ঋতুবতী স্ত্রীর সহিত সঙ্গম
****************************************
হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন? ইয়াহুদী সমাজে মেয়েলোক যখন ঋতুবতী হয়, তখন তাহারা তাহাদর সহিত একত্রে খাওয়া-দাওয়াও করে না এবং যৌন সঙ্গমও করে না। ইহা জানিয়া নবী করীম (স)-এর সাহাবীগণ এই বিষয়ে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। এই সময় কুরআন মজীদের এই আয়াতটি নাযিল হয়ঃ ‘লোকেরা তোমাকে ঋতুবতী স্ত্রীলোকদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। তুমি বল, ইহা একটা রোগ বিশেষ। অতএব তোমরা ঋতুবতী স্ত্রী হইতে বিচ্ছন্ন হইয়া থাক। নবী করীম (স) নিজে এই প্রসঙ্গে বলিলেনঃ শুধু যৌনসঙ্গম ছাড়া অন্যসব কিছুই করিতে পার।
(মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ স্ত্রীর ঋতু বা হায়য হইলে তাহার সহিত কিরূপ আচরণ কতটা গ্রহণ করা যাইতে পারে, সে সম্পর্কে এই হাদীসে স্পষ্ট বলা হইয়াছে। প্রথম কথা, ঋতুবতী স্ত্রীর সহিত সঙ্গম করা যাইবে না। ইহা হাদীসের কথা নয়। ইহা কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণায় বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। কুরআনের আয়াতে ঋতুবতী স্ত্রী সম্পর্কে বলা হইয়াছে ******************* ‘ঋতু অবস্থায় পতিত স্ত্রীকে বর্জন বা পরিহার কর’। কিন্তু পরিহার বা বর্জনের ধরন কি এবং সীমা কতদূর, তাহা কুরআন হইতে জানা যায় না- কুরআনে তাহা বলা হয় নাই। তাহা হাদীস হইতে জানা যায়। এই কারণে আলোচ্য হাদীসটি কুরআনের এ আয়াতটির যথার্থ ব্যাখ্যাও। কুরআনের সঠিক অর্ত হাদীসের সাহায্য ব্যতীত যথাযথভাবে বোঝা যায় না, আলোচ্য হাদীসটি এই কথার অকাট্য দলীলও।
তদানীন্তন আরবের ইয়াহুদী সমাজের রীতি এই ছিল যে, তাহারা ঋতুবতী স্ত্রীকে সম্পূর্ণ বয়কট করিত। তাহাদের সহিত একত্রে খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা ও একসঙ্গে এক শয্যায় শয়ন করা পর্যন্ত তাহারা বাদ দিয়া চলিত। শুধু তাহাই নয়, আবূ দায়ূদের বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ **************** ‘ঋতুবতী স্ত্রীকে তাহারা ঘর হইতে বহিষ্কৃত করিত’। এ বিষয়ে মুসলমানদের করণীয় কি, সাহাবায়ে কিরাম তাহাই জানিতে চাহিয়াছিলেন রাসূলে করীম (স)-এর নিকট। ইহার প্রথম জবাব কুরআন মজীদের আয়াত। আয়াতটিতে প্রথমে ঋতু বা হায়যকে রোগ বা কষ্ট বা আবর্জনা ময়লা পংকিলতা বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে এবং পরে এই ঋতুবতী মেয়েলোক সম্পর্কে বলা হইয়াছে, ************** অর্থাৎ **** কর। এখানে এই ****অর্থ দুই মিলিত জিনিসের সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতা কি ইয়াহুদীদের মত করিতে হইবে? ইহার জবাব কুরআনে নাই। আলোচ্য হাদীসটিতে ইহারাই জবাবে নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ ************ ‘যৌন সঙ্গম ছাড়া আর সব কিছুই কর’।
আবূ দায়ূদের বর্ণনার ভাষা এইঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিলেন, তোমরা তাহাদের সহিত ঘরে একত্র বসবাস, কর, মেলা-মেশা কর, ছোয়া ছুয়ি কর, ধরাধরি কর, কোলাকূলি কর এবং যৌন সঙ্গম ছাড়া আর সব কিছুই কর।
এই সব কিছুরই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এই হাদীসটিরই অপর এক উদ্ধৃতিতে। তাহাতে বলা হইয়াছেঃ
রাসূলে করীম (স) সাহাবায়ে কিরাম (রা) কে নির্দেশ দিলেন যে, ঋতুবতী স্ত্রীদের সহিত একত্রে পানাহার করিবে, তাহাদের সহিত একই ঘরে বসবাস করিবে এবং যৌন সঙ্গম ছাড়া তাহাদের সহিত আর সব কিছুই করিবে।
হযরত আয়েশা (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমি হায়য অবস্থায় থাকিলেও নবী করীম (স) আমার সঙ্গে একই শয্যায় শয়ন করিতেন। আমাদের দুইজনের মাঝে শুধু একখানি কাপড়েরই ব্যবধান থাকিত।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স)-এর বেগমগণের মধ্যে কেহ ঋতুবতী হইলে তিনি তাঁহাকে হায়যের স্থানে শক্ত করিয়া কাপড় বাঁধিতে এবং তাহাকে লইয়া একত্রে শয়ন করিতেন।
হাদীসের শব্দ ***** হইতে বোঝা যায় যে, এই অবস্থায় স্ত্রীর সহিত কেবলমাত্র সঙ্গম ছাড়া আর সব কিছুই করা যাইতে পারে।
হারেস কন্যা হযরত মায়মুনা ও উমর ফারুকক কন্যা হযরত হাফসা (রা)- রাসূলের দুই বেগম হযরত ইবনে আব্বাসের মুক্তি দেওয়া দাসী বদরাকে হযরত ইবনে আব্বাসের স্ত্রীর নিকট কোন কাজের জন্য পাঠইয়াছিলেন। সে আসিয়া দেখিল, তাহার বিছানা হযরত ইবনে আব্বাসের বিছানা হইতে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র রাখা হইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলে হযতর ইবনে আব্বাসের বেগম বলিলেনঃ *********** ‘আমি ঋতুবতী হইলে আমার বিছানা আমি আলাদা করিয়া লই ও স্বতন্ত্র শয্যায় শয়ন করি’। এই কথা যখন রাসূলের বেগমদ্বয় জানিতে পারিলেন, তখন তিনি হযরত ইবনে আব্বাসের নিকট বলিয়া পাঠাইলেনঃ
****************************************
‘তোমার মা’ [১] বলিতেছেন, তুমি কি রাসূলে করীম (স)-এর সুন্নাত পালন হইতে বিমুক হইয়া গিয়াছ? রাসূলে করীম (স)-এর নিয়ম তো এই ছিল যে, তাঁহার বেগমদের মধ্যে কেহ ঋতুবতী হইলে তিনি তাঁহার সহিত একত্রে শয়ন করিতেন এবং এই দুইজনের মধ্যে একখানা কাপড় ছাড়া পার্থক্য বা বিভেদকারী আর কিছুই থাকিত না। অবশ্য পরণের সেই কাপড় কখনও হাঁটুর উপর উঠিত না।
রাসূলে করীম (স) এক প্রশ্নের জবাবে বলিয়াছিলেনঃ
****************************************
ঋতুবতী স্ত্রী তাহার পরনের কাপড় শক্ত করিয়া বাঁধিয়া লইবে। অতঃপর উপর দিয়া যাহা কিচু করিতে চায় করিতে পারে।
ঋতুবতী স্ত্রীর প্রতি ইয়াহুদীদের আচরণ অমানবিক। আর খৃস্টানদের আচরণ সীমালংঘনকারী- তাহারা যৌন সঙ্গম পর্যন্ত করিত এই অবস্থায়ও। কিন্তু ইসলাম এই সীমালংঘনমূলক আচরণের মাঝে মধ্যম নীতি অবলম্বন করিয়াছে।
এই সবের ভিত্তিতে জমহুর ফিকাহবিদদের মত হইলঃ
****************************************
কাপড়র উপর দিয়া যত পার সুখ সম্ভোগ ও আনন্দ লাভ কর। কাপড়ের নীচে যাইবে না।
ইমাম আবূ হানীফা, মালিক ও শাফেয়ীও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
(******************)
নারীদের ব্যাপারে সতর্কবাণী
****************************************
হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) হযরত নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ পৃথিবী সুমিষ্ট-সুস্বাদু সবুজ-সতেজ। আর আল্লাহ তা’আলা তোমাদিগকে এই পৃথিবীতে তাঁহার খলীফা বানাইয়াছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি যেন দেখিতে পারেন তোমরা কিরূপ ও কিভাবে কাজ কর। অতএব তোমরা ভয় কর পৃথিবী, ভয় কর নারীদের। কেননা বনী ইসরাইলীদের সমাজে যে প্রথম বিপর্যয় দেখা দিয়াছিল এই নারীদের লইয়া।
(মুসলিম, বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যাঃ এই পৃথিবী সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করা উচিত, পৃথিবীতে মানুষের স্থান ‘পজিশন’ কি এবং এই পৃথিবীতে মানুষের কিভাবে জীবন যাপন করা উচিত, উপরোক্ত হাদীসটির মূল বক্তব্য সেই পর্যায়ের। দুনিয়া বাস্তবতার দৃষ্টিতে মানবজীবনে কি রূপ লইয়া দেখা দেয়, এখানে মানুষের জীবনের প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য কি এবং কিরূপ সতর্কতার সহিত এখানে মানুষের জীবন যাপন করা উচিত তাহাই মৌলিকভাবে বলা হইয়াছে এই হাদীসটিতে।
প্রথমতঃ রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, দুনিয়াটা সুমিষ্ট শ্যামল সবুজ সতেজ। মানুষের নিকট ইহা চিরকালই লোভনীয় ও আকর্ষণীয় হইয়া দেখা দেয়। বৈষয়িক সুখ-শান্তি ও স্বাদ সুমিষ্ট ফলের মতই। উহা যেমন মানুষকে প্রলুব্ধ করে, তেমনি উহা মানুষকে নিজের দিকে আকর্ষণও করে অত্যন্ত তীব্রভাবে। মানুষ স্বভাবতই এই সব পাওয়ার জন্য আকুল ও উদগ্র হইয়া উঠে। দ্বিতীয়তঃ ইহা যতই আকর্ষণীয় ও লোভনীয় হউক না- কেন, উহার আয়ূষ্কাল খুবই সীমাবদ্ধ। খুব অল্পকালের মধ্যেই ধ্বংস হইয়া যায়। ইহাতে স্থায়ীত্ব বলিতে কিছুই নাই। ইহা নয় শাশ্বত বা চিরস্থায়। কিন্তু ইহার ক্ষণস্থায়ীত্ব ও প্রতিমূহুর্ত তিলে তিলে অবক্ষয়মানতা মানুষ সাধারণত বুঝিতে পারে না, উপলব্ধীও করিতে পারে না। ফলে মানুষ এক মায়া মরীচিকার পিছনে পাগলপারা হইয়া ছুটিতে থাকে। আর ইহার পরিণাম মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে কখনই ভাল হইতে পারে না।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এই পৃথিবীর বুকে খলীফার মর্যাদার অভিষিক্ত করিয়াছেন। ‘খলীফা’ বলা হয় তাহাকে যে প্রকৃত মালিক বা কর্তা হয় না, হয় আসল মালিক ও কর্তার প্রতিনিধি। আসল মালিক ও কর্তার যাবতীয় কাজের কর্তৃত্ব পরিচালনার দায়িত্ব তাহার উপরই অর্পিত হয়। কিন্তু সে কর্তৃত্ব সে নিজ ইচ্ছমত চালাইতে পারে না, প্রকৃত মালিকের দেওয়া আইন-বিধান ও নিয়ম-নীতি অনুসরণের ভিত্তিতেই সে এই কাজ করিতে বাধ্য। বস্তুত মানুষও এই দুনিয়অর আসল মালিক ও কর্তা নয়। আসল মালিক ও কর্তা মহান আল্লাহ তা’আলা। তিনি মানুষকে এই দুনিয়া পরিচালনার যেমন অধিকার ও সুযোগ দিয়াছেন, তেমনি দিয়াছেন সেই অধিককার ও সুযোগ ব্যবাহারের জন্য পূর্ণাঙ্গ ও মৌলিক আইন ও বিধান। এই হিসাবেই মানুষ এই পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা। কুরআন মজীদেও আল্লাহ তা’আলার মানব-সৃষ্টি পূর্বের ঘোষনা উল্লেখ করা হইয়াছে এই ভাষায় ************** ‘আমি দুনিয়ার খলীফা বানাব’।
