মদ্য
মদ্য বা সূরা বলা হয় এমন এক এ্যালকোহলীয় পদার্থকে, যা পান করা হলে নেশাগ্রস্ত হতে হয়।
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পর্যায়ে আমরা প্রথমেই বলতে চাই, এ পদার্থটি পান করার ফলে ব্যক্তির বিবেক-বুদ্ধি ও দৈহিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। তার দ্বীনদারীও নি:শেষ হয়ে যায়। বৈষয়িকতার দিক দিয়েও তাকে কঠিন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। তার পরিবারটিকেও বিরাট ক্ষতির মধ্যে পড়তে হয়। আর এরূপ অবস্থা জাতি ও সমাজের বস্তুগত, নৈতিক ও আধ্যত্মিক জীবনে চরম দুর্গতি নিয়ে আসে অনিবার্যভাবে।
একজন বিশেষজ্ঞ ঠিকই বলেছেন যে মানুষকে সুরা যতটা কঠিন আঘাত হেনেছে ততটা আর কিছুই নয়। দুনিয়ার হাসপাতালসমূহ করে দেখলে দেখা যাবে মদ্য পানের দরুণ বহু লোক পাগল হয়ে গেছে, চিকিত্সার করা যায় না এমন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। মন-মগজের সুস্থতা হারিয়ে ফেলে হত্যাকাণ্ড ঘটায়, স্নায়বিক রোগে জর্জরিত হয়ে থাকে, পেটে স্থায়ী রোগ সৃষ্টি হয়। এমনকি অনেকে স্থীয় ধন-সম্পদ উড়িয়ে নি:স্ব সর্বস্ব হয়ে পড়ে। এদের সংখ্যা এত বেশি হবে যে, এদেরকে যত নসীহতই করা হোক, সবই বৃথা যাবে। এদের জীবনে কোনরূপ পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হবে না।
জাহিলিয়াতের যুগে আরবরা সুরা পানের জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলে। তাদেরও সুরা আসক্তির কোন সীমা ছিল না। তাদের ভাষায় সুরার প্রায় একশটি নাম রাখা হয়েছিল। তাদের কাব্য ও কবিতায় সুরার বিভিন্ন প্রকারের উল্লেখ রয়েছে, প্রত্যেক প্রকারের বিশেষত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। তা পান ও পরিবেশনকরী-কারিণীদের সৌন্দর্য বর্ণনায়, সুরা পানের মজলিস সমূহের গুণগানের মুখর হয়ে উঠেছিল।
ইসলাম এসে তাদেরকে একটা সুনির্দিষ্ট ও সুস্থ পথে শিক্ষিত ও পরিচালিত করে। এজন্যে মদ্যপান হারামকরণের ক্রমিক নীতি অবলম্বিত হয়েছে।
সর্ব প্রথম নেশাগ্রস্থ হয়ে নামায পড়তে নিষেধ করা হয়। অতপর তাদের বোঝান হয় যে, মদ্যপানের গুনাহ তার কল্যাণের তুলনায় অনেক বেশি। আর শেষ পর্যায়ে সূরা আল মায়িদার ব্যাপক তাত্পর্যপূর্ণ আয়াতের মাধ্যমে মদ্যপানকে চিরদিনের তরে ও চূড়ান্তভাবে হারাম করা হয়। আয়াতটি এই : (আরবী*************************)
হে ঈমানদার লোকেরা, নিশ্চিতভাবে জানবে, মদ্য, জুয়া, বলিদাদের নির্দিষ্ট স্থান এবং ভাগ্য জানার নিয়ম নিতান্তই অপবিত্র শয়তানী তত্পরতা মাত্র। অতএব তোমরা তা পরিহার কর। আশা করা যায়, তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে। এ মদ্য ও জায়ার মধ্যে তোমাদের নিক্ষেপ করে শয়তান তোমাদের পরস্পরে শত্রুতা ও হিংসা-দ্বেষ সৃষ্টি করে দেয়; আর আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদের বিরত রাখে। এমনতবস্থায় তোমরা এসব কাজ থেকে বিরত হবে কি?
