ব্যক্তিগত সম্পত্তির হিসাব
যারা পরের প্রতি হিসাব-নিকাশের বেলায় কঠোর-ইতিহাসে এরূপ শাসকেদের উদাহরণ যথেষ্ট থাকলেও নিজেদের হিসেব নিকেশের বেলায় আরোও অধিক কঠোর এরূপ শাসনকর্তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই বললেনই চলে।
এদিক বিবেচনা করলে ইতিহাসের সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি অন্যের সম্পদের উপর হিসেবের কঠোরতা করার আগে নিজের সম্পদের পর্যালোচনা ও পরিসংখ্যান করেছিলেন।
ইবনে সাদ বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খলিফা মনোনীত হবার পর তার সম্পত্তির পরিসংখ্যান করলেন। তাঁর নিকট যে সমস্ত দাস দাসী, বস্ত্র, সুগন্ধি এবং এ জাতীয় আরো যে সব অপ্রয়োজনীয় জিনি ছিল, তিনি সে সব বিক্রি লব্ধ ত্রিশ হাজার দীনার আল্লাহর পথে দান করে দিলেন এবং তিনি একজন সাধারণ নাগরিকের স্তরে নেমে আসলেন। সয়াইদা ব্যতিত তাঁর আর কোন সম্পত্তি ছিলনা। এ সুয়াইদা হতে তিনি বার্ষিক দেড়শত দীনার মূল্যের ফসল পেতেন। এটা ছিল তাঁর একমাত্র আমদানী এবং এ আমদানী দিয়েই তাঁর সংসার চলত।
আবদুল ফরিদের ভাষ্যকার বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বায়তুল মাল হতে কোন অর্থই গ্রহণ করতেন না এমনকি রাজস্ব হতেও না। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে একবার বলা হল যে, হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) রাজস্ব খাত হতে দৈনিক দুই দেরহাম গ্রহণ করতেন, আপনি অন্ততঃ সেই পরিমাণই গ্রহণ করুন তিনি যে পরিমাণ গ্রহণ করতেন। তিনি বলনে, ওমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর কোন সম্পদ ছিল না, কিন্তু আমার প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ আছে। সুতরাং আমি কেন গ্রহণ করব?
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বায়তুল মাল অথবা জনগণের ধন-ভান্ডার হতে অর্থ গ্রহণ করাকে খুবই অন্যায় মনে করতেন। তিনি খুব অনাড়ম্বর ও সাধারণ জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তবুও বায়তুলম মালের উপর সামান্য বোঝা চাপিয়ে দেওয়াও পছন্দ করতেন না। এমনকি যদি কোন সময় সামান্য অর্থের বিশেষ প্রয়োজন হত তবুর তিনি তা বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করতেন না ইবনুল জাওযি এ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যে, একবার তিনি স্ত্রী ফাতেমার নিকট এসে বললেন, আমার আঙ্গুর খেতে খুব ইচ্ছা হয়েছে, তোমার নিকট কি একটি দেরহাম আছে? ফাতেমা অবাক হয়ে বললেন, আপনি এত বিরাট সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা, আপনি একটি দেরহামেরও ব্যবস্থা করতে পারেন না?
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, খিয়ানতের অপরাধে ধৃত হয়ে জাহান্নামের বেড়ী পরিধান করার চেয়ে এই অবস্থাকেই ভাল মনে করি।
অন্য কথায় বায়তুল মাল হতে সামান্য অর্থ গ্রহণ হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের মতে দোযকের পথ প্রশস্ত করা মনে হতো। তাঁর সততা-সাধুতা এতই দৃঢ় ছিল যে, কঠিন প্রয়োজনের মুহূর্তেও তিনি বায়তুল মাল হতে কোন অর্থই গ্রহণ করতেন না।
ইবনুল জাওযি বলেন, একবার হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ক্ষুধায় অস্থির হয়ে পড়লেন, অথচ বায়তুল মালে প্রচুর খাদ্য সামগ্রী মওজুদ ছিল, কিন্তু তিনি সেখান থেকে কিছুই গ্রহণ করলেন না।
তিনি ঘরে স্ত্রীকে বললেণ, তোমাদের নিকট খাওয়ার কিচু আছে কি? ঘরে কয়টি খেজুর ছাড়া আর কিচুই ছিল না। তাঁকে সেই খেজুর দেয়া হলে তিনি তা খেয়ে পানি পান করলেন এবং বললেন, যে ব্যক্তি তার পেটে আগুন ভরে আল্লাহপাক তাকে তার নিকট হতে দূর করে দেন।
তিনি কখনও তার পেটে এ আগুন ভরতেন না। তাঁর আমদানী খুবই সামান্য ছিল, তার ও তার পরিজনের প্রয়োজন মিটাবার মত অর্থ আয় হত না। কাজেই অধিকাংশ সময়ই তাঁর ঘরে ভাল কোন খাদ্য-দ্রব্য তৈরি হত না। সাধারণত তিনি পিয়াজ ও তেল দিয়েই রুটি খেতেন।
ইবনু জাওযি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের এক ভৃত্য আবু উমাইয়ার কথা বর্ণনা করে বললেন যে, বৃত্য জুমার সময় তার মনিব পত্নীর নিকট আসলে তিনি তাকে পিঁয়াজ দিয়ে রুটি খেতে দিলেন। সে প্রতিবার করে বলল, প্রত্যেক দিন পিঁয়াজ! পিঁয়াজ! আর ভাল লাগে না। মনিব পত্নি বললেন বৎস! এটা যে, তোমার মনিরেব খাদ্য।
প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল তার মনিবের দৈনন্দিন খাদ্য-তালিকা। বায়তুল মালের উপর যাতে কোন প্রকার চাপ সৃষ্টি না হয়, এ উদ্দেশ্যেই তিনি এ খাদ্য বেছে নিয়েছিলেন। মুসলমানদের বায়তুল মাল ছিল তাঁর নিকট নিষিদ্ধ খাদ্যের মত। এমন কি কোন সময় যদি সরকারী ডাক যোগে কোন জিনিস তাঁর নিকট আসত, তাও গ্রহণ করতেন না।
ইবনুল জাওযি উদাহরণ স্বরূপ বর্ণনা করেন, একবার তার বন্ধুও আম্মারা ইবনে নাসী সরকারী ডাকের মাধ্যমে কিছু খেজু পাঠাল। যে ব্যক্তি খেজুর নিয় তাঁর নিকট আসল তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ খেজুর কিভাবে বহন করে এনেছ? সে বলর, ঘোড়ার ডাক যোগে আনা হযেছে। তিনি নির্দেশ দিলেন যে, এগুলি বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দাও। সে ব্যক্তি খেজুরের ঝুড়ি নিয়ে বাজারে আসলে একজন উমাইয়া বংশীয় লোক সে খেজুরের ঝুড়ি ক্রয় করে অবিকল সেরূপেই খলিফার নিকট হাদিয়া হিসেবে পাঠিয়ে দিল। খলিফা তা দেখে বললেন, এটা যে সেই খেজুরই! অতঃপর সে সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি তা তার খাদেমদেরকে খেতে দিলেন। এবং নিজে তার মূল্য বায়তুল মালে জমা দিয়ে দিলেন।
এরূপ একটি ঘটনা আরো একবার ঘটেছিল। একবার তিনি বললেন, লেবানন বা সীজের মধূ হলে খুব ভাল হত। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা তার এ আকাংকার কথা জানতে পেরে তার খাদেমকে পাঠিয়ে লেবাননের গভর্ণনা ইবনে মাদিকারাবকে এ সম্পর্কে জানালেন। ইবনে মাদিকারাব প্রচুর মধু পাঠিয়ে দিলেন। এ মধু ফাতিমার নিকট এসে পৌঁছলে তিনি তা খলিফার সামনে হাজির করলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সমসত বিষয় জানতে পেরে সমস্ত মধু বাজারে পাঠিয়ে বিক্রি করে দিলেন এবং তার মূল্য বায়তুল মালে জমা করে দিলেন। তারপর তিনি ইবনে মাদিকারাবকে লিখেলেন যে, যদি ফাতেমার কথায় আর কখনও মধু পাঠাও তবে আমি আর কখনও তোমার মুখ দেখব না এবং তোমার দ্বারা কোন খেদমতও গ্রহণ করব না।
এ ধরনের আরও একটি ঘটনার কথা জানা যায়, একদিন তিনি তার স্ত্রীর নিকট মধু খেতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার স্ত্রীর নিকট মধু ছিল না। কিছুক্ষণ পর তিনি খলিফার নিকট মধু পাঠিয়ে দিলেন তিনি মধু খেয়ে খুবিই তৃপ্ত হলেন। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন। এ মধু কোথা হতে এনেছ?
তার স্ত্রী বললেন, আমার নিকট দু’টি দেরহাম ছিল তা দিয়ে সরকারী বাহনে একটি খাদেমকে পাঠিয়ে এ মধু বাজার থেকে ক্রয় করে এনেছি। তিনি মধুর বাসনটি আনলেন এবং স্ত্রীকে মধুর মূল্য দিয়ে বললেন, ওমরের প্রবৃত্তি দমনের জন্য সরকারী ঘোড়া ব্যবহার করা তোমার উচিত হয়নি। তখন সে মধু বায়তুল মালে পাঠিয়ে দিলেন।
একবার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর আপেল আসল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ গরীবদের মধ্যে সে আপেল বিতরণ করেছিলেন, হঠাৎ একটি ছোট ছেলে এসে আপেলের স্তুপ থেকে একটি আপেল নিয়ে খেতে লাগল। তিনি এটা দেখে তার হাত থেকে আপেলটি কেড়ে নিলেন। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের নিকট চলে গেল। তার মা বাজার থেকে আপেল খরিদ কয়ে এনে তাকে শান্তনা দিলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ঘরে এসে আপেলের ঘ্রাণ পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বায়তুলমালের আপেলের অংশ পেয়েছ? তার স্ত্রী বললেন না, ছেলে কাঁদতেছিল দেখে আমি বাজার থেকে ক্রয় করে এনেছি।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে বলেন, আল্লাহর কসম! যখন আমি ছেলের হাত থেকে আপেলিটি কেড়ে নিলাম, তখন মনে হলো, যেন আমার কলিজাটি চিড়ে ফেললাম। কিন্তু আল্লাহর সামনে মুসলমানদের একটি আপেলের জন্য অপমাণিত হওয়াটা আমার কাছে খুবই খারাপ মনে হল।
বাস্তবিক পক্ষে যে কোন মূল্যেল বিনিময়ে তিনি এ অপদস্ততা পছন্দ করতেন না। ইবনুল জাওযি বলেন, তিন বায়তুল মালের সম্পদের ব্যাপারে এতই কঠোরতা অবলম্বন করতেন যে, একদিন প্রচণ্ড শীতের সময় জুমার নামাযের উদ্দেশ্যে গোসল কার জন্য খাদেমগণকে পানি গরম করতে বললেন। খাদেমগণ বলল যে, জ্বালানী নেই, কি দিয়ে পানি গরম করব? তরপর তারা সরকারী রন্ধনশালা থেকে পানি গরম করে আনলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা বলেছিলে জ্বালানী নেই তবে এখন কিভাবে পানি গরম করছো? খাদেমগণ পানি গরম করার ঘটনা বর্ণনা করল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রন্ধন শালার প্রধানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি তোমাকে বলেছিল এটা খলিফার পানির পাত্র, গরম করে দাও। রন্ধন শালার প্রধান বলল, আল্লাহর শপথ! এ পানি গরম করতে আমি এক টুকরো জ্বালানী ব্যবহার করিনি। খাদ্য পাকাবার পর চুল্লিতে অঙ্গর জ্বলছিল যদি তা ছেড়ে দিতাম তবুও নিভে যেত এবং ভষ্ম হত।
এরূপ কারন দর্শাবার পরও হযরত ওমর ইবনে আবদু আজিজ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, জ্বালানীর মূল্য কত ছিল? সে জ্বালানীর মূল্য বলল। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে জ্বালানীর মূল্য পরিশো করে দিলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বায়তুল মালের অর্থ দিয়ে একটি লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্র আলেম, ফাজেল ও অন্যান্য গরীব লোকদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। একদিন মেহমানগণ দস্তরখানে বসে খাদ্য খেতে অস্বীকার করলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদু আজিজ জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা খাচ্ছেন না কেন, তারা বলল, আপনি আমাদের সাথে না খেলে আমরা খাব না। তখন হযরত ওমর ইবনে আবদু আজিজ তাদের সাথে খাদ্য খেতে বাধ্য হলেন এবং তার ব্যক্তিগত তহবিল হতে দৈনিক দু দেরহাম বায়দুল মালে জমা করে দিতে আদেশ দিলেন। তারপর হতে তিনি প্রত্যেক দিন মেহমানের সাথে মিলে খাদ্য খেতেন।
হযরত ওমর লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠা করার পর তাঁর পরিবারের লোকগণ সতর্ক করে দিযে বলললেন, সাবধান! কেউ যেন কখনও লঙ্গরখানা হতে কোন জিনিস চেয়ে না আনে। কারণ এ সমস্ত গরীব মিসকীন ও মুসাফিরদেন জন্য।
ইবনে সাদ বলেন, একদিন হযরত ওমর বললেন, তাঁর দাসীকে একটি আবৃদ দুধের পাত্র উঠাতে দেখে বললেন, এটা কার জন্য এবং কোথা হতে এনেছ? দাসী বলল, আপনার এক বেগম অন্তঃসত্ত্বা, তিনি দুধ খেতে চেয়েছিলেন, আর গর্ভবতী রমনী কোন কিছু খেতে চাইলে তার আশা পূর্ণ করতে হয়, অন্যথায় গর্ভস্থিত সন্তান নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে। এ জন্যই আমি এক পিয়ালা দুধ দারুল ফুকরা হতে চেয়ে এনেছি। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ দাসীকে হাত ধরে টেনে নিতে লাগলেন এবং উচ্চস্বরে বললেন, যদি গরীম মিসকীনদের জন্য নির্ধারিত খাদ সামগ্রী না খেলে তার গর্ভ ঠিক না থাকে, তবে আল্লাহ যেন তা নষ্টই করে দেন। একথা বলতে বলতে তিনি দাসীকে টেনে স্ত্রীর নিকট গিয়ে বললেন, এ দাসী বলে যে, তুমি নাকি গরীব-মিসকীনদের জন্র রক্ষিত খাদ্য না খেলে তোমার গর্ভ ঠিক থাকবে না, আমি দোয়া কির, যদি এরূপই হয় তবে এ গর্ভ যেন নষ্ট হয়ে যায়।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের স্ত্রী তাঁর উদ্দেশ্য বুঝে দাসীকে তিরস্কার করলেন এবং দুধপাত্রটি ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।
ইবনে সাদ আরও বলেন, রন্ধন শালায় দীর্ঘ এক মাস পর্যন্ত তাঁর জন্য অজুর পানি গরম করা হচ্ছি কিন্দু তিনি তা জানতে পারেননি। তারপর যখন তিনি জানতে পারলেন, তখন খাদেমদের বললেন, তোমরা কত দিন যাবত এখানে পানি গরম করছ? খাদেমগণ বলল, এক মাস যাবত পানি গরম করছি। তখন তিনি সে পরিমাণ জ্বালানী কাঠ রন্ধনশালায় পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন।
উবাইদ ইবনে ওয়ালিদ বলেন, যদি ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রাতে সরকারী কাজ করতেন তখন তিনি বায়তুল মালের বাতি ব্যবহার করতেন আর যদি ব্যক্তিগত কাজ করতেন তখন ব্যক্তিগত বাতি ব্যবহার করতেন।
এ বর্ণনাকারীই বলেন যে, একবার কাজ করতে করতে বাতির তৈল শেষ হয়ে গেল। তিনি বাতির তৈল ভরতে উঠলেন। তার নিকট উপবিষ্ট লোকেরা বলল, আমরাও তো এ কাজটুকু করে দিতে পারি! কিন্তু ওমর রাজি হলেন না নিজেই বাতির তৈল ভরে এনে বললেন, আমিও পূর্বেও যে ওমর ছিলাম এখনও সেই ওমরই আছি। তিনি বায়তুল মালের সম্পদরে এতই গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি যখন কোন সরকারী কাগজে সরকারী ফরমান লিখতেন তখনও তিনি সরু কলম দ্বারা ছোট অক্ষর দ্বারা সংক্ষিপ্ত আকারে ফরমান লিখতেন।
ইবনে সাদের ভাষ্যটি এই- তাঁর লিখা চিঠিপত্র খুবই সংক্ষিপ্ত হত তার চিঠিপত্র মাত্র চারটি লাইন থাকত।
হযরত ওমর বায়তুলমালের অথবা লঙ্গরখানার কোন আসবাব দ্বারা নিজে উপকৃত হতে খুবই ঘৃণা বোধ করতেন। যদি খাদেমগণ কোন সময় তাড়াহুড়ার দুরন লঙ্গরখানা চুলায় তাঁর কোন খাদ্য পাকিয়ে আনত হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তা খেতেন না।
ইবনুল জওযি, আল হাকাম ইবনে ওমরের একটি ভাষ্য বর্ণনা করেছেন। ভাষ্যকার বলেন যে, একবার আমি ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি তাঁর এক খাদেমকে গোশত ভেজে আনতে নির্দেশ দিলেন। উক্ত খাদেম খুব তাড়াতাড়িই গোশত ভেজে নিয়ে আসল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার দ্রুতগতি দেখে বললেন, তুমি খুব তাড়াতাড়ি করেছ। সে বলল, জ্বি হা, বাবুর্চিখানা হতে ভেজে এনেছি। তিনি খাদেমকে বললেন, তবে এখন তুমি এটা খেয়ে ফেল। তোমার জন্যই তুমি এ খাদ্য তৈরি করেছ। আমার জন্য নয়।
তিনি বাড়ীতে বসবাস করার সময় যেরূপ সতর্কতা অবলম্বন করতেন প্রবাসেও ঠিক সেরূপই করতেন। তিনি যখন কোন সরকারী সফরে বের হতেন তখন সরকারী অর্থে নির্মিত কোন ঘরে অর্থাৎ কোন সারাইখানা বা কোন বাংলোতে অবস্থান করতেন না, বরং তিনি স্বীয় তাবুতে থাকতেন নিজের খাদ্য খেতেন কোন লোকের দাওয়াত বা কারও প্রেরিত খাদ্য খেতেন না। তিনি কারও কোন হাদীয়া গ্রহণ করতেন না। তাঁর মনে এসমস্ত ঘুষ বা উৎকোট হিসেবে বিবেচিত হত।
হাদীয়া বা উপঢৌকন সম্পর্কে ইবনুল জওযি মুহরিবের বরাত দিয়ে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন যে, একবার হযরত ওমর ইবনে আজিজ আপেল খেতে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন। তাঁর বংশের একটি লোক এটা জানতে পেরে তাঁর জন্য কিছু আপেল ক্রয় করে হাদীয় পাঠিয়ে দিলেন। এই আপেল যখন তাঁর নিকট উপস্থি করা হল তখন তিনি আপেল হাতে নিয়ে বললেন, কত সুন্দর! কত সুগন্থি! এটা দাতার নিকট নিয়ে গিয়ে তাকে আমার সালাম দিয়ে বল, তোমার হাদীয় আমার অন্তরের সেই স্থানই দখরল করেছে, যা তুমি কামনা করছ।
মুহারিব বলেন, আমি নিবেন করলাম, আমিরুল মুমেনিন! সেত আপনারেই চাচাত ভাই, আপনার বংশের লোক! এছাড়া আপনি অবশ্যই জানেন যে, মহানবী (সা) হাদীয়া বস্তু খেতেন, যদিও তিনি ছাদকা গ্রহণ করতেন না।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, তোমার জন্য আফসুস হয়। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্য হাদীয়া প্রকৃতই হাদীয়া ছিল, কিন্তু এখনকার সময়ে এটা আমাদের জন্য সরাসরি উৎকোচ ব্যতীত আর কিছুই নয়।
এতো হল তাঁর চাচাত ভাইয়ে ঘটনা। এরূপ ঘটনা তার এক সফরের সময়ও ঘটেছিল। তিনি এক সফরে ছিলেন তাঁর সঙ্গে ফুরাত ইবনে মুসলিমও ছিল। এ সময়ও তিনি আপেল খেতে আকাঙ্খা প্রকাশ করলেন। তাঁর বাহন অগ্রসর হতে লাগল, দেখা গেল যে, কিছু লোক আপেলের ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছে। হযরত ওমর ইবনে আজিজ তাঁর সওয়ারীকে আপেল বহনকারী একজনের নিকবর্তী করে একটি আপেল তুলে নিলেন এবং তা ঘ্রাণ শুকে সেটা যথাস্থানে রেখেদিলেন এবঙ বললেন, তোমরা স্বগৃহে চলে যাও। সাবধান, তোমাদের কেহ যেন আমার কোন লোককে কোন বস্তু হাদীয়া না দেয়।
বর্ণনাকারী বলেন, আমি আমার খচ্ছরকে তাড়া করে হযরত ওমর ইবনে আজিজের নিকটবর্তী হলাম এবং বললা, হযরত! আপনি আপেল খেতে চেয়েছেন, আমরা তা তালাশ করেছি কিন্তু পাইনি। এ আপেল আপনার নিকট হাদীয়া হিসেবে এসেছে, আর আপনি তা এভাবে ফিরিয়ে দিলেন? তিনি বললেন, আল্লাহর রসূল (স) হযরত আবুবকর (রা) ওমর ফারুক (রা) জন্য হাদীয়া হাদীয়াই হত কিন্তু তাদের পরবর্তী শাসকদের জন্য তা হাদীয়া নয় বরং সরাসরি উৎকোচ।