এই ঘোষণানুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষই ব্যক্তিগতভাবে এবং সমস্ত মানুষ সামষ্টিকভাবে এই পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফাহ। এই খিলাফত এই দিক দিয়াও যে, প্রত্যেক যূগের মানুষ তাহাদের পূর্ববর্তী যুগের স্থলাভিষিক্ত। আর সামষ্টিকভাবে গোটা মানব জাতি তাহাদের পূর্ববর্তী পৃথিবী-অধিবাসীদের- তাহারা যাহারাই হউক না কেন- স্থলাভিষিক্ত। এই স্থলাভিষিক্ততার মধ্যে এই কথাটিও নিহিত রহিয়াছে যে, তাহাদিগকে তাহাদের পরবর্তী কালের লোকদের জন্য নিজেদের স্থান ছাড়িয়া দিয়া পৃথিবী হইতে চলিয়া যাইতে হইবে। তখন তাহাদের পরবর্তী লোকেররা তাহাদের স্থানে হইবে আল্লাহর খলীফা। এই দুনিয়ার সর্বযুগের মানুষের প্রকৃত অবস্থান কোথায়, তাহা বুঝাইবার জন্য রাসূলে করীম (স)-এর সংক্ষিপ্ত বাক্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীতে মানুষের আসল অবস্থানের কথা বলার পর রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ মানুষকে এইভাবে খলীফা বানাইবার মূলে আল্লাহ তা’আলার একমাত্র উদ্দেশ্য হইল, তিনি বাস্তবভাবে দেখিতে চাহেন, মানুষেরা কি রকমের কাজ করে- ব্যক্তি হিসাবে এবং সামষ্টিকভাবে। কুরআন মজীদে এই পর্যায়ে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
সেই মহান আল্লাহই মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করিয়াছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি তোমাদের মধ্যে উত্তম কাজ কে করে, তাহা পরীক্ষা করিবেন।
এই পরীক্ষায় সঠিকভাবে উত্তীর্ণ হইবার জন্য আহবান জানাইয়া রাসূলে করীম (স) মানুষকে দুনিয়া এবং নারী সমাজ সম্পর্কে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বনের জন্য বলিয়াছেন। দুনিয়া সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্কতাবলম্বনের নির্দেশ দিয়াছেন এই জন্য যে, দুনিয়া বাস্তবিকই এমন একটি স্থান যেখানে মানুষ নিজেদের প্রকৃত অবস্থানের কথা ভূলিয়া গিয়া অবাঞ্ছনীয় ও মারাত্মক ধরনের কাজ কর্মে লিপ্ত হইতে পারে। আর এই দুনিয়ার মানুষের বিভ্রান্তির সর্বাপেক্ষা বড় কারণ হইতে পারে নারী। কেননা দুনিয়ায় পুরুষের জন্য সর্বাধিক তীব্র আকর্ষণীয় হইতেছে নারী, আর নারীর জন্য পুরুষ। এই আকর্ষণ নারী ও পুরুষকে অবৈধ সংসর্গ ও সংস্পর্শে প্রবৃত্ত করে এবং উভয় উভয়ের নিকট হইতে সর্বধিক স্বাদ গ্রহণে লালায়িত হইয়া পড়ে। কিন্তু এই অবস্থাটা মানুষের জন্য কখনই কল্যাণকর হইতে পারে না। আর ইহা যে কল্যাণকর হইতে পারে না, বনী ইসরাইলীদের বিপর্যয়ের ইতিহাসই তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ। রাসূলে করীম (স) তাঁহার নারী সংক্রান্ত সতর্কীকরণের মুক্তি হিসাবে সেই ইতিহাসের উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেনঃ বনী ইসরাইলরা যে কঠিন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়িয়া গিয়াছিল, নারীই ছিল উহার প্রথম কারণ। সেই সমাজের নারীরা তাহাদের পুরুষদেরকে প্রথমে অবৈধ সংসর্গে প্রলুব্ধ করে। তাহার পরই গোটা সমাজের যে পতন ও বিপর্যয় শুরু হয়, তাহারই পরিণতিতে তাহারা আল্লাহ কর্তৃক চরমভাবে অভিশপ্ত হয়। বস্তুত যে সমাজে নারী পুরুষের অবাধ মিলনের নিয়ন্ত্রণহীন সুযোগ উন্মুক্ত থাকে, সে সমাজের সর্বাত্মক পতন ও বিপর্যয় কেহই রোধ করিতে পারে না। সমাজ জীবনে সুস্থতা ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য এই হাদীসটি দিগদর্শনের কাজ করে। রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি আরও গুরুত্ব সহকারে বলা হইয়াছে নিম্নোদ্ধৃত বর্ণনায়।
সায়ীদ ইবনে জায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমার পরে লোকদের মধ্যে পুরুষদের জন্য সর্বাধিক বিপদ মেয়েদের হইতে আসার আশংকাবোধ করিতেছি।
এই হাদীসের ***** শব্দের অর্থ পরীক্ষার মাধ্যম। ইহার আর এক অর্থ বিপদ, মুছীবত, বিপর্যয়। এই বিপদ-মুছীবত-বিপর্যয়ও পরীক্ষারই উদ্দেশ্যে। বস্তুত নারীরা পুরুষের ঈমান ও চরিত্রের ব্যাপারে একটা বিরাট পরীক্ষা-মাধ্যম। কেননা আল্লাহ তা’আলা পুরুষদের স্বভাব প্রকৃতিতেই নারীর প্রতি তীব্র আকর্ষণ সংরক্ষিত করিয়াছেন। এই আকর্ষনের দরুন জ্বেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হইতে পারে যেমন, তেমনি তাহাদের জ ন্য পুরুষরা মারা-মারি কাটাকাটি বা পারস্পরিক কঠিন শক্রতায় লিপ্ত হইতে পারে- হইয়া থাকে। অন্তত নারীরা যে পুরুষদের দুনিয়ার দিকে অধিক আকৃষ্ট করিতে ও হালাল-হারাম নির্বিচারে অর্থ লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত করিতে পারে- করিতে থাকে, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই। আর মানুষের জন্য ইহাপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদ আর কিছু হইতে পারে না। রাসূলে করীম (স)-এর কথা ***** ‘আমার পর- ইহার অর্থ, আমি দুনিয়ায় বাঁচিয়া থাকা পর্যন্ত এই ব্যাপারে জনগণকে সর্বোতভাবে সাবধান ও সতর্ক রাখিয়াছি। ফলে নারীকেন্দ্রিক সামাজিক উচ্ছৃংখলতা ও বিপর্যয় অনেকাংশে প্রতিরুদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু এই ‘কারণ’ কি একটি চিরস্থায়ী ব্যাপার? এবং ইহা কি সর্বাধিক ক্ষতিকর বিষয়? এই ক্ষতিকর ‘কারণ’ কি মানুষকে অনেক বেশী ক্ষতির মধ্যে ফেলিবে? এইরূপ আশংকা রাসূলে করীম (স) দুনিয়া হইতে চলিয়া যাওয়ার সময়ও অনুভব করিতেছিলেন। বস্তুত সেই তীব্র আশংকাবোধই প্রকাশি হইয়াছে রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি হইতে।
হাফেজ ইবনুল হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
অন্যান্য জিনিসের দ্বারা সৃষ্ট বিপর্যয়ের তুলনায় নারীদের সৃষ্ট বিপর্যয় অনেক কঠিন মারাত্মক ও সুদুরপ্রসারী হইয়া থাকে।
কুরআন মজীদে নৈতিক সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ সমূহের উল্লেখ প্রসঙ্গে এই নারীদের প্রতি যৌন আকর্ষনের সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছেঃ
****************************************
নারী আকর্ষণের প্রেম মানুষের জন্য সাধারণভাবে বেশী চাকচিক্যপূর্ণ বানাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
ইহা হইতে বুঝা যায় যে, নৈতিক ও সামাজিক জীবনে যে সব কারণে বিপর্যয় ঘটে, তাহার মধ্যে নারীই হইতেছে আসল কারণ।
চিন্তাবিদ বিজ্ঞানীরা বলিয়াছেনঃ
নারীর সবটাই বিপর্যয়ের কারণ। আর তাহাতে অধিক খারাপ দিকটি হইল এই যে, তাহাদিগকে এড়াইয়া চলা খুবই অসম্ভব ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায়।
নারীদের বিবেক-বুদ্ধির স্বাভাবিক অসম্পূর্ণতা এবং দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে কম দায়িত্বের কারণে তাহারা কঠিন বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হইয়া থাকে।
(***************)
নারী ও পুরুষের পারস্পরিক পার্থক্য সংরক্ষণ
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) পুরুষদের সহিত সাদৃশ্য গ্রহণকারী নারীদের এবং স্ত্রী লোকদের সহিত সাদৃশ্য গ্রহণকারী পুরুষের উপর অভিশাপ করিয়াছেন।
(বুখারী, তিরমিযী, আবূ দায়ূদ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ ইবনে জরীর তাবারী এই হাদীসের ভিত্তিতে লিখিয়াছেনঃ পোষাক ও নারীদের জন্য নির্দিষ্ট অলংকারাদী ব্যবহারের দিক দিয়া স্ত্রীলোকদের সহিত পুরুষদের সাদৃশ্য করণ সম্পূর্ণ হারাম। স্ত্রীলোকদের পক্ষেও জায়েয নয় এই সব দিক দিয়া পুরুষদের সহিত সাদৃশ্য করা। এই সাদৃশ্য করার অর্থ, যে সব পোষাক ও অলংকারাদি কেবলমাত্র মেয়েরাই সাধারণত ব্যবহার করে তাহা পুরুষদের ব্যবহার করা, অনুরূপভাবে যেসব পোষাক ও ভূষণ সাধারণত পুরষরা ব্যহার করে তাহা স্ত্রীলোকদের ব্যবহার করা জায়েয নয়। ইবনুল হাজার আসকালানী বলিয়াছেনঃ কেবলমাত্র পোষাক পরিচ্ছদের দিক দিয়াই এই সাদৃশ্য নিষিদ্ধ নয়। চলন-বলনেও একের পক্ষে অপরের সহিত সাদৃশ্য করা- মেয়েদের পুরুষদের মত চলাফিরা করা, কথা বলা এবং পুরুষদের মেয়েদের মত চলাফিরা করা, কথা বলা অবাঞ্ছনীয়। এক কথায় বলা যায়, আল্লাহ তা’আলা মানুষকে দুই লিঙ্গে বিভক্ত করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি যাহাদিগকে পুরষ বানাইয়াছেন, তাহারা যদি স্ত্রী লোকদের ন্যায় চলন বলন ভূষণ পরিচ্ছন গ্রহণ করে, অথবা যদি ইহার বিপরীতটা হয়- স্ত্রী লোকেরা যদি পুরুষদের চলন-বলন-ভূষণ গ্রহণ করে, তাহা হইলে ইহা আল্লাহর সৃষ্টির উপর বিদ্রূপ ছাড়া আর কিছুই হয় না। স্পষ্ট মনে হয়, সে স্ত্রী বা পুরুষ হইয়া কিছু মাত্র সন্তুষ্ট নয়। সে বিপরীতটা হইবার কামনা-বাসনা পোষণ করে। ইহা আল্লাহর প্রতি চরম না-শোকরিয়াও বটে। আর এই ধরনের নারী পুরুষদের উপর রাসূলে করীম(স)-এর অভিশাপ বর্ষণের মৌল কারণও ইহাই। ইহারা আল্লাহর রহমত পাইতে পারে না। অভিশাপ বর্ষনের তাৎপর্যও ইহাই।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত আর একটি হাদীসের ভাষা এইঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) পুরুষ মুখান্নাস ও পুরুষালী স্ত্রীলোকদের উপর অভিশাপ দিয়াছেন।
