বিবাহে মহরানা
****************************************
আমের ইবনে রবীয়াতা হইতে বর্ণিত হইয়াছে, ফজারা বংশের একটি মেয়ে এক জোড়া জুতার বিনিময়ে বিবাহ করিল। তখন রাসূলে করীম (স) তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কি তোমার মনের ও তোমার ধন-সম্পদের দিক দিয়া দুইখানি জুতার বিনিময়ে বিবাহ করিতে রাযী হইতে পারিয়াছ? মেয়েটি বলিলঃ হ্যাঁ, তখন নবী করীম (স) এই বিবাহকে বৈধ ঘোষণা করিলেন।
(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ একজোড়া জুতার বিনিময়ে বিবাহ হওয়া ও স্বয়ং নবী করীম (স) কর্তৃক উহা বৈধ ঘোষিত হওয়ার কথা হাদীসটিতে বলা হইয়াছে। ইহা হইতে অনেকে প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন যে, অতীব নগণ্য-সামান্য মূল্যের জিনিসও বিবাহের ‘মহরানা’ হইতে পারে এবং এই ধরনের বিবাহ সম্পূর্ণ জায়েয। কিন্তু সনদের দিক দিয়া এই হাদীসটি যয়ীফ। অবশ্য ইমাম তিরমিযী ইহাকে ‘সহীহ হাসান’ বলিয়াছেন।
এই পর্যায়ে হযরত উমর, আবূ হুরাইরা, সহল ইবনে সায়াদ, আবূ সায়ীদ খুদরী, আনাস, আয়েশা, জাবির ও আবূ হাদরাদ আল-আসলামী প্রমুখ সাহাবী হইতে বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত ও গ্রন্হসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছে, এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল ও বলিলঃ আমি আনসার বংশের একটি মেয়ে বিবাহ করিয়াছি। নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
****************************************
কত দিয়া তুমি বিবাহ করিলে?
অর্থাৎ বিবাহে মহরানা কত ধার্য করিলে? লোকটি বলিলঃ চার আউকিয়া (‘আউকিয়া- তদানীন্তন) আরব সমাজের একটি বিশেষ মুদ্রা পরিমাণ)
হযরত আনাসের বর্ণনায় বলা হইয়াছে, নবী করীম (স) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা)-এর গায়ে হলূদ রঙ দেখিতে পাইলেন। তিনি তাহাকেঁ জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ইহা কি? তিনি বলিলেনঃ
****************************************
স্বর্ণের এক রত্তি পরিমাণের মহরানা দিয়া আমি সম্মতি একটি মেয়ে বিবাহ করিয়াছি।
নবী করীম (স) বলিলেন ********************* ‘আল্লাহ তোমার এই বিবাহে বরকত দান করুন’। স্বর্ণের উপরোক্ত পরিমাণের মূল্য তখনকার সময়ে ছিল পাঁচ দিরহাম; কিংবা এক দীনারের এক চতুর্থাংশ।
এই সব হাদীস ও এই ধরনের আরও বহু শত হাদীস হইতে জানা যায় যে, বিবাহে মহরানা ধার্য করিতে হইবে। মহরানা ব্যতীত বিবাহ সহীহ হইতে পারে না।
কুরআন মজীদে বিবাহে স্ত্রীর প্রাপ্য হিসাবে মহরানার উল্লেখ হইয়াছে বহু কয়টি আয়াতে। এই পর্যায়ে প্রথম উল্লেখ্য আয়াতটি এইঃ
****************************************
যে সব মেয়েলোক পরস্ত্রী- তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যে সব মেয়ে লোকের মালিক হইয়াছে তাহাদের ছাড়া- সকলেই হারাম। ইহা আল্লাহর তরফ হইতে তোমাদের প্রতি লিখিয়া দেওয়া ফরমান। ইহাদের ছাড়া অন্যান্য সব মেয়েলোক তোমাদের জন্য হালাল করা হইয়াছে এই শর্তে যে, তোমরা তাহাদিগকে তোমাদের ধন-মালের বিনিময়ে পাইতে চাহিবে পবিত্রতা রক্ষাকারী বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে, ব্যভিচারী রূপে নয়। পরস্তু তোমরা তাহাদের মধ্য হইতে যাহাদের নিকট যৌন-সঙ্গম স্বাদ-আস্বাদন করিবে, তাহাদিগকে নির্ধারিত পরিমাণ ‘পারিশ্রমিক’ দাও।
(আন-নিসা-২৪)
আয়াতে ******* (বলিয়া ) ঘোষণা করা হইয়াছে যে, স্ত্রী গ্রহণ করিতে হইবে ধন-মালের বিনিময়ে। এই ধন-মাণ দিতে হইবে বিবাতে মহরানা স্বরূপ, কেবলমাত্র অর্থদানই নয়, নির্দিষ্ট পরিমাণ মহরানা দেওয়াই বিধেয়। আয়াতের শেষের দিকে বলা হইয়াছেঃ ************ ইহাতে ধার্যকৃত মহরানা আদায় করিয়া দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। কুরআনের এই আয়াতে মহরানাকে ****** বলা হইয়াছে। কেননা উহা কার্যতঃ ************* ‘স্ত্রী সঙ্ম স্বাদ-আস্বাদনের বিনিময় মূল্য’।
কিন্তু ইহা কিসের বিনিময় মূল্যঃ বলা হইয়াছে, ইহা স্ত্রীর যৌন অঙ্গ সম্ভোগের বিনিময় মূল্য। কেননা মুনাফা স্বরূপ যাহা পাওয়া যায় তাহাই মজুরী, পারিশ্রমিক বা ******** অবশ্য কেহ কেহ বলিয়াছেন, ইহা স্ত্রী সঙ্গম হালাল হওয়ার বিনিময় মূল্য। অন্যরা বলিয়াছেন, স্ত্রী সমস্ত দেহের বিনিময় মূল্য হইয়াছে তাহাদে দেওয়া মহরানা। আসলে স্ত্রীর দেহ মন ও যৌন অঙ্গ সম্ভোগ, স্বাদ গ্রহণ- এই সব কিছুর বিনিময় মূল্য এই মহরানা।
(************************)
আল্লামা আবূ বকর আল-জাসসাস লিখিয়াছেনঃ এই আয়াত অনুযায়ী বিবাহের আকদ মুবাহ ও জায়েয হইবে স্ত্রী অঙ্গ ব্যবহারের বিনিময় মূল্য আদায় করিয়া দেওয়ার শর্তে। এবং তাহা কোন মাল-সম্পদ (kind) হইতে হইবে। ইহা হইতে দুইটি কথা জানা গেল। একটি এই যে, স্ত্রীর যৌন অঙ্গেন বিনিময় মূল্য দেওয়া ওয়াজিব। যে জিনিসের বিনিময়ে স্ত্রীর যৌন অঙ্গের স্বাদ গ্রহণ হালাল হয় তাহা তাহাকে দিয়া দিতে হইবে। আর দ্বিতীয় কথা, মহরানা হইতে হইবে এমন যাহা জিনিস বা kind পর্যায়ে গণ্য হইতে পারে। যাহা মাল-সম্পদ নয়, তাহা মহরানা হইতে পারে না।
(************)
দ্বিতীয় উল্লেখ্য আয়াত হইলঃ
****************************************
তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের মহরানা দিয়া দাও দেওয়ার মতই- আন্তরিকতা ও মনের সন্তুষ্টি সহকারে।
বস্তুত মহরানা আল্লাহর ধার্য করিয়া দেওয়া স্ত্রীর হক। ইহা তাহার পাওনা। এই পাওনা তাহাকে পাইতেই হইবে। ইহা আদায় করিয়া দেওয়া ফরয। আদায় করিতে হইবে কুণ্ঠিত সংকচিত মন-মানসিকতা লইয়া নয়, করিতে হইবে স্ব-ইচ্ছায়, সাগ্রহে ও আন্তরিক ইচ্ছা সহকারে।
হযরত আলী (রা) ও হযরত ফাতিমা (রা)-এর বিবাহ হইল, তখন নবী করীম (স) হযরত আলীকে বলিলেন, ********** ‘তুমি ফাতিমারকে কিছু একটা দাও’। হযরত আলী (রা) বলিলেন *********** ‘দিতে পারি এমন কোন জিনিসই আমার নাই’। নবী করীম (স) বলিলেন *********** ‘তোমার হিতমিয়া বর্মটি কোথায়’? অর্থাৎ সেই বর্মটি বিক্রয় করিয়া কিছু একটা লইয়া আস ফাতিমাকে দিবার জন্য।
ইহা হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইল, স্বামী স্ত্রীর মিলন হওয়ার পূর্বেই মহরানার একটা অংশ স্ত্রীকে দিয়া দেওয়া স্বামীর কর্তব্য। হাদীসে যদিও স্পষ্ট বলা হয় নাই যে, অতঃপর হযরত আলী (রা) সেই বর্মটি বা উহার বিক্রয় লব্ধ অর্থ দ্বারা কিছু নিয়ে মহরানা বাবদ দিয়াছিলেন কিনা; কিন্তু অন্যান্য কয়েকটি বর্ণনা হইতে জানা যায়, বর্মটি তিনি বিক্রয় করিয়া উহার মূল্য মহরানা বাবদ দিয়াছিলেন।
(*******)
মুসনাদে আহমাদ গ্রন্হে এই হাদীসটির বর্ণনা স্বয়ং হযরত আলী (রা) হইতে উদ্ধৃত হইয়াছে। তিনি বলিলেনঃ আমি রাসূলে করীমের কন্যার সহিত বিবাহের প্রস্তাব দিবার কথা চিন্তা করিলাম। মনে মনে বলিলাম, আমার দিবার মত কিছুই নাই। তাহা হইলে কিভাবে হইতে পারে? পারে রাসূলে করীম (স) –এর সহিত আমার সম্পর্কের কথা চিন্তা করিয়া শেষ পর্যন্ত প্রস্তাব দিয়াই ফেলিলাম। তিনি বলিলেনঃ ************** ‘তোমার নিকট মহরানা বাবত দিবার মত কিছু আছে?’ বলিলাম, না। বলিলেনঃ আমি যে তোমাকে অমুক দিন একটা বর্ম দিয়াছিলাম, সেটি কোথায়? বলিলাম সেটি আমার নিকট রহিয়াছে। বলিলেন, তুমি উহাই দিয়া দাও।
(***********)
মোট কথা সব কয়টি হাদী হইতে মহরানা দেওয়ার অপরিহার্যতা প্রমাণীত হয়।
