বিবাহে কুফু
****************************************
(**********)
হযতর আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের নিকট এমন ব্যক্তি যখন বিবাহের প্রস্তাব দিবে, যাহার দ্বীনদারী ও চরিত্রকে তোমরা পছন্দ কর, তাহা হইলে তাহার নিকট মেয়ে বিবাহ দাও। তোমরা যদি ইহা না কর, তাহা হইলে পৃথিবীতে অশান্তি ও ব্যাপক বিপর্যয় সংঘটিত হইবে। (তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ বিবহের দুইট পক্ষ। একটি পক্ষে ছেলে- যে বিবাহ করিবে। আর অপর পক্ষে মেয়ে এবং তাহার নিকটাত্মীয়গণ। ছেলে বা মেয় পক্ষ যখন কাহারও ঘরে মেয়ে বিবাহ করার প্রস্তাব দেয়, তখন মেয়ে পক্ষের লোকদের কর্তব্য হইল ছেলেকে দেখিয়া বা তাহার সম্পর্কে খবরাখবর লইয়া বিবাহ সম্বন্ধ করা হইবে কিনা, সে বিষয়ে অনতিবিলম্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এই পর্যায়ে মেয়ের বা মেয়ে পক্ষের প্রধান বিচ্যে বিষয় হইল ছেলের দ্বীনদারী ও চরিত্র, আচার-আচরণ ও সভ্যতা-ভব্যতা। এই বিবেচনায় ছেলের দ্বীনদারী ও চরিত্র যদি তোমাদের পছন্দ হয়, তাহা হইলে তোমরা এই বিবাহে সম্মত হইবে ইহাই স্বাভাবিক। হাদীসের ঘোষণানুযায়ী মনে হয়, বিবাহের প্রথম প্রস্তাব ছেলে বা ছেলের পক্ষ হইতে হইবে এবং উহা গ্রহণ করা ও বিবাহে সম্মত হওয়ার দায়িত্ব মেয়ের- মেয়ে পক্ষের। (তবে এইরূপই যে হইতে হইবে, ইহার বিপরীত হইলে- মেয়ে পক্ষ হইতে প্রথম প্রস্তাব দিলে যে তাহা নাজায়েয হইয়া যাইবে, এমন কথা বলা যায় না)। এই ব্যাপারে মেয়ে পক্ষের বিচ্যে বিষয় ছেলের শুধু দ্বীনদারী ও চরিত্র। ইহা ছাড়া অন্য কিচু নয়। দ্বীনদারী ও চরিত্রের দিক দিয়া ছেয়ে যদি পছন্দ না হয়, তাহা হইলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি পছন্দ হয় তাহা হইলে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিবার কোন অধিকার তোমাদের নাই। দ্বীনদারী ও চরিত্রের দিক দিয়া ছেলে পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও যদি তোমরা বিবাহে সম্মত না হও, ছেলের শুধু উচ্চবংশ, রূপ-সৌন্দর্য ও ধন-ঐশ্বর্যতেই বেশী গুরুত্ব দাও, আর এই দিক দিয়া কোন দ্বীনদার চরিত্রবান ছেলেকে মেয়ের বর হিসাবে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত না হও, তাহা হইলে- হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী- দুই ধরনের বিপদ আসিতে পারে। একটি হইল, বহু মেয়ে অবিবাহিতা থাকিয়া যাইবে, স্বামী-সঙ্গ লাভ হইতে বঞ্চিতা থাকিবে এবং সেই সঙ্গে বহু সংখ্যক পরুষ স্ত্রীহীন থাকিতে বাধ্য হইবে। তাহারা স্ত্রী লাভ করিতে পারিবে না। কেননা দুনিয়ায় খুব বেশী লোক দেখিতে সুশ্রী, উচ্চ ও অভিজাত বংশ সম্ভ্রান্ত এবং ধন-ঐশ্বর্যের অধিকারী নয়- হয় না। আর এই উভয় কারণে সমাজের বিবাহ যোগ্য ছেলে ও মেয়ের বিবাহের মাধ্যমে যৌন-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার সুযোগ হইতে বঞ্চিত থাকিয়া অবৈধ পন্হা অবলম্বন করিতে এবং জ্বেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হইতে বাধ্য হইবে।
দ্বিতীয়, দ্বীনদারী ও চরিত্রের দিক দিয়া ছেলে উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাহার বিবাহ-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হইলে ছেলে নিজে বা তাহার অভিভাবক পক্ষ অপমানিত বোধ করিতে পারে আর ইহার পরিণামে মনোমালিন্য, তিক্ততা, ঝগড়া-বিবাহ ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হইতে পারে, হইতে পারে মারামারি ও রক্তপাত। আর ইহার পারিণামে বংশ নষ্ট, বংশের ধারা বিচ্ছিন্ন, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার পতন ও পবিত্র পরিশুদ্ধ পরিবেশের অনুপস্থিতি সংঘটিত হইতে পারে।
ইমাম মালিক বিবাহের উপযুক্ততার (কুফু) জন্য একমাত্র দ্বীনদারী ছাড়া অন্য কোন ভিত্তি স্বীকার করেন নাই। আর জহুর ফিকাহবিগণ এই পর্যায়ে চারটি জিনিসের উল্লেখ করিয়াছেন। তাহা হইল, দ্বীনদারী, স্বাধীন-মুক্ত হওয়া-ক্রীতদাস না হওয়া (বর্তমানে ইহা অবান্তর), বংশ ও পেশা। ফলে মুসলিম মেয়ে অমুসলিম পুরুষের নিকট বিবাহ দেওয়া চলিবে না। চরিত্রবতী দ্বীন পালনকারী মেয়ে ফাসিক, নীতি-আদর্শহীন, পাপীষ্ঠ ও চরিত্রহীন পুরুষের নিকট বিবাহ দেওয়া চলিবে না। স্বাধীন মুক্ত মেয়ে ক্রীতদাসের নিকট বিবাহ দেওয়া চলিবে না। অত্যন্ত হীন-নীচ বংশের পুরুষের নিকট বিবাহ দেওয়া চলিবে না উচ্ছ ভদ্র-অভিজাত বংশীয় মেয়ে। ব্যবসায়ীর মেয়ে কৃষিজীবী ছেলেকে বিবাহ করিলে রুচি ও আচার-আচরণ এবং সাংসারিক কাজ-কামের পার্থক্য, পারিবারিক নিয়ম-নীতি ও ধরণ-ধারণের পার্থক্যের কারণে বিশেষ অসুবিধা অমিল ও মানসিক অশান্তির সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এই কারণেই ইহা পছন্দ করা হয় নাই। কিন্তু যদি এই রূপ বিবাহ হইয়া, তবে বিবাহ যে ছহীহ হইবে তাহা নিঃসন্দেহ।
(************* )
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, তোমাদের নিকট এমন কেহ যখন (বিবাহের প্রস্তাব লইয়া আসিবে) যাহার দ্বীনদারী ও চরিত্র তোমরা পছন্দ কর ও ভাল মনে কর, তাহা হইলে তাহার সহিত মেয়ের বিবাহ দাও। তোমরা যদি ইহা না কর, তাহা হইলে দুনিয়ায় অশান্তি ও বিপর্যয় দেখা দিবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, যদি তাহার মধ্যে… হয়? … রাসূলে করীম বলিলেন, ‘তোমাদের নিকট পছন্দসই দ্বীনদারী ও ভাল চরিত্রের ভূষিত কেহ (বিবাহের প্রস্তাব লইয়া) আসে, তাহা হইলে তাহার নিকট (মেয়ে) বিবাহ দাও- এই কথাটি তিনবার বলিলেন।
হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী আবূ হাতিম আল মুজানী। তিনি রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবী ছিলেন এবং এই একটি মাত্র হাদীসই তাঁহার কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। ইহা হইতে মূল কথার উপর রাসূলে করীম (স)-এর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ বুঝা যাইতেছে এবং এই ধরনের ছেলে পাওয়ার পর তাহার উচ্চ বংশ-শরীফ খান্দান ও বিপুল ধন-সম্পদ আছে কিনা এসব প্রশ্ন করা ও উহার উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করা, উপরন্তু এসব দিক দিয়া তাহাকে ‘শূণ্য’ পাইলে তাহার নিকট মেয়ে বিবাহ না দেওয়াকে কিছুমাত্র পছন্দ করেন নাই।
এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত। তাহা এইঃ
****************************************
হযরত আলী (রা) কে লক্ষ্য করিয়া নবী করীম (স) নির্দেশ দিয়াছেন, তিনটি কাজ কখনই বিলম্বিত করিবে না। নামায পড়া যখন উহার সময় উপস্থিত হইবে, জানাজার নামায ও দাফন যখন উহা উপস্থিত হইবে এবং স্বামী নাই এমন পূর্ণ বয়স্কা মেয়ের জন্য উপযুক্ত সম্বন্দ পাইলে তাহাকে বিবাহ দিতে। (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ, মুসনাদে আহমদ, ইবনে হাব্বান) (**************)
ব্যাখ্যাঃ স্বামী নাই এমন পূর্ণ বয়স্কা মেয়ের জন্য যখন ‘কুফু’ পাওয়া যাইবে তখন তাহার বিবাহে বিলম্ব করা উচিত নয়। এই ‘কুফু’ অর্থ ইসলাম, সামাজিক মর্যাদা, চরিত্রগুণ ও ভাল উপার্জনের দিক দিয়া মেয়ের সহিত সামঞ্জস্যশীলতা ও উপযুক্ততা। যে সব দিক দেখিয়া-শুনিয়া মেয়ে বিবাহ দেওয়া হয়, এই গুলিই হইল সেই সব দিক। এই সব দিক দিয়া যোগ্য বর পাওয়া গেলে অন্য কোন কারণে বিবাহ বিলম্ব করা শরীয়াত পরিপন্হী কাজ।
(*****************)
উপরোদ্ধৃত হাদীসে কনে পক্ষের লোকদেরকে সম্বোধন করা হইয়াছে এবং বর-পক্ষের বিয়ের প্রস্তাব আসিলে কনে পক্ষের কি করা উচিত তাহা বলা হইয়াছে। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, স্বাভাবিক নিয়মে ‘বর’ এর পক্ষ থেকেই বিয়ের প্রতম প্রস্তাব আসা উচিত এবং ‘কনে’ পক্ষের তাহা বিবেচনা করিয়া দেখিয়া সিদ্ধান্ত করা। তাই বলিয়া মেয়ের দিক হইতে বিবাহের প্রস্তাব হওয়া নিষিদ্ধ হইবে এমন কথা নয়।
ইসলামে ছেলে-মেয়ের বিবাহের ‘কুফু’র প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করিয়াছে; কিন্তু এই পর্যায়ে বর্ণিত সব কয়টি হাদীস একত্রিত করিয়া পাঠ করিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, এই ‘কুফু’র ব্যাপারটি বংশ প্রভৃতির দিক দিয়া যতটা না বিবেচ্য, তাহার চাইতে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবেচ্য হইতেছে ছেলের চারিত্রিক গুণের দিক দিয়া। আল্লামা শাওকানী এই পর্যায়ের সব কয়টি হাদীস এক সঙ্গে উদ্ধৃত করার পর মন্তব্য করিয়াছেনঃ
****************************************
এই সব হাদীসে স্পষ্ট প্রমাণ রহিয়াছে এই বিষয়ে যে. দ্বীনদারী ও চরিত্রের দিকদিয়াই ‘কুফু’র বিবেচনা করিতে হইবে।
অর্থাৎ এই দুইটি দিকদিয়া ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকিলে তাহাদের পারস্পরিক বিবাহ হইতে কোনই বাধা হইতে পারে না।
ইমাম মালিক দৃঢ়তা সহকারে বলিয়াছেনঃ
****************************************
‘কুফু’র ব্যাপারটি কেবলমাত্র দ্বীনের দিক দিয়াই বিবেচ্য।
অর্থাৎ কনে যদি দ্বীনদার ও পবিত্র চরিত্রের হয় আর বর হয় বেদ্বীন-চরিত্রহীন কিংবা ইহার বিপরীত, তাহা হইলে অন্যান্য সব দিক দিয়া মিল হইলেও মে-মিল যেমন শরীয়াতের দিক দিয়া কাম্য নয়, তেমনি এই বিবাহ স্থতিশীল নাও হইতে পারে, হইলেও সে দাম্পত্য জীবন হইতে পারে তিক্ত ও বিষাক্ত।
হযরত উমর ইবনে মাসউদ (রা) ও মুহাম্মদ ইবনে সিরীন ও উমর ইবনে আবদুল আজীজ প্রমুখ হইতেও এই কথাই বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে। আর এই কথাই প্রমাণিত হয় কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াত হইতেঃ
****************************************
নিঃসন্দেহে তোমাদের মধ্যকার সেই লোক আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানার্হ যে লোক তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী।
ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেনঃ
****************************************
‘কুফু’র বাহিরে বিবাহ হওয়াটা হারাম নয়।
ইমাম শাওকানী আরও লিখিয়াছেনঃ
****************************************
বংশের দিক দিয়া ‘কুফু’র বিবেচনা করিত হইবে এমন কথার কোন হাদীসই সহীহ প্রমাণিত হয় নাই।
তবে এই পর্যায়ে মুহাদ্দিস বাজ্জার হযরত মুয়ায বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। হাদীসটি এইঃ
****************************************
আরব দেশের লোকেরা পরস্পরের জন্য কুফু এবং মুক্ত ক্রতদাসরা পরস্পরের কুফু।
