হাদীস শরীফ
চতুর্থ খণ্ড
সামাজিক জীবন
সামাজিক জীবনের দায়-দায়িত্ব
****************************************
হযরত আবূ সায়ীদ আল-খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ তোমরা পথে-ঘাটে আসন গ্রহণ করা পরিত্যাগ কর। সাহাবীগণ বলিলেনঃ ইয়া রাসূল! পথে-ঘাটে বসা আমাদের জন্য অপরিহার্য হইয়া পড়ে। আমরা সেখানে বসিয়া পারস্পরিক কথা-বার্তা বলি। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তোমরা এই বসা হইতে বিরত থাকিতে যখন অস্বীকার করিতেছ, তখন বস, তবে সেই সঙ্গে পথের অধিকার পুরাপুরি আদায় কর। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেনঃ পথের অধিকার কি হে রাসূল! বলিলেনঃ দৃষ্টি নিম্নমুখী রাখা, পীড়ন বন্ধ করা, সালামের প্রত্যুত্তর দেওয়া এবং ভাল-ভাল কাজের আদেশ করা ও মন্দ-নিষিদ্ধ কাজ হইতে বিরত রাখা।
(বুখারী, মুসলিম, আবূ দায়ূদ)
ব্যাখ্যাঃ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ও সমাষ্টিকতা ছাড়া মানুষের জীবন অচল। এই সামাজিক জীবনে মানুষকে অন্যান্য মানুষের সহিত নানাবাবে সম্পর্ক সংশ্রব রাখিতে হয়। ইহা ছাড়া মানুষের উপায় নাই। মানুষের এই সামাজিক-সামষ্টিক জীবনে রাস্তা-ঘাটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। কেননা এই রাস্তা-ঘাটে জনগণের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ হইয়া যায়। এই সাক্ষাৎই তাহাদের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়িয়া তোলে। সামাজিক মানুষের পরস্পরের কথা-বার্তা হয় পথে-ঘাটে। জোট বাঁধিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া তাহারা কথা-বার্তা বলে ও নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করিয়া থাকে। ইহা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু রাস্তা-ঘাটে ভিড় করা বা দাঁড়াইয়া থাকা অনেক সময় সমাজেরই অন্যান্য মানুষের পক্ষে বিশেষ ক্ষতিকর হইয়া দাঁড়ায। সৃষ্টি করে নানারূপ অসুবিধা। ইহা অবাঞ্ছনীয়। ইহা ছাড়া পথে দাঁড়ানোর কিছু দায়-দায়িত্বও রহিয়াছে। পথে দাঁড়াইলে তাহা অবশ্যই পালন করিতে হইবে।
পথে দাঁড়াইবার এই সব দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সাহাবীগণকে সতর্ক করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে প্রথমে তিনি বলিরেনঃ *********** ‘রাস্তা-ঘাটে বসা হইতে তোমরা নিজদিগকে দূরে রাখ’। হযরত আবূ তালহা বর্ণিত অপর এক হাদীসে বলা হইয়াছেঃ ********** নবী করীম (স) বলিলেনঃ এই রাস্তা-ঘাটে না বসিলে তোমাদের কি হয়? তোমরা রাস্তা-ঘাটে বসা পরিহার কর’। কিন্তু রাস্তা-ঘাটে বসা বা দাঁড়ানো কিংবা চলা-ফিরা করা সামাজিক মানুসের জন্য অপরিহার্য, তাহা সত্ত্বেও রাসূলে করীম (স) ইহা করিতে নিষেধ করিলেন কেন? মূলত নিষেধ করাই তাঁহার উদ্দেশ্যে নয়, উদ্দেশ্যে হইল এই ব্যাপারে আপতিত দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সাহাবীগণকে সতর্ক ও সচেতন করিয়া তোলা। এজন্য প্রথমেই নিষেধকরা কথার উপর গুরুত্ব আরোপের জন্য রাসূলে করীমের (স) একটা বিশেষ স্টাইল। এইভাবে কথা বলিলে শ্রোতৃমণ্ডলি স্বভাবতঃই ইহার কারণ জানিবার জন্য উৎকর্ণ হইয়া উঠিবে- হইয়াছেও তাহাই। এই কথা শুনয়াই সাহাবীগণ বলিলেনঃ ইহা না করিয়া আমাদের উপায় নাই। আমরা রাস্তা-ঘাটে বসিয়া পরস্পরে কথা-বার্তা বলিয়া থাকি। এই কথা-বার্তা তো বলিতৈই হইবে। তখন নবী করীম (স) রাস্তা-ঘাটে বসার দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তাঁহাদিগকে অবহিত করিলেন। বলিলেনঃ তোমরা রাস্তা-ঘাটে বসা হইতে বিরত থাকিতে যখন প্রস্তুত নহ, তখন রাস্তা-ঘাটের যে অধিকার তোমাদের উপর বর্তে, তাহা যথাযথভাবে আদায় করিতে তোমাদিগকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে।
রাস্তা-ঘাটের কি অধিকার, তাহা জানিতে চাহিলে রাসূলে করীম (স) পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের উল্লেখ করিলেন। এই পাচঁটি কাজ যথাক্রমেঃ (১) দৃষ্টি নিম্নমুখী রাখা, (২) কষ্টদান বা পীড়ন উৎপীড়ন বন্ধ করা, (৩) সালঅমের জওয়াব দেওয়া, (৪) ভাল ও সৎ পূণ্যময় কাজের আদেশ করা এবং (৫) অন্যায়, মন্দ ও পাপ কাজ হইতে নিষেধ করা।
