হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর পিতার ইন্তেকাল
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) শিক্ষা-দীক্ষা সমাপ্ত করে মদীনা থেকে দামেশকে গেলেন, তারপর সেখান থেকে পিতার নিকট মিশরে চলে গেলেন এবং তাঁর পিতার ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি পিতার নিক অবস্থান করেছিলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) যখন তাঁর পিতা আবদুল আজীজের নিকট থাকতেন তখন তাঁর পিতাকে তাঁকে কোন কাজে নিযুক্ত করেছিলেন কিনা, তাঁকে প্রশাসণিক কোন দায়িত্ব দিয়েছিলেন কিনা এবং তিনি তাঁর পিতার নিকট কত দিনই অবস্থঅন করেছিলেন তা জানা সক্ষম হয়নি।
মনে হয়, তিনি সামান্য কিছুদিন পিতার সাথে অবস্থান করেছিলেন। যখন তিনি পিতার নিকট আসলেন তখন তাঁর পিতা ও চাচা আবদুল মালেকের মধ্যে যুবরজ নিযুক্তির ব্যাপারে মন-কষাকষি চলছিল।
আবদুল মালেকের ইচ্ছা ছিল যে, আবদুল আজীজ-এর পুত্র ওমর ওয়ালিদের স্বপক্ষে খেলাফতের দাবী পরিত্যাগ করুক। কিন্তু আবদুল আজীজ এতে সম্মত ছিলেন না।
ইবনে কাছীর বরেন, আবদুল মালেক প্রথম প্রথম ইশারা-ইঙ্গিত তার উদ্দেশ্য প্রকাশ করতেন। তারপর তিনি মনোভাব স্পষ্ট উল্লেখ করেই একটি পত্র লিখলেন। আবদুল আজীজ খুব সংক্ষিপ্ত অথচ খুব পরিষ্কার ভাষায় পত্রের উত্তর দিলেন যে, আপনি ওয়ালিদ সম্পর্কে যে আশা পোষণ করেন, আমি ওমর ইবনে আবদুল আজীজ সম্পর্কেও সেই আশা পোষণ করি।
এতে আবদুল মালেক তার প্রতি অসন্তুষ্ট হযে তাঁকে লিখলেন যে, মিশরের সমস্ত রাজস্ব দগামেশকে পাঠানো হোক। আবদুল আজীজ যখন থেকে মিশরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন তখন থেকেই তিনি একজন স্বাধীন শাসনকর্তা হিসেবে দেশ শাসন করছিলেন। দীর্ঘ বিশ বছর পর্যন্ত তিনি মিশরে আমদানীর একটি পয়সাও দামেশকে পাঠাননি। তার কোন হিসাবও দেননি। তদুপিরি মিশর ও পশ্চি ও পশ্চিম আফ্রিকার সমস্ত প্রশাসকগণ সরাসরি আবদুল আজীজের অধীনস্থ ছিল। সমস্ত আমদানীর অর্থ তার নিকট জমা হত, তিনি তাঁর ইচ্ছামত তা ব্যয় করতেন অথবা সরকারী কোষাগারে জমা রাখতেন। আবদুল মালেক অস্বাভাবিক রূপেই এ নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। আবদুল আজীজ অত্যন্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তিক্ততা বৃদ্ধি করতে রাজি হননি। কাজেই তিনি এর একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন। পত্রের বিষয়বস্তু ছিল এই -+
হে আমীরুল মুমিনীন! আমি ও আপনি জীবনের এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যে, আমাদের বংশের খযুব কম লোকই এর পর জীবিতত আছে। আমি জানি না, আপনি ও জানেন না, আমাদের কে প্রথম মৃত্যু বরণ করবে! যদি আপনি ভাল মনে করেন তবে আমার বাকী জীবনের এ সামান্য সময় আমাকে আর তিরষ্কার করবেন না।
ইবনে কাছীর বলেন যে. এ সংক্ষিপ্ত চিঠি আবদুল মালেকের অন্তরে ভীষণ রেখাপাত করল। তিনি খুব কাঁদলেন এবং ভাইকে লিখলেন, আমার আল্লাহর কসম! তোমার বাকী জীবনে আমি আর তোমাকে কোন প্রকার তিরষ্কার করব না।
আবদুল আজজ তাঁর ভাইকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা লিখেননি। তিনি সে বছরই ইন্তেকাল করলেন। আবদুল মালেক এজন্যই বেশি অনুতপ্ত হলেন যে, তিনি কেন তাঁর ভাইযের যুবরাজের দাবী প্রত্যাহার করতে চাপ দিচ্ছিলেন। ইবনে কাছীর লিখেন, যখন আবদুল মালেক তাঁর ভাই আবদুল আজীজের মৃত্যও সংবাদ শুনতে পেল, তখন ব্যাথা-বেদনায় পাহাড় যেন তার উপর ভেঙ্গে পড়ল। তিনি এবং তার পরিবারের সকলেই কেঁদে শোক প্রকাশ করতে লাগলেন। (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়অ ৮, খন্ড, ৫৯ পৃ.)
ঐতিহাসিকগণ বলেন, হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ সবসময় আবদুল মালেককে আবদুল আজীজের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করত, তা না হলে তারা দু’ মায়ের সন্তান হলেও তাদের মধ্যে ভালবাসা ও সম্প্রীতি ছিল। জীবনের পটভূমিকায় তারা সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন। রাজত্ব ও নেতৃত্ব লাবের জন্য উভয়েই সমভাবে কাজ করেছিলেন।
আবদুল আজীজ শত আশা পোষণ করা সত্ত্বেও তার পুত্র ওমরকে রাজসিংহাসনে সবাতে পারেননি। যদি আবদুল আজীজ আরও কিচুদিন জীবিত থাকতেন তবে হয়তো তিনি ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে আফ্রিকা অথবা পাশ্চাত্যের কোন দেশের আমীর নিযুক্ত করতেন অথবা তারপর তাঁকে মিশরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন। কিন্তু তাঁর জীবন তাঁকে এ সুযোগ দেয়নি। তার পুত্রদের বা ওমরের জন্য কিছু না করেই ৮৫ হিজরীতেহ তিনি ইন্তেকাল করলেন। অবশ্য তিনি তাঁর পুত্র-কন্যাদের জন্য প্রচুর ধন-সম্দ রেখে গিয়েছিলেন।
ইবনে কাছীর তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তি সম্পর্কে বলেন- আবদুল আজীজ ধন-সম্পদ, উট-ঘোড়া, গাধা-খচ্চর ইত্যাদি অগণিত সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন। তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তির মধ্যে শুধু স্বর্ণই ছিল তিন শত মুদ অর্থাৎ আমারেদ দেশী হিসেবে ৭৫০ মণ (সাতশত পঞ্চাশ মণ)।
