হাদিয়া-তোহফা ও দান জায়েয
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইত বর্ণিত হইয়াছে, হযরত নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে মেয়েই কোন মহরানা কিংবা কোন দান বা অন্যান্য দ্রব্যাদির ভিত্তিতে বিবাহিত হইবে বিবাহ-বন্ধন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে, তাহা সবই সেই মেয়ের হইবে। আর যাহা বিবাহ বন্ধন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর দেওয়া হইবে। তাহা সে পাইবে, যাহাকে সেই জিনিস দেওয়া হইয়াছে। ব্যক্তি তাহার কন্যার বা বোন হওয়ার কারণে সম্মানিত হইবার অধিক অধিকারী।
(আবু দায়ূদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী।)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটিতে যে বক্তব্য রাখা হইয়াছে তাহা মোটামুটিভাবে এই যে, কোন মেয়ের বিবাহের কথ-বার্তা পাকপাকি হইয়া গেলে এবং তাহার মহরানাও নির্দিষ্ট হইলে তখন বর পক্ষ হইতে যাহা কিছু দেওয়া হইবে, তাহা মহরানা বাবদ হউক কিংবা নিছক দান হউক বা এই দান পর্যায়ের অন্য যে কোন জিনিসই দেওয়া হইবে, তাহা সবই সেই মেয়ে পাইবে, যে মেয়ের বিবাহের কথাবার্তা চূড়ান্ত হইয়াছে। ইহা বিবাহ বন্ধন হইয়া যাওয়ার পূর্বকার বিষয়ে কথা।
আর বিবাহের আকদ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর জামাতার পক্ষ হইতে শ্বশুর বাড়ীতে বিশেষ হাদিয়া তোহফা যাহা আসিবে, তাহা সেই লোক পাইবে, যাহার যাহার জন্য আসিবে। অর্থাৎ বিবাহের আকদ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কাহারও সাথে যেহেতু পুরুষটির কোন আত্মীয়তা থাকে না, সম্পর্ক থাকে শুধু এতটুকু যে, এই মেয়েকে সে বিবাহ করিবে বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে। অতএব বিবাহের আকদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে যদি কিছু হাদিয়া-তোহফা দেয় তবে তাহা সেই মেয়ের জন্যই দেওয়া হইয়াছে বলিয়া ধরিয়া লইতে হইবে। এবং যাহা দেওয়া হইবে তাহা সে-ই পাইবে। অন্য কাহারও তাহাতে কোন অংশ নাই।
কিন্তু আকদ অনুষ্ঠিত হওয়র পর সেই মেয়ে ছাড়াও মেয়ের বাবা বা মেয়ের ভাই বোনও জামাতার নিকট সম্মান বা হাদিয়া তোহফা পাওয়ার অধিকারী হইয়া যায়। তখন কেবল স্ত্রীকেই সব কিছু দেওয়া উচিত নয়। বরং মেয়ে যে পিতার সন্তান সে পিতাও সম্মান পাওয়ার যোগ্য। যে ভাইর সে বোন, কিংবা যে বোনের সে বোন, সেও হাদিযা তোহফা পাইতে পারে। জামাতার উচিত তাহাদিগকেও হাদিয়া তোহফা দিয়া সম্মানিত করা। উমর ইবনে আবদুল আজীজ, সওরী, আবূ উবাইদ, মালিক প্রমুখ ফিকাহবিদগণ এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম আবূ ইউসূফ বলিয়াছেন, বিবাহের আকদ হওয়ার পূর্বেও যদি কাহারও জন্য কোন হাদিয়া-তোহফা প্রস্তাবিত বরের পক্ষ হইতে আসে তবে তাহা গ্রহণ করা তাহার পক্ষে সম্পূর্ণ জায়েয হইবে। ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন, আকদ অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে কনে ছাড়া অন্য কাহারও নামে হাদীয়া-তোহফা বরপক্ষ হইতে আসিলে এই নাম নির্ধারণ গ্রহণযোগ্য হইবে না। মূলত ইহা স্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের সহিত ভাল সম্পর্ক রক্ষা করার পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর পথ-নির্দেশ। এই রূপ হাদিয়া-তোহফা দিলে স্ত্রী এবং তাঁহার পিতা বা ভাই কনে ও বরে প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হইবে ইহাই স্বাভাবিক। এইরূপ হাদিয়া তোহফা গ্রহণ করা তাহাদের জন্য হালাল। ইহা কোন নিষিদ্ধ রসম নয়।
(*************************)
****************************************
হযরত আলী (রা) হইতে বর্নিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) হযরত ফাতিমা (রা) কে বড় পাড়ওয়ালা চাদর, পানি পাত্র, এমন বালিশ বা উপাধান যাহার উপরের খোলটা চামড়া দিয়া তৈরী এবং ভিতরে সুগন্ধি যুক্ত ঘাষ ভর্তি থাকে- বিবাহের জেহায বা যৌতুক স্বরূপ দিয়াছিলেন।
(মুসহাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ বিবাহ হওয়ার পর কন্যা যখন পিতার বাড়ি হইতে বিদায় লইয়া স্বামীর বাড়ি চলিয়া যাইতে থাকে, তখন পিতার কর্তব্য হইল মেয়েকে কিছু প্রাথমিক প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র ও গার্হস্থ্য সরঞ্জামাদি সংগে দিয়অ দেওয়া। নবী করীম (স) তাহার কন্যা হযরত ফাতিমা (রা)-কে এই পর্যায়ে কিছু জিনিস দিয়াছিলেন। উপরোক্ত হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর দেওয়া কয়েকটি জিনিসের নাম উল্লেখ করা হইয়াছে। সে জিনিসগুলি হইলঃ একখানি মোটা পাড়ওয়ালা চাদর, একটি পানি-পাত্র এবং বালিশ বা উপাধান।
অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) যখন হযরত ফাতিমা (রা)-কে বিবাহ দিলেন, তখন তাঁহার সহিত একটি চাদর, সুগন্ধিযুক্ত ঘাষ ভর্তি চামড়ার খোলের বালিশ, একটি যাঁতা, পানির একটি পাত্র এবং দুইটি পাঁকা মাটির পাত্র পাঠাইয়অ দিয়াছিলেন।
এই বর্ণনায় দুইটি বেশী জিনিসের উল্লেখ আছে। একটি হইল যাঁতা, যাহাতে গম বা চাল বা ডাল পেষা হয়। আর ইহা ছাড়া দুইটি মাটির পাত্র, সম্ভবত রান্না-বান্না করার জন্য।
হযরত উম্মে সালমা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) যখন তাঁহাকে বিবাহ করিয়া আনিয়াছিলেন, তখন তাঁহারকে সম্বোধন করিয়া তিনি বলিয়াছিলেনঃ
****************************************
তোমার অন্যান্য দ্বীনী বোনদিগকে যাহা যাহা দেওয়া হইয়াছে আমি তোমাকে তাহা হইতে কিছু মাত্র কম দিব না। আর তাহা হইলঃ যাঁতা, মাটির তৈরী পাত্র এবং ঘাষভর্তি চামড়ার খোলের তৈরী বালিশ।
এই বর্ণনা কয়টি হইতে স্পষ্ট বোঝা যায়, দান-জেহাযে চমৎকারিত্ব, চাকচিক্য ও উচ্চমানের বিলাসিতা করা রাসূলে করীম (স)-এর নীতি নয়। তিনি তদানীস্তন সমাজ ও জীবন যাত্রার মান অনুযায়ী মাঝা মাঝি ধরনের জেহেয দিয়াছিলেন।
কিন্তু এই পর্যায়ে দুইটি কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রথম কথা হইল, রাসূলে করীম (স) এই যাহা কিছু দ্রব্য সামগ্রী দিয়াছিলেন তাহা কেবলমাত্র হযরত ফাতিমা (রা) রুখসত করার বা তুলিয়া দেওয়ার সময়। তাহার কারণও ছিল এবং সে কারণটি এই যে, মদীনা শহরে হযরত আলী (রা)-এর নিজস্ব কেন ঘর-বাড়ি ছিল না। তিনি অর্থশালী লোকও ছিলেন না। বিবাহের পূর্বে তিনি স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে বসবাস করিতেন। বিবাহের পর একটি বাড়ি ভাড়ায় লইয়া তিনি হযরত ফাতিমা (রা)-কে তুলিয়া নিয়াছিলেন। এই নূতন ঘর বাসোপযোগী বানাইবার জন্যই নবী করীম (স) নিজ হইতে এই জিনিসগুলি সংগ্রহ করিয়া দিয়াছিলেন। ইহা ছিল গার্হস্থ্য জীবনের জন্য অপরিহায্য প্রয়োজন পূরণ মাত্র। ইহা যৌতুক দেওয়ার কোন রসম পালন নয়।
দ্বিতীয়ত নবী করীম (স) হযরত ফাতিমা (রা) ছাড়া তাঁহার অন্যান্য কোন কন্যাকে বিবাহ দেওয়ার সময় এই ধরনের কোন জিনিসই কিন্তু দেন নাই। কেননা তাহার দ্বিতীয় জামাতা হযরত উসমান (রা) অর্থশালী ব্যক্তি ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত ফাতিমা (রা) কে রাসূলে করীম (স) কর্তৃক কিছু গার্হস্থ্য দ্রব্য দেওয়া হইতে রড়জোর শুধু এতটুকুই প্রমাণিত হয় যে, কন্যার বিবাহ কালে কন্যার নূতন ঘর-সংসার চালূ করার উদ্দেশ্যে ও প্রাথমিক প্রয়োজন পূরণ স্বরূপ কোন জিনিস সঙ্গে পাঠাইয়া দেওয়ার প্রয়োজন বোধ হইলে এবং পিতা তাহা সহজে ও কোনরূপ ঋণের বোঝা মাথায় চাপাইয়া লওয়া ছাড়াই দিতে সক্ষম হইলে তাহা দেওয়া জায়েয হইবে। কিন্তু ইহাকে বাধ্যতামূলক রসম হিসাবে চালূ করা ও পালন করা আর যাহাই হউক রাসূলে করীম (স)-এর ‘সুন্নাত’ হইতে পারে না। বর্তমানে মুসলিম সমাজে যে কঠিন যৌতুক প্রথা চাপিয়া বসিয়াছে ইহাকে একটি অবাঞ্ছিত অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এই ‘রসম’ সোজাসুজি প্রতিবেশী মুশরিক হিন্দু সমাজ থেকেই যে আমদানী হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই।
বস্তুত দান জেহেয (আজ কালকার যৌতুক) দাবি করিয়া বা চাপ প্রয়োগ করিয়া আদায় করার জিনিস নয়। কন্যাপক্ষ মেয়ের স্বামীর ঘন করিতে যাওয়ার সময় প্রাথমিক ভাবে প্রয়োজনীয় কেন জিনিস দেওয়াকেই ‘জেহেয’ বলা হয়। ইহা পিতার ইচ্ছা, কন্যা-বাৎসল্য ও ক্ষমতা সামর্থ্য অনুপাতেই হইয়া থাকে। সেই সঙ্গে নিজের ও বর পক্ষের সামাজিক মান-মর্যাদার দিকেও লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। আসলে ইহা দ্বারা বর ও বরপক্ষের লোকজনকে খুশী করিয়অ দেওয়াও একটা লক্ষ্য। তাহাদের সহিত সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় ও গাঢ় করিয়া তোলা ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু তাই বলিয়া মেয়ের যৌতুক জোগাড় করিতে গিয়া পিতাকে যদি জমি বা অন্য কোন বিত্ত সম্পত্তি বন্ধক রাখিতে বা বিক্রয় করিয়া দিতে অথবা ঋণ গ্রহণ করিতে হয় কিংবা বিরাট মূল্যের জেহেয দিতে অক্ষম বলিয়া কোন পিতার কন্যাকে আইবুড়ো ও অবিবাহিতা হইয়া থাকিতে হয়, তবে তাহার অপেক্ষা অধিক দুঃখের কারণ আর কিছুই হইতে পারে না। সামাজিক বদ রসমের প্রবাল্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তাহাই হইতে দেখা যায়। এই বদরসম যত শীঘ্র বিলুপত্ হয়, মানবতার পক্ষে ততই মঙ্গল।
বস্তুত শরীয়াতের বিচারে এইরূপ বদ রসম সম্পূর্ণ হারাম। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
পুরুষটির জন্য একটি শয্যা, তাহার স্ত্রীর জন্য একটি শয্যা, তৃতীয় শয্যা অতিথি-মেহমানের জন্য। আর ইহার উপর চতৃর্থ একটি থাকিলে তাহা নিশ্চয়ই শয়তানের জন্য।
