ওমর ইবনে আবদুল আজিজের জুলুম প্রতিরোধ
ইসলামী জীবনবিধান তথা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কেবল সে সমস্ত লোকই রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার অধিকারী যারা নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে সাধারন মানুষের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেয় এবং যারা সাধারণ মানুষের মত যে স্তরে থাকবে তারা সেই স্তরেই থাকবে।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ,অবশ্যই অবগত আছেন যে, মহানবী (সা) নিজে তাঁর কর্মময় জীবনে এর বহু দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন। ইবনে সা’দসহ অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ সাক্ষ্য দেন যে, রাসুলূল্লাহ (সা) সর্বদাই নিজের দলের অভাবী লোকদের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের উপর প্রাধন্য দিয়েছেন। যদি সাধারণ মানুষ অনাহারে থাকত তিনিও অনাহারে থাকতেন। তিনি অন্ন-বস্ত্র এবং বাস্থান কোন দিক দিয়েই সাধারন মানুষ হতে উচ্চস্তরে অবস্থান করতেন না। সাধারণ লোকেরা যা খেত, সাধারণ মানুষ যা পরিধান করত তিনিও তাই খেতেন ও পরতেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সাধারন ভাবে জীবনযাপন করেছেন। তার ঘরের চার দেওয়াল ছিল মাটির, ছাদ ছিল খেজুর পত্র ও খড়ের, তাঁর ঘরে কোন খাট পালঙ্ক ছিল না। তিন দিন পর্যন্ত তার ঘরে চুলা জ্বলত না। জীবনে তিনি কখনও পেট ভরে আহার করেনিনি। ইবনে সা’দ বর্ণনা করেছেন হযরত আয়েশা (রা) যিনি সবচেয়ে প্রিয়ধর্মিনী ছিলেন। তিনি কসম করে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কখনও খেজুরন ও পানি অথবা রুটি ও পানি দিয়ে পেট ভরে আহার করেননি এবং তাঁর এ অভ্যাস মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল।
হযরত আবু বকর (রা) খেলাফতে আসন অলংকৃত করার পর তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাত অনুসরণ করে জীবন যাপন করেছেন। যাদের উপর শাসন করার জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনিও তাদের কাতারে এসে যোগদান করেছিলেন। তিনি তাঁর সোয়া দুই বছর খেলাফতের সময়ে কখনও সাধারণ নাগরিকদের প্রয়োজনের চেয়ে নিজের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেননি। সাধারণ মানুষ যা খেত, পরিধান করত তিনিও সেরূপ খাওয়া পরা করতেন, সাধারণ মানুষ যেস্থানে বসবাস করত তিনিও সেরূপ স্থানে বসবাস করতেন।
হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর যুগ অত্যন্ত প্রাচুর্য্য ও সুখ-সমৃদ্ধির যুগ ছিল। তাঁর যুগে মানুষের জীবনযাত্রার মান বহুলাংশে উন্নীত হয়েছিল। কোন মুসলমানই তখন অনাহারে ও বস্ত্রাভাবে জীবন যাপন করেনি। সকলেই দুই বেলা খাওয়া এবং সাধারণভাবে পোষাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করতে পারত। এজন্য হযরত ওমর (র) তার পূর্বর্তী বুজুর্গদের মত অনাহরি থাকতেন না, তিনি তিন দিন পর্যন্ত উপবাস করতেন না, বস্ত্রহীনও থাকতেন না এবং মুক্ত আকাশের নীচেও শয়ন করতেন না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সর্বসাধারণের মতই জীবন অতিবাহিত করেছেন। মোটা আটার রুটি খেতেনে, তৈল, সিরকা এবং শুকনো গোশত ছিল তাঁর সাধারণ খাদ্য। তাঁর পরিধেয় বস্ত্রে বেশ কয়টি তালি থাকত।
যদিও তিনি ভাতা রেজিষ্ট্রারের তালিকায় ৩৯ ক্রমিক নম্বরের অধিকারী ছিলেন। যদিও তিনি বদরী সাহাবীরেদ মত ভাতা গ্রহণ করতনে তথাপি তার জীবন যাপন প্রণালী ছিল সাধারণ মানুষের মত।
হযরত আলী (রা)-এর জীবনও সাধারণ মানুষের জীবনের মত অনাড়ম্বর ছিল। তিনি যে কাপড় পরিধান করতেন তার মূল্য চার দেরহামের বেশি ছিল না। তিনি যে খাদ্য খেতেন তার চাকর-বাকররাও তা পছন্দ করত না। তিনি সাদারণ মানুষের দ্বারা নির্বাচিত খলিফা হওয়ার ফলেই তার ভাল খাদ্য ও ভাল পোষাক পরিধান করার কোন অধিকার আছে বলে তিনি মনে করতেন না।
তিনি যে পোষাক পরিধান করতেন তা দেখে কোন অপরিচিতলোক তাঁর ও সাধালন মানুষের মধ্যে কো পার্থক্য করতে পারত না। একবার কোন এক আীর তাকে দীন মজুর মনে করে তার মাথায় বোঝা উঠিয়ে দিয়েছিল।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবা, হযরত আবু বকর (রা) হযরত ওমর (রা) হযরত উসমান (রা) এবং হযরত আলী (রা) এ চার মহাপুরুষের জীবনের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, এ চারজনের কেউই কোন দিক দিয়ে নিজেদেরকে সাধারণ মানুষের চেয়ে উন্নত মনে করতেন না এবং নিজেদের সন্তান বা পরিচনের প্রয়োজনকে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের উপর প্রাধাণ্য দিতেন না।
এ সম্পর্কে ইমাম তিরমিযি (র) একটি স্পষ্ট উদাহরণ দিয়েছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা)-এর কন্যা হযরত ফাতেমা (রা) পানি উঠাতে উঠাতে হাতে কড়া পড়ে গিয়েছিল, তিনি রাসূলূল্লাহ (সা)-এর নিকট একজন দাসীর জন্য আবেদন করেছিলেন। দেয়ার মত দাসীও ছিল তবুও মহানবী (সা) তার আবেদন গ্রহণ করে বললেন, কোন আনসারী স্ত্রী আমার নিকট দাসীর জন্য আবেদন করেছিল, তাদের প্রয়োজন তোমার পূর্বে পূরণ করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা) যে ক্ষেত্রে তার প্রাণপ্রিয় কন্যার প্রয়োজনকে আনসারদের স্ত্রীদের প্রয়োজনের উপর প্রাধান্য দেননি। সেক্ষেত্রে তরই স্থলাভিষিক্ত হযরত আবু বকর, ওমর ফারুক, উসমাণ যিন্নুরাইন ও আলী (রা) কখনও নিজেদের প্রয়োজনকে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের উপর প্রাধান্য দেননি। যদি তারা এমন কিছু করতেন তাহলে ইতিহাসের সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তারা সমালোচনার উর্ধ্বে থাকতে পারতেন না।
আমাদের দাবী হলো, একমাত্র ইসলামই এমন একটি জীবন ব্যবস্থা যা সাধারণ মানুষের উপর বিশিষ্ট লোকদের কখনও প্রাধান্য দেয় না। ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মহানবী (সা) এবং তাঁর সাহাবীগণও ইসলামের পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নের পর তারা নিজেদেরকে সাধারণ মানুষের চেয়ে উন্নত মনে করেননি এবং তাঁদের পরও যারা ইসলামের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁরাও তাঁদের নিজেদেরকে অথবা তাদের সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনকে কোন দিক দিয়েই প্রাধান্য দেননি।
তাঁদের ধারণা রাষ্ট্রীয় কোষাগার ছিল আল্লাহপাকের তরফ হতে একটি পবিত্র আমানত। আল্লাহর রসূল (সা) এবং তাঁর সযোগ্য খলীফাগণ রাষ্ট্রীয় ধন ভান্ডারকে সাধারণ মুসলমানদের সম্পদ মনে করতেন। তাঁরা নিজেদেরকে সে ধন ভান্ডারের একজন বিশ্বস্ত সংরক্ষণকারী মনে করতেন। তাঁরা এমন চরিত্রবান ছিলেন যে, তাদের কোন প্রকার খেয়ানত সম্পর্কে কারও মনে কোনরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। একজন সাধারণ নাগরিক সে কোষাগার হতে যেটুকু পাবার অধিকারী ছিল তারাও তার চেয়ে এর অতিরিক্ত কিছু পাবার অধিকারী ছিলেন না।
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে উবাইদের বর্ণনা মতে, রসূলুল্লাহ (সা) শাসনকর্তাদের মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করার মত অর্থই শুধুমাত্র তাদেরকে কোষাগার হতে গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এর অতিরিক্ত এক পয়সা নেয়া তাঁর মতে খিয়ানতের শামিল ছিল।
