অমুসলিম সংখ্যালঘু
ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ বলেন-
রাবিকাশ শাওমি বলেন যে, একবার আমি হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি ডাকের ঘোড়ায় আরোহণ করে যাত্রা করলাম। পথিমধ্যে সিরিয়ার কোন এক স্থানে আসার পর উক্ত ঘোড়াটি মারা গেল। আমি কোন এক নাবতির নিকট হতে বিনা ভাড়ায় একটি ঘোড়া নিয়ে খানাজেরায় এসে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের নিকট হাজির হলাম।
তিনি আমাকে জিজ্ঞাস করলেন যে, মুসলমানদের পালকের খবর কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম, পালক দিয়ে আপনি কি বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন ডাক। আমি বললাম, অমুক স্থানে এসে ডাকের ঘোড়াটি মারা গিয়েছে। তিনি জিজ্ঞাস করলেন, তাহলে তুমি কিভাবে এসেছো? আমি বললাম, এক নাবতীর কাছে হতে বিনা ভাড়ায় একটি ঘোড়া নিয়ে এসেছি। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ বললেন, আমার রাজত্বে তোমরা বেকার খাটাও? এরপর তিনি আমাকে চল্লিশটি বেত্রঘাত করতে নির্দেশ দিলেন এবং আমাকে চল্লিশটি বেত্রাঘাত করা হলো।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সমস্ত নাবতীর কথা উক্ত ঘটনায় উল্লেখ করা হয়েছে- তারা যিম্মি বা কোন অমুসলিম ছিল না।
তার নিকট হতে বিনা ভাড়ায় ঘোড়া নেয়ার অপরাধে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তার একজন বিশ্বস্ত কর্মচারীকে চল্লিশটি বেত্রাঘাত করলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে যা পেশ করতে সক্ষম নয়। কিন্তু হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের শাসনামলে এ জাতীয় দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
তিনি রাষ্ট্রের সর্বত্রই শুধু বেকার প্রথাই বাতিল করেননি বরং শুধু জিযিয়া ও খেরাজ অবশিষ্ট রেখে তিনি কর রহিত করে দিয়েছিলেন এবং জিযিয়া আদায়েও চুড়ান্ত ইনসাফের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিলেন। শুধু এ জাতীয় লোকদের নিকট হতেই এ উভয় প্রকার কর আদায় করা হত যারা এটা আদায় করতে সম্পূর্ণ সক্ষম ছিল। অর্থাৎ যারা স্বাস্থ্যবান, উপার্জনক্ষম তারাই জিযিয়া দিত। আর একমাত্র শষ্য উৎপাদন উপযোগী জমিরই ভূমিকর গ্রহণ করা হত।
শষ্য উৎপাদন অনুপযোগী অথবা আনাবাদী জমি আবাদ উপযোগী হওয়ার পূর্বে ভূমিকর আদায় করা হতো। এ ব্যাপারে হযরত ইবনে আব্দুল আজিজ একটি বস্তবাধর্মী নির্দেশ দিয়ে সে অনুযায়ী কর্মতৎপরতা গ্রহণ করার জন্য শাসকদেরকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সে নির্দেশ এটা স্পষ্ট ব্যক্ত করেছিলেন যে, এমন কোন জমি হতে কর আদায় করা যাবে না, যা শষ্য উৎপাদনে উপযোগী নয়।
শষ্য উৎপাদনে অনুপযোগী জমি সরকারী ব্যয়ে সংস্কার করে শষ্য উৎপাদন উপযোগী হলে পর তা হতে কর আদায় করা হত এবং কর আদায়েও কোন প্রকার জুলুম নির্যাতনের নাম গন্ধ থাকত না। ইবনে সাদ বলেন, তিনি ইরানের শাসনকর্তা আদী ইবনে আরতাতকে লিখেছিলেন, যিম্মি অথবা অমুসলিম প্রজাদের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে।
তাদের যদি কেউ বার্ধক্যে উপনীত হয় এবং তার কোন মাল না থাকে তাহলে সরকারী কোষাগার হতে তাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করবে।