এ আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা’আলা মদ্যপান ও জুয়া খেলাকে কঠোর ভাষায় হারাম করেছেন এবং তা পরিহার করার জন্যে অত্যন্ত কড়া আদেশ বা তাগিদ করেছেন। এ আয়াতে মদ্যপান ও জুয়া খেলাকে বলিদানের স্থান ও ভাগ্য জানার উপায়াবলীর সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে এ দুটির জঘন্যতা ও বীভত্সতা দেখাবার জন্যে। এ কাজকে কুরআনী ভাষায় رجس বলা হয়েছে এবং এটাকে শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। আর শয়তানী কাজ যে জঘন্য রকমের নির্লজ্জতা তা বলাই বাহুল্য। এভাবে আয়াতে এ দুটিকে পরিহার করতে বলা হয়েছে। আর এ দুটোকে সামষ্টিক ক্ষতির দিক ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, এর ফলে মদ্যপায়ী নামায পড়তে পারবে না, আল্লাহকে ভুলে যাবে। লোকদের পরস্পরের মধ্যে চরম হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রাণের শত্রুতা পর্যন্ত সৃষ্টি হয়ে পড়বে। নাময পড়া ও আল্লাহকে স্মরণ করা- এ দুটো আত্মিক উত্কর্ষ লাভের মাধ্যমে মানুষ হারিয়ে ফেলবে। এসব বলার পর ঈমানদার লোকেরা সে দুটির কাজ সম্পূর্ণ পরিহার করে চলবে কিনা, তা অত্যন্ত কড়া ভাষায় জানতে চাওয়া হয়েছে।
এরূপ কড়া আদেশ ও নির্দেশের জবাবে মুমিনদের একটি মাত্র কথাই বলার থাকতে পারে। আর তা হচ্ছে :
হে খোদা ! আমরা পরিহার করলাম।
হে খোদা আমরা তা থেকে বিরত থাকলাম।
আর কার্যত মুসলিম বিস্ময়কর দৃশ্যের সৃষ্টি করল। কিছু সংখ্যক মুসলিম একস্থানে একত্রিত হয়ে মদ্যপান করছিল। কারো হাতে পাত্র ছিল কিছু পান করেছে, এখনও পাত্র শেষ হয়নি। এ আয়াত শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গেই সে পাত্রটি মুখের কাছ থেকে টেনে নিল এবং অবশিষ্ট অংশ উপুড় করে ফেলে দিল।
মদ্য পানের এ দুষ্ক্রিয়া যা ব্যক্তি পরিবার সমাজ জাতি ও রাষ্ট্রের জীবন কঠিনভাবে প্রতিফলিত হয়, আধুনিক কালেরও বহু কয়টি রাষ্ট্র আইন ও ক্ষমতার বলে তা নিষিদ্ধকরণের জন্যে চেষ্টা চালিয়েছে। আমেরিকা এক সময় আইনের জোরে মদ্যপান বন্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ কাজ চরমভাবে ব্যর্থতা স্বীকার করতে হয়। কেবলমাত্র ইসলামই মদ্যপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তার মূলোত্পাটনে পূর্ণমাত্রায় সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
গীর্জা-কর্তৃপক্ষের মধ্যে সূরা পান সম্পর্কে খ্রিষ্টীয় ধর্মমত নির্ধারণে বড় মতদ্বৈততা দেখা দিয়েছে। তারা ইনজিলের এক একটি বাক্যাংশকে ভিত্তি করে একটা মত দাঁড় করিয়েছে :
অল্প পরিমাণ সুরা পান পাকস্থলীর জন্যে ভাল উপকারী।
এ কথা যদি নির্ভুল হয় আর মদ্য পাকস্থলীর জন্যে ভালই হয়, তাহলে অল্প পরিমাণ পান করত করতে মদ্যপায়ী বেশি বেশি পরিমাণে পান করতে শুরু করে দেবে, এটা তো অবধারিত। মদের একটি পাত্র আরও বহু কয়টি পাত্রের কামনা জাগিয়ে দেয় মাত্র। ফলে মাদ্যপান সে যেমন অভ্যস্থ হয়ে পড়বে, তেমনি পরিমাণের কোন সীমা রক্ষা করাই তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ইসলামের ভুমিকা সুস্পষ্ট এবং অকাট্য। তার মতো শুধু মদ পানই হারাম নয়, সে কাজ সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতাও সম্পূর্ণরূপে হারাম।
