অন্তর্বর্তীকাল
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের জীবনের দীর্ঘ ছয়টি বছর অর্থাৎ ৯৩ হিজরী থেকে ৯৯ হিজরী পর্যন্ত কিভাবে অতিবাহিত হয়েছিলেন- ঐতিহাসিকগণ তার কোন বিস্তারিত আলোচনা করেননি।
ইবনে কাছীর এ সম্পর্কে মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য ব্যবহার করেছেন- (আর*ি************)
অর্থাৎ তারপর তিনি দামেশকে তাঁর চাচাত ভাইদের নিকট চলে গেলেন।
এ বাক্রের সাথে সাথেই ইবনে কাছীর যহরীর বর্ণনার একটি উদ্ধৃতি পেশ করেছেন, যার প্রবক্তা স্বয়ং ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)।
“একদিন দ্বিপ্রহরের সময় ওয়ালীদ আমাকে ডেকে পাঠালেন, আমি তাঁর নিকট এসে দেখলাম যে,তিনি খুবই অস্থিার। তিনি আমাকে বসতে বললেন, আমি বসলাম। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, যে ব্যক্তি খলীফাগণকে গালি দেয় তাকে হত্যা করা যাবে? একে আমি নীরব রইলাম। তিনি সে কথাই আবার বললেন। তখনও এতে আমি কোন উত্তর দিলাম না। তিনি তৃতীয় বারেও একই প্রশ্ন করলেন, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, হত্যাও করেছে? ওয়ালীদ বললেন, না, সে শুধু গালি দিয়েছি। আমি বললাম, তবে তাকেও অনুরূপ গালি দেয়া হোক। এতে ওয়ালিদ অসন্তুষ্ট হয়ে তার পরিবার-পরিজনের নিকট চলে গেলেন।
ইবনুল জাওযিও এ জাতীয় একটি ঘটনা সুলায়মানের যুগে সংঘটিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। সুলায়মানের যুগে এক ব্যক্তি খলীফাগণকে গালি দিয়েছিল। সুলায়মান হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে ডেকে এনে এ সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, তুমিও তাঁকে গালি দাও। সুলায়মান বললেন, সে আমার বাপ দাদাকে গালি দিয়েছে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ বললেন, তুমিও তার বাপদাদাকে গালি দাও। কিনউত সুলায়মান তাঁর কথা রক্ষা না করে সে ব্যক্তিকে হত্যা করে।
ইবনুল জাওযি আরও বলেন, এ সময় সুলায়মানের পুত্র, খেলাফতের পরবর্তী উত্তরাধিকারী আয়্যুবও সেখানে ছিল। সে একে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের ঔদ্ধত্য ও অভদ্রতা জ্ঞান করে তাঁর সাথে তর্ক করতে লাগল। সুলায়মান পুত্রকে তিরষ্কার করে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের নিকট ক্ষমা চাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।
এ সমস্ত ঘটনা ব্যতীত ঐতিহাসিকগণ আরও কয়েকিট ঘটনা উল্লেখ করেছন, যাতে প্রতীয়মান হয় যে, ওয়ালীদ ও সুলায়মান সইবনে মালেক যখনই কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনেই তারা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে ডেকে তাঁর পরামর্শ করতেন। তবে তারা কোন কোন সময় তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেন আবর কোন কোন সময় তারা তাঁর মতামত অগ্রাহ্যও করতেন।
কোন জটিল সমস্যা হলে ওয়ালীদ তাঁর খাদেমগেণকে নির্দেশ দিতেন যে, সেই সৎ লোকটিকে ডেকে আন। তারাও ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে সৎলোক বলেই বিশ্বাস করত। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন ভাল লোক ছিলেন। এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে যা িঠিক তিনি সে পরামর্শ দিতেন। পরিণাম কি হবে জিজ্ঞাসাকারী খুশি হবে না অখুশি হবে, তিনি তার ভয় করতেন না।
উদাহরণ স্বরূপ ইবনে আব্দুল হাজামের একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো, একদা ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের সাথে তার কোন বোনের উত্তারিধাকর সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। সুলায়মান বললেন এ সম্পর্কে খলীফা আব্দু মালেকের একটি দলীল আছে। তাতে তিনি তাদেরকে মিরাছ হতে বঞ্চিত করেছেন এবং তিনি তাঁর পুত্রকে সেই দলীল আনতে নির্দেশ দিলেন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ উপহাস করে বললেন, খলিফা কি কুরআন পাক আনতে নির্দেশ দিলেন? ওয়ালিদের পুত্র আয়্যূব একে অভদ্রতা জ্ঞান করে ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে বলল, এ কথাটিই একটি হত্যা করার পক্ষে যথেষ্ট। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ বললেন, তুমি যখন খলীফা হবে তখন এরূপই করিও। এতে সুলায়মান পুত্রকে তিরস্কার করলেন এবং ওমর ইবনে আবদুল আজীজের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন।
ইবনুল জাওযি বলেন, কোন কোন সময় খলীফাগণ তাঁর কথা মেনেও নিতেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, একবার এক সফরে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ সুলায়মানের সাথে ছিলেন। তাঁদের সাথে সামরিক বাহিনীর কিছু লোকও ছিল। সুলায়মান কিছু লোককে গান গেতে গুনে তাদেরকে ডেকে আনলেন এবং তাদেরকে নপুংসক করে দিতে নির্দেশ দিলেন। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ প্রতিবাদ করে বললেন, এটা শরীয়ত বিরোধী একটি নির্দেশ। তাদেরকে ছেড়ে দাও। সুলায়মান তাঁর কথা মেনে নিলেন।
এরূপ এক সফরে তিনি সুলায়মানের সাথে ছিলেন, এমন সময় খুব ঝড় শুরু হলো ও বিদ্যুৎসহ বজ্রপাত হতে লাগল। সুলায়মান ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তার বাহনের উপর জড়সড় হয়ে বসেছিলেন এবং ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে ডাকছিলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ এটা দেখে হাসতে লাগলেন। সুলায়মা অভিমান করে বললেন, আমরা ভয়ে মরি আর আপনি হাসে! ওমর ইবনে আবদুল আজীজ বললেন, এটা আল্লাহর রহমত, রহমত দেখে আনন্দ করা উচিত। কাঁদতে হয় আল্লাহর আযাব দেখে। একদিন সুলায়মান দেখলেন, বহুলোকের সমাগম হয়েছে। তিনি ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে জিজ্ঞেস করলেন, এ সমস্ত লোক কি চায়? হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ বললেন, এরা তোমারই নিকট অভিযোগ করতে এসেছে। সুলায়মান বললেন, এ এখ লাখ টাকা নিয়ে তাদের মধ্যে বিতরণ করে দিন। ওমর বললেন, এর চেয়েও ভাল হবে যে, তুমি তাদের অভিযোগ শুনে তার প্রতিকার বিধান কর। অতএব সুলায়মান ওমরের কথা মত তাদের অভিযোগ শুনে তার প্রতিকার করলেন।
একবার সুলায়মান ও হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের মধ্যে একটি ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হল। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর কোন গোলাম সুলায়মানের কোন এক গোলামকে খুব মারপিট করল। উক্ত গোলাম সুলায়মানের নিকট এ অভিযোগ করলেন। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। তিনি বললেন, তোমার বলার পূর্বে আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। সুলায়মান ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, আপনি মিথ্যাবাদী। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ বললেন, (আরবী************)
অর্থাৎ তুমি বল, আমি মিথ্যাবাদী, অথচ আমি যখন হতে কাপড় পরিরধান করি, তখন হতে কোন মিথ্যা কথা বলিনি। আল্লাহর পৃথিবী তোমার মজলিস হতে অনেক প্রশস্ত। এ কথা বলে সুলায়মানের মজলিস হতে বের হয়ে আসলেন এবং বাড়ীতে এসেই তিনি মিশরে যেতে প্রস্তুত হলেন। সুলায়মান এটা জানতে পেরে খুবই বিব্রত বোধ করলেন এবং লোক পাঠিয়ে সুলায়মান এটা জানতে পেরে খুবই বিব্রত বোধ করলেন এবং লোক পাঠিয়ে ওমরের নিকট ক্ষমা চাইলেন এবং তাকে ফিরিয়ে আনলেন। যখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তার নিক আসলেন তখন তিনি বললেন, আপনি মিশর যাত্রা করে আমাকে যেরূপ বিব্রত করেছেন এরূপ আর কখনও হয়নি।
ঐতিহাসিকগণ বিশেষতঃ ইবনে আবদুল হাকাম ইবনুল জাওযি এবং ইবনে কাছীর তার সত্যবাদীত ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এ সমস্ত ঘটনা উল্লেখ করেছেন এবং ৯৩ হিজরী হতে ৯৯ হিজরী পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছর দামেশকে অতিবাহিত করেন বলে উল্লেখ করেছন। ইবনুল জাওযি এটাও বলেছেন যে, একদিন সুলায়মান কোন এক জনপদে গিয়েছিলেন। তার কাফেলা ভীষণ ঝড়ে আক্রান্ত হল। তখন সুলায়মান চিৎকার করে বলেছিলেন, হে ওমর! হে ওমর!
