ওমর ইবনে আবদুল আজীজের সাধারণ জীবন
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ নিজেই নিজের হিসেব করে আড়ম্বরহীন দুঃখ-দৈন্যের জীবন অবলম্বন করেছিলেন। সরকারী কোষাগারের উপর কোন প্রকার চাপ সৃষ্টি না করে অতি সাধারণ মোটা ও ফাটা কাপড় পরিধান করতেন। পরহেজগারী ও ফকিরী, দরবেশীর উদ্দেশ্যে ছিল না। খেলাফরেত দায়িত্ববার গ্রহণ করার পর তার মনের কামনা বাসনাও মৃত্য হয়নি। তাঁর অন্তরের শিরা উপশিরাও বন্ধ হয়ে যায়নি। তারপরও তার আশা আকাঙ্খার রজু ও ছিন্ন হয়ে যায়নি।
এ সমস্ত হিসাব-নিকাশ, এ সকল আড়ম্বরহীনতা, বায়তুল মাল ও ব্যক্তিগত বিত্ত বৈভব হতে সংযমশীলতা তিনি শুধু এ জন্যই অবলম্বন করেছিলেন যে, ইসলাম বায়তুল মালের সম্পদের অধিকার কোন ব্যক্তির বিশেষের জন্য নির্ধারণ করেনি। এটা কোন খলিফার কোন বাদশার বা কোন শাহজাদার ব্যক্তির সম্পদ ছিল না। এটা শুধু জনসাধারণের কল্যাণের নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এটা আবু সুফিয়ান ও উমাইয়ার পুত্র-সন্তানদের ভোগ বিলাসের জন্য ছিল না। হযরত আলী (রা) হযরত ফাতেমা (রা)-এর পুত্র সন্তানদের ভোগের জন্য ছিল না। এরটা মারওয়ানের পুত্র আবদুল মালেকের জন্য ছিল না, ছিল না আব্দুল আজিজ, ওয়ালীদ, সুলায়মান অথবা ইয়াযিদ প্রমুখের ভোগ বিলাসের জন্য। ইয়াযিদ, আবদুল মালেক, ওয়ালীদ ও সুলায়মান এবং অন্যান্যরা এতে অন্যায় হস্তক্ষেপ করেছিল। কামনা বাসনা চরিততার্থ করতে তারা বিনাদিধায় জনসাধারণে সম্পদ খরচ করেছিল। সাধারণ মানুষকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের সম্পদ লণ্ঠন করেছিল। যদি বায়তুল মাল কারো ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত হতো তবে এটা তা হত- মুহাম্মাদ রাসূলূল্লাহ (সা), তার প্রিয়তমা কন্যা হযরত ফাতেমা (রা) এবং তার পুত্র হযরত হাছান ও হুছাইন (রা)-এর জন্য। এটা হতো হযরত আবু বকর (রা), তার কন্যা হযরত আয়েশা (রা), আসমা ও তার পুত্র মুহাম্মদ এবং আবদুর রহমানের জন্য। এটা হতো ওমর ফারুক (রা) এবং তার পুত্র আছেম ও আবদুল্লাহর জন্য। এটা তালহা, যুবাইর, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ, সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাছ, মাআয ইবনে জাবাল, সা’দ ইবনে মাআয, আবু আয়্যুব আনসারী, বিলাল হাবশী ও অন্যান্য বিশিষ্ট সাহাবী (রা) দের জন্য যারা তাদের প্রাণেল বিনিময়ে ইসলামের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যারা আবু জেহল, আবুল লাহাব, প্রমুখের অন্যায় অত্যাচার নীরবে সহ্য করেছিলেন, যারা ইসলামী শাসনের চারা বৃক্ষকে তাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে লালন করে বলবান বৃক্ষে পরিণত করেছিলেন।
ইয়াযিদ, মারওয়ান, আবদুল মালেক, ওয়ালিদ ও সুলায়মান ও অন্যান্য উমাইয়া খলিফাগণ মুধু পাকা শষ্য ও পাকা ফল ভোগ করেছিল। এরা না ছিল ইসলামের স্থপতি না ছিল স্থপতিদের বংশধর।
তারপর এখানে স্থপতি বা স্থপতি পুত্রদের কোন প্রশ্নই উঠে না। এখানে স্থপতিদের কোন মূল্যই ছিল না, মূল্য ছিল শ্রমিকদের। এ নতুন সংগঠন বা মক্কায় সংঘটিত হয়েছিল, যে সংগঠন আবু আবু সুফিয়ান, ও আবু লাহাবের হাতে নির্মমভাবে বাঁধাগ্রস্থ হয়েছিল। দীর্ঘ তিন বৎসর পর্যন্ত অর্থনৈতিক অবরোধ সহ্য করতে হয়েছিল, যে জামাত আত্মরক্ষা করতে মক্কা ত্যাগ করে সুদূর মদীনায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। তাঁরা এমন এক বিপ্লবের আহবান করেছিল যাতে বংশ গোত্র বা গোষ্ঠীগত আভিজাত্যের কোন স্থান ছিল না। এটা কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা কারো রক্তের পবিত্রতার প্রবক্তা ছিল না। এ দল শুধু এ জন্যই সকল দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছিল যাতে তারা এমন এক সমাজ গঠন করবে, এমন এক শাসন পদ্ধতি কায়েম করবে, যাতে মালিক শ্রমিকের, প্রভু ও গোলামের, দুর্বল ও সবলের কোন ভেদাভেদ থাকবে না। যে সমাজে কান পীড়িত বা কোন পীড়ণকারীও থাকবে না। এ দুল বুকের রক্ত পানি করে এমন এক সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার কাজে সচেষ্ট ছিল, যাতে কোন প্রকার অন্যায়-অবিচার বা উঁচু নিচুর ভেদাভেদ থাকবে না। সকলেই সমভাবে নিজ নিজ অধিকার ভোগ করার পূর্ণ সুযোগ পাবে।
তাঁরা এমনি এক সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন, যে সমাজ ব্যবস্থা বঞ্চিত, দুঃস্থ দরিদ্রদের সাহায্য সহায়তার জন্য অকাতরে অর্থ সম্পদ ব্যয় করেছিল। যে সমাজ ব্যবস্তায় আমদান ব্যয় হতো বিধবা, এতীম, নিঃস্ব মুসাফির, অভাবক্লিস্ট, আশ্রয়হীণ, ঋণগ্রস্ত দুঃখী মানুষের জন্য। কিন্তু এ সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তক মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা)কেও যিনি আল্লাহর প্রিয়নবী চিলেন, কিছু গ্রহণ করতে অনুমতি দেয়নি। তিনি তার সন্তান-সন্ততি ও প্রিয়জনের আরাম-আয়েশের জন্য এ সমাজ ব্যবস্থার আমাদানীর কিছু মাত্রও ব্যয় করেননি।
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ভালবাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইসলাম কোন বিশেষ বংশ বা গোষ্ঠীর বিত্ত-বৈভব বৃদ্ধির বা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের কল্যানের জন্য দায়ী নয়। এটা উঁচু নিচু, ভদ্র-অভদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেকটি নাগরিকের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের জন্য সমভাবে যিম্মাদার। তাঁর সামনে ইসলামের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, ইসলামের শাসন পদ্ধতির প্রবর্তক মুহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ (সা) এর আদর্শ বিরাজমান ছিল, যিনি কয়দিন আহার কনেনি, যাঁর কন্যার জন্য কোন উন্নত মানের কোন পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা ছিল না, উন্নত মানের খাদ্যের সংস্থান করেননি, যার প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত আয়েমা (রা) ক্ষুধার তাড়নায় দীর্ঘ সময় ক্রন্দ করতেন।