ঐতিহসিকগণ বলেন- উমাইয়া বংশীয় বাদশাহদের মধ্যে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) ছিলেন সবচেয়ে সম্পদশালী। তিনি খুব উত্তম পোষাক পরিধান করতেন, উন্নত জীবন-যাপন করতেন, উত্তম খাদ্য আহার করতেন, উন্নতমানের বাহনে আরোহন করতেন এবং খুব বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করতেন।
আবদুল আজীজের মৃত্যুর পর অনতিবিলম্বে আবদুল মালেক তার পুত্র আবদুল্লাহকে মিশরের শাসনকর্তার দায়িত্ব দিলেন, তখন আবদুল্লাহর বয়স মাত্র ২৭ বছর। তিনি ৮৬ হিজরী জমাদিউল উখরায় মিশরে পৌঁছে শাসকনর্তার দায়িত্বভার গহণ করলেন।
তখন সম্ভবত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ মিশর থেকে দামশকে এসেছিলেন। তবে এটা জানা যায়নি যে, তিনি স্বেচ্ছায় দামেশকে এসেছিলেন না, আবদুল মালেক শেষ জীবনে ভাইযেল প্রতি সৃষ্ট তিক্ততা এড়াবার জন্যই তাঁকে দামেশকে ডেকে এনে তাঁর প্রতি করুণা প্রদর্শন করেছিলেন।
ইবনে কাছীর বলেন- তিনি যখন মিশর থেকে দামেশকে গেলেন তখন আবদুল মালেক তাঁকে তাঁর পুত্রদের সাথে অবস্থান করাতেন। তাঁকে তাঁর পুত্রদের চেয়েও অধিক প্রাধান্য দিতেন। ইবনে কাছীরের ভাষ্যটি এই- (আরবী************)
অর্থাৎ যখন তাঁর পিতা ইন্তেকাল হল তখন খলীফা আবদুল মালেক তাঁকে দামেশকে আনিয়ে তার পুত্রদের সঙ্গে রাখলেনে, এমনটি তাদের অধিকাংশের উপর তাঁকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
খলীফা আবদুল মালেক তাঁর মর্যাদা উন্নতী করার জন্য প্রিয় কন্যা ফাতেমাকে তাঁর সাথে বিয়ে দিলেন। উক্ত বিযেতে তাঁকে প্রচুর পরিমাণ ধন-সম্পদ উপহার হিসেবে দিলেন এবং বারি বর্ষণের মত দান-খায়রাত করেছিলেন।
ফাতেমা খুবই সৌভাগ্যশালী মহিলা ছিলেন, তিনি একজন বুদ্ধিমতি শাহজাদিী ছিলেন। কোন এক কবি তাঁর প্রশংসা করে যে কাব্য রচনা করেছিল, তার একটি অংশ ছিল এ- (আরবী*******************)
অর্থাৎ খলীফার কন্যা, খলীফার পোত্রী অনেক খলীফার ভগ্নি এবং তাঁর স্বামীও একজন খলীফা।
ফাতেমার স্বভাব ছিল মধুর ও প্রাণবন্ত। তিনি খুবই স্বামীভক্ত এবং দায়িত্বশীল মহিলা ছিলেন। আবদুল মালেকের মত দোর্দাণ্ড প্রতাপশালী খলীফার কন্যা হিসেবে তার মনে কোন অহংকার ছিল না।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর সাথে তার বিয়ে হওয়ার তিনি তার ভাগ্য প্রসন্নতার জন্য গর্ব করতেন। সারা বংশে ওমর উমাইয়া ইবনে আবদুল আজীজ (র) সবচেয়ে সুন্দর যুকব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অবশ্য আহত হওয়ার কারণে তিনি চলার সময় শরীরের ভারসাম্র রক্ষা করতে পারতেন না।
ইবন কাছীর আতাবী থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন- “যখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) নিজ পিতৃব্যের নিকট আসলেন, তখন তার পিতৃব্য জিজ্ঞেস করলেন, তুমি চলার সময় শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে পার না কেন? ওমর ইবনে আবদুল আজীজ বললেন, আমি গাঘার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন আঘাত পেয়েছিলে? তিনি উত্তরে বললেন, মূত্রশয় ও পিঠির মধ্যবর্তী স্থানের জোড়ায়।
ইবনে কাছীর বলেন, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) যে উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করলেন, এতে খলীফা অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্ট রূহ ইবনে থাম্বাহকে বললেন, যদি এ প্রশ্নই তোমার বংশের অন্য কাউকে করা হতো তবে এমন রুচিশীল ও মার্জিত উত্তর দিতে পারত না।
ঐতিাহাসিকগণ এর কারণ উল্লেখ করেননি যে, খলিফা আবদুল মালেক তাঁর অন্যান্য ভ্রাতুষ্পুত্রদের প্রতি এত দয়ালু ছিলেন না কেন? তবে অনুমতি হয় যে, জনসাধারণ সম-সাময়িক শিক্ষিত আলেম সমাজ ও বুদ্ধিজীবীগণ ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং মহৎ চরিত্রের প্রভাবে যেমন প্রভাবান্বিত ছিলেন, আবদুল মালেকও তাদের মতই প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ইবনে হাকাম এ প্রভাবের কারণ উল্লেখ করে বলেছেন, যখন আবদুল আজীজ নিজ স্ত্রী উম্মে আসেমের নিকট থেকে তাঁর পুত্র সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (র)-এর অভিমত জনে আবদুল মালেককে সে সম্পর্ক জানিয়ে দিলেন, তখন থেকেই আবদুল মালেকের অন্তরে তাঁর প্রভাব বিস্তার জানিয়ে দিলেন, তখন থেকেই আবদুল মালেকের অন্তরে তাঁর প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং এর ফলেই তাঁর খলীফা তাঁর জন্য মাসিক এক হাজার দীনার ভাতা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন, অথচ এত বিপুল পরিমাণ ভাতা আর কোন শাহাজাদার জন্র বরাদ্দ করা হয়নি। এমনকি ওয়ালিদ এবং সুলায়মানও এর পরিমাণ ভাতা পেত না। (আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া ৭ম খণ্ড, ১৯৫ পৃ.)