বস্তুত একটি নব দম্পতির জন্য শয্যার দিক দিয়া ইহাই নূন্যতম প্রয়োজনের মান। ইমাম নববী উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেনঃ
নূন্যতম প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাহা কিছু হইবে, তাহা সংগ্রহ করা বড় মানুষী, বাহাদুরী, গৌরব- অহংকার প্রদর্শন এবং দুনিয়ার চাকচিক্য ও জাঁকজমকের উপকরণ মাত্র। আর যাহা এই পর্যায়ের প্রয়োজনাতিরিক্ত হইবে, তাহাই শয়তানের প্ররোচনার ফসল মাত্র। কেননা প্রয়োজনাতিরিক্ত বিলাস সমাগ্রী দেখিয়া শয়তান সন্তুষ্ট হয়। সেই ইহার প্ররোচনা দেয়, ইহার সৌন্দর্য প্রচার করে এবং এই কাজে সহযোগিতা করে।
কাহারও কাহারও মতে রাসূলে করীম (স)- এর উপরোক্ত কথার বাহ্যিক অর্থই গ্রহনীয়। ঘরে প্রয়োজনাতিরিক্ত সাজ-শয্যা ও দ্রব্য সরঞ্জাম পুঞ্জীভূত হইয়া থাকিলে তাহা প্রকৃতপক্ষেই শয়তানের ব্যবহারে আসে। যেমন অন্য হাদীসে বলা হইয়াছে, রাত্রিকালে ঘরের মালিক আল্লাহর যিকির না করিলে সে ঘরে শয়তানের বসতি হয়। হাদীসে স্বামী ও স্ত্রীর জন্য দুইটি শয্যার কথা বলিয়া ঘরের লোকসংখ্যানুপাতে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি সাধনের প্রয়োজন সম্প্রসারিত হওয়ার দিকেই ইংগিত করা হইয়াছে। এই কথায় এদিকেও ইশারা হইতে পারে যে, স্বামী স্ত্রী যদি এক শয্যায় রাত্রি যাপন না করে, ভিন্ন ভিন্ন শয্যায় থাকে, তবে তাহাতে কোন দোষ নাই। এক শয্যায় একত্রে থাকা জরুরী নয় বলিয়াও কেহ কেহ এই হাদীসের ভিত্তিতে মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু এই হাদীসের ভিত্তিতে এইরূপ মত প্রকাশ অত্যন্ত দুর্বল কথা। আসলে এই হাদীসের প্রয়োজন হিসাবে আলাদা শয্যার কতা বলা হইয়াছে। আর একজনের অসুখ বিসুখ হইলে যে এই প্রয়োজন তীব্রভাবে দেখা দেয় তাহা সকলেই জানেন। স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে একই শয্যায় শয়ন করা শরীয়াতের দিক দিয়া ওয়াজিব না হইলেও অন্য এক দলীলের ভিত্তিতে ইহাই সঠিক কাজ। আর তাহা হইল, স্বতন্ত্র শয্যায় শয়নের বিশেষ কোন কারণ না হইলে স্বামী-স্ত্রীর একই শয্যায় রাত্রি যাপন বাঞ্ছনীয় এবং উত্তম। রাসূলে করীম (স) তাহাই করিয়াছেন চিরকাল। তিনি ইহাকে স্ত্রীর হক মনে করিয়াই তাহার সঙ্গে সব সময় একই শয্যায় শয়ন করিয়াছেন। আর একই শয্যায় একত্রে শয়ন করিলেই যে স্বামী-স্ত্রী সঙ্গম হইবে বা হইতে হইবে, এমন কোন কথা নাই।
অলীমা’র দাওয়াত
****************************************
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইলেন। তাঁহার দেহে সোনালী হলূদের চিহ্ন লাগানো ছিল। ইহা দেখিয়া নবী করীম (স) তাঁহকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। জবাবে তিনি জানাইলেন যে, তিনি সম্প্রতি আপনার বংশের একটি মেয়ে বিবাহ করিয়াছেন। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তাহাকে কত মহরানা দিলে? তিনি বলিলেনঃ এক দানা পরিমাণ স্বর্ণ। রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ অলীমা’র দাওয়াত কর- একটি ছাগী দিয়া হইলেও।
(বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি মোটামুটি তিনটি কথা আলোচনা সাপেক্ষ। প্রথম সোনালী হলুদের চিহ্ন গায়ে, থাকা; দুই মহরানার পরিমাণ এবং তিন, অলীমা করার নির্দেশ।
এই হাদীসটির মূল ভাষা হইলঃ **************** তাহার দেহে হলুদের চিহ্ন ছিল। অপর এক বর্ণনায় এই স্থলের শব্দ হইলঃ ********** অর্থাৎ তাঁহার গায়ের জাফরানের রঙ মাখা ছিল। অন্য একটি বর্ণনায় এখানকার ভাষা হইল ********** অর্থাৎ এক প্রকার সুগন্ধি মাখা ছিল। আর একটি বর্ণনার ভাষা এইঃ *************** নবী করীম (স) তাঁহার চোখে-মুখে নব বিবাহের হাসি-খুশী ও উৎফুল্লতা দেখিতে পাইলেন। আর তিরমিযীর ভাষা হইলঃ **************** ‘নবী করীম (স) আবদুর রহমান ইবনে আউফের (দেহে বা কাপড়ে) হলুদ চিহ্ন দেখিতে পাইলেন। হলুদ চিহ্ন বা জাফরান মাখা দেখার তাৎপর্য হইল, তাহার শরীরে জাফরান মাখা কাপড়- যাহা সাধারণত নব বিবাহিত ব্যক্তিরা পরিয়া থাকে- পরিহিত ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলিয়াছেনঃ
****************************************
যে মুসলমানই বিবাহ করিবে সে যেন সোনালী হলুদ বর্ণ মাখা কাপড় পড়ে। ইহা নব বিবাহ ও তজ্জনিত আনন্দ উৎফুল্লতার বাহ্য লক্ষণ হইবে। তোমরা কি হাদীসের এই বাক্যটি দেখিতে পাওনা, যাহাতে বলা হইয়াছেঃ তাঁহার চোখে-মুখে নববিবাহের উৎফুল্লতা প্রতিভাত ছিল।
কেহ কেহ বলিয়াছেনঃ ‘নব বিবাহিত ব্যক্তি এই ধরনের কাপড় পরিবে এই উদ্দেশ্যে, যেন লোকেরা তাহার অলীমা’র অনুষ্ঠান করায় ও নব গঠিত পরিবারের ব্যয় বহনে সাহায্য করে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
সমস্ত রঙের মধ্যে সর্বোত্তম রঙ হইল সোনালী হলুদ বর্ণ। কেনা কুরআন মজীদেই আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ হলুদবর্ণ- উহার রঙ অত্যুজ্জল। উহা দ্রষ্টা ও দর্শককে আনন্দিত ও উৎফুল্ল করিয়া দেয়।
কুরআনের ও আয়াতটি সূরা আল-বাকারা’র ৬৯ আয়াতাংশ। ইহাতে বলা কথার ভঙ্গী হইতে জানা যায়, মানসিক আনন্দ লাভ হয় হলূদ বা ঘিয়ের রঙে। এই কারণে নবী করীম (স)ও এই রঙটি খুবই পছন্দ করিতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) কে নবী করীম (স)-এর পছন্দনীয় রঙ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল। জবাবে তিনি বলিয়াছিলেনঃ
****************************************
নবী করীম (স) সোনালী হলুদ রঙ মাখিতেন। আমিও উহা মাখি এবং এই রঙ আমি ভালবাসি, পছন্দ করি।
ইবনে আবদুল বার জুহরী হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ
****************************************
সাহাবায়ে কিরাম (রা) সোনালী হলুদ রঙ মাখিতেন এবং তাহাতে তাঁহারা কোন দোষ দেখিতে পাইতেন না।
ইহা হইতে বুঝিতে পারা যায় যে, বর্তমানকালে বিবাহের প্রক্কালে বর-কনের গাত্রে হলূদ মাখার যে সাধারণ ও ব্যাপক রেওয়াজ রহিয়াছ তাহা বহু প্রাচীনকাল হইতে চলিয়া আসা রীতি এবং তাহাতে শরীয়াতের দৃষ্টিতে কোন দোষ নাই।
দায়ূদী বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁহার শ্বশ্রু সোনালী হলুদ বর্ণে রঙীন করিয়া রাখিতেন। ফলে তাঁহার কাপড়-পোষাক এই রঙে রঙীন হইয়া যাইত।
হযরত উমর (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমি নবী করীম (স)-কে দেখিয়াছি, তিনি এই রঙ মাখিতেন এবং ইহার অপেক্ষা অন্য কোন রঙ তাঁহার অধিক প্রিয় ও পছন্দ ছিল না। তিন তাঁহার সমস্ত কাপড়- এমন কি তাঁহার পাগড়ীও এই রঙে রঙীন করিয়া রাখিতেন।
আসলে ইহা জাফরানী রঙ সম্পর্কে কথা। উহা ছাড়া আর যে রঙে কোন গন্ধ নাই তাহা মাখা জায়েয হওয়ায় কোন মত-বিরোধ নাই।
(**************)
অবশ্য ইবনে সুফিয়ান বলিয়াছেনঃ সোনালী হলুদ বর্ণ কাপড়ে লাগানো জায়েয, দেহে লাগানো জায়েয নয়। ইমাম আবূ হানীফা, শাফেয়ী ও তাঁহাদের সঙ্গী-সাগরিদগণ কাপড়ে বা দাড়িতে জাফরানী রঙ ব্যবহার মকরুহ মনে করিতেন। তাঁহাদের দলীল হইল হযরত আনাস বর্ণিত হাদীসঃ
****************************************
পুরুষ মানুষকে জাফরানী রঙ লাগাইতে নবী করীম (স) নিষেধ করিয়াছেন।
প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাকারী আল্লামা আবদুর রহমান মুবারকপুরী লিখিয়াছেনঃ হাদীসের এই বাক্যটির অর্থ হইলঃ
****************************************
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফের (রা) অবয়বে নব বিবাহ সংক্রান্ত সুগন্ধি হিসাবে ব্যবহৃত জাফরানের চিহ্ন লাগিয়া ছিল।
অর্থাৎ তিনি এই জাফরানী রঙ নিজে ইচ্ছা করিয়া লাগান নাই। কেননা পুরুষদের এই রঙ ব্যবহার সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর স্পষ্ট নিষেধ সহীহ বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে। অনুরূপভাবে ************* হলুদবর্ণ সম্বলিত সুগদ্ধি ব্যবহারও পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ। কেননা ইহা মেয়েদের ভূষণ। আর পুরুদিগকে মেয়েদের সহিত সাদৃশ্য করিতে নিষেধ করা হইয়াছে। তাঁহার মতে ইহাই আলোচ্য হাদীসের সঠিক তাৎপর্য। কাযী ইয়ায ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ হাদীসের এই অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু আল্লমা বদরুদ্দীন আইনী এইরূপ অর্থ গ্রহণে এক মত নহেন।
কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, বলা হইয়াছে, বরের জন্য এই রঙ ব্যবহার করা জায়েয। আবূ উবাইদ উল্লেখ করিয়াছেনঃ
****************************************
সাহাবায়ে কিরাম (রা) যুবকদের বিবাহ উৎসব কালে এই রঙ ব্যবহার করা জায়েয বলিয়া ঘোষণা করিতেন।
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) আনসার বংশের যে মেয়েটি বিবাহ করিয়াছিলেন, জুবাইর উল্লেখ করিয়াছেন, সে মেয়েটি আবুল হাসান ইবনে রাফে’র কন্যা। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেন ******* ইহার অর্থঃ ***** ‘তাহাকে মহরানা বাবদ কত দিয়াছ’? জওয়াবে তিনি বলিয়াছিলেনঃ ******** ‘একদানা ওজনের স্বর্ণ’। মূল কথা একই, ভাষা ও শব্দ প্রয়োগের পার্থক্য মাত্র। ‘একদানা পরিমাণ’ বা ‘একদানা ওজনের স্বর্ণ’ কতটুকু? ইমাম খাত্তাবী বলিয়াছেনঃ ******** এমন একটা ওজন বা পরিমাণ বুঝায় যাহা তদানীন্তন সমাজের সকলেরই জানা ছিল এবং ইহা কাহারও নিকট অপরিচিত ছিলনা। উহার মূল্য পরিমাণ ছিল পাঁচ দিরহাম। ইহাই অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মত। তবে ইমাম তিরমিযীর বর্ণনা মতে একদানা পরিমাণ স্বর্ণের ওজন হইল তিন দিরহাম ও এক দিরহামের এক তৃতীয়াংশ। আর ইসহাক বাহওয়াই বলিয়াছেন, ইহার ওজন পাঁচ দিরহাম ও এক দিরহামের এক তৃতীয়াংশ। বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণের মূলে যে পার্থক্য হইয়াছে, তাহারই প্রতিফলন ঘটিয়াছে এই সব কথায়।
এই আলোচনা হইতে জানা গেল, বিবাহে মহরানা একটা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কে কত মহরানা ধার্য করিয়াছে বা দিয়াছে তাহাই পারস্পরিক জিজ্ঞাসা বিষয়। সমাজ প্রধান হিসাবে রাসূলে করীম (স)-এরও ইহা একটি দায়িত্ব ছিল।
রাসূলে করীম (স) হযরত আবদুর রহমান (রা)-এর বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর তাঁহাকে নির্দেশ দিলেনঃ *********** অলীমা কর- অলীমার জিয়াফতের ব্যবস্থা কর একটি ছাগী দ্বারা হইলেও।
‘অলীমা’ কাহাকে বলে? আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় যে খাবার বা জিয়াফতের আয়োজন ও অনুষ্ঠান করা হয়, তাহারই নাম ‘অলীমা’।
ইবনুল আসীর বলিয়াছেনঃ
****************************************
বিবাহ উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ খাবার ও জিয়াফতকেই অলীমা বলা হয়।
আল্লামা আজহারী বলিয়াছেন ******* শব্দের মূল হইল ***********- ইহার অর্থ *******- ‘একত্রিত ও সমবেত হওয়া’। এইরূপ নাম করণের কারণ হইলঃ ********** ‘কেননা স্বামী-স্ত্রী দুইজন একত্রিত হয়’- এই উপলক্ষেই এই জিয়াফতের ব্যবস্থা করা হয়। এই জন্যই ইহার নাম ‘অলীমা’।
বস্তুত বিবাহ উৎসবকে কেন্দ্র করিয়া কিংবা বিবাহন্তে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদিগকে দাওয়াত করিয়া খাওয়ানোর জন্য রাসূলে করীম (স) এই নির্দেশ দিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ************ ‘তুমি কি বিবাহ করিয়াছ’? বলিলেনঃ **** হ্যাঁ’। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ********* ‘তুমি কি অলীমা করিয়াছ’? বলিলেনঃ ‘না’।
****************************************
তখন রাসূলে করীম (স) একদানা পরিমাণ স্বর্ণ তাঁহার দিকে নিক্ষেপ করিলেন এবং বলিলেনঃ অলীমা কর- যদি একটি ছাগী দ্বারাও তাহা হয়।
কথার ধরন হইতেই স্পষ্ট হয় যে, একটি ছাগীদ্বারা অলীমার জিয়াফত খাওয়ানো কমসে-কম নিয়ম। অর্থাৎ বেশী কিছু করিতে না পারিলেও অন্তত একটি ছাগী যবেহ করিয়া অলীমা খাওয়াইতে হইবে। আর নবী করীম (স) যে একটি স্বর্ণ দানা তাহাকে দিলেন, ইহার তাৎপর্য এই যে, বর বা তাহার অভিভাবক নিজস্ব ব্যয়ে যদি অলীমার জিয়াফতের ব্যবস্থা করিতে অসমর্থ হয়, তাহা হইলে সমাজের লোকদের- অন্ততঃ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, মুরব্বী, সমাজপতি সর্বশেষ অবস্থায় সরকারের কর্তব্য হইল তাহার সাহায্য করা। নবী করীম (স) ইহারই পথ-নির্দেশ করিয়াছেন বাস্তব আদর্শ সংস্থাপন করিয়া।
হযরত আনাস (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) তাঁহার স্ত্রীগণের মধ্যে জয়নবের বিবাহে যে অলীমা করিয়াছেন সেইরূপ অলীমা অন্য কোন স্ত্রীর বিবাহে করেন নাই। তখন তিনি একটি ছাগী যবেহ করিয়া অলীমা করিয়াছেন।
অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছে, হযরত আনাস (রা) বলিয়াছেনঃ লোকদেরকে আহবান করার জন্য রাসূলে করম (স) আমাকে পাঠাইয়াছিলেন। পরে তিনি তাহাদিগকে পেট ভরিয়া গোশত রুটি খাওয়াইয়াছিলেন।
বুখারী গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
নবী করীম (স) তাঁহার কোন কোন স্ত্রীকে অধিক মর্যাদা দেওয়ার জন্যই অলীমা খাওয়ানোর এইরূপ পার্থক্য করিয়াছেন, তাহা নয়। বরং বিভিন্ন সময়ের বিবাহ কালে রাসূলে করীম (স)-এর আর্থিক সামর্থ্য কখনও সংকীর্ণ ছিল এবং কখনও প্রশস্ত ছিল, এই কারণেই এই রূপ হইয়াছে।
হযরত বুরাইদা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
হযরত আলী (রা) যখন হযরত ফাতিমা (রা)-কে বিবাহ করার প্রস্তাব দিয়াছিলেন, তখন নবী করীম (স) বলিয়াছিলেনঃ বিবাহে অলীমা করা একান্ত আবশ্যক।
ইবনে হাজার আল আসকালানী বলিয়াছেনঃ প্রথমে উদ্ধৃত মূল হাদীসটির সনদে কোন দোষ নাই। আর এই হাদীসটি একথাও প্রমাণ করে যে, অলীমা করা ওয়াজিব। অবশ্য ইবনে বাত্তাল বলিয়াছেন, অলীমা করাকে কেহ ওয়াজিব বলিয়াছেন, তাহা আমার জানা নাই। কিন্তু তিনি জানেন না বলিয়াই তাহা ওয়াজিব হইবে না, এমন কথা নয়। কাহারও অজ্ঞতা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ প্রমাণ করে না। অহশী ইবনে হারব-এর মরফু’ হাদীসের ভাষা এইরূপ (************) অলীমা সত্য-সপ্রমাণিত। ইহার সহিত বিভিন্ন লোকের হক জড়িত। বস্তুত বিবাহ একটা সামাজিক আনন্দ অনুষ্ঠান। এই সময় বর পক্ষের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং কনে পক্সের নিকটাত্মীয় ও আপনজনের হক বা অধিকার হয় বর পক্ষের নিকট হইতে জিয়াফত খাওয়ার আহবান পাওয়ার। এই হক বা অধিকার অবশ্যই পূরনীয়, পালনীয়। কিন্তু ইবনে বাত্তাল এই হাদীসেরও ভিন্ন অর্থ করিয়াছেন। তাঁহার মতে হাদীসের শব্দ ************ অর্থ ‘বাতিল নয়- ভিত্তিহীন নয়’। আর যাহা বাতিল বা ভিত্তিহীন নয়, তাহা বড়জোড় ‘মুস্তাহাব’ হইতে পারে। তাই উহাকে ********** ‘একটি মর্যাদাশীল সুন্নাত’ বা ‘রাসূলের একটি সম্মানযোগ্য রীতি’ বলা যাইতে পারে, ওয়াজিব নয়। উপরন্তু উহা সম্প্রতি সৃষ্ট একটি আনন্দমূলক ঘটনা সংশ্লিষ্ট জিয়াফত। ফলে ইহা অন্যান্য সাধারণ দাওয়াত-জিয়াফতের মতই একটি কাজ। (আল মুগনী-ইবনে কুদামাহ( আর ইহা করার জন্য যে আদেশ দেওয়া হইয়াছে, তাহা পালন করা ‘মুস্তাহাব’ মাত্র- ওয়াজিব নয়। আর রাসূলে করীম (স)-এর কথা ****** ‘একটি ছাগী দিয়া হইলেও’- ছাগী জবেহ করিয়া অলীমা করা যে ওয়াজিব নয়, ইহা তো সর্ববাদী সম্মত কথা। তবে জমহুর আলেমের মতে ইহা ‘সুন্নাতে মুয়াক্কাদা’।
কিন্তু ইহাও সর্বশেষ কথা নয়, কেননা আল্লাম বদরুদ্দীন আইনীর উদ্ধৃতি অনুযায়ী, শাফেয় মাযহাবের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে ইহা ওয়াজিব। কেননা নবী করীম (স) হযরত আবদুর রহমানকে ইহা করার জন্য আদেশ করিয়াছেন। আর হযরত আবদুর রহমানকে একটি ছাগী যবেহ করিয়া হইলেও অলীমা করার নির্দেশ দিয়াছেন, তাহার অর্থ এই নয় যে, অলীমার দাওয়াতে ইহার অধিক কিছু করা যাইবে না। হযরত আবদুর রহমানের আর্থিক অবস্থার বিচারে ইহা ছিল তাঁহার সামর্থ্যের সর্বনিম্ন পরিমাণ ব্যয়। অবশ্য কাহারও কাহারও মতে সদ্য হিজরতকারী সাহাবীদের আর্থিক অস্বচ্চলতা বরং সংকটের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই এইরূপ বলা হইয়াছে। উত্তরকালে সাহাবীদের আর্থিক অবস্থায় যখন প্রশস্ততা আসে, তখন অলীমা’র ব্যয়-পরিমাণেও প্রশস্ততা আসে।
(****************)
অলীমা’র সময়
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ প্রথম দিনের দাওয়াত সত্য, দ্বিতীয় দিনের দাওয়াত সুন্নাত, তৃতীয় দিনের দাওয়াত প্রদর্শনমূলক। আর যে লোক দান ও বদান্যতা ইত্যাদি করিয়া নিজেকে বিখ্যাত করিতে বা গৌরব অহংকার প্রকাশ করিতে চাহিবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাহাকে মিথ্যুক প্রদর্শনকারী লোকদের মধ্যে প্রখ্যাত করিবেন।
(তিরমিযী, আবূ দায়ূদ, ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী জিয়াদ ইবনে আবদুল্লাহ। ইমাম তিরমিযী বলিয়াছেন, এই হাদীসটি কেবলমাত্র জিয়াদ ইবনে আবদুল্লাহর সূত্রেই মরফূ’। ইবনে হাজার আল-আসকালানী বলিয়াছেন, তাঁহার বর্ণিত হাদীসকে দলীলরূপে গ্রহণ করা যায় না। ইহা ছাড়াও তিনি ইহা আতা’র নিকট শুনিয়াছিলেন এমন সময় যখন তাঁহার স্মৃতি শক্তি প্রখরতা হারাইয়া ফেলিয়াছিল। সম্ভবত তাঁহার বর্ণিত হাদীস দলীলরূপে গ্রহণ করিতে এবং জন্যই আপত্তি উঠিয়াছে। কিন্তু এই পর্যায়ে ইহাই একক হাদীস নয়। ইহার সমর্থক ********* আরও হাদীস রহিয়াছে। ফলে এই একই বিষয়ে বর্ণিত বহু কয়টি হাদীসের সমষ্টি একথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, এই সব হাদীসের মূল কথা ও প্রতিপাদ্য মোটেই অমূলক ও ভিত্তিহীন নয়। ইহার একটি ভিত্তি থাকা এবং রাসূলে করীম (স) এইরূপ কথা বলিয়াছেন, এইরূপ বিশ্বাস করার যৌক্তিকতা কোন ক্রমেই অস্বীকার করা যায় না- ইহাও হাদীস শাস্ত্রেরই সর্বজন স্বীকৃত নীতি।
হাদীসিটতে বলা হইয়াছে, প্রথম দিনের জিয়াফত হক। অর্থাৎ একান্ত্রভাবে প্রমাণিত, অনিবার্য কর্তব্য, জরুরী ভিত্তিতে পালনীয়। এক কথায় ওয়াজিব। প্রথম দিন বলিতে বিবাহ হওয়ার দিন। যাঁহারা মনে করেন, অলীমা করা ওয়াজিব বা অন্তত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, ইহা তাহাদের মত। তাঁহারা রাসূলে করীম (স)-এর এই কথা হইতে বুঝিয়াছেন যে, অলীমা করা ওয়াজিব। ইহা তরক করা নিতান্তই অন্যায় ও দোষনীয়। ইহা না করিলে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করিতে হইবে। যদিও সেজন্য শাস্তি হওয়াটা অনিবার্য বা অবধারিত নয়। আল্লামা আইনী লিখিয়াছেনঃ অলীমা করার উপযুক্ত সময় সম্পর্কে প্রাচীন কাল হইতেই শরীয়াতবিদদের বিভিন্ন মত রহিয়াছে। প্রশ্ন উঠিয়াছে, ইহা কখন করিতে হইবে? বিবাহের আকদ হওয়ার সময়? কিংবা উহার পর-পরই? অথবা প্রথম মিলন বা বাসর ঘর অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন? না উহার পর অথবা বিবাহের আকদ হওয়ার সময় হইতে স্বামী-স্ত্রী মিলন ও প্রথম বাসর ঘর উদযাপনের দিন পর্যন্ত অলীমা করার সময়টি বিস্তীর্ণ ও সম্প্রসারিত- ইহার মধ্যে যে কোন সময় করিলেই চলিবে? ইমাম নববীও এই মত-বিরোধের উল্লেখ করিয়াছেন। কাযী ইয়ায কোন সময় করিলেই চলিবে? ইমাম নববীও এই মত-বিরোধের উল্লেখ করিয়াছেন। কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, মালিকী মাযহাব মতে স্বামী-স্ত্রী মিলন সংঘটিত হওয়ার পর এই দাওয়াত হওয়া মুস্তাহাব- অর্থাৎ ইহাই পছন্দনীয় সময়। এই মালিকী মাযহাবের অনেকে আবার বিবাহের আকদ হওয়ার সময়টিই ঠিক সময় বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ইবনে হুবাইবের মতে হয় আকদ হওয়ার সময় করিতে হইবে, নতুবা করতে হইবে মিলন হওয়ার পর। অন্যত্র বলা হইয়াছে, মিলনের পূর্বে বা পরে যে কোন সময়ই করা যাইতে পারে। আল্লামা মা-আর্দি বলিয়াছেন, মিলন-সময়ই ঠিক সময়। হযরত আনাস বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) জয়নাবের সঙ্গে বাসর রাত্রি উদযাপন করার পর সকাল বেলা লোকদের দাওয়াত করিলেন।
ইহা হইতে বুঝা যায়, অলীমা মিলন হওয়ার পর অনুষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে বর্তমান মুসলিম সমাজের রেওয়াজ হইল, বর যাত্রীরা কন্যার পিত্রালয়ে গমন করে কনেকে তুলিয়া আনার জন্য। সেখানে কন্যা পক্ষ হইতে বর পক্ষকে জিয়াফত দেওয়া হয়। পরে কনেকে বাড়ীতে লইয়া আসার দিন কিংবা উহার পর ২-৩ দিনের মধ্যে প্রথম সুযোগেই বর পক্ষ অলীমা’র জিয়াফত করে, ইহা সর্বদিক দিয়া শরীয়াত সম্মত কাজ।
দ্বিতীয় দিনের জিয়াফন সুন্নাত। আবূ দায়ুদে বর্ণিত হাদীসের ভাষা হইলঃ ************ বিবাহ উপলক্ষে প্রথম দিনের জিয়াফতটাই অলীমা, দ্বিতীয় দিনের খাওয়ানোটা চলতি রীতি’। অর্থাৎ ইহাতে কোন দোষ নাই। আর তৃতীয় দিনের জিয়াফত খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যমূলক। লোকেরা জানিতে পারে যে, অমুকের বিবাহের পর পর তিন দিন পর্যন্ত লোকদিগকে খাওয়ানো হইয়াছে। সে যে একজন বড় ও নামকরা দানশীল, লোকদিগকে খুব খাওয়ায়, এই সুনাম ও সুখ্যাতি চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িবে, এই খাওয়ানো ঠিক সেই উদ্দেশ্যে এবং এই উদ্দেশ্য ছাড়া তিন দিন ধরিয়অ খাওয়ানের কোন কারণ বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে থাকিতে পারে না। এই কারণে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাহাকে এই শাস্তিই দিবেন যে, যে মিথ্যাবাদী ও খ্যাতি লোভী বলিয়া চিহ্নিত হইবে এবং আল্লাত তা’আলা লোকদিগকে জানাইয়া দিবেন যে, এইলোকটি রিয়াকার, লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ও সুনাম পাওয়ার অসৎ মতলবে কাজ করিয়াছে- লোকদিগকে খাওয়াইয়াছে। ইহার ফলে লোকদের নিকট সে অকথ্যভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হইবে। আল্লামা তাইয়্যেবী বলিয়াছেনঃ
****************************************
আল্লাহ তা’আলা যদি কাহাকেও নিয়ামত দান স্বরূপ ধন-ঐশ্বর্য দেন, তবে সেজন্য তাহার প্রকাশ হওয়া উচিত আল্লাহর শোকর স্বরূপ। দ্বিতীয় দিনের খাওয়ানো দ্বারা প্রথম দিনের খাওয়ানোর যে অসম্পূর্ণতা রহিয়া গিয়াছে, তাহার ক্ষতিপূরণ হইয়া যায়। আর সুন্নাত তো সব সময় ওয়াজিবের পূর্ণতা বিধায়ক- পরিপূরক। অতঃপর তৃতীয় দিনেও খাওয়ানো হইলে তাহা নিতান্তই রিয়াকারীমূলক ও খ্যাতিলাভের মতলব প্রসূত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
অতএব প্রথম দিনে যাহাদিগকে আহবান করা হইবে, তাহাদের দাওয়াত কবুল করা ওয়াজিব। দ্বিতখীয় দিনেরও দাওয়াত হইলে তাহা রক্ষা করা সুন্নাত। কিন্তু তৃতীয় দিনেও সে দাওয়াত হইলে তাহা কবুলকরা শুধু মাকরূহ নয়- হারাম।
মূল্লা আলী আল-কারী লিখিয়াছেন, মালিকী মাযহাবের লোকদের অলীমার দাওয়াত ক্রমাগত সাত দিন পর্যন্ত কবুল করা মুস্তাহাব। কিন্তু আলোচ্য হাদীস এই কথার প্রতিবাদ করে। এই উক্তি সম্পর্কে বক্তব্য হইল, মালিকী মাযহাবের লোকদের এই মতটি নিতান্ত ভিত্তিহীন নয়। হাফসা বিনতে শিরীন বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমার পিতা যখন বিবাহ করিয়াছিলেন, তখন তিনি সাতদন পর্যন্ত সাহাবায়ে কিরাম ( রা) কে জিয়াফত খাওয়াইয়াছেন। যে দিন আনসারগণ নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন, সে দিন হযরত উবাই ইবনে কায়াব ও জায়দ ইবনে সাবিত (রা) কে আহবান করিলেন। এইদিন আমার পিতা রোযাদার ছিলেন। উপস্থিত লোকেরা যখন খাওয়া দাওয়া সমাপ্ত করিলেন, তখন আমার পিতা দোয়া করিলেন ও আল্লাহর হামদ-সানা করিলেন।
আবদুর রাজ্জাক উদ্ধৃত এই বর্ণনাটিতে তিন দিনের পরিবর্তে সাত দিনের উল্লেখ হইয়াছে। সম্ভবত এই বর্ণনাটিই মালিকী মাযহাবের লোকদের উপরোক্ত মতের ভিত্তি। (ফতহুল বারী) ইমাম বুখারীও এই মত সমর্থন করিয়াছেন। তিনি বুখারী শরীফে এ পর্যায়ে হাদীস সমূহের শিরোনামায় দিয়াছন এই ভাষায়ঃ
****************************************
অলীমার দাওয়াত কবুল করা কর্তব্য এবং সাত দিন বা এই রকম সময় পর্যন্ত অলীমা করা সম্পর্কিত অধ্যায়।
সেই সঙ্গে ইহাও বলিয়াছেন যে, অলীমা একদিন করা হইবে কি দুইদিন এমন নির্দিষ্ট করা কোন কথা নবী করীম (স) বলেন নাই। ইহাতে আলোচ্য হাদীসটি যায়ীফ হওয়ার ইংগিত থাকিলেও যেহেতু এই পর্যায়ে বহু কয়টি হাদীস বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে, সেই জন্য উহার কোন না কোন ভিত্তি আছে বলিয়া বিশ্বাস করিতে হইবে। আলোচ্য হাদীস অনুযায়ী শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীরা আমল করেন। কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, অলীমার জিয়াফত খাওয়ানো এক সপ্তাহকাল চলাটা অপছন্দীয় নয়। অবশ্য ইহা কেবলমাত্র বিপুল ঐশ্বর্যশালী লোকদের পক্ষেই সম্ভব। তবে সেজন্য অনেকে এই শর্তের উল্লেখ করিয়অছেন যে, এই সাতদিন পর্যন্ত একই লোকদিগকে না খাওয়াইয়া প্রত্যেক দিন নূতন নূতন লোককে খাওয়াইতে হইবে। একবার যাহারা খাইয়াছে, তাহাদিগকে বার বার খাওয়ানো চলিবে না। আলোচ্য হাদীস অনুযায়ী তৃতীয় ও উহার পরবর্তী দিনগুলি খাওয়ানো নিষিদ্ধ বলিব শুধু তখন, যদি ইহা অকারণ করা হইবে এবং কেবলমাত্র সুনাম সুখ্যাতি লাভই ইহার উদ্দেশ্যে হইবে এবং তাহা যদি হয় বর পক্ষের প্রকৃত আর্থিক সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও- ঋণ করিয়া বা জমি বন্ধক দিয়া ইত্যাদি।
(*****************)
অলীমার দাওয়াত কবুল করা
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদিগকে যখন দাওয়াত করা হইবে, তখন তোমরা সে দাওয়াতে উপস্থিতত হও। (তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ তিরমিযী উদ্ধৃত এই হাদীসটির মোটামুটি অর্থ এই যে, কোন দাওয়াত পাওয়া মাত্র তাহা কবুল করা এবং সেই অনুযায়ী দাওয়াতকারী কর্তৃক নির্দিষ্ট স্থানে কিংবা তাহার বাড়ীতে উপস্থিত হওয়অ কর্তব্য। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে কোন দাওয়াতের কথা নির্দিষ্ট করা না হইলেও ইমাম নববী বলিয়াছেন, এই হাদীসে খাওয়ার দাওয়াতের কথা বলা হইয়াছে। এই কারণে হাদীসবিদগণ বলিয়াছেনঃ
****************************************
প্রত্যেক প্রকারের দাওয়াতই কবুল করা ও তদানুযায়ী উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব- তাহা বিবাহের দাওয়াত হউক বা অন্য কিছু, এই হাদীসটি-ই এই কথার দলীল।
মুসলিম শরীফে এই হাদীসটির ভাষা হইলঃ
তোমাদের কেহ যখন অলীমা উপলক্ষে নিমন্ত্রিত হবে, তাহার উচিত তাহাতে উপস্থিত হওয়া।
শাফেয়ী মাযহাবের কোন কোন লোক এই হাদীসের ভিত্তিতেই এই মত গ্রহণ ও প্রকাশ করিয়াছেন যে, দাওয়াত মাত্রই কবুল করা ওয়াজিব, তাহা বিবাহের উপলক্ষে খাওয়ার দাওয়াত হউক কি অন্য কিছুর। ইবনে হাজামের মতে জমহুর সাহাবী ও তাবেয়ীনেরও ইহাই মত। হযরত ইবনে উমর (রা) একজন লোককে খাওয়ার দাওয়াত করিলেন। তিনি বলিলেন ************* ‘আমাকে মাফ করুন’। ইহা শুনিয়অ হযরত ইবনে উমর বলিলেনঃ ***************** ‘না ইহা হইতে আপনার জন্য কোন ক্ষমা নাই- উঠুন চলুন’। ইবনে সাফওয়ান হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) কে দাওয়াত করিলেন। তিনি বলিলেনঃ ************ ‘আমাকে আপনি যদি ক্ষমা না-ই করেন, তাহা হইলে আসিব’। অলীমার দাওয়াত সম্পর্কে এই কথা। কিন্তু অলীমার দাওয়াত ছাড়া অন্যান্য দাওয়াতে কবুল করা ও উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব নয় বলিয়া মালিকী, হানাফী, হাম্বলী ও জমহুর শাফেয়ীগণ মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম সরখসী এই ব্যাপারে চূড়ান্ত মত দিয়াছেন এই বলিয়া যে, ইহাতে ইজমা হইয়াছে। ইমাম শাফেয়ীর কথা হইলঃ *************** ‘অলীমার দাওয়াত গ্রহণ ও তাহাতে উপস্থিত অবশ্য কর্তব্য’। আর অলিমা বলিতে সাধারণত বিবাহের দাওয়াতকেই বুঝায়। আর সাধারণভাবে যে জিয়াফতেই লোকদেরকে আহবান করা হয়, তাহাই অলীমা। কাজেই উহা প্রত্যাখ্যঅন করা ও উহাতে না যাওয়ার অধিকার কাহারও নাই। যদি কেহ তাহা প্রথ্যাখ্যান করে তবে সে গুনাহগার হইবে কিনা তাহা অবশ্য স্পষ্টভাবে জানা যায় নাই। কিন্তু অলীমার দাওয়াত সম্পর্কে একথা পরিষ্কার যে, তাহা কবুল না করিলে গুনাহগার হইতে হইবে। আর অলীমা বলিলেই তাহা বিবাহ উপলক্ষে খাওয়া বুঝাইবে। ইহা একটি সাধারণ কথা।
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, যে অলীমা রদাওয়অতে বাছিয়অ বাছিয়া কেবলমাত্র ধনী লোকদিগকে আহবান করা হয় এবং গরীব লোকদিগকে আহবান করা হয় না, সে অলীমার খাবার নিকৃষ্টতম খাবার। আর যে লোক অলীমার দাওয়াত কবুল করে না ও উহাতে যায় না, সে আল্লাহ এব তাঁহার রাসূলেরই নাফরমানী করে।
(বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটিতে মোট দুইটি কথা বলা হইয়াছে। একটি হইল অলীমার খাওয়ায় লোকদিগকে দাওয়াত করার নীতি কি হইবে এবং দ্বিতীয় অলীমার দাওয়াত কবুল করা সম্পর্কে।
