শরীয়ত বিরোধী আইনের সংস্কার
শরিয়ত বিরোধী আইনের সংস্কারের মহান খেদমতের কারণে সমকালীন আলেম সমাজ ও ঐতিহাসিকগণ ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে খুলঅফায়ে রাশেদার যুগের হাদী প্রভৃত সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তিনি এ মহান খেদমতের ফলেই দ্বিতীয় ওমর ও যুগের আবু বকর হিসেবে প্রশংসিত হতে পেরেছিলেন।
খেলাফরেত দায়িত্ব গ্রণ করে প্রথম দিনই রাষ্ট্রের শাসনকর্তাদের নিকট তিনি যে আদেশ নামা লিখেছিলেন- তাতে সুস্পষ্ট রূপেই ব্যক্ত করেছিলেন যে, ইসলামের কতকগুলি শরায়ে ও সুনাম রয়েছে। যে ব্যক্তি সে অনুযায়ী কাজ করে না, তার ঈমান অপূর্ণ রয়ে গেছে। যদি আমি জীবিত থাকি তবে তোমাদেরকে এ সমস্ত নমুনা বা পদ্ধতি শিক্ষা দেব। সে অনুযায়ী কাজ করতে তোমাদেরকে বাধ্য করব। আর যদি মরে যাই তবে আমি তোমাদের মধ্যে থাকার জন্য লোভী নই।
ইবনে আল হাকাম বলেন যে, তিনি সেদনি সাধারণ ভাষণে এ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-
(আরবী*****************)
আল্লাহ রাসুল (সা) এবং তার মহান খলিফাগণ আমারেদ জন্য একটি কর্মপদ্ধতি রেখে গিয়েছেন। সে কর্ম পদ্ধতির অনুসরণ করেই আল্লাহর বিতাবের বাস্তবায়ন ও তাঁর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা সম্ভব-অন্য কোন উপায়ে তা সম্ভব নয়। কোন ব্যক্তিই তা পরিবর্তনের সাহস দেখাতে পারে না, এমনকি এ কর্মপদ্ধতির পরিপন্থী কোন চিন্তাও করতে পারে না। যে এর দ্বারা পথের সন্ধান করবে সে সুষ্ঠুপতেল সন্ধান পাবে, যে এর সাহায্য কামনা করবে সে সফলকাম হবে, আর যে এটা বর্জন করে অন্য কোন পথে চলবে, তার পরিণাম হবে দুঃখময় জাহান্নাম।
অপর এক বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মুসলমানদেরকে বলেছিলেন, হে লোক সকল! তোমাদের নবীর পর আর কোন নবী আসবেন না। তোমাদের নবীর উপর যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে এরপর আর কোন কিতাবও অবতীর্ণ হবে না। অতএব আল্লাহ কাপ তাঁর মাধ্যমে যা হালাল করেছেন তা কিয়ামত পর্যন্ত হালাল থাকবে এবং যা হারাম করেছেন তা কিয়ামত পর্য্ত হারাম হিসেবে গণ্য হবে। আমি এমন বিচারক নই যে, আমি আমার স্বাধীন ইচ্ছ অনুযায়ী কোন কিছুর মীমাংসা দার করব। আমি শুধু আল্লাহর নির্দেশসমূহকেই বাস্তবায়িত করব এবং ব্যতিক্রম কিছুই করব না।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাঁর প্রথম দিনের ভাষণে এ কথাও বলেছিলেন, আল্লাহ পাক কতকগুলো কাজ ফরয করে দিয়েছেন, কিছু কর্ম-পদ্ধতিও স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে সে সফলতা লাভ করতে আর যে বিরোধীতা করবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।
সাধারণ ভাষণে তিনি জনসাধারণকে আরো বলেছিলেন, সুন্নাতের বিপরীত জীবনে কোন শান্তি নেই। আর আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে কোন সৃষ্ট জীবের অনুসরণ করা উচিত নয়।
ইবনে জাওযি বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের প্রত্যেকটি চিঠিতে এ তিনটি বিষয়ের নির্দেশ অবশ্যই থাকত; সুন্নাতের সংস্কার, বেদআত প্রতিরোধ ও মুসলমানদের মধ্রে সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন। উদাহরন স্বরূপ তাঁর প্রথম আদেশ নামটির মর্মার্থ উল্লেখ করা হল।
আমি তোমাদেরকে আল্লহর কিতাব ও নবী এর সুন্নাতের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিচ্ছি।
যে সমস্ত কাজ করতে হবে এবং যে সমস্ত কাজ করতে হবে না আল্লাহ পাক সে সমস্ত তার কিতাবে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। কাজেই আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ মত চল তাঁর নির্দেশিত পদ্ধতি মেনে নাও। তিনি যে সমস্ত কাজের নির্দেশ দিয়েছেন সেটাও কর্তব্য বলে মনে কর। তার মুশাবিহাত গুলোর প্রতি ঈমান আন। আল্লাহ তোমাদের যা শিখাতে চান তা স্পষ্টরূপে বলে দিয়েছেন।
তিনি যা হালাল করেছেন তা কিয়ামত পর্যন্ত হালাল আর যা হারাম করেছেন তা কিয়ামত পর্যন্ত হারাম থাকবে। আল্লাহ তাঁর পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর নবীকে অবহিত করেছেন। নবী তা উত্তম রূপে উপলব্ধি করেছেন এবং সে পদ্ধতির অনুসরণেই তিনি তাঁর উম্মাতের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছেন।
আল্লাহ পাক তাঁর কিতাব ও তার নবীর মাধ্যমে দ্বীন-দুনিয়ার সকল বিষয়েই শিক্ষা দিয়েছেন কোন কিছুই বাদ দেননি। এটা তোমদের জন্য এক বিরাট নেয়ামত। এর জন্য তোমাদের আল্লাহর শোকর আদায় করা ওয়াজিব।
আল্লাহর কিতাব ও নবীর পদ্ধতে তোমাদের কারো শোকর আদায় করা ওয়াজিব।
আল্লাহর কিতাব ও নবীর পদ্ধতিতে তোমাদের কারো কোন প্রকার ছল চাতুরীর সুযোগ নেই। সে সমস্ত নির্দেশের সামনে তোমাদের কারো ব্যক্তিগত মতামতের কোন মূল্য নেই। তোমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হল সে সমস্ত নির্দেশকে বাস্তাবিয়ত করা , তার জন্য চেষ্টা করা। অবশ্য যে সমস্ত বিষয়ে মীমাংসা করা শুধু শাসকেরই দায়িত্ব তাতে বাড়াবাড়ি করবে না এবং তার মতামত ব্যতীত কোন ফায়সালা করবে না।
আমি আমার চিঠির মোধ্যমে তোমাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলাম। আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাতের পূর্বে তোমরা ভ্রষ্ট ও অজ্ঞতার অন্ধাররে নিমজ্জিত ছিলে। তোমাদের জীবন ছিল বেকার। আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে তোমাদের সে দুর্বলতাকে সম্মান, শান্তি ও সামাজিক ঐক্যের মাধ্যমে পরিবন্তন করে দিয়েছেন। অন্যের হস্তস্থিত যে সমস্ত সম্পদ তোমরা লাভ করতে সমর্থ ছিলেনা, আল্লাহ সেসব তোমাদের দান করেছেন। আল্লাহ পাক বিশ্বাসীদের সাথে এ প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলেন।
আমি শুধু এ উদ্দেশ্যেই এ পত্র লিখেছি, আমার চিন্তাধারা সম্পর্কে যারা আজও অজ্ঞ, তারা যেন সাবধান হয়ে যায় এবং তারা যেন এটাও জেনে রাখে যে, আমি বাকপ্রিয় নই, তবে হ্যাঁ, যে সমস্ত সমস্যার দ্রুত সমাধানের প্রয়োজন সেখানে ভিন্ন কথা।
স্মরণ রেখ, আমি আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাত এবং আমার পূর্ববর্তীদের আদর্শ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত আছি।
এ পবিত্র পত্রটি খুব দীর্ঘ। আমরা এর কিচু অংশ এ উদ্দেশ্যে উল্লেখ করলাম যেন সম্মানিত পাঠকবৃন্দ জানতে পারেন যে, এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা হয়েও হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার কর্মচারীদের সামনে কোন ধরণের কর্মপদ্ধতি পেশ করেছিলেন।
এ পত্রে একজন বিজ্ঞ আইনজ্ঞের যুক্তিও আছে, অপরদিকে একজন দৃঢ়চেতা শাসকের আত্মবিশ্বাসেরও অভিব্যক্তি রয়েছে।
এরপর তিনি অপর একটি পত্রে তার কর্মচারীদেরকে শুধু একজন দৃঢ়চেতা শাসক হিসেবে সম্বোধন করেছেন।
তিনি লিখেছিলেন, তোমরা এটা নিজের জন্য অপরিহার্য মনে কর, যখন তোমরা কোন মজলিসে কথা বলবে বা নিজ বন্ধু-বান্ধবের সাথে মেলা মেশা করবে তখন আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাতের পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই উল্লেখ করবে। তাদেরকে আল্লাহর কিতাব এবং নবীর সুন্নাতের পরিপন্থী কাজ হতে ফিরিয়ে রাখবে। মনে রেখ, সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা বর্তমান, যেমন আলোকের বিরুদ্ধে অন্ধকার বর্তমান। জাতি সৎপথ স্বরূপ দৃষ্টিশক্তি লাভ করার পর তাকে ভ্রষ্টতা স্বরূপ অন্ধকার হতে বাঁচিয়ে রাখা তোমাদের মৌলিক দায়িত্ব।
আমি তোমাদের যে সমস্ত নির্দেশ দিয়েছি যথাযথ ভাবে তার অনসরণ কর এবং যে সমস্ত কাজ করতে নিষেধ করেছি তা হতে বিরত থাক। তোমাদের কেই যেন আমার ইচ্ছা বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে। কারণ তোমাদের নিকট যে ধন-সম্পদ রয়েছে আমি তার অকাঙ্ক্ষী নই এবং আমার নিকট যা আছে তাতেও আমার খুব একটা আসক্তি নেই।
মনে রেখ, আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাতের সাথে যে কো প্রকার বিরোধ সহ্য করা হবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল এবঙ আমার নির্দেশের বিরোধীতা করবে ইমও কখনও তাকে শাসন ক্ষমতায় থাকতে দিব না।