বনু উমাইয়্যার লোকদের সাধারণ রীতি ছিল যখন তাদের কেউ কোন বিপদে পতিত হত তখনই ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে ডাকত এবং তিনিও এইত আমি আসছি” বলে তার ডাকে সাড়া দিতেন।
ইবনুল জাওযির অপর একটি বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, শুধু বনু উমাইয়্যার খলীফাগণই নয় বরং সাধারণ লোকেরাও বিপদাপদে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের সাহায্য প্রার্থী হত।
৯৩ হিজরী হতে ৯৯ হিজরী পর্যন্ত বনু উমাইয়া এবং বনু উমাইয়র খলীফাগণ বিশেষতঃ ওয়ালীদ ও সুলায়মান সকল প্রকার দুঃখ-শোকে, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক গুরত্বিপুর্ণ বিষয়ে ওমর ইবনে আবদুল আজজের পরামর্শ চাইতেন, আর তিনিও পরম বিশ্বস্ততার সাথে তাদেরকে উত্তম পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন।
খেলাফতের উত্তরাধিকার লাভ
সুলায়মানের চরিত্র যদিও দোষ-ত্রুটির কোন সীমা ছিল না, তবুও তাঁর মহত্ব ছিল যে, তিনি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে আন্তরিকভাবে ভালবাসতেন। সাধারণতা তিনি তাকে সঙ্গে করেই সফর করতেন এবং অধিকাংশ ব্যাপারেই তিন তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। ইতোপূর্বে আমরা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ ও সুলায়মানের প্রিয় পুত্র আয়্যূবের মধ্যে এবং সুলায়মান ও ওমর ইবনে আবদুল আজীজের মধ্যে মতবিরোধ সম্পর্কি তিনটি ঘটনা বর্ণনা করেছি।
আয়্যূব সুলায়মানে প্রিয় পুত্র এবং খেলাফতের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত ছিল। ওমর ইবনে আবদুল আজীজের খাতিরেই সুলায়মান তাঁর এ পুত্রকে দুই বার তিরস্কার করেছেন এবং ওমর ইবনে আবদুল আজীজের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। সুলায়মান তাঁকে মিথ্যাবাদীতার অভিযোগ দেয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। অথচ এতসব হওয়ার পর ধারণা কারও ধারণা ছিল না যে, মৃত্যুর কঠিন হাত যখন তাঁর দ্বারে করাঘাত করবে তখন তিন ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে খেলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করবনে। তাঁর প্রধানমন্ত্রী রেজা বিন হায়াতের পরামর্শেই সুলায়মান এ মহৎ কর্ম করতে উদ্বুদ্ধ হলেন।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন- সুলায়মানের পুত্র আয়্যূব খেলাফতের পরবর্তী উত্তরাধিকারী ছিল। কিন্তু সুলায়মানের পূর্বেই সে ইন্তেকাল করল। এছাড়া সুলায়মানের অন্যান্য সন্তানগণ সকলেই ছিল অল্প বয়স্ক। যখন তাঁর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল এবং তিনি কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে ইচ্ছা করলেন, তখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ এবং রেজা ইবনে হায়াত এসে উপস্থিত হলেন। সুলায়মান রেজাকে বললেন, আমার সন্তানগণকে জামা-কাপড় পরিধান করিয়ে আমার নিকট নিয়ে আস। তারপর সন্তানগনকে তার নিকট হাজির করা হল। তারা এতই অল্পবয়স্ক ছিল যে, তারা জামা কাপড় পর্যন্ত ঠিক রাখতে পারত না। সুলায়মান তাদের প্রতি তাকিয়ে এ কথা কয়টি আবৃত্তি করলেন। আমার সন্তানগণ ছোট ছোট তারা যদি বড় হতো তবে আমি সফল হতাম। এতে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ পবিত্র কুরআনের আশ্রয় গ্রহণ করলেন এবং পাঠ করলেন-
অর্তাৎ যে ব্যক্ত আত্মশুদ্ধ লাভ করে আল্লাহর স্মরণ করে নামায পড়ে সেই সফল হয়েছে।
সুলায়মান রেজাকে পুনরায় আদেশ করলেন যে, আমার পুত্রগণকে অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত করে আমার নিকট নিয়ে আস। তারপর তাদেরকে আনা হল, তখন দেখা গের যে তাদের কোমরে বাঁধা তরবারী মাটি স্পর্শ করছে।
ইবনে সাদ বলেন, রেজা বিন হায়াত বলেছেন, শুক্রবার দিন সুলায়মান সবুজ রঙের রেশমী কাপড় পরিধান করলেন। তারপর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আক্ষেপ করে বললেন, আল্লাহর কসম! আমি একজন যুবক বাদশাহ। তারপর লোকের সাথে জুমার নামাযে শরীক হবার জন্য বের হলেন। নামায হতে ফিরে এসে তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন এবং একটি অছিয়তনামা তিনি তার অল্প বয়স্ক পুত্র আয়্যূবকে খেলাফতের পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেন। এতে আমি নিবেদন করলাম আমীরুল মোমিনীন! যে খলিফা কোন যোগ্য লোককে তার স্থলাভিষিক্ত না মনোনীত না করে যায়, তিনি কিরূপে কবরে শান্তি ও নিরাপত্তা আশা করতে পারেন? সুলায়মান বললেন, আমি আল্লাহর কিতাব দ্বারা এস্তেখারা করব এবং আরও চিন্তা ভাবনা করব। এভাবে এক দুই দিন চলে গেল। অবশেষে তিনি তার পূর্ব লিীখত অছিয়তনামাটি ছিড়ে ফেললেন এবং আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, দাউদ ইবনে সুলায়মান সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? আমি বললা, তিনি আছেন কনস্টান্টিনোপলে। আপনি জানেন না যে, তিনি কি জীবিত আছেন না ইন্তেকাল করেছেন। সুলায়মান পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তবে তোমার মতমত কি? আমি বললাম, মতামতের অধিকারী তো আপনিই। আমার কর্তব্য হল আপনার মতামত সম্পর্কে চিন্তা করা ও পরীক্ষ নিরীক্ষা করে যথাযথ বাস্তবায়িত করা।