সমস্ত মাদক দ্রব্যই হারাম
নবী করীম (সা) যখন সর্বপ্রথম মদ্যপান নিষেধ ঘোষণা করেন তখন তিনি কি দিয়ে সুরা তৈরী করা হয়, সেদিকে আদৌ ভ্রুক্ষেপ করেন নি। তার নযর নিবদ্ধ ছিল তার ফল ও প্রতিক্রিয়ার উপর। আর তা হচ্ছে মাদকতা। কাজেই যে জিনিসেই মাদকতা থাকবে, তাই হারাম বিবেচিত হবে, তা সে বস্তু থেকেই তৈরী হোক- না কেন। মদ্য সম্পর্কে এ হচ্ছে ইসলামের চূড়ান্ত কথা। অতএব Beer এবং তার মতো অন্যান্য সর্বপ্রকার মাদক পানীয়ই সম্পূর্ণ হারাম।
নবী করীম (সা) এর কাছে মধু, ভুট্টা ও যব থেকে তৈরী মদ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস করা হয়েছিল। জবাবে তিনি একটি মৌলনীতির ঘোষনা করেন এবং বলেন : (আরবী*********************)
সকল প্রকার মাদক দ্রব্যই খামর। আর সব খামরই হারাম। (মুসলিম)
হযরত উমর ফারূক (রা) নবী করীম (সা) এর মিম্বারের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষনা করেছিলেন :
(আরবী************)
যে দ্রব্যই মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন ও বিকৃত করে, তাই খামর এবং নিষিদ্ধ। (বুখারী, মুসলিম )
মাদক দ্রব্য মাত্রই হারাম- অল্প হোক কি বেশি
ইসলামে মাদক দ্রব্য মাত্রই হারাম ঘোষিত হয়েছে। এ ব্যাপারে তার পরিমাণের ওপর মোটেই দৃষ্টি দেয়া হয়ানি। কাজেই তার পরিমাণ কম হোক কি বেশি, উভয় অবস্থায়ই তা হারাম। এ পিচ্ছিল পথে পা দিয়ে মানুষ যেন আছাড়ের পর আছাড় খেতে বাধ্য না হয়, সে জন্যেই এ ব্যবস্থা। নবী করীম (সা) স্পষ্ট করে বলেছেন :
(আাবী****************)
যে জিনিসের অধিক পরিমাণ নেশাগ্রস্ত করে, তার অঞ্জলী ভরা পরিমাণও হারাম। (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী)
(আরবী*******************)
যে জিনিসের কয়েক রতি পরিমাণও নেশাগ্রস্ত করে, তার অঞ্জলী ভরা পরিমাণও হারাম।
সুরার ব্যবসা
নবী করীম (সা) সুরা কম কি বেশি পরিমাণ পান করাকেই শুধু হারাম করে ক্ষান্ত হন নি। সুরার ব্যবসা করাকেও তিনি হারাম ঘোষণা করেছেন। এমনকি, অমুসলিমদের সাথেও এ ব্যবসা জায়েয নয়। কাজেই সুরার আমদানী বা রফতানী পর্যায়ের ব্যবসা করা কোন মুসলমানদের জন্যেই জায়েয হতে পারে না। সুরা উত্পাদনের কারখানা নির্মাণ বা বার খুলে বসা- কোনটিই জায়েয নয়। সুরার দোকানে চাকরী করাও সমানভাবে নিষিদ্ধ। এ কারণেই নবী করীম (সা) সুরার ব্যাপারে দশ ব্যক্তির ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। তারা হচ্ছে :(আরবী**********************)
সুরা উত্পাদনকারী, যে, উত্পাদন করায়, মদ্যপায়ী, বহনকারী, যার কাছে বহন করে নেয়া হয়, যে পান করায় পরিবেশনকারী, বিক্রয়কারী, মূল্য গ্রহণ ও ভক্ষণকারী, ক্রয়কারী এবং যার জন্যে তা ক্রয় করা হয়- এ সকলেরই ওপর অভিশাপ। (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
(আরবী*******************)
আল্লাহ তাআলা সুরা পান হারাম করেছেন। কাজেই যে ই এ হুকুম জানতে পারবে তার কাছে তার কিছু পরিমাণ থাকলেও তা পানও করতে পারবে না, তা বিক্রয়ও করবে না। (মুসলিম)