উপরের লাইন কয়টির উপর গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ভালভাবেই জানতেন যে, তার কর্মচারীদের কারও নিকট অগাধ ধন-সম্পদ রয়েছে। সে হয়ত তার ধন-সম্পদের জোরে তাঁর অন্তর জয় করতে চেষ্টা করবে। এ জন্যই তিনি প্রথম হতেই তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের লেখা সমস্ত চিঠিসমূহ সামনে রাখলে ইবনে জাওযির বর্ণনাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে মনে হবে। উদাহরণ স্বরূপ তাঁর লেখা একটি চিঠির মর্মার্থ উল্লেখ করা হল।
যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর, তুমি যে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত আছ এবং ভবিষ্যতে যেখানে পৌছাবে তার প্রতিও সদা লক্ষ্য রেখ। শত্রুর সাথে তোমার সংগ্রাম কর নিজ প্রবৃত্তির সাথে সে রূপেই সংগ্রাম কর। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ঘৃণিত কাজে ধৈর্য ধারণ কর। তিনি মুমিনদের যে সব প্রতিশ্রুটি দিয়েছেন, তাঁর সেই সব প্রতিশ্রুতির প্রতি গভীর ভাবে বিশ্বাস রেক।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার অধীনস্থ লোকদের প্রতি কড়াকড়ি করতে এবং সৈনিকদের কঠোর শাস্তি দিতে নিষেধ করে সকলের সাথে সদয় ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ চিঠিতে তিনি আরও লিখলেন, নিজের অধীনস্থদের প্রতি সদয় ব্যবহার কর। তাদের নগদ অর্থ বা অন্য কোন বস্তু সামগ্রীর ভেট গ্রহণ করবে না, এমনকি প্রশংসা এবং কাব্যের দ্বারাও না।
তোমার নিজের দ্বার রক্ষক সৈনিকের, প্রহরীদের এবং বাইরের যাতায়াতকারী কর্মচারীদের নিকট হতে এ মর্মে প্রতিশ্রুটি গ্রহণ কর যে, তাঁরা কারো প্রতি জুলুম –অন্যায় করবে না, কাউকে কষ্ট দেবে না। সবসময় তাদের কঠোর হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করবে! তাদের মধ্যে যে সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ তাকে উত্তমরূপে পুরস্কার প্রদান করবে। আর যে অসৎ ও অলস তাকে চাকরী হতে বরখাস্ত করবে এবং তার পরিবর্তে সৎ কর্তব্য সচেতন ঈমানদার লোক নিয়োগ দিবে। আল্লাহ পাক তার নিকট তাঁর সৃষ্টি জীবের উপর আমাকের যে ক্ষমাত দিয়েছেন সে জন্য আমি তাঁর নিক ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের কাজ সহজ করে দেন, আমাদের অন্তরে সৎকর্মের প্রেরণা দান করেন, আমাদেরকে সংযমশীলতার তওফিক দান করেন এবং তিনি যে কাজে সন্তুষ্ট তাই যেন করতে সুযোগ দান করেন তার অপছন্দনীয় কাজ হতে যেন আমাদেরকে বিরত রাখেন।
তিনি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তদের নিকট যকন এ দুটি পত্র প্রেরণ করেন, প্রায় সে সময়ই খাওয়ারেজেদের কতিপয় দলপরিত নিটরও একটি পত্র লিখেছিলেন। নিম্নে তার মর্মার্থ উল্লেখ করা হলো-
আল্লাহ পাক নগন্য বান্দা আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট হতে তাদের নামে যারা দল ত্যাগ করে পৃথক হয়ে গিয়েছে আমি তোমাদের আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাত অনুসরণের জন্য আহবান করছি। মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং সৎকর্মের আহবান করে, তার কথার চেয়ে উত্তম আর কার আছে? এবং বলে আম আত্মসমর্পণকারী। আমি তোমাদেরকে তোমাদের নিতাদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে আল্লহর স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি এবং তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করছি, তোমরা কিসের ভিত্তিতে দ্বীন ত্যাগ করেছ, হারাম রক্তকে হালাল করেছ এবঙ হারাম মাল গ্রহণ করেছ?
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সেনাপতি মনসুর ইবনে সালেবকে যখন দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নির্বাচন করলেন এবং সৈন্য বাহিনীসহ তাকে বাহিরে প্রেরণ করলেন তখনও তিনি তাকে যেসব নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে সর্বপ্রকার নির্দেশ চিল- প্রত্যেক কাজ ও কথায় আল্লাহকে ভয় করবে। কারণ আল্লাহর ভয়ই সর্বপ্রকার সৎকর্মের উৎস। তারপর তাকে নির্দেশ দিলেন, তোমার ও তোমার সঙ্গীদের আল্লা দ্রোহীতাকেই সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করবে এবং সবসময় তা হতে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করবে।
এরূপ একটি সাধারণ পত্র তিনি তাঁর সেনাপতিদেরকেও লিখেছিলেন। তাদেরকেও এ কথাই বুঝিয়েছিলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিতাবের অনুরসরণ করবে তার দ্বীন তার জীবন ও তার পরকাল সব কিছুতেই সীমাহীন সুখ-শান্তি লাভ কবে।
সামরিক বেসারিক সমস্ত কর্মচারী নাগরিকদের উদ্দেশ্যে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা এর চেয়ে আরও পরিষ্কার ভাষায় বর্ণিত ছিল।
আমি প্রত্যেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করতে, আমানত রক্ষা করতে এবঙ আল্লাহর নির্দেশসমূহ বাস্তবায়িত করতে এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছি। অপর একটি আদেশে তিনি সমস্ত কর্মচারীদের বলেছিলেন যে, স্মরণ রেখ, আল্লাহজ পাক মুহাম্মদ (সা) কে যে সত্য দ্বীন, যে আলো ও জীবন ব্যবস্থাসহ প্রেরণ করেছেন তা প্রচলিত সমস্ত দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থাসহ প্রেরণ করেছেন তা প্রচলিত সমস্ত দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থার উপর জয়ী হবে, যদিও অংশীবাদীগণ তা অপছন্দ করে। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা) কে যে কিতাবসহ দেওয়া হয়েছে তার মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য এবং তার নির্দেশ সমূহের অনুসরণ কর, আল্লাহর কিতাবা যে কাজ হতে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক, তার নির্দেশ মত হুদুদ প্রতিষ্ঠিত কর, তাঁর নির্ধারিত কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়িত কর, তার হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মনে কর। যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে সেই সৎপথ প্রাপ্ত হয়; আর যে তার বিরুদ্ধাচরণ করে, সে কুপথ ও অশুভ পরিণামের প্রতিই ধাবিত হয়।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার সামরিক ও বেসামরিক কর্ম-কর্তাদেরকে শুধু সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি। সময় সময় তিনি তাদেরকে প্রয়োজনীয় বিষয়ে শরীয়তের কার্য পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ দিতেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, তিনি তার এক পত্রে লিখেছিলন যে, আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “প্রত্যেক মাদকদ্রব্যই হারাম। আমার মতে সকল মুসলমানকেই তা হতে বিরত থাকতে হবে, সকলেই এর ব্যবহার নিজের জন্য হারাম মনে করবে। কেননা এটা সমস্ত অন্যায় কর্মের মূল উৎস। আমার ভয় হয়, যদি মুসলমানগণ এর ব্যবহার করে তবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
বাজারের জিনিস পত্রে মাপ ও পরিমাণ সম্পর্কেও তিনি নির্দেশ দিয়ে লিখেছিলেন, আমার মতে সমগ্র রাষ্ট্রে সর্বত্রেই পরিমাপও বাটখারা একই হওয়া উচিত। এতে কোন বেশকম যেন না থাকে। ফলে মাপে কম দেয়ার আর সম্ভাবনা থাকবে না তিনি লিখলেন উশর (উৎপন্ন শষ্যের দশমাংশ) শুধু কৃষকদের নিকট হতেই গ্রহণ করা যাবে। কৃষকগণই শুধু এর যোগ্য অন্য কেহ নয়।
জিযিয়ার-কর দেয়ার যোগ্য তিন ব্যক্তি। জমির মালিক, এমন শিল্পী যে উৎপাদন করতে সক্ষম এবং যে ব্যবসায়ী ব্যবসা বাণিজ্য করে তার সম্পদ বৃদ্ধি করে লাভবান হয়। এ তিন ব্যক্তির জিযিয়া-কর সমান সমান হবে। তাদের সম্পদের মুসলমানদের সাদকা প্রাপ্য। বছরে তা একবর গ্রহণীয়। যখনই তা তাদের নিকট হতে গ্রহণ করা হবে, তার প্রাপ্তি স্বীকার করে প্রমাণ দিতে হবে যে, এ বৎসর তার নিকট হতে আর কোন কিছুই গ্রহণ করা যাবে না। নগরশুল্ক, এটা গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। মানুষের সম্পদ হতে নগরশুল্ক গ্রহণ করোনা এবং আল্লাহর জমিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। তরপর লিখলেন- আমর মতে কোন শাসনকর্তা বা কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিজ নিজ কর্মস্থলে কোন ব্যবসা করতে পারবে না।
তিনি তা বর্ণনা করে বলেছেন, এতে তারা অবৈধভাবে অতিরিক্ত লাভবান হবার সুযোগ পাবে। কারণ মানুষ অধিক মূ্ল্যে তার জিনিষপত্র ক্রয় করবে, ফলে শাসক ও কর্মকর্তাদের মনে অধিক অর্থের লোভ সৃষ্টি হবে। তিনি আরও লিখলেন, জমির উত্তরাধিকার তার সত্বাধিকারীদের উত্তরাধকারীদের জন্য অথবা যারা তাদের মত শুল্ক প্রদান করে, তাদের জন্য। তাদেরনিকট হতে জিযিয়া-কর যাবে না অবশ্য শাসকবৈধ খেরাজ গ্রহন করার জন্য তাদের নিকট আদায়কারী পাঠাতে পারবেন এবং সে তার নিকট হতে বৈধ রাজস্ব আদায় করতে পারবে।
