মুসলমানদের সামাজিক দায়িত্ব
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ একজন মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের অধিকার পাঁচটি । একজন মুসলমানের কর্তব্য তাহার ভাইর সালামের জওয়াব দেওয়া, হাঁচি দাতার দোয়ার জওয়াবে দোয়া করা, আহবান করিলে উহা কবুল করা ও যাওয়া, রোগীক দেখিতে যাওয়া এবং দাফনের জন্য গমনকারী লাশের অনুসরন করা।
(মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ মুসলমানকে সামাজিক জীবন যাপন করিতে হয়। তাই তাহাকে ব্যক্তিগত ভাবে যেমন ইসলামের নিয়ম নীতি পালন করিতে হয়, তেমনি বহু সামাজিক কর্তব্য দায়িত্বও তাহাকে পালন করিতে হয়। এই সামাজিক কর্তব্য ও দায়-দায়িত্বের তালিকা অনেক লম্বা, বহু দিকে তাহা সম্প্রসারিত। উপারোদ্ধৃত হাদীসে মাত্র পাঁচটি সামাজিক দায়িত্বের কথা বলা হইয়াছে। ইহা কোন চূড়ান্ত তালিকা নয়। বরং এই কয়টি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের কর্তব্য ও দায়িত্ব। সামাজিকতার দৃষ্টিতে বিচার করিলে সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকারের বহু কয়টি পর্যায় দেখা যাইবে। এই কয়ীট একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের। বস্তুত প্রাথমিক পর্যায়ের এই দায়িত্ব-কর্তব্য কয়টিকে খুবই সামান্য নগণ্য ও গুরুত্বহীন মনে করা হইতে পারে। কিন্তু এই প্রাথমিক ও সামান্য দায়িত্ব-কর্তব্য কয়টিই পালন করিতে প্রস্তুত হইল না; কিংবা যথাযথ ভাবে পালন করিল না, সে যে বৃহত্তর ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করিতে প্রস্তুত হইবে বা যথাযথভাবে পালন করিবে, তাহার ভরসা কি করিয়া করা যাইতে পারে?
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) যে আদর্শ সমাজ গঠন করার দায়িত্ব লইয়া আসিয়াছিলেন, তাহাতে প্রাথমিক পর্যায় হইতে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সমস্ত সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সুন্দর রূপে সজ্জিত ও সুবিন্যস্ত।[] প্রাথমিক পর্যায়ে এই কর্তব্য ও দায়িত্ব ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে। ইহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রহিয়াছে ব্যক্তিতে-সামষ্টিতে- ব্যক্তিতে রাষ্ট্রে।
উপরোদ্ধৃত হাদীসে যে পাঁচটি হক বা অধিকারের কথা বলা হইয়াছে, তাহা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আরোপিত। যদিও ইহাই শেষ কথা নয়।
যে পাঁচটি হক্ক বা অধিকারের কথা বলা হইয়াছে তন্মধ্যে প্রথম হইল সালামের জওয়াব দান। এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা পূর্ববর্তী হাদীসে পেশ করা হইয়াছে। দ্বিতীয়টি হইল ******* -****** অর্থঃ হাঁচিদাতা- যে হাঁচি দেয় তাহার কর্তব্য হইল, সে ***** বলিবে। অতঃপর শ্রোতা বলিবেঃ ******** ‘আল্লাহ তোমাকে রহমাত দান করুন’। এইরূপ বলাকেই পরিভাষায় বলা হয় *********। ফিকাহবিদ লাইস বলিয়াছেনঃ ************ প্রত্যেকটি ব্যাপারে আল্লাহর স্মরণই হইল ***** হাঁচি দাতাকে ***** বলা এইরূপ যিকর মাত্র। এই যিকর এর প্রয়োজন দেখা দেয় হাঁচিদানকারীর জন্য। কেননা হাঁচিটি দৈহিক বিকৃতি কম্পন ও সংকোছনের বহিপ্রকাশ। এইরূপ হাঁচি একবার হইতে হইবে। একাধিক বার হইলে বুঝিতে হইবে এই হাঁচি সর্দির দরন এবং তাহাতে এইরূপ নিয়ম নাই। এইরূপ হাঁচিদাতাকে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ ******* তুমি সর্দিতে আক্রান্ত। হাঁচি উঠিলে কি করা উচিত এই পর্যায়ে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
নবী করীম (স) যখন হাঁচি দিতেন, তখন তিনি তাঁহার হাত বা কাপড় দ্বারা তাঁহার মুখমণ্ডল ঢাকিয়া ফেলিতেন ও এই উপায়ে তদজনিক শব্দকে চাপিয়া রাখিতেন।
(আবূ দায়ূদ, তিরমিযী, হাকেম)
ইবনুল আরাবী ও ইবনুল হাজার আল আসকালানী এই হাদসের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ হাঁচি দাতার সামাজিক সৌজন্য মূলক নীতি হইল, সে উহার শব্দ চাপিয়া রাখিবে ও উচ্চস্বরে খোদার হামদ করিবে এবং মুখমন্ডল ঢাকিয়া ফেলিবে। কেননা এই সময় তাহার মুখের বিকৃতির দরুন তাহার নাক ও মুখ হইতে এমন সব জিনিস বাহির হইয়া পড়িতে পারে যাহা নিকটে বসা লোকদিগকে কষ্টে ফেলিতে পারে। এই কারণে তাহার মুখ ভিন্ন দিকে ফিরাইয়া রাখা কর্তব্য।
(********)