****************************************
হযরত সহল ইবনে সায়াদ সায়েদ হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ একটি মেয়েলোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল এবং বলিলঃ ইয়া রাসূল! ‘আমি নিজেকে আপনার জন্য উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত হইয়াছি’। এই কথা শুনিয়া নবী করীম (স) তাহার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। পরে তাহার উপর-নিচের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, এবং গভীরভাবে চিন্তা-বিবেচনা করিলেন। পরে রাসূলে করীম (স) তাঁহার মাথা উপরে তুলিলেন। অতঃপর মেয়েলোকটি লক্ষ্য করিল, নবী করীম (স) তাহাতে তাঁহার কোন প্রয়োজন দেখিতে পাইলেন না। পরে সে বলিয়া রহিল। এই সময় রাসূলের একজন সাহাবী দাঁড়াইয়া বলিলেনঃ ইয়া রাসূল! এই মেয়ে লোকটিতে আপনার যদি কোন প্রয়োজন না থাকে, তাহা হইলে এই স্ত্রীলোকটিকে আমার নিকট বিবাহ দিন। তখন রাসূলে করীম (স) বলিলেন, তোমার নিকট মহরানা দেওয়ার মত কিছু আছে কি? সাহাবী বলিলেনঃ আল্লাহর শপথ, ‘হে রাসূল, আমার নিকট মহরানা দেওয়ার মত কিছুই নাই’। তখন রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তোমার ঘরের লোকদের নিকট যাও এবং খুঁজিয়া দেখ, কোন জিনিস পাও কিনা! সাহাবী চলিয়া গেলেন। পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেনঃ হে রাসূল, আল্লাহর শপথ, কিছুই নাই। তখন রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ দেখ, লোহার একটা আঙটিও পাও কিনা। তিনি চলিয়া গেলেন, পরে ফিরিয়অ আসিলেন, বলিলেন, না, ইয়া রাসূল, একটা লোহার আঙটিও নাই। তবে আমার এই কাপড়খানা (তাঁহার চাদর) আছে, ইহার অর্ধেম মহরানা স্বরূপ তাহাকে দিতে পারি। রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তোমার এই কাপড়খানা লইয়া তুমি কি করিবে! ইহা যদি তুমি ব্যবহার কর, তাহা হইলে তোমার স্ত্রীর ব্যবহারের ইহার কিছুই আসিবেনা। আবার সে যদি ইহা ব্যবহার করে তাহা হইলে তোমার গায়ে ইহার কোন অংশ থাকিবে না। তখন এই (সাহাবী) লোকটি বসিয়া রহিলেন। দীর্ঘসময় ধরিয়া বসিয়া থাকার পর তিনি দাঁড়াইলেন। রাসূলে করীম (স) তখন তাঁহাকে চলিয়া যাইতে দেখিলেন। তখন রাসূলে করীম (স) তাঁহাকে ডাকিয়া আনিবার জন্য নির্দেশ দিলেন। ডাকার পর তিনি যখন ফিরিয়া আসিলেন, রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি কুরআন মজীদ কতটা শিখিয়াছ? বলিলেনঃ কুরআনের অমুক অমুক সূরা আমি আয়ত্ত করিয়াছি। তিনি তাহা গণিয়া দিলেন। রাসূল বলিলেনঃ তুমি ইহা বুঝিয়া অন্তর দিয়া পড়? বলিলেন, হ্যাঁ, তখন রাসূলে করীম (স), বলিলেনঃ যাও, তুমি যতটা কুরআন শিখিয়াছ উহার বিনিময়ে তুমি এই মেয়ে লোকটির স্বামীত্ব লাভ করিলে।
(বুখারী, মুসলিম, দারে কুতনী, মুসনাদে আহমাদ, তাবারানী)
ব্যাখ্যাঃ এই দীর্ঘ হাদীসটিতে প্রধানত দেন-মোহর বা মহরানা সম্পর্কে আলোচিত হইলেও ইহার দীর্ঘ বিবরণ ও উহাতে উদ্ধৃত কথোপকথন হইতে বহু প্রয়োজনীয় বিষয় জানা যায়। হাদীসের শুরুতে বলা হইয়াছে, একটি মেয়েলোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল। হাদীসে মেয়েলোকটির নাম বলা হয় নাই। ইবনে হাজার আসকালানী বলিয়াছেন *************** আমি তাহার না জানিতে পারি নাই। তখন রাসূলে করীম (স) কোথায় ছিলেন? সুফিয়ান সওরীর বর্ণনা হইতে জানা যায়, *************** তখন নবী করীম (স) মসজিদে আসীন ছিলেন। মেয়ে লোকটি বলিলঃ ****************** ‘আমি নিজেকে আপনার জন্য উৎসর্গ করিবার উদ্দেশ্যে উপস্থিত হইয়াছি’। অর্থাৎ সে যেন বলিলঃ ************** কোন রূপ বিনিময় ছাড়াই আমি আপনাকে বিবাহ করিব’। আর সোজা কথায় ইহার অর্থ, আপনি আমাকে বিবাহ করুন, কোন মহরানা আমাকে দিতে হইবে না। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, একজন মেয়ে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট বিবাহিতা হইবার উদ্দেশ্যে নিজেকে পেশ করিতে পারে- ইহা জায়েয। কুরআন মজীদে এই কথাই বলা হইয়াছেঃ নিম্নোদ্ধৃত আয়াতেঃ
****************************************
মু’মিন স্ত্রীলোক যদি নিজেকে নবীর জন্য উৎসর্গ করে যদি নবী তাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে- একান্তভাবে তোমার জন্য হে নবী- অন্যান্য মু’মিন ছাড়া। (তবে তাহা জায়েয হইবে)।
এই আয়াত ও উপরোক্ত দীর্ঘ হাদীসই এইরূপ বিবাহ জায়েয হওয়র অকাট্য দলীল এবং এই অনুযায়ী কোন মেয়ে যদি নিজেকে রাসূলে করীম (স)-এর সহিত বিবাহিতা হওয়ার জন্য পেশ করে ও রাসূলে করীম (স) মহরানা না দিয়াই বিবাহ করে তাহা হইলে তাহা তাঁহার জন্য হালাল হইবে। পরেও তাহাকে কোন মহরানা দেওয়া তাঁহার উপর ওয়াজিব হইবে না- না সঙ্মম হওয়ার কারণে না মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার পর। কিন্তু এই ব্যবস্থা কেবলমাত্র রাসূলে করীম (স)- এর জন্য, অন্য কহারও এইরূপ করার অধিকার নাই। অন্য কেহ এইরূপ করিলে- অর্থাৎ মহরানা ছাড়াই বিবাহ করিলে- মহরানা দেওয়া অবশ্যই ওয়াজিব হইবে।
নবী করীমের পক্ষে ****** ‘হেবা’ শব্দে বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে দুইটি কথা আছে। একটি হইল কুরআন মজীদেই এইরূপ বলা হইয়াছে। এই হাদীসেও তাহাই বলা হইয়াছে। অতএব তাহা হইতে পারে। আর দ্বিতীয় হইল, ‘হেবা’ শব্দে বিবাহ সংঘটিত হয়না। বরং সত্য কথা এই যে, বিবাহ (******* বা *********) শব্দ বলা চাড়া বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় না। রাসূলের উম্মতের লোকদের ব্যাপারেও তাহাই। এই শেষোক্ত দুইটি শব্দের যে কোন একটি ছাড়া বিবাহ হইতে পারে না। ইহা ইমাম শাফেয়ীর মত। আর ইমাম আবূ হানীফা (র) বলিলেনঃ
****************************************
চিরন্তন স্বামীত্বের অধিকার পাওয়ার কথা বুঝায় যে শব্দেই, তাহা বলা হইলে যে-কোন দম্পতির বিবাহ সম্পন্ন হইতে পারে।
সুফিয়ান সওরী, আবূ সওর এবং মালিকী মাযহাবের বহু বিশেষজ্ঞ ইমাম শাফিয়ীর উপরোক্ত মত সমর্থন করিয়াছেন। ইহা কাযী ইয়াযের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ।
মেয়ে লোকটির উক্ত কথা বলার পর রাসূলে করীম (স) কি করিলেন? উপরোদ্ধৃত হাদীসে বলা হইয়াছে? রাসূলে করীম (স) তাহার প্রতি তাকাইলেন। চোখ উপর হইত নিচের দিকে নিয়া আসিলেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয়, যে মেয়েকে বিবাহ করার কথা-বার্তা ও প্রস্তাব হইবে তাহাকে এইভাবে দেখা—যেভাবে রাসূলে করীম (স) মেয়েটিকে দেখিয়াছিলেন- সম্পূর্ণ জায়েয। ইমাম নববীর মতেঃ
****************************************
কোন উন্নত চরিত্রবান আদর্শ ব্যক্তির নিকট নিজেকে বিবাহ করার প্রস্তাব একটি মেয়ের নিজেই পেশ করা পছন্দনীয় কাজ- এ কথার প্রমাণ ইহাতে রহিয়াছে।
বুখারীর বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ ************ মেয়েটির ঐ কথা বলার পর রাসূলে করীম (স) কোন উত্তর দিলেন না। আর তাবারানীর বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) চুপ করিয়া থাকিলেন। মেয়েটি নিজেকে আবার পেশ করিল। তখনও তিনি চুপ থাকিলেন। (হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত সহল বলেন) আমি নিজে মেয়েটিকে চিন্তান্বিতা অবস্থায় দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিলাম এবং দাঁড়াইয়া থাকিয়াও সে নিজেকে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট পেশ করিতেছিলেন। কিন্তু তিনি চুপ ও নির্বাক হইয়া রহিয়াছেন।
আর হাম্মাদ ইবনে জায়দের বর্ননায় বলা হইয়াছেঃ
মেয়ে লোকটি নিজেকে আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের জন্য উৎসর্গ করিল। রাসূলে করীম (স) বলিলেন, আমার কোন মেয়ে লোকের প্রয়োজন নাই।