আমাদের বিশ্বাস যে, আবদুল আজীজের চিঠিতে শুধু খলীফার অন্তরে এ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মদীনার গভর্ণরও ওমর ইবনে আবদুল আজীজের শিক্ষা-দীক্ষা এবং তার নৈতিক ক্রমোন্নতি সম্পর্কে গোপনে খলীফাকে জানাতেন- যার ফলে খলীফার অন্তর দিন দিন তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল এবং এ কারণেই আবদুল আজীজের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি তার অন্যান্য সন্তানগণকে রেখেই ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) কে দামেশকে ডেকে আনলেন এবং তার নিজের পার্শ্বে অবস্থান কাতে দিলেন।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)ও তাঁর পিতৃব্যের প্রতি গভীর মহব্বত ও শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। ইবনে কাছীর বলেন, যখন তাঁল পিৃতব্য খলিফা আবদুল মালেক ইন্তেকাল করলেন, তখন তিনি তাঁর বিয়ো-ব্যথায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি এতই ব্যথিত হয়েছিলেন যে, দীর্ঘ সতেরো দিন পর্য়ন্ত শোক প্রকাশ করলেন। (আল বিদায়া ওয়ান-নেহায়য়অ ৮ম খন্ড. পৃ. ১৯৫)
আবদুল মালেকের মৃত্যুর পর তার পুত্র ওয়ালীত খলীফার পদে অধিষ্ঠিত হলেন। আবদুল মালেক তার প্রতি যেরূপ আচরণ কছিলেন ওয়ালীদও সেরূপ আচরণ করতে লাগলন। তিনিও সুলায়মান ব্যতীত অন্যান্য যুবরাজদের উপর তাঁকেই প্রাধান্য দিতেন।
তাঁর প্রতি অধিক সম্মান প্রদর্শন করেই ওয়ালীদ তাঁকে হেজাজের গভর্ণর পতে নিয়োগ দান করলেন। খলীফা আবদুল মালেকের মৃত্যুর কিছুদিন পরই তিনি এই সম্মানিত পতে অধিষ্টিত হলেন।
মদীনার শাসনকর্তা ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)
হরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) যে পদ লাভ করেছিলেন, এটা অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার পদ ছিল। তিনি মদঅনাকে সীমাহীন ভালবাসতেন। যেখঅনে সরওয়ারে দু’আলম (সা) চিরনিদ্রায় আরাম করেছেন। (কিছু শব্দ নেই*************) ইসলাম আশ্রয় গ্রহণ কছিল, যা েইসলামের প্রধান কেন্দ্র ছিল, ———-হযরত উরুয়া, হযরত ইকরামা, হযরত সাঈদ ইবন মুসাইয়্যাব, হযরত আবু সালমা হযরত আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান, হযরত উবায়দাল্লাহ ইবনে ওতবা হযরত সালেহ ইবনে কাইসান (র) প্রমুখ মহামনীষীগণ এবং আরও অন্যান্য বিশিষ্ট আলেমগণ অবস্থান করছলেন, সেই পবিত্র ভূমির প্রতি তাঁর আন্তরিক আকর্ষণও ছিল সীমানহীন।
ওয়ালীদ যখন তাঁকে এ পদে নিযুক্ত করেন তখন তাঁর সন্তুষ্টিত নিযুক্ত করেছিলেন, না ওয়ালীদ নিজের ইচ্ছায়ই এরূপ করেছিলেন ঐতিহাসিকগণ এদিকে কোন ইঙ্গিত দেননি। তবে এতটুকু সত্য যে, মদীনার শাসনকর্তার পদ লাভ করে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।
ইবনুল জাওযির মতে ৮৭ হিজরীতে তিনি মদীনার শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঐহতিহাসিক ইবনে সাদও এ কথাই বলেন। কিন্তু ইবনে কাছীর তাঁল এ নিযুক্তি ৮৬ হিজরীর ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আবদুল মালেকের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তাঁমে মদীনার শাসনকর্তার পদে মনোনীত করা হয়। এ দু’টি মতের ঐক্য এরূপই হতে পারে যে, তিনি ৮৬ হিজরীতে নিযুক্ত হয়েছিলেন সত্য, তবেচ ৮৭ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে তিনি মদীনায় শুভাগমন করেছিলেন। (ইবনুল জওযি-৩২, ইবনে সা’দ ৫ম, ২৪৪ পৃ.; ইবনে কাছীর ৮ম খণ্ড, ১৯৪)
এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। যদি বয়সের এ বর্ণনা সঠিক বলে ধরা যায়, তবে তাঁর জন্ম ৬১ হিজরীতেই হয়েছে বলে স্বীকার করে নিতে হবে।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) তাঁর স্ত্রী, সেবক-সেবিকা ও অনচরগণসহ ৮৭ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে শাহজাদার বেশেই মদীনায় শুভাগমন করলেন।
ইবনে সাদ বলেন, তাঁর পোষাক-পরিচ্ছদ ছিল খুবই সুন্দর, তিনি সবসময় সুগন্থি দ্রব্য ব্যবহার করতেন। তাঁর চাল-চলনে নমনীয়তা ছিল। যে পথ দিয়ে চলতেন সুগন্ধি মোহিত হয়ে যেত। তিনি এতই মূলবান পোষাক পরিধঅন করতেন যে, লোকেরা তাঁকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। তার পায়জামার আঁবল পায়ে জড়িয়ে থাকত, তাঁর কুঞ্চিত কেশ তাঁর ললাটদেশে পড়ত।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন, তাঁর চাল-চলনে আমীরানা এবং আড়ম্বরপূর্ণ ভাব ছিল। কিন্তু সাথে সাথে এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, এ আড়ম্বরপূর্ণ ভোগ-বিলাস সত্ত্বেও তিনি কখনও হারাম মাল ভক্ষণ করতেন না, পরস্ত্রীর প্রতি কোনদিন ফিরে চাননি এবং কখনও শরীয়ত বিরোধী কোন আদেশ জারী করতেন না।
তিনি যখন মদীনায় এসে শাসনভার গ্রহণ করলেন, তখন মদীনার দশজনদ বিশিষ্ট ফকীহ ও আলেমকে একত্রিত করলেন। ইবনুল জাওযির ভাষ্যটি হল- (আরবী*******************)
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) শহরের বিশিষ্ট দশজন ব্যক্তিকে ডেকে আনলেন। তন্মধ্যে উরুয়া, কাসেম িএবং সালেমও ছিলেন এবং তিন তাদেরকে বললেন, আমি আপনাদেরকে এ উদ্দেশ্যেই কষ্ট দিয়েছি যে, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা আমার কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। যদি আপনারা আমার কোন কর্মচারীকে জুলুম করতে দেখেন অথবা কারো প্রতি জুলুমের সংবাদ পান তবে আপনাদের উপর দায়িত্ব হল যে, সে ব্যাপারে আমাকে জানাবেন। তারা তাঁর এ আবেগ-অনুভূতির প্রশংসা করে সরেবাতোভাবে তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে গেলেন। (ইবনুল জাওযি ৩২)
ইবনুল জাওযি লিখেছেন যখন ওয়ালীদ ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে মদীনার শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করলেন, তখন তিনি মদীনায় যেতে বিলম্ব করতে গেলেন। এতে ওয়ালীদ তার প্রথান উজিরকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি? ওমর তার দায়িত্ব পাল করতে যায় না কেন? প্রধান উজির বললেন, ওমর শর্ত পেশ করেছেন! তারপর ওয়ালীদ ওমর ইবনে আজীজকেজ ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি শর্ত আছে? ওমর ইবনে আবদুল আজীজ বললেন, আমার পুর্ববর্তী শাসকগণ জুলুম-অত্যাচার করেছে। তারা অন্যায়-অবিচার করে আমাদনী বৃদ্ধি করেছে, আমি জুলুম-অত্যাচার করতে পারব না, আমদানীও বৃদ্ধি করতে পারব না। (তাবাকাতে ইবনে সাদ ৫ম খন্ড, পৃ. ২৪৪)
ওয়ালীদ বললেন, আপনি সর্বদাই সত্য-ন্যায় পধ অবলম্বন করবেন। আমার অনুমতি থাকল, যদি এতে আপনি এক পয়সাও কেন্দ্রে পাঠাতে না পারেন তবও আপনি অন্যায়-অত্যাচর করবেন না।
যখন ওয়ালীদ তাঁর সকল শর্ত মেনে নিয়ে তাঁকে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করলেন, তখন তিনি মদীনায় গিয়ে সর্বত্র ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করলে। মদীনা ছাড়া মক্কা এবং তায়েফও তাঁর শাসনাধীন ছিল।
তিনি ন্যায়বিচার ও সাধারণ মানুষের অধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। মদীনার সর্বশ্রেষ্ঠ ফকীহ, আল্লাহভীরু ও ন্যায়পরায়ণ বিচারক আবু বকর ইবন হাযমকে তিনি প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেছিলেন।
কর আদায়ের ক্ষেত্রে সকল প্রকার কঠোরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। যেমন মদীনার ফকীহগণকে বলা হয়েছিল যে, যেখানেই তাঁরা কোন অন্যায়-অবিচার হতে দেখবেন, তাঁরা তাঁকে জানাবেন, মক্কা, তায়েফ এবং অন্যান্য স্থানের ফকীহগণের নিকট অনুরূপ আবেনদ পেশ করা হল।
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মদীনার শাসনকর্তা হিসেবে যেরূপ ন্যায়পরায়ণতা, সুবিচার ও নিষ্ঠা সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন, যার ফলেই মদীনার সবচেয়ে বেশি আত্মমর্যাদাশীল ও সম্রাজ্যবাদ বিদ্বেষী ফকীহ সাঈদ ইবনে মুযায়্যাব (র) তাঁকে মাহদী উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
ইবনে সাদ বলেন- একদা কোন এক ব্যক্তি ইবনে মুসায়্যাব (র)কে জিজ্ঞেস করল যে, মাহদীর গুণাবলী কি কি? তিনি বললেন, মারওয়ানের বাসভবনে গিয়ে নিজের চোখে মাহদীকে দেখে আস। (তাবাকাতে ইবনে সাদ ৫ম খন্ড, ১৪১ পৃ.)