তৃতীয়টি হইলঃ ********** আহবান-নিমন্ত্রণ কবুল করা ও যথাস্থানে উপস্থিত হওয়া। বস্তুত একজন মুসলমান যখন অপর একজন মুসলমানকে খাওয়ার আহবান জানায়, তখন সে আহবান কবুল করা ও খাওয়ার স্থানে উপস্থিত হইয়া আহার্য গ্রহণ করা কর্তব্য। ইহা না করিলে সামাজিক জীবনের প্রাথমিক কর্তব্যটুকুও পালিত হয় না। শুধু তাহাই নয়, যে লোক উৎসাহ করিয়া এই আহবান জানায়, তাহার সব উৎসাহ উদ্দীপনা নিঃশেষ হইয়া যা। মনে মনে দুঃখ পায়, নিজেকে রীতিমত অপমানিত বোধকরে। এই পর্যন্ত আসিয়াই ব্যাপারটি থামিয়া যায় না। আহবান দাতার অন্তরে ইহার তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সে নিমন্ত্রিত ব্যক্তির প্রতি যে আন্তরিকতা পোষণ করিত তাহা শক্রতার ভাবে রূপান্তরিত হইয়া যায়। আর এইরূপ অবস্থা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইসলাম ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে আন্তরিকতা ঐকান্তিকতা-সহৃদয়তার গভীর পুততাবধারার উপস্থিতি চায়। কিন্তু এই অবস্থা উহার সম্পূর্ণ পরিপন্হী। ******** ডাকের জওয়াব দেওয়ার আর একটি অর্থ হইল কেহ কোন কাজের বা প্রয়োজনে কাহাকেও ডাকিলে সে ডাকে সাড়া দেওয়া ও উপস্থিত হওয়া কর্তব্য।
চতুর্থটি হইলঃ ******** রোগীকে দেখিতে যাওয়া। কেহ রোগাক্রান্ত হইয়া পাড়িয়াছে জানিতে পারিলে তাহাকে দেখার জন্য যাওয়া সর্বসম্মতভাবে সুন্নাত। নবী করীম (স) অতীব গুরুত্বসহকারে এই কাজটি করিতেন। কোন সময়ই ইহার ব্যতিক্রম হইতে দেখা যাইত না। রোগী আত্মীয় হউক, অনাত্মীয় হউক, পরিচিত হউক, অপরিচিত হউক, তাহার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই এই ব্যাপারে।
হযরত উম্মে সালমা (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমরা যখন কোন রোগী বা মৃতের নিকট উপস্থিত হইবে, তখন খুব ভাল কথা বলিবে। কেননা তোমরা এই সময় যাহা বলিবে, উপস্থিত ফেরেশতাগণ তাহাতে আমীন আমীন বলিয়া থাকেন।
ইমাম নববী এই হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ রোগী বা মৃতের নিকট উপস্থিত হইয়া ভাল ভাল কথা বলা এই হাদীস অনুযাযী মুস্তাহাব। ব্যক্তির জন্য দোয়া ও গুনাহমাফী চাওয়অ, তাহার কষ্ট দূর বা আসান হওয়ার কামনা করা ইহার মধ্য গণ্য। হাদীসটি হইতে ইহাও জানা গেল যে, এই সময় তথায় ফেরেশতাগণ উপস্থিত থাকেন এবং লোকদের এ পর্যায়ের কথা ও দোয়া সমর্থন করিয়া আমীন-হে আল্লাহ তাহাই হউক- হে আল্লাহ তাহাই হউক বলিয়া খোদার নিকট প্রার্থনা জানান।
পঞ্চম হইল জানাযার নামায পড়া ও মৃতের লাশ দাফনের জন্য যখন কবরস্থানে লইয়া যাওয়া হয়, তখন উহার সহিত যাওয়া। এই পর্যায়ে রাসূলে করীমের (স) বহু সংখ্যক হাদীস গ্রন্হসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হইয়াছে, নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত হইয়াছে তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
যে ব্যক্তি মৃতের জানাযা পড়িল তাহার জন্য এক ‘কীরাত’ সওয়াব এবং যে লোক লাশের অনুসরণ করে কবরে রক্ষিত (দাফন) হওয়া পর্যন্ত সঙ্গে থাকিল তাহার জন্য দুই কীরাত সওয়াব।
এই হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর এক হাদীসে রাসূলে করীমের (স) এই কথা উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
যে ব্যক্তি জানাযার নামায পড়িল কিন্তু উহার (লাশের) অনুসরণ করিল না, তাহার জন্য এক ‘কীরাত’। যদি উহার অনুসরণ করে তবে তাহার জন্য ‘দুই কীরাত’।
একজন জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ****** ‘কীরাতানে’ বলিতে কি বুঝায়? জওয়াবে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিলেনঃ
****************************************
‘দুইটি বড় পাহাড়ের মত’।
‘কীরাতানে’ (দুই কীরাত)-এর এক বচনে ‘কীরাতুন’- এক ‘কীরাত’।
‘কীরাত’ বলিতে বাস্তবিকই কি বুঝায়, এই পর্যায়ে ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
‘কীরাত’ সওয়াবের এমন একটা পরিমাণ যাহা আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন।
এই পর্যায়ের হাদীস সমূহ হইতে জানা যায়, কবরস্তানে যাওয়া ও দাফন হইতে দেখাই যথেষ্ট নয়, কবরের উপর মাটি দেওয়াও ইহার মধ্যে শামিল। অন্যথায় সওয়াব পুর্ণ মাত্রায় পাওয়া যাইবে না।
(************)
এই পর্যায়ে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীস এইরূপঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, একজন মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের হক ছয়টি। জিজ্ঞাসা করা হইল, ইয়া রাসূল, ঐগুলি কি কি? বলিলেনঃ তুমি যখন তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে তখন তাহাকে সালাম করিবে, সে যখন তোমাকে ডাকিবেন বা আহবান করিবে তুমি তাহার জওয়াব দিবে। সে যখন তোমার নিকট নসীহত চাহিবে, তুমি তাহাকে নসীহত করিবে। সে যখন হাঁচি দিবে ও খোদার হামদ করিবে, তখন তুমি তাহাকে ‘আল্লাহ তোমাকে রহমত করুন’ বলিবে। সে যখন রোগাক্রান্ত হইবে তুমি তাহাকে দেখিতে যাইবে এবং সে যখন মরিয়া যাইবে তুমি তাহার সহিত কবর পর্যন্ত যাইবে।