সুলায়মান বললেন, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? আমি বললাম, তিনি একজন সৎ যোগ্য লোক। সুলায়মান বললেন, তোমার কথা সঠিক। তিনি যথার্থই একজন সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি। কিন্ত যদি আমি তাঁকে খলিফঅ মনোনীত করি এবং আবদুল মালেকের সন্তানদের মধ্যে কাউকেও খলিফা মনোনীত না করি তবে খুব গোলমান হবে এবং ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তাদের উপর শাসন পরিচালনা করুক তারা একটা কখনও সহ্য করবে না। কিন্তু যদি ওমর ইবনে আবদুল আজীজের পর তাদের কাউকে খলীফা মনোনিত করে যাই তবে হয়ত তারা এটা মেনে নিতে পারে। ইয়াযিদ ইবনে আবদুল মালেক এখন রাজধানীতে উপস্থিত নেই। আমি তাকেই ওমর ইবনে আবদুল আজীজের পরবর্তী খলীফা মনোনীত করছি। এতে সে কিছুটা সান্ত্বনা লাভ করে আমার মনোয়নে রাজী হতে পারে। আমি বললাম, আপনার মতামত যথার্থ এবং মতামত প্রকাশের জন্য আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।
ইবনে সাদ বলেন ইবনে জাওযি, ইবনে কাছীর, ইবনে হাকাম ও তাবারীসহ প্রায় সকল ঐতিহাসিকিই এ ব্যাপারে এক মত যে, এই রেজা বিন হায়তই ওমর ইবনে আবদুল আজীজের খেলাফতের পক্ষে সুলায়মানকে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি যদি সুলায়মানকে কবরে শাস্তি সম্পর্কে ভয় না দেখাতেন তবে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের মনোয়নের ব্যাপারে বাধার সৃষ্টি হতো।
ইবনে হাকাম ও ইবনে সাদের বর্ণনা যদিও পরস্পর বিরোধী, তবু তারা উভয়েই স্বীকার করছেন য, রেজা বিন হায়াতই হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে খলীফা মনোনিত করার জন্য সুলায়মানকে সম্মত করিয়েছিলেন।
রেজা বিন হায়াত খুব দৃঢ় ব্যক্তিত্বশীল, সংকল্পে অটল ও বিশেষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন উজির ছিলেন এবং কারো ব্যক্তিত্বে তিনি আকৃষ্ট হতেন না। তিনি কুবই বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের প্রতি সুলায়মানের মন আকৃষ্ট করেছিলেন।
ইবনে সাৎদ পূর্ববর্তী ঘটনাবলি ছাড়াও এক বর্ণনায় বলেছিলেন যে, রেজা বিন হায়াত ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে খলিফা মনোয়নের জন্য নিজের পক্ষ থেকে সুলায়মানকে পরামর্শ দিয়েছেন।
ইবনে জাওযি ইমাম শাফী (র) এর একটি কথা বর্ণনা করছিলেন যে, (আরবী*************)
অর্থাৎ আমি আশা করি যে, আল্লাহপাক সুলায়মানকে এ জন্যই জান্নাতে স্থান দিবেন যে, তিনি ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে খলীফা মনোনীত করেছিলেন।
রেজা বিন হায়াতো পরামর্শক্রমেই সুলায়মান ওমর ইবনে আবদুল আজীজের পক্ষে মনোয়ন পত্র লিখেছিলেন।
ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ সুলাইমানের উজীর আজম রেজা বিন হায়াতের মৌখিক ভাষ্যটি এরূপ বর্ণনা করেছন:
সুলাইমান অছিয়তনামাটি লিপিবদ্ধ করে তাতে সীল মোহর করলেন এবং দেহরক্ষী প্রধান কাব ইবনে হামেদুল আইসীকে ডেকে তাঁর বাড়ীর লোকজনকে ডেকে একত্রিত করল। তখন খলিফা সুলাইমান রেজাকে বললেন, তুমি আমার লিখিত চিঠিসহ তাদের নিকট গিয়ে বল যে, এটা আমার লিখিত অছিয়তনামা এবং তাদেরকে এটা মেন নিতে এবং এতে আমি যাকে খলিফা হিসেবে মনোনীত করেছি তার আনুগত্য স্বীকার করতে দাও। তারপর যখন প্রধানমন্ত্রী রেজা তার কথামত তাদের নিকট গিয়ে উক্ত নির্দেশ দিলেন, তখন তারা বলল, আমরা আমিরুল মোমিনীনের নিকট গিয়ে তাঁকে সালাম করতে চােই। রেজা বিন হায়াত তাদের অনুমতি দিলেন। তারা যখন সুলাইমানের নিকট উপস্থিত হল, তখন সুলাইমান তাদেরকে উক্ত অছীয়তনামার প্রতি ইঙ্গিত করলেন, তারা তার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে খলীফা তাদেরকে বললেন, এটাই আমার অছীয়তনামা, আমার নির্দেশ মেনে নাও এবং আমি যার জন্য খেলাফতের অছীয়ত করেছি তার আানুগত্য স্বীকার করে তারপর তা একের পর এক এক কর। সকলেই বায়আত গ্রহণ করল। তারপর প্রধানমন্ত্রী রেজা বিন হায়াত সেই সীল মোরকৃত অছয়তনাম নিয়ে বাইরে আসলেন।
রেজা বিন হায়াত আরো বলেছেন যে, যখন সমস্ত লোক চলে গেল, তখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ আমার নিকট এসে বললেন, আমার সন্দেহ হয় যে, এ অছয়তনামাতে আমার সম্পর্কে কিছু লেখা হয়েছে। তিনি আরো বললেন, রেজা! “তোমার প্রতি আল্লাহ সদয় হোন” তুমি আমার বন্ধুত্বের প্রতি লক্ষ্য করে এ সম্পর্কে আমাকে কিছু জানাও। যদি আমার সন্দেহই সঠিক হয়, তবে তুমি বল আমি এখনই পদ হতে ইস্তফা দিয়ে মুক্তিলাভ করি। কারণ এখনও সময় আছে। রেজা বিন হায়াত বললেন, এ সম্পর্কে আমি আপনাকে কোন কিছুই বলতে পারব না। এ কথা শুনে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রাগ করে সেখা হতে চলে গেলেন।
রেজা বিন হায়াত বলেন, এরপর হিশাম ইবনে আবদুল মালেক আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বলল, “রেজা! তুমি আমাকে এ অছীয়তনামর বিষযবস্তু সম্পর্কে জানাও।”
যদি এতে আমার সম্পর্কে কিছু বলা হয়ে থাকে তবে এখন হতেই আমি তা জেনে নিলাম, আর যদি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকেও এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়ে থাকে, তবে এখনই তার প্রতিবা করব। কারণ আমার মত লোক এরূপ অন্যায় অবিচার নীরবে মেনে নিতে পারে না।
রেজা নি হায়াত গোপন রহস্য উদঘাটন করতে দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করলেন। হিশাম নিরাশ হয়ে ফিরে গেল এবং এক হাত দিয়ে অপর হাতে মারতে মারতে বলতে লাগল, “যদি খেলাফতের দায়িত্ব আমি না পাই, তবে আবদুল মালেকের বংশে আর কে আছে?