রাসূলে করীম (স) এই যে পাঁচটি কাজের উল্লেখ করিলেন পথ-ঘাটের অধিকার হিসাবে, মূলত ইহা ইসলামী সমাজ জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজ গুলি না করিলে পথে-ঘাটে বসার অধিকার থাকে না যেমন, তেমন ইসলামী সমাজে বসবাস করাও অধিকার থাকিতে পারে না। পথে-ঘাটে বসার- অন্য কথায় সামাজিক জীবন যাপন করার তোমার যে অধিকার, তাহা যদি তুমি ভোগ করিতে চাও, তাহা হইলে তোমাকে পথ-ঘাট –তথা সমাজের অধিকার আদায় করিতেও প্রস্তুত থাকিতে হইবে। ইহা তোমার কর্তব্য। তুমি তোমার অধিকার আদায় করিয়া নিবে, কিন্তু তোমার কর্তব্য তুমি পালন করিবে না, ইসলামে ইহা সম্ভব নয়। ইসলামী জীবন-আদর্শ মানুষ ও পৃথিবকে পারস্পরিক অধিকার কর্তব্য রজ্জুতে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া দিয়াছে। এই বন্ধনে একটা হইবে আর অন্যটা হইবে না, তাহা হইতে পারে না। কর্তব্য কয়টির ব্যাখ্যা করিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, ইসলামী সমাজের জন্য ইহার সবকয়টি একান্তই অপরিহার্য।
সর্বপ্রথম কর্তব্য হইল চক্ষু নিম্নমুখী রাখা। নিজ চরিত্র নিষ্কুলষ রাকার জন্য চক্ষু নিম্নমুখী রাখা জরুরী। কেননা পথে কেবল পুরুষ লোকই চলাফিরা করে না, মেয়ে লোকও চলা-ফিরা করিতে পারে, করিয়া থাকে। পুরুষরা যদি পথে বসিয়া বা দাঁড়াইয়া থাকিয়া চলাচলকারী স্ত্রীলোকদের প্রতি চক্ষু উন্মীলিত করিয়া রাখে এবং রূপ সৌন্দর্য ও যৌবন দেখিয়া চক্ষুকে ভারাক্রান্ত করিতে থাকে, তবে উহার কুফল তাহার চরিত্রে অনিবার্যভাবে প্রবিফলিত হইবে। পক্ষান্তরে মেয়ে লোক পথে চলিতে গিয়া যদি অনুভব করে যে, পুরুষদের চক্সু তাহাদিগকে গিলিয়া ফেলিতে ব্যস্ত, তবে তাহাদের মনে কুণ্টা ও সংকোচ আসিয়া তাহাদের গতিরোধ করিতে পারে। তাহাদের কোন দুর্ঘটনার শিখার হইয়া পড়াও অসম্ভব নয়। রাসূলে করীম (স) এই কারণেই একথাটির উল্লেখ করিয়াছেন সর্বপ্রথম।
রাসূলে করীম (স)-এর এই আদেশটি স্পষ্ট ও সরাসরিভাবে কুরআন মজীদ হইতে গৃহীত। আল্লাহ তা’আলা নিজেই রাসূলে করীম (স)কে সম্বোধন করিয়া ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
হে নবী! মু’মিন লোকদিগকে বলিয়া দিন, তাহারা যেন নিজেদের দৃষ্টিকে নিম্নমুখী রাখে এবং তাহাদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা সংরক্ষণ করে। ইহাই তাহাদের জন্য পবিত্রতর কর্মপন্হা। লোকেরা যাহা কিছু করে সে বিষয়ে আল্লাহ পুরাপুরি অবহিত।
এ আয়াতে ‘গদ্দে বাচার’- ******- এর স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। হাদীসেও ঠিক এই শব্দই ব্যবহৃত হইয়াছে। ইহা হইতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, কুরআনে উল্লেখ বাণী সমূহে রাসূলে করীম (স) নিজের ভাষায় প্রসংগত উল্লেখ করিয়া জনগণকে ইসলামের বিধান বুঝাইয়াছেন। ইহার উদ্দেশ্যে পুরুষদিগকে চক্ষু নিচু- নিম্নমুখী রাখিতে নির্দেশ দেওয়া। কুরআন মজীদে পর্দার বিধানের প্রসঙ্গে এই নির্দেশটি উদ্ধৃত হইয়াছে। চক্ষু নিচু রাখিতে বলা হইয়াছে কোন জিনিস হইতে, তাহা আয়াতে বলা হয় নাই। উদ্ধৃত হাদীসটিতেও উহার উল্লেখ নাই। কিন্তু ইহা স্পষ্ট সর্বজনবোধ্য যে, ভিন-গায়র মুহাররাম-স্ত্রী লোকদের প্রতি চক্ষু উন্মীলিত করিয়অ তাকাইতে নিষেধ করা হইয়াছে।
বস্তুত চক্ষু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ স্পর্শকাতর এবং মর্মস্পশী। চক্ষু যাহাতে মুগ্ধ হয়, হৃয়দ তাহাতে বিগলিত না হইয়া পারে না। ইন্দ্রিয় নিচয়ের মধ্যে ইহার কার্যকরতা অত্যন্ত তীব্র, শাণিত। এই কারণে মানুষ এই চক্ষুর দরুন বহু পাপ কাজে লিপ্ত হইয়া পড়ে। আয়াতটির আলোকেও বুঝা যায়, চক্ষু অবনত রাখা না হইলে লজ্জা স্থানের পাপ পংকিলতায় পড়িয়া যাওয়া সুনিশ্চিত। আর চক্ষু অবনত রাখা হইলে উহার সংরক্ষণ অতীব সহজ ও সম্ভব। চরিত্রকে পবিত্র রাখার ইহাই সর্বোত্তম পন্হা। যাহারা নিজেদের দৃষ্টি পরস্ত্রীর উপর অকুণ্ঠভাবে নিবন্ধ করে, তাহারা প্রথমে নিজেদের মন-মগজকে কলুষিত করে এবং পরিণতিতে নিপতিত হয় কঠিন পাপের পংকিল আবর্তে। ইহাই স্বাভাবিক।
এই কারণে সর্বপ্রকার হারাম নিজিস হইতে দৃষ্টি নিচু ও অবনত রাখিতে হইবে। এই আদেশ উপরোক্ত কেবলমাত্র পুরুষদের জন্যই দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু এই আদেশ স্ত্রী লোকদের জন্যও। ইহারই পরবর্তী আয়াতে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
হে নবী! স্ত্রীলোকদিগকে বল, তাহারা যেন তাহাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং এইভাবে তাহাদের লজ্জাস্থানকে অপবিত্রতা হইতে রক্ষা করে।
অতএব পুরুষদের জন্য যেমন ভিন মেয়ে লোক দেখা হারাম, তেমনি স্ত্রীলোকদের জন্যও ভিন পুরষ দেখা হারাম। এই পর্যায়ে রাসূলে করীমের একটি কথা উদ্ধৃত করা আবশ্যক। তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
আত্মসম্মান চেতনা ঈমানের লক্ষণ এবং নারী পুরষের একত্রিত হওয়া মুনাফিকির কাজ।