এই হাদীসটিতে এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের অধিকার পাঁচটির পরিবর্তে ছয়টির উল্লেখ করা হইয়াছে। আসলে এই অধিকারের কোন সংখ্যা সীমা নাই, সংখ্যা সুনির্দিষ্ট নয়। এই অধিকার অসংখ্য এবং ইহার ক্ষেত্র বিশাল। রাসূলে করীম (স) যখন যে কয়টির উল্লেখ জরুরী মনে করিয়াছেন তখন সেই কয়টিরই উল্লেখ করিয়াছেন। ইহাতে বৈপরীত্য কিছুই নাই। পূর্বের হাদীসটিতে কথার যে ধরন ছিল, এই হাদীসটিতে কথার ধরন ভিন্নতর। ইহাতে যে অতিরিক্ত অধিকারটির কথা বলা হইয়াছে, তাহা হইলঃ ********* যখন তোমার নিকট কেহ নসীহত চাহিবে, তখন তুমি তাহাকে ‘নসীহত’ করিবে। ‘নসীহত’ শব্দের অর্থঃ কাহারও মংগল ও কল্যাণ কামনা করা। ইমাম রাগেব লিখিয়াছেনঃ
****************************************
কাহারও সংশোধন বা কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে কোন কথা বলা বা কোন কাজ করার সংকল্প গ্রহণ করাই হইল ‘নসীহত’।
এই প্রেক্ষিতে ‘যদি কেহ নসীহত চায় তবে তাহাকে নসীহত করিবে’ অর্থ কাহারও কল্যাণের কোন কথা বলা বা কোন কাজ করার প্রয়েজন দেখা দিলে তাহা অবশ্যই করিতে হইবে। এই কাজ ওয়াজিব।
(*********)
মুসাফিহা ও মুয়ানিকা
****************************************
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, একব্যক্তি বলিলঃ হে রাসূল! আমাদের কেহ তাহার বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ করিলে সে কি তাহার জন্য মাথা নত করিবে? হযরত আনাস বলেন, ইহার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেন, না। লোকটি জিজ্ঞাসা করিল, তবে সে কি তাহাকে জড়াইয়া ধরিবে ও চুম্বন করিবে? রাসূলে করীম (স) বলিলেন, না। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করিল, তবে কি সে তাহার সহিত করমর্দন করিবে? রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ হ্যাঁ- যদি সে ইচ্ছা করে।
(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ সামাজিক জীবনে পরস্পরের সহিত সাক্ষাৎ করা নিত্যকার ঘটনা। কিন্তু এই পর্যায়ে প্রশ্ন হইল, দুইজন পরস্পর পরিচিত লোক একত্রিত হইলে তাহারা পরস্পরের প্রতি কিরূপ আচরণ করিবে? একজন অপর জনকে কিভাবে গ্রহণ করিবে? উপরোদ্ধৃত হাদীসটি এই পর্যায়ে লোকদের পন্হা নির্দেশ করিতেছে।
প্রশ্নকারী বলিয়াছিল, এই সময় একজন অপর জনের জন্য মাথা নত করিয়া দিবে? ****** শব্দটি ****** হইতে সঠিত। আর ইহার অর্থঃ ****** মাথা ও পীঠ ঝুঁকাইয়া দেওয়া, নত করা। রাসুলে করীম (স) কাহারও জন্য এই কাজ করিতে নিষেধ করিয়াছেন। কেননা মাথা ও পীঠ নত করাকেই ইসলামি পরিভাষায় রুকু ও সিজদা করা। আর এই রুকু ও সিজদা ইসলামী ইবাদত পর্যায়ের অনুষ্ঠান এবং ইহা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই করা যাইতে পারে।
বস্তুত মাথা ও পীঠ অবনমিত করা কাহারও প্রতি সম্মান ও ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের চূড়ান্ত রূপ। এই চূড়ান্ত রূপের সম্মান ও ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন তওহীদ বিশ্বাসী মানুষ একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া আর কাহারও জন্য করিতে প্রস্তুত হইতে পারে না। করিলে তাহা পরিষ্কার হারাম হইবে। এই কারণে নবী করীম (স) উক্ত জিজ্ঞাসার জওয়াবে স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেনঃ ‘না’।
পরবর্তী প্রশ্ন ছিল ‘জড়াইয়া ধরা’ ও ‘চুম্বন করা’ সম্পর্কে এবং ইহার জওয়াবেও নবী করীম (স) ‘না’ বলিয়াছেন বলিয়া উপরোক্ত হাদীসে উল্লেখ করা হইয়াছে। **** ‘জড়াইয়া ধরা’কে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ******** ‘মুয়ানিকা’ বা গলাগলি করা। ‘মুয়ানিকা’ বা গলাগলি করা এই হাদীস অনুযায়ী নিষিদ্ধ মনে হয়। কিন্তু তাহা ঠিক নয়। কেননা এই পর্যায়ে বহু কয়টি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে এবং তাহাতে ‘মুয়ানিকা’ গলাগলি করা সম্পূর্ণ জায়েয বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে।
হযরত বরা ইবনে আজেব (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
দুইজন মুসলমান যখন পরস্পন করমর্দন করে, দুই জনই আল্লাহর হামদ করে ও মাগফিরাত চায়, তাহাদের দুই জনকে ক্ষমা করা হয়।