প্রথম পর্যায়ে বলা হইয়অছে, যে অলীমার জিয়াফতে বাছিয়া বাছিয়া কেবলমাত্র ধনী ও সচ্ছল অবস্থার লোকদিগকে আহবান করা হয়, গরীব লোকদিগকে দাওয়াত করা হয় না, গরীব লোকদের পক্ষে সেখানে ‘প্রবেশ নিষেধ’, সে অলীমায় যত মূল্যবান খাবারেরই ব্যবস্থা করা হউক না কেন, তাহা নিকৃষ্টতম খাবার। ইহার কারণ এই যে, একেতো ইহা জাহিলিয়াতের রসম ও রেওয়াজ। ইসলামের পূর্বে তদানীন্তন আরব সমাজে এই প্রচলন ছিল যে, ধনী লেঅকেরা বিরাট-বিরাট ও অতিশয় জাঁকজমক পূর্ণ বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠান করিত এবং অলীমার দাওয়াতে কেবলমাত্র ধনী লোকদিগকেই শরীক হওয়ার জন্য আহবান করা হইত। গরবী লোকদিগকে আদৌ দাওয়াত ক রা হইত না। এইভাবে কেবল ধনী লোকদিগকে খাওয়ানো ও গরীব লোকদিগকে তাহা হইতে বঞ্চিত রাখা অতিশয় হীন মানসিকতার লক্ষণ। ইহা মানবতার প্রতি চরম অবমাননাও বটে। ইসলাম এই মানসিকতার মূলোৎপাটন করিয়াছে এবং এইরূপ কেবল ধনীদের জন্য অলীমার অনুষ্ঠান করাকে হারাম করা হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ এইরূপ নীতির দ্বারা নির্বিশেষ শ্রেণীহীন মানব সমাজকে সরাসরি দুইটি ভাগে বিভক্ত করিয়া দেওয়া হয়। এক শ্রেণীর লোক শুধু ধনী। আর এক শ্রেণীল লোক সর্বহারা- গরীব। ধনী শ্রেণীর লোকেরা যাবতীয় আনন্দ-উৎসব নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। তাহাতে সর্বহারা শ্রেণীর লোকদের প্রবেশানুমতি নাই। আর সর্বহারা শ্রেণীর লোকদের পক্ষে যেহেতু এই ধরনের জাঁকজমক পূর্ণ আনন্দ অনুষ্ঠান করা সম্ভবপর হয় না, এই কারণে এরূপ শ্রেণী কেন্দ্রিক দাওয়াত অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের মধ্যে খুব তীব্র হইয়া দেখা দেয়। তাহারা স্বাভাবিকভাবেই মনে করিতে শুরু করে, আমরা বুঝি মানুষ নহি। আমাদেরই সম্মুখে এতবড় অলীমার জিয়অফতের অনুষ্ঠাহ হইয়া গেল। অথ তাহাতে আমাদিগকে দাওয়াত দেয়া হইল না কেবলমাত্র এই কারণ যে, আমরা গরীব। ফলে তাহাদের হৃদয়-মনে যে ক্ষোভ দেখা দেয়, তাহাই বিক্ষোভের উদ্ভব করে এবং বিক্ষোভের ও বঞ্চনা-অনুভূতির ফলে তীব্র আক্রোশ ও প্রতিহিংসার সৃষ্টি করে। ইহার দরুন যে সামষ্টিক অশান্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাহাকেই বলা হয় শ্রেণী বিদ্বেষ। ইহারই অনিবার্য পরিণতি শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রেণী সংঘর্ষ। আর যে সমাজে একবার এই শ্রেণী বিদ্বেষ ও শ্রেণী সংগ্রাম সূচিত হয়, সে সমাজে চরম ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দেওয়া অনিবার্য হইয়া পড়ে। এই প্রেক্ষিতেই নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটির তাৎপর্য অনুধাবনীয়ঃ
****************************************
হযরত ইবনে আব্বসা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
যে অলীমায় কেবলমাত্র পেট ভরা পরিতৃপ্ত লোকদিগকেই খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেওয়া হয় এবং অভুক্ত ক্ষুধর্ত লোকদিগকে তাহাতে শরীক হইতে বাধাগ্রস্ত করা হয়, সেই খাবার অত্যন্ত খারাপ ধরনের- নিকৃষ্টতম খাবার।
বস্তুত মূল খাবারে তো কোন কারাবী বা দোষ প্রবেশ করে নাই। আসল দোষ হইল লোকদিগকে খাওয়ানের এই নিয়ম ও দৃষ্টিভঙ্গীতে। কেননা ইহা বিদ্বেষমূলক ও বিভেদকারী রসম। তেলা মাথায় তেল ঢালার ও তেলহীন মাথাকে তেল বঞ্চিত রাখার দৃষ্টিভঙ্গী। এই দৃষ্টিভঙ্গী মানবতার জন্য কখনই কল্যাণকর হইতে পারে না। দূর অতীত কাল হইতে বর্তমান এবং বর্তমান হইতে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত এই হীন ও বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা ও দৃষ্টি ভঙ্গীর বিরুদ্ধে ইসলামের সংগ্রাম অভিযান অব্যাহত, অবিশ্রান্ত ও শাশ্বত। কাজেই শুধু অলীমারই নয়, সর্বপ্রকারের দাওয়াতেই ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত দেওয়া ও শেষোক্তদের দাওয়াত না দেওয়ার নীতি বর্বর জাহিলিয়াত ছাড়া আর কিছুই নয়।
দ্বিতীয় বলা হইয়াছে, অলীমা’র দাওয়াত পাইলে তাহা কবুল করা ও সে দাওয়াত অনুযায়ী উপস্থিত হওয়া একান্তই কর্তব্য। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসের ভাষা অত্যন্ত তীব্র ও কঠোর। তাহাতে বলা হইয়াছেঃ দাওয়াত পাইয়া যে তাহা কবুল করে না ও উপস্থিত হয় না, সে আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের নাফরমানী করে। ইহার কারণ এই যে, আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূল (স) এই সব দাওয়াতে উপস্থিতত হওয়ার নির্দেশ দিয়াছেন। আর সে কার্যত উহা পালন করে নাই, দাওয়াতে উপস্থিত না হইয়া সে আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের আদেশ অমান্য করিয়াছে।
ইহা হইতে বুঝা যায়, অলীমা’র দাওয়াত কবুল করা- কথা ও বাস্তব উভয় দিক দিয়াই ওয়াজিব। *********** ‘নাফরমানী’ শব্দটি কেবল ওয়াজিব তরক করা সম্পর্কেই প্রযোজ্য। ওয়াজিব কাজ করা না হইলেই বলা যায়, নাফরমানী করা হইয়াছে। আর ইবনে আবদুল বার, কাযী ইয়ায ও নববী প্রমুখ হাদীসবিশারদ মনীষীগণ ইহার ওয়াজিব হওয়া বিষয়ে সম্পূর্ণ মতৈক্য প্রকাশ করিয়াছেন।
এই পর্যায়ের আর একটি হাদীসঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে অলীমার জিয়াফতে সেই লোকদিগকে আসিতে নিষেধ করা যাহারা এই ধরনের দাওয়াতে সাধারণত অসিতে অভ্যস্থ- আসে এবং আহবান জানানো হয় সেই লোকদিগকে, যাহারা উহা অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করে। আর যে লোক দাওয়াত কবুল করে না, দাওয়াতে উপস্থিত হয় না, সে আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের নাফরমানী করে
এই হাদীসটি ‘মরফু-মুত্তাসিল’ অর্থাৎ রাসূলে করীম (স) এর কথা, সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত এবং সনদের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন, সুরক্ষিত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বিবাহের অলীমা ও অন্যান্য সকল প্রকারের দাওয়াতই কবুল করিতেন এবং অনেক সময় তিনি রোযাদার হইয়াও তাহাতে উপস্থিত হইতেন। হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
দাওয়াতে উপস্থিত তো হইবে। তাহার পর রোযাদার না হইলে সে খাইবে, আর রোযাদার হইলে যুগল দম্পতির জন্য সে দোয়া করিবে।
স্ত্রীর সহিত প্রথম সাক্ষাতের পর দোয়া
****************************************
জায়দ ইবনে আসলাম হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের কেহ যখন বিবাহ করে কিংবা কোন দাসী ক্রয় করে তখন (তাহার সহিত প্রথম সাক্ষাতের কালে) তাহার মাথার অগ্রভাগের উপর হাত রাখা ও বরকতের জন্য দোয়া করা তাহার কর্তব্য। আর তোমাদের কেহ যখন কোন উট (গরু বা মহিষ) খরীদ করে, তখন উহার চুটে’র উপর হাত রাখিয়া শয়তান হইতে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া উচিত।
(মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি মুয়াত্তা ইমাম মালিক হইতে গ্রহীত। জায়দ ইবনে আসলাম সাহাবী নহেন। তিনি একজন তাবেয়ী। তাবেয়ী লোকের সরাসরিভাবে রাসূলের কথা বর্ণনা করা ও যে সাহাবী রাসূলের নিকট এই কথাতিট প্রথম শুনিয়াছিলেন তাঁহার নাম উল্লেখ না করাকে ******** বলা হয় ও এই হাদীসকে বলা হয় ‘মুরসাল’। এই হিসাবে উপরোদ্ধৃত হাদীসটি ‘মুরসাল’। ইবনে আবদুল বার বলিয়াছেন, আম্বাসা ইবনে আবদুর রহমানও এই হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন; কিন্তু তিনি এই হাদীসের প্রথম বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম উল্লেখ করিয়াছেন। সেই হিসাবে তাঁহার বর্ণনার সনদ ‘মুত্তাসিল’ (***********)। ‘তবে আম্বাসা যয়ীফ বর্ণনাকারী।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবূ লাসআল-খাজায়ী হইতেও এই হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে। তবে উহার ভাষা ইহা হইতে কিছুটা ভিন্নতর। ইবনে মাজাহ উদ্ধৃত ‘আমর ইবনে শুয়াইব- তাঁহার পিতা হইতে- তাহার দাদা হইতে- এই সনদে হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে, তাহাতে **************- এর স্থলে ************ উদ্ধৃত হইয়াছে।
এই কথার অপর একটি বর্ণনার ভাষা এইরূপঃ
****************************************
তোমাদের কেহ যখন স্ত্রী গ্রহণ (বিবাহ) করে, কিংবা কোন সেবক (দাস) ক্রয় (নিয়োস) করে, তখন যেন সে তাহার মাথার অগ্রভাসে হাত রাখিয়া মহান আল্লাহর নাম উচ্চারণ করিয়া বরকতের জন্য দোয়া করে। এই সময় যেন সে বলে, হে আল্লাহ আমি ইহার অনিষ্ট দুষ্কৃতি ও যে স্বভাব-প্রকৃতি দিয়া তুমি ইহাকে সৃষ্টি করিয়াছ উহার অনিষ্ঠ ও ক্ষতি হইতে তোমার নিকট আশ্রয় চাহি।
রীতি অনুযায়ী একটা হইল ইজাব-কবুল- বিবাহের আকদ। আর একটা হইল স্ত্রীর সহিত প্রথম সাক্ষাৎকার। আলোচ্য হাদীসে যে দোয়া করিতে বলা হইয়াছে, তাহা নিশ্চয়ই স্ত্রীর সহিত নিবিড় নিভৃত একাকীত্বে প্রথম সাক্ষাৎকারের সময়ই হইতে পারে, তাহার পূর্বে নয়।
বরকতের দোয়া অর্থ, স্ত্রীর কপালের উচ্চ-অগ্রভাগের উপর হাত রাখিয়া এইরূপ দোয়া করাঃ
****************************************
হে আল্লাহ! আমার জন্য এই স্ত্রীতে বরকত দাও এবং উহার উপরও বরকত বর্ষণ কর।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর বর্ণনায় দোয়ার ভাষা এইঃ
****************************************
হে আমাদের আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ইহার সার্বিক কল্যাণ পাইতে চাহি এবং তুমি যে মৌল প্রকৃতির উপর উহাকে সৃষ্টি করিয়াছ, তাহার কল্যাণ তোমার নিকট প্রার্থনা করি। আর আমি তোমার নিকট পানাহ চাহি ইহার সর্বপ্রকার অনিষ্ট ও অনিষ্টকারিতা হইতে এবং তুমি তাহাকে যে প্রকৃতির উপর সৃষ্টি করিয়াছ উহার ক্ষতি ও অনিষ্ট হইতে।
আর যখন উষ্ট (গরু ছাগল মহিষ) ইত্যাদি খরীদ করিবে তখন উহার পৃষ্ঠদেশের উচ্চ স্থানে হাত রাখিয়া শয়তানের শয়তানী প্রভাব হইতে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া উচিত। এই পানাহ চাওয়ার কাজটি হইবে তখন যখন খরীদ করা হইয়া যাইবে ও মালিক জন্তুটি ক্রয়কারীর হাতে হস্তান্তরিত করিয়া দিবে। ইহার কারণ এই যে, জন্তু-জানোয়ারের উপর শয়তানের অনেকটা কর্তৃত্ব স্থাপিত হইয়া থাকে। কিন্তু যখন আল্লাহর নাম ও ‘আয়ুযুবিল্লাহ’ উচ্চারিত হয়, তখন শয়তান পালাইয়া যায়। হযরত ইবনে উমরের বর্ণনামতে এইখানেও পূর্বোদ্ধৃত দোয়া পাঠ করিতে বলা হইয়াছে।