এই দুই ধরনের বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য বলা যায়, রাসূলে করীম (স) ইহা বলিয়াছিলেন সর্বশেষে। প্রথম দিকদিয়া তিনি নির্বাক ও লা-জওয়াবই রহিয়াছেন। তিন হয়ত মনে করিয়াছিলেন, মেয়েটির প্রস্তাবের কোন জবাব না দিলেই সে বুঝিতে পারিবে যে, তাহাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার কোন ইচ্ছাই রাসূলে করীমের নাই। কিন্তু সে যখন বার বার একই কথা বলিয়া নিজেকে পেশ করিতে লাগিল, তখন সুস্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দেওয়া প্রয়োজন মনে করিলেন।
রাসূলে করীম (স)-এর অস্বীকৃতির পর দরবারে উপস্থিত একজন লোক দাঁড়াইয়া বলিলেনঃ ইয়া রাসূল, আপনার প্রয়োজন না থাকিলে মেয়ে লোকটিকে আমার নিকট বিবাহ দিন। লোকটি কে ছিলেন? ইবনে হাজার আসকালানী লিখিয়াছেন ************ ‘আমি এই লোকটির নাম জানিতে পারি নাই’। আর তাবারানীর বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তখন একজন লোক দাঁড়াইল, হাদীস বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি মনে করি, লোকটি আনসার বংশের হইবেন। তবে তিনি যে একজন সাহাবী ছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।
রাসূলে করীম (স) বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশকারী সাহাবীকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ মহরানা দেওয়র মত কোন জিনিস তোমার নিকট আছে কি? তিনি তখণ কিছুই উপস্থিত করিতে পারিলেন না, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
দেখ, একটা লোহার আঙটিও জোগাড় করিতে পার কি না।
ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, মহরাহনা ব্যতীত কোন বিবাহই সংঘটিত হয় না। কেননা এই মহরানাই সমস্ত ঝগড়া-বিবাদ মিটাইয়া দেয়। আর মেয়ে লোকটির জন্যও এই মহরানা ধার্য হওয়া মর্যাদাসম্পন্ন জীবন যাপনেনর জন্য বিশেষ সহায়ক। কেনন নির্দিষ্ট পরিমাণ মহরানার ভিত্তিতে বিবাহ হইলে স্বামী যদি তাহাকে সংগম-সহবাসের পূর্বেই তালাক দিয়া দেয়, তাহা হইলে সে সেই পরিমাণের মহরানার অর্ধেক লাভ করিতে পারিবে। আর ইহা তাহার ইদ্দতকালীন ও অন্য স্বামী গ্রহণ পর্যন্তকার জন্য সম্বল হইবে। তবে আকদের সময় মহরানা নির্দিষ্ট না করা হইলেও বিবাহ শুদ্ধ হইবে। কুরআন মজীদেই আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা যদি মহরানার কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট না করিয়া এবং বিবাহের পর স্ত্রীকে স্পর্শ অর্থাৎ সঙ্গম করার পূর্বেই তাহাকে তালাক দাও, তবে তাহাতে কোন দোষ নাই।
ইহা হইতে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, আকদের সময় মহরানা নির্দিষ্ট করা না হইলেও বিবাহ এবং স্ত্রীকে তালাক দেওয়া জায়েয। অবশ্য আকদের স ময় মহরানা ধার্য না হইলেও পরে ইহা ধার্য করা ওয়াজিব হইবে। কেননা মহরানা তো দিতে হইবেই। ইহা স্ত্রীর অধিকার।
মহরানা কখন ওয়াজিব হয়। আকদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, না স্ত্রী সঙ্গম হওয়ার পর? এই বিষয়ে ফিকাহবিদগণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌছিয়াছেন। ইমাম শাফিয়ীর দুইটি কথা এ বিষয়ে উদ্ধৃত হইয়াছে। তন্মধ্যে নির্ভুলতম কথা হইল, স্ত্রী সঙ্গম সংঘটিত হইলেই মহরানা ওয়াজিব হইয়া যায়। উপরোক্ত আয়াত হইবে বাহ্যতঃ তাহাই মনে হয়।
আলোচ্য হাদীসের উপরোদ্ধৃত বাক্যাংশ হইতে একথাও প্রমাণিত হয় যে, মহরানার নির্দিষ্ট ও শরীয়াত কর্তৃক ধার্যকৃত কোন পরিমাণ নাই। উহা কম পরিমাণেরও হইতে পারে, হইতে পারে বেশী পরিমাণেরও। উভয়পক্ষ স্বামী ও স্ত্রী যে পরিমাণে পরস্পর সম্মত ও ঐক্যমত হইবে, তাহাতেই বিবাহ সহীহ হইবে। কেননা রাসূলে করীম (স) মহরানা হিসাবে একটা লোহার আঙটিও আনিতে বলিয়াছেন।আর লোহার আঙটি তো মূল্যের দিক দিয়া অতি নগণ্য। ইমাম শাফিয়ী এই মত দিয়াছেন এবং পূর্ব ও পরের অধিকাংশ আলেমই এই মত গ্রহণ করিয়াছেন! রবীয়া, আবুজ-জানাদ, ইবনে আবূ জি’ব, ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ, লাইসা ইবনে সায়াদ, সওরী আওজায়ী, ইবনে আবূ লাইলা, দায়ূদ এবং অন্যান্য হাদীস ও ফিকাহবিদগণ এই কথাই সমর্থন করিয়াছেন। রবীয়া, আবুজ-জানাদ, ইবনে আবূ জি’ব, ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ, লাইসা ইবনে সায়াদ, সওরী, আওজায়ী, ইবনে আবূ লাইলা, দায়ূদ এবং অন্যান্য হাদীস ও ফিকাহবিদগণ এই কথাই সমর্থন করিয়াছেন। মালিকী মাযহাবের অনুসারী হাদীস ফিকাহবিদ ইবনে অহাবও এই কথাই বলিয়াছেন কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, হিজাজ, বাছরা, কূফা ও সীরিয়ার প্রখ্যাত আলেমগণের মাযহাব এই যে, স্বামী-স্ত্রী যে পরিমাণ মহরানায় পরস্পর সম্মত হইবে, তাহা কম হউক বেশী হউক এবং চাবুক, জুতা বা লোহার আংটি প্রভৃতি যাই হউক না কেন, তাহাতেই বিবাহ জায়েয হইবে। ইমাম মালিক বলিয়াছেন, মহরানার নুন্যতম পরিমাণ হইল চার দীনার। এই পরিমাণ সম্পদ চুরি করিলে ‘চুরি’ সাব্যস্ত হয় ও দন্ডযোগ্য অপরাধ রূপে গণ্য হয়। কাযী ইয়াযের মতে ইহা ইমা মালিকের একার মত। ইহাতে তাঁহার সমর্থক কেহ নাই। ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁহার সঙ্গীগণ বলিয়াছেনঃ ********** ‘মহরানা নূন্যতম পরিমাণ হইল দশ দিরহাম’। ইহার কম পরিমাণের মহরানার বিবাহ জায়েয নয়। ইবনে শায়রামাতা বলিয়াছেনঃ নূন্য পরিমাণ মহরানা হইল পাঁচ দিরহাম। অবশ্য এই মত অধিকাংশ ফিকাহবিদদের মতের বিপরীত। বর্তমান আলোচ্য হাদীস হইতেও হানাফী মতের বিপরীত কথাই প্রমাণিত হয়। কেননা এই সহীহ হাদীসটি প্রমাণিত হয় যে, একটা লোহার আঙটিও মহরানা হইতে পারে। আর একটা লোহার আংটির মূল্য যে অতি সামান্য তাহা সর্বজনবিদিত।
এই হাদীস হইতে একথা জানা যায় যে, স্ত্রীর মহরানা অনতিবিলম্বে তাহাকে দিয়া দেওয়া ভাল। হাদীসটিতে উদ্ধৃত বিবহা-প্রার্থী সাহাবীর প্রায় প্রত্যেকটি কথার শুরুতে ************** বলিয়া আল্লহর শপথ উদ্ধৃত হইয়াছে। অথচ ইহা শপথ করিয়া কথা বলার স্থান নয় এবং উহার কোন প্রয়োজনও এখানে নাই। ইহা হইতে জানা যায় যে, বিনা প্রয়োজনে ও প্রকৃত শপথের লক্ষ্য না থাকা সত্ত্বেও শপথ করিয়া কথা বলা সম্পূর্ণ নাজায়েয নয়। কিন্তু আসলেই ইহা পছন্দনীয় কাজ নয়। এই ঘটনার বিবরণ হইতে একথাও জানা যায় যে, দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদেরও বিবাহ করার অধিকার আছে। এজন্য সমাজ তথা রাষ্টের পক্ষ হইতে তাহাদের সহিত সহযোগিতা হওয়া বাঞ্ছনীয়। গরীব মানুষ বলিয়া বিবাহ করিবে না, কেবল ধনী ও সচ্ছল লোকেরাই বিবাহ সুখ ভোগ করিবে, ইহা আর যাহাই হউক, মানবিক নীতি হইতে পারে না। ইসলামী নীতিতো নয়-ই।
বিবাহ-প্রার্থী সাহাবী যখন বলিলেনঃ আমার কাপড় খানাই আছে। ইহার অর্ধেক তাহাকে মহরানা স্বরূপ দিতে পারি। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ ‘তুমি এই কাপড় থানা দিয়া কি করিবে? তুমি ইহা পরিলে তোমার স্ত্রীর কোন কাজে লাগিবে না। আর সে পরিলে তোমার ব্যবহারের জন্য কোন অংশ থাকিবে না’। আসলে ইহা সাহাবীর কাজের পরিণতিতে যে অসুবিধা ও জটিলতা দেখা দিতে পারে- যে বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশংকা রহিয়াছে, ইহা তাহারই বিশ্লেষণ এবং সেই দিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৃ্টি আকর্ষণ। বস্তুত প্রত্যেক জন-নেতা, সমাজ-পতি ও রাষ্ট্র প্রধানের ইহাই কর্তব্য।
সর্বশেষে মহরানা পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেনঃ
****************************************
তুমি কোরআনের যে সূরা কয়টির নাম করিলে তাহা কি মুখস্থ করিয়াছ ও হৃদয় দিয়া এইগুলির সংরক্ষণ করিতেছ?