রেজা বিন হায়াত আরো বলেন, এরপর আমি সুলাইমানের নিকট এসে দেখি তিনি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। আমি কেবলামুখী করে দিলাম। তখন তিনি বললেন, যদি তুমি তাদের নিকট হতে দ্বিতীয়বার বায়আত না নাও তবে তারা মানবে না। তারপর সুলাইমান আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু” বলতে বলতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
রেজা বিন হায়াত বলেন আমি সবুজ রঙ্গের একটি চাদ দিয়ে তাঁর দেহ আবৃত করে দরজা বন্ধা করে দিলাম। তাঁর স্ত্রী সংবাদ বাহক পাঠিয়ে তার অবস্থা অবগত হতে চাইলেন। আমি বললা, খলীফা এখন ঘুমন্ত অবস্থায় আছেন। সংবাদ বাহক চাদর দিয়ে খলিফার দেহ আবৃত দেখে তাঁর স্ত্রীকে এই সংবাদ দিল। বেগম সাহেবাও তার কথা সত্য বলে বিশ্বাস করলেন। আমি উক্ত সংবাদবাহককে দরজায় দাঁড় করিয়ে তার নিকট থেকে অঙ্গিকার নিলাম যে, কাউকে এখানে আসতে অনুমতি দেবে না। তারপর আমি সেখান হতে বের হয়ে কাব ইবনে হামিদুল আইসীর নিকট লোক পাঠালাম এবং খলিফা পরিবারের সমস্ত লোকজনকে “মসজিদে ওয়াবিতে” হাজির করার ব্যবস্থা করলাম এবং তাদেরকে বললাম যে, তোমরা অছিয়ত নামর প্রতি বায়আত কর। তারা বলল, আমরা একবার বায়আত করেছি আবর কেন? তুমি দ্বিতীয় বার বায়আত গ্রহণ করতে চাও? আমি বললাম এটা আমিরুল মুমিনীনের অছিয়তনামা। প্রতিশ্রুটি দাও যে, এ মোহরকৃত অছিয়তনামার যাকে খলিফঅ হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে, তোমরা তার আনুগত্য স্বীকার করবে। তখন একে একে সকলেই দ্বিতীয় বার বায়আত করল।
রেজা বিন হায়াত বলেন, যখন সকলেই দ্বিতীয় বায়আত করল, তখন আমি মনে করলাম যে, এখন কথা মজবুত হয়ে গিয়েছে, কাজেই তাদেরকে খলিফার মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে দেওয়া উচিত। তখন আমি বললাম, তোমরা সকলেই দাঁড়িয়ে যাও, শোন তোমারেদ খলিফা ইন্তেকাল করেছেন। এরপর আমি সীলমোহরকৃত চিঠি খুলে সকলেই সামনে পাঠ করতে লাগলাম, কিন্তু যখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজের নাম ঘোষণা করলাম, তখন হিশাম ইবনে আবদুল মালেক চিৎকার করে বলতে লাগল, আল্লাহর কসম! আমি তার বায়আত করব না। আমিও চিৎকার করে বললাম, আল্লাহর কসম! তুমি বায়আত না করলে আমি এখনই তোমাকে হত্যা করব। উঠ, বায়আত কর। তারপর সে বাধ্য হয়ে উঠলো। তখন সে দু’ পা ফরামের উপর মারছিল এবং ইন্না লিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাহি রাজিউন পড়ছিল। আমি ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে বললাম, উঠুন! মিম্বরে আরোহন করুন। তিনি অতন্ত বিরক্তির সাথে ইন্না লিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাহি রাজিউন বলতে বলতে মিম্বরে আরোহন করে বললেন, এমন হল কেন?
রেজা বিন হায়াত আরো বলেন, যখন ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মিম্বরে আরোহন করলেন এবং হিশাম ইবনে মালেক ইন্না লিল্লাহি বলতৈ বলতে বায়আত করতে আসল, তখন যে ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে বলল, আফসুসের বিষয়- আব্দুল মালেকের সন্তানরা বঞ্চিত হল আর তোমাকে খলিফা মনোনীত করা হল। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ উত্তরে বললেন, হ্যাঁ আমিত কখনও এটা কামননা করিনি, বরং অপছন্দই করতাম। আবার তিনি ইন্না লিল্লাহি পাঠ করলেন। এরপর সুলায়মানের কাফন দাফনের ব্যবস্থা করা হল। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জানাযার নামায পড়ালেন। আল্লামা দা, তাবারী ইবনুল জাওযী ইবনে কাছীর যে বর্ণনা প্রদান করেছন তা দ্বারা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়েছে যে, সুলায়মান ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে যেরূপ প্রীতির চোখে দেখতেন তাতেই তিনি সন্দেহ প্রবণ হয়ে পড়লেন যে, হয়তঃ তাকেই খেলাফতের জন্য মনোনয়ন করা হয়েছে। কিন্তু তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলনা, কাজেই তিনি রেজা বিন হায়াতের মাধ্যমে দঢ় অবতির পর পদ হতে ইস্তফা দিয় মুক্তি লাভ করতে চেয়েছিলেন, অন্যতায় তিনি এরূপ করতেন না। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের খেলাফরেত ঘটনা বর্ণনা করে অন্যান্য ঐতিহাসিকদের হাতে কিছুটা ভিন্ন ধরনের সূক্ষ্ণ তথ্য সংযোজন করেছেন। তিনি বলেন যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ পূর্ব হতেই অবগত ছিলেন এবং রেজা বিন হায়াতের নিকট এসে তাকে তার বন্ধুত্ব ও আল্লাহর রহমতের দোহাই দিয়ে কোন মতে এ পদ হতে ইস্তফা গ্রহণ করে তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য রেজা বিন হায়াতকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইলেন। কিন্তু রেজা বিন হায়াত কোন মতে তাতে রাজী হলেন না।
ইবনে খালদুনের এ বর্ণনায় বুঝা যায় যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ পূর্বেই জানতে পেরেছিলেন এবং পদ হতে ইস্তফা দিয়ে মুক্তি লাভ করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে রেজা বিন হায়াতই ছিল তার একমাত্র প্রতিবন্ধক।
যা হোক আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ সত্য যে, রেজা বিন হায়াতই হযরত ইবনে আবদুল আজীজকে খেলাফতের পদ গ্রহণের জন্য রাজী করেছিলেন। এ ব্যাপারে ইবনে সাদের এ বর্ণনাটিও বিশেষ প্রণিধান যোগ্য। রেজা ইবনে হায়াত বলেন যে, যখন সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেকের মৃত্যুযন্ত্রণা বৃদ্ধি পেতে লাগলো, তখন আমি অস্থিরভাবে ঘরে ভিতর বাইরে আসা যাওয়অ করতে লাগলাম। এই অবস্তায় ওমর ইবনে আবদুল আজীজ আমাকে ডেকে বললেন, রেজা তুমি আমার পরম হিতৈষী বন্ধু, তোমাকে ইসলাম ও আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, যদি প্রসঙ্গক্রমে খলীফার সামনে আমার আলোচনা উঠে এবং যদি তিনি তোমার পরামর্শ চান, তবে অনুরেধ করে আমার পক্ষ হতে তার দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দিও। আমি তোমার জন্য আল্লাহ পাকের নিকট দোয়া করব। কারণ এ ব্যাপরে তোমার পরামর্শ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রেজা বিন হায়াত বলেন, আ ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে তিরষ্কার করে বললামম, তুমি তো কম লোভী নও! তোমার ইচ্ছ যে,, আমি তোমাকে খলীফঅ মনোনীত করার জন্য সুলায়মানের নিকট সুপারিশ করি। এতে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ খুব লজ্জিত হয়ে চলে গেলেন। আমিও ভিতহর চলে গেলাম। তখন সুলায়মান বললেন, তুমি কাকে খলীফা মনোনীত করতে পরামর্শ দাও এবং তার সম্পর্কে অছীয়তনামা লিখতে বল? আমি বললাম আমিরুল মুমিনীন, আপনি আল্লাহকে ভয় করুন। কেননা, আপনি আল্লাহর সাথে মিলিত হতে যাচ্ছেন। তিনি আপনাকে এব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। সুলায়ান বললেন, তবে তোমার ইচ্ছ কী? তখন আমি ওমর ইবনে আবদুল আজজের নাম প্রস্তাব করলাম। সুলায়মান এ বলে প্রতিবাদ করলেন যে, তবে আবদুল মালেকের অছীয়তনামা কী হবে? তিনি আমার নিকট তার জীবিত সন্তানদের ব্যাপারে এবং ওয়ালিদের নিকট হতেও এ প্রতিশ্রুটি নিয়েছেন। আমি বললাম, তাদের কাউকেও ওমর েইবনে আবদুল আজীজের পরবর্তী খলীফা মনোনীত করে দেন, কোন ঝামেলা থাকবে না। সুলায়মান আমার কথা সম্পূর্ণ রূপেই বঝতে পারলেন এবং বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, কাগজ কলম নাও। আমি কাগজ কলম এনে দিলাম, তিনি ওমর ইবনে আবদুল আজীজের খেলাফতের অছিয়তনামা লিখে দিলেন।
ইবনে সা’দের অপর এক বর্ণনায় স্পষ্টই জানা যায় যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ খেলাফতের পদ লাভের জন্য মোটেই আশা করতেন না। তিনি অছিয়তনামা শুনে শপথ করে বললেন যে তিনি কখনও খেলাফরেত পদ লাভের আশা করেননি। তার বক্তব্য ছিল এই (আরবী*****) আল্লাহর কসম! কখনও আমি আমা করিনি।
ইবনে আবদুল হাকাম এ ঘটনাটি যদিও খুব সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এতে নতুন তথ্য যোগ করা হয়েছে। তার ভাষ্যটি এরূপ-
১। তারপর সুলাইমান যখন মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, তখন রেজা বিন হায়াত তাঁর মৃত্যুর সংবাদ গোপন করে লোকদের কাছে গমন করে বললেন, খলিফঅ তোমাদের অছিয়ত নামায় লিখিত ব্যক্তি ব্যক্তি সম্পর্কে নতুনভাবে বায়আত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
২। রেজা বিন হায়াতের এ কথা শুনে তারা বলল, আমাদেরকে খলিফার কাছে নিয়ে চলূন। তখন রেজা ভিতর প্রবেশ কর মৃত খলিফাকে বালিমৈর সাহায্যে সোটা করে বসিয়ে দিলেন এবং একজন খাদেমকে তাঁর নিকট দাঁড় করিয়ে তিনি নিজে বাইরে আসলেন এবং লোকজনকে ভিতরে প্রবেশ করতে বললেন। লোকেরা ভিতরে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে দূর হতেই তাঁকে দেখছিল এবং সালাম করে বের হয়ে যাচ্ছিল। তখন একজন খাদেম রোগীর ন্যায় খলিফার গাযের চাদর এদিক ওদিক করছিল।
৩। রেজা বিন হায়াত তখন লোকদেরকে মসজিদে একত্রিত করলেন, তখন খলিফা পরিবারের লোকজনের সাথ অন্যান্য গণমান্য লোকেরাও একত্রিত হয়েছিল। এবং তারা সকলেই এক সঙ্গে অছীয়তনামায় নির্দেশিত ব্যব্তর প্রতি বায়আত করলেন।
৪। তারপর যখন অছীয়ত নামা পাঠ করা হল, তখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের নাম শুনে হিশাম ইবনে মালেককে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠল, তখন একজন সিরিয়বাসী যুবক তরবারী উত্তোলন করে হিশাম ইবনে মালেককে ধমক দিয়ে বলল, “খলিফার অছিয়তনামা পড়া শেষ হোক, তারপর তুমি চিৎকার করবে।”
তারপর ইয়াজিদ ইবনে আবদুল মালেকের নাম শুনে হিশাম বলল, আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য স্বীকার করলাম। এরপর সকলে উঠে ওমর ইবনে আবদুল আজিজের হাতে বায়আত করল।
এ ব্যাপারে ইবনুল জাওযিও একটি মূলব্রন তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, হিশাম ইবনে মালেক বলল, আমি তখনই এ অছিয়তনাম মেনে যখন আমি জানতে পারব যে, তাতে আবদুল মালেকের সন্তানদের অধিকার স্বীকা করা হয়েছে। লোকেরা তার এই কথার জন্য তাকে তিরস্কর করল এবং সে ভীষণ লজ্জা পেল। তখন সমস্ত লোক সামি’না ওয়া আত’না অর্থাৎ আমরা আনুগত্যের শপথ করলাম বলে নতুনভাবে বায়আত করল। যখন রেজা ইবনে হায়াত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ মিম্বরে দাঁড়াতে অনুরোধ করলেন। তিনি মিম্বরের নিকটিই ছিলেন, তিনি বললেন, “আল্লাহর কমস”! আমি প্রকাশ্য বা গোপন কোনভাবেই এর আশা করিনি।
ইবনুল জাওযি আরো বলেন, এ দ্বিতীয় বায়আতের পর সুলাইমানকে দাফন করে যখন ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মসজিদে আসলেন, তখন ম্বিরে আরোহণ করে বলনে, হে লোক সকল! আমাকে আমাকে আমার মতামত ও ইচ্ছা ছাড়াই খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তোমাদেরকে আমার বায়আত হতে মুক্তি দিলাম। তোমরা স্বাধীনভাবে যাকে ইচ্ছা খলীফা নির্বাচন কর। সমস্ত লোক সমস্বরে চিৎকার কর বলে উঠল, আমরা আপনাকেই খলীফা মনোনীত করেছি, আমরা আপনাকেই খলিফা মনোনীত করেছি। আমরা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট।
প্রথম পদক্ষেপ
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ সুলায়মানের জানাযায় নামায পড়িয়ে যখন তাকে দাফন কররেণ তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ অন্য কোন কাজ করার পূর্বেই দোয়াত-কলম আনিয়ে সর্বপ্রথম তিনটি নির্দেশ প্রদান করলেন।
লোকজন তাঁর ব্যস্তায় কানাঘোষা করতে লাগল। কেউ কেই বলল, “এতো তাড়াহুড়া কেন, এ কাজ তো তিনি ঘরে ফিরেও করতে পারতেন। মনে হয় খেলাফতের লোভ-লালসায় তাঁকে পেয়ে বসেছে।
ইবনুল হাকাম বলেন, খেলাফরেত লোভ-লালসার কারণেই ওমর ইবনে আবদুল আজিজ দোয়াত-কলম আনার ব্যবস্থা করেননি, বরং তিনি নিজেই নিরেজর পর্যালোচনা করেছেন এবং এই অবহেলাও তার অনুভূতি এবং কর্তব্য পরায়ণতার প্রতিকুলে ছিল বলেই তিনি এরূপ ব্যস্ততা প্রকাশ করেছিলেন।
এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজের এ ব্যস্ততার কারণ কর্তব্যপরায়ণতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কেননা, যদি তিনি বাদশাহী পছন্দ করতেন, যদি তিন বাদশাহীর উপকরণাদি লাভ করতে ভালবাসতেন তবে ওয়ালিদ বা সুলাইমানের যুগে প্রকাশ্যে না হোক গোপনে হলেও এর জন্য কোন প্রচেষ্টা চালাতেন । অথচ বাস্তব ও সত্য কথা হলো ঐতিহাসিক ইবনে আবদুল হাকাম স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন যে, সমগ্র বনু উমাইয়ার মধ্যে ওয়ালিদ ও সুলায়মান ব্যতীত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বনু উমাইয়ার সকলের নিকটই প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি দেশব্যাপী উলামা, ফুকাহা এবং মুহাদ্দেসিন সকলের নিকটই প্রশংসনীয় ছিলেন। তদুপরি মিশর ও আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকায় তাঁর যথেষ্ট সংখ্যক ভক্ত- অনুরক্ত ছিল। তিনি ইচ্ছ করলে ওয়ালিদ বা সুলায়মানর যুগেও মিশরে স্বাধীনভাবে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কারণ তৎকালীন তিনজন নামকরা সেনাপতি মোহাম্মদ ইবনে কাসেম মূসু ইবনে নাছীর এবং কুতাইবা ইবনে মুসলিম ওমর ইবনে আবদুল আজিজের পরম ভক্ত ছিল। বিশেষতঃ মূসা ও কুতাইবা তাঁর ইশারায় লাখ লাখ সৈন্যসহ ময়দানে হাজির হতে দ্বিধাবো করত না।