তাঁর সামনে খলিফাতুর রাসূল হযরত আবু বকর (রা)-এর মহান আদর্শ বিরাজমান ছিল, যিনি মুসলমানদের নির্বাচিত খলিফা হওয়া সত্ত্বেও সরকারী কোষাগার হতে শুধু মাত্র প্রাথমিক প্রয়োজনাদি পূরণ করতে সামান্য পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করতেন। তিনি খলিফা নির্বাচিত হবার পর কোষাগার হতে দুধ পান করার জন্য একটি মাটির পেয়ালা, আটা পিষার জন্য একটি যাতা, দুধের জন্য একটি উটনী এবং ব্যক্তিগত কাজ-কর্ম করার জন্য একজন খাদেম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পরিচ্ছদ ও আহার্য ছিল অত্যন্ত সাধারণ।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের সামনে ইসলামের মহান খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর মহান আদর্শ বিদ্যমান ছিল। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতার মানব ইতিহাসে যিনি এক অতুলনীয় উদাহরণ সৃষ্টি করে ছিলেন। যিনি মুসলিম সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ এবং সবচেয়ে প্রজ্ঞাশীল শাসক হিসেবে খ্যাত ছিলেন কিন্তু তিনিও শুস্ক রুটি আহার করতেন, মোটা কম্বল পরিধান করতেন, যার সমগ্র পশ্চাতে আঠারটি তালি লাগানো থাকতো। তিনিও সরকারী কোষাগার হতে কোন ভাল পোষাক বা খাদ্যের সংস্থান করেননি।
কিন্তু তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে সকল অভাবী মানুসের অভাব অনটন দূর হলো। তাঁদের সাধনার ফলে সকল মুসলমানের দুঃখ দৈন্যের অবসান ঘটল, সাধারণ সমাজের অবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হল। তাদে প্রচেষ্টায় প্রত্যেকটি মুসলমান উত্তম কাপড় পরিধান করার ও উত্তম খাদ্য আহার করার সুযোগ পেল এমনকি সদ্য প্রসূত সন্তানেরও সমস্ত অভাব পূরণ হল। তাঁরা একজন দরিদ্র হতে দরিদ্রতম মুসলমান শিশুর জন্য সে কাপড় ও খাদ্য ভাতার ব্যবস্থা করলেন যা হযরত আলী, হযরত ওসমান, হযরত আবু বকর, হযরত ওমর (রা) প্রমুখ বিশিষ্ট লোকদের সন্তানদের জন্য বরাদ্দ ছিল।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কাছেও সরকারী আমদানী হতে সেসব লোকই কিচু পাবার অধিকারী ছিল যাদেরকে আল্লাহর রাসূল (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদীন হকদার হিসেবে সাব্যস্ত করেছিলেন। এ কারণেই তিনি নিজে পুত্র সন্তান, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজনদের জন্য একটি পয়সাও করচ করতেন না। এ কারণেই তিনি আবদুল মালেক, ওয়ালিদ ও সুলায়মান কর্তৃক বরাদ্দকৃত তাঁর ফুফুর ভাতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর ফুফু ও পবিত্র কোরআন, আল্লাহর রাসূল খোলাফায়ে রাশেদীনের বিঘোষিত পদ্ধতি অনুযায়ী সরকারী ভাতা পাবার অধিাকরী ছিল না। তিনি দিন রাত মুসলমানদের জন্যই কাজ করতেন। কাজেই নীতিগতভাবে তাঁর পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে সরকারী কোষাগার গ্রহণ করতে বাধ্য ছিল।
কিন্ত ইতোপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি যে, বার্ষিক দু’ শত দীনার আমাদানীর একটি জায়গীর তিনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। আর যেহেতু এ জায়গীর তাঁর ছিল, কাজেই সরকারী কোষাগারের উপর তার নিজস্ব প্রয়োজনের চাপ প্রদান করতে তিনি কোন মতেই সঠিক মনে করেননি। একবার তার এক হিতাকাঙ্ক্ষী তার দুঃখ দুর্দশা দেখে হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর মত রাস্ট্রীয় কোষাগার হতে প্রয়োজনীয় খরচ গ্রহণ করতে তাকে পরামর্শ দিলে তিনি তাকে এ কথাই বলেছিলেন।
হযরত ওমর (রা)-এর ধারণায় রাষ্ট্রীয় কোসাগার হতে প্রয়োজনীয় করচ তিনি তখনই গ্রহণ করতে পারতেন যদি তিন সম্পদহীন হতেন এবং ওমর ফারুক (রা)-এর মত তারও কোন কিছুই না থাকত।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয়ের খাত নির্ধারিত ছিল, তা কোন প্রকার পরিবর্তন করা সম্ভব ছিল না।
তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তার শাসনকর্তাদের নামে যেসব পত্র লিখেছিলেন তাতে তিনি সরকারী অর্থ ব্যয়ের কথা স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। তার পত্রের মর্ম ছিল- অতঃপর আল্লাহর রসুল (সা) নগদ মুদ্রা, ক্ষেতের ফসল, চতুস্পদ জন্তুর উপর যাকাত ফরয করে তাদের পরিমাণ ও ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন যে সকল প্রকার সাদকা ফকীর মিসকীন সরকারী কর্মচারী এবং যাদের চিত্ত আকর্ষণ করতে হয় তাদের জন্য এবং দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত ও আল্লাহর পথে জিহাদগ এবং মুসাফিরদের জন্য ব্যয় করতে হবে।
আল্লাহর রাসূল (সা) নিজের দুশমনদের সাথে একাধিকবার যুদ্ধ করেছেন তার সৈন্য বাহিনীও অনেকবার দুশনের মুকাবিলা করেছেন। যদি তিনি নিজে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেন, তবে প্রাপ্ত সমস্ত গনিমতের মাল প্রকাশ্যে বন্টন করে দিতেন। আর তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর মনোনীত প্রতিনিধি তথা প্রধান সেনাপতিই পবিত্র দায়িত্ব পালন করতেন এবং কুরআনের এ নির্দেশকে যথাযথ বাস্তবায়িত করতেন। (আরবী***********)
“আরও জেনে রেখ যে, তোমরা যুদ্ধে কোন বস্তু সামগ্রীর মধ্য থেকে যা কিচু গনীমত হিসেবে পাবে তার এক পঞ্চমাংশ হল আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের জন্য। তার নিকটাত্মীয় স্বজনের জন্য এবং এতীম-অসহায় মুসাফিরদের জন্য যদি তোমার বিশ্বাস থাকে আল্লাহর উপর এবং সে বিষয়ের উপর যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি। কিয়ামতের দিনে যেদিন সম্মুখীন হয়ে যায় উভয় সেনাদল আর আল্লাহ সব কিছুর উপরই ক্ষমতাশীল।”
