাদীসটিতে যদি শুধু পিতার কথাই বলা হইয়া থাকে এবং মার কথা নাও বলা হইয়া থাকে, তবুও তাহাতে কোন দোষ নাই। কেননা পিতার মর্যাদা সন্তানের নিকট যদি এতটা নাজুক হইয়া থাকে, তাহা হইলে মা’র মর্যাদা সন্তানের নিকট ইহা হইতেও অনেক গুণ- অতন্তঃ তিনগুণ-বেশী হইবে, তাহা তো এই হাদীস হইতেই বুঝা যায়।
কিন্তু মুল কথায় রাসূলে করীম (স) শুধু পিতার কথা বলিয়াছেন এমন মনে হয় না। বরং তিনি পিতা-মাতার উভয়ের কথাই বলিয়াছেন, এই কথা বিশ্বাস করার অনেক কারণ আছে। বিশেষ করিয়া এই হাদীসটিরই যে বর্ণনা তাবারানী উদ্ধৃত করিয়াছেন তাহাতে পিতা-মাতা উভয়ের কথাই আছে। উহার ভাষা এইঃ
****************************************
আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতা-মাতা দুইজনের সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর রোষ-অসন্তষ্টি পিতা-মাতা উভয়ের অসন্তুষ্টিতে নিহিত।
কিন্তু কেন এই কথা? আল্লাহর সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টির সহিত পিতা মাতার সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টির এই গভীর সম্পর্ক এবং প্রথমটির দ্বিতীয়টির উপর এই নির্ভরশীলতার মুল কারণ কি?
ইহার কারণ হইল, আল্লাহ তা’আলার আদেশ নিষেধ পালন করিলে যে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন এবং তাঁহাকে অমান্য-অগ্রাহ্য করিলে যে তিনি অসন্তুষ্ট ও ক্রদ্ধ হন ইহা তো সকলেরই জানা কথা। আর ইহাই যদি জানা কথা হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই কথাটুকুও জানিয়া রাখা উচিত যে, স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই পিতা-মাতার হক আদায় করিতে ও সম্মান শ্রদ্ধা ভক্তি করিতে আদেশ দিয়াছেন। এমতাবস্থায় যে লোক পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালন করিবে-ইহা আল্লাহর আদেশ মনে করিয়া, সে ঠিক আল্লাহরই আদেশ পালন করিল এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ সৃষ্টি করিল। পক্ষান্তরে যদি কেহ পিতা-মাতার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শণ করিল- আল্লাহর নিষেধ থাকা সত্ত্বেও সে কেবল পিতা-মাতারই অপমান করিল না, সে আল্লাহরও অমান্য করিল। কাজেই সে অবস্থায় যে আল্লাহর রোষ-অসন্তুষ্টি বর্ষিত হইবে, তাহা কে রোধ করিবে?…. কাজেই রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটিতে একটি কঠোর কঠিন সতর্কবাণী- অশুভ অকল্যাণের ঘোষণা- উচ্চারিত হইয়াছে। ইহাপেক্ষা কঠোর কঠিন বাণী আর কিছুই হইতে পারে না্
হযরত আবুদ দারদা (রা) বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
পিতা (এবং মাতাও) জান্নাতের দরজা সমূহের মাধ্যম।
মুসনাদে আহমাদের একটি বর্ণনায় ****** এর পরিবর্তে **** শব্দটি বলা হইয়াছে। অর্থাৎ জান্নাতে যাওয়ার এবং উহাতে উচ্চতর মর্যাদা লাভ করার সর্বোত্তম অসীলা ও উপায় হইতেছে পিতা-মাতা। কেহ কেহ বলিয়াছেন, জান্নাতের বহু কয়টি দরজা পথ আছে। প্রবেশ করার জন্য উহাদের মধ্যে সর্বোত্তম দ্বার-পথ হইল মধ্যবর্তী দরজা। আর এই মধ্যবর্তী দ্বারপথে প্রবেশ লাভের প্রধান উপায় হইল পিতা-মাতার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা। এই কারণে পিতা-মাতার অধিকার হরণ ও তাহাদের সহিত সম্পর্কচ্ছেদ করা ও তাহাদের প্রতি অমর্যাদা দেখানো- রাসূলে করীম (স)-এর ঘোষণা মতে-কবীরা গুনাহ। রাসূলে করীম (স) সাহাবীদের লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ
****************************************
পিতা (এবং মতও) জান্নাতের দরজা সমূহের মাধ্যম।
মুসনাদে আহমাদের একটি বর্ণনায় ***** এর পরিবর্তে ***** শব্দটি বলা হইয়াছে। অর্থাৎ জান্নাতে যাওয়অর এবং উহাতে উচ্চতর মর্যাদা লাভ করার সর্বোত্তম অসীলা ও উপায় হইতেছে পিতা-মাতা। কেহ কেহ বলিয়াছেন, জান্নাতের বহু কয়টি দরজা পথ আছে। প্রবেশ করার জন্য উহাদের মধ্যে সর্বোত্তম দ্বার-পথ হইল মধ্যবর্তী দরজা। আর এই মধ্যবর্তী দ্বারপথে প্রবেশ লাভের প্রধান উপায় হইল পিতা-মাতার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা। এই কারনে পিতা-মাতার অধিকার হরণ ও তাহাদের সহিত সম্পর্কচ্ছেদ করা ও তাহাদের প্রতি অমর্যাদা দেখানো- রাসূলে করীম (স)-এর ঘোষণা হতে- কবীরা গুনাহ। রাসূলে করীম (স) সাহাবীদের লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ
****************************************
কবীরা গুনাহ সমূহের মর্ধে অধিক বড় গুনাহ কোনটি তাহা কি আমি তোমাদিগকে বলিব? সাহাবীদগণ বলিলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই আমাদিগকে বলুন। অতঃপর তিনি বলিলেনঃ তাহা হইলঃ আল্লাহর সহিত শিরক করা এবং পিতা-মাতার সহিত সম্পর্কচ্ছেদ, অধিকার অনাদায় ও দুর্ব্যবহার করা।
******** ইসলামী বিধানের একটা বিশেষ পরিভাষা। ইহার অর্থঃ সন্তানের এমন সব কাজ করা বা কথা বলা কিংবা আচরণ গ্রহণ করা, যাহার ফলে পিতা-মাতার মনে ও দেহে কোন রূপ কষ্ট পায়।
****** ইসলামী বিধানের একটা বিশেষ পরিভাষা। ইহার অর্থঃ সন্তানের এমন সব কাজ করা বা কথা বলা কিংবা আচরণ গ্রহণ করা, যাহার ফলে পিতা-মাতা মনে ও দেহে কোন রূপ কষ্ট পায়।
হযরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা মা (সেই সঙ্গে পিতা)র সহিত সম্পর্কচ্ছেদ ও দুর্ব্যবহাররের অপরাধ করাহে হারাম করিয়া দিয়াছেন।
(বুখারী, মুসলিম)
পিতা-মাতার সহিত দুর্ব্যবহার, সম্পর্কচ্ছেদ ও অধিকার আদায় না করার আচরণের পরিণতি সম্পর্কে হাদীসে আরও কঠোর বাণী উচ্চারিত হইয়াছে। হযরত আবূ বাকরাতা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ সমস্ত গুনাহ-ই এমন যে, তাহা হইতে আল্লাহ যাহা এবং যতটা ইচ্ছা মাফ করিয়া দিবেন। কিন্তু পিতা-মাতার সহিত সম্পর্কচ্ছেদ করণ, দুর্ব্যবহার করা, অধিকার আদায় না করার গুনাহ তিনি মাফ করিবেন না। বরং যে লোক এই গুনাহ করে তাহার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পূর্বেই তাহার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন।
(মিশকাত)
এই পর্যায়ে কুরআন মজীদে নিম্নোদ্ধৃত আয়াতটি অবশ্যই স্মার্তব্য; আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
তুমি তাহাদের (পিতা-মাতার) জন্য উহ বলিও না। তাহাদের দুই জনকে ভৎসনা করিও না। তাহাদের দুইজনের জন্য সর্বদা দয়ার্দ্র হৃদয়ে বিনয়ের হস্ত অবনত করিয়া রাখ এবং বলঃ হে রব! এই দইজনের প্রতি রহমত বর্ষণ কর, যেমন তাহারা দুইজন আমাকে বাল্যবস্থায় লালন পালন করিয়াছেন।
আল্লাম কুরতুবী এই আয়াতটির তাফসীরে এই পর্যায়ের কতিপয় হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। একটি হাদীসে হযরত আবদুল্লাহ (রা) রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
****************************************
মহান আল্লাহ তা’আলার নিকট বান্দাহর কোন কাজ অধিক প্রিয়, পছন্দনীয়”
নবী করীম (স) বলিলেনঃ ************* সময় মত ফরয নামায আদায় করা। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ইহার পর কোন টি? নবী করীম (স) বলিলেনঃ ******* অতঃপর পিতা মাতার সহিত ভাল-সম্ভ্রমপূর্ণ আচার আচরণ অবলম্বন।
এই হাদীসে নবী করীম (স) বলিয়াছেন, ইসলামের সর্বাধিকক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ নামাযের পরই পিতা-মাতার সহিত সদ্ব্যবহার করার গুরুত্ব।
পরিভাষা হিসাবে ******** এরই বিপরীত অর্থজ্ঞাপক শব্দ হইল ******- হাদীস অনুযায়ী পিতা-মাতাকে গালাগাল করা ***** এর অন্তর্ভুক্ত এবং অন্যতম কবীরা গুনাহ। একজন সাহাবী বলিলেন ****** ইয়া রাসূল! পিতা-মাতাকেও কি কোন লোক গালাগাল করে? তিনি জওয়াবে বলিলেনঃ ************ হ্যাঁ, একজন লোক অপর এক লোকের পিতাকে গাল দেয়, তখন সে-ও তাহার পিতাকে গাল দেয়, একজন অপর জনের মা’কে গাল দেয়, সেও তাহার মা’কে গাল দেয়। আর এই ভাবেই একজন তাহার নিজের পিতা-মাতাকে গালাগাল করে।
পিতা-মাতার বৈধ ইচ্ছা-বাসনার বিরুদ্দতা করা *******- এর মধ্যে গণ্য। যেমন তাহা পূরণ করা ও পিতা-মাতার কথা মত কাজ করা ******* মধ্যে গণ্য।
আলোচ্য হাদীস সমূহ এবং এই পর্যায়ের আরও বহু হাদীস উপরোক্ত আয়াতটিরই ব্যাখ্যা মাত্র। উক্ত আয়াতের ভিত্তিতেই নবী করীম (স) এই সব কথা ইরশাদ করিয়াছেন। অতএব কুরআন ও হাদীস যে পরস্পর সম্পৃক্ত, ওতোপ্রোত জড়িত তাহাতে একবিন্দু সন্দেহ থাকে না।
(***************)
পিতা-মাতার খেদমত জিহাদ অপেক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর নিকট এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহার নিকট জিহাদে যোগদান করার অনুমতি চাহিল। নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমার পিতা-মাতা জীবিত আছে কি? লোকটি বলিল, জ্বি হ্যাঁ, তাহারা দুই জনই জীবিত আছেন। তখন নবী করীম (স) বলিলেন, তাহা হইলে সেই দুইজনের খেদমতে জিহাদ করার কাজে নিযুক্ত থাক।
(বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ ‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ কোন উদ্দেশ্যের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়া চরম প্রচেষ্টা চালানো। দ্বীন-ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়া চালানো হয়,ইসলামী পরিভাষায় তাহাকেই জিহাদ বলা হয়। ফিকাহর ফয়সালা অনুযায়ী জিহাদের কাজ মুসলমানদের জন্য ফরয হইলেও এই কাজে অন্যান্য বহু লোক নিয়োজিত থাকিলে তখন অন্যান্য মুসলমানদের জন্য উহা ‘ফরযে কেফায়া’ পর্যায়ের হইয়া যায়। এই সময় কাহারও পিতা-মাতা যদি বৃদ্ধ অক্ষম হয়, তাহা হইলে বিশেষ করিয়া এই অবস্থায় পিতা-মাতার খেদমত করা সন্তান বিশেষ করিয়া পুত্র সন্তানের উপর ‘ফরযে আইন’ হইয়া যায়। রাসূলে করীম (স)-এর নিকট লোকটি জিহাদে যোগদানের অনুমতি চাহিলে জিজ্ঞাসা করিয়া যখন তিনি জানিতে পারিলেন যে, লোকটির পিতা-মাতা জীবিত তখন হয়ত তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, এই লোকটির জিহাদে যোগদান অপেক্ষা বৃদ্ধ-অক্ষম ও সন্তানের খেদমতের মুখাপেক্ষী পিতা-মাতার খেদমতে নিযুক্ত থাকা-ই উত্তম এবং জরুরী। তাই তিনি তাহাকে নির্দেশ দিলেনঃ ********** তোমার পিতা-মাতার খেদমতেই তুমি জিহাদ কর- সর্বাত্মক চেষ্টা চালাইয়া যাও। অর্থাৎ জিহাদের তুলনায় পিতা-মাতার খেদমতে লাগিয়া থাক-ই তোমার অধিক কর্তব্য। বস্তুত ইহা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। নবী করীম (স) জিহাদে লোক নিয়োগ কালে প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত অবস্থা পর্যালোচনা করিয়া কাহার জিহাদে যাওয়া উচিত, কাহার ঘরে থাকিয়া পি তা-মাতার খেদমত করিয়া যাওয়া উচিত এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা গ্রহণ করিতেন। সেই অসংখ্য ঘটনাবলীর মধ্যে ইহাও একটি। বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইতে এই হাদীসটি এ ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-কে বলিলেনঃ আমি জিহাদ করিব। রাসূলে করীম (স) তাহাকে জিজ্ঞাসু হইয়া বলিলেনঃ তোমার পিতা-মাতা আছে? লোকটি বলিলেন হ্যাঁ। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ ‘তাহা হইলে তুমি সেই দুইজনের খেদমতে নিয়োজিত থাকিয়া জিহাদ কর।