**** অর্থঃ নারী পুরুষের একত্রে সমাবেশ, নিবিড় নিভৃত একাকীত্বে ভিন নারী পুরুষের একত্রিত হওয়া। ইহা সর্বোতভাবে চরিত্র ধ্বংসকারী অবস্থা।
দ্বিতীয় হইল কষ্টদান বা পীড়ন উৎপীড়ন বন্ধ করা, ইহা হইতে বিরত থাকা। ইহার অর্থ পথে চলমান মানুষের সর্বাত্মক নিরাপত্তা বিধান। তুমি পথে বসিয়া বা দাঁড়াইয়া থাকিয়া লোকদিগকে কোনরূপ কষ্ট দিতে পারিবে না। কাহাকেও কোন পীড়াদায়ক কথা বলিতে পারিবে না। এমন কাজও কিছু করিতে পারিবে না, যাহাতে মানুষের কষ্ট হয়।
তৃতীয় সালামের জওয়াব দান। অর্থাৎ তুমি পথে বসিয়া বা দাঁড়াইয় থাকিলে চলমান মুসলমান তোমাকে সালাম দিবে। তোমার কর্তব্য হইল সেই সালামের জওয়াব দান। এই সালাম দেওয়া ও উহার জওয়াব দেওয়া ইসলামী সমাজ ও সভ্যতা সংস্কৃতির একটা অত্যন্ত জরুরী অংশ। মুসলমান মুলমানকে দেখিলে বলিবেঃ আস-সালামু আলাইকুম। আর ইহার জওয়াবে মুসলমান বলিবেঃ অ-আলাইকুমুস সালাম। ইহা ইসলামের চিরন্তন রীতি। সালাম বিনিময় মুসলমানদের একটা সামাজিক কর্তব্য-ও।
চতুর্থ, আমরু বিল মা’রূফ-ন্যায়, ভাল ও সৎ কাজের আদেশ করা। **** ‘মা’রূফ’ একটি ইসলামী পরিভাষা। কুরআন মজীদে ইহার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। আল্লামা আইনী ইহার অর্থ লিখিয়াছেনঃ
****************************************
‘মা’রূফ’ বলিতে এটা ব্যাপকজিনিস বুঝায়। যাহাই আল্লাহর আনুগত্যের কাজ, যাহাতেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় এবং জনগণের কল্যাণ সাধিত হয়। আর শরীয়াত যে সব নেক ও কল্যাণময় কাজের প্রচলন করিয়াছে, তাহা সবই ইহার অন্তর্ভুক্ত।
পঞ্চম, মুনকার হইতে বিরত রাখা। মারূফ-এর বিপরীত যাহা তাহাই মুনকার। সব রকমের খারাপ, কুৎসিত, জঘন্য, হারাম ও ঘৃণ্য অপছন্দনীয়, তাহা সবই মুনকার-এর মধ্যে শামিল। আবু দায়ূদের বর্ণনায় ইহার সহিত একটি অতিরিক্ত কথা উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহা হইলঃ
****************************************
পথ দেখাইয়া দেওয়া বা পথের সন্ধান দেওয়া এবং হাচিঁদাতা যদি আল-হামদুলিল্লাহ’ বলে, তাহা হইলে ****** আল্লাহ তোমাদিগিকে রহমাত করুন’ বলা।
এই দুইটিও পথের অধিকার ও পথের প্রতি কর্তব্য বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। অপর একটি বর্ণনায় এই সঙ্গে আরও একটি কথা উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহা হইলঃ ******* ‘উত্তম কথা বলা’। অর্থাৎ পথে-ঘাটে লোকদের পারস্পরের দেখা সাক্ষাৎ হইলে কথা-বার্তা অবশ্যই হইবে। এ কথা-বার্তা খুবই-ই উত্তম এবং ভাল হওয়া বাঞ্ছনীয়। কোনরূপ কটু বা অশ্লীল কথা বলা কিছুতেই উচিৎ হইতে পারে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনুজ্জুবাইর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
বৈঠকগুলি শয়তানের চক্র। বৈঠকের লোকেরা ‘হক’ দেখিতে পাইলে তাহা গ্রহণ করে না এবং ‘বাতিল’ দেখিতে পাইলে তাহার প্রতিরোধ করেন না।
তিরমিযী শরীফে এই পর্যায়ে যে হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে তাহার ভাষা এইরূপঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) আনছার গোত্রের কতিপয় লোকের নিকট উপস্থিত হইলেন। এই লোকেরা পথের উপরে বসিয়া ছিল। তাহাদিগকে দেখিয়া তিনি বলিলেনঃ তোমরা যদি এই কাজ একান্ত কর-ই এবং এই কাজ না করিয়া তোমাদের কোন উপায় না-ই থাকে, তাহা হইলে তোমরা মুসলমানদের সালামের জওয়াব অবশ্যই দিবে। নিপীড়িত অত্যাচারিত লোকদের সাহায্য সহযোগিতায় সক্রিয়ভাবে আগাইয়া-আসিবে এবং পথহারা অন্ধ ও পথভ্রান্ত লোকদিগকে অবশ্যই পথ দেখাইবে।
কথার মূল সুর হইল, পথের উপর বসা যথার্থ কাজ নয়। কেননা পথ হইল লোকদের চলাচল ও যাতায়াতের স্থান। এই স্থান জুড়িয়া লোকেরা বসিয়া থাকিলে পথের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হইয়া পড়ে। আর তাহাতে সামাজিক সামষ্টিক কাজ বিঘ্নিত হয়। এই কাজ সাধারণত করাই উচিৎ নয়। আর অবস্থা যদি এই হয় যে, এই কাজ তোমাদের না করিলেই নয়, তাহা হইলে এই কারণে তোমাদের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়, তাহা পালন করিতে তোমাদিগকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে। এক কথায় হয় পথে আদৌ বসিবেই না। না হয়- অর্থাৎ পথে বসিলে এই দায়িত্ব পালন করিতেই হইবে।
উদ্ধৃত তিরমিযীর হাদীসিটতে মাত্র তিনটি দায়িত্বের কথা উদ্ধৃত হইয়াছে। এই পর্যায়ের হাদীস সমূহের আরও বহু কয়টি দায়িত্ব ও কর্তব্যের উল্লেখ হইয়াছে। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এই পর্যায়ে বর্ণিত হাদীস সমূহ হইতে মাত্র সাতটি কর্তব্যের কথা প্রকাশ করিয়াছেন। (***********) ইবনে হাজার আল-আসকালানীর মতে এই দায়িত্ব ও কর্তব্য হইল মোট চৌদ্দটি। একত্রে সে চৌদ্দটি কর্তব্য এইঃ
