এক সঙ্গে তিন তালাক
****************************************
লাইস নাফে হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত ইবনে উমর (রা) কে যখনই কোন তিন তালাক দাতা ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইত, তখনই তিনি সেই লোককে বলিতেনঃ তুমি যদি এক তালাক বা দুই তালাক দিতে (তাহা হইলে তোমার পক্ষে খুবই ভাল হইত); কেননা নবী করীম (স) আমাকে এইরূপ করিতে আদেশ করিয়াছেন। বস্তুত যদি কেহ তাহার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়া দেয় তাহা হইলে সে (স্ত্রী) তাহার জন্য হারাম হইয়া গেল। যতক্ষণ না সে অন্য কোন স্বামী গ্রহণকরে।
ব্যাখ্যাঃ হযরত ইবনে উমর (রা)-এর কথা ‘তুমি যদি এক তালাক বা দুই তালাক দিতে’-ইহা অসম্পূর্ণ কথা। ইহার সম্পূর্ণরূপ হইতে পারে দুইটি কথা শামিল করিলে। একটি উপরে দুই বেষ্টনীর মধ্যে লিখা হইয়াছে। ইহার দ্বিতীয় কথা হইলঃ তাহা হইলে তুমি স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইবার অধিকারী হইতে। ইহার তাৎপর্য হইল, এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়ার পরিবর্তে যদি এক বা দুই তালাক দেওয়া হয়, তাহা হইলে স্বামী স্ত্রীকে ফিরাইয়া স্ত্রী হিসাবেই গ্রহণ করিতে পারে। তখন কোন ঝামেলায পড়িতে হয় না। কিন্তু যদি এক সঙ্গে তিন তালাকই দিয়া থাকে, তাহা হইলে দুঃখে মাথা কুটিয়া মরিলেও স্ত্রীকে গ্রহণ করিতে পারে না। তাহাকে পুনরায় স্ত্রী হিসাবে পাইতে হইলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অপেক্ষায় থাকিতে হইবে এবং কার্যত তাহা সম্ভব হইবে, স্ত্রী যদি অন্য কোন স্বামী গ্রহণ করে, স্বামী স্ত্রী সঙ্গম হয়, তাহার পর সেই স্বামী মরিয়া যায় কিংবা তিন তালাক দিয়া তাহাকে বিদায় করিয়া দেয়, কেবল তখন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, আবদে ইয়াজীদের পুত্র বনু মুত্তালিবের ভাই রুকানা তাহার স্ত্রীকে একই বৈঠকে তিন তালাক দিয়াছিলেন। ফলে এজন্য তিনি খুব সাংঘাতিক ভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত হইয়া পড়িলেন। তখন- হযরত ইবনে আব্বাস বলেন- রাসূলে করীম (স) তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কিভাবে তোমার স্ত্রীকে তালাক দিলে? রুকানা বলিলেনঃ আমি তাহাকে তিন তালাক দিয়াছি। হযরত ইবনে আব্বাস বলেন- রাসূলে করীম জিজ্ঞাসা করিলেনঃ একই বৈঠকে দিয়াছ কি? বলিলেনঃ হ্যাঁ। তখন রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ ইহা তো মাত্র এক তালাক। কাজেই তুমি তোমার স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওযদি তুমি ইচ্ছা কর। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেন, অতঃপর রুকানা তাঁহার স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইলেন। ইহা হইতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এই মত গ্রহণ করিলেন যে, তালাক কেবলমাত্র প্রত্যেক তুহরে দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
(মুসনাদে আহমাদ, আবূ ইয়ালা)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটিতে তালাক সংক্রান্ত ঘটনার বিস্তারিক উল্লেখ রহিয়াছে। কিন্তু এখানে মুসনাদে আহমাদ হইতে হাদীসের যে ভাষা উদ্ধত হইয়াছে, উহাতে অন্যান্য হাদীস গ্রন্হে উদ্ধৃত ভাষার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যাইতেছে। তিরমিযী শরীফে আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াজীদ ইবনে রুকানা তাঁহার পিতা হইতে তাঁহার দদা অর্থাৎ রুকানা হইতে এই সূত্রে যে হাদীসটি বর্ণনা হইয়াছে, তাহার ভাষা এইরূপঃ
****************************************
রুকানা বলিলেনঃ আমি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলাম, ইয়া রাসূল! আমি আমার স্ত্রীকে ‘বাত্তা’ তালাক দিয়াছি। নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি ইহার দ্বারা কি নিয়্যত করিয়াছ। বলিলেনঃ আমি বলিলাম এক তালাক, নবী করীম (স) বলিলেন, আল্লাহর কসম? বলিলাম, হ্যাঁ, কসম। রাসূলে করীম (স) বলিলেন, তাহা হইলে তুমি যাহা নিয়্যাত করিয়াছ, তাহাই হইবে। **** অর্থ চূড়ান্তভাবে কর্তন করা, দৃঢ় সংকল্প কার্যকর করা।
এই বর্ণনাটি পূর্বোদ্ধৃত বর্ণনা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। ‘নেছায়া’ গ্রন্হে বলা হইয়াছে? ‘রুকানার কথা **** অর্থ, তাহাকে আমি কর্তনকারী তালাক দিয়াছি। এই কথাটির অর্থ তিনি তিন তালাক দিয়াছেন এইরূপ গ্রহণ করা হাদীসের বর্ণনাকারীর নিজের মত মাত্র এবং নিজের এই মতের প্রতিফলন ঘটাইয়া মুসনাদে আহমাদ গ্রন্হের প্রথমোদ্ধৃত হাদীসটিতে তিন তালাকের কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করিয়া দিয়াছেন। অথচ মূলত রুকানা তিন তালাক নয়, ‘আল-বাত্তা’ তালাক দিয়াছিলেন। কাজেই এক সঙ্গে তিন তালাক দিলেও তাহাতে এক তালাক রিজয়ী হইবে, হাদীসটি হইতে এইরূপ মত গ্রহণ করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন।
ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটির উল্লেখ করার পর বলিয়াছেনঃ এই বর্ণনার সনদে জুবাইর ইবনে সায়ীদ আল হাশেমী একজন বর্ণনাকারী রহিয়াছেন। বহু কয়জন মুহাদ্দিস তাঁহাকে ‘যয়ীফ’ বলিয়াছেন। ইমাম বুখারীও তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ ****** ‘তিনি হাদীসের কথাগুলি ওলট-পালট করিয়া দিয়া থাকেন’। কখনও উহাতে তালাক বলেন, কখনও বলেন, এক তালাক। আর আসলে সহীহতম কথা হইল, রুকানা ‘আল-বাত্তা’ তালাক দিয়াছিলেন, তিন তালাক দেওয়ার কথা বলা হইয়াছে উহার ভাবার্থ হিসাবে। তিনি নিজে তাহা বলেন নাই।
রুকানার স্ত্রীর নাম ছিল ‘সুহাইমা’।
তিরমিযী হইতে উদ্ধৃত এই হাদীসটিতে রাসূলে করীম (স)-এর কথা হিসাবে বলা হইয়াছেঃ ******* ‘উহা তাহাই যাহার তুমি নিয়্যত বা ইচ্ছা করিয়াছ’। আবূ দায়ূদের বর্ণনা ইহার পরিবর্তে রাসূল সম্পর্কে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ ******* ‘রাসূলে করীম (স) রুকানার স্ত্রীকে তাঁহার নিকট ফিরাইয়া আনিয়াছিলেন’ ইহার ভিত্তিতেই ইমাম খাত্তাবী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
তালাক দিয়া চূড়ান্তভাবে কাটিয়া ছিন্ন করিয়া ফেলার কথা বলিলে এক তালাক হইবে- যদি এইরূপ বলিয়া এক তালাকের বেশী দেওয়ার নিয়্যত না করিয়া থাকে এবং এইরূপ তালাকে রিজয়ী তালাক হইয়া থাকে, স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়া যায়। সম্পূর্ণ হারাম হইয়া যায় না।
কেহ যদি তাহার স্ত্রীকে বলেঃ *********** ‘তুমি তালাক চূড়ান্তভাবে’ তাহা হইলে ইহার ফলে কয়টি তালাক হইবে, সে বিষয়ে বিভিন্ন কথা বলা হইয়াছে। হযরত উমর (রা)-এর মতে ইহাতে এক তালাক হইবে, আর যদি তিন তালাকের নিয়্যত করে তবে তাহাই হইবে। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফেয়ী এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। কিছু লোক বলিয়াছেন, আল-বাত্তা তালাক দিলে তিন তালাক হয়। হযরত আলী, ইবনে উমর, ইবনুল মুসাইয়্যিব, ওরওয়া, জুহরী, ইবনে আবূ লাইলা, ইমাম মালিক, আওজায়ী ও আবূ উবাইদ প্রমুখ ফিকাহবিদগণ এইমত দিয়াছেন বলিয়া বর্ণনা হইয়াছে।
মুল্লা আলী আল-ক্বারী বলিয়াছেনঃ আল-বাত্তা তালাকে ইমাম শাফেয়ীর মতে এক তালাক রিজয়ী হয়-দুই বা তিন তালাকের নিয়্যত করিলে তাহাই হইবে। ইমাম আবূ হানীফার মতে এক তালাক বাঈন হইবে, তবে তিন তালাকের নিয়্যত করিলে তিন তালাকই হইবে। ইমাম মালিকৈর মতে সম্পূর্ণভাবে তিন তালাক হইবে।
অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ বলিয়াছেনঃ এ ব্যাপারে ব্যক্তির নিয়্যতই আসল। যেমন নিয়্যত হইবে তালাক ততটাই হইবে।
(*****************)
উপরে উদ্ধৃত এই বর্ণনা দুইটি মূলত একই ঘটনা সম্পের্কে। এই ঘটনার আসল কথা হইল, রুকানা তাঁহার স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দেন নাই। তিনি আল-বাত্তা তালাকা দিয়াছেন। আর এইরূপ তালাকে তালাক দাতার নিয়্যতই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। নিয়্যত যে কয় তালাকের হইবে, সেই কয় তালাকই সংঘটিত হইবে।
রুকানা বলিয়াছেনঃ ‘একই বৈঠকে তালাক দিয়াছি’, সম্ভবতঃ ইহার অর্থ এক শব্দে বা একবাক্যে তালাক দিয়াছি- একই তালাক শব্দের বার বার উল্লেখ না করিয়া। যেমন বলা হইয়াছেঃ তোমাকে তিন তালাক দিয়াছি। যদি কেহ বলেঃ তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক এবং ইহাতে যদি একই কথার তাকীদ মনে না করা হইয়া থাকে ও এই বাক্য কয়টি ভিন্ন ভিন্নভাবে উচ্চারণ করা হয়, তাহা হইলে উহার ফলে তিন তালাক হইয়া যাইবে। তাহা এক মজলিসে বলিলেও ফলে কোন পার্থক্য হইবে না।
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) হযরত আবূ বকর (রা)-এর যুগে এবং হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতের প্রথম দুই বৎসর তালাকের অবস্থা এই ছিল যে, তিন তালাক দিলে এক তালাক সংঘটিত হইত। পরবর্তী কালে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলিলেনঃ যে ব্যাপারে লোকদের জন্য বিশেষ মর্যাদা, ধৈর্যসহ অপেক্ষা ও অবকাশ ছিল, তাহাতে লোকেরা খুব তাড়াহুড়া করিয়া ফেলিয়াছে। কাজেই আমরা উহা তাহাদের উপর কার্যকর করিব না কেন! অতঃপর তিনি উহাকে তাহাদের উপর কার্যকর করিয়া দিলেন।
(মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসের মুল বক্তব্যটি রাসূলে করীম (স)-এর নয়, বরং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)-এর কথা। আর তিনি একজন সাহাবী বিধায় হাদীস বিজ্ঞানের নীত অনুযায়ী ইহা একটি মরফু হাদীসের মর্যাদা পায়।
হাদীসটি অত্যন্ত বিতর্কমূলক এবং হাদীসের ব্যাখ্যাকারী ও ফিকাহবিদগণ এই হাদীসটি লইয়া যথেষ্ট পর্যালোচনা করিয়াছেন। ইহার সনদ যাচাই পরীক্ষা করিয়াছেন এবং ইহার তাৎপর্য লইয়া যথেষ্ট তর্ক-বিতর্ক ও সওয়াল জওয়াব করা হইয়াছে।
মুসলিশ শরীফে উদ্ধৃত এই বর্ণনাটির প্রথম বর্ণনাকারী (হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে) হইলেন তায়ূস তাবেয়ী। মুসলিশ শরীফে উদ্ধৃত এই হাদীসেরই আরও দুইটি বর্ণনার প্রথম বর্ণনাকারী হইলেন চাহবা তাবেয়ী। সে বর্ণনা দুইটি এখানে পরপর উদ্ধৃত করা যাইতেছে। প্রথমটি এইঃ
****************************************
আবূ চাহবা হযরত আব্বাস (রা) কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘আপনি কি জানেন, রাসূলে করীম (স)’ হযরত আবূ বকর (রা) এবং হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতের প্রথম তিন বছর তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হইত? ইবনে আব্বাস (রা) বলিলেনঃ হ্যাঁ।
দ্বিতীয়টি এইঃ
****************************************
আবূ চাহবা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) কে বলিলেনঃ আপনার জ্ঞান তথ্য হইতে কিছু প্রকাশ করুন। রাসূলে করীম (স) ও হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগে তিন তালাক কি এক তালাক ছিল না? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ, তাহাই ছিল বটে; কিন্তু হযরত উমর (রা)-এর সময়ে লোকেরা পরপর তালাক দিতে শুরু করিলে তিনি তাহাদের উপর তাহাই কার্যকর করিয়া দিলেন।
মসলিম শরীফের বর্ণনা এই পর্যন্তই। কিন্তু এই হাদীসটিই আবূ দায়ূদ গ্রন্হে আবূ চাহবা কর্তৃক ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। উহার ভাষায় যে পার্থক্য আছে তাহা এইরূপঃ
****************************************
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিলেন, এক ব্যক্তি যখন তাহার স্ত্রীকে বিবাহের পর সঙ্গম করার পূর্বেই তালাক দিত, তখন লোকেরা তিন তালাককে এক তালক গণ্য করিত।
উপরোদ্ধৃত চার প্রকারের বর্ণনা হইতে স্পষ্ট বোঝা যায়, একটি মূল ঘটনার বর্ণনা চার ভাবেই হইয়াছে এবং ইহাতে মূল হাদীসের ভাষায় যথেষ্ট পার্থক্য দেখা দিয়াছে। প্রথম উদ্ধৃত হাদীসটির ভাষা হইতে বাহ্যত মনে হয়, সাধারণভাবে তিন তালাক দেওয়া হইলেই এক তালাক গণ্য করা হইত এবং নবী করীম (স), হযরত আবূ বকর, হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতের শুরু জামানা পর্যন্ত এইরূপ হইতে থাকে। তখন স্বামী স্ত্রীকে সহজেই ফিরাইয়া লইতে পারিত। কিন্তু হযরত উমর (রা) তাহার খিলাফতের দুই বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তিন তালাককে তিন তালাকই কার্যকর করিয়া দিতে লাগিলেন। ইহা তাঁহার নিজের করা কাজ। তাঁহার এই কাজটির পশ্চাতে রাসূলে করীম (স)-এর কোন উক্তি বা কুরআন মজীদে কোন আয়াতের সমর্থন ছিল এমন কথা বর্ণনার বাহ্যিক ভাষা হইতে বুঝা-ই যায় না। ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, শরীয়াতের একটা ব্যাপারে রাসূলে করীম (স) ও প্রথম খলীফার আমলে এক রকমের রায় দেওয়া হইত। হযতর উমর (রা) নিজের খিলাফতের আমলে সে রায় নিজ ইচ্ছামত পরিবর্তন করিয়া ভিন্নভাবে কার্যকর করিতে লাগিলেন। কিন্তু এইরূপ করার কি তাঁহার কোন ইখতিয়ার ছিল?