তাবারানী উদ্ধৃত একটি হাদীসের ভাষা এইরূপঃ
****************************************
এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল এবং বলিলঃ আমি আল্লাহর পথে জিহাদ যুদ্ধ করিতে ইচ্ছুক। রাসূলে করীম (স) তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমার মা কি জীবিত? লোকটি বলিলেন, হ্যাঁ, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তাহার পায়ে লাগিয়া থাক। সেখানেই জান্নাত অবস্থিত।
পায়ে লাগিয়া থাকা অর্থ, তাহার খেদমতে স্থায়ীভাবে নিয়োজিত থাক।
অপর একটি বর্ণনায় আলোচ্য হাদীসটির ভাষা এইরূপঃ
****************************************
একটি লোক রাসূলে করীম (স)-এর দিকে অগ্রসর হইয়া গিয়া বলিলঃ আমি আপনার নিকট হিজরত ও জিহাদের ‘বয়আত’ করিতেছি। ইহা করিয়া আমি আল্লাহ তা’আলার নিকট হইতে শুভ পূণ্যফল পাইতে চাহি। বলিলেনঃ অতঃপর তুমি তোমার পিতা-মাতার নিকট ফিরিয়া যাও এবং পরে তাহাদের দুইজনের উত্তম সাহচর্য অবলম্বন কর।
কিন্তু মুসনাদে আহমাদ গ্রন্হে এই হাদীসটি যে ভাষা উদ্ধৃত হইয়াছে তাহাতে এই পর্যায়ে সমস্ত কথা স্পষ্ট হইয়া যায়। হাদীসটি এইঃ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বলেনঃ
****************************************
‘একটি লোক’ নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত ইলেন, অতঃপর বলিলেনঃ আমি আপনার নিকট বায়আত করিবার উদ্দেশ্যে আসিয়াছি। আমি আমার পিতা-মাতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রাখিয়া আসিয়াছি। এই কথা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তাহাদের নিকট ফিরিয়া যাও এবং তুমি তাহাদিগকে যেমন কাঁদাইয়াছ, তেমনি গিয়া হাসাও। আর তিনি তাহাকে বায়আত করিতে অস্বীকার করিলেন।
লোকটি কিসের বায়আত করিতে আসিয়াছিল, উপরোক্ত বর্ণনার ভাষায় তাহার উল্লেখ নাই। তবে আবূ দায়ূদ ও মুসনাদে আহমাদের অপর এক বর্ণনায় ***** শব্দটির উল্লেখ হইয়াছে। আর এই হিজরাতও যে জিহাদেরই উদ্দেশ্যে তাহা সহেজই বুঝিতে পারা যায়। ইমা খাত্তাবী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ
****************************************
জিহাদের উদ্দেশ্যে যে লোক ঘর-বাড়ি ও আত্মীয়-স্বজন ছাড়িয়া বাহির হইয়া দূরে চলিয়া যায়, তাহা যদি তাহার জন্য নফল পর্যায়েল হইয়া থাকে, তাহা হইলে পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত ইহা জায়েয হইবে না। কিন্তু এই জিহাদ যদি ফরযে আইন করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে উহাতে যাওয়ার জন্য পিতা-মাতার অনুমতির অপেক্ষা রাখার প্রয়োজন হইবে না।
(**************)
এই সব হাদীসের ভাষা ও বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন হইলেও মূল কথা ও প্রতিপাদ্য এক ও অভিন্ন। আর তাহা হইল, পিতা-মাতার খেদমতে নিযুক্ত থকার বিরাট ফযীলত- মর্যাদা, গুরুত্ব ও সওয়াব আল্লাহ ও রাসূল কর্তৃক স্বীকৃত এবং উচ্চস্বরে বিঘোষিত। উপরন্তু অবস্থা বিশে ষ ইহা জিহাদের তুলানায়ও অধীক গুরুত্বপুর্ণ ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। বিশেষজ্ঞগণ এই সব হাদীসের ভিত্তিতেই বালিয়াছেন, পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত জিহাদে যোগদান করা জায়েয নয়, অবশ্য যদি সে পিতা মাতা মুসলিম ইসলামী মতানুসারী হয়। অন্যথায় এই কাজের অনুমতি লওয়ার শর্ত নাই। ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য ফিকাহবিদরা এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। তবে ইহাও সেই সময়ের কথা, যখন জিহাদে শরীফ হওয়ার জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে সাধারণ নির্দেশ দেওয়া ও সেজন্য আহবান জানানো হয় নাই। যদি সে রূপ আহবান জানানো হয় ও নির্দেশ দেওয়া হয় তাহা হইলে তাহাদের অনুমতি ব্যতিরেকেই জিহাদে যোগদান করিতে হইবে।
(****************)
সিলায়ে রেহমীর গুরুত্ব
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। এই কাজ হইতে যখন অবসর পাইলেন, তখন রিহম দাঁড়াইয়া গেল। বলিলঃ ইহা বিচ্ছিন্নতা ও কর্তন হইতে পানাহ চাওয়ার স্থান। আল্লাহ তা’আলা বলিলেনঃ হ্যাঁ, তুমি কি সন্তুষ্ট হইবে না এই অবস্থায় যে, আমি সম্পর্ক রাখিব সেই ব্যক্তির সহিত যে তোমাকে রক্ষা করবে এবং আমি সম্পর্ক কর্তন করিব সেই ব্যক্তির সহিত যে তোমাকে কর্তন করিবে? রিহম বলিলঃ হ্যাঁ, অবশ্যই। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিলেনঃ তোমার জন্য ইহাই করা হইবে। এই কথা বলার পর রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তোমরা ইচ্ছা করিলে কুরআনের (সূরা মুহাম্মদ ২২-২৪ দ্রষ্টব্য) এই আয়াত পাঠ কর। এখানে তোমাদের হইতে ইহাপেক্ষা আরও কিছুর আমার করার যায় কি যে, তোমরা যদি উল্টা মুখে ফিরিয়া যাও তাহা হইলে পৃথিবীতে আবার তোমরা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করিবে এবং রিহামকে কাটিয়া ছিন্ন ভিন্ন করিবে?… ইহারা সেই লোক, যাহাদের উপর আল্লাহ তা’আলা অভিশাপ বর্ষণ করিয়াছেন। অতঃপর তাহাদিগকে তিনি বধির করিয়া দিয়াছেন এবং তাহাদের চক্ষুকে অন্ধ করিয়া দিয়াছেন। এই লোকেরা কি কুরআন মজীদ চিন্তা- গবেষণা করে নাই, কিংবা দিল সমূহের উপর উহার তালা পড়িয়া গিয়াছে?
(মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ রেহম- ‘রক্ত সম্পর্কের আত্ময়তা’ রক্ষা সম্পর্কে ইহা একটি অতিশয় মহিমান্বিত বিরাট গুরুত্ব সম্পন্ন হাদীস। এই হাদীসে ‘রেহম’কে শরীরী ও দেহসত্তা সম্পন্নরূপে পেশ করা হইয়াছে। কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, ‘রেহম’- যাহা রক্ষা করা হয় কিংবা ছিন্ন ও কর্তন করা হয়-একটি অশরীরী বিষয়, ইহার কোন দেহ-সত্তা নাই। ইহা বলিতে বুঝায়, সম্পর্ক ও বংশীয় আত্মীয়তার নৈকট্য। ইহার সূচনা হয় মা’র ‘রেহেম- গর্ভাধার হইতে। সম্পর্কের ইহা কেন্দ্র স্থল। এই দিক দিয়া যে সব লোকের পরস্পরে মধ্যে সম্পর্ক আছে, সেই সম্পর্ক যথাযথ রক্ষা করা ও উহার হক ও অধিকার গুরুত্ব সহকারে আদায় করিতে থাকাই হইল ‘সিলায়ে রেহমী’ রক্ষা করা।
এই অশরীরী ও বিদ্রোহী সত্তা সম্পর্কে ‘দাঁড়ানো ও কথা বলা’র কথা অবান্তর- অকল্পনীয়। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও অত্র হাদীসে এবং ইহার ন্যায় আরও বহু কয়টি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ রেহেম দাঁড়াইল, কথা বলিল। মূলত ইহা রূপক পর্যায়ের কথা। আরবী ভাষায় ইহার ব্যাপক প্রচলন প্রাচীনকাল হইতে একাল পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে। এখানে এইরূপ বলার উদ্দেশ্যে, উহার মাহাত্ম্য, বিরাটত্ব ও অতিশয় গুরুত্ব বুঝানো মাত্র। যে ইহার হক আদায় করে তাহার বিশেষ মর্যাদা এবং যে ইহা কর্তন ও ছেদন করে তাহার বিরাট গুনাহ ও পাপের কথা বুঝাইত চাওয়া হইয়াছে এইরূপ বলিয়া। ‘রেহম সম্পর্ক ছেদন’ করাকেই বলা হয় **** কিংবা *****। প্রথমটি এক বচন, দ্বিতীয়টি বহু বচন। ইহার অর্থঃ ***** দীর্ণ করা, ছেদন করা। যে ইহা করে সে রেহম সম্পর্কে জড়িত। মানুষগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘সিলায়ে রেহমী’ না করিয়া ‘কেতে রেহমী’ করিল (অর্থাৎ রক্ত সম্পর্কের দাবি পুরণ করিল না।)
‘রেহম দাঁড়াইল ও বলিল’ এই কথাটির এ তাৎপর্যও গ্রহণ করা যাইতে পারে যে, একজন ফেরেশতা দাঁড়াইয়া গেলেন ও আল্লাহর আরশ ধরিয়া রেহম সম্পর্কের হক আদায় করা সম্পর্কে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করিলেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা জওয়াবে সেই সব কথা বলিলেন, যাহা মূল হাদীসে উদ্ধৃত হইয়াছে। ***** শব্দটির অর্থ ও তাৎর্য হইল ***** ‘নম্রতা, দয়া, অনুগ্রহ আর আল্লাহর **** করার অর্থঃ দয় করা অনুগ্রহ করা সেই লোকের প্রতি, যে রেহেম সম্পর্ক রক্ষা করে ও উহার হক আদায় করে। তিনি তাহার প্রতি নানা ভাবে অনুগ্রহ দেন, নিয়ামত দান করেন। সেই সঙ্গে আল্লাহর উচ্চতর মালাকুতী জগতের সহিত তাহার গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার কথাও ইহাতেই নিহিত আছে। আল্লাহর গভীর পরিচয় লাভ এবং আল্লাহর আনুগত্য করা এই লোকের পক্ষেই সম্ভব। ইহাও এই তাৎপর্যের অংশ।
কাযী ইয়ায ইহাও বলিয়াছেন যে, ‘সিলায়ে রেহমী’ করা ওয়াজিব এবং ইহা ছিনন করা কবীরা গুনাহ। এই পর্যায়ে শরীয়াত অভিজ্হ সমস্ত মনীষী সম্পূর্ণ একমত। এ বিষয়ে যত হাদীস বর্ণিত হইয়াছে তাহা সবই একবাক্যে এই কথাই বলে। তবে ‘সিলায়ে রেহমী’র বিভিন্ন পর্যায় আছে এবং এক একটি পর্যায়ের গুরুত্ব ও মর্যাদা ভিন্ন ভিন্ন। একটি অপরটির তুলনায় উচ্চতর ও অধিক গুরুত্বশীল। ইহার প্রাথমিক ও নিম্নতম পর্যায়ে সম্পর্ক ছিন্ন করা হইতে বিরত থাকা, অন্ততঃ পরস্পরে কথা-বার্তা ও সালাম-কালাম জারী রাখা। শক্তি-ক্ষমতা ও প্রয়োজনের বিচারেও ইহার গুরুত্ব বিভিন্ন হইয়া দাঁড়ায়। কখনও ইহা রক্ষা করা ওয়াজিব হয়, কখনও মুস্তাহাব। তবে ইহার কিছুটা পরিমাণও রক্ষা করা হইলে এবং প্রয়োজন পরিমাণ রক্ষা করিতে অক্ষম হইলে ‘সিলায়ে রেহমী’ কর্তন করিয়াছে এমন বলা যাইবে না। তবে সে তাহা রক্ষা করিয়াছে, এইরূপ বলারও কারণ নাই।