যে সকল যিম্মি রুগ্ন, আতুর, পঙ্গু বা অন্য কোন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগতো তাদের সম্পর্কে এরূপ নির্দেশ ছিল।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুর আজিজ কখনও ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। আল মাওয়ারিদের ভাষ্য অনুযায়ী জিযিয়া সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত ছিল যে, যে সমস্ত লোক সুস্থ, সামর্থবান, বুদ্ধিমান এবং স্বাধীন তাদের নিকট হতেই শুধু জিযিয়া আদায় করা হবে।
দরিদ্র বা যে কোন কাজ করতে অসমর্থ বা যারা কাজ পায় না বেকার তারা জিযিয়া হতে মুক্ত ছিল। অন্ধ, খঞ্জ এবং অন্যান্য রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে জিযিয়া হতে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। গীর্জার পাদ্রিদের নিকট হতে কোন জিযিয়া আদায় করা হত না।
কাজী আবু ইউসুফ এবং ইয়াহইয়া ইবনে আদাম বলেন যে, জিযিয়া ধার্য্য এবং তা আদায়ের জন্য নাগরিকদেরকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছিল।
সাধারণ নাগরিক- বার্ষিক ১২ দেরহাম (বর্তমান হিসেবে মাসিক চার বা আট আনা)। মধ্যম- ২৪ দেরহাম বার্ষিক (মাসিক আট আনা বা এক টাকা)।
ধনী ব্যক্তি- বার্ষিক ৪৮ দেরহাম (মাসিক একটাকা বা দুই টাকা)।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের নির্দেশক্রমে ইসলামের বুনিয়াদি মূলনীতি রাষ্ট্রে সর্বত্রই অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হয়েছিল। ইবনে সাদের ভাষ্য অনুযায়ী শুধু একটি স্থানের লোক হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের নিকট অভিযোগ করেছিল যে, তার একজন কর্মকর্তা তাদের প্রতি কঠোর ব্যবহার ও অত্যাচার শুরু করেছে।
খলীফা তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, আমার এই চিঠি পাওয়া মাত্রই লোকের উপর সকল প্রকার নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করে দিবে- আমি এটা পছন্দ করি না।
কোন যিম্মি অমুসলিম নাগরিকের প্রতি কোন প্রকার অন্যায় অবিচারও তিনি পছন্দ করতেন না। যদি কোন মুসলমান কোন যিম্মির উপর কোন প্রকার জুলুম করত অথবা কোন নৈতিক অপরাধ করত তখণ তিনি ইসলামের বিধান অনুযায়ী তার শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, একবার তিনি জানতে পারলেন যে, হিরার কোন মুসলমান একজন যিম্মিকে অনর্থক হত্যা করেছে। তিনি সেখানকার শাসকেকে নির্দেশ দিলেন যে, হত্যাকারীকে নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসদের নিকট সোপর্দ করে দাও এবং তাদেরকে এ অধিকার দাও “তার সাথে তারা যা ইচ্ছা করতে পারবে। ইসলামের দন্ডবিধি যে, প্রত্যেক হত্যাকারীকে নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসদের নিকট হাজির করা হবে যদি তারা ইচ্ছা করে তাহলে তাকে হত্যা করতে পারে বা নগদ রক্তপণ গ্রহণ করে ক্ষমাও করে দিতে পারে। অতএব উক্ত ঘটনায় যিম্মিগণ হত্যাকারী ব্যক্তিকেও হত্যা করেছিল।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের নিকট মুসলমান অমুসলমান আইনের দৃষ্টিতে সকলই সমান ছিল। এমনকি তাঁর ছেলে অথবা নিকট আত্মীয় যদি অপরাধী এবং কোন অমুসলিম প্রজা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করত কখন তিনি আত্মীয় হিসেবে তার প্রতি কোন গুরুত্ব দিতেন না উভয়কে একই কাতারে দাঁড় করাতেন।
একবার তাঁর স্ত্রীর ভাই এবং সিংগ পুরুষ খলিফা আব্দুল মালেকের পুত্র মুসলিমার সাথে এক ঈসায়ীর ঝগড়া হয়েছিল তারা উভয়ে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের নিকট অভিযোগ করতে আসল। মুসলিম তার পদ-মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য করেই আসনে উপবেসন করল।