হযরত ওমর ইবনে আজিজ (র) যথার্থই বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত ওমর ফারুকের (রা) জন্য যে সব লোক হাদীয়া পাঠাতেন তাদের অন্তরে লোভ লালসার লেশমাত্রও থাকত না এবঙ হাদীয়া সেসব পবিত্রাত্মা মনীষীদের উপর কোন প্রভাবও বিস্তার করত না।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের যুগে সাধারণ মানুষের নৈতিকমান এতই নীচে নেমে এসেছিল যে কর্মচারীগণ কথায় কথায় ঘুষ গ্রহন করতে দ্বিধাবোধ করত না। বিশেষতঃ খলিফা ও তার ঘরে হাদীয়া উপঢৌকনের পাহাড় জমে উঠত। ঈদ উৎসব নববর্ষ ইত্যাদি দিবসে খলিফঅগণ লাখ লাখ টাকা সালামী বা নযর নিয়াজ পেতেন।
আল-ইয়কুবীর বর্ণনায় জানা যায় যে, প্রাচীনকালে প্রজাগণ নওরোজ ও মেহেরজান দিবসে রাজার জন্য যে সমস্ত উপঢৌকন প্রেরণ করত, বনু উমাইয়ার খলিফাদের যুগ হতে তা পুনরায় চালু হয় এবং এ কুসংস্কারটি খলিফা সুলায়মানের যুগ পর্যন্ত চালু ছিল। হযরত ওমর ইবনে আজিজ খলিফা হয়েই এ কুসংস্কার বন্ধ করে দিলেন এবং এ ব্যাপারে এতই কঠোরতা অবলম্বন করলেন যে, সমস্ত কর্মচারীই সতর্ক হয়ে গেল। বায়তুলমাল হতে এক পয়সাও বেশী গ্রহণ করার মত সাহস কারও ছিল না। সাধারণ প্রয়োজনীয় ব্যয়ের জন্যও হযরত ওমর ইবনে আজিজের নিকট তাদের আবেদন করে মঞ্জুরী গ্রহণ করতে হত। তাঁর অনুমতি ব্যতীত বায়তুল মাল হতে কেউ এক পয়সাও খরচ করতে পারত না।
ইবনে হাজম হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের একজন বিশ্বস্ত ও প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে মদীনায় শাসনকর্তা পদে নিয়োগ করেছিলেন। ইবনে হাজম হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট আবেদন করলেন যে, পূর্ববর্তী শাসকগণ সরকারী খরচেই বাতি ব্যবহার করতেন, কাজেই আমাকেও সে ব্যাপারে অনুমতি দেয়া হোক। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তা উত্তরে লিকলেন, ইবনে হাজম! আল্লাহর কসম! আমি তোমার সেই দিনও দেখেছি যখন শীতের গভীর অন্ধকার রাথে তুমি প্রদীপ ছাড়া বাইরে যাতায়াত করতে। এখন তোমার অবস্থা পূর্বের তুলনায় অনেক ভাল। তোমার ঘরে যে প্রদীপ আছে তাই যথেষ্ট, অন্য কোন প্রদীপের তোমার প্রয়োজন নেই।
এছাড়াও ইবনে হাজম একবার আবেদন করেছিলেন যে, তার পূর্ববর্তী শাসকদণ সরকারী তহবীল হতেই কাগজ-কলম ও কালির খরচ পেতেন, কাজেই তাকেও সরকারী পর্যায়ে এ সমস্ত দ্রব্যাদি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হোক। এর উত্তরে তিনি লিখলেন যে, আমার এ চিঠি পাওয়া মাত্রই তোমার কলমের আগা সরু করে নিবে, শব্দ খুব খন করে লিখবে এবং অনেক কথা একই পত্রে লিখতে চেষ্টা করবে যাতে বায়তুল মালে কোন চাপ না পড়ে, কারণ এরূপ লম্বা চিঠিপত্র লেখায় জনসাধারণের কোনও উপকারে আসবে না।
উদাহরণ স্বরূপ এ দু’টি ঘটনা উল্লেখ করা হলো এ জন্য যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ শুধু নিজেই বায়তুলমাল হতে কিছু নিতে অপছন্দ করতেন না তা নয়, বরং প্রশাসনিক কাজে অন্যা্য কর্মচারীদের অপ্রয়োজনীয় খরচও তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর মতে অপ্রয়োজনীয় খরচের বোঝা বায়তুল মালের উপর দেয়া কোন মতেই জায়েয নেই। তিনি বায়তুল মালকে একটি পবিত্র আমানতে পরিণত করে দিয়েছিলেন। যদি কোন কর্মচারী কখনও কোন অর্থ নষ্ট করত তখন তিনি তাকে সেজন্যে গ্রেফতার করতেন।
ইবনে আবদুল হাকাম একটি উদাহরণ পেশ করে বলেছেন যে, ইয়ামেনের গভর্ণর ওয়াহ্হাব ইবনে মুনতিয়া হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে জানালেন যে, বায়তুল মালের কিছু দীনার হারানো গিয়েছি। এর উত্তরে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যে, নির্দেশ দিয়েছিলেন তা বর্তমান যুগের জনসাধারণ এবং শাসকদের জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে। তিনি ওয়াহ্হাবকে লিখলেন- (আরবী*****************)
অর্থাৎ আমি তোমার সততা ও আমানতদারীর উপর অভিযোগ করি না, তবে তোমার বাহুল্য ও অনর্থক খরচের জন্য আমি তোমাকে অভিযুক্ত করছি। কারণ আমি জনসাধারণে সম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। কাজেই এ ব্যাপারে সমস্ত লোক জমা করে তাদের সামনে কসম কর যে, তুমি এ ব্যাপারে নির্দোষ। তুমি সুখে শান্তিতে থাক।
বায়তুল মাল সম্পর্কে তিনি কতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করতেন, নিম্নের ঘটনা দ্বারা তার কিছু উপলব্ধি করা যায়। যে সমস্ত আতর ও সুগন্ধি দ্রব্য সুলায়মান ব্যবহার করতেন, আবদুল্লাহ ইবনে রাশে একদিন সে সমস্ত আতর ওমর ইবনে আবদুল আজিজের সামনে হাজির করল। তিনি তা দেখতে পেয়েই হাত দিয়ে নাক বন্ধ করে দিলেন এবং বললেন, “আতরের ঘ্রাণই গ্রহণ করা হয়।”
তার ব্যক্তিগত খাদেম মুজাহিম কাছেই ছিল। সে বলল, আমিরুল মুমিনীন! এর ঘ্রাণ শুধু বাতাসে মিশ্রিত হয়ে আপনার নাকে পৌঁছেছে। তিনি মাজাহিমকে তিরস্কার করে বললেন, হতভাগা! আতরের ঘ্রাণ গ্রহণ ছাড়া আর কোন উপকারী আছে কি?