সিলায়ে রেহমী- যা রক্ষা করা ওয়াজিব- তাহার সীমা কতটা বিস্তীর্ণ, এ বিষয়ে বিভিন্ন কথা বলা হইয়াছে। কেহ কেহ বলিয়াছেন, রেহম সম্পর্কের দিক দিয়া যত লোকের পারস্পরিক বিবাহ হারাম, সেই সবের মধ্যে সিলায়ে রেহমী রক্ষা করা ওয়াজিব। অতএব চাচাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই-ভগ্নি এই পর্যায়ে নয়। একজন মেয়ে লোক এবং তাহার ফুফি বা খালাকে একত্রে একজনের স্ত্রীরূপে গ্রহণ জায়েয না হওয়ার অন্যতম দলীল হইতেছে এই হাদীস।
কাহারও কাহারও মতে মীরাসী আইনে ‘যবীল-আরহাম’ বলিতে যত লোককে বুঝানো হইয়াছে, এই পর্যায়ে তাহারা সকলেই গণ্য।
নবী করীম (স) এই পর্যায়ে কুরআন মজীদের যে আয়াতটি দলীল রূপে উল্লেখ করিয়াছেন উহা সূরা মুহাম্মদ-এর ২২, ২৩ ও ২৪ আয়াত। এই আয়াতে কেতে রেহেমী করাকে হারাম করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কুরআন মজীদের আরও বহু কয়টি আয়াতে ইতিবাচকভাবে সিলায়ে রেহমী করার- আত্মীয়-স্বজনের সহিত ভাল ব্যবহার করার ও তাহাদের হক আদায় করার স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে ও উহার বড় সওয়াবের কথা বলা হইয়াছে। নবী করীম (স) কথা প্রসঙ্গে এই আয়াত পাঠ করিয়া বুঝাইয়াছেন যে, তিনি রেহেম সম্পর্কে যাহা বলিয়াছেন, তাহা তাঁহার নিজের কথা নয়। ইহা কুরআনের- আল্লাহর কথা। কুরআন চিন্তু গবেষণা করিলেই এই সব কথা জানা যায়। বস্তুত হাদীস যে এক হিসাবে কুরআনের ‘তাফসীর এবং হাদীস না পড়িলে কুরআনের সঠিক মর্ম বুঝা যায় না, উপরন্তু হাদীস যে কোন ভিত্তিহীন জিনিস নয়, উহা কুরআন হইতেই উৎসারিত, এই হাদীস হইতে তাহা অকাট্যভাবে বুঝিতে পারা যায়।
(**********)
মৃত পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য
****************************************
হযরত আবূ আসীদ মালিক ইবনে রবীয়াতা আস-সায়দী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট বসা ছিলাম, এই সময় আনসার বংশের একজন লোক আসিয়া উপস্থিত হইল। অতঃপর বলিলঃ ইয়া রাসূল! আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাহাদের সহিত সিলায়ে রেহমীও ভাল ব্যবহার করার এমন আর কোন কাজ অবশিষ্ট থাকিয়া গিয়াছে কি যাহা আমি করিতে পারি? রাসূলে করীম (স) জবাবে বলিলেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই করার মত কাজ আছে এবং তাহা মোটামুটি চারটি ভাগের কাজ। তাহা হইলঃ তাহাদের দুইজনের জন্য পরিপূর্ণ রহমতের জন্য দোয়া করিতে থাকা ও তাহাদের জন্য আল্লাহর নিকট মাগফিরাত চাওয়া, তাহাদের দুইজনের ওয়াদা প্রতিশ্রুতি পূরণ ও কার্যকর করা, তাহাদের দুইজনের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সেই রেহম সম্পর্ক রক্ষা করিয়া চলা যাহা তাহাদের দুইজনের সম্পর্কের দিক ছাড়া অন্য কোন দিক দিয়া তোমার উপর বর্তায় না।…. তাহাদের দুইজনের মৃত্যুর পর তাহাদের জন্য করনীয় শুভ আচারণের মোটামুটি এই কয়টি কাই অবশিষ্ট থাকে।
(আবূ দায়ূদ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ পিতা-মাতর সহিত সদ্ব্যবহার ও তাহাদের অধিকার আদায় করা সন্তানের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু এই কর্তব্য কেবল মাত্র তাহাদের জীবন্তকাল পর্যন্তই সীমাবন্ধ নহে। তাহাদের মৃত্যুর পর তাহাদের প্রতি করনীয় কর্তব্য নিঃশেষ হইয়া যায় বলিয়া মনে করা যে সম্পূর্ণ ভূল, তাহা এই হাদীস হইতে স্পষ্ট ভাবে জানা যায়। মুসনাদে আহমাদ উদ্ধৃত হাদীসটির ভাষায় এই কথা জানা গিয়াছে জনৈক আনসার ব্যক্তির জিজ্ঞাসার জবাবে রাসূলে করীম (স)-এর বলা কথা হইতে। কিন্তু আবূ দায়ুদ ও ইবনে মাজার উদ্ধৃত বর্ণনায় *****- এর পরিবর্তে **** বলা হইয়াছে। ইহাতে মূল কথায় কোনই পার্থক্য হয় না। শুধু এতটুকুই পার্থক্য হয়, এই বর্ণনানুযায়ী প্রশ্নকারী আনসার বংশের নয়, সালেমা বংশের।
রাসূলে করীম (স)-এর জওয়াব হইতে জানা গেল, পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও সন্তানের পক্ষে তাহাদেরই জন্য চারটি কাজ করনীয় রহিয়াছে। প্রথমঃ
****************************************
তাহাদের দুইজনের জন্য পরিপুর্ণ রহমতের দোয়া করা এবং তাহাদের দুইজনের জন্য আল্লাহর নিকট গুনাহ মাফ চাওয়া।
এখানে *******অর্থ ‘রহমতের কালেমা’- পরিপুর্ণ রহমত নাজিল হওয়ার জন্য দোয়া করা। সম্ভবত এই দোয়াই আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে শিক্ষা দিয়াছেন এই বলিয়াঃ
****************************************
হে রব! পরোয়অর দিগার, আমার পিতা-মাতা দুই জনের প্রতি রহমত নাযিল কর ঠিক তেমনই যেমন তাহারা দুই জনে মিলিত হইয়া আমার শৈশব অবস্থায় থাকাকালে আমাকে লালন-পালন করিয়াছেন।
দ্বিতীয় কাজ হইলঃ ************* ‘পিতা-মাতা দুইজনের করা ওয়াদা প্রতিশ্রুত পরিপূরণ ও কার্যকর করণ’। পিতা-মাতা তাহাদের জীবদ্দশায় কাহারও সহিত কোন ভাল কাজের ওয়াদা করিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু জীবনে বাঁচিয়া থাকা অবস্থায় তাহারা নিজেরা তাহা পূরণ করিয়া যাইতে পারে নাই। এইরূপ ওয়াদা প্রতিশ্রুতি পরিপূরণ সন্তানের দায়িত্ব। পিতা-মাতার গ্রহণ করা ঋণও এই পর্যায়ের জিনিস। কেননা তাহাও তো তাহারা গ্রহন করিয়াছিল ফিরাইয়া দিবার ওয়াদা করিয়া। কিন্তু জীবদ্দশায় তাহা তাহারা ফিরাইয়অ দিয়া যাইতে পারে নাই।
তৃতীয় হইল, পিতা-মাতার ইন্তিকালের পর তাহাদের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। অন্য একটি হাদীসে এই পর্যায়ে নবী করীম (স) এই কথাটি উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
পিতা-মাতার চলিয়া যাওয়া ও সন্তানের তাহাদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর পিতা-মাতার বন্ধু পরিবার ও ব্যক্তিদের সহিত সম্পর্ক রক্ষা করিয়া চলা পিতা-মাতার সহিত সিলায়ে রেহমী করার অতীব গুরুত্বপুর্ণ কাজ।
স্বয়ং নবী করীম (স) তাঁহার প্রথম বেগম হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা)-এর আত্মীয়-স্বজনের সহিত তাঁহার ইন্তেকালের পরও সিলায়ে রেহমী রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন। ইহা তাঁহার আমল। তাহা হইলে পিতা বন্ধুদের সহিত যে অতি জরুরী ভাবে সিলায়ে রেহমী রক্ষা করিয়াছেন, তাহাতে আর সন্দেহ কি।
আর চতুর্থ হইল, কেবল মাত্র পিতা-মাতার দিক দিয়া ও পিতা-মাতার কারণে যাহাদের সহিত রেহমী সম্পর্ক রহিয়াছে, তাহাদের সহিত সিলায়ে রেহমী করিয়া যাওয়া।
এই হাদীসটি ইবনে হাব্বান ও তাঁহার সহীহ হাদীস গ্রন্হেও উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাহাতে শেষে একটু বেশী কথা রহিয়াছে। তাহা হইলঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স)-এর কথা শুনার পর লোকটি বলিলঃ এই কাজগুলি তো খুব বেশী নয় বরং ইহা অতীব উত্তম কাজ। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তাহা হইলে তুমি এই অনুযায়ী আমল করিতে থাক।
(*********)
রাসূলে করীম (স)-এর উপরোক্ত কথা হইতে তাঁহার নেতৃত্বে গঠিত সমাজের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব স্পষ্ট বুঝা যায়। সে সমাজের লোকদের পারস্পরিক শুভেচ্ছা পোষণ, ওয়াদা প্রতিশ্রুতি সংরক্ষণ, পারস্পরিক বন্ধুতা-প্রীতি ও ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন এবং রক্ত সম্পর্কের হক আদায় করা এবং উহার অব্যাহত ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। একজন মরিয়া গেলে তাহার জীবদ্দশায় এই পর্যায়ের কৃত যাবতীয় কাজ বন্ধ হইয়া না যাওয়া বরং উহার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার বংশানুক্রমিক দায়িত্বশীলতা। বস্তুত সন্তান যেমন পিতা-মাতার পরিত্যাক্ত বস্তুগত সম্পদ-সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাইয়া থাকে, তেমনি তাহাদের অ-বস্তুগত ন্যায়-কাজ সমূহ করার দায়িত্বের উত্তরাধিকারও পাইয়া থাকে। অ-ইসলামী সমাজে এই মহৎ ব্যবস্থার কোন দৃষ্টান্তই খুঁজিয়অ পাওয়া যাইতে পারে না।
তালাক
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেন, মহীয়ান, গরীয়ান আল্লাহ তা’আলার নিকট সমস্ত হালাল কাজের মধ্যে ঘৃণ্যতম কাজ হইতেছে তালাক।
(আবূ দায়ূদ, ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যাঃ উপরোদ্ধৃত হাদীসটিতে তালাক সম্পর্কে ইসলঅমের দৃষ্টিকোণ তুলিয়া ধরা হইয়াছে। হাদীসটির ভাষ্য হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়, তালাক আল্লাহর নিকট হালাল বটে; কিন্তু ইহা নিকৃষ্টতম ও ঘৃণ্যতম হালাল। হালাল-হারাম আল্লহ তা’আলাই নির্ধারিত করিয়া দিয়াছেন। হারাম হইল তাহা যাহা করিতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন এবং যাহা করিলে আল্লাহ তা’য়ালা সন্তুষ্ট ও ক্রদ্ধ হন। কুরআন বা রাসূলে করীম (স)-এর মাধ্যমে জানাইয়া দিয়াছেন এবং যাহা অকাট্য দলীল (******) দ্বারা প্রমাণিত।
আর হালাল তাহা যাহা করিলে আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট হন না, ক্রব্ধ হন না; বরং সন্তুষ্ট হন বলিয়া জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু তালাক হইল এমন একটা কাজ যাহা করিলে আল্লাহ তা’আলা কিছু মাত্র সন্তুষ্ট হন না;দ বরং অত্যন্ত বেশী অসন্তুষ্ট ও ক্রুব্ধ হন, যদিও তাহা হারাম করিয়া দেওয়া হয় নাই। ইহার পিছনে নিশ্চয়ই কারণ নিহিত রহিয়াছে। সে কারণের বিশ্লেষণের পূর্বে ‘তালাক’ বলিতে কি বুঝায়, তাহার ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
ইমাম নববী বলিয়াছেনঃ ‘তালাক ****** শব্দের অর্থঃ ***** ছড়িয়া দেওয়া ত্যাগ করা বা বন্ধন খুলিয়া দেওয়া। আরবী ভাষায় বলা হয় **** ‘আমি শহর ত্যাগ করিয়াছি’। শহর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। (******)
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
‘তালাক” শব্দের অভিধানিক অর্থঃ ****** বাধঁন খুলিয়া ফেলা। জন্তু-জানোয়ার রশি দিয়া বাঁধিয়া রাখার পর রশি খুলিয়া উহাকে মুক্ত করিয়া দিলে বলা হয় *****: ‘উহার গলার রশির বাঁধন খুলিয়া ফেলিয়াছি’। উহাকে ছাড়িয়া দিয়াছি, উহাকে অন্যত্র চলিয়া যাইতে দিয়াছি। আর শরীয়অতের পরিভাষায় ‘তালাক’ হইলঃ ********* বিবাহের বন্ধন তুলিয়া ও খুলিয়া দেওয়া। (*******)