কোন কোন সূরা তাঁহার মুখস্ত আছে, তাহার নাম এই বর্ণনায় উল্লেখ করা হয় নাই। কিন্তু হযরত ইবনে মাসউদের বর্ণনায় সূরা কয়টির নাম উল্লেখ করা হইয়াছে । তাহাতে সাহাবীর জবাব এই ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ *************** হ্যাঁ, সূরা বাকারা ও আর একটি দীর্ঘ সূরা। আর আবূ দায়ূদ ও নাসায়ীতে হযরত আবূ হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ ************** সেই লোক এই প্রশ্নের জবাবে যখন বলিলেন, হ্যাঁ, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
যাও, তুমি কুরআনের যতটা মুখস্থ ও সংরক্ষিত রাখিয়াছ, উহার বিনিময়েই তোমাকে এই মেয়েলোকটির স্বামীত্বের মালিক বানাইয়া দেওয়া হইল।
বুখারীর বর্ণনায় ইহার ভাষা হইলঃ ************* ‘আমি তোমাকে ইহার মালিক করিয়া দিলাম। কিন্তু ইমাম দারে কুতনী বলিয়াছেন, ইহা ভ্রামাত্মক। সহীহতম বর্ণনানুযায়ী শব্দটি হইবেঃ ******** ‘আমি তোমাকে এই স্ত্রীলোকটির সহিত বিবাহ দিলাম’। অথবা ‘তোমার নিকট স্ত্রীলোকটিকে বিবাহ দিলাম’। এই দুইটিই হইতে পারে।
এই হাদীসের ভিত্তিতে এই মতও শরীয়াত সম্মত যে, কুরআন মজীদ শিক্ষা দেওয়াটাও অবস্থা বিশেষে বিবাহে স্ত্রীর মহরানা হইতে পারে এবং ইহাকে ‘মহরানা’ ধরিয়া বিবাহের আকদ করা হইলে সে বিবাহ সহীহ হইবে। ইহা ইমাম শাফেয়ীর মত এবং তাঁহার মতে এই হাদীসের দলীল অনুযায়ী কুরআন শিক্ষা দানের পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয। আতা, হাসান ইবনে সালেহ, মালিক ও ইসহাক প্রমুখ ফিকাহবিদগণও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। অবশ্য ইমাম জুহরী ও ইমাম আবূ হানীফা ইহা সমর্থন করেন নাই। আলোচ্য হাদীসটি এবং
****************************************
তোমরা যে সব কাজে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর, কুরআন তন্মধ্যে ইহার বেশী অধিকার সম্পন্ন। অর্থাৎ শিক্ষাদানের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ অবশ্যই জায়েয।
এই সহীহ হাদীসটি হইতেও কুরআন শিক্ষাদানের পারিশ্রমিক লওয়া জায়েয প্রমাণিত হয়।
(*********************)
এই দীর্ঘ হাদীসটির কথা সংক্ষিপ্তভাবেও বর্ণিত হইয়াছে বিভিন্ন বর্ণনায়। একটি বর্ণনার ভাষা এইঃ
****************************************
নবী করীম (স) একটি লোককে- যাহার নিকট কিছুই ছিল না- সূরা বাকারার বিনিময়ে বিবাহ দিলেন।
অপর একটি বর্ণনার ভাষা এইঃ
****************************************
নবী করীম (স) তাঁহার একজন সাহাবীকে বিবাহ করাইয়াছিলেন একটি দীর্ঘ সূরার বিনিময়ে, উহাকে মহরানা স্বরূপ ধরিয়াছিলেন এবং মেয়েটিকে তাহার নিকট প্রবেশ করাইয়া দিয়া বলিয়াছিলেন, ইহাকে তাহা শিক্ষা দাও।
বেশী ও বড় পরিমাণের মহরানা ধার্যকরণ
****************************************
আবূল আজফা হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত উমর ইবনূল খাত্তাব (রা) বলিয়াছেনঃ তোমরা মেয়েদের মহরানা বেশী বেশী পরিমাণে ধার্য করিও না। কেননা বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করাই যদি দুনিয়ায় অধীক সম্মানজনক হইত এবং ইহাই যদি আল্লাহর নিকট তাকওয়া প্রমাণকারী হইত, তাহা হইলে তোমাদের অপেক্ষা রাসূলে করীম (স)-ই এইরূপ করার অধিক উপযুক্ত ছিলেন। অথচ নবী করীম (স) তাঁহার স্ত্রীদের কেহকে বিবাহ করার সময় কিংবা তাঁহার কন্যাদের মধ্যে কাহাকেও বিবাহ দেওয়ার সময় ‘বারো আউকিয়া’র অধিক পরিমাণে মহরানা ধার্য করিয়াছেন বলিয়া আমি জানিনা।
(তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ উপরে যে হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে, ইহা হযরত উমর ফারুকের কথা। তিনি প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। সাহাবীর কথাও হাদীস, ইহা তাহার অকাট্য প্রমাণ। কেননা সাহাবীরা শরীয়াতের যে সব বিষয়ে কথা বলিয়াছেন তাহা সরাসরি রাসূলের কথার ভিত্তিতে বলিয়াছেন কিংবা রাসূলের নিকট হইতে জানিয়া লইয়া বলিয়াছেন। এই হাদীসটিতেও তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহার সত্যতা প্রমাণের জন্য রাসূল (স)-এর ‘বাস্তব আমল’কে ভিত্তি করিয়াছেন।হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) প্রথমতঃ বলিয়াছেনঃ ‘তোমরা বিবাহে মেয়েদের জন্য খুব বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করিও না’। কেন? তাহার প্রথম কারণ এই যে, বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করা হইলেই কাহারও জন্য অত্যাধিক সম্মান ও মর্যাদার কারণ হয় না। সেকাল হইতে একাল পর্যন্তকার লোকদের মধ্যে যাহারা নিজদিগকে শরীফ খান্দানের লোক বলিয়া আহমিকা বোধ করে, তাহাদের মধ্যে বেশী বেশী পরিমাণের মহরানা ধার্য করার প্রবণতা প্রকট হইয়া থাকিতে দেখা যায়। তাহারা মনে করে, আমরা যেহেতু শরীফ খান্দান- তথা উচ্চ বংশের এবং বড় লোক, অতএব আমাদের ঘরের মেয়ে বিবাহ করিতে হইলে অধিক পরিমাণে মহরানা দিতে হইবে এবং ইহারাই যখন অন্য ঘর হইতে মেয়ে বিবাহ করিয়া লইয়অ আসে তখনও খুব বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করে ও দিতে স্বীকৃত হয়। কেননা তাহাদের মতে কম পরিমাণেল মহরানা ধার্য করা হইলে শরাফতী প্রমাণিত হয় না। হযরত উমর (রা) বলিয়াছেন, এই মনোভাব ভিত্তিহীন ও এই শরাফতীবোধ সম্পূর্ণ অমূলক। তিনি দ্বিতীয়ত; বলিয়াছেন, ইহা দ্বারা খোদাভীতির মাত্রাতিরিক্ততাও প্রমাণিত হয় না। আর এই উভয় কথার যুক্তি হিসাবে তিনি বলিয়াছেনঃ মানব সমাজে রাসূলে করীম (স)- ই সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি। বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করাই যদি অধিক মর্যাদা ও খান্দানী শরাফতীর লক্ষ্য হইত, তাহা হইলে তিনি নিজে ইহা করিতেন। তিনি নিজে যে সব বিবাহ করিয়াছেন তাহাতে বেশী পরিমাণ মহরানা দিতে রাযী হইতেন এবং তাঁহার কন্যাদের বিবাহেও বেশী বেশী মহরানা ধার্য করিতেন, কিন্তু তিনি তাহা করেন নাই। তিনি মোটামুটি ভাবে বারো আউকিয়া-৪৮০ দিরহামের অধিক পরিমাণ মহরানা কোন ক্ষেত্রেই ধার্য করেন নাই। এই পরিমাণটা খুবই সাধারণ, অতএব মহরানা ধার্য করার ক্ষেত্রেও মুসলমানদের কর্তব্য রাসূলে করীম (স)-এর আমলকে অনুসরণ করা। এই ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি পরিবারিক জীবনে চরম ভাঙন ও বিপর্যয় আনিয়া দেয় অনিবার্যভাবে। আর যদি এক্ষেত্রে জবরদস্তি বা হঠকারিতা দেখানো হয়, তাহলে দাম্পত্য কলহ ও স্থায়ী অশান্তির কারণ হওয়া অবধারিত।
রাসূলে করীমের বেগম উম্মুল মু’মিনীন উম্মে হাবীবার মহরানা ছিল চার হাজার দিরহাম, একথা ঠিক। কিন্তু এই পরিমাণ মহরানা রাসূলে করীম (স) নিজে দেন নাই, দিয়াছেন রাসূলে করীম (স)-এর পক্ষ হইতে আবিসিনীয়ার বাদশাহ নাজাশী। কাজেই ইহা হযরত উমর ফারুকের কথার আওতাবহির্ভূত। এই পরিমাণ মহরানা নবী করীম (স) কর্তৃক ধার্যকৃতও নয়। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) তাঁহার বেগমদের জন্য দেওয়া মহরানা ছিল বারো আউকিয়া ও অর্ধ আউকিয়া। আর ইহাতে মোট পাঁচ শত দিরহাম হয়। রাসূলে করীম (স)-এর দেওয়অ মহরানা গড়ে ইহাই ছিল।
কিন্তু এই পরিমাণটাও মোটামুটিভাবে হযরত উমর (রা) কথিত মহরানা পরিমাণের অধিক নয়। বড় জোর এতটুকু বলা যায়, হযরত আয়েশা (রা)- এর বর্ণনায় যে অর্ধ আউকিয়ার কথা আছে, তাহা তিনি গণ্য করেন নাই। অতএব এই দুইটি বর্ণনার মধ্যে কোনই বিরোধ বৈপরীত্য নাই। আর ইহাও হইতে পারে যে, হযরত উমর (রা) হয়ত উম্মে হাবীবা ও হযরত আয়েশার এই বর্ণনার কথা জানিতেন না। কিন্তু ইহাতে মৌলিক পার্থক্য এই জন্য নাই যে, তিনি তো রাসূলের দেওয়া মহরানা-পরিমাণের অধিক ধার্য করিতে নিষেধ করিয়াছেন মাত্র এবং তাহা নিঃসন্দেহে যথার্থ।
এখানে প্রশ্ন উঠিতে পারে, কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
এবং তোমরা দিয়অছ তোমাদের কোন এক স্ত্রীকে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ মহরানা স্বরূপ, তাহা হইল উহা হইতে একবিন্দুও ফিরাইয়া লইও না।
*********** শব্দের অর্থ বিপুল সম্পদ।
ইহা হইতে বুঝা যায়, মহরানা স্বরূপ বিপুল ধন-সম্পদও দেওয়া যাইতে পারে। তাহা হইলে হযরত উমর (রা)- এর উপরোক্ত কথা কুরআনের এই কথার বিপরীত হয় না কি?