এই হাদীসটিতে আঞ্চলিত ভাষা ভিত্তিক ও বংশীয় দিকদিয়া কুফু’র বিবেচনা করার কথা বলা হইয়াছে। ইহা হইতে মনে হয়, আরব-অনারবের পারস্পরিক বিবাহ বুঝি জায়েয নয় এবং মুক্ত ক্রীতদাস বুঝি স্বাধীন বংশের মেয়ে বিবাহ করিতে পারে না। ইহাতে বংশের দিকদিয়া আশরাফ-আতরাফের মধ্যে পার্থক্য করার বৈধতা প্রমাণিত হয়। কিন্তু হাদীসটি সহীহ নয়। ইহার সনদ দুর্বল। অতএব উক্ত ধারণা ঠিক নয়।
ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
দ্বীনের দিকদিয়া কুফু’র বিচার ও বিবেচনাই সর্বসম্মত। অতএব কোন মুসরিম মহিলার কোন কাফের ব্যক্তির সহিত (অথবা ইহার বিপরীত) বিবাহ হালাল ও জায়েয হইতে পারে না।
ইমাম খাত্তাবী লিখিয়াছেনঃ অধিকাংশ মনীষীর মতে কুফু’র বিবেচনা কেবলমাত্র চারটি দিক দিয়া হইতে পারে। তাহা হইলঃ
দ্বীন ও দ্বীনদারী, স্বাধীনতা (ক্রীতদাস না হওয়া), বংশ ও শিল্প ব্যবসায়- তথা পেশা বা উপার্জন উপায়।
বস্তুত স্বামী-স্ত্রীতে গভীর মিল-মিশ ও সুখময় দাম্পত্য জীবন লাভই কুফু’র ক্ষেত্রে একমাত্র লক্ষ্য অন্য কিছু নয়।
(********************)
মেয়ের বিবাহে অভিভাবকত্ব
****************************************
হযরত আবূ মূসা আনসারী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন, অভিভাবক ছাড়া বিবাহ নাই। (তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ ‘অভিভাবক ছাড়া বিবাহ নাই’ এই মর্মে বহু কয়জন সাহাবী হইতে বহু সংখ্যক হাদীস হাদীসের গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছে। এই পর্যায়ে হযরত আয়েশা বর্ণিত হাদীস আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে খুজাইমা, ইবনে হাবান ও হাকেম কর্তৃক উদ্ধত হইয়াছে। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীস তাবারানী ও জামে’ সুফিয়ানে উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত হুরায়রা বর্ণিত হাদীস ইবনে মাজাহ, দারে কুতনী ও বায়হাকী গ্রন্হে উর্দ্ধথ হইয়াছে। হযরত হুরাইরা বর্ণিত হাদীস ইবনে মাজাহ, দারে কুতনী ও বায়হাকী গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছেঠ। হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণিত হাদীস মুসনাদে আহমদ, দারে কুতনী, তাবারানী, বায়হাকী, মুসনাদে শাফেয়ী গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত আনাস বর্ণিত হাদীস ইবনে আদী, নাসায়ী কর্তৃক উদ্ধৃত হইয়াছে । ইহা হইতে বুঝিতে পারা যায়, আলোচ্য হাদীসটির বর্ণনা ও উদ্ধৃতি অত্যন্ত ব্যাপক।
তিরমিযী আবূ দায়ূদ- এ হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হাদীসটি এইঃ
****************************************
যে মেয়েই তাহার অভিভাবক ব্যতীতই বিবাহিত হইবে, তাহার বিবাহ বাতিল, তাহার বিবাহ বাতিল, তাহার বিবাহ বাতিল।
কিন্তু ইহা তিরমিযীর ভাষা। আর আবূ দায়ূদের ভাষায় হাদীসটি এইঃ
****************************************
যে মেয়ই তাহার মুরব্বীর অনুমতি ব্যতীত বিবাহ করিবে, তাহার বিবাহ বাতিল- ইহা তিনবার।
আর হযরত আব্বাস বর্ণিত হাদীসের ভাষা এইরূপঃ
****************************************
অভিভাবক-মুরব্বী ব্যতিরেকে কোন বিবাহ নাই। আর যাহার অভিভাবক-মুরব্বী নাই, রাষ্ট্র সরকারই তাহার অভিভাবক ও মুরব্বী।
মেয়ের অভিভাবক ছাড়া মেয়ের বিবাহ হইতে পারে না এবং যে মেয়েই তাহার অভিভাবক ছাড়া বিবাহিতা হইবে বা বিবাহ করিবে; তাহার সে বিবাহই বাতিল হইয়া যাইবে। এই প্রসঙ্গের সমস্ত হাদীসের মূল বক্তব্য ইহাই। ফিকাহবিদগণ এই হাদীসের ভিত্তিতে এ সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। সাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী, উমর ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর ও আবূ হুরাইরা, আয়েশা (রা) এবং হাসান বছরী ও ইবনুল মাসাইয়্যিব প্রমুখ তাবেয়ীগণ এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। ইবনুল মুনযির তো দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ
****************************************
কোন একজন সাহাবী হইতেও ইহার বিপরীত মত জানা যায় নাই।
ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন ************** অভিভাবক-মুরব্বী ব্যতিরেকে বিবাহের মূল আকদ- ঈজাব-কবুলই সহীহ হয় না। তিনি বরং এ পর্যায়ের অন্যান্য হাদীসের ভিত্তিতে এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন। তাহার একটি দলীল হইল এই হাদীসঃ
****************************************
পূর্বে স্বামী প্রাপ্তা- অন্য বর্ণনানুযায়ী- বর্তমানে স্বামীহারা মেয়ে তাহার নিজের বিবাহের ব্যাপারে তাহার অভিভাবক অপেক্ষা অধিক অধিকার সম্পন্ন।
মুল্লা আলী আল-কারী লিখিয়াছেন, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল বলিয়াছেনঃ
****************************************
মেয়েদের কথা ও উদ্যোগেই বিবাহ মূলতই সংঘটিত হয় না- সে নিজেরই হউক কি অন্য কাহারও প্রতিনিধি হইয়া হউক।
ইমাম আবূ ইউসূফ ও ইমাম মুহাম্মদ বলিয়াছেনঃ
‘কুফু’ ছাড়া বিবাহ করার ব্যাপারেই শুধু অভিভাবকের মতামত দেওয়ার ইখতিয়ার রহিয়াছে। আর কুফু’তে বিবাহ হইলে তাহাতেও অভিভাবকের অনুমতির প্রয়োজন রহিয়াছে।
ইমাম মালিক এর মত উদ্ধৃত হইয়াছেঃ উচ্চতর মানের ছেলের সহিত নিম্ন বংশের মেয়ের বিবাহ দিতে হইলে অভিভাবকের অনুমতির প্রয়োজন হইবে। পক্ষান্তরে নিম্ন মানের ছেলের সহিত নিম্ন বংশের বোঝা বিবাহে ইহার প্রয়োজন হইবে না।
অবশ্য এই সব কয়টি মতেরই বিপরীত মতও প্রকাশ করা হইয়াছে। আবূ সওর বলিয়াছেনঃ অভিভাবকের অনুমতি লইয়া মেয়ে নিজেই নিজের বিবাহের ব্যবস্থা করিলে তাহা জায়েয হইবে।
মওলানা খলীল আহমাদ লিখিয়াছেন, কেবলমাত্র অল্প বয়স্কা নাবালেগা ও পাগল মেয়ের বিবাহ অভিভাবক ছাড়া হয় না। ইমাম সয়ূতী লিখিয়াছেন, উপরোল্লিখিত হাদীসটি হইতে জমহুর ফিকাহবিদগণ এইমত গ্রহণ করিয়াছেন যে, অভিভাবক ছাড়া বিবাহ আদতেই সহীহ হয় না।
(*********************)
আর ইমাম আবূ হানীফা (র) অভিভাবক ছাড়া বিবাহ অসম্পূর্ণ হয় বলিয়া মনে করিয়াছেন। ইমাম মালিক বলিয়াছেনঃ মেয়েটি যদি চরিত্রহীনা হয়, আর সে নিজেই নিজের বিবাহ সম্পন্ন করে; কিংবা নিজেই অন্য কাহকেও দায়িত্ব দেয় তাহাকে বিবাহ দেওয়ার জন্য, তবে তাহার বিবাহ বৈধ হইতে পারে; কিন্তু যে মেয়ে ভদ্র সচ্চরিত্রবতী তাহার জন্য অভিভাবক অপরিহার্য।
ইবনুল হুম্মাম উল্লেখ করিয়াছেন, মেয়েদের বিবাহ অভিভাবকের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন পর্যায়ে হাদীস ও ফিকাহবিদদের সাতটি মত উদ্ধৃত হইয়াছ, ইমাম আবূ হানীফার দুইটি মতের একটি এই যে, পূর্ণবয়স্কা ও সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ের পক্ষে নিজের ও অন্য মেয়ের বিবাহ পরিচালনা করা মোটামুটিভাবে জায়েয। তবে উহা নিশ্চয়ই পছন্দনীয় এবং বাঞ্ছিত নয়ঙ আর দ্বিতীয় মতটি এই যে, কোন মেয়ে যদি তাহার জন্য ‘উপযুক্ত’ ও মানানসই (*******) কোন বিবাহই করিয়া বসে তবে তাহা জায়েয হইবে। আর যদি ইহার বিপরীত হয়, তবে তাহা জায়েয হইবে না।
এই সব হাদীস বাহ্যত মুসলিম ও মুয়াত্তা মালিক উদ্ধৃত এই হাদীসটির বিপরীতঃ ************** ‘স্বামীহীনা মেয়ে তাহার নিজের বিবাহের ব্যাপারে তাহার অভিভাবক-মুরব্বী অপেক্ষা অধিক অধিকার সম্পন্না। কিন্তু প্রকৃতভাবে ইহা উহার সহিত সাংঘর্ষিক নয়। কেননা শেষোক্ত হাদীস মেয়ের অভিভাবকের অধিকারকে সম্পূর্ণ কাড়িয়া বা হরণ করিয়া লওয়া নাই। বরং উহাতে অভিভাবকেরও কিছু না কিছু অধিকার আছে একথা বলিষ্ঠ ভাবেই বুঝাইতেছে- যদিও তাহাতে পূর্ণ বয়স্কা মেয়ের অধিকারকে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেওয়া হইয়াছে। এই হাদীস অনুযায়ীও মেয়ের অনুমতি ও সন্তোষ জানিতে পারার পর সমস্ত বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন ব্যবস্থা করার ব্যাপারে অভিভাবকের অধিকার অনস্বীকার্য। এই দিক দিয়া ‘অভিভাবক ছাড়া বিবাহ নাই’ হাদীসটির তাৎপর্য ও ব্যবহারিকতা স্পষ্ট হইয়া উঠে এবং ইমাম আবূ হানীফার মত- অভিভাবক ছাড়া মেয়ের বিবাহ সম্পূর্ণ হয় না- এই কথার যৌক্তিকতা প্রতিভাত হয়। উপরন্তু এই দই ধরনের হাদীসের মধ্যে তেমন কোন বৈপরীত্যও প্রকট হইয়া উঠিতে পারে না।
এতদ্ব্যতীত এই কথাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, ‘অভীভাবক ছাড়া বিবাহ নাই’ অর্থের হাদীস সমূহের সনদ দুর্বল- যয়ীফ, মুজতারিব ( কথার অসামাঞ্জস্যতা ও সনদের আউল-ঝাউল) খুব বেশী। কাহারও মতে ইহার সনদ নবী করীম (স) পর্যন্ত ‘মুত্তালিক’, তাহারও মতে মুত্তাসিল নয়- মুনকাতা, ছিন্ন-ভিন্ন। আবার কেহ কেহ বলিয়াছেন, মুরসাল- পরবর্তী বর্ণনাকারী তাহার পূর্বের বর্ণনাকারীর উল্লেখ না করিয়া তাহার উপরের বর্ণনাকারীর নামে বর্ণনা করা হাদীস। হযরত আয়েশা হইতে বর্ণিত হাদীসটির সত্যতা ও যথার্থতা অস্বীকার করিয়াছেন। ইমাম তাহাভী লিখিয়াছেন, ইবনে জুরাইন ইবনে হিশাব জুহরীর নিকট এই হাদীসটি পেশ করিলে তিনি ইহা বর্ণনা করিয়াছেন তাহা মানিয়অ লইতেও অস্বীকার করিলেন।
হাফেয ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেন, বিবাহ অভিভাবকের শর্ত সম্পর্কে আলেমগণের মতভেদ রহিয়াছে। জমহুর ফিকাহবিদ এই শর্তের যথার্থতা মানিয়া লইয়াছেন এবং বলিয়াছেনঃ *************** ‘কোন মেয়েই নিজেকে বিবাহ দিবে না- একেবারেই না’। ‘অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হয় না’। এই পর্যায়েল হাদীস সমূহকেই তাঁহারা দলীল বানাইয়াছেন। সেই সঙ্গে কুরআনের একটি আয়াতকেও তাঁহারা দলীলরূপে পেশ করিয়াছেন। হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার (রা) বলিয়াছেনঃ আমার বোনকে আমি এক ব্যক্তির নিকট বিবাহ দিলাম। পরে সে তাহাকে (বাঈন নয় (রা) এমন) তালাক দেয়। অতঃপর তাহার ইদ্দত শেষ হইয়া গেলে সেই লোকটিই আবার তাহাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেয়। আমি লোকটিকে বলিলামঃ আমার বোন তোমার নিকট কখনও ফিরিয়া যাইবে না। কিন্তু বোনটি তাহার নিকটই ফিরিয়া যাইতে ইচ্ছুক ছিল। তখন এই প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের এই আয়াতটি পেশ করা হয়ঃ
****************************************
তোমরা মেয়েদিগকে তাহাদের স্বামীর সহিত নূতন বিবাহ করা হইতে বিরত রাখিতে চেষ্টা করিও না- যদি তাহারা ভালভাবে ও প্রচলিত নিয়মে পারস্পরিক পুনঃবিবাহে সম্মত হয়।
ইহারা এই আয়াতটিকে ভিত্তি করিয়া বলিয়াছেন, যেহেতু বিবাহের অভিভাবকের কর্তৃত্ব রহিয়াছে, সেই কর্তৃত্ব চালাইয়া মেয়েদিগকে তাহাদের আগের স্বামীকে পুনরায় গ্রহণ করিতে এ আয়াতে নিষেধ করা হইয়াছে। যদি অভীভাবকের কোনই কর্তৃত্ব না থাকিত এবং মেয়েরা নিজেদের ইচ্ছাতেই বিবাহ করিতে পারিত, তাহা হইলে এই আয়াতের কোন তাৎপর্য থাকে না। কেননা যাহার আদৌ কর্তৃত্ব নাই, তাহাদের নিষেধ কে শুনে!
কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা এই মত সমর্থন করেন নাই। তিনি বলিয়াছেন, বিবাহে অভিভাবকের অনুমতির কোনই শর্ত নাই এবং বয়স্কা মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের বিবাহ সম্পন্ন করিবার পূর্ণ অধিকারী। যদি কোন মেয়ে উপযুক্ত ও মানান সই বিবাহ করে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীতও, তবুও তাহা জায়েয হইবে।
বলা হয়, তিনি প্রধানতঃ ক্রয়-বিক্রয়ে মেয়ের স্বাধীন অধিকারের উপর কিয়াস করিয়াই বিবাহের ক্ষেত্রে ও এই স্বাধীন অধিকারের পক্ষে এই মত রচনা করিয়াছেন। আর অভিভাবকের শর্তের হাদীস সমূহ সম্পর্কে বলিয়াছেন, ইহা কেবল অল্প বয়স্কা মেয়েরদের ব্যাপারেই প্রযোজ্য, বড়দের ও একবার স্বামী প্রাপ্তাদের ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু এই কথা ঠিক নয়। ইহা ইমাম আবূ হানীফার উপর মিথ্যা দোষারোপ মাত্র।
বস্তুত ইমাম আবূ হানীফা (র) কেবলমাত্র কিয়াসের উপর নির্ভর করিয়া এই ব্যাপারে একবড় মত দিয়অছেন, এই কথা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আসলে ইমাম আবূ হানীফার মতটি সাধারণ বিকে বুদ্ধি প্রসূত। উপরন্তু তিনি কুরআনের আয়াত ও প্রমাণিত হাদীসের ভিত্তিতেই এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। প্রথমত কুরআনের আয়াতঃ
****************************************
কোন মু’মিন স্ত্রীলোক যদি নিজেকে নবীর জন্য উৎসর্গ করে…. নবী যদি তাহাকে বিবাহ করিতে চাহেন….।
এই আয়াত হইতে একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, একটি পূণৃ বয়স্কা মেয়ের তাহার মনোনিত পুরুষের নিকট নিজের বিবাহের প্রস্তাব নিজ থেকেই পেশ করার অধিকার আছে এবং পুরুষটি সে প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া লইলে বিবাহও হইয়া যাইতে পারে। ইহাতে অভিভাবকের মত-অমত বা মঞ্জুরী-না মঞ্জুরীর কোন শর্ত করা হয় নাই।
কুরআনে দ্বিতীয় আয়াত হইলঃ
****************************************
স্বামী যদি স্ত্রীকে (তিন) তালাক দিয়া দেয়, তাহা হইলে অতঃপর সে এই (তালাকদাতা) স্বামীর জন্য হালাল হইবে না যতক্ষণ না সে তাহাকে ছাড়া অন্য কোন স্বামী গ্রহন করিবে।
এই আয়াত সম্পর্কে প্রথম কথা হইল, ইহাতে বিবাহ করা বা স্বামী গ্রহণ করার কাজটি স্ত্রীলোকের বলা হইয়াছে, কোন অভিভাবকের কাজ বলা হয় নাই। কাজেই বয়স্কা মেয়ের নিজের ইচ্ছানুক্রমে বিবাহ সংগত হইবেনা কেন? আর দ্বিতীয় কথা হইল, আয়াতটিতে মেয়ে লোকের বিবাহকে হারাম হওয়ার চরম লক্ষ্য বলা হইয়াছে। অতএব তাহার নিজের বিবাহেই সে হারাম হওয়ার অবসানও হইতে হইবে। এতদ্ব্যতীত ************ ‘তাহাদের (স্ত্রী ও পুরুষ) দুইজনই যদি পরস্পরের নিকট প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে তাহাতে কোন দোষ হইবে না’। ইহাতেও বিবাহ ও পুনবিবাহের সমস্ত কাজ স্ত্রী ও পুরুষের বলা হইয়াছে। এই মূল ব্যাপারে অভিভাবকের কিছু করার আছে একথা বলা হয় নাই। অতএব মেয়েদের নিজেদের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তক্রমেই বিবাহ হইতে পারে। তাহাতে অভিভাবকের অনুমতির কোন শর্ত নাই। দ্বিতীয়তঃ উপরোক্ত আয়াতে মেয়েদের নিজেদের অনুমতিক্রমে স্বামী গ্রহণ হইতে বিরত রাখার চেষ্টা করিতে অভিভাবককে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হইয়াছে। আর অভিভাবককে এইরূপ নিষেধ করায় স্বতঃহ প্রমাণিত হয় যে, মেয়েদের এই কাজ করার স্বাধীন অধিকার রহিয়াছে।
অতঃপর হাদীসের দলীল হইল, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ ******************** ‘পূর্ণ বয়স্কা কুমারী অকুমারী মেয়ের বিবাহের ব্যাপারে অভিভাবকের কোনই কর্তৃত্ব নাই’।
এই হাদীস অভিভাবকের কর্তৃত্ব হরণ করিয়াছে।
দ্বিতীয় হাদীসঃ
****************************************
স্বামীহীনা পূর্ণ বয়স্কা মেয়ে তাহার নিজের বিবাহের ব্যাপারে তাহার অভিভাবক অপেক্ষা অধিক অধিকার সম্পন্না।
অর্থাৎ কোন মেয়ে যখন পূর্ণ বয়স্কতা লাভ করে এবং তাহার বুদ্ধি-বিবেচনা শক্তি সুস্থ বিকশিত হয়, তখন তাহার বিবাহের অভিভাবকত্ব সে নিজেই অধিকার করিয়া বসে। তখন তাহার বিবাহের চূড়ান্ত মঞ্জুরী দানের কর্তৃত্ব অন্য কাহারও হাতে থাকে না, এই দিক দিয়া কেহ তাহার অভিভাবক হয় না। ইহা কেবর মহিলাদের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, এইরূপ কর্তৃত্বের অধিকারই লাভ করিয়া থাকে একটা বালকও যখন সে পূর্ণ বয়স্কতা লাভ করে।
মোট কথা, পিতা তাহার অল্পবয়স্কা ও নাবালিকা মেয়ের অভিভাবক হয় মেয়ের প্রতিনিধি হিসাবে মাত্র এবং তাহার ততদিন যতদিন সে মেয়ে পূর্ণ বয়স্কা হয় না। ইহাই শরীয়াতের সিদ্ধান্ত। কেননা বিবাহ একটি সামাজিক বৈষয়িক ও দ্বীনী কল্যাণ মূলক কর্মতৎপরতা। ইহার প্রয়োজন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় দিকদিয়াই অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বাল্য বয়সে এই কাজে মেয়ে অক্ষম থাকে বলিয়াই পিতার অভিভাবকত্বের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পূর্ণবয়স্কতা লাভ হইলে এই কাজে মেয়ে অক্ষমতা দূর হইয়া যায় এবং নিজের বিবাহের ব্যাপারে ভাল-মন্দ নিজেই বিবেচনা করিতে পারে বলিয়া সমস্ত ইখতিয়ার তাহার একার হইয়া যায়। তখন তাহার উপর অন্য কাহারও অভিভাবকত্বের কর্তৃত্ব চালাবার সুযোগ থাকে না।
কুরআন মজীদের আয়াতঃ
****************************************
তোমরা তোমাদের স্বামীহীনা মেয়েদিগকে বিবাহ দাও।
এই কথাটি অভিভাবকদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলা হইয়াছে, একথা ঠিক। কিন্তু এই কথা বলিয়া এ কথা বুঝানো হয় নাই যে, অভিভাবকরা বিবাহ দিলেই বিবাহ জায়েয ও শুদ্ধ হইবে, নতুবা নয়। সমাজের সাধারণ অবস্থা ও প্রচলন প্রথার দিকে লক্ষ্য রাখিয়াই এই কথাটি বলা হইয়াছে। কেননা বিবাহ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ- খবরাখবর লওয়া, উপযুক্ত বর সন্ধান, কথাবার্তা ঠিক করা, বিবাহের উদ্যোগ আয়োজন করা প্রভৃতি মেয়েরা নিজেরা কখনও করে না। কারণ, এই জন্য বাহিরে দৌড়া-দৌড়ি, যাতায়াত ও পুরুষদের সঙ্গে অনেক যোগাযোগ করার প্রয়োজন হয়। মেয়ের মঞ্জুরী লইয়া পুরুষরাই এই সব কাজ করিবে ইহাই নিয়ম।
এই প্রেক্ষিতে রাসূলে করীম (স)- এর বাণী ****************** ‘মেয়েদিগকে কেবল অভিভাবকরাই বিবাহ দিবে কথাটিও বুঝিতে হইবে। ইহাতে সেই সাধারণ নিয়ম ও প্রচলেন কথাই ধ্বনিত হইয়াছে। ইহার অর্থ কক্ষণই ইহা নয় যে, মেয়েদের বিবাহের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বুঝি অভিভাবকদের হাতে। নবী করীম (স)- এর বাণী **************** ‘অভিভাবক ছাড়া বিবাহ নাই’ কথাটিও পুরাপুরিভাবে এই পর্যায়ের ও এই ধরনের। সেই সঙ্গে স্মরণীয়, মুহাদ্দিস সনদ বিশারদগণ বলিয়াছেনঃ তিনটি হাদীস রাসূলে করীম (স) হইতে প্রমাণিত নয়। তন্মধ্যে ইহাও একটি। এ কারণেই বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হে এই হাদীসটি স্থান পায় নাই। আর হযরত আয়েশা বর্ণিত হাদীসটির একজন বর্ণনাকারী জহুরী ইহাকে অস্বীকার করিয়াছেন যেমন, তেমন হযরত আয়েশার নিজের আমল ছিল ইহার বিপরীত। অভিভাবক ছাড়াও মেয়ের বিবাহ হয় এবং তাহা বৈধ, ইহাই ছিল তাঁহার ফিকহী মত। কাজেই হাদীসের মূল বর্ণনাকারীর নিজের আমলের (কাজ) বিপরীত মত জ্ঞাপক এই হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও ভুলিলে চলিবে না যে, অভিভাবকদের এড়াইয়া ডিঙাইয়া ও তাহাদিগকে সঙ্গে না লইয়া কেবল মাত্র নিজের ইচ্ছা ও একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে বিবাহ করাও কোন শরীফ-শালীন চরিত্রবান মেয়ের কাজ হইতে পারে না।
বিবাহের ঘোষণা দেওয়া
****************************************
হযরত রুবাই বিনতে মুয়াওয়ায ইবনে আফরা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) আসিলেন এবং আমার ফুল শয্যার রাত্রে ঘরে প্রবেশ করিলেন। অতঃপর আমার শয্যার উপর বসিলেন যেমন তুমি আমার নিকট হইতে দূরত্ব রক্ষা করিয়া বসিয়াছ। তখন আমাদের কতকগুলি মেয়ে দফ বাজাইতে শুরু করিল এবং বদর যুদ্ধে আমার পিতৃবংশের যেসব লোক শহীদ হইয়াছিলেন তাঁহাদের জীবন ও কীর্তি সৌন্দর্যের উল্লেখ পূর্ণ গৌবরগীতি গাহিতে লাগিল। সহসা একটি মেয়ে বলিয়া উঠিলঃ আমাদের মধ্যে আছেন এমন নবী যিনি ভবিষ্যতের কথা জানেন। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তোমরা এই কথাটি বলা বন্ধ কর এবং তোমরা যাহা বলিতেছিলে তাহাই বলিতে থাক। (বুখারী)
ব্যাখ্যাঃ ফুর শয্যার রাত্রির একটি ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই হাদীসটিতে দেওয়া হইয়াছে। ঘটনার বর্ণনাকারী একজন মহিলা সাহাবী- আফরা পুত্র মুওয়াযের কন্যা হযরত রুবাই (রা)। তিনি বলিয়াছেন, তাঁহার যখন বিবাহ হইল ও তাঁহাকে লইয়া ঘর বাঁধার উদ্দেশ্যে বিবাহের উৎসব অনুষ্ঠিত হইতেছিল এবং তিনি রাত্রিকালে ফুল শয্যার ঘরে বসিয়াছিলেন, এই সময় রাসূলে করীম (স) সেই ঘরে উপস্থিত হইয়া হযরত রুবাই হইতে খানিকটা দূরে আসিয়া বসিয়া গেলেন। তখন বিবাহ উৎসবের একটি অংশ হিসাবে কতকগুলি অল্প বয়স্কা মেয়ে একত্রিত হইয়া গীত গাহিতে ছিল এবং ‘দফ’ বাজাইতেছিল। গীতের বক্তব্য ছিল বদর যুদ্ধে শাহাদাত প্রাপ্তা লোকদের জীবন ও কীর্তি সৌন্দর্যের গৌরব গাঁথা। গায়িকা মেয়েগুলির মধ্যে হইতে একটি মেয়ে নবী করীম (স) কে দেখিতে পাইয়া তাঁহার প্রশংসার উদ্দেশ্যে গীতের বাক্যসমুহের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্ন বাক্য শামিল করিয়া দিল। তাঁহাতে সে বলিলঃ আমাদের মধ্য একজন নবী রহিয়াছেন, যিনি আগামীকারে অর্থাৎ ভবিষ্যতের কথা জানেন। নবী করীম (স) মেয়েটির এই কথা শুনিয়া তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ এইরূপ কথা বলিও না- ইহা বলা বন্ধ কর। ইহা ছাড়া যাহা বলিতে ছিলে তাহা বলিতে থাক। নবী করীম (স) সম্পর্কে যে বাক্যটি বলা হইয়াছিল তাহা যেহেতু প্রকৃত ব্যাপারের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাহা ছিল অমূলক, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা- উপরন্তু নবী করীম (স) নিজের প্রচারিত তওহীদী আকীদা-বিশ্বাসেরও পরিপন্হী, তাই তাহা বলিতে নিষেধ করিলেন। ইহার কারণ এই যে, নবী করীম (স) আগামীকালের, অর্থাৎ ভবিষ্যতের কথা জানেন ইহা সম্পূর্ণ শিরকী আকীদা। ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ তা’আলা ছাড়া আর কেহই জানে না। কেননাঃ ******************* ‘গায়েব ও আদৃশ্য জগতের সব চাবিকাঠি একান্তভাবে আল্লাহর মুঠির মধ্যে। সে বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেহই কিছু জানে না’। ইসলামের ইহাই আকীদা এবং এই আকীদারই প্রচারক ছিলেন স্বয়ং নবী করীম (স)। তাঁহারই সম্মুখে তাঁহারই প্রচারিত আকীদা পরিপন্হী ও শিরকী কথা বলা হইবে, তিনি উহার প্রতিবাদ করিবেন না বা ভূল শোধরাইয়া দিবেন না তাহা কিছুতেই হইতে পারে না। নবী করীম (স) সঙ্গে সঙ্গেই তাহা বলিতে নিষেধ করিলেন এবং এই বাক্যটি ব্যতীত তাহারা আর যাহা বলিতেছিল তাহা বলিবার অনুমতি দিলেন। তাঁহার এই অনুমতির তাৎপর্য ছিল, আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীর ভাষায়ঃ
****************************************
বীরত্ব ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ে যে সব গীত সাহিতেছিলে তাহাই গাহিতে নিমগ্ন থাক।
আলোচ্য হাদীসটি হইতে কয়েকটি কথা জানা গেল।
প্রথম কতা, ইহাতে হযরত রুবাই’র বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার কথা বলা হইয়াছে। আর তাহা হইল তাঁহার নিকট নবী করীম (স)- এর তাঁহার ঘরে উপস্থিতি এবং তাঁহার নিকটে আসন গ্রহণ। এখানে প্রশ্ন উঠে, রুবাই একজন ভিন মহিলা- গায়র মুহাররম, নবী করীম (স) তাঁহার ঘরে কি ভাবে গেলেন এবং তাঁহার সম্মুখেই বা আসন গ্রহণ করিলেন কেমন করিয়া? ইহার জওয়াবে বলা যায়, নবী করীম (স) হয়ত তাঁহার ঘরে পর্দার আড়ালে বসিয়াছিলেন। তাহা হইলে তো পর্দা নষ্ট হওয়ার কোন প্রশ্ন উঠিতে পারে না। কিংবা এই ঘটনা হয়ত তখনকার সময়ের যখন পর্দার বিধান নাযিল হয় নাই। অথবা বলা যাইতে পারে, বিশেষ প্রয়োজনের কারণে ভিহ মহিলার প্রতি দৃষি।ট দেওয়া তো সম্পূর্ণ না জায়েয নয়। ইহা ছাড়া কোনরূপ অঘটন ঘটিবার আশংকা না থাকিলে এইরূপ ঘরে প্রবেশ ও উপবেশন করা শরীয়াতের সম্পূর্ণ পরিপন্হী নয়। সর্বোপরি নবী করীম (স)- এর পক্ষে কোন ভিন মেয়ের ঘরে যাওয়া ও তাহার উপর দৃষ্টি দেওয়ার একটা বিশেষ অনুমতি থাকাও অসম্ভব নয়। কিন্তু মুল্লা আলী আল-কারীর মতে এইরূপ ব্যাখ্যা দেওয়া অদ্ভূত ও বিস্ময়কর। কেননা মূল হাদীসে একথা আদৌ বলা হয় নাই যে, হযরত রুবাই মুখ খুলিয়া রাসূলে করীম (স)-এর সম্মুখে উপস্থিত হইয়া ছিলেন এবং তাঁহার সহিত-নিভৃত একাকীত্বে মিলিত হইয়াছিলেন । বরং ইহার বিপরীত কথাই হাদীস হইতে বোঝা যায়। কেননা ইহা ছিল তাঁহার ******** ফূল শয্যার রাত্র বা মধু যামিনী। এই রাত্রে স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সহিত নিভৃত একাকীত্বে মিলিত হওয়ার কোন প্রশ্ন উঠিতে পারে না, তাহার কোন সুযোগ থাকাও স্বাভাবিক নয়।
আলোচ্য হাদীসে রুবাই বিবাহ ও ফুল শয্যার রাত্রিতে বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে ‘দফ’ বাজানো ও ছোট ছোট মেয়েদের গীত গাওয়ার কথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছে। তাহাও আবার করা হইয়াছে শরীয়াতের বিধান প্রবর্তন স্বয়ং নবী করীম (স)-এর উপস্থিতিতে এবং তাঁহার বিশেষ সংশোধনীসহ অনুমোদনক্রমে। একতারা ঢোলকে দফ বলা হয়। ইহা বাজাইয়া বিবাহ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া ও প্রচার করা হইতেছিল। বস্তুত ইহার বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। বিবাহ একটা সামাজিক অনুষ্ঠান। ইহাতে সমাজের অনুমোদনের যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বিবাহ অনুষ্ঠানের কথা সমাজের সকল লোককে সাধারণভাবে জানাইয়া দেওয়া। বিবাহের পূর্বমুহূর্তে যে যুবক ও যুবতী পরস্পরের জন্য হারাম ছিল, এই দুইজনের নিভৃত নির্জনতার একত্রিত হওয়া ছিল অণনুমোদিত। বিবাহ হইয়া যাওয়ার মুহুর্ত হইতেই পরস্পরের জন্য হালাল হইয়া গেল। অতঃপর দুইজনের নিভৃত নিরালায় একত্রিত হওয়াটার উপর কাহারও আপত্তি থাকে না, কেহ তাহার প্রতি কটাক্ষ পর্যন্ত করিতে পারে না। ইহা সম্ভব সামাজিক সমর্থন ও সাধারণের অনুমতি ও অবগতির কারণে। এই কারণেই বলা হইয়াছে, সামাজিক সমর্থন ও সাধারণের অবগতি ব্যতীত যুবক-যুবতীর নিভৃতে মিল সুস্পষ্ট ব্যাভিচার ছাড়া কিছু নয়। বিবাহ ও ব্যভিচারের মধ্যে এখানেই পার্থক্য। বিবাহ হয় সমাজের সমর্থন অনুমোদনক্রমে এবং সকলকে প্রকাশ্যে জানাইয়া। আর ব্যাভিচার হয় গোপনে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, সাধারণ্যের অজ্ঞাতসারে। মুহাম্মদ ইবতে হাতিব আল-জুমহা বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ হালাল ও হারাম বিবাহের পার্থক্যকারী হইল বাদ্য ও শব্দ।