কিন্তু আবূ দায়ূদের বর্ণনাটি পাঠ করিলে এই প্রশ্নের কোন অবকাশ থাকে না। আবূ দায়ূদের বর্ণনা হইতে জানা যায়, তিন তালাক দেওয়া সত্ত্বেও তাহাতে মাত্র এক তালাক সংঘটিত হওয়ার প্রচলন সাধারণ ভাবে সর্বক্ষেত্রে ছিল না। ইহা হইতে কেবলমাত্র তখন, যদি কেহ বিবাহ করার পর স্ত্রীর সহিত সঙ্গম করার পূর্বেই তাহাকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়া দিত, তখন। সঙ্গমকৃত স্ত্রীকে একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া হইলে তাহাতে তিন তালাকক-ই সংঘটিত হইত, এক তালাক নয়। হাদীসের উদ্ধৃত বর্ণনা সমুহের ভিত্তিতে ইহা হইল একটা মোটামুটি পর্যালোচনা।
ইমাম নববী লিখিয়াছেন, স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়া হইলে তখন শরীয়াতের ফয়সালা কি, এই বিষয়ে ফিকাহবিদণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করিয়াছেন। কেহ যদি তাহার স্ত্রীকে বলেঃ *********** ‘তুমি তিন তালাক, এই বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং একালের ও সেকালের জমহুর শরীয়াতবিদগণ বলিয়াছেন, তিন তালাক সংঘটিত হইবে। আর তায়ূস ও জাহেরী মাযহাবের কিছু সংখ্যক আলেমের মতে ইহাতে মাত্র এক তালাক হইবে, তিনি তালাক নয়। হাজ্জাজ ইবনে আরতাত ও মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক হইতেও এইমতই বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও হাজ্জাজ ইবনে আরতাতের প্রখ্যাত মত হইল, এইরূপ বলা হইলে তাহাতে কোন কিছুই হয় না। ইবনে মুক্কাতিল ও মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক হইতেও এইরূপ মতের বর্ণনা জানা যায়। ইহারা সকরে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর উদ্ধৃত হাদীসকেই দলীল হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন। কোন কোন বর্ণনায় হযরত ইবনে উমর (রা) সম্পর্কে উদ্ধৃত হইয়াছে যে, তিনি তাঁহার স্ত্রীকে হায়য অবস্থায় তিন তালাক দিয়া দিলেন; কিন্তু তাহা গণ্য হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ রুকানা সম্পর্কেও বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে যে, তিনি তাঁহার স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়াছিলেন, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও নবী করীম (স) তাঁহাকে তাহার স্ত্রীকে ফিরাইয়া গ্রহণ করিবার জন্য নির্দেশ দিলেন। এই দুইটি বর্ণনাও এই শেষোক্ত লোকদের মত গঠনের সাহায্য করিয়াছে, এই দুইটি হাদীসও তাহাদের দলীল।
আহলি সুন্নাত আল-জামায়াতের চারজন শ্রেষ্ট ইমাম ও জমহুর ফিকাহবিদদের মতের প্রধান উৎস হইল কুরআন মজীদের আয়াতঃ
****************************************
ইহাই হইল আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে লোক আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমা লংঘন করিবে, সে নিজের উপর জুলুম করিবে। তুমি জান না, হয়ত আল্লাহ তা’আলা ইহার পর কোন ব্যাপার ঘটাইতেহ পারেন।
আল্লাহর সীমা অর্থ, আল্লাহর দেওয়া আইন বিধান। তিনি ইহা বান্দাহদের পালন করা ও মানিয়া লওয়ার জন্য ব্যাখ্যা করিয়া বরিয়া দিয়াছেন। ইহা লংঘত করিতে তিনি নিষেধ করিয়া দিয়াছেন। তাই যে লোক ইহা লংঘন করে সে নিজের উপর নিজে জুলূম করে। নিজেকে ধ্বংসকেন্দ্রে পৌঁছাইয়া দেয়।
যে ব্যাপারটি আল্লাহ ত’আলা পরে ঘটাইতে পারেন বলিয়া জানানো হইয়াছে, তাহা হইল আল্লাহ তা’আলা তালাক দাতার মনের পরিবর্তন ঘটাইতে পারেন। তাহাতে ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির পরিবর্তে প্রেম ভালবাসা ও সন্তুষ্টি জানাইয়া দিতে পারেন। অনীহার পরিবর্তে আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করিয় দিতে পারেন। তালাক দেওয়ার দৃঢ় ইচ্ছাকে হরণ করিয়া অনুতাপ ও লজ্জা জাগাইয়া দিতে পারেন। আর তাহার পর লোকটি এই তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইতে পারে। এই আয়াতে ****** শব্দ বলিয়া আল্লাহ তা’আলা ‘স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়ার ইচ্ছা ও আগ্রহ’ বুঝাইয়াচেন। এ ব্যাপারে সমস্ত তাফসীরকারই সম্পূর্ণ একমত। আর সমস্ত কথার সার ইল, এক তালাক দেওয়ার উৎসাহ দান এবং তিন তালাক দিতে নিষেধ করণ ও বিরত রাখা। তাহা সত্ত্বেও যদি কেহ এক সঙ্গে তিন তালাক দেয়, তাহা হইলে সে নিজেরই ক্ষতি সাধন করে। কেননা ইহার ফলে স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হইয়া যায় ও তাহাকে ফিরাইয়া লওয়ার আর কোন পথ উন্মুক্ত পায় না।
ইমাম নববী লিখিয়াছেন, উপরোদ্ধৃত আয়াতের ভিত্তিতে জমহুর ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন, তালাক দাতা যেহেতু এক সঙ্গে তিন তালাক বাঈন দিয়াছে, এই কারণে তাহার মনে অনুতাপ ও অনুশোচনা জাগা স্বাভাবিক। এই কথা-ই উক্ত আয়াতের শেষাংশে বলা হইয়াছে। উহাতে যদি তিন তালাক সংঘটিত না হয়, তাহা হইলে উহাতে রিজয়ী তালাক হইবে। আর রিজয়ী তালাক হইলে তাহাতে অনুতাপ অনুশোচনার কোন প্রশ্ন থাকে না। রুকানার হাদীস সম্পর্কে তাঁহাদের বক্তব্য হইল, রুকানা তো আল-বাত্তাতা’ তালাক দিয়াছিলেন, সুস্পষ্ট ভাষায় তিন তালাক দেন নাই। আর ‘আল-বাত্তাতা’ তালাকে এক বা তিন- যাহারই নিয়্যাত করা হইবে তাহাই সংঘটিত হইতে পারে। নবী করীম (স) তাঁহাকে বলিয়াছেনঃ ********** ‘আল্লাহর নামে শপথ করিয়া বল যে, তুমি এক তালাকেরই নিয়্যত করিয়াছিলে’? রুকানা বলিলেন ******* আল্লাহর নামে শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি এক তালাক ছাড়া আর কিছুরই নিয়্যত করি নাই। এই কথোপকথন হইতেই প্রমাণিত হয় যে, রুকানা তিন তালাকের নিয়্যত করিলে তিন তালাকই হইতে পারিত। নতুবা এইরূপ শপথ করানোর কোন তাৎপর্য থাকিত না। এক কথায় ইহাত অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইল যে, এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তাহা সংঘটিত ও কার্যকর হইবে। রুকানা তিন তালাক দিয়া ছিলেন; কিন্তু নবী করীম (স) উহাকে এক তালাক হিসাবে কার্যকর করিয়া ছিলেন বলিয়া বিপরীত মতের লোকেরা দলীল বর্ণনা করিয়াছে। এই বর্ণনাটির আসল ও যথার্থ কথা হইল, রুকানা তিন তালাক দেন নাই, দিয়াছিলে ‘আল-বাত্তাতা’ তালাকা। আর ‘আল-বাত্তাতা’ তালাকে এক ও তিন উভয় ধরনের তালাক অর্থ করা যাইতে পারে। ফলে এই যয়ীফ বর্ণনাটি বর্ণনাকারী মনে করিয়াছেন যে, উহাতে তিন তালাক হইয়াছে এবং তাহার এই ধারণাটিকেই সে হাদীসের বর্ণনা হিসাবে চালাইয়া দিয়াছে। আর ইহাতেই সে মারাত্মক ভূল করিয়া বসিয়াছে।
হযরত ইবনে উমর (লা) সংক্রান্ত হাদীস সম্পর্কে বক্তব্য এই যে, উহার সহীহ বর্ণনা হইল, তিনি মাত্র এক তালাক দিয়াছিলেন, তিন তালাক নয়। কাজেই তিন তালাক এক তালাক করা হইয়াছে, উহার ভিত্তিতে এইরূপ কথা বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন।
তৃতীয়, হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর বর্ণিত আলোচ্য হাদীসটি সম্পর্কে বক্তব্য এই যে, ইহার সঠিক তাৎপর্য ও জওয়াব দান পর্যায়ে হাদীস বিশারদগণ বিভিন্ন কথা বলিয়াছেন। তবে যথার্থ ও সহীহতম কথা এই যে, ইসলামের প্রথম দিকে একজন লোক যদি স্ত্রীকে বলিতঃ তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক এবং সে এইরূপ বলিয়া একই কথার তাকীদ ও প্রত্যেকটি কথা নূতন অর্থে না বলার নিয়্যত করিত, তাহা হইলে উহাতে এক তালাক সংঘটিত হওয়ার ফয়সালা-ই দেওয়া হইত। কেননা এই বাক্যগুলি নূতন করিয়া এক-একটি তালাক সংঘটনের উদ্দেশ্যে বলা হইত না। তখন সাধারণত মনে করা হইত যে, সে আসলে মাত্র এক তালাক দিয়াছে ও সেইটির তাকীদের উদ্দেশ্যেই পরবর্তী বাক্য দুইটি উচ্চারণ করিয়াছে মাত্র। কিন্তু উত্তর কালে হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত আমলে লোকেরা তালাক দিতে গিয়া এই রকমেই তিনটি বাক্য বলিত ও প্রত্যেকটি বাক্য নূতন করিয়া উচ্চারণ করিতে লাগিল। ফলে সাধারণত বুঝা যাইতে লাগিল যে, লোকটি আলাদা-আলাদা ভাবে তিনটি তালাক-ই দিয়াছে। এই কারণে তখন উহার দ্বারা তিন তালাকই সংঘটিত করানোহইল। হযরত উমর (রা)-এর উক্ত কথার প্রকৃত তাৎপর্য ইহাই। কাজেই হযরত উমর (রা) শরীয়াতের আইন পরিবর্তন করিয়া দিয়াছিলেন এমন কথা কিছুতেই বলা যাইতে পারে না। কেহ কেহ এইরূপ তাৎপর্যও বলিয়াছেন যে, ইসলামের প্রথম দিকে নবী করীম (স) ও হযরত আবূ বকর (রা)-এর আমালে লোকেরা সাধারণত এক তালাকই দিত উচ্চারণ যতটারই করা হউক না কেন। এই কারণে তখন এক তালাকই সংঘটিত করানো হইত। আর হযরত উমর (রা)-এর আমলে লোকেরা এক সঙ্গেই তিন তালাক দিতে শুরু করিয়াছিল বিধায় তাহাতে তিন তালাকই সংঘটিত করানো উচিত হইয়া পড়িয়াছিল। ফলে হযরত উমর (রা)-এর কথাটি হইতেছে লোকদের অভ্যাস পরিবর্তিত হওয়ার সংবাদ দান পর্যায়ের। তিনি নিজে শরীয়াতের হুকু পরিবর্তন করিয়াছেন তাঁহার উক্ত কথাটি সেই পর্যায়ের নয়।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেন, তাবেয়ীন ও তৎপরবর্তী কালের জমহুর আলেমগণ ইমাম আওজায়ী, নখয়ী, সওরী, আবূ হানীফা, ও তাঁহার সঙ্গীদ্বয়, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং তাঁহাদের সঙ্গী-সাথীগণ, ইসহাক, আবূ সওর, আবূ উবই ও অন্যান্য বহু সংখ্য বড় বড় ফিকাহবিদ এই মত দিয়াছেন যে, কোন লোক যদি তাহার স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দেয়, তবে তাহা অবশ্যই সংঘটিত হইবে। যদিও সে লোকটি গুনাহগার হইবে। ইহারা এই কথাও বলিয়াছেন যে, এই মতের বিপরীত মত পোষণকারীদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। আর তাহারা আহলূস সুন্নাত আল-জামায়াতের বহির্ভূত, তাহারা আলে বিদয়াতপন্হী। তাহাদের মতের কোন মূল্য নাই। সেইকে ভ্রুক্ষেপও করা যাইতে পারে না। উপরন্তু যে জামায়াত কুরআন ও সুন্নাতে কোনরূপ রদবদল করিয়াছে বলিয়া ধারণাও করা যায় না- সেই সুন্নাত আল জামায়াত হইত তাহারা বাহির হইয়া গিয়াছে।
ইমাম তাহাভী হযরত উমর (রা-এর বক্তব্যটি নিম্নোদ্ধৃত ভাষায় উল্লেখ করিয়াছেনঃ
****************************************
হে জনগণ! তালাকের ব্যাপারে তোমাদের জন্য একটা মহা সুযোগ ও অবকাশ দেওয়া হইয়াছিল। যে লোক আল্লাহর দেওয়া এই সুযোগকে তালাকের ক্ষেত্রে সংক্ষিপত্ ও ত্বরান্বিত করিবে, আমরা তাহাকে উহার জন্য বাধ্য করিয়া দিব।
ইহা ইমাম তাহাভী’র সহীহ সনদে উদ্ধৃত বর্ণনা। হযরত উমর (রা) এই ভাষণ দিয়াছিলেন সেই লোকদের সম্মুখে, যাঁহারা নবী করীম (স)-এর যুগে কি বিধান ছিল তাহা ভাল করিয়াই জানিতেন। কিন্তু তাঁহাদের কেহই হযরত উমর (রা)-এর এই কথার প্রতিবাদ করেন নাই। কাজেই ইহা একটা অতিবড় ও অকাট্য প্রমাণ-ইহা সাহাবীদের ইজমা (*******)। নবী করীম (স)-এর যুগে অনেক ব্যাপারের এক রকমের তাৎপর্য ছিল, তাঁহারই সঙ্গী-সাথীগণ সেই সবেরই ভিন্ন তাৎপর্য বাতিল করিয়া দিয়াছে। সাহাবীদের ইজমা কুরআনের অকাট্য সুস্পষ্ট ঘোষণার- **** -এর মতই ইলমে ইয়াকীন দেয়। কাজেই এই ব্যাপারে কোনই সন্দেহ বা মত-বিরোধের অবকাশ থাকিতে পারে না। সাহাবীদের ইজমা ‘মশহুর হাদীস’ হইতেও অধিক বলিষ্ঠ। উহার ভিত্তিতে অকাট্য দলীল- ********-এর উপর বৃদ্ধি সাধন ও জায়েয।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর অন্য একটি কথা হইতেও তাঁহার উপরোদ্ধৃত বর্ণনা বাতিল হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলে, একটি লোক আসিয়া হযরত ইবনে আব্বাস (রা)কে বলিলঃ আমার চাচা তাহার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়াছে। তখন হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিলেনঃ
****************************************
তোমার চাচা আল্লাহর নাফরমানী করিয়াছে ও শয়তানের আনুগত্য করিয়াছে।
কিন্তু অতঃপর তিনি তাঁহার জন্য কোন উপায় বলিয়া দেন নাই। একথা বলেন নাই যে, ‘ইহাতে এক তালাক হইয়াছে- চিন্তার কারণ নাই’।
ইহার পর বলা হইয়াছেঃ ‘যে লোক তিন তালাক দেওয়া স্ত্রীকে তাহার জন্য হালাল মনে করে তাহার সম্পর্কে আপনার মত কি? তিনি বলিলেনঃ
****************************************
যে লোক আল্লাহকে ধোঁকা দিবে, আল্লাহও তাহাকে ধোঁকায় ফেলিয়া রাখিবেন।
ইহার অর্থ, তিন তালাক দিয়াও স্ত্রীকে হালাল মনে করা আল্লাহর সহিত ধোঁকাবাড়ি করার সমান অপরাধ। মুজাহিদদের সূত্রের একটি বর্বণাও ইহার সমর্থন রহিয়াচে। এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাস (রা)-এর নিকট আসিয়া বলিল; সে তাহার স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়া ফেলিয়াছেন। এই কথা শুনিয়া তিনি চুপ থাকিলেন। মনে হইল যেন তিনি ইহা প্রত্যাখ্যান করিবেন। পরে বলিলেনঃ
****************************************
তুমি তাহাকে ভয় কর নাই। কাজেই আমি তোমার জন্য মুক্তির কোন পথ দেখিতেছি না। তুমি তোমার আল্লাহর নাফরমানী করিয়াছ এবং তোমার স্ত্রী তোমার হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ হারাম হইয়া দিয়াছে।
(******)
বস্তুত হাদীসের বর্ণনাকারীই যদি সেই হাদীসের মূল প্রতিপাদ্যের বিপরীত ফতোয়া দেন তাহা হইলে তাঁহার বর্ণনা অপেক্ষা তাঁহার ফতোয়া-ই গ্রহণের দিক দিয়া অগ্রাধিকার পাইবে, ইহা সর্বজনমান্য নীতি।
ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন, তিনি হয়ত পরে সঠিক কথা জানিতে পারিয়া তাঁহার পূর্ববর্তী কথাকে তিনি নিজেই বাতিল করিয়া দিয়াছেন। কেননা তিনি রাসূলে করীম (স)-এর নামে এক রকমের বর্ণনা কারিয়া উহার বিপরীত কাজ করিতে পারেন না।
আল্লাম আবূ বকর আল-জাসসাস বলিয়াছেন, হযরত ইবনে আব্বাস যদি মনে করিয়াও থাকেন যে, তিন তালাক এক সঙ্গে দিলে তাহাতে এক তালাকই হয়, তবুও তাহা বাতিল মনে করিত হইবে কুরআনের আয়াতের ভিত্তিতে। কুরআনের আয়াত হইলঃ * ******** ‘তালাক মাত্র দুইবার’। অর্থাৎ আয়াত অনুযায়ী দুই তালাক পর পর দেওয়া হইলে যদি কার্যকর হইতে পারে তাহা হইলে এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তাহা কার্যকর হইবে না কেন? আর ****** ‘ভালভাবে ছাড়িয়া দেওয়া’ কুরআনের কথাটি হইতেও এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়ার ও তাহা কার্যকর হওয়ার কথাই বুঝায়। এই দীর্ঘ আলোচনা হইতে নিঃসন্দেহে জানা গেল যে, এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তাহাতে তিন তালাকই সংঘটিত ও কার্যকর হইবে এক তালাক নয়। এই কথাটি খোদ কুরআন হইতেই প্রমাণিত।
(********************)
তিন তালাক পাওয়া স্ত্রীর প্রথম স্বামীর সহিত বিবাহ
****************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রিফায়া আল কুরাজীর স্ত্রী রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিয়া বলিলঃ ইয়া রাসূল! রিফায়অ আমাকে তালাক দিয়াছে। আমার সে তালাক অকাট্য ও কার্যকর হইয়াছে। অতঃপর আমি আবদুর রহমান ইবনে জুবাইর আল কুরাজীকে বিবাহ করিয়াছি। কিন্তু তাহার নিকট যাহা আছে তাহা কাপড়ের ‘পাড়ের’ মত মাত্র। তখন রাসুলে করীম (স) বলিলেনঃ সম্ভবত তুমি রিফায়ার নিকট ফিরিয়অ যাইতে চাও। কিন্তু তাহা সম্ভব হইবে না যতক্ষণ সে (আবদুর রহমান) তোমার মধু পান না করিবে এবং তুমি তাহার মধু পান না করিবে।
(বুখারী, মুসলিম, তাবারানী)
ব্যাখ্যাঃ তাবারানীর বর্ণনা হইতে জানা গিয়াছে, এই স্ত্রী লোকটির নাম ছিল তমীমা বিনতে অহাব। সে প্রথমে কুরাজী বংশের রিফায়া নামক একটি লোকের স্ত্রী ছিল। কিন্তু সে পরে তালাক দেয়। সে তালাক অকাট্য ও চূড়ান্ত হইয়া যা। ********** ‘সে আমাকে সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়’। ইহার অর্থ দাঁড়া, সে হয়ত এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়াছে; কিংবা একের পর এক করিয়া তিন তালাক দিয়াছে। এই তিন তালাকের কারণে সে তাহার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হইয়া গিয়াছে ও পরে সে আবদুর রহমান ইবনে জুবাইর নামক কুরাজী বংশেরই অপর এক ব্যক্তিকে বিবাহ করে। মেয়ে লোকটি বলিলঃ তাহার সহিত যাহা আছে, তাহা কাপড়ের পাড়ের মত। এই কথা দ্বারা সে বুঝাইতে চাহিয়াছে যে, আবদুর রহমানের পুরুষাঙ্গ শক্তিহীন, কাপড়ের পাড় যতটা শক্ত, তাহার পুরুষাঙ্গও ততটা শক্ত। অর্থাৎ অত্যন্ত দুর্বল। (তাহা দিয়া সে তাহাকে পরিতৃক্ত পরিতে পারে না।) এই কথাটি শুনিয়াই নবী করীম (স) বুঝিতে পারিলেন যে, মেয়ে লোকটি আবদুর রহমানের পৌরুষের প্রতি যৌনতার দিক দিয়া মোটেই সন্তুষ্ট নয়। এই কারণে সে তাহার স্ত্রী হইয়া থাকিতে রাযী নয় এবং সে তাহার পূর্ববর্তী স্বাম রিফায়া- যে তাহাকে পূর্বে তালাক দিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিল-এর নিকট যাইতে ও তাহাকে পুনরায় বিবাহ করিতে চাহে। কিন্ত্র প্রশ্ন হইল, এখন স্ত্রী লোকটি তাহার পূর্বের সেই তালাক দাতা স্বামীকে কি করিয়া পুনরায় বিবাহ করিতে পারে? নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তাহার নিকট যাইতে ও তাহাকে স্বামীরূপে বরণ করিতে পার না। সে তোমার জন্য হারাম হইয়া গিয়াছে।তবে তাহার একটি মাত্র পথ হইল, তুমি যদি তোমার বর্তমান স্বামীর সহিত সার্থক সঙ্গম কার্য করিতে পার এবং সে তোমাকে তালাক দেয় তবে তাহার পর তুমি তোমার সেই প্রথম স্বামী রিফায়াকে বিবাহ করিতে পারিবে- ‘মধুপান’ অর্থ সার্থক স্বামী-স্ত্রী সঙ্গম। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় হযরত আয়েশার এই কথাটি উদ্ধৃত হইয়াছে।
রাসূলে করীম (স)-এর এই ঘোষণা কুরআন মজীদের স্পষ্ট ঘোষণার উপর ভিত্তিশীল। প্রথম কথাটি সম্পর্কে কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হইলঃ
****************************************
বর্তমান স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেয়, তাহা হইলে সে স্ত্রী লোকটি ও তাহার পূর্ববর্তী স্বামী যদি মনে করে যে, তাহারা পুনরায় স্বামী-স্ত্রী হইয়া আল্লাহর সীমা সমূহ কায়েম ও রক্ষা করিতে পারিবে, তাহা হইলে তাহাদের দুইজনের পুনরায় স্বামী-স্ত্রী হইতে কোন দোষ নাই।
আর দ্বিতীয় কথাটি সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা হইলঃ
****************************************
স্বামী যদি তাহার স্ত্রীকে (তিন) তালাক দিয়া দেয়, তাহা হইলে এই স্ত্রী তাহার জন্য হালাল হইবে না যতক্ষণ না সে জন্য এক স্বামী ‘বিবাহ’ করিবে।
অন্য এক স্বামীকে ‘বিবাহ’ করিলে তাহার (সে স্বামীর তালাক বা মৃত্যুর পর) প্রথম স্বামীর জন্য এই স্ত্রী হালাল হইবে। ইহা কুরআনের আয়াতের বাহ্যিক অর্থ। এ অর্থে ***** শব্দের অর্থ করা হইয়াছে ‘বিবাহ’। কিন্তু এখানে এই ‘নিকাহ’ বা ‘বিবাহ’ বলিতে সত্যি-ই কি বুঝানো হইয়াছে, তাহা আলোচনা সাপেক্ষ।
বিবাহ বলিতে এখানে কি বুঝানো হইয়াছে ও কি কাজ হইলে প্রথম স্বামীর সহিত পুনরায় বিবাহিত হওয়া হালাল হইবে, এ বিষয়ে শরীয়াতবিদ লোকেরা নানা কথা বলিয়াছেন। সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব এবং তাঁহার সমর্থকদের মত হইল, দ্বিতীয় একজনের সাথে শুধু বিবাহের আকদ (*****) হওয়াই যথেষ্ট। হাসান ইবনে আবুল হাসান বলিয়াছেনঃ কেবলমাত্র সঙ্গমই যথেষ্ট নয়। স্ত্রী অঙ্গে শুক্র নিষ্ক্রমণ হওয়া জরুরী। জমহুর আলেম ও বিপুল সংখ্যক ফিকাহবিদ বলিয়াছেন, শুধু যৌন সঙ্গমই যথেষ্ট। আর তাহা হইলে স্ত্রী অঙ্গের মধ্যে পুরুষাঙ্গের প্রবেশ করা- যাহার ফলে গোসল ওয়াজিব হয় এবং রোযা ও হজ্ব বিনষ্ট হয় এবং পূর্ণ মহরানা দিয়া দেওয়া ওয়াজিব হয়।
ইবনুল আরাবী বলিয়াছেন, আমার নিকট ফিকাহর এই মাসলাটি সর্বাপেক্ষা কঠিনও দুর্বোধ্য। ফিকাহর নিয়ম ও মূল নীতি একটা জিনিসের নামের প্রথম ভাগের সহিত সংশ্লিষ্ট, না উহার শেষ ভাগের সঙ্গে, ইহাই বড় প্রশ্ন। ‘বিবাহ’ কাজটির প্রথম ভাগ হইল শুধু আকদ হওয়া। আর উহার দ্বিতীয় ভাগ- উহার অনিবার্য পরিণতি স্ত্রী সঙ্গম। কুরআনের ‘নিকাহ’ শুদ্ধ হইতে উহার প্রথম ভাগ- অর্থাৎ আকদ- বুঝিলে সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিবের কথাকে সত্য মানিয়া লইতে হয়। আর শেষ ভাগ বুঝিলে, এই শর্ত করিতে হয় যে, দ্বিতীয় স্বামীর সহিত যৌন সঙ্গম ও তাহাতে শুক্র নিষ্ক্রমণ হওয়া জরুরী। কেননা ইহাই হইল স্বামী-স্ত্রীর মধু পানের সর্বশেষ পর্যায়।
ইবনুল মুনযির বলিয়াছেন, আয়াতের ‘নিকাহ’ অর্থ বিবাহ হওয়ার পর যৌন সুখ মাধুর্য লাভ করা। আর তাহা স্ত্রী সঙ্গমেই সম্ভব। অতএব প্রথম স্বামীর জন্য স্ত্রীর হালাল হওয়া নির্ভর করে দ্বিতীয় স্বামীর সহিত বিবাহের আকদ ও সার্থক যৌন সঙ্গম সংঘটিত হওয়ার উপর।
যে সব লোকের নিকট এই পর্যায়ের হাদীস পৌঁছায় নাই কিংবা পৌঁছিয়া থাকিলেও যাহারা এই পর্যায়ের হাদীসেকে সহীহ মনে করেন নাই, কেবলমাত্র তাহাকেই দ্বিতীয় স্বামীর সহিত শুধু ‘আকদ-নিকাহ’ হওয়াকেই প্রথম স্বামীর পক্ষে তাহার হালাল হওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে করিয়াছেন। কিন্তু এই পর্যায়ের হাদীস সহীহ না হওয়ার কোনই কারণ নাই, হযরত আয়েশা (রা) হইতে বুখারী বর্ণিত হাদীসটি উপরে উদ্ধৃত হইয়াছে। এই পর্যায়ে আরও একটি হাদীস হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত। উহার ভাষা এইরূপঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, এক ব্যক্তি তাহার স্ত্রীকে তিন তালাক দিলে ও স্ত্রী তাহার জন্য হালাল হইবে না যতক্ষণ না সে তাহার ছাড়া অন্য এক স্বামী গ্রহণ করিবে এবং তাহাদের দুইজনের প্রত্যেকের পরস্পরের মধুপান করিবে।
বুখারী উদ্ধৃত অপর একটি হাদীস হইতেও এই কথা জানা যায়। হাদীসটি এইঃ
****************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, এক ব্যক্তি তাহার স্ত্রীকে তালাক দিল। পরে সে স্ত্রী অন্য এক স্বামী গ্রহণ করিল। পরে সেও তাহাকে তালাক দিল। এই সময় নবী করীম (স)কে জিজ্ঞাসা করা হইল, এই স্ত্রী লোকটি কি তাহার প্রথম স্বামীর জন্য হালাল? জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেন, না যতক্ষণ না এই দ্বিতীয় স্বামী তাহার মধু পান করিয়াছে, যেমন করিয়াছে প্রথম স্বামী।
এই দুইটি হাদীস হইতে কুরআনে ব্যবহৃত ****** যতক্ষণ না বিবাহ করিবে কথাটির সঠিক তাৎপর্য স্পষ্ট ভাবে জানা যায়। আর তাহা হইলে, দ্বিতীয় স্বামীর সহিত বিবাহের আকদ হওয়ার পর যৌন সঙ্গম শুধু সঙ্গম নয়, সার্থক সঙ্গম হইতে হইবে এবং তাহাতে এই দুইজনের সমান ভাবে যৌন মাধুর্য লাভ করিতে হইবে। নতুবা অতঃপর এই স্বামী তাহাকে তালাক দিলে সে তাহার পূর্ববর্তী স্বামীর জন্য হালাল হইবে না। নবী করীম (স)-এর কথা এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট, অকাট্য ও বলিষ্ঠ।
(*************)
জোর পূর্বক তালাক লওয়া
****************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি রাসূলে করীম (স) কে বলিতে শুনিয়াছি যে, প্রতিবন্ধকতায় তালাকও হয় না, দাসমুক্ত করণও হয় না।
(আবূ দায়ূদ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, হাকেম)
ব্যাখ্যাঃ স্ত্রীকে তালাক দেওয়া ও দাসমুক্ত করার কাজটি অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ ও সূদুর প্রসারী পরিণতি সম্বলিত কাজ। ইহা সার্বিকভাবে উম্মুক্ত পরিবেশের মধ্যে সম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইহার ব্যতিক্রম হইলে এই দুইটি কাজ হইল বলিয়া মনে করা যাইতে পারে না।
হাদীসের শব্দ **** ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। ইহার মূল শব্দ হইল *****। অভিধানে ইহার কয়েকটি অর্থ লিখিত হইয়াছে। তাহা হইলঃ সংকীর্ণমনা হওয়া, ক্রোধান্ধ হওয়া, চরিত্রহীন হওয়া। ********** ‘তাহাকে এইকাজ করিতে সে বাধ্য করিয়াছে, ও ****** অর্থ, দরজা বন্ধ হওয়া। ***** অর্থ, তালা লাগানো। মুহাদ্দিসদের মতে **** অর্থ ***** জোর করিয়া কোন কাজ করিতে বাধ্য করা। কেননা যাহার উপর জোর প্রয়োগ করা হয় তাহাকে সাধারণত কোন কক্ষে বা ঘরে বন্দী করা হয়, বাহির হইতে তালা লাগানো হয়। কিংবা ঘরে, দরজা এমন ভাবে বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় যে, আদিষ্ট কাজটি না করা পর্যন্ত উহা হইতে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভ সম্ভবপর হয় না। এই প্রেক্ষিতে এ হাদীসটির মোটামুটি অর্থ দাঁড়ায়, জোর পূর্বক তালাক লওয়া হইলে সে তালাক গণ্য হইবে না। দাসমুক্ত করণের ব্যাপারটিও এইরূপ।
বস্তুত বিবাহ যেমন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভাবে ও নিজস্ব ইচ্ছা ও উদ্যোগ সহকারে হইয়া থাকে, তালাকও অনুরূপ ভাবে স্বামীর ইচ্ছা ও সংকল্পের ভিত্তিতে হইতে হইবে। স্বামী নিজ ইচ্ছা ও সংকল্পে যখনই তালাক দিবে, তখনই তালাক সংঘটিত হইবে। ইহাতে যদি অন্য কাহারও চাপ প্রয়োগ হয়, কেহ যদি কাহারও নিকট হইতে জোর পূর্বক তালাক আদায় করিতে চাহে ও কাহাকেও আটক করিয়া- গলায় গামছা দিয়া তালাক দিতে বাধ্য করে, তবে তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও নিষ্ফল চেষ্টা মাত্র, উহাতে তালাক হয় না। এই উপায়ে যে তালাক লওয়া হয়, ইসলামী শরীয়াতে তাহা তালাক বলিয়া গণ্য হয় না।
আল মুনযেরী বলিয়াছেন, কাহারও কাহারও মতে এই হাদীসে **** শব্দের অর্থঃ ******- ক্রোধ। আবূ দায়ূদ তাঁহার গ্রন্হে এই হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়া লিখিয়াছেনঃ ************ এখানে ****** বা ***** অর্থ ক্রোধের বশঃবর্তি হইয়া তালাক দেওয়া। এই অর্থে কেহ যদি ক্রোধান্ধ হইয়া স্ত্রীকে তালাক দেয়, তবে সে তালাক সংঘটিত ও কার্যকর হইবে না।
কিন্তু এই হাদীস হইতে এরূপ অর্থ গ্রহণ সহীহ হইতে পারে না। কেননা যদি তাহাই হইবে তাহা হইলে দুনিয়ায় তালাক আদৌ সংঘটিত হইতে পারে না। কেননা স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্রুব্ধ না হইলে কেহই তাহার স্ত্রীকে তালাক দেয় না। কাজেই **** শব্দের অর্থ ***** ‘ক্রোধ’ করা সহীহ নয়।
এই হাদীস হইতে একথা অকাট্য ভাবে প্রমাণিত হয় যে, জোরপূর্বক কাহাকেও তালাক দিতে বাধ্য করা হইলে তাহাতে তালাক হইবে না। হযরত আলী, উমর, ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর ও জুবাইর (রা) প্রমুখ সাহাবী এবং হাসান বসরী, আতা, মুজাহিদ, তায়ূস, শুরাইহ, আওজায়ী, হাসান ইবনে সালেহ, মালিক, শাফেয়ী প্রমুখ তাবেয়ী ও পরবর্তী ফিকাহবিদগণ এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
উপরোদ্ধৃত হাদীসটিই তাঁহাদের এই মতের দলীল। তাঁহারা দলীল হিসাবে আরও একটি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা হইল, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমার উম্মতের লোক ভূল-ভ্রান্তি ও বাধ্যতার কারণে যাহা করে তাহা মাফ করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