হযরত আনাস হইতে বর্ণিত অপর এক হাদীসের ভাষা এইরূপঃ তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) কোন লোকের হাত ধরিয়া ছাড়িয়া দিলে তিনি অবশ্যই বলিতেনঃ হে আমাদের আল্লাহ! তুমি আমাদিগকে দুনিয়ায় মঙ্গল দাও, মঙ্গল দাও পরকালেও এবং জাহান্নামের আযাব হইতে আমাদিগকে রক্ষা কর। -এইরূপ না বলিয়া তিনি কাহারই হাত ছাড়িতেন না।
আবূ দায়ূদ (তাবেয়ী) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি হযরত বরা ইবনে আজেব (রা)-এর সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে প্রথমে সালাম দিলেন। অতঃপর আমার হাত ধরিলেন এবং আমার দিকে তাকাইয়া হাসিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ********** তুমি জান, আমি তোমার সহিত এইরূফ করিলাম কেন? আমি বলিলাম, জানি না, তবে আপনি নিশ্চয়ই ভাল’র জন্য করিয়া থাকিবেন। তখন তিনি বলিলেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। তখন তিনি আমার সহিত তাহাই করিলেন যাহা আমি তোমার সহিত করিয়াছি। অতঃপর তিনি আমাকে সেই প্রশ্নই করিলেন যাহা আমি তোমাকে করিয়াছি এবং উহার জওয়াবে আমি তাহাই বলিলাম যাহা তুমি আমাকে বলিলে। তাহার পর নবী করীম (স) বলিলেনঃ দুইজন মুসলমান পরস্পরে মিলিত হইয়া একজন অপরজনকে সালাম করিবে ও একজন অপরজনের হাত ধরিবে। – হাত ধরিবে কেবলমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে- তাহাদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়ার পূর্বেই তাহাদের গুনা মায়াফ হইয়া যাইবে।
হাদীসের অংশ *********** ধরিবে না তাহাকে বরং শুধু মহান আল্লাহর জন্য- এই কথার অর্থঃ
****************************************
এই হাত ধরার কাজে তাহাকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে অন্য কিছুই নয়- শুধু মহান আল্লাহর কারণে সৃষ্ট ভালবাসা। সে ধন বা অতীব সম্মান ও মর্যাদাশীল ব্যক্তি বলিয়া দেখানোপনার জন্য সে এই রূপ করিবে না- তবেই এই মাগফিরাত পাওয়া যাইবে।
আতা ইবনে আবদুল্লাহ আল-খুরাসানী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা পরস্পর ‘মুছাফিহা’- করমর্দন কর, তাহা হইলে ক্লেদ হিংসা বিদ্বেষ দূর হইয়া যাইবে এবং তোমরা পরস্পর উপহার তোহফার বিনিময় কর, তাহা হইলে পরস্পরে ভালবাসার সৃষ্টি হইবে এবং পারস্পরিক শক্রতা চলিয়া যাইবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নবী করীম (স) হইতে তাঁহার এই কথাটি বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
অর্থাৎ একজন মুসলমান যখন অপর মুসলমানের সাক্ষাৎ পাইবে তখন যে সালাম বিনিময় করার ব্যবস্থা রহিয়াছে, এই সালামের সম্পুর্ণতা হইল পরস্পরের হাতে হাত রাখা ও মুসাফিহা করা। কেননা মুসাফিহা করার সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
সনদের দিক দিয়া এই হাদীসটি মরফু নয়। একটি মতে ইহা আবদুর রহমান ইবনে জায়দ কিংবা অন্য কাহারও কথা। ইবনে হাজার আল-আসকালানীও এই মত সমর্থনকরিয়াছেন।
(********)
হযরত বরা ইবনে আজেব (রা) হইতে বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
দুইজন মুসলমান পরস্পর সাক্ষাত করা ও মিলিত হওয়ার পর পরস্পর মুসাফিহা করিলে তাহাদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলা সেই দুইজনকে মাফ করিয়া দিবেন্
এই হাদসি হইতে জানা গেল, দুই মুসলমানের সাক্ষাৎ কালে সালাম ও মুসাহিফা করা এবং এই সময় আল্লাহর হামদ করা ও গুনাহের মাফী চাওয়া সুন্নাত।
হযরত হুযায়ফাতা ইবনুল ইয়ামানা (রা) নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
এক মু’মিন ব্যক্তি যখন অপর মু’মিন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পাইয়া তাহাকে সালাম দেয় ও তাহার হাত ধরিয়া মুসাফিহা করে তখন এই দুই জনের গুনাহ সমূহ ঠিক সেই রকম করিয়া ঝরিয়া পড়ে যেমন করিয়া গাছের পাতা ঝরিয়া পড়ে।
এই সব কয়টি হাদীস হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, মুসলিম সমাজে সালামের সঙ্গে সঙ্গে মুসাফিহা বা করমর্দনও একটি সাংস্কৃতিক কাজ এবং ইহা রাসূলের সুন্নাত। কিন্তু ইসলামের নিছক করমর্দনের কোন মূল্য না।মুসাফিহা করার সময় প্রথমতঃ আল্লাহর হামদ করিতে হইবে এবং উভয়কেই বলিতে হইবে ************* আল্লাহ আমাদেরও মাফ করুন, মাফ করুন তোমাদেরও। সেই সঙ্গে রাসূলের প্রতি দরুদ পাঠও মুস্তাহাব। এই পর্যায়ে হে খোদা আমাদিগকে এই দুনিয়ায়ও মঙ্গল দাও, পরকালেও মঙ্গল দাও এবং জাহান্নামের আগুন হইতে বাঁচাও বলিয়া দোয়াও করা যাইতে পারে। ইহা মুস্তাহাব।