(তিরমিযী, বুখারী, মুসলিম, নিসায়ী, ইবনে মাযাহ)
হাদীসের ‘হালাল বিবাহ’ অর্থ বৈধভাবে স্ত্রীগ্রহণ এবং ‘হারাম বিবাহ’ বলিয়া বোঝানো হইয়াছে অবৈধভাবে নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবন যাপন। বাদ্য বাজাইয়া ও শব্দ ধ্বনি সহকারে সাধারণের অবগতির ভিত্তিতে বিবাহের মাধ্যমে নারী পুরুষের যে মিল, তাহা সম্পূর্ণ হালাল। পক্ষান্তরে যে নারী-পুরুষের মিলনে সাধ্যমত গোপণীয়তা রক্ষা করা হয়- লোকেরা জানুক, তাহা কিছুতেই চাওয়া হয় না, পূর্ণ শক্তিতে চেষ্টা করা হয় লোকদের অবগতি হইতে তাহা গোপন রাখার জন্য, তাহাই হারাম, তাহাই ব্যাভিচার। প্রসঙ্গত মনে রাখা আবশ্যক যে, এই সব হাদীসের মূল উদ্দেশ্যে হইল লোকদের জানাইয়া-শুনাইয়া বিবাহ অনুষ্ঠান করা, গোপনে গোপনে নয়। আর প্রচার মাধ্যমে যুগে যুগে পরিবর্তশীল। যে যুগে যে ধরনের প্রচারে উদ্দেশ্য সাধিত হয় সে যুগে তাহাই গ্রহনীয়। সব যুগে একই মাধ্যম গ্রহণের কোন বাধ্যবাধকতা নাই।
ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়া এ সম্পর্কে মন্তব্য করিয়াছেন *********** ভাল হাদীস। ইবনে হাব্বান ও হাকেম এই হাদীসটিকে বলিয়াছেন ‘সহীহ’। দারে কুতনী ও মুসলিমের সূত্রে ইহাকে সহীহ বলিয়াছেন। ইমাম নাসায়ী মুজাহিদ ইবনে মুসা হইতে এবং ইবনে মাজাহ আমর ইবনে নাফের সূত্রে এই হাদীসটি নিজ নিজ গ্রন্হে উদ্ধৃত করিয়াছেন। এই পর্যায়ের আর একটি হাদীস হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। হযরত আয়েশা (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমরা এই বিবাহের ঘোষণা ও সাধারণ্যে জানান দাও। বিবাহের মূল্য অনুষ্ঠান মসজিদে কর এবং এই সময় দফ বাদ্য বাজাও।
ইবনে মাজাহ হাদীস গ্রন্হেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে। কিন্তু তাহাতে ***************** বাক্যটি নাই। উহার ভাষা এইঃ
****************************************
এই বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রচার কর এবং এই উপলক্ষে বাদ্য বাজাও।
এই পর্যায়ে আর একটি বর্ণনা হইলঃ
****************************************
নবী করীম (স) গোপনে বিবাহ করাকে অপছন্দ করিতেন, যতক্ষণ না বাদ্য বাজানো হইবে।
বিবাহের প্রচার করার ও ঘোষণা দেওয়ার অর্থ, প্রথমতঃ বিবাহ হওয়ার প্রমাণ ও সাক্ষী রাখ। লোকদের উপস্থিতিতে বিবাহের ‘ইজাব কবুল’ করাও এবং বিবাহ যে হইল তাহার লিখিত প্রমাণ বা দলীল দস্তাবেজ তৈয়ার কর। রাসূলের এই আদেশটি পালন করা ওয়াজিব। অর্থাৎ ইহার অর্থ, প্রচার ও বিজ্ঞপ্তি কর। এই আদেশ মুস্তাহাব। মসজিদে বিবাহ অনুষ্ঠান করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে এই কারণে যে, মসজিদে ইসলামী জনতা সদা সমপস্থিত থাকে এবং ইহাতে সমাজে বিবাহের সংবাদ সহজেই সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িতে পারে, অনেকটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই সাধারণ্যে জানাজানি হইয়া যায়। অথবা এই নির্দেশ এজন্যও হইতে পারে যে, মসজিদ অত্যন্ত পবিত্র ও বরকতের স্থান। এখানে বিবাহ অনুষ্ঠিত হইলে উহা পবিত্র পরিমণ্ডলে সমাপ্ত হইবে এবং উহাতেও বরকত আসিবে। মসজিদে বিবাহ (অর্থাৎ আকদ *****) অনুষ্ঠিত হইলে বাদ্যবাজনা নিশ্চয়ই মসজিদে বাজানো যাইবে না। তাহা হইবে মসজিদের বাহিরে- নিজের ঘরে কিংবা অন্য কোন উম্মুক্ত স্থানে।
হাদীস সমূহে এই যে দফ (***) বাজাইবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, ইহা হইতে কি ধরনের বাধ্য বুঝায়? ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেনঃ ***************** ‘দফ এমন বাদ্য যাহাতে ধ্বনি আছে কিন্তু ইহার ঝংকার নাই, যাহাতে সুরের মূর্ছনা বাজিয়া উঠে না’। ‘বাদ্য বাজাও’ এই নির্দেশে বাহ্যত সাধারণ এবং নারী-পুরুষ উভয়ই বাদ্য বাজাইবার কাজ করিতে পারে বলিয়া মনে হয়। অনেক ব্যাখ্যাকারী এই মতই দিয়াছেন। কিন্তু হাফেয ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেন, এই মতটি দুর্বল। বলিষ্ঠ হাদীসসমূহ হইতে প্রমাণিত হয় যে, বাদ্য বাজাইবার এই অনুমতি বিবাহের সহিত সংশ্লিষ্ট মহিলাদের জন্য। বাদ্য কেবল মেয়েরাই বাজাইবে। সেখানে পুরুষের উপস্থিতি অবাঞ্ছিত। কেননা সাধারণত নারী-পুরুষের সংমিশ্রণ নিষিদ্ধ। শুধু বাদ্যই নয়, শালীনতাপূর্ণ ও জায়েয ধরনের গীত গান গাওয়ার কাজটিও কেবলমাত্র মেয়েদেরই করণীয়। এই কাজ পুরুষদের জন্য নাজায়েয।
ইমাম তিরমিযী ও ইবনে হাজার আসকালানীর মতে তিরমিযী বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসটি যয়ীফ। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেনঃ এই হাদীসটির একজন বর্ণনাকারী ইসা ইবনে মায়মুন দুর্বল ব্যক্তি। ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীসটির সনদে খালিদ ইবনে ইলিয়াস একজন বর্ণনাকারী, সে পরিত্যাক্ত- তাহার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। অবশ্য ইমাম আহমাদ এই হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবনুজ জুবাইর হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন। আর ইবনে হাব্বান ও হাকেম উহাকে সহীহ বলিয়াছেন। কিন্তু ইহাতে হাদীসের কথা শুধু এতটুকুঃ *********** ‘বিবাহের ঘোষণা দাও’। তাহাতে ************** ‘এবং উহাতে ‘দফ’ বাজাও’ কথাটুকুর উল্লেখ নাই।
(*********************)
বিবাহের আনন্দ উৎসব
****************************************
কুরাজা ইবনে কায়াব ও আবূ মাসউদ আনসারী হইতে বর্ণিত হইয়াছ, তাঁহার দুইজন একসঙ্গে বলিয়াছেনঃ বিবাহ উৎসবে আমাদিগকে খেলা-তামাসা ও আনন্দস্ফুর্তি করার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। (তিরমিযী)
হযরত সায়েব ইবনে ইয়াজিদ হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) কতিপয় মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন। তাহারা গীত গাহিতে ছিল এবং তাহাতে বলিতেছিলঃ ‘তোমরা আমাদিগকে বাঁচাও, আমরা তোমাদিগকে বাঁচাইব’। নবী করীম (স) বলিলেনঃ তোমরা এইরূপ কথা বলিও না। বরং তোমরা বল ‘(আল্লাহ) আমাদিগকে বাঁচাইয়াছেন, তিনি তোমাদিগকেও বাঁচাইবেন’। তখন একজন লোক বলিলঃ ইয়া রাসূল! আপনি কি বিবাহে লোকদিগকে এই সব কাজের অনুমতি দিতেছেন? রাসূলে করীম (স) বলিলেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কেননা, ইহাতো বিবাহ, ব্যাভিচার নয়’।
(তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ এই হাদীস দুইটি হইতে নিঃসন্দেহে জানা যাইতেছে যে, বিবাহ কার্যটি উৎসবের ব্যাপার এবং এই উৎসব অনুষ্ঠানে আনন্দ স্ফুর্তি ও গানবাদ্য করাটা শরীয়াতের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ নয়। বরং ইহার অনুমতি রহিয়াছে। তবে শর্ত এই যে, তাহা পুরাপুরিভাবে শালীনতাপূর্ণ ও শরীয়াতের আওতার মধ্যে হইতে হইবে। আর দ্বিতীয় কথা এই যে, উহাতে গান বাদ্য করিবে কেবল মাত্র মেয়েরা। কোন মেয়রা। যে কয়টি হাদীস গান-বাদ্য করার ঘটনার উল্লেখ আছে, তাহাতে বলা হইয়াছে যে, মেয়েরাই গান ও গীত গাহিতেছিল। এই পর্যায়ে ব্যবহৃত শব্দ হইল ****** অথবা ****** কিংবা ******* ইহা ******* শব্দ হইতে ছোটত্ব বুঝাইবার জন্য বানানো শব্দ। অর্থাৎ ইহারা ছিল ছোট ছোট মেয়ে। এই সব মেয়ে কাহারা ছিল? বলা হয় *************** ‘ইহারা ছিল আনসার বংশের ছোট ছোট মেয়েরা- দাসী-বান্দীরা নয়’। আবার অন্যরা বলিয়াছেনঃ ************* এই মেয়েরা পূর্ণ বয়স্কা ছিল না। তাহাদিগকে দেখিয়ে যৌনকামনা উত্তেজিত হইতে পারে না। ইহা হইতে স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, বিবাহ উৎসবে বর-কনে পক্ষের ছোট ছোট মেয়েরা কিছুটা গান-বাদ্য করিয়অ যদি স্ফুর্তি আনন্দ প্রকাশ করে তাহা হইলে তাহা ইসলামী শরীয়াতের বিপরীত কাজ হইবে না। তবে সমাজের বড়দের সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক, যেন উহাতে কোন রূপ অশ্ললতা বা শিরক প্রবেশ করিতে না পারে এবং যে গীত গাওয়া হইতে, তাহাতে কোন অসত্য বা শিরকী কথা-বার্তা শামিল হইতে না পারে।
এই পর্যায়ে একটি বিশেষ হাদীস উল্লেখ্য। আমের ইবনে সায়াদ তাবেয়ী বলেন, আমি কুরাইজা ইবনে কায়অব ও আবূ মাসউদ আল-আনসারী (রা) এই সাহাবীদ্বয়ের সহিত এক বিবাহ অনুষ্ঠানে একত্রিত হইলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক মেয়ে গীত গাহিতেছিল। আমি ইহা দেখিয়া তাঁহাদিগকে বলিলামঃ
****************************************
রাসুলে করীম (স)-এর সাহাবীদ্বয়, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদ্বয়। আপনাদের উপস্থিতিতে এইরূপ করা হইততেছে, (অথচ আপনারা কিছুই বলিতেছেন না)?
তখন তাঁহারা দুইজন বলিলেনঃ
****************************************
তুমি ইচ্ছা হইলে বস ও আমাদের সঙ্গে থাকিয়া শুন। অন্যথায় এখান হইতে চলিয়া যাও। এখানে যে আনন্দ ও হাসিখুশী করা হইতেছে, বিবাহনুষ্ঠানে ইহার করার আমাদিগকে অনুমতি দেওয়া হইয়াছে।
ইমাম শাওকানী এই পর্যায়ের হাদীস সমূহ উদ্ধৃত করার পর লিখিয়াছেনঃ
****************************************
এইসব হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, বিবাহ অনুষ্ঠানে দফ একতারা বাদ্য বাজানো এবং উচ্চ শব্দে কোন কথা (গদ্য-পদ্য-গীত) পাঠ করিয়া প্রচার করা সম্পূর্ণ জায়েয।
তিনি আরও লিখিয়াছেনঃ
****************************************
অন্যায়, দুষ্কৃতি, চরিত্রহীনতার উদ্বোধন ও রূপ সৌন্দর্য বর্ণনা সম্বলিত গান এবং মদ্যপানের আসর জমানো বিবাহনুষ্ঠানেও হারাম, যেমন হারাম উহার বাহিরে।(*************)
****************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিন তাঁহার নিকটাত্মীয় আনসার বংশের একটি মেয়েকে বিবাহ দিয়াছিলেন। এই সময় রাসূলে করীম (স) তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমরা কি এই মেয়েটির সঙ্গে এমন কাহাকেও পাঠাইয়াছ, যে গীত গাহিবে, গান করিবে? হযরত আয়েশা (রা) বলেন, ইহার উত্তরে আমি বলিলামঃ না, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ আনসার বংশের লোকেরা গান-গজল খুব পছন্দ করে। তোমরা যদি কনের সঙ্গে এমন কাহাকেও পাঠাইতে যে বলিতঃ ৱৱ আমরা আসিয়াছি, আমরা আসিয়াছি। আল্লাহ আমাদিগকে বাঁচাইয়া রাখুন, তোমাদিগকেও বাঁচাইয়া রাখুন! (তাহা হইলে খুবই ভাল হইত)
(ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যাঃ আল্লাম বদরুদ্দীন আইনীর মতে এই হাদীসটি যায়ীফ। আর ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল বলিয়াছেনঃ ************* ইহা গ্রহণ অযোগ্য হাদীস। কিন্তু ইহা ইবনে মাজাহর বর্ণনার সনদ সম্পর্কে মন্তব্য। হাদীসের মূল প্রতিপাদ্য বা বক্তব্যই ভিন্নতর সনদ সূত্রে বুখারী, বায়হাকী, মুস্তাদরাক হাকেম এবং আহমদ ইবনে হাম্বল কর্তৃক তাঁহাদের নিজ নিজ গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে এবং সে বর্ণনা সমূহের ভাষারও তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য নাই। মুসনাদে আহমাদে উদ্ধৃত হাদীসটির ভাষা এইঃ
****************************************
নবী করীম (স)-এর বেগম হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত, তিনি বলিয়াছেনঃ আমার কোলে আনসার বংশের একটি মেয়েকে লালন-পালন করিয়অ বড় করিয়াছিলাম। পরে আমি সে মেয়েটিকে বিবাহ দিলাম। তিনি আরও বলিয়াছেন, এই সময় রাসূলে করীম (স) মেয়েটির বিবাহ (বা বাসর রাত্রির) দিনে আমার ঘরে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু তিনি কোন খেল-তামাসা-স্ফূতির শব্দ শুনিতে পাইলেন না। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ হে আয়েশা! আনসারদের এই লোকেরা অমুক অমুক কাজ খুব পছন্দ করে ও ভালবাসে……….।
এই হাদীসটি হইতে দুইটি কথা স্পষ্ট জানা গেল। একটি, মেয়েটির সঠিক পরিচয়। আর দ্বিতীয়, বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠানে নবী করীম (স) স্বাভাবিকভাবেই কিসের আশা করিতেছিলেন।
মেয়েটির পরিচয় এই জানা গেল যে, সে আনসার বংশের এক ইয়াতীম মেয়ে ছিল। হযরত আয়েশার আভিভাবকত্বে লালিতা পালিতা হইয়াছিল এবং হযরত আয়েশা (রা) নিজ দায়িত্বেই মেয়েটির বিবাহ দিয়াছিলেন।
আর দ্বিতীয় কথা এই যে, এই উৎসব উপলক্ষে বেশ আমোদ-স্ফুর্তি অনুষ্ঠিত হইবে। খেলা, তামাসা, গীত ও বাদ্য হইবে। যাহাতে বুঝা যাইবে ও চারিদিকে লোকেরাও টের পাইবে যে, এই বাড়ীতে বিবাহ অনুষ্ঠিত হইতেছে। কিন্তু তিনি হযরত আয়েশার ঘরে উপস্থিত হইয়া তেমন কিছুরই টের পাইলেন না। কোন বাদ্যের শব্দ শুনিতে পাইলেন না। গীত গানের ধ্বনি তাঁহার কর্ণ কুহরে প্রবেশ করিল না। ইহাতে তিনি বিস্মিত হইলেন এবং হযরত আয়েশা (রা) কে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলেন। ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে, আমোদ-স্ফূর্তিহীন, খেলা-তামাসা, গীত ও বাদ্য ধ্বনি শূণ্য-নিতান্ত সাদামাটা ধরনের বিবাহ অনুষ্ঠান তিনি পছন্দ করিতে পারেন নাই।
এই সব কথা অধিক স্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণিত হাদীসে। উহার ভাষা এইঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) হযরত আয়েশা (রা) কে বলিলেনঃ সেই মেয়েটির শ্বশুরবাড়ী কোন মেয়েকে সঙ্গী করিয়া পাঠাইয়াছ কি? হযরত আয়েশা বলিলেনঃ হ্যাঁ। তখন নবী করীম (স) বলিলেন, তাহার সঙ্গে এমন কাহাকেও কেন পাঠাইলে না, যে তাহাদিগকে গান ও গীত গাহিয়া শুনাইবে?… কেননা আনসাররা এমন লোক যে, তাহাদের মধ্যে মেয়েদের পারস্পরিক গীত বিনিময় করার ব্যাপার প্রচলন করিয়াছে।
এই হাদীস হইতে প্রথমত জানা গেল, কনের সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র মেয়ে পাঠাইয়অ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এই মেয়েটি কনের সঙ্গে থাকিবে। নতুন বাড়ীতে সম্পূর্ণ ভিন্নতম পরিবেশে আসিয়া কনে লজ্জায় ও অপরিচিতির কারণে সেখানকার লোকদের সাথে কথাবার্তা বলিতে সংকোছ বোধ করিবে। কাজেই তাহার পরিচিত সঙ্গী কোন মেয়ে থাকিলে তাহার সঙ্গে কথা বলিতে বা নিজে কোন প্রয়োজনের কথা জানাইতে পারিবে। ইহার প্রচলন বোধ হয় সকল দেশে ও সকল সমাজে আছে এবং সেকাল হইতে একাল পর্যন্ত ইহা পরিব্যাপ্ত।
দ্বিতীয় জানা গেল, কনের শ্বশুর বাড়ী গিয়া গীত ও গান গাহিয়া শুনাইবে এমন একজনও (বা সম্ভব হইলে একাধিক) মেয়ে পাঠানোও আবশ্যক। কেননা এই ভবে গান-গীতের বিনিময় করা- কনের পিতার বাড়ি হইতে যাওয়া মেয়ে এবং স্বামীর বাড়ীর মেয়েরা একের পর এক গান-গীত গাহিয়া বিবাহ বাড়ীটিকে আনন্দ মুখর করিয়া তুলিবে। এইরূপ কাহাকেও পাঠানো হইয়াছে কিনা তাহা নবী করীম (স) হযরত আয়েশার নিকট জানিতে চাহিয়াছেন। শুরাইক বর্ণিত হাদীসে এই কথাটির ভাষা এইরূপঃ
****************************************
তোমরা কি কনের সঙ্গে এমন একটি মেয়ে পাঠাইয়াছ, যে সেখানে বাদ্য বাজাইবে ও গান-গীত গাইবে?