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল-কাহলানী ছানয়ানী ও ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ তালাক শব্দের অভিধানিক অর্থঃ ******* ‘শক্ত রজ্জুর বাঁধন খুলিয়া ফেলা’। এই শব্দটি গ্রহীত হইয়াছে ৮*** হইতে। ইহার অর্থ ছাড়িয়া দেওয়া, ত্যাগ করা। আর শরীয়াতের পরিভাষায় ইহার অর্থঃ ****** বিববাহের শক্ত বাঁধন খুলিয়া দেওয়া’। ইসলামরে পূর্বেও এই শব্দের ব্যাপক ব্যবহাররের কথা বিশেষজ্হগণ স্বীকার করিয়াছেন।
বস্তুত বিবাহ একটা বন্ধন। ইহাতে দুই বিচ্ছিন্ন ও পরস্পরের জন্য হারাম ব্যক্তিসত্তা ও একজন পুরুষ ও একজন মেয়েকে-ঈজাব ও কবুলের শক্ত রশি দিয়া সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে বাঁধিয়া দেওয়া হয়। এক দেহ এক প্রাণ হইয়া একত্র জীবন যাপন, জৈবিক উদ্দেশ্যে ও কামনা-বাসনা পরিপূরণ এবং এক সঙ্গে থাকিয়া পারিবারিক দায়িত্ব পালন করার উদ্দেশ্যেই এই বাঁধন সংস্থাপিত করা হয়। এই বাঁধনকে ছিন্ন করা, এক সঙ্গে থাকিয়া দাম্পত্য জীবন যাপনের সিদ্ধানন্তকে বাতিল করিয়া পরস্পরিক বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়া এবং শরীয়অতের বিধান অনুযায়ী স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে মুক্ত ও পরিত্যাগ করাকেই বলা হয় ‘তালাক’। এই হিসাবে বিবাহ পরিবার গঠন করে। আর তালাক পরিবার সংস্থাকে চুর্ণ করে।
ইসলামে বিবাহের ব্যবস্থা করা হইয়াছে পরিবার গঠন, পারিবারিক জীবন যাপনের মাধ্যমে বৈধ উপায়ে যৌন প্রবৃত্তি ও বাসনা-কামনা পরিপূরণ ও সন্তান উৎপাদন- সর্বোপরি পিতৃ-মাতৃ স্নেহে সন্তান উৎপাদন ও প্রকৃত মানুষরূপে তাহাদিগকে গড়িয়া তোলার উদ্দেশ্যে।
বস্তুত স্বামী-স্ত্রীর কঠিন দুশ্ছেদ্য প্রতিশ্রুতি বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া একটি পবিত্রমত ব্যাপার। ইহা ভাঙিয়া ও ছিন্ন হইয়া যাওয়অ আল্লাহর নিকট কিছুতেই পছন্দনীয় হইতে পারে না। একজন পুরুষ ও একজন মেয়ে লোক যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন ইহার সম্ভাবনার দ্বার উম্মুক্ত হয়। তাই আল্লাহ তা’আলা ইহাতে যার পর নাই সন্তুষ্ট হন। কিন্তু যখন ‘তালাক’ সংঘটিত হয়, তখন ইহার সম্ভাবনা তিরোহিত হইয়া যায়। কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা বিবাহ বন্ধনকে কঠিন দুশ্ছেদ্য প্রতিশ্রুতি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
এবং মেয়েরা তোমাদের নিকট হইতে শক্ত ও দুশ্ছেদ্য প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করিয়াছে।
এই প্রতিশ্রুতি ভঙ করায় আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির অনিবার্য পরিণতি। কেননা প্রথম কাজটি- অর্থাৎ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া- আল্লাহ তা’আলারই ইচ্ছার বাস্তবতা। আর দ্বিতীয় কাজটি অর্থাৎ তালাক দেওয়া- আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির সম্পূর্ণ পরপন্হী। আল্লাহ তা’আলা গঠন ও সংযোজন পছন্দ করেন এবং ভাঙন ও বিচ্ছেদ করেন অপছন্দ, ইহা তো সকলেরই জানা কথা। কুরআনে ঘোষণা করা হইয়াছেঃ ******************** আল্লাহ বিপর্যয় ভাঙন ও অশান্তি পছন্দ করেন না। ‘তালাক’ যে পারিবারিক জীবনের একটা প্রচণ্ড ভাঙন, ও বিপর্যয় তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না। তাই হাদীসের কথাঃ ‘তালাক’ হালাল বটে, কিন্তু ইহা নিকৃষ্টতম ঘৃণ্যতম এবং আল্লাহর রোষ ক্রোধ উদ্রেককারী হালাল কাজ। ইহা খুবই তাৎপর্যপুর্ণ কথা।
রাসূলে করীম (স) অপর একটি হাদীসে তালাক-এর ভয়াবহ পরিণতির কথা ঘোষনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা বিবাহ কর, কিন্তু তালাক দিও না। কেননা তালাক সংঘটিত হইলে আল্লাহর আরশ কাপিয়া উঠে।
‘তালাক’ স্বামী স্ত্রীর পবিত্র বন্ধন ছিন্ন করিয়া দেয়। এই কাজের উদ্যোগ গ্রহণকারী আসলে পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। ইসলামের দৃষ্টিতে সে মহা অপরাধী।
পরিবার গঠনের সূচনা হয় পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক ইচ্ছা, সম্মতি, মানসিক প্রস্তুতি ও আগ্রহ-উদ্যোগের ফলে। ইহার স্থিতি ও স্থায়ীত্বও নির্ভর করে পারস্পরিক আস্থা বিশ্বাস ও ঐকান্তিকতার উপর। কিন্তু সে ইচ্ছা ও আগ্রহ যখন বিলুপ্ত হইয়া যায়, যখন একজন অপর জনের নিকট অসহনীয় হইয়া উঠে- উহার কারণ যাহাই হউক না কেন- তখন তাহাদের মধ্যে বিচ্ছেদ অনিবার্য হইয়া উঠে। পরস্পর হইতে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য পাগল হইয়া উঠে। এই সময় উভয়ের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হইয়া পড়ে। একত্রে ও মিলিত হইয়া থাকা যখন সম্পূর্ণ অসম্ভব হইয়া পড়ে তখন মুক্তির একটা বিধিসম্মত পথ উম্মক্ত থাকাও বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় স্বামী বা স্ত্রী কারো পক্ষেই সুখ সাচ্ছদ্য সহাকারে বাঁচিয়া থাকা সম্ভব হয় না, ঠিক এই কারণেই ইসলামে এই তালাক-এর ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে। যে সব ধর্মে তালাক দেওয়ার- উক্তরূপ অবস্থায় পরস্পর হইতে নিষ্কৃতি পাওয়ার- কোন পথ বরবাদ নির্দিষ্ট হয় নাই, সেই ধর্মাবলম্বীদের জীবন অনিবার্যভাবে দুর্বিসহ হইয়া পড়ে। স্বামীর ঘর-সংসার বরবাদ হইয়া যায়। স্ত্রী সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পড়িয়া যায় ইহা অনস্বীকার্য। তাই ইসলামে তালাক ঘৃণ্য অপছন্দনীয় ও আল্লাহর ক্রোধ উদ্রেককারী হইলেও স্বামী-স্ত্রীর জন্য মুক্তির এই উপায়টিকে বিধিবদ্ধ করা হইয়াছে। এই দৃষ্টিতেইহা এক স্বভাব-সম্মত ব্যবস্থা। যখন স্বামী-স্ত্রী হিসাবে জীবন সম্ভব নয়, তখন পরস্পর হইতে মুক্তি লাভ করিয়া অন্যত্র সুখী জীবন লাভের সন্ধান করা উভয়ের জন্য অবশ্যই মানবিক ব্যবস্থা এবং সর্বতোভাবে যুক্তি সংগত পন্হা। দাম্পত্য জীবনের উত্থান পতন এবং ভাঙা-গড়া সম্পর্কে যাহাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, তাহারা ইহা অবশ্যই স্বীকার করিবেন।
তালাক দেওয়ার ব্যবস্থা ইসলামে চূড়ান্ত নিরুপায়ের উপায় স্বরূপই বিধিবদ্ধ হইয়াছে। বিবাহিত জীবনের চরম লক্ষ্যই যখন বিঘ্নত হয় এবং একত্রের জীবন যাপন সম্পূর্ণ অসম্ভব, তখন বিধিসম্মত ভাবে পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়া আর কি পথ থাকিতে পারে? তাই কুরআন মজীদে তালাক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সে ‘তালাক’ যে কিছু মাত্র আনন্দ দায়ক ব্যাপার নয়, বরং অত্যন্ত দুঃখ-বেদনাময় ও হৃদয় বিদারক, তাহা রাসূলে করীম (স)-এর আলোচ্য ছোট্ট হাদীসটি হইতে জানা যায়।
অতএব পারস্পরিক মিলমিশ ও মিটমাট চূড়ান্ত মাত্রার চেষ্টা করিয়াও যখন একত্র ও স্বামী-স্ত্রী হিসাবে থাকা ও জীবন যাপন করা সম্ভব হইবে না বলিয়াই সিদ্ধান্ত হইবে, ঠিক সেই মুহূর্তে সর্বশেষ উপায় রূপে এই অস্ত্র প্রয়েঅগ করা যাইতে পারে, তাহার পূর্বে নয় এবং তাহা শরীয়াতের প্রদর্শিত পথে ও নিয়মেই তাহা ব্যবহার করিতে হইবে, খামখেয়ালীভাবে ও নিজ ইচ্ছামত নয়।
এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস স্মরণীয়। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
নবী করীম (স) হযরত হাফসা (রা)-কে ‘তালাক’ দিয়াছেন, পরে তাহাকে ফিরাইয়া লইয়াছেন।
এই হাদীসটির ব্যাখ্যায় ইমাম শওকানী লিখিয়াছেন, এই হাদীসটি হইতে প্রমাণিত হয় যে, অপছন্দ না করিয়াও স্ত্রীকে কোন না কোন কারণে তালাক দেওয়া স্বামীর জন্য জায়েয। কেননা যে কাজ জায়েযের সীমার মধ্যে, সম্পূর্ণ হারাম নয়, রাসূলে করীম (স) সে কাজ অপছন্দ করা ছাড়াই করিতেন। ইহা তালাক ঘৃণ্য হওয়া সংক্রান্ত হাদীসের সহিত সংঘর্ষিত নয়। কেননা কোন কাজ ঘৃণ্য ও অপছন্দনীয় হইলেও যে তাহা হারাম হইবে, কিছুতেই করা যাইবে না, তাহা জরুরী নয়।
এই ঘটনা এই কথাও প্রমাণ করে যে, তালাক দিয়ও- যে তালাক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ আনিয়অ দেয়- স্ত্রীকে স্ত্রী হিসাবে পুনরায় গ্রহণ করা যায়, ইহাও এক প্রকারের তালাক। এই রূপ তালাক হইলে স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করা শরীয়াত সম্মত কাজ। ইহা হইতে একথাও বুঝা যায় যে, কেহ যদি একান্ত নিরুপায় হইয়া স্ত্রীকে তালাক দেয়-ই তাহা হইলে সে যেন এমন ভাবে তালাক দেয়, যাহাতে তালাক দেওয়ার পরবর্তী সময়ে তাহাকে স্ত্রী হিসাবে পুনরায় গ্রহণ করার পথ উন্মুক্ত থাকে, সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়া না যায়। রাসূলে করীম (স) হযরত হাফসা (রা) কে তালাক দেওয়ার পর পুনরায় ফিরাইয়া লইয়া সেই পথই দেখাইয়াছেন।
আবূ দায়ূদ গ্রন্হে উদ্ধৃত বর্ণনায় এই মূল হাদীসটির ভাষা হইলঃ
****************************************
তালাক অপেক্ষা অধিক ঘৃণ্য জঘন্য ক্রোধ উদ্রেককারী অসন্তোষজনক আর কোন জিনিসকেই আল্লাহ তা’আলা হালাল করেন নাই।
আবূ দায়ূদে এই বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ হইলেও হাকেম-‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্হে ইহা মরফু মুত্তাছিল [‘মরফু’ বলিতে সেই হাদীস বুঝায় যাহা স্বয়ং রাসূলের কথা এবং ‘মুত্তাসিল’ বলিতে সেই হাদীস বুঝায় যাহার সনদের ধারাবাহিকতা অক্ষত, মধ্যখানে ছিন্ন হইয়া যায় নাই।] রূপে উদ্ধৃত হইয়াছে।
হাদীসটি হইতে একথা প্রমাণিত হইয়াছে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হইলে শয়তান যারপর নাই উল্লাসিত হয়। ইহার প্রেক্ষিতে বলা যায়, এই বিচ্ছেদ বা তালাক আল্লাহর নিকট আদৌ পছন্দনীয় কাজ হইতে পারে না।
এই পর্যায়ের আর একটি হাদীসঃ
****************************************
হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়ানে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ হে মুয়ায! দাস মুক্তি বা বন্দী মুক্তি অপেক্ষা অধিক প্রিয় ও পছন্দময় কাজ আল্লাহ তা’আলা ভূ-পৃষ্ঠে আর কিছু সৃষ্টি করেন নাই। অনুরূপভাবে তালাক অপেক্ষা অধিকতর ঘৃণ্য ও অপছন্দনীয় কাজ আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে আর কিছুই সৃষ্টি করেন নাই।
(দারে কুতনী)
ব্যাখ্যাঃ দাস মুক্তি ও বন্দীমুক্তি এবং তালাক দুইটি কাজই আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহর উদ্ভাবন। কিন্তু তন্ম্যে একটি অধিক পছন্দনীয় আর অপরটি অধিক ঘৃণ্য। একটি কাজে আল্লাহ খুবই খুশী হন। আর অপর কাজটিতে আল্লাহ হন অসন্তুষ্ট, রাগান্বিত ও ক্রুব্ধ। অথচ উভয় কাজের পরিণাম মুক্তি। ইহার কারণ কি?