‘মুখান্নাস’ বলা হয় পোষাক অলংকার, রং, কণ্ঠস্বর, রূপ-আকৃতি, কথা-বার্তা, সর্বপ্রকার চলাফিরা, উঠাবসা, গতি-বিধি প্রভৃতির দিক দিয়া যেসব পুরুষ নারীদের সহিত একাকার হয় তাহাদিগকে। এইরূপ করা পুরুষদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেননা ইহাতে আল্লাহর সৃষ্টি লক্ষ্যের চরম বিকৃতি ও পরিবর্তন সাধিত হয়। আর আল্লাহর সৃষ্টি লক্ষ্যের বিকৃতি ও পরিবর্তন স্বভাব-নীতির বিরুদ্ধতা এবং স্বভাব নীতির বিরুদ্ধতা যে কখনই কল্যাণকর হইতে পারে না, তাহা বলাই বাহুল্য। ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ যে সব পুরুষ জন্মগতভাবেই কোন কোন মেয়েলী গুণের ধারক হয় এবং স্ব-চেষ্টায় এমন কোন গুণ গ্রহণ করে না, তাদের ব্যাপারে রাসূলে করীম (স)-এর এই বাণী প্রযোজ্য নয়। যাহারা নিজের ইচ্ছা করিয়া এইরূপ করে কেবল মাত্র তাহাদের সম্পর্কেই এই কথা। আর ইহাই নিষিদ্ধ। এই লোকদের উপরই অভিশাপ বর্ষণ করা হইয়াছে। অনুরূপভাবে যে সব মেয়েলোক জন্মগতভাবেই কোন-না-কোন পুরুষালি গুণের অধিকারী এবং তাহা স্বইচ্ছা ও স্বচেষ্টার কোন সংযোগ নাই, তাহারাও অভিশপ্ত হইবে না। দ্বিতীয় যে সব মহিলা পুরুষদের মতই দৃঢ় প্রত্যয় ও জ্ঞান বিবেক শক্তির অধিকারী, সাহসী, তাহাদের প্রতিও এই অভিশাপ হয় নাই। কেননা এই গুণ মেয়েদের জন্যও প্রশংসনীয়। হযরত আয়েশা (রা) সম্পর্কে সাধারণত বলা হইত ****** ‘তিনি পুরুষদের ন্যায় দৃঢ় মত ও বিবেচনা শক্তির অধিকারী’।
এক কথায় বলা যায়, নারী ও পুরুষের মাঝে যে স্বাভাবিক পার্থক্য, তাহা কাহারও পক্ষে কোন দিক দিয়াই লংঘন করা উচিত নয়। এ পর্যায়ে কৃত্রিমভাবে যাহাই করা হইবে, তাহাই অন্যায় ও অপরাধ হইবে।
ইসলামে নারী ও পুরুষের মাঝে এই পার্থক্য রক্ষার জন্য এক দিকে যেমন পর্দার ব্যবস্থা করা হইয়াছে, তেমনি আচার-আচরণ, কথাবার্তা, পোষাক-পরিচ্ছদ ও সুগদ্ধি ব্যবহারের দিক দিয়াও এই পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ পুরুষদের সুগদ্ধি এমন হইবে যাহার ঘ্রাণ প্রকাশমান; কিন্তু উহার বর্ণ প্রচ্ছন্ন। আর মেয়ে লোকদের সুগদ্ধি তাহা যাহার বর্ণ প্রকাশমান ও ঘ্রাণ প্রচ্ছন্ন। (তিরমিযী)
অর্থাৎ পুরুষরা সুগন্ধির জন্য যে জিনিস ব্যবহার করিবে, তাহা বর্ণ প্রকাশমান হইবে না। যেমন গোলাপ জল, মিশক-আম্বর, কর্পূর, আতর ইত্যাদি। পক্ষান্তরে মেয়ে লোকেরা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যে জিনিস ব্যবহার করিবে তাহার বর্ণ প্রকাশমান হইবে; কিন্তু উহার গন্ধ প্রকাশমান হইবে না, যেমন জাফরান, আলতা ইত্যাদি। হাদীস বিশারদগণ বলিয়াছেনঃ
****************************************
মহিলাদের সুগন্ধি ও সৌন্দর্যবৃদ্ধিমূলক দ্রব্যাদি সম্পর্কে উপরোক্ত হাদীসে যাহা কিছু বলা হইয়াছে, তাহা ঠিক সেই প্রসঙ্গে প্রযোজ্য, যখন তাহারা ঘর, হইতে বাহির হইবে। কিন্তু তাহারা যখন ঘরে ও স্বামীর নিকট থাকিবে, তখন তাহারা যে কোন সুগন্ধি ব্যবহার করিতে পারে। উহার ঘ্রাণ প্রকাশমান হইলেও কোন দোষ হইবে না।
এই পর্যায়ে হযরত ইমরান ইবনে হুচাইন (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছে? নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
পুরুষদের জন্য উত্তম সুগন্ধি হইল যাহারা ঘ্রাণ প্রকাশমান ও বর্ণ প্রচ্ছন্ন এবং স্ত্রী লোকদের জন্য উত্তম সুগন্ধি হইল যাহার বর্ণ প্রকাশমান ও ঘ্রাণ প্রচ্ছন্ন।
এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর কথা কেবল মাত্র ভাল মন্দ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ইহাপেক্ষাও কঠিন ও কঠোর। হযরত আবূ মূসা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
প্রতিটি চক্ষুই ব্যভিচারী। কোন স্ত্রী লোক যখন সুঘ্রাণ ব্যবহার করিয়া পুরুষদের সমাবেশে যায়, তখন সে ইহা…. ইহা।
‘প্রতিটি চক্ষুই ব্যাভিচারী’ অর্থ যে দৃষ্টিই ভিন মেয়ে লোক বা পুরুষ লোকের উপর যৌন কামনা মিশ্রিত হইয়া পতিত হইবে, তাহাই ব্যভিচারে লিপ্ত মনে করিতে হইবে। অর্থাৎ যৌন কামনা মিশ্রিত দৃষ্টি কখনও ভিন্ন মেয়ে পুরুষের উপর পতিত হওয়া উচিত নয়। এই ধরনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া অনিবার্য হইয়া পড়ে বিশেষ করিয়া তখন যখন কোন মেয়ে লোক তীব্র ঘ্রাণযুক্ত কোন সুগদ্ধি বা সাজ-সয্যা ব্যবহার করিয়া পুরুষদের সমাবেশে উপস্থিত হয়। তখন ইহা প্রথমে তিন মেয়ে পুরুষের কামনা-পংকিল দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। পরে ইহা ব্যাভিচারের দ্বার উন্মুক্ত করে। কেননা এই সুঘ্রাণ পুরুষদের মনে যৌন উত্তেজনার সৃষ্টি করে অনিবার্যভাবে। তখন শুধু দৃষ্টি বিনিময় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে না। এক কথায় দৃষ্টির ব্যভিচার কার্যত ব্যাভিচার ঘটাইবার কারণ হইয়া দাঁড়ায়। কাজেই ইহা অবশ্যই পরিতাজ্য।
(**********)
বস্তুত পুরুষ পুরুষই, নারী নয়। আর নারী নারই, পুরুষ নয়। এ কথা চূড়ান্তভাবে সত্য। ইহার বিপরীত সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। ইহাদের মধ্যে দেহগত মৌলিক পার্থক্য রহিয়াছে এবং তাহা জন্মগত। তাহাদের স্বাভাবিক কাজ কর্মও মৌলিক পার্থক্য পূর্ণ। প্রত্যেকেরই একটি নিজস্ব বিশেষত্ব রহিয়াছে। এইরূপ অবস্থায় পুরুষ যদি নারীজনোচিত কাজ করে, পোষাক পরে, কিংবা নারী করে পুরুষজনোচিত, তাহা হইলে চরম সামাজিক বিপর্যয় অনিবার্য হইয়া পড়িবে। নারী তাহার নারীত্ব ও নারীর সুকোমল গুণাবলী হারাইয়া ফেলিবে, পুরুষ তাহার পৌরুষের বিশেষত্ব হইতে অবশ্যই বঞ্চিত হইয়া পড়িবে।উভয়ই নিজ নিজ মৌল সত্তা সংক্রান্ত বিশেষত্ব ও গৌরবের আসন হইতে বিচ্যুত হইবে।
এই কারণে নবী করীম (স) সম্পর্কে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
যে পুরুষ মেয়ে লোকের পোষাক পরিধান করিল এবং যে মেয়েলোক পুরুষের পোশাক পরিধান করিল, নবী করীম (স) এই উভয়ের উপর অভিসম্পাত করিয়াছেন।
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত, বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) পুরুষের বেশ দারণকারী মেয়েলোকের উপর অভিশাপ বর্ষণ করিয়াছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স হইতে ইমাম আহমাদ বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি একটা গলাবদ্ধ পরিহিত একটি মেয়েলোক দেখিতে পাইলেন- দেখিলেন, মেয়েটি পুরুষের মত চলিতেছে। তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ***** এ কে? সে জওয়াবে বলিলঃ আমি উম্মে সায়ীদ বিনতে আবূ জিহল। তখন তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
যে মেয়েলোক পুরুষ সদৃশ হইবে, সে আমাদের সমাজভুক্ত নয়।
যে সব মেয়েলোক পুরুষালি চরিত্র ও ভুষণ অবলম্বন করিবে, তাহাদিগকে নবী করীম (স) ঘ র হইতে বহিষ্কৃত করিতে বলিয়াছেন।
হযরত আহূ হুরাইরা (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, একজন নপুংষককে রাসূলে করীম (স)-এর সামনে উপস্থিত করা হইল। সে তাহার দুই হাতও হেনার রঙে রঙীন বানাইয়া লইয়াছিল। তাহাকে দেখিয়া রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ এই ব্যক্তির অবস্থা কি? লোকেরা বলিলেনঃ সে নারীদের সহিত সাদৃশ্য রক্ষা করিতেছে। তখন নবী করীম (স) তাহাকে নির্বাসিত করিবার আদেশ করিলেন। কেহ জিজ্ঞাসা করিলেন, হে রাসূল, আপনি লোকটিতে হত্যা করাইলেন না কেন? জওয়াবে বলিলেন, নামাযী লোকদের হত্যা করার জন্য আমি আদিষ্ট হই নাই।
রাসূলে করীম (স) হযরত উসামা ইবনে জায়দ (রা) কে মিশরের কিবতীদের বয়নে তৈরী একটি পোষাক উপঢৌকন দিয়াছিলেন। উসামা তাহা তাঁহার স্ত্রীকে দিয়াছিলেন। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কিবতীদের সেই (আমার দেওয়া) কাপড় পরিতেছনা কেন? উসামা ইবনে জায়দ বললেন, হে রাসূল! আমি তো সে পোষাক আমার স্ত্রীকে পরাইয়া দিয়াছি। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
তুমি তোমার স্ত্রীকে সেই কাপড়ের নীচে আর একটা কাপড় (পেটিকোট) পরিতে বলিবে কেননা আমি ভয় পাইতেছি, ও কাপড় এতই পাতলা যে, উহা পরিলেও তোমার স্ত্রীর অস্থির মজ্জা পর্যন্ত বাহির হইতে দেখা যাইবে।
অপর একটি বর্ণনায় হাদীসটির ভাষা হইলঃ
****************************************
তোমার স্ত্রীকে বল, সে যেন সে কাপড়ের নীচে আর একটি কাপড় পরে, যাহাতে ভিতরে অঙ্গ প্রতঙ্গ দেখা যাইবে না।
ইমাম শাওকানী লিখিয়াছেন, এই হাদীসটি প্রমাণ করে যে, মেয়েদের উচিত তাহার কাপড় দ্বারা দেহকে এমনভাবে আবৃত করা, যেন উহা ছাপাইয়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দৃশ্যমান হইয়া না উঠে। পুরুষদের আটোশাটো পোশাক এই পর্যায়েই পড়ে। তাহা এতই টাইট হয় যে উহা পরা সত্ত্বেও অংগ প্রত্যংগ বাহিরে প্রকাশমান হইয়া পড়ে।
মোট কথা, পুরুষ সর্বদিক দিয়া পুরুষ থাকিবে, মেয়েলোক সর্বদিক দিয়া মেয়েলোক থাকিবে ইহাই ইসলামী শরীয়াতের বিধান। ইহার ব্যতিক্রম সমাজে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
লজ্জাস্থান আবৃত রাখার তাকীদ