তারপর আল্লাহপাক তাঁর রাসূল মুহাম্মদ (রা) কে যে সমস্ত জনপদ ও সম্পরেদ উপর বিজয়ী করেছেন, যাতে তিনি এরপরও যে সমস্ত জনপদ বিজিত হবে তাতে একটি বিধিবদ্ধ পদ্ধতি নির্ধারিত হয়ে যায়, আর পবিত্র কুরআন সে পদ্ধতিটি এ রূপে নির্ধারিত করে দিয়েছে।
“জনপদবাসীদের কাছ থেকে তার রাসূল (সা) কে যা দিয়েছেন তা আল্লাহর রাসূলের আত্মীয় স্বজনের এতিম-মিসকিন, পথিকদের জন্যে যাতে েএটা তোমারদের ধনীদের সম্পদে পরিণত না হয়। আল্লাহর রাসূল (সা) তোমাদেরকে যা দেন তোমরা তা গ্রহণ কর এবঙ যা তিনি নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবঙ আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহপাক কঠোর শাস্তিদাতা।”
(আরবী*****************)
অর্থঃ এই ধন-সম্পদ দেশত্যাগী নিঃস্বদের জন্যে যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের কামনায় এবং আল্লাহ, তার রাসূলের সাহায্যার্থে নিজেদের বাস্তুভিটা ও ধন-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তারাই সত্যবাদী। (সূরা হাশর: ৮)
যে সমস্ত লোক মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তাঁদের উদ্দেশ্যেই এই আয়াত অবতীর্ণ। আনসারগণ তাঁদের মধ্যে শামিল ছিলেন না। তারপর এ আয়াত লিখলেন- (আরবী****************)
অর্থঃ যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসবাস করছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল তারা মুহাজিরদের ভালবাসে,মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে তজ্জন্যে তারা অন্তরে ঈর্ষা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দান করে। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত তারা সফলকাম। (সূরা হাশর: ৯)
এই আয়াতের মর্মানুযায়ী মদীনার আনসারদের অধিকার স্বীকৃত হল কারণ আল্লাহর রাসূল (সা) হিজরত করে তাদের নিকট এসেছিলেন। অতঃপর তৃতীয় আয়াত দ্বারা এই দলের পর অবশিষ্ট মুসলমানদের অধিকার সাব্যস্ত হল।
তারপর তিনি এই আয়াত উদ্ধৃত করলেন- (আরবী ******************)
অর্থঃ আর এই সম্পদ তাদের জন্যে যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানের অগ্রণী আমাদের ভ্রাতাদেরকে ক্ষমা কর।
এই আয়াত সমস্ত মুসলমানদের শামিল করেছে। আর এর অর্থ প্রথম হিজরত থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মুসলমানকে শামিল করেছে।
অপর এক চিঠিতে, যা প্রথমটির মতই ব্যাপক ছিল, হযরত ওমর (রা) এতে বিশেষ আলোকপাত করেছেন। ইবনে আবদুল হাকাম বলেন, তিনি লিখলেন-
হিজরত আমারেদ নিকট অত্যন্ত প্রশস্ত-অতএ যদি কোন আরাবী স্বীয় পশু বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে নিজেদের বাড়ী-ঘর ছেড়ে দারুল হিজরতে আগমন করে এবঙ আমাদের দুশমনদেরে বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে – তবে সে মুহাজির।সে প্রথম যুগের মুহাজিরদের মত পুরস্কার পাবে এবং তার সঙ্গে মুহাজিরদের মত আচরণ করা হবে।
মুহাজিরগণ বেতন ভাতা ছাড়াই আল্লাহর পথে সংগ্রাম করতেন। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে বিজয়ের মাধ্যমে সাফল্য দান করলেন। এ সমস্ত বিজয়ের সুফল সেসব লোকেরাও পাবে,যারা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের মত কাজ করবে এবং যারা তাদের ভাইদেরকে ভালবাসবে তাদের মঙ্গলের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করবে।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের এ সুদীর্ঘ চিঠি আমরা এ উদ্দেশ্যেই উল্লেখ করলাম, যাতে এ কথা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, তিনি সরকারী অর্থ ব্যয়ের ঐসমস্ত খাতকেই বৈধ খাত বলে মনে করতেন, যা আল্লাহর রাসুল (সা) পবিত্র কুরআনে আলোকে নির্ধারিত করেছিলেন এবং যেগুলোকে খোলাফায়ে রাশেদীন সনদ হিসেবে গ্রহণ করেছেলেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রাসূলুল্রাহ (সা)-এর যুগে সরকারী আয় বলতে যাকাত, মালে গনিমত এবং বিজিত ভূমির শস্য ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না। আর এই সমস্ত আমদানীও যেহেতু নির্ধারিত ছিলনা এ জন্যই যখন বাহির হতে কোন সম্পদ মদীনায় আসত তখন রাসূলুল্লাহ (সা) তা মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন।
তারপর যখন হযরত আবু বকর (রা) খলিফা নির্বাচিত হলেন তকন বাহির হতে কোন অর্থ মদীনায় আসলে তিনিও তা মদীনা ও পার্শ্ববর্তী লোকদের মধ্যে সমবাবে বন্টন করে দিতেন। হযরত আয়েমা সিদ্দিকা (রা) বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় বৎসর তিনি এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন।
হযরত আবু বকর (রা) এর ইন্তেকালের সময় সরকারী কোষাগারে একটি দেরহাম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দু’ বৎসরের সমস্ত আমদানী তিনি মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছিলেন।
হযরত ওমর (রা) খলিফা হওয়ার পর যখন তিনি বায়তুল মালে হিসাব করলেন, তখন তিনি মুদ্রা ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। এতে তিনি ক্রন্দ করে বলেছিলেন, যদি এ দেরহামটিও আবু বকরের দৃষ্টি পড়ত তবে এটাও তিনি বিতরণ করে দিতেন।
হযরত আবু বকর (রা) যুগে সরকারী আয় খুবিই নগণ ছিল। সমস্ত মুসলমানদের প্রয়োজন পূরণের মত সরকারী সম্পদ ছিল না। এ জন্যই তিনি ব্যয়ের খাতগুলি নির্ধারণ করেননি, বরং যকন যে খাত বেশি প্রয়োজনীয় বিবেচিত হত তাতেই ব্যয় করতেন।