হাদীস বর্ণনা কারী বলেন, এ সময় যার কাছে সূরা মজুদ ছিল। তারা সকলেই তা মদীনার পথে ঘাটে প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন।
সুরা পানের সব পথ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করা হয়েছে, কোন মুসলমান যেন এমন কোন ব্যক্তির কাছে আঙ্গুর বিক্রয় না করে, যার সম্পর্কে জানা যাবে সে, সে আঙ্গুর দ্বারা সুরা তৈয়ার করবে।
হাদীসে বলা হয়েছে : (আরবী************************)
যে লোক আঙ্গুরের ফসল কেটে রাখাই করবে কোন ইয়াহুদী, খ্রিস্টান বা এমন ব্যক্তির কাছে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে যে তা থেকে সুরা তৈরী করবে, তাহলে সে জেনে-শুনেই আগুনে ঝাপ দিল। (আল তিবরানী ফিল আওসাত)
মুসলমান সুরা উপঢৌকন দিতে পারে না
সুরা বিক্রয় করা ও তার মূল্য ভক্ষন করাই মুসলমানদের জন্যে হারাম নয়, কোন মুসলিম ব্যক্তিই তা কোন অমুসলিমকে উপঢৌকন স্বারূপ দেয়াও সম্পূর্ণ হারাম। তার জন্যেও এ উপঢৌকন আসতে পারে না। কেননা মুসলমান পবিত্র। সে পবিত্র জিনিস ছাড়া অন্য কিছু উপঢৌকন বা মেহমানী হিসেবে কাউকে দিতেও পারেনা সে নিজেও গ্রহণ করতে পারে না। এক ব্যক্তি রাসূলে করীমের খেদমতে হাদিয়া হিসেবে সুরা পেশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। নবী করীম (সা) তা জানতে পেরে তাকে বললেন যে, আল্লাহ তাআলা সুরা হারাম করেছেন। তখন লোকটি বলল : তাহলে আমি তা বিক্রয় করে দিই? রাসূল বললেন : (আরবী***********)
যিনি তা পান করা হারাম করেছেন তিনিই তা কোন ইয়াহুদীকে তোহফাস্বরূপ দেয়াও হারাম করেছেন।
তখন লোকটি বলল, তাহলে আমি তা নিয়ে কি করব? রাসূলে করীম (সা) বললেন : মদীনার অলিগলিতে তা প্রবাহিত কর।
সুরা পানের আসর পরিহার করা
এ প্রেক্ষিতেই মুসলিম মাত্রকেই সুরা পানের আসর বা মজলিস পরিহার করে চলবার জন্যে আদেশ করা হয়েছে। মদ্যপায়ীদের সঙ্গে উঠা বসা করাও তাদের জন্যে নিষেধ। হযরত উমর (রা) বর্ণনা করেছেন : হযরত রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেন : (আরবী**********************)
আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার ব্যক্তি যেন এমন মজলিসে বা টেবিলে একত্রে না বসে, যেখানে সুরা পরিবেশন করা হয়। (আহম্মদ)
অপরদিকে মুসলিম মাত্রেই কর্তব্য অন্যায় ও পাপকর্য বন্ধ করার জন্যে চেষ্টা করা। কিন্তু তা করা যদি সম্ভবই না হয়, তাহলে সে নিজে তো অন্তত সেখানে থেকে কেটে পড়বে।
হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজীজ মদ্যপায়ীদের সঙ্গে সঙ্গে সে লোকদেরও দোররা মারতেন, যারা তাদের মজলিসে উঠা বসা করত- নিজেরা তা পান না করলেও। একবার কতিপয় মদ্যপায়ী ধরে আনা হলো। তিনি তাদের শাস্তি দেবার নির্দেশ দিলেন। কেউ বললেন , তাহলে তো ওকেই প্রথম শাস্তি দিতে হবে। তোমরা কি আল্লাহর ও ফরমান শুনতে পাওনি :
(আরবী******)
তোমাদের কুরআনে এ ফরমান নাযিল হয়েছে যে, তোমরা যখন আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করতে ও তার প্রতি ঠাট্রা-বিদ্রুপ করা কথাবর্তা শুনতে পাবে, তখন তোমরা তার সাথে আর বসবে না। পরে যদি তারা অন্য কোন কথায় মনোযোগ দেয়, তখন অবশ্য অন্য কথা। কিন্তু ঐ সময়ও যদি তোমরা তাদের সাথে বসা থাক, তাহলে তোমরাও অনুরূপ অপরাধে অপরাধী হবে।