আমানত ও খিয়ানতের এ ধারণা ইসলামের একটি মৌলিক ধারণা। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর খেলাফতের পরেই এই ধারণা সম্পূর্ণভাবে শক্তি প্রয়োগ করে খেলাফত লাভ করেছিলে। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত ছিলেন না বলেই সরকারী কোষাগারকে সর্বসাধারণের সম্পদের হিসেবে মনে না করে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেছিলেন। কোসাগার থেকে তিনি যা ইচ্ছা গ্রহণ করতেন। বিলুপ্ত হয়ে যায়। হয়তো উমাইয়া খলীফা আবদুল মালেক যাকে উমাইয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তার বংশের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমীর মুয়াবিয়া (রা)-এর চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রচেষ্টা করেছিলেন। এজন্য তিনি আমীর মুয়াবিয়া (রা)-এর চেয়ে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। তার সন্তান সন্ততি বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন এবং পরিবার পরিজনদের জন্য সরকারী কোষাগা হতে যথেচ্ছাভাবে ব্যয় করেছেন। রাজ্যের আমদানী হতে যা ইচ্ছা গ্রহণ করেছেন। তিনি বসবাসের জন্য সুউচ্চ প্রাসদ নির্মাণ করেছিলেন, খাটপালঙ্ক ইত্যাদি তৈরী করেছিলেন, রেশমী বস্ত্র পরিধান করেছেন এবং সর্বসাধারণের ধন-ভান্ডারকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেই তা থেকে খরচ করেছেন।
বাস্তবিক পক্ষে এটাই কি ইসলামের বিধান ছিল? না কখনই এটা ইসলামের বিধান ছিল না। তিনি নিজেও তো উপলব্ধি করতেন, কিন্তু তিনি আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের আদর্শের সামনে নিজেকে জওয়াবদিহী করতে হবে এ কথা ভাবতে পারিনি। উদাহরণ স্বরূপ ইবনে কাছীর আবদুল মালেক সম্পর্কে ইবনুল আরাবীর নিম্ন ভাষ্যীট বর্ণনা করেছেন। (আরবী**************)
অর্থাৎ আবদুল মালেক যখন খলীফা মনোনীত হলেন তখন তার নিকট একখানা কোরআন শরীফ ছিল। তিনি তাকে বন্ধ করে দিয়ে বললেন, এটাই আমার ও তোমার শেষ বিদায়।
অন্য এক বর্ণনায় আছে- (আরবী************)
অর্থাৎ এটাই তোমার শেষ সাক্ষাত।
আবদুল মালেক খেলাফতের আসন গ্রহণ করার পূর্বেই আল্লাহর কিতাবের সম্পর্কে ত্যাগ করেছিলেন। অথচ ইবনে কাছীরের বর্ণনা মতে, খলীফা হবার পূর্বে যখন আবদুল মালেক মদীনায় অবস্থান করতেন তখন তিনি আল্লাহভীরুতা ও সংযম শীলতার কারণে মদীনার বিশিষ্ট আলেমদের মধ্যে গণ্য ছিলেন।
অপর এক বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত ইবনে জুবাইর শহীদ হবর পর আবদুল মালেক হজ্জের সময় এক সাধারণ ভাষণে বলেছিলেন যে, আমার পূর্ববর্তী খলীফাগণ নিজেরা খেতেন, অপরকে খাওয়াতেন,কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি একমাত্র তরবারীর সাহায্যে এ উম্মতের চিকিৎসা করব।
ইবনে কাছীর স্পষ্টই উল্লেখ করেছেন যে, আবদুল মালেক একজন রক্ত পিপাসু বাদশাহ ছিলেন। তিনি অগণিত লোককে হত্যা করেছিলেন। তারই প্রতিনিধ হাজ্জাজ অনর্থাক লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল।
আবদুল মালেক ও তার প্রতিনিধি হাজ্জাজ এ দুজন যার প্রতি অসন্তুষ্ট হতেন-তার সম্পদ কেড়ে নিতেন এবং তাকে হত্যাও করা হতো, আর তারা দু’জন যার প্রতি সন্তুষ্ট হতেন তাকে সরকারী ধনভান্ডার খুলে দিতেন।
এখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজের সামনে দু’টি মাত্রা পথই খোলা ছিল। হয়তো তিনি তাঁর পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করবেন অথবা আল্লাহর রাসুল (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের পথ অনুসরণ করবেন।
তিনি আল্লাহর রাসূল (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের পথকে বেছে নিলেন এবং আবদুল মালেকসহ অন্যান্য শাসকগণ যে সমস্ত অন্যায় অবিচার, জুলুম করেছিল তিনি সেই সবের প্রতিকার বিধান করলেন। তিনি নিজ হস্তে এর সূচনা করেছিলেন।
ঐতিহাসিক ইবনে সা’দের বর্ণনায় জানা যায় যে, ইবনে সুহাইল বলেছেন, আমি ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে তার ঘর হতে জুলুম প্ররোধ ও সংস্কারের সুচনা করতে দেখেছি। সর্বপ্রথম তিনি নিজের পরিবারের লোকদের জুলুম অত্যাচার প্রতিরোধ করে অন্য লোকদের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিনে। আবু বকর ইবনে বুসরা বলেন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ যখন জুলুম অত্যাচার প্রতিরোধ ও লন্ঠিত ধন-সম্পদ ফেরত দিতে শুরু করলেন, তখন তিনি বললেন, সর্বপ্রথম আমার নিজের পক্ষ থেকেই শুরু করা উচিত। সুতরাং তিনি নিজের অধিকারভুক্ত ধন-সম্পরেদ হিসাব করে তার কাছে স্থাবর-অস্থাবর যে সমস্ত ধন-সম্পদ ছিল তিনি তা মুসলমানগণকে ফেরত দিয়ে দিলেন, এমনকি ওয়ালিদ তার প্রাচ্যদেশীয় আমদানী থেকে তাকে একটি আংটি উপহার দিয়েছিলেন, তাও খুলে তিনি বায়তুল মালে জমা দিলেন।
ইবনে জাওযি বলেন, যে রাত্রিতে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খেলাফতের মসনদে বসলেন সে রাতেই তার ঘর হতে ক্রন্দনের শব্দ পাওয়া গেল। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, তিন যখন তার বাদীগণকে অনুমতি দিলেন যে, তারা ইচ্ছা করলে থাকতে পার, আর ইচ্ছা করলে চলেও যেতে পারে। কেননা আমি এমন এক দায়িত্বের বোঝা গ্রহণ করেছি যে, এরপর আর তাদের প্রতি ফিরে তাকাতে সয়ম পাবনা। যে চায় আমি তাকে মুক্ত করে দিতে প্রস্তুত, আর যে চায় সে থাকতে পারে কিন্তু আমার সাথে করও কোন সম্পর্ক থাকবে না।আমার উপর কোন নাশা ভরসাও করতে পারবে না।
একথা শুনে বাঁদীরা কাঁদতে লাগল।
একনে জাওযির অপর এক বর্ণনায় জানা যায় যে, বর্ণনাকারী বলেন, আমি এবং ইবনে আবু যিকর হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের বাড়ীর কাছে উপস্থিত ছিলাম, আমরা তার ঘরের কান্নার আওয়াজ শুনে তার কারণ জিজ্ঞেস করলে লোকেরা বলল, খলীফা তার স্ত্রীকে এ অধিকার দিয়েছেন যে তুমি ইচ্ছা করলে এ ঘরে থাকতে পার, ইচ্ছা করলে তোমার পিত্রালয়ে চলে যেতে পার। কারণ আমি যে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি এরপর স্ত্রীলোকের প্রতি আমার সাধারণ আসক্তিটুকুও আর নেই।
এ কথা শুনে খলীফার স্ত্রী ক্রন্দ করতে লাগলেন এবং তাঁর ক্রন্দনের ফলে তাঁর বাঁদীরাও ক্রন্দন করতে লগল।
এ ভদ্র মহিলাই দোর্দন্ড ও প্রতাপশালী খলীফা আব্দুল মালেকের সর্বধিক প্রিয়তমা কন্যা ছিলেন। তিনি পূর্ববর্তী দু’জন খলীফঅ ও সুলায়মানের ভগ্নি ছিলেন। তিনি যে ভোগ বিলাসের জীবন অতিবাহিত করেছেন সে যুগে আর কারও ভাগ্যে জুটেনি।
ইবনে জাওযি এ রাতের একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ওমর ইবনে আবদুল আজীজের স্ত্রী ফাতেমার একটি সুন্দরী দাসী ছিল। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তাকে খুব ভাল বাসতেন। খলীফা হবার পূর্বে তিনি স্ত্রী ফাতেমার নিকট বহুবার এ দাসীটি চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তার এ ব্যর্থতা দাসীর প্রতি তাঁর আকর্ষণকে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছিল। তারপর তিনি যখন খলীফা মনোনীত হলেন তখন ফাতেমা তাকে বললেন, আমি সে দাসীটি আপনাকে দান করে দিলাম। এতে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি ফাতেমাকে বললেন, তাকে আমার নিকট পাঠিয়ে দাও। ফাতেম তাকে খুব ভালরূপে সজ্জিত করে তার নিকট পাঠিয়ে দিলেন। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাতে দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি দাসীকে তার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ এক কর্মচারীর উপর জরিমানা করে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল, আমিও তার অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। তারপর হাজ্জাজ আমাকে খলীফা আবদুল মালেকের নিকট পাঠিয়ে দিলেন এবং তিনি তাঁর স্নেহাধিক কন্যা ফাতেমাকে দান করলেন।