অর্থাৎ ইহার কোন কার্যকারিতা নাই। সে জন্য আল্লাহ কাহাকেও দায়ী করিবেন না। পক্ষান্তরে নখয়ী, সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, সওরী, উমর ইবনে আবদুল আজীজ এবং ইমাম আবূ হানীফা ও তাহার সঙ্গীদ্ব মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, কেহ বাধ্য হইয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তালাক দেয় তাহা হইলে তাহা সংঘটিত হইবে ইহাদের প্রথম দলীল কুরআন মজীদের আয়াত ******* ‘তোমরা যখন তোমাদের স্ত্রীদের তালাক দিবে, তখন তাহাদিগকে তালাক দিবে তাহাদের ইদ্দতের জন্য’। এখানে তালাক দেওয়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ শর্তহীন। তালাক দিলেই হইল কোন কারণে ও কি অবস্থায় তালাক দিয়াছে সে দিকে লক্ষ্য রাখা হয় নাই।
দ্বিতীয় দলীল হইব, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
সব তালাকই সংঘতি হইবে- বালক ও পাগল- বেহুঁশ লোকের তালাক ছাড়া।
কুরআন ও হাদীস উভয় স্থানেই তালাক শর্তহীন ভাবেই সংঘটিত হওয়ার কথা ঘোষিত হইয়াছে। কাজেই তালাক যে অবস্থায়ই দেওয়া হউক না কেন তাহা অবশ্যই সংঘটিত হইবে। জোর পূর্বক তালাক লওয়া হইলে- কাহারও চাপে পড়িয়া তালাক দিতে বাধ্য হইয়া তালাক দিলেও তাহা কার্যকর হইবে। ইহার স্বপক্ষে যুক্তিও রহিয়াছে। যে লোক কোন চাপে বাধ্য হইয়া তালাক দেয়, প্রকৃতপক্ষে সে তালাক উচ্চারণ করিতে প্রস্তুত হয় বলিয়াই উহার শব্দ মুখে উচ্চারণ করে। আর এই উচ্চারণেই তালাক কার্যকর হইয়া যায়। উপরোদ্ধৃত হাদীসটি হইতে যে অর্থ গ্রহণ করা হইতেছে তাহা উহার প্রকৃত অর্থ নয়। যে লোক ***** এর অর্থ ****** করে সে মারাত্মক ভূল করে।
তাহা হইলে আলোচ্য হাদীসটির কি অর্থ দাঁড়ায়? এই হাদীসটির অর্থ হইল, ******** ‘কুফরির উপর জরবদস্তি’। যে লোকদের সামনে এই হাদীসটি ঘোষিত হইয়াছিল, তাহারা নূতন নূতন ইসলাম কবুল করিয়াছিলেন। এ সময় কুফরির উপর জোর প্রয়োগ ছিল একটা সাধারণ ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর তাঁহাদের মুখে ভূল ও ভ্রান্তি বশতঃ কুফরি কালামও প্রায়ই উচ্চারিত হইত। এই কারণে আল্লাহ তা’আলা তাহা মাফ করিয়া দেওয়ার কথা ঘোষণা করিয়াছেন।
আমর ইবনে শারাহীল হইতে বর্ণিত হইয়াছে, একটি স্ত্রীলোক তাহার স্বামীকে তালাক দিতে জোর পূর্বক বাধ্য করিল। সে তালাক দিয়া দিল। পরে এই মামলা হযরত উমর ফারূক (রা)-এর সমীপে উপস্থিত করা হয়। তিনি সে তালাককে কার্যকর করিয়া দেন।
(*************)
খোলা তালাক
হযরত সহল ইবনে আবূ হাসমা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, সহল কন্যা হাবীবা সাবিত ইবতে কাইস ইবনে শিমাস আল-আনসারীর স্ত্রী ছিল। পরে সে (স্ত্রী) তাহাকে (স্বামীকে) ঘৃণা করিতে লাগিল। কেননা সে (সাবিত) একজন কুৎসিত বীভৎস চেহারা ও খারাপ আকার-আকৃতির লোক ছিল। এই সময় সে (হাবীবা) নবী করীম (স)-এর নিকট আসে ও বলেঃ ইয়া রাসূল! আমি লোকটিকে দেখি বটে। কিন্তু মহান আল্লাহর ভয়ই যদি না থাকিত, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই তাহার মুখের উপর থুথু নিক্ষেপ করিতাম। তখন রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি কি তাহার সেই বাগানটা তাহাকে ফিরাইয়া দিবে, যাহা সে তোমাকে মহরানা বাবদ দিয়াছিল? সে বলিল, হ্যাঁ, দিব। তখন রাসূলে করীম (স) তাহার নিকট লোক পাঠায়া তাহাকে ডাকিয়া আনাইলেন। হাবীবা তাহার বাগানটি তাহাকে ফিরাইয়া দির। অতঃপর রাসূলে করীম (স) তাহাদের দুইজনের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাইয়া দিলেন। হাদীসটির বর্ণনাকারী বলিয়াছেন, ইসলামে ইহাই ছিল প্রথম সংঘটিত খোলা তালাক।
(মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদে বাজ্জার, তাবারানী- কবীর)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির মোটামুটি বক্তব্য হইল, স্বামী যদি স্ত্রীর অপছন্দ হয়, স্ত্রী যদি স্বামীর সহিত থাকিতে অরাযী হয় এবং তাহার মূলে কোন বাস্তব কারণ বর্তমান থাকে, তাহা হইলে স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক চাহিতে পারে। এই রূপ প্রস্তাবনার পর স্বামী তালাক দিলে শরীয়াতের পরিভাষায় এই তালাককে খোলা তালাক ***** বলা হয়। অভিধানের দৃষ্টিতে খোলা তালাকের কয়েকটি সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে। তন্মধ্যে একটি হইলঃ
****************************************
ধনমালের বিনিময়ে এক ব্যক্তির তাহার স্ত্রী হইত বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়া।
অথবাঃ ************ অর্থ সম্পদের বিনিময়ে স্ত্রীর বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়া। ইহা আরবী কথন ****** ‘কাপ খুলিয়া ফেলা’ হইতে গৃহীত। কেননা কুরআনে ঘোষণাঃ
****************************************
স্ত্রীরা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরা তাদের জন্য পোশাক।
এই অনুযায়ী স্ত্রী তাৎপর্যগতভাবে স্বামীর পোশাক। কাজেই স্ত্রীকে তালাক দেওয়া ও গায়ের পোশাক খুলিয়া ফেলা একই ধরনের কাজ। ইসলামী শরীয়াতের বিশেষজ্ঞগণ একমত হইয়া বলিয়াছেনঃ এই পন্হায় স্ত্রী স্বামীর নিকট হইতে তালাক গ্রহণ করিতে পারে। ইহা শরীয়াত সম্মত এবং সত্যিকার ও বাস্তব কারণে এই পন্হায় তালাক গ্রহণ করা হইলে তাহাতে গুনাহ হইবে না।
কিন্তু এই সংজ্ঞা উত্তম ও যথার্থ নয় কেননা ইহাতে খোলা তালাকের বিনিময়ে নগদ ধন-মাল হওয়াকে শর্ত করা হইয়াছে। কোন রূপ ঋণ বা শাস্তির কারণে ‘খোলা’ হইয়া থাকিলে তাহাও এই সংজ্ঞার দৃষ্টিতে সহীহ বলিয়া মনে করিতে হয়। অথচ তাহা ঠিক নয়। বরং স্বামী কোনরূপ ধন-মাল গ্রহণ না করিলেও ‘খোলা তালাক’ হইতে পারে। এই কারণে মুল লক্ষ্য লাভের উপরই গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে, গ্রহণ করার উপর নয়। অন্যান্যরা বলিয়াছেনঃ
****************************************
স্বামী স্ত্রীকে যাহা কিছু দিয়াছে তাহার বিনিময়ে স্ত্রীত্ব খতম করিয়া দেওয়াই হইল ‘খোলা তালাক’।
আল্লামা নাসাফী বলিয়াছেনঃ
****************************************
ধন-মাল গ্রহণের বিনিময়ে ‘খোলা’ শব্দ প্রয়োগ সহকারে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোই হইল ‘খোলা তালাক’।
ইহার শর্ত তাহাই যাহা সাধারণতঃ তালাকের শর্ত। আর ইহার পরিণতি হইল ‘বাঈন তালাক’ সংঘটিত হওয়া। ইহা স্বামীর দিক দিয়া ‘কসম’ পর্যায়ের কাজ। আর স্ত্রীর দিক দিয়া ওদল-বদল করণ।
‘খোলা তালাক’ কিভাবে সংঘটিত হয়? কেবল বিনিময় গ্রহন করা হইলেই কি তালাক আপনা-আপনি সংঘটিত হইয়া যাইবে? না মুখের শব্দের কিংবা নিয়্যতে তালাক বলিলেই তবে তালাক সংঘটিত হইবে? এই বিষয়ে ফিকাহবিদগণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। হানাফী মাযহাবের ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন, উহা খোলা ও তালাক উভয় শব্দেই সংঘটিত হইতে পারে। তবে তাহাতে ধন-মালের বিনিময় হইতেই হইবে এবং ইহা বাঈন তালাক হইবে। ইমাম শাফেয়ীর প্রাচনী কতা হইল, ইহা ঠিক তালাক নহে, ইহা বিবাহ ভাঙিয়া দেওয়া মাত্র। হযরত ইবনে আব্বাস (রা)ও এই মত প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেনঃ যদি একই স্ত্রীর সঙ্গে কয়েকবার খোলা করা হয় তবুও তাহাদের মধ্যে অন্য স্বামী গ্রহণ ছাড়াই বারবার বিবাহ হইতে পারিবে। ইমাম আহমাদও এইমত সমর্থন করিয়াছেন। ইমাম শাফেয়ীর আর একটি মত হইল, ইহা রিজয়ী তালাক। তবে তাঁহার তৃতীয় একটি মতও আছে। আর তাহা হইল, ইহা এক তালাক বাঈন। হানাফী মাযহাবের মতও ইহাই। ইহার ভিত্তি হইল নবী করীম (স)এর উক্তিঃ
****************************************
‘খোলা’ এক তালাক বাঈন মাত্র।
হযরত উমর, আলী ও ইবনে মাসউদ (রা) এই মতই দিয়াছেন।
এই ব্যাপারে আরও দুইটি কথা আছে। একটি, ইহা এক তালাক বাঈন। হযরত উসমান, আলী ও ইবনে মাসউদ (রা) ইহা বলিয়াছেন। ইহাতে যদি তিন তালাক বলা হয়, তবে তাহাই হইবে। ইহা ইমাম মালিক, সওরী, আওজায়ী ও কুফী ফিকাহবিদদের মত।আর দ্বিতীয় কথা হইল, ইহা তালাক নয়, ইহা ফিসখ। অর্থাৎ বিবাহ ভাঙিয়া দেওয়া মাত্র। অবশ্য তালাকের নিয়্যত করা হইলে তাহাই হইবে। ইবনে আব্বাস, তায়ূস, ইকরামা, ইমাম আহমাদ, শাফেয়ী, ইসহাক, আবূ সওর প্রমুখ ফিকাহবিদদের এই মত। হানাফী মতের ভিত্তি যে হাদীসের উপর, তাহা হইল, হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
নবী করীম (স) খোলাকে এক তালাক বাঈন গণ্য করিয়াছেন।
কিন্তু ইহার সনদে দুর্বলতা রহিয়াছে। ইমাম বুখারী এই হাদীসটি গ্রহণ করেন নাই। ইমাম নাসায়ী বলিয়াছেন, ইহার একজন বর্ণনাকারী পরিত্যক্ত। শু’বা বলিয়াছেনঃ এই হাদিসটি তোমরা পরিহার কর। দারে কুতনী ইহার সনদ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেন নাই। তবে ইবনে আব্বাস (রা) হইতে আরও একটি উক্তি উহাতে উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহা হইলঃ ********** ‘খোলা বিচ্ছিন্নকরণ মাত্র’। -ইহা তালাক নয়।
আর সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব হইতেবর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
নবী করীম (স) খোলা’তে এক তালাক হয় বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।
বস্তুত ‘খোলা’- তালাকের ব্যবস্থা রাখা ও মূল তালাকের সুযোগ রাখার মতই ইসলামী শরীয়াত ও সমাজ ব্যবস্থার এক গুরুত্বপুর্ণ অবদান। বিবাহ হইয়া গেলে জীবন দুর্বিসহ হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর হইতে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভের কোন পথ উন্মুক্ত না থাকা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক ব্যবস্থা। তাহা মানবোপযোগী ব্যবস্থা হইতে পারে না, তাই বস্তুনিষ্ঠ ও অনিবার্য কারণের ভিত্তিতে তালাক দেওয়া বা নেওয়ার ব্যবস্থা করিয়া ইসলাম বিশ্ব মানবতার অবর্ণনীয় কল্যাণকর অদান রাখিয়াছেন, একথা বলিষ্ঠ কণ্ঠেই বলিতে হইবে।
দাম্পত্য জীবনের জন্য একান্তই অপরিহার্য হইতেছে, পারস্পরিক নিবিড় শান্তি, স্বস্থি, প্রেম-ভালবাসা, গভীর প্রীতি, আন্তরিক দরদ, সহানুভূতি, সহযোগিতা, উত্তম আচার-আচরণ এবং প্রত্যেকেরই অপরের অধিকার আদায়ের জন্য অতন্ত্র প্রহরীর মত সদা সচেতন ও সদাজাগ্রত হইয়া থাকা। এইরূপ না হইলে দাম্পত্য জীবন মরুভূমির উপর দিয়া নৌকা বাওয়া কিংবা সমুদ্রের উপর দিয়া রেলগাড়ী চালানার মতই অসম্ভব, অচল। তাই দাম্পত্য জীবনে সাধারণত এইরূপ অবস্থারই বিরাজমাতনা কাম্য এবং লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, উক্তরূপ সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ সুমধুর দাম্পত্য জীবনেও বিপর্যয় আসে। আর যখন বিপর্যয় আসিয়াই পড়ে তখন আর একসঙ্গে জীবন যাপনের কথা চিন্তা না করিয়া পরস্পর হইতে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভের উপায় কি হইতে পারে তাহাই প্রধান চিন্তা ও বিবেচনার বিষয়। ইসলাম এ অবস্থায় যে ব্যবস্থা উপস্থাপিত করিয়াছে তাহাকেই বলা হয় খোলা তালাক।এই তালাকের দুইটি দিক। কখনও স্বামী ইহার প্রয়োজন বোধ করে। ফলে সে-ই উদ্যোগী হইয়া নিজ হইতেই তালাক দিয়া দেয়। আবার এমন কারনের উৎপত্তি হওয়াটাও কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয় যে, স্বামী হয়ত তালাক দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে না, কিন্তু স্ত্রী এই স্বামীর ঘর কিরিতে পারে না- এই স্বামীর ঘর করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া দাঁড়ায়। তখন স্ত্রী উদ্যোগী হইয়া স্বামীর নিকট হইতে তালাক গ্রহণ করিতে সচেষ্ট হয়। এই দ্বিতীয় প্রকারের তালাক গ্রহণই হইল ‘খোলা তালাক’।
উপরোদ্ধৃত হাদীসৈ যে ঘটনার বিবরণ দেওয়া হইয়াছে, তাহার সার কথা হইল, হাবীবা সাবিতের স্ত্রী ছিল। বিবাহটা উভয়ের পছন্দ ও সম্মতিক্রমে হইয়াছিল কিনা, এই বর্ণনায় তাহার উল্লেখ নাই। কিন্তু বিবাহিত জীবনে হাবীবা সাবিতকে পাইয়া কিছুমাত্র সুখী হয় নাই। সুখী না হওয়ার একটি মাত্র কারণেরই উল্লেখ করা হইয়াছে। তাহা হইল, সে তাহার স্বামীকে অপছন্দ ও ঘৃণা করিত। আর এই অপছন্দ ও ঘৃণা করার কারণ হইল, সে ছিল ‘দমীম’। আরবী ***** শব্দের অর্থ *********** ‘দেখিতে কুৎসিত ও দৈহিক আকার আকৃতিতে ক্ষুদ্র, বেঁটে’। এই শব্দটির মূল হইল *****। ইহার অর্থ ****** ‘ক্ষুদ্রকায় পিপিলিকা’। আর একটি লোককে ***** বলার অর্থ, সে আকার আকৃতিতে ক্ষুদ্র। অর্থাৎ স্বামীর কুৎসিত বীভৎস চেহারা ও আকার-আকৃতির ক্ষুদ্র্বের কারণে হাবীবা তাহাকে পছন্দ করিতে পারে নাই। বরং সে তাহাকে ঘৃণা করে। স্বামীর প্রতি তাহার এই ঘৃণা কতখানি তীব্র ও উৎকট ছিল তাহা তাহার পরবর্তী কথা হইতেই স্পষ্ট বুঝা যায়। সে নিজেই রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া তাহার বিবাহের ফয়সালা প্রার্থনা করে এবং তাহার তালাক চাওয়ার কারণ প্রদর্শণ করিতে গিয়া সে নিজেই বলিয়া উঠেঃ আমি তাহাকে দেখি বটে; কিন্তু আল্লাহর ভয় না থাকিলে আমি তাহার মুখের উপর-ই থুথু নিক্ষেপ করিতাম। বস্তুত কোন কিছুর প্রতি থু থু নিক্ষেপ করা সেই জিনিসের প্রতি প্রবল তীব্র ও উৎকট ঘৃণার চরমতম প্রকাশ। এই ঘৃণা তাহার মন মগজে শক্ত হইয়া বসিয়াছিল এবং ইহাকে পছন্দে ও আকর্ষনে পরিবর্তিত করার কোনই উপায় নাই। রাসূলে করীম (স) তাহার এই কথা শুনিয়াই মূল অবস্থাটা নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং সেই সঙ্গে ইহাও তাঁহার নিকট প্রতিবাত হইয়া পড়িয়াছিল যে, এই দম্পত্তির স্থিতি অসম্ভব। ইহাদের মধ্যে বিচ্ছেদ অনিবার্য, অপরিহার্য এবং তাহা যত শীঘ্রই হয় ততই মঙ্গল। তাই নবী করীম (স) এ বিষয়ে অধিক আর কোন কথা-বার্তা বলার প্রয়োজন মনে করিলেন না। বরং কি ভাবে এই বিচ্ছেদ ঘটিতে পারে অনতিবিলম্বে সেই দিকেই নজর দিলেন।