হযরত ওমর (রা) জনসাধারণকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিক্ত করলেন। পবিত্র কুরআনের আলোকে তিনি মুহাজির, আনসার ও সাধারণ মুসলমানদের স্তর নির্ধারণ করলেন এবং প্রত্যেক স্তরের জনগণকে নিয়মিত ভাবে বার্ষিক ভাতা প্রদান করতে লাগলেন। হযরত ওমর (রা) ভাতার যে সমস্ত ক্রম নির্ধারণ করেছিলেন, তাতে ইসলাম গ্রহণের অগ্রগামী হওয়াকেই তিনি মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সৈনিকদের মধ্যে সাধারণ সৈনিক, বদর, ওহুদ, খন্দক ও হুদায়বিয়ায় অংশ গ্রহণকারীদের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করলেন।
এ পর্যায় ও ক্রম নির্ধারণের পরও তিনি প্রথম স্তরের জন্য এরূপ ভাতার ব্যবস্থা করেননি যাতে অন্যান্যদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে। বা তাদের মৌলিক প্রয়োজন পুরণে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
তিনি স্বাধীন, গোলাম, বালক, বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মুসলমানের নিয়মিতভাবে সরকারী কোষগার হতে তা প্রদান করার ব্যবস্থা করলেন। এছাড়াও বার্ষিক পনর দেরহাম হতে দু’শত দেরহাম বিভিধ কাজে খরচের জন্য প্রদান করা হল।
ঐতিহাসিক ইবনে উবাইদ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তার একান্ত ইচ্ছা ছিল যে, প্রত্যেকটি মুসলমানের জন্য তিনি বার্ষিক দু’হাজার দেরহাম ভাতার ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু তার এ বাসনা পূর্ণ হবার পূর্বেই ইন্তেকাল করলেন। এর বাস্তবায়নের জন্য আর সুযোগ পেলেন না।
হযরত ওমর (রা) কর্তৃক রাষ্ট্রের আমদানীকৃত অর্থ নির্ধারিত ব্যয়ের খাতগুলি হযরত আলী (রা) এর যুগ পর্যন্ত চালু ছিল।
হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর উত্তরাধিকারীদের যুগে এ পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটল। আমদানীর ব্যয়খাতগুলি সম্পূর্ণরূপেই ভিন্ন হয়ে গেল। অতঃপর হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজও সে সমস্ত ব্যয়খাতগুলি নির্ধারণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, তার মতে হযরত ওমর (রা)-এর নীতিই সুষ্ঠ ইসলামী নীতি বলে পরিগণিত ছিল। তাঁর মতে হযরত ওমর ফারুক (রা) ন্যায়পরায়ণ খলিফা ছিলেন। তিনিও তাঁর অনুসৃত নীতি সমূহই অনূসর করতে চেষ্টা করলেন। বেতন ভাতা নির্ধারণ সম্পর্কে তিনি রাজ্যের গভর্ণরদের নিকট লিখিত তাঁর এক পত্রে এ পদ্ধতির উল্লেখ করে লিখেছিলেন-
হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) বিজিত সম্পদ সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত তিনি সমস্ত মুসলমানদের জন্য বেতন বাতা নির্ধারণ কলেন যা প্রতি বছর তারা পেতে থাকে। সুতলাং এ ন্যায়পরায়ণ খলিফার অনুসরণ করা তোমাদের কর্তব্য।
ইবনে আবদুল হাকাম ইবনে সাদ বলেন যে, হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ নিজেও এ ন্যায়পরায়ণ খলিফার অনুসরণ অপরিহার্য্য মনে করতেন। তিনিও হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর মত রাজ্য ভান্ডার হতে জনসাধারণকে বেতন ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন, তবে তার যুগে রাষ্ট্রে আমদান যেহেতু হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর যুগের তুলনায় খুবই কম হ্রাস পেয়েছিল এবং লোকও সে পর্যায়ে ছিল না। কাজেই তিনি বেতন ভাতার ক্রম বিভক্তি বাতিল করে এক সাধারণ পদ্ধতি গ্রহণ করলেন, আর হযরত ওমর ফারুক (রা) এই পদ্ধতি অবলম্বন করতেই চেয়েছিলেন। অবশ্য বিশিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্যতিনি বিশে ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন।
ইবনে জাওযি ও ইবনে আবদুল হাকামের বর্ণনা মতে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার কর্মচারীদের একশত হতে তিনশত দীনার বার্ষিক বেতন ভাতা নির্ধারণ করেছিলেন।
কর্মচারী ব্যতীত সাধারণ লোকদের জন্য তিনি এক রকম বেতান ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে ইবনে সাদের নিম্ন লিখিত ভাষ্যটি প্রণিধানযোগ্য-
ওসমান ইবনে হানী বলেন, আমি হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজকে দুই স্থানে বেতন প্রদান করতে দেখেছি। তিনি সমস্ত লেককেই একই রকম বেতন দিতেন।
মুহাম্মদ ইবনে হেলাল বলেন যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ব্যবসায়ী ছাড়া অন্যান্য সমস্ত লোকদের ভাতা নির্ধারণ করে দিতে আবুবকর ইবনে হাজামকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
অন্য একটি বর্ণনায় ব্যবসায়ীদের ভাতা বরাদ্দ না করার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। রবিয়া ইবনে আতা বরেন, একবার আমি বিশিষ্ট পন্ডিত ও আলেম সুলাইমান ইবনে ইয়াসারের নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। তার সামনে আবু বকর ইবনে হাজামের নিকট হযর ওমর ইবনে আবদুল আজিজের চিঠির কথা আলোচিত হল যাতে তিনি ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ না করতে নিয়ে দিয়েছিলেন। তখন সুলায়মান ইবনে ইয়াসার বললেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের চিন্তাধারা খুবই যথার্থ। কারণ ব্যবসায়ীগণ মুসলমান জনসাধারণের কল্যাণ চিন্তা ব্যতীতই নিজ নিজ ব্যবসা বাণিজ্য নিয়োজিত থাকা।
অপর এক বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সর্বোচ্চ ভাতা নির্ধারণ করেছিলেন দু’হাজার দীনার।
অন্য একটি বর্ণনায় সরকরী কোষাগার হতে মদীনাবাসীদের ভাতার কথা বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ২৮ মাস ২৫ দিনে মদীনাবাসীদের জন্য তিনটি ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের খেলাফরেত যুগও এ সামান্য সময়ই ছিল। এই বৎসরের ভাতা জনসাধারণের প্রাপ্য ছিল এবং তিনি অসুস্থ অবস্থায় তৃতীয় ভাতা প্রদানের নির্দেশ এ জন্যই দিয়েছিলেন যাতে জনসাধারণের কোন প্রকার অসুবিধা না হয়।