বর্ণনাকারী বলেন- যতক্ষণ পর্যন্ত সে আতর তাঁর কাছ থেকে দূর না করা হল ততক্ষণ তিনি নাক বন্ধ করে রাকলেন। এজন্য আবদুল আজিজ মাজশুন বলেছেন যে, “হযরত ওমর ইবনে আজিজের চেয়ে কঠোর নীতিপরায়ণ শাসনকরতা আমি আর দেখিনি।”
একদিন ইবনে যাকারিয়া হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে বলল, আপনি আপনার কর্মচারীগণকে এক শত আবার কাউতে দুইশত দীনার বেতন দিয়ে থাকেন, আর আপনি কো ভাতা গ্রহণ করেন না। অথচ আপনিওি প্রশাসনিক কাজ করেন, প্রশাসনে আপনারও অধিকার আচে। আপনার পরিবারেরও অভাব অভিযোগ আছে। সুতরাং উর্ধ্বতন কর্মচারীদের যে পরিমান বেতন ধার্য করা আছে আপনিও সে পরিমান ভাতা গ্রহণ করুন।
হযরত ওমর ইবনে আজিজ বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি কর্মচারীদের এ জন্যই অধিক বেশি দেই, যাতে তারা পরিবার-পরিজনের চিন্তা ভাবনা মুক্ত থেকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এ সুন্নাত অনযায়ী কাজ করতে পারে।
তারপর তিনি ইবনে যাকারিয়াকে বললেন, আমি তোমার সৎ ধারণা বুঝতে পেরেছি। আমার পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কথা জেনেই তুমি আমার নিকট এ ধরনের প্রস্তাব দিয়েছ।
বর্ণনাকারী বলে, এরপর তিনি তার ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বললেন, এ অস্থি মাংস আল্লাহর সম্পদে গড়া। আল্লাহর কসম! আমি এর কিছুই পরিবর্ধন হতে দিব না।
মুহাম্মাদ ইবনে কায়ে বর্ণনা করেন যে, একবার মুজাহিম আমার কাছে এসে বলল, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের গৃহে খাওয়ার মত কিছুই নেই, তাঁর পারিবারিক খরচের অত্যন্ত প্রয়োজন, কিন্তু আমি জানি না যে, এ খরচের অর্থ কোথা হতে যোগাড় করব। তখন মুহাম্মদ ইবনে কাযেস বললেন, যদি আমার নিকট বেশি দীনার থাকত তবে আমি আপনাকে দিতাম। মুজাহিম জিজ্ঞেস করল, আপনার নিকট কত দীনার আছে? আমি বললাম মাত্র পাচটি দীনার আছে। মুজাহিম বলল, পাঁচ দীনারতো অনেক বেশি। এটা দেন পরে আপনাকে ফেরত দেব।
উক্ত বর্ণনাকারী বলেন, তারপর হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের ইয়ামেনের জমি শষ্য আসল। একদিন মুজাহিম আমার নিকট এসে খুব সোল্লাসে বলর, আমাদের জমির ফসল এসেছে, আপনার প্রাপ্য টাকা তাড়াতাড়ি পরিশোধ করে দেব। এ কথা বলে সে হযরত ওমর ইবনে আজিজের নিকট গিয়েই আবার ফিরে আসল এবং মাথায় হাত রেখে বলতে লাগল আল্লাহ খলিফাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দান করুন। তার সাথে সাথে আমিও এ কথার পুনরাবৃত্তি করলাম। তারপর মুজাহিম বলল যে, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাঁর ব্যক্তিগত মাল বায়তুলমালে কেন জমা দিয়েছিলেন।
এই সমস্ত বর্ণনায় এমন কোন সুস্পষ্ট তথ্য নেই যে, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাঁর ব্যক্তিগত মাল বায়তুলের কেন জমা দিয়েছিলেন।
তবে ধারণা করা হয় যে, হয়ত তাঁর খাদেমগণ অথবা তার পরিবারের লোকেরা সাধারণ লঙ্গরকানা হতে খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করেছিল এবং হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তা এভাবে পরিশোধ করে দিয়েছেন।
অথবা এটাও সম্ভব যে, তখন বায়তুল মালে প্রশাসন পরিচালনা প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব ছিল বলে তিনি তার সমস্ত সম্পদ বায়তুল মালে জমা দিয়েছিলেন।
যা হোক, হযরত ওমর ইবনে আজিজের মতে সাধারণ মানুষের সম্পদ দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণ করা কোন মতেই উচিত নয়। যদি প্রয়োজনের তাগিদে তিনি কখনও বায়তুল মাল হতে কোন কিছু গ্রহণ করতেন তবে তা ফেরত দেয়া অবশ্য প্রয়োজন বলে মনে করতেন। উদাহরণ স্বরূপ তাঁর মন্ত্রী ফুরযাত ইবনে মুসলেমার ভাষ্যটি উদ্ধৃতি করা হল।
ইবনে মুসলেমা বলেন, প্রত্যেক জুমার দিন তার নিকট সমস্ত কাগজপত্র হাজির করা হত। সে রীতি অনুযায়ী আমি এক জুমার দিন তাঁর নিকট কাগজপত্র হাজির করলে তিনি তার কোন প্রয়োজনে চার অঙ্গুলী পরিমাণ একটুকরো কাগজ নিয়ে রাখলেন। আমি মনে করলাম, তিনি এর কথা ভুলে গিয়েছেন। দ্বিতীয় দিন তিনি আমাকে কাগজপত্র নিয়ে আসতে ডেকে পাঠালেন। আমি কাগজপত্র নিয়ে হাজির হলে তিনি আমাকে কাগজপত্র নিয়ে ভিতরে আসতে বললেন। আমি ভিতরে প্রবেশ করলে তিনি বললেন, এখন আমার খুবই ব্যস্ততা অবসর নেই। কাগজপত্র রেখে চলে যাও। আমি তোমাকে ডাকলে এসো। এরপর আমি কাগজপত্র নিয়ে ফিরে গিয়ে খাতা পত্র খুলে দেখি যে, যে পরিমাণ কাগ খলিফা নিয়েীছিলেন সে পরিমাণ কাগজ দিয়ে দিয়েছেন।
