ওমর ইবনে আবদুল আজীজ
ইসলামী শাসনের বাস্তব চিত্র
মূল: রশীদ আখতার নদভী
অনুবাদ
মাওলানা আবুল বাশার
পরিবেশক
খন্দকার প্রকাশীনী
পাঠকদের প্রতি সম্পাদকের নিবেদন
ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ওমর ইবনে আবদুল আজীজের জীবনলেখ্য আমরা এই উদ্দেশ্যেই প্রকাশণার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি- যাতে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীগণ উপলীবচ্ধ করতে পারেন যে, সততা ও নিষ্টার সাথে দেশের শাসন-ব্যবস্থা পরিচালনা করলে দেশের জনগণ সুখী ও সমৃদ্ধশালী হতে পারে এবং দেশ সেবার মহান ব্রত গ্রহণ করলে ব্যক্তি জীবনে ভোগ-বিলাস ত্যাগ করতে হয়। তদুপরি পক্ষপাতহীন ও স্বজন প্রীতিমুক্ত মনে দেশর সেবা করে গেলে দেশের আপমর জনসাধারণও তার পিছনে এসে দাঁড়ায়।
খেলাফতে রাশেদীনের পর মুসলিম জাহানের স্বজন-প্রীতি, ব্যক্তিস্বার্থ, অন্যায়-অবিচারের যে অমানিশার অন্ধাকর নেমে এসেছিল ওমর ইবনে আবদুল আজীজ সেই সব অন্ধকারের আবরণ ছিন্ন করে আবার মুসলিম জাহানে নতুন প্রাণ স্পন্দনের সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর ব্যক্তি জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করে। আমরা আজকের দিনেও যতি তাঁর অনুসরণ করি তবে আমরাও তাঁর ন্যায় দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারি।
এই গ্রন্থখানি ওমর ইবনে আবদুল আজীজের জীবনীর সবচেয় তথ্যবহুল ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ক্লাশে ইতিহাসের ছাত্রদের জন্যও বিশেষ সহায়ক হবে বলে মনে করি।
মুদ্রণ জনিত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। যদি কোন ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তাহলে আমাদের জানালে পরবর্তী সংস্কারণে সংশোধণ করে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
গ্রন্থকারের কথা
একদিন পরাক্রমশালী আব্বাসীয় খলীফা মামুনুর রশীদের সামনে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের কথা আলোচিত হল। এই প্রভাবশালীও পরম অনুতাপের সাথে বলেন, ‘বনু উমাইয়ার এ লোকটি আমাদের সকলের জন্য যে অবদান রেখে গেছেন, সত্যিই তা ভোলার নয়।’
বাস্তবিকই হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের মাধ্যমেই সমগ্র বনু উমাইয়া শ্রেষ্ঠত্ব মর্যাদার এক সুউচ্চ আসন লাভ করেছিল। শুধু বনু উমাইয়া কেন? বলতে গেলে সমগ্র মিল্লাত বা জাতিই এ সশ্রদ্ধ মহান মনীষীরি শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা ও কল্যাণ দানে পরিপূর্ণ ছিল। এ কারণেই ঐতিহাসিকগণ যখনই খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তখন তারা শ্রদ্ধার সাথে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের কথা উল্লেখ না করে পারেন না। তারা তাঁর শাসনামলকে খোলাফায়ে রাশেদীনের মতই সম্মান প্রদান করেন।
বর্ণাকারী ইবনে সাদ বলেন, নবী (সা)-এর সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাযিঃ) একদা ওমর ইবনে আবদুল আজীজের পিছনে নামায পড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলে উঠলেন-
(আরবী*******************)
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পর এই যুবক ছাড়া অন্য কারো পিছনে রাসূলুল্লাহ (সা)-নামাযের মত নামাজ আমি আর পড়িনি।
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাযিঃ) যখন তাঁর সম্বন্ধে এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন, তখনও তিনি খেলাফতের উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত হননি। তখন তিনি উমাইয়া বংশীয় খলীফা ওয়ালীদের পক্ষ থেকে মদীনার শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিশ অথবা একুশ বছর।
যখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ স্বয়ং খলীফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন যদি হযরত আনাস (রাযিঃ) জীবিত থাকতেন তবে নিশ্চয় তিনি শপথ করে বলতেন- “আমি এই যুবক ছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শাসনের মত শাসন আর কোনো শাসনকর্তাকেই দেখিনি।