আর হিশাম ইবনে ওরওয়া সূত্রে হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত এবং বুখারী মুস্তাদরাক হাকেম- এ উদ্ধৃত অপর একটি হাদীসে এই কথাটির ভাষা হইলঃ
****************************************
হে আয়েশা! তাহাদের সঙ্গে কি কোন আমোদ-স্ফুর্তির আয়োজন নাই? কেননা আনসার বংশের লোকেরা আমোদ ফূর্তি ও খেলা তামাসা খুব পছন্দ করে।
গান-গীত গাহিবার জন্য লোক সঙ্গে গিয়াছে কিনা? এই প্রশ্নের কারণ স্বরূপ (প্রত্যেকটি হাদীসের ভাষায়) নবী করীম (স) আনসারদের গান-গীত প্রিয়তার কথাই উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা হইতে দুইটি কথা বুঝিতে পারা যায়। একটি হইল, মেয়েটি ছিল আনসার বংশের ইয়াতীম, হযরত আয়েশার অভিভাবকত্বে বিবাহিতা হইয়াছিল সেই আনসার বংশেরই কোন ছেলের সাথে। আর দ্বিতীয় এই যে, আনসার বংশের লোকেরা গান-গতি পছন্দ করে। অতএব বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠানে তাহাদের এই রুচি ও পছন্দ রক্ষা করা ও তদনুযায়ী কাজ করা- উহার আয়োজন ব্যবস্থা করা- কনে পক্ষেরও কর্তব্য। অবশ্য তাহা যদি সুস্পষ্ট হারাম না হইয়া তাকে। তৃতীয় যে কথাটি জানা গেল তাহা এই যে, আনসার বংশের প্রাচীন কাল হইতে চলিয়া আসা এই রসমটি ইসলাম পরিপন্হী ছিল না বলিয়া উহাকে চালূ রাখা হইয়াছে।
আর এই পর্যায়ের সমস্ত উদ্ধৃত অনুদ্ধৃত হাদীস এবং হাদীসের মূল ভাষার পর্যালোচনা হইতে আরও দুইটি বড় বড় কথা জানা যায়। তাহার একটি হইল, নবী করীম (স)-এর বেগমদের নিজস্ব ইচ্ছা ও ইখতিয়ারে এমন অনেক কাজ হইত, যাহাতে তাঁহাদের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। রাসূলে করীম (স) নিজে তাহাতে কিছুমাত্র হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করিতেন না। আনসার বংশের এই মেয়েটির নবী করীম (স)-এর বেগম হযরত আয়েশার অভিভাবকত্বে লালিতা-পালিতা ও বিবাহিতা হওয়ার সমস্ত ব্যাপারটি আমাদের এই কথার জ্বলন্ত প্রমাণ। এই প্রসঙ্গে নবী করীম (স) হযরত আয়েশা (রা) কে ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যাহা কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছেন ও নীতিগত উপদেশ দিয়াছেন, তাহা একচেটিয়া কর্তৃত্ব সম্পন্ন গৃহকর্তার মত নয়্ তাহা একজন কল্যাণকামী প্রতিবেশী বা সম্মানিত অতিথি কিংবা সামাজিক সুষ্ঠতা বিধানকারী কোন মুরব্বীর মত।
আর দ্বিতীয় কথা এই যে, বিবাহ কাজটি একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক, আমোদ-প্রমোদ ও আনন্দ ফূর্তির সমন্বিত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানকে নিরেট সাদামাটা ও যেন-তেন প্রকারের সম্পন্ন করিতে চেষ্টা করা উচিত নয়, উচিত নয় এই অনুষ্ঠানকে কিছুমাত্র তুচ্ছজ্ঞান করা। কেননা ইসলামী সমাজের প্রথম ইউনিট হইল পরিবার। আর পরিবারের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় বিবাহের মাধ্যমে। ইহার সহিত আরও দুইটি কথা আছে। একটি হইল, মানুষের প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবেই আমোদ-উৎসব প্রিয়তা রহিয়াছে। সমীচীন পরিধি-পরিমন্ডলের মধ্যে ও সুরুচি-শালীনতা রক্ষা করিয়া যতটা সম্ভব, ইহার চরিতার্থতার সুযোগ ও ব্যবস্থা হওয়া বাঞ্ছণীয়। ইসলাম সে সুযোগ দিয়াছে। বস্তুত ইসলাম নিছক শুষ্ক-নিরস আনন্দ শূণ্য কোন ধর্মমাত্র নয় ইহা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা বিধায় ইহাতে ব্যক্তি ও সমাজের সমস্ত স্বাভাবিক রুচি-প্রবণতার চরিতার্থতার সুষ্ঠু ব্যবস্থা রহিয়াছে। আর দ্বিতীয় কথা এই যে, বিবাহে দুইট ভিন্ন পরিবার জড়িত। এই উভয় পরিবারের উচিত অপর পরিবারের প্রচলিত বৈধ আচার রীতির সহিত আনুকূল্য ও সহযোগিতা করা। কেবল নিজের রুচিটি অপরের বা অপর পরিবারের উপর চাপাইয়া দিতে চেষ্টা করা কোনক্রমেই উচিত হইতে পারে না। আনসার বংশের এই ইয়াতীম মেয়েটির বিবাহকে কেন্দ্র করিয়া নবী করীম (স) এত গুরুত্বসহকারে এই কথাগুলি বলিয়াছিলেন এই কারণেই।
(*********************)
বিবাহে উকীল নিয়োগ
****************************************
হযরত উকবা ইবনে আমের ( রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) এক ব্যক্তিকে বলিলেনঃ আমি তোমার সহিত অমুক মেয়ে লোকটির বিবাহ দিব, তুমি কি রাযী আছ? সে বলিলঃ হ্যাঁ। তিনি মেয়ে লোকটিকে বলিলেনঃ আমি তোমাকে অমুক ব্যক্তির নিকট বিবাহ দিব, তুমি রাযী আছ? সে বলিলঃ হ্যাঁ। অতঃপর তিনি একজনের সহিত অপরজনকে বিবাহ দিলেন। পরে সে তাহার সহিত মিলিত হইলঃ কিন্তু তাহার জন্য কোন মহরানা ধার্য করা হয় না, কোন জিনিসও সে তাহাকে দেয় নাই। এই লোকটি হুদাইবিয়ার সন্ধি অভিযানে শরীক ছিল। আর হুদাইবিয়ার সন্ধি অভিযানে শরীক হওয়া লোকদিগকে খায়বারের জমি দেওয়া হইয়াছিল। শেষে লোকটির মৃত্যু মুহূর্ত উপস্থিত হইলে সে বলিলঃ রাসূলে করীম (স) আমার সহিত অমুক মেয়ে লোকটিকে বিবাহ করাইয়া দিয়াছিলেন; কিন্তু আমি তাহার জন্য কোন মহরানা ধার্য করি নাই এবং তাহাকে কিচু দেইও নাই। এখন আমি তোমাদিগকে সাক্ষী বানাইয়া বলিতেছিঃ আমি আমার এই স্ত্রীকে তাহার মহরানা বাবদ আমার খায়বারে প্রাপ্ত অংশের জমি খন্ড দিলাম। পরে স্ত্রী লোকটি তাহার (স্বামীর) অংশটি গ্রহণ করিল ও একলক্ষ্য মুদ্রায় বিক্রয় করিয়া দিল। (আবূ দাউদ)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি ব্যাপক তাৎপর্যবহ। প্রথমত ইহাতে বিবাহের উকীল নিয়োগ বা উকীলের সাহায্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বলা হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ বিবাহকালে মহরানা ধার্য না হইলেও বিবাহ সহীহ হয় এবং স্ত্রীর সহিত একত্রে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে জীবন যাপন ও সঙ্গম করা যায়। আর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মহরানা আদায় করাও নাজায়েয নয়।
উকীল দ্বারা বিবাহ অনুষ্ঠান পর্যায়ে হযরত উম্মে হাবীবা (রা)-এর বিবাহের ব্যাপারটি উল্লেখ্য। তিনিও অন্যান্য সাহাবীদের সঙ্গে হাবশায় হিজরত করিয়া গিয়াছিলেন। সেখানেই নাজাশী তাঁহাকে রাসূলে করীম (স)-এর সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন। এই বিবাহে রাসূলে করীম (স)-এর পক্ষ হইতে উকীল হইয়াছিলেন হযরত আমের ইবনে উমাইয়্যাতা আজ-জামারী (রা)। রাসূলে করীম (স) নিজে তাঁহাকে এই জন্য উকীল বানাইয়াছিলেন। আর নাজাশী নিজে রাসূলে করীম (স)- এর পক্ষ হইতে চারশত দীনার মহরানা আদায় করিয়া দিয়াছিলেন।
(আবূ দায়ূদ)
‘অকালাত’ (*******) শব্দের অর্থ কাহাকেও কোন কাজের জন্য নিজের পক্ষ হইতে দায়িত্বশীল বানানো। নির্দিষ্ট কোন কাজ সমাধা করার উদ্দেশ্যে একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করা। যাহাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বা নিজের স্থলাভিষিক্ত বানানো হয় তাহাকেই ‘উকীল’ বলে। ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন, যে কাজ কাহারও নিজের করা জায়েয সেই কাজের জন্য অপর কাহাকেও দায়িত্বশীল বা উকীল বানানোও সম্পূর্ণ জায়েয। ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা, হক দাবি করা, কোন কিছু হাসিল করার জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো ইত্যাদি সব কাজই ইহার মধ্যে গণ্য। স্বয়ং নবী করীম (স) তাঁহার কোন কোন সাহাবীর বিবাহ কার্যে নিজে উকীল হইতেন ও বিবাহ সম্পন্ন করিতেন, তাহা উপরে উদ্ধৃত হাদীস হইতে স্পষ্ট ও অকাট্যরূপে জানা যাইতেছে। উপরোক্ত হাদীস হইতে একথাও জানা যায় যে, একই ব্যক্তি বিবাহের- বর পক্ষ ও কনে পক্ষ- উভয়ের উকীল হইতে পারে। যে কোন পূর্ণ বয়স্ক- বালেগ- সুস্থ বিবেক বুদ্ধিমান স্বাধীন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে উকীল বানাইতে পারে। তাহার পক্ষ হইতে এই গুণের কাহাকেও উকীল বানানো যাইতে পারে, নিজে নিজের বা অপর কাহারও উকীল হইতে পারে। যে লোক এই গুণ সম্পন্ন নয়, সে উকীল হইতেও পারে না, বানাইতেও পারে না। যেমন পাগল, নাবালেগ, ক্রীতদাস, দিশাহারা ব্যক্তি।
পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ বিবেকবুদ্দি সম্পন্ন স্ত্রী লোক নিজের পক্ষ হইতে নিজের ইচ্ছামত কাহাকেও উকীল বানাইতে পারে কিনা এই বিষয়ে ফিকাহবিগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করিয়াছেন। এই মত-বিরোধের ভিত্তি হইতেছে এই বিষয়ের মতবিরোধ যে, সে নিজের বিবাহ নিজেই সম্পন্ন করিতে কারে কিনা।
ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর মতে পুরুষ যেমন উকীল বানাইতে পারে, একজন স্ত্রী লোকও তেমনিই উকীল নিযুক্ত করিতে পারে। কেননা মেয়ে লোক যে কোন চুক্তি করার অধিকার রাখে। এই অধিকার যখন রহিয়াছে, তখন সে নিজের কাজ করার জন্য অপর কাহাকেও দায়িত্বশীল বানাইতে পারে। তাহা সম্পূর্ণ জায়েয। শাফেয়ী মাযহাবের আলেমগণ পিতা ও দাদা এবং তাহাদের ছাড়া অন্যান্য ‘ওলী’ (অভিভাবক) দের মধ্যে স্ত্রীলোকের উকীল বানাইবার ব্যাপারে পার্থক্য করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, পিতা ও দাদাকে নূতন করিয়া উকীল বানাইবার প্রয়োজন নাই। কেননা তাহারা স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবক ও উকীল। অন্যদের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে উকীল বানাইতে হইবে। যদি বানানো হয় তবেই সে তাহার পক্ষ হইতে দায়িত্ব পালন করিতে পারিবে।
উকীল বানানোর কাজ দুইভাবে হইতে পারেঃ শর্তহীন। শর্তহীন উকীল বানানোর অর্থ, কোন নির্দিষ্ট মেয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ মহরানা ছাড়াই বিবাহ করাইয়া দেওয়ার জন্য কেহ কাহাকেও উকীল বানাইতে পারে। আবার কেহ নির্দিষ্ট মেয়ে ও নির্দিষ্ট পরিমাণের মহরানার ভিত্তিতে বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য উকীল বানাইতে পারে। ইমাম আবূ হানীফার মতে উকীলকে কোন শর্ত দেওয়া যাইতে পারে না। উকীল যদি তাহার মুয়াক্কিলকে কোন নির্দিষ্ট মেয়ের সহিত বিবাহ দেয়, আর তাহা কুফু ছাড়া ও অরিতিক্ত পরিমাণের মহরানায় হয়, তবে সে বিবাহ শুদ্ধ ও জায়েয হইবে। ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ বলিয়াছেনঃ উকীল বানাইবার সময় মেয়েটির সুস্থ, কুফুর সামঞ্জস্য ও সমপরিমাণ মহরানার শর্ত করিয়া দেওয়া আবশ্যক।
আর শর্তাধীন উকীল বানানো হইলে উহার বিরুদ্ধতা করা জায়েয নয়। তবে যদি দেওয়া শর্তের নির্দিষ্ট পুরুষের সহিত বিবাহ ঘটাইবার জন্য উকীর বানাইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার পুরাপুরি শর্তাদি পূর্ণ হইলেই বিবাহ সংঘটিত হইবে ও মুয়াক্কিলার জ ন্য তাহা বাধ্যতামূলক হইবে- অন্যথায় নৰয়। আর অনির্দিষ্টভাবে যে কোন পুরুষের সহিত বিবাহ দেওয়াইবার আদেশ করিয়া থাকিলে বিবাহ হইয়া যাওয়ার পর উহার কার্যকারতা তাহার মঞ্জুরীর উপর নির্ভর করিবে।
বিবাহের উকীল মুয়াক্কিলের দূত বা প্রস্তাবক মাত্র। কাজেই তাহার সম্পন্ন করা বিবাহের বাধ্যবাধকতা তাহার উপর বর্তিবে না। তাহার নিকট হইতে মহরানারও দাবি করা যাইবে না। স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য হইলে তাহারকে অনুগতা বানাইয়া দেওয়ার দায়িত্বও তাহার মাথায় চাপিবে না।
উকীল বানানো নীতিগত জায়েয হওয়া সত্ত্বেও বিবাহে কন্যার ক্ষেত্রে অপর একটি ব্যাপার রহিয়াছে। তাহা হইল বিবাহেচ্ছু নারীর উপর ********* বা অভিভাবকত্বের ব্যাপার। এই অভিভাবকত্ব দুই প্রকারের। একটি হইল জোর খাটাইতে সক্ষম অভিভাবকত্ব। যে নারীর নিজের বিবাহ নিজের করা অধিকার বা ক্ষমতা নাই, তাহার উপর অভিভাবকত্ব। ইহা জোর প্রয়োগের অভিভাবকত্ব ***************। যেমন নাবালেগা মেয়ে। তার বালেগা-পূর্বে বিবাহ হয় নাই, কুমারী মেয়ে। তাহার উপর এই অভিভাবকত্ব কাজ করিবে। বালেগা-পূর্ণ বয়স্কা-কুমারী ও অ-কুমারী ‘সাইয়্যেবা’। মেয়ের উপর তাহা কোন কাজ করিবে না। জমহুর ফিকাহবিদগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, পূর্ণ বয়স্কা কুমারী ও অ-কুমারী উভয় ধরনের মেয়র বিবাহের ব্যাপারে তাহার নিজের মতই সর্বাগ্রগণ্য। কোন অভিভাবকই তাহার মতের বিরুদ্ধে তাহাকে বিবাহ দিতে পারিবে না।