ইহা হইতে নিঃসেন্দেহে প্রমাণিত হইল যে, স্বামীর চেহারা-ছুরত ও দৈহিক আকার-আকৃতি স্ত্রীর পছন্দ ও মনোমত হওয়া দাম্পত্য জীবনের স্থিতি ও স্থায়ীত্বের জন্য একান্তই জরুরী। ইহা না হইলে স্ত্রীর অকীকার আছে স্বামীর সহিত থাকিতে অস্বীকার করা এবং তাহার নিকট তালাক চাওয়া। আলোচ্য হাদীসের বর্ণনায় রাসূলে করীম (স) শুধু এই কারণেই হাবীবার অভিযোগের যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়া লইলেন এবং তাহার তালাক চাওয়ার আবেদনকে অগ্রাহ্য করিলেন না।
তিনি এই তালাক সংঘটিত হওয়ার পন্হা উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে হাবীবাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমাকে সে মহরানা বাবদ যে বাগানটি দিয়াছিল, তাহা কি তুমি ফিরাইয়া দিতে প্রস্তুত আছ? ইহার অর্থ, খোলা তালাকে- স্ত্রীর ইচ্ছা ও উদ্যোগে স্বামী যে তালাক দেয় তাহাতে স্বামীর মহরানা বাবদ দেওয়া মাল-সম্পদ ফিরাইয়অ দিতে হয়। উহা ফেরত দেওয়ার বিনিময়েই স্ত্রী স্বামীর নিকট হইতে তালাক গ্রহণ করে।
কিন্তু স্বামী মহরানা বাবদ স্ত্রীকে যাহা কিছু দিয়াছিল তাহা ফিরাইয়া লওয়া ও উহার বিনিময়ে তালাক দেওয়া পর্যায়ে শরীয়াত বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মত উদ্ধৃত হইয়াছে। আবূ বকর ইবনে আবদুল্লাহ আল মুজানী তাবেয়ী এ সম্পর্কে বলিয়াছেন, স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার বিনিময়ে তাহার নিকট হইতে স্বামীর কোন কিছুই গ্রহণ করা উচিত নয়- তাহার জন্য তাহা হালালও নয়। কেননা কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা ইহা করিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন। দলীল হিসাবে তিনি এই আয়াতটি পেশ করিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা যদি এক স্ত্রীর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক হও এবং তোমরা তাহাদের কাহাকেও বিপুল পরিমাণ সম্পদও দিয়া থাক, তাহা হইলে তোমরা তাহা হইতে কিচুই গ্রহণ করিও না।
(আন-নিসা- ২০)
এই আয়াতটি হইতে তালাকের বিনিময়ে স্ত্রীর নিকট হইতে স্বামীর কিচুই গ্রহণ করা নিষেধ জানা যায়।
কিন্তু কুরআন মজীদেরই অপর একটি আয়াত হইতে ইহার বিপরীত কথা জানা যায়। আয়াতটি এইঃ
****************************************
তোমরা যদি আশংকাবোধ কর যে, স্বামী স্ত্রী আল্লাহর সীমা সমূহ কায়েম ও রক্ষা করিতে পারিবে না (বা করিবে না), তাহা হইলে স্ত্রী যে বিনিময় মূল্য দিবে, তাহার ভিত্তিতে (বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত করার) তাহাদের দুই জনের গুনাহ হইবে না। এই আয়াতটি হইতে বিনিময় গ্রহণ করা স্বামীর জন্য জায়েয প্রমাণিত হয়।
(আল-বাকারাঃ ২৯)
আবূ বকর ইবনে আবদুল্লাহ মনে করিয়াছেন যে, সূরা বাকারা এই শেষোক্ত আয়াতটি সূরা নিসার উরোদ্ধৃত আয়াতটি দ্বারা মনসুখ হইয়া গিয়াছে। অতএব তালাকের বদলে স্বামী স্ত্রীর নিকট হইতে কোন কিছু গ্রহণ করিতে পারিবে না- এই হুকুমই বলবত রহিয়াছে।
ইবনে জায়দ প্রমুখ বলিয়াছেন, আবূ বকররের কথা যথার্থ নয়। বরং সূরা বাকারার যে আয়াতটি দ্বারা সূরা নিসার আয়াতটিই মনসুখ হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলঃ
****************************************
তোমরা স্ত্রীদের যাহা কিছু দিয়াছ তাহা হইতে কিছু গ্রহণ করা- হে স্বামীরা- তোমাদের জন্য হালাল নয়।
অতএব তালাকের বিনিময়ে স্বামী স্ত্রীর নিকট হইতে মাল-সম্পদ গ্রহণ করিতে পারিব।
কিন্তু মনসুখ হওয়া সম্পর্কে এই দুইটি কথাই ঠিক নয়। কেননা প্রকৃত পক্ষে এই কোনটিই আয়াত কয়টিই কোনটি কর্তৃক মনসুখ বা বাতিল হইয়া যায় নাই। বরং আয়াতত্রয়ের প্রত্যেকটি স্ব স্ব স্থানে অনড়, অবিচল, অপরিবর্তিত- *****। আসল ব্যাপার হইল ইহাদের প্রত্যেকটি আয়াতই এক একটা বিশেষ পরিপেক্ষিতে প্রযোজ্য। ইমাম তাবারী বলিয়াছেন, আবূ বকরের কথার কোন অর্থ নাই। কেননা স্ত্রী দিতে প্রস্তুত হইলে স্বামীর পক্ষে তাহা গ্রহণ করা স্বয়ং নবী করীম (স) কর্তৃকই জায়েয ঘোষিত হইয়াছে। যে মূল হাদীসটি লইয়া এই আলোচনা। তাহাই ইহার অকাট্য প্রমাণ। ইহাতে নবী করীম (স) সাবিতের জন্য তাহার দেওয়া বাগানটি তাহার স্ত্রী হাবীবকে তালাক দেওয়ার বিনিময়ে ফিরাইয়া আনিয়া দিয়াছেন।
এই পর্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে যে হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে তাহা এখানে উল্লেখ্য। হাদীসটি এইঃ
****************************************
সাবিত ইবনে কাইসের স্ত্রী নবী করীম (স)-এর নিকট আসিল ও বলিলঃ ইয়া রাসূল! কাইসের পুত্র সাবিত সম্পর্কে তাহার চরিত্র ও দ্বীনদারীর দিক দিয়া আমি কোন দোষারোপ করিব না। কিন্তু আসল কথা হইল, ইসলামে কুফীরকে আমি ঘৃণা করি। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি কি তাহার বাগানটি ফিরাইয়া দিবে? সে বলিল, হ্যাঁ, দিব। তখন নবী করীম (স) কাইসের পুত্র সাবিতকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেনঃ তুমি বাগানটি গ্রহণ কর এবং উহাকে (স্ত্রী হাবীবাকে) এক তালাক দাও।
এ বর্ণনায় সাবিতের স্ত্রী নাম বলা হয় নাই। কিন্তু বুখারীর-ই অপর একটি বর্ণনায় তাহার নাম বলা হইয়া জমীলা বিনতে ইবনে সলুল। বর্ণনায় বলা হইয়াছে, জমীলা সাবিতের পূর্বে হানজালা ইবনে আবূ আমেরের স্ত্রী ছিল। পরে সাবিতের সঙ্গে বিবাহ হয়। ইবনে মাজার বর্ণনায়ও এই নামই বলা হইয়াছে।
প্রথমোদ্ধৃত হাদীসটির শেষ কথাটিতে দাবিকরা হইয়াছে যে, সাবিত হাবীবাকে যে খোলা তালাক দিয়াছিল, তাহাই ছিল ইসলামী সমাজের প্রথম খোলা তালাক। কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর একটি বর্ণনায় ভিন্ন কথা বলা হইয়াছে। সে বর্ণনাটি এইঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর ভগ্নির খোলা তালাকই ইসলামী সমাজের প্রথম ঘটনা। সে নবী করীম (স)-এর নিকট আসিল ও বলিল ইয়া রাসূল! আমার ও তাহার মাথা কখনও একত্রিত হয় না। আমি তাঁবুর এক পাশ খুলিয়া তাকাইয়া দেখিলাম সে কয়েকজন লোক সমভিব্যহারে চলিয়া আসিতেছে। বুঝিতে পারিলাম, সে সঙ্গের অন্যান্য সব লোকের তুলনায় অধিক উৎকৃষ্টভাবে কৃষ্ণবর্ণ, আকৃতিতে সকলের অপেক্ষা ছোট ও বেঁটে এবং চেহারার দিকদিয়া সকলের তুলনায় অধিক কুৎসিত ও বীভৎস। তখন নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কি তাহার দেওয়া বাগানটি ফেরত দিবে? সে বলিল, হ্যাঁ, দিব। সে তাহারও বেশী চাহিলে তাহাও তাহাকে দিব। পরে নবী করীম (স) এই দুইজনের মধ্যে বিচ্ছেধ ঘটাইয়া দেন।
(আল-কুরতুবী)
আল্লাম কুরতুবী বলিয়াছেন, ‘খোলা তালাক’ পর্যায়ে এইটিই আসল হাদীস- মূল ভিত্তি। জমহুর ফিকাহবিদগণেরও এই মত। ইমাম মালিক বলিয়াছেনঃ শরীয়াতবিদদের নিকট হইতে আমি সব সময় এই কথাই শুনিয়া আসিতেছি। আর বস্তুতও এই মতটি সর্বসম্মত।
এই সব আয়াত ও হাদীস হইতে একথা প্রমাণিত হয় যে, স্বামী যদি স্ত্রীকে কোন কষ্ট না দেয়, কোনরূপ খারাপ বা ক্ষতিকর আচরণ না করে, সে তালাক দিতে ইচ্ছুকও না হয়, তাহা সত্ত্বেও এরূপ অবস্থায় কেবল স্ত্রীই যদি স্বামী হইতে তালাক দিতে উদ্যোগী হয়, তাহা হইলেঃ
****************************************
তালাকের বদলে স্ত্রী যাহা কিছুই দিতে প্রস্তুত হইবে, তাহা সবই গ্রহণ করা স্বামীর জন্য সম্পূর্ণ হালাল- যেমন নবী করীম (স) ইহা করাইয়াছেন।
পক্ষান্তরে দুর্ব্যবহার ও খারাপ আচরণ যদি স্বামীর হয়, সে যদি স্ত্রীকে কষ্ট দেয়, তাহার ক্ষতি করে, তাহা হইলে স্বামী স্ত্রীর নিকট হইতে যাহা কিছু গ্রহণ করিয়াছে, তাহা সে ফেরত দিতে বাধ্য হইবে, সেই সঙ্গে তালাকও দিবে।
কিছু লোকের মতে খোলা তালাক লওয়া জায়েয হইবে কেবল মাত্র তখন যখন উভয়ের মধ্যে চরম বিরোধ ও ক্ষতিকর অবস্থার উদ্ভব হইবে। খোলা তালাদের জন্য ইহাই শর্ত। সাবিত সম্পর্কিত আলোচ্য ঘটনা সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা)-এর বর্ণনাটির ভাষা হইল সমর্থক। তাহা হইল, হযরত আয়েশা (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
সহল তনয়া হাবীবা সাবিত ইবনে কায়সের স্ত্রী ছিল। সে তাহাকে মারধর করে এবং তাহার কাঁধ চূর্ণ করিয়া দেয়। সকাল বেলা সে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া ইহার অভিযোগ করে। নবী করীম (স) সাবিতকে ডাকিয়া বলিলেনঃ তুমি ইহার নিকট হইতে তাহার কিছু মাল-সম্পদ গ্রহণ কর ও তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দাও।
এই বর্ণনাটি হইতেও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীর নিকট হইতে ধন-মাল লইয়া তাহাকে তাহার প্রস্তাব অনুযায়ী তালাক দেওয়া জায়েয। এই বর্ণনার শেষে বলা হইয়াছে, সাবিত নবী করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
****************************************
ইহা আমার জন্য ভাল হইবে, ইয়া রাসূল?
তিনি বলিলেন হ্যাঁ, তখন সাবিত বলিলেনঃ
****************************************
আমি তাহকে দুইটি বাগান মহরানা স্বরূপ দিয়াছি এবং সে দুইটই তাহার হাতে রহিয়াচে।
নবী করীম (স) বলিলেনঃ ******** এই দুইটি বাগানই তুমি ফিরাইয়া লও এবং তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দাও।
বস্তুত ইহাই জমহুর ফিকাহবিদদের মত। তাঁহারা বলিয়াছেনঃ
****************************************
স্বামীর কোন রূপ ক্ষতিকর আচরণের অভিযোগ ছাড়াই খোলা তালাক লওয়া জায়েয।
এ ক্ষেত্রে সূরা বাকারার আয়অতটির ভিত্তিতে বিপরীত কথা বলা যাইতে পারে না। কেননা আল্লাহ তা’আলা উহাকে শর্ত হিসাবে পেশ করেন নাই। খোলা তালাকের সাধারণ প্রচলিত নিয়মের ও অবস্থার দৃষ্টিতেই সে কথাটি বলা হইয়াছে। এ সম্পর্কে আল্লাহর একথাটিও স্মরনীয়ঃ
****************************************
স্ত্রী যদি নিজ হইতেই কোন কিছু দেয় তবে তোমরা তাহা খুব স্বাদ লইয়াই খাইবে।
(*******************)
ইদ্দাত
****************************************
আবুস-সানাবিলইবনে বাকাক (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ সুবাইয়া নাম্নী এক মহিলা তাহার স্বামীর মৃত্যুর তেইশ দিন কিংবা পঁচিশ দিন পর সন্তান প্রসব করিল। অতঃপর তিনি যখন নেফাস হইতে পবিত্র হইয়া বিবাহ করার ইচ্ছুক ও উদ্যোগী হইলেন, তখন তাহাকে এই কাজ করিতে নিষেধ করা হইল। পরে এই ব্যাপারটি নবী করীম (স)-এর নিটক বলা হইল। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ যে যদি তাহা করে তবে করিতে পারে। কেননা তাহার ইদ্দতের মেয়াদ তো অতিক্রান্ত হইয়া গিয়া।
(তিরমিযী, বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসের মূল বর্ণনাকারী হযরত আবুস-সানাবিল (রা) একজন প্রখ্যাত সাহাবী। তিনি সুবাইয়া নাম্মী এক মহিলার ইদ্দাত সংক্রান্ত একটি ব্যাপার এই হাদীসে বর্ণনা করিয়াছেন। সুবাইয়া ছিলেন হারিস নামক এক সাহাবীর কন্যা। সুবাইয়া সায়াদ ইবনে খাওলার স্ত্রী ছিলেন। সায়াদের ইন্তেকালের তেইশ পঁচিশ দিন পর সুবাইয়ার সন্তান প্রসব হয়। পরে নেফাস হইতে পবিত্র হওয়ার পর বিবাহ করার প্রস্তুতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করে। লোকেরা তাহা করিতে নিষেধ করে। কেননা তাহারা মনে করিয়াছিল, তাহার স্বামী মরিয়াছে মাত্র কয়েক দিন হয়। এখনও স্বামী-মৃত্যুর ইদ্দত অতিক্রান্ত হয় নাই। কাজেই এখনই কি করিয়া সে বিবাহ করিতে পারে। অথচ মরিয়া যাওয়া ব্যক্তির স্ত্যকে অবশ্যই ইদ্দাত পালন করিতে হয় ইহা ইসলামী শরীয়াতের বিধান। পরে নবী করীম (স) এই সব কথা জানিতে পারিয়া বলিলেনঃ হ্যাঁ সে যদি বিবাহ করিতে চায় তাহা হইলে সে এখনই তাহা করিতে পারে। কেননা তাহার যাহা ইদ্দাত ছিল, সে ইদ্দাত কতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। আর ইদ্দাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুনরায় বিবাহ করা সম্পূর্ণ রূপে শরীয়াত সম্মত।
এখানে প্রশ্ন ছিল, সুবাইয়ার স্বামীর মৃত্যুর পর তাহাকে ইদ্দাত পালন তো করিতে হইবে, কিন্তু তাহা কত দিনের ইদ্দাত? স্বামী মরিয়া গেলে স্ত্রকে কতদিন ইদ্দাত পালন করিতে হইবে তাহা কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তোমাদের মধ্যে যে সব লোক মৃত্যু বরণ করিবে এবং স্ত্রী রাখিয়া যাইবে, সেই স্ত্রীরা নিজদিগকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় বসাইয়া রাখিবে।
অপেক্ষায় বসাইয়া রাখিবে অর্থাৎ ইদ্দাত পালন করিবে এবং এই ইদ্দাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য স্বামী গ্রহণ করিবে না। পুনঃবিবাহ করিতে পারিবে না। অন্য কথায় স্বামী মৃত্যু জনিত ইদ্দাতের মেয়াদ মোট চার মাস দশদিন। ইহা স্বামী মরা বিধবা হওয়া সব স্ত্রীলোকের জন্যই প্রযোজ্য। স্ত্রী ছোট বয়সের হউক কিবা বড় ও বেশী বয়সের সঙ্গমকৃতা হউক কি অসঙ্গমকৃতা। স্বামী মরিয়া গেলে তাহাকেই এই ইদ্দাত পালন করিতে হইবে। তাহা হইলে সুবাইয়া এই মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই পুনরায় বিবাহিতা হওয়ার ও অন্য স্বামী গ্রহণ করার উদ্যোগ কিরূপে গ্রহণ করিল? আর রাসূলে করীম (স)ই বা তাহাকে অনুমতি দিলেন কিভাবে?…. এই পর্যায়েই গর্ভবতী স্ত্রীলোকের ইদ্দাত সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে।