এ ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছা্কে পূর্ণনাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি জমির মালিক, কৃষকুকুল ও সাধারণ নাগরিকদের নিকট হতে সর্বপ্রকার অবৈধ কর যা কুরআন অথবা রাসুলূল্লাহ (সা) প্রবর্তন করেননি, তার সব কিছুই বন্ধ করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা) রাজস্বের যে হার ধার্য করেছিলেন, তিনি সেই হারকেই বহাল বা পূনঃপ্রবর্তন করলেন। এমনকি জিযিয়া-কর ও রাজস্বের শরিয়ত নির্ধারিত হার পূণপ্রবর্তন করলেন অমুসলিম ধনীরেদ নিকট হতে ৪৮ দেরহারম এবং ব্যতীত অন্য কোন প্রকার কর আদায় বৈধ মনে করতেন না। হযরত ওমর ফারুক (রা) জমির উৎপাদনের স্তর ভিত্তিক বিভিন্ন জমির যে কর ধার্য করেছিলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ও তার সাম্রাহেজ্যর সর্বত্র তাই পুনঃপ্রবর্তন করলেন। ইবনে সাদ বলেন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ স্বীয় কর্মচারীগণকে নির্দেশ দিলেন যে, যে ব্যক্তি তার সম্পদরে যাকাত দেয় তা আদায় কর আর যে না দেয় তাকে আল্লহর জন্য ছেড়ে দাও।
একবার তিনি তার কর্মচারীগণকে কঠোর নির্দেশ দিয়ে বললেন, জন সাধারণের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা ও তাদের সংস্কারের জন্য কমপক্ষে ততটুকু করবে, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ জোর-জুলুম করতে চেষ্টা করেছিল। একবার তিনি তার কর্মাচারী আদী ইবনে আরতাতকে লিখলেন, আমি বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারলাম যে, আকরাদের (স্থান বিশেষ) পথে চলন্ত পথিকদের নিকট হতে কতিপয় লোক উশর আদায় করছে। যদি আমি তা জানতে পারি যে, তুমি তাদেরকে এরূপ কিছু কতে নির্দেশ দিয়েছ অথবা জানার পর তুমি তা প্রতিরোধ করনি, তবে আমি কখনও তোমার চেহারা দেখব না।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ শুধু অপছন্দনীয় কাজ-কর্মের জন্য তার কর্মচারীগণকে সতর্কই করতেন না, বরং তাদেরকে নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত করার সময় স সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যাদিও তাদেরকে প্রদান করতেন। উহারণ স্বরূপ বলা যায়- তিনি মিশরের শাসনকরাতা আয়্যুব ইবনে মুযরাহিলকে একটি দীর্ঘ পত্র লিখলেন, এতে তিনি বিভিন্ন নিষিদ্ধ কাজের কথা উল্লেখ করে তাদের হুরমত বা অবৈধতা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়তও উদ্ধৃত করলেন।
তিনি লিখলেন, আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের তিনটি সূরায় মদ সম্পর্কে তিনিটি আয়াত নাযিল করেছেন। প্রথম দু’টি আয়াত অবতীর্ণ হবার পরও মানুষ মদ্যপান করত, তৃতীয় আয়াত দ্বারা মদ্যপান হারান ঘোষণা করা হয় এবং স্থায়ীভাবে হারামের হুকুম বলবত করা হয়।
আল্লাহ সর্বপ্রথম বললেন- (আরবী*******************)
অর্থাৎ তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন যে এ দুইয়েল মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য ভীষণ গোণাহ। তবে কিছু লাভও আছে। যেহেতু এই আয়াতে লাভের কথাও আছে, কাজেই এরপও লোক মদ্যপান করত। অতঃপর দ্বিতীয় আয়াত অবতীর্ণ হল- (আরবী******************)
অর্থা হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাযের নিকটবর্তী হইয়ো না। যতক্ষণ না তোমরা বল তা হৃদয়ঙ্গম করতে পার। তখনও লোক নামাযের সময় ব্যতীত অন্যান্য সময়ে মদ্যপান করত। তারপর আল্লাহ পাক এ আয়াত অবতীর্ণ করলেন-
(আবরী*******************)
অর্থাৎ হে বিশ্ববাসীগণ! মদ, জুয়া, জুয়ার কাঠিও শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব তোমরা এ সমস্ত কাজ হতে দূরে থাক, তা হলে তোমরা সফলাম লাভ করবে। এ মদের দ্বারা বহু লোক চরিত্র বিনষ্ট করে ধ্বংসের পথে ধাবিত হয়। অনেক নেশার ঘোরে হারাম বস্তুকে হালাল করে নেয়। অন্যায় রক্তপাত, হারাম সম্পদ ভোগ এবং অবৈধ যৌন ক্রিয়াকে হালাল মনে করে। কোন কোন লোক বলেন যে, “আলা” (এক প্রকার হালকা মাদক দ্রব।) পান করা যায়, কিন্তু আমার জীবনের শপথ, পানাহারের যে দ্রব্যই মদের সাথে সম্পর্কযুক্ত তবে তা নিরাপদ দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়।
কর্মচারীদের হিসাব-নিকাশ
বর্তমানে এটা যদিও অসম্ভব বলেই মনে হয় কিন্তু তবুও সত্য কথা হলো হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যতদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠত ছিলেন, তাঁর সাম্রাজ্যের কোথাও যদি ঘটনাক্রমে কোন কর্মচারী শরিয়ত বিমুখ হয়ে যেত তখন তার কঠোর হিসাব নিকাশ গ্রহণ করতেন। তার কোন কর্মচারী বা শাসনকর্তা ন্যায়বিচার ও ইসলামী জীবন বিধানের বিপরীত কোন কাজ করলে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য করতেন না। তার কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতেন অথবা তাকে ক্ষমতচ্যুত করতেন। তবে আশ্চর্যের কথা হলো, কোন অপরাধী কর্মচারীকেও তিনি শরীয়ত বিরোধী শাস্তি দিতে প্রস্তুত ছিলেন না।
ইবনে জাওযি বলেন- তার নিয়োজিত মদীনার শাসনকর্তা বায়তুল মালের সম্পদ আত্মসাত করেছে। কিন্তু তা এখনও তারা ফেরত দেয়নি। ইবনে হাজম এ অবস্থা সম্পর্কে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে অবহিত করিয়ে যে সমস্ত কর্মচারী এখনও লুন্ঠিত অর্থ ফেরত দেয়নি তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে অনুমিতি প্রার্থনা করলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এ চিঠি পাওয়ার পর ইবনে হাজমকে খুব কঠোর ভাষায় লিখলেন- অতন্ত আশ্চর্যের কথা যে, তুমি মনে মরছ এ অনুমতিই তোমাকে আল্লাহর গজব হতে রক্ষা করবে। সাবধান! যার বিরুদ্ধে দৃঢ় সাক্ষ্য পাওয়া যায়। তার নিকট হতে সেই সাক্ষ্য অনুযায়ী লন্ঠিত অর্থ আদায় কর, আর যে নিজেই স্বীকার করে তার স্বীকারোক্তি মতই তার নিকট হতে আদায় কর। কিন্তু যদি কেউ অস্বীকার করে তাহলে তাকে কসম করতে বল, যদি সে কসম করে তাহলে তাকে ছেড়ে দাও। এ জাতীয় একটি চিঠি তার কর্মচারীকে শাস্তি দিতে অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকেও কঠোর ভাষায় এরূপই লিখলেন এবং তাকেও কর্মচারীদের প্রতি কঠোর ব্যবহার করতে নিষেধ করলেন।
একবার ইরাকের শাসনকর্তা আবদুল হামিদকেও এরূপ কর্মচারীদের শাস্তি বিধান করতে ইচ্ছ প্রকাশ করায় খলিফা তাকেও কঠোর ভাষায় তিরস্কার করে উক্ত কাজ করতে নিষেধ করলেন। তখন অপর দিক হতে উত্তর আসল এভাবে চলতে থাকলে বায়তুল মাল শুন্য হয়ে পড়বে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে লিখলেন, তাহলে তুমি তাতে ঘাস ভরে দাও। ইবনে জাওযি বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এক আদেশ জারী করে কর্মচারীগণকে সংক্ষিপ্ত উপদেশ দিয়ে বললেন।
নগরের অনাবিল শান্তি, প্রজাদের আন্তরিক ভালবাসা ও তাদের প্রশংসা লাভ করতেই শাসকদের সুখ ও আনন্দ। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যেভাবেই কর্মচারীদের হিসাব-নিকাশ করতেন যার ফলে তার কোন কর্মচারীই তার অনুমতি ব্যতীত কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে সাহস পেত না। উদাহারণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, এক কর্মচারী তাকে লিখলেন,
মানুষ আপনার খেলাফত লাভের খবর শুনেই দ্রুততার সাথে যাকাত আদয় করতে শুরু করেছে। এখন আমার নিকট প্রচুর সম্পদ জমা হয়েছে। আমি আপনার মতামত ব্যতীত কোন কিছু করতে পছন্দ করিনি। এর উত্তরে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খুব সংক্ষিপ্ত একটি চিঠি লিখলেন। আমার জীবনের কসম! তারা আমাকে ও তোমাকে তাদের আশানুরূপ পায়নি। তুমি তাদের সম্পদ আটকিয়ে রেখেছো? আমার চিঠি পাওয়া মাত্রই তা মুসলনাদের মধ্যে বিতরণ করে দিবে। জারাহ ইবনে আবদুল্লাহ খুরাসানের উপ-প্রশাসক ছিলেন। তিনি এর উমুবী শাহজাদা আবদুল্লাহ ইবনে আহতামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করলেন। লোকটি খুই অযোগ্য ছিল। সে সাধারণ নাগরিকদের অধিকার শ্রদ্ধার চোখে দেখত না। তখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জারাহকে কঠোর ভাষায় লিখলেন, আল্লাহ আবদুল্লাহ ইবনে আহতামের কোন কাজের যেন বরকত না দেন। তাকে এখনই বরখাস্ত কর। অথচ সে ছিল খলিফার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।