মূসা ইবনে নাছীর সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের ধারণা হলো, মূসার সাথে ওমর ইবনে আবদুল আজীজেরে পিতা আবদুল আজিজের বন্ধুত্ব ছিল। ওমরের সাথেও মূসার সম্পর্ক সেরূপ ঘনিষ্ট ছিল। কারণ মূসা যখন ইরাকের মন্ত্রী ছিলেন, তকন খলীফা আব্দুল মালেকের রোষে পড়ে তিনি কুফা হতে পারিয়ে মিশরে আবদুল আজিজের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এটা জানতে পেরে আবদুল মালেক তার ভাই আবদুল আজিজতে লিখলেন যে, মূসা পলাতক ব্যক্তি-তাকে দামেশকে পাঠিয়ে দেয়া হোক। কিন্তু আবদুল আজিজ কোন পরওয়াই করলেন না। বরং তাকে তিনি আফ্রিকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে সেখানকার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে দিলেন। মূসাও সেই সুযোগে বিপুল পরিমাণে শক্তি বৃদ্ধি করে নিলেন।
সুলাইমান তার অভিষেকের সময় যখন মূসাকে গ্রেফতার করেন, তখন ওমর ইচ্ছা করলে মূসাকে স্বপক্ষে আনতে পারতেন এবং মূসাও তার সমর্থন পেলে এমন এক বিদ্রোহ ঘটাতে পারতেন যার ফলে সুলাইমান কেন, সমগ্র বনু উমাইয়ার নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে যেত। কিন্তু ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এমনটা করলেন না।
যদি তিনি খেলাফত পরিচালনার লোভ করতেন তবে কুতাইবা ইবনে মুসলিম- যিনি প্রাচ্যের মহান বিজেতা ছিলেন, তার দ্বারাও তিনি সে দিনই খেলাফতের পতাকা উড্ডীন করতে পারতেন, যেদিন দামেশকে সুলাইমানের খেলাফতের সাধারণ বায়আত গ্রহণ করা হয়েছিল। ইবনে কাছীর স্পষ্ট ভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, ইয়াজিদ ইবনে মুহারিবের কারণে কুতাইবা সুলাইমানের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি সুলায়মানকে পদচ্যুত করার জন্যে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন। যদি ওম ইবনে আবদুল আজীজ গোপনে ও একজন সংবাদ বাহকের মাধ্যমে তাকে কোন ইঙ্গিত দান করতেন যে সুলাইমানের পরিবর্তে তুমি আমার বায়আত গ্রহণ কর তবে কুতাইবা তাঁর এতটুকু ইশারায় তার খেলাফতের পতাকা উড্ডীন করে দিতেন। এবং তার এ কর্মতৎপরতায় কেউ বাধা দিতে সাহস পেত না। তিনি প্রকাশ্যে রাজধানী দামেস্কে এস উপস্থিত হতেন, আর একজন উমবী যুবরাজের পৃষ্ঠপোষকতাই তাকে তাঁর এ সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিত।
কিন্তু ওমর ইবনে আবদুল আজীজ খেলাফতের মসনদকে শুধু কন্টাকাপূর্ণ নয় বরং অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পূর্ণ মনে করতেন। তিনি বলতেন, যে ব্যক্তির ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতা থাকে, সে খলিফা নিযুক্ত হবার পর তার সে অধিকারটুকুও খর্ব হয়ে যায়।
যা হোক, তাঁর এরূপ কর্তব্যপরায়ণতাই সুলাইমানের জানাযার পর তাঁকে তিনটি ফরমান জারি করতে বাধ্য করেছিলি। তন্মধ্যে প্রথম ফরমান ছিল মুসলিম ইবনে মালেককে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক তাবারীর মতে, সুলাইমান ইবনে মালেক তার ভাই মুসলিমকে ৯৮ হিজরীতে কনষ্টান্টিনোপল প্রেরণ করে নির্দেশ দিয়েছেন যে, কনষ্টান্টিনোপল জয় না করা পর্যন্ত সে সেখানেই অবস্থান করবে, পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সে ফিরে আসতে পারবে না।
মুসলিমা যখন সেখানে গিয়ে কনষ্টান্টিনোপুলের নিকটবর্তী হলেন, তখন তিনি প্রত্যেক অশ্বারোহীকে দুই মণ গম সঙ্গে নিতে নির্দেশ দিলেন। অশ্বরোহী সৈনিকগণ তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করল এবং তারা কনষ্টান্টিনোপুলের নিকটে গমের একটি পাহাড় সৃষ্টি করে দিল। মুসলিমা তাদেরকে এ গম খেতে নিষেধ করলেন এবং রোমানদের ভান্ডার লুন্ঠন করে এবং তাঁদের কৃষিক্ষেত্রে চাষ করা খাদ্য সংগ্রহ করতে নির্দেশ দিলেন।
সৈন্যবাহিনী কাঠ-খড় দ্বারা সেখানেই ঘর-বাড়ী নির্মাণ করে কৃষিকাজ শুরু করে দিল। তাদের কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপন্ন না হওয়া পর্যন্ত তারা লুটতরাজ করে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করতো। যখন তাদের কৃষি ক্ষেত্রে ফসল উৎপন্ন হল তখন পূর্বের খাদ্য সংরক্ষণ করে উৎপননদ্রব্য তারা খেতে লাগল।
তাবারী বলেন, বাহ্যতঃ মুসলিমার এ কর্মসূচী খুবই উত্তম ছিল। কিন্তু রোমানগণ চালাকী করে তাদের এ কর্মসূচী সম্পূর্ণরূপে ভুন্ডুল করে দিল। রোমান সেনাপতি এক রাত্রিতে অতর্কিতে আক্রমণ করে মুসলমানদের নতুন ও পুরাতন উভয় শষ্য ভান্ডারে আগুন ধরিয়ে দিল। সমস্ত শষ্য ভান্ডার পুড়ে ভষ্ম হয়ে গেল। এখন সুলাইমানের সৈন্যবাহিনী খাদ্যের বিরাট সংকটের সম্মুখীন হয়ে মৃত্যুবরণ করতে লাগল।
মুসলমানরা খাদ্যের অভাবে তাদের বাহনের জন্তুগুলি খেয়ে অবশেষে বৃক্ষের মূল ও পাতা খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগল।। সুলাইমান যথারীতি এ সংবাদ অবগত হয়ে এর কোন প্রতিকার করলেন না। তিনি অত্যন্ত একগুঁয়ে ছিলেন। তিনি ওয়াবেক নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু মুসলমান সৈন্যবাহিনীকে কনষ্টান্টিনোপুল ত্যাগ করতে অনুমতি দিলেন না। তাবারী এ ঘটনা উল্লেখ করে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা বাস্তবিকই করুণ ও মর্মান্তিক। তিনি বলেন, তারা অনাহারে তাদের বাহনের সমস্ত পশু খেয়ে ফেলল, মাটি ব্যতিত গাচের শিকড় ও পাতাসহ সবকিছুই তারা ভক্ষণ করছিল, অথচ সুলাইমান ওয়াবেকে অবস্থান করেও এর কোন প্রতিকার বিধান করতে এগিয়ে আসলেন না। এভাবেই শীতকাল এসে পড়ল এবয় সুলায়মান মৃত্যুমুখে পতিত হলেন।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন, রোমানরা যখন মুসলমানদের সাথে প্রবঞ্চনা করে তাদের খাদ্যসামগ্রী জ্বালিয়ে দিল এ সংবাদ শুনে সুলাইমান খুবই রাগান্বিত হয়ে কসম করলেন যে, তিনি মুসলিমাকে আর ফেরত আনবেন না।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট এটা একটি নিবর্তনমূলক কসম ছিল, কাজেই তিনি সুলাইমানের জানাযা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ কসম ভঙ্গ করে মুহূর্তকাল বিলম্ব না করেই মুসলিমাকে দেশে ফিরে আসতে নির্দেশ দিলেন। তিনি লিখলেন তুমি ফিরে আস। এবং সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে দামেস্কে ফিরিয়ে আন।