যদিও তাঁর এই আল্লাহভীরুতা, ত্যাগ-তিতীক্ষা এবং সত্য নিষ্ঠার ফলে তাঁর নিজ বংশীয় লোকেরা তাঁর পরার্শে শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। তাঁর ব্যক্তিগত খাদেমের ভাষা মতে, যদিও তিনি খেলাফতের পদ গ্রহণ করে নিজেকে নিজেই মহাবিপদে ফেলেছিলেন, যদিও তিনি স্বীয় পরিবার পরিজনের সমস্ত প্রকার ভোগ-বিলসের দ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছেন, তথাপি তিনি পৃথিবীর বুকে সোনালী অক্ষরে বাস্তবতার এমন এক চিত্র অংকন করে গেছেন যে, যদি কোনে শাসনকর্তা স্বীয় ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশের পরিবর্তে দেশের জনসাধারণের কল্যাণ সাধন করতে চায় তবে এটা তার পক্ষে খুব কঠিন সমস্যা নয়।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ একজন রাজতান্ত্রিক শাসনকর্তা ছিলেন। ইসলামের সত্য-সনাতন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনসুরণে তাঁর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, তাঁর পূর্বের এক রাজতান্ত্রিক শাসক তাঁকে খলীফা বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এই ঘোষণাই পরবর্তী পর্যায়ে গণতান্ত্রিক নির্বাপনে পর্যবসিত হয়েছিল। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ স্বীয় কর্মপ্রবাহ দ্বারা তিনি নিজেকে খলীফাদের নিকটতম করেছিলেন। পূর্ববর্তী খলীফাগণ জনসাধারণের সুখ-সুবিধার জন্য যা করেছিলেন, তিনিও তাই করলেন। খোলাফায়ে রাশেদীন জনগণের প্রয়োজন ও কল্যাণ সাধনের জন্য যে সমস্ত বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন, তিনিও তাঁদের অনুসৃদ নীতিই অনুসরণ করে গিয়েছেন।
ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণে কাউকে ক্ষমা করে না অথবা কারো প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করে না, এটা সুশাসন ও কু-শাসকদের কুশাসনের চুলচেরা সমালোচনা করে থাকে। এই সমালোচনামুখর ইতিহাসও ওমর ইবনে আবদুল আজীজের চরিত্রের চুলচেরা সমালোচনা করেই তাকে খোলাফায়ে রাশেদীনের কাতারে এনে শামিল করেছে এবং অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, তার শাসনামলও খেলাফতে রাশেদার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজের শাসনামল ছিল খুবইসংক্ষিপ্ত, মাত্র দুই বছর পাঁচ মাস। এই সামান্য সময় জাতীয় জীবনে একটি মুহূর্ত মাত্র। তথাপি এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই এক পবিত্র আত্মা সকল প্রকার বাড়াবাড়ি, অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-অবিচার সকল কিচুর নাম-নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়ে এমন আইন-শৃঙ্খলা এবং শাসন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাতে রাজ্যের দুর্বল হতে দুর্বলতর নাগরিকও স্ব-স্ব অধিকারের স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
এ পুস্তক সংকলনের একমাত্র কারণ এর বাস্তবতা। আমরা পাঠকদের সামনে কেবল এই উদ্দেশ্যেই ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে পেশ করেছি, যাতে তাঁরা বিচার করতে পারেন যে, তিনি উমাইয়া বংশীয় প্রভাবশালী খলীফা আবদুল মালেকের ভ্রাতুষ্পুত্র, মারওয়ান ইবনুল হাকামের পৌত্র হওয়া সত্ত্বেও জনগণকে যে সীমাহীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ দান করেছিলেন তার নজীর ইতিহাসে বিকল। তিনি যখন খলীফা ছিলেন না, তখন তিনি উন্নত মানের খাদ্য গ্রহণ করতেন, উন্নত মানের পোষাক পরিধান করতেন; কিন্তু তিন খোলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেই সর্বপ্রকার ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ করলেন। তিনি জীবন ধারণের দিক দিয়ে অতি সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসলেন। অতি সাধারণ মানুষ যা খেতো, তিনিও তাই খেতেন, অতি দরিদ্র মানুষ যা পরিধান করত তিনিও তাই পরতেন।