অতএব এ ব্যক্তি মারওয়ানের বাসভবনে এসে অন্যান্য সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সাথে অপেক্ষা করতে লাগল। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) অনুমতি দিলে তাদের সাথে সেও ভিতরে প্রবেশ করল এবং ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) কে দেখে এস সাঈদ ইবনে মুসায়্যা (র) কে বলল, আমি মারওয়ানের বাসভবনে গিয়েছিলাম কিন্তু মাহদী সম্পর্কে কেউ আমাকে কেউ কিছু বলল না এবং কেউ মাহীর প্রতি ইঙ্গিতও করল না।
তখন সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব (র) বললেন, তুমি কি ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখনি? সে বলল, হ্যাঁ, দেখেছি। তিনি বললেন, তিনিই যুগের মাহদী।
আসলেই তিনি মাহদী ছিলেন। সাধারণ মানুখষ পরবর্তীতে তা বুঝতে পেরেছিল। হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব (র) মদীনার সেই সমস্ত আলেমদের অন্যতম ব্যক্তি, যিনি কোন শ্রেষ্ঠ বা কোন সীমাহীন জালেম নরপতির সামনে মাথা নত করেননি। তিনি ওয়ালীদের মত খলিফার সম্মানার্থে দাঁড়াতে পছন্দ করেননি। তিনি ছিলেন হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর বিশিষ্ট শিষ্য। তিনি ছিলেন শরীয়তের জ্ঞানের বিশাল সমুদ্র। তিনি ওমর ইবনুল আবদুল আজীজ (র)কে সম্মান করতেন।
ইবনে হাকাম বলেন, একবার ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) কোন প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য মসজিদের নিকট এসে তার দূতকে হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যাবের নিকট প্রেলন করলেন। দূত ভূত করে হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যাবকে (র) বলল, আমীর! আপনাকে স্মরণ করেছেন। অথচ হযরত সাঈদ ইবনে মুাসায়্যাব (র) কোন আমীর বা বাদশাহর ডাকে কোনদিনই সাড়া দেননি। এবারের আহ্বানকারী যেহেতু ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তাই সাঈদ ইবনে আবদুল আজীজ তাঁকে উঠতে দেখেই দৌড়িয়ে তাঁর নিকট গিয়ে বললেন, হে মুহাম্মাদের পিতা! আমি আপনার নিকট যাচ্ছি, আপনি কি স্বস্থানে ফিরে যাবেন না? আমার দূত আপনার নিকট হাজির হয়েছিল আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে অবগত করতে। আমি আপনাকে ডেকে নিতে তাকে পাঠাইনি। সে ভুল করেছে। আমি শুধু জিজ্ঞেকস করার জন্যই তাকে পাঠিয়েছিলাম।
ইবনে আবদুল হাকাম ফকীহ সায়ীদ ইবন মুসায়্যাবের কঠোর স্বভাবের কথা আলোচনা করে বলেছেন, একদিন রাত্রে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব (র)-এর বৈঠকের পার্শ্বেই নামায পড়ছিলেন। তিনি খুব জোরে কিরাত পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে জোরে জোরে কিরাত পড়ছিলেন। হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব (র) তাকে জোরে কিরাত পাঠ করতে শুনে তার খাদেমে বারাদকে বললেন, হে বারাদ! এ লোকের কিরাত আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে, একে সরিয়ে দাও না! গোলাম বারাদ কিরাত পাঠকারীর মর্যাদা সম্পর্কে অবগত ছিল, কাজেই তাঁকে সরানোর চেষ্টা করল না। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ কিরাত পড়তেই লাগলেন। পুনারয় হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব (র) বললেন, তোমার জন্য দুঃখ হয়, আমি না তোমাকে এই ক্বারীকে সরিযে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলাম! বারাদ উত্তরে বলল, হুজুর! মসজিদ শুধু আমাদের জন্যই নয়।
বারাদ নেহায়ত সত্য কথাই বলেডছিল, মসজিদ শুধু তাঁর জন্য ছিল না। সমস্ত মুসলমাননের জন্যই। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) একথা শুনে নিজেই মসজিদের শেষ প্রান্তে চলে গেলেন। (ইবনুল হাকাম ২২ পৃ,)
তিনি নবী করীম (সা)-এর মসজিদের সীমাহীন সম্মান করতেন। তিনি যখন কোন রাত্রে মসজিদে নববীতে অবস্থান করনে, তখন তাঁর কোন স্ত্রী বা বাঁদীকে মসজিদে আসার অনুমতি দিতেন না। কারণ এতে মসজিদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) যতদিন মদীনার শাসনকর্তা কিংবা তাঁর শাসনাধীন কোন অঞ্চল কোন নির্যাতনমূলক আদেশ জারী করতে দেননি।
এ প্রসঙ্গে ইবনুল হাকাম একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন- একবার সুলায়মান হজ্জ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করলেন। ওমর ইবন আবদুল আজীজও তাঁর সাথে ছিলেন। রাত্রে তিনি তার বাহনেই শয়ন করেছিলেন। তাঁর বাহন কুষ্ঠ রোগীদের আশ্রয় কেন্দ্রের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিল, এমন সময় সেখান থেকে খুব গোলমালের শব্দ শুনা গেল। এ গোলমালের শব্দে সুলায়মানের নিদ্রায় ব্যাঘাট ঘটল। তিনি উঠে বসলেন এবং লোক পাঠিয়ে তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হলেন যে, এরা কুষ্ঠ রোগী। তখন রাগান্বিত হয়ে তাদের এ বস্তিতে আগুন জ্বালিদেয় দিতে নির্দেশ দিলেন।
এ নির্যাতনমূলত নির্দেশের কথা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ জানতে পেরে আদেশ কার্যকরী দলকে বাঁধা দিলেন এবং তিনি সুলায়মানের নিকট গিয়ে এরূপ নির্যাতনমূলক আদেশ থেকে বিরত করলেন এবং তাদের বস্তি জ্বালিয়ে দেয়ার পরিবর্তে তাদেরকে এ স্থান থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে অনুমতি গ্রহণ করলেন।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ ব্যক্তিগতভাবেই হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফকে পছন্দ করতেন না। একবার হাজ্জাজ খলীফা ওয়ালীদের নিকট থেকে অনুমত গ্রহণ করলেন যে, তিনি হজ্জ করতে মক্কায় গিয়ে হজ্জ শেষে মদীনা যাবেন তারপর প্রত্যাবর্তন করবেন। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ হাজ্জাজের এ অভিপ্রায় জানতে পেরে ওয়ালীদকে লিখলেন, হাজ্জাজ এ স্থঅন হয়ে অতিক্রম করুক, এটা আমি মোটেই পছন্দ করি না। ওয়ালীদ এ চিঠি পেয়েই হাজ্জাজকে লিখলেন, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তোমার মদীনা হওয়া যাতায়াত করা পছন্দ করেন না, কাজেই তোমার উচিত এ দিক দিয় অতিক্রম না করা। (ইবন আবদুল হাকাম, ১১-১৩; ইবন কাছীর ৮ম খণ্ড, পৃ. ১৯৪)