শুধু মদীনাবাসীই তাঁর এরূপ দয়ার দানে ধন্য হয়নি, বরং প্রতিটি মুসলমানই তাঁর দান লাভে ধন্য হয়েছিল। তালহা ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আমার মাধ্যমে আমার বংশের লোকদেরকে তিনটি ভাতা প্রদান করলেন অথচ সাধারণ লোকেরা দু’টি বাতা পেয়েছিল।
অপর একটি বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রাজ্যের মুসলমানদের জন্য ভাতা নির্ধারণ করে ঘোষণা করে দিলেন যে, যাদের জন্য বাতা বরাদ্দ করা হয়নি, তারা যেন তাকে সে বিষয়ে জ্ঞাত করেন, যাতে তিনি তাদের ভাতা বরাদ্দ করে দিতে পারেন।
মুহাম্মদ ইবনে ওমর বলেন- আমার চাচা আমাকে বলেছেন যে, আমি ৯৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার বয়স যখন তিন বৎসর তকন ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খলিফা নির্বাচিত হলেন এবং আমিও সাধারণ ভাতা হিসেবে তিন শত দীনার পেতে লাগলাম।
নগদ ভাতা ছাড়াও হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সমস্ত লোককেই শস্য প্রদান করতেন এবং সকলকেই খাদ্য শস্য প্রদানের সাম্যের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। প্রত্যেককেই প্রায় ১০ (দশ) মন খাদ্য প্রদান করা হত।
সাধারণ মানুষের ভাতা আদায়ে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতেন। এমন কি কয়েদীদের বাতা নিয়মিত আদায় করার ব্যবস্তা ছিল।
ইবনে হাজাম বলেন, আমরা কয়েদীদের রেজিস্টার বের করতে পারে। তিনি আরও বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আমাকে লিখলেন যে, ভাতা প্রাপ্তদের কেহ যদি উপস্থিত না থাকে বা আশপাশে কোথাও গিয়ে থাকে তবে তার ভাতার অর্থ কোষাধ্যক্ষের নিকট রেখে দিও যাতে সে এসে গ্রহণ করতে কোন অসুবিদায় না পড়ে, আর যদি কেউ দূরে চলে গিয়ে থাকে তবে তার ফিরে আসা পর্যন্ত তার ভাতা বন্ধ রাখ। যে দিন সে আসবে বা তার মৃত্যুর সংবাদ পাবে অথবা তার কোন প্রতিনিধি তার জীবিত থাকার প্রমাণ নিয়ে উপস্থিত হবে তকন তাকে তা দিয়ে দিবে।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ প্রথম বছর হতেই চৌদ্দ বৎসরের বয়স্ক বালক-বালিকাদের জন্য বাতা বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য তাদের ভাতা সৈনিকদের ভাতার চেয়ে কম ছিল। তিনি শুধু পনের বছর বয়সের কম বয়সের সৈনিককেও সৈনিক ভাতা দিতেন না। এ ব্যাপারে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ একটি ফরমান জারী করেছিলেন যে, পনের বছর বয়সের কম সৈনিকদের সাধারণ ফরমান জারী করেছিলেন যে, পনের বছর বয়সের কম সৈন্যদেরকে সাধারণভাতা প্রদান করা হবে না। মুধু পনের বৎসর বয়স্কদের জন্য সৈনিক ভাতা প্রদান করা হবে।
সামরিক বাহিনীর বেতনও বিবিন্ন পর্যায় ছিল। পদস্থ ও দক্ষ সৈনিকদের বেতন ছিল বার্ষিক তিন শত দীনার। এ সম্পর্কে তাঁর সুনির্দিষ্ট আদেশ ছিল। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, যখন সৈনিকদর একশত দীনার বেতন দাও, তখন লক্ষ্য করে দেখবে তার ঘোড়া আরবী কিনা, তাঁর বর্ম, তরবারী, তীর ধনুক ও বর্শা সহ প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা।
যে সমস্ত সৈনিক ডাক বা এ জাতীয় কোন কাজে নিযুক্ত থাকত তাদের সৈনেকদের ভাতা প্রদান করা হত। সকল শ্রেণীর বেতন ভাতা আদায় করার জন্য তিনি খুব চিন্তিত থাকতেন। বছরের শুরুতেই কোষাগারের দরজা খুলে দিতেন।
ইবনে সাদ বর্ণনা করেন, ইরাকের শাসনকরতা আবদুল হামিতের গোলাম বলেছে যে, আবদুল হমিদ সর্বপ্রথম ওমর ইবনে আবদুল আজিজের যে পত্র পেলেন, তাতে লিকা ছিল শয়তানের ধোকা এবং বাদশার জুলুমের পর মানুষের জীবনের কোন মূল্যই থাকে না। আমার এ পত্র পাওয়া মাত্রই তুমি প্রত্যেক হকদারের হক আদয় করে দিবে।
আবু বকর ইবনে মরিয়াম, হযত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আরব, অনারব, স্বাধীন, গোলাম নির্বিশেষে সকল মুসলমানের খাদ্য, পোষাক এবং বেতন সমান সমান করে দিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি মুক্তিপ্রাপ্ত গোলামের ভাতা নির্দারণ করেছিলেন পঁচিশ দীনার।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এ ব্যাপারে একটি অদ্ভূত কাণ্ডও করেছিলেন। তিনি মদীনার হাসেম বংশীয়কে রাসূলুল্লাহ (সা) –এর আত্মীয়তার মর্যাদার দান করে বার্ষিক দশ হাজার দীনার ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন- (আরবী*******************)
একদিন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন যে, বায়তুল মাল হতে চার অথবা পাঁচ হাজার দীনার নাও এবং আবু বকর ইবনে হাজামের নিকট গিয়ে তাকে বলবে, সে যেন এতে আরও পাঁচ কি ছয় হাজার মিলিয়ে দশ হাজার করে নেয় এবং এটা হাসেম বংশীয়দের নিকট বিতরণ করে দেয়। তাকে এটাও বলবে যে, স্ত্রী পুরুষ, বালক-বৃদ্ধ সকলকেই যেন সমান সমান অংশ দেয় কোন পার্থক্য যেন না করে।
ভাষ্যকার বলেন, আবু বকর ইবনে হাজাম এরূপই করলেন, ফলে যায়েদ ইবনে হাছান অসন্তুষ্ট হয়ে খলিফা সম্পর্কে দুই চার কথা ভালমন্দ বলে ফেললেন এবং অীভযোগ করলেন, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আমাদেরকে ছেলেদের সাথে মিলিত করে দিয়েছে। আবু বকর ইবনে হাজম তাকে বললেন, খলিফা আপনার প্রতি ভাল মনোভাব পোষণ করেন। তিন যদি আপনার এসব কথা শুনেন তবে নিশ্চয় অসন্তুষ্ট হবেন। যায়েদ তার নিকট বললেন, খলিফাকে অবশ্যই এটা অবহিতকরতে হবে। আবু বকর ইবনে হাজাম খলিফার নিকট তার লিখিত এক পত্রে এ কথাও উল্লেখ করলেন।
বর্ণনাকারী বলেন, আমি খলিফাকে বললাম, যায়দ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরম আত্মীয়। কাজেই খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যায়েদের কথায় মোটেই অসন্তুষ্ট হলেন না।