ইবনে জাওযি বলেন, তখন হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ বললেন, তোমার প্রতিপক্ষ আমার সামনে দন্ডায়মান, আর তুমি আসনে উপবিষ্ট! তুমি ইচ্ছা করলে তোমার পক্ষে উকীল নিযুক্ত করতে পার, কিন্তু বসার অধিকার পাবে না। এ কথা বলে তিনি মুসলিমাকে উঠিয়ে দিলেন। মনে হয় মুসলিমা তার দরবারে আসলে প্রথা অনুযায়ী স্বাভাবিক ভাবে তিনি তাকে বসতে দিয়েছিলেন।
কিন্তু যখন যে মুকদ্দমা দায়ের করল, তখন তিনি তাকে উঠিয়ে দিলেন। কারণ ইসলামের বিধানানুসারে বাদী-বিবাদী উভয়ে সমান। কারোও কোন আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই।
ইবনে জওযি বলেন, মুসলিমা উঠে গিয়ে অভিযোগের প্রতি পক্ষের বিরুদ্ধে একজন উকীল নিযুক্ত করল। উকীল বিবাদীর মত তার সামনে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য পেশ করল। খলিফা উভয়ের বক্তব্য শুনলেন এবং যেহেতু মুসলিমার প্রতিপক্ষের দাবীতে যুক্তি ছিল কাজেই তিনি তার শ্যালকের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করলেন।
ইবনে জওযি আরও বলেন, হেমছের এক বৃদ্ধ যিম্মি খলিফার নিকট উপস্থিত হয়ে খলিফার ভ্রাতুস্পুত্র আব্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, সে তার জমি জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ আব্বাছের নিকট এর কারণ জিজ্ঞাস করলে সে বলল যে, আমি এ দলিলের মাধ্যমে তার মালিক হয়েছি।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ ব্যতীত অন্য কোন শাসকর্তা হলে হয়ত এ দলিলের সম্মান করে সেটা আইন সিদ্ধ মনে করত এবং যিম্মিকে ফিরিয়ে দিত। কিন্তু ন্যায়পরায়ণ খলিফা প্রকৃত তথ্য জেনে যিম্মিকে নিরাশ করলেন না বরং উক্ত জমি আব্বাছের নিকট হতে ফেরত নিয়ে যিম্মিকে প্রদান করলেন। ইবনে জওযি এ ঘটনা ব্যক্ত করার পর বলেন যে, তাঁর বা তাঁর পরিবারবর্গের নিকট জুলুমের যে সমস্ত মালামাল ছিল, তিনি তা সব কিছুই প্রকৃত মালিকদেরকে ফেরত দিয়েছিলেন।
ইবনে জাওযি আরও বলেন, একবার জনৈক যিম্মি কৃষক এসে তাঁর নিকট অভিযোগ করল যে, তার এক সৈন্য বাহিনী তার শষ্যক্ষেতের উপর দিয়ে অতিক্রম করার ফলে তার সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তাকে দশ হাজার দেরহাম ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে আদেশ করলেন এবং নির্দেশ দিলেন, যাতে এই জুলুম আর কখনও না হয়।
ঐতিহাসিক বালুজুরী এ প্রসঙ্গে আরও দু‘ একটি উদাহরণ পেশ করেছেন, তার মধ্যে একটি ঘটনা ঘটেছিল যখন দামেস্কের খৃষ্টানরা অভিযোগ করল যে, বনু নছর বংশের দখলকৃত সমস্ত গীর্জাই তাদের সম্পত্তি। এগুলো তারা ফেরত পেতে চায়। আর তার প্রমাণ হিসেবে হযরত খালেদ (রা) এর ঐতিহাসিক চুক্তিপত্র দাখিল করল। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ এ চুক্তিপত্র দেখে বুঝলেন যে, তাদের অভিযোগ যথার্থ। সুতরাং তিনি এ গীর্জাসমূহ এবং সংশ্লিষ্ট জমিও তাদেরকে দিয়ে দিলেন। অনুরূপ অপর একটি জায়গীর গীর্জার বলে দাবী করা হল, এবং এটা গীর্জার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ এ ক্ষেত্রে ঈসায়ীদের দাবী মেনে নিয়ে মুসলমান জায়গীরদারের নিকট হতে জায়গীরটি খৃষ্টানদেরকে ফেরত দেওয়ার আদেশ দিলেন।