****************************************
বহজ ইবনে হাকীম হইতে, তাহার পিতা হইতে, তাঁহার দাদা হইতে বর্ণিত হইয়াছে, বলিয়াছেন, আমি বলিলামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের লজ্জাস্থান সমূহের মধ্যে কতটা আমরা আবৃত রাখিব আর কতটা ছাড়িয়া দিব? রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তোমার লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ কর। তবে তোমার স্ত্রী কিংবা তোমার দক্ষিণ হাতের মালিকানাভুক্তদের ব্যাপারে এই সংরক্ষণ থাকিবে না। জিজ্ঞাসা করিলাম, লোকেরা যখন পরস্পরে সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া থাকে তখন কি করিতে হইবে? বলিলেনঃ যদি পার যে, কেহ কাহারও লজ্জাস্থান দেখিবে না, তাহা হইলে কক্ষণই দেখিবে না। বলিলামঃ আমাদের কেহ যখন একান্ত একাকী থাকে, তখনকার জ ন্য কি হুকুম? বলিলেনঃ তখন তো আল্লাহ তা’আলা বেশী অধিকার সম্পন্ন এই জন্য যে, তাঁহার ব্যাপারে লজ্জাবোধ করিতে হইবে।
(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দায়ুদ, ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যাঃ ইমা তিরমিযীর ভাষায় বহজ ইবনে হাকীম বলিয়াছেনঃ ‘আমার পিতা- (হাকীম) আমার দাদার নিকট হইতে এই হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন। বহজ- এর দাদা এই হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী। তিনি সাহাবী ছিলেন এবং নিজেই রাসূলে করীম (স)-এর সহিত কথা বলিয়াছেন, যাহার বিবরণই এই হাদীস। তাঁহার নাম মুয়াবীয়া ইবনে হীদা (রা)।
হাদীসের শব্দ ***** শব্দটি ***** এর বহুবছন। মানব দেহের যে অঙ্গের উলংগ হইয়া পড়া লজ্জাকর, তাহাই **** বা লজ্জাস্থান। ইহা পুরুষে নারীতে পার্থক্য রহিয়াছে। নাভী হইতে হাটু পর্যন্ত পুরুষ দেহের লজ্জাস্থান এবং স্বাধীনা নারীর মুখ মণ্ডল ও কবজি পর্যন্ত দুই হাত ছাড়া সমগ্র দেহই লজ্জাস্থান। মানবদেহের এই লজ্জাস্থান অবশ্যই আবৃত রাখিতে হইবে। নামাযে যেমন তেমনি নামাযের বাহিরেও সব সময়ই ইহা ঢাকিয়া রাখিতে হইবে।
আমাদের দেহের কোন কোন অংশ আবৃত রাখিব আর কোন কোন অংশের আবরণ মুক্ত করিতে পারিব, এই জিজ্ঞাসার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তোমার লজ্জাস্থান- নাভী হইতে হাঁটু পর্যন্তকার অঙ্গ সমূহের আবরণ রক্ষা কর। কিন্তু তোমার স্ত্রী ও ক্রীতদাসীর ক্ষেত্রে এই নির্দেশ নাই।
দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হইয়াছেঃ পুরুষ লোকেরা যখন একটি স্থানে পরস্পর একত্রিত হয় ও মিলিয়া-মিশিয়া থাকে, নিজেদের স্থান ত্যাগ করে না, তখন সেই লোকদের পক্ষে লজ্জাস্থান আবৃত রাখা ও পূর্ণ মাত্রার পর্দা পালন সম্ভবপর হয় না। অনেক সময় পরিধানের কাপড়ের সংকীর্ণতা বা জীণ-শীর্ণতার দরুন; কিংবা প্রয়োজন দেখা দেওয়ার দরুন ইহা করা কঠিন হইয়া পড়ে। তখন আমরা লজ্জাস্থান আবৃত রাখার ব্যাপারে কি করিতে পারি? ইহার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) যাহা বলিয়াছেন তাহার অর্থ, তখনও যদি পার তাহা হইলে কেহ স্বীয় লজ্জাস্থান অন্যকে দেখাইবে না। অর্থাৎ বহুলোকের একস্থানে একত্রিত হইয়া মিলিয়া মিশিয়া একাকার হইয়া থাকা অবস্থায়ও লজ্জাস্থান আবৃত রাখা ও উহার কোন অংশ অন্যকে না দেখানোর জন্য সতর্ক থাকিবে ও সাধ্যমত চেষ্টা চালাইবে।
রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি দুইটি বর্ণনায় দুই রকম উদ্ধৃত হইয়াছে; কিন্তু দুইটির মূল বক্তব্য তাহাই যাহা বলা হইল।
তৃতীয় প্রশ্ন হইল, মানুষ যখন একান্ত নিভৃতে নিঃসংগ একাকী থাকে তখন কি করিতে হইবে? অর্থাৎ তখন তো আর লজ্জা নিবারণের কোন কারণ থাকে না। তাহার লজ্জাস্থান দেখিতে পারে এমন কেহই কোথায়ও থাকে না। তখন এ ব্যাপারে খুব একটা সতর্কতার প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে হয় না? ইহার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) যাহা বলিয়াছেনঃ তাহার তাৎপর্য হইলঃ মানুষ নিভৃত একাকীত্বে নিঃসঙ্গ হইয়া থাকিলেও এবং দ্বিতীয় কোন লোক নিকটে না থাকিলেও মহান আল্লাহ তথায় উপস্থিত থাকেন। কাজেই তাঁহার ব্যাপারে লজ্জাবোধ করা তো অধিক প্রয়োজন। আল্লাহর ব্যাপারে এই লজ্জাবোধ-লজ্জাস্থান তাঁহার অগোচরে ও তাঁহার হইতে গোপন রাখার দিক দিয়া নয়। কেননা তাহা কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়। এই লজ্জাবোধ থাকিতে হইবে লজ্জাস্থান আবৃত রাখার খোদায়ী নির্দেশ পালনের দিক দিয়া। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা লজ্জাস্থান আবৃত রাখার যে নির্দেশ দিয়াছেন তাহা লোকদের ভয়ে পালন করা উচিত নয়, পালন করা উচিত আল্লাহকে ভয় করিয়া। তাই কেহ নিকটে-আছে না থাকিলেও আল্লাহ তো থাকেন এবং দেখেন। তাই তখনও- সেই নিবৃত একাকীত্বেও-উলংগ হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা তখন তাহা করা হইলে কোন লোক হয়ত লজ্জাস্থান অনাবৃত রাখার এই অপরাধ দেখিতে পায় না; কিন্তু আল্লাহ তো দেখিতে পান যে, লোকটি একাকীত্বের সুযোগে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করিয়াছে। এই সময় বরং মানুসের উচিত আল্লাহকে অধিক লজ্জা করা- আল্লাহর নিদের্শ অধিক পালন করা। বস্তুত খোদার প্রতি মানুষের এই যে ভীতি ও লজ্জাবোধ, ইহাই ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তি। রাসূলে করীম (স) নানাভাবে নানা সময়ে ভিন্ন প্রসঙ্গের কথার মাধ্যমেও মানুষের মধ্যে এই ভিত্তিটির সুদৃঢ় করিয়া তুলিতে ও সুদৃঢ় রাখিতে চেষ্টা করিয়াছেন।
লজ্জাস্থান আবৃত রাখার আদেশে দুইটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রাখা হইয়াছে। একটি হইল স্ত্রী ও নিজ মালিকানাধীন ক্রীতদাসী। এই ক্ষেত্রে বিশেষ করিয়া সঙ্গম কালে পরস্পরের যৌন অংগ দর্শন নিষিদ্ধ করা হয় নাই। এতদ্ব্যতীত অন্য সমস্ত ক্ষেত্রেই তাহা সম্পূর্ণ হারাম। অতএব একজন পুরুষ যেমন অপর পুরুষের লজ্জাস্থান দেখিতে পারে না, তেমনি একজন মেয়েলোকও পারে না অপর মেয়েলোকের লজ্জাস্থান দেখিতে।
উপরোক্ত হাদীসটি হইতে একথাও জানা যায় যে, নিতান্ত নিবৃত নির্জনের একাকীত্বকালেও উলংগ হওয়া জায়েয নয়। অবশ্য ইমাম বুখারী হযরত মুসা ও হযরত আইউব (আ)-এর ঘটনার উল্লেখ করিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, গোসল করার সময় নিভৃত একাকীত্বে উলংগ হওয়া জায়েয। কেননা এই দুইজন নবীর এইরূপ ঘটনা বর্ণিত হইয়াছে এবং আমরা তাঁহাদের মানিয়া চলার জন্য আদিষ্ট হইয়াছি। যতক্ষণ না বিশেষ কোন কাজের নিষেধ আমাদের শরীয়াতে আসিয়াছে। নবী করীম (স) নিজেই তাঁহাদের নিভৃত একাকীত্বে উলংগ হইয়া গোসল করার কথা বর্ণনা করিয়াছেন; কিন্তু তিনি তাহা করিতে নিষেধ করেন নাই। ফলে এই ব্যাপারে উভয় শরীয়াতের অভিন্নতাই প্রমাণিত হয়। যদি আমাদের জন্য তাহা নাজায়েয হইত, তবে নবী করীম (স) তাহা সঙ্গে সঙ্গেই বলিয়া দিতেন। এই দৃষ্টিতে ইসলামী শরীয়াতে একটি ফর্মূলা রচিত হইয়াছে এই ভাষায়ঃ
****************************************
আমাদের পূর্ববর্তী লোকদের শরীয়াত আমাদেরও শরীয়াত যতক্ষণ না তাহা রহিত হইয়া যায়।
তবে ইমাম বুখারীর এই মত সহীহ হাদীসের বিপরীত বলিয়া মনে হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
রাসূলে করীম স) বলিয়াছেনঃ তোমরা উলংগ হওয়া হইতে নিজদিগকে দূরে রাখ। কেননা তোমাদের সহিত এমন সব লোক রহিয়াছে যাহারা তোমাদের হইতে কখনই বিচ্ছিন্ন হয় না। তবে পায়খানা করা ও স্ত্রী সহিত সঙ্গম অবস্থা এই নিষেধের বাহিরে। অতএব তোমাদের সেই সঙ্গীদের ব্যাপারে তোমরা লজ্জাবোধ করিবে এবং তাহাদিগকে সম্মান দিবে।
অর্থাৎ নিভৃত একাকীত্বেও উলংগ হইবে না। তবে কেবলমাত্র পায়খানা পেশাব করা ও স্ত্রী সঙ্গম কালে ইহার ব্যতিক্রম করার অনুমতি রহিয়াছে।
হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
একজন পুরুষ অপর পুরুষের লজ্জাস্থানের উপর দৃষ্টি দিবে না, একজন স্ত্রীলোক অপর স্ত্রীলোকের লজ্জাস্থান দেখিবে না। অনুরূপ ভাবে একজন পুরুষ অপর পুরুষের নিকট এক কাপড়ে এবং একজন স্ত্রীলোক অপর স্ত্রীলোকের নিকট এক কাপড়ে যাইবে না।
এক কাপড়ে যাওয়া, অর্থ দেহের লজ্জাস্থান সম্পূর্ণ আবৃত না করিয়া যাওয়া, এমন ভাবে যাওয়া যাহাতে লজ্জাস্থানের কোন অংশ উলংগ হইয়া থাকে। ইহা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
(*******)
স্বামী-স্ত্রীর গোপন কার্য প্রকাশ না করা
****************************************
হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ আল্লাহর নিকট কিয়ামতের দিন মান-মর্যাদার দিক দিয়া নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হইবে সেই পুরুষ, যে স্ত্রীর সহিত মিলন ও সঙ্গম করে এবং স্ত্রী স্বামীর নিকট হইতে সঙ্গম সুখ উপভোগ করে। অতঃপর ইহার গোপন কথ প্রকাশ ও প্রচার করিয়া দেয়।
(মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক অতীব গোপনীয় ব্যাপার। ইহা প্রকাশ্যে লোক চক্ষুর সম্মুখে কখনও সাধিত হইতে পারে না, হওয়া শোভন ও বাঞ্ছনীয় নয়। শুধু তাহাই নয়, সম্ভবত লোকদের সম্মুখে এই কার্য সাধিত হইলে তাহাতে বাঞ্ছিত চূড়ান্ত সুখ লাভ করাও সম্ভবপর নয়। তাই ইহা সম্পূর্ণ গোপনে সাধিত হইতে হইবে। শুধা তাহই নয়। ইহা সাধিত হইতে হইবে এমনভাবে, যাহাতে অন্য কেহ টেরও না পায়। বস্তুত স্বামী-স্ত্রী মিলনের সমস্ত মাধুর্য ও পবিত্রতা সম্পূর্ণরূপে এই গোপনীয়তায়ই নিহিত।
কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক লীলা খেলা গোপনে সাধিত হওয়ার পর স্বামী বা স্ত্রী যদি উহার তত্ত্ব রহস্য অন্যদের নিকট প্রকাশ করিয়া দেয়, তাহা হইলে তাহার মত নির্লজ্জতা- অতএব নিতান্ত পশু শোভন কাজ আর কিছুই হইতে পারে না। কেননা তাহাতে সেই গোপনীয়তার সমস্ত পবিত্রতা ও মাধুর্য ইহাতে নিঃশেষ হইয়া যায়।
এই পর্যায়ে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) একদা সাহাবায়ে কিরামের প্রতি মুখ ফিরাইয়া বসিলেন এবং বলিলেনঃ তোমরা সকলে নিজ নিজ আসনে বসিয়া থাক। তোমাদের মধ্যে কি এমন কোন পুরুষ আছে, যে তাহার স্ত্রীর নিকট আসে, ঘরের দুয়ার বন্ধ করিয়া দেয় এবং পর্দা ঝুলাইয়া দেয়— অতঃপর বাহির হইয়া বলিতে শুরু করে, ‘আমি আমার স্ত্রীর সহিত এই এই করিয়াছি’। ‘আমি আমার স্ত্রীর সহিত এই—এই করিয়াছি? সাহাবীগণ এই প্রশ্নে সম্পূর্ণ চূপ করিয়া থাকিলেন। ইহার পর নবী করীম (স) মহিলাদের দিকে আগাইয়া গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমাদের মধ্যে এমন কেহ আছে কি, যে এই রূপ বলিয়া বেড়ায়? তখন একজন যুবতদী তাহার এক হাঁটুর উপর ভয় দিয়া উচ্চ হইয়া বসিল, যেন রাসূলে করীম (স) তাহাকে দেখিতে পান ও তাহার কথা শুনিতে পারেন। অতঃপর সে বলিলঃ আল্লাহর কছম, এই পুরুষেরা এইরূপ নিশ্চয়ই বলে এবং এই মেয়েরও এইরূপ বলিয়া বেড়ায়। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ এই রূপ যাহারা করে তাহাদিগকে কিসের সহিত দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে তাহা কি তোমরা জান? এইরূ কাজ যে যে করে তাহাকে পুরুষ শয়তান ও নারী শয়তানী বলিয়া দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে। যাহাদের একজন অপর জ নের সহিত রাজপথে মিলিত হয় ও নিজের যৌন প্রয়োজন স্বীয় সঙ্গী হইতে পুরণ করিয়া লয়। আর লোকেরা সব উহার দিকে চক্ষু মেলিয়া তাকাইয়া থাকে ও কাজ হইতে দেখিতে পারে।
(মুসনাদে আহমাদ, আবূ দায়ূদ, নাসায়ী, তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসটিতে পুরুষ শয়তান ও নারী শয়তানের প্রকাশ্যে রাজপথে যৌন প্রয়োজন পূরণ করার যে দৃষ্টান্তটি রাসূলে করীম (স) দিয়াছেন তাহা সেই স্বামী স্ত্রীর দৃষ্টান্ত যাহারা গোপনে যৌন প্রয়োজন পূরণের পর অনুষ্ঠিত লীলা খেলার কথা লোকদের নিকট বলিয়া বেড়ায়। এই হাদীসটিতে যে মজলিসের উল্লেখ রহিয়াছে, সম্ভবত তাহা কোন নামাযের পরবর্তী মজলিস। রাসূলের যুগে মেয়ে পুরুষ উভয়ই মসজিদে নামাযের জামায়াতে শরীক হইতেন যদিও তাহাদের স্থান হইত ভিন্ন ভিন্ন। উভয় শ্রেণীর লোকদের নিকট জিজ্ঞাসা করার পর রাসূলে করীম (স) যে কথা গুলি বলিয়াছেন, তাহা উভয়ই শুনতে পাইতেছিল। কেননা ইহাদের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশী ছিল না।
শেষোক্ত হাদীস হইতে ইহাও জানা যায় যে, স্বামী-স্ত্রীর মিলন হইবার সময় ঘরের দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া লওয়া উচিত, যেন হঠাৎ করিয়া কেহ ঘরে প্রবেশ করিয়া না বসে। সেই সঙ্গে ভিতর হইতে পর্দাও ঝুলাইয়া দেওয়া উচিত। যেন বাহির হইতে কেহ চেষ্টা করিলেও যৌন মিলন কার্য প্রত্যক্ষ করিতে না পারে।
এই দুইটি হাদীস হইতেই অকাট্য স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যৌন মিলন সক্রান্ত ঘটনাবলীর বিবরণ অন্য লোকদের নিকট বর্ণনা করা ও উহার প্রচার করা ঠিক তাহাদের সম্মুখে প্রকাশ্যভাবে যৌন কর্ম করার মত ব্যাপার এবং এই কাজ যাহারা করে, তাহারা নিকৃষ্টতম লোক। বস্তুত এইরূপ হীন জঘন্য ও বীভৎস কাজ আর কিছু হইতে পারে না। ইহা নিতান্তই শয়তানের মত নির্লজ্জ কাজ। এই কাজটি যদি খুব ছোট মানের খারাপ হইত, তাহা হইলে এই কাজ যাহারা করে তাহাদিগকে রাসূলে করীম (স) নিশ্চয়ই ****** ‘নিকৃষ্টতম’ বলিয়া অভিহিত করিতেন না।লোকদের দেখাইয়া যৌন কার্য সমাধা করাও অনুরূপভানে নিকৃষ্টতম জঘন্যতম কাজ। ইহার হারাম হওয়ার একবিন্দু সন্দেহ নাই।
হযরত আবূ সায়ীদ বর্ণিত প্রথমোক্ত হাদীসটিতে কেবল পুরুষ বা স্বামীকেই নিকৃষ্টতম লোক বলা হইয়াছে। স্ত্রীলোক সম্পর্কে উহাতে কিছুই বলা হয় নাই। ইহার কারণ এই যে, এই ধরনের কাজ প্রধানত পুরুষদের দ্বারাই সংঘটিত হইয়া থাকে। আর স্ত্রী লোকদের তুলনায় পুরুষরা যে একটু বেশী নির্লজ্জ, তাহা তো সকলেরই জানা। কেহ কেহ বলিয়াছেন, স্ত্রী সঙ্গম সুখের ব্যাপার সমূহ- যাহা স্বামীতে-স্ত্রীতে ঘটিয়া থাকে তাহা- স্ত্রী যেরূপ আচরণ করে, যে সব কথা বলে ও কাজ করে, তাহার যে অবস্থা দেখা দয়ে সেই সবের বর্ণনা দেওয়াই হারাম। শুধু স্ত্রী সঙ্গমের কথা উল্লেখ করিলে তাহা হারাম হইবে না। তবে তাহা মকরূহ অবশ্যই হইবে। কেননা ইহা মানুষের শালীনতা বিরোধী। ইহার বর্ণনা অর্থহীনও বটে। অর্থহীন নিস্ফল কথা বলা পরিহার করা ইসলামী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
যে লোক আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, তাহার উচিত ভাল ও কল্যাণময় কথা বলা। আর তাহা না বলিলে বা বলিতে না পারিলে তাহার চুপ করিয়া থাকা উচিত।
তবে ইহার উল্লেক যদি প্রয়োজনীয় হইয়া পড়ে কোন কারণে, তাহা হইলে তাহার উল্লেক করায় কোন দোষ নাই। যেমন স্ত্রী যদি স্বামীর যৌন সঙ্গমকে অস্বীকার করে বা বলে যে, সে ইহাতে অক্ষম, ইত্যাদি কারণে ইহার উল্লেখের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। স্বয়ং নবী করীম (স)-ও বলিয়াছেনঃ *********** ‘হ্যাঁ, আমি নিজেই এই কাজ করি, আর সেও করে। তিনি হযতর আবূ তালহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেনঃ ****** ‘তুমি কি রাত্রিবেলা স্ত্রীর সহিত যৌন মিলন করিয়াছ’। ইত্যাদি। তবে নিছক উল্লেখ এককথা, আর উহার বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বিবরণ দেওয়া বা রসময় কাহিনী বানাইয়া বলা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। প্রথমটি সম্পূর্ণ হারাম নয়, দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণ হারাম।
(*********)
এইরূপ নিষেধ বাণীর মূল উদ্দেশ্য হইল, পরিবেশকে পবিত্র ও যৌন পংকিলতা মুক্ত রাখা। ইসলামের দৃষ্টিতে ইহা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে ইসলামী সমাজে নগ্নতা ও অশ্ললতা সব সময়ই বর্জনীয়। নারী পুরুষের উচ্ছৃঙ্খল চলা ফিরা, অবাধ মেলা-মেশা পথে-ঘাটে, পার্কে, বিপনীতে, ক্লাবে, থিয়েটারে এবং পত্র-পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে যৌন আবেদন উদ্বোধনমূলক কোন অনুষ্ঠান প্রচার এই কারণে সম্পূর্ণ নিষেধ।
স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার
****************************************
হযরত মুয়াবীয়া আল কুশাইরী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি বলিলাম, ইয়া রাসূল! আমাদের উপর আমাদের একজনের স্ত্রীর কি কি অধিকার রহিয়াছে? জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি যখন খাইবে তখন তাহাকেও খাওয়াইবে, তুমি যখন পরিবে তখন তাহাকেও পরিতে দিবে। আর মুখের উপর মারিবে না। তাহাকে কটুরূঢ় অশ্লীল কথা বলিবে না এবং ঘরের ভিতরে ছাড়া তাহার সহিত সম্পর্ক ত্যাগ করিবে না।
(আবূ দায়ূদ ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার কি এই প্রশ্নের জওয়াবে নবী করীম (স) এখানে মোট পাঁচটি কথা বলিয়াছেন। প্রথম কথা খাবার দেওয়া, দ্বিতীয় পরার কাপড়-জামা দেওয়া, তৃতীয় মুখের উপর না মারা, চতুর্থ কটুরূঢ় অশ্লীল কথা না বলা এবং পঞ্চম ঘর ছাড়া অন্য কোথাও তাহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন না করা।
রাসূলে করীম (স)-এর এই কথা কয়টি অতীব মৌলিক ও নিতান্তই প্রাথমিক পর্যায়ের। কেননা এই কাজ কয়টি যথাযথ না হইলে স্ত্রীর জীবন মান রক্ষা করাই সম্ভব হইত পারে না। যেমন খাওয়া পরা। খাওয়া মানুষের জীবন বাঁচাইয়া রাখার জন্য অপরিহার্য। খাবার জোটানো স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। রাসূলের কথার ধরণ ****** ‘তুমি যখন খাইবে তখন তাহাকেও খাইতে দিবে’। অর্থাৎ তুমি নিজের খাবার ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীরও খাবার জোটানো তোমার কর্তব্য। তুমি যখন অবিবাহিত ছিলে তখন হয়ত তোমার পরিবারিক দায়িত্ব কিছুই ছিল না। তখন হয়ত তুমি একা নিজের খাবার জুটাইবার জন্যই চিন্তান্বিত হইতে। কিন্তু বিবাহ করার পর তোমার খাবারের সঙ্গে যুক্ত হইয়াছে তোমার স্ত্রীর খাবার জোটানোর দায়িত্ব। ইহাতে আরও দুইটি কথা নিহিত আছে। একটি হইল, তুমি যাহা খাইবে স্ত্রীকেও তাহাই খাইতে দিবে। তোমার খাওয়া দাওয়ার যে মান, তোমার স্ত্রীর খাওয়া-দাওয়ার মানও তাহাই হইত হইবে। তাহার কোন অংশে কম হইতে পারিবে না। এমনও হইতে পারিবে না যে, তুমি ভাল খাইবে আর স্ত্রীকে নিকৃষ্ট মানের খাবার দিবে বা তাহা খাইতে বাধ্য করিবে। কিংবা যাহা রান্না হইতে তাহা তুমি একাই সব খাইয়া নিঃশেষ করিয়া ফেলিবে, আর স্ত্রীকে অভুক্ত থাকিতে বাধ্য করিবে। সম্ভবত এই কথাটাও ইহা হইতে বুঝিতে পারা যায় যে, স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে খাবার খাইবে। বস্তুত এক সঙ্গে তথা একপাত্রে খাবার খাওয়া দাম্পত্য জীবনে মাধুর্য ও ভালবাসার গভীরতা সৃষ্টির জন্য বিশেষ সহায়ক। দ্বিতীয়ঃ ******* তুমি নিজে যখন জামা-কাপড় পরিবে, স্ত্রীকেও তখন জামা-কাপড় পড়িতে দিবে। পোষাক-পরিচ্ছদ তোমার একারই প্রয়োজন নয়, উহা তোমার স্ত্রীর-ও প্রয়োজন। পোশাক তো সাধারণ ভাবে সব মানুষেরই লজ্জা নিবারণের একমাত্র উপায়। কিন্তু শুধু তাহাই নয়। তোমার সামর্থ্যানুযায়ী যে মানের পোশাক তুমি নিজে পরিবে স্ত্রীকেও সেই মানের কাপড় পড়িতে দিবে। তুমি যদি বেশী মূল্যের ও অতীব উত্তম মানের পোশাক গ্রহণ কর; আর স্ত্রীকে যেমন-তেমন কাপড় পড়িতে দাও, তাহা হইলে তাহা যেমন মানবিক নয়, তেমনি দাম্পত্য জীবনের পক্ষে শান্তি-সম্প্রীতি সৃষ্টিরও অনুকুল হইতে পারে না। সেই সঙ্গে একথার প্রতিও লক্ষ্য রাখা আবশ্যক যে, তুমি যখন একটা নূতন পোশাক কিনিবে, তোমার স্ত্রীর জন্যও তখন নূতন কাপড় ক্রয় করিবে। ইহাতে স্ত্রীর মন রক্ষার ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব পালিত হইবে। সেই সঙ্গে স্ত্রীও তোমার প্রতি অধিক আস্থা সম্পন্না ও শ্রদ্ধাশীলা হইবে। খাওয়া-পড়া সংক্রান্ত রাসূলে করীম (স)-এর এই নির্দেশটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এই পর্যায়ে কুরআন মজীদের তিনটি আয়াত স্মরণীয়। একটি আয়াত এইঃ
****************************************
যাহার জন্য সন্তান- অর্থাৎ স্বামী- তাহার কর্তব্য স্ত্রীদের জন্য প্রচলিত নিয়মে, মধ্যম মান অনুযায়ী খোরাক ও পোশাকের ব্যবস্থা করা।
****************************************
সচ্ছল অবস্থাশালী স্বামীর কর্তব্য তাহার সামর্থ্যানুযায়ী পরিবার বর্গের জন্য ব্যয় করা এবং দরিদ্র-অভাবগ্রস্থের কর্তব্য তাহার সামর্থ অনুযায়ী ব্যয় করা। কিন্তু এই উভয় অবস্থায়ই প্রচলিত মান অনুযায়ী খোরাক-পোশাক দিতে হইবে। আর ইহা সদাচারী লোকদের জন্য অবশ্যই পালনীয়।
তৃতীয় আয়াতঃ
****************************************
সচ্ছল অবস্থাশালী ব্যক্তি পরিবার বর্গের জর্ন ব্যয় করিবে তাহার সচ্ছলতা অনুপাতে। আর যাহার রিযিক পরিমিত, স্বল্প, সে যেন আল্লাহর দেওয়া জিনিস হইতে সেই অনুপাতে ব্যয় করে। আল্লাহ কাহাকেও তাঁহার দেওয়া পরিমাণের অধিক ব্যয় করার দায়িত্ব দেন না।
হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
স্ত্রীদের খাওয়া ও পরার ব্যবস্থা করা তোমাদের- অর্থাৎ স্বামীদের দায়িত্ব।
এই পর্যায়ের অপর একটি হাদীসের ভাষা হইলঃ
****************************************
‘মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট হইতে একটা উত্তম নিয়ম ও আচার পদ্ধতি গ্রহণ করিয়াছে। তাহা হইল, আল্লাহ যখন তাহাতে প্রশস্ততা বিপুলতা দেন, সেও (ব্যয়ের ক্ষেত্রে) প্রশস্ততা অবলম্বন করে। আর যখন তিনি তাহাকে সংকীর্ণতা- অভাব ও দারিদ্রে- ফেলেন, তখন সেও সংকীর্ণতার মধ্য দিয়াই চলে।
রাসূলে করীমের অপর একটি বানী হইলঃ
****************************************
তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার তোমাদের উপর এই যে, তোমরা তাহাদের খোরাক পোশাক জোগাইবার ব্যাপারে বিশেষ আন্তরিকতা পোষণ করিবে- যতবেশী ভাল করা সম্ভব তাহা করিবে।
তৃতীয় বলা হইয়াছেঃ ******** মুখের উপর- মুখ মণ্ডলের উপর কখনও মারিবেনা। শুধু মুখ মণ্ডলের উপর মারিতে নিষেধ করা হইয়াছে। তাহা হইলে কি দেহের অন্যান্য অংশের উপর মারা যাইতে পারে… মূলত স্ত্রীকে মারার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না। কেননা স্ত্রীকে মার ধর করিবে, এই উদ্দেশ্যে তো আর কেহ বিবাহ করে না। কিন্তু তবুও স্ত্রীকে অবস্থা ও কারণ বিশেষ কিছুটা মারধর করার অধিকার অনুমতি স্বামীকে কুরআন মজীদেই দেওয়া হইয়াছে। এই পর্যায়ের সম্পূর্ণ আয়াতটি সম্মুখে রাখিলেই ইহার তাৎপর্য বুঝিতে পারা যাইবে এবং পাওয়া যাইবে আমাদের এইমাত্র উত্থাপিত জিজ্ঞাসাগুলির সঠিক জওয়াব। আয়াতটি এইঃ
****************************************
যে সব স্ত্রীদের স্বামীর আনুগত্য হইতে বিদ্রোহ করার ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত আশংকা বোধ করিবে, তাহাদিগকে তোমরা উপদেশ দিবে, শয্যায় তাহাদের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিবে এবং তাহাদিগকে মারিবে।
স্বামী-স্ত্রীর মিলিত সংসারের কর্ণধার ও প্রধান পরিচালক হইল স্বামী। আর স্ত্রী সর্বব্যাপারে স্বামীর সহিত সহযোগিতা ও আনুকূল্য করিবে, ইহাই স্ত্রীর কর্তব্য। কিন্তু স্বামীকে এই মর্যাদা দিতে স্ত্রী যদি প্রস্তুত না হয়, সে যদি ক্রমাগত স্বামীর সহিত অবাধ্যতা করিতে থাকে, স্বামীর প্রবর্তিত পারিবারিক নিয়ম শৃঙ্খলা ভংগ করে, এই বিষয়ে স্বামীর দেওয়া যুক্তিসংঘত ও শরীয়ত সম্মত আদেশ-নিষেধ লংঘন করে, স্বামীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করার পরিবর্তে ক্রমাগত ঘৃণাই করিতে থাকে। তাহা হইলে স্বামীর মন কিছুতেই সুস্থির থাকিতে পারে না। তাহাকে তো দাম্পত্য শৃংখলা ও সংসার সংস্থাকে রক্ষা করিতেই হইবে। তাহা হইলে তখন সে কি করিবে? উপরোক্ত আয়াতে তাহার জন্য সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। আয়াতে বলা হইয়াছে, স্ত্রী এই বিদ্রোহাত্মক ভূমিকা দেখিয়া তুমি নীরব দর্শক হইয়া থাকিও না। তোমরা দায়িত্ব পালনার্থে তোমাকে পুরাপুরি কর্তব্য করিতে হইবে। আর তাহা হইল, সর্বপ্রথম স্ত্রীকে বুঝাইবে, উপদেশ দিবে, নছীহত করিবে। এই ব্যাপারে আল্লাহর দেওয়া বিধানের কথা তাহাকে স্মরণ করিয়াই জানাইয়া দিবে। দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য ও স্থিতি স্থায়ীত্ব রক্ষার্তে স্বামীর ন্যায়-সংগত সব কাজেই তাহাকে পুর্ণ আনুকূল্য ও আনুগত্য দিতে হইবে- দেওয়া কর্তব্য এবং এই ক্ষেত্রে স্বামীর প্রাধান্য মানিয়া চলা তাহার জন্য দ্বীনী ফরয, একথা সবিস্তারে তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিবে। যদি ইহাতেও সে নরম ও অনুগত না হয়, তাহা হইলে দ্বিতীয় কর্মপন্হা রূপে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
রাত্রিকালীন শয্যা গ্রহণে তাহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন কর’।
শযায় সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থ ঘুমাইবে একই শয্যায়- যেমন তোমাদের সাধারণ নিয়ম; কিন্তু শয্যায় শুইয়া স্ত্রীর সহিত কোন সম্পর্ক স্থাপন করিবে না। তাহার দিকে ফিরিয়া নয়, পিঠ ফিরাইয়া ঘুমাইবে। আর তাহার সহিত শৃংগার ও সঙ্গম করিবে না। শয্যায় দূরত্ব রক্ষা করিয়া থাকিবে। কেননা এইরূপ করা হইলে স্ত্রীর হৃদয়মনে স্বামীর প্রতি যদি একবিন্দু ভালবাসা থাকে, তাহা হইলে সে তাহার স্বামীর এই অনীহা ও বিতৃষ্ণার কারণ দূর করিতে ও তাহার সহিত মীমাংসা করিয়া ফেলিতে আগ্রহান্বিত হইবে। আর ইহাতেও যদি তাহার অনমনীয়তা দূরীভূত না হয় তাহা হইলে শেষ উপায় হিসাবে তাহাকে মারিবে। এই মার হয়ত স্ত্রীকে পথে আনিতে অনেক সাহায্য করিবে। বিদ্রোহী অসহযোগী অনমনীয় স্ত্রীকে পথে আনার ইহাই ইসলামের শিক্ষা দেওয়ার উপায় ও পদ্ধতি। ইহার কারণ এই যে, বিদ্রোহাত্মক ভাবধারা লক্ষ্য করিয়া যদি এই পন্হা গ্রহণ করা না হয়, তাহা হইলে তো হয় তাহাকে তখনই তালাক দিতে হয়, না হয় স্ত্রীকে বিনা তালাকেই বাপের বাড়ি বা অন্যত্র পাঠাইয়া ফেলিয়া রাখিতে হয়। কিন্তু ইহার কোনটাই ইসলাম সম্মত নয়। ইসলামের কাম্যও ইহা নয়। পরিবার সংস্থার অক্ষুণ্নতা ও শান্তি-সম্প্রীতি ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই ইসলাম এই ক্রমিক পদ্ধতি পেশ করিয়াছে।
কিন্তু স্ত্রীকে মারিবার এই অনুমতি নিরংকুশ বা শর্তহীন নয়। প্রথমতঃ এই মারটা হইবে ******* আদব ও নিময় শৃঙ্খলা শিক্ষা প্রদান উদ্দেশ্যে দেওয়া অকঠিন অশক্ত মার। আর ******* ‘এই মার না হাড় ভাঙিবে, না কোন জখম করিবে’। কেননা এস্থলে মারাটাই আসল লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হইতেছে স্ত্রীকে সংশোধন করা। আলোচ্য হাদীসে তাই বলা হইয়াছেঃ মুখের উপর মারিবে না। অর্থাৎ কোন সময় স্ত্রীকে পথে আনার জন্য অন্যান্য সব উপায় ব্যর্থ হওয়অর পর যদি এই পর্যন্ত পৌঁছিতেই হয় এবং ইহা ছাড়া আর কোন উপায়ই হাতে না থাকে, তাহা হইলে সর্বশেষ উপায় হিসাবে স্ত্রীকে মারিতে পার। কিন্তু সে মারের কোন আঘাত যেন মুখমণ্ডলের উপর না পরে। কেননা মুখমণ্ডল মানব দেহের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইহাতে নাক, চোখ, কপোল, মুখ, দাঁত ইত্যাদি অত্যন্ত নাজুক প্রত্যংক রহিয়াছে। মুখে মারিলে ইহার যে কোন একটা আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হইতে পারে। আর তাহা হইলে ইহা অত্যন্ত বীভৎস ব্যাপার হইয়া দাড়াইবে।
(*************)
ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন, চারটি কারণে স্ত্রীকে মারার স্বামীর অধিকার আছে। তাহা হইল (১) স্ত্রীর সাজ-সজ্জা পরিহার করা- অথচ স্বামী তাহা চাহে, (২) সঙ্গমে আহবান করার পর বিনা কারণে অস্বীকৃতি (৩) নামায না পড়া (হাদীসের কোন কোন বর্ণনা অনযায়ী) (৪) স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে ঘরের বাহিরে যাতায়াত।