‘সালাম বিস্তার করা, ভাল ভাল কথা বলা, সালামের জওয়াব দেওয়া, হাঁচিদাতা আলহামদুলিল্লাহ বলিলে ইয়ার হামুকাল্লাহ বলা, বোঝা বহনে লোকদের সাহায্য করা, মজলূমের উপর জুলুম বন্ধ করানো, আর্তনাদকারীর ফরিয়াদ শোনা, লোকদের সুপথ সঠিক পথ দেখানো, পথভ্রষ্টকে পথ চিনাইয়া দেওয়া, ভাল ভাল ও উত্তম কাজের আদেশ করা, খারাপ বা পাপ কাজ হইতে লোকদিগকে বিরত রাখঅ, কষ্টদায়ক জিনিস পথ হইতে দূর করা, চক্ষু নিম্নমুখী রাখা এবং বেশী বেশী করিয়া আল্লাহর যিকির করা’।
(***********)
ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ পথে ঘাটে বসিতে ও জট পাকাইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে নবী করীম (স) নিষেধ করিয়াছেন। সেই সঙ্গে তিনি এই নিষেধের কারণও বলিয়া দিয়াছেন। সে কারণ হইলঃ ইহাতে নানা দুর্ঘটনা ঘটিতে পারে। স্ত্রীলোকদের চলাফিরায় অসুবিধা হইতে পারে। অনেক সময় এই পুরুষরা চলমান স্ত্রীলোকদের প্রতি তাকাইয়া থাকে, তাহাদের সম্পর্কে বদচিন্তা ও আলাপ-আলোচনায় মশগুল হয়, তাহাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা বা উক্তি ক র। ইহাতে সাধারণ লোকদের অনেক অসুবিধাও হইতে পারে। ইহা ছাড়া চলমান লোকদের প্রতি সালাম জানানো কিংবা ভাল কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ করার দায়িত্বও ইহারা পালন করে না। আর এই গুলিই হইল এই নিষেধের প্রকৃত কারণ।
ইহা সাধারণ অবস্থায় চিত্র এবং যে নির্ভুল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। এই কারণেই নবী করীম (স) উপরোক্ত কথাগুলি বলার প্রয়োজন বোধ করিয়াছেন। বস্তুত ইসলাম পরিকল্পিত সামাজিক পরিবেশ গঠনের জন্য এই কথাগুলি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যে সমাজ পরিবেশে জনগণ এই কর্তব্য যথাযথাভাবে পালন করে তাহাই যে সর্বাপেক্ষা উত্তম সমাজ, তাহা অস্বীকার করা কাহারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
(******************)
সালাম
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যানবাহনে আরোহী পায়ে হাঁটা লোককে সালাম করিবে। পায়ে হাঁটা লোক বসিয়া থাকা লোককে সালাম করিবে এবং অল্প সংখ্যক লোক বহু সংখ্যক লোককে সালাম করিবে।
(বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ মুসলমান মুসলমানের সাক্ষাৎ পাইলে বলিবে ‘আসসলামু আলাইকুম’। ইহা ইসলামের সামাজিক বিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। চৌদ্দশত বৎসর হইতে মুসলিম সমাজে এই ধারা অব্যাহতভঅবে চলিয়া আসিয়াছে। ইহা ইসলামী সংস্কৃতির একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিয়ম। উপরে মুসলিম গ্রন্হ হইতে হাদীসটি উদ্ধৃত করা হইয়াছে। বুখারী গ্রন্হে একটি অতিরিক্ত বাক্য আসিয়াছে, যাহা উপরোদ্ধৃত বর্ণনায় নাই। তাহা হইলঃ ************** ‘ছোট বয়সের লোক বড় বয়সের লোককে সালাম করিবে। এই হাদীসে সালাম দেওয়অর একটা স্থায়ী নিয়ম বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। বস্তুত ইহা যেমন যুক্তি সংগত, তেমনি শাশ্বত ব্যবস্থা।
‘সালাম’ শব্দটি সম্পর্কে বলা যায়, ইহা আল্লাহর অসংখ্য নামের মধ্যকার একটি নাম। আবদুস-সালাম- অর্থাৎ আল্লাহর দাস- কোন ব্যক্তির নাম রাখার রেওয়াজ ইসলামী সমাজে বহু পুরাতন। এ দৃষ্টিতে ********** এর অর্থ ******** ‘সালাম’ নামটি তোমার জন্য অর্থাৎ ‘তোমার জন্য আল্লাহর নাম’। এইরূপ বলার তাৎপর্য হইলঃ ************** ‘তুমি আল্লাহর হেফাযতে আছ বা থাক’। এই কথাটি এ রকমেরই কথা, যেমন বলা হয়ঃ ********* কিংবা ***** ‘আল্লাহ তোমার সঙ্গে এবং আল্লাহ তোমার সঙ্গী হইবেন’।
কেহ কেহ বলিয়াছেন ********* অর্থ ********* শান্তি ও নিরাপত্তা তোমার জন্য অনিবার্য, অবিচ্ছিন্ন।
উপরোদ্ধৃত হাদীসে যে ‘সালাম’ দেওয়ার কথা বলা হইয়াছে, তাহা প্রথমে দেওয়অ সুন্নাত। কিন্তু ইহার জওয়াব দেওয়া ও জওয়াবে ******** বলা ওয়াজিব। ইবনে আবদুল বার প্রমুখ মনীষীগণ বলিয়াছেনঃ *********** প্রথমে সালাম দেওয়া সুন্নাত। আর উহার জওয়াব দেওয়া ফরয। যাহাকে সালাম করা হইয়াছে সে যদি একজন হয়, তাহা হইলে এই জওয়াব দেওয়া তাহার জন্য ফরযে আঈন। আর যদি একাধিক বা বহুলেকা হয় তবে উহা ফরযে কেফায়া। যে কোন একজন দিলেই ফরয আদায় হইবে। (*********) কেননা সালাম দেওয়া সম্পর্কে কুরআন মজীদে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ না থাকিলেও জওয়াব দেওয়া সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশ উল্লেখ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তোমাদিগকে যদি কোনরূপ সম্ভাষিত করা হয়, তাহা হইলে তোমরা উহাপেক্ষা উত্তম সম্ভাষণে সম্ভাষিত কর। কিংবা উহাই ফিরাইয়া দাও। জানিয়া রাখিও, আল্লাহ প্রত্যেকটি জিনিসেরই বিশেষ হিসাব গ্রহণকারী।