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ ঈসায়ীও অন্যান্য যিম্মিদেরকে যে সুযোগ সুবিধা প্রদান করেছিলেন এতে তারা বিশেষভাবে আবিভূত হয়ে পড়েছিল। তারা তার নিকট এমন কতগুলি সমস্যা তুলে ধরল, যেগুলো তাঁর পূর্ববর্তী খলিফাগণ চুড়ান্ত মীমাংসা করেছিলেন। যেমন দামেস্কের ইউহান্না গীর্জার ব্যাপারেও খৃষ্টানরা নতুন করে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের নিকট দাবী উত্থাপন করল। ব্যাপারটি খুবই জটিল ছিল। বিচার-বিশ্লেষণে খৃষ্টানদের দাবী যথাযথ প্রমাণিত হল। ওয়ালিদ গীর্জার যে অংশে মসজিদ নির্মাণ করেছিল তা হযরত খালেদ কর্তৃক বিজয়ের সময় যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল সেই অনুযায়ী তা খৃষ্টানদের অধিকারে ছিল। মুসলমান জনসাধারণ হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের ইনছাফের কথা বিবেচনা করে তাদের উকীল দাঁড় করাল। উকীলরা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল যে, দামেস্কের বাইরে সমস্ত গীর্জাই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন দায়ের মারানের গীর্জা, তুমা রাহেব ইত্যাদি গীর্জা সমূহ হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদের সাথে খৃষ্টানদের সম্পাদিত চুক্তিতে উল্লেখিত হয়নি। মুসলমান উকীলগণ আরও বললেন, যদি চুক্তি কার্যকরী করতেই হয় তাহলে আমরা সমস্ত গীর্জাই ফেরত দিব, তোমরা এই ইউহান্না গীর্জার যে অর্ধেকের উপর মসজিদ নির্মিত হয়েছে তার দাবী ত্যাগ কর। কথাটি খুব যুক্তি সঙ্গত ছিল। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ খৃষ্টানদের নিকট এ প্রস্তাব করলেন। তারা তিন দিনের সময় চেয়ে নিল এবং চতুর্থ দিনে এসে এ শর্তে তাদের দাবী পরিত্যাগ করল যে, বাইরের সমস্ত গীর্জায় তাদের অধিকার স্বীকৃত হবে এবং এ ব্যাপারে একটি লিখিত চুক্তিও সম্পাদন করতে হবে।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তাদেরকে একটি চুক্তিপত্র লিখে দিলেন, সমস্যা সমাধান হয়ে গেল। যদি এভাবে এই সমস্যার সমাধান না হত তাহলে তিনি অনর্থক মসজিদ ধ্বসিয়ে দিতেও কোন প্রকার ইতস্ততঃ করতেন না।
যিম্মিদের সম্পর্কে তিনি খুরাসানের শাসনকর্তা উকবার নিকট যে পত্র লিখেছিলেন, তা দিয়ে যিম্মিদের সম্পর্কে তার অনুসৃত নীতি স্পষ্ট হয়ে যায়। আমরা পাঠকদের অবগতির জন্য নিম্নে উক্ত পত্রের মর্মার্থ উল্লেখ করলাম। ভূমিকর আদায়ের ভদ্রতা ও ন্যায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। কখনও বাড়াবাড়ি করবে না। যদি এরূপ কর্মচারীদের বেতন ভাতা প্রদান করার মত অর্থ আদায় হয়ে যায় তবেই যথেষ্ট। আর তা না হলে আমার কাছে পত্র পাঠাবে আমি কেন্দ্র হতে অর্থের ব্যবস্থা করব।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, তার পূর্বকার উমাইয়া শাসনকর্তাগণ যেখানে কর বৃদ্ধি করতে প্রশাসকদেরকে নির্দেশ দিতেন এবং এটা সুলায়মান পর্যন্তই পালিত হয়ে আসছিল এবং অত্যন্ত অন্যায়ভাবে কর বৃদ্ধি করা হত। যিম্মিদের প্রতি তাদের কোন সহানুভূতিই ছিল না। সে ক্ষেত্রে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ সে আমদানী এ পরিমাণ হৃাস করতেও রাজি ছিলেন যাতে কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও চলত না। তার মতে দেশে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করাই সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য, অর্থ উপার্জন বা আমদানী বৃদ্ধি নয়। যেসব শাসক ও আদর্শ অনুসারণ করেন তারা আমদানীর হ্রাস বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য করেন না।
বন্দীদের অবস্থার সংস্কার