তিনি আরো লিখলেন, আমি জানতে পারলাম যে, তুমি আম্বারকে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল করেছে। আম্বারার কোন প্রয়োজন নেই আমি তার জুলুম নির্যাতনকে পছন্দ করি না। যে ব্যক্তি মুসলমানদের রক্ত দিয়ে তার হাত রঙ্গীন করে এমন লোকের আমার কোন প্রয়োজন নেই। এখনই তুমি তাকে বরখাস্ত কর। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার কর্মচারী ও প্রজাদের খুঁটিনাটি বিষয়েরও খবর রাখতেন এবং অশোভন কাজ হতে তাদেরকে সতর্ক করতেন।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, একবার তিনি জানতে পারলেন বসরার কিছু অভিজাত শ্রেণীর আমীর এমন আছেন যে, খাওয়ার পর তাদের সেবকরা তাদের হাত ধৌত করিয়ে দেয় এবং তস্তরূ পূর্ণ হবার পূর্বেই তা উঠিয়ে নেয়। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ একে ইসলামী আদাবের পরিপন্থি বলে মনে করলেন। তিনি এ ব্যাপারে বাসরার শাসনকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখলেন,
আমি জানতে পারলাম, লোক হাত ধৌত করার সময় তস্তরী পূর্ণ হবার পূর্বে উঠিয়ে নেয়। এটা অনরাবদের নীতি। তুমি আমার এ পত্র পাওয়া মাত্রই এ নিয়ম বন্ধ কর। যতক্ষণ তস্তরী পূর্ণ না হয় বা শেষ ব্যক্তি হাত ধৌত না করে ততক্ষণ যেন তস্তরী উঠান না হয়। কিছুদিন পূর্বে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের ইন্তেকাল হয়, কিন্তু সে সমাজে নানা প্রকার কুসংস্কার চালু করে যায়। এই জন্যই হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যখন আদীকে ইরাকের শাসনকর্তা নিয়েঅগ করেন, তখন তিনি তার নিকট ক্রমাগত পত্র লিখতে লাগলেন এবং প্রত্যেক পত্রেই হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের কার্যাবলী বর্জন করতে নির্দেশ দিতেন। তার একটি চিঠির মর্মার্থ নিম্নে উদ্ধৃত করা হল-
আমি তোমাকে বার বার পত্র লিখেছি, প্রত্যেক বারই আল্লাহর নিকট তোমার মঙ্গল কামনা করেছি এবং হাজ্জাজের কুপ্রথা ত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছি। সে নামাযে দেরী করত অথচ নামাযে দেরী করা উচিত নয়। সে মানুষের নিকট হতে অন্যায় অত্যাচার করে যাকাত আদায় করে সেটা অন্যায় পথেই খরচ করত। এসব কাজ হতে বিরত থাক। আল্লাহ পাক হাজ্জাজের মৃত্যুর মাধ্যমে দেশ ও জনগণকে তার অনিষ্ট হতে রক্ষা করেছেন। হাজ্জাজের জুলুম অত্যাচার ও অন্যায় কাজ কর্মের ফলে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। যে সমস্ত লোক হাজ্জাজকে সহযোগিতা প্রদান করত তিনি তাদের সকলকেই পদচ্যূত করলেন। এমন কি এক ব্যক্তি সামান্য কয়েকদিন মাত্র হাজ্জাজের অধীনে কাজ করেছিল, তিনি তাকেও পদচ্যূত করলেন। সে ব্যক্তি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট এসে আবেদন করল যে, আমি অল্প কয়েকদিন মাত্র তার অধীনে কাজ করেছি। তার উতএর তিনি বললেন, অসৎ সংসর্গ একদিন নয়, সামান্য সময় হলেই যথেষ্ট।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ হাজ্জাজের সম্পূর্ণ বংশের প্রতিই অসন্তুষ্ট ছিলেন। হাজ্জাজের এক নিকটাত্মীয় মুসলিম ছাকাফী কোন তত্ত্বাবধায়কের ভুলক্রমে এক সামরিক অভিযানের সময় সামরিক বাহিনীর কোষাধ্যক্ষের পদে নিয়েচিত ছিল । সৈন্য বাহিনী রওয়ানা হবার পর তিনি জানতে পারলেন। তখন সৈন্যবাহিনী বেশ দূরে চলে গিয়েছৈ। তিনি তার পিছনে সে লোকের নামে একটি পত্র দিয়ে একটি লোককে দ্রুত পাঠালেন। এখনই ফিরে আসবে, কারণ তুমি যে বাহিনীতে থাকবে সে বাহিনী কখনও জয়ী হতে পারবে না। তার কর্মচারীগণ যখনই তাকে কোন ভুল পরাম্শ দিত,তার জন্য তাদেরকে কঠোর ভাসায় তিরস্কার করতেন।
ইবনে জাওযি বলেন, একবার ইরাকের জনৈত উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছালেহ ইবনে আবদুর রহমান ও তাঁর এক সহকর্মী হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে লিখছেন যে, “লোকের স্বভাব গঠন এবং সংস্কারের জন্য তরবারী ব্যবহার অপরিহার্য। যতক্ষণ তাদের কিছু লোকের শিরচ্ছেদ করা না হয় ততক্ষণ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।” হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এ পত্র পেয়ে তাদেরকে তিরস্কার করে লিখলেন, “দুজন অভদ্র ও নিচু লোক তাদের নীচতার কারণে আকামে মুসলমানদে রক্তপাওেতর জন্য পরামর্শ দিচ্ছে। মনে রেখ, অন্যান্য মুসলমানদের রক্তপারেত চেয়ে তোমাদের দুজনের রক্তপাত আমার নিকট খুব কঠিন কাজ নয়।”
তিনি কোন প্রকার আমদানীর পক্ষপাতি ছিলেন না। একবার তিনি জানতে পারলেন যে, ফিলিস্তিনের নাগরিকদের নিকট হতে নগরশুল্ক আদায় করা হয়। তিনি তার কর্মচারী আবদুল্লাহ ইবনে আউফকে লিকলেন, ‘নগর শুল্ক অীফসে গিয়ে তা ধ্বংস করে দাও, যা থাকে তা সমুদ্রে ভাসিয়ে দাও, যাতে ওর নিশানাও না থাকে।” তাঁর জনৈক কর্মচারী কিছুটা অলস প্রকৃতির ছিল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এটা জানতে পেরে তাকে লিখলেন, “কোন কথা নয়, তোমার অলস্য শুধু এ শর্তেই ক্ষমা করা যেতে পারে যে, তুমি তোমার হস্তকে মুসলমানের রক্ত হতে পবিত্র রাখবে, তোমার পেটে তাদের কোন মাল ভরবেনা এবং তাদের সাথে অন্যায় আচরণ করবে না।
সৎ ও সংস্কারমূলক কাজ করতে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ কর্মচারীগণকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। যদি কোন কর্মচারী সৎ কাজ করতে বারবার তাঁর পরামর্শ চেয়ে সময় নষ্ট করত, তখন তিনি তাকেও ক্ষমা করতেন না- কঠোর ভাষায় তার নিন্দা করতেন। উহারণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, তিনি ইয়ামেনের গভর্ণনরকে লিখলেন, আমি তোমাকে মুসলমানদের নিকট হতে অন্যায়ভাবে গৃহীত মাল তাদেরকে ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছি। তুমি বারবার এর ব্যাখ্যা চেয়েছ। অথচ আমার ও তোমার মধ্যেকার দূরত্ব সম্পর্কে তুমি সম্পূর্ণ অবগত আছ। তুমি এমন করার সময় নিশ্চয় মৃত্যু কথা ভুলে যাও। আমি যখন তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি যে, মুসলমানদের উপর জুলুম-করা হয়েছে- তা বন্ধ কর। এর পরও তুমি আকৃতি-প্রকৃতি নিয়ে আমার সাথে কথা বল। সাবধান! তোমার কর্তব্য মুসলমানদের জুলুম-নির্যাতন থেকে নিরাপদ রাখা। আমার নিকট বারবার জিজ্ঞেসা করবে না। নিজের কর্তব্য পালন কর।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ কর্মকর্তাগণকে এরূপ বলগাহীন স্বাধীনতা দিতেন না যে, তার যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবে। তাদের শুধু এ অধিকার ছিল যে, তারা অপরাধীদের অপরাধ অনুসারে শাস্তি প্রদান করবে।
ইবনে জাওযি এ সম্পর্কে তার একটি চিঠি উদ্ধৃত করেছেন যা তিনি সকল কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। নিম্নে সে চিঠির মর্মার্থ উল্লেখ করা হলো।
“মানুষকে তার অপরাধ অনুসারে শাস্তি প্রদান কর। যদি তা একটি বেত্রাঘাতও হয়। আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করবে না।
অবশ্য যে সমস্ত লোক অপরাধী ছিল বা যারা পেশাদার অপরাধী ছিল তাদের শাস্তি প্রদান করতে তিনি কখনও কর্মচারীকে নিষেদ করেন নি।
এ ব্যাপারে ইয়াহইয়া আরকাসানী তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আমাকে মুসলিম প্রদেশের শাসনকর্তার দায়িত্ব দিলেন। আমি সেখানে গিয়ে দেখি যে, এটা চো-ডাকাতদের একটি কেন্দ্র দুনিয়ার আর কোন শহরে এরূপ দেখা যায় না। আমি তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করলাম এবং অন্যায় ধারণার উপর কাকে শাস্তি দিব, একে অন্যের উপর মিথ্যা অভিযোগ করলে শাস্তি প্রদান করব না সুন্নাত অনুযায়ী যথারীতি সাক্ষ্য প্রমাণের পর শাস্তি প্রদান করব? হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ উত্তরে লিখলেন, সাক্ষ্য অনুযায়ী শাস্তি প্রদান কর, সুন্নাত অনুযায়ী চল। যদি সততা তাদের সংস্কার করতে সমর্থ হয় তাহলে মনে করো আল্লাহ তাদের সংস্কার ও সংশোধন করতে চান না।
ইয়াহইয়া বলেন, আমি তাঁর আদেশ অনুযায়ীই কাজ করলাম কিন্তু যখন আমি মোসুল ত্যাগ করি তখন চুরি ডাকাতি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ দিক দিয়ে সেটা দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট শহর ছিল।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার কর্মচারীদের কাজ –কর্মের হিসাবই শুধু গ্রহণ করতেন না। জনসাধারণের অবস্থাও পর্যবেক্ষণ করতে এবং ভাল মন্দের পার্থক্যের প্রতি দৃষ্টি রাখতেন। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, তিনি ইয়ামেনের গভর্ণরকে সেখানে বংশটি সম্পর্কে অবহিত করে লিখলেন, এ বংশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ কর, তাদের প্রতি লক্ষ্য রেখ, তাদেরকে নিকটবর্তী হতে সুযোগ দিও না, কোন কাজেই তাদেরকে শরীক করো না, এরা অত্যন্ত জঘন্য প্রকৃতির লোক।