এই ঘটনা শুনে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খুব ব্যথিত হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হাজ্জাজ যে কর্মচারীর প্রতি কঠোর ব্যবহার করেছিল সে কী জীবিত আছে? দাসী বলল, উক্ত কর্মচারী মারা গিয়েছে তবে তার সন্তানগণ জীবিত আছে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ উক্ত দাসীকে বিদায় করে দিয়ে কুফায় শাসনকর্তাকে লিখে পাঠালেন যে, অমুকের পুত্রকে আমার নিকট পাঠিয়ে দাও। তারপর সে ব্যক্তি ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট এসে উপস্থিত হল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার পিতার বাজেয়াপ্ত সমস্ত সম্পত্তি সাথে এ দাসীটিও ফেরত দিলেন। ইবনুল জাওযি আরও বলেন যে, তাঁর মৃত্যু পর্য়ন্ত এই দাসীর মহব্বত তার অন্তরে একটা স্থান দখল করে রেখেছিল কিন্তু এরপর তিনি আর কখনও এই দাসীর সাথে সাক্ষাত করেননি।
ইবনে কাছীরের বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার ব্যক্তিগত যে সব সম্পত্তি কোষাগারে জমা দিয়েছিলেন তন্মধ্যে ফাদাকের বাগানটি জমা দেয়ার কথা ঘোষণা করে বলন, ফাদাক রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ছিল। তিনি আল্লাহর নির্দেশ মতই তার আমদানী ব্যয় করতেন। তারপর হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত ওমর (রা) এরূপ করেছেন। কিন্তু মারওয়ান ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে তা দখল করে ভোগ করেছিল এবং তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির একাংশ আমিও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। ওয়ালিদ এবং সুলায়মানও তাদের অংশ আমাদে দান করেছেন। কাজেই আমি আমার সেসব সম্পত্তি সরকারী কোষাগারে ফেরত দিচ্ছি তর চেয়ে অপবিত্র আর কোন সম্পত্তি নেই। আমি যা বায়তুলমালে জমা দিচ্ছি, রাসূলূল্লাহ (সা) যেভাবে এটা ব্যয় করতেন এটা সেভাবেই ব্যয় করা হবে।
অপর একটি বর্ণনায় জানা যায় যে, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ শুধু স্থাবর সম্পত্তি ও নগদ অর্থই বায়তুলমালে জমা দেননি, তিনি তাঁর স্ত্রীর মূল্যবান অলংকারদী এবং পোষাকাদী পর্যন্ত বায়তুলমালে জমা দিয়েছেন।
ইবনুল কাছীর বলেন, তিনি খেলাফতের পদ লাভ করার পূর্বে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির আয় ছিল বার্ষিক চল্লিশ হাজার দীনার বা স্বর্ণমুদ্রা। এ সবই বায়তুলমালে জমা দিয়েছেন, অথচ তার অনেক সন্তানাদী ছিল, কয়েকজন স্ত্রী ছিলেন এবং এক স্ত্রী তো ছিলেন একজন বিশিষ্ট শাহজাদী।
এভাবে তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ শুরু করলেন এবং নিজবংশের সমস্ত জবর দখলকৃত সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে সরকারী কোষাগারে জমা দিলেন। তিনি রাজ্যের সমস্ত প্রাদেশিক শাসককর্তাগণকে লিখলেন যে, আমার পূর্বে যে স্থানেই কোন জুলুম অত্যাচর করে মানুষের সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে তা তাদেরকে ফেরত দেয়া হোক।
ইবনে সা’দ ইবনে যুহাইলের একটি ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, “ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যখন তাঁর নিজের ও নিজের বংশের ধন-সম্পদদের হিসাব-নিকাশ করে তাদের অপবিত্র বায়তুলমালে জমা দিলেন তখন ওয়ালিদের এক পুত্র তার বংশের লোকদের বললেন, তোমরা ওমর ইবনে খাত্তাবের বংশের একজন লোককে খলীফা মনোনীত করেছ অতএব তিতিনও তাঁর মতই করেছেন।”
উদ্দেশ্যে ছিল যে, ওমর ফারুকের সন্তানগণ তাদের পূর্ব পুরুষের নির্দেশিত পথ পরিত্যাগ করবেন না। আমরাও ইতিপূর্বে ওমর ইবনে আবদুল আজিজের বাল্যজীবন বর্ণনার সময় তাঁর কথা লিখেছি যে, তিনি যখন আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-এর নিকট হতেতার মাতার নিকট ফিরে আসতেন তখন বলতেন, “মা আমিও আপনার চাচার মত হতে চাই।”। তিনি খলীফা মনোনীত হবার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-এর পুত্র সালেমের নিকট এমন ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন।
ইবনে কাছীর বলেন, হযরত ওমর ইবনে আজীজ সালেম ইবনে আবদুল্লাহকে বলেন যে, আার জন্য ওমর চরিত রচনা করুন, আমি সে অনুযায়ী কার্য্যক্রম চালাব। সালেম বলেন, আপনি পারবেন না। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জিজ্ঞেস করলেন আপনি সেটা কিভাবে বুঝলেন? সালেম কথার মোড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে বললেন, যদি আপনি সে অনুযায়ী কাজ করেন তাহলে হযরত ওমর(রা) কেও হারিয়ে দিবেন, তাঁর চেয়েও উত্তম আদর্শ সৃষ্টি করতে পারবেন। কারণ তার যুগে সৎকর্মে সহযোগিতাকারী লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু আপনার কোন সাহায্যকারী নেই।
সালেম যদিও সত্য কথা বলেছিলেন যে, সৎকর্মে তাঁর কোন সাহায্যকারী নেই কাজেই তিনিও হযরত ওমর (রা) হতে পারবেন না। কিন্তু ইতহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি হযরত ওমর (রা)-এর পদ্ধতি অনুসরণ করে চলতে অপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ফলে তিনি বিশ্বে দ্বিতীয় ওমর হিসেবে খ্যাতি লাভ করে অমর হয়ে রয়েছে।
ইবনে সা’দ বলেন, হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রা)-এর পর হতে জনগণের প্রতি বনু উমাইয়াদের যে সমস্ত অন্যায় অবিচল চলে আছিল হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সেগুলোর সংস্কার সাধন করলেন এবং সে যুগ হতে যে সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠিত হয়ে আসছিল, তাও তিনি ফেরত দিলেন। অর্থাৎ বনু উমাইয়ার লোকেরা অন্যায়ভাবে যে সমস্ত ধন-সম্পদ উপার্জন করেছিল অথবা পূর্ববর্তী খলীফাগণ মুসলমান জনসাধারণের সম্পদ হতে তাদেরকে যা দান করেছিল ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সেসব মুসলমানদের ফেরত দিয়েছিলেন।
ইবনে কাছীরের ভাষ্যটি হলো- (আরবী*******************)
অর্থাৎ ওমর ইবনে আবদুল আজিজ হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর পর হতে তার যুগ সৃষ্ট সকল প্রকার অবিচারের সংস্কার সাধন করলেন। এমনকি হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর উত্তরাধিাকরীদের দ্বারা লণ্ঠিত জনসাধারণের সকল অধিকার আদায় করে দিলেন।
দামেশক ছাড়াও মক্কা, মদীনা, ইয়ামেন, তায়েফ, ইরাক এবং মিশরের যে সব স্থানে লণ্ঠিত সম্পদ জমাকৃত ছিল তা হিসেব অনুযায়ী নিজ নিজ মালিককে ফেরত দেয়ার জন্য হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (র) অন্যায় ভাবে অর্জিত ও লন্ঠিত সমস্ত সম্পদ বায়তুলমালের জমা করে দিলেন এবং বায়তুলমালে যে সমস্ত অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদ অথবা লন্ঠিত সম্পদ ছিল তাও তিনি তার প্রকৃত মালিককে ফেরত দিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে যে কয় বছর সে মাল বায়তুলমালে জমা ছিল সে কয় বছরের যাকাত রেখে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে এ নির্দেশ সংশোধন করে শুধু চলতি বছরের যাকাত রেখে দিতে নির্দেশ দিলেন।