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ দীর্ঘ ছয় ছর মদীনার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এ সময়ে তাঁর কোন কর্মচারী কোন প্রজাকেই জুলুম করতে সাহস পায়নি। যদিও ঐতিহাসিকগণ তাঁর মদীনার শাসনামলের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেননি, তবুও ইবনে কাছীর বলেন. এ সময় সামাজিক সৌহার্দ ও প্রজারেদ সাথে কর্মচারীদের আচরণের দিক দিয়ে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যুগ হিসেবে পরিচিত ছিল। যখনই কোন সমস্যা দেখা দিত তিনি মদীনার বিশিষ্ট দশজন ফকীহকে ডেকে পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তাঁদের পরামর্শ ব্যতীত কোন সমস্যারই সমাধন করতেন না।
এ সমস্ত মনীষীগণ ছিলেন, হযরত উরুয়া, হযরত উবায়দুল্লাহ, হযরত আবুল্লাহ হযরত আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান, হযরত আবু বকর ইবনে সলায়মান, হযরত সুলায়মান ইবনে ইয়াসার, হযরত কাসেম ইবনে মুহাম্মদ, হযরত সালেম ইবনে আবদুল্লাহ এবং হযরত খায়েজা ইবন যায়েদ (র)।
আয-যাহরী তাযকেরাতুল হুফফাযে এবং সাদ তাবকাতের ৫ম খণ্ডে এ সমস্ত পণ্ডিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেছেন যে, তাঁরা ছিলেন মদীনার সবচেয়ে বড় ও বিশিষ্ট ফকীহ এবং ইসলারেম আদর্শ ও উদ্দেশ্যের ধারক ও বাহক।
ইবনে কাছীর এ দশজন ছাড়া হযরত সায়দ ইবনে মাসায়্যাবের (র) কথাও উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে, তিনি হযরত সায়দ ইবনে মুসায়্যাব (র)-এর কোন সিদ্ধান্তই অমান্য করতেন না। হযরত সায়দ ইবনে মুসায়্যাবও এমন ব্যক্তি্ব সম্পন্ন আলেম ছিলেন যে, তিনি কোন খলীফার দরবারেই গমন করতেন না। কিন্তু হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) মদীনার শাসনকর্তা থাকাকালীন তিনিও তাঁর নিকট গমন করতেন।
ইসলামের বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক ব্যক্তি শাসনের অভিযোগকারী গণন্ত্রের ধব্জাধারীদের চিন্তা করা উচিত যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) খলীফা ছিলেন না। তিনি মাত্র একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদে অধিষ্টিত হয়ে দেশের সেরা দশজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি পরামর্শ সভার ব্যবস্থা করেছিলেন কেন? পবিত্র কুরআনের এ নির্দেশকে (আরবী*****) (পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ কর) বাস্তাবায়িত করার উদ্দেশ্যেই নয় কি? আধুনিক গণতন্ত্র এর চেয়েও উন্নত মানের পরামর্শ সভার আদর্শ স্থাপন করতে পেরেছে কি?
মদীনায় ছয় বছরের শাসনামলে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) সত্য ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে জনসাধরণকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করেছিলেন। তিনি দেশের সর্বশ্রেণীর নাগরিকদের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজ করেছিলেন।
মক্কা-মদীনার আশেপাশে কূপ খনন করে জনসাধারণের পানির অভাব দূর করেছিলেন। মসজিদে নববী সংলগ্ন বাগানটিতে একটি ঝর্ণা ও একটি হাউজ নির্মাণ করে আগতদের পানির অভাব পূরণ করেছিলেন। তিনি হেজাজের রাস্তাঘাট সংস্কার করেছিলেন, বিশেষতঃ মক্কা-মদীনা এবং তায়েফের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী রাস্তাসমূহের সংস্কার সাধন করে পর্যটনের পথ সহজ করে দিয়েছিলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল মসজিদে নববী পুনঃনির্মাণ ও তা সৌন্দর্য বৃদ্ধি। এ বিরাট কীর্তি তিনি মদীনায় শুভাগমন করার এক বছর পর অর্থাৎ ৮৮ হিজরীর সফর মাসে শুরু করেন। (মুয়াজ্বামূল বুলদান, ৪র্থ খণ্ড, ৬৬ পৃ; বালযুরী ৭৬; মকাদ্দাসী ৪৭৭; ইবনে সাদ ২য় খণ্ড)
ঐতিহাসিকগণ খলিফা ওয়ালীদকে মসজিদের নির্মাতা বলে উল্লেখ করেছেন, তা যথার্থই করেছেন। খলিফা ওয়ালীগ এ হিসেবেই এর নির্মাতা যেহেতু, তিনি এ মহান কর্মকাণ্ডের জন্য বিপুল সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি স্বর্ণ-রৌপ্য গাড়ী বোঝাই করে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের নিকট প্রেরণ করেছিলেন।
সিরিয়া, মিশর ও আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান থেকে উন্নতমানের প্রকৌশলী এনে মদীনায় প্রেরণ করেছিলেন। যেখানেই উত্তম পাথর পাওয়া গিয়েছে সেখান থেকেই মর্মর, রুখম ও মূসা পাথর গাড়ী বোঝাই করে মদীনায় প্রেরণ করেছিলেন।
যখন মসজিদে নববীর পুনঃনির্মা কাজ শুরু হল তখন মনে হল মসজিদে নববী নয়, সমগ্র মদীনাই যেন পুনঃনির্মিত হযেছে। প্রকৃতপক্ষে এটা মদীনার পুনঃনির্মাণ ছিল না, এটা ছিল প্রেম-প্রীতির দুনিয়ার নব নির্মাণ।
ইবনে সাদ বলেন- ওয়ালীদ ও ওমর ইবনে আবদুল আজীজ মসজিদে নববীর পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন এজন্যই যে, তখন মুসলমানদে সংখা অগণিত ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, নামাজের সময় মসজিদে স্থান সংকুলান হতো না। যদিও হযরত ওমর ফারুক (রা) ও হযরত ওসমান (র) নিজ নিজ যুগে মসজিদে ননবীকে বিশেষভাবে সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেছিলেন, তবুও মসজিদে নামাযীর সংখ্যা এতই বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে, মসজিদের বাইরের মহল্লায়ও মুসাল্লা বিছিয়ে নামায পড়ত হত।
হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) এ অবস্থায় মুসল্লীদের দুর্দশার কথা খলিফা ওয়ালীদকে জানালে ওয়ালীদ এই মহান কাজ সম্পাদন করে এক অমর গৌরবের অধিকারী হলেন।