সুরা রোগ- ঔষধ নয়
এসব অকাট্য দলিল- প্রমাণের ভিত্তিতে বোঝা যায়, ইসলাম সুরা বিরোধী সংগ্রামে অত্যন্ত কঠিন ও অনমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। মুসলিমকে তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে। মুসলমান ও সুরা পানের মাঝে দুর্লংঘ্য প্রাচীর দাঁড় করাতে চেয়েছে। যেন একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র ও পথও উন্মুক্ত না থাকে। সুরাকে কোন কাজে ব্যবহার করার কোন সুযোগই মুসলমানদের জন্যে উন্মুক্ত রাখা হয়নি।
মুসলমানের জন্য মদ্যপান- সামান্য পরিমাণও জায়েয রাখা হয়নি। তা ক্রয়-বিক্রয়ও করা যেতে পারে না। হাদিয়া-তোহফা হিসেবে তা করো জন্যে পেশ করাও যেতে পারে না। তা তৈরী করাও নিষেধ, স্বীয় দোকানে, অফিসে বা বসবাসের ঘরে তা রাখাও সম্পূর্ণ হারাম। উত্সব-দাওয়াত-যিয়াফত-মেহমানদারীতে তা পেশ করা যেতে পারে না। অমুসলিম মেহমানদের মেহমানদারীও করা যেতে পারে না তা দিয়ে। অনুরূপভাবে খাদ্য পানীয়ের সাথে তা মিলিয়ে দেয়ারও কোন অনুমতি নেই ইসলামে।
তবে ঔষধ হিসেবে সুরা ব্যবহার করা যায় কিনা- আজকের মানুষের এ একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসূলে করীম (সা) কেও এ প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বললেন : (আরবী*******************)
সুরা কোন ঔষধ নয় আসলে তা ব্যাধি মাত্র । (মুসলিম, আহম্মদ, আবূ দাউদ, তিরমিযী)
রাসূলে করীম (সা) বলেছেন : (আরবী*********************)
আল্লাহ রোগ-ব্যাধি ও তার ঔষধ উভয়ই নাযিল করেছে। তোমাদের রোগের চিকিত্সার ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা চিকিত্সা করবে, তবে হারাম জিনিস দ্বারা নয়। (আবু দাউদ)
(আরবী*******************)
যে সব জিনিস তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে, আল্লাহ তাতে তোমাদের রোগের আরোগ্য রাখেন নি।
সুরা ও অন্যন্য হারাম দ্রব্য দ্বারা চিকিত্সা করান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এটা কোন বিস্ময়োদ্দিপক ব্যাপার নয়। কেননা একটি জিনিস হারাম করার অর্থ হচ্ছে তা থেকে দূরে থাকতে বলা, তা সম্পূর্ণ ও সর্বতোভাবে পরিহার করে চলতে নির্দেশ দেয়া। এক্ষণে তাই যদি ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সে হারাম জিনিসের মধ্যেই ডুবে থাকতে হবে, তার দিকেই উত্সাহ যোগান হবে। আর তাহলে সে জিনিস হারাম করাটাই অর্থহীন হয়ে যায়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম এ যুক্তিই দেখিয়েছেন।
তিনি আরও বলেছেন : হারাম জিনিস ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি থাকলে তার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণই বৃদ্ধি পাবে। কেননা তার প্রতি মনের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে। বিশেষ করে তা যখন উপকারী প্রমাণিত হবে, রোগ নিরাময়কারী ও স্বাস্থ্যদানকারী মনে হবে, তখন তা থেকে বিরত থাকা সম্ভব হবে না। সুরাকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি থাকলে তা লালসা চরিতার্থ করার উপায় হয়ে দাঁড়াবে। এ পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানস্তত্ত্বিক দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন :
ঔষধ দ্বারা আরোগ্য লাভের জন্যে তা আগ্রহ ও আন্তরিকতা সহকারে ব্যবহার করা কর্তব্য। তাকে উপকারী মনে করতে হবে। আল্লাহ তাতে যে আরোগ্য রেখেছেন তার বরকত লাভ সম্ভব হবে বলে মনে করতে হবে বলে মনে করতে হবে। কিন্তু একজন মুসলমান বিশ্বাস করে যে, সুরা অকাট্যভাবে হারাম। এ বিশ্বাসের কারণেই তার পক্ষে সুরার দ্বারা আরোগ্য লাভ সম্ভব হবে না। এরূপ বিশ্বাস সুরা সম্পর্কে ভাল ধারণার সৃষ্টি হতে দেবে না। তা আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করাও কঠিন। বরং বান্দা ইমানে যতটা পরিপাক হবে, সুরাকে সে তত বেশি ঘৃণাই করবে। তাকে খারাপ মনে করবে, তা সে সহ্যই করতে পারবে না। এরূপ অবস্থায় সুরা ব্যবহারে রোগমুক্তি লাভ সম্ভব হবে না বরং তাতে তার রোগ বেড়েই যাবে। (আরবী*******************)
এ সব কথাই সত্য। তবুও প্রয়োজন ও ঠেকা-বাধাও শরীয়তের দৃষ্টিতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ জন্যে তার প্রতি লক্ষ্য রেখে শরীয়তের বিধান রচনা করা হয়েছে। যে রোগে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে আর তার জন্যে সুরা বা সুরা মিশ্রিত কোন ঔষধ যদি একমাত্র ঔষধ রূপে চিহ্নিত করা হয়, তা ছাড়া যদি এমন আর কোন ঔষধই পাওয়া না যায় তার বিকল্প হতে পারে কোন ইমানদার মুসলিম ডাক্তারই যদি তার ব্যবস্থা দিয়ে থাকে যার মধ্যে ঈমানী বলিষ্ঠতা বর্তমান, কেবলমাত্র এরূপ অবস্থায়ই তা ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। (তবে এরূপ অবস্থা খুব যে দেখা যায় তা নয়) কেননা শরীয়ত মানুষের জীবন সহজতা নিয়ে আসে, প্রতিবন্ধকতা ও অসুবিধা দূর করে। অবশ্য ইসলামের এ অনুমতি নির্দিষ্ট ও সংকীর্ণ সীমার মধ্যেই কাজে লাগাতে হবে, তা লংঘন করা যাবে না। আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন : (আরবী*******************)
কেউ যদি কঠিনভাবে ঠেকায় পড়ে যায় কিন্তু সে নিজে ইচ্ছুক ও আগ্রহী নয়, সীমালংঘনকারীও নয়, তাহলে আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াবান।
চেতানা নাশক দ্রব্যাদি
খামর তাই যা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি আচ্ছন্ন করে দেয়। এ একটি অতী গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক তাত্পর্যপূর্ণ মৌলনীতি। হযরত উমর (রা) রাসূলে করীমের মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দান প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন। এ কথার আলোকে কুরআনে ব্যবহৃত خمر শব্দের তাত্পর্য বোঝা যায় এবং এ ব্যাপারে কোনরূপ শোবাহ-সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এ থেকে অকাট্যভাবে জানা গেল, যে দ্রব্যই মানুষের বিবেক-বুদ্ধি আচ্ছন্ন করে, অনুভূতি ও বিচার-বুদ্ধি, বোধশক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ শক্তি হরণ বা কোন রূপ প্রভাবিত করে, তাই খামর বা সুরা (মদ্য) নামে অভিহিত। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সে জিনিসকেই চিরদিনের তরে হারাম করেছেন।