ইবনে সাদ হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের পোষাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে বলেন যে, হযরত ওমর ইবনে আজিজের ঘরে কাল রঙ্গের একটি পুরাতন জামা পরিধান করতেন।
মায়মুন কর্তৃক বর্ণিত আছে, আমি ছয় মাস পর্যন্ত ওমর ইবনে আজিজের নিকট ছিলাম। এ ছয় মাস তার গায়ে একটি চাদর ব্যতীত অন্য কোন কাপড় দেখিনি। এ চাদরটি তিনি জুমার দিন ধুয়ে দিতেন।
ইবনে মাআফফা বলেন, হযরত ওমর ইবনে আজিজ একবার অসুস্থ হলেন। মুসলেমা ইবনে আবদুল মালেক তার নিকট আগমন করল এবং তার ভগ্নি ফাতেমাকে বলল, খলিফার অবস্থা আজ কিছুটা সংকটাপন্ন, তাঁর গায়ের জামাটি খুব নোংরা দেখা যাচ্ছে। এটা বদলিয়ে দাও, যেন লোকজনকে তাঁর নিকট আসার অনুমতি দেয়া যায়। ফাতেমা কিছু বললেন না। মুসলেমা তার কথাটির পুনরুক্তি করল যে, তাকে অন্য কোন জামা পরিধান করিয়ে দাও। ফাতেমা কসম করে বললেন, এটা ছাড়া তার অন্য কোন জামা নেই।
অপর এক বর্ণনাকারী বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খুব ছোট চাদর পরিধান করতেন। তা খুব বেশী হলে ছয় ফুট এক গিরা লম্বা এবং সাত গিরা প্রশস্ত থাকত।
ওমর ইবনে মায়মুন বলেন, হযরতের জামার মূল্য ছিল খুব বেশি হলে এক দীনার।
রেজা ইবনে হায়াত বলেন, যখন ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খলিফা নির্বাচিত হলেন তখন তার খাদেমগণ তাঁর জন্য যে পোষাক ক্রয় করেছিল তার মূল্য ছিল বার দেরহাম। এটা মিশরীয় কাপড় ছিল। তন্মধ্যে জামা, পাগড়ী, কুবা, মোজা ইত্যাদি সবকিছুই ছিল।
সায়ীদ ইবনে সুয়াইদ বলেন, একবচার তিনি ওমর ইবনে আবদুল আজিজের সাথে জুমার নামায পড়ার সময় দেখলেন যে, তার জামার সামনে ও পিছনে অসংখ্য তালি লাগনো আছে। অপর এক বর্ণনাকারী বলেন যে, তিনি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজজে খানাফেরা নামস স্থানে ভাষণ দিতে দেখেছেন, তখন তার জামায় তালি লাগানো ছিল।
মারুফ ইবনে ওয়াছেল একবার তাকে মক্কা শরীফে আগমন করতে দেখলেন তখন তার পরিধানে মাত্র দু’টি চাদ ছিল। অন্য এক বর্ণনাকারী বলেন, আমি তাকে শুধু একটি জুব্বা পরিহিত অবস্থায় নামায পড়তে দেখেছি, তখনও তার পরিধানে কোন পয়জামাও ছিল না।
ইবনে আদুল হাকাম বলেন, একবার তিনি জুমার নামাযে আসতে দেরী করলেন, এতে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, আমি জামা ধৌত করে তা শুকানোর জন্যে রোদ্রে দিয়েছিলাম। কাজেই দেরী হয়েছে।
ফাতেমাও কসম করে একথাই বলেছিলেন যে, একটি মাত্র জামা ব্যতীত তাঁর আর কোন জামা নেই।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন যে, একবার তিনি তার কোন এক লোককে কাপড় ক্রয় করতে আশিটি দেরহাম দিলেন। তাঁর কাপড় ক্রয় করে আনলে তিনি তার উপর হাত রেখে বললেন, কত নরম! কত মুলায়েম! সে ব্যক্তি এ কথা শুনে হেসে দিল, তিনি তাকে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আপনি খলিফা না হতে একবার আপনার জন্য আটশত দেরহাম দিয়ে একটি জামা ক্রয় করেছিলাম, আপনি তা দেখে বলেছিলেন, কত মোটা! কত শক্ত ও অমসৃণ? আর আজ আশি দেরহাম দিয়ে যে কাপড় ক্রয় করা হয়েছে, তা দেখে আপনি বলেছেন, কত নরম ও মসৃণ। এতে আমি আশ্চার্য়ান্বিত হয়ে হেসে দিলাম। আবদুল ফরিদে আছে যে, সে ব্যক্তির নাম ছিল রেবাহ।
অন্য এক বর্ণনায় হযরত ওমর ইবনে আজিজের সম্পূর্ণ পোষাকের মূল্য ষাট দেরহারম ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইবনে জাওযি বলেন যে, হযরত ওমর ইবনে আজিজ নিজে তাঁর পূর্ণ পোষাক জামা চাদর ও পায়জামার মূল্য ১৪ দেরহাম ছিল বলেছেন। এক বর্ণনায়ই আছে যে হযরত ওমর ইবনে আজিজকে জিজ্ঞেস রা হল, আপনি জুমার নামাজে দেরীকরে এসেছেন কেন? তখন তিনি বললেন, আমি কাপড় ধৌত করে তা শুকানের জন্যে রোদ্রে দিয়েছিলাম। তখন বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করলেন, কি কি কাপড়? ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জবাবে বললেন, জামা, চাদর ও পায়জামা তার মূল্য ১৪ দেরহাম।
খলিফা নির্বাচিত হবার পর তিনি এ জাতীয় পোষাক পছন্দ করতেন। অথচ খেলাফতের পূর্বে তিনিও একজন অভিজাত শ্রেণীর শাহজাদার মত কাপড় ব্যবহার করতেন এবং তিনি সম-সাময়িক যুগে সর্বোত্তম পোষাক পরিধানকারী হিসেবে খ্যাত ছিলেন।
খাদ্য ও পোষাকে তিনি যে আড়ম্বরহীনতা অবলম্বন করেছিলেন, বাসস্থানের বেলায়ও ঠিক সেরূপই অপলম্বন করেছিলেন। তাঁর ধারনায় সরকারী অর্থ ব্যয়ে তার প্রাসাদ তৈরি করা একটি জঘন্য অপরাধ বলে মনে করতেন। তিনি তার কয়েক বৎসরের শাসনামলে কোন প্রাসাদ নির্মাণ করতেন। তিনি তার কয়েক বৎসরের শাসনামলে কোন প্রাসাদ নির্মাণ করেনিনি। তাঁর পূর্বর্তী খলফাগণ যেরূপ সরকারী অর্থে শাহী প্রাসাদ ও অন্যান্য প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, তা দেখে তিনি কসম করেছিলেন যে, কোন দিন তিনি ক্ষমতা লাভ করলে সরকারী অর্থ ব্যয় করে কোন প্রাসাদ নির্মাণ করবেন না।