বস্তুত স্ত্রীর সহিত প্রথম সাক্ষাৎকালে উক্তরূপ দোয়া করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা স্ত্রীর কারণেই সাধারণত দাম্পত্য জীবন সুখেরও হয়, হয় দুঃখেরও। অথচ এই স্ত্রীকে লইয়া সারাটি জীবন অতিবাহিত করিতে হয়। পরবর্তী বংশের ধারা তাহার গর্ভজাত সন্তান হইতেই অগ্রসর হইতে থাকে। সেই বংশের ভাল বা মন্দ হওয়া অনেকখানি স্ত্রীর উপরই নির্ভর করে।
(*******************)
নব দম্পতির প্রথম সাক্ষাৎ ও নিভৃত একাকীত্বে প্রথম মিলনকালে নফল নামায পড়ার কথাও একটি হাদীসে উল্লেখিত হইয়াছে। আবূ উমাইদের মুক্ত দাস আবূ সায়ীদ একজন তাবেয়ী। তিনি বলিয়াছেনঃ আমি বিবাহ কলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবূ যার গিফারী ও হুযাইফা (রা) প্রমুখ সাহাবীগণকে আহবান করিলাম। তখন তাঁহারা আমাকে বলিলেনঃ
****************************************
তোমার নিভৃত ঘরে তোমার স্ত্রী যখন প্রবেশ করিবে, তখন তুমি দুই রাকআত নামায পড়িবে। অতঃপর তোমার ঘরে যাহা প্রবেশ করিয়াছে উহার কল্যাণ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর এবং উহার অনিষ্ট হইত তাঁহার নিকট পানাহ চাও। তাহার পর তুমি ও তোমার স্ত্রীর যাহা ইচ্ছা তাহাই করিবে।
মনে রাখা আবশ্যক, এই বক্তব্যটি স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-এর নয়, ইহা সাহাবীগণের কথা। এই হাদীসটির সনদ সহীহ বলা হইয়াছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ স্ত্রী যখন তাহার স্বামীর নিভৃত কক্ষে প্রথম প্রবেশ করিবে, তখন স্বামী দাঁড়াইবে এবং স্ত্রী তাহার পিছনে দাঁড়াইবে। অতঃপর দুইজনেই একত্রে দুই রাকআত (নফল) নামায পড়িবে। আর এই বলিয়া দোয়া করিবে; হে আমাদের আল্লাহ! আমার পরিবারবর্গে আমাকে বরকত দাও এবং আমাকে বরকত দাও আমার পরিবারবর্গের জন্য। হে আল্লাহ! আমার মাধ্যমে তুমি তাহাদিগকে রিযিক দাও, আর আমাকে রিযিক দাও তাহাদের মাধ্যমে। হে আল্লাহ! আমাদিগকে তুমি যতক্ষণ একত্রিত রাখিবে, কল্যাণের মধ্যে রাখিও। আর যখন তুমিই বিচ্ছিন্ন করিবে, তখনও কল্যাণের মধ্যেই বিচ্ছন্ন করিও।
(ইবনে আবূ শাইবাহ, তাবারানী)
মুহাদ্দিসদের মতে হাদীসটির সনদ সহীহ।
এই পর্যায়ে আরও একটি কথা স্মরনীয়। আর তাহা হইল, স্ত্রীর সহিত প্রথম সাক্ষাৎকারে করে যেমন সুসজ্জিত থাকে, অনুরূপভাবে, পুরুষটিরও উচিত বর হিসাবে যথা সম্ভব সুসজ্জিত হইয়া কনের সম্মুখে উপস্থিত হওয়া। এই বিষয়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর একটি উক্তি উল্লেখ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমি অবশ্যই আমার স্ত্রীর (সন্তুস্টির) জন্য সুসাজে সজ্জিত হইব যেমন সে আমার (সন্তুষ্টির) জন্য সুসাজে সজ্জিত হইয়াছে। উপরন্তু তাহার উপর আমার যা কিছু অধিকার আছে তাহা সবই সম্পূর্ণরূপে আমি আদায় করিয়া লইতে চাহি। তাহা হইলে সেও আমার নিকট হইতে তাহার পাওনা সম্পূর্ণ মাত্রায় আদায় করিয়া লইবে।
(কুরতুবী)
নারী প্রকৃতির রহস্য
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) হইতে, তিনি বলিয়াছেনঃ যে লোক আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার, সে যেন তাহার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয় আর তোমরা স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও। কেননা তাহারা পাঁজড়ের হাড় হইতে সৃষ্ট। আর পাঁজড়ের হাড়ের উচ্চ দিকটাই বেশী বাঁকা। তুমি যদি উহাকে সোজা করিতে যাও, তাহা হইলে উহাকে চূর্ণ করিয়অ ফেলিবে। আর উহাকে যদি এমনিই ছাড়িয়া দাও, তাহা হইলে উহা চিরকাল বাঁকা-ই থাকিবে। অতএব তোমরা মেয়েদের প্রতি কল্যাণকামী হও।
(বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী)
ব্যাখ্যাঃ পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিতে হাদীসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইহাতে সাধারণভাবে স্ত্রীলোকদের কল্যাণ কামনার কথা বিশেষ তাকীদ সহকারে বলা হইয়াছে, বলা হইয়াছে প্রতিবেশীকে কোনরূপ কষ্ট না দেওয়ার কথা এবং সর্বোপরি ইহাতে নারী-প্রকৃতি সম্পর্কে এক গভীর সুক্ষ্ম তত্ত্ব কথা বলা হইয়াছে। কথাগুলি বিস্তারিত বিশ্লেষণ সাপেক্ষ।
হাদীসটির সূচনাতেই বলা হইয়াছে, যে লোক আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার, সে যেন তাহার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। অন্য কথায় সৃষ্টিলোকের সূচনা কিরূপে হইল, মানুষ কিভাবে অস্তিত্ব ও জীবন লাভ করিল এ বিষয়ে ইসলামের দেওয়া আকীদা বিশ্বাস করিলে সে কখনও প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতে পারে না। কেননা, ইসলামের ঘোষণা হইল, কিছুই ছিল না, এক আল্লাহ ছাড়া। তিনিই প্রথম নিজ ইচ্ছা ও কুদরতে এই বিশ্বকে সৃষ্টি করিয়াছেন। মানুষকেও তিনিটি জীবন ও অস্তিত্ব দিয়াছেন। আর মানুষ হিসাবে দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে একই বংশজাত সন্তান রূপে সৃষ্টি করিয়াছেন। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন সামাজিক জীব হিসাবে। সমাজবদ্ধ হইয়া বসবাস করিতে মানুষ নানা দিকদিয়াই বাধ্য। অতএব মানুষের পাশে মানুষের অবস্থান এক স্বাভাবিক ও অপরিহার্য ব্যাপার। তাহা সম্ভব হইতে পারে কেবল তখন তিনি যদি পাশাপাশি বসবাসকারী লোকেরা পরস্পরকে কোনরূপ কষ্ট ও যন্ত্রণা না দেয়। যদি দেয়, তাহা হইলে ইহা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, সে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনিতে পারে নাই। কেননা যদি আল্লাহর প্রতি ঈমানদার হইত, তাহা হইলে প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রতিবেশীকে আল্লাহর সৃষ্ট ও একই মানব বংশজাত মনে করিয়া তাহাকে ভাই বলিয়া বুকে জড়াইয়া রাখিত, তাহাকে জ্বালা যন্ত্রণা দেওয়ার কোন কাজই সে করিতে পারিবে না। তবে প্রতিবেশীকে জ্বালা যন্ত্রণা দেয় এমন মুসলমান ব্যক্তি যে সম্পূর্ণ কাফির হইয়া গিয়াছে, এইরূপ ফতোয়া দেওয়া বোধ হয় এই হাদীসের উদ্দেশ্য নয়। ইহার তাৎপর্য এই যে, এইরূপ ব্যক্তি নিজেকে ঈমানদার দাবি করিলে বুঝিতে হইবে, তাহার যথার্থ বা পূর্ণ ঈমান নাই। ইহা অবশ্য এক ধরনের আকায়েদের ব্যাপার। কিন্তু রাসূলে করীম (স)-এর কথার ভঙ্গী ও ধরন বিবেচনা করিলে নিঃসন্দেহে বুঝিতে হয় যে, প্রতিবেশীকে জ্বালা যন্ত্রণা দেওয়া বা না দেওয়ার ব্যাপারটির স হিত ব্যক্তির আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানের গভীর সম্পর্ক রহিয়াছে। তাহা না হইলে রাসূলে করীম (স) এইরূপ ভঙ্গীতে কথাটি বলিতেন না। প্রতিবেশীকে জ্বালা যন্ত্রণা দেওয়া সম্পূর্ণ বেঈমানীর কাজ। ইহা পরবর্তী কথার ভূমিকায় মনে করা যাইতে পারে। কেননা পুরুষের জন্য স্ত্রী এবং স্ত্রীর জন্য স্বামী সর্বাধিক নিকটবর্তী প্রতিবেশী। সেই কারণেই ইহার পরবর্তী সব কথাই স্ত্রীলোক সম্পর্ক বলা হইয়াছে। প্রথম কথা, ***************** ইহার একটি অর্থ, স্ত্রী লোকদের কল্যাণ চাওয়ার ব্যাপারে, হে পুরুষেরা- তোমরা পরস্পরকে উপদেশ দাও। কিন্তু বায়জাবী বলিয়াছেন, এই বাক্যাংশে অর্থঃ
****************************************
আমি তোমাদিগকে স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে ভাল উপদেশ দিতেছি, তোমরা তাহাদের ব্যাপারে আমার দেওয়া এই অসিয়াত কবুল কর।
আর তাইয়্যেবী বলিয়াছেনঃ এই বাক্যটির অর্থঃ
****************************************
স্ত্রীলোকের কল্যাণ সাধনের ব্যাপারে তোমরা নিজেদের নিকট হইতেই সৎপরামর্শ লাভ করিতে চেষ্টা কর।
আবার কেহ কেহ এই বাক্যটির অর্থ করিয়াছেনঃ *************** ‘তোমরা রোগাক্রান্ত মুমূর্ষ ব্যক্তির নিকট হইতে তাহার স্ত্রী বা স্ত্রীদের ব্যাপারে অসীয়াত বা উইল পাইতে চাও’। অর্থাৎ এইরূপ ব্যক্তি তাহার স্ত্রী বা স্ত্রীদের জন্য অসীয়াত করিয়া যাইতে বল, তাহাকে এই জন্য উদ্বুদ্ধ কর। কেননা স্ত্রীলোকেরা নাজুক, দুর্বল, অসহায়। সহসা স্বামীর মৃত্যু হইয়া গেলে তাহারা অকূল পাথরে পড়িয়া যাইতে পারে ও নানাভাবে তাহাদিগকে জ্বালা-যন্ত্রণা দেওয়অর ও জীবিকা পাওয়ার অধিকার হইতে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র শুরু হইয়া যাইতে পারে।
ইহার আরও একটি অর্থ লিখা হইয়াছে। তাহা হইলঃ
****************************************
তোমরা স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে আমার দেওয়া উপদেশ ও নসীহত গ্রহণ কর, সেই অনুযায়ী আমল কর। তাহাদের ব্যাপারে মোটেই তাড়াহুড়া করিবে না- বিশেষ ধৈর্য তিতিক্ষা ও অপেক্ষা-প্রতীক্ষা অবলম্বন করিও। তাহাদের সহিত খুবই সহৃদয়তাপূর্ণ দয়ার্দ্র এবং নম্র-মসৃণ ব্যবহার গ্রহণ করিবে। আর তাহাদের প্রতি অনুগ্রহ ও অনুকম্পামূলক আচরণ করিও।
ইহার পর হাদীসে স্ত্রীলোদের প্রকৃতি ও স্বভাব সম্পর্কে যাহা বলা হইয়াছে তাহা এ পর্যন্ত বলা কথার কারণ ও যৌক্তিকতা বুঝাইবার জন্য বলা হইয়াছে। এই পর্যায়ের কথা দুইটি ভাগে বিভক্ত। উহার প্রথম ভাগে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
কেননা স্ত্রীলোক পাঁজড়ের হাড় হইতে সৃষ্টি। আর পাঁজড়ের হাড়ের উপরিভাগটাই অধিক বাঁকা।