মসজিদে নববী পূননির্মাণের প্রেরণা দানকারী ওমরই হোক অথবা ওয়ালীদ নিজে নিজেই উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকুক, মসজিদে নববীর পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু হলে মদীনায়েই নয়, মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকা, মক্কা এবং আরও বহু দূর-দূরান্ত থেকে দর্শকগণ এসে মদীনায় ভীড় জমাচ্ছিল। তখন মসজিদে নববী প্রদর্শনীর রূপ ধারণ করেছিল।
পুরাতন মসজিদ ভেঙ্গে দেয়া হল, তার সাথে সাথে খড়-কুটা ও খেজুর পত্র দ্বারা নির্মিত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সহধর্মীনীদের (রা) পবিত্র হুজরাসমূহও ভেঙ্গে দেয়া হল।
ঐতিহাসিক ইবনে সাদ যার নিকট থেকে ঘটনা বর্ণনা করেছেন, তার অবস্থা বর্ণনা করে বলেন যে, বর্ণনাকারী অশ্রুসিক্ত নয়নে বলছিল, আফসো! যদি ঐ পবিত্র হুজরাসমূহ ভেঙ্গে না দেয়া হত, তবে আগত দিনের মুসলমানগণ দেখতে পারত, তাদেন নবী (সা) কিভাবে জীবনযাপন করতেন, উম্মাহাতুল মুমিনীনগণ কেমন হুজরায় বসবাস করতেন। (তাবাকাতে ইবনে সাদ, ২য় খণ্ড)
বাস্তবিকই এ সমস্ত হুজরাসমূহ দর্শনীয় স্মৃতিই ছিল। হুজরার দেয়াল, ছাদ এবং তাঁদের শয্যা আগত দিনের মুসলমানদের চোখের মনি হিসেবেই বিবেচিত হতো। কিন্তু এ খড়-কুটাঠ নির্মিত হুজরাসমূহ আজীবন রক্ষা করা মোটেই সম্ভব ছি না। মাত্র পঞ্চশ বছরের অধিকাংশগুলিই ভেঙ্গে গিয়েছিল, দেওয়ালে অসংখ্য ছিদ্র হয়ে গিয়েছিল, ছাদ ঝুলে পড়েছিল। তা না হলে দশজন বিশিষ্ট ফকীহ যাঁদের মধ্যে হযরত সায়দ ইবনে মুসাইয়্যাব, হযরত আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান, হযরত ইবনে হাজম, হযরত সালেম এবং হযরত উরুয়া (র)-এর মত নবী প্রেমিকগণ কখনও এ সমস্ত পবিত্র হুজরার ভাঙ্গার সম্মাতি দিতেন না। এমনকি হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের নিকটও এ খড়-কুটা ও মাটির নির্মিত পবিত্র মসজিদ এবং হুজরাসমূহ অত্যন্ত পবিত্র ও শ্রদ্ধেয় ছিল। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বগুণসম্পন্ন মহামানব জনাবে মুহাম্মদুর রাসূলূল্লাহ (সা) এবংতাঁর অনুসারীগণ। তিনি কখনও এসব ভাঙ্গতে সাহস করতেন না। এ মসজিদও এসব হুজরা যখন ভাঙ্গা হয় তখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ কেঁদেছিলেন, সায়দ ইবনে মুসাওয়াবের দু’ চোকেও অশ্রু বন্যা প্রবাহিত হচ্ছিল।
কেবল উম্মাহাতুল মুমিনীনদের হুজরা সমূহই অত্র মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, বরং আশপাশের সমস্ত ঘর-বাড়ীও ক্রয় করে মসজিদ বৃদ্ধির কাজে শামিল করা হল।
যখন সমস্ত বাড়ী-ঘর ভেঙ্গে মসজিদের ভিত্তি তৈরী শুরু হল, তখন হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ যে দশজন বিশিষ্ট ফকীহদের পরামর্শক্রমে সমস্ত কাজ করেতেন, সে ফকীগণকে ডেকে এনে তাঁদের দ্বারা এ পবিত্র মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করালেন। কারণ হযরত উমর ইবন আবদুল আজীজের দৃষ্টিতে সম-সাময়িক যুগে এ দশজন ব্যক্তির চেয়ে শ্রদ্ধেয় সম্মানিত আর কেউ ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টিতে খলফা ওয়ালীদ এবং খেলাফতের পরবর্তী উত্তরাধিকারী সুলায়মানও তাঁদের তুলনায় অতি নগণ্য ছিলেন।
এ সমসত্ সমানিত মনীষীগণ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করার পর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত ৮০ জন প্রকৌশলী তাদের অধীনস্থ বহু রাজমিস্ত্রী সমন্বয়ে মসজিদের দেওয়াল উঠাতে শুরুক করলেন। এ সমস্ত প্রকৌশলীদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক রোমীয় ও মিশরীয় ছিল। তাবারী এ প্রকৌশলীদের সংখ্যা বলেছিলেন ৮০ জন বা একশত জন।
আল্লামা মুকাদ্দাসী (র) বলেন- এরা অত্যন্ত উচ্চস্তরের প্রকৌশলী ছিলেন, রোম সম্রাট তাদেরকে মিসকাল (এক মেসকাল সমান সাড়ে চার আানা পরিমাণ ওজন) স্বর্ণ এবং চল্লিশ গাড়ি মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য পাথরও সরবরাহ করেছিলেন। (মুয়াজ্জামুল বুলদান, ৪র্থ খণ্ড, ৪৬৬ পৃষ্ঠা)
দীর্ঘ তিন বচর ব্যাপী এ সমস্ত রোমীয় ও মিশরীয় প্রকৌশলীগণ মসজিদ নির্মাণের কাজে লিপ্ত ছিলেন। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তাদেরকে মুক্ত হস্তে রাজকীয় পুরস্কার দিয়েছিলেন। বিশেষতঃ দশজন বিশিষ্ট প্রকৌশলী তিন বছরে রাজকীয় পুরস্কার দিয়েছিলেন। বিশেষতঃ দশজন বিশিষ্ট প্রকৌশলী তিন বছরে এক লক্ষ্ আশি হাজার দীনার মজুরী পেয়েছিলেন। দেয়ালের ভিত্তিতে পাথর বসান হয়েছিল এবং স্তম্ভ সমূহ পাথর দ্বার নির্মিত হয়েছিল। ইয়াকুতের ভাষ্যটি হলো- দেওয়াল ও ভিত্তি পাতরের নির্মিত হয়েছিল। ইয়াকুতের ভাষ্যটি হলো- দেয়াল ও ভিত্তি পাথরের নির্মিত ছিল এবং স্তম্ভসমূহও পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। আর দেওয়াল গাত্রে এবং স্তম্ভসমূহে যে সমস্ত উপাদন কারুকার্য খচিত হয়েছিল তাতেও বেশ কয়েক মণ স্বর্ণ-রৌপ্য ব্যবহার করা হয়েছিল। (মুয়াজ্জামুল বুলদান, ৪র্থ খণ্ড, ৪৬৬ পৃষ্ঠা)
মসজিদে নববী পূণনির্মাণ যে সমস্ত বিচিত্র রঙ্গের পাথর ব্যবহৃত হয়েছিল, তা স্বর্ণ-রৌপ্য দ্বারা কারুকার্য খচিত ছিল এবং এতই মূল্যবান ছিল যে, কেবলামুখী গম্বুজ সংলগ্ন দোহারী ছাদটির মূল ছিল চল্লিশ হাজার আশরাফী। (খুলাছাতুল ওফা, ১৪০ পৃষ্ঠা)
দীর্ঘ তিন বছর ব্যাপী ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) এ মজজিদ নির্মাণ কাজে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তিনি সারা দিনি সাধারণ মজুরদের মতেই পাথর ও অন্যান্য উপকরণ ধৌত করে এ পবিত্র মসজিদ নির্মান কার্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ তিনি বছেরে মসজিদ নির্মাণ কার্য শেষ হল।
ইয়াকুতের বর্ণনা মতে- মসজিদের দৈর্ঘ ছিল দুৎশত গজ এবং প্রস্থও ছিল দু’শত গজ। সামনের দিক পূর্ণ দু’ শত গজ ছিল এবং পিছনের দিকের দৈর্ঘ্য ছিল ২ শত ৮০ গজ। (মুয়াজ্জামুল বুলদান, ৪র্থ খন্ড, ৪৬৬ পৃষ্ঠা)