আয়াতের ****** শব্দের শাব্দিক অর্থ ***** ‘জীবনের জন্য দোয়া’। ব্যবহারিত অর্থ, ‘সালাম’। কুরআন মজীদের অপর একটি আয়াতে এই ‘সালাম’ শব্দটি স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হইয়াছে। আয়াতটি এইঃ
****************************************
যে লোক তোমাকে সালাম জানাইল তাহাকে তোমরা বলিও না যে, তুমি ঈমানদার ব্যক্তি নও।
এই আয়াতে উদ্ধৃত ***** অর্থ, আমাদের এখানে আলোচ্য ***** -ই। প্রথমোক্ত আয়াতের নির্দেশ হইল, তোমাকে যদি কেহ শুধু **** বলে, তাহা হইলে তুমি উহা হইতেও উত্তমভাবে জওয়াব দিবে। আর উত্তমভঅবে জওয়াব দেওয়ার অর্থ উহার জওয়াবে *********** বলা। আর তাহা না বলিলে কোন ক্ষতি নাই। তবে প্রথম ব্যক্তি যতটুকু বলিয়াছে, অন্তত অতটুকু তো বলিতেই হইবে। ইহাই আয়াতে দেওয়া নির্দেশ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, প্রথম সালাম দাতা ও উহার জওয়াব দাতা যদি এক একজন লোকও হয়, তবুও বহুবচন সম্বলিত ********** ই বলিতে হইবে। ফিকাহদি ইহরাহীম নখয়ী বলিয়াছেনঃ
****************************************
তুমি যখন একজনকে সালাম করিবে, তখন বলিবৈ আসসালামু আলাইকুম। কেননা সেই এক ব্যক্তির সঙ্গে ফেরেশতা রহিয়াছে। অনুরূপভাবে উহার জওয়াবও বহু বচনে হইবে।
ফকীহ ইবনে আবূ জায়দ বলিয়াছেনঃ
****************************************
প্রথম সালাম দাতা বলিবেঃ আসসালামু আলাইকুম। উহার জওয়াব দাতাও বলিবেঃ অ-আলাইকুমুস সালাম।
কিন্তু হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত একটি হাদীস হইতে সালামের জওয়াব দানের নিয়ম জানা যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স) তাঁহাকে বলিলেনঃ ************** হযরত জিব্রাঈল তোমাকে সালাম বলিতেছেন। জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ ************* তাহার প্রতিও সালাম, রহমত ও বরকত হউক। অর্থাৎ আসসালামু আলাইকুম-এর জওয়াবে অ-আলাইকুমুসসালাম অ-রাহমাতু ও বারাকাতুহু’ পর্যন্ত বলাই নিয়ম।
(***********)
প্রথমোক্ত আয়াতটিতে যে *********** বলা হইয়াছে, ইহাই তাহার অর্থ।
প্রথমে উদ্ধৃত হাদীসে বলা হইয়াছে, যানবাহনে আরোহী প্রথমে সালাম দিবে পায়ে হাঁটা লোককে। কেননা আরোহী ব্যক্তি বাহির হইতে আসিয়াছে। তাহার গতি বেশী পায়ে হাঁটা লোকটির তুলনায়। অনুরূপভাবে পা হাঁটিয়া আসা লোক প্রথমে সালাম দিবে দাঁড়াইয়া থাকা বা বসিয়া থাকা লোককে। এখানেও সেই কারণ। আর অল্প সংখ্যক লোক বেশী সংখ্যক লোককে প্রথমে সালাম দিবে এই জন্য যে, বেশী সংখ্যক লোকের মর্যাদা কম সংখ্যক লোকের তুলনায় বেশী। বালকদিগকে সালাম দেওয়া উচিৎ কিনা, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞগণ ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করিয়াছেন। তবে সালাম না দেওয়া অপেক্ষা দেওয়াই উত্তম। কেননা ইহা বড়দের পক্ষ হইতে ছোটদের জন্য দোয়া বিশেষ। ফিকাহবিদগণ মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, গায়র মুহারম মহিলাদিগকে পুরুষদের সালাম দেওয়া উচিত নয়। কেননা তাহাদের নামাযে আযান ইকামত বলা হইতে তাহাদিগকে যখন অব্যহতি দেওয়া হইয়াছে কণ্ঠস্বর প্রচারিত হওয়ার আশকায়, তখন সালামের জওয়াব দেওয়াও তাহাদের জন্য ওয়াজিব হইতে পারে না। আর এই কারণেই তহাদিগকে সালাম না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। যদিও হাদীসে গায়ের মুহাররম মহিলাদিগকে সালাম দেওয়অর বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত আসমা বিনতে ইয়াজীদ (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
নবী করীম (স) একদা মসজিদে গমন করিলেন, তখন একদল মহিলা সেখানে বসা ছিল। নবী করীম (স) তাহাদিগকে সালাম সহকারে হাত দ্বারা ইশারা করিলেন। ইহা হইতে সালাম দেওয়অর একটা বিশেষ পদ্ধতি জানা গেল। এই সালাম দেওয়ায় নবী করীম (স) মুখের শব্দ ও হাতের ইংগিত কে একত্রিত করিয়াছেন।
আবূ দায়ূদে উদ্ধৃত হাদীসে এখানকার শব্দ হইলঃ ********** তিনি আমাদের প্রতি সালাম করিলেন।
ইমাম বুখারী তাঁহার গ্রন্হে একটি অধ্যায় দাঁড় করিয়াছেন এই শিরোনামেঃ
****************************************
পুরুষদের সালাম করা মহিলাদিগকে এবং মহিলাদের সালাম করা পুরুষদিগকে।
ইহাতে তিনি দুইট হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। একটি হাদীসে বলা হইয়াছে সাহাবায়ে কিরামের সেই বৃদ্ধকে সালাম করার কথা, যিনি জুময়ার দিন তাহাদিগকে খাবার আগাইয়া দিতেছিলেন। আর দ্বিতীয় হাদীসটি হইল, নবী করীম (স) হযরত আয়েশা’র নিকট হযরত জিবরাঈলের (আ) সালাম পৌঁছাইয়া দিলেন। এইভাবে ইমাম বুখারী পুরুষ-নারীর পারস্পরিক সালাম বিনিময় করা মাকরূহ- এই মতের প্রতিবাদ করিয়াছেন। তবে কোনরূপ নৈতিক বিপদের আশংকা না থাকিলে এই সালাম বিনিময় জায়েয বটে। আর নবী করীম (স)-এর ব্যাপারে এইরূপ কোন আশংকা না-থাকাই যখন নিশ্চিত, তখন তাঁহার জন্য ইহা জায়েয হওয়াতে কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না। তাই কেহ যদি নিজেকে এই আশংকামুক্ত মনে করে, তবে সে-ও সালাম বিনিময় করিতে পারে। অন্যথায় চুপ থাকাই বাঞ্ছনীয়। মুহাদ্দিস আবূ নয়ীম একটি হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
পুরুষরা মহিলাদের সালাম দিবে, মহিলারা পুরুষদের সালাম দিবে না।
কিন্তু ইহার সনদ একেবারে বাজে।
এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস উল্লেখ্য। হযরত উম্মে হানী (রা) বলিয়াছেনঃ
আমি নবী করীম (স) এর নিকট আসিলাম। তখন তিনি গোসল করিতেছিলেন। আমি তাঁহাকে সালমা দিলাম।
ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ বহু সংখ্যক মহিলা একত্রে থাকিলে তাহাদিগকে পুরষরা সালাম করিতে পারে। আর যদি একজনমাত্র মহিলা হয়, তবে অন্যান্য মেয়েলোক তাহার স্বামী ও অন্যান্য মুহাররম পুরুষরাই শুধু সালাম করিবে- সে মেয়ে লোকটি সুন্দরী হউক কিংবা নয়, অন্যরা করিবেনা।
(**************)
মহিলাদের সমাবেশকে সম্বোধন করিতে হইলে তখন প্রথমে আসসালামু আলাইকুম বলা ইসলামী রীতিসম্মত। হযতর উমর (রা)কে মহিলাদের এক সমাবেশকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিবার জন্য রাসূলে করীম (স) পাঠাইয়াছিলেন। তিনি দরজায় দাড়াইয়া সালাম দিলেন। মহিলারা ভিতর হইতে উহার জওয়াব দিয়াছিলেন।
(আবূ দায়ূদ **********)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
‘আসসালাম’ মহান আল্লাহ তা’আলার বহু সংখ্যক নমের মধ্যকার একটি নাম। এই নামটিকে তিনি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করিয়াচেন। অতএব তোমরা পরস্পরিক ক্ষেত্রে ইহার ব্যাপক বিস্তার সাধন কর।
ইমাম বুখারী এই হাদীসটি রাসূলে করীম (স)-এর একটি কথা হিসাবেই তাঁহার আদাবুল মুফরাদ গ্রন্হে উদ্ধৃত করিয়াছেন।
হযরত আনাস (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমরা সাহাবীরা রাসূলের সহিত একত্রে থাকিতাম। সেখান হইতে উঠিয়া যাওয়ার পর আমাদের মাঝে একটি গাছও আড়াল হইয়া পড়িলে অতঃপর আমরা আবার যখন সাক্ষাত করিতাম আমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করিতাম’।
ইহারই সমর্থন পাওয়া যায় ফিকাহবিদ আদুল্লাহ ইবনে যাকারিয়ার কথায়, তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবীগণ এক সাথে চলিতে চলিতে পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইতেন। তখন তাঁহাদের মধ্যে একটি গাছের আড়াল হওয়ার পরও আবার যদি একত্রিত হইতেন, তাহা হইলে তাঁহারা পরস্পরকে সালাম দিতেন। নামায পড়িতে কিংবা কুরআন পাঠ করিতে থাকা লোককে সালাম দেয়া উচিৎ নয়। যদি দেওয়া হয় তবে সে অংগুলির ইশারায় উহার জওয়াব দিতেও পারে। আর নামাজ ও কুরআন শেষ করিয়াও দিতে পারে। অবশ্য প্রাকৃতিক ডাকের কোন কাজ পায়খানা-পেশাব ইত্যাদি পর্যায়ের করিতে থাকলে সেই অবস্থায় কাহাকেও সালাম দেওয়া সম্পূর্ণ অবাঞ্ছনীয়। এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)কে এইরূপ অবস্থায় সালাম দিলে পরে তিনি বলিলেনঃ
****************************************
তুমি যখন আমাকে এইরূপ অবস্থায় পাও বা দেখ, তখন আমাকে সালমা দিও না। কেননা সালাম দিলে তখন আমি উহার জওয়াব দিতে পারিব না।
(**********)
সালাম’ পারস্পরিক ভালবাসা সৃষ্টির মাধ্যম
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, যাঁহার হাতে আমার প্রাণ তাঁহার শপথ, তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করিবে না যতক্ষণ না তোমরা ঈমান আনিবে এবং তোমরা ঈমানদার হইবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালবাসিবে। আমি কি তোমাদিগকে এমন কাজের কথা জানাইব না যাহা করিলে তোমরা পরস্পরকে ভালবাসিতে পারিবে? তাহা হইলঃ তোমরা সকলে পারস্পরিক সালামের ব্যাপক প্রচার ও বিস্তার কর।
(তিরমিযী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসটিও হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। তবে বর্ণিত হাদীসটি ‘সালাম’ পর্যায়ে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ ভাবে এইজন্য যে, নবী করীম (স) মূল কথাটি বলার পূর্বে আল্লাহর নামে শপথ করিয়াছেন। কিন্তু আল্লাহ শব্দটি বলা হয় নাই, বলা হইয়াছে, যাঁহার হাতে আমার প্রাণ রহিয়াছে তাঁহার শপথ। প্রাণীর প্রাণ কাহার মুঠোর মধ্যে? ইহা সর্বজন বিদিত ও স্বীকৃত যে, প্রাণীর প্রাণ মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলারই বিশেষ দান। তিনি এই প্রাণ দিয়াছেন বলিয়াই আমরা দুনিয়ায় জীবন লাভ করিয়াছি ও বাঁচিয়া আছি। কিন্তু এই জীবন বা প্রাণ আমার নিজস্ব কোন সম্পদ নয়, উহা লইয়া আমরা যাহা ইচ্ছা করিতে পারি না। আমার দেহাভ্যন্তরে উহার স্থিতি হইলে উহার উপর পুর্ণ ও নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও আধিপত্য একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই প্রতিষ্ঠিত। কোন প্রাণীরই প্রাণ আল্লাহর নিয়ন্ত্রন মুক্ত নয়। যে কোন মুহূর্তে তাঁহার দেওয়া প্রাণ তিনিই টানিয়া দেহ হইতে বাহির করিয়া নিতে পারেন। অথচ প্রাণী সাধারণ প্রাণ পাইয়া এই কথাটি বেমালূম ভুলিয়া যায এবং জীবনে যাহা ইচ্ছা করিতে থাকে। কিন্তু প্রত্যেক প্রাণীরই যে মৃত্যু নির্দিষ্ট ও অবশ্যম্ভাবী তাহা কোন মৃহূর্তেই ভূলিয়া যাওয়া উচিত নয়। মানব দেহ জৈব রাসায়নিক উপাদানে তৈরী। কিন্তু এই জৈব রাসায়নিক উপাদান সমূহ যৌগিক রূপ পরিগ্রহ করিলেই তাহাতে প্রাণের সঞ্চার স্বতঃই হইয়া যায় না। আল্লাহ-ই এই প্রাণটা সেই যৌগিক উপাদান গঠিত দেহে নিজে ফুঁকিয়া দেন। কুরআন মজীদে প্রাণী-জীবন্ত মানুষ সৃষ্টির এই নিয়মের কথাই বলা হইয়াছে। রাসূলে করীমের এই শপথ সেই তত্ত্বের দিকে ইংগিত করিতেছে না এমন কথা কেহ বলিতে পারে না।
কিন্তু কথার পূর্বে এইরূপ শপথের তাৎপর্য কি? কোন গুরুত্বপূর্ণ ও তত্ত্বমূলক কথা বালার পূর্বে এইরূপ ভাষায় শপথ করাই ছিল রাসূলে করীম (স)-এর স্থায়ী নিয়ম। আলোচ্য হাদীসে এই শপথের পর যে কথাটি বলা হইয়াছে তাহা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাহা সহজেই বুঝা যায়।
ইমাম নববী মুল কথাটির ব্যাখায় বলিয়াছেনঃ ‘তোমরা ঈমানদার হইবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকেক ভালবাসিবে’ এই কথার তাৎপর্য হইলঃ ‘তোমাদের ঈমান পূর্ণত্ব লাভ করিবে না এবং ঈমানদার হিসাবে তোমাদের বাস্তব জীবন ব্যস্থা গড়িয়া উঠিবে না পারস্পরিক ভালবাসা ছাড়া’। পাস্পরিক ভালবাসা না হইলে ঈমানই হইবে না, ঈমানের পরও বেঈমান-ঈমানহীন-ই থাকিয়া যাইবে, এমন কথা নয়। আসলে রাসূলে করীম (স) মূলত প্রকৃত ঈমানের যে পরিচয়, তাহাই বলিয়াছেন, এইরূফ বলিয়া। আর আমাদের ভাষায় তাহা হইল পূর্ণ ঈমান। আর পূর্ণ ঈমান না হইলেই মানুষ সম্পূর্ণ বেঈমান হইয়া গেল এমন কথা বুঝা যায় না।
কিন্তু রাসূলে করীম (স)-এর প্রথম বাক্যটি সম্পূর্ণ যথার্থ। তাহা হইলঃ ‘তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করিবে না ঈমান না আনিলে’। ইহা স্পষ্ট ও সত্য কথা। জান্নাতে প্রবেশের প্রথম শর্তই হইল ঈমান। বেঈমান লোক কখনই বেহেশতে যাইতে পারিবে না, ইহা স্বতঃসিদ্ধ।
শেয়খ আবূ আমর এই হাদীসের অর্থ বলিয়াছেনঃ *********** ‘পারস্পরিক ভালবাসা না হইলে তোমাদের ঈমান পুর্ণ হইবে না’। আর পূর্ণ ঈমান না হইলে বেহেশতে প্রবেশ সম্ভব হইবে না।
মূল কথাটির দ্বিতীয় ভাগে আবার গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যেই রাসূলে করীম (স) শ্রোতৃমণ্ডলির নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াছেনঃ ‘তোমাদিগকে কি এমন একটা বিষয়ে বলিব না যাহা করিলে তোমাদের পরস্পরে ভালবাসা সৃষ্টি হইবে’? অর্থাৎ পারস্পরিক ভালবাসা না হইলে ঈমান পূর্ণ হইবে না। পূর্ণ ঈমান না হইলে বেহেশতে যাইতে পারিবে না। এইটুকু কথা বলিয়াই নবী করীম (স) তাঁহার দায়িত্ব পালিত হইয়াছে মনে করিতে পারেন নাই। কেননা এই ভালবাসা সৃষ্টির উপায়টা বলিয়া দেওয়াও তাঁহারই দায়িত্ব, সেই দায়িত্বই তিনি পালন করিয়াছেন কথার শেষাংশে পেশ করিয়া। তাহা হইলঃ তোমরা পারস্পরিক ‘সালাম’ প্রচার ও প্রসার বিস্তার কর ব্যাপক ভাবে। হাদীস ব্যাখ্যাতা তাইয়্যেবী বলিয়াছেনঃ
****************************************
এই কথায় সালাম বিস্তার করাকে পারস্পরিক ভালবাসা সৃষ্টির কারণ বলা হইয়াছে এবং পারস্পরিক ভালবাসাকে কারণ করিয়াছেন পূর্ণ ঈমানের।
কেননা পারস্পরিক সালামের বিস্তারই পারস্পরিক ভালবাসা ও বন্ধুতার কারণ।উহার ফলেই পারস্পরিক প্রীতি, আন্তরিকতা ও মুসলিমদের মধ্যে সামষ্টিকতা ও সংহতি সৃষ্টি হইতে পারে। আর ইহার ফলেই দ্বীন পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পাইতে পারে, ইসলামের বাণী চতুর্দিকে ব্যাপক প্রচর ও বিস্তার লাভ করিতে পারে।
‘সালাম’ দ্বারা পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক গড়িয়া উঠে। কিন্তু এই সালাম দেওয়া না হইলে পারস্পরিক বিচ্ছেদ নিঃসম্পকতা ও মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির পরিবর্তে বিরাট ভাঙন ও বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়া অবধারিত। ইহা ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতি ব্যবস্থার প্রতি পরম ঐকান্তিকতার লক্ষণ ও প্রমাণ। ইবনুল হাজার-আল- আসকালানী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
লোকদের মধ্যে সালাম প্রচারের অর্থ উহার প্রচলনকে জীবন্ত ও অব্যাহত রাখা্
বস্তুত মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য, অপর মুসলমানদের সাক্ষাৎ পাওয়া মাত্র সালাম দেওয়া, আসসালামু আলাইকুম’ বলা- সে ব্যক্তিগতভাবে পারিচিত হউক কি অপরিচিত। মুল্লা আলী-আলকারী লিখিয়াছেনঃ
সালাম দেওয়া সুন্নাত এবং এই সুন্নাত ফরয হইতেও উত্তম।কেননা উহাতে ব্যক্তির বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ পায়। এবং ইহার ফলে ওয়াজিব আদায় করার অর্থাৎ সালামের জওয়াব দেওয়ার সুযোগ ঘটে। একজন সালাম দিলেই না উহার জওয়াব দেওয়া যাইতে পারে। এই জওয়াব দান ওয়াজিব।
শুরাইহ ই বনে হানী তাঁহার পিতা (হানী) নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ তিনি বলিলেনঃ
****************************************
‘হে রাসূল! আমাকে এমন একটি কাজ জানাইয়া দিন, যাহা করিলে আমার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হইয়া যাইবে’। রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ মিষ্ট মধুর কথা বলা এবং ‘সালাম’ দেওয়া এবং লোকদের খাবার খাওয়ানো।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
এক ব্যক্তি নবী করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন ধরনের ইসলাম পালন উত্তম? তিনি বলিলেনঃ খাবার খাওয়াইবে, সালাম বলিবে যাহাকে চিন তাহাকে, যাহাকে চিন না তাহাকেও।
এই সালাম দিতে হইবে প্রথমেই এবং কথাবার্তা বলার পূর্বেই। রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ ********* ‘কথা বলার পূর্বে সালাম দিতে। অপর একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ ************* ‘সালাম না দেওয়া পর্যন্ত কাহাকেও খাইবার জন্য ডাকিবে না।
হযরত ইবনে উমর (রা) প্রায়ই বলিতেনঃ
****************************************
তোমরা সালাম ছড়াইয়া দাও, খাবার খাওয়াও এবং পরস্পর ভাই হইয়া যাও যেমন আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দিয়াছেন।
আল্লাহ নির্দেশ দিয়াছেন বলিয়া ইংগিত করা হইয়াছে কুরআনের আয়াতের দিকে। সূরা আলে-ইমরানে বলা হইয়াছেঃ **************** তোমরা হইয়া গেলে আল্লাহর অনুগ্রহে ভাই ভাই। আর সূরা আল-হুজরাতে বলা হইয়াছেঃ ***** ‘মু’মিনগণ পরস্পর ভাই’। হযরত ইবনে উমরের কথার তাৎপর্য হইল, সালাম ছড়াইয়া দিলে ও খাবার খাওয়াইলে তোমরা পরস্পর সেই ভাই হইয়া যাইতে পারিবে যাহার নির্দেশ আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে দিয়াছেন।
(***********)
হযরত আনাস (রা) বর্ণিত হাদীস হইলঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) আমাকে বলিয়াছেনঃ হে প্রিয় পুত্র! তুমি যখন তোমার পরিবার বর্গের নিকট ঘরে প্রবেশ করিবে, তখন সালাম দিবে। তাহা হইলে ইহা তোমার ও তোমার ঘরস্থ পরিবার বর্গের জন্য বরকতের কারণ হইবে।
এই হাদীসটির সনদে আলী ইবনে জায়দ ইবনে জাদয়ান একজন বর্ণনাকারী। মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে এই বর্ণনাকারী যায়ীফ হইলেও ইমাম তিরমিযীর বিচারে যায়ীফ নহেন।
(*********)
এই পর্যায়ে একটি প্রশ্ন এই যে, সালাম তো কেবল মুসলমানদের জন্য। কিন্তু যেখানে মুসলিম অমুসলিম একত্রে আছে, সেখানে কিভাবে সালাম দেয়া যাইবে? ইহার জওয়াব পাওয়া যাইবে এই হাদীসেঃ হযরত উসামা ইবনে জায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
নবী করীম (স) এমন একটি মজলিসে উপস্থিত হইলেন, যেখানে মুসলমান ও ইয়াহুদী সংমিশ্রিত ছিল। তখন নবী করীম (স) সকলের প্রতি ‘আসসালমু আলাইকুম’ বলিলেন।
বুখারী মুসলিমের বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
মুসলমান, মুশরিক, মুর্তিপূজারীও ইয়াহুদী সংমিশ্রিত ছিল।
ইহা সত্ত্বেও নবী করীম (স) সকলকে সালাম দিলেন। ইমাম নবব লিখিয়াছেন, ‘এইরূপ মুসলিম-অমুসলিম সংমিশ্রিত লোকদের মজলিসে সাধারণ ভাবে সালাম করাই সুন্নাত। তবে মনের লক্ষ্য থাকিবে শুধু মুসলমানদের প্রতি সালাম করা।
(************)
স্পষ্ট ভাষায় আসসালামু আলাইকুম বলার পরিবর্তে কোনরূপ অংগ ভংগী করিয়া সম্ভাষণ করা ইসলামী সংস্কৃতির পরিপন্হী। রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমাদের হইতে ভিন্ন লোকদের সহিত যে সাদৃশ্য করিবে, সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়। তোমরা ইয়াহুদী বা খৃস্টানদের সহিত সাদৃশ্য করিও না। ইয়াহুদীদের সম্ভাষণ অংগুলির ইশারা আর নাছারাদের সম্ভাষণ হাতের ইংগিত।