অন্য কথায় স্ত্রীলোককে পাঁজড়ের অধিক বাঁকা হাড় দিয়া সৃষ্টি করা হইয়াছে। আর অধিক বাঁকা হাঁড়টি হইতেছে সর্বোচ্চের হাড়খানি। এখানে প্রশ্ন উঠে, স্ত্রী লোকদিগকে পাঁজড়ের অধিক বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হইয়াছে রাসূলের এই কথাটির ব্যাখ্যা কি? প্রকৃতই কি পাঁজড়ের অধিক বাঁকা হাড় দিয়া স্ত্রীলোকদিগকে সৃষ্টি করা হইয়াছে? (তাহা হইলে প্রশ্ন উঠে সে হাড় কাহার?) না এই কথাটি দৃষ্টান্তমূলক বা রূপক? স্ত্রীলোকদের স্বভাব প্রকৃতি সাধারণত যে বক্রতা, হঠকারিতা, জিদ ও অনমণীয়তা দেখা যায়, ভাঙ্গিয়া যায়, তবু নতি স্বীকার করে না- এই কথাটি পাঁজড়ের বাঁকা হাড়ের দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইয়াছেন? কুরআন হাদীসে বিশেষজ্ঞ লোকদের নিকট হইতে এই উভয় পর্যায়ের কথা ও ব্যাখ্যা গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছে।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেন, হ্যাঁ, প্রকৃতপক্ষেই স্ত্রীলোকদিগকে পাঁজড়ের বাঁকা হাড় দিয়া সৃষ্টি করা হইয়াছে। তাহার ইতিহাস এই যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (আ)-কে সৃষ্টি করিয়া যখন জান্নাতে থাকিতে দিলেন, তখন তিনি একাকীত্ব ও সঙ্গীহীনতার কারণে অস্থীর চিত্ত হইয়া পড়েন। তিনি নিরুপায় হইয়া আল্লাহর নিকট স্বীয় নিঃসঙ্গতার অভিযোগ করেন। পরে তিনি যখন ঘুমাইলেন, তখন স্বপ্নে এক অপূর্ব সুন্দরী রমনী দেখিতে পান। নিদ্রাভঙ্গ হইলে জাগ্রতাবস্থায় তিনি তাঁহার পার্শ্বে সেই স্বপ্নে দেখা রমনীকেই বসিয়া থাকিতে দেখলেন। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কে? বলিলেনঃ আমি হাওয়া। আমাকে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করিয়াছেনঃ ************** “এই উদ্দেশ্যে যে, তুমি আমার নিকট শান্তি সুখ স্থিতি লাভ করিবে। আর আমি শান্তি সুখ স্থিতি লাভ করিব তোমার নিকট”।
এই পর্যায়ে তাবেয়ী আতা হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ ************ ‘হযরত হওয়া হযর আদমের পাঁজড়ের হাড় দিয়া সৃষ্ট হইয়াছিলেন’। আল্লামা জাওহারী বলিয়াছেন; হযরত হাওয়াকে সৃষ্টি করা হইয়াছে পাঁজড়ের যে হাড় দিয়া উহার নাম ******** সর্বনিম্ন হাড়। মুজাহিদ বলিয়াছেনঃ নারীকে নারী বলা হইয়াছে এই কাণে যে, তাহাকে নর হইতে সৃষ্টি করা হইয়াছে। আর সে নর ব্যক্তি হইল আদম। মুকাতিল ইবনে সুলাইমান বলিয়াছেনঃ হযরত আদম জান্নাতে কিছুক্ষণ ঘুমাইয়া ছিলেন। তখন তাঁহার ডান পার্শ্বের পাঁজড়ের ছোট হাড়খানি দিয়া হযরত হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়। এই হাড়খানিকে বলা হয় **********। কিন্তু আদম কোনরূপ ব্যাথ্যা যন্ত্রণা অনুভব করেন নাই। কেননা তিনি যদি ব্যাথ্যাই পাইতেন, তাহা হইলে পুরুষরা স্ত্রীলোকদিগকে কক্ষণই ভালবাসিতে পারিতেন না।
রুবাই ইবনে আনাস বলিয়াছেনঃ হযরত হাওয়া হযরত আদমের (সৃষ্টির পর উদ্ধৃত্ত) মৃত্তিকা হইতে সৃষ্টি হইয়াছেন। তিনি তাঁহার এই কথার দলীল হিসাবে কুরআনের এই আয়াতটি পেশ করিয়াছেনঃ ********* ‘সেই আল্লাহই তোমদিগকে মৃত্তিকা দিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন’। ‘তোমাদিগকে’ বলিতে পুরুষ ও নারীর সব মানুষই বুঝায়। কিন্তু এই মত সমর্থনীয় নয়। কেননা কুরআন মজীদেরই ঘোষণাঃ
****************************************
সেই আল্লাহ তোমাদিগকে এক মাত্র ‘প্রাণী’ হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন। সেই একটি মাত্র প্রাণী হইতেই তাহার জৃড়িতে সৃষ্টি করিয়াছেন।
এ আয়াত একটি মাত্র প্রাণী’ হইলেন হযরত আদম এবং তাঁহার জুড়ি বলিতে হযরত হাওয়াকে বুঝানো হইয়াছে। হওয়াকে সৃষ্টি করা সম্পর্কে আল্লাহর বাণী হইল ************** সেই একটি মাত্র প্রাণী হইতেই (হাওয়াকে) সৃষ্টি করিয়াছেন। এই হিসাবে রাসূলে করীম (স)আলোচ্য হাদীসের বাণীটুকু কুরআনের এই আয়াতেরই ব্যাখ্যা বলিতে হইবে।
এই ইতিহাসের প্রেক্ষিতে রাসূলে করীমের আলোচ্য কথাটির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হইয়া যায়। ইহা ছাড়া ইহাকে দৃষ্টান্তমূলক কথা মনে করিলেও কোন দোষ নাই। বরং বলিতে হইবে, নারী প্রকৃতি বুঝাইবার জন্য ইহাপেক্ষা সুন্দর পূর্ণাঙ্গ যথার্থ দৃষ্টান্ত আর কিছু হইতে পারে না। নারী প্রকৃতির বক্রতা বুঝাইবার জন্য ********* পাঁজড়ের হাড়ের শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে। কেননা পাঁজড়ের হাড় বাঁকা- উহার অগ্রভাগ বেশী বাঁকা, তাহাতো সর্বজনবিদিত। ইহার অর্থঃ
****************************************
স্ত্রীলোক এমন এক প্রকৃতিতে সৃষ্ট হইয়াছে যে, সেই মূল সৃষ্টি-প্রকৃতিতেই বক্রতা নিহিত হইয়া আছে। অন্য কথায়, তাহারা বাঁকা মৌল উপাদান দ্বারাই সৃষ্ট। কাজেই উহা দ্বারা কাজ লইতে ও উপকৃত হইতে হইলে তাহারা প্রকৃতিগতভাবে যেমন আছে তেমন রাখিয়া ও তাহা পুরাপুরি পর্যবেক্ষণাধীন রাখিয়অ উহাকে প্রয়োগ ও নিয়োগ করিতে হইবে এবং তাহাদের স্বভাবগত বক্রতার ব্যাপারে পুরাপুরি ধৈর্য অবলম্বন করিতে হইবে।
এই প্রেক্ষিতেই দ্বিতীয় ভাগের কথা অনুধাবনীয়। বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তুমি যদি এই বক্রতাকে সোজা করিতে যাও বা চেষ্টা কর তাহা হইলে তুমি উহাকে ভাঙিয়া ফেলিবে। আর যদি যেমন আছে, তেমনি থাকিতে দাও, তাহা হইলে উহা চিরকালই বাঁকা থাকিবে। এই বাঁকা অবস্থায়ই তোমরা কাজ করিয়া যাইবে।
কথাটি স্পষ্ট। সাধারণত বলা হয়, ‘স্বভাব যায় না মইলে’। কয়লার কৃষ্ণত্ব উহার আসল প্রকৃতিগত। সহস্র লক্ষবার ধুইলেও উহা কখনই সাদা বা ধলা হইবে না। রাসূলে করীম (স) এই জন্যই বলিয়াছেনঃ তোমরা যদ শুনিতে পাও একটি পাহাড় স্থানান্তরিত হইয়াছে, তবে তাহা বিশ্বাস করিতে পার। কিন্তু কাহারও স্বভাব বা প্রকৃতি পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে শুনিতে পাইলে তাহা কিছুতেই বিশ্বাস করিও না।
এতদসত্ত্বেও উহাকে সোজা ও ঋজু করিতে চাহিলে উহার অনিবার্য পরিণতি হইবে উহার চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যাওয়া। ইহাও পূর্ববর্তী দৃষ্টান্তেরই জের। চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যাওয়া অর্থ তালাক ও চিরবিচ্ছিন্নতার উদ্ভব হওয়া। ইহা ছাড়া অন্য কোন পরিণতি হইতে পারে না নারী প্রকৃতিকে সোজা ও ঋজু করিতে চেষ্টা করার। মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত এই হাদীসটির ভাষা হইতে উহা অধিকতর স্পষ্ট হইয়া উঠে। হাদীসটি এইঃ
****************************************
তুমি যদি তাহা দ্বারা সুখ লাভ করিতে চাহ, তাহা হইলে তোমাকেক তাহার এই স্বভাবগত বক্রতা সহকারেই তাহাকে ব্যবহার করিতে হইবে। আর তুমি যদি এই বক্রতাকে সোজা ও ঋজু করিতে চেষ্টা কর, তাহা হইলে তুমি তাহাকে চূর্ণ করিয়া দিবে। আর তাহার চূর্ণতা হইল তাহাকে তালাক দিয়া দেওয়া।
অর্থাৎ তোমার সেই চেষ্টা ব্যর্থ ও অসফল হওয়ার কারণে তোমার মন এতই বিরক্ত ও বিদ্রোহী হইয়া উঠিবে যে, শেষ পর্যন্ত তুমি তাহাকে তালাক না দিয়া পারিবে না।
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
স্ত্রীলোকদের সহিত সহৃদয়তা ও সহানূভূতিপূর্ণ ব্যবহার করা, তাহাদের প্রতি কল্যাণময় আচরণ গ্রহন করা- দয়া অনুগ্রহ প্রদর্শন করা, তাহাদের স্বভাব-চরিত্রের বক্রতার জন্য ‘সবর’ করা- তাহা দেখিয়া ধৈর্য হারাইয়া না ফেলা, তাহাদের জ্ঞান-বুদ্ধির দুর্বলতা বরদাশত করার জন্য স্বামীগণকে উদ্বদ্ধ করিতে চাওয়া হইয়াছে এই হাদীসে এবং বিনা কারণে তাহাদিগকে তালাক দেওয়ার প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে যে, তাহাদের স্বভাবগত বক্রতাকে সোজা করিতে চাওয়া ও চেষ্টা করা উচিত নয়।
ইহাই হাদীসটির সারকথা ও মূল শিক্ষা।
এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস স্মরণীয়। হাদীসটি এইঃ
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ কোন ঈমানদার পুরুষ কোন ঈমানদার মেয়ের প্রতি কোন সর্বাত্মক ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করিবে না। কেননা সে মেয়েলোকটির চরিত্রের একটি দিক যদি তাহার পছন্দ না-ই হয়, তবুও তাহার চরিত্রের অপর একটি দিক নিশ্চয়ই এমন যাহাতে সে অবশ্যই সন্তুষ্ট হইতে পারিবে।
(মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ কোন মানুষই নিরংকুশ ও অবিমিশ্রভাবে মন্দ ও ঘৃণ্য হইতে পারে না। তাহার মধ্যে অনেকগুলি খারাপ দিক থাকিলেও কোন কোন দিক নিশ্চয়ই এমন থাকিবে যাহা ভাল বলিয়া মনে করা যাইবে ও পছন্দ হইবে। ইহা সাধারণ লোক-চরিত্র সম্পর্কিত কথা। কিন্তু আলোচ্য হাদীসটির বিশেষ প্রয়োগ হইল স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক জীবনের ক্ষেত্রে। স্বামী হয়ত স্ত্রীর চরিত্রের কোন একটি দিক খুব খারাপ দেখিতে পাইল। আর এমনি চট করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়া বসিল, এ ভাল নয়, এই স্ত্রী লইয়া ঘর করা যাইবে না, ইহাকে লইয়া আমার জীবন সুখময় হইবে না। আর এই মনোভাবের দরুন তখন-তখনই তাহাকে তালাক দিয়া বসিল। ইহা বস্তুতই শুধু অনুচিতই নয়, ইহা জুলুম, ইহা মানবতার অপমান। কেননা সে যখন ঈমানদার-স্বামী কিংবা স্ত্রী- তখন তাহার মধ্যে মন্দ দিক দুই-একটা থাকিলেও অনেকগুলি দিক তাহার নিশ্চয়ই ভাল থাকিবে। ইহাই স্বাভাবিক। ফলে একদিক দিয় স্ত্রী কিংবা স্বামী অপছন্দ হইলেও এবং উহার দরুন জীবন অচল ও বিড়ম্বনাময় হইলেও অন্য অনেক কয়টি দিক দিয়া জীবন মাধুর্যপূর্ণ হইয়া উঠিতে পারে। বিশেষত সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা দুই যুবক-যুবতী যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া নূতনভাবে জীবন যাপন করিতে শুরু করে, তখন পরস্পরের ব্যাপারে এইরূপ অবস্থা দেখা দেওয়া- বিশেষ করিয়া বিবাহের পর-পরই এ দাম্পত্য জীবনের সূচনায়ই- কিছুমাত্র বিচিত্র নয়, অসম্ভবও নয়। তাই নবী করীম (স)- এর এই বাণী এবং এই দৃষ্টিতে ইহার মূল্য অসামান্য। এ কথাটির প্রয়োগ এখানেও যে, স্ত্রীর গায়ের চামড়া উজ্জ্বল কান্তিপূর্ণ নয় দেখিয়া স্বামী যদি হতাশাগ্রস্ত হইয়া পড়ে, তবে তাহার চিন্তা করা উচিত যে, হইতে পারে ইহার চামড়া সুশ্রী বা সুন্দর নয়, কিন্তু ইহার হৃদয়-অন্তর ও স্বভাব-চরিত্র তো সুন্দর হইতে পারে; ভাল ভাল গুণ, যোগ্যতা-কর্মক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা তাহার থাকিতে পারে। অতএব মনে তাহার প্রতি কোন স্থায়ী বিদ্বেষ ও বিরুপভাব পোষণ করা এবং ইহার ফলে তাহাকে ত্যাগ করিতে উদ্যত হওয়া কোন বুদ্ধিমান লোকের কাজ হইতে পারে না। কুরআন মজীদে ঠিক এই কথাটিই বলা হইয়াছে, এই ভাষায়ঃ