ইবনে জাওযি তাঁর এক খাদেরমের ভাষ্য উদ্ধৃতি করেছেন, ভাষ্যটি হলো, হযরত ওমর ইবনে আজিজের জন্য একটি চোবতরা নির্মাণ করা হয়েছিল। মাঝে মাঝে তার সিঁড়ির ইট খসে পড়ছিল। তিনি যখন তাতে উঠা নামা করতেন তখন তার ইট নড়া চড়া করত। তার এক খাদেম কাদা দিয়ে সেই ইট খসা ইটগুলো লাগিয়ে দিল। একনিদ সিড়ি দিয়ে নামার সময় সে ইট আর নড়াচড়া করল না। তখন তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। খাদেম বলল, আমি কাদা দিযে ঠিক করে দিয়েছি। তখন তিনি বললেন, আমি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছিলাম, যদি আমি ক্ষমতা লাভ করি, তবে পাকা বা কাঁচা ইট দিয়ে কোন কিছু নির্মাণ করব না।
হযরত ওমর ইবনে আজিজ খেলাফত লাভ করে শুধু থাকা-খাওয়া ও পোষাক পরিচ্ছেদই আড়ম্বরহীনতা অবলম্বন করেননি, ইবনে কাছীরের ভাষ্য অনুযায়ী সর্বপ্রকার আরাম আয়েশ এবং বিলাস সামগ্রী বর্জন করেছিলেন।
ইবনে কাছীরের ভাষ্যটি নিম্নে উদ্ধৃত করা হল-
তিনি পোষাক পরিচ্ছদ, থাকা খাওয়াসহ সকল প্রকার ভোগ বিলাস ত্যাগ করেছিলেন। এমন কি তার অনিন্দ সুন্দরী স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আবদুল মালেকের সম্ভোগ পর্যন্ত বর্জন করেছিলেন।
ফাটা ও মোটা কাপড়ই ছিল তার সাধারণ পোষাক। তাঁর দরবারে যে প্রদীপদি জালানে হতে তাও বাঁশর তিনটি খুটির উপর রাখা হত এবং প্রদীপটি ছিল মাটির। তিনি তাঁর শাসনামলে কোন ঘর বা প্রাসাদ তৈরী করেননি। তিনি নিজেই কাজ সম্পাদন করতেন। তিনি খুব নিম্নমানের খাদ্য আহার করতেন এবং কোন প্রকার ভোগ বিলাস পছন্দ করতেন না। তিনি তাঁর আনাবশ্যক বাসনা পূর্ণ করেননি।
ইবনে কাছীর বলেন, হযরত ওমর ইবনে আজিজ বায়তুল মাল হতে কোন অর্থ গ্রহণ করতেন না। খেলাফত পূর্বে তার বার্ষিক আমাদানী ছিল চল্লিশ হাজার দেরহাম। তিনি এ সমস্তই বাইতুল মালে জমা দিয়ে দিলেন। নিজের জন্যে শুধু বার্ষিক দু’শত দেরহাম আমদানীর একটি সম্পত্তি রেখেছিলেন।
এ উঁচু স্তরের তাকওয়ার ও পরহেজগারীর সাথে সাথে তিনি উঁচু স্তরে সঞিষ্ণুতার, বিনয় নম্রতা অবলম্বন করেছিলেন িএবং খাওয়া পরা ও বসবাসের অনাড়ম্বরতার সাথে সাথে আচার-আচরণেও ভদ্র ও মার্জিত ছিলেন। তিনি পূর্ববর্তী বাদশাদের মত লোকজনকে নিজের জন্য দাঁড় করে রাখতেন না এবং তাদের সাথে অভদ্র অমার্জিত আচরণও করতেন না। তারপরেও যে তিনি তাদের চেয়ে উত্তম এটা কোন প্রকারেই প্রকাশ করতেন না।
ইএন জাওযি ও ইবনে কাছীর এ সম্পর্কে একটি উদাহরণ পেশ করে বলেছেন যে, একবার হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তা কোন এক দাসীকে পাখা করতে বললেন। দাসী পাখা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল। তখন হযরত ওমর ইবনে আজিজ পাখা দিয়ে দাসীকে বাতাস করতে লাগলেন। অবশেষে দাসীর নিদ্রার ঘোর কেটে গেলে সে খলিফাকে বাতাস করতে দেখে চিৎকার করে উঠলো। খলিফা বললেন, অস্থির হওয়ার কোন কারণ নেই। তুমিও আমার মতই একজন মানুষ। আমার মতই তোমরও গরম লেগেছিল আমার ইচ্ছা হলো তুমি যেরূপ আমাকে বাতাস করেছ আমিও তোমাকে সেরূপ বাতাস করি।
এ ধরনের অত্যাশ্চর্য উদাহরণ আম্বিয়া (আ) সাহাবায়ে কেরামগণ ও আওলিয়াগণ ছাড়া কোন সাধারণ মানুষের জীবন ঘটতে দেখা যায় না।
একদিন হযরত ওমর ইবনে আজিজ নামাযের পর দরবারে বসে সাধারণ মানুষের অভিযোগ শুনছিলেন। এমন সময় হযরত উসামা ইবনে যায়েদের (রা) এক কন্যা তার সেবিকাসহ সেথায় এসে উপস্থিত হলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে দেখে তার আসন ছেড়ে উসামা ইবনে সাদেরের কন্যার দিকে অগ্রসর হলেন এবঙ তাকে সসম্মানে নিজের আসনে বসতে দিলেন এবং তিনি তার সামনে বসে তার কথা শুনলেন এবং তার সকল প্রয়োজন পূরণ করে দিলেন।
হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা) রাসূলূল্লাহ (সা)-এর আজাদকৃত গোলাম হযরত যাযেদ (রা)-এর পুত্র ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইন্তেকালের পর সিরিয়া অভিযানকারী সৈন্য বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর কন্যা রাসূলুল্লাহ (সা) এরই একজন আজাদকৃত গোলামের পৌত্রী ছিলেন।