গর্ভবতী স্ত্রীকে যদি তালাক দেওয়া হয়; অথবা স্ত্রী গর্ভবস্থায় যদি স্বামীর মৃত্যু হয়, তাহা হইলে সেই স্ত্রীর উদ্দাতের মেয়াদ কত? এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
আর গর্ভবতী স্ত্রীদের ইদ্দাতের সময় সীমা হইল তাহাদের সন্তান প্রসব হওয়া।
স্বামীর মৃত্যু হওয়া জনিত স্ত্রীর মেয়াদ চার মাস দশ দিন এবং গর্ভবতী স্ত্রীলেক প্রাপ্তা হইলে তাহার ইদ্দাত সন্তান প্রসব হওয়া-ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এই দুইটি কথা কুরআন মজীদের উপরোদ্ধৃত আয়াতটি হইতে নিঃসন্দেহে জানা গেল। কিন্তু যে গর্ভবতী স্ত্রীর স্বামী সন্তান প্রসব হওয়ার পূর্বে সন্তান গর্ভে থাখা অবস্থায়ই মৃত্যু মুখে পতিত হইল- সে কি করিবে? আয়াতদ্বয় হইতে প্রমাণিত দুই ধরনের মিয়াদের মধ্যে কোন মেয়াদের ইদ্দাত সে পালন করিবে, এই বিষয়ে কুরআন মজীদে কিছুই বলা হয় নাই। এই বিষয়ে শরীয়াতের সিদ্ধান্ত জানিবার জন্য হাদীসের আশ্রয় লইতে হইবে।
কথিত স্ত্রী লোকটির অবস্থার প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন দিক দিয়া এই দুইটি আয়াত-ই প্রযোজ্য। তাহার স্বামী মরিয়া গিয়াছে, অতএব তাহার উপর সূরা বাকারর প্রথমোদ্ধৃত আয়াতটি প্রযোজ্য। কিন্তু যেহেতু সে তখন গর্ভবতী ছিল ও পরে তাহার সন্তানও প্রসব হইয়াছে, এই দিক দিয়া তাহার ইদ্দাতকাল শেষ হইয়া গিয়াছে মনে করিতে হয় এই শেষোক্ত সূরা আত-তালাক-এর আয়াত কিন্তু এই দুই মেয়াদের দীর্ষতার বিরাট পার্থক্য রহিয়াছে।
হাদীসের ঘোষণা হইতে এই সমস্যা চূড়ান্ত সমাধান পাওয়া যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বলিয়াছেনঃ
****************************************
যাহার ইচ্ছা সে আমার সহিত পারস্পরিক অভিশাপ প্রার্থনায় যোগ দিতে পারে এই কথা লইয়া যে, সূরা আত-তালাকের আয়াতটি সূরা আল-বাকারার আয়াতের পরে নাযিল হইয়াছে।
আর একই বিষয়ে দুইটি ভিন্ন ধরনের হুকুম নাযিল হইয়া থাকিলে উহার মধ্যে শেষে যেটি নাযিল হইয়াছে সেইটিই গ্রহণ করিতে হইবে। ইহাই শরীয়াতের বিধান। কাজেই সুবাইয়ার সন্তান প্রসব ও নেফাস হইতে পবিত্রতা লাভের পরই পুনরায় স্বামী গ্রহণে উদ্যোগী হওয়ার সর্বোতভাবে শরীয়াত সম্মত কাজ। উহার বিরোধী মোটেই নয়। নবী করীম (স) ঠিক এই কারণেই তাহার এই কাজের বৈধতা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়াছিলেন- এখানে এই বর্ণনাটিও স্মরণীয়ঃ
****************************************
যে স্ত্রী লোকটির স্বামী মরিয়া গিয়াছে- এ অবস্থায় যে, সি নিজে গর্ভবতী, তাহার সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ তোমরা কি তাহার উপর কঠোরতা করিতে ও নির্মমতা চাপাইতে চাও? এবং তাহার পক্ষে সুবিধা হয় এমন নীতি গ্রহণ করিতে চাও না? ছোট সূরা (অর্থাৎ আত-তালাক) তো বড় সুরা নিসা (সূরা আল-বাকারা)র পরে নাযিল হইয়াছে। আর যে আয়াতটি পরে নাযিল হইয়াছে, উহার হুকুমকে এই স্ত্রীলোকটির জন্য গ্রহণ করা হইলে তাহার প্রতি সহজতা আরোপ করা হয়। আর শেষে নাযিল হওয়া সে আয়াতটি হইলঃ গর্ভবতী মেয়ে লোকের ইদ্দাত কাল হইল তাহাদের সন্তান প্রসব হওয়া। (বুখারী, নাসায়ী)
হযরত আলকামা (রা)-এর এই কথাটিও হাদীসগ্রন্হ সমূহে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
যাহার ইচ্ছা সে আমার সহিত এই কথা লইয়া হলফ বিনিময় করিতে পারে যে, গর্ভবতী স্ত্রীদের সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্তই তাহাদের ইদ্দতের মেয়াদ। এই কথাটি স্বামী মরিয়া যাওয়া স্ত্রীর ইদ্দাত সংক্রান্ত আয়াতের পর নাযিল হইয়াছে। কাজেই স্বামী মরিয়া যাওয়া গর্ভবতী স্ত্রী যখন-ই সন্তান প্রসব করিবে, তখনই অন্য স্বামী গ্রহণ তাহার জন্য হালাল হইয়া যাইবে। স্বামী মরিয়া যাওয়া সংক্রান্ত আয়াতটির কথা হইলঃ তোমাদের মধ্যে যাহারা মরিয়া যায় ও স্ত্রীদের রাখিয়া যায় তাহারা চারমাস দশ দিন ইদ্দাত পালন করিবে।
আলকামার এই কথাটি এ পর্যায়ে আরও স্পষ্ট ও বলিষ্ঠঃ
****************************************
সূরা আত-তালাকের আয়াত ‘গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের ইদ্দাত তাহাদের সন্তান প্রসব হওয়া অন্য সব ইদ্দাতকে বাতিল করিয়া দিয়াছে। অর্থাৎ তালাক প্রাপ্তা বা স্বামী মরিয়া যাওয়া স্ত্রীর ইদ্দাতের শেষ হইল তাহার সন্তান হওয়া।
হযরত উবাই ইবনে কায়াব (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
‘আমি নবী করীম (স)-কে জিজ্ঞাসা করিলামঃ গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের ইদ্দাত সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত’ এই কথাটি কি তিন তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী সম্পর্কে, না স্বামী মরিয়া যাওয়া স্ত্রী সম্পর্কে? জবাবে তিনি বলিলেন, ইহা এই উভয় প্রকারের স্ত্রী লোকদের ব্যাপারেই প্রযোজ্য।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-কে স্বামী মরিয়া যাওয়া গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের ইদ্দাতের মেয়াদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
সে যখন-ই সন্তান প্রসব করিবে, তখনই তাহার ইদ্দাত শেষ হইয়া গিয়াছে মনে করিতে হইবে।
এই সময় একজন আনসার ব্যক্তি বলিলেন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
সেই গর্ভবতী স্ত্রী লোকটি যদি তাহার মৃত স্বামীর লাশ খাটের উপর থাকা অবস্থায় এবং দাফন হওয়ার পূর্বেই সন্তান প্রসব করে, তাহা হইলেও তাহার ইদ্দাতের মেয়াদ শেষ হইয়া গিয়াছে, বুঝিতে হইবে।
প্রথমে যে হাদীসটি উদ্ধৃত করা হইয়াছে, বুখারী শরীফে উহার আর একটি বর্ণনার ভাষা এইরূপঃ
****************************************
সুবাইয়া আসলামী তাহার স্ত্রী মৃত্যুর কয়েক রাত্রির পরই সন্তান প্রসব করে। পরে সে নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া বিবাহের অনুমতি প্রার্থনা করে। নবী করীম (স) তাহাকে অনুমতি দেন। অতঃপর সে বিবাহ করে।
সুবাইয়ার নিজের কথা হইলঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) আমাকে ফতোয়া দিলেন যে, আমি যখনই আমার সন্তান প্রসব করিয়াছি তখনই আমার পালনীয় ইদ্দাত শেষ করিয়াছি। আর আমার ইচ্ছা হইলে আমি বিবাহ করিতে পারি বলিয়া আমাকে নির্দেশ করিলেন।
ইমাম তিরমিযী প্রথমোদ্ধৃত হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর লিখিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবীদের অধিকাংশ আহলি-ইলম-ই এই মত পোষণ করিতেন যে, গর্ভবতী স্ত্রীর স্বামী মরিয়া যাওয়ার পর যখনই সন্তান প্রসব করিবে, তখনই তাহার ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হইয়া যাইবে, স্বামী মৃত্যু সংক্রান্ত ইদ্দাত (চারমাস দশ দিন) তখন শেষ না হইলেও কোন অসুবিধা নাই এবং সে তখনই অন্যত্র বিবাহিতা হইতে পারিবে। কিন্তু হযরত আলী (রা), সায়ীদ ইবনে মনছুর, আবদ ইবনে হুমাইদ ও অন্যান্য কয়েকজনের মত হইলঃ **** দুই ধরনের ইদ্দাতের মধ্যে যেটি অধিক দীর্ঘ ও বিলম্বে আসে, সেইটই পালন করিতে হইবে। অর্থাৎ চারমাস দশদিন গত হওয়ার আগেই যদি সে সন্তান প্রসব করে, তাহা হইলে এই মেয়াদটি শেষ করা পর্যন্ত তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইবে। সন্তান প্রসব করিলেই ইদ্দাত শেষ হইল মনে করা যাইবে না। আর যদি চারমাস দশ দিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও গর্ভ থাকে সন্তান প্রসব না হয়, তাহা হইলে উহার জন্য অপেক্ষা করিতে হইবে। কিন্তু এইমত সহীহ নয়। সুবাইয়া সংক্রান্ত হাদীস হইতে সহহি কথা জানা যায়।
স্বামী মরা স্ত্রীর ইদ্দাত
****************************************
হযরত উম্মে সালমা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, একজন স্ত্রীলোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলঃ ইয়া রাসূল! আমার মেয়ের স্বামী মরিয়া গিয়াছে। এখন তাহার চক্ষুদ্বয় রোগাক্রন্ত হইয়া পড়িয়াছে। এমতাবস্থায় আমরা কি তাহাকে সুর্মা ব্যবহার করাইব? জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেন, না। দুইবার কি তিনবার জিজ্ঞাসার প্রত্যেক বারের জওয়াবে তিনি না-ই বলিতে থাকিলেন। পরে বলিলেন,ইহাতো ইদ্দাতের চার মাস দশদিনের ব্যাপার মাত্র। অথচ জাহিলিয়াতের জামানায় তোমাদের এক-একজন বৎরের মাথায় গিয়া উষ্ট্রীর গোবর নিক্ষেপ করিতে।
(তিরমিযী, বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ যে স্ত্রীর স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে, সে কতদিনের ইদ্দাত পালন করিবে এবং ইদ্দাত কালে কি করিত পারিবে, কি পারিবে না, হাদীসটিতে সেই বিষয়ে কথা বলা হইয়াছে। হাদীসটির শেষাংশে ইসলাম পূর্ব কালে স্বামী মরা স্ত্রীরা কি করিত সে দিকে ইংগিত করা হইয়াছে।
বস্তুত স্বামীর মৃত্যু জনিত ইদ্দাত চার মাস দশ দিন। ইহা সুনির্দিষ্ঠ। এই মেয়াদ নির্দিষ্ট করার মূলে গর্ভে সন্তান সঞ্চার হওয়ার জন্য জরুরী সময়ের যৌক্তিকতা রহিয়াছে। মূলত ইদ্দাত পালনের একটি উদ্দেশ্য হইল, স্বামীল মৃত্যুতে শোক পালন। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, স্ত্রীর গর্ভে কোন সন্তান আছে কিনা তাহা দেখা। প্রজনন বিদ্যা পারদর্শীদের মতে মা’র গর্ভে সন্তান পুরাপুরি দানা বাঁধিয়া উঠিতে এবং উহাতে প্রাণের সঞ্চার হইতে অন্তত একশত বিশ দিন অর্থাৎ চারটি পূর্ণ মাস সময় প্রয়োজন। আর সতর্কতাবলম্বনের উদ্দেশ্যে আর মাত্র দশটি দিন অতিরিক্ত ধরা হইয়াছে। কেননা চন্দ্র মাস বেশী ক ম হইতে পারে বিধায় কখনও কম হইয়া গেলে এই অতিরিক্ত ধরা দশটি দিন দ্বারা সেই কমতি পূরণ করা হইবে। কুরআন মজীদে এই মেয়াদের ইদ্দাত কার মূলে নিহিত হইই কারণ। বলা বাহুল্য, চার মাস দশ দিনের সঙ্গে উহার রাত্র গুলিও অবশ্যই ইদ্দতের মধ্যে গণ্য করিতে হইবে। এই কারণে পরবর্তী স্বামী একাদশ রাত্রি অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে তাহার সহিত সঙ্গম করিতে পারিবে না।
(**********)
হাদীসটিতে যে সুর্মা লাগানো ব্যাপারটির উল্লেখ হইয়াছে উহার কারণ হইল স্বামী-মৃত্যুর কারণে স্ত্রীর শোক পালন। কিন্তু সুর্মা লাগানো বিশেষত মেয়েদের জন্য যেহেতু বিলাসিতা ও সাজ-শয্যার উদ্দেশ্যে প্রসাধন দ্রব্য ব্যবহারের মধ্যেও গণ্য হইতে পারে। এই কারণে উহা ইদ্দাত কালে ব্যবহার করা জায়েয কিনা, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়াছে। আর এই বিষয়ে শরীয়াতের ফয়সালা কি তাহাই এই হাদীসটির আলোচ্য
কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, জাহিলিয়াতের যুগে কোন স্ত্রীলোকের স্বামী মরিয়া গেলে সে একটি সংকীর্ণ ঘরে প্রবেশ করিত, নিকৃষ্ট ধরনের পোশাক পরিধান করিত। কোনরূপ সুগন্ধি ব্যবহার করাও তাহার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এতদ্ব্যতীত কোন রূপ প্রসাধন দ্রব্য বা অলংকারাদি ব্যবহার করারও তাহার জন্য অনুমতি ছিল না। এই ভাবে দীর্ঘ একটি বৎসর কাল অতিবাহিত হইয়া যাইত। পরিশেষে একটি বশেষ অনুষ্ঠান পালনের পরই সে কোনরূপ সুগন্ধী ব্যবহার করিতে পারিত। কিন্তু ইসলাম এই সব বদ রসম বাতিল করিয়া দিয়াছে।
ইসলামে স্বামী মরা স্ত্রীর জন্য মাত্র চার মাস দশ দিন ইদ্দাত পালনের মেয়াদ নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। রাসূলে করীম (স)-এর কথা হইর, জাহিলিয়াতের জামানার কষ্টকর ও দীর্ঘ মেয়াদী অপেক্ষার পরিবর্তে এখন মাত্র এই সময়টুকুও অপেক্ষা করা তোমাদের পক্ষে কষ্টকর বোধ হইতেছে, ইহা কেমন কথা! এই স্বল্প সময়টুকুর মধ্যে আবার তোমরা চোখের সামান্য কষ্টের জন্য ইসলামের সহজ নিয়মাদিও পালন করিতে প্রস্তুত হইতে চাহেনা। অথচ অপেক্ষার সময় কাল চারমাস দশ দিনের বেশী নয়। কাজেই এই সংক্ষিপ্ত মেয়াদের মধ্যে তোমরা চোখে সুর্মা লাগাইবা রকাজ করিবা না। স্বামী মরা যে স্ত্রী লোকটির চোখে সুর্মা লাগাইবার এই বর্ণনা,- ইবনে অহব তাঁহার ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হে বলিয়াছেন- তাহার নাম আতেকা বিনতে নয়ীম ইবনে আবদুল্লাহ।
(*******)
হযরত উম্মে আতীয়াতা (রা) বর্ণিত হাদীসে রাসূলে করীম (স) সুর্মা ব্যবহার করিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করিয়া বলিয়াছেনঃ ********* ‘তুমি সুর্মা ব্যবহার করিও না’। এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, স্বামী মরা স্ত্রীর পক্ষে ইদ্দাত কালে সুর্মা ব্যবহার করা হারাম। উহার প্রয়োজন দেখা দিক আর না-ই দিক, কোন অস্থায়ই সুর্মা ব্যবহার করা যাইবে না।
হযরত উম্মে সালমা বর্ণিত অপর এক হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর কথাটি এই ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
তুমি রাত্রি বেলা সুর্মা লাগাও, আর দিনের বেলা উহা মুছিয়া ফেল।