মুহাদ্দিস ইবনে বাত্তাল বলিয়াছেনঃ ইসলামে বিশেষজ্ঞ মনীষীদের মতে ‘মুসাফিহা’ খুবই উত্তম কাজ। ইমাম মালিক প্রথমে ইহাকে মাকরূহ মনে করিতেন। কিন্তু পরে তিনি মত পরিবর্তন করিয়া ইহাকে মুস্তাহাব বলিয়াছেন।
ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ ‘মুসাফিহা’ সর্বসম্মতভাবে সুন্নাত। তিনি ***** গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ ******** সর্বপ্রকার সাক্ষাৎকার কালেই মুসাফিহা করা খুবই পছন্দনীয় কাজ। তবে লোকেরা ফজর ও আছরের নামাযের পরে মুসাফিহা করার যে রেওয়াজ রহিয়াছে, শরয়াতে ইহার কোন ভিত্তি নাই। তবে তাহাতে গুনাহও নাই কিছু। শাহ অলী উল্লাহ দেহলভী মুয়াত্তার শরাহ **** গ্রন্হেও এই কথাই লিখিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, ঈদের দিনের ‘মুসাফিহা’ সম্পর্কেও এই কথাই বলিতে চাই। কেননা মূলত শরীয়াতে ইহার বিধান রহিয়াছে। এখন লোকেরা যদি ইহা বিশেষ বিশেষ সময়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে করে, তবে তাহাতে এই বিধানের তো কোন হের-ফের হইতে পারে না এবং তাহাতে কোন গুনাহের কাজ হইল, তাহা বলা যাইবে না।
ইবনুল হাজার আল-আসকালানী বলিয়াছেনঃ ‘সাধারণভাবে সকলের সঙ্গেই মুসাফিহা করা যাইবে। তবে গায়র মুহাররম মহিলা ও অল্প বয়স্ক সুশ্রী যুবক ইহার মধ্যে গণ্য নহে। অর্থাৎ ইহাদের সহিত করমর্দন বা মুসাফিহা করা জায়েয নয়।
এই মুসাফিহায় প্রত্যেকের একটি মাত্র হাত ব্যতহৃত হওয়া সুন্নাত এবং উহা ডান হাত হইতে হইবে। হানাফী শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের বিশেষজ্ঞগণ এই বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। কেননা ডান হাতই সাধারণত সকল ভাল কাজে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। অতএব এই কাজে বাম হাত ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয়। ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
মুসাফিহা ডান হাত দ্বারা হওয়াই বাঞ্ছনীয় এবং ইহাই উত্তম।
শায়খ আবদুর রউফ আল মুনাভী শাফেয়ী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
কেননা কোন ওযর না থাকিলে ডান হাতে হাত না রাখিলে সুন্নাত হাসিল হইবে না।
ইহার দলীল হিসাবে মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করিয়াছেনঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুসর (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা আমার এই হাতখানা দেখিতেছ। আমি সাক্ষ্য দিতেছি যে, এই হাতই আমি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর হাতের উপর রাখিয়াছি। (এই বলিয়া তিনি তাঁহার ডান হাতই দেখাইয়াছেন)
অপর বর্ণনায় ইহার ভাষা এইরূপঃ
****************************************
তোমরা আমার এই হাতখানি দেখিতেছ, এই হাত দিয়াই আমি রাসূলে করীম (স)-এর সহিত মুসাফিহা করিয়াছি।
হযরত আবূ ইমামা (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
‘হাতদ্বারা ধরা ও ডান হাত দিয়া মুসাফিহা করাই হইল সালামের সম্পূর্ণ রূপ।
অন্যকথায় মুখে সালাম করাই শুধু জরুরী নয়; বরং সেই সঙ্গে মুসাফিহা করাও জরুরী।
(********)
এই প্রসঙ্গে ‘মুয়ানিকা’ কোলাকুলি সম্পর্কে হাদীসের ভাষ্য উল্লেখ্য। প্রথমে উদ্ধৃত ‘জড়াইয়া ধরিবে কিনা’ প্রশ্নের জওয়াবে রাসূলে করীম (স) ‘না’ বলিয়াছেন বলিয়া উল্লেখিত হইয়াছে। কিন্তু এই কথাও ঠিন নহে। কেননা ‘মুয়ানিকা’- পরস্পর জড়াইয়া ধরা বা গলাগলি করাও ইসলামে জায়েয আছে।
এই পর্যায়ের কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ
****************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ হযরত সায়াদ ইবনে হারেসা (রা) সফর হইতে ফিরিয়া মদীনায় উপস্থিত হইলেন, এই সময় রাসূলে করীম (স) আমার গরে অবস্থান করিতেছিলেন। হযরত জায়দ আসিয়া দরজায় শব্দ করিলেন। তখন নবী করীম (স) জায়দের আগমনে আনন্দিত হইয়া বাহিরে যাওয়ার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তখন গাত্র নগ্ন ছিলঃ তিনি পারিধানের কাপড় টানিতে টানিতে বাহিরে গেলেন- খোদার শপথ, আমি তাঁহাকে কখনও নগ্ন গাত্রে বাইরের কোন লোকের সহিত মিলিত হইতে দেখি নাই- না ইহার পূর্বে, না ইহার পর- অতঃপর তিনি তাঁহার সহিত ‘মুয়ানিকা’ (গলাগলি) করিলেন এবং তাঁহাকে চুম্বন করিলেন।
(তিরমিযী)
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলিয়াছেনঃ আমি সিরিয়া গিয়া আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসের দরজায় দাঁড়াইয়া নিজের উপস্থিতির কথা জানাইলে ইবনে উনাইস পরনের কাপড় টানিতে টানিতে আসিলেন। অতঃপর ***** তিনি আমার সহিত গলাগলি করিলেন এবং আমিও তাঁহার সহিত গলাগলি করিলাম।