রেজা ইবনে হায়াত, যিনি খলিফা সুলায়মানে প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন, তিনি বলেন, আমি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের সাথে রাত্রি যাপন করেছিলাম। বাতির আলেঅ তখন নিভু নিভু করছিল। তার পার্শ্বেই খাদেম শুয়েছিল। আমি বললাম খাদেমকে জাগিয়ে দেব কি? তিনি বললেন না, তাকে ঘুমাতে দাও। আমি বললাম, তবে আমি উঠি। তিনি বললেন, না, মেহমান দিয়ে কাজ করান অভদ্রতা ও মানবতা বিরোধী। তারপর তিনি চাদর রেখে উঠে তৈল পাত্রের নিকট গেলেন এবং বাতিতে তৈল ভরে তৈল পাত্রটি যথাস্থানে রাখলেন। তারপর বললেন, যখন আমি একাজ করতে উঠলাম তখনও আমি হযরত ওমর ইবনে আজিজ আর এখনও আমি সেই হযরত ওমর ইবনে আজিজ।
সাধারণ মানুষের জীবনে এ ধরনের উদাহারণ প্রায়ই দেখা গেলেও রাজা বাদশাদের জীবনের বিশেষতঃ আবদুল মালেক, ওয়ালিত ও সুলায়মানের মত বিলাসী বাদশাদের জীবনে এ ধরনের উদাহরণ পাওয়া ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার।
আল হাকাম ইবনে ওমর আর রাবিনী বলেন, একবার প্রবল বৃষ্টির দিনে আমি হযরত ওমর ইবনে আজিজের সাথে এক জানাযায় শরীক ছিলাম। এক অপরিচিত ব্যক্তির ছাতা ছিল না। সে তার সামনে আসলে তিনি তাকে কাছে ডেকে এনে তার পাশে বসালেন এবং তার চাদর দিয়ে তাকে জড়িয়ে দিলেন।
এ ভাষ্যকারই বলেন, আমি ওমর ইবনে আজিজকে দেখিছি যে, তিনি সাধারণ লোকদের এক মজলিস হতে উঠে অন্য মজলিসে গিয়ে বসেছেন। সাধারণতাঃ কোন অপরিচিত লোক এসে তাঁর কাছেই জিজ্ঞেস করত, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ কোথায়? কারণ তার সাজসজ্জায় তাকে চিনার কোন উপায় ছিল না।
তারপর হয়তো কেউ ইশারা করে তাকে দেখিয়ে দিত আর তখন সে অবাক হয়ে তাঁকে সালাম করত।
তিনি জেনে বুঝেই এ সাধারণ বেস-ভুষা ব্যবহার করতেন। তিনি সাধারণ মানুষের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করার উদ্দেশ্যেই হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর নীত অনুসরণ করে সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসলেন।
তিনি কারও নিকট হতে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। অথচ তাঁর পূর্ববর্তী খলিফাগণ যে কোন ঔদ্ধত্ব প্রকাশকারীকে নির্মূল করে দিত।
খানাফেরার জনৈক লোক বলেন, একবার ফাতেমার গর্ভজাত এক পুত্র অন্যান্য বালকদের সাথে খেলা করতে বাড়ীর বাইরে গিয়েছিল। অন্য এক বালক তাকে মেরে আহত করল। লোকেরা এটা দেখতে পেয়ে আহতকারী বালকসহ খলিফার বাড়ীর ভিতর ফাতেমার নিকট নিয়ে গেল। ক্রন্দন ধ্বনি শুনে হযরত ওমর ইবনে আজিজ ঘরের এক কামরা হতে বাইরে এসে দেখলেন যে, এক মহিলা চিৎকার করে বলছে এ আমার এতীম ছেলে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ছেলে কি বায়তুল মাল হতে বৃত্তি পায়? মহিলা বলল, না। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের বললেন, এখনই এ ছেলেকে বৃত্তি গ্রহণকারীদের তালিকায় নাম লিখে নাও। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা ক্ষোভে দুঃখে বললেন, এ ছেলে আপনা ছেলেকে আহত করেছে আর আপনি কি না তার বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। আল্লাহিই তাকে এতীম করেছেন এটা তাঁরই কাজ। সে আপনার ছেলেকে আহত করেছে আবার হয়ত অন্য ছেলেকে আহত করবে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বললেন, তোমরা তাকে ভয় পাইযে দিয়েছ। আর কেন?
পুত্র সন্তানের প্রতি স্নেহ বাৎসল্য সকলেরই থাকে, বিশেষতঃ রাজা-বাদশাহদের ছেলে মেয়ে খুবই আদরের হয়ে থাকে। এ এতীম বালকটিই ফাতেমা বিনতে মালেকের পুত্র, ওয়ালিদ ও সুলায়মানে ভাগিনা এবং ওমর ইবনে আবদুল আজিজের ঔরষজাত সন্তানকে আহত করেছে আর তিনি স্বয়ং ছেলের পক্ষে ওকালতি করেছেন কিন্তু হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এতীম বালকের ব্যাপারে কারও কথা শুনলেন না। তাকে একটু ধমক পর্যন্ত দিলেন না। বরং বায়তুল মাল হতে তার ভাতার ব্যবস্থা করে দিলেন। একমাত্র হযরত ওমর ইবনে আজিজ ব্যতীত দুনিয়ার আর কোন বাদশাহের জীবনে এরূপ আদর্শ চরিত্রের উদাহরণ আছে বলে জানা যায়নি।
ইবনে জাওযি বলেন, একদিন ওমর ইবনে আবদুল আজিজ বৈঠক শেষ করে উঠেছেন এমন সময় একটি লোক কাগজপত্র নিয়ে উপস্থিত হল। লোকে মনে করল, সে হয়ত খলিফার নিকট কোন আবেদন করবে কিন্তু লোকটির ধারণা হল যে, হয়তো এসব লোকটির ধারণা হল যে, হয়তো এসব লোক তাকে খলিফার নিকট যেতে বাধা দিবে। কাজেই সে কাগজের পুটলিটি খলিফঅর দিকে ছুড়ে মারল। খলিফা এ দিকেই মুখ ফিরালেন, সেটা গিয়ে খলিফার মুখ মন্ডলে লাগল এবং তাকে আহত করে দিল। তাঁর মুখমন্ডল হতে রক্ত বের হতে লাগল। কিন্তু তিনি রৌদ্রে দাঁড়িয়ে সে সমস্ত কাজপত্র দেখতে লাগলেন। কাগজপত্র পাঠ শেষে তিনি তার পক্ষে যা ভাল সেরূপ নির্দেশ দিলেন। আর তাকে কিছুই বললেন না। বিনয় নম্রতার এরূপ উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহসে আর পাওয়া যাবে না।