আবু জুনাদ বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (র) ইরাকের অন্যায় অবিচার প্রতিরোধ করতে আমাদেরকে আদেশ দিলেন, তার এই আদেশ কার্যকরী করতে গিয়ে প্রকৃত হকদারের হক আদায় করতে করতে বায়তুলমাল খালি হয়ে গেল। অতঃপর প্রশাসনিক ব্যয় বহন করার মত আর কোন অর্থই বায়তুলমালে থাকল না, সুতরাং হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সিরিয়া হতে ইরাকে অর্থা পাঠিয়ে দিলেন।
আবু জুনাদ আরও বলেন যে, সত্ত্বাধিকারীদে সত্ব ফিরিয়ে দিতে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সাক্ষ্য প্রমাণের কড়াকড়ি করলেন না, বরং নিপীড়িত জনতার নিপীড়ন প্রতিরোধ পথ সহজ করে দিলেন। তিনি নিপীড়নের কারণ অবগত হলেই তার লন্ঠিত সম্পদ ফিরিয়ে দিতেন তাকে অকাট্য প্রমাণাদী সংগ্রহ করতে বলতেন না।
ইবনে হাজম বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাদেরকে লিখে পাঠালেন যে, “আমি যেন কোষাগারের হিসাব করে তার পূর্বে প্রত্যেক মুসলমান ও জিম্মিদের সম্পদের পরিসংখ্যান করি এবং যদি কোন মুসলমান বা কোন জিম্মির প্রতি কোন অন্যায় করা হয়ে থাকে তবে আমি যেন তার ক্ষতি পূরণ ফিরিয়ে দেই। যদি নির্যাতিত ব্যক্তি ইন্তেকাল করে থাকে তবে তার প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে ফিরিয়ে দিততে নির্দেশ দিলেন।”
ইবনে সা’দ বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ইবনে হাজমকে এবং তৎকালীন সবচেয়ে বড় বড় ফকীহগণকে লিখেছেন যে, তাদেরকে মানুষের কাছে গিয়ে অভিযোগ শুনতে বলেন। কেই যদি সে উমাইয়্যা বংশেরও হয়, তবুও যেন তারা তাকে কোন প্রকার ছাড় না দেন এবং হিসাব নিকাশের সময় যেন খলীফার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি বিশেষ কড়াকড়ি ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। যেহেতু ঝগড়ার সময় তারা অধিক শক্তি প্রয়োগ করে থাকে।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ নিজেও এ মূলনীতি সামনে রেখেই কাজ করেছিলেন। ইবনুল জাওযি বলেন, একবার কয়েকজন গ্রাম্যলোক এসে তার আদালতে অভিযোগ করল যে, ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালেক তার খেলাফরেত সময় তার এক টুকরো জমি কেড়ে নিয়ে খলিফার পরিবারের লোককে দিয়েছেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার এ দাবীর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে বললে সে বলল এটা একটি অনাবাদি ভূমি ছিল, আমিই সর্বপ্রথম এটা আবাদ করেছি। তখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের রাসূলুল্লাহ (সা) এর এই ফরমান স্মরণ হয়ে গেল- (আরবী*********************)
অর্থাৎ জমি আল্লাহর, বান্দাও আল্লাহর, অতএব যে ব্যক্তি অনাবাদী ভূমি আবাদ করবে সে ঐ ভূমির মালিক হবে।
সুতরাং মহানবী (সা)-এর এই নির্দেশ অনুাযায়ী হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ গ্রাম্য লোকটির দাবী মেনে নিলেন।
ইবনুল জাওযি বলেন, খলিফা সুলাইমানের দাফন কার্য শেষ করে শাহী প্রাসাদে এসেই হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জুলুম অবিচার প্রতিরোধ শুরু করে দিলেন। তিনি সমস্ত পর্দা, গালিচাসহ সকল আসবাবপত্র বিক্রয় করে তার বিক্রয়লব্ধ র্থ বায়তুলমালে জমা দিলে।
ইবনুল জাওযির অপর একটি বর্ণনায় জানা যায় যে, সুলায়মানের দাফন শেষ করে পরবর্তী দিন হতেই তিনি জুলুম অত্যাচার প্রতিরোধ করতে শুরু করে দিলেন। ফজরের নামাযের পূর্বেই তিনি ঘোষক ওয়াবেককে শহরের অলিগলিতে এ বলে ঘোষণা করতে নির্দেশ দিলেন যে, যার প্রতি কোন প্রকার অন্যায় অবিচার করা হয়েছে সে যেন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কাছে এসে তার আবেদন পেশ করে।
এ ঘোষণা শুনে সর্বপ্রথম হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কাছে অভিযোগ পেশ করেছিল হেমসের অধিবাসী একজন অমুসলিম জিম্মি। সে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কাছে এসে আবেদন করল যে, আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী আমার অভিযোগের ফয়সালা করুন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার অভিযোগ জানতে চাইলে সে বলর, আব্বাছ ইবনে ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালেক তার এক টুকরা জমি জবরদস্তিমূলক দখল করে নিয়েছিল। আব্বাছও সেস্থানেই উপস্থিত ছিল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আব্বাছকে জিজ্ঞেস করলেন যে, এ সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কি? আব্বাছ বলল, খলিফা ওয়ালীদ আমাকে এ সম্পত্তি দান করে দানপত্র লিখে দিয়েছিলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যিম্মিকে জিজ্ঞেস করলে সে তার দাবীরি পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করল। সুতরাং হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার দাবী মেনে নিয়ে আব্বাছকে তার জমি ফেরত দিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন।
অপর এক বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যখন জুলুম প্রতিরোধ শুরু করলেন তখনও জোহরের সময় হয়নি। তিনি সমস্ত লোককে মসজিদে একত্রিত করে তাদের সামনে মুজাহিমকে তাঁর নিজের সম্পত্তির দলীল সমূহ এক এক করে পাঠ করতে বললেন। ইবনুল জাওযি বলেন, মুজাহিম এক একটি দলীল পাঠ করত আর হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ নিজের হাতে প্রত্যেকটি দলীল কাচি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতেন। এত হলো দলীল দস্তাবিজের কথা । তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আবদুল মালেকের নিকট খুব মূল্যবান একটি মতি ছিল। তার পিতা আবদুল মালেক এটা তাকে দিয়েছিলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ফাতেমার নিকট এ মতিটি চেয়ে বললেন, তুমি দু’টি বিষেয়ে একটি বেছে লও। হয়তো এ মতি বাইতুল মালে জমা দাও আর না হয় আমাকে অনুমতি দাও যে, আমি তোমা হতে পৃথক হয়ে যাই। কারণ এ মতি থাকা অবস্থায় তোমার সাথে একই ঘরে অবস্থান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ফাতেমা নিবেদন করলেন, আমি মতির চেয়ে আপনাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। এক একটি মতি কেন? এরূপ যদি হাজার মতি আমার থাকত তবু আমি আপনাকেই প্রাধান্য দিতাম। অতএব হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মতি এনে বাইতুলমালে জমা করে দিলেন।