বর্তমানে ইউরোপের বিশেষ করে উন্নতিশীল কোন কোন দেশের সরকার বন্দী ও সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের অবস্থার সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সংস্থা খুলে রেখেছে। আধুনিক যুগের লোকদের ধারণা যে, মানবীয় সহনুভূতি এবং পাপী আত্মার প্রতি এ ধরণের অন্তরঙ্গতা এ যুগেরই একটি আবিস্কার। এ সমস্ত লোক জানেনা যে, ৯৯ হিজরীর উমাইয়া সাম্রাজ্যের খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ ছিলেন এ জাতীয় নিপীড়িত মানবতার প্রতি সর্বপ্রথম ভ্রাতৃত্বের হস্ত সম্প্রাসারিতকারী। যারা স্বাভাবিক দুর্বলতা এবং ভ্রান্ত শিক্ষার শিকারে পরিণত হয়ে বিভিন্ন প্রকার অন্যায় কাজে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে এবং অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের স্টীম রোলারে নিষ্পেষিত হতে থাকে। কথিত আছে যে, হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ সাধারণ অপরাধে অপরাধী এক লক্ষ লোকের বুকের তাজা রক্ত হাত রঞ্জিত করেছিল। সে সাধারণ ত্রুটি-বিচ্যুতির দরুন দলে দলে মানুষকে জেলখানায় বন্দী করে রাখতো। ঐতিহাসিক ইয়াকুবি অভিযোগ করেছেন যে, ওয়ালিদের মত ব্যক্তি ও সাধারণ সন্দেহের কারণে লোককে বন্দী করে শাস্তি প্রদান করত।
এমনকি বিনা বিচারে মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করত না। সুলায়মান ও তাদের শাসনকর্তাদেরও একই নীতি ছিল। উসামা ইবনে যায়েদ তামহী ইয়াযিদ ইবনে মাহলাব, মুখাল্লাদ, আব্দুর রহমান, আশআছ এবং এ জাতীয় অন্যান্য উমুরী শাসকগণ সাধারণ অপরাধে জনসাধারণকে কঠোর ও নির্মম শাস্তি প্রদান করত। তাদের চোখ বন্ধ করে অন্ধকারে প্রকাষ্ঠে আবদ্ধ রাখত, তাদের হাত পা কেটে দেওয়া হতো এবং তাদের দ্বারা ঘানি টেনে অনাহারে রাখা হতো। নিম্নমানের জেলে তাদেরকে বন্দী করে রাখা হত। যদি কোন আসামী মারা যেত তবে দাফন কাফনহীন অবস্থায় তার লাশ কয়েকদিন পড়ে থাকত। অসহায় কয়াদীগণ ভিক্ষা সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গীর লাশের সৎকার করত। যে সমস্ত শাসক মনুষত্বের মূল্য বুঝত না যারা বিনা কারণে হাজার হাজার লোককে মজবুত সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই তরবারীর আঘাতে মৃত্যুর দুয়ারে পৌছে দিত, তারা এ সমস্ত হতভাগ্য মানুষের অবস্থা-উন্নয়নের জন্য কিরূপ লক্ষ্য করবে? মানুষের প্রতি সহানুভুতি, তদুপরি অপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা শুধু সৎ সাহস ছিল না যে, তারা প্রতিপক্ষের কঠোর সমালোচনা সহ্য করে তাদের তরবারী কোষবদ্ধ করে রাখবে।
ঐতিহাসিক ইবনে কুতাইবা কবি ফারজদাকের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, একবার খলীফা সুলায়মানের নিকট কিছু বন্দী আনা হল। সুলায়মান পরীক্ষামূলক ফারজদাকের হাতে তরবারী তুলে দিয়ে বললেন, এদের কাউকে হত্যা কর। কবি হাত উঠালেন বটে কিন্তু হাত কাঁপতে লাগলো। তরবারীও কাঁপতে লাগলো। এটা দেখে সুলায়মান ও তার পরিষদবর্গ হাসতে লাগল।
এরা বন্দী ছিল বটে তাবে শরিয়তের বিচারে মৃত্যুদন্ড দেয়ার উপযোগী অপরাধী ছিল না। সুলায়মান এটা দ্বারা শুধু তার সাহস পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
অন্য ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, সুলায়মানের নিকট বন্দীদের জীবনের কোন মূল্যই ছিল না। তারা অতি সহজেই তাদেরকে হত্যা করে ফেলতো। তারা তাদের উন্নতির ও প্রগতির জন্য কিরূপ দৃষ্টিপার করবে?