সালায়মান জীবিত অবস্থায় যখন তিনি মুসলমানদের এ দুঃখ কষ্টের কথা জানতে পারলেন তখন সুলায়মান একগুঁয়েমিতে অবিচল ছিলেন কিন্তু ওমর ইবনে আবদুল আজিজ অত্যন্ত বিচলিত ও মর্মাহত হয়েছিলেন।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন, এটা ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে বিচলিত ও মর্মাহত করেছিল অতঃপর তিনি খেলাফতের পদ লাভ করার পর এক মুহূর্তও মুসলমানদের দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারলেন না। এ কারণেই তিনি পত্র লিখতে ব্যস্ততা প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি দ্বিতীয় যে পত্র লিখেছিলেন, তা প্রথম পত্র অপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি এ পত্রের মাধ্যমে মিশরে রাজস্ব সচিব উসামান ইবনে যাযেত আততানুহীকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। তিনি আরো নির্দেশ দিলেন যে, তাকে প্রত্যেক ঘাটিতে এক বছর করে বন্দী করে রাখা হোক।
ইবনে হাকাম এ কঠোর নির্দেশের কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, সে ছিল একজন অত্যাচারী ও আল্লাহর সীমালঙ্ঘনকারী শাসক। সে মানুষকে আল্লাহর বিধানের বিপরীতে শাস্তি দিত। সে এমন সব অপরাধে মানুষের হাত কেটে দিত যাতে আল্লাহ পাক অনুরূপ বিধান দেননি। সুতরাং ওমর ইবনে আবদুল আজীজের ন্যায় কর্তব্যপরায়ণ আল্লাহভীরু শাসনকর্তা এরূপ জালেম ও জল্লাদ কর্মকর্তাকে কিভাবে বরদাশত করতে পারেন? অতএব তিনি যথাশীঘ্র সম্ভব মুসলমানগণকে এরূপ পাপিষ্ট ব্যক্তির হাত থেকে মুক্তি দিতে ব্যস্তার সাথে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন।
তিনি তৃতীয় ফরমান লিখেছিলেন আফ্রিকার শাসনকর্তা ইয়াযিদ ইবনে আবু মুসলিমাকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে। ইয়াযিদ ইবনে মুসলিম শাহী নির্দেশাবলী অতি কঠোরভাবে কর্যকরী করত, মানুষের উপর সীমাহীন যথারীতি আল্লহর যিকির ও তসবীহ তাহলীলও পাঠ করত। সে যখন কাউকে শাস্তি দিত তখন তার গোলামকে আদেশ দিত, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, হে বালক! তার শীরের অমুক অমুক স্থানে জোরে জোরে আঘাত কর। কখনো কখনো লা-ইলাহা ইল্লাহ আল্লাহ আকবার ধ্বনী করে এসব নির্দেশ দিত।
বাস্তবিক পক্ষে এটা আল্লাহর যিকির ও ইসলারে প্রতি বিদ্রূপেরই নামান্তর ছিল। সে যেন আল্লাহর নাম নিয়েই মানুষের উপর জুলুম অত্যাচর করত এবং মানুষকে শাস্তি দিত।
এ তিনটি ফরমান লিখে যখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ সুলায়মানের কবস্থান হতে উঠে আসলেন, তখন তাঁর শাহী সওয়ারী হাজির করা হল। তিনি এ সমস্ত সওয়ারী দেখে বললেন, এ সমস্ত কিসের সওয়ারী? উত্তর দেওয়া হল, এ নবনির্বাচিত খলিফার জন্য নির্ধারিত সওয়ারী। ইতোপূর্বে এসব বাহনে আর কেউ আরোহন করেনি। এতে নবনির্বাচিত খলিফা প্রথম দিন আরোহন করে থাকেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ এসব সওয়ারী ফিরিয়ে দিয়ে তার নিজের খচ্চরের দিকে এগিয়ে চললেন এবং ব্যক্তিগত সেবক মুজাহিমকে বললেন, এ সমস্ত বায়তুল মালে নিয়ে যাও। এগুলি সাধারণষ মুসলমানের সম্পদ।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন, তাঁর জন্য এরূপ নতুন তাঁবু ও শামিয়ানা টানানো হল-যাতে ইতোপূর্ব আর কেউ তাতে বসবাস করেনি। এটাই সাধারণ প্রচলিত প্রথা ছিল। যে ব্যক্তি নতুন খলিফা নির্বাচিত হবেন তার জন্য এরূপ নতুন তাবুর ব্যবস্থা করা হত।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এ সমস্ত নতুন তার দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এগুলি কিসের তাবু? উত্তর দেওয়া হল, এ সমস্ত তাবুতে ইতিপূর্বে কারও বসার সৌভাগ্য হয়নি। কোন নবনির্বাচিত খলিফা খেলাফতের মর্য়াদায় আসীন হবার পরই এসব তাবুতে অবস্থান করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মুজাহিমকে বললেন, এগুলিও মুসলমানদের সম্পদ, এগুলোও বায়তুলমালে জমা করে দাও। এরপর তিনি তার খচ্চরে আরোহন করে সে সব বিছানার প্রতি অগ্রসর হলেন যা পূর্বনিয়ম অনুযায়ী সম্পূর্ন নতুন ছিল এবং যা ইতোপূর্বে আর কারও জন্য বিছানো হয়নি এবং কোন খলিফাও যাতে বসার সৌভাগ্য লাভ করেননি। মোটকথা এসব বিছানা সম্পূর্ণ নতুন ছিল শুধু অভিষেক অনুষ্ঠানের মর্যাদার খাতিরেই ঐসব ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বাহন হতে অবতরণ করে এ বিছানার নিকটবর্তী হয়ে তার হাতের ছড়িয়ে অগ্রভাগ দিয়ে তা গুটিয়ে দিলেন এবং খালি চাটাই বের করে তাতে উপবেশন করলেন।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন, যখন ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খলিফা হলেন তখন সমসত লোক তার সামনে দন্ডয়মান হল, তিনি উপস্থিত জনতাকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন, লোক সকল! তোমরা যদি আমার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে থাক তবে আমিও দাঁড়িয়ে যাব। যদি তোমরা বস আমিও বসব। মানুষ শুধু আল্লাহর সামনেই দাঁড়াবে। আল্লাহ মানুষের জন্য কিছু কাজ ফরযও কিছু কাজ সুন্নত করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এগুলি যথারীতি পালন করবে, সে সফলকাম হবে আর যে ব্যক্তি একথার প্রতি অবহেলা করবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।
তোমাদের মধ্যে যে আমাদের সাহচর্যে আসবে তার পাঁচটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।
১। সে আমারেদ নিকট তার সেসব প্রয়োজনীয় কথা পৌঁছাবে, আমরা যা অবগত নই।
২। আমারেদকে এরূপ সুবিচারের প্রতি ধাবিত করবে- যা আমারেদ দ্বারা হওয়া সম্ভব ছিল না।
৩। সত্যৗবাদিতার দিক দিয়ে সর্বদাই আমাদের সঙ্গী হবে।
৪। সবসময় আমাদের ও মুসলমান জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা করবে।
৫। আমারেদ নিকট কারও বদনাম না গীবত করবে না।
এই পাঁচটি বিষয় যে লক্ষ্য রাখবে না তার জন্য আমারেদ দরজা বন্ধ থাকবে।