ইহার কারণ সুস্পষ্ট। দাস বা বন্দী মুক্তিতে মানুষ চরম মর্মান্তিক ও লাঞ্ছিত অপমানিত দুরবস্থা হইতে মুক্তি লাভ করে। অতঃপর মানুষের মত মাথা উঁচু করিয়া মুক্ত আলো-বাতাসে জীবন যাপন করিবার সুযোগ পায়। মানুষকে তো আল্লাহ তা’আলা মুক্তই সৃষ্টি করিয়াছেন। হযরত উমর ফারূক (রা)-এর ভাষায়। ************** ‘তাহাদের মায়েরা তাহাদিগকে মুক্ত ও স্বাধীন অবস্থায়ই প্রসব করিয়াছে’। দাসত্ব নিগড়ে কিংবা কারাগারে মানুষকে বন্দী করে মানুষই। কাজেই ইহা মনুষ্যত্বের অপমান। ইহা হইতে মুক্তি পাইলে মানুষ তাহার আসল মর্যাদায় ফিরিয়া আসে। এর ফলে আল্লাহর অপেক্ষা অধিক সন্তুষ্টির উদ্রেক আর কাহার হইতে পারে।
তালাকেও মুক্তি। স্ত্রী স্বামীর এবং স্বামী স্ত্রীর বন্ধন হইতে মুক্ত হয়। কিন্তু এই মুক্তি কাহারও কাম্য হওয়া উচিত নয়। এই মুক্তিতে সর্বাধিক উল্লাসিত হয় শয়তান। কেননা স্বামী-স্ত্রীর বৈধ যৌন মিলন ও পবিত্র যৌন জীবন শয়তান পছন্দ করিতে পারে না। উহার পছন্দ হইল জ্বেনা-ব্যভিচার। পরিবার দুর্গে দাম্পত্য বন্ধনের মধ্যে জীবন-যাপনকারী নারী-পুরুষের পক্ষে এই কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার কোন সুযোগ থাকে না বলিলেই চলে। কিন্তু এই দুর্গ ভাঙিয়া গেল, নারী-পুরুষ মুক্ত জন্তু-জানোয়ারের ন্যায় অবাধ বিরচণ করিতে পারিলেই তাহাদের দ্বারা জ্বেনা-ব্যভিচার ধরনের দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া অত্যন্ত সহজ হইয়া যায়। আর তখনই হয় শয়তানের উল্লাসের সূচনা।
কিন্তু এতদসত্বেও তালাক অনেক সময় অপরিহার্য হইয়া পড়ে। অনেক সময় শরীয়াতের দিক দিয়াই তালাক দেওয়া প্রয়োজন তীব্র হইয়া দেখা দেয়। যেমন স্ত্রী বা স্বামী যদি দ্বীন ও শরীয়াত অমান্যকারী হয়, শত বলা ও বুঝানো সত্ত্বেও যদি শরীয়াত পালন ও ফরযাদি যথারীতি পালন করিতে প্রস্তুত না হয় এবং শেষ পর্যন্ত যদি স্পষ্ট হইয়া যায় যে, সে শরীয়াত পালন করিবে না, তখন একজন দ্বীনদার মুসলমান পুরুষের পক্ষে তাহার সহিত একত্র দাম্পত্য জীবন যাপন করা সম্ভবপর হয় না। তখন তালাক দেওয়া শুধু অপরিহার্যই নয়, একান্তই বাঞ্ছনীয় হইয়া পড়ে। ইবনুল হুম্মম বলিয়াছেন, এইরূপ অবস্থায় স্ত্রীকে(বা স্বামীকে) তালাক দেওয়া মুস্তাহাব। আবূ হাফচ বুখারী বলিয়াছেন, বেনামাযী স্ত্রী (বা স্বামীর সহিত) সঙ্গম করা অপেক্ষা তাহাকে তালাক দিয়া তাহার মহরানা (বা তালাক বাবদ দেয়) নিজ মাথায় চাপাইয়া লওয়া অধিক পছন্দনীয় কাজ।
এই কারণে তালাক সম্পর্কে শরীয়াত যে পথ ও পন্হা বাতলাইয়া দিয়াছেন তাহা অতীব স্বভাবসিদ্ধ ও মানবিক বলিয়া স্বীকার না করিয়া পারা যায় না। শরীয়াত মুতাবিক যদি কেহ স্ত্রীকে তালাক দেয় এবং পর মুহূর্তেই যদি তাহাকে পুনরায় গ্রহণ করার ইচ্ছা জাগে তবে তাহার সুযোগ উন্মুক্ত থাকে। শরীয়াতের দেখাইয়া দেওয়া নিয়ম লংঘন করিয়া তালাক দিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হইয়াছে এই কারণেই। অনেক ক্ষেত্রে তালাক দাতার বা উদ্যোক্তার উপর অনেক অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব চাপাইয়া দেওয়া হয়, যেন শেষ পর্যন্ত একটি পরিবারের এই ভাঙনটা রোধ করা সম্ভবপর হয়।
হাদীস-পারদর্শীদের মতে তালাক চার প্রকারের। তাহা হইল, হারাম, মাকরূহ, ওয়াজিব ও মুস্তাহাব। দুইটি অবস্থায় তালাক দেওয়া হালাল, দুইটি অবস্থায় তালাক দেওয়া হারাম। হালাল অবস্থা এই যে, স্ত্রী ঋতু হইতে পবিত্র হইয়াছে ও সঙ্গম হয় নাই, অথবা স্ত্রী গর্ভবর্তী হইয়াছে ও তাঁহার গর্ভ প্রকাশ পাইয়াছে। স্ত্রীর ঋতুবতী অবস্থায় তালাক দেওয়া হারাম- অর্থাৎ তালাক তো সংঘটিত হইবে; কিন্তু হারাম কাজ করার গুনাহ হইবে। আর স্ত্রীর সহিত সঙ্গম চলিতেছে, গর্ভাধারে কোন গর্ভের সঞ্চার হইয়াছে কিনা স্বামী সে বিষয়ে অবহিত নয়, এইরূপ অবস্থায় তালাক দেওয়া হারাম। (*****-হযরত ইবনে আব্বাস-এর কথা)। ইহা অবস্থাগত বিবেচনা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ চরমপর্যায়ে পৌঁছিলে ও তালাকই সর্বশেষ উপায় হইয়া দাঁড়াইলে তখন তালাক দেওয়া ওয়াজিব। চারমাস পর্যন্ত স্বামী যদি স্ত্রীর সহিত সম্পর্ক না রাখে ও স্ত্রী তাহার অধিকার পাইবার দাবি জানায় আর স্বামী যদি সে অধিকার দিতে কিংবা তালাক দিয়া দিতে রাযী না হয়, তাহা হইলে তখন সরকার রিজয়ী তালাক দেওয়ার নির্দেশ দিবে। ইহাও ওয়াজিব। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভাল থাকা সত্ত্বেও স্বামী যদি বিনা কারণে তালাক দিয়া বসে, তবে ইহা মাকরূহ।
যে তুহরে সঙ্গম হইয়াছে, সেই তুহরে তালাক দেওয়া হারাম। কাহারও একাধিক স্ত্রী থাকিলে ও একজনের জন্য নির্দিষ্ট রাত্রি আসিবার পূর্বেই তাহাকে তাহার পাওনা হইতে বঞ্চিত করা হারাম। দাম্পত্য জীবনে আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমা রক্ষা করা সম্ভব না হইলে তখন তালাক দেওয়া মুস্তাহাব।
এই পর্যায়ে বিশেষ ভাবে স্বরণীয় যে, তালাক দেওয়ার অধিকার কেবলমাত্র স্বামীর। কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে (****************** ‘পুরুষটির হাতেই নিবন্ধ রহিয়াছে বিবাহ বন্ধন’। তাই এই বন্ধন কেবল মাত্র সেই রাখিতে পারে এবং সে-ই তাহা খুলিয়া দিতে পারে। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ (****************** যে উরু ধরিয়াছে অর্থাৎ স্বামী তালাক দেওয়ার অধিকার ও ক্ষমতা তাহারই। অন্য কাহারও নয়।[বিবাহে স্ত্রীর পক্ষ হইতে ইজাব হয়, আর স্বাম তাহা কবুল করে। ফলে যে বিবাহ বন্ধনটি হইয়া যায় উহার সূত্রের গোড়া স্বামীর হাইতে নিবন্ধ হয়। ফলে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা স্ত্রীর থাকে না।]
ইসলামে তালাক দেওয়ার মৌলিক অধিকার কেবলমাত্র স্বামীকেই দেওয়া হইয়াছে। ইহার কারণও রহিয়াছে। স্বামী বিবাহে ধন-সম্পদ ব্যয় করে এবং নবগঠিন পরিবার সংস্থার যাবতীয় ব্যয়ভার কেবলমাত্র তাহাকেই বহন করিতে হয়। এই কারণে পরিবার সংস্থা অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে স্বাভাবিক ভাবে সে-ই যে অধিক আগ্রহী ও সচেষ্ট হইবে এবং কোন মতেই তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে রাযী হইবে না- চূড়ান্তভাবে নিরূপায় হওয়া ছাড়া, তাহা বলাই নিষ্প্রয়োজন। তাহাকেই ভাবিতে হইতে হয় যে, স্ত্রীকে তালাক দিয়া পরিবার সংস্থা চূর্ণ করিয়া দিলে পুনরায় আর একটি বিবাহ করিয়া এই পরিবার সংস্থাকে নূতন করিয়অ পোহাইতে হইবে তাহাতেও সন্দেহ নাই। আর পরবর্তী বিবাহিত স্ত্রী বর্তমানের চেয়ে যদি ভালো না হয় তাই শেষ পর্যন্ত পরিবার সংস্থা রক্ষা করা ও উহাকে কোনরূপ চূর্ণ হইতে না দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা স্বামীর পক্ষেই স্বাভাবিক। উপরন্তু তালাক দেওয়ার পর স্ত্রীর পাওনা অবশিষ্ট মহরানা ও জরুরী দ্রব্য সামগ্রী দেওয়া এবং স্ত্রী-ইদ্দৎকালীন থাকা-খাওয়া-পরার ব্যবস্থায় অর্থ ব্যয় করার দায়িত্বও তাহাকেই পালন করিতে হইবে। এই সব দিক দিয়া স্ত্রীর কোন দায়-দায়িত্ব থাকে না। কাজেই তালাক দেওয়ার ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে স্বামীতের হাতে অর্পন কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়, পক্ষপাতিত্বও নয় এবং স্ত্রীর প্রতি নয় কোনরূপ অবিচার। বিবাহরে আকদ করার সময় স্ত্রী ‘ইজাব’ করিয়া সেই নিজের অধিকার স্বামীকে দিয়াছে। তাই উহা ছাড়া না-ছাড়ার ইখতিয়ার স্বামীর-স্ত্রীর নয়।
দ্বিতীয়তঃ স্বামী স্ত্রীর তুলনায় অধিক ধৈর্যশীলও হইয়া থাকে। তাই আশা করা যায় যে, সে সামান্য ও খুটিনাটি ব্যাপারে ক্রুব্ধ হইয়া সহসা তালাক দিয়া বসিবে না। পক্ষান্তরে স্ত্রী সহসা ও কারণে-অকারণে ক্রোধান্ধ হইয়া পড়িতে পারে। তাহার সহ্য শক্তিও সীমিত, সামান্য। তালাকের পর তাহাকে কোন দায়-দায়িত্ব বা ঝামেলাও পোহাইতে হয় না। এই কারণে সে খুব সহজেই এবং অতি তাড়াতাড়িই তালাক দানে উদ্যত হইতে পারে। এই জন্যই আল্লাহ তা’আলা তালাক দানের মৌলিক ও চূড়ান্ত ক্ষমতা স্ত্রীর হাতে দেন নাই। বাস্তবতার নিরিখেও এই ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও নিভুর্ল। ইউরোপে এই ক্ষমতা স্ত্রীকেও দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তথায় তালাকের হার বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। মুসিলম সমাজে যত না তালাক সংঘটিত হয়, তাহা অপেক্ষা বহুগুণ বেশী তালাক সংঘটিত হয় ইউরোপীয় সমাজে।
তালাক দেওয়ার ক্ষমতার যথার্থ প্রয়োগের জন্য স্বামীর পূর্ণ বয়স্ক সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী ও স্বাধীন বা স্বেচ্ছাধিকারী হওয়া পূর্বশর্ত। এইরূপ স্বামী তালাক দিলেই সেই তালাক সংঘটিত ও কার্যকর হইবে। পক্ষান্তরে স্বামী পাগল, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা চাপে বাধ্য হইলে তাহার দেওয় তালাক সংঘটিত ও কার্যকর হইবে না। কেননা তালাক এমন একটা কাজ যাহার একটা পরিণাম-পরিণতি সংঘটিত হইয়া থাকে স্বামী-স্ত্রীর জীবনে। এই কারণেই তালাক দাতাকে সর্বদিক দিয়া যোগ্যতা সম্পন্ন হইতে হইবে। তিরমিযী ও বুখারী মওকুফ বর্ণিত হাদীসে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
সর্বপ্রকারের তালাকই কার্যকর-বিবেক-বুদ্ধি রহিত ব্যক্তির তালাক ব্যতীত।
অর্থাৎ বিবেক-বুদ্ধিশূণ্য ব্যক্তির তালাক কার্যকর হইবে না। চোর-ডাকাতের জবরদস্তিতে মজবুর ও বাধ্য হইয়া তালাক দিলে- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেনঃ ********* ‘উহা গণনার যোগ্য নয়’। (বুখারী)। জোর জবরদস্তি করিয়া কাহাকেও মুসলিম বানাইলে সে প্রকৃত মুসলিম হয় না। জোর পূর্বক কাহাকেও কুফরি কালেমা বলিতে বাধ্য করা হইলে সেও কাফির হইয়া যায় না। কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
যে লোককে কাফির হওয়ার জন্য বলপ্রয়োগে বাধ্য করা হইয়াছে তাহার দিল যদি ঈমানে অবিচল থাকে, তবে (সে কাফির হইয়া যাইবে না।)
অনুরূপভাবে কাহাকেও যদি বলপ্রয়োগে তালাক দিতে বাধ্য করা হয় তবে তাহার তালাকও কার্যকর হইবে না। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমার উম্মতের ভূল-ভ্রান্তি ও বলপ্রয়োগে জবরদস্তি করানো কাজ ক্ষমা করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহমাদ ও দায়ূদ জাহেরী এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আলী ইবনে আবূ তালিব ও ইবনে আব্বাস প্রমুখ সাহাবী (রা) গণও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম আবূ হানীফা বলিয়াছেনঃ *********** যাহাকে বল প্রয়োগে বাধ্য করা হইয়াছে তাহার দেওয়া তালাক কার্যকরী হইবে। কিন্তু ইহার সমর্থনে কোন দলীল পাওয়া যায় নাই।