দ্বিতীয় প্রকারের ****** বা অভিভাবকত্ব ইখতিয়ারী বা ইচ্ছামূলক। ইহা পূর্ণ বয়স্কা ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মেয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে। এই প্রেক্সিতে ফিকহবিদগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে নিজে সরাসরি বা উকীলের মাধ্যমে নিজের বিবাহ নিজে সম্পন্ন করাইতে পারে না।
পূর্ণ বয়স্কা সুস্থ বিবেক বুদ্ধির মেয়ের পিতাই তাহার বিবাহের ইখতিয়ারী অভিভাবক। তাহার পিতা নিজের কন্যার সহিত পরামর্শ করিয়া ও তাহার অনুমতি লইয়া নিজের কন্যাকে বিবাহ দিবে। তবে সে কন্যা নিজেই যেহেতু নিজের বিবাহের প্রকৃত অধিকারী, তাই পিতার অনুমতি ও উপস্থিতিতে যে কোন মুহাররম পুরুষকে উকীল বানাইতে পারে। স্বয়ং নবী করীম (স) কোন কোন সাহাবী মহিলার বিবাহের উকীল হিসাবে কাজ করিয়াছেন। আর বিবাহের উকীল বানানোর ইহাই অন্যতম একটি অকাট্য দলীল। হযরত আব্বাস (রা) তাঁহার স্ত্রীর ভগ্নি উম্মুল মু’মিনীন হযরত মায়মুনা বিতিল হারেস (রা)-কে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট বিবাহ দেওয়ার জন্য স্বয়ং মায়মুনার অনুরোধক্রমেই উকীল হইয়াছিলেন। ইহা সপ্তম হিজরী সনের ঘটনা।
(*********************)
বিবাহে কনের অনুমতি
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ পূর্বে স্বামীসঙ্গ প্রাপ্তা কনের স্পষ্ট আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাহাকে বিবাহ দেওয়া যাইবে না এবং পূর্বে স্বামী অ-প্রাপ্তা কনের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত তাহাকে বিবাহ দেওয়া যাইবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, উহার অনুমতি কিভাবে লওয়া যাইতে পারে? বলিলেনঃ তাহার চুপ থাকাই (অনুমতি)।
(মুসলিম, বুখারী, নাসায়ী)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির মূল বক্তব্য স্পষ্ট। ইহাতে বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে উদঘাটিত করা হইয়াছে। বিবাহ মূলত একটি মেয়ে ও একটি ছেলের নিজস্ব ব্যাপার হইলেও ইহা একটা বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে মেয়ে ও ছেলের অভিভাবকরাই সাধারণত কর্তৃত্ব করিয়া থাকে এবং সে কর্তৃত্বে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ছেলে ও মেয়ের- মূলত যাহাদের বিবাহ- মতামত, সন্তুষ্টি- অসন্তুষ্টি ও খুশী-অখুশীর প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করা বা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাহাদের উপর অভিভাবকদের জবরদস্তি ও নিপীড়নও চলে। তাহাদের ইচ্ছা ও মজীর বিরুদ্ধে ও কেবল অভিভাবকদের ইচ্ছানুক্রমেই বিবাহ অনুষ্ঠিত হইতে দেখা যায়। কিন্তু ইহা কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না। এইরূপ বিবাহ ছেলে বা মেয়ের- বর বা কনে যাহার মনেই সামান্য অনিচ্ছার বীজ বপিত থাকিবে, সে এই বিবাহকে অন্তর দিয়া কখনই গ্রহণ করতে পারিবে না। ফলে তাহাদের গোটা দাম্পত্য জীবনই তিক্ত বিষাক্ত এবং শেষ পর্যন্ত চরম ভাঙন ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইয়া পড়ে। এই কথা কেবল আরব জাহিলিয়াতের সমাজেই প্রচলিত ছিল না, বর্তমান সুসভ্য সমাজেও এইরূপ ঘটনার দৃষ্টান্ত নেহাত বিরল নয়।
কিন্তু মানব সমস্যার সুষ্ঠু নির্ভূল সমাধান ও সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য যাঁহার আগমন সেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এই সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান পেশ করিয়াছেন। তাঁহার এই ঘোষণা স্পষ্ট, অকাট্য এবং শরীয়াতের বিধান ইহার উপরই ভিত্তিশীল।
হাদীসবিদরা বলিয়াছেন, হাদীসের শব্দ ****** অর্থঃ ******* বিবাহিতা, স্বামী প্রাপ্তা, যে স্ত্রীর স্বামী মরিয়অ গিয়াছে, কিংবা তালাক পাইয়াছে। ইহার আরও কয়েকটি অর্থ রহিয়াছে। এই পর্যায়ের অন্যান্য হাদীস হইত তাহা স্পষ্ট হইয়া উঠে। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসের ভাষা এইঃ
****************************************
পূর্বে স্বামী প্রাপ্তা মেয়ে তাহার নিজের যাবতীয় (বিশেষ করিয়া বিবাহ) ব্যাপারে তাহার অভিভাবকের তুলনায় বেশী অধিকার সম্পন্না। আর পূর্বে স্বামী অপ্রাপ্তা কুমারী মেয়ের নিকট বিবাহের নির্দেশ চাহিতে হইবে। আর তাহার অনুমতি হইল তাহার চুপ থাকা।
*********** শব্দের অর্থ ******** নির্দেশ বা সিন্ধান্ত চাওয়া, কিংবা ************ পরামর্শ করা, মত চাওয়া।
আর হযরত ইবনে আব্বাস হইতে অপর একটি সূত্রে বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে তাহার নিজের যাবতীয় ব্যাপারে তাহার অভিভাবকদের তুলনায় বেশী অধিকার সম্পন্না। আর পর্বে স্বামী অপ্রাপ্তা কন্যার নিকট অনুমতি চাহিবে তাহার পিতা। আর তাহার অনুমতি হইল তাহার চুপ করিয়া থাকা। অনেক সময় বলা হয়, তাহার চুপ থাকাই তাহার স্বীকৃতি।
শরীয়াত বিশারদ কাজী ইয়াব বলিয়াছেন, ************ শব্দের আভিধানিক অর্থ হইল এমন মেয়ে লোক, যাহার স্বামী নাই, সে ছোট হউক বা বড়। অবিবাহিকা হউক, কি পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা। এই অভিধানিক অর্থের দৃষি।টতে এই শব্দটি পুরুষদের সম্পর্কেও ব্যবহৃত হয়। আরবী ভাষায় বলা হয়ঃ ****** স্ত্রীহীন পুরুষ, স্বামীহীনা মেয়ে। কিন্তু আলোচ্য হাদীসে ******* বলিয়া কি বোঝানো হইয়াছে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করিয়াছন। বিশেষজ্ঞ ও ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন, আলোচ্য হাদীসে *********** অর্থ ******* ‘স্বামী নাই এমন মেয়ে লোক’। তাঁহাদের দলীল হইল, প্রথমোক্ত হাদীসটিতে ******* বলিয়া যাহাদিগকে বুঝাইয়াছেন, অনান্য হাদীসে ***** বলিয়া ঠিক তাহাদিগকেই বোঝানো হইয়াছে। উপরন্তু এই দুইটি শব্দ প্রত্যেকটি হাদীসেই ******** এর বিপরীতে ব্যবহৃত হইয়াছে, আর *********** শব্দটির অধিক ব্যবহারও ******* অর্থেই হইয়া থাকে। কূফী ফিকাহবিদ ও ইমাম জুফার বলিয়াছেনঃ
****************************************
‘আল-আয়েম্ম’ বলিতে এখানে এমন প্রত্যেক মেয়েকে বুঝায়, যাহার স্বামী নাই। সে পূর্বে স্বামী অপ্রাপ্তা হউক, কি স্বামী প্রাপ্ত।
এসব হাদীসের মূল বক্তব্য হইল, যে মেয়েই পূর্ণ বয়স্কা হইয়াছে, সে তাহার নিজস্ব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাহার অভিভাবক অপেক্ষা বেশী অধিকার সম্পন্না। আর সে নিজেই উদ্যোগী হইয়া যদি তাহার নিজের বিবাহ সম্পন্ন করে, তবে তাহার সম্পূর্ণ সহীহ হইবে। শ’বী ও জুহরী এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন। আর অভীভাবকদের কর্তৃত্ব পর্যায়ে তাঁহাদের মত হইলঃ
****************************************
কোন মেয়ের অভিভাক তাহার (মেয়ের) বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য কোন অপরিহার্য শর্ত নয়; বরং উহা বিবাহের পূর্ণত্ব লাভের অংশ বিশেষ।
ইমাম আওজায়ী আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মদ বলিয়াছেন, পূর্বে স্বামী প্রাপ্তা মেয়ের ইচ্ছাকৃত বিবাহের শুদ্ধতা অভীভাবকের অনুমতির উপর নির্ভরশীল। কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, নবী করীম (স)-এর বাণী *********** এ কথার তাৎপর্যে মতভেদ রহিয়াছে। প্রশ্ন হইয়াছে, ‘সাইয়্যেবা’- ‘পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে তাহার বিবাহে তাহার অভিভাবকের অপেক্ষাও বেশী অধিকার সম্পন্না’ কোন ব্যাপারে? তাহা কি কেবল অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে, না অনুমতি দান ও নিজের বিবাহ সংঘটন- এই উভয় ব্যাপারে? জমহুর আলিমগণের মধ্যে কেবলমাত্র বিবাহের অনুমতির ব্যাপারেই তাহার অধিকার তাহার অভিভাবকের অপেক্ষাও বেশী। আর অন্যান্য ফিকাহবিদের মতে এই উভয় ব্যাপারেই তাহার অধিকার সর্বাধিক। নবী করীম (স)- এর বানী ********** শাব্দিক অর্থের দিক দিয়া ইহার অর্থ হইলঃ
****************************************
সে তাহার অভিভাবকের অপেক্ষা বেশী অধিকার সম্পন্ন সব ব্যাপারেই- বিবাহ সংঘটন করা ইত্যাদি।
ইমাম আবূ হানীফা ও দায়ূদ যাহেরীও এই মত দিয়াছেন। তবে রাসূলের এই কথাটির এ-ও অর্থ হইতে পারেঃ ************ ‘রাযী হওয়ার ব্যাপারে সে-ই বেশী অধীকার সম্পন্না’।অর্থাৎ সে যতক্ষণ পর্যন্ত সশব্দে অনুমতি দান না করিবে, ততক্ষণ তাহার বিবাহ সংঘটিত হইতে পারে না। পূর্বে স্বামী অপ্রাপ্তা- ********* – মেয়ের কথা ভিন্নতর। কিন্তু রাসূলে করীম (স)এর অপর একটি কথাও রহিয়াছে। তাহা হইল ************ অভিভাবক ছাড়া কোন মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠিত হইতে পারে না’। এই পর্যায়ে রাসূলে করীমের আরও অনেক উক্তি রহিয়াছে। এই সব হাদীসের দৃষ্টিতে মেয়ে বিবাহ দেওয়ার ব্যাপারে অভীভাবকের সম্মতি জরুরী শর্ত বিশষ। তাই ‘মেয়ের বেশী অধিকার সম্পন্না হওয়া’ সংক্রান্ত আলোচ্য বাণীটির দ্বিতীয় অর্থ- ‘কেবলমাত্র বিবাহর চূড়ান্ত অনুমতি দানের ব্যাপারেই বেশী অধিকার সম্পন্না’ মনে করা সমীচীন।
এই পর্যায়ে আরও কথা হইল, রাসূলের কথা ********** শব্দটি মূলত অধিকারের ব্যাপারে অংশীদারিত্ব বুঝায়। অর্থাৎ ‘সাইয়্যেবা’ মেয়ে তাহার নিজের বিবাহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার সম্পন্না। সেই সঙ্গে তাহার অভিভাবকদের এই ব্যাপারে মত দেওয়া ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উদ্যোগ-আয়োজন করার অধিকার রহিয়াছে। তবে এই দুইটি অধিকারের মধ্যে মেয়ের অধিকার অধিক প্রভাবশালী ও অগ্রাধিকার সস্পন্ন। কেননা অভিভাবক যদি মেয়েকে কোন উপযুক্ত ছেলের নিকট বিবাহ দিতে ইচ্ছা করে আর সে মেয়ে সেখানে অরাযী থাকে ও নিষেধ করে, তাহা হইলে সে বিবাহে মেয়েকে বাধ্য করা যাইবে না। আর মেয়ে নিজে যদি কোন উপযুক্ত ছেলের সহিত বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়; কিন্তু অভিভাবক তাহাতে অরাযী হয়, তাহা হইলে সরকার মেয়ের মত অনুযায়ী বিবাহ দিতে অভিভাবককে বাধ্য করিতে পারিবে। ইহা শরীয়াতের সর্বসম্মত শাশ্বত বিধান। ইহা হ ইতেও মেয়ের বেশী অধিকার থাকার কথাটাই প্রমাণিত হয়।
এই পর্যায়ে হযরত খানসা (কিংবা খুনাস) বিনতে খিজাম বর্ণিত হাদীসটি স্মরণীয়। তিনি নিজে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
তাহার পিতা তাহাকে বিবাহ দেন, অথচ তিনি সাইয়্যেবা- পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা। তিনি এই বিবাহ পছন্দ করেন নাই- এই বিবাহে রাযী হন নাই। পরে তিনি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিয়া তাহার অসম্মতি জানাইলে রাসূলে করীম (স) তাঁহার পিতার দেওয়া বিবাহকে প্রত্যাখ্যান করিয়া দেন।
মুসনাদে আহমাদে এই মেয়েটির পরিচয় দিয়া বলা হইয়াছে, এই মেয়েটির একবার বিবাহ হইয়াছিল। পরে সে স্বামীহীনা হয়। তখন তাহার পিতা তাহার মতের বিরুদ্ধে বিবাহ দেন। তখন এই বিবাহ বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়া নবী করীম (স) ফরমান জারী করিলেনঃ
****************************************
তাহার নিজের বিবাহের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাহার অধিকারই বেশী। অতএব তাহাকে তাহার নিজের ইচ্ছামত স্বামী গ্রহণের জন্য ছাড়িয়া দাও।