ইমাম মুহাম্মদ বলিয়াছেন, নাময তরক করিলে, অপবিত্রতার হায়যের গোসল না করিলে স্ত্রীকে মারার স্বামীর কোন অধিকার নাই।
(************)
ইসলাম স্বামীকে অধিকার দিয়াছে স্ত্রীকে মার ধর করার। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা ও পারিবারিক রীতি-নীতি এই ব্যাপারে জনমনে বিশেষ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করিয়াছে। ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাইবার ও জনগণকে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ বানাইবার জন্য এই ব্যাপারটিকে একটি গুরুত্বপুর্ণ উপাদান রূপে গ্রহণ করা হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে প্রকৃত পক্ষে বিভ্রান্তির কিছুই নাই। উপরন্তু এই ব্যবস্থাকে বর্বরতা বলারও কোন যৌক্তিকতা নাই। কেননা আধুনিক মনস্তাত্ববিজ্ঞান এই ব্যবস্থার যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়াছে। আধুনিক মনস্তত্বের পারদর্শীগণ বলিয়াছেনঃ কোন কোন মানসিক রোগ এমন থাকিতে পারে যাহাতে দৈহিক শাস্তি দান ছাড়া রোগীর চিকিৎসার অন্য কোন পন্হাই কার্যকর হয় না। কোন কোন স্ত্রীলোক মার না খাওয়া পর্যন্ত পথে আসে না, বশ মানেনা। অনেক পুরুষও এমন রোগে আক্রান্ত হইতে পারে। তখন স্ত্রীকেই উহার ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হয় এবং এই উপায়েই তাহাকে শায়েস্তা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা। ফলে ইসলামের এই পথ-নির্দেশ কিছু মাত্র বিস্ময়কর বা আপত্তিকর হইতে পারে না।
হাদীসের চতুর্থ কথাঃ ****** ইহার অর্থ, স্ত্রীকে খারাপ রূঢ় অশ্লীল ও নির্মম কথা বলিও না, তাহাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিওনা, মন্দ বলিও না। অশালীন, অসৌজন্য মূলক ও অপমানকর কথা বলিও না। ******* আল্লাহ তোমাকে মন্দ বা ধ্বংস করুন বলিও না। ইত্যাদি ধরনের কথাবার্ত পারিবারিক জীবনের সব পবিত্রতা ও মাধুর্যকে বিনষ্ট করে।
বস্তুত স্ত্রীও যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা, তাহারও আত্মমর্যাদা আছে, আছে আত্মমর্যাদা বোধ, বরং অনেক পুরুষের অপেক্ষাও অনেক বেশী ও তীব্র, সে কথা অনেক স্বামীই বেমালুম ভুলে যায়। স্ত্রীকে দাসী-বান্দী কিংবা জন্তু-জানোয়ার ও ইতরপ্রাণী মনে করা বর্বর ঘোঁড়া প্রকৃতির লোকদের স্বভাব। ইহা যেমন ঘৃণ্য, তেমনি পারস্পরিক পারিবারিক দাম্পত্য জীবনের শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে হুমকি স্বরূপ। তাই ইহা অবশ্যই পরিত্যজ্য। পরস্পরের মর্যাদা-স্বাতন্ত্র্যের সম্ভ্রম রক্ষা করিয়া কথা-বার্তা বলা একান্তই আবশ্যক। ইহাও ইসলামেরই একটা বিশেষ অবদান।
উদ্ধৃত হাদীসে রাসূলে করীম (স) এর পঞ্চম ও শেষ কথাটি হইল, স্ত্রীকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিও না। তাহাকে শাসন করার উদ্দেশ্যে কোন পর্যায়ে যদি তাহাকে যে শাসনই করিতে হয়, তাহা ঘরের মধ্যে রাখিয়াই করিবে। সাধারণত দেখা যায়, স্বামী একটু অসন্তুষ্ট হইলেই ক্রদ্ধ হইয়া স্ত্রীকে গলা ধাক্কা দিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া দেয় কিংব স্ত্রীর বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দেয়। ইহা নিতান্তই মুর্খতামূলক, নিতান্তই বর্বরতা। ইহার অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়।
(**************)
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বর্ণনা করিয়াছেন হযরত নবী করীম (স) হইতে। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ স্বামী যখন তাহার স্ত্রীকে নিজের শয্যায় আসিবার জন্য আহবান জানাইবে তখন যদি সে আসিতে অস্বীকার করে, তাহা হইলে ফেরেশতাগণ সকাল হওয়া পর্যন্ত তাহার উপর অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকেন।
(বুখারী)
ব্যাখ্যাঃ স্বামী যখন তাহার স্ত্রীকে তাহার নিজের শয্যায় আসিবার জন্য আহবান জানায় ইহা ইংগিত মূলক কথা। ইহার অর্থ, স্বামী যখন স্ত্রীর নিকট সঙ্গম ইচ্ছা প্রকাশ করে ও সে জন্য ভাবে, এই সময় স্ত্রী যদি অস্বীকৃতি জানায়, স্বামীর ইচ্ছাপূরণে প্রস্তুত না হয়, তাহা হইলে সকাল হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ সেই স্ত্রীর উপর অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকেন। ফেরেশতাগণ অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকেন, তাহার কারণ হইল, স্বামীর ইচ্ছাপূরণ করা স্ত্রীর বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিবাহিত জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যের মধ্যে ইহা অন্যতম। কিন্তু স্ত্রী অস্বীকৃতিতে এই কর্তব্যও পালন হয় না এবং এই উদ্দেশ্যও ব্যাহত ও ক্ষুণ্ন হয়। আসলে যৌন সঙ্গম যদিও স্বামীর স্ত্রী উভয়েরই যুগপৎ বাসনা ও ইচ্ছার ব্যাপার আর এক জনের ইচ্ছা জাগিলে সেই সময় অন্যজনও ইচ্ছুক হইবে, এমন কোন কথাও নাই। কিন্তু তবুও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কর্তব্যের মধ্যে ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য যে, একে অপরের বাসনা চরিতার্থ করিবে। এতদ্ব্যতীত স্ত্রীলোকদের তুলনায় পুরুষের ইচ্ছা অনেক সময় অদম্য হইয়া থাকে এবং উহার চরিতার্থতা হইয়া পড়ে অপরিহার্য। কাজেই তাহার ইচ্ছা পুরণে স্ত্রীর বাধ্য ও প্রস্তুত হওয়া উচিত। ইহা পরস্পরের জন্য ত্যাগ ও তিতিক্ষা বা কষ্ট স্বীকারে প্রস্তুত থাকার ব্যাপার। দাম্পত্য জীবনের একজনের জন্য অপর জনের কষ্ট স্বীকার-অনিচ্ছা সত্ত্বেও সঙ্গম কার্যে প্রবৃত্ত ও প্রস্তুত হওয়া এবং এই ব্যাপারে পরস্পর সহযোগিতা করা গভীর দাম্পত্য প্রেম ও মনের ঐকান্তিক দরদ ও সহানুভূতির ব্যাপারও। কিন্তু কোন কারণ ব্যতীতই স্ত্রী যদি স্বামীর আহবানকে অগ্রাহ্য করে, তাহা হইলে স্বামীল মন স্ত্রীর প্রতি বিরক্ত ও অনাসক্ত হইয়া পড়িতে পারে। আর ইহা দাম্পত্য জীবনের স্থায়ীত্বের পক্ষে মারাত্মক। এমনকি, অনেক সময় ইহার দরুনই স্বামী স্ত্রীকে হঠাৎ রাগের বশবর্তী হইয়া তালাক পর্যন্ত দিয়া বসিতে পারে। সে অন্য স্ত্রীলোকের নিকট গমন করিতে পর্যন্ত বাধ্য হইয়া পড়িতে পারে। শুরু হইতে এই পরিণতি পর্যন্ত প্রত্যেকটি ব্যাপারই অবাঞ্ছিত এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টিরও কারণ। স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষণ হওয়ার কারণও ইহাই। বলা বাহুল্য, ‘অভিশাপ’ কথাটি তীব্র ক্ষোভ ও রোষ বুঝায়। আর যে ফেরেশেতাদের আনুকূল্য ও সহযোগিতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কর্মে ও প্রতিটি ক্ষেত্রে জরুরী, তাহা হইতে বঞ্চিত হইয়া যাওয়া চরম দুর্ভাগ্যের কারণ। *************** সকাল বেলা হওয়া পর্যন্ত। অর্থাৎ ফেরেশতারেদ এই অভিশাপ বর্ষণ সকাল হওয়া পর্যন্ত চলিতে থাকে। এই কথা দ্বারা বুঝা যায়, সকাল বেলা হইলেই ফেরেশতা তাহাদের অভিশাপ বর্ষণ বন্ধ করিয়া দেন। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তাহা নয়। সারারাত্রি ধরিয়া অভিশাপ বর্ষণ করা ও সকাল বেলা হইলেই রাত্রির অবসান হইলেউ উহারও অবসান হইয়া যাওয়ার এই কথাটি সাধারণ রীতি অনুযায়ীই বলা হইয়াছে। কেননা স্বামী স্ত্রীকে সঙ্গম কাজের জন্য সাধারণত রাত্রি বেলাই আহবান করিয়া থাকে। দিনের বেলা ইহার সুযোগ সব স্বামীর জন্য সব সময় হয় না। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এইরূপ স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতাদের অভিশাপ-ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ সেই রাত্রিকাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে না, উহা থাকে সমগ্র রাত্রি ও দিন ব্যাপী। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি বর্ণনা হইতে এই কথা স্পষ্ট ও অধিক সমর্থিক হইয়াছে। সে বর্ণনাটির ভাষা এইঃ রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
যাঁহার মুষ্ঠির মধ্যে আমার প্রাণ তাহার শপথ, যে লোকই তাহার স্ত্রীকে তাহার শয্যায় আহবান জানাইবে, কিন্তু যে আহবানে সাড়া দিতে স্ত্রী অস্বীকৃত হইবে, তাহার প্রতিই আকাশ লোকে অবস্থানকারী ক্ষুব্ধ-অসন্তুষ্ট হইয়া যাইবে- যতক্ষণ না সেই স্বামী তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হইবে।
(মুসলিম)
এই হাদীসটির শেষ শব্দ ********* অর্থ যতক্ষণ না সেই স্বামী তাহার (স্ত্রীর) প্রতি সন্তুষ্ট হইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আকাশলোকে অবস্থানকারী আল্লাহর ফেরেশতাগণও তাহার প্রতি ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট থাকিবেন। ইহাতে ঘটনার রাত্রি পর্যন্তই সে ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি সীমাবদ্ধ থাকার কথা নাই, স্বামীর সন্তুষ্টি লাভ করা পর্যন্ত সে ক্ষোভের সীমা বলা হইয়াছে। এমনও হইতে পারে যে, রাত্রির প্রথম বা মধ্যম প্রহরে স্বামীর আহবানে সাড়া না দেওয়ার ফলে স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতাদের ক্ষোভ সূচিত হইল্ আর শে প্রহরে সাড়া দেওয়ার ফলে সে ক্ষোভের অবসান হইয়া গেল। ইহা এতদাপেক্ষাও দীর্ঘায়িত ও বিলম্বিত হইতে পারে। ইহা কতক্ষণ বা কতদিন থাকিবে তাহা নির্ভর করে শুধু স্বামীর ডাকে স্ত্রীর সাড়া দেওয়ার উপরই নহে, বরং স্বামীর সন্তুষ্টি পুনর্বহাল হওয়ার উপর।