তবে বেহুশ ও ক্রোধান্ধ ব্যক্তির দেওয়া তালাক সম্পর্কে ফিকাহবিদগণ বিভিন্ন রকমের সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছেন।
স্বামী যদি স্ত্রীকে বলেঃ তুমি আমার উপর হারাম – ইহাতে স্বামী যদি স্ত্রীকে নিজের জন্য হারাম মনে করিয়া লয়, তবে তাহাতে সে প্রকৃতপক্ষেও হারাম হইয়া যাইবে না। কেননা হালাল কে হারাম করার কধিকার বা ক্ষমতা কাহারও নাই। এক ব্যক্তি হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর নিকট আসিয়া বলিলঃ ************* ‘আমি আমার স্ত্রীকে আমার উপর হারাম করয়াছি’। তখন তিনি বলিলেনঃ ************** ‘না সে তোমার উপর হারাম নয়’।
আর সে যদি এই কথা তালাক দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলে এবং এই শব্দ দ্বারা তালাক বুঝিয়া থাকে, তবে সে তালাক সংঘটিত হইবে। তখন ইহা ইংগিতমূলক কথা বিবেচিত হইবে। বোবা-বাকশক্তিহীন ব্যক্তি স্পষ্ট ইশারা করিয়া স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক ছিন্ন করিতে পারে। প্রতিনিধির মাধ্যমেও স্ত্রীকে তালাক দেওয়া যাইতে পারে, চিঠি লিখিয়া তালাক দিলে তাহাও সংঘটিত হইবে। তবে তাহা স্ত্রীকে সম্বোধন করিয়া স্পষ্টভাষায় লিখিত হইতে হইবে।
কুরআন মজীদে সূরা *****-এর ২ নং আয়াতে তালাক সংক্রান্ত নির্দেশ প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ
এবং তোমরা সাক্ষী বানাও তোমাদের মধ্য থেকে সুবিচার ও ন্যায়পরতা সম্পন্ন দুইজন লোককে এবং আল্লাহর জন্য তোমরা সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত কর।
তালাক দেওয়া এবং উহার পর স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়া হইলে উভয় ক্ষেত্রেই সাক্ষী বানানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। ইহা উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ইমাম আবূ হানীফার মতে ইহা মুস্তাহাব। আর এক তালাক দেওয়ার পর স্ত্রীকে ফিরাইয়া আনা হইলে তখন সাক্ষী বানানো ইমাম শাফেয়ীর মতে ওয়াজিব। ইমাম আহমাদের একটি মত ইহার সমর্থক এই পর্যায়ে কোন হাদীস বর্ণিত বা উদ্ধৃত হয় নাই- না নবী করীম (স)-এর কোন উক্তি, না সাহাবীদের কোন কথা। তবে একটি বর্ণনায় দেখা যায়, হযরত ইমরন ইবনে হুসাইন (রা)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিলঃ এক ব্যক্তি তাহার স্ত্রীকে তালাক দিয়াছে পরে তাহাকে ফিরাইয়া লইয়াছে; কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই সে সাক্ষী বানায় নাই। এ সম্পর্কে আপনার মত কি? তিনি বলিয়াছিলেনঃ
****************************************
সুন্নাতের নিয়ম ব্যতীতই তালাক দিয়াছে, সুন্নাতের নিয়ম ব্যতীতই তাহাকে ফিরাইয়া লইয়াছে। তালাক দান ও ফিরাইয়া লওয়া উভয় ক্ষেত্রেই সাক্ষী বানাও।
এক বোন কর্তৃক অপর বোনের তালাক চাওয়া
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি এই বাক্যটি রাসূলে করীম (স) পর্যন্ত পৌঁছাইতে ছিলেন, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ কোন মেয়ে লোক-ই তাহার ভগিনীর তালাক চাহিতে পারিবে না- এই উদ্দেশ্যে যে, তাহার পাত্রে যাহা আছে তাহার সবটুকুই সে একাই ঢালিয়া লইবে।
(তিরমিযী, ইবনে হাব্বান, বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ উপরের হাদীসটি তিরমিযী গ্রন্হ হইতে উদ্ধৃত হইয়াছে। ইবনে হাব্বান এই হাদীসটিই নিজ গ্রন্হে উদ্ধৃত করিয়াছেন ভিন্নতর ভাষায়। উহার ভাষা এইঃ
****************************************
কোন মেয়ে লোক-ই তাহার ভগিনীর তালাকের দাবি করিতে পারিবে না- এই উদ্দেশ্যে যে, সে তাহার (ভগিনীর) পাত্রের সব কিছুই সে নিজে নিঃশেষ করিয়া লইবে। কেননা মুসলিম মহিলা অপর মুসলিম মহিলার ভগিনী।
আসলে এই কথাটি দৃষ্টান্তমূলক। কোন মহিলার স্বামী যখন অপর একজন মহিলাকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তখন এই (দ্বিতীয়) মহিলা সেই পুরুষটিকে বলেঃ তোমার বর্তমান স্ত্রীকে যদি আগেই তালাক দিতে পার এবং তাহা দিয়া দাও, তাহা হইলেই আমি তোমাকে বিবাহ করিতে রাযী হইব। ইহা যেমন তদানীন্তন আরব সমাজে একটা অনাচার হিসাবে প্রচলিত ছিল, বর্তমানেও ইহার দৃষ্টান্ত নিতান্ত বিরণ নয়। কিন্তু ইহা একটি চরম অবিচার ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, এই পুরুষটি হয়ত একজন কুমারী কিংবা অধিক সুন্দরী যুবতী বা ধনবতী মেয়েকে বিবাহ করার লোভে পড়িয়া নিজের বর্তমান স্ত্রীকে তালাক দিয়া বসে। অথচ সে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার যুক্তি সংগত কোন কারণই নাই। আর বিনা কারণে-বিনা দোষে স্ত্রীকে তালাক দেওয়অর মত অন্যায় অবিচার ও জুলুম আর কিছুই হইতে পারে না। যে মেয়েটি এইরূপ কথা বলে- তাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে তাহার বর্তমান স্ত্রীকে তালাক দিতে প্ররোচিত করে, সে তো একজন মুসলিম মেয়ে লোক, যাহাকে তালাক দিবার জন্য এই প্ররোচনা, সেও একজন মুসলিম মহিলা। আর এই দুইজন মুসলিম মিল্লাতের লোক হিসাবে পরস্পরের বোন ছাড়া কিছুই নয়। অনুরূপভাবে কোন পুরুষের যদি এক সঙ্গে একাধিক স্ত্রী থাকে এবং তাহাদের একজন স্বামীকে বলে যে, তুমি তোমার অন্য বা অন্যান্য স্ত্রীদের তালাক দিলে আমি তোমাকে বেশী ভালবাসিব। এই ধরনের কথা-বার্তা প্রায়ই হইয়া থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরুষটি তাহার কথা মত তাহার আগের বা অপর স্ত্রীকে তালাক দিয়া দিতে উদ্যত হইয়া যায়। উপরোক্ত হাদীস এই প্রেক্ষিতেই প্রযোজ্য। বুখারী শরীফে এই হাদীসটির শেষাংশের ভাষা এই রূপঃ
****************************************
একজন মেয়ে লোক অপর এক মেয়ে লোককে তালাক দিবার জন্য তাহার স্বামীকে প্ররোচিত করে এই উদ্দেশ্যে যে, তাহার পাত্রটি সে নিজে নিঃশেষ করিয়া লুটিয়া লইবে। এইরূপ করা নিস্ফল, কেননা সে তো ততটুকুই পাইবে যতটুকু তাহার জন্য নির্ধারিত হইয়াছে।
এই হাদীসের আর একটি ভাষা হইলঃ
****************************************
কোন মেয়ে লোকের জন্যই কল্যাণকর নয় যে, সে তাহারই এক বোনকে তালাক দানের শর্ত করিবে এই উদ্দেশ্যে যে, সে নিজে তাহার পাত্রটি একাই লুটিয়া পুটিয়া খাইবে।
ইমাম নববী এই হাদীসের তাৎপর্য লিখিয়াছেনঃ
****************************************
এই হাদীসের তাৎপর্য হইল, অপরিচিত বা সম্পর্কহীন মেয়েলোক একজন পুরুষকে তাহার স্ত্রীকে তালাক দিতে প্ররোচিত করিবে- যেন সে তাহাকে তালাক দিয়া সেই মেয়েলোককে বিবাহ করে- এই কাজ হইতে বিরত রাখা।
ইবনে আবদুল বার এই হাদীস হইতে যে মৌলনীতি গ্রহণ করা যায় বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা হইলঃ
****************************************
কোন মেয়ে লোক তাহার সতীনকে তালাক দিবার জন্য স্বামীকে বলিবে এই উদ্দেশ্যে যে, অতঃপর সে একা-ই থাকিয়া যাইবে ও সব কিছু একাই ভোগ দখল করিবে- ইহা কিছুতেই সমীচীন হইতে পারে না।
ইবনে হাজার আল-আসকালীন বলিয়াছেনঃ ইবনে আবদুল বার লিখিত তাৎপর্য হইতে পারে সেই হাদীসটির, যাহাতে বোনের তালাকের দাবি করার কথা বলা হইয়াছে। কিন্তু যে হাদীসটিতে তালাক দেওয়ার শর্ত করার কথা বলা হইয়াছে, তাহাতে নিশ্চয়ই কোন সম্পর্কহীন মেয়ে লোক প্রসংগে কথা। আসল কথা হইল, এই ধরনের কথা বলা যায় যে ধরনের মন-মানসিকতা থাকিলে, তাহা নিতান্তই স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা ও হীন জিঘাংসাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন মেয়েলোক তাহারই মত অপর একজন মেয়ে লোককে স্বামী বঞ্চিতা করার কুটিল ষড়যন্ত্র পাঁকাইবে, ইসলাম ইহা কোনক্রমেই পছন্দ করিতে পারে না। মুসলমান হইয়া অপর একজন অবলা মুসলমানের কপাল ভাঙার জন্য এইরূপ কার্যকলাপ করিবে, রাসূলে করীম (স) আলোচ্য হাদীসের মাধ্যমে ইহা হইতে পরিষ্কার কণ্ঠে নিষেধ করিয়াছেন।
এই প্রেক্ষিতে বক্তব্য হইল, ইসলামে তালাক কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। উহা কোন আনন্দ বা খুশীর ব্যাপারও নয়। ইহা কোন ছেলে খেলাও নয়। ইহা অত্যন্ত জটিল ও সাংঘাটিত ব্যাপার। কথায় কথায় রাগ করিয়া সাময়িক ঝগড়া-ঝাটির দরুন উত্তেজিত হইয়া কখনই তালাক দেওয়া উটিত হইতে পারে না। তালাক দিবার পূর্বে শতবার ভাবিতে হইবে। ইহার পরিণতি নিজের জীবনে, পারিবারিক ক্ষেত্রে ও সন্তানাদির জীবনে কি রূপ দেখা দিবে, তাহা সুস্থ ও সূক্ষ্ম দৃষি।টতে বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে।
(*************)
এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা স্মরণীয়। তাহা হইল, কোন স্ত্রীর পক্ষে নিজের স্বামীর নিকট নিজের তালাক চাওয়া বা দাবি করাও কি কোনক্রমে উচিত হইতে পারে? স্ত্রী স্বামীকে বলিবে, ‘তুমি আমাকে তালাক দিয়া ছাড়িয়া দাও’, এই কথা সাধারণভাবেই অকল্পনীয়। কোন বিশেষ কারণ যদি না-ই থাকে এবং দাম্পত্য জীবনকে অব্যাহত অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সর্বশেষ চেষ্টা করিয়াও যদি ব্যর্থতা হয়, তবে স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু তাহার পূর্বেই সেরূপ কোন কারন ছাড়-ই তালাক দাবি করাকে ইসলাম আদৌ সমর্থন করে না। এই পর্যায়ে নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটি স্মরণীয়ঃ
****************************************
হযরত সাওবান (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে মেয়ে লোকই স্বামীর নিকট তাহার নিজের তালাক চাহিবে- স্বামীকে বলিবে- তাহাতে তালাক দিতে কোনরূপ কঠিন ও অসহ্য কারণ ব্যতীতই- তাহার জন্য জান্নাতের সুগন্ধি- সৌরভ সম্পূর্ণ হারাম।
(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, আবূ দায়ূদ, দারেমী, ইবনে হাব্বান, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ তালাক অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। কোন স্ত্রী-ই নিজের স্বামীর নিকট নিজের তালাক চাহিতে পারে না, বলিতে পারে নাঃ ‘তুমি আমাকে তালাক দাও’। তবে কয়েমটি ক্ষেত্রে ইহারও অনুমতি দেওয়া যাইতে পারে। উপরোদ্ধৃত হাদীসের শব্দ ******* ‘কোনরূপ কঠোরতা ব্যতীত’ হইতেই এই কথা জানিতে ও বুঝিতে পারা যায়। ***** শব্দের অর্থ ***** কঠিন অবস্থা, কঠোরতা, চূড়ান্ত ভাবে ঠেকিয়া যাওয়া। এমন অবস্থা, যাহা মানুষকে তালাক চাহিতে বাধ্য করে, যখন চূড়ান্ত বিচ্ছেদ- ছাড়া কোন গতিই থাকে না এমন কোন বাস্তব কারণ যদি দেখা দেয়, কেবলমাত্র তখনই স্ত্রী স্বামীকে বলিতে পারে আমাকে তালাক দাও। এইরূপ অবস্থায় পড়িয়া স্ত্রী যদি স্বামীর নিকট তালাক চাহে, তবে তাহাতে গুনাহ হইবে না।