ফলে এই মেয়েটি যাহাকে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিল, তাহাকেই বিবাহ করিল।
ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, পূর্বে স্বামী প্রাপ্তা মেয়েকে তাহার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামী গ্রহণে বাধ্য করা যাইবে না। করা হইলে তাহা সেই মেয়ের ইচ্ছামত বাতিল হইয়া যাইবে।
(***************)
কিন্তু মেয়ে সাইয়্যেবা- পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা নয়, কুমারী- তাহার প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র। এই পর্যায়ের মেয়ের বিবাহ ব্যাপারে রাসূলে করীম (স) এর পূর্বোদ্ধৃত বাণীর শেষাংশ। তাহা হইলঃ
****************************************
এই কথাটির সঠিক তাৎপর্য সম্পর্কে বিভিন্ন মতের উল্লেখ হইয়াছে। ইমাম শাফেয়ী, ইবনে আবূ লাইলা, ইমাম আহমাদ ও ইসহাক প্রমুখ ফিকাহবিদগন বলিয়াছেনঃ কুমারী মেয়ের বিবাহে তাহার অনুমতির গ্রহণ করার জন্য শরীয়াতের স্পষ্ট নির্দেশ রহিয়াছে। অভিভাবক যদি পিতা হয় কিংবা দাদা হয়, তাহা হইলে মেয়ের অনুমতি গ্রহণ মুস্তাহাব। এইরূপ ক্ষেত্রে অভিভাবক যদি মেয়ের মত জানিতে না চাহিয়াও বিবাহ দেয় তবে সে বিবাহ সহীহ হইবে। কেননা পিতা বা দাদা এমন অভিভাবক, কন্যার প্রতি যাহার স্নেহ মমতা ও সার্বিক কল্যাণ কামনা সকল প্রকার সন্দেহ বা প্রশ্নের উর্ধ্বে। অভিভাবক যদি পিতা বা দাদা ছাড়া অন্য কেহ হয়, তাহা হইলে মেয়ের সন্তুষ্টিমূলক অনুমতি গ্রহণ ওয়াজিব। এইরূপ অনুমতি ব্যতিরেকে মেয়ের বিবাহ কোনক্রমেই সহীহ হইতে পারে না। কিন্তু ইমাম আওজায়ী ও ইমাম আবূ হানীফা প্রমুখ কূফী ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেনঃ
****************************************
প্রত্যেক পূর্ণ বয়স্কা কুমারী মেয়ের বিবাহে তাহার অনুমতি গ্রহণ ওয়াজিব।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
পূর্ণ বয়স্কা ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্না মেয়ে যদি অভিভাবক ছাড়াই নিজে বিবাহিতা হয়, তবে ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আবূ ইউসুফের মতে তাহার এই বিবাহ কার্যকর হইবে। তবে ইমাম মুহাম্মদের মতে এই বিবাহ অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষ থাকিবে।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ তিনি বলিলেনঃ
****************************************
ইয়া রাসূল! কুমারী মেয়ে তো বিবাহের অনুমতি দিতে লজ্জাবোধ করে। তাহা হইলে তাহার অনুমতি পাওয়া যাইবে কিরূপে? রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তাহার চুপ থাকাটাই তাহার অনুমতি ও রাযী থাকা বুঝাইবে।
মুসলিম শরীফে রাসূলে করীমের এই কথাটির ভাষা হইলঃ ************** ‘তাহার চুপ থাকাই তাহার অনুমতি’- এই কথাটি সাধারণভাবে প্রত্যেক বয়স্কা কুমারী মেয়ে এবং প্রত্যেক অভিভাবকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মেয়ের নিকট যথারীতি অনুমতি চাওয়া হইবে। অনুরূপভাবে অভিভাবকের সম্মতিও জানিতে চাওয়া হইবে। ইহাদের কেহ চুপ থাকিলে- হ্যাঁ বা না কিছু না বলিলে- ধরিয়া লইতে হইবে যে, প্রস্তাবিত বিবাহে তাহার অনিচ্ছা বা অমত নাই, বরং সম্মতিই রহিয়াছে। ইমাম নববী লিখিয়াছেন: ********************* ;ইহাই সঠিক, যথার্থ ও সহীহ বিধান’। অন্যান্য হাদীসবিদগণ লিখিয়াছেনঃ অভিভাবক যদি পিতা বা দাদা হয়, তাহা হইলে তাহার অনুমতি গ্রহণ মুস্তাহাব। জিজ্ঞাসার পর চুপ থাকিলে অনুমতি আছে বুঝিতে হইবে। কিন্তু অভিভাবক যদি এই দুইজন ব্যতিরেকে অন্য কেহ হয়- যেমন ভাই, চাচা, মামা, নানা ইত্যদি- তাহা হইলে মেয়ের স্পষ্ট সশব্দ উচ্চারিত অনুমতি আবশ্যক। কেননা মেয়ে পিতা বা দাদার নিকট লজ্জায় চুপ থাকিতে পারে; ইহা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অন্যদের বেলায় এই লজ্জার মাত্রা অতটা হওয়া স্বাভাবিক বিবেচিত হইতে পারে না। অবশ্য জমহুর হাদীস-ফিকাহবিদদের মতে, সব অভিভাবকের বেলায়ই কনের চুপ থাকাটা অনুমতির সমার্থবোধক হইবে। ইহাকে বলিতে হইবে ‘মৌন সম্মতি’। কেননা এ ব্যাপারে হাদীসের ভাষঅ সাধারণ ও ব্যাপক এবং লজ্জা কুমারী মেয়ের শালীনতার পরিচায়ক বিধায় সর্বক্ষেত্রেই প্রকট হইতে পারে। তবে অ-কুমারী- সাইয়্যেবার ব্যাপারে মৌন সম্মতি যথেষ্ট বিবেচিত হইবে না। সেখানে সশব্দ অনুমতির উচ্চারণ আবশ্যক, সে অভিভাবক যে-ই হউক না কেন। ইহাতে কোন মতবিরোধ নাই। কেননা ইতিপূর্বে একবার সে এইরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়াছে। সে বিবাহের ফলে স্বামী কর্তৃক সঙ্গমকৃত ও সতীত্বের আবরণ ছিন্ন হউক, আর না-হউক, তাহাতে কোন পার্থক্য হইবে না। শাফেয়ী ও অন্যান্য সব ফকহী মযহাবে একথা স্বীকৃত যে, কুমারী মেয়ের চুপ থাকাটাই যে তাহার সম্মতি ও অনুমতির সমার্থবোধক, এ কথা প্রকাশ করিয়া বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে মালিকী মাযহাবের কিছু সংখ্যক ফিকাহবিদ ইহার শর্ত করেন। ইহা প্রকাশ করা যে ভাল, সে বিষয়ে মালিকী মাযহাবের সকলেই একমত।
এখানে আর একটি প্রশ্ন আলোচিতব্য। তাহা হইল, বিবাহের শুদ্ধতায় অভিভাবকের অনুমতি কি শর্ত? এ প্রসঙ্গে ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেনঃ
****************************************
হ্যাঁ, অভিভাবকের সম্মতি ব্যতীত কুমারী মেয়ের বিবাহ সহীহ হইবে না। এই সম্মতি বিবাহের শুদ্ধতার জন্য শর্ত।
আর ইমাম আবূ হানীফা (র) বলিয়াছেনঃ
****************************************
অভিভাবকের সম্মতি ও অনুমতি অ-কুমারী-সাইয়্যেবা মেয়ের বিবাহ শুদ্ধ হওয়অর জন্য শর্ত নয়। কুমারী বালিগা মেয়ের ক্ষেত্রেও নয়। বরং কুমারী বালিগা মেয়ে তাহার অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীতই নিজের বিবাহের সিদ্ধান্ত নিজেই গ্রহণ করিতে পারে।
ইমাম আবূ সওর বলিয়াছেন, কুমারী বালিগা মেয়ে তাহার অভিভাবকের অনুমতি লইয়া নিজের বিবাহের সিদ্ধান্ত নিজেই লইতে পারে। কিন্তু অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া তাহা জায়েয নয়।
দায়ূদ যাহেরী বলিয়াছেন, কুমারী মেয়ের বিবাহে অভিভাবকের সম্মতি একটা জরুরী শর্ত। সাইয়্যেবা মেয়ের জন্য নয়।
ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ীর দলীল হইল, রাসূলে করীম (স)- এর প্রখ্যাত হাদীস ************* ‘অভিভাবক ছাড়া বিবাহ নাই- হয় না’। এই কথাটির স্পষ্ট প্রতিপাদ্য হইল, অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হইলে তাহা শুদ্ধ হইবে না। আর দায়ূদ বলিয়াছেনঃ মুসলিম শরীফের উপরোদ্ধৃত হাদীসে কুমারী ও অকুমারী মেয়ের বিবাহে সুস্পষ্ট পার্থক্য ঘোষিত হইয়াছে। সে অনুযায়ী সাইয়্যেবা নিজের ব্যাপারে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। আর কুমারী মেয়ের অনুমতি লওয়ার শর্ত করা হইয়াছে।
শাফেয়ী, মাযহাবের পক্ষ হইতে ইহার জবাবে বলা হইয়াছে যে, অকুমারী- অর্থাৎ সাইয়্যেবা মেয়ে- ‘অধিক অধিকার সম্পন্না’ বলার অর্থই হইল এই অধিকার সম্পূর্ণ নিরংকুশ নয়। ইহাতে তাহার অধিকারের সঙ্গে অভিভাবকের অধিকারও স্বীকৃত। তবে একথা সঠিক যে, সাইয়্যেবা মেয়েকে অভিভাবকের মতে চাপ দিয়া বাধ্য করা যাইবে না। আর স্বামী কে হইবে তাহা নির্ধারণেও মেয়ের বকক্তব্যই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।
আবূ সওর তাঁহার মতের সমর্থনে একটি হাদীসের উল্লেখ করিয়াছেন। হাদীসটি এইঃ
****************************************
যে মেয়েই তাহার অভিভাবকের অনমুতি ব্যতিরেকে বিবাহ করিবে, তাহারই সে বিবাহ বাতিল গণ্য হইবে।
ইহার যৌক্তিকতা এখানে যে, ওলী বা অভিভাবক সব সময়ই মেয়ের উপযুক্ত এবং ভাল বর-এর নিকট বিবাহ দিতে ইচ্ছুক ও সচেষ্ট থাকে। যেন পরে কোন দিক দিয়াই লজ্জার, অপমানের বা দুঃখের কারণ না ঘটে। এমতাবস্থায় অভিভাবকের অভিমত অনুযায়ী বিবাহ হইলে এই দিকটি পুরাপুরি রক্ষা পায়। কেননা অভিভাবক সর্বদিক বিচার করিয়াই বিবাহে অনুমতি দিবে, ইহাই স্বাভাবিক।
ইমাম তিরমিযী উপরোদ্ধৃত হাদীস নিজ গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়া ইহাকে ************* ‘উত্তম সনদভিত্তিক হাদীস’ বলিয়া নিজে মন্তব্য করিয়াছেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও তিনি লিখিয়াছেন, জুহরী বর্ণিত এই হাদীসটির সনদের ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ আপত্তি তুলিয়াছেন। এই কারণে এই হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ বলা যাইতে পারে। স্বয়ং ইমাম জুহরীও এই হাদীসটিকে অপছন্দ করিয়াছেন। আর হাদীসের বর্ণনাকারী নিজেই যদি তাহার বর্ণিত হাদীসকে অপছন্দ করেন, তা হইলে সে হাদীসটি মিথ্যাও হইতে পারে, তাহাতে বিস্মৃতিও লাগিতে পারে। আর কোন হাদীসের ক্ষেত্রে তাহা ঘটিলে তাহা গ্রহণযোগ্যতা হারাইয়া ফেলে অনিবার্যভাবে।
(*************************)
এমতাবস্থায় বলা যায়, মেয়ের বিবাহ অভিভাবকের অনুমতির অপরিহার্যতা সহীহ হাদীস হইতে প্রমাণিত নয়।
ইমা আবূ হানীফা (র) ক্রয়-বিক্রয়ের উপর কিয়াস করিয়াছেন। অভিভাবক ছাড়াই যখন ক্রয় বিক্রয় করারও তাহার অধিকার রহিয়াছে, তখন তাহার নিজের বিবাহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাহার অধিকার অবশ্যই স্বীকার্য। যেসব হাদীসে অভিভাবকের অনুমতির শর্তের উল্লেখ রহিয়অছে, ইমাম আবূ হানীফার মতে তাহা কেবলমাত্র ক্রীতদাসী ও নাবালেগা মেয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এই পর্যায়ে সর্বশেষে উল্লেখ্য এই যে, নাবালেগা মেয়েল অভিভাবকরা তাহার বিবাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিবাহ দিতে পারে। দিলে তাহা শরীয়াতের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ জায়েয হইবে। নাবালেগা’র বিবাহ অবশ্য বাঞ্ছনীয় নয়। সর্বক্ষেত্রে তাহা শুভ পরিণতি আনিবে- সে দাবি করা যায় না।
(*******************)
****************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, একটি যুবতী মেয়ে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল। অতঃপর বলিলঃ ইয়া রাসূল! আমার পিতা আমাকে তাহার ভ্রাতুষ্পুত্রের নিকট বিবাহ দিয়াছে। সে আমার দ্বারা তাহার নীচতা-হীনতাকে উচ্চ-উন্নত বাইতেছে। নবী করীম (স) এই ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করার দায়িত্ব তাহার উপর ন্যাস্ত করিয়া দিলেন। তখন মেয়েটি বলিলঃ আমার পিতা যাহা করিয়াছে আমি উহা অক্ষুন্ন, অব্যাহত ও অপরিবর্তিত রাখিলাম। কিন্তু আমার ইচ্ছা হইয়াছে, আপনি মহিলাদিগকে এই কথা শিক্ষা দিবেন যে, এই ক্ষেত্রে আসলে পিতাগণের কোন কিছু করার ক্ষমতা নাই।
(আবূ দায়ূদ, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, বায়হাকী দারে কুতনী)
ব্যাখ্যাঃ বায়হাকী ও দারে কুতনী বলিয়াছেন, এই হাদীসটি ‘মুরসাল’। অর্থাৎ হযরত আয়েশা (রা) হইতে হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন আবদুল্লাহ ইবনে কুরাইদা। কিন্তু আবদুল্লাহ নিজে হযরত আয়েশা হইতে ইহা সরাসরি শুনিতে পান নাই। মাঝখানে একজন বর্ণনাকারী- অর্থাৎ হযরত আয়েশা (রা) হইতে নিজে শুনিয়া যিনি ইহা প্রথম বর্ণনা করিয়াছেন, তাঁর নাম অনুল্লেখিত। কিন্তু তবুও হাদীস হিসাবে ইহা সহীহ। ইবনে মাজাহ গ্রন্হে ইহা সঠিক সনদে- আবদুল্লাহ তাঁহার পিতার মুরাইজা হইতে- হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। এই সন্দ নির্ভূল ও সহীহ।