গাঁজা, আফিম, কোকেন, প্রভৃতি এই পর্যায়েরই জিনিস। তা মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে দেয় যে, দুরবর্তী জিনিস নিকটবর্তী এবং নিকটবর্তী জিনিস দূরবর্তী মনে হয়। যা বস্তবিকই বর্তমান, সে ব্যাপারে বিভ্রম বা ভ্রান্তি হতে শুরু করে। আর যা প্রকৃতপক্ষেই নেই, তা আছে বলে মনে করতে থাকে। এভাবে সে চরম ভুল-ভ্রন্তি ও ভিত্তিহীন ধারণা-কল্পনার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সে নিজের সত্তা নিজের দীন ধর্ম ও দুনিয়া সব কিছুই ভুলে গিয়ে নিছক কল্পনার জগতে বিচরণ করতে শুরু করে।
তা ছাড়া এ ধরনের মাদক দ্রব্য পানে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। স্নায়ুবন্ডলী চেতনা হারিয়ে ফেলে। শরীর দুর্বল হয়ে যায়। উপরন্তু তার দুর্বলসম মানসিকতা, সাহসহীনতা, নৈতিক পতন ও ইচ্ছাশক্তি ধৈর্যহীনতার সৃষ্টি হয়, তার ফলে এসব বিষাক্ত দ্রব্যাদি পানে অভ্যস্ত ব্যক্তি সমাজ দেহে ব্যাপক পচন ধরিয়ে দেয়।
এতসব দোষ ও বিপর্যয় চাড়াও ধন-মালের অপচয় এবং ঘর-সংসারের ভাঙন ও বিপর্যয় এক অনিবার্য পরিণতি। অনেক সময় এসব চেতনা নাশক (annesthetic) দ্রব্যাদি পানে অভ্যস্ত ব্যক্তি তার সন্তান-সন্ততির খাবার –দাবারের পয়সাও এই দ্রব্য ক্রয়ে ব্যয় করে ফেলে। এ জন্য দুর্নীতি ও অসত্ পন্থা অবলম্বনেও তাদের কোন কন্ঠা বা দ্বিধা থাকে না।
পূর্বেই বলা হয়েছে, ইসলামের মৌলনীতি হচ্ছে, হারাম জিনিস সমূহই সর্ব প্রকার জঘন্যতা, মন্দত্ব, নিকৃষ্টতা ও ক্ষতির কারণ। আর বাস্তবত এ সত্য উদঘাটিত হয়েছে যে, স্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে মনস্তাত্ত্বিক, সামষ্টিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিতেও এ সব জিনিসই অত্যান্ত ক্ষতিকর ও মারাত্বক- এতে কোনই সন্দেহ নেই। যে সব ফিকাহবীদ জীবনদ্দশায় এ সব জিনিসের প্রচলন শুরু হয়েছিল, তারা এগুলোর জঘন্যতা ও নিকৃষ্টতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এদের মধ্যে সর্বাগ্রসর। তিনি লিখেছেন:
হাশীশ-গাঁজা হারাম। তাতে বেঁহুশী হোক আর নাই হোক। তা পান করলে হৃদয়-চাঞ্চন্য, উল্লাস-স্ফূর্তী এবং আনন্দে আত্মহারা ভাব জেগে উঠে। এ কারণে প্রধানত খোদাদ্রোহী লোকেরাই তা পান করতে অভ্যস্থ। ক্রিয়া ও বিশেষত্বের দিক দিয়ে তা সুরার মতই উত্তেজক। তা মানুষকে ঝগড়া-ঝাটি করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর গাঁজা বুদ্ধিবিভ্রম ঘটিয়ে চরম জিল্লতির সৃষ্টি করে। তা মানুষের বিবেক ও মেজাজ প্রকৃতিও খারাপ করে দেয়। তা যৌন দুষ্প্রবৃত্তির উত্তেজনা সৃষ্টি করে। মানুষ আত্মমর্যাদাবোধও হারিয়ে ফেলে। এসব কারণে গাঁজা মাদকতার দিক দিয়ে সুরার চাইতেও বেশি নিকৃষ্ট ও অনিষ্টকর। তাতার সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থানের প্রভাবে লোকেদের মধ্যে এ জিনিসের ব্যাপক প্রচলন ঘাটায়। তা পান করলে- পরিমাণ বেশি বা কম- মদ্যপানের দণ্ড আশি বা চল্লিশ চাবুক মারা উচিত।