কিন্তু এইরূপ অবস্থার উদ্ভব না হওয়া সত্ত্বেও যদি কোন স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক পাইতে চাহে, তাহা হইলে তাহার জন্য আলোচ্য হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
সেই স্ত্রীলোকটির জন্য জান্নাতের সুগন্ধি সম্পূর্ণ হারাম হইয়া যাইবে।
কিছু সংখ্যক হাদীস বিশেষজ্ঞ এই কথাটুকুর ব্যাখ্যায় বলিয়াছেনঃ ইহা ইংগিতমূলক কথা। ইহা হইতে বুঝানো হইয়াছে যে, সে মেয়ে লোকটি জান্নাতে যাইতে পারিবে না। কেননা সুগন্ধি পাওয়া যায় নিকটে গেলে, ভিতরে প্রবেশ করিলে। আর ভিতরে প্রবেশ করিলে সুগন্ধি না পাওয়ার কোন কথা হইতে পারে না। অতএব যখন বলা হইয়াছে যে, সে সুগন্ধি পাইবে না, তখন বুঝিতেই হইবে যে, সে জান্নাতে যাইতেই পারিবে না, এই কথাই বলা হইয়াছে।
অবশ্য কেহ কেহ এই কথাটুকুকে উহার শাব্দিক ও সীমাবদ্ধ অর্থে গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, এইরূপ মেয়েলোক জান্নাতে গেলেও জান্নাতে গেলেও জান্নাতের সৌরভ লাভ করিতে পারিবে না। আর এই মোট কথাটির তাৎপর্য হইল, সে জান্নাতে প্রথম চোটে প্রবেশকারী লোকেদের সঙ্গে প্রবেশ করিতে পারিবে না। কেননা সে স্বামীর নিকট তালাক চাহিয়া একটা অত্যন্ত বড় গুনাহ করিয়াছে। আর এই কথাটা দ্বারা এরূপ স্ত্রী লোককে খুব বেশী সাবধান ও সতর্ক করিয়া দেওয়া হইয়াছে মাত্র।
আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেন, যে সব হাদীসে স্ত্রীলোকদিগকে তাহাদের স্বামীর নিকট তালাক চাওয়ার দরুন ভয় দেখানো হইয়াছে, তাহা কেবলমাত্র সেই অবস্থায়ই প্রযোজ্য, যদি কোনরূপ কঠিন কারণ ব্যতীতই তালাক চাওয়া হয়।
(******************)
পিতা-মাতার নির্দেশে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমার এক স্ত্রী ছিল, আমি তাহাকে ভাল বাসিতাম, কিন্তু আমার পিতা উমর (রা) তাহাকে অপছন্দ করিতেন। এই কারণে উহাকে তালাক দেওয়ার জন্য আমাকে আদেশ করিলেন। কিন্তু আমি তাহা করিতে অস্বীকার করিলাম। তখন তিনি নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেনঃ ইয়া রাসূল! আমার পুত্র আবদুল্লাহর একজন স্ত্রী আছে, আমি উহাকে তাহার জন্য অপছন্দ করি। এই কারণে উহাকে তালাক দেওয়ার জন্য আমি তাহাকে আদেশ করিয়াছি। কিন্তু সে আদেশ পালন করিতে অস্বীকার করিয়াছে। অতঃপর রাসূলে করীম (স) আবদুল্লাহকে বলিলেনঃ হে আবদুল্লাহ! তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দাও। ফলে আমি তাহাকে তালাক দিয়া দিলাম।
(আবূ দায়ূদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিযী, নাসায়ী)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির মূল কথা হইল, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের একজন স্ত্রী ছিল, তিনি তাহাকে খুবই ভালবাসিতেন। কিন্তু হযরত উমর (রা) তাহাকে পছন্দ করিতেন না বলিয়া তাহাকে তালাক দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। হযরত উমরের পছন্দ না করার কারণ কি ছিল তাহা হাদীসে বলা হয় নাই। ইহার একটা শরীয়াত সম্মত কারণ নিশ্চয়ই ছিল। নতুবা অযথা ও শুধু শুধুই তিনি পুত্রবধুকে তালাক দিতে বলিতে পারেন না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) পিতার আদেশ মানিয়া স্ত্রীকে তালাক দিতে রাযী হইলেন না। হয়ত যে কারণে হযরত উমর (রা) তালাক দিতে বলিয়াছিলেন, সে কারণটি তাঁহার নিকট স্পষ্ট ছিল না। অথবা তিনি হয়ত সে কারণে এতটা গুরত্ব দেন নাই যে, তাহার জন্য স্ত্রীকে তালাকই দিতে হইবে।
উপরোদ্ধৃত হাদীসের ভাষায় বলা হইয়াছে, হযরত উমর (রা) নবী করীম (স)-এর নিকট এই ব্যাপারটিকে একটি মামলা হিসাবে পেশ করিলেন। নবী করীম (স) হযরত উমরের কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়া তিনিও স্ত্রীকে তালাক দিবার জন্য ইবনে উমর (রা) কে নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তিনি এই নির্দেশ মত তালাক দিয়া দিলেন।
তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত হাদীসটির ভাষা ইহাপেক্ষা সংক্ষিপ্ত। হযরত উমর (রা) এই ব্যাপারটি নবী করীম (স)-এর নিকট পেশ করিয়াছেন, তাহাতে এই কথার উল্লেখ নাই। তাহাতে বলা হইয়াছে, হযরত আবদুল্লাহ ইব নে উমর (রা) নিজই এই ব্যাপারটি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট পেশ করিয়াছিলেন। হইতে পারে পিতা পুত্র উভয়ই ব্যাপারটি নবী করীম (স)-এর নিকট পেশ করিয়াছেন। কিন্তু একজন বর্ণনাকারী হযরত উমর (রা)-এর পেশ করার কথা উল্লেখ করিয়াছেন এবং অন্য বর্ণনাকারী হযরত আবদুল্লাহর নিজেরই পেশ করার কথা উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু ইহাতে মূল ব্যঅপারে কোনই তারতম্য হয় নাই। এই হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হইয়াছে। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, পিতার আদেশ হইলে পুত্রকে প্রিয়তমা স্ত্রীকে তালাক দিতে হইবে। ইহা পিতৃ আদেশ পালন করার ব্যাপারে পুত্রের বাধ্যবাধকতা প্রমাণ করে। ইসলামে আল্লাহর পরই পিতা-মাতার স্থান আদেশ মান্যতার দিক দিয়া। অতএব পুত্রের প্রিয়তমা স্ত্রীকে তালাক দিতে পিতা আদেশ করিলে তাহা অবশ্যই পালন করিতে হইবে।
হযরত উমরের নির্দেশ মত স্ত্রীকে তালাক দিতে রাযী না হওয়ার একটা কারণই ছিল বলা যায়। আর তাহা হইল তিনি তাহাকে ভালবাসিতেন। কিন্তু কেবলমাত্র ভালবাসার কারণেই কোন মেয়ে লোক স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা পাইবে, এমন নাও হইতে পারে। এই ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও এমন শরীয়ত সম্মত কারণ থাকিতে পারে, যাহার দরুন স্ত্রীকে ত্যাগ করাই কর্তব্য ও বাঞ্ছনীয় হইয়া পড়ে।
এক কথায় বলা যায়, পিতা-মাতার আদেশক্রমে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া পুত্রের জন্য কর্তব্য। হাদীসে কেবল পিতার কথা উদ্ধৃত হইয়াছে। কিনউত সন্তানের নিকট পিতার তুলনায় মাতার স্থান যে অনেক উপরে সে কথা বহু কয়টি হাদীস হইতেই অকাট্যভাবে জানা গিয়াছে। কাজেই পিতার ন্যায় মায়ের নির্দেশ হইলেও স্ত্রীকে তালাক দিতে হইবে। আল্লাহর নিকট এই ঘৃণ্যতম কাজটিও পিতা কিংবা মাতার নির্দেশে করিতে হয়। ইহাই আলোচ্য হাদীসটির বক্তব্য।
হায়য অবস্থায় তালাক
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি তাহার স্ত্রীকে তালাক দিলেন এমন সময় যখন তাঁহার স্ত্রী ঋতুবতী। ইহা রাসূলে করীম (স)-এর জীবিত থাকা সময়ের ঘটনা। তখন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) এই বিষয়ে রাসূলে করীম (স)কে জিজ্ঞাসা করিলেন। জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তাহাকে আদেশ কর, সে যেন তাহার স্ত্রীকে ফিরাইয়া লয়। আর তাহাকে রাখিয়া দেয়। পরে সে যখন হায়য অবস্থা হইতে পবিত্র হইবে, পরে আবার ঋতুবতী হইবে, পরে আবার সে পবিত্র হইবে, তখন সে ইচ্ছা করিলে পরবর্তী কালের জন্য তাহাকে রাখিয়া দিতে পারে, ইচ্ছা করিলে তালাকও দিতে পারে। তবে তাহা স্পর্শ করার পূর্বে দিতে হইবে। ইহাই হইল সেই ইদ্দত যে জন্য স্ত্রীদের তালাক দিবার জন্য আল্লাহ তা’আলা আদশে করিয়াছেন।
(বুখারী, মুসলিম আবূ দায়ূদ, নাসায়ী)
ব্যাখ্যাঃ স্ত্রীকে তালাক দেওয়া পর্যায়ে এই হাদীস। কোন অবস্থায় তালাক দেওয়া যায় কোন অবস্থায় নয়, প্রধানত এই বিষয়েই পথ-নির্দেশ এই হাদীসটিতে রহিয়াছে। তালাক দেওয়ার ব্যবস্থা ইসলামে এক চূড়ান্ত পন্হা ও নিরুপায়ের উপায় হিসাবেই রাখা হইয়াছে এবং এই ব্যাপারে মূল কর্তৃত্ব দেওয়া হইয়াছে স্বামীকে। কুরআন মজীদের ঘোষণা ‘তাহার- অর্থাৎ স্বামীর হাতেই রহিয়াছে বিবাহে বন্ধন (খোলার চাবিকাঠি)’। সহীহ সনদে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ *********** ‘বিবাহ বন্ধনে (খোলার) কর্তৃত্ব স্বামীকেই দেওয়া হইয়াছে’ (*****)। অর্থাৎ তালাক দেওয়ার মূল মালিক ও অধিকারী হইতেছে স্বামী। সে ইচ্ছা করিলে তালাক দিবে, না হয় না দিবে। সে তালাক না দিলে বা দিবার সুযোগ করিয়া না দিলে তালাক হইতে পারে না। তবে সরকার যদি কোন বিশেষ অবস্থায় বিবাহ ভাঙিয়া দেয় ও স্বামী-স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয় তবে সে কথা স্বতন্ত্র।
কিন্তু প্রশ্ন হইল, স্বামী স্ত্রীকে কোন কারণে তালাক দিবে? কি অবস্থায় তালাক দিবে? কোন রূপ কারন ছাড়াই স্ত্রীকে তালাক দেওয়া কি সংগত, তালাক কি যখন-ইচ্ছা তখনই দিতে পারে?…. এই সব প্রশ্নেরই সুস্পষ্ট জওয়াব পাওয়া যায় উপরোদ্ধৃত হাদীসে। এই পর্যায়ে প্রথমে আমরা হাদীসে উদ্ধৃত কথাগুলির পর্যালোচনা করিব। পরে তালাক সংক্রান্ত অন্যান্য জরুরী কথা পেশ করা হইবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) তাঁহার স্ত্রীকে তালাক দিয়াছিলেন। তাঁহার এই স্ত্রীর নাম ছিল আমেনা- গিফারের কন্যা। মুসনাদে আহমাদ-এ বলা হইয়াছে, তাহার নাম ছিল ‘নাওয়ার’। এই দুইটি বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্য ও সংগতি বিধানের জন্য বলা যাইতে পারে, নাম ছিল আমেনা, ‘নওয়ার’ ছিল তাহার উপনাম বা ডাক নাম।
হাদীসে বলা হইয়াছে ***** অর্থাৎ হযরত ইবনে উমর (রা) তাঁহার স্ত্রীকে যখন তালাক দিয়াছিলেন, তখন সে ছিল ঋতুবতী। তাহার হায়য হইতে ছিল। কাসেম ইবনে আচবারের বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তিনি তাঁহার স্ত্রীকে তালাক দিলেন, তখন সে ঋতুবতী ছিল, তাহার রক্তস্রাব হইতেছিল। আর রায়হাকীর বর্ণনার ভাষা হইলঃ
****************************************
তিনি তাহার স্ত্রীকে তাহার (স্ত্রীর) হায়য অবস্থায় তালাক দিলেন।
তাহার পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া সমস্ত ব্যাপারটি বিবৃত করিলেন। ইহা গুনিয়া রাসূলে করীম (স) রাগান্বিত হইলেন। আবূ দায়ূদের বর্ণনায় রাসূলে করীম (স) ক্রব্ধ হওয়ার কথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছে। উহার ভাষা হইলঃ
****************************************
হযরত উমর (রা) রাসূলে করীম (স) কে সমস্ত ঘটনার বিবরণ বলিয়া শুনাইলেন। সব শুনিয়া রাসুলে করীম (স) ক্রব্ধ ও রাগান্বিত হইলেন।
পরে তিনি বলিলেনঃ ‘সে যেন তাহার স্ত্রীকে অবিলম্বে ফিরাইয়া লয় এবং ঘরে রাখে। অতঃপর হায়য অবস্থা হইতে পবিত্র হওয়ার পর এতটা সময় অতিবাহিত করাইতে হইবে যখন আবার তাহার হায়য হইবে এবং সে হায়য হইতেও পবিত্র হইবে। এই ভাবে চলতি হায়য অতিক্রান্ত হওয়ার পর এক তুহরে ও এক হায়েয অতিবাহিত হইতে হইবে। ইহার পর যে তুহার হইবে, সে যদি তাহাতে তালাক দিতে বদ্ধপরিকরই হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই তুহর অবস্থায় তালাক দিবে। কিন্তু শর্ত এই যে, এই তুহর কালে সে যেন স্ত্রীর সহিত সঙ্গম না করে।