ইবনে জাওযি বলেণ, এরা ছিল হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের নিকট আত্মীয় ছাকাফীর বংশধর।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ গভর্ণরদকে তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রতি অপ্রয়োজনীয় কড়াকরি করতে এবং অনর্থক জিজ্ঞেসাবাদ করে হয়রানী করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি জাজিয়ার গভর্ণরকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত নির্দেশ দিয়ে লিখলেন, আল্লাহ পাক তোমাদেরকে যাদের উপর গভর্ণর নিয়োগ করেছেন, তাদের দোষ ত্রুটির জন্য তাদেরকে উপদেশ দান কর, তাদের দুর্বলতা যথাসাধ্য এড়িয়ে যাও, তবে হ্যাঁ, যে সমস্ত দোষ-ত্রুটি এড়ানো আল্লাহর নিকট জায়েয নেই সেগুলো ধরতে হবে। যখন তাদের কোন কাজে তোমার ক্রোধের সঞ্চার হয় তখন আত্মসংবরণ কর এবং যদি তাদের কোন কাজে সন্তুষ্ট হও তখনও নিজেকে সংবরণ কর। এ দুই অবস্থার মধ্যে তোমার ও তাদের মধ্যকার একটি উত্তম পন্থা অবলম্বন করবে। তাদের প্রাপ্য অনুযায়ী তাদেরকে পুরস্কার প্রদান করবে এবং বঞ্চিত করতে ও ন্যায় এবং সতর্কতা অবলম্বন করবে। যেদিন ও সময় অতিবাহিত হয় এবং তা তুমি মানুসের হক আদায় করার যে সুযোগ পাও সেটাকেও সৌভাগ্যের মনে কর।
তিনি সাধারণ নাগরিকগণকে হয়রানী করা মোটেই পছন্দ করতেন না। তার গভর্ণরগণকে সাধারণ মানুষকে হয়রানী করতে নিষেধ করে উপদেশ দিয়েছিলেন।
তোমরা মানুষের উপর কর্তত্ব লাভ করেছ। যদি এটা তোমাদেরকে তাদের উপর জোর-জুলুম করতে উৎসাহিত করে তাহরে স্মরণ রেখো, তোমর যেরূপ তাদেরকে উৎপীড়ন করতে ক্ষমতা লাভ করেছ, আল্লাহ পাক সেরূপ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম ।
যদিও হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ কথায় কথায় কর্মচারীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে তাদের খোঁজ খবর নিতেন। সময় সময় গুপ্তচর পাঠিয়ে তাদের কাজ কর্মের তদন্ত করতেন, কিন্তু তবুও তিনি তাদের কোন দোষী কর্মচারীর রক্তে তাঁর পবিত্র হাত কলঙ্কিত করেননি। যদি কেহ তার পরীক্ষায় সফল হত তখন তাকে বহার রাখতেন আর তা না হলে অযোগ্য ব্যক্তিকে পদচ্যুত করতেন এবং এমন শক্ত শাস্তি দিতেন যাতে কোন ভাবেই জালেম বলা না যায়। ইতহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি তাঁর কোন কর্মকর্তার বা সাধারণ কর্মচারীকে রক্ত দিয়ে তাদের হাত নিয়ে আমার আল্লাহর দরবারে উপস্থিতির চেয়ে তাদের অন্যায়ের বোঝা নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়া আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়।
পূর্বে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যে দিন সুলায়মানের ইন্তেকাল হল সে দিন তাকে দাফন করার পর সর্বপ্রথম অত্যাচারী জালেম শাসকগণকে পদচ্যুত করেছিলেন।
উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, মিশরের রাজস্ব সচিব উসামা ইবনে যায়েদ একজন জালেম ও অত্যাচারী ছিল। তিনি তাকে পদচ্যূত করলেন বটে তবে তাকে ফাঁসিও দেননি বা হত্যাও করেননি। তাকে প্রত্যেক ছাওনিতে এক বছর করে বন্দী করে রাখতে নির্দেশ দিলেন। প্রথম বছর তাকে মিশরে বন্দী করে রাকা হল। তারপর তাকে ফিলিস্তিনে এনে আরও এক বৎসর করে রাখা হয়।
উসামার মত আফ্রিকার শাসনকর্তা ইয়াযিদ ইবনে আবু মুসলিকও খুব অত্যাচারী শাসক ছিল। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকেও পদচ্যুত করলেন, তবে সে উসামার মত জালিম ছিল না, কাজেই তাকে পদচ্যুত করারই তার যথেষ্ট শাস্তি মনে করেছিলেন।
অবশ্য তিনি বসরার শাসনকর্তা ইয়াযিদ ইবনে মুহালিবকে বরখাস্ত করার সাথে সাথে তাকেও বন্দীও করেছিলেন। ইয়াযিদ সুলায়মানের যুগে একজন প্রভাবশালী শাসক ছিলেন। সুলায়মানের সাথে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও ছিল। এসব কারণেই সে অনেক কাজ কর্মের সীমা লংঘণ করত। তাবারী বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে প্রথমেই পদচ্যুত করেননি। কিন্তু সুলায়মানের মৃত্যু এবং হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের খেলাফত লাভের সংবাদেই সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে, তার ক্ষমতার সময় শেষ হয়ে গেছে। কারণ সে নিজেকেও জানত এবং ওমর ইবনে আবদুল আজিজকেও জানত।
ঐতিহাসিক তাবারী বলেন, ইয়াযিদ হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে একজন রিয়াকর বা বাক্যাড়ম্বর প্রিয় বলে মনে করত। অবশ্য হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খলিফা হওয়ার পর তার এ মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছিল কিন্তু তার সম্পর্কে খলিফার মনোভাব অপরিবর্তিত রয়ে গেল। প্রথমে ও তাঁর যে মনোভাব ছিল শেষেও সেই মনোভাবই ছিল। তিনি তাকে এবং সম্পূর্ণ বংশকেই জালেমও অত্যাচরী মনে করতেন। তার পদচ্যুটির কারণ এটা ছিল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খেলাফত লাভ করার কিছুদিন পর তিনি আদী ইবনে আরতাতকে বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠালেন এবং ইয়াযিদকে গ্রেফতার করে তাঁর নিকট পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। ইয়াযিদ তখন ওয়াসেত নামক স্থানে অবস্থান করছিল। যখন সে পদচ্যুতি ও গ্রেফতারের নির্দেশ পেল, তখন মূসা ইবনে ওয়াজিহ তাকে গ্রেফতার করে দামেস্কে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট পাঠিয়ে দিল। তিনি তার সাথে কোন কঠোর ব্যবহার করলেন না। অবশ্য তিনি তার নিকট সরকারী অর্থের হিসাব চাইলেন এবং ইয়াযিদ স্বেচ্ছায় সুলায়মানের নিকট যে অর্থের কথা স্বীকার করেছিল তা ফেরত চাইলে। ইয়াযিদ খলিফার নির্দেশ কার্যকরী কতে অস্বীকার করে একটি ব্যাখ্যা পেশ করল যে, সে স্বীকারোক্তি কেবল ঔদ্ধত্বের কারণে ছিল, কারণ আপনি অবশ্য অবগত আছেন যে, খলিফা সুলায়মান আমাকে যথেষ্ট খাতির করনে, তাঁর নিকট আমার একটা বিশেষ মর্যাদা ছিল। আমার বিশ্বাস ছিল যে, আমি স্বীকার করলেও তিনি আমা কাছ সে অর্থ ফেরত চাবেন না। শুধু এ জন্যই আমি স্বীকার করেছিলাম।
কিন্তু হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলেন না, তিন তাকে এ বলে চাপ দিলেন যে, সুলায়মানের কাছে যে অর্থের কথা লিখিতভাবে স্বীকার করেছে অবশ্যই তা তাকে ফেরত দিতে হবে। ইয়াযিদ এ অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকার করলে তিনি তাকে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠিয়ে দিবেন।
ইয়াযিদকে পদচ্যুদ করার আরও অনেক কারণ ছিল। প্রথমতঃ সে ছিল অত্যন্ত যালেম ও অত্যাচারী শাসক। দ্বিতীয়তঃ সে যথেচ্ছাভাবে সরকারী অর্থ খরচ করত। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের মতে এটা খিয়ানত হিসাবেই গণ্য ছিল। তা সত্ব্ওে তিনি ইয়াযিদ ইবনে মুহারিবকে বন্দী করা ছাড়া অন্য কোন শাস্তি পদান করেননি।
অপর এক বর্ণনায় জানা যায় যে, তিনি ইয়াযিদকে একটি পশমী জুববা পরিধান করিয়ে ওয়াহলাকের দিকে বিতাড়িত করেছিলেন। অবশ্য কিছুদিন পর তার এ শাস্তি বাতিল করে বন্দী করে রাখাই যথেষ্ট মনে করলেন।
খুরাসানের শাসনকর্তা জাবিহ ইবনে আবদূল্লাহকে তিনি পদচ্যুত করলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে নিয়োগ দান করেছিলেন। তিনি দেড় বৎসর খুরাসানের শাসনকর্তা ছিলেন। ইনিই ইয়াযিদ ইবনে মুহালিবের পুত্র মুখাল্লার শুন্যস্থান পূরণ করেছিলেন। ইনি একজন বিশিষ্ট চিন্তশীল ও বিচক্ষ সংস্থাপক এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাকে দেখেই সাধারণতঃ লোক প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ত। তিনি খুরাসানে আগমন করে দেড় বৎসর পর্যন্ত হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি খুরাসানে এসেই সেখানকার লোকদের সম্পর্কে রিপোর্ট লিখলেন এবং অপরাধী লোকদের বেত্রাঘাত করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন। কিন্তু হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে এরূপ করতে নিষেধ করলেন এবং তাকে লিখলেন- হে জারাহ মা’র পুত্র, তুমি সাধারণ মানুষের চেয়ে ফেতনা ফাসাদের দিকে ঝুকে পড়েছ। কোন মুসলমান বা কোন সংখ্যালঘূকেও সঙ্গত কারণ ব্যতীত একটি বেত্রাঘাত করতে পারবেন না। তাদের মধ্যে কিসাস প্রতিষ্ঠার সময়ও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করবে। মনে রেখো, তুমিও আল্লাহর নিকট ফিরে যাবে। আর আল্লাহ চোখের খিয়ানত এবং মনের গোপন ইচ্ছা সম্পর্কেও বিশেষভাবে অবহিত আছেন।