এ সম্পর্কে ইবনুল জাওযি মুহাম্মদুল মারুযির মাধ্যমে যে বর্ণনা করেছেন তাতে সুলায়মানের দাফন শেষ এবং খলিফার জন্য নতুন সওয়ারী হাজির করার বর্ণনায় কিছু অতিরিক্ত বিষয়ও বর্ণিত হয়েছে- তিনি বললেন, আমার বাহন আন। যখন তাঁর বাহনের জন্তুটি তাঁর নিকট উপস্থিত করা হল এবং তিনি তাতে আরোহন করলেন, তখন শহররক্ষী প্রধান এসে তার সামনে হাজির হল এবং খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে আগে আগে চলল। খলীফা তাকে বললেন, আমার সামনে হতে সরে যাও, তোমার কোন প্রয়োজন নেই। আমার নিকট তোমার কোন কাজও নেই। আমি একজন সাধারণ মুসলমান, একজন সাধারণ মানুষ মাত্র। তিনি চলতে লাগলেন। মানুও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলল। তিনি মসজিদে এসে মিম্বরে আরোহন করে বসলেন, সমস্ত লোক তার চারদিকে জমায়েত হল। এরপর তিনি এই ভাষণ দিলেন,
হে লোক সকল! আমি তোমাদেরকে আল্লহর ভয় করার পরামর্শ দিচ্ছি। আল্লাহর ভয় সর্বপ্রথমে। আল্লাহর ভয় ব্যতীত কোন উপায় নেই। নিজের জীবন পরিপাটি করার জন্য যা কিচু প্রয়োজন মনে কর তবে যে ব্যক্তি পরকালের কাজ করে যায় আল্লাহ তার দুনিয়ার কাজ সঠিক করে দেন। যদি তোমরা তোমাদের অভ্যন্তরকে ঠিক রাখ তাহলে আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক দিক ঠিক রাখবেন। মৃত্যুকে বেশি স্মরণ কর। মৃত্যু যখন আসবে তখন তার জন্য উত্তমরূপে প্রস্তুত থাকা উচিত। মৃত্যু মানুষের জীবনের সমস্ত আনন্দে উপবোগ কেড়ে নেয়। এ উম্মত আল্লাহ ও তার রাসূল এবং আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে কোন মতবিরোধ করবে না। কিন্তু তারা ধন-সম্পদ নিয়ে ঝগড়া ফাসাদ করবে। আল্লাহর কসম, প্রাপ্য অধিকার ছাড়া আমি কাউকে কোন কিছুই দেবনা, কারও অধিকারে হস্তক্ষে করব না। তারপর তার কণ্ঠস্বর আরও গম্ভীর হয়ে গেলে। তিনি বলরেন, হে লোক সকল! যে আল্লাহর আনুগত্য করে মানুষের উপর তার অধীনতা স্বীকার করা ফরজ। যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানী করে মানুষের উপর তার আনুগত্য স্বীকার করা জায়েয নেই। আমি যদি আল্লাহর নাফরমানী করি তবে তোমরাও আমার কথা অমান্য করবে।
অপর এক বর্ণনায় দেখা যায় যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এ সময় নিম্নলিখিত ভাষণ দিয়েছেন, “হে লোক সকল! এটা বাস্তব সত্য যে, তোমাদের নবীর পর আর কোন নবী আগন করবেন না, তোমাদের কিতাবের পর আর কোন কিতাব অবতীর্ণ হবে না। মহান আল্লাহ যে সমস্ত বস্তু হালাল করেছেন সেগুলো হালাল আর তিনি যা হারাম করেছেন তাই হারাম। আর এ হারামের বিধান কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। হে লোক সকল! স্মরণ রেখো, আমি চুড়ান্ত বিচারক হিসেবে এ আসনে উপবেশন করিনি। আমি শুধু আল্লহর বিধানসমূহ কার্যকরী করতেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমি কোন নতুন বিষয়ের দাবী করব না, আমি আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে চলব। হে লোক সকল! দেখো, আল্লাহর বিধানের বিপরীতে কারোও আনুগত্য তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে না।
আরও মনে রেখো, আমি তোমাদের মধ্যে সকলের চেয়ে উত্তম ব্যক্তি নই। আমি তোমাদেরই ম একজন সাধারন মানুষ। কিন্তু আল্লাহপাক তোমাদের চেয়ে আমাকে অনেক বেশী দায়িত্ব দিয়েছেন।
ইবনুল জাওযি বলেন, তার এ ভাষণ হওয়া মাত্রই একজন আনসারী সর্বপ্রথম উঠে এসে তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করলেন। তারপর একের পর এক লোক এসে বায়আত গ্রহণ করতে লাগল, এরূপে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠান শেষ হল। তারপর তিনি তার তাবুতে আসেলন, পূর্ব হতেই তাঁর জন্য সুলায়মানের গালিচা বিছানো ছিল, তিনি এ গালিচা উঠিয়ে একটি আরমানি বিচানা বিছিয়ে তাতে বসলেনস এবঙ বললেন, আল্লাহর কসম! আমি যদি মুসলিম জনতার দায়িত্ব গ্রহণ না করতাম তবে তোমার উপর বসতাম না।
এ আরমানি বিছানাটি খুবই নিম্নমানের ছিল বলেই তিনি তাকে পছন্দ করেছিলেন তা না হলে তিনি তা পছন্দ করতেন না।
ইবনুল জাওযির অপর এক বর্ণনায় জানা যায় যে, তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি তাঁর সামনে এসেছিল তার দুঃখ-কষ্টের কথা শুনে তিনি কেঁদে অস্থির হয়ে গেলেন, তাঁর চোখের পানিতে হাতের লাঠিটিও ভিজে গিয়েছিল। অবশেষে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তাকে নিজের তরফ হতে দুশত দীনার এবং বায়তুল মাল হতে আর তিনশ দীনার প্রদান করলেন এবঙ তার জন্য পৃথকভাবে মাসিক দশ দীনার ভাতা ধার্য করে দিলেন।
তারপর তিনি তার বাসস্থানে আসলেন, তখন রাত অনেক হয়েছিল। কাজেই তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করলেন। পরের দিন সকালে সুলায়মানের বাসগৃহে চলে গেলেন।
ইবনে আাবদুল হাকাম বলেন, সারা রাত ধরে সুলায়মানের পরিবারের লোকেরা শাহী আসবাবপত্র উল্টাপাল্টা করতে লাগল, অব্যহৃত সুগন্ধি ব্যবহৃত বোতলে রাখল, নতুন কাপড় পরিধান করতে লাগল, যেন সেগুলোও ব্যবহৃত দেখা যায়। তারা এসব করার কারণ হলো, পূর্ব হতে প্রচলিত ছিল যে, যখন কোন খলিফার মৃত্যু হত তখন খলিফার ব্যবহৃত জিনিসপত্র, সুগন্ধি ও অন্যান্য সামগ্রী তার সন্তানগণ অংশীদার হতো, আর যা অব্যবহৃত থাকত তা নতুন খলিফা লাভ করত।
পরের দিন সকালে সুলায়মানের পরিবারের লোকেরা ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে এ সমস্ত সামান-পত্র দেখিয়ে বলল, এগুলি তোমার আর এগুলি আমাদের। খলিফা এ কথার ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তারা বলল, সুলায়মান যে সব কাপড় পরিধান করেছেন, যে সব সুগন্ধি ব্যবহার করেছেন সেগুলো তার সন্তানদের আর যেগুলি ব্যবহার করেননি সেগুলো আপনার।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এ ব্যাখ্যা শুনে বললেন, এসব আমারও নয় তোমাদেরও নয়। এসব মুসলমানদের সম্পদ। তখন তার খাদেমকে বললেন, মুজাহিম এসব বায়তুল মালে জমা করে দাও।
এখন শুধু বাঁদীগণ অবশিষ্ট থাকল। এই সমস্ত বাঁদী তাঁর সামনে হাজির করা হল, এরা জীবিকার জন্য এ পেশা গ্রহন করেছিল। তাদের প্রত্যেকের পরিচয়, বংশ, দেশ সম্পর্কে অবহিত হয়ে তিনি নির্দেশ দিলেন যে, এদের প্রত্যেককে তাদের পিতা-মাতার নিকট পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন, মন্ত্রীগণ, পরিষদবর্গ এবং উমাইয়া বংশের লোকেরা এসব দেখে নিরাশ হয়ে পড়ল, তারা বুঝল যে, তিনি শুধু ইনসাফ তথা ন্যায় বিচারকেই বেছে নিবেন। তিনি কোন অন্যায়-অবিচার প্রশ্রয় দিবেন না।