প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এই প্রশ্নই এক বর্ণনানুযায়ী হযরত উমর (রা)- এর উপরোক্ত ভাষণের পর পরই উত্থিত হইয়াছেঃ হযরত উমর (রা) যখনই উক্ত কথা বলিয়াছেন তখনই মজলিস হইতে একজন মহিলা দাঁড়াইয়া বলিলেনঃ
****************************************
হে উমর! আল্লাহ (সুবহানাহু) তা’আলা তো আমাদিগকে দিতেছেন আর আপনি আমাদিগকে বঞ্চিত করিতেছেন? আল্লাহ সুবহান কি বলেন নাই? ‘আর তোমরা কোন স্ত্রীকে যদি বিপুল ধন-সম্পদ দিয়অ থাক, তাহা হইলে উহা হইতে কিছুই ফিরাইয়া লইও না’?
তখন হযরত উমর (রা) বলিলেনঃ ******* ‘একটি মেয়ে লোক ঠিক বলিয়াছে আর উমার ভুল করিয়াছে’। অন্য বর্ণনার ভাষা হইলঃ ********** মেয়েলোক ঠিক বলিয়াছে আর পুরুষ ভূল করিয়াছে’। *********** ‘অতঃপর তিনি বেশী মহরানা ধার্য অস্বীকার করা পরিহার করিয়াছেন’।
এই বর্ণনাটি ইমা কুরতুবী তাঁহার তফসীরে উদ্ধৃত করিয়াছেন। কিন্তু তিনি ইহা কোন গ্রন্হ হইতে গ্রহণ করিয়াছেন তাহার উল্লেখ করেন নাই। উপরে তিরমিযী হইতে যে হাদীসটি উদ্ধৃত করা হইয়াছে, তাহাতে এই কথার উল্লেখ নাই। আবূ হাতিম আল বুস্তী তাঁহার সহীহ মুসনাদ গ্রন্হে এই আবুল আজফা হইতেই এই বর্ণনাটি উদ্ধৃত করিয়াছেন; কিন্তু তাহাতেও কুরতুবী উদ্ধৃত অংশের উল্লেখ নাই। ইবনে মাজাহ গ্রন্হেও আবুল আজফা হইতে বর্নিত এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে, কিন্তু তাহাতেও মেয়ে লোকের আপত্তি করা ও হযরত উমরের ভূল (?) স্বীকার করা সংক্রান্ত বিবরণের কোনই উল্লেখ নাই।
সে যাহাই হউক, এই আয়াতের দৃষ্টিতেও হযরত উমরের কথার বাতুলতা প্রমাণিত হয় না। কেননা আয়াত হইতে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ স্ত্রীকে মহরানা স্বরূপ দেওয়া বড়জোর শুধু জায়েযই প্রমাণিত হইতে পারে; কিন্তু তাহা করাই যে উত্তম ও মঙ্গলজনক, তাহা বুঝায় না। অথচ হযরত উমরের সমস্ত কথা উত্তম ও কল্যাণময় পরিমাণ সম্পর্কে, কতটা জায়েয আর কতটা নাজায়েয সে বিষয়ে তিনি কিছুই বলেন নাই।
অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় উদ্ধৃত হইয়াছে, হযরত উমর (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা স্ত্রীদের মহরানা চল্লিশ আউকিয়ার বেশী ধার্য করিও না। যদি কেহ বেশী ধার্য করে তাহা হইলে অতিরিক্ত অংশ আমি বায়তুল মালে জমা করিয়া দিব।
ইহাতে চল্লিশ আউকিয়া ন্যুন্য পরিমাণ বলা হইয়াছে। কিন্তু এই বর্ণনাটি ********* বিচ্ছিন্ন সনদ সূত্রে উদ্ধৃত হইয়াছে। অবশ্য মসরুক হইতে ‘মুত্তাসিল’ সূত্রে এই বর্ণনাটি-ই বর্ণিত হইয়াছে। মুহাদ্দিস সাইয়্যিদ জামালুদ্দীন তাঁহার ‘রওজাতুল আহবাব’ গ্রন্হে উল্লেখ করিয়াছেনঃ
****************************************
হযরত ফাতিমার মহরানা ধার্য করা হইয়াছিল চার শত মিসকাল রৌপ্য।
কিন্তু ইবলুল হুম্মাম উল্লেখ করিয়াছেনঃ
****************************************
হযরত ফাতিমা (রা)-এর মহরানা চার শত দিরহাম ছিল।
কাজেই প্রথমোক্ত কথা গ্রহণযোগ্য নয়। আসলে হযরত আলী (রা) ফাতিমার মহরানা বাবত তাহার একটি বর্ম দিয়াছিলেন। উহা বিক্রয় করিয়া যে মূল্য পাওয়া গিয়াছিল তাহাই ছিল হযরত ফাতিমার মহরানা।
(********************)
ন্যূন্য পরিমাণ মহরানা
ন্যুন্য পরিমাণ মহরানা সম্পর্কে বহু কয়টি হাদীস বর্ণিত ও গ্রন্হ সমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে। একটি হাদীসঃ
****************************************
হযরত জাবির (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ দশ দিরহামের কমে কোন মহরানা নাই।
ব্যাখ্যাঃ আল্লামা আবূ বকর আল জাসসাস, হানাফী এই হাদীসের ভিত্তিতে বলিয়াছেন, মহরানার ন্যূন্যতম পরিমাণ দশ দিরহাম। দশ দিরহামের কম পরিমাণে মহরানা ধার্য হইলে বিবাহ সহীহ হইবে না। তিনি ইহার সমর্থনে উল্লেখ করিয়াছেনঃ
****************************************
হযরত আলী (রা) বলিয়াছেনঃ দশ দিরহামের কমে কোন মহরানা নাই।
আল্লামা জাসসাস বলিয়াছেন, মহরানা আল্লাহর নির্ধারিত হক। কিন্তু উহার পরিমাণটা যে কি, তাহা ইজতিহাদের মাধ্যমে জানা যায় না। উহা জানার উপায় হইল শরীয়াতের জ্ঞান ও ইংগিত। আর ইহার পরিমাণ হইল দশ দিরহাম। এই বিষয়ে অন্তত এতটুকু বলা যায় যে, ইহা শরীয়াতের জ্ঞান ও ইংগিত হইতে জানা গিয়াছে। এইরূপ বলার দৃষ্টান্ত শরীয়াতেই রহিয়াছে। যেমন হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ হায়েযের ন্যূন্যতম মিয়াদ হইল তিন দিন এবং বেশীর পক্ষে দশ দিন। আর উসমান ইবনে আবুল আচ আস-সাকাফী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নিফাসের মিয়াদ বেশীর পক্ষে চল্লিশ দিন। আর ইহা শরীয়াতের জ্ঞান ও ইংগিত হইতে জানা গিয়াছে। কেননা এইরূপ কখনও চিন্তা কল্পনা প্রসূত হইতে পারে না। হযরত আলী (রা)- এর আর একটি বর্ণনা এই রূপঃ
****************************************
নামাযের শেষে তাশাহুদ পাঠ পরিমাণ সময় বসিয়া থাকিলেই নামায সম্পুর্ণ হইয়া গেল।
বুঝা গেল, তাশাহুদ পরিমাণ বসার ফরযটির এই সময় পরিমাণ শরীয়াতের জ্ঞান ও ইংগিত হইতে জানা গিয়াছে।
হানাফী মযহাবের কেহ কেহ দশ দিরহামের মহরানা হওয়ার দলীল এই দিয়াছেন যে, স্ত্রীর যৌন অস্থ ব্যবহার মুবাহ হইতে পারে কোন মাল-সম্পদের বিনিময়ে। ফলে এই ব্যাপারটি চোরের হাত কাটার সহিত সদৃশ হইয়া গেল। হাতও একটা অঙ্গ। উহার কর্তন মুবাহ হইতে পারে কোন মাল-সম্পদ চুরির কারণে। আর এই সম্পদের মূল্য পরিমাণ ন্যূন্য পক্ষে দশ দিরহাম। মহরানার ব্যাপারটিও এইরূপ। দ্বিতীয় কথা, এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, স্ত্রীর যৌন অঙ্গ সম্ভোগ একজন পুরুষের জন্য মুবাহ হইতে পারে বিনিময় মূল্য দেওয়া হইলে। মতবিরোধ শুধূ নূন্যতম পরিমাণ লইয়া। কাজেই ইহার মীমাংসা হইতে পারে এমন জ্ঞানের ভিত্তিতে যাহা শরীয়াত হইতে উৎসারিত। উহা মুবাহ হইবে না যতক্ষণ না উহা জায়েয হওয়ার কোন দলীল পাওয়া যাইবে। এই দলীল হইতেই জানা গিয়াছে দশ দিরহাম। এই পরিমাণটা সর্বসম্মত। এই পরিমাণের কমে মতভেদ রহিয়াছে।
(**************)
কিন্তু মহরানার ন্যুন্যতম পরিমাণ পর্যায়ে হানাফী মাযহাবের বিশেষজ্ঞদের এই সব যুক্তি-জাল ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া যায় যখন হাদীস বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে হযরত আলী (রা) বর্ণিত এসব হাদীসের বিচার-বিবেচনা করা হয়। হযরত জাবির বর্ণিত যে হাদীসটি দারে কুতনী গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাতে বলা হইয়াছে ********* ‘দশ দিরহামের কমে কোন মহরানা হইতে পারে না’। ইহাকে সনদের দিক দিয়া সহীহ মনে করা গেলেও ইহা সেই সব সহীহ হাদীসের পরিপন্হী যাহা হইতে ইহার কমেও মহরানা হইতে পারে বলিয়া অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। কিন্তু সনদের বিচারে এই হাদীসটি সহীহ নয়। কেননা ইহার সনদে মুবাশশির ইবনে উবাইদ ও হাজ্জাজ ইবনে আরতাত দুইজন বর্ণনাকারীই যয়ীফ। আর হাজ্জাজ ‘তাদলীস’ [তাদলীস-*********** হাদীসের বর্ণনাকারী উপরের বর্ণনাকারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন বটে; কিন্তু তাহার নিকট হাদীস শুনিতে পায় নাই, তাহা সত্ত্বেও তাহার নিকট হইতে শুনিয়াছেন ভুলবশতঃ এই কথা মনে করিয়অ তাহার সূত্রে হাদীস বর্ণনা করা। অথবা তাহার নিকট হইতে কিছু শুনিয়াছেন বটে; কিন্তু যাহা শুনিয়াছেন তাহার পরিবর্তে অন্য কিছু তাহার সূত্রে বর্ণনা করা। হাদীস শাস্ত্রে ইহা অত্যন্ত কঠিন ঘৃণ্য কাজ। উস্তাদের নাম বা উপনাম কিংবা গুণ এমন ভাষায় উল্লেখ করা যাহাতে তাঁহাকে চিনিতে পারা না যায়, ইহাও তাদলীস। তবে ইহা প্রথম প্রকারের তুলনায় কতকটা হালকা ধরনের।] করে বলিয়া প্রখ্যাত এবং মুবাশশির পরিত্যাক্ত- তাহার বর্ণিত হাদীস অগ্রহণযোগ্য। ইমাম দারে কুতনী নিজেই ইহা বলিয়াছেন। ইমাম বুখারী বলিয়াছেনঃ *********** [সিকাহ বর্ণনাকারী অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য হাদীসের বিপরীত হাদীস বর্ণনা করে এবং একাকী অত্যন্ত যয়ীফ হাদীস বর্ণনা করিতে অভ্যস্থ।]