হযরত আবূ যা’র (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমাকে ডাকিয়া আমার জন্য লোক পাঠানো হইয়াছিল। আমি রাসূলের নিকট আসিলাম যখন তিনি মৃত্যু শয্যায় শায়িত ছিলেন। আমি তাঁহার উপর ঝুঁকিয়া পড়িলাম। তিনি তাঁহার হাত উপরে তুলিলেন ও আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন।
‘জড়াইয়া ধরিলেন’ অর্থ আমার সহিত তিনি ‘মুয়ানিকা’ করিলেন। ‘মুয়ানিকা’ পর্যায়ে উদ্ধৃত হাদসি সমূহ হইতে একথা স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, ইসলামী সমাজে সালাম ও মুসাফিহার পর মুয়ানিকা করারও ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং ইহা শরীয়াত সম্মত কাজ।
হযরত জায়দ বর্ণিত হাদীসটি উদ্ধৃত করিয় ইমাম তিরমিযী উহাকে একটি উত্তম হাদীস (******) বলিয়াছেন। ইমাম বুখারী এই হাদীসটি তাঁহার (*******) গ্রন্হে উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইহা অতীব উত্তম সনদ সম্পন্ন হাদীস। এই সব হাদীস অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, ‘মুয়ানিকা’ শরীয়াত সম্মত। তবে বিশেষ করিয়া বিদেশাগত ব্যক্তির সহিত মুয়ানিকা করা খুবই উত্তম। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
নবী করীম (স)-এর সাহাবীগণ যখন পরস্পরে সাক্ষাৎ করিতেন তখন (সালাম দেওয়ার পর) মুসাফিহা করিতেন এবং তাঁহারা যখন বিদেশ সফর হইতে ফিরিয়া আসিতেন তখন পরস্পর ‘মুয়ানিকা’ করিতেন।
মুহাদ্দিস হায়সামী এই হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন, ইহার বর্ণনাকারী সব কয়জন লোকই সিকাহ।
এই পর্যায়ে হযরত আনাস বর্ণিত প্রথমে উদ্ধৃত হাদীসটিতে মুয়ানিকা করার যে নিষেধ উল্লেখিত হইয়াছে তাহা সেই লোকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যাঁহারা বিদেশ সফর হইতে আসেন নাই। আর হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীস এবং হযরত আবূ যা’র (রা) বর্নিত হাদীস দুইটি হইতে বিদেশাগত মুসলমান ভাইর সহিত ‘মুয়ানিকা’ করার কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত হইয়াছে। কাজেই ইহার শরীয়াত সম্মত হওয়ার ব্যাপারে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।
বস্তুত ইসলামী সমাজের লোকদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও ভালবাসা সৃষ্টির জন্যই এই সব অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। অন্য কোন সমাজে ইহার তুলনা নাই।
(***********)
এই হাদীসদ্বয় হইতে প্রমাণিত হয় যে, বিদেশ হইতে আগত আপন জনের সহিত গলাগলি করা শরীয়াত সম্মত। হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হাদীসের ভাষা হইলঃ
****************************************
‘সাহাবাগণ যখন পরস্পর মিলিত হইতেন তখন পরস্পর মুসাফিহা করিতেন। আর যখন বিদেশ ভ্রমণ হইতে প্রত্যাবর্তন করিতেন তখন তাঁহারা পরস্পর কোলাকুলি করিতেন।
মুসাফিহা ও মুয়ানিকা করমর্দন ও গলাগলি মুসলিম সমাজের স্থায়ী সংস্কৃতি মূলক কাজ। পারস্পরিক ভালবাসা বন্ধুতা ও আপনত্বের ভাবধারা গাঢ় ও গভীর করার জন্য ইহার বিশেষ অবদান রহিয়াছে।
ব্যক্তির সামাজিক কর্তব্য
****************************************
হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ একজন মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের ছয়টি ভাল ভাল কাজ করণীয় হইয়া আছে। (১) সে যখন তাহার সাক্ষাৎ পাইবে, তাহাকে সালাম দিবে, (২) যে যখন হাঁচি দিবে (ও আলহামদুলিল্লাহ বলিবে), (৩) যে যখন রোগাক্রান্ত হইবে, তখন তাহার শশ্রূষা করিবে, (৪), সে যখন তাহাকে ডাকিবে সে উহার জওয়াব দিবে, (৫) সে যখন মৃত্যু বরণ করিবে তখন তাহার নিকট উপস্থিত হইবে (৬) এবং সে নিজের জন্য যাহা ভালবাসে বা পছন্দ করে তাহার জন্যও ঠিক তাহাই ভালবাসিবে ও পছন্দ করিবে এবং অসাক্ষাতে অনুপস্থিতিকালে তাহার কল্যাণ কামনা করিবে।
(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ রাসূলে করীম (স) যে সামজ গঠনের জন্য প্রাণান্ত সাধনা করিয়াছেন, তাহাকে এক কথায় বলা যায়, জনগণের পারস্পরিক অধিকার বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত সমাজ। এই সমাজের কেহ সেই অধিকার হইতে বঞ্চিত নয়। এই অধিকারের অপর নাম হইল পরস্পরের প্রতি কর্তব্য। বস্তুত যেখানেই কর্তব্য সেখানেই অধিকার এবং যেখানে অধিকার, উহারই অপর দিক কর্তব্য। এই কর্তব্য অবশ্যই পালনীয়।