এই কথা হইতে ইদ্দাত কালে সুর্মা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ ও সার্বিক ভাবে হারাম প্রমাণিত হয় না। বরং রাত্রি বেলা উহা ব্যবহার করার সুস্পষ্ট অনুমতি ঘোষিত হইয়াছে। যদিও দিনের বেলা উহা মুছিয়া ফেরার নির্দেশও সঙ্গে সঙ্গেই রহিয়াছে। ফলে এই দুই ধরনের হাদীসে স্পষ্ট বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যাইতেছে।
উক্ত দুই প্রকারের কথার মাঝে সংগতি ও সামঞ্জস্য সৃষ্টির পর্যায়ে হাদীসবিদগণ বলিয়াছেন, স্বামী মরা স্ত্রীর ইদ্দাত পালন কালে যদি রোগের চিকিৎসার্থে সুর্মা ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহা হইলে এই শেষোক্ত হাদীস অনুযায়ী কেবলমাত্র রাত্রি বেলা তাহার ব্যবহার করা জায়েয হইবে, দিনের বেলায় নয়। আর প্রয়োজন ব্যতীত তাহা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারামই থাকিবে। আর প্রয়োজন বশত যদি কেহ রাত্রি বেলা উহা ব্যবহার করেও, তবুও দিনের বেলা উহা সম্পূর্ণ মুছিয়া ফেলা কর্তব্য হইবে। তবে প্রয়োজন দেখা দেওয়া সত্ত্বেও যদি উহার ব্যবহার না করিয়া পারে এবং উহার ব্যবহার করা হইতে বিরত থাকে, তবে তাহাই উত্তম।
এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী অনুমতি দেওয়ার হাদীসটি হইতে বুঝিতে হইবে যে, মূলত উহা ব্যবহার করার অনুমতি না থাকিলেও কেবল মাত্র প্রয়োজনের কারণে ব্যবহার করা হারাম হইবে না এবং তাহাও কেবলমাত্র রাত্রি বেলার জন্য। আর যে হাদীসে স্পষ্ট নিষেধ উদ্ধতৃ হইয়াছে, সে হাদীসটি সম্পর্কে মনে করিতে হইবে যে, ইহা কোনরূপ প্রয়োজন না হওয়া অবস্থার জন্য শরীয়াতের ফয়সালা। উপরন্তু যে হাদীসে চোখের অসুখ হওয়ার কথা বলা সত্বেও নিষেধ উদ্ধৃত হইয়াছে, মনে করিতে হইবে যে, এই নিষেধ তানজীহী মাত্র। অর্থাৎ কাজটি মূলত হারাম নয়; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও উহা করিতে নিষেধ করা হইয়াছে কেবলমাত্র স্বামীর মৃত্যুর কারণে স্ত্রীর শোক পালনের নিয়ম হিসাবে। অন্যান্য ফিকাহবিদদের মতে এই নিষেধ কেবলমাত্র সেই সুর্মা সম্পর্কে যাহা নিছক প্রসাধন দ্রব্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যাহা ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, এই নিষেধ সে সম্পর্কে নয়্
এই প্রেক্ষিতেই স্বামী-মৃত্যুর শোক পালন রত ও ইদ্দত পালনকারী স্ত্রীল পক্ষে সুর্মা বা কোন রূপ সুগন্ধী ব্যবহার পর্যায়ে ফিকাহবিদদের বিভিন্ন মত রহিয়াছে। সালেম ইবনে আবদুল্লাহ, সুলাইমান ইবনে ইয়ামার এবং ইমাম মালিক হইতে একটি বর্ণনানুযায়ী চোখের ব্যাপার বড় বকমের ক্ষতির আশংকা দেখা দিলে সুগন্ধীহীন সুর্মা ব্যবহার করা জায়েয। অনেক ফিকাহবিদ বলিয়াছেন, প্রয়োজন হইলে উহা ব্যবহার করা জায়েয- উহাতে সুগন্ধী থাকিলে দোষ হইবে না। কেবল শরীয়াতের আইনে প্রকৃত প্রয়োজন রক্ষার স্পষ্ট অনুমতি রহিয়াছে, তাহাতে হারাম জিনিস ব্যবহার করিতে হইলেও। ইমাম শাফেয়ীর মতে প্রয়োজন হইলে সুগন্ধীহীন সুর্মা ব্যবহার করা যাইবে কেবলমাত্র রাত্রি বেলা, দিনের বেলা নহে।
রাসূলে করীম (স)-এর কথাঃ ********** ইহা মাত্র চার মাস দশ দিনের ব্যাপার- ইহার বেশী নয়। ইহা হইতে প্রমাণিত হইল যে, জাহিলিয়াতের জামানার দীর্ঘ এক বৎসর কাল ইদ্দাত পালনের প্রচলনকে ইসলাম মনসুখ ও বাতিল করিয়া দিয়াছে। জাহিলিয়াতের জামানায় স্ত্রী লোকদের ইদ্দাত পালন ছিল অত্যন্ত কঠোরও কষ্টসাধ্য এক কৃচ্ছ সাধনার ব্যাপার। এই পর্যায়ে হযরত উম্মে সালমারই অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
জাহিলিয়াতের জামানায় কোন মেয়েলোকের স্বামী মরিয়া গেলে সে একটি ঝুপড়ি কিংবা তাঁবুতে প্রবেশ করিত, নিকৃষ্টতম কাপড় পরিধান করিত, কোনরূপ সুগন্ধি ব্যবহার করিতে পারিত না- কোন জিনিসই না, এই ভাবে দীর্ঘ একটি বৎসর অতিবাহিত হইয়া যাইত। পরে একটি গাধা বা ছাগল কিংবা একটি পাখী তাহার নিকট দেওয়া হইত। সে উহার উপর পানি ছিঁটাইত।
ইবনে কুতাইবা হিজাজ বাসীদের কথার আলোকে এই কথাটির ব্যাখ্যা দিয়াছেন এইভাবে যে, ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতের জামানায় ইদ্দাত পালনকারী স্ত্রী গোসল করিতে পারিত না, পানি ছুঁইতে পারিত না। নখ কাটিতে পারিত না। এই অবস্থায় একটি বৎসর কাল কাটাইয়া দেওয়ার পর অত্যন্ত বীভৎস চেহারা ও আকার-আকৃতি লইয়া তাঁবু হইতে বাহির হইত, পরে একটি পাখী বা ছাগী কিংবা কোন জন্তুর সাহায্যে ইদ্দাত ভঙ করিত। তাহা এই ভাবে যে, প্রথমে সেটি পানি দ্বারা গোসল করাইত, পরে সে নিজেও গোসল করিত। ইমাম মালিক বলিয়াছেন, পানি দ্বারা উহার পক্ষ ও পালক বা গাত্র মুছিয়া দিত। ইবনে অহাব বলিয়াছেন, স্ত্রী লোকটি নিজের সিক্ত হাত দ্বার উহার পিঠ মালিশ করিয়া দিত। অপর লোকদের জন্তু বা পাখীকে গোসল করাইবার পর সে নিজেও সেই পানি দ্বারা গোসল করিত। এবং পরে সে ভাল পানি দ্বারা গোসল করিয়া নিজের শরীরকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করিয়া লইত। ইহার পর সে ঘর হইতে বাহির হইত। তখন তাহার হাতে গোবর তুলিয়া দেওয়া হইত। সে উহা নিক্ষেপ করিত। এই রূপ ঘৃণ্য পন্হায় ইদ্দাত কাল অতিক্রম করাই ছিল জাহিলিয়াতের সময়ের সাধারণ প্রচলিত নিয়ম। অর্থাৎ ইসলাম পূর্ব কালে স্বামী মরা স্ত্রীর ইদ্দাত কাল ছিল পুর্ণ একটি বৎসর। ইসলাম তাহা বাতিল করিয়া মাত্র চার মাস দশ দিন ইদ্দাতের মেয়াদ নির্দিষ্ঠ করিয়া দিয়াছে।
স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর শোক
****************************************
হযরত উম্মে আতায়াতা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ ও পরকারের প্রতি ঈমানদার কোন স্ত্রীলোকের পক্ষে তিন দিনের বেশী কাল কাহারও জন্য শোক পালন করা হালাল নয়। তবে স্বামীর জন্য স্বতন্ত্র কথা। এই সময় সে সুর্মা লাগাইবে না, কোন রঙীন কাপড় পরিবে না, তবে মোটা সুতীর কাপড় (পরিবে)।
(বুখারী)
ব্যাখ্যাঃ নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে স্ত্রীলোককে শোক পালন করিতে হয়। আত্মীতার নিকটত্ব বিশেষ এই শোকের মেয়াদের মধ্যে তারতম্য হইয়া থাকে। হাদীসটিতে বলা হইয়াছে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার- অর্থাৎ মুসলমান স্ত্রীলোক পিতা-মাতা বা ভাই বোন কিংবা অন্য কোন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে যে শোক পালন করিবে, উহার মেয়াদ হইল মাত্র তিন দিন। তিন দিনের অধিক কাল কোন মৃত্যুর জন্য শোক পালন করা কোন মুসলমান স্ত্রীলোকের জন্যই জায়েয নয় তবে স্বামীল কথা স্বতন্ত্র। কেননা স্ত্রীলোকের পক্ষে তাহার স্বামীর তুলনায় অধিক নিকটাত্মীয় ও অতি আপনজন কেহ হইতে পারে না। এই কারণে স্বামীর জন্য শোক করার মেয়াদ মাত্র তিন দিন নয়। ইহা হইতে অনেক বেশী। আর তাহা হইল চার মাস দশ দিন। এই শোক কাল নির্ধারণের মূল্যে আরও একটি উদ্দেশ্যে নিহিত আছে।
এই শোক কালকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘ইদ্দাত’ ****। ‘ইদ্দাত’ শব্দের শাব্দিক ও অভিধানিক অর্থ ‘গণনা’ করা। এই দিনগুলি বিশেষ ভাবে গণিয়া গণিয়া শেষ করা হয়। এবং কবে যে তাহা শেষ হইবে সে জন্য উদগ্রীব হইয়া অপেক্ষা করা হয়। এই কারণেই ইহাকে ‘ইদ্দাত’ বলা হয়। মুহাদ্দিস কাহলানী সানয়ানী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
ইদ্দাত হইল সেই মেয়াদের নাম, যে কালে স্ত্রী তাহার স্বামী গ্রহণ হইতে বিরত থাকে ও প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকে। ইহা পালন করা হয় সন্তান প্রজনন দ্বারা কিংবা তুহর গণনা দ্বারা অথবা মাস গণনার দ্বারা।
আল্লামা বদরুদ্দনি আইনী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
শরীয়াতের দৃষ্টিতে ইদ্দাত হইল অপেক্ষা কাল- অর্থাৎ স্ত্রীলোকের বিবাহ শেষ হইয়া যাওয়ার পর যে সময়টা তাহাকে পুনর্বিবাহের জন্য অপেক্ষা করিয়া কাটাইতে হয় তাহারই নাম ইদ্দাত।
স্ত্রীকে এই ইদ্দাত বা অপেক্ষাকাল কিভাবে অতিবাহিত করিতে হইবে এবং তখন তাহার জীবন ধারা কি রূপ হইবে, তাহাই আলোচ্য হাদীসটির বক্তব্য। নবী করীম (স) বলিয়াছেন, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর এই অপেক্ষাকাল অত্যন্ত সাদাসিদা ভাবে কাটাইতে হইবে। এই সময় সে সুর্মা লাগাইতে পারিবে না। কোন রঙীন বা রেশমী চকচকে পোশাক পরিধান করিতে পারিবে না। এই সময় সে সুতার মোটা কাপড় পরিধান করিবে। হাদীসের পরিভাষায় বিধবা স্ত্রীর এইরূপ করাকে বলা হয় *****।
ইবনুল মুনযির বলিয়াছেন, শোকাতুরা স্ত্রীর পক্ষে রঙীন চকচকে কাপড় পরা জায়েয নয়। তবে কালো বর্ণের বা কালো রঙ করা কাপড় পরিতে পারিবে। হযরত ওরওয়া ইবনে জুবাইর, ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ী কালো রঙের কাপড় পরা জায়েয বলিয়াছেন। ইমাম জুহরী কালো রঙের কাপড় পরা মাকরূহ বলিয়াছেন। ওরওয়া বলিয়াছেন, লাল বর্ণের কাপড় পরিতে পারিবে না।
ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন, যে বর্ণে ও রঙেই চাকচিক্য বা সৌন্দর্য আছে, তাহা পরা যাইবে না, উহা মোটা কাপড়ই হউক, কিংবা পাতল। হালকা সাদা কাপড় পরাই বিধেয়। ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
স্বর্ণ ও রৌপ্যের বা মূল্যবান পাথরের-মণি-মুক্তার অলংকার এই সময় ব্যবহার করা হারাম।
উম্মে আতীয়াতার অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
এই পর্যায়ে নবী করীমের এই নিষেধবাণী বর্ণিত হইয়াছেঃ সে (বিধবা স্ত্রী) সুগন্ধী স্পর্শ করিতে পারিবে না। তবে হায়য হইত যখন পবিত্র হইয়া উঠিবে, ঠিক সেই শুরুতে পবিত্রতা লাভের প্রাথমিক সময় কুশত ও আজগার সুগন্ধী সামান্য মাত্রায় ব্যবহার করিতে পারিবে।
ইমাম নববী বলিয়াছেনঃ ইহা সুগন্ধীর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিবেনা, ব্যবহার করিবে হায়য জনিত দুর্গন্ধ দূল করার উদ্দেশ্যে।
আবূ হাতেম আর-রাযী বর্ণনাটি এই ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) স্ত্রীলোককে তিন দিনের অধিক কাহারও জন্য শোক কারিতে নিষেধ করিয়াছেন। তবে স্বামীর মৃত্যুতে সে শোক করিবে চার মাস দশ দিন। আর এই সময় সে রঙীন কাপড় করিবে না, পরিবে মোটা সুতীর কাপড়। সুর্মা লাগাইবে না এবং সুগন্ধি স্পর্শ করিবে না। নাসায়ীর বর্ণনায় অতিরিক্ত শব্দ হইতেছেঃ ***** মাথায় চিরুনী চালাইবে না। মাথা আচড়াইবে না।
(*************)
ইদ্দাতকালে স্ত্রীর বসবাস
****************************************
মালিক ইবনে সিনানের কন্যা ফুরাইয়া (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি জানাইয়াছেন যে, তিনি রাসূলে করীম (স) কে এই কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিলেন যে, তিনি বনু খুদরা বংশে অবস্থিত তাঁহার পারিবারবর্গের নিকট ফিরিয়া যাইবেন কিনা। কেননা তাঁহার স্বামী তাহার পালাইয়া যাওয়া ক্রীত দাসগণের সন্ধানে বাহির হইয়াছিল, তিনি যখন ‘তরাফূল কুদুম’ নামক স্থানে পৌঁছেন তখন উহারা তাঁহার নিকট আসিয়া তাঁহাকে হত্যা করিয়া ফেলিয়াছে। ফুরাইয়া বলেন, আমি রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি আমার পিতৃ বংশের লোকদের নিকট ফিরিয়া যাইব কিনা? কেননা আমার স্বামী আমার জন্য এমন কোন ঘরবাড়ী রাখিয়া যায় নাই (কিংবা আমাকে এমন গরে রাখিয়া যায় নাই) যাহার সে মালিক এবং খরচ পত্রেরও কোন ব্যবস্থা করিয়া যায় নাই। ফুরাইয়া বলেন, আমার এই কথা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ হ্যাঁ। ফুরাইয়অ বলিয়াছেন, অতঃপর আমি ফিরিয়া যাইতে লাগিলাম।
পরে আমি হুজরা কিংবা মসজিদের মধ্যে থাকিতেই রাসূলে করীম (স) আমাকে ডাকিলেন কিংবা আমাকে ডাকার জন্য আদেশ করেন, ফলে আমি ডাকিত হই। পরে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি কিসের কথা বলিলে? ফুরাইয়া বলেন, অতঃপর আমি আমার স্বামী সম্পর্কে ইতিপূর্বে যাহা বলিয়াছিলাম সেই সমস্ত কাহিনী আবার বলি। সবকিছু শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তোমার ঘরে অবস্থান কর যতক্ষণ না ইদ্দাতের মেয়াদ সম্পূর্ণ হয়। ফুরাইয়া বলিয়াছেন, অতঃপর আমি আমার থাকার ঘরে চার মাস দশদিন ইদ্দাত পালন করি। ফুরাইয়া বলেন, হযরত উসমান যখন খলীফা হলেন, তখন তিনি আমার নিকট লোক পাঠাইয়া আমাকে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাঁহাকে সব খবর জানাইয়া দেই। তখন তিনি পূর্ব সিদ্ধান্তই অনুসরণ করেন এবং উহারই ফয়সালা করিয়াছেন।
(মুয়াত্তা মালিক, তিরমিযী, আবূ দায়ূদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, দারেমী)
ব্যাখ্যাঃ এই দীর্ঘ হাদীসটিতে স্বামী মরিয়া যাওয়া এক স্ত্রীর ইদ্দাত পালন কালানী অবস্থান সমস্যার বিবরণ এবং রাসূলে করীম (স) কর্তৃক দেওয়া উহার সমাধান বিস্তারিত ভাবে বিবৃত হইয়াছে।