। ইমাম আহমাদ বলিয়াছেন, তাহার বর্ণিত অপরাপর বর্ণনা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আর হযরত আলী (রা)- এর উপরোদ্ধৃত কথাটি বায়হাকী গ্রন্হে উদ্ধৃত। ইহার সনদে রহিয়াছে দায়ূদ আল-উয়াদী, এই নামটি দুইজন লোককে বুঝায়। একজন দায়ূদ ইবনে জায়দ। সে সর্বসম্মতভাবে যয়ীফ। আর দ্বিতীয় জন দায়ূদ ইবনে আবদুল্লাহ। ইমাম আহমাদ তাহাকে সিকাহ ও বিশ্বাস্য বলিয়াছেন বটে; কিন্তু ইয়অহইয়অ ইবনে মুয়ীন হইতে তাঁহার সম্পর্কে বিভিন্ন মত বর্ণিত হইয়াছে। বায়হাকী হযরত জাবির (রা) বর্ণিত কথাটিও উদ্ধৃত করিয়াছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বলিয়া দিয়াছেন *********** ইহা যয়ীফ হাদীস। হযরত আলী (রা) হইতে উক্ত কথাটি অন্য একটা সূত্রেও বর্ণিত হইয়াছে। তাহাতে আবূ খালেদ আল-ওয়াসেতী নামের একজন বর্ণনাকারী আছেন। কিন্তু ইহা একটি দূর্বল সূত্র। ইহাকে দলীল হিসাবে পেশ করা যাইতে পারে না। যদি একথা বলা হয় যে, বহু কয়টি যয়ীফ হাদীসও মিলিত হইয়া শক্তিশালী হইয়া উঠে, তাহা হইলে বলিতে হইবে, এই যয়ীফ হাদীসগুলি মিলিত হইয়াও এমন পর্যায়ে পৌঁছে না, যাহা বিশ্বাসযোগ্য হইতে পারে। (আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী এই কথার জবাবে বলিয়াছেনঃ যয়ীফ হাদীস যদি এমন সূত্রে বর্ণিত হয় যাহা ‘হাসান’ হইয়া যায়, তাহা হইলে উহাকে দলীল হিসাবে পেশ ও গ্রহণ করা যাইতে পারে) বিশেষত এই দুর্বল হাদীস সমুহের প্রতিপাদ্য যখন বুখারী মুসলিম বর্ণিত সহীহতম হাদীসেরও পরিপন্হী, তখনই এইগুলিকে গণনার যোগ্য মনে করা যায় না। দ্বিতীয়ত ন্যূন্যতম পরিমাণ পর্যায়ে আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ হইতেই ভিন্নতর কথা বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর বলিয়াছেন, পঞ্চম দিরহাম। নখয়ী বলিয়াছেন, চল্লিশ দিরহাম। ইবনে শাবরামাতা বলিয়াছেন, পাঁচ দিরহাম। ইমাম বলিয়াছেন, এক দীনারের এক চতুর্থাংশ.. ইত্যাদি। সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব তাঁহার কন্যার বিবাহ দিয়াছিলেন মাত্র দুই দিরহাম মহরানার বদলে। আর আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) মাত্র পাঁচ দিরহাম মহরানায় বিবাহ করিয়াছিলেন।
কাজেই এই সব বিতর্কে না পড়িয়া সহজ ও সোজা মত এই হইতে পারে যে, বর ও কনে-বরপক্ষ ও কনে পক্ষের পারস্পরিক মতের ভিত্তিতে যে পরিমাণটাই ধার্য হইবে, তাহাই সঠিক মহরানা বিবেচিত হইবে। কয়েকজন প্রখ্যাত ফিকাহবিদ এই মত প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেনঃ
****************************************
সংশ্লিষ্ট লোকেরা পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও শুভেচ্ছার ভিত্তিতে যে পরিমাণটা ধার্য করিবে, তাহাই সঠিক মহরানা।
আহমাদ ইবনে মাজাহ ও তিরমিযী উদ্ধৃত ও আমের ইবনে রবীয়াতা বর্ণিত হাদীস হইতে দুই জুতাকে মহরানা ধার্য করিলেও বিবাহ সহীহ হয় বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে।
বিবাহ অনুষ্ঠানের সময়
****************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) আমাকে শওয়াল মাসে বিবাহ করিয়াছেন এবং সেই শাওয়াল মাসেই আমাকে লইয়া ঘর বাঁধিয়াছেন।
(তিরমিযী, মুসলিম, নাসায়ী)
ব্যাখ্যাঃ ইমাম নববী লিখিয়াছেন, এই হাদীস হইতে জানা যায়, শওয়াল মাসে বিবাহ করা এবং সওয়াল মাসেই নববধু লইয়া বাসর ঘরে প্রবেশ করা উত্তম। যাহারা ইহাকে মুস্তাহাব মনে করেন, তাঁহারা এই হাদীসের ভিত্তিতেই এই মত গ্রহণ করিয়াছেন।
হযরত আয়েশা (রা) শাওয়াল মাসে বিবাহ হওয়া এবং তাঁহাকে লইয়া বাসরঘর সাজানো হউক, ইহাই তিনি চাহিয়াছিলেন ও তাঁহার ইচ্ছানুযায়ীই ইহা হইয়াছিল। তিনি এইরূপ করিয়া জাহিলিয়াতের সময়ের একটা কুসংস্কার চূর্ণ করিতে চাহিয়াছিলেন মাত্র। কেননা তখনকার সময়ে শাওয়াল মাসে লোকেরা বিবাহ-শাদী করা অমংগলজনক মনে করিত। বিশেষ করিয়া এজন্যও যে, শাওয়াল মাস হজ্জ্বের জন্য নির্দিষ্ট মাস সমূহের একটি। আর হজ্জ্বের মাস সমূহে বিবাহ-শাদীর অনুষ্ঠান করা সাধারণভাবেই ভাল মনে করা হইত না।
বস্তুত ইসলাম যাবতীয় ভিত্তিহীন কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত করিয়াছে। বিবাহ অনুষ্ঠান, বাসর-ঘর সাজানো ও নববধু লইয়া ঘর বাঁধা ইত্যাদির ব্যাপারে অশিক্ষিত মানুষ সর্বকালেই বিশেষ করিয়া সময়ের ব্যাপারে নানা কুসংস্কারে নিমজ্জিত থাকে। ইসলাম ইহা হইতে মানুষকে মুক্ত করিয়াছেন এবং জানাইয়া দিয়াছে যে, এই সব কাজ বছরের যে কোন দিনে যে কোন মাসে বা যে কোন সময়ে অনুষ্ঠিত হইতে পারে। ইসলামে বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য কোন লগ্ন নাই। লগ্ন না হইলে বিবাহ হইবে না এবং লগ্ন চলিয়া গেলে বিবাহ হইতে পারিবে না, ইহা কেবল মাত্র মুশরিকদের রীতি, তওহীদ বিশ্বাসীদের নয়।
(******************)
বিবাহের খুতবা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে ‘প্রয়োজন সময়ের ভাষণ’ শিক্ষা দিয়াছেন। তাহা-এই যে, প্রথমে পড়িতে হইবে (মূলের তরজমা): ‘সমস্ত তা’রীফ আল্লাহন জন্য তাঁহারই সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁহার নিকট ক্ষমা চাহি। আমরা সকলে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি আমাদের মন ও প্রবৃত্তির সমস্ত দুষ্কৃতি হইতে। আল্লাহ যাহাকে হেদায়েত দেন, তাহার ভ্রষ্টকারী কেহ নাই।, আর তিনি-ই যাহাকে ভ্রষ্ট করেন, তাহার হেদায়াতকারী কেহ নাই। আমি সাক্ষ্য দিতেছি, আল্লাহ ছাড়া কেহ মা’বুদ নাই। আমি এই সাক্ষ্যও দিতেছি যে, হযরত মুহাম্মদ তাঁহার বান্দাহ ও রাসূল। অতঃপর তিনটি আয়াত পরপর পড়িতে হইবে। (১) হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যেমন ভয় তাঁহাপকে করা উচিত এবং তোমরা মুসলমান অবস্থা ছাড়া মৃত্যু মুখে পতিত হইও না। (২) হে মানুষ! তোমরা ভয় কর তোমাদের রবকে, যিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন একই ব্যক্তিসত্তা হইতে এবং তাহা হইতেই সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার জুড়ি। আর এই দুই জনের সম্মিলনের ফলে ছড়াইয়া দিয়াছেন বিপুল সংখ্যক পুরুষ ও নারী। তোমরা ভয় কর আল্লাহকে, যাঁহার দোহাই দিয়া তোমরা পরস্পরের নিকট কিছু চাও এবং রেহেমকে- আল্লাহ নিঃসন্দেহে তোমাদের পর্যবেক্ষক হইয়া আছেন। (৩) হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা ভয় কর আল্লাহকে এবং বল সত্য যথার্থ কথা, তাহা হইলে তিনি তোমাদের কাজ কর্ম ভাল কল্যাণময় করিয়া দিবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ মাফ করিয়া দিবেন। আর যে লোক আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করে, সে বিরাট সাফল্য লাভে ধন্য হয়। ইহা পড়ার পর তোমার প্রয়োজনের কথা বল।
(মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দায়ূদ, নাসায়ী, হাকেম, বায়হাকী)
ব্যাখ্যাঃ ইহা রাসূলে করীম (স)-এর শিক্ষা দেওয়া একটা ভাষণ। হাদীসের মূল ভাষায় ইহাকে ************** ‘প্রয়োজনের ভাষণ’ বলা হইয়াছে। বিবাহও মানব সমাজের একটা বিরাট প্রয়োজন। তাই হাদীসে উদ্ধৃত সমস্ত ভাষণটি বিবাহ অনুষ্ঠানকালে পাঠ করার স্থায়ী নিয়ম হিসাবে গৃহীত হইয়াছে।
এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী শু’বা। তিনি আবূ ইসহাকের নিকট হইতে এই হাদীসটি শুনিয়াছিলেন। তিনি আবূ ইসহাককে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
****************************************
এইসব কথা কি বিবাহ-ভাষণে বলিতে (বা পড়িতে) হইবে? না উহা ছাড়া অন্য প্রসঙ্গেও পড়া যাইবে?