যদি বাস্তবতার অনুসন্ধান করা যায় তবে জানা যাবে যে, সে যুগে এ মানব সন্তানরা সব চেয়ে বেশী নিপীড়িত নির্যাতিত ছিল। যদি মানবীয় দুর্বলতা বা অন্য কোন অপরাধে তারা সামান্যতম অপরাধীও সাব্যস্ত হত তবে যালেম উমুবী শাসকরা তাদেরকে পুতিগন্ধময় মৃত্যু গহবরের মত অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী করে রাখতো। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজই সর্বপ্রথম এ নির্যাতিত মানব সন্তানদের প্রতি করুণার হাত প্রসারিত করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম অপরাধের সীমা নির্ধারণ করে শরিয়ত অনুমোদিত সর্বপ্রকার শাস্তির প্রথা রহিত করেন এবং শাসকদের লিখেছিলেন যে, আল্লাহর সীমার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে, কাকেও শরিয়ত অননুমোদিত শাস্তি প্রদান করবে না।
ইতিপূর্বে শাসনকর্তাদের হিসাব নিকাশ অধ্যায়ে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ লিখিত কয়েকটি চিঠির মর্মার্থ উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে তিনি বারবার তার কর্মকর্তাগণকে এ কথাই হৃদয়ঙ্গম করাতে চেয়েছেন যে, শরিয়তের নির্ধারিত শাস্তিই প্রদান করবে। নিজের পক্ষ হতে নতুন কোন শাস্তি প্রদান করবে না, এমনকি তিনি শুধু সন্দেহের কারণে ভালভাবে অনুসন্ধান ব্যতীত অপরাধী কর্মকর্তাগণকে শাস্তি দিতে পছন্দ করতেন না।
মদীনার গভর্ণর ইবনে হাজম একবার হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজকে লিখলেন যে, কোন কোন কর্মচারীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। যদি আপনার অনুমতি হয় তাহলে আমি তাদেরকে অপরাধ স্বীকার করতে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারি। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তাকে যে ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন, তার দ্বারাই তাঁর অনুসৃত কর্মপদ্ধতি স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি তাকে লিখলেন-
আশ্চর্যের কথা হলো তুমি মানুষকে শাস্তি দেয়ার জন্য আমরা অনুমতি চেয়েছ? হয়ত তোমার বিশ্বাস, আমার এ অনুমতি তোমাকে আল্লাহর রোষ ও গজব হতে রক্ষা করবে।
মনে রেখ, যদি তোমার নিকট এমন কোন স্পষ্ট প্রমাণ থাক যে, অমুকের নিকট কোন কিছু প্রাপ্য, তাবে তা আদায় করে নিও বা যদি কেউ স্বেচ্ছায় কিছু স্বীকার করে তাহলে তাও গ্রহণ কর। কিন্তু যদি কেউ অস্বীকার করে এবং কসম করে তাহলে তাকে ছেড়ে দাও।
এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয়, হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ এ কর্মপদ্ধতি সেসব কর্মকর্তাদের বেলায়ও ছিল যাদের বিরুদ্ধে বায়তুল মালের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের কাছে মুসলমানদের বায়তুলমালের হেফাজত করা অতীত পবিত্র দায়িত্ব হিসেবেই বিবেচিত ছিল। এ অর্থ আত্মসাতের কল্পনা করাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এহেন বিরাট অভিযোগের পর তিনি কর্মকর্তাদের প্রতি কোন প্রকার কঠোরতা করতে নিষেধ করতেন। কারণ তার মতে অপরাধ অবশ্যেই শাস্তিযোগ্য। কিন্তু তাঁর নিকট এটা মোটেই পছন্দনীয় ছিল না যে, তাঁর পক্ষ হতে বা তাঁর কর্মকর্তাদের পক্ষে হতে এমন কোন কঠোরতা প্রকাশ করা হোক যা শরিয়ত বিরোধী।
তিনি হাজ্জাজের পরম দুশমন ছিলেন, কারণ সে আল্লাহর প্রদত্ত সীমালংঘন করে আল্লাহর বান্দাগণকে শাস্তি দিত। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ যার হাতে ইরাকের শাসনভার ন্যস্ত করেন তাকে বার বার লিখে হাজ্জাজের অনুকরণ হতে বিরত করেছিলেন। ইরাকের দুজন শাসনকর্তা ছিলেন। একজনকে দেওয়া হয়েছিল অর্থ বিভাগের দায়িত্ব আর অপর জনকে সামরিক বিভাগের দায়িত্ব। তারা উভয়ই তাকে পরামর্শ দিতেন যে, অপরাধ প্রতিরোধের জন্য অপরাধীকে হত্যা করা প্রয়োজন, তা না হলে অপরাধ কমবে না। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তাদের এ পরামর্শের দরুন তাদের প্রতি এমন কঠোর ভাষা ব্যবহার করলেন যে হয়ত আর কখনও কোন গভর্ণরের প্রতি এই ধরনের ভাষা ব্যবহৃত হয়নি।