এই সমাজ অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পরিবর্তে কর্তব্য পালনে প্রত্যেকের নিজের তীব্র অনুভূতি ও কর্তব্য পালনের প্রতিযোগিতায় সমৃদ্ধ। সেই কারণে এখানে শ্রেণী সংগ্রামের অবকাশ নাই, কাহারও অধিকার অনাদায় থাকিয়া যাওয়ারও নাই একবিন্দু আশংকা।
উপরোদ্ধৃত হাদীসে যে ছয়টি ভাল ভাল কাজের উল্লেখ হইয়াছে, বস্তুত রাসূলের ইস্পিত আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য এই কয়টি এবং এই ধরনের অন্যান্য যে সব কাজের উল্লেখ অন্যান্য হাদীসে হইয়াছে তাহা একান্ত জরুরী।
উল্লিখিত বিষয়গুলির প্রায় সব কয়টিরই ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে করা হইয়াছে। ‘সালাম’ মুসলমানের পারস্পরিক ভালবাসা ও আন্তরিকতা ও অকৃত্রিমতা সৃষ্টির একটা অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা। হাঁচি দেহের জড়তা নিঃসরণের লক্ষণ। তাই হাঁচি দেওয়ার পর ব্যক্তির কর্তব্য আল-হামদুলিল্লাহ বলিয়া এই জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা এবং ইহা যে লোক শুনিতে পাইবে, তাহার কর্তব্য। লোকটিকে ‘আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত করুন’ বলা। ইহাতেও আন্তরিক কল্যাণ কামনা প্রকাশ নিহিত। তবে হাদীসে এই হাঁচিকে তিন বারের মধ্যে সীমিত করার হইয়াছে। রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
হাঁচি দাতা তিন বার পরপর হাঁচি দিলে তবেই দোয়ার বাক্য বলিতৈ হইবে। উহার বেশী হইলে কোন বাধ্যবাধকতা নাই।
রোগ হইলে দেখিতে যাওয়া ও রোগীর সেবা শশ্রুষা করা একটা অতীব মানবীয় ও মানব কল্যাণ মূলক কাজ। কেহ রোগাক্রান্ত হইলে সে নিজের প্রয়োজনীয় কাজ কর্ম- তত্ত্ব- তালাফী ঔষধ সেবন ইত্যাদি কিছুই করিতে পারে না। তাহা করিয়া দেওয় সুস্থ মানব শ্রেণীর মানবীয় ও সামাজিক দায়িত্ব। তাহা ছাড়া রোগী সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে বিধায় তাহার মনে বাসনা জাগে, তাহার আপনজন বন্ধু বান্ধব ইত্যাদিরা তাহাকে দেখিতে আসুক। লোকেরা দেখিতে আসিলে রোগী রোগের অনেক যন্ত্রণাই ভুলিয়া যায়। সাময়িক ভাবে হইলেও অনেক মানসিক কষ্ট হইতে সে রেহাই পায়।
ডাকিলে উহার জওয়াব দেওয়া, ডাকে সাড়া দেওয়া এবং তাহার নিকট উপস্থিত হওয়াও কর্তব্য। কেননা এই ডাক সাধারণত প্রয়োজনের কারণেই হইয়া থাকে। বিনা প্রয়োজনে কেহ কাহাকেও ডাকে না। কাজেই কাহারও ডাককে উপেক্ষা করা উচিত নয়। তাহাতে ব্যক্তি নিজেকে অপমানিক বোধ না করিয়া পারে না।
আর কাহারও মৃত্যু ঘটিলে তাহার কাফন জানাযা ও দাফনে উপস্থিত হওয়া যে সমাজের লোকদের একান্তই কর্তব্য তাহা ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইবার প্রয়োজন হয় না। কেননা মৃত্যু অবধারিত। প্রত্যেক প্রাণী ও মানুষকেই উহার শিকার হইতে হইবে। পার্থক্য শুধু আগে ওপরের। নতুবা মৃত্যু হইতে কাহারও নিষ্কৃতি নাই।
হাদীসটির সর্বশেষ বাক্যে এক অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ কথা বলা হইয়াছে। মানুষ নিজের জন্য যাহা পছন্দ করে তাহাই তাহার পছন্দ করা উচিত অন্য মানুষের জন্য। বস্তুত যে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ এই গুণে গুণাম্বিত ও এই কর্তব্যে সজাগ ও সক্রিয় সে সমাজে কোন মানুষেরই একবিন্দু দুঃখ থাকিতে পারে না। কেননা কোন ব্যক্তিই নিজের জন্য দুঃখ কষ্টতে পছন্দ করিতে পারে না। তাহা হইলে কেহ অন্য মানুষের জন্যও দুঃখের কারণ ঘটাইবে না। আর যে সমাজে মানুষ মানুষের জন্য দুঃখের কারণ ঘটায়না, সে সমাজে প্রত্যেকটি মানুষই নিরবচ্ছিন্ন ও অখন্ড সুখে জীবন যাপন করিতে পারে; তাহাতে একবিন্দু সন্দেহ থাকিতে পারে না। এই হাদীসটি বহু কয়টি সূত্রে বর্ণিত। ইহার একটি সুত্রের একজন বর্ণনাকারী আল হারেস দুর্বল। কিন্তু এমন সূত্রেও ইহা বর্ণিত হইয়াছে যাহাতে এই আল-হারেস নাই। আর অন্যান্য সূত্রগুলি নিঃখুত। সেই কারণে ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটিকে ‘হাদীসুন হাসানুন’ বলিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর একটি দীর্ঘ হাদসে রাসূলে করীম (স)-এর একটি বাক্য উদ্ধৃত হইয়াছে এই ভাষায়ঃ
****************************************
তুমি তোমার পাড়া-প্রতিবেশীর সহিত সদাচারণ কর, তাহা হইলে তুমি প্রকৃত মু’মিন হইতে পারিবে এবং তুমি লোকদের জন্য তাহাই পছন্দ কর, যাহা পছন্দ কর নিজের জন্য।
হযরত আনাস (রা) বর্ণিত ও আবূ দায়ূদ ছাড়া অন্যান্য সব কয়খানি হাদীস গ্রন্হে উদ্ধৃ এই পর্যায়েল একটি বর্ণনা হইলঃ
****************************************
তোমাদের কেহ ঈমানদারই হইবে না যতক্ষণ না সে তাহার ভাইর জন্য তাহাই পছন্দ করিবে যাহা সে নিজের জন্য পছন্দ করে- ভালবাসে।