কিন্তু হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের এসব উপদেশ জারাহর উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে হকদারদেরে অীধকারের প্রতি মোটেই লক্ষ্য রাখেননি। যিম্মিদের প্রতি কঠোর ব্যবহার করেছিলেন।
তাবারীর ভাষ্য হলো, জারাহর এ ঘনিষ্ট আত্মীয় খাওল নামক স্থানে একটি বিরাট বিজয় অর্জন করেছিল। জারাহ এ বিজয়ের সংবাদ দেয়ার জন্য হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করলেন। উক্ত দুলে দু’ ব্যক্তি জারাহর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তি নীরব ছিল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যখন এ তৃতীয় ব্যক্তির নিকট জিজ্ঞেসা করলেন, তখন সে জারাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলল-
১. সে বিশ হাজার মাওয়ালি দিয়ে যুদ্ধ করে তাদেরকে কোন বেনত বা পুরস্কার দেয়নি।
২. সে একজন আরববে একশত মাওয়ালির সমতুল্য মনে করে।
৩. সে বংশ, বিদ্বেষ প্রচার করে বেড়ায় ও তা শিক্ষা দেয়।
৪. যে সমস্ত যিম্মি ইসলাম গ্রহণ করে, সে তাদের নিকট হতেও কর আদায় করে।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার এ সকল অভিযোগে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং জারাহকে পদচ্যুত করে আদেশ লিখলেন। তবে তার পদচ্যুতি ব্যতীত তিনি তাকে আর অন্য কোন শাস্তি প্রদান করেননি।
তাবারীর ভাষ্যটি হলো, যখন জারাহ খুরসান ত্যাগ করে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নিকট রওয়ানা করলেন তখন তিনি কোষাগার হতে বিশ সহস্র দেরহাম নিয়ে লোকদেরকে বললেন, আমি এটা খলিফার নিকট আদায় করে দিব। তারপর তিনি যখন খলিফার নিকট আসলেন, খলিফা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কখন রওয়ানা করেছিলে? তিনি বললেন, রমযান শেষ হবার কয়েকদিন পূর্বে। তারপর জারাহ নিবেদন করলেন যে, আমি ঋণগ্রস্ত, আপনি অনুগ্রহ করে আমার ঋণ শোধের ব্যবস্থা করুন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ উত্তরে বললেন, যদি তুমি রমযান পূর্ণ করে সেখান হতে আসতে তাহলে আমি তোমার ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করে দিতাম। তারপর তার বংশদরদের ভাতা হতে ঋণ পরিশোদ করা হল।
প্রকাশ্যভাবে বুঝা যায় যে, তার সাধারণ একটি ভুলের কারণে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার এ ঋণ পরিশোধ করতে অস্বীকার করেছিলেন। আসলে তা নয়। তিনি জারাহকে এ জন্যই এ শাস্তি দিয়েছিলেন যে, তিনি শরিয়তের সীমা ও উদ্দেশ্য বুঝতেন না। যেমন তিনি রমযান শেষ হওয়ার পূর্বেই সফর শুরু করে তার মেনাকামনার অপর একটি প্রমাণ পেশ করেছিলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ কর্মকর্তা নিয়োগ নিজের পক্ষ হতে পূর্ণ সতর্কতাও সাধুতার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। তবুও কোন কোন সময় অন্যান লোকদের প্রশংসার উপর ভিত্তি করে শাসনকর্তা নিয়োগ করতেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নাগরিকদেরকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতেন। তাবারীর ভাষ্য হলো হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যখন আবদুর রহমান ইবনে নায়ীমকে খুরাসানের দেশ রক্ষা সচিব এবং আবদুল্লাহকে রাজস্ব সচিব নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন তখন সেকানকার লোকদেরকে লিখলেন, আমি আবদুর রহমানকে তোমাদের দেশরক্ষা সচিব ও আবদুল্লাহকে রাজস্ব বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের পরিচয় জানিনা এবঙ তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করারও সুযোগ পাইনি। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের যে পরিচয় পেয়েছি সে অনুযায়ীই তাদেরকে কাজে নিয়োগ করেছি। যদি তারা ভাল হয় তোমাদের পছন্দ অনযায়ী কাজ কর্ম করে তবে আল্লাহর প্রশংসা করো এবঙ তাঁর শোকর আদায় করবে। আর যদি এর বিপরীত প্রমাণিত হয় তবে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে অর্থাৎ আমাকে লিখে অবহিত করবে, আমি তাদেরকে বরখাস্ত করব।
তিনি তাদের দু’জনকে প্রেরণ করার সময় তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে তাদেরকে বিশেষভাবে অবহিত করেন যে, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে। তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকবে। তারা যখন রাজধানীতে উপনীত হল তখনও তিনি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন।
তাবারী বলেন- তিনি আবদুর রহমান ইবনে নায়ীমকে লিখলেন- আল্লাহর বান্দারেদ উপদেশ দান করবে, আল্লাহর হক আদায় করতে এবং হুদুদ (নির্ধারিত শাস্তি) প্রবর্তন করতে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারের ভয় করবে না, বান্দার তুলনায় আল্লাহ তোমার নিকট উত্তম হওয়া বাঞ্ছনীয়। মুসলমানদের প্রত্যেক কাজেই ন্যায় ও ইনসাফের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। তোমাদেরকে যে সব দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাতে সততা অবলম্বন করবে। সর্বতা সত্য বলবে কারণ, আল্লাহর নিকট কোন কথাই গোপন থাকে না এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট প্রত্যাবর্তন করবে না।
আবদুর রহমান ইবনে নায়ীম হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নির্দেশাবলী যথাযথ কার্যকরী করে একজন সৎ যোগ্য শাসক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার শাসনামলে যে সমস্ত প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন নিম্নে তাদের নামের তালিকা দেয়া হল।
১। মদীনা আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল আজীজ হাজম। ইনি একজন বিশিষ্ট আলেম এবং দীশক্তিসম্পন্ন ফকীহ ছিলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার মাধ্যমে বহু কাজ করেছেন। তিনি তার নিকট নিয়মিত পত্র লিখতেন এবং প্রত্যেক জরুরী প্রয়োজনীয় নির্দেশ গ্রহণ করতেন। ইবনে সাদ বলেন, আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাজমের নিকট যখনই হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কোন পত্র আসত, শরিয়ত বিরোধী কাজের প্রতিরোধ, বেতন-ভাতা নির্ধারণ এবং শরিয়তের হুকুম-আহকাম জারীর নির্দেশ অবশ্যই তাতে থাকত।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাঁর শাসনামলে শুরুতে ইবনে হাজমের নিকট যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ আদেশ নামা লিখতেন, তার মধ্যে একটি হাজমের নিকট যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ আদেশ নামা লিখতেন, তার মধ্যে একটি ছিল যে, ঘরে বসে থাকবে না, মানুষের সাথে মিলামিশা করবে, তাদের নিকট বসবে, নিজের কাছে তাদেরকে ডেকে আনবে, যখন তারা তোমার নিকট আসে তখন সকলের সাথে সমভাবে বসবে। তাদের প্রতি একই রকম দৃষ্টি দিবে, তাদের কেউ যেন, সে যে কেউ হোক না কেন অধিক সম্মানিত ও প্রিয় না হয়। লোকে যেন, সে যে কেউ হোক না কেন অধিক সম্মানিত ও প্রিয় না হয়। লোকে যেন না বলে যে, সে আমিরুল মুমিনিনের প্রিয় লোক। আজকের দিনে সকল নাগরিকই সমান। বরং তাদের মধ্যেও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে যদি কোন ঝগড়া-বিবাদ লাগে তাহলে সাধারণ নাগরিককেই প্রাধান্য দিতে হবে। যদি তুমি কখনও কোন কিছু মীমাংসা করতে অসুবিধা বোধ কর, তখন আমার নিকট পত্র লিখে অবগত করবে।
ইবনে হাজম স্বয়ং বলেন যে, একবার হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে লিখলেন। রেজিষ্ট্রার সমূহকে পবিতহ্র কর, তা ভুল ভ্রান্তি দূর কর। আমার পূর্বে যে সব মুসলমান বা যিম্মির প্রতি অবিচার ও জুলুম করা হয়েছে তাদের হক নষ্ট করা হয়েছে, সে গুলির ক্ষতি পূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা কর। যদি নির্যাতিত ব্যক্তি ইন্তেকাল করে থাকে তবে তাদের ওয়ারিশদের কাছে একবার লিখেছিলেন- ব্যবসায়ী ব্যতীত সমস্ত সাধারণ লোকের ভাতা নির্ধারিত করে দাও।