মধ্যব্তী মেহরাবের কারুকাজ করতে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম হয়েছিল। মসজিদে চারটি মেহরাব তৈরী করা হয়েছিল িএবং একটি উন্নত ধরনের হাউজ ও একটি ঝর্ণা তৈরী করা হয়েছিল।
কলকশান্দি বলেন- মধ্যবর্তী মেহরাবটির অভ্যন্তর ভাগ খোলা ছিল। সমস্ত স্তম্ভই মর্মর ও রোখাম পাথর দিয়ে নির্মিত ছিল। রোখামই সবচেয়ে মূল্যবান পাথর। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ ওয়ালীদের নির্দেশেই এ সমস্ত পাথর মাদায়েন থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। কিছু পাথর রোম সম্রাট উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন এবং অবশিষ্ট কিছু মিশর ও আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। (কলকশান্তি, ৩য় খন্ড)
এ দীর্ঘ সময় ওয়ালীদ মসজিদ নির্মাণের ব্যপারে খুব অধীর ছিলেন এবং তিনি স্বর্ণ-রৌপ্যের গাড়ী বোঝাই করে পাঠাতেন আর উমর ইবনে আবদুল আজীজকে এ পবিত্র কাজ যথাশীঘ্র সম্ভ তাড়াতাড়ি শেষ করতে নির্দেশ দিতেন। খুলাছাতুল ওফার বর্ণনা মতে, মসজিদ নির্মাণ কাজ শেষ হলে ওয়ালীদ মদীনায় এসে মসজিদ দেখে কুবই আনন্দিত হলেন।
আবুল মুহসিন, বালাযুরী, ও মাসুদীর বর্ণনা মতে, মসজিদ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ৮৮ হিজরীতে; কিন্তু ইয়াকুতীর মতে ৮৭ হিজরীর সফর মাসে শুরু হয়ে ৮৯ হিজরীতে শেষ হয়েছিল। আর অন্যান্যদের নিকট এটা শেষ হয়েছিল ৯১ হিজরীতে। ((বালাযুরী, ৭৬ পৃষ্ঠা; মুকাদ্দাসী, ১২; মাসুদী, ৫ম খন্ড)
যাহোক, ওয়ালীদ ও হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজী (র) উভয়েই এ মহান কাজের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁরা এতই শান-শওকতের সাথে এ মসজিদ পুনঃনির্মাণ করেছিলেন যে, এটা সম-সাময়িত যুগের বৃহত্তম প্রাসাদ হিসেবে গণ্য হয়েছিল। যদিও ইসলাম অনাড়ম্বরপ্রিয়, ইসলামর দৃষ্টিতে প্রাসাদে স্বর্ণ-রৌপ্য ব্যবহার করা অবব্যয় বলে গণ্য হয়, কিন্তু ওয়ালীদের ব্যক্তিগত ধন ভাণ্ডার যে সম্পদ জমা হয়েছিল, তা ব্যয় করার জন্য এর চেয়ে আর কোন উত্তম স্থান ছিল না। ওমর ইনে আবদুল আজীজের মত বিচক্ষণ এবং ইবলাম সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল একজন শাসনকর্তা এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পদকে এরূপে মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজে ব্যয় করেই পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন। যদি জনণের ধন-ভাণ্ডারের হেফাযেতের দায়িত্ব তাকে দেয়া হতো তবে তিনি কখনও তা থেকে এতে এভাবে ব্যয় করতেন না।
মসজিদ নির্মাণ শেষ হওয়ার পর মাত্র দু’ বছর হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) মদীনার শাসনকর্তার পদে বহাল ছিলেন। ইবনুল জাওযি বলেন- ৯৩ হিজরীতে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই শাসনকর্তার পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইবনে কাছীর বলেন যে, হাজ্জাজের প্ররোচরনায় ওয়ালীদ তাঁকে পদচ্যুত করেচিলেন। কারণ যা হোক, এ সৌভাগ্য ও সম্মানিত পদ হারিয়ে তিনি খুবই দুঃতি হয়েছিলেন। তিনি যখন মদীনা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন তিনি মদীনার প্রতি অশ্রুসিক্ত নয়নে বারবার ফিরে তাকাচ্ছিলেন এবং ক্রন্দন করতে করতে বলেছিলেন-
(আরবী**************)
অর্থাৎ হে মুজাহিম, আমার আশংকা হয় যে, আমরাও মদীনার রোষে পতিত হব। মদীনা তার অন্যায়কে দূর করে দেয়, যেমন রেত লোহার ময়লা দূর করে দেয় এবং পরিচ্ছন্ন খাঁটি লোহা অবশিষ্ট থাকে। (ইবনুল জাওযি)
ইবনে কাছীর বলেন যে, আবদুল মালেক ও তার বংশধরগণ হাজ্জাজের প্রভাবে প্রভাবিত ছিল। আবদুল মালেক হাজ্জাজকে তার পিতার খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করতেন এবং মৃত্যুর সময় খলিফা মালেক ওয়ালীদকে হাজ্জাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও পূর্ববৎ সম্পর্ক বজায় রাখতে বলেছিলেন। খলিফা ওয়ালীদগও হাজ্জাজের মর্যাদা বুঝতেন। তদুপরি হাজ্জাজ ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সম্পর্কে ওয়ালীদকে যে বিষয়ে অবগত করেছিল তাও ভুল ছিল না। হাজ্জাজ লিখেছিলেন, ইরাকের বিচ্ছিন্নতাবাদীগণ এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে মদীনা ও তায়েফে আশ্রয় নিয়েছে। এ অবস্থা চলতে দিলে দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবননিত ঘটবে। (ইবনু জাওযি -৩৫)
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) অত্যন্ত দয়ালূ লোক ছিলেন। তা ছাড়া হাজ্জাজ যাদেরকে দুষ্কৃতিকারী বলে মনে করত তারা তাঁর দৃষ্টিতে নির্যাতিত বলেই বিবেচিতক হত। তাঁরা যখন তাঁর নিকট এসে আশয় প্রার্থন করত তখন তিনি তাদেরকে আশ্রয় দেয়া নৈতিক দায়িত্ব মনে করে আশ্রয় দিতেন।
হাজ্জাজ ওয়ালীদের নিকট এ অভিযোগ করে দৃঢ়তার সাথে বলল, যদি দুষ্কৃতিকারীগণ এভাবে পালিয়ে গিয়ে হেজাজে আশ্রয় নিতে থাকে তবে সাম্রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে। ওয়ালীদের নিকট ওমর ইবনে আবদুল আজীজের চেয়ে রাজত্ব ও রাজ সিংহাসন অধিকতর প্রিয় ছিল। তিনি হাজ্জাজকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ধারণায় এমন কোন ব্যক্তি আছ, যে এ সমস্ত দুষ্কৃতিকারীদের প্ররিরোধ করে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে? হাজ্জাজ তার বন্ধদের মধ্যে দু’জনের পক্ষে সুপারিশ করল। অতএব ওয়ালীদ তাদের একজনকে মদীনা ও অপরজনকে মক্কার শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত করে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে দামেশকে ফিরিয়ে নিলেন।
ইবনে কাছীর হাজ্জাজের এ অভিযোগকে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের বিরুদ্ধে প্রশোধমূলক অীভযোগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একবার ওমর ইবনে আবদুল আজীজের হাজ্জাজের নির্যাতন-নিপীড়ন সম্পর্কে ওয়ালিদের নিকট অভিযোগ করেছিলেন।