হযরত আবূ যার (রা) নবী করীম (স)-এর একটি কথা বর্ণনা করিয়াছেন। তাহাতে তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমার প্রিয় আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়াছেন। সে পাঁচটি নির্দেশ হইল (১) আমি গরীব মিসকীন লোকদের প্রতি দয়াশীল হইব, তাহাদের সহিত উঠা-বসা ও ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করিব, (২) যাহারা আমার নীচে, তাহাদের প্রতিই দৃষ্টি দিব, যাহারা আমার উপরে তাহাদের প্রতি লোলূপ দৃষ্টি ফেলিব না। আমি রক্ত সম্পর্ক রক্ষা করিয়া চলিব। আর সত্য কথাই বলিব, তাহা যতই তিক্ত হউক না কেন।
বস্তুত নবী করীম (স)-এর প্রতি তাঁহার প্রিয় খোদার এই নির্দেশ মুসলিম মাত্রের প্রতিও নির্দেশ এবং ইসলামী সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিরই কর্তব্য আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী উক্ত গুণাবলী নিজের মধ্যে র্জণ করা। কেননা পারিকল্পিত ইসলামী সমাজ এই সব গুণাবলী সমন্বিত ব্যক্তিদের ছাড়া গড়িয়া উঠিতে পারে না।
ইসলামী সমাজে ধনী-গরীব বা বড় ছোটর কোন শ্রেণী বিভাগ নাই। এখানে সমস্ত মানুষ নির্বিশেষ। বিশেষজ্ঞরাও এখানে নির্বিশেষের সহিত মিলিয়া মিশিয়া থাকিতে ও একাকার হইয়া জীবন যাপন করিতে অভ্যন্ত হইয়া থাকে। ফলে এখানে কোন দিনই শ্রেনী পার্থক্য ও তদজনিত শ্রেণী সংগ্রামের আশংকা থাকে না। তাহার কোন অবকাশই নাই। এখানে রক্তের সম্পর্ক যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার পাইয়া থাকে। কেহই এই সম্পর্ক ছ্ন্নি করিতে পারে না। কেহ তাহা করিলে সে ইসলামী সমাজ নীতিরই বিরুদ্ধতা করার মতই অপরাধেঅপরাধী সাব্যস্ত হয়। সর্বাপেক্ষা বড় কথা, এখানে প্রত্যেক ব্যক্তিই সত্য কথা বলিবার অধিকার ও দায়িত্ব সম্পন্ন। সত্য কথা সর্বাবস্থায়ই বলিতৈ হইবে, তাহা কাহারও পক্ষে হউক, কি কাহারও বিপক্ষে। কেননা এই সমাজ শাশ্বত ও মহান সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সত্য যদি কখনও উপেক্ষিত হয় যদি উহার উপর অন্য কোন দৃষ্টি বা বিবেচনা প্রাধান্য লাভ করিতে বসিতে পারে, তাহা হইলে সমাজের সত্য ভিত্তিই বিনষ্ট হইয়া যাইবে। আর যে সমাজ উহার ভিত্তির উপর কুঠারাঘাত চালায় বা চালাইবার সুযোগ দেয়, সে সমাজ কোন দিনই রক্ষা পাইতে পারে না। উহার ধ্বংস চির নিশ্চিত।
হযরত উবাদাতা ইবনে চামেত (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা নিজেদের দিক হইতে আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ কর, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব গ্রহণ করিতেছি। সে ছয়টি বিষয় হইল (১) যখন তোমরা কথা বলিবে, সত্য ও যথার্থ কথা বলিবে, (২) যখন তোমরা ওয়াদা করিবে যে কোন রকমের ওয়াদাই হউক না কেন- তাহা অবশ্যই পুরণ করিবে, (৩) তোমাদের নিকট যখন কোন কিছু আমানত স্বরূপ রাখা হইবে, তোমরা উহা অবশ্যই রক্ষা করিবে- প্রকৃত মালিককে উহা যথা সময় পৌঁছাইয়া ফিরাইয়া দিবে। (৪) তোমাদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা অবশ্যই রক্ষা করিবে, (৫) তোমাদের দৃষ্টি অবনত রাখিবে এবং (৬) তোমাদের হাত সর্বপ্রকার ক্ষতিকর কাজ হইতে বিরত রাখিবে।
এক কথায় বলিতে গেলে বলা যায়, যে সমাজের লোকেরা মিথ্যা কথা বলিতৈ অভস্থ, ওয়াদা করিয়া উহা পূরণ করে না, প্রতিশ্রুতি ভৃগ করে, আমানতের খিয়ানত করে, বিনষ্ট করে বা নিজেই ভক্ষণ করে, মালিককে ফিরাইয়া দেয় না, নারী বা পুরুষ কেই স্বীয় লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করে না, উহার যথেচ্ছা যেখানে সেখানে ও অবাধ ব্যবহার করে, জ্বেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত থাকে, লালসার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং সামান্য সামান্য কারণে হস্ত উত্তোলিত হয়, লোকেরা পরস্পর মারামারিক কাটাকাটি করিতে শুরু করিয়া দেয়, সেই সমাজে লোকদের পক্ষে বেহেশতে যাওয়া তো দূরের কথা, তাহাদের পক্ষে মানুষের মত সুখে নিরাপদে জীবন যাপন করাও সম্ভব হইতে পারে না। কাজেই সমাজকে এইসব দুষ্কৃতি হইতে মুক্ত ও পবিত্র রাখার জন্য চেষ্টা করা ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটি ব্যক্তির এবং সামষ্টিকভাবে গোটা সমাজের দায়িত্ব। রাসূলে করীম (স) উপরোদ্ধৃত বাণীতে সেই দায়িত্বের কথাই ঘোষণা করিয়াছেন।
হাদীসটির সনদে হযরত উবাদহর পরে রহিয়াছে আল-মুত্তালিব। কিন্তু তিনি নিজে হযরত উবাদাহর নিকট হইতে প্রত্যক্ষ ভাবে শুনেন নাই বলিয়া মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করিয়াছেন।
(***********)