যে ব্যক্তি গাঁজা পান করেছে বলে প্রমাণিত হবে, মনে করতে হবে সে সুরা পান করার অপরাধ করেছে। কোন কোন দিক দিয়ে তা সুরা পানের চাইতেও বেশি মাত্রায় অপরাধ। কাজেই তাকে সুরা পানের দণ্ডই দিতে হবে। শরীয়তের নিয়ম হলো যেসব হারাম জিনিসের প্রতি মনে কামনা ও বাসনা জাগে যেমন সুরা ও ব্যভিচার তাতে হদ্দ জারী করতে হবে। কিন্তু যেসব জিনিসের প্রতি কামনা জাগে না, যেমন মুর্দার খাওয়া, তা খেলে তাজীর দিতে হবে। আর গাঁজা পানকারীদের কাছে তা এতই প্রিয় ও লোভনীয় যে, তা তারা কখনই ত্যাগ করতে পারে না অথচ কুরআন ও সুন্নাতের অকাট্য দলিলাদি এগুলোর হারাম হওয়ার কথা এতই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যেমন সুরা ও অন্যান্য ধরনের জিনিস হারাম হওয়া প্রমান করে।
(আরবী**************)
ক্ষতিকর জিনিস মাত্রই হারাম
ইসলামী শরীয়তের সাধারন নিয়মে মুসলমানের পক্ষে এমন কোন জিনিস খাওয়া বা পান করা জায়েয নয়, যা তাকে সঙ্গে সঙ্গে অথবা ধীরে ধীরে ধ্বংস ও সংহার করতে পারে। সর্ব প্রকারের বিষ বা অপর কোন ক্ষতিকর জিনিস এ জন্যেই হারাম। খুব বেশি পরিমান পানাহার করাও নাজায়েয, কেননা তাতে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়া স্বাভাবিক। মুসলিমকে কেবল নফসের দাবি পূরণের কাজ করলেই চলবে না, তার দ্বীন, মিল্লাত, জীবন, স্বাস্থ্য, ধন-মাল ও আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতও তার কছে আমানস্বরূপ রক্ষিত। সে সবের হকও আদায় করতে হবে। কাজেই এর কোন একটা জিনিসও বিনষ্ট করার তার কোন অধিকার নেই। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : (আরবী**********************)
তোমরা নিজেদের সত্তাকে হত্যা কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতীব দয়াময়। (সূরা আন-নিসা : ২৯)
(আরভী*********************)
তোমরা নিজেদের হাতেই নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষপ করবে না।
রাসূলে করীম (সা) বলেছেন : (আরবী********************)
নিজের ক্ষতি স্বীকার করবে না, অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।
এসব মৌল নীতিমালার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি, তামাক ব্যবহারকারীদের বক্ষে তা যদি ক্ষতিকর হয়, তাহলে তা হারাম। (হারাম বলার সরাসরি কোন দলিল নেই। যা আছে তাতে বড়জোর মাকরূহ বলা যায়) বিশেষ করে চিকিত্সক যদি কোন বিশেষ ব্যক্তির পক্ষে তামাক খাওয়া ক্ষতিকর বলে দেয়, তাহলে তা উপরিউদ্বৃত আয়াতে নিষিদ্ধ আর যদি তা স্বাস্থ্য হানিকর নাও হয়, তবু তাতে যে ধন মালের চরম অপচয় হয়, তাতে না কোন দ্বীনী ফায়দা আছে, না বৈষয়িক, এতে কোন সন্দেহ নেই। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : (আরভী*************************)
ধন-মালের অপচয় বিনষ্ট করতে নবী করীম (সা) নিষেধ করেছন।
কিন্তু কেউ যদি এতদূর গরীব হয়ে থাকে, যার পক্ষে তার নিজে ও পরিবারবর্গের জন্যে প্রয়োজনীয় খরচ পত্র যোগাড় করাও কঠিন, তাহলে তার জন্যে এ নিষেধ অধিক কড়া ও তাগিদপূর্ণ।