ব্যক্তিগত দিক দিয়ে বিচার-বিবেচনা করলে দেখা যায়, ওমর ইবনে আবদুল আজীজও তৎকালীন অভিজাত শ্রেণীর অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইতিহাস বিখ্যাত শাহী পরিবারের সদস্য ছিলেন। তাঁর পিতা আবুদল আজীজ ছিলেন মহা প্রতাপশালী উমাইয়া খলীফা আবদুল মালেকের ভাই। তদুপরি তিনি একাধারে দীর্ঘ বিশ বচর পর্যন্ত মিশরের স্বাধীন শাসনকর্তার পদে অধিষ্টিত থেকে এই পুত্রের সুখ-সুবিধার জন্য কত কিছুই না রেখে গিয়েছেন! কিন্তু তাঁর এই পুত্র খলীফা পদে অধিষ্টিত হয়েই তাঁর সমস্ত সম্পদ সরকারী কোষাগারে সোপর্দ করে দিলেন, এমনকি তাঁর স্ত্রীর যাবতীয় অলংকারাদী পর্যন্ত সরকারী কোষাগারে জমা করে দিলেন।
বর্তমান জগতের এই গণতান্ত্রিক যুগেও এটা ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ একজন রাজতান্ত্রিক শাসক হয়েও জনসাধরণের সুখ-সুবিধার জন্য তিনি নিজেই নিজেকে কিরূপে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতেন এবং তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য কত বড় ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করেছেন।
আজকের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ধারক ও বাহকদের নিকট ওমর ইবনে আবদুল আজীজের অনুসৃত শাসনপদ্ধতি যদিও প্রজাতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির মৌলিক শর্ত হিসেবে স্বীকৃত নয়; কিন্তু ইসলাম দুনিয়ার বুকে সমাজ ব্যবস্থার যে ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল, এটাই ছিল তাঁর মৌলিক ও প্রধান শর্ত যে, দেশের জনগণ যদি অনাহারে, অর্ধাকারে দিন কাটায়, তারা যডিদ উলঙ্গ বা অর্ধালোঙ্গ এবং অভাবক্লিষ্ট থাকে তবে তাদের শাসনকর্তাও তাদের মত অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাবে। জনগণকে দুঃখ-দুর্দশায় রেখে ভোগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দেয়ার অধকার শাসনকর্তার নেই।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ যখন থেকে খেলাফতের মহান দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন যদি প্রজাসাধারণ ক্ষুধার্ত উলঙ্গ থাকত, তাদের ভাত-কাপড়ের কোন সংস্থান তারা করতে না পারত, তখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজও জনগণের কাতারে নেমে আসতেন, তিনিও অনাহারে থাকতেন, তাদের মত পোষাক পরতেন।
তিনি যে ধার্মিকতা অবলম্বন করেছিলেন, খলীফা হওয়ার পর তিনি যে সাদাসিধা, অনাড়ম্বর জীবন যাপনের পথ বেছে নিয়েছিলেন, তখনকার যুগের চাহিদা অনযায়ীই তিনি তা অবলম্বন করেছিলেন। সেই সময়ের এটাই ছিল সাধারণ চাহিদা। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ জীবনের সর্বপ্রকার সুখ ভোগ জলাঞ্জলি দিয়ে জনগণের সেই চাহিদাই পূরণ করেছিলেন। তিনি যে বিশ্বস্ততার সাথে জনগণের চাহিদা পূরণ করেছিলেন, ইতিহাস তাঁর দ্বিতীয় নজীর পেশ করতে পারেনি।
আমরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, যুগের পরিবর্তন ঘটেছে, জীবন ধারণের মান পরিবর্তন হয়েছে। আজকের জনগণ আর খলীফা ওমরের যযগের জনগণ এক নয়। সেই যুগে মোটর গাড়ী ছিল না, উড়োজাহাজ, রেলগাড়ী, ছিল না আজকের জীবন ধারণের বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক প্রয়োজন। তবুও এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রকৃতপক্ষে এই দুনিয়ার জনসাধারণ বিশেষতঃ আফ্রিকা-এশিয়ার জনগণের জীবন মান আজকের দিনেও সেই যুগ থেকে একটা উন্নত হয়নি, তাদের না আছে মোটর গাড়ী, না আছে উড়োজাহাজে আরোহণ করার সামর্থ। আজকেও তাদের পোষাক টুটা-ফাটা,, তাদের আহার্য সাদাসিধা।
আফ্রিকা-এশিয়ার বহু দেশ এখনও এমন আছে, যেখানকার অধিকাংশ অনাহারে, উলঙ্গ দিন কাটাচ্ছে, যারা সাধারণ ডাল-ভাতেরও ব্যবস্থা করতে পারে না, ইজ্জত-আবরু ঢাকার মত সাধারণ থেকে অতি সাধারণ কাপড়েরও ব্যবস্থা করতে পারে না। সুতরাং, সেই সমস্ত দেশের শাসকগোষ্ঠীকেও জনসাধারণের কাতারে শামিল হওয়ার জন্য ওমর ইবনে আবদুল আজীজের ন্যায় নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনায়ন করা অপরিহার্য। বিশেষত: যে সব দেশের শাকগোষ্ঠী নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করেন, ইসলামী শাসন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য চিৎকার করেন, তাদের জন্য এরূপ পরিবর্তন আরও অধিক প্রয়োজনীয়।