ইবনুল জাওযি একটি দীর্ঘ ঘটনার মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন যে, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এখনও জুলুম প্রতিরোধের কাজ শুরু করেননি। সূচনাতেই তিনি তার প্রাধান উপদেষ্টা ও ব্যক্তিগত খাদেম মুজাহিমকে বললেন যে, পূর্ববর্তী খলিফাগণ আমাকে এমন কিছু সম্পত্তি দিয়ে দিয়েছেন-প্রকৃত পক্ষে আমি সে সবের মালিক নই এবং সেসব দান গ্রহণ করাও আমার পক্ষে উচিত নয়। এখন যেহেতু আমি খলিফা কাজেই সে সমস্ত সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ করা প্রয়োজন। এতে মুজাহিম তার উদ্দেশ্যে বুঝতে পারল এবং সে তাকে বলর, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার সন্তানদের কি উপায় হবে? তিনি বললেন, তাদের জীবিকার ব্যবস্থা আল্লাহই করবেন। একথা মুজাহিমের মনোপুত হল না, সে তার পুত্র আবদুল মালেকের নিকট গিয়ে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল। আবদুল মালেক পিতার কসে এসে বললেন, আপনি যা সংকল্প করেছেন, যথা শীঘ্র সম্ভব তা বাস্তবায়ন করুন। আপডনি আমাদের জন্য কোন চিন্তাই করবেন না। দীনের কাজে বিলম্ব করা আল্লাহ পছন্দ করেন না। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার পুত্র আবদুল মালেকের এ কথায় অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তার কপালে চুম্বন করলেন এবং আল্লাহ তাঁকে এমন সৎ সন্তান দান করেছেন এজন্যে তিনি তাঁর শুকরিয়া আদায় করলেন।
খলিফা সুলায়মান মৃত্যুর পূর্বে গাসবা ইবনে সায়াদ ইবনে আছকে বিশ হাজার দীনার দান করে একটি দানপত্র লিখে দিয়েছিলেন। এ দানপত্র বিভিন্ন দপ্তরে অতিক্রম করে কোষাধ্যক্ষের নিকট এসে সীলমোহার হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গাসবার হাতে পৌছার পূর্বেই সুলাইমান ইন্তেকাল করলেন।
সুলায়মানের দাফনের পর দ্বিতীয় দিন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের খেলাফতের প্রথম দিন গাসবা তাঁর নিকট আসল, তখন উমাইয়অ বংশের সকলেই ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কাছে সমবেত ছিল। উমাইয়া বংশের লোকেরা গাসবাকে দেখে ভাবল যে, গাসবা খলিফার পরম বন্ধু। দেখা যাক খলিফা তার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করে। তারপর তাঁর সঙ্গে তারা নিজেদের ব্যাপারে কথা বলবে।
তাদের সামনেই গাসবা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কক্ষে প্রবেশ করল এবং বলল জনাব, খলীফা সুলায়মান আমাকে কিছু দীনার দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ নির্দেশ কোষাগারে এসে পৌঁছেছে। আপনার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তাতে আমি অবশ্য আশা পোষণ করি যে, আপনি তা বরাদ্দকৃত দীনার দেওয়ার নির্দেশ দিবেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জিজ্ঞেস করলেন, কত টাকা? গাসবা বলল, বিশ হাজার দীনার। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, বিশ হাজার দীনারতো চার হাজার মুসলমান পরিবারের জন্য যথেষ্ট। এটা তোমাকে দেয়া কিভাবে সম্ভব? এত বিপুল পরিমাণ অর্থ আমি একজনকে কিভাবে দেব? আল্লাহর কসম! এটা আমার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়।
গাসবা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের উত্তর শুনে রাগে শাহী দানপত্র মাটিতে ছুড়ে মারল। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, দানপত্র নষ্ট না করে যত্নের সাথে রেখ। হয়তো আমার পর এমন কেউ আসবে যে এর যথাযথ মূল্যায়ণন করবে। গাসবা অতিযত্নে সেই দানপত্রটি রেখে দিল। আর যেহেতু হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের পক্ষে তার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল কাজেই তাকে খোঁচা দিয়ে বলল, হুজুর এইত কথা হল, কিন্তু “জাবালুল ওয়ারাস” সম্পর্কে আপনি কি করবনে? হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের জাবালুল ওয়ারস নামে একটি বড় জায়গীর ছিল। তিনি এ কথা শুনে গাসবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বললেন, তুমি আমাকে খোচা দিচ্ছ।
তারপর তিনি তার ছেলেকে ডেকে দলীল-দস্তাবেজ আনতে নির্দেশ দিলেন। পুত্র সিন্দুক এনে হাজির করল। তিনি জাবালুল ওয়ারসের দলীলসহ সমস্ত দলীল দস্তাবেজ ছিড়ে ফেললেন। গাসা এ দৃশ্য দেখে বাইরে অবস্থানরত উমাইয়া বংশের লোকদেরকে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল। তারা গাসবাকে অনুরোধ করল যে, তুমি ভিতরে গিয়ে আমাদেরকে ঘরে ফিরে যেতে অনুমতি এনে দাও। গাসবা ফিরে গিয়ে উমাইয়াদের পক্ষে আপনার বংশের লোকেরা বলছে যে, আপনার পূর্বে তাদেরকে যে ভাতা প্রদান করা হতো তা যথারীতি আদায় করতে নির্দেশ দিয়ে তাদেরকে বাধিত করুন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, আল্লাহর কসম! এটা আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় এবং আমি এমন করতে পারব না! তখন গাসবা বলল, তবে আপনি তাদেরকে অন্য কোতায়ও চলে যেতে অনুমতি দিন। তারা জীবিকার জন্য কোন উপায় বের করে নিক।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, তারা যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পারে, আমার পক্ষ হতে কোন প্রকার বাধা বিঘ্ন নেই। তারপর গাসবা আবার বলল, তবে আমাকেও অনুমতি দিন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, তুমিও যেতে পার। তবে আমি মনে করি তুমি একজন সম্পদশালী লোক, তুমি এখানে থাকলে ভালই হত, কারণ আমি সুলায়মানের পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিক্রয় করে দেব। তুমি ইচ্ছা করলে তা হতে এমন কিছু জিনিস পত্র ক্রয় করতে পার যা পরে বিক্রয় করলে লাভবান হবে। অতঃপর গাসা সেখানেই অবস্থান করল এবং হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সুলায়মানের পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিক্রয় করার সময় গাসবা এক লক্ষ দীনারের মাল ক্রয় করে ইরাকে নিয়ে গিয়ে দুই লক্ষ দীনার বিক্রয় করল।
ন্যয় ও সুবিচারের ভিত্তিতে যে শাহী ফরমান জারী হয়নি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট তা একেবারে মূল্যহীন ছিল।
ইবনে হাকাম তার পূর্বেকার নিবর্তন মূলক শাহিী ফরমানের প্রতি তাঁর অশ্রদ্ধার আরোও একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। “ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালেকের” রুহ নামক একটি ছেলে ছিল। গ্রামে লালিত পালিত হওয়ার ফলে তাকে গ্রাম্য বলেই মনে করা হত। কিছু লোক হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট এসে অভিযোগ করল যে, হেমছের সারাইখানা ওয়ালিদ ইবনে মালেক তার পুত্র রুহকে প্রদান করেছিলেন। এখনও রুহ সেগুলো দখল করে ভোগ করে চলছে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রুহকে এ সমস্ত সারাইখানা প্রকৃত মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। রুহ আবেদন করল যে, ওয়ালিদ এ সব সারাইখানা আমাকে যে দানপত্র লিখে দিয়েছেন তা এখনও আমার নিকট আছে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, ওয়ালিদ লিখিত দানপত্র তোমার কোন উপকারেই আসবে না। কারণ এ সমস্ত সারাইখানা যে তাদের, এ সম্পর্কে তারা প্রয়োজনীয় স্বাক্ষী প্রমাণ সংগ্রহ করেছে।
বর্ণনাকারী বলেন রুহ হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের এ নির্দেশকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে হেমছের অধিবাসীদের সারাইখানা ফেরত দিতে অস্বীকার করল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এ ঘটনা জানতে পেরে শহররক্ষী প্রধান কাবকে বললেন যে, তুমি এখনই রুহের নিকট চলে যাবে, যদি রুহ সরাইখানার দখল ছেড়ে প্রকৃত মালিকদের ফেরত দিয়ে থাকে তবে তো ভালই, অন্যথায় তুমি তার শিরচ্ছেদ করবে। ঘটনাক্রমে উক্ত মজলিসে এক ব্যক্তি হেমছে গিয়ে রুহকে এই সংবাদ অবহিত করল। অতঃপর কাব যখন তার নিকট সারাইকানা উন্মুক্ত তরবারী হাতে উপস্থিত হল, এর পূর্বেই সে সমস্ত সারাইখানা ফেরত দিয়ে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের প্রতিশোধ হতে আত্মরক্ষা করল।
গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে, রুহ ছিল ওয়ালীদের পুত্র এবং ওয়ালিদও তার পূর্বে একজন পরাক্রমশালী খলীফঅ এবং তার পরম আত্মীয় ছিলেন। তবুও সত্য এবং ন্যায়ের খাতিরে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আত্মীয় ও রক্ত সম্পর্কের কোন মূল্যই দিলেন না। ইবনে হাকাম বলেছেন যে, রুহের মত উমাইয়ার বংশের আরো কিছু কিছু লোক হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের সংস্কারের পাল্লায় পড়েছিল এবং তিনি তাদের নিকট হতে বে –আইনি দখলকৃত সত্তর হাজার দীনার আদায় করে বাইতুল মালে জমা দিয়েছিলেন।
ইবনে হাকাম এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ববর্তী খলীফাগণ বনু উমাইয়ার লোকদের জন্য যেসব ভাতা বরাদ্দ করেছিলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাও বন্ধ করে দিরেন এবং তার এক ফুফুর ভাতাও বন্ধ করে দিলেন।
তাঁর এ ফুফু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করার জন্য এক রাতে তাঁর স্ত্রী ফাতেমার নিকট আগমন করলেন। তখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ শাহী কাজ কর্মে ব্যস্ত ছিলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর পুত্র এসে ঘর থেকে তাঁর ব্যক্তিগত প্রদীপ নিয়ে গেল। ফাতেমা বললেন, তিনি এ মাত্র শাহী কাজ কর্ম হতে অবসর হয়েছেন, ছেলে এসে তার ব্যক্তিগত প্রদীপ নিয়ে গিয়েছে। আপনি ভিতরে এসে অপেক্ষা করুন। অতঃপর তাঁর ফুফু ভিরতে এসে অপেক্ষা করতে থাকেন। এরপর দেখলেন, তিনি যে ঘরে এসে আহার করতে বসেছেন তার সামনে দু’ টুকরো রুটি, একটি লবণ ও সামান্য তৈল ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। ফুফু খাদ্যের এ আয়োজন দেখে বললেন, এসেছিলাম নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু কথা বলতে কিন্তু এখন দেখি তোমার সম্পর্কেই আমার প্রথম কথা বলতে হচ্ছে। অতঃপর তিনি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের খাদ্যের সমালোচনা করে বললেন, তুমি কি এর চেয়ে উন্নত মানের আহার্য গ্রহণ করতে পার না? তখন ওরম ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, “আমার শ্রদ্ধেয় ফুফু আম্মা! এর চেয়ে উন্নতমানের খাদ্য গ্রহণ করার মত অবস্থা যে আমার নেই। যদি আমার সামর্থ থাকত তবে নিশ্চয়ই আপনার কথা পালন করার চেষ্টা করতাম্”
তারপর তার ফুফু আলোচনা শুরু করে বললেন, “তোমার চাচা আবদুল মালেক জীবিতকালে আমার জন্য অনেক ভাতা বরাদ্দ করেছিলেন। তাঁরপর তোমার ভাই ওয়ালীদ তা আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছিল এবং সুলায়মানও বৃদ্ধি করে দিয়েছিল কিন্তু তুমি খলীফা হয়ে আমর সে ভাতা বন্ধ করে দিলে?”
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, ফুফুজান! আমার চাচা আবদুল মালেক এবং আমার ভাই ওয়ালিদ ও সুলায়মান আপনাকে সাধারণ মুসলমানদের সম্পদ হতে আপনার ভাতা বরাদ্দ করেছিল। এসব সম্পদ তো আমার নয়। আমি শুধু আমার সম্পদ আপনাকে দিতে পারি, যদি আপনি সুখী হন। ফুফু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি পরিমাণ সম্পদ আছে? তিনি বললেন, আমার বার্ষিক আমদানী দু’শত দীনার, আপনি তা গ্রহণ করুন। ফুফু বললেন, এতে আামর কোন উপকার হবে না। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, তা ছাড়া যে আমার কাছে আর কিছু নেই! তাঁর ফুফু এ কথা শুনে ফিরে গেলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মোটেই অসত্য কথা বলেননি। তার বার্ষিক আমদানী ছাড়া তাঁর অন্য কোন সম্পদ ছিল না। অথচ তিনি খলীফা হবার পূর্বে মিকিদা, জাবালুল ওয়ারস এবং ফাদাকের মত জায়গীর ছাড়াও ইয়ামামাতেও কয়েকটি জায়গীর ছিল। তিনি খলীফা মনোনীত হবার পর দ্বিতীয় দিন এ সমস্ত সম্পদ বাইতুলমালে জমা দিয়েছেন। তাঁর অধিনে ছিল একমাত্র সুয়াইদা নামক একটি ঝরণা তা হতেই তিনি বার্ষিক ১৫০ দীনার মূল্যের শষ্য পেতেন।
ইবনে জাওযি বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের এ ফুফুই একবার তাঁর বংশের পক্ষ হতে সুপারিশ করার জন্য তাঁর নিকট আসলেন। তিনি ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট বনু উমাইয়ার লোকদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করে বললেন, তোমার বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ হলো, তুমি তাদের রুজি কেড়ে নিয়েছ অথচ তুমি তা তাদেরকে প্রদান করনি। অন্যরা তাদেরকে এসব প্রদান করেছিল।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জবাব দিলেন, সত্য ও ন্যায় যা ছিল আমি তা করেছি। তারপর তিনি একটি দীনার, একটি আঙ্গার দানি ও এক টুকরা মাংস আনতে বললেন এবং অঙ্গারা দানিতে সে দীনারটি গরম করলেন। যখন তা খুবই গরম হয়ে গেল, তখন সেটা গোস্তের টুকরার উপর রেখে দিলেন। ফলে গোস্তের টুকরাটি যখন পুড়ে গেল তখন ওমর ইবনে আবদুল আজিকজ তাঁর ফুফুকে বললেন, ফুফূজান! আপনি কি আপনার ভাতিজাকে এরূপ কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচাতে চান না? তাঁর ফুফু লজ্জিত হয়ে বনু উমাইয়ার লোকদের নিকট ফিরে গেলেন এবং বললেন, তোমরা ওমর ইবনে খাত্তাবের ঘরে বিবাহ করবে অথচ তার মত সন্তান হলেও চিৎকার করবে। এখন তোমরা মজা বুঝ।
ইবনুল জাওযি বলেন গাসবা একবার ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট এসে আবেদন করল, যে আমিরুল মুমিনীন! আপনার পূর্ববর্তী খলীফাগণ আমার জন্য যে ভাতা বরাদ্দ করেছিলেন, আপনি তা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমার পরিবার পরিজনের জন্য সম্পদের প্রয়োজন আছে। আপনি অনুমতি দিলে আমি আমর জমিতে গিয়ে চাষাবাদ করে পরিবারের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতে পারি। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে অনুমতি দিয়ে বললেন, চলে যাও। সে যখন দরজায় উপস্থিত হল তখ তিনি তাকে ডেকে বললেন, যদি জীবিকা সংকীর্ণ হয় তবে মৃত্যূকে অধিক মনে করবে এতে জীবিকা প্রশস্ত হয়ে যাবে। আর যদি জীবিকা কিছুটা সংকীর্ণ মনে হয়ে আসবে।
সুলায়মানের এক পুত্র হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট অভিযোগ করলেন, তা যে ধন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছৈ তা অন্যায়ভাবে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছৈ। এ সম্পত্তির পক্ষে তার নিকট দলীল আছে। সে ওমর ইবনুল আবদুল আজিজকে সেই দলীলটি দেখাল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পূর্বে এই সম্পত্তি কার ছিল? সে বলল, হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, তবে তো এটা হাজ্জাজই পাবে। সে তোমার চেয়ে বেশি হকদার। সুলায়মানের পুত্র কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল, না এটা হাজ্জাজের ছিল না। এটা বায়তুল মালের ছিল। তখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, তবে মুসলমানগণই এর বেশি হকদার।
এইঅধিকর প্রশেনই হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের বংশের সমস্ত লোক তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিল। এ সব লোক প্রত্যেক দিন তাঁর নিকট প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাঁকে বুঝাতে চেষ্টা করত এবং তাদের দখলকৃত সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ না করতে তাঁকে পরামর্শ দিত।