তিনি জবাবে বলিলেনঃ *************** সর্বপ্রকার প্রয়োজন কালেই এই খোতবা পড়া যাইতে পারে।
তিরমিযী’র বর্ণনায় ইহাকে বলা হইয়াছে ************- সাক্ষ্যদান। সে বর্ণনার শুরুতে বলা হইয়াছে; হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে নামায পড়ার তাশাহুদ এবং প্রয়োজনে পড়ার তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়াছেন।
অতঃপর নামাযের তাশাহুদ হিসাবে আততাহিয়্যাতু উদ্ধৃত হইয়াছে এবং প্রয়োজনের তাশাহুদ হিসাবে উপরোক্ত ভাষণটির উল্লেখ হইয়াছে। ‘তাশাহুদ’ শব্দের অর্থ সাক্ষ্যদান। নামাযের আততাহিয়্যাতুতে এবং উপরোদ্ধৃত ভাষণে যেহেতু আল্লাহর তাওহীদের ও রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য উদ্ধৃত হইয়াছে, এই কারণে এই সমস্ত বর্ণনাকে ‘তাশাহুদ’ বলা হইয়াছে।
বস্তুত ইহা বিবাহে ‘ঈজাব’ ‘কবুল’ হওয়াকালীন ভাষণ এবং এই ভাষণ রাসূলে করীম (স) শিক্ষা দিয়াছেন। অতএব বিশেষ করিয়া বিবাহকালে ইহা পড়া বাঞ্ছনীয়। বায়হাকীর বর্ণনার শুরুতেই স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তোমাদের কেহ যখন বিবাহ ইত্যাদি প্রয়োজনে ভাষণ দিতে ইচ্ছা করিবে তখন সে বলিবে।
এই ভাষণে পরপর তিনটি আয়াত পড়ার শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে। তন্মধ্যে প্রথম আয়াতটিতে ঈমানদার লোকদিগকে দুইটি কথা বলা হইয়াছে। একটি হইল, আল্লাহকে ভয় কর- যেমন ভয় আল্লাহকে করা উ চিত। আল্লাহই স্রষ্টা, রিযিকদাতা, রক্ষাকর্তা, জীবন ও মৃত্যুদাতা, অতএব তাঁহাকে সর্বাধিক ভয় করা- প্রতি মুহূর্তে ভয় করিতে থাকা বাঞ্ছনীয়। আর দ্বিতীয় কথা হইল, তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া মরিও না। ‘মুসলিম’ অর্থ বাস্তবভাবে আল্লাহর আনুগত্য, খোদার আইন-বিধান অনুযায়ী জীবন যাপনকারী। আর মৃর্তু কখন আসিবে তাহা যেহেতু কাহারও জানা নাই। তাই সব সময়ই আল্লাহর অনুগত হইয়া থাকা আবশ্যক, যেন যে মুর্হর্তে মৃত্যু আসিবে, সে মুহূর্তে সে ‘মুসলিমৱ হইয়া থাকিতে ও মরিতে পারে।
দ্বিতীয় আয়াতটিতে, প্রথমে আল্লাহকে ভয় করিতে বলা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, তিনিই প্রথমে একজন পুরুষ মানুষ বানাইয়া ও তাহা হইতেই তাহার স্ত্রী জুড়ি বানাইয়া মানব বংশের ধারা প্রবাহের সূচনা করিয়া দিয়াছেন এবং দুনিয়ার সমস্ত মানুষ এই ধারা হইতেই উদ্ভূত হইয়াছে। আয়াতটির শেষের দিকে পুনরায় আল্লাহকে ভয় করিতে বলার সঙ্গে সঙ্গে ‘রেহেম’ পারস্পরিক রক্ত সম্পর্ককেও ভয় করিত ও উহার হক্ক আদায় করিতে, উহার মর্যাদা রক্ষা করিতে বলা হইয়াছে।
তৃতীয় আয়াতটিতেও প্রথমে আল্লাহকে ভয় করিতে বলা হইয়াছে এবং জীবনের সমস্ত কাজ সুষ্ঠূ সুন্দর ও নির্ভুল করার এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা পাওয়ার উদ্দেশ্যে সত্য সঠিক কথা বলিবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। সেই সঙ্গে একথাও বলা হইয়াছে যে, খোদা ও রাসূলের আনুগত্য করিলেই জীবনের সাফল্য সম্ভব।
এই আয়াত তিনটির মূল কথাগুলি বিবেচনা করিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, বিবাহকালীন ভাষণ প্রসঙ্গে এই তিনটি আয়াত পাঠ করিয়অ শুনানো এবং বর ও মজলিসে উপস্থিত সমস্ত মানুষকে এই কথাগুলি বুঝাইয়া দেওয়ার গভীর তাৎপর্য এবং ‘সুদূরপ্রসারী শুভ প্রভাব নিহিত রহিয়াছে। বিবাহ অর্থ নূতন পরিবারের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা। পরস্পর পূর্ব অপরিচিত, ভিন্ন ভিন্ন পরিবার পরিবেশের- পরস্পরের জন্য হারাম দুইটি নারী-পুরুষ এই বিবাহের মাধ্যমেই একত্রিত, পরস্পর পরিচিত, নিবিড় ঘনিষ্ঠ ও পরস্পরের জন্য হালাল হইয়া যায় এই বিবাহের মাধ্যমেই এই সময় এই কথাগুলি যদি উভয়ের মনে দৃঢ়মূল করিয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে উভয়ের পক্ষে একত্রিত জীবনে ইসলামী আদর্শ পুরাপুরি অনুসরণ করিয়া চলা সম্বব ও সহজ হইবে বলিয়া খুব-ই আশা করা যায়। ইসলামী আদর্শের উপর পরিবার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইহা জরুরী।
(*****************)
বিবাহে এই খোতবা পড়া কি? ইহা না পড়িলে কি বিবাহ হয় না? ইহার জবাবে প্রথমে বলিতে চাই, ফিকাহর খুঁটিনাটি প্রশ্ন না তুলিয়া সোজাসুজি চিন্তা করা দরকার, রাসূলে করীম (স) নিজে ইহা শিক্ষা দিয়াছেন এবং পড়িয়াছেন ও। আর ইহাতে যে সব কথা বলা হয়, তাহা মুসলিম নব দম্পতির পক্ষে খুবই প্রেরণাদায়ক ও উদ্বোধক। দ্বিতীয় বলিতে চাই, এই খোতবা পাঠ না করিলে বিবাহ শুদ্ধ হইবে না এমন কথা নয়। রাসূলে করীম (স)ও এই খোতবা ছাড়া বিবাহ পড়াইয়াছেন। বনু সুলাইম বাংশের এক ব্যক্তি (নাম অজ্ঞাত) বলিয়াছেন আমি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আবদুল মুত্তালিব কন্যা আমামাতাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলে তিনি তাহা মঞ্জুর করিলেন। *************** তিনি আমার বিবাহ পড়াইলেন, কিন্তু তাহাতে তাশাহুদ- বিবাহের খোতবা- পড়িলেন না। এই হাদীসটি আবূ দায়ূদ ও বুখারীও উদ্ধৃত করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন ইহার মূলসুত্র অজ্ঞাত। ইমাম শাওকানী বলিয়াছেন, মূল বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম জানা না গেলেও বিশেষ দোষ নাই। ইবনে হাজার আল-আসকালানী সহল ইবনে সায়াদ সায়েদীর হাদীস উদ্ধৃত করিয়া লিখিয়াছেনঃ
****************************************
এই হাদীস প্রমাণ করে যে, প্রথমে খোতবা পড়া বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়।
অবশ্য জাহেরী মতের ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেনঃ বিবাহের পূর্বে খোতবা পাঠ ওয়াজিব। শাফেয়ী মাযহাবের আবূ আওয়ানাও এই মতই পোষণ করেন। তিনি তাঁহার হাদীস গ্রন্হে একটি শিরোনামা দিয়াছেন এই ভাষায় ************** বিবাহের আকদ হওয়ার সময় খোতবা পড়া ওয়াজিব।
(*********************)
ইমাম তিরমিযী উপরোদ্ধৃত হাদীসটি লেখার পর লিখিয়াছেনঃ
****************************************
খোতবা ছাড়াও বিবাহ জায়েয- সহীহ। সুফিয়ান সওরী প্রমুখ হাদীস ও ফিকাহবিদগণ এই মত দিয়াছেন। তাহা হইলে এই খোতবা পাঠ মুস্তাহাব মনে করিতে হইবে।
(**************)
বিবাহে মুবারকবাদ দেওয়া
হযরত আবূ হুরায়রাতা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, কোন লোক যখন বিবাহ করিত, তখন নবী করীম (স) সেই লোকের জন্য আন্তরিকভাবে পূর্ণ আনুকূল্য ও সুন্দর সুখের একত্রিত জীবনের জন্য দোয়া করিতেন এবং বলিতেনঃ আল্লাহ তোমাকে মুবারক করুন, তোমার উপর বরকত নাযিল করুন এবং তোমাদের দুইজনকে প্রকৃত মহা ও বিপুল কল্যাণের মাধ্যমে একত্রিত রাখুন।
(মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে খুজাইমা, আবূ দায়ূদ, ইবনে হাব্বান)