অবশ্য সময় বাঁচানোর জন্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে স্পর্ক রক্ষা করার জন্য, পারিপার্ষ্বিক জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শাসকগণ উড়োজাহাজ, মোটর গাড়ী ইত্যাদি যানবাহনে আরোহণের অধিকারী, কিন্তু যত দিন পর্যন্ত জীবন ধারণের মান উন্নত না হয়, যত দিন তারা পেট ভরে খেতে না পায়, ইজ্জত-আব্রু ঢাকার মত প্রয়োজনীয় কাপড়ের এবং মাথা গুজবার মত বাসস্থান করতে না পারে ততদিন শাসকগোষ্ঠীকেও তাদের ব্যক্তিগত জীবনে জগণের মত খাদ্য খেতে হবে, তাদের মত পোষাক পরতে হবে, তাদের মত বসবাস করতে হবে।
তা না হলে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের যুগেও ব্যক্তিগত জীবনে ভোগ-বিলাস, সুখ-স্বাচ্ছন্দ, উন্নত মানের বসবাস, খাওয়া-পরা ইত্যাদির মোটেই অভাব ছিল না। সেই যুগেও অগণিত মানুষ এমন ছিল যারা উন্নত মানের বাহনে আরোহন করত, শাহী প্রাসাদে বাস করত, রেশম বস্ত্র ও অন্যান্য মসৃণ কাপড় পরিধান করত উন্নতমানের আহার্য গ্রহণ করে খুবই আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করত। তাঁর নিজের বংশেও এরূপ লোকের অবাব ছিল না, যারা রাজপ্রাসাদে বাস করে বিভিন্ন প্রকার সুখ ভোগ করে জীবন উপভোগ করত। স্বয়ং খুবই উন্নত মানের জীবন যাপন করতেন।
কিন্তু শাসন ক্ষমতার অধিষ্টিত হয়েই তিনি তাঁর জীবনের গতি সম্পূর্ণরূপেইপরিবর্তন করে দিলেন। কারণ পূর্বে তিনি ছিলেন একটি মাত্র ব্যক্তি এবং ব্যক্তি হিসেবে তার নিজের ধন-সম্পদ দ্বারা পুরোপুরি জীবন উপভোগ করার পূর্ণ অধিকার ছিল্ কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্তির পর তিনি আর এক ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি একাই একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের সমস্ত লোকের দেখা-শুনার ভার তাঁর উপর সোপর্দ হয়েছিল। তাদের সকল প্রয়োজন পূর্ণ করা এবঙ তাদের জীবনের মান উন্নত করার সকল প্রকার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর উপর। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে যে স্বাধীনতা ভোগ করতেন ইসলাম তাঁর সেই আজাদী ছিনিয়ে নিয়েছিল।
অনুরূপ আজকের দিনেও যে কেউ, তার ব্যক্তিগত ধন-দৌলত দ্বারা জীবন উপভোগ করার সম্পূর্ণ অধিকারী। তিনি ব্যক্গিত জীবনে ভাল ভাল কাপড় পরতে, উন্নতমানের বাসস্থানে বাস করতে এবং উপবোগ্য খাদ্য খেতে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু জাতির নেতা হিসেবে, জনগণের শাসক হিসেবে তার এই অধিকার নেই। তার ব্যক্তি জীবনে যে সমস্ত বিষয়ে তিনি স্বাধীন ছিলেন তার সেসব স্বাধীনতা থাকবে না। তিনি এখন আর ভাল কাপড়, উন্নত বাসস্থান, উপভোগ্য খাদ্য ইত্যাদির সুযোগ পাবেন না। তার নিজের জীবনকে জনগণের জীবনের সাথে মিলিয়ে একাকার করে দিতে হবে, যেমনভাবে ওমর ইবণে আবদুল আজীজ তাঁর জীবনের গতি সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দিয়ে জগণের কাতারে এসে শামিল হয়েছিলেন। তিনি যদি এটা করতে পারেন তবেই তিনি মুসলিম শাসক হিসেবে দাবী করতে পারেন। তা না হলে সে যুগেও আবদুল মালেক, ইয়াজিদ, মারওয়ান, সুলায়মান, হাশেমপ্রমুখ নরপতিগণও নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করেছেন।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ জীবনের গতি পরিবর্তন করে নিজের জন্য যে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ বিধান করেছিলেন, আমরা তার কারণ ও যৌক্তিকতা যথাস্থানে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। যা হোক দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের সম্মুখে এ উমাইয়া নরপতির জীবনের সকল দিক তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই আমরা তাঁর জীবনালেখ্য রচনায় মনোনিবেশ করেছি।
প্রকৃতপক্ষে এটা আমাদের কর্তব্য নয়, এটা তাদের কর্তব্য, যারা তাঁর অনুসৃত নীতি অবলম্বন করে দেশের পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করবেন, আর না হয় তা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের মনগড়া রুচিসম্মত কর্মসূচী গ্রহণ করে জীবন উপভোগ করবেন। এটাই আমাদের কথা।
বিনীত রশীদ আখতার নদভী