চতুর্থ অধ্যায়
আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মীয় অন্ধ অনুসরণ
পারস্পরিক কাজকর্ম ও লেনদেন
খেলা-তামাসা ও স্ফূর্তির অনুষ্ঠান
সামাজিক-সামষ্টিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ
অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক
আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মীয় অন্ধ অনুসরণ
সুস্থ সঠিক ও নির্ভুল আকীদা-বিশ্বাসই হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি। আর তওহীদ-সর্বতোভাবে আল্লাহ্ এক-একক ও অদ্বিতীয়- বিশ্বাসই হচ্ছে এ আকীদার নির্যাস এবং পূর্ণ দ্বীন ইসলামের প্রাণশক্তি। নির্ভুল আকীদা ও খালেস তওহীদের সংরক্ষণকেই ইসলাম তার শরীয়ত গঠনে ও শিক্ষার ভিত্তি স্থাপনে চরম লক্ষ্য হিসেবে সম্মুখে রেখেছে। সেই সাথে মূর্তি পূজারীরা যে জাহিলী আকীদা-বিশ্বাস ব্যাপকভাবে প্রচার করে রেখেছিল, তার বিরোধীতা ও মূলোৎপাটনও তাকে করতে হয়েছে। কেননা মুসলিম সমাজ-সামষ্টিকে শিরকের মলিনতা-কদর্যতা ও গুমরাহীর অবশিষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্যে এ কাজ একান্তই অপরিহার্য।
আল্লাহর সুন্নাতের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা
ইসলাম তার অনুসারীদের মন-মগজে সর্বপ্রথম এ বিশ্বলোক সংক্রান্ত দর্শনকে সুদৃঢ় করেছে। ইসলাম ঘোষণা করেছে, মানুষ এ বিশ্বলোকের বিরাট ব্যবস্থার অধীন তার পৃথিবীর ওপর ও আকাশ মণ্ডলের নিচে জীবন যাপন করে। এ বিরাট বিশ্বলোক কোন ‘মগের মুল্লুক’ নয়, ছেলে-শিশুদের খেলনা নয়। তা হেদায়েতের বিধান ছাড়া চলছে না, ইচ্ছামত যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে না। তা কোন সৃষ্টির কামনা-বাসনা অনুযায়ীও চালিত হচ্ছে না। কেননা সৃষ্টির কামনা-বাসনা এক ও অভিন্ন নয়, পরস্পর সামঞ্জস্য সম্পন্ন নয় বরং পরস্পর সাংঘর্ষিক। তাও যে বিভ্রান্ত ও দিশেহারা তা-ও নিঃসন্দেহ। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
প্রকৃত মহাসত্য যদি তাদের কামনা বাসনা অনুসরণ করে চলত, তাহলে আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী এবং তার মধ্যে যা কিছু আছে, তা সবই ধ্বংস ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেত। (সূরা আল-মুমিনীনঃ ৭১)
বস্তুত এ বিশ্বলোক প্রাকৃতিক আইন ও আল্লাহ্ প্রদত্ত সুন্নাতের সুদৃঢ় বন্ধনে বন্দী। এ নিয়ম ও আল্লাহ্ প্রদত্ত সুন্নাতের কোন পরিবর্তন নেই, তাতে নেই কোনরূপ ব্যতিক্রম। কুরআন মজীদের কয়েকটি স্থানেই এ কথা বলিষ্ঠ ঘোষিত হয়েছে। সূরা ফাতির-এ বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
আল্লাহর সুন্নