স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক অধিকার
বিবাহ একটা সুসংবদ্ধ বন্ধন, একটা সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি। পুরুষ ও নারীর মাঝে সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলার জন্যেই আল্লাহ্ তা’আলা এ ব্যবস্থা কার্যকর করেছেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর উভয়ই উভয়ের জুড়ি। ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে স্বতন্ত্র হলেও বাস্তবতার দৃষ্টিতে তারা একে অপরের জুড়ি। একজন অপরজনের প্রতিভু। প্রত্যেকেরই নিজস্ব কামনা-বাসনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পরস্পর সম্পৃক্ত, সংযোজিত।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার এ সম্পর্কের চূড়ান্ত দৃঢ়তা ও অবিচ্ছিন্নতার কথা বোঝাবার উদ্দেশ্যেই কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
স্ত্রীরা তোমাদের পোশাক, তোমরা তাদের জন্যে পোশাক।
এ আয়াতের আসল বক্তব্য হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পর সুসংবদ্ধ, পরস্পরের গোপনীয়তা আচ্ছাদনকারী, পরস্পরের সমর্থক-সাহায্যকারী এবং একজন অপরজনের জন্যে সৌন্দর্য বিধায়ক হতে হবে। অন্য কথায় প্রত্যেকেরই অপরজনের ওপর অধিকার রয়েছে। সে অধিকার পুরামাত্রায় অবশ্যই আদায় করতে হবে। এ অধিকার সম্পূর্ণ সমান, পুরুষদের প্রকৃতি অনুযায়ী তাদের দেয়া বিশেষ বিশেষ অধিকার ছাড়া আল্লাহর কথা থেকেই তা স্পষ্ট। তিনি বলেনঃ (আরবী****************)
স্ত্রীদের জন্যে রয়েছে সেসব যা আছে তাদের ওপর সুস্পষ্ট ও প্রচলিত বা সাধারণ নিয়মে। তবে পুরুষদের জন্যে তাদের ওপর একটা অগ্রাধিকার রয়েছে।
সে অগ্রাধিকারের পর্যায় হচ্ছে পরিচালক নিয়ন্ত্রক দায়িত্বশীল ও জবাবদিহি করতে বাধ্য হওয়ার। নবী করীম (সা)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেনঃ আমাদের ওপর আমাদের স্ত্রীদের কি অধিকার রয়েছে? জবাবে তিনি বললেনঃ (আরবী****************)
তা হচ্ছে, তাদের নিজেদের সঙ্গে খাওয়াবে, নিজেদের মতোই পরাবে। আর মুখমণ্ডলের ওপর মারবে না, তাকে খারাপ-অশ্লীল গালাগালি করবে না এবং তাকে তার ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ছাড়বে না। (আবূ দাঊদ, ইবনে হাব্বান)
কাজেই নিজ স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যাপরে ঔদাসিন্য বা উপেক্ষা দেখান কোন মুসলমানের পক্ষেই জায়েয নয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
একজন লোকের গুনাহগার হওয়ার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট যে, যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত, তাদের প্রতি সে ব্যাপারে চরম উপেক্ষা দেখাবে। (আবূ দাঊদ, নিসায়ী, হাফেম)
স্ত্রীর মুখের ওপর মারার কোন অনুমতি ইসলাম দেয়নি। কেননা এ কাজ মানবীয় সম্মান ও মর্যাদা পরিপন্থী। তাতে দেহের সর্বাধিক সম্মানার্হ ও মর্যাদাসম্পন্ন অঙ্গ- দেহের সমস্ত সৌন্দর্য যেখানে কেন্দ্রীভূত- আহত ও ক্ষুণ্ণ হয়। নাফরমান ও স্বেচ্ছাচারী স্ত্রীকে প্রয়োজন মতো সুশিক্ষাদান ও গড়ে তোলার প্রশ্নে কখনও স্ত্রীকে হালকাভাবে মারাও যেতে পারে। কিন্তু তাকে কষ্ট দেয়া ও মুখমণ্ডলকে ক্ষতবিক্ষত করার মতো মারা কিছুতেই জায়েয হতে পারে না। স্ত্রীকে গালাগালি করাও জায়েয নয়। তার মনে কষ্ট দেয়া, তার জন্যে অসহনীয় কথাবার্তা বলা এমন কি তার জন্যে বদ দো’আ করা প্রভৃতিও সম্পূর্ণ নাজায়েয।
স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার পর্যায়ে নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটি উল্লেখ্য। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
যে স্ত্রীলোক আল্লাহর প্রতি ঈমানদার, তার পক্ষে তার স্বামীর ঘরে এমন ব্যক্তিকে আসবার অনুমতি দেয়া বৈধ নয়, যাকে তার স্বামী পছন্দ করে না। স্বামীর অনুমতি ব্যতীত ঘরের বাইরে যাওয়াও তার জন্যে জায়েয নয়। এ ব্যাপারে অপর কারো কথা মান্য করাও তার উচিত নয়, স্বামীর শয্যা থেকে দূরে থাকাও নয় বাঞ্ছনীয়। স্বামী যদি অত্যাচারী হয়, তা হলে তাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা চালাবে। তার এই খিদমত স্বামী গ্রহণ করলে তো ভালই। আল্লাহ্ তার ওযর কবুল করে নেবেন এবং তার সত্যপন্থী হওয়াটাও প্রকাশ করে দেবেন। আর স্বামী যদি রাজি না হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে তার অক্ষমতার ওযর পৌঁছে যাবে।
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ধৈর্য ধারণ
মুসলিম স্বামী মাত্রেরই কর্তব্য তার স্ত্রীর ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা। বিশেষ করে তার মধ্যে এমন কিছু লক্ষ্য করে যা তার পছন্দ নয়। মানুষের মধ্যে মানুষ হওয়ার কারণে যে সব দোষত্রুটি স্বাভাবিক ভাবেই থাকে আর স্ত্রীলোকদের মধ্যে নারীত্বজনিত যে সব দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়, তা সহ্য করে নিতে অভ্যস্ত হওয়া স্বামীর একান্তই কর্তব্য। অনুরূপভাবে স্ত্রীর দোষগুলোর তুলনায় তার গুণগুলো এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি অপেক্ষা ভাল ভাল দিকগুলোর প্রতিই নজর প্রকট করে রাখা বাঞ্ছনীয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
কোন ঈমানদার পুরুষ যেন কোন ঈমানদার নারীকে ঘৃণা না করে। কেননা তার মধ্যে একটি ব্যাপার যদি অপছন্দনীয় থকে তাহলে অপরাপর গুণাবলী নিশ্চয়ই পছন্দনীয় পাওয়া যাবে। (মুসলিম)
আর আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা স্ত্রীদের সাথে ভালভাবে বসবাস ও জীবন যাপন কর (ভাল আচরণ গ্রহণ কর)। তোমরা যদি তাদের অপছন্দ কর, তাহলে অসম্ভব নয় যে আল্লাহ্ তাদের মধ্যে অনেক কিছুই ভাল ও কল্যাণ জমা করে রেখেছেন।
ইসলাম যেভাবে স্বামীকে স্ত্রীদের অপছন্দনীয় ব্যাপারাদিতে ধৈর্য ধারণ করতে ও পরম সহিষ্ণুতা দেখাতে বলেছে, অনুরূপভাবে স্ত্রীদেরও নির্দেশ দিয়েছে নিজ নিজ স্বামীকে যথাসাধ্য সন্তুষ্ট রাখার জন্যে চেষ্টা চালিয়ে যেতে এবং স্বামীকে অসন্তুষ্ট রেখে রাত যাপন না করতে। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************)
তিন ব্যক্তির নামায তাদের মাথার এক বিগত উপরেও যায় না। এক ব্যক্তি সে, যে লোকদের ইমামতি করে অথচ সেই লোকেরা তাকে পছন্দ করে না। দ্বিতীয় সেই স্ত্রীলোক, যে স্বামীকে অসন্তুষ্ট অবস্থায় রেখে রাত যাপন করে। আর তৃতীয় এমন দুই ভাই যারা পরস্পরের সাথে লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত। (ইবনে মাযাহ, ইবনে হাব্বান)।
স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ দেখা দিলে
পুরুষ ঘর ও পরিবারের কর্তা, পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। তাকে এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার মধ্যেই এর যোগ্যতা পাওয়া যায় বিধায় জীবন সংগ্রাম ক্ষেত্রে তার মর্যাদাও এরূপই বলে এবং মোহরানা ও খরচাদি বহনের দায়িত্ব তারই বলে এ মর্যাদায় তাকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। অতএব তার আনুগত্য না করা ও আনুগত্য-বহির্ভূত কাজ করা, তার অবাধ্য হওয়া এবং তাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার কোন অধিকার স্ত্রীর থাকতে পারে না। এরূপ যদি করা হয়ই তাহলে পারস্পরিক সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে যাওয়া অবধারিত। সংসার তরণী হাবুডুবু খাবে এবং কোন প্রকৃত মাঝির অনুপস্থিতির কারণে তা সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়।
স্বামী যখন লক্ষ্য করবে যে, স্ত্রীর পক্ষ থেকে তাকে অমান্য করা হচ্ছে, স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে চলছে, তখন ভাল ভাল উপদেশ, যুক্তিপূর্ণ প্রাণস্পর্শী কথাবার্তা দ্বারা তাকে সংশোধন করার সাধ্যমত চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু উপদেশ কার্যকর না হলে তাকে তার শয্যায় পরিহার ও বর্জন করতে হবে, যেন তার মধ্যে নারীসুলভ ভাবধার জাগ্রত হয় এবং শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে ও বাধ্য-অনুগত হয়ে যায়।
এ ব্যবস্থাপনা কার্যকর না হলে তার ওপর হাত তোলা যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে চরম মাত্রার মারধোর, নিপীড়ন ও মুখের ওপর আঘাত করা কিছুতেই চলবে না, তা সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবেই। কোন কোন স্ত্রীলোকের জন্যে হালকা ধরনের মারধোর অনেকটা কল্যাণকর ও সঞ্জীবক হয়ে দেখা দেয়। মারধোর অর্থ চাবুক বা ডান্ডা বা লাঠি দ্বারা মার নয়। নবী করীম (সা)-এর একটি উক্তি থেকে এ বিয়য়ে সুস্পষ্ট আলো পাওয়া যায়। তাঁর কোন খাদেম কোন ব্যাপারে তাঁকে রাগিয়েছিল কোন বিশেষ কাজের জন্যে। তখন তিনি বলেছিলেনঃ (আরবী****************)
কিয়ামতের দিন বদলা নেয়ার ব্যবস্থা না থাকলে আমি তোমাকে এ মিসওয়াক দ্বারাই আঘাত দিতাম। (তাবকাতে ইবনে সা’আদ)
মারধোর করাটা রাসূলে করীম (সা) আদৌ পছন্দ করেন নি। তিনি বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমাদের এক একজন নিজ স্ত্রীকে এমনভাবে মারধোর করে কেন, যেমন মনিব তার দাসকে মারছে? আর তারপরই সম্ভবত রাত্রিকালেই সে তার সাথে সঙ্গম করবে। (মুসনাদে আহমদ)
যারা স্ত্রীলোকদের মারধোর করে তাদের সম্পর্কে নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
এ ধরনের লোক তোমাদের মধ্যে কখনও ভাল লোক বলে গণ্য হতে পারে না।
হাফেয ইবনুল হাজার লিখেছেনঃ
তোমাদের মধ্যে যারা ভাল লোক তারা কখনও নিজেদের স্ত্রীদের মারধোর করবে না রাসূলে করীম (সা)-এর এ কথা থেকে বোঝা যায় যে, স্ত্রীদের মারা মোটামুটি জায়েয বটে। তবে তার সঠিক সময় হচ্ছে তখন, যখন স্বামী তার স্ত্রীর মধ্যে যে ব্যাপারে তার আনুগত্য করা কর্তব্য সেই ব্যাপারেই আবাধ্যতা দেখতে পায়। এরূপ অবস্থায় সে তাকে বাধ্য ও আনুগত্য চাপানর উদ্দেশ্যে মারতে পারে। তবে যদি ধমক-ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদির দ্বারা কাজ চলে যায়, তহলে মারপিট অবশ্যই পরিহার করতে হবে। কেননা তাতে স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি ঘৃণা তীব্র হয়ে উঠে। আর তা সম্প্রীতিপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের পরিপন্থী। অথচ বিবাহিত জীবনের তা-ই হচ্ছে আসল লক্ষ্য কিন্তু আল্লাহর নাফরমানী সংক্রান্ত্র কোন ব্যাপারে যদি তাকে মারতে হয় তবে তা স্বতন্ত্র কথা।
নাসায়ী গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ (আরবী****************)
রাসূলে করীম (সা) তাঁর কোন বেগমকে কিংবা কোন খাদেমকে কখনই মারেন নি। অপর কাউকেও তিনি কখনও মারবার জন্যে হাত তোলেন নি। তবেত আল্লাহর পথে কিংবা আল্লাহর মর্যাদার অমর্যাদাকরণের দরুন আল্লাহরই ওয়াস্তে কাউকে শাস্তি দিয়ে থাকলে সে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার। (ফাতহুলবরী ৯ খণ্ড, পৃ. ২৪৯)
কিন্তু এসব পদক্ষেপও যদি ব্যর্থ হয় ও আ-ফলপ্রসু হয়ে যায় এবং পারস্পরিক বিরোধ বৈষম্য বিস্তীর্ণ ও গভীরতর হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয়, তাহলে তখনই ইসলামী সমাজের প্রভাবশালী কর্তৃত্বসম্পন্ন ও কল্যাণকামী লোকেরা তাতে হস্তক্ষেপ করে সংশোধনের জন্যে চেষ্টা চালাবে। তার পন্থা হচ্ছে, স্বামীর পক্ষ থেকে একজন ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন সালিশকারী নিয়োগ করতে হবে, যার বাস্তবিকই উভয়ের কল্যাণকামী হবে। তারা স্বামী-স্ত্রীকে মিলিত করতে ও যে বিরোধ দেখা দিয়েছে তা দূর করতে চেষ্টা করবে, তা হলে আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে মিলমিশ সৃষ্টি করে দেবেন। এসব ব্যাপারে মহান আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছেঃ (আরবী****************)
যে সব স্ত্রী সম্পর্কে তোমরা বিদ্রোহ ও অবাধ্যতার আশংকা বোধ করবে, তাদের বোঝও- উপদেশ দাও। তোমাদের শয্যায় তাদের ত্যাগ কর এবং তাদের মার। পরে যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা দোষ তালাস করে বেড়িও না। নিশ্চিত জানবে আল্লাহ্ উচ্চতর ও বড়ই মহান। আর তোমাদের পরস্পরের বিচ্ছেদের আশংকা দেখা দিলে স্বামীর আত্মীয়ের মধ্য থেকে একজন ও স্ত্রীর আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত কর। এরা দুজন যদি বস্তবিকই সংশোধনের চেষ্টা প্রচেষ্টা চালায়, তাহলে আল্লাহ্ তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে দেবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ ও সর্ববিষয়ে অবহিত।
কেবল এরূপ অবস্থায়ই তালাক দেয়া যেতে পারে
উপরে উল্লেখিত ও বিশ্লেষণকৃত সমস্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলে তারপরই প্রয়োজনের খাতিরে সর্বশেষ উপায় হিসেবে ইসলামী শরীয়ত প্রদত্ত পন্থা গ্রহণ করা স্বামীর জন্যে জায়েয হতে পারে, যেন সকল সমস্যা ও জটিলতা দূর হয়ে যায়, আর তা হচ্ছে তালাক দেয়া। ইসলাম খুব অনাগ্রহ ও অসন্তুষ্টি ভিত্তিতে এ পন্থা গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। তা তার কাছে পছন্দনীয় কাজ নয়, ওয়াজিব-ফরয নয়। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
আল্লাহর কাছে হালাল কার্যাবলীর মধ্যে সবচাইতে অধিক ঘৃণিত ও অপছন্দনীয় হচ্ছে তালাক।
(আরবী****************)
আল্লাহ্ তালাকের অপেক্ষা অধিক কোন না-পছন্দনীয় কাজকে হালাল করেন নি।
আর তালাক যে হালাল অথচ অপছন্দনীয় কাজ, তা এ কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তালাক হচ্ছে একটি অনুমতি, কেবলমাত্র কঠিন প্রয়োজন ও উপায়হীন অবস্থায়ই তা প্রয়োগ করা জায়েয। পারিবারিক জীবন যখন অচল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, স্বামী-স্ত্রীর মনে পারস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ যখন তীব্র হয়ে উঠে এবং তাদের আল্লাহ্ নির্ধারিত সীমার মধ্যে টিকে থাকা সম্ভবপর না থাকে, পারস্পরিক দাম্পত্য অধিকারও আদায় করতে না পারে, তাহলে এ পন্থা গ্রহণ ব্যতীত কোন উপায়ই থাকে না। মিলের যখন কোন উপায়ই নেই তখন বেমিলই ভাল- এ একটি সাধারণ কথা। আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আরবী****************)
তারা দুজন যদি পরস্পর বিছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ্ তাদের দুজনকেই স্বীয় প্রশস্ততার দ্বারা পরস্পর অ-বিমুখ ও অ-নির্ভরশীল বানিয়ে দেবেন।
ইসলামের পূর্বে তালাক প্রথা
তালাক কেবল ইসলাম প্রবর্তিত ব্যবস্থাই নয়। ইসলামের পূর্বে সমগ্র দুনিয়ায় তালাক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল ব্যাপকভাবে। দু একটি জাতির ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম দেখা যেত। স্বামী যখন স্ত্রীর ওপর রাগান্বিত হতো- কোন সঙ্গত কারণে কিংবা অসঙ্গতভাবেই, তাহলে তখন তাকে ঘর থেকে বহিষ্কৃত করত। স্ত্রী তখন স্বীয় প্রতিরক্ষা বা আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছুই বলতে বা করতে পারত না। স্বামীর কাছ থেকে কোনরূপ বিনিময় লাভ করাও তার পক্ষে সম্ভবপর হতো না। অন্য কোন প্রকারের অধিকারও স্বীকৃত ছিল না। গ্রীকদের খ্যাতি ও প্রাধানের যুগে তাদের সভ্যতার বিজয় পতাকা যখন পতপত করে উড়ত তখন তাদের সমাজেও তালাক প্রথা কোনরূপ শর্ত বা বাধা বন্ধন ব্যতীতই কার্যকর ছিল। রোমানদের সমাজে বিয়ে অনুষ্টিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তালাক গণ্য হতো। এমনকি স্বামী-স্ত্রী তালাকহীনতার শর্ত আরোপ করলেও বিচারক বিয়ে বাতিল হয়ে যাওয়ার রায় দিয়ে দিত।
রোমানদের প্রাচীন গোত্র সমূহের মতে ধর্মীয় বিয়ের ক্ষেত্রে তালাক হারাম হয়ে যেত। তবে স্বামী তার স্ত্রীর ওপর সীমাহীন কর্তৃত্ব লাভ করত। এমনকি কোন কোন অবস্থায় স্ত্রীকে হত্যা করাও তার জন্যে বৈধ হয়ে যেত। উত্তরকালে তাদের ধর্মে তালাককে নাগরিক আইনের মতোই বৈধ ঘোষণা করা হয়।
ইয়াহূদী ধর্মে তালাক
ইয়াহূদী ধর্মে স্ত্রীদের মান-মর্যাদা উন্নত করতে চেষ্টা করা হয় বটে কিন্তু তালাককে বৈধ ঘোষণা করে তার বৈধতায় বিপুল প্রশস্ততা এনে দেয়া হয়। স্ত্রীর গুনাহের অপরাধ প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর স্বামী ধর্মীয় দৃষ্টিতেই তালাক দিতে বাধ্য হয়ে যেত। স্বামী তার গুনাহ ক্ষমা করে দিলেও তাকে তালাক দেয়া তার জন্যে অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে পড়ত। দশ বছর কাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও স্ত্রীর গর্ভে সন্তান জন্ম না নিলে আইনের দৃষ্টিতেই তালাক দেয়া জরুরী বিবেচিত হতো।
খ্রিস্ট ধর্মে তালাক
খ্রিস্ট ধর্ম তালাকের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছে। একদিকে তা ইয়াহূদী ধর্মের বিরোধীতা করেছে। ইনজীল হযরত ইসার নামে তালাকদান কাজটিকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। উপরন্তু তালাকদাতা পুরুষ ও তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর বিয়েকেও হারাম করে দিয়েছে। ইনজীল মথির বিবরণে বলা হয়েছেঃ
আর উক্ত হইয়াছিল, ‘যে কেহ আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে, সে তাহাকে ত্যাগপত্র (তালাকনামা) দিউক। কিন্তু আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, যে কেহ ব্যভিচার ভিন্ন অন্য কারণে আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে, সে তাহাকে ব্যভিচারিণী করে এবং যে ব্যক্তি সেই পরিত্যক্ত স্ত্রীকে বিবাহ করে, সে ব্যভিচার করে। (মথি-৫ অধ্যায়, ৩১-৩২ স্তোত্র)
মার্ক লিখিত সুসমাচারে বলা হয়েছেঃ
যে কেহ আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া আমাকে বিবাহ করে, সে তাহার বিরুদ্ধে ব্যভিচার করে, আর যদি আপন স্বামীকে পরিত্যাগ করিয়া আর একজনকে বিবাহ করেম তবে সেও ব্যভিচার করে।
বাইবেলে এই হারাম করণের কারণস্বরূপ বলা হয়েছেঃ
ইশ্বর যাহার যোগ করিয়া দিয়াছেন, মনুষ্য তাহার বিয়োগ না করুক। (মথি-১৯ অধ্যায়, ৬ স্তোত্র)
এই উক্তিটি স্বতঃই সত্য ও সঠিক। কিন্তু তালাক দেয়াকে হারাম ঘোষণার ক্ষেত্রে এ উক্তির প্রয়োগ বড়ই বিস্ময়কর। আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বামী-স্ত্রীকে জুড়ে দেয়ার সহজ সরল অর্থ হচ্ছে, তিনি বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছেন। বিয়েকে তালাক দেয়ার অনুমতি দিয়ে থাকেন তবে এ বিচ্ছেদও আল্লাহরই পক্ষ থেকে হয়েছে মনে করতে হবে- যদিও বিচ্ছিন্নকরণের কার্যটি মানুষ দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, আল্লাহ্ যাকে জুড়ে দিয়েছেন তাকে বিচ্ছিন্নকারী মানুষ নয়, সেই আল্লাহই।
ব্যভিচার সঙ্ঘটিত হলে উভয়কে বিচ্ছিন্নকারী কি আল্লাহ্ নন? ব্যভিচার ছাড়া বিচ্ছিন্ন করণের কারণ আরও আছে কি?
তালাকের ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্মের ভিন্নমত
ইনজীল যদিও ব্যভিচার সঙ্ঘটিত হলে স্ত্রীকে তালাক দেয়া হারাম বলে না, হারাম থেকে মুক্ত ও ব্যতিক্রম করে; কিন্তু ক্যাথলিক ধর্মম এ ব্যতিক্রমের ব্যাখ্যা দিয়েছে। তারা বলে, মূলত এখানে ব্যতিক্রম (exception) কিছুই নেই। তালাক দেয়ার কোন সুযোগই কোথাও নেই। খৃষ্ট ধর্মে তালাকের কোন অস্তত্বই স্বীকৃত নয়। তবে ব্যভিচার সঙ্ঘটিত হওয়ার কারণে তালাকের ব্যাপারটির সঠিক অর্থ হচ্ছে, ব্যভিচার নিজেই বিবাহ-বন্ধনকে ছিন্ন করে দেয়। এ কারণেই ব্যভিচার সঙ্ঘটিত হলে স্বামীর কর্তব্যই হচ্ছে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা।
প্রোটেস্টান্ট ধর্মমত এর সম্পূর্ণ বিপরীত রায় দিয়েছে। এ মতের লোকেরা বিশেষ অবস্থায় তালাক দেয়া জায়েয মনে করে। আর তা হচ্ছে স্ত্রীর ব্যভিচার করা কিংবা স্বামীর বিশ্বাসভঙ্গ করা প্রভৃতি। তাদের এ মত কিন্তু ইনজীল মথির ঘোষিত নীতির অতিরিক্ত। কিন্তু এরূপ অবস্থায় ইনজীল তালাকদাতা পুরুষ ও তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর পুনরায় বিবাহিত হওয়াকে হারাম বলেছে।
অর্থোডক্স (orthodox) ধর্মমতের অনুসারী লোকেরা মিশরে অনুষ্ঠিত তাদের ধর্মসভায় স্ত্রীর ব্যভিচারকরণ ও অন্যান্য কারণে তাকে তালাক দেয়া জায়েয ঘোষণা করেছ। ক্রমাগতভাবে তিন বছর কাল পর্যন্ত স্ত্রীর বন্ধ্যা থাকা, সংক্রামক রোগ এবং মীমাংসার আশা নেই এমন ঝগড়া-বিবাদের দীর্ঘসূত্রিতা প্রভৃতি এসব কারণের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এসব কারণ ইনজীলের ঘোষণার ওপর অতিরিক্ত। এ কারণেই এ ধর্মমতের সংরক্ষকরা অন্যদেরকে এসব কারণে তালাক দেয়া জায়েয হওয়ার মত মানিয়া নিতে পারেনি। আর এ কারণেই মিশরের খ্রিস্ট আদালতে জনৈক খ্রিস্ট স্ত্রীর স্বামীর দারিদ্রের কারণে পেশ করা তালাক প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল। সেই সাথে এ মন্তব্য করেছিল যে, ধর্মের কোন কোন নেতা ও এ মজিলিসের সদস্যরা এমন সব কারণের ভিত্তিতে তালাক দেয়া জায়েয বলেছেন, যার কোন সনদই ইনজীলে নেই- এটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়।
তালাকের ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসৃত নীতির পরিণাম
তালাকের ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্মে প্রবর্তিত এসব নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যবাধকতার পরিণাম খুবই খারাপ হয়ে দেখা দিল। খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের ধর্মকে অস্বীকার করতে শুরু করে দিল। আল্লাহ্ যাকে জুড়েদিলেন, তারা তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। খ্রিস্টান পাশ্চাত্য এমন সব নাগরিক আইন (Civil code) বানাল, যার ফলে তাদের এ বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ আইনমম্মত হয়ে গেল। আমেরিকা ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে তালাককে অবাধ ও সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন কাজ বানিয়ে দেয়া হলো। কার্যত তারা ইনজীলেকেই চ্যালেঞ্জ করে বসল। তার ফল এই দেখা দিল যে, সাধারণ কার্যকারণেই লোকেরা তালাকের অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করে দিল। তার চূড়ান্ত পরিণতি স্বরূপ দাম্পত্য জীবন ও পরিবার ব্যবস্থায় যখন চরম বিপর্যয় দেখা দিল, তখন সে সমাজে সুধীদের মনে প্রশ্ন দেখা দিল যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি? তালাক মামলার একজন প্রখ্যাত বিচারক বলতে বাধ্য হলেন যে, তাদের দেশ থেকে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন শেষ হয়ে যেতে আর বড় দেরী নেই। অতঃপর নারী-পুরুষের মধ্যে চরম নৈরাজ্য ও অবাধ যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হবে। এক্ষণে দাম্পত্য জীবন একটা ব্যবসায়ী কোম্পানীর অবস্থা পরিগ্রহ করে গেছে। তার দুজন অংশীদার যে কোন অতি সাধারণ ও নগণ্য কারণে পারস্পরিক চুক্তি ভঙ্গ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থা দুনিয়ার কোন ধর্ম মতেরই অনুকূল বা তার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কেননা এক্ষণে কোন ধর্মবিশ্বাস তাদের জুড়ে রাখতে পারছে না। নিছক যৌন সুখ-সম্ভোগই তাদের নারী পুরুষের সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি হয়ে দাড়াল।
তালাক পর্যায়ে খ্রিস্ট ধর্মের স্বতন্ত্র ভূমিকা
ধর্মের শিক্ষাকে বাদ দিয়ে পারিবারিক আইনকে নাগরিক বিধিতে রপান্তরিত করার দৃষ্টান্ত খ্রিস্টান পাশ্চাত্য ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেবলমাত্র খ্রিস্টানরাই এ ক্ষেত্রে ধর্মের শিক্ষাকে মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়েছে। তার মূলে একটা কারণও প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাদের নিজেদেরই এ ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে, তালাক পর্যায়ে তাদের ধর্মের বিধিবিধান বাস্তবতার পরিপন্থী। মানব প্রকৃতি তার সাথে সামঞ্জস্য সম্পন্ন হয়। অতএব মানব জীবনে তার প্রয়োগ ঠিক নয়। (আরবী****************)
খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষা সাময়িক
তালাক পর্যায়ে ইনজীল কিতাবে যা কিছু বলা হয়েছে, তা যদি সঠিক ও যথার্থ হয়ও এবং প্রাথামিক যুগে তাতে কোনরূপ পরিবর্তন যদি সাধিত না-ও হয়ে থাকে, তবুও একথা স্পষ্ট যে, হযরত ঈসা (আ) কোন স্থায়ী চিরন্তন ও শাশ্বত বিধান দিয়ে যান নি। তা সর্বকালের সকল মানুষের জন্যে অনুসরণীয় ও গ্রহণযোগ্য নয়। ইয়াহূদীরা আল্লাহর দেয়া সুযোগ সুবিধা ও অনুমতির ক্ষেত্রে সীমালংঘন করে গিয়েছিল। তালাকের ক্ষেত্রে তাদের এ সীমালংঘন অত্যন্ত প্রকট। হযরত ঈসা তার বিরোধিতাই করতে চেয়েছিলেন মাত্র। মথি রচিত সুসমাচারে উদ্ধৃত হয়েছেঃ ফরাসীরা যখন হযরত ঈসার পরীক্ষা নিতে চেয়েছিল, তখন তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ
যে-সে কারণে কি আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা বিধেয়? তিনি উত্তর করিলেন, তোমরা কি পাঠ কর নাই যে, সৃষ্টিকর্তা আদিতে পুরুষ ও স্ত্রী করিয়া তাহাদিগকে নির্মাণ করিয়াছিলেন, আর বলিয়াছিলেনঃ এ কারণ মনুষ্য পিতা ও মাতাকে ত্যাগ করিয়া আপন স্ত্রীতে আসক্ত হইবে এবং সে দুজন একাঙ্গ হইবে? সুতরাং তাহারা আর দুই নয়, কিন্তু একাঙ্গ। অতএব ঈশ্বর যাহার যোগ করিয়া দিয়েছেন; মনুষ্য তাহার বিয়োগ না করুক। তাহারা তাহাকে কহিল, তবে মোশি কেন ত্যাগ পত্র দিয়া পরিত্যাগ করিবার বিধি দিয়াছেন? তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, তোমাদের অন্তকরণ কঠিন বলিয়া মোশি তোমাদিগকে আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিবার অনুমতি দিয়াছিলেন, কিন্তু আদি হইতে এরূপ হয় নাই। আর আমি তোমাদিগকে কহিতেছি, ব্যভিচার দোষ ব্যতিরেকে যে কেহ আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যকে বিবাহ করে, সে ব্যভিচার করে এবং যে ব্যক্তি সেই পরিত্যক্তা স্ত্রীকে বিবাহ করে সেও ব্যভিচার করে। (মথি লিখিত সুসমাচার-১৯ অধ্যায়, ৩-৯ স্তোত্র)
এ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, হযরত মূসা যে তালাকের অনুমতি দিয়েছিলেন, ইয়াহূদীরা তাতে যখন বাড়াবাড়ি করল, তখন হযরত মসীহ শাস্তি হিসেবে তাদের ওপর তালাককে হারাম করে দিলেন। কেবলমাত্র ব্যভিচারিণীর জন্যে তালাক থাকল। আর তা ছিল সাময়িক ব্যবস্থা। হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর আগমন ও সর্বাত্মক ও চিরন্তন শাশ্বত শরীয়তের প্রবর্তিত হওয়া পর্যন্তই ছিল তার আয়ুষ্কাল।
হযরত ঈসা মসীহ তালাকের এই বিধানকে চিরন্তন শরীয়তরূপে পেশ করতে চেয়েছিলেন, তা যুক্তিসঙ্গত কথা নয়। কেননা তার সঙ্গী সাথী হাওয়ারী ও শিষ্য শাগরিদরাই এই বিধানকে অচল ঘোষণা করে দিলেন। তাঁরা বলেছিলেনঃ যদি আপন স্ত্রীর সঙ্গে পুরুষের এরূপ সম্বন্ধ হয় তবে বিবাহ করা ভাল নয়। (মথি সুসমাচার-১৯ অধ্যায়, ১০ স্তোত্র)
কেননা এরূপ অবস্থায় বিয়ে করা অর্থ নিজের গলায় এমন দড়ি বাধা যার থেকে মুক্তি লাভ কখনই সম্ভব নয়। পুরুষের হৃদয় স্ত্রীর দিক থেকে যতই ঘৃণাপূর্ণ ও বিদ্বেষী হোক-না-কেন এবং সে তার প্রতি যতই মনক্ষুণ্ণ হোক-না-কেন উভয়ের স্বভাব-মেজাজ ও ঝোঁক-প্রবণতায় যতই পার্থক্য থাকুক না কেন।
তালাকের ব্যাপারে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ
তালাকের ক্ষেত্রে ইসলাম বিভিন্ন শর্ত ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ফলে সে ক্ষেত্রটি অত্যন্ত সংর্কীণ হয়ে গেছে। উপরে যে সব উপায়ের উল্লেখ আমরা করেছি সেগুলো ব্যবহার না করে এবং বিনা কারণে তালাক দেয়া ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ। কেননা তা করা হলে শুধু স্ত্রীরই নয়, স্বামীরও খুবই ক্ষতি ও অসুবিধা হওয়া অনিবার্য। তা তার নিজের কল্যাণেরও পরীপন্থী। কাজেই এরূপ অবস্থায়স্ত্রীকে তালাক দেয়া তেমনি হারাম, যেমনি ধন-মাল বিনষ্ট করা হারাম। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
না নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, না অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বা তা হতে দেবে।
এই হাদীসের দৃষ্টিতেও বিনা কারণে অযথা তালাক দেয়া জায়েয নয়।
যারা আনন্দের আতিশয্যে খুব বেশি তালাক দেয় তাদের এ কাজ আল্লাহর পছন্দ নয়, রাসূলেরও নয়। নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************)
স্বাদ আস্বাদন করে বেড়ানোর পুরুষ বা নারী আমার পছন্দ নয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
তালাক প্রয়োজনের কারণেই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।
হায়েয অবস্থায় তালাক দেয়া হারাম
তালাক দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলেই যে-কোন সময়ই তালাক দেয়া জায়েয নয়। তার জন্যে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করা আবশ্যক। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে তার জন্যে উপযুক্ত সময় হচ্ছে স্ত্রীর পবিত্র অবস্থা অর্থাৎ স্ত্রী যখন হায়েয নিফাসের অবস্থায় নয় এবং এমন পবিত্র অবস্থা, যখন তার সাথে সঙ্গম করেনি। তবে স্ত্রী গর্ভবতী হলে ও তার গর্ভ প্রকাশমান হয়ে পড়লে তখন ভিন্ন কথা।
এরূপ শর্ত এ জন্যে আরোপ করা হয়েছে যে, হায়েয বা নিফাস অবস্থায় স্বামী স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা থাকে। স্ত্রী সঙ্গম থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়। এরূপ অবস্থায় স্বামী তার প্রতি মণক্ষুণ্ণ বা ক্ষুদ্ধ থাকতে পারে। আর এ কারণেই তাকে তালাক দিতে উদ্যত হয়ে থাকতে পারে। এই সম্ভবনার কারণে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, স্বামী তালাক দেয়ার জন্যে স্ত্রীর সম্পূর্ণ পবিত্র হওয়ার অপেক্ষায় থাকবে। আর পবিত্র হওয়ার পর সঙ্গম করার পূর্বেই তালাক দিয়ে দেবে।
স্ত্রীর হায়েয অবস্থায় তালাক দেয়া যেমন হারাম, অনুরূপভাবে যে পবিত্রাবস্থায় সঙ্গম করেছে, তখন তালাক দেয়াও হারাম। কেননা স্বামী যদি জানতে পারত যে স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছে তাহলে সে হয়ত তাকে তালাক দিতই না। গর্ভ হওয়ার কারণে স্ত্রীকে তালাক না দেয়ার সিদ্ধান্ত করাও বিচিত্র নয়।
কিন্তু স্ত্রী যখন পবিত্রাবস্থায় হবে ও তখন স্বামী তার সাথে সঙ্গম করেনি অথবা স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছে ও সে গর্ভ প্রকাশমান হয়ে পড়ছে, এরূপ অবস্থায় তালাক দেয়ার অর্থ, স্ত্রীর প্রতি ঘৃণা প্রচণ্ড রূপ ধারণ করেছে। কাজেই এরূপ অবস্থায় তালাক দেয়ার অনুমতি আছে।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা) নবী করীমের জীবদ্দশায় তাঁর স্ত্রীকে হায়েয অবস্থায় তালাক দিয়েছিলেন। হযরত উমন (রা) এ বিষয়ে নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস কররে তিনি বললেনঃ (আরবী****************)
তাকে বল, সে যেন স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়। পরে তার পবিত্রাবস্থায় ইচ্ছা করলে যেন তালাক দেয় সঙ্গমের পূর্বেই।
এ হচ্ছে ইদ্দতের জন্যে তালাক। আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে সেই কথাই বলেছেনঃ (আরবী****************)
হে নবী! তোমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দেবে, তখন তালাক দেবে ইদ্দত পালনের লক্ষ্যে।
তার অর্থ ‘তুহর’- স্ত্রীর পবিত্রাবস্থায় তালাক দান।
অপর একটি হাদীসে রাসূলের কথাটি এ ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছেঃ (আরবী****************)
তাকে বল, সে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিক। পরে পবিত্রাবস্থায় বা গর্ভবতী অবস্থায় তাকে তালাক দিক।
তবে এখানে প্রশ্ন উঠে, ‘হায়েয’ অবস্থায় তালাক দিলে তা সঙ্ঘটিত হবে কিনা? সকলের সাধারণভাবে জানা কথা হচ্ছে তালাক যখনই দিক, তা সঙ্ঘটিত হবেই। কিন্তু অসময়ে তালাক দিলে দাতা গুনাহগার হবে।
কোন কোন ফিকাহবিদ বলেছেন, অসময়ে তালাক দিলে তা সঙ্ঘটিত হবে না। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা এ ধরনের তালাক বিধিবদ্ধ করেন নি। তার অনুমতিও দেন নি। এ কারণে এ ধরনের তালাক শরীয়তসম্মত নয়। তাহলে সে তালাককে সহীহ বলা যায় কি করে আর তা কার্যকরই বা হবে কেমন করে?
হযরত ইবনে উমর (রা)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ (আরবী****************)
যে লোক তার স্ত্রীকে ‘হায়েয’ অবস্থায় তালাক দিল, তার সম্পর্কে আপনার মত কি?…… উত্তরে তিনি প্রশ্নকারীকে তার নিজের স্ত্রীকে ‘হায়েয’ তালাক দেয়ার কাহিনী শোনালেন এবং বললেন, নবী করীম (সা) সে তালাক রদ করেছিলেন এবং তাকে তালাক গণ্যই করেন নি।
তালাকের কসম খাওয়া হারাম
‘তালাক’ কে কসম বানানো অর্থাৎ অমুক কাজ করা বা না করায় ‘তালাক হয়ে যাবে’ বলা জায়েয নয়। নিজের স্ত্রীকে ভয় দেখিয়ে বলা যে, তুই এ কাজ করলে তোকে তালাক- সম্পূর্ণ নাজায়েয। কেননা ইসলামে কসমের একটা বিশেষ ভাষা ও শব্দ আছে, তা ভিন্ন অপর কোন ভাষা বা শব্দে কসম কিরা অনুষ্টিত হয় না বা তা করার অনুমতি ইসলাম দেয়নি।
তা হচ্ছে আল্লাহর নামে কসম খাওয়া। রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী****************)
যে লোক আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কিছুর নামে কিরা করবে, সে শিরক করে।
(আরবী****************)
যে লোক কিরা বা কসম খাবে, সে যেন আল্লাহর নামে কিরা কসম করে, নতুবা যেন চুপ করে থাকে।
তালাকপ্রাপ্তা স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করবে
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর কর্তব্য তার স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করা- ইদ্দতকাল অতিবাহিত করা। সে ঘর ত্যাগ করে চলে যাওয়া- বাইরে বের হওয়া হারাম। স্বামীর পক্ষেও স্ত্রীকে ইদ্দতকালে তার ঘর থেকে বহিষ্কৃত করা হারাম। কেননা ইদ্দতকালে স্বামী স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করতে পারে, তার সম্ভাবনা রয়েছে- যদি সে এক বা দুই তালাক দিয়ে থাকে। এরূপ অবস্থায় যদি ঘরে স্বামীর কাছাকাছি থাকে, তাহলে স্বামীর ক্রোধ বা অসন্তোষ দূর করার সুযোগ পাবে। আর স্বামীও তার ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ লাভ করবে।
গর্ভাধারের পবিত্রতার নিশ্চয়তা বিধান- গর্ভে সন্তান নেই, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া, স্বামীর অধিকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ এবং তার স্ত্রীত্বের মর্যাদা রক্ষার উদ্দেশ্যে ইদ্দত পালনের হুকুম দেয়া হয়েছে। মানব মনের অবস্থা পরিবর্তনশীল। পরিবর্তিত অবস্থায় মানুষের মনের অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে, নতুন দৃষ্টিকোণে চিন্তা করে। ক্রোধ ও অসন্তোষ দূর হয়ে গিয়ে তথায় সন্তুষ্টি ও সম্প্রীতির উদ্রেক হওয়া কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। আবেগে প্রবাহিত মানুষ ঠাণ্ডা মন-মেজাজে চিন্তা করতে শুরু করে। আর তার ফলে যাকে পছন্দ নয়, তাকে পছন্দও করতে পারে। স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালনের এ বাধ্যবাধকতার তাৎপর্য খুবই ব্যাপক ও গভীর।
তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী****************)
তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যিনি তোমাদের রব্ব। তোমারা তাদের ঘর থেকে তাদের বহিষ্কৃত করো না, তারাও যেন বের হয়ে না যায়। তবে সুস্পষ্ট প্রকাশ্য যে লোক আল্লাহর নির্দিষ্ট করা সীমা লংঘন করে, সে নিজেরই ওপর জুলুম করে। তোমরা তো জানো না, আল্লাহ্ হয়ত এর পর কোন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব করবেন।
কিন্তু স্বামী-স্ত্রী বিছিন্ন করা যদি অপরিহার্যই হয়ে পড়ে, তা হলে দুজনের ভালভাবে ও প্রচলিত নিয়মে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া উচিত।
স্ত্রীকে কোনরূপ কষ্ট দেয়া চলবে না, মিথ্যা অভিযোগ তোলা বা দোষারোপ করা চলবে না, কারো অধিকারও হরণ করা যাবে না। আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আরবী****************)
তাহলে ভালভাবেই তাদের রাখ অথবা ভালভাবেই তাদের বিছিন্ন করে দাও।
বলেছেনঃ (আরবী****************)
তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীদের প্রচলিত নিয়মে কিছু মালমাত্তা দিতে হবে। মুত্তাকী লোকদের ওপর এটা তাদের অধিকার এবং তা তাদের দায়িত্ব।
এক তালাকের পর আর এক তালাক
ইসলাম মুসলমানকে নিয়ম করে দিয়েছে যে, স্ত্রীকে সে তিন তালাক একবারে নয়, তিন তালাক ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেবে। তার নিয়ম হচ্ছে, যে তুহরে- পবিত্রাবস্থায়- স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করে নি, তখন এক তালাক দেবে। আর তাকে এমনি অবস্থায়ই রেখে দেবে। এভাবে থাকার মধ্য দিয়ে তার ইদ্দতকাল নিঃশেষ হয়ে যাবে। ইদ্দতকালেই স্বামী যদি তাকে রাখার সিদ্ধান্ত করে, তাহলে অতি সহজেই তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু যদি সে ফিরিয়ে না নেয়, আর এ অবস্থায়ই ইদ্দতকাল শেষ হয়ে যায়, তাহলে পরেও নতুন বিয়ের মাধ্যমে তাকে ফিরে পেতে পারবে। আর স্বামী যদি তাকে রাখার কোন প্রয়োজনই বোধ না করে, তাহলে তখন স্ত্রী আর একজনকে স্বামীত্বে বরণ করে নিতে পারবে।
প্রথমবারের তালাক দানের পর স্বামী যদি তাকে পুনরায় স্বীয় স্ত্রীত্বে ফিরিয়ে নেয়, পরে দুজনের সম্পর্ক আবার খারাপ হয়ে যায় ও মিলমিশ সৃষ্টির সব পথই রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে সে দ্বিতীয়বারও তালাক দিতে পারে। এই যে পন্থার উল্লেখ করা হলো, এতে এখনও স্বামীর অধিকার অবশিষ্ট থাকে যে, ইদ্দত চালাকালে সে তাকে ফিরিয়ে নেবে কিংবা ইদ্দত শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন আকদ করে তাকে স্ত্রীত্বে বরণ করে নেবে।
কিন্তু দ্বিতীয়বার ফিরায়ে গ্রহণ করার পর তৃতীয়বারও যদি তালাক দেয়, তাহলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে যে, এ দুজনার মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে, এদের মধ্যে মিলমিশ হওয়ার কোন আশাই নেই। এরূপ অবস্থায়- এই তৃতীয়বার তালাক দেয়ার পর স্বামী স্ত্রীকে আবার গ্রহণ করতে পারবে না। এক্ষণে সে তার জন্যে হালাল নয়, যতক্ষণ না সে অপর এক স্বামী গ্রহণ করে তার সাথে ঘর করছে। এ বিয়ে সহীহ হতে হবে, শরীয়ত মুতাবিক হতে হবে। বিয়ে লক্ষ্য হতে হবে, শুধু প্রাক্তন স্বামীর জেন্যে হালাল বানানর উদ্দেশ্যে বিয়ে হলে চলবে না।
তালাক দেয়ার এই হচ্ছে শরীয়তসম্মত নিয়ম ও পন্থা যদি কেউ এ পদ্ধতি ছাড়া অন্যভাবে- একই সময়ে এক এক করে তিন তালাক কিংবা এক বাক্যে তিন তালাক দেয়, তবে তা শরীয়ত প্রদত্ত নিয়ম ও পন্থার সম্পূর্ণ পরিপন্থী হবে। সে লোক হেদায়েতের পথ ত্যাগ করে গুমরাহীর পথ অবলম্বন করে চলেছে, সিরাতুল মুস্তাকীমকে সে হারিয়ে ফেলেছে। সহীহ্ হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলে করীম (সা) জানতে পারলেন, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসঙ্গে তিন তালাক দিয়েছেন। তিনি ক্রোধে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেনঃ ( আরবি******************)
আমি তোমাদের মধ্যে বর্তমান অবস্থায়ই এ লোকটি আল্লাহর কিতাব নিয়ে তামাসা খেলছে? এক ব্যক্তি এ সময় দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূল! এমন ব্যক্তিকে কি আমি হত্যা করব না? (নিসায়ী)
স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে ও নির্দিষ্ট ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হয়ে এলে স্বামীর কর্তব্য দুটো কাজের মধ্যে যে কোন একটি করাঃ
হয় তাকে ভালভাবে ও প্রচলিত নিয়মে রেখে দেবে অর্থাৎ ভাল আচরণ ও ব্যবহার করার ও তাঁকে সংশোধন করে নেয়ার উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে নিয়ে স্ত্রীত্বে বরণ করবে, লড়াই-ঝগড়া করার বা অকারণ কষ্ট দেয়ার কোন উদ্দেশ্য থাকবে না।
অথবা ভালভাবে ও প্রচলিত নিয়মে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করবে অর্থাৎ ইদ্দত শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাকে ফেলে রাখাবে। তারপর কোনরূপ ক্ষতি সাধন না করেই- এবং তার সব অধিকার আদায় করেও তাতে কোনরূপ কার্পণ্য না করে তাকে বিদায় করে দেবে।
ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হয়ে এলে স্ত্রীকে কষ্ট ও পীড়ন দেয়া ও ইদ্দতের মেয়াদ দীর্ঘ করার উদ্দেশ্যে তাকে ফিরিয়ে নেবে এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ থেকে তাকে বঞ্চিত রাখাবে, স্বামীর জন্যে তা আদৌ জায়েয নয়।
জাহিলিয়াতের আমলে লোকেরা এরূপ আচরণ গ্রহণ করত। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা এভাবে স্ত্রীকে কষ্ট দেয়াকে হারাম করে দিয়েছেন। তিনি এই হারাম করে দেয়ার কথা খুবই মর্মস্পর্শী ভঙ্গীতে বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দেবে,পরে তারা তাদের ইদ্দত শেষ করে দিল তখন ভালভাবে তাদের ফিরিয়ে রাখা অথবা ভালভাবে তাদের বিদায় করে দাও। কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের আটকে রাখবে না। তাহলে তা হবে সীমালংঘন। আর যে তা করবে, সে নিজেরই ওপর জুলুম করবে। আর আল্লাহর আয়াতসমূহকে হাস্যকর ঠাট্টা বিদ্রেূপর শিকার বানিও না। আর আল্লাহর অনুগ্রহকে- যা তোমাদের ওপর তিনি করেছেন স্মরণ কর। স্মরণ কর সেই কিতাব ও হিকমতকে যা তিনি তোমাদের জন্যে নাযিল করেছেন। তিনি তো তোমাদের উপদেশে দিচ্ছেন। তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলবে আর জেনে রাখবে, আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে পূর্ণ অবহিত। (সূরা বাকারাঃ ২৩১)
এ আয়াত কয়টি গভীর মনোনিবেশ সহকারে পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি, এখানে সাতটি বাক্যাংশ, তাতে ভয় প্রদর্শনের পর ভয় প্রদর্শন, সাবধান কারণের পর সাবধানকরণ রয়েছে। উপদেশ রয়েছে, নসীহতও রয়েছে। স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে আল্লাহর নিয়ামতসমূহ। সেই সাথে বারবার ভীতির বাণীও রয়েছে এতে। বস্তুত যার হৃদয় রয়েছে, মন দিয়ে লক্ষ্য করতে যে প্রস্তুত, যে সজাগ দৃষ্টি সম্পন্ন, তার জন্যে এ আয়াত কয়টি অতীব মূল্যবান।
তালাক প্রাপ্তকে ইচ্ছামত বিয়ে করতে বাধা দেবে না
তালাকপ্রাপ্তার ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে যাকে সে চাইবে, পছন্দ করবে, তাকে বিয়ে করতে তাকে বাধা দেয়া যাবে না। তার প্রাক্তন স্বামী বা তার অভিভাবক কিংবা অন্য কারোরই এ কাজ করার অধিকার নেই। শরীয়ত ও প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাব দান ও নিজের মানুষের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে বিয়ে হতে থাকলে তার ওপর আপত্তি করারও অধিকার নেই কারো। কোন কোন পুরুষ নিজ স্ত্রীকে তালাক দিয়েও তার ওপর স্বীয় কর্তৃত্ব বহাল রাখতে ও প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করতে থাকে। অপর পুরুষ সম্পর্কে তাকে ভয় দেখাতে ও তার সাথে বিয়ে হলে ভাল হবে না বলে ধমকাতে থাকে। চরম মুর্খতা, বর্বরতা ও জাহিলিয়াতের চরিত্র ছাড়া এ আর কিছুই নয়।
অনুরূপভাবে স্ত্রী যদি তার প্রাক্তন স্বামীকে পুনর্বার বিয়ে করতে- স্বামীত্বে বরণ করতে ইচ্ছুক হয়, আর ভালভাবে ও প্রচলিত নিয়মে যাদি উভয়েই রাজি হয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে অভিভাবক বা ঘরের অন্য কারোরই তাতে বাধার সৃষ্টি করা জায়েয নয়। আল্লাহ্ বলেছেনঃ সন্ধি সুলেহ করে নেয়াই কল্যাণকর।
বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা যখন তোমাদের স্ত্রীদের তালাক দিয়ে দাও আর তারা ইদ্দতের মেয়াদ পূর্ণ করে ফেলে তখন তারা তাদের ভাবী স্বামীকে বিয়ে করবে- যদি তারা প্রচলিত নিয়মে বিবাহিত হতে পরস্পর রাজি হয়ে যায়- তাতে তোমরা বাধাদান বা অসুবিধা সৃষ্টি কর না। একথা বলে উপদেশ দেয়া হচ্ছে তাদের, যাদের ঈমান রয়েছে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি। তোমাদের জন্যে এ অতীব পবিত্র পরিচ্ছন্ন নিষ্কলুষ পন্থা। আল্লহই জানেন, তোমরা জান না। (সূরা বাকারাহঃ ২৩২)
স্বামীর প্রতি ঘৃণা সম্পন্না স্ত্রীর অধিকার
কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, তাকে অপছন্দ করে এবং তার সাথে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে ঘর-কন্না করতে পারবে বলে মনে করতে না পারে, তাহলে বিনিময় মূল্য দিয়ে সে তার নিজের আযাদী ও মুক্তি ক্রয় করতে পারে। স্বামী যে মোহরানা বা উপহার-উপঢৌকন তাকে দিয়েছে তা সব- কিংবা যতটায় উভয় পক্ষ রাজি হয় তা ফিরিয়ে দিয়ে নিজেকে স্ত্রীত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে- এ অধিকার তার রয়েছে। তবে স্বামী তার জন্যে যা কিছু ব্যয় করেছে তার অধিক কিছু তার গ্রহণ করা উচিত নয়। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা যদি একথা চিন্তা করে ভয় পাও, স্বামী স্ত্রী দুজনে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করে চলতে পারবে না, তাহলে স্ত্রী যা-ই বিনিময় মূল্য দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তাতে তাদের দুজনের কোন গুনাহ হবে না। (সূরা বাকারাঃ ২২৯)
হযরত সাবিত ইবনে কায়েমের স্ত্রী রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেনঃ হে রাসূল! আমি আমার স্বামী সাবিত ইবনে কায়েমের চরিত্র ও দ্বীনদারীর দিক দিয়ে কোন দোষারোপ বা অভিযোগ করছি না। কিন্তু আসলে আমি তাকে পছন্দ করি না। নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ সে তোমাকে কি দিয়েছেল? তিনি বললেনঃ একটি বাগান। সে তালাকের বিনিময়ে সেই বাগানটি ফিরিয়ে দিতে রাজি কিনা জিজ্ঞেস কররে, সে বলল, জি হ্যাঁ। তখন নবী করীম (সা) সাবিতকে বললেনঃ ( আরবি******************)
তুমি বাগানটি ফিরিয়ে নাও এবং ওকে তালাক দিয়ে দাও।
এ পর্যয়ে মনে রাখা আবশ্যক যে, স্বামীর পক্ষ থেকে বাস্তবিকই কোন কারণ না থাকলে স্ত্রীর তালাক গ্রহণের জন্যে তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে মেয়েলোক কোন কারণ ব্যতিরেকেই স্বামীর কাছে তালাক চাইবে তার জন্যে জান্নাতের সুগন্ধিও হারাম হয়ে যাবে।
স্ত্রীকে জ্বালাতন করা হারাম
স্ত্রীকে এ উদ্দেশ্যে কষ্ট দেয়া যে, সে তাকে যা কিছু দিয়েছে তা ফিরিয়ে দিয়ে দিক এবং সে জন্যে তাকে জ্বালা-যন্ত্রণা দেয়া স্বামীর জন্যে সম্পূর্ণ হারাম। তবে সে যদি কোন প্রকাশ্য নির্লজ্জতার কাজ করে বসে তবে তা স্ব’তন্ত্র কথা। এ সম্পর্কেই আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা যা কিছু তোমাদের স্ত্রীদের দিয়েছ তার কোন অংশ ফিরিয়ে পাওয়ার উদ্দেশ্যে তোমরা তাদের কষ্ট দিও না। তবে তারা যদি কোন প্রকাশ্য নির্লজ্জতার কাজ করে, তবে তা স্বতন্ত্র কথা। (সূরা আন-নিসাঃ ১৯)
আর স্ত্রী যদি স্বামীর অপছন্দই হয় এবং সে নিজেই তাকে তালাক দিয়ে অপর কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক হয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রীর কাছ থেকে কিছুই ফেরত লওয়া জায়েয নয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরাই যদি এক স্ত্রীর স্থলে আর এক স্ত্রী গ্রহণ করার ইচ্ছা করে থাক, আর তোমরা একজনকে বিপুল পরিমাণ মালমাত্তা দিয়ে থাক, তাহলে তোমরা তা থেকে কিছুই গ্রহণ করতে পারবে না। তোমরা কি দোষারোপ করে ও সুস্পষ্টভাবে অধিকার হরণ করে তা গ্রহণ করতে চাও? আর তা তোমাদের গ্রহণ করবেই বা কি করে? অথচ তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে দাবি আদায় করে নিয়েছ। আর তারা তোমাদের কাছ থেকে শক্ত ও কঠিন প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে।
স্ত্রী পরিত্যাগের ‘কসম খাওয়া’ হারাম
ইসলাম নরীর অধিকার আদায়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। তার একটা জ্বলন্ত প্রমাণ এই যে, স্বামী ক্রদ্ধ হয়ে স্ত্রীকে শয্যায় এত দীর্ঘ সময়ের জন্যে পরিত্যাগ করার কসম খাবে যা স্ত্রীর পক্ষে সহ্য করা বড়ই দুষ্কর, তা স্বামীর জন্যে ইসলাম সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। স্বামী যদি স্ত্রী থেকে আলাদা থাকার কিরা-কসম খেয়ে বসে, তাহলে তাকে মাত্র চার মাসের অবকাশ দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তার ক্রোধ ঠান্ডা হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। তখন সে তার ইচ্ছা পরিবর্তন করতে পারে। সে যদি এ চার মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই নিজ স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে নেয়, তাহলে ইতিমধ্যে তার এ কারণে যে গুনাহ হয়েছে, আল্লাহ্ তা মাফ করে দেবেন, তার জন্যে তার প্রশস্ত দরজা উন্মুক্ত করে দেবেন। তখন তার এ কিরা কসমের কাফফারা দেয়া ওয়াজিব। কিন্তু এ সময়কাল অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার মধ্যেও সে নিজ ইচ্ছা পরিবর্তন না করে ও ‘কসম’ না ভেঙ্গে, তাহলে তার স্ত্রী তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। স্ত্রীর অধিকার আদায়ে উপেক্ষা প্রদর্শনের এ-ই উচিত শাস্তি, সন্দেহ নেই।
কোন কোন ফিকাহবিদের মতে উপরিউক্ত সময়কাল অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তালাক সঙ্ঘটিত হবে। কাযী বা প্রশাসকের কোন ফয়সালার অপেক্ষায় থাকার কোন প্রয়োজন হবে না।
আবার অপর কোন কোন ফিকাহবিদ মনে করেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ব্যাপারটি প্রশাসকের সমীপে পেশ করা জরুরী। প্রশসক তাকে দুটো পস্থার যে কোন একটি গ্রহণের সুযোগ দেবে। হয় সে নিজের ইচ্ছায় পুনর্বিবেচনা করে স্ত্রীকে বাধ্য করে নেবে নতুবা সে তাকে তালাক দেবে। দুটোর মধ্যে যেটাই তার ভাল মনে হবে, সেটাই গ্রহণ করতে পারবে।
স্ত্রীর কাছে না যাওয়ার এ ‘কসম’কে শরীয়তের পরিভাষায় বলা হয় ‘ঈলা’। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)
যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক না রাখার কসম খেয়ে বসে, তাদের জন্যে চার মাসের মেয়াদ দেয়া হলো। যদি তারা স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়, তাহলে আল্লাহ্ ক্ষমাশীল দয়াবান। আর যদি তালাক দেয়ারই সিদ্ধান্ত করে তাহলে আল্লাহ্ সব শোনেন, সব জানেন! (সূরা বাকারাহঃ ২২৬-২২৭)
চার মাসের সময় দেয়া হয়েছে এজন্যে যে, স্বামী যেন পুনর্বিবেচনা করার ও বুদ্ধি বিবেচনা সহকারে কাজ করার পূর্ণ সুযোগ লাভ করতে পারে। অপর দিকে একজন স্ত্রী স্বামীহীনা হয়ে খুব বেশের পক্ষে এ সময়কাল পর্যন্তই ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পারে।
তাফসীরগণ এ পর্যায়ে হযরত উমরের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন
এক রাতে তিনি যখন অবস্থা পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে মদীনার অলিতে-গলিতে ঘুরতে লাগলেন, তখন তিনি একটি নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তার স্বামী জিহাদের জন্যে দূরদেশে চলে গিয়েছিল। স্বামী-বিরহে কাতর হয়ে নারী করুন কন্ঠে গাইতেছিল।
রাত দীর্ঘ হয়ে গেছে চারদিকে অন্ধকার সমাচ্ছন্ন
আর আমাকে কাঁদাচ্ছে এ কথা যে,
আমার বন্ধু আমার কাছে নেই, যার সাথে আমি
খেলা করব।
আল্লাহর নামের শপথ, যদি আল্লাহর আযাবের
ভয় না থাকত,
তাহলে, এখনই এ পালঙ্কের বাহুগুলো
নড়ে উঠত।
হযরত উমর (রা) নারীর এই ফরিয়াদ শ্রবণ করে তাঁর কন্যা হযরত হাফসা (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ স্বামী বিরহে নারী কতদিন ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারে? তিনি বললেনঃ চার মাস। তখন আমীরুল মুমিনীন নির্দেশ দিয়ে দিলেনঃ কোন ব্যক্তিকে যেন তার নিজের স্ত্রী থেকে চার মাসের অধিককাল বিচ্ছিন্ন করে রাখা না হয়।