হযরত হুসাইন (রা) এর কন্যা ফাতেমা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে এক পত্র লিখে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন যে, তিনি একটি ভাল কাজই করেছেন। যার কোন খাদেম ছিল না, তিনি তাকে খাদেম প্রদান করেছেন, যার পরিধানের কাপড় ছিল না তাকে কাপড় প্রদান করেছেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ফাতেমার এই পত্র পেয়ে খুব খুশি হলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ একটি বিরাট কর্তব্য পালন করেছিলেন। দীর্ঘ ষাট বছর যাবৎ বায়তুলমালের আমদানীকৃত অর্থ হতে যাদেরকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল তিনি তাদেরকে সেই অধিকার ফিরিয়ে দিলেন। এটা তার একটি দায়িত্বও ছিল। ফাতেমার এ পত্র খলিফাকে খুবই খূশী করল। যেহেতু এটা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নাতনীর পবিত্র পত্র, এটা হযরত আলীর (রা) দৌহিত্রীর লিখিত পত্র, এটা শহীদে কারবালা হযরত হসাইন (রা)-এর প্রাণ প্রিয় কন্যার পত্র। তিনি এ পত্র চোখে মুখে লাগালেন এবং পত্র বাহককে পাঁচশত দীনার পুরস্কারসহ হযরত ফাতেমাকে ধন্যবাদ জানাতে মদীনায় পাঠালেন ও তার জন্য দোয়া করতে বললেন।
বর্ণনাকারী বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার চিঠির জবাবে যে উত্তর লিখেছিলেন তাতে তিনি তাঁর মর্যাদা এবং আল্লাহপাক তাদের যে সমস্ত অধিকার প্রদান করেছেন তাও স্বীকার করেছিলেন।
ফাতেমা ব্যতীত অন্যান্য হাশেম বংশীয়গণও হযরও ওমর ইবনে আবদুল আজিজের এই কর্তব্যপরায়ণতার জন্য তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
ইবনে সাদ বলেন, একদিন বনি হাশিমের কিছু লোক সমবেত হয়ে একটি পত্র লিখলেন এবং একজন বাহক মারফত তা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আত্মীয়তার মর্যাদা দান করে যা করেছেন তাতে তাঁরা তাকে ধন্যাদ প্রদান করলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ উক্ত পত্রের উত্তরে তাদেরকে লিকলেন যে, পূর্ব হতেই আমার এরূপ অভিপ্রায় ছিল এবং আমি ওয়ালিদ ও সুলায়মান উভয়কেই এই পরামর্শ দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা আমার কথা বুঝতেও পারেনি। এখন যেহেুত আমিই দায়িত্ব বোঝা গ্রহণ করেছি কাজেই আমার পূর্ব ইচ্ছাকে বাস্তাবায়িত করে যাচ্ছি।
অপর এক বর্ণনাকরী বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সর্বপ্রথম যে সমস্ত অর্থেই বিতরণ করলেন যা তিনি সিরিয়া হতে মদীনায় প্রেরণ করেছিলেন। তা হতে স্ত্রী-পুরুষ, বালক বৃদ্ধ নির্বিশেসে সকলেই সমান অংশ পেয়েছিল।
অতঃপর আহলে বাইতের একজন বললেন যে, আমরা আহলে বাইতের সদস্যগণ প্রত্যেকেই তিন হাজার দীনার ভাতা পেযেছি তদুপরি তিনি লিখেছেন যে, আমি জীবিত থাকলে আপনাদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করব।
পবিত্র কুরআনে বায়তুল মালের সম্পদ ব্যয়ের যে সমস্ত খাতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সে সমস্ত খাতেই বায়তুল মালের অর্থ ব্যয় করতেন। এমন কি তিনি ঋণগ্রস্ত লোকের ঋণও পরিশোধ করে দিয়েছিলেন।
ইবনে সাদ বলেন যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এক ঋণগ্রস্ত লোকের পঁচাত্তর দীনার ঋণ পরিশোধ করলেন। আর এটা ঋণগ্রস্তদের জন্য নির্ধারিত অংশ হতেই প্রদান করেছিলেন।
একবার আছেম, কাতাদা ও বশির ইবনে মুহাম্মদ হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট এসে হানাজেরায় তাঁর সাথে সাক্ষত করলেন এবং তার নিকট তাদের উভয়ের ঋণের কথা ব্যক্ত করলেন। তিনি তাদের প্রত্যেকের পক্ষ হতে চার শত দীনার ঋণ আদায় করে দিলেন। এ সম্পর্কে তিনি যে পত্র লিখেছিলেন তাতে কালব বংশের সাদকা হতে এই অর্থ প্রদান করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটা দীর্ঘদিন যাবৎ বায়তুলমালে জমা পড়েছিল।
অপর এক বর্ণনাকারী বলেন, একবার কাশেস ইবনে মুখাইমা তাঁর নিকট এসে তার ঋণ পরিশোধ করে দেওয়ার আবেদন করল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ঋণের পরিমাণ কত? সে বলল, ৯০ দীনার। তিনি বললেন ঠিক আছে, এটা ঋণ গ্রস্তদের অংশ হতেই আদায় তরে দেওয়া হবে।
ইবনে আবি হাইচামা বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খলিফা থাকা অবস্থায় আমার আড়াই শত দীনার ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছিলেন।
মূল কথা, পবিত্র কুরআন ও আল্লাহর রাসূল (সা) যে সমস্ত খাতে বায়তুল মালের অর্থ ব্যয় করতে নির্দেশ দিয়েছেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যতদিন মুসলিম রাষ্ট্রের খলিফা ছিলেন, ততদিন তিনি সে সমস্ত খাতেই বায়তুল মালের অর্থ ব্যয় করেছিলেন। তিনি হকদারদের হক আদায় করতে এবং রাষ্ট্রের সমস্ত হকদারদেরকে বায়তুল মাল হতে নির্ধারিত অংশ প্রদান করতে সবসময় ব্যস্ত থাকতেন এবং এ চিন্তায় কোন কোন সময় ক্রন্দনও করতেন।
তার স্ত্রী ফাতেমা বলেন, আমি কখনও কখনও তাঁর নিকট এস বলতাম, হে আমিরুল মুমিনীন, আপনার উপর কি আমার কোন অধিকার নেই? পূর্বে যা কিছু ছিল তাও কি এখন শেষ হয়ে গিয়েছে? তিনি বলতেন আমাকে আমার কাজে ছেড়ে তুমি তোমার মত থাক। আমি বলতাম, আমাকে কিছু বলেন। তখন তিনি বলতেন, আমি এ রাষ্ট্রের ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি নাগরিকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। তাদের ক্ষুধার্ত, নিঃস্ব, অসহায়, মুসাফির, অপরারগ, বন্দী, সামান্য পুজির মালিক, বহু সন্তানের দরিদ্র পিতা যারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে শহরে বন্দরে বসবাস করছে, তাদের কথা স্মরণ হয়। আমি জানি িএ সম্পর্কে আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, আল্লাহর রাসূলও জিজ্ঞাসার করবেন। আমার ভয় হয়, যদি আল্লাহ আমার ওযর আপত্তি গ্রহণ না করেন, আল্লাহ পাক আমর কোন দলীল না মানেন, তখন আমি কি উপায় হবে?