তিনি লিখলেন- দুটি নীচ ব্যক্তি তাদের নীচতা ও অভদ্রতার দরুন আমাকে মুসলমানদের পবিত্র রক্তে হাত কলংকিত করতে পরামর্শ দিচ্ছে।
এটা কত কঠোর পত্র। মনে হয় তাদের চিঠি তার ধমনীতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গে প্রবেশ করে দিয়েছিল। অপরাধীকে তার অপরাধের তুলনায় অধিক শাস্তি দেয়ার কথা তিনি মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। তিনি মিশরের শাসনবর্তাকেও এ কথাই লিখেছিলেন।
মানুষকে তাদের অপরাধ অনুযায়ীই শাস্তি দিবে, যদি তা একটি বেত্রাঘাতও হয়। কাউকে শাস্তি দিতে আল্লাহর সীমা লংঘন করবে না।
অপরাধের তুলনায় বেশি শাস্তি দেয়া নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বন্দীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন এবং সে যুগের জেলাখানাগুলোকেও তিনি বর্তমান ইউরোপ-আমেরিকার জেলখানা থেকে উন্নত করলেন। অপ্রশস্ত কক্ষের পরিবর্তে প্রশস্ত ও খোলা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে নির্মান করলেন। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করলেন। প্রত্যেক প্রাদেশিক গভর্ণরকে লিখলেন যে, প্রত্যেক সপ্তাহে স্থনীয় জেলখানায় উপস্থিত হয়ে স্বয়ং কয়েদীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবে এবং তাদের অভিযোগ শুনবে।
ইবনে সা’দ ইবনে উবায়দের ভাষ্য বর্ণনা করে বলেছেন যে, হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ সকল প্রাদেশিক গভর্ণরকে বন্দীদের সম্পর্কে যে ফরমান লিখেছিলেন তাতে এ নির্দেশও ছিল তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিবে না। তাদের মধ্যে যারা অসুস্থ তাদের সেবা শুশ্রুসার ব্যবস্থা করবে, যার কেউ নেই বা যার কোন অর্থ সম্পদ নেই তাদের দেখা শুনা করবে।
যারা অভাবের দরুন ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় বন্দী হয়েছে, তাদেরকে অন্যান্য নৈতিক অপরাধে অপরাধীদের সঙ্গে একই জেলখানা বা বন্দী শিবিরে রাখবেন। মহিলাদের জন্য পৃথক জেলখানার ব্যবস্থা করবে। আর যাদেরকে হিসাব নিকাশের দায়িত্ব দিবে তাদের অবশ্যই নির্ভরযোগ্য হতে হবে তারা যেন ঘুষ গ্রহণ না করে। যারা ঘুষ বা উত্কুচ গ্রহণ করে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবে এবং দায়িত্ব হতে সরিয়ে দিবে।
ইবনে সা’দ বলেন, হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের এ নির্দেশ সকল সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিকটই একটি গুরত্বপূর্ণ ফরমান হিসেবে বিবেচিত ছিল। অন্য কথায় হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের এই নির্দেশে বিভিন্ন অপরাধীদের জন্য বিভিন্ন প্রকার জেলখানা নির্মিত হল। নৈতিক অপরাধীদের জন্য পৃথক জেলখানা, ঋণ খেলাপীদের জন্য পৃথক মহিলাদের জন্য পৃথক জেলখানা নির্মিত হল।
বিশ্বের ইতিহাসে বন্দীদের অবস্থার সংস্কারের জন্য এটাই ছিল সর্বপ্রথম পদক্ষেপ। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের পূর্বে বন্দীদের অবস্থার উন্নতির জন্য এরূপ নির্দেশ আর কোন শাসনকর্তাই জালী করেননি।
এটা ছিল একটি মৌলিক সংস্কার। দ্বিতীয়ত: তিনি প্রত্যেক বন্দীর জন্য ভাতা নির্ধারণ করে তাদের দুরাবস্থার সংস্কার সাধন করেছিলেন। তাদের এ ভাতা অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের মত নিয়মিত প্রদান করা হতো।
মদীনার শাসনকর্তা ইবনে হাজম বলেন, আমরা হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের নির্দশ বন্দীদের রেজিষ্টার নিয়ে জেলখানায় উপস্থিত হতাম এবং তাদেরকে ভাতা দেয়ার জন্য জেলখানার বাইরে নিয়ে আসতাম।