এই পর্যায়ে আল্লামা খাত্তাবী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
এই হাদীসটির এ কথার দলীল যে, হায়য অবস্থায় তালাক দেওয়া বিদয়াত- সুন্নাত বিরোধী কাজ। যদি কেহ হায়য অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দিয়া বসে আর সে যদি সঙ্গমকৃত হইয়া থাকে এবং তালাকের একটা অংশ অবশিষ্ট থাকিয়া থাকে। অর্থাৎ তিন নয়, এক বা দুই তালাক ইতিপূর্বে দিয়া থাকে, তাহা হইলে স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়া তাহার কর্তব্য।
অর্থাৎ তুহর অবস্থায় তালাক দেওয়া সুন্নাত তরীকা মুতাবিক। তিনি আরও লিখিয়াছেনঃ
****************************************
এই হাদীসটি একথাও প্রমাণ করে যে, বিদয়াত পন্হায় তালাক দিলেও তাহা কার্যকর হয় যেমন কার্যকর হয় সুন্নাত পন্হানুযায়ী দেওয়া তালাক। কেননা তাহা যদি কার্যকর না হইত তাহা হইলে স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইতে বলার কোনই অর্থ হয় না।
হাদীসের ভাষা হইলঃ ************************* ইহার অর্থ, হযরত উমর (রা)-এর পুত্র যে তাহার স্ত্রীকে হায়য অবস্থায় তালাক দিয়াছেন, এই ব্যাপারে শরীয়াতের হুকুম বা ফয়সালা কি, তাহাই তিনি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট জানিতে চাহিয়াছেন। ইহার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) যে ফয়সালা শুনাইলেন উহার শুরুতে তিনি হযরত উমর (রা)কে বলিলেন ***** অর্থাৎ তোমার পুত্রকে নির্দেশ দাও, সে যেন এইরূপ করে। রাসূলে করীম (স)-এর এই যে নির্দেশ, শরীয়াতের দৃষ্টিতে ইহার মর্যাদা কি, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ নানা কথা বলিয়াছেন। ইমাম মালিকের মতে এই নির্দেশ পালন করা ওয়াজিব। আর তাহার অর্থ এই যে, যদি কেহ তাহার স্ত্রীকে হায়য বা নেফাস (সন্তান প্রসবজনিত রক্তস্রাব( অবস্থায় তালাক দেয়, তাহা হইলে তাহাকে ‘রুজু’ করিতে- স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইতে বাধ্য করিতে হইবে। ইমাম মালিকের এই কথায় হায়য অবস্থা ও নেফাস অবস্থাকে এক ও অভিন্ন অবস্থা ধরিয়া লওয়া হইয়াছে। ইবনে আবূ লাইলা, আওজায়ী, শাফেয়ী, আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক, আবূ সওর প্রমুখ ফিকাহবিদগণ এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
***************** তাহাকে আদেশ করা হইবে, যেন সে তাহার স্ত্রীকে ফিরাইয়া লয়; কিন্তু ফিরাইয়া লইতে ‘মজবুর’ বা বাধ্য করা যাইবে না। ইহাদের এই মতে রাসূলের আদেশ বা নির্দেশ পালন করা মুস্তাহাব ধরিয়া লওয়া হইয়াছে, ওয়াজিব নয়। আর তাহাও এই জন্য যে, তালাক দেওয়ার কাজটা যেন সুন্নাট তরীকা মুতাবিক হয়।
কিছু লোক (ইবনে দকীকুল-ঈদ) এখানে ইসলামী আইন রচনার মূলনীতির প্রশ্ন তুলিয়াছেন। তাহা এই যে, রাসূলে করীম (স) হযরত উমর (রা) কে আদেশ করিলেন, তিনি যেন তাঁহার পুত্রকে এইরূপ করার নির্দেশ দেন। ইহা হইল ************ ‘কোন কাজ করিবার আদেশ করার জন্য আদেশ করা’। কিন্তু ইহা কি সেই মূল করনীয় কাজের জন্য আদেশ? আল্লাম ইবনে হাজেব এই প্রশ্ন তুলিয়া বলিয়াছেনঃ ‘কোন কাজের আদেশ করার জন্য রাসূলে করীম (স) আদেশ করিয়া থাকিলে সেই মূল কাজের জন্য রাসূলে করীমের নির্দেশ করা হইল না। অতএব রাসূলের দেওয়া ফয়সালা অনুরূপ আমল করা ওয়াজিব। কিন্তু আল্লামা রাযী বলিয়াছেনঃ এই মত ঠিক নয়। বরং কোন কাজ করার জন্য কাহাকেও আদেশ করার জন্য আদেশ করা হইলে তাহা সেই মূল আদেশকারীরই আদেশ হইল বলিয়া মনে করিতে হইবে।
হযরত উমর (রা) রাসূলে করীম (স)-এর আদেশ পাইয়া তাঁহার পুত্রকে সেই মতো করিতে আদেশ করিলেন। হযরত ইবনে উমর (রা) অতঃপর কি করিলেন, তাহা উপরোদ্ধৃত হাদীসের ভাষায় বলা হয় নাই। মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ তাঁহার স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইলেন, যেমন করার জন্য তাঁহাকে রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিয়াছিলেন।
ইহাতে বুঝা যায়, রাসূলে করীম (স)-এর আদেশকে তিনি তাঁহার প্রতি করা আদেশরূপেই গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং রাসূলে করীম (স)-এর আদেশ মনে করিয়াই তিনি তাহা পালন করিয়াছিলেন। আর এই আলোকে বলা যায়, ইমাম রাযীর উপরোক্ত মতই যথার্থ।
হযরত ইবনে উমর (রা) তাঁহার স্ত্রীকে হায়য অবস্থায় তালাক দিয়াছিলেন, একথা বহু কয়টি বর্ণনায়ই উদ্ধৃত হইয়াছে; কিন্তু কয়টি তালাক দিয়াছিলেন, তাহা উপরোদ্ধৃত বুখারীর বর্ণনায় উল্লেখ করা হয় নাই। তবে মুসলিম শরীফের অপর একটি বর্ণনায় স্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
তিনি তাঁহার স্ত্রীকে এক তালাক দিয়াছিলেন তাহার ঋতুবতী হওয়া অবস্থায়।
এখন প্রশ্ন দাঁড়াইয়াছে, স্ত্রীর হায়য হওয়া অবস্থায় তাহাকে এক তালাক দিলে তাহাকে ফিরাইয়া লওয়া (*****) করা কি ওয়াজিব ইমাম মালিক ও আহমাদ ইবনে হাম্বল এই ওয়াজিব হওয়ার মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু জমহুর ফিকাহবিদ বলিয়াছেন, ইহা করা মুস্তাহাব। আর হেদায়াত গ্রন্হে বলা হইয়াছে, ইহা করা ওয়াজিব। কেননা ইহা করার জন্য রাসূলে করীম (স)-এর স্পষ্ট আদেশ হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ হায়য অবস্থায় তালাক দেওয়াই যখন হারাম, তখন বিবাহ অবস্থা স্থায়ী বা বিলম্বতি রাখা ওয়াজিব হইবে। হাদীসের ভাষাঃ ****** ‘স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইয়া ঘরে রাখিয়া দিবে’। ইহার অর্থ, তাহাকে নিজের স্ত্রীরূপে ঘরে স্থান দিবে, থাকিতে ও পারিতে দিবে- যতক্ষণ চলতি হায়েয শেষ হওযার পর এক তুহর ও এক হায়য অতিক্রম হইয়া আবার ‘তুহর’ অবস্থায় ফিরিয়া না আসে।
মূল হাদীসের ভাষা হইলঃ
****************************************
অতঃপর ইচ্চা করিলে পরবর্তী কালের জন্য তাহাকে স্ত্রী হিসাবে রাখিবে। আর রাখার ইচ্ছা না হইলে ও তালাক দেওয়ার ইচ্ছা হইলে তালাক দিবে- স্পর্শ করার পূর্বে’।
স্পর্শ করার পূর্বে ‘অর্থ’ যে তুহর-এ তালাক দিবে, সে তুহরে স্ত্রী সঙ্গম করিতে পারিবে না সেই তুহরে স্ত্রী সঙ্গম করা হইলে সে স্ত্রীকে সে তুহরে তালাক দেওয়া চলিবে না। ইহা হইতে বুঝা গেল, স্ত্রীর হায়য অব্স্থায় তাহাকে তালাক দেওয়া যাইবে না, তালাক দিলে দিতে হইতে তুহর অবস্থায়। কিন্তু যে তুহরে স্ত্রী সঙ্গম হইয়াছে, তুহরে তালাক দেওয়া চলিবে না।
হাদীসটির শেষ বাক্য হইলঃ ********** ইহাই হইল সেই ইদ্দত, যে ইদ্দত পালনের কথা সম্মুখে রাখিয়া স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা’আলা আদেশ করিয়াছেন।
‘আল্লাহ আদেশ করিয়াছেন’ বলিয়া রাসূলে করীম (স) এই আয়াতটির দিকে ইংগিত করিয়াছেনঃ
****************************************
হে নবী, তোমরা যখন স্ত্রীদিগকে তালাক দিবে, তখন তোমরা তাহাদিগকে তাহাদের ইদ্দতের জন্য তালাক দাও।
ইহার অর্থ হইল, তালাক দেওয়ার ব্যাপারে তোমরা দায়িত্বহীনতার আচরণ করিও না। স্বামী-স্ত্রীতে কোনরূপ মনোমালিন্য ঘটিলেই ক্রোধান্ধ হইয়া চট করিয়া তালাক দিয়া বসিবে না। এমনভাবে তালাক দিবে না যে তাহার পর স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়ারও কোন অবকাশ থাকিবে না। বরং তালাক যদি দিতেই হয় তাহা হইলে বিচার বিবেচনা করিয়া দিবে এবং তালাক দিবে ইদ্দাত পালনৈর উদ্দেশ্যে। আল্লামা জামাখশারী এই আয়াতের অর্থ করিয়াছেন এই ভাষায়ঃ *********** ‘তাহাদিগকে তালাক দাও তাহাদের ইদ্দতের জন্য’ অর্থ, তাহাদের ইদ্দাত কাল সম্মুখে রাখিয়া তালাক দাও’।[এই আয়াত সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা জানিবার জন্য পাঠ করুন ‘তাফহীমুল কুরআন সূরা আত-তালাক-এর ১ নং টীকাঃ ২৮ পারা। (**************)]
এই হাদীস হইতে শরীয়াতের কয়েকটি বিধান জানা যায়ঃ (১) স্ত্রীর হায়য অবস্থায় তাহাকে তালাক দেওয়া হারাম। এই কারণেই হযতর উমর (রা)-এর নিকট হযরত উমর (রা)-এর তালাক দানের বিবরণ শুনিয়া রাসূলে করীম (স) রাগান্বিত হইয়াছিলেন। আর রাসূলে করীম করীম (স) কোন হারাম কাজেই রাগান্বিত হইতে পারেন, অ-হারাম কাজে নয়। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও যদি কেহ হায়য অবস্থায়ই তালাক দেয় তবে তাহা সংঘটিত হইবে। তবে কাহারও মতে তালাক দিলেও তাহা কার্যকর হইবে না। ইহা জাহেরী ফিকাহবিদদের মত। কোন কোন তাবেয়ীও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের সংখ্যা নগণ্য। (২) সুন্নাত তরীকা মত তালাক দেওয়ার নিয়ম হইল স্ত্রীর তুহর অবস্থায় তালাক দেওয়া। (৩) তালাক দেওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়ার জন্য নবী করীম (স) আদেশ করিয়াছেন। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, হযরত ইবনে উমর (রা) তাঁহার স্ত্রীকে এমন তালাক দিয়াছিলেন, যে তালাকের পর স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়ার সুযোগও থাকে। তাহাকে বলা হয় রিজয়ী তালাক। আর এক তালাক দেওয়ার কথা যে হাদীসের বর্ণনা হইতে জানা গিয়াছে তাহা আমরা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করিয়াছি। ইহা ‘বাঈন’ তালাক ছিল না। কেননা বাঈন তালাক দেওয়ার পর স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়া যায় না। (৪) রিজয়ী তালাক দেওয়ার পর স্বামী ইচ্ছা করিলে স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইতে পারে। সেজন্য স্ত্রীর রাযী অরাযীর কোন প্রশ্নই নাই। এই ফিরাইয়া লওয়াটা স্ত্রীর রাযী হওয়ার উপর নির্ভরশীলও নয়। (৫) রিজয়ী তালাক দেওয়া স্ত্রীকে শুধু মুখের কথা দ্বারাই ফিরাইয়া লওয়া চলিবে। এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নাই। তবে এ জন্য কোন কাজ করিতে হইবে কিনা, এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রা) ‘হ্যাঁ’ বলিয়াছেন এবং ইমাম শাফেয়ী ‘না’ বলিয়াছেন। (৬) ইমাম আবূ হানীফা এই হাদীসের ভিত্তিতে বলিয়াছেন যে, স্ত্রীর হায়য অবস্থায় তালাক দেওয়া হইলে স্বামী গুনাহগার হইবে। স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়া তাহার কর্তব্য। যদি ইদ্দতের মধ্যে ফিরাইয়া না লয় বরং ইদ্দত শেষ হইয়া যায়, তাহা হইলে এক তালাকেই স্ত্রী হারাম হইয়া যাইবে।