হযরত জাবির (রা) হইতে মরফু (স্বয়ং রাসূলের কথা- সে পর্যন্ত সনদ সহ) হাদীস বর্ণিত হইয়াছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
****************************************
তিনজন লোকের নামায কবুল হয় না ও কোন নেক আমল ঊর্ধ্বলোকে উত্থিত হয় না। তাহারা হইলঃ পলাতক ক্রীতদাস- যতক্ষণ না সে ফিরিয়া আসে, নেশাপানে অস্থির মস্তিষ্ক- যতক্ষণ না সে পূর্ণ সুস্থতা পায় এবং সেই স্ত্রীলোক যাহার স্বামী তাহার প্রতি ক্ষুব্ধ-ক্রদ্ধ অসন্তুষ্ট- যতক্ষণ না সে স্বামী সন্তুষ্ট হয়।
এই হাদীসটিতে বলা কথা অধিকতর কঠোর ও ভয়-উদ্দীপক। কেননা মুসলমানের প্রধান ইবাদত নামায যদি আল্লাহর নিকট কবুলই না হয় আর এতদ্ব্যতীত অন্যান্য নেক আমলও যদি আল্লাহর নিকট স্বীকৃতি না পায়- নেক আমল হিসাবে যদি আমল নামায় লিপিবদ্ধ না হয়, তাহা হইলে উহাপেক্ষা মারাত্মক ক্ষতি তাহার পক্ষে আর কি হইতে পারে।
এই হাদীসটিতেও মেয়েলোকটির দুর্ভাগ্য যে রাত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, তাহা বলা হয় নাই। বরং ইহা দিন রাত্র পর্যন্ত বিস্তৃত।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে অপর এক সূত্রে বর্ণিত এই পর্যায়েল হাদীসটিও এখানে উল্লেখ্য। তাহা এইঃ হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
স্বামী সঙ্গম উদ্দেশ্যে আহবান করিলে যে স্ত্রী বলেঃ হ্যাঁ, শীঘ্রই হইবে, আর যে বলে যে, আমি ঋতুবতী- অথচ সে ঋতুবতী নয়, এই দুইজন স্ত্রীলোকের প্রতি রাসূলে করীম (স) অভিশাপ বর্ষণ করিয়াছেন।
ইহা হইতে প্রমাণিত হইল যে, মুসলমান গুনাহগার ব্যক্তিকে ভয় দেখাইয়া হেদায়াতের পথে আনিবার উদ্দেশ্যে অভিশাপ দেওয়া জায়েয। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে ইহা আল্লাহর রহমত হইত কাহাকেও দূরে লইয়া যাওয়া ও উহা হইতে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত নয়। ইহা হইবে তাহাকে হেদায়াতের দিকে ফিরাইয়া আনা ও তওবা করিতে রাযী করানোর উদ্দেশ্যে।
(**************)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ একটি মেয়েলোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল এবং জিজ্ঞাসা করিলঃ
****************************************
হে রাসূল! স্ত্রীর উপর স্বামীর কি কি অধিকার আছে?
জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
স্ত্রী তাহার স্বামীকে তাহার ইচ্ছা পূরণ হইতে নিষেধ করিবে না, যদি তাহা অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ সহকারেও হয়।
অন্য একটি বর্ণনায় এই হাদীসটি ভাষা এইঃ
****************************************
সে তাহার স্বামীকে তাহার ইচ্ছা পূরণ হইতে বিরত রাখিবে না- যদি তাহার (স্ত্রীর) চুলার উপর রান্না কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায়ও হয়।
আর তালক ইবনে আলী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
স্বামী যদি তাহার যৌন প্রয়োজন পূরণার্থে তাহার স্ত্রীকে ডাকে, তাহা হইলে তাহার চলিয়া আসা উচিত- যদিও সে চুলার কাছে রান্না কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকা অবস্থাও হয়। ইহাতে যদি স্বামীল কোন মাল-সম্পদ নষ্ট হইয়া যায়, তবুও তাহার পরোয়অ করা চলিবে না। কেননা স্বামীর ক্রোধের উদ্রেক করা অপেক্ষা কিছু জিনিস নষ।ট হওয়া অনেক সহজ।
ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষণের কথাটি এইআলোকে বুঝিতে হইবে যে, ফেরেশতারা খোদানুগত বান্দাহদের জন্য দোয়া করেন যখন তাহারা খোদানুগত্যমূলক কাজে নিমন্গ থাকে। আর পাপী নাফরমান লোকদের জন্য বদদোয়া করিতে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তাহারা নাফরমানী ও পাপ কাজে লিপ্ত থাকে। ইহাই তাঁহাদের কাজ।
ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষণ এবং হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর হাদীস অনুযায়ী রাসূলে করীম (স)-এর অভিশাপ বর্ষণ হইতে একথা বুঝা যায় যে, মুসলমান ব্যক্তি যখন নাফরমানী করিতে শুরু করে তখন তাহাকে ভীত সতর্ক ও উহা হইতে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তাহার উপর অভিশাপ বর্ষণ করা জায়েয। আর যদি নাফরমানী করিয়াই বসে তাহা হইলে তাহাকে তওবা ও হেদায়াতের পথ অবলম্বনের আহবান জানাইতে হইবে এবং ইহা যাহাতে সে করে সেজন্য তাহার অনুকূলে দোয়া করিতে হইব।
(******************)
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত এই পর্যায়ের অপর একটি হাদীসের ভাষা হইলঃ
****************************************
নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ স্ত্রী যদি তাহার স্বামীর শয্যা ত্যাগ করিয়া রাত্রি যাপন করে, তাহা হইলে ফেরেশতাগণ তাহার উপর অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকে- যতক্ষণ না সে ফিরিয়অ আসে।
অর্থাৎ স্ত্রী নিজের ইচ্ছা ও নিজের বশবর্তী হইয়া যদি স্বামীর সংসর্গ ত্যাগ করে, স্বামীর শয্যা ত্যাগ করিয়া অন্যত্র শয্যা গ্রহণ করিয়া রাত্রি যাপন করে, তবে তাহার উপর ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষণ চলে যতক্ষণ না সে স্বামীর শয্যায় প্রত্যাবর্তণ করে। আর স্বামীই যদি নিজের ইচ্ছা ও স্ত্রীর কোন অপরাধের কারণ ব্যতীত স্ত্রীর শয্যাত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়, তবে তাহাতে স্ত্রীর উপর অভিশাপ পড়িবে না। ইহা হইতে জানা যায়, ফেরেশতাণ গুনাহগার লোকদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করিয়া থাকেন।
ফেরেশতাদের সম্পর্কে প্রশ্ন উঠিতে পারে, ইহারা কোন ফেরেশতা? রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ফেরেশতা, না অন্যরা?
ইহার জওয়াবে বলা যাইতে পারে, এই দুইটি কথারই সম্ভাব্যতা আছে। তবে এই কাজে নিযুক্তি কিছু সংখ্যক ফেরেশতাও হইতে পারে।
আসল কথা হইল, আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদের বহু প্রকারের ও বহু ধরনের কাজে নিয়োজিত করিয়া রাখিয়াছেন। তাঁহাদের সকলেই কিংবা বিশেষ একটি বিভাগে নিযুক্ত ফেরেশতাগণ অভিশাপ বর্ষণ করিয়া থাকিতে পারেন।
এই হাদীস হইতে বুঝা যায়, স্বামীর সহিত সহযোগিতা করা স্ত্রীর কর্তব্য। সেই সেই কাজ করিতে সতত চেষ্টিত হওয়া উচিত যে যে কাজে স্বামী সন্তুষ্ট হয়- যদি তাহা শরীয়াত বিরোধী না হয়। দ্বিতীয়তঃ স্ত্রীলোকদের তুলনায় পুরুষদের সঙ্গম ইচ্ছা অদমনীয়। তাৎক্ষণিকভাবে তাহা চরিতার্থ না হইলে অনেক সময় এই ইচ্ছা পুরুষদিগকে পাপের পথে ঠেলিয়া দিতে পারে। এই কারণে রাসূলে করীম (স) স্ত্রীদিগকে স্বামীদেরক সহিত পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্য আহবান জানাইয়াছেন। এই সব হাদীসের মাধ্যমে।
(***************)
এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস স্মরনীয়ঃ
****************************************
হযরত উম্মে সালমা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে স্ত্রী এমন অবস্থায় রাত্রি যাপন ও অতিবাহিত করে যে, তাহার স্বামী তাহার প্রতি সন্তুষ্ট, সে বেহেশতে প্রবেশ করিবে।
(তিরমিযী)
হাদীসটি হইতে বুঝা যায়, একজন স্ত্রীলোকের বেহেশত লাভ যে সব জিনিসের উপর নির্ভরশীল; কিংবা যে সব আমলের দৌলতে একজন স্ত্রী বেহেশত লাভ করিবে, স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখা ও তাহার প্রতি স্বামীর খুশী থাকা তাহার মধ্যে একটি। এই হাদীসটিতে বলা হইয়াছে, যে স্ত্রী রাত্রি যাপন করে এমন অবস্থায় যে, তাহার প্রতি তাহার স্বামী সন্তুষ্ট- এই রাত্রি যাপন বিশেষ কোন রাত্রি নিশ্চয়ই নয়। বরং বিবাহিত জীবনের প্রতিটি রাত্র অর্থাৎ স্বামীকে অসন্তুষ্ট করা বা অসন্তুষ্ট হইলে তাহাকে সেই অবস্থায় থাকিতে দেওয়া, তাহার অসন্তুষ্টি দূর করিয়া সন্তষ্টির উদ্রেক করিতে চেষ্টা না করা ও বেপরোয়া হইয়া নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করা স্ত্রীর জান্নাতে যাওয়ার অনুকূল হইতে পারে না।
ইবনে মাজাহ গ্রন্হেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে। তবে উহাতে ***** অর্থ এর স্থান ****** শব্দ বলা হইয়া।ইহার অর্থ মৃত্যুবরণ করিল। ইহা হইতে বুঝা যায়, স্ত্রীর মৃত্যুকালে স্বামী যদি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তবে সে বেহেশত লাভ করিবে। এই দুইটি বর্ণনা হইতে একই কথা জানিতে পারা যায়। আর তাহা হইল, বিবাহিত জীবনে স্বামীকে সব সময় সুখী ও তাহার প্রতি সন্তুষ্ট রাখিতে চেষ্টা করা এবং কখনই অসন্তুষ্ট না করা- অসন্তুষ্ট হইলে তাহার অসন্তুষ্টি দূর করিয়া দেওয়া স্ত্রীর কর্তব্য। শুধু মৃত্যু কালীন সন্তুষ্টির জন্যও প্রয়োজন সারাটি দাম্পত্য জীবন ভরিয়া স্বামকে সন্তুষ্ট রাখিতে চেষ্টা করা। যে স্ত্রী স্বামীর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি পরোয়া করে না, তাহার পক্ষে বেহেশতে যাওয়া কঠিন।
কেননা সে হয়ত আল্লাহর হক আদায় করিয়াছে; কিন্তু স্বামীর হক অগ্রাহ্য করিয়াছে। অথচ স্বামীর হক হক্কুল ইবাদ। হাক্কুল ইবাদ আদায় না করিলে হক্কুল্লাহও আদায় হয় না। পরিণামে উহার কোন মূল্যই হইবে না।
(*************)