ইবনে আবদুল হাকাম বর্ণনা করেন- (আরবী************************)
একবার ইরারেক এক মহিলা হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজের সাথে দেখার করার জন্য তাঁর গৃহে আগমন করল। এ মহিলা ফাতেমার নিকট গিয়ে উপস্থিত হল, তখন ফাতেমা গৃহে বসে সেলাইয়ের কাজ করছিলেন, সে মহিলা তাঁকে সালাম করলে তিনি সালামের জওয়াব দিয়ে তাকে ঘরে এসে বসতে বললেন যে, ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। এতে সে বলল, আমি এসেছি কি, এ খালি ঘরের ওসিলায় আমার ঘর পূর্ণ করতে? ফাতেমা জওয়াব দিলেন, তোমার মত লোকদের ঘর ঠিক করতে গিয়ে এ ঘর বিরান হয়েছে।
তারপর হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ ঘরে প্রবেশ করলেন এবং ঘরের কাছেই একটি কূপ ছিল, তা হতে পানি উঠিয়ে প্রাঙ্গনস্থিত মাটিকে ঢাললেন। এ সময় তিনি বারবার ফাতেমাকে দেখছিলেন। সেই মহিা ফাতেমাকে বলল, আপনি এই এই বেগানা লোকটি হতে কেন পর্দা করেন না? এ লোকটি বার বার আপনাকে দেখছে। ফাতেমা বললেন, ইনিই আমিরুল মুমিনীন। তারপর হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ সামনে অগ্রসর হয়ে সালাম করলেন এবং তার কক্ষে প্রবেশ করলেন। তারপর জায়নামাযের দিকে যেতে যেতে মহিলার কথা জিজ্ঞেস করলেন। ফাতেমা তার আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলে, হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ আঙ্গুরে ঝুড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে কয়েকটি ভাল আঙ্গুর সেই মহিলাকে দিলেন এবং তার অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। সে নিবেদন করল যে, আমি ইরাক হতে আগমন করেছি। আমার পাঁচটি কুমারী বালিকা আছে, আমি খুবই অভাগ্রস্থ। এটা শুনে তিনি কাঁদতে লাগলেন। তারপর দোয়াত কলম নিয়ে ইরাকের শাসনকর্তাকে এক আদেশনামা লিখলেন এবং সে মহিলাকে বললেন, তোমার বড় মেয়ের নাম বল, সে বড় মেয়ের নাম বললে তিনি তার ভাতা ধার্য্য করলেন। মহিলা এতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তারপর দ্বিতীয়,তৃতীয় ও চতুর্থ বালিকার নাম জিজ্ঞেস করে তাদেরও ভাতা নির্ধারণ কররেন। মহিলা অত্যন্ত খুশী হয়ে তাঁর জন্য দোয়া করল। পঞ্চম বালিকার জন্য তিনি কোন ভাতা বরাদ্দ না করে বললেণ, এ চার জনের ভাতা দ্বারাই তারও খরচ বহন করতে পারবে।
সে মহিলা আদেশনামা নিয়ে ইরাকে প্রত্যাবর্তন করল এবং যখন ইরাকের শাসনকর্তাকে সে আদেশ নামা দিল তখন তিনি খুব কাঁদতে লাগলেন এবং আদেশনামা লেখকের জন দোয়া করতে লাগলেন। মহিলা জিজ্ঞেস করল, তিনি কি ইন্তেকাল করেছন? গভর্ণর বললেন, হ্যাঁ, এটা শুনে মহিলাও চিৎকার করে উঠল। গভর্ণনা তাকে শন্ত্বনা দিলে বললেণ, তোমার আশংকার কোন কারণ নেই। আমি কখনও এই মহামানবের চিঠির অমর্যাদা করব না। অতঃপর তিনি তার কন্যাদের ভাত নির্ধারণ করে তার সকল অভাব দূর করে দিলেন। কিন্তু তাদের এ ভাতার পরিমান কত ছিল, এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি। তবে এক বর্ণনায় জানা যায় যে, তিনি বনু উমাইয়াদের প্রত্যেকের জন্য দশ দীনার ভাতা দিয়েছিলেন। আর এটা ছিল সবচেয়ে কম ভাতা।
বর্ণনাকারীর ভাষ্যটি হলো, একবার আম্বা ইবনে সায়ীদ হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ-এর নিকট হতে বের হচ্ছিলেন, তখন বনু উমাইয়ার লোকেরা তাঁর দরজায় উপবিষ্ট ছিল। তাদের মধ্যে ইয়াযিদ ইবনে আবদুল মালেকও ছিলেন। তিনি ওমর ইবনে আবদুর আজিজের পরবর্তী খলিফঅ হিসেবে মনোনীত ছিলেন। লোকেরা আমার কাছে অভিযোগ করে বলল, হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ আমাদের দশ দীনার ভাতা দিয়েছেন। আমরা তার অসন্তুষ্টির ভয়ে ফিরিয়ে দেইনি। ইয়াযিদ বললেন তাবে বল যে, আমি এ দশ দীনার ভাতা গ্রহণ করব না। তিনি কি আমাকে তার পরবর্তী খলিফা মনে করেন না? আম্বা খলিফার কাছে ফিরে এসে বললেন, আপনার পিতার বংশধরেরা আপনার দরজায় উপবিষ্ট। দশ দীনার করে ভাতা দেওয়াতে তারা আপনার প্রতি অন্তুষ্ট। ইয়াযিদ বলেন যে, আপনি কি মনে করেন? তিনি আপনার পরবর্তী খলিফঅ নন? হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ আম্বাকে বললেন, তাদেরকে আমার সালাম দিয়ে বল যে, আমি গতরাত্রে সারারাত্র জেগে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছি এবং আল্লাহর নিকট ওয়াদা করেছি, যাতে সমস্ত মুসলমানগণ কে বাদ দিয়ে তাদের কিছু না দেই। আল্লাহর কসম! আমি সমস্ত মুসলমানদেরকে বাদ দিয়ে তাদেরকে একটি দেরহামও অতিরিক্ত প্রদান করব না, যদি দেই তবে তখনই দিব যখন সকলেই এই পরিমাণ পাবে।
এ ভাষ্য দ্বারা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়ে যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ বনু উমাইয়ার লোকদের দশ দীনার ভাতা দিয়েছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝা যায় যে, এ পরিমাণ তিনি প্রত্যেক মুসলমানকেই প্রদান করতেন।
আমরা সঠিক বলতে পারি না যে, তিনি কি তাদেরকে মাসিক দশ দীনার দিতেন, না এটা তাদের জন্য বিশেষ অনুদান ছিল। এ দশ দীনার দিয়ে তিনি তার আত্মীয়দেরকে তার অর্থনৈতিক পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। কারণ ইবনে আবদুল হাজমের অপর এক বর্ণনায় স্পষ্টই বুঝা যায় যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ বায়তুল মালের কোন অর্থ হকদার ব্যতীত অন্য কাকেও বা কোন আমির-উমরাকেও প্রদান করতেন না।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন, একবার আম্বা হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজের নিকট অর্থ চেয়েছিল। তিনি তাকে বললেন, তোমার কাছে মাল আছে যদি তা হালাল হয়, তবে তাই তোমার জন্য যথেষ্ট, আর যদি হয় তবে সেটা বৃদ্ধি করো না। আমাকে বল, তুমি কি দরিদ্র? সে বলল না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ঋণগ্রস্থ? সে বলল না। হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ বললেন, তবে আমার কাছে আল্লাহর দেয়া আমানত হতে বিনা প্রয়োজনে তোমাকে কিছু দিতে তুমি কেন আমাকে পরামর্শ দাও? যদি তুমি অভাবী হতে তবে তোমার প্রয়োজন মিটাতে পারে সে পরিমাণ অর্থ আমি তোমাকে দিতাম। তুমি যদি ঋণগ্রস্ত হতে তবে আমি তোমার ঋণ পরিশোধ করার ব্যবস্থ করে দিতাম। তোমার নিকট যে সম্পদ আছে তাই খাও এবং আল্লাহকে ভয় কর।