হাদীস উল্লেখিত মেয়েটির অভিযোগের সারমর্ম হইল, তাহার পিতা তাহাকে নিজের পছন্দ মত পাত্রের নিকট বিবাহ দিয়াছে, এই পাত্র হইতেছে পিতার ভাই-পুত্র। অর্থাৎ মেয়েটির চাচাতো ভাই। কিন্তু ছেলেটি ছিল অত্যন্ত হীন ও নীচ স্বভাব-চরিত্রের লোক। মেয়েটি তাহাকে আদৌ পছন্দ করিতে পারে নাই। স্বামী হিসাবে তাহাকে মানিয়া লইতে তাহার মন প্রস্তুত হইতে পারিতেছিল না। এইরূপ বিবাহ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, হীন-নীচ স্বভাব-চরিত্রের ছেলে ভাল স্বভাব চরিত্রের মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে পাইলে সে হয়ত পরিণামে ভাল হইয়া যাইবে। কিন্তু মেয়েটি এই মতলবকে আদৌ সমর্থন করিতে পারে নাই। তাহার মতে ইহা অশোভন বিবাহ। সব কথা শুনিয়অ নবী করীম (স) এই বিবাহ ব্যাপারে কিছু একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইখতিয়ার মেয়েটিকেই দান করেন। অর্থাৎ বলেন, এই বিবাহ বহাল রাখা বা না রাখা ও ভাঙ্গিয়া দেওয়া মেয়েটির ইচ্ছাধীন। সে ইচ্ছা করিলে এই বিবাহ অস্বীকার করিতে ও ভাঙিয়াও দিতে পারে। মেয়েটি বলিল, আমার পিতা যাহা করিয়াছে আমি তাহা খতম করিয়া দিতে চাহিনা। পিতার অমর্যাদা হয় এমন কাজ আমি করিব না। কিন্তু ইহার মাধ্যমে নারীকূলের জন্য একটা নীতিমূলক শিক্ষা হইয়া যাওয়া উচিত। এই শিক্ষা আপনিই তাহাদিগকে দিবেন। সে শিক্ষাটি হইল, মেয়েদের বিবাহ শাদীর ব্যাপারে বাপদের নিজেদের ইচ্ছামত কিচু করার কোন অধিকার নাই।
হাদীস এইখানেই শেষ। মেয়েটির প্রস্তাব ও অনুরোধের জওয়াবে নবী করীম (স) কি বলিলেন বা কি করিলেন, এখানে তাহার উল্লেখ নাই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই পর্যায়ের অন্যান্য বহু ঘটনা হইতেই একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এই প্রস্তাবটি নবী করীম (স)-এর নিকট আগ্রাহ্য ও প্রত্যাখ্যঅন হয় নাই। মেয়েদের বিবাহের ব্যাপারে পিতাদের মৌলিকভাবেযে কিছুই করার নাই, মেয়েটির এই কথাকে নবী করীম (স) প্রত্যাখ্যান বা বাতিল করিয়া দেন নাই। উপরন্তু বিবাহের ক্ষেত্রে মেয়ের নিজের মতের গুরুত্ব যে অনেক বেশী রাসূলে করীম (স) নিজে সেই গুরুত্ব দিয়াছেন, তাহা বহু সংখ্যক হাদীস ও হাদীসের উল্লেখিত ঘটনাবলী হইতে নিঃসন্দেহে জানা যায়। বস্তুত বিবাহে মেয়ের নিজের মতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী। এই ব্যাপারে বাপদের তেমন কোন ক্ষমতা বা ইখতিয়ার ইসলামী শরীয়াতে দেওয়া হয় নাই। ইসলামের বিবাহ বিধানেই এই কথা স্বীকার্য ও ঘোষিত।
হযরত জাবির (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
এক ব্যক্তি তাহার কুমারী কন্যাকে বিবাহ দেয়, কিন্তু সে তাহার কন্যার নিকট হইতে এই ব্যাপারে অনুমতি গ্রহণ করে নাই। পরে মেয়েটি নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া এই বিবাহে তাহার অনুমতি নেওয়া হয় নাই এবং ইহাতে তাহার মতও নাই বলিয়া জানায়। নবী করীম (স) সমস্ত কথা শুনিয়া এই বিবাহ বাতিল করেন এবং উভয়কে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেন।
(নাসায়ী)
ইহা হইতে স্পষ্ট জানা গেল, পূর্বে বয়স্কা কুমারী মেয়ের মত ও অনুমতি ছাড়াই যদি পিতা-ও তাহার ইচ্ছামত বিবাহ দেয়ে, তবে মেয়ে ইচ্ছা করিলে এই বিবাহ বাতিল করিবার জন্য সরকারের নিকট আবেদন করিতে পারে এবং সরকার তদন্ত করিয়া ব্যাপার সত্য দেখিতে পাইলে এই বিবাহ ভাঙিয়া উভয়কে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করিয়া দিতে পারে। তবে বিবাহ ভাঙিয়া দেওয়ার এই ইখতিয়ার নাবালেগা মেয়ের বালেগ হওয়ার মুহুর্ত পর্যন্ত সীমিত। সেই মুহুর্তে এই বিবাহের প্রতিবাদ বা বিরুদ্ধতা না করিলে প্রমাণিত হইবে যে, সে এই বিবাহ মানিয়া লইয়াছে। তবে অতঃপর তাহা ভাঙিয়া দেওয়ার অধিকার থাকিবে না।
বিবাহে সাক্ষী গ্রহণ
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ স্বৈরিনী-ব্যভিচারিণীরাই নিজেদের বিবাহ কোনরূপ সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতীত নিজেরাই সম্পন্ন করিয়া থাকে।
(তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটি নিজ গ্রন্হে উদ্ধৃত করিয়া এ সম্পর্কে বক্তব্য প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন, এই হাদীসটি বহু কয়টি সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু তাহার মধ্যে কেবলমাত্র একটি সূত্রই সহীহ। সায়ীদ ইবনে আরুব প্রমুখ এই হাদীসটি হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর নিজের উক্তি ****** হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর কথা (****) হিসাবে নয়। তবে আবদুল আ’লা এই হাদীসটিকে রাসূলে করীমের কথা (********) হিসাবেই বর্ণনা করিয়াছেন এবং ইহাকে গ্রহণযোগ্য হাদীস মনে করিয়াছেন। কেননা আবদুল আ’লা সিক্কাহ বর্ণনাকারী। এতদ্ব্যতীত এই হাদীসটি ভিন্নতর ভাষায় হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন, হযরত আনাস, হযরত মুয়ায ও হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতেও বর্ণিত হইয়াছে।
হযরত আবূ হুরাইরা (রা) বর্ণিত হাদীসটির ভাষা এইঃ
****************************************
কোন মেয়ে নিজের বিবাহ নিজেই সম্পন্ন করিবে না। কেননা কেবলমাত্র ব্যভিচারিনীই নিজের বিবাহ নিজে সম্পন্ন করে।
এই শেষ বাক্যটির অর্থ, যে মেয়ে নিজের বিবাহ নিজেই সম্পন্ন করে, সেই ব্যাভিচারীনী।
ইমাম তিরমিযী আরও লিখিয়াছেন, নবী করীম (স)- এর সাহাবী এবং তাঁহাদের পর তাবেয়ী ও তাবে’তাবেয়ীগণ এই হাদীস অনুযায়ী আমল করিতেন। অর্থাৎ হাদীসটি তাঁহাদের নিকট গ্রহীত হইয়াছিল এবং এই হাদীসটির সত্যতায় তাঁহাদের মনে কোন আপত্তি ছিল না। এই হাদীসটিকে রাসূলে করীমের কথা হিসাবে তাঁহারা মানিয়া লইয়াছিলেন।
আর ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) বর্ণিত হাদীসের ভাষা এইঃ
****************************************
অভিভাবক এবং দুইজন বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য সাক্ষীর উপস্থিতি ছাড়া বিবাহ হইতে পারে না।
অর্থাৎ অভিভাবক ও সাক্ষী ছাড়া বিবাহ হইলে তাহা শরীয়াত মুতাবিক বিবাহ হইবে না। আর শরীয়াত মুতাবিক বিবাহ না হইলে নারী-পুরুষের যৌন মিলন ব্যভিচার ছাড়া আর কিছুই নয়।
দারে কুতনী এই হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মুহাররর ইহার একজন বর্ণনাকারী। কিন্তু সে মতরুক, তাহার বর্ণিত হাদীস পরিত্যাক্ত, অগ্রহণযোগ্য। ইমাম জায়লায়ী বলিয়াছেন, বিবাহে সাক্ষী-প্রমাণের অপরিহায্যতা পর্যায়ে বিভিন্ন শব্দ ও ভাষায় মোট এগারজন সাহাবী হইতে হাদীস বর্ণিত হইয়াছেন।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসটি এইঃ
****************************************
অভিভাবক ও দুইজন বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য সুবিচারক সাক্ষী ব্যতীত বিবাহ হয় না। যে বিবাহ ইহা ছাড়া হইবে, তাহা বাতিল।
আর যে বিবাহ বাতিল, অশুদ্ধ, তাহার পর নারী-পুরুষের যৌন মিলন সুস্পষ্ট ব্যভিচার।
দারে কুতনী উদ্ধৃত অপর একটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে এই ভাষায়ঃ
****************************************
অভিভাবক, বর এবং দুইজন সাক্ষী- এই মোট চারজন ব্যক্তি বিবাহ অনুষ্ঠানে অপরিহার্য।
আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানীর মতে এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী- আবূ হাবীব নাফে ইবনে মায়সারাতা- ************ অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি।
ইমাম শাফেয়ী হাসান হইতে ‘মুরসাল’ হিসাবে প্রথমোদ্ধৃত হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, এই হাদীসটির সনদ যদিও বিচ্ছিন্ন (**********), তবুও অধিকাংশ মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদ এই হাদীসটি গ্রহণ করিয়াছেন।
হযরত আনাস ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত আর একটি হাদীসের ভাষা এইরূপঃ
****************************************
চার ব্যক্তি ছাড়া বিবাহ হয় না। তাহারা হইলঃ প্রস্তাবকারী, অর্থাৎ বিবাহেচ্ছু বর, অভিভাবক এবং দুইজন সাক্ষী।
এই হাদীসের সনদে মুগীরা ইবনে শু’বা একজন বর্ণনাকারী। ইমাম বুখারীর মতে সে ************* তাহার বর্ণিত হাদীস অগ্রহণযোগ্য।
হাদীসের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাতা তাইয়্যেবী বলিয়াছেন, প্রথমোক্ত হাদীসে যে ********** -এর কথা বলা হইয়াছে, ইহার অর্থ সাক্ষী। ইহা ছাড়া কেবল ব্যভিচারিনীরাই বিবাহ করে বলিয়া ঘোষণা দেওয়া হইয়াছে। এই ধরনের বিবাহ মূলত ব্যীভচারী- ব্যভিচারিণীর যৌন সঙ্গমের জন্য পারস্পরিক চুক্তি বিশেষ, ইহা বিবাহ নয়। ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আবূ হানীফাও এই কথাই বলিয়াছেন। ইহার অর্থ ****** বা অভিভাবকও হইতে পারে। তখন হাদীসের তাৎপর্য হইবে, অভিভাবকের মতে অনুমতি ও উপস্থিতি ব্যতীত যে বিবাহ, তাহা কখনই শুভ, সুন্দর ও শোভন হইতে পারে না। সাক্ষী বা অভিভাবক ব্যতীত ‘বিবাহে’র প্রতি রাসূলে করীম (স)-এর অত্যন্ত কঠোর মনোভাব প্রকাশিত হইয়াছে। এই ধরনের ‘বিবাহ’কে তিনি ‘বিবাহ’ বলিয়া মানিয়া লইতেই প্রস্তুত নহেন। কেননা বাহ্যত উহা জ্বেনা বা ব্যভিচার ছাড়া আর কিছুই নয়।
হাদীসে দুইজন বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য সাক্ষীর উপস্থিতির কথা জোরালোভাবে বলা হইয়াছে। এই সাক্ষীদ্বয় দুইজন পুরুষ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। দুইজন পুরুষ পাওয়া না গেলে- বিশেষজ্ঞদের মতে- একজন পুরুষ ও দুইজন মহিলার উপস্থিতিতেও বিবাহ অনুষ্ঠিত হইতে পারে। ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল ও ইসহাক রাহওয়াই এই মত দিয়াছেন। ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন, সাক্ষীদ্বয়কে অবশ্যই পুরুষ হইতে হইবে। পুরুষ সাক্ষী ছাড়া বিবাহ শুদ্ধ ও সহীহ হয় না।
‘হেদায়া’ গ্রন্হে বলা হইয়াছে, বিবাহ অনুষ্ঠানে সাক্ষী জরুরী। কেননা হাদীসে বলা হইয়াছে ****************** ‘একাধিক সাক্ষী ছাড়া বিবাহ হইতে পারে না’। কিন্তু ইমাম মালিক বিবাহে সাক্ষীর শর্ত করেন নাই। শর্ত করিয়াছেন প্রচারের- জানান দেওয়ার। হানাফী-ফিকাহর একটি মতে সাক্ষ্য দেওয়ার বা সাক্ষী হওয়ার ব্যাপারে পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। পুরুষ বা মেয়ে যে-কোন দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতেই বিবাহ হইতে পারে।
ইমাম শাওকানী এই পর্যায়ের সবকয়টি হাদীস উদ্ধৃত করার পর লিখিয়াছেনঃ
বিবাহে সাক্ষীর প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই স্বীকার্য। এই মত যাঁহারা প্রকাশ করিয়াছেন, তাঁহাদের মত-ই যর্থাথ। কেননা এই পর্যায়ে বর্ণিত হাদীস সমূহ পরস্পরের পরিপূরক ও সমর্থক। হাদীসে যে ************** বলা হইয়াছে, ইহার অর্থ ‘বিবাহ শুদ্ধ হয় না’। এই কথাটি স্পষ্ট জানাইয়া দেয়া যে, বিবাহে সাক্ষ্য শর্তরূপে গণ্য। কেননা যাহা না হইলে কোন কিছু শুদ্ধ হয় না তাহা উহার শর্ত মনে করিতে হইবে।
এই সাক্ষীর বিশ্বস্ত ও ন্যায়বাদী-সাত্যবাদী হওয়া পর্যায়ে দুইটি মত রহিয়াছে। কাসেমীয়া ও ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন, ইহার গুরুত্ব অবশ্যই স্বীকৃতব্য। আর জায়দ ইবনে আলী, আহমদ ইবনে ঈসা ও ইমাম আবূ হানীফা ইহার উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করেন নাই। কিন্তু শেষোক্ত মতটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা হযতর ইমাম ইবনে হুসাইন ও হযরত আয়েশা (রা) প্রমুখ সাহাবী বর্ণিত হাদীসে বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য সত্যবাদী সাক্ষীর উপ উপস্থিতিকে জরুরী বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে।
(****************************************)