এক পত্রে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ সমস্ত সাধারণ নাগরিকদের ভাতা প্রদান করতে তাকে নির্দেশ দিয়ে লিখেছিলেন-
ভাতা গ্রহণকারীদের মধ্যে যে ব্যক্তি অনুপস্থিত, যদি সে কাছেই থাকে কোষাধ্যক্ষের নিকটই তার ভাতার অর্থ জমা রেখে দাও। আর যদি দূরে চলে গিয়ে থাকে তাহলে তার ভাতা তার মৃত্যুর সুসংবাদ না আসা পর্যন্ত সাময়িক মুলতবী রাকবে বা তার কোন প্রতিনিধি এসে তার জীবিত থাকার প্রমাণ দিতে পারে তাহলে তার কাছে তার ভাতা পদান করবে।
ইবনে হাজম আরো বলেন, আমরা বন্দীদের ভাতার রেজিষ্টার নিয়ে তাদের নিকট আগমন করতাম, বন্দীগণ তাদের ভাতা গ্রহণ করত। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের এক পত্রের মাধ্যমে এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল।
তার নামে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ একবার লিখেছিলেন- তুমি কাগজের কথা উল্লেখ করে লিখেছ যে, তোমার পূ্র্বের যে কাগজ পত্র জমা ছিল তা শেষ হয়ে গিয়েছে এবং আরও লিখেছ যে, এ ব্যাপারে তোমার জন্র যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তা পূর্বের তুলনায় কম। তবে তুমি কলম সরু করে নিবে এবং ঘন করে লিখবে আরও অনেক জরুরী কথা একই পত্রে লিখবে। কারণ, যে সব কাজে মুসলমানদের কোন লাভ নেই সে কাজে অর্থ ব্যয় করা খিয়ানত ছাড়া আর কিছুই নয়।
তার নিকট অপর এক পত্রে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ লিখেছিলেন, তুমি সুলায়মানের নিকট যে পত্র লিখেছিলে আমি তা পাঠ করেছি। তুমি লিখেছিলে যে তোমার পূর্বেকার মদীনার গভর্ণনরদের জন্য প্রদীপের খরচ বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ করা হতো তা দিযেই তাদের বাসস্থানও আলোকিত করে রাখা হতো। তোমার এ চিঠির উত্তর আমাকে দিতে হল। আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে সে সময়ও দেখেছি যখন তুমি শীতের অন্ধকার রাতে প্রদীপ ছাড়াই ঘরের বাইরে যাতায়াত করতে। আল্লাহর কসম, আজ তোমার আর্থিক অবস্থা পূর্বের চেয়ে অনেক ভাল। তোমার ঘরেও যথেষ্ট প্রদীপ আছে, সেইগুলোতেই কাজ চালিয়ে যাও।
ইবনে হাজমের নিকট তাঁর লিখিত পত্রের ভাষা প্রমাণ করে যে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ও তার মধ্যে বহু পূর্ব থেকেই ঘনিষ্টতা ছিল। এই জন্য তার প্রতি বিশেষ লৌকিকতার প্রয়োজন ছিল না। এত ঘনিষ্টতার সত্ত্বেও তিনি ইবনে হাজমের এ দু’টি সাধারণ আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ মুসলমাদের বায়তুলমালের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি তিনি গোনাহর কাজ কনে করতেন।
ইবনে হাজমের নিকট তার লিখিত অপর একটি পত্রের মর্ম হলো- তোমার নিকট যদি কান ঋণগ্রস্থ লোক আগমন করে এবং সে কোন অন্যায় কাজের জন্য ঋণ গ্রহণ করে না থাকে, তাহলে তুমি বায়তুলমাল হতেই তার ঋণ আদায় করার ব্যবস্থা করবে।
২। বসরা ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকা- আদী ইবনে আলতাত, বসরা যদিও চতুর্ত বা পঞ্চম শ্রেণীর প্রদেশ ছিল তবুও আদী ইবনে আরতাতকে তিনি সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ করলেন। তাঁর উপর হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের বিশ্বাস ছিল। তরি নিকট লিখিত পত্র সমূহতেও হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কর্মপদ্ধতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
আদী ইবনে আরতাত অত্যন্ত নেক অনুগত বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। তিনি প্রত্যেক কাজেই হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের মতামত চাইতেন। কোন কাজই তার মতামত ব্যতীত করতেন না। কিন্তু এতে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী কাজ কর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি হত; কাজেই হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে লিখলেন, তুমি শীত গ্রীষ্ম সবসময়ই লোক পাঠিয়ে আমার নিকট সুন্নাতে রাসূল সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, এরূপে আমাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন কর বটে তবে ভবিষ্যতে তুমি হাসানর উপর নির্ভর করবে। আমর এ চিঠির পর তুমি হাসানকে সকল কথা জিজ্ঞেস করে কাজকর্ম করবে। আমার পক্ষে এবং সমস্ত মুসলমানের পক্ষে তোমাকে এ দায়িত্ব দেয়া হল। আল্লাহ হাসানের প্রতি রহম করুন। তিনি ইসলামের একটি প্রাসাদ সমতুল্য। হাসান বসরী তখন বসরায় অবস্থান করতেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন সমযের শ্রেষ্ঠ ফকীহ।
আদী ইবনে আরতাতের নিকট লিখিত পত্রসমূহ পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই তা পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজ। ইবনে সাদ তার লিখিত আরও কয়েকটি পত্রের কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে প্রথম পত্রে তিনি শরিয়ত বিরুদ্ধ আমদানী বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আদী ইবনে আরতাতের কাছে অপর একটি পত্রে তিনি লিখেছিলেন, তোমার পূর্ববর্তী অন্যায় অত্যাচর অবিচার করতে যে প্রচেষ্টা করা হয়েছিল, তোমরা ন্যায়, ইনসাফ ও সংস্কারের জন্য অত্যন্তঃ ততটুকু প্রচেষ্টা করতে পার।
আল্লাহ পাক যখন জান্নাতবাসীগণকে জান্নাতে প্রবেশ করার আদেশ দিবেন তখন তারা আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং তিনিও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। অতএব তুমিও তোমার প্রজাদেরকে আল্লাহর প্রশংসা করতে শিক্ষা দান কর।
আদী ইবনে আরতাতের কাছে লিখিত তার এ পত্রটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে।
যিম্মিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ কর। যদি তাদের কেউ বার্থক্যে পৌঁছে যায় এবং তার কোন সহায়-সম্পদ না থাকে, তাহলে বায়তুল মাল হতে তার ভরণ পোষণের ব্যবস্থ করবে। অথবা যদি তার কোন নিকটাত্মীয় থাকে তাহলে তাদেরকে তার ভরণপোষণ করতে আদেশ দিবে। তার রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। তুমি তাকে তোমার একজন সেব মনে করবে যে, সারা জীবন তোমার সেবা করেছে। এখন তার বার্ধক্যের সময় মৃত্যু পর্যন্ত বা রোগ মুক্তি পর্যন্ত তার সেবা-যত্ন করা তোমার কর্তব্য। আমি জানতেদ পারলাম যে, তুমি মাদকদ্রব্যের কর আদায় করে থাক এবং তা বায়তুল মালে জমা করেছ। সাবধান! হালাল মাল ব্যতীত বায়তুলমালে অন্য কিছুই জমা করবে না।
৩। কুফা ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকা: আবদুল হামিদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে খাত্তাব।
আবদুল হামিদ ছিলেন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের মনঃপুত শাসকদের মধ্যে অন্যতম ও তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের সর্ববৃতৎ প্রদেশের শাসনকর্তা। আর এ প্রদেশের জনসারণ ছিল সবচেয়ে চরিত্রহীন। বিশেষতঃ কুফার লোকেরা ছিল অত্যন্ত জালেম ও অসভ্য। তার কোন শান্তিপ্রিয় শাসকের আনুগত্য স্বীকা করত না। একমাত্র উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ ও হাজ্জাহ ইবনে ইউসুফের মত নিকৃষ্ট শাসক। আল্লাহর দুশমনের নীতির সাথে হাজ্জাজ ছিল সর্বনিকৃষ্ট শাসক। আল্লাহর দুশমনদের নীতির সাথে হাজ্জাজের নীতির মিল ছিল। এ কারণেই তিনি কুফা ও তৎসংশ্লিষ্ট অঞ্চলের শাসন ভার আবদুল হামিদের উপর ন্যস্ত করলেন। আব্দুল হামিদ ছিলেন হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর ভ্রাতা জায়েদের পৌত্র। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে ব্যক্তিগতভাবেই চিনতেন। তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আলেম। প্রজ্ঞাশীল রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন শান্ত ও ভদ্র প্রকৃতির লোক। তিনি ব্যক্তিগতভাবেই তাঁকে জানতেন। মদীনায় অবস্থানকালে তিনি অনেক দিন তাঁর নিকট ছিলেন এবং হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের খেলাফত লাভের পর ঘুরে ছিরে তাঁর প্রতিই তাঁর দৃষ্টি পড়েছিল।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাঁর সাহায্যকারী হিসেবে অন্য একজন বিশিষ্ট আলেম আবুজানাদকে সচিব করে তাঁর সঙ্গে পাঠালেন এবং যুগের ইমাম অতুলনীয় পান্ডিত্যের অধিকারী শুধু খলীফাদেরই উস্তাদ নন বরংদুনিয়ার আলেমদের উস্তাদ হযরত শাবীকে প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্টিত করলেন।