এ সমস্ত হকদার ছাড়াও হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ বায়তুল মাল হতে ঐ সময় লোকদেরকে একশত হতে তিনশত দীনার পর্যন্ত ভাতা প্রদান করতেন- যারা জুলুম প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে বাদী হতেন অথবা তাঁর নিকট আবেদন পেশ করার জন্য দূর হতে সফর করে আগমন করত।
ইবনে হাকাম বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ তার অধীনস্ত কর্মচারীগণকে নির্দেশ দিলেন যে যে ব্যক্তি কোন জুলুম প্রতিরোধ করতে অথবা ধর্মীয় সংস্কারমূলক কোন কাজ করার জন্যে আমাদের কাছে আগমন করবে তা কোন ব্যক্তিগত ব্যাপারেই হোক বা সামাজিক ব্যাপারই হোক তাকে একশত হতে তিনশত দীনার প্রদান করবে। হয়ত আল্লাহ তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেবেন, আর না হয় তার মাধ্যমে কোন বাতিল শক্তি ধ্বংস করে দিবেন বা তার দ্বারা কোন মঙ্গল সাধিত হবে।
হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ বায়তুলমাল হতে কুমারী মেয়েদের বিবাহ এবং যিম্মি সংস্কার উন্নয়নের জন্য অর্থ সাহায্য করতেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ কুফার শাসনকর্তা যায়িদ ইবনে আবদুর রহমানকে তাঁর এক পত্রের উত্তরে লিখলেন, তুমি লিখেছ যে সৈন্য বাহিনীর বেতন ভাতা প্রদান করার পরও তোমার কাছে অর্থ উদ্ধৃত রয়েছে। তবে তুমি অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে এখন ঋনগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করে দাও। যারা কোন অসৎ উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করেনি এবং যে সমস্ত লোক অর্থাভাবে বিবাহ করতে পারেনি তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করে দাও। যায়েদ তাঁর নির্দেশ যথাযথ কার্যকরী করার পরও তার নিকট অর্থ থেকে গেল। তিনি পুনরায় লিখলেন হযরত ওমর ইবনে আবদুর আজিজ নির্দেশ দিলেন যে, এ অতিরিক্ত সম্পদ তুমি অমুসলিম কৃষকদের ও অন্যান্যদে অবস্থার উন্নয়নের জন্য বিতরণ কর যেহেতু তাদের সাথে তোমার সম্পর্ক দু’ এক বছরের জন্য নয়।
ঐতিহাসিক ইবনে আসাকের এ ঘটনা বর্ণনা করে সে নির্দেশনামর শেষ বাক্যটি উল্লেখ করেছেন তা এই- (আরবী***********)
অর্থাৎ যে সমস্ত লোক জিযিয়া কর প্রদান করে এবং এর ফলে তার ক্ষেত বা অন্য কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাকে তার অবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান কর। যাতে সে ভালরূপে কৃষিকাজ করতেপারে। কারণ আমাদের সাথে তাদের সম্পর্ক এক বা দু’ বছরের নয়।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ গরীব মুাসাফিরদের সফরের খরচও বায়তুল মাল হতে বহন করতেন, কারণ পবিত্র কোরআন ইবনুস সাবীল দ্বারা মুসাফিগণকে সাদকার অধিকারী করেছে। মুসাফিরদে আরাম আয়েসের জন্য তিনি তার রাষ্ট্রে বিভিন্ন সরাই খানা নির্মাণ করেছিলেন এবং কর্মচারীগণকে নির্ধেশ দিয়েছিলেন যে, এ সমস্ত সরাইখানায় যে সমস্ত মুসাফির অবস্থান করবে সরকারী মেহমান খানা হতে তাদেরকে একদিন ও এক রাতের খাদ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করবে এবং অসুস্থ মুসাফিরদের দুদিন দু রাতের খোরাকীর ব্যবস্থা করবে। যে সমস্ত মুসাফির দেশে ফিরে যেদে চায় অথচ রাস্তা খরচের খভাবেদেশে যেতে পারে না। তাদের দেশে ফিরে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্যের ব্যব্থা করে দিবে।
মূল কথা হলো, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খলিফা হবার পর জনসাধারণের মধ্যে এমন কোন দরিদ্র-অভাবী হকদার ছিল না, বায়তুলমাল যার ব্যয়ভারের দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। এ কারণেই তার মাত্র দু’ বছরে সংক্ষিপ্ত শাসনামলে সমগ্র জনসাধারণ সুখী ও সমৃদ্ধিশালী হয়ে গিয়েছিল- কোথাও কোন দরিদ্র ও অভাবী লোক ছিল না।
এ সম্পর্কে ইবনে আবদুল হাকাম যায়েদ ইবনে খাত্তাবের একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মাত্র আড়াই বছর মুসলিম সাম্রাজের্যর খলিফা ছিলেন। এ সামান্য সময়ের মধ্যে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এ দাঁড়াল যে, কোন কোন লোক বিপুল ধন-সম্পদ নিয়ে আমাদের কাছে এসে বলত, আমার এই সম্পদ গ্রহণ করুন এবং আপনাদের ইচ্ছা অনুযায়ী গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে দনি। তখন তার এ ধর-দৌলত ফিরিয়ে দিয়ে বলা হত যে, আমাদের জানামতে এমন গরীব লোক নেই যাকে এই ধন-সম্পদ দেয়া যেতে পারে। কারণ হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের প্রচেষ্টায় সমস্ত মানুষ সুখী ও সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল।
এটা কোন বাহুল্য কথা নয়। রাষ্ট্রে সকল অভাবী ও দরিদ্র হকদারদের জন্য ওমর ইবনে আবদুল আজিজ প্রয়োজনীয় ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। কাজেই দরিদ্র ও অভাবের কোন প্রশ্নই ছিল না। এ সস্ত দোষ শুধু সে সব স্থানেই প্রকাশ পায়, যেখানকার শাসকগণ স্বার্থপর ও লোভী, যেখানকার শাসকগণ বায়তুলমালের অর্থ নিজেরা আত্মসাত করে এবং যেখানে সাধারণভাবে মানুষেল উপর জোর-জুলুম করা হয়।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জোর জুলম-অত্যাচার ও নির্যাতনের সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কাজেই এ পতিক্রিয়া প্রকাশ পাবার সুযোগই ছিল না। তিনি বায়তুলমালকে বৈধখাত ব্যতীত খরচ করতেন না।