****************************************
তোমরা যদি (তোমাদের) স্ত্রীদের অপছন্দই করিয়া বস, তাহা হইলে নিশ্চিত জানিও, এটা খুবই সম্ভব যে, তোমরা হয়ত কোন একটি জিনিস অপছন্দ করিতেছ, অথচ আল্লাহ তা’আলা তাহাতেই বিপুল কল্যাণ রাখিয়া দিয়াছেন।
আল্লামা কুরত্ববী এই আয়াতটির তফসীরে উপরোক্ত হাদীসটিই উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা হইতে নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারা যায় যে, এই আয়াতটির তাফসীর যেমন এই হাদীসটির দ্বারা স্পষ্ট হয়, তেমনি এই হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা বুঝিবার জন্য এই আয়াতটি অবশ্যই স্মার্তব্য। কুরআন ও হাদীস যে কতখানি ওতোপ্রোত ও পরস্পর জড়িত, তাহা বুঝিতে কিছুমাত্র কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
(*************)
অতএব নারী জাতির কল্যাণ কামনায় ব্রতী হওয়া সকলেই কর্তব্য। এই কল্যাণ কামনা প্রসঙ্গে যে সব উপদেশ নসীহত দেওয়া হইয়াছে, তাহা মনে-প্রাণে কবুল করা উচিত। স্ত্রী জাতির এই স্বাভাবিক বক্রতার কথা মনে রাখিয়া দাম্পত্য জীবন শুরু করিলে বিপর্যয় এড়াইয়া নিয়া সুন্দর সহজ ও মধুময় জীবন যাপন সম্ভবপর হইবে। কেননা নারী প্রকৃতি সম্পর্কে সামান্য ধারণাও না থাকার দরুন স্বামীর দিক হইতে এমন সব আচরণ হয়, যাহার পর বিচ্ছেদ অনিবার্য হইয়া পড়ে। অথচ তাহা কখনই কাম্য হইতে পারে না।
(*******************)
এই হাদীসটির আলোকে মানব-প্রকৃতি সব বিশ্বপ্রকৃতি খুব সহজেই বুঝিতে পারা যায়। মহান সৃষ্টিকর্তা এই বিশ্বলোককে- ইহার প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকেও একটি কঠিন নিয়মের বন্ধনে বাঁধিয়া রাখিয়াছেন। প্রত্যেকটি বস্তুকেই দিয়াছেন একটা একান্ত্র নিজস্ব ও স্বতন্ত্র প্রকৃতি। সে প্রকৃতি সমূলে পরিবর্তন করার সাধ্য কেহরই নাই। বাহ্যিক দিকদিয়া কিছুটা পরিবর্তন আনা সম্ভব হইলেও হইতে পারে। লবনের লবনাক্ততা ও মধুর তীব্র মিষ্টতা বদলানো যায় না। বদলাইলে তখন লবন লবন থাকিবে না, মধু উহার মাধুর্য হারাইয়া ফেলিবে।
মানুষও একটি মৌলিক প্রকৃতিতে সৃষ্ট। ইহা সাধারণ সর্বমানুষের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই মানুষতো জন্মগতভাবেই দুই লিঙ্গে বিভক্ত পুরুষ ও নারী। পুরুষ তাহার নিজস্ব প্রকৃতি লইয়াই বাঁচিতে পারে। বাঁচিতে পারে. দায়িত্ব পালন করিতে পারে পুরুষ হিসাবে। তাহার পৌরুষ নিঃশেষ করিয়া নারী প্রকৃতিতে সজ্জিত করা সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে নারীও একটা বিশেষ ও একান্ত নিজস্ব প্রকৃতিতে নারী। তাহার নারীত্ব উৎপাটিত করিয়া তাহাকে পৌরুষে সুশোভিত করিতে চাওয়া শুধু ভুলই নয়, প্রকৃতি পরিপন্হী কাজ। আর প্রকৃতি পরিপন্হী কাজ কখনই সফল হইতে পারে না। এই কথা যেমন পুরুষকে মনে রাখিতে হইবে, তেমনি মনে রাখিতে হইবে নারীকেও। অতএব পুরুষকে পুরুষোচিত কাজ করিবার এবং নারীকে নারীজনোচিত কাজ করিতে দিতে হইবে সমাজ গঠন ও সামাজিক শৃংখলা স্থাপন ও সংরক্ষণের জন্য। অন্যথায় বিপর্যয় অবধারিত হইয়া পড়িবে।
যৌন মিলনের প্রাক্কালীন দোয়া
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্নিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের কেহ যখন তাহার স্ত্রীর নিকট যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে আসে, তখন যে যেন বলেঃ হে আমাদের আল্লাহ, শয়তানকে আমাদের হইতে দূরে সরাইয়া দাও এবং তুমি আমাদেরকে যে সন্তান রিযিক হিসাবে দান করিবে, তাহার হইতেও শয়তানকে দূরে সরাইয়া রাখ। এই দোয়ার পর যৌন মিলনের ফলে আল্লাহ তা’আলা যদি কোন সন্তান দেন, তাহা হইলে শয়তান তাহার কোন ক্ষতি করিতে পারিবে না।
(তিরমিযী, বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির প্রথম বাক্যের অংশ ************ অর্থঃ ********** ‘যখন স্ত্রী সঙ্গম করার সংকল্প করিবে ও সেজন্য প্রস্তুত হইবে’। অর্থাৎ উহা শুরু করার পূর্বে রাসূলের শিখানো এই দোয়াটি পাঠ করিবে। মুসলিম ও আবূ দায়ূদের বর্ণনার ভাষা হইতেছে ******* ‘যখন স্ত্রীর নিকট সঙ্গম উদ্দেশ্যে যাইবার ইচ্ছা করিবে’। এই বাক্যটি এই পর্যায়ে বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের ব্যাখ্যাকারী। আর যে ব্যাখ্যা এই যে, সঙ্গম কার্য করার সময় নয়, উহার ইচ্ছা ও সংকল্প গ্রহণের সময় এই দোয়া পড়িতে হইবে। যেমন কুরআন মজীদের আয়াত **************** ‘তুমি যখন কুরআন পড় তখন আয়ূযুবিল্লাহ বল’- ইহার অর্থ হইল, যখন তুমি কুরআন পড়ার ইচ্চা করিবে বা পড়িতে শুরু করিবে, তখন শুরু করার পূর্বে আউযুবিল্লাহ বলিবে। হাদীসের এই কথাটিও তেমনি।
হাদীসের বক্তব্য হইল, স্ত্রী সঙ্গম শুরু করার পূর্বে এই দোয়া পড়িলে সঙ্গমের পর যে সন্তান হইবে, শয়তান তাহার কোন ক্ষতি করিতে পারিবে না। এই কথা বলার বিশেষ কারণ এই যে, সন্তান জন্ম হওয়ার পর হইতেই শয়তান তাহার উপর প্রভাব বিস্তার করিতে, তাহাকে নিজেকে অনুসারী ও ‘চেলা’ বানাইবার জন্য চেষ্টা শুরু করিয়া দেয়। কিন্তু এই সন্তানের জন্ম হইয়াছে যে স্বামী-স্ত্রীর যৌন সঙ্গমের ফলে তাহারা যদি উহার পূর্বে এই দোয়া পাঠ করিয়া থাকে, তাহা হইলে এই সন্তানের উপর শয়তানের কোন প্রভাব পড়িবে না। সে নেক আমলকারী হইতে পারিবে তাহার নেক আমল করার পথে শয়তান বাধা দান করিতে পারিবে না। মুসলিম শরীফ ও মুসনাদে আহমাদের উদ্ধৃত হাদীসে এখানকার ভাষা হইলঃ ********* শয়তান তাহার উপর প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে না।
আর বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনার ভাষা হইলঃ ********** ‘শয়তান কক্ষণ-ই তাহার ক্ষতি করিতে পারিবে না’। ‘শয়তান তাহার কোন ক্ষতি করিতে পারিবে না’ এই কথার প্রকৃত তাৎপর্য কি? ক্ষতি বলিতে কোন ধরনের ক্ষতি বুঝানো হইয়াছে? ইহা কি সাধারণ অর্থে? না ইহা বিশেষ কোন ক্ষতির প্রতি ইংতি করা হইয়াছে? এই পর্যায়ে হাদীস ব্যখ্যাকারীগণ বিভিন্ন কথা বলিয়াছেন। সেই সব কিছু মিলাইয়া একত্র করিয়া বলিলে বলা যায়, এইরূপ সঙ্গম কার্যের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানের কোনরূপ ক্ষতিই শয়তান করিতে পারিবে না। না দৈহিক দিক দিয়া, না মানসিক দিক দিয়া, না দ্বীন পালনের দিক দিয়া। অতএব সব পিতা-মাতা- অর্থাৎ সব স্বামী-স্ত্রীরই ইহা কাম্য হওয়া উচিত।
এই দোয়া পাঠ করার পর অনুষ্ঠিত যৌন মিলনের ফলে যে সন্তান হয়, সে সেই লোকদের মধ্যে গণ্য হইয়া যায় যাহাদের সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা শয়তাদের চ্যালেঞ্জের জওয়াবে বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমার বান্দাহ যাহারা, তাহাদের উপর- হে শয়তান তোমার কোন কর্তৃত্ব চলিবে না।
এই কথার সমর্থন পাওয়া যায় অপর একটি বর্ণনা হইতে। বর্ণনাটি হাসান হইতে বর্ণিত। উহাতে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
এই দোয়া পড়ার অনুষ্ঠিত সঙ্গম কর্যের ফলে স্ত্রী যদি গর্ভবতী হয়, তাহা হইলে নেককার সন্তান পাওয়ার আশা করা যায়।
এই বর্ণনাটি ‘মুরসাল’। কেননা হাসান তো তাবেয়ী। তাহা সত্ত্বেও- ইহা নবী করীম (স)-এর কথা নয়-কেহ নিজে চিন্তা করিয়া বলিয়াছেন, এমন কথা কনে করার কোনই কারণ নাই।
কিন্তু এই দোয়া পাঠের পর ভূমিষ্ঠ সন্তান মা’সুম বা নির্দোষ- নিষ্পাপ হইবে, এমন কথা কিন্তু কোন হাদীসেই বলা হয় নাই, কেননা ‘মা’সুম’ হওয়ার গুণ কেবল মাত্র নবী-রাসূলগণের। ইহার অধিকার আর কাহারও নাই। নবী-রাসূলগণ মহান আল্লাহর পূর্ণ সংরক্ষণ পাইয়া থাকেন। এই কারণে তাঁহারা মানুষ হইয়াও সর্বপ্রকারের গুনাহ হইতে রক্ষা পাইয়া থাকেন। কিন্তু মানুষ- সে যত বড় ওলী-দরবেশ-পীর হউক না কেন, তাহা নয়।
ইহা হইতে আরও স্পষ্টভাবে জানা গেল যে, সকল কাজের শুরুতেই যেমন ‘বিসমিল্লাহ’ বলিতে হইবে, তেমনি স্ত্রী সঙ্গম হওয়ার পূর্বেও ইহা বলা মুস্তাহাব।
(*****************)
হাদীসে সন্তানকে রিযিক বলা হইয়াছে। বস্তুত আল্লাহ মানুষকে যাহা কিছু দিয়াছেন, তাহা সবই তাঁহার দেওয়া রিযিক। মানুষের যাহা কিছুই আছে, তাহা সবই আল্লাহর দেওয়া এবং তাহা সবই আল্লাহর দেওয়া রিযিক ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই সন্তানও আল্লাহর দেওয়া রিযিক মাত্র। এই রিযিক লাভের উদ্দেশ্য লইয়াই স্ত্রীসঙ্গমের প্রবৃত্ত হইতে হইবে। কুরআন মজীদে স্ত্রীকে স্বামীর জন্য ক্ষেত বিশেষ বলা হইয়াছে। চাষী যেমন ফসল ফলাইবার ও ফসল পাওয়ার উদ্দেশ্য লইয়াই জমি চায় করে, ফসল পাওয়া ছাড়া জমি চাষের মূলে তাহার আর কোন উদ্দেশ্যেই থাকে না। চাষ করিবে, হাড় ভাঙা পরিশ্রম করিবে, অথচ ক্ষেত্রে ফসল ফলিবে না, চাষী তাহা কল্পনাও করিতে পারে না। স্বামীরও ঠিক সেই উদ্দেশ্য লইয়াই অর্থাৎ সন্তান পাওয়ার উদ্দেশ্য লইয়া সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া উচিত এবং সন্তান পাওয়া, গেলে তাহাকে আল্লার রিযিক হিসাবেই সাদরে গ্রহণ করা উচিত। এই সন্তানের প্রতি কোনরূপ অনীহা উপেক্ষা বা অসন্তুষ্টি আল্লাহর রিযিক দানেরই অবমাননা এবং তাহা আল্লাহ কখনই বরদাশত করেন না।