ইবনে কাছীর খুব বিশ্বস্ততার সঙ্গেই বর্ণনা করেছেন যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ পদচ্যুত হয়েছিলেন।
ইবনুল জওযি তাঁর পদত্যাগের যে ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তাও উল্লেখ করা হলো। ইবনুল জাওযি বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইয়েরের (রা) পুত্র খুবাইব মদীনাতেই বসবাস করতেন। তিনি একবার রাসূলুল্লাহ (সা) হতে একটি হাদীসন বর্ণনা করেন যে, আবুল আছের বংশঘরগণ যখন ত্রিশ জনে পৌঁছবে, তখন তারা আল্লাহর বান্দাদের দাসে পরিণত করবে এবং আল্লাহর সম্পদ লুট করবে।
এ হাদীছ মুখে মুখে প্রচার হয়ে ওয়ালিদের কানেও গিয়ে পৌঁছল। তাঁর মতে এটা ছিল খুবইবের মনগড়া রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি একটি মিথ্যা অপবাদ। কাজেই তিনি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে লিখলেন যে, খুবাইবকে এই অপরধে একশত বেত্রাঘাত কর। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তাঁকে ডেকে এনে বেত্রাঘাত করতে নির্দেশ প্রদান করলেন। খুবাইব খুব দুর্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন, জল্লাদ খুব নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করেছিল। তারপর যখন তাঁকে ফিরিয়ে নেয়া হল, তখন বেত্রাঘাতের যন্ত্রণায় তিনি মারা গেলেন। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তাঁর মৃত্যু-সংবাদ শুনতে পেয়ে াকে-দুঃখে মাটিতে গড়াগড়ি করে তাঁদতে লাগলেন এবং গভর্ণর পদ ত্যাগ করলেন। কারণ খুবাইবের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ পদত্যাগ করে ওয়ালিদকে লিখেছেন, কিন্তু এ পদত্যাগ পত্র ওয়ালিদের নিকটে পৌঁছার পূর্বই তিনি হাজ্জাজের পত্রে প্রভাবিত হয়ে তাঁকে পদচ্যুত করে আদেশ জারী করেছেন।
তিনি পদচ্যুত হয়ে থাকুন অথবা পদত্যাগ করেই থাকুন, তিনি যখন মদীনা হতে দামেশকের পথে যাত্রা করলেন তখন রাত্র ছিল এবং জেনে বুঝেই তিনি রাত্রের সফর অবলম্বন করেছিলেন।
অতীব আশ্চর্যের বিয় হলো, ঘটনাক্রমে সে রাত্রেই চন্দ্রের কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়েছিল। তাঁর ব্যক্তিগত সেবক মুজাহিম এ অবস্থা লক্ষ্য করে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) কে বললেন- (আরব*ি******************)
অর্থাৎ চন্দ্রের প্রতি লক্ষ্য করে দেখছেন কি? আজ রাতের সাথে কি সুন্দর মিল রয়েছে?
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) চন্দ্রের প্রতি তাকিয়ে মুজাহিমকে বললেন, আমি তোমরা কথার অর্থ বুঝেছি। তবে মনে রেখ, আমাদের যাত্রার উপর চন্দ্র-সূর্যের কোন প্রভাব পড়বে না, হ্যাঁ একমাত্র পরাক্রমশালী মহান আল্লাহর ফায়ালা।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) পদত্যাগ করলে মক্কা-মদীনা ও তায়েফবাসীগণ যে দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হল, কোন ঐতিহাসিক তার বর্ণনা দেননি।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর পদত্যাগে মদীনার ফকীহগণ অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। কারণ তাঁদের মাহদী এবং তাদের প্রিয় শাসক মদীনা হতে বষ্কিৃত হলেন এ দুঃখে তাঁরা সচ অধীর হয়ে পড়নে। বিশেষতঃ হযরত সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যাব (র) সব চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন। কারণ তিনি ওমর ইবনে আবদুল আজীজের দ্বারাই ওয়ালিদের ক্রোধ হতে মুক্তি পেয়েছিলেন।
ইবনে কাছীর বলেন, আবদুল মালেক এবং তারপর ওয়ালিদ উভয়ই সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যাব (র)-এর প্রতি বৈরীভাব পোষণ করতেন। কারণ, সায়ীদের একটি কন্যা সমসায়িক যুগে সব চেয়ে সুন্দরী, শিক্ষিত ও ভদ্র বলে খ্যাত ছিল। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলে সুন্নাহর জ্ঞানেও সে ছিল পারদর্শী। তার এ সস্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে আবদুল মালেক তার পুত্র ওয়ালিদের সাথে তার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (র) তাঁর এই প্রস্তাবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। ফলে আবদুল মালেক রাগান্বিত হয়ে মদীনার শাসকর্তাকে লিখলেন যে, সাঈদকে বেত্রাঘাত কর। কাজেই তাকে বেত্রাঘাত করা হল।
যখন আবদুল আজীজ মারা গেলেন, তখন আবদুল মালেক তার পুত্র ওয়ালিদের খেলাফতের পক্ষে জনসাধারণের নিকট থেকে বায়আত গ্রহণ করলেন। মদীনার তৎকালীন শাসনকর্তা হিশাম ইবনে ইসমাঈল তাঁর অনুরণ করলেন, কিন্তু হযরত সায়াদ ইবনে মাসাইয়্যাব (র) ওয়ালীদের খেলাফতের বায়আত করতে অস্বীকার করলেন। যার কারণে তাঁর বেত্রাঘাত করা হল এবং চরমভাবে অপমানিত করে সমস্ত মদীনায় ঘুরান হল।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজের দ্বারাই তাঁর প্রতি এ সমস্ত নিপীড়নমূলক আচরণ বন্ধ হয়েছিল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) সায়দ ইবনে মুসাইয়্যাব (র) কে খুব শ্রদ্ধা করতেন, তিনি তাঁর মতামতের বিরুদ্ধে কোন নির্দেশ প্রদান করতেন না। াকরণ হযরত সায়দ ইবন মুসাইয়্যাব (র) সম-সাময়িক যুগে মদীনার সবচেয়ে বিজ্ঞ আলেমও সাধক ছিলেন।
ইবনে কাছীরের ভাষ্যটি হলো- (আরবী******************)
অর্থাৎ অনর্থক কথা ও কাজে তিনি বেশি সংযত ছিলেন এবং হাদীসের বেলায় তিনি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
ইবনে কাছীর বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) যখন মদীনা থেকে বের হলেন, তখন হযরত সায়দ ইবনে মুসাইয়্যাব (র) অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁর জন্য দু’হাত উঠিয়ে হান আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করেছিলেন এবং ক্রন্দ করছিলেন।