স্ত্রী লোকটির নাম ফুরাইয়া। তিনি একজন মহিলা সাহাবী ছিলেন। বনু খুদরা নামক এক প্রখ্যাত গোত্রের কন্যা এবং প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ সায়ীদ খুদরির ভগ্নি ছিলেন। তাহার সম্পর্কিত এই দীর্ঘ বিবরণ জয়নাব বিনতে কায়াব কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। ফুরাইয়ার স্বামীর নাম না মূল হাদীসে উল্লেখিত হইয়াছে, না হাদীসটির কোন ব্যাখ্যাকারী তাহা বলিয়াছেন। ফুরাইয়া তাঁহার স্বামীর নিহত হওয়ার কাহিনী নিজেই বলিয়াছেন। তাঁহার স্বামীর অনেকগুলি ক্রীতদাস ছিল। তাহারা পালাইয়া গিয়াছিল। স্বামী তাহাদের সন্ধানে ঘর হইতে বাহিরে চলিয়া গিয়াছিল। ঘুরিয়া ফিরিয়অ মদীনা শহর হইতে ছয় মাইল অবস্থিত ‘তরফুল কুদুম’ (অগ্রসর হইয়া আসার দিক) নামক স্থানে পৌঁছিয়াছিল, তখন সেই ক্রীতদাসগুলি তাহাকে হত্যাক করে। ইহাতে ফুরাইয়া বিধবা হইয়া যায়। অতঃপর তাঁহাকে স্বামীর ইদ্দাত চার মাস দশ দিন পর্যন্ত পুনর্বিবাহের অপেক্ষায় থাকিতে হইবে। কিন্তু এই সময় তিনি কোথায় অবস্থান করিবেন, তাহাই ছিল সমস্যা। তিনি তাঁহার এই সমস্যার কথা বলার ও ইহার সমাধান পাওয়ার উদ্দেশ্যেই নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন। তিনি তাঁহাকে তাঁহার স্বামীল নিহত হওয়ার কাহিনী বলার পর বলিলেন, তাঁহার স্বামীর নিজের মালিকানায় কোন ঘর নাই এবং খরচ পত্রেরও কোন ব্যবস্থা নাই, এমতাবস্থায় তিনি তাঁহার পিতৃবংশের লোকদের নিকট ফিরিয়া যাইবে কিনা তাহা জানিতে চাহিলেন। নবী করীম (স) প্রথমে তো বলিলেন হ্যাঁ! অর্থাৎ যাও। কিন্তু ফুরাইয়ার মসজিদে নববী হইতে বাহির হইয়া চলিয়া যাওয়ার পূর্বেই আবার তাঁহাকে ডাকিয়া তিনি বলিলেনঃ তুমি যে ঘরে এতকাল ধরিয়া অবস্থান করিতেছিলে, এখনও সেই ঘরেই থাক ও অবস্থান কর। যতক্ষণ না কুরআনের লিখিয়া দেওয়া ফরয করিয়া দেওয়া তোমার ইদ্দাত খতম হয়। হাদীসের ভাষা হইলঃ ********* ইহার শাব্দিক তরজমা হয়ঃ যতক্ষণ না ‘লেখা’ উহার মিয়াদ পর্যন্ত পৌঁছায়। ইহার অর্থ ইদ্দাত কাল শেষ হওয়া। ইদ্দাত কালকে ‘কিতাব’ বলা হইয়াছে, কেননা এই ইদ্দাত- অর্থাৎ স্বামী মরিয়া গেলে স্ত্রীর ইদ্দাত পালনের এই কথাটি আল্লাহর কিতাবে লিখিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং চার মাস দশ দিনের মেয়াদে ইদ্দাত পালন করা আল্লাহ তা’আলা ফরয করিয়া দিয়াছেন।
এই বিবরণ হইতে স্পষ্ট ভাবে জানা গেল, স্বামী মরিয়া গেল স্ত্রীকে মৃত্যু জনিত ইদ্দাত পালন করিতে হইবে। কিন্তু এই ইদ্দাতের কালে সে কোথায় অবস্থান করিবে এই সময়টা সে কোথায় থাকিয়া কাটাইবে, ইহা ফিকাহশাস্ত্রের একটা বিতর্কিত বিষয়। ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর লিখিয়াছেনঃ
****************************************
নবী করীম (স)-এর সাহাবীদের মধ্যে যাঁহারা বিশেষজ্ঞ তাঁহারা ও অন্যান্যরা এই হাদীস অনুযায়ী আমল করিয়াছেন। তাঁহারা ইদ্দাত পালনারী স্ত্রীর পক্ষে ইদ্দাত সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বামীর ঘর ছাড়িয়া যাওয়ার অনুকুলে মত প্রকাশ করেন নাই।
তিনি আরও লিখিয়াছেন যে, সুফিয়ান সওরী, ইমাম শাফেয়ী, আহমাদ ও ইসহাক প্রমুখ ফিকাহবিদগণও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। তবে অন্য কিছু সংখ্যক বিশেষজ্ঞ সাহাবীগণ ও কতিপয় ফিকাহবিদ এই মতও দিয়াছেন যে, স্বামী মরা স্ত্রীর যেখানে ইচ্ছা সেখানে থাকিয়াই ইদ্দাত পালন করিতে পারে। স্বামীর গরে থাকিয়া ইদ্দাত পালন না করিলেও কোন দোষ নাই। ইমাম তিরমিযীর কথা এই পর্যন্তই।
শরহহিস সুন্নাহ গ্রন্হে বলা হইয়াছে, স্বামী মরা স্ত্রীর ইদ্দাত পালন কালীন অবস্থান সম্পর্কে ফিকাহবিগণ বিভিন্ন মত দিয়াছেন। এই পর্যায়ে ইমাম শাফেয়ীর দুইট কথা বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু তাঁহার সহীহতম কথা হইল, স্বামী মরা স্ত্রীকে ইদ্দাত পালন কালে অবস্থানের জন্য স্থান দিতে হইবে। হযরত উমর হযর উসমান হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এবং ইমাম আবূ হানীফা প্রমুখ এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদর বক্তব্য হইল, উপরোদ্ধৃত হাদীসে নবী করীম (স) ফুরাইয়াকে প্রথমে বাপের বাড়ি চলিয়া যাওয়ার অনুমতি দিয়াছিলেন; কিন্তু পরে বলিয়াছেনঃ ********* ‘তুমি তোমার বর্তমান ও এ যাবত কালের অবস্থানের ঘরেই বসবাস কর’। ইহাতে এই শেষোক্ত কথাটি দ্বারা তাঁহার প্রথম কথাটি মনসুখ ও বাতিল হইয়া গিয়াছে। ইহার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেনঃ
****************************************
এই ঘটনায় একথার দলীল রহিয়াছে যে, শরীয়াতের দেওয়া কোন হুকুম অনুযায়ী আমল করার পূর্বেই উহাকে মনসুখ করা সম্পূর্ণ জায়েয।
এই বিষয়ে ইমাম শাফেয়ীর দ্বিতীয় কথা এই যে, স্বামী-মরা স্ত্রীকে ইদ্দাত কালে বসবাসের স্থান দেওয়া জরুরী নয়। সে যেখানে ইচ্ছা ইদ্দাত পালন করিতে পারে। হযরত আলী হযরত ইবনে আব্বাস হযরত আয়েশা (রা) এই মত দিয়াছেন। তাঁহাদের দলীল হইল, নবী করীম (স) ফুরাইয়াকে তাঁহার পিতৃ ঘরে ফিরিয়া যাওয়ার অনুমতি দিয়াছিলেন। এই অনুমতির অর্থ হ ইল, বসবাসের স্থান স্বামীর নিকট হইতে পাওয়ার তাহার অধিকার নাই। আর পরে যে তিনি ফুরাইয়াকে তাঁহার স্বামীর ঘরে থাকিয়া ইদ্দাত পালন শেষ করার নির্দেশ দিয়াছিলেন, এই নির্দেশ মুস্তাহাব পর্যায়ের। কিন্তু ইহা সহীহ কথা মনে হয় না।
হাদীসবিদ মুল্লা আলী আল কারী লিখিয়াছেন, স্বামী মরা স্ত্রীকে যে স্বামীর ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইত হইবে না, তাহাতো কুরআন মজীদেই বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। কুরআনের সে আয়াতটি এইঃ
****************************************
তোমাদের মধ্যে যাহারা মরিয়া যায় ও স্ত্রীদের রাখিয়া যায় তাহারা যেন তাহাদের স্ত্রীদের জন্য অছীয়াত করিয়া যায় এক বৎসর কালের জীবন-জীবিকা দেওয়ার, ঘর হইতে বাঞ্ছিত না করার অবস্থায়।
মুল্লা আলী আল কারী বলিয়াছেন, এই আয়াত হইতে প্রমাণিত হয় যে, স্বামী মরা স্ত্রীর তাহার স্বামীর ঘরে অবস্থান করিবে এবং সেখান হইত তাহাকে বহিষ্কৃত করা চলিবে না। পরে অবশ্য এক বৎসর কালের কথাটি মনসুখ হইয়া গিয়াছে এবং সেখানে চার মাস দশ দিন ইদ্দাত কাল নির্দিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু তাহাকে যে ঘর হইতে বাহির করা যাইবে না, এই কথাটি মনসুখ হয় নাই। ইহা অপরিবর্তিত রহিয়া গিয়াছে।
ইবনুল কাতান বলিয়াছেন, এই হাদীসিট সহীহ। ইবনে আবদুল বার বলিয়াছেন, ইহা এক প্রখ্যাত হাদীস। কাজেই ইহাকে অবশ্যই গণ্য ও গ্রহণ করিতে হইবে এবং এই অনুযায়ী আমলও করিতে হইবে। এই পর্যায়ে দারে কুতনীর একটি বর্ণনার কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। তাহাতে নবী করীম (স) স্বামী মরা এক স্ত্রীকে নির্দেশ দিয়াছিলেনঃ ************ সে যেখানে ইচ্ছা ইদ্দাত পালন করিতে পারে। দারে কুতনী বলিয়াছেন, এই হাদীসের সনদে আবূ মালিক নখয়ী যয়ীফ। ইবনুল কাতান বলিয়াছেন, ইহা অপর একজন বর্ণনাকারী মাহবুব ইবনে মুহরাজও যয়ীফ। আতা ইবনে আবদ সংমিশ্রণকারী আর আবূ বকর ইবনে মালিক সর্বাধিক যয়ীফ। ইমাম শওকানী লিখিয়াছেন, ফুরাইয়ার হাদীসটি হইতে প্রমাণিত হয় যে, যে ঘরে থাকা অবস্থায় স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনিতে পায়, তাহার সেই ঘরেই অবস্থান করা উচিত এবং উহা হইতে বাহির হইয়া অর্থাৎ সেই ঘর ত্যাগ করিয়া সে অন্যত্র চলিয়া যাইবে না।
(************)
তালাকের পর সন্তান পালন
****************************************
হযরত আদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ একটি স্ত্রী লোক নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইল। অতঃপর বলিলঃ হে রাসূল! এই পুত্রটি আমার সন্তান। আমার গর্ভই ছিল ইহার গর্ভাধার, আমার ক্রোড়ই ছিল ইহার আশ্রায়স্থল, আর আমার স্তনদ্বয়ই ছিল ইহার পানপাত্র। ইহার পিতা আমাকে তালাক দিয়াছে এবং সংকল্প করিয়াছে ইহাকে আমার নিকট হইতে কাড়িয়া নিবার। তখন রাসূলে করীম (স) তাহাকে বলিলেনঃ তুমি যতদিন বিবাহ না করিবে ততদিন ইহার লালন পালনের ব্যাপারে তোমার অধিকার সর্বাগ্রগণ্য।
(আবূ দায়ূদ, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ ইসলামে তালাকের ব্যবস্থা থাকায় তালাকের পর সন্তান পালনের ব্যাপারে পিতা ও মাতা-ইহাদের মধ্যে কাহার অধিকার অগ্রগণ্য, ইহা সবসময়ই একটি জটিল সমস্যা হইয়া দেখা দিয়াছে। কেননা সন্তান পিতা ও মাত উভয়ের। উভয়ই একত্রিত হইয়া সন্তান লালন পালন করিবে, যতক্ষণ তাঁহারা একত্রিত হইয়া স্বামী-স্ত্রী হিসাবে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন যাপন করিতে থাকিবে। কিন্তু স্বামী যদি স্ত্রীকে তালকা দেয়, আর তাহার ক্রোড়ে শিশু সন্তান থাকে, তাহা হইলে এই সন্তান লালন-পালনের ব্যাপারে একটা জটিলতা দেখা দেওয়া অবধারিত। কেননা তখন পিতা বলিতে পারে, আমি এই সন্তানের পিতা, আমিই ইহাকে লালন পালন করিব। কিন্তু সন্তানের জননীর মমতা আর্ত্মনাদ করিয়া উঠিতে পারে এই বলিয়া যে, আমিই তো ইহাকে গর্ভে ধারণ করিয়াছি, আমিই ইহাকে কোলে করিয়া টানিয়াছি এবং আমার বুকের দুধ খাইয়াই সে লালিত পালিত হইয়াছে। কাজেই ইহার পরবর্তি লালন-পালনের অধিককার আমার। উপরোদ্ধৃত হাদীসটিতে নবী করীম (স) কর্তৃক এই রূপ একটি জটিল ব্যাপারেই নির্ভূল মীমাংসা করিয়া দেওয়া বিবরণ বর্ণিত হইয়াছে। মহিলাটির ব্যাপারটি বিবৃত করিতেই নবী করীম (স) বলিয়া দিলেন যে, এই সন্তানটি লালন পালনের ব্যাপারে তোমার অধিকারই সর্বাগ্রগণ্য, পিতার নয়। মহিলাটি যে সব কাজের বিবরণ দিল তাহা একান্তভাবে তাহারই কাজ, এই ক্ষেত্রে পিতার কোন অংশ নাই। অতএব এইরূপ বিরোধ হইলে মা-ই সন্তান পালনের অধিকারী হইবে, পিতা নয়। তবে তালকা প্রাপ্ত মহিলার এই অধিকার থাকিবে যতদিন সে পুনরায় বিবাহ না করে, অন্য স্বামী গ্রহণ না করে। রাসূলে করীম (স) এই কথা স্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছেন।
ইমাম শাওকানী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
এই হাদীস প্রমাণ করিতেছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত বিবাহ না করিবে বা অন্য কোন প্রতিবন্ধক না দেখা দিবে মা-ই সন্তানের লালন পালনের ব্যাপারে পিতার অপেক্ষা উত্তম। এই মত সর্বজন সম্মত।
কিন্তু সে যদি অন্য স্বামী গ্রহণ করে, তাহা হইলে তখন তাহার এই অধিকার থাকিবে না। তখন পিতা-ই উহার লালন-পালনের অধিকারী হইবে। ইমাম খাত্তাবী লিখিয়াছেনঃ সন্তানটির মা যদি অন্যত্র বিবাহিতা হয় তখন সেই মায়ের মা (সন্তানটির নানী) বর্তমান থাকিলে তাহার স্থলে সে-ই এই অধিকার পাইবে। ইসলামী শরীয়াতের ইহাই বিধান। ইবনে শাইবা হযরত উমর (রা) সম্পর্কে বর্ণনা করিয়াছে, তিনি তাঁহার স্ত্রী জমীলা বিনতে আসেমকে তালাক দিলে তাঁহার পুত্র আসেমকে লইয়া দুই জনের মধ্যে মত বিরোধ হয়। তখন ব্যাপারটি খলীফা হযরত আবূ বকরের (রা) গোচরীভূত করা হয়। তখন খলীফা হযরত আবূ বকর (রা) ফয়সালা দিয়া বলিলেনঃ
****************************************
হে উমর, তুমি উহাকে ছাড়িয়া দাও। তোমার তুলনায় তোমার এই তালাক দেওয়া স্ত্রীর ক্রোড় ও সুগন্ধি তোমার সন্তানের জন্য অধিক উত্তম ও কল্যাণবহ যতদিন সে যুব বয়স পর্যন্ত না পৌঁছায়। যুবক হইয়া উঠিলে সে নিজেই বাছিয়া লইতে পারিবে সে কাহার সহিত থাকিবে।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত অপর একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
একটি স্ত্রীলোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল, তাহাকেক তাহার স্বামী তালাক দিয়াছিল, সে তাহার সন্তানকে লইয়া যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করিল। নবী করীম (স) বলিলেনঃ তোমরা স্বামী-স্ত্রীর দুইজন ‘কোরয়া’ (লটারী) কর। তখন পুরুষটি বলিলঃ আমার ও আমার পুত্রের মধ্যে কে অন্তরায় হইয়া দাঁড়াইতে পারে? তখন নবী করীম (স) পুত্রটিকে বলিলেনঃ তোমার পিতা ও মাতা দুই জনের মধ্যে যাহাকে ইচ্ছা তুমি গ্রহণকর। অতঃপর ছেলেটি তাহার মাকে গ্রহণ করিল এবং মা তাহার পুত্রকে লইয়া চলিয়া গেল।
ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটি সংক্ষিপ্তভাবে উদ্ধৃত করার পর লিখিয়াছেন, সন্তান লালন-পালন সম্পর্কে উহার মা ও বাবার মধ্যে ঝগড়ার সৃষ্টি হইলে তখন সন্তানকেই ইহাদের মধ্য হইতে একজনকে নিজের অভিভাবক রূপে বাছিয়া লইবার অধিকার ও সুযোগ দিতে হইবে। সে তাহার নিজের মত অনুযায়ী যে কাহাকেও মানিয়া লইতে পারে। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক বলিয়াছেনঃ
****************************************
সন্তান ছোট থাকা অবস্থায় মা-ই উহার লালন পালনের অধিকারী। কিন্তু সন্তান সাত বছর বয়সে পৌঁছিলে তাহাকে বাপ ও মা এই দুইজনের মধ্যে একজনকে গ্রহণের ইখতিয়ার দিতে হইবে। সে নিজের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তানুসারে দুইজনের যে কোন একজনের সঙ্গে যাইতে ও থাকিতে পারিবে। এই মতের অনুকূলে ফতোয়া হইয়াছে।
এই পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ গণের মত হইল, সন্তান যদি নিজস্ব ভাবে খাওয়া পরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করিতে সক্ষম হয়, তাহা হইলে তখন পিতা-ই তাহার লালন পালনের অধিকারী। সাত বছর বয়স ইহারই একটি অনুমান মাত্র। হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, পিতা ও মাতার মধ্যকার বিবাদ মিটাইবার জন্য ‘কোরয়া’ (To cast cots)র ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যাইতে পারে। তবে সন্তান সাত বৎসরের কম বয়সের হইলে মা-ই লালন পালনের অধিকার পাইবে এবং সাত বা উহার অধিক বয়সের হইলে সন্তানকেই তাহার অভিভাবক বাছাই করার সুযোগ দিতে হইবে। তখন সে নিজ ইচ্ছা মত যে কোন এক জনের সঙ্গে যাইতে পারিবে।
(******************)