কাজী আবু ইউসুফ এ ব্যাপারে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের এ আদেশ নকল করেছেন। যার ভিত্তিতে তিনি নিম্নলিখিত সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করে এ সম্পর্কে যে নির্দেশনামা প্রস্তুত করেছিলেন নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১। বন্দীদের উপর কোন প্রকার কঠোরতা করা যাবে না।
২। তাদের সেবা-শুশ্রুষা করতে হবে, অসুস্থ হলে তার চিকিত্সার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। যে বেড়ী পরালে নামায পড়তে অসুবিধা হয়, মুসলমান বন্দীদের এ ধরণের কোন বেড়ী পরান যাবে না।
৪। রাতে প্রত্যেক বন্দীর বেড়ী ও হাতকড়া খুলে দিতে হবে যাতে তারা আরাম করে শয়ন করতে পারে।
৫। প্রত্যেক বন্দীর জন্য এ পরিমাণ ভাতা দিতে হবে যাতে তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে।
৬। প্রত্যেক বন্দীর নিজ নিজ ভাতা গ্রহন করার ও খাদ্য তৈরি করে খাওয়ার অনুমতি থাকবে।
৭। জেলখানায কোন খাদ্য তৈরি করা চলবে না, কারণ জেলের কর্মচারীরা ভাল খাদ্য তৈরি করতে পারে না।
৮। জেলের কর্মচারীদেরকে বিশ্বস্ত, সহানুভুতিশীল ও সৎ হতে হবে। তাদের নিকট সকল বন্দীর নাম ঠিকানা থাকতে হবে।
৯। প্রত্যেক মাসেই তারা বন্দীদের নামের তালিকা অনুযায়ী তাদের মাসিক ভাতা নিয়মিত আদায় করবে। প্রত্যেক বন্দীকে নিজের নিকট ডেকে এনে তার হাতেই তার ভাতা প্রদান করবে।
১০। শীতের দিনে প্রত্যেক বন্দীকে একটি কম্বল, একটি জামা এবং গরমের দিনে একটি জামা ও একটি লুঙ্গি দিতে হবে।
১১। মহিলা বন্দীদেরকে প্রয়োজনীয পোষাক ব্যতীত ও একটি অতিরিক্ত চাদর দিতে হবে।
১২। সরকারী ব্যয়ে মৃতদের কাফন ও দাফন করতে হবে।
১৩। সরকারী ব্যয়ে রোগীদের চিকিত্সার ব্যবস্থ করতে হবে।
এ নির্দেশনামার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল যে, শুধু যে সমস্ত অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, তাদেরকেই বন্দী করা হবে। আর যার অপরাধ প্রমান হয়নি, শুধু সন্দেহের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বন্দী করে রাখা যাবে না।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের এ নির্দেশনামার পরিপ্রেক্ষিতে সে যুগের জেলখানাসমূহ শিক্ষাগারে পরিবর্তিত হয়েছিল, ফলে প্রত্যেক কায়েদী জেলখানা হতে একজন উন্নত নাগরিক হিসেবে বের হত। জেলের তত্ত্বাবধায়ক তাদের শিক্ষা দীক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা করতেন। তাদের চিকিত্সার ব্যবস্থা করতেন এবং তাদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতার মনোভাব সৃষ্টি করে দিতেন। একমাত্র হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বন্দী ছাড়া অন্য কারো প্রতি কঠোর ব্যবহার করতে দিতেন না। হত্যাকারীকে তার অনুমতি ক্রমে বেড়ী পরান হত। কারণ হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের মতে হত্যা একটি জঘন্যতম ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ছিল। তিনি মুসলমান বা যিম্মি কাউকেও হত্যা করতে ঘৃণা বোধ করতেন। যে ব্যক্তি এ অপরাধ করত, তিনি তাকে ক্ষমা করতেন না। সে যেই হোক না কেন, কিন্তু তাদের অপরাধ প্রমাণিত হবার পরই শুধু তাদেরকে বেড়ী পরান হত। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের নির্দেশ ছিল যে,
জেলখানার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখবে। আর জেলে শুধু ঐসব লোককেই রাখবে যাদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত না হলে কাউকে জেলে কাউকে জেলে আটক রাখা যাবে না। সমগ্র সাম্রাজ্যে তার এ নির্দেশ পালিত হয়েছিল এবং এই নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী সর্বত্রই তাকে প্রাণে ভরে দোয়া করছিল। আর তার অযাচিত করুণার জন্য নিজ অপরাধ হতে তাওবা করে নিজেকে সংশোধিত করে নিত।