ইবনে সা’দের ভাষ্য হলো, যখন আবদুল হামিদ নিয়োগপত্র নিয়ে দামেশক হতে কুফায় আগমন করলেন, তখন তিনি সর্বপ্রথম হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের যে পত্র পেলেন যা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ছিল। তার মর্মার্থ হলো-
শয়তানের ধোকা অত্যাচারী শাসকের নির্যাতনে মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়। আমার পত্র পাওয়া মাত্রই প্রত্যেক হকদারের হক আদায় করে দিবে।
প্রকৃতপক্ষে হকদারদের হক প্রদান করাই উত্তম শাসনব্যবস্থার বুনিয়াদ। এটাই আল্লাহর বিধান এবং ইবলামের চিরন্তন নিয়ম-পদ্ধিতি।
এ পত্র পেয়েই আব্দুল হামিদ হাজ্জাজের উত্তরাধিকারী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের হিসাব নিকাশ গ্রহণ করতে শুরু করলেন। সে আল্লাহর বান্দাদের উপর যে জুলুম নির্যাতনে করেছিল তারও বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করলেন এবং যে জুলুম নির্যাতনে সংস্কারযোগ্য ছিল সেগুলোর দ্রুত সংস্কার করলেন। হাজ্জজ যে সমস্ত লোককে অন্যায়ভাবে জরিমানা করে তাদের সহায় সম্দপ বায়তুল মালে জমা করেছিল আবদুল হামিদ তাদেরকে ডেকে এনে তারেদ ধন-সম্পদ তাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন এবং তাদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
আর যে সব লোক ইন্তেকাল করেছিল তাদের সম্পর্কে তিনি খলিফার মতামত চেয়ে পত্র লিখলেন। খলিফা উত্তর দিলেন, তাদের সম্পত্তি ওয়ারিশদের কাছে বুঝিয়ে দাও। আব্দুল হামিদ খলিফার নির্দেশ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এ অবস্থা দাঁড়াল যে, বায়তুল মাল শুন্য হয়ে পড়ল। বায়তুল মালে নগদ কোন মূদ্রাই ছিল না, যা কিছু ছিল, তাও হাজ্জাজ লোকের নিকট হতে জোর-জুলুম করে আদায় করেছিল। যখন বায়তুল মাল শূন্য হয়ে গেল, তখন আবদুল হামিদ খলিফাকে অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলেন। খলিফা কেন্দ্রীয় বায়তুলমাল হওত অর্থ পাঠিয়ে তাঁকে শান্ত্বনা দিয়ে বললেন, চিন্তার কোন কারণ নেই, এই হল আল্লাহর বিধান এবং এর বাস্তবায়নই ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ।
ইবনে সা’দ আরো বলেন, যখন আব্দুল হামিদ হাজ্জাজের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ করলেন, তখন দেখা গেল যে, তার আস্তাবলে এক হাজার বাহনের পশু আছে। আবদুল হামিদ খলিফঅকে একথা লিখে জানালেন। সে দিক হতে উত্তর আসল। সেসব বিক্রয় করে কুফাবাসীদের মধ্যে বিতরণ করে দাও। অতঃপর আবদুল হামিদ তাই করলেন। আবদুল হামিদ হাজ্জাজের সম্পদ বিক্রি করে সমুদয় অর্থ জনগণের মধ্যে বিতরণ করেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের পূর্ণ শাসনামলব্যাপী আব্দুল হামিদ, কুফার শাসনকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি বিশৃংখল শাসন ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও সুশৃংখল করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাঁর প্রতি অত্যন্ত খুশি ছিলেন। তাঁকে বার্ষিক হাজার দেরহাম ভাতা প্রদান করতেনে। সম্ভবতঃ এ ছিল গভর্ণরদের সর্বোচ্চ ভাতা। এই পরিমাণ ভাতা তিনি আর কোন গভর্ণরকেই দিতেন না।
৪। মিশর- হায়্যান ইবনে শুরাইঃ মিশর ছিল হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের প্রিয় স্থান। তার পিতা আবদুল আজিজ দীর্ঘ বিশ বৎসর পর্যন্ত সেখানকার শাসনকর্তা ছিলেন। ভাই-ভগ্নি ও অন্যান্য আত্মীয়সহ তার বংশের সকলে সেখানে বসবাস করত। তিনি তাঁর কোন ভাই বা অন্য কোন আত্মীয়কে মিশরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেন না। হয়্যান ইবনে শুরাইহ একজন সরল-সোজা ও ভাল লোক ছিলেন। খলিফঅ তাকেই মিশরের শাসনকর্তা পদে নির্বাচন করলেন। হায়্যানের আগে অপর এক হাজ্জাজ মিশরের শাসক ছিল। তাঁর নাম ছিল উসামা। এ নরাধম সেখানে অকথ্য নির্যাতন করে জনজীবনকে অতীষ্ঠ করে তুলেছিল। সে বহু মানুষের হাত পা কর্তন করে পঙ্গু করে দিয়েছিল। বহু লোকের কাছ থেকে মোটা অংকের জরিমানা আদায় করে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ হায়্যানকে সেখানে পাঠাবার সময় তার কনে কানে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন যে, তোমাকে জনসাধারণের রাখাল ও তাদের সাহায্যকারী বন্ধু হিসেবে প্রেরণ করা হচ্ছে। তুমি তাদের দন্ড মুন্ডের হর্তাকর্তা নও। তাদের অন্যানয়-অপরাধের জন্য তুমি তাদেরকে সতর্ক করতে পারবে বটে, তবে তাদেরকে শরিয়ত বিরোধী কোন শাস্তি দিতে পারবে না।
তিনি মিশরে পৌঁছার পর খলিফা তাঁকে লিখলেন, মানুষকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন না, কাউকেও ত্রিশটির বেশি বেত্রাঘাত করবে না। আল্লাহর হক অবশ্যই পালন করবে।
হায়্যান মিশরে শাসনকর্তা হিসেবে আগমন করে আল্লাহর নির্দেশকে যথাযথ বাস্তবায়িত করেছিলেন। তিনি মানুষের প্রতি ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে এক সুখী জীবন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি কারোও প্রতি জুলুম করেননি, প্রত্যেককেই তার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করেছিলেন।
তিনি শুধু মুসলমান নয় অমুসলিম প্রজাদের অন্তরও জয় করেছিলেন। ফলে অমুসলিমগণ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে লাগল। হায়্যান হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে লিখলেন, অমুসলিমরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করছে, ফলে কর আদায় কমে গেছে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাকে লিখলেন-
আল্লাহ পাক মুহাম্মদ (রা)কে সত্যের আহবানকারী হিসেবে প্রেরণে করেছিলেন, কর আদায়কারী হিসেবে বা জরিমানা আদায়কারী হিসেবে প্রেরণ করেননি। আমার এ চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার দফতর বন্ধ করে এখানে চলে এস।
৫। ইয়ামেন-উরুয়া ইবনে আতিস, সা’দী।
৬। জাজিরা- আদী ইবনে আদীল কান্দী।
৭। আফ্রিকা- ইসমাঈল ইবনে উবায়দুল্লাহ ইবনে আবুল মুহাজির।
৮। দামেস্ক- মুহাম্মদ ইবনে সুয়াদুল ফাহদী। এ চারজন প্রত্যেকেই অত্যন্ত বিশ্বস্ত ঈমানদার ও সৎ লোক ছিলেন।
৯। খুরাসান- জারাহ ইবনে আবদুল হিকমী।
তিনি ক্ষমাচ্যুত হয়েছিলেন। তার পদচ্যুতির বর্ণনা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের সবচেয়ে গৌরবের বিষয় হলো, তার কর্মকর্তাদের মধ্যে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম তিন জন আলেমও ছিলেন। হযরত হাসান বসরী, মেহরান, মেহরান ও ইমাম শাবী (র)।
হাসান বসরী (র) ছিলেন বসরার প্রধান বিচারপতি। তিনি পরে যদিও পদত্যাগ করেছিলেন তবুও বসরার শাসনকর্তার প্রতি নির্দেশ ছিল, কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই যেন তাঁর মতামত ব্যতী মীমাংসা না করা হয। হযরত মেহানের সাথে যেন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের প্রগাড় বন্ধুত্ব ছিল এবং তিনি ছিলেন তার প্রধান উপদেষ্টা। ইবনে সাদ বলেন, মেহরান ছাড়াও রেজা ইবনে হায়াত, আমর ইবনে কাযেক, আউন ইবনে আবদুল্লাহ এবং মুহাম্মদ ইবনে ইবনে জুবাইর প্রমুখ বিশিষ্ট মনিষীগণ তার প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মেহরানকে জাজিরার শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু সেখানকার শাসনকার্য পরিচালনা করা খুবই জটিল ছিল বিধা, তিনি কয়েকবার পদত্যাগ করলেও খলিফা তার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করেননি। যখনই তিনি কাজ কর্মের চাপে অভিযোগ করতেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাঁকে শান্ত্বনা প্রদান করে পত্র লিখতেন।
প্রিয় মায়মূন! তুমি বলেছ যে, শাসন পরিচালনা ও রাজস্ব আদয় করা খুব কঠিন কাজ। আমি তোমাকে বেশি কষ্ট দিতে রাজি নই। তোমার নিকট যে মাল আসে তার মধ্যে হালালটি শুধু গ্রহন করবে, আর যে সব সমস্যা উপস্থিত হয় তাতে সততার প্রতি লক্ষ্য রেখে সিদ্ধা্ত গ্রহণ করবে। যদি কোন বিষয়ের জটিলতার সম্মুখীন হও তখন আমাকে পত্র লিখবে।”
হযরত মেহরান ব্যতী অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিকটও তিনি এরূপ নির্দেশ পাঠাতেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার কর্মকর্তাদের প্রতি যেরূপ দৃষ্টি রাখতেন এর ফলে তার কর্মকর্তাগণ জনসাধারণের উপর কোন নির্যাতনে করতে সাহস পেত না। ফলে প্রজা সাধারণগণ করতব্যপরায়ণ, স্নেহশীল, মাতা-পিতার স্নেহ ছায়ার মত বসবাস করেছে।