ব্যাখ্যাঃ বিবাহ মানব জীবনের একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইহা যেমন একজনের জীবনের একটা নবতর অধ্যায়ের সূচনা তেমনি ইহা জীবনের ধারাবাহিকতায় একটি মৌলিক মোড়-ও। জীবনের অবিবাহিত অধ্যায় অতিক্রম করার পর ইহা দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরম্ভ। এতদিন পর্যন্ত সে একক নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করিতেছিল। বিবাহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই একক জীবনের অবসান হইয়া যৌথ- স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মিলিত জীবন সূচিত হইল। এখন আর সে একা নয়, তাহার হৃদয়-মন ও জীবনের প্রতিটি ব্যাপারের সহিত জড়িত হইয়াছে অন্য একটি মেয়ের জীবন। সে মেয়ে ভিন্ন পরিবার ও পরিবেশ হইতে আসিয়াছে। দুই জনেরই একক জীবন আলাদা আলাদা ধারায় চলিয়া আসিয়াছে। প্রায় দুইজনের মধ্যে মন-মেজাজের মিল-মিশ ও পূর্ণ সামঞ্জস্য একান্তই অপরিহার্য। যদি তাহা হয়, তাহা হইলে উভয়েল জীবন শান্তি সুখে মধুময় হইয়া চলিবে। আর যদি কোন একটি দিকেও একবিন্দু ব্যতিক্রম ঘটে, তাহা হইলে চরম দুঃখ লাঞ্ছনা এবং পরিণতিতে দুইটি জীবনের চরম ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়িবে। যাহা কিছুতেই বাঞ্চনীয় হইতে পারে না।
এই অবস্থায়-স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক চেষ্টায় ও সতর্কতার যেমন প্রয়োজন রহিয়াছে, তেমনি পরিপার্শ্বের বিশেষ করিয়া মুরব্বী শ্রেণীর লোকের আন্তরিক দোয়া ও শুভেচ্ছারও একান্তই প্রয়োজন।
বিশ্বমানবতার প্রকৃত কল্যাণকামী হযতর মুহাম্মদ (স) এই ব্যাপারে যে নীতির প্রবর্তন করিয়াছেন তাহা হইল, বিবাহের আকদ হইয়া গেলেই মজলিসে উপস্থিত সকল লোকদের উচিত দম্পতির জন্য দোয়া করা, বর ও কনেকে মুবারক দেওয়া। আলোচ্য হাদীসে সেই কথাই বলা হইয়াছে।
বলা হইয়াছে, কোন লোক বিবাহ করিলে ও তথায় নবী করীম (স) উপস্থিত থাকিলে তাৎক্ষণিকভাবে বরকে তিনি বর-কনের আনুকূল্যপূর্ণ জীবনের জন্য দোয়া করিতেন। আর মুখে বলিতেনঃ আল্লাহ তোমাকে মুবারক-বরকত ও কল্যাণপূর্ণ করুন, আল্লাহ তোমার উপর বরকত বর্ষণ করুন, পরম গভীর কল্যাণে তোমাদেরকে আল্লাহ তা’আলা একত্রিত রাখুন।
বস্তুত দোয়ার একটা দিক সরাসরি আল্লাহর নিকট। আর আল্লাহ এক মুসলমান ভাইয়ের কল্যাণের জন্য অপর মুসলিম ভাইয়ের নিঃস্বার্থ দোয়া কবুল করেন। কেননা মানুষের জীবনের সব জটিলতা ও সমস্যার সমাধানকারী তো একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহই দিতে পারেন কল্যাণ, সুখ ও শান্তি। আল্লাহই যদি না দেন, তাহা হইলে তাহা পাওয়ার কোন আশাই করা যাইতে পারে না।
এই দোয়ার আর একটি দিক শুভেচ্ছা ও সহৃদয়তা। ইহার মূল্য ব্যক্তিগতভাবে বর ও কনের জন্য এবং সামষ্টিকভাবে গোটা সমাজের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।
মূলত ইহা ইসলামী সংস্কৃতির অঙ্গীভূত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইহা কার্যকর হওয়া একান্তই জরুরী এবং ইহার প্রতি একবন্দু উপেক্ষা প্রদর্শন কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় হইত পারে না। বনু তামীম-এর এক ব্যক্তি বলিয়াছেন, জাহিলিয়াতের যূগে বিবাহ হইয়া গেলে আমরা বরকে খুব বেশী পুত্র সন্তান হওয়ার জন্য আর্শিবাদ করিতাম। কিন্তু রাসূলে করীম (স) উহার পরিবর্তে এই কথা বলিবার শিক্ষা দিয়াছেন যাহা এই হাদীসে বলা হইয়াছে।
(********************)
মুয়াত্তা ইমা মালিক গ্রন্হে জায়দ ইবনে আসলাম (রা) বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহাতে বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
তোমাদের কেহ যখন (কোন মেয়ে লোক) বিবাহ করিবে, তখন সেই মেয়ে লোকটির কপোল ধারণ করিবে এবং বরকতের জন্য দোয়া করিবে।
ইহা রাসূলে করীম (স)-এর একটা নির্দেশ বিশেষ। তবে এ নির্দেশ প্রধানত স্বামীর পক্ষেই পালনীয়। কেননা স্বামীর পক্ষেই স্ত্রীর কপোল স্পর্শ করা সম্ভব এবং তাহা সম্ভব প্রথম ফুলশয্যার রাত্রে। এই হাদীসটির ব্যাখ্যায় শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী লিখিয়াছেনঃ ************************* ইসলামের বিশেষজ্ঞ মনীষীদের দৃষ্টিতে ইহা একটি অতীব উত্তম ও সুনদ্র আচরণ এবং রীতি। নিকটাত্মীয় মহিলারাও কনেকে এইভাবে বরকতের দোয়া করিতে পারে।
জাহিলিয়াতের যুগে লোকেরা নব বিবাহিত দম্পতিকে বিবাহের সম্বর্ধনা জানাইয়া বলিতঃ **************** তোমার সুখ হউক, তোমার অনেক পুত্র সন্তন হউক’। কিন্তু নব দম্পতিকে সম্বর্ধনা জানাইবার এই ভাষা ও শব্দ ইসলামে পছন্দ ও গ্রহণ করা হয় নাই। বিশেষতঃ এই ভাষায় ও কথায় কেবলমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ার দোয়া করার রীতি রহিয়াছে। ইহাতে কন্যা সন্তানের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই ঘৃণা ও বিদ্বেষের ভাবধারা প্রকাশিত হয়। আর ইহাই ছিল জাহিলিয়াতের যুগের বিশেষ ভাবধারা। এই কারণে এই বিদ্বেষাত্মক কথা ইসলাম পরিহার করিয়াছে এবং উহার পরিবর্তে ইসলামী ভাবধারা সম্পন্ন কথা বলার শিক্ষাদান করা হইয়াছে। নবী করীম (স) এই দোয়া করার শিক্ষা দিয়াছেনঃ
****************************************
আল্লাহ তোমর জন্য এই বিবাহকে বরকত পূর্ণ করুক, তোমার উপর বরকত বর্ষিত হউক এবং আল্লাহ তোমাদের স্বামী-স্ত্রী দুইজনকে পরম ও বিপুল কল্যাণের মধ্যে একত্রিত করিয়া রাখুন।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত একটি হাদীস হইত নব বিবাহিতা কন্যাকে সম্বর্ধনা জানাইবার ইসলামী পদ্ধতি জানা যায়। হাদীসটি হইলঃ
****************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) আমাকে বিবাহ করিলেন। অতঃপর আমার মা আমার নিকট আসিলেন ও আমাকে নির্দিষ্ট একটি ঘরে লইয়া গেলেন। সেখানে ঘরের মধ্যে বহু সংখ্যক আনসার বংশীয় মহিলা উপস্থিত ছিলেন। তাহারা আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ কল্যাণ ও বরকতের উপর প্রতিষ্ঠিত হউক এবং সুদীর্ঘকালীন কল্যাণ হউক।
ইহা হইতে জানা গেল যে, আনসার বংশীয় মহিলারা আরব জাহিলিয়াতে প্রচলিত বিবাহকালীন সংবর্ধনার কথা ও ভাষা পরিহার করিয়া রাসূলে করীম (স) প্রদত্ত শিক্ষা অনুযায়ী বিবাহকালীন সম্বর্ধনার কথা ও ভাষা আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিলেন এবং তাহা বলিতেই অভ্যস্ত হইয়াছিলেন।
একালে আমাদের সমাজে বিবাহকালীন সম্বর্ধনার ভাষা ও কথা এখনও রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী চালু হয় নাই। ইসলামের পদ্ধতি হিসাবে তাহা চালূ করা মুসলমানদের কর্তব্য। বর-কনেকে সম্বর্ধনা জানাইবার জন্য ইহাপেক্ষা উত্তম ও তাৎপর্যপূর্ণ কথা ও ভাষা-অন্য কিছুই হইতে পারে না।