একবার আবদুল মালেকের সব চেয়ে অহংকারী পুত্র হিশাম যে বনু উমাইয়ার শাহজাদার মধ্যে নিজেকে খেলাফতের সবচেয়ে বেশি হকদার মনে করত, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট তার সংশের পক্ষে মধ্যস্থতা করতে এসে একটি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে তাঁকে পরামর্শ দিল। সে বলল, আমার বংশের লোকেরা বলে, যে পর্যন্ত আপনার খেলাফতের সম্পর্ক তা আপনি যা ইচ্ছা করেন, তাতে তাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার পূর্ববর্তী খলিফাগণ যা করে গিয়েছেন, আপনি সেটা সে ভাবেই ছেড়ে দিন। এ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করবেন না।
যদি অন্য কোন রাজনীতিবিদ হত এবং ন্যায়নিষ্ঠ না হয়ে রাজনীতি প্রিয় হত তবে অবশ্যই এ মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা করত না। ফলে তার বংশের লোকেরাও খুশী হত এবং তাঁর উপর কোন অসন্তুষ্টও হত না। কিন্তু যেহেতু নিজেকে রক্সা করা বা বংশের লোকদের খুশী করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল শুধু ন্যায় ও সুবিচারের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা- যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন এবং তার দায়িত্বের উপরও কোন প্রকার অভিযোগ না ওঠে। এ জন্য তিনি হিশামকে জিজ্ঞেস করলেন, যদি আমার নিকট এরূপ দু’টি ফরমান আনা হয় একটি হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর লিখিত এবং অপরটি আবদুল মালেক লিখিত এবং উভয় ফরমান একই বিষয় সম্পর্কিত হয়, তবে তুমি আমাকে কোন ফরমান অনুযায়ী কাজ করতে পরামর্শ দিবে? হিশাম বলল, পূর্বেরটির। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, তবে আমি ঠিকই করেছি। যে সব বিষয় আমার নিকট বলছ তা আমার যুগেরেই হোক অথবা আমার পূর্বের যুগেরই হোক আমি তাতে আল্লাহর কিতাবের পরেই স্থান দিব।
হযরত ওসমান (রা) এর পৌত্র সায়ীদ ইবনে খালিদ উমাইয়া বংশের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনি খুব বিনয়ের সাথে হিশামের সমর্থন করে বলছিলেন যে, আমীরুল মুমিনীন! আপনার যুগের বিষয় সমূহেরই ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর থাকুন, আপনার জন্য কল্যাণকর হবে।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সায়ীদকে লক্ষ্য করে বললেন, “আল্লাহ তোমাকে সৎপথ প্রদর্শন করুন, আমরা সকলেই তাঁর নিকট ফিরে যাব। মনে কর, এক ব্যক্তি কয়েকটি ছোট বড় ছেলে রেখে ইন্তেকাল করল। বড় ছেলেরা তার শক্তিতে ছোটদেরকে নির্যাতন করে তাদের ধন সম্পদ আত্মসাত করতে লাগল, আর আমার নিকট ছোট ছেলেরা এসে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করল, এখন তুমি কি করবে? খালেদ বলল, ‘সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আমি বড়দের নিকট থেকে ছোদের হক আদায় করে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, আমিও দেখছি যে, আমার পূর্ববর্তী শসকগণ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, এমনকি তাদের অধীনস্ত লোকেরাও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই জনগণকে নির্যাতন করে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। অতএব আমার কাছে ক্ষমতা আসার পর সবল হতে দুর্বলের অধিকার আদায় করে দেয়া ছাড়া আমি অন্র কোন পথই দেখতে পাচ্ছি না।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যথার্থই বলেছিলেন, মূলত: এরূপই হয়েছিল। হযরত মুয়াবিয়অ (রা) এর স্থালাভিষিক্ত শাসকগণ বিশেষতঃ খলিফা আবদুল মালেক এবং তার উত্তরাধিকারীগণ সাধারণ নাগরিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, তাদের উত্তম ফসলোপযোগী জমিসহ অন্যান্য সহায় সম্পদ জোর করে দখল করেছিলেন। তারা সম্পূর্ণ ইরনী যুবরাজদের মতই জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। সাধারণ নাগরিক ও তাদের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান ছিল। মনে হত তারা যেন আকাশ হতেই জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং বাকী সব লোক মাটি থেকে জন্ম গ্রহণ করেছে। তারা স্বর্ণ রৌপ্য খচিত গদীতে আরাম করতেন, স্বর্ণের বাসনে খাদ্য খেতেন, রেশমী কাপড় পরিধান করতেন। তাদের কারও আস্তাবলে সুন্দর ঘোড়ার অভাব ছিল না। তাদের প্রাসাদ রঙধনুর মত উজ্জ্বল ঝলমলে ছিল। তাদের অন্তঃপুরে দুনিয়ার সেরা সুন্দরী মহিলাগণকে দাসী হিসেবে আনা হত এবং তোদের সাথে আনন্দ উপভোগকে শুধু শরিয়ত সম্মতই মনে করত না বরং গৌরব বলেই মনে করত।
ইবনুল জাওযি বলেন, একবার যুদ্ধক্ষেত্র হতে কয়েকজন সুন্দরী যুদ্ধবন্দিনী ওমর ইবনে আবদুল আজিজের সামনে আনা হল। যখনই কোন সুন্দরী মহিলাকে তার সামনে আনা হত তখনই ওয়ালিদের পুত্র আব্বাছ মুখে পনি উঠিয়ে বলত, আমিরুল মুমিনীন! আপনি স্বয়ং একে গ্রহণ করুন। এ কথা সে বার বার বলতে লাগল। এতে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে তিরস্কার করে বললেন, তুমি কি আমাকে ব্যাভিচার করার জন্য বলছ।
আব্বাছ যেরূপ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল, সে অনুযায়ী এটা ব্যাভিচার ছিল না। তার পিতা, তার চাচা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের অন্তঃপুরে এরূপ দাসীর অভাব ছিল না। সেও ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে সে কথাই বলেছিল- যা তার পিতা, দাদা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনকে করতে দেখেছে। কাজেই ওমর ইবনে আবদুল আজিজের ঘর হতে বের হয়ে গেল এবং দরজায় অবস্থানরত তার আত্মীয়-স্বজনকে দেখে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বলল, তোরা এ লোকের দরজায় এসে বসেছ, সে তো তোমাদের বাপ-দাদাকে ব্যাভিচারী বলছে।
আসলে এটা তার বাপ-দাদাকে ব্যাভিচারী মনে করার কথা নয়, প্রকৃত পক্ষে ইয়াযিদ হতে শুরু করে খলিফা সুলায়মান পর্যন্ত উমাইয়া বংশীয় যুবরাজগণ সম্পূর্ণরূপেই শরিয়ত বিরোধী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। তারা সমালোচনার উর্ধ্বে ছিল না। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপেই ইসলারেম পরিপন্থী ছিল।
ইসলাম এ জন্য আবির্ভূত হয়নি যে, কোন মানুষ অপর কোন মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করবে, আমীর লোকেরা অন্তঃপুর হাজারও সুন্দরী রমণী রেখে ভোগ বিলাস করবে আর সর্বসাধারলেনর সহায় সম্পদ জোর করে নিরেজ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বন্টন করে দিবে। অপরদিকে সাধারণ মানুষ ক্ষুধা দারিদ্রের কবলে নিষ্পেষিত হয়ে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করবে।
আল্লাহর কিতাব এবং মহানবী (সা) জীবনাদর্শ এরূপ জীবন উপভোগের অনুমতি দান করেনি বলেই হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ দাসী ব্যবহার করা থেকে বিরত ছিলেন।
যা হোক, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যখন খালেদকে এসব কথা বললেন, তখন সে নির্বাক হয়ে গেল এবং অবশেষে বলল, আল্লাহ আপনার সহায় হোন।
খালেদ অবশ্যই চরিত্রবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে সৎকর্ম করার জন্যে দোয়া করেই বিদায় হলেন। কিন্তু ওয়ালিদের পুত্র শাহী জীবন যাপরে অভ্যস্থ ছিল, সে কঠোর ভাষায় ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে তিরষ্কার করে তাঁকে একটি পত্র লিখল। ‘তুমি তোমার পূর্ববর্তী খলিফাদের দোষ-ত্রুটি খোঁজ করছ, তাদের উপর অভিযোগ দাঁড় করছ। তুমি তাদের প্রতি ও তাদের সন্তানদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন পথ অবলম্বন করছ। তুমি কোরাইশ বংশীয় লোকদের ও তাদের ধন সম্পদের উপর যুলুম করে অন্যায়ভাবে তা বাইতুল মালে জমা করে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহপাক যাদের সাথে প্রীতির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দিয়েছেন, তা লঙ্ঘন করেছ।
হে আব্দুর আজিজের পুত্র! আল্লাহকে ভয় কর। তুমি জালিম, এ মসনদে তুমি তৃপ্তি লাভ করতে পারছ না। তুমি তোমার অন্তরে দুর্বার আগুন নিভাবার জন্যই নিরেজ আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি জুলুম-অত্যাচার শুরু করেছ।
আল্লাহর কসম! যিনি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা)কে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছিলেন, তুমি তোমার শাসনের সামান্য সময়ের মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর নবী (সা)-এর পথ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছ। অথচ তোমার এ শাসন আমলকে তুমি একটি পরীক্ষা মনে করছ। তোমারও একজন পরাক্রমশালীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে। তুমি তাঁর শক্তি অতিক্রম করতে পারবে না এবং তিনি তোমার এসব জুলুম-অত্যাচারকেও ক্ষমা করবেন না।
এ ব্যক্তি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে যে সব জুলুম-অত্যাচারের অভিযোগ উত্থাপন করেছে তা কি বাস্তবিকেই জুলুম অত্যাচার ছিল? তা শুধু এ ছিল যে, তিনি তার নিকট হতে এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের নিকট হতে মুসলমানদের অধিকার আদায় করে প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। স্বয়ং জালিমগণ অবিচারকে সুবিচার আর সুবিচারকে অবিচার বলে মনে করেছিল।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খুব উত্তম ও সঠিকবাবেই তার উত্তর লিখেছিলেন যে, “তুমি মনে কর যে, আমি জালিম-অত্যাচারী। কারণ আমি তোমাকে ও তোমার আত্মীয় স্বজনকে আল্লাহপাকের সে সমস্ত সম্পদের অংশ দিতে রাজী নই যা কেবল আত্মীয়-স্বজন, দরিদ্র ও বিধবাদের জন্যই নির্ধারিত ছিল।
তুমি আমার উপর এ অভিযোগ আনার সময় ভুলে গেলে কেন আমার চেয়েও বড় জালিম সে ব্যক্তি যে, তোমার মত একটি নির্বোধকে শুধু পিতৃ স্নেহেই একটি বিরাট মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি নিয়োগ করেছিল, আর তুমি যথেচ্ছাভাবে মুসলিম বাহিনীর উপর কর্তৃত্ব করেছিলে। তোমার এ নিয়োগের পশ্চাতে পিতৃস্নেহ বৈ আর কোন কারণ ছিল কি?না আর কোন কারণ ছিল না।
আফসোস! তোমার ও তোমার পিতার বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন কত লোক যে অভিযোগ করবে, সেদিন তোমরা কিবাবে এ অভিযোগকারীদের থেকে আত্মরক্ষা করবে, তা ভেবে অস্থির হই।
আমার চেয়ে বহু গুণ বেশি জালিম সেই ব্যক্তি, যে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ছাকাফীর মত নরাধমকে আরবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিল। এই হাজ্জাজ বিনা কারণে মুসলমানদের হত্যা করত এবং তাদের ধন-সম্পদ লুট করে নিত।
আমার চেয়েও বহু গুণ বেশি জালিম সে ব্যক্তি, যে কুরযা ইবনে শুরাইকের মত চরিত্রহীন, অসভ্য ও মুর্খকে মিশরের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দান করেছিল এবং তাকে প্রকাশ্যভাবে অনর্থক খেলাধুলা, মদ্যপানসহ সকল প্রকার অন্যায় অপকর্মের অনুমতি দিয়েছিল। আমার চেয়েও শতগুণ জালিম এবং আল্লাহর আইন লঙ্ঘনকারী সে ব্যক্তি, যে আলিয়া বারবারিয়াকে মুসলমানদের সম্পদের অংশীদার করে দিয়েছিল। যদি আমি পর্যাপন্ত সময় পেতাম তবে আমি আল্লাহর সম্পদ এবং মুসলমানদের অধিকার পূর্ণভাবে তোমাদের কাছ থেকে আদায় করে তাদের নিকট ফিরিয়ে দিতাম এবং তোমার ও তোমার বংশের সকল গর্বই খর্ব করে দিতাম। দীর্ঘ দিন যাবত তোমরা সাধারন নাগরিকদে সম্পদ লুন্ঠন করে খাচ্ছ। আল্লাহর কসম! এখন যদি তোমাদেরকে গোলাম বানিয়ে বিক্রয় করে দেয়া হয় এবং সেই বিক্রয়লব্ধ অর্থ বঞ্চিত, বিধবা, ইয়াতিম ও দরিদ্রের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয় তবুও তোমার কৃত জুলুম-অত্যাচারের ক্ষতি আদায় হবে না।
আমরা জানিনা, ইবনে ওয়ালিদ এই পত্র পেয়ে তা বাড়াবাড়ি বলে মনে করেছিল কি না। তবে সত্য কথা হলো, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ওয়ালিদের পুত্রকে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করেননি।
কুররা ইবনে শুরাইক এবং হাজ্জজ ইবনে ইউসুফ বনু উমাইয়ার ললাটে দু’টি কলঙ্কের ছাপ ছিল। এই দু’ জালিমের একজন মিশরে অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়েছিল, অপর জন ইরাকে রক্তের নদী প্রবাহিত করেছিল। বিশেষতঃ হাজ্জাজ ছিল সে যুগের হালাকু খাঁ। পার্থক্য ছিল শুধু এ যে, হালাকু খাঁ ছিল অমুসলিম আর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ছিল মুসলমান এবং নিজেকে হাফিজে কুরআন দাবী করত। হালাকু খাঁর অপরাধ ক্ষমাযোগ্য কিন্তু হাজ্জআজের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। এ হাজ্জাজই উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেকের অতি প্রশংসনীয় ব্যক্তি ছিল। তিনি মৃত্যুর সময় তার পুত্র ওয়ালিদকে অছিয়ত করেছিলেন যে, হাজ্জাজই তোমাদের সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। সবসময় তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে, কাউকেও তার উপর প্রাধান্য দিবে না।
ইবনে খালকান বলেন, বাস্তবিকই হাজ্জাজ সমকালীন যুগে বিশিষ্ট বাগ্মী ও পবিত্র কোরআনের হাফিজ ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ হাফিজে কোরআনই আবুদল মালেকের রাজত্বকে সুসংহত করতে কাবা শরীফের উপর পাথর নিক্ষেপ করতেও সংকোচবোধ করেনি। এ জালিম শাসক পবিত্র কাবার চার দেওয়ালের ভিতরে রক্তনদী বহাতেও তার বিবেক দংশন করেনি। সে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) ও তাদের মুখে থুথু নিক্ষেপ করেছিল যারা নবী (সা)-এর পবিত্র চেহারা হতে নূর গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিল। যে হযরত আনাস (রা) যিনি একাধারে দীর্ঘ দশ বৎসর মহানবী (সা)-এর সঙ্গী ছিলেন, তার উপর কঠোরতা করত এবং তাকে অপদস্ত করতেও বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেনি। এ পাপিষ্ঠ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা)-এর মত বিশিষ্ট যুগশ্রেষ্ঠ সাহাবীর লাশ মুবারক চল্লিশ দিন পর্যন্ত শূলিতে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
এ পাপিষ্ঠ কা’বা শরীফের উপর পাথর নিক্ষেপ এবং সাহাবীগণের সন্তানগণকে হত্যাও করেও এই অপরাধের জন্য জীবনে কোন দিন অনুতপ্ত হয়নি এবং লজ্জিত হয়নি। সে কুফার লোকগণকে অত্যাচারে জর্জরিত করেছিল। অনেক নিরপরাধ গুণী মানুষকে হত্যা করেছিল, শুধু এ অপরাধে যে, তাঁরা আবদুল মালেককে ন্যায় হিসেবে মানতে পারেননি। সে বিনাদ্বিধায় মুসলমানদের ধন-সম্পদ লুট করেছিল, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল এবং নিষ্পাপ মানুষের রক্ত দিয়ে আল্লাহর জমিনকে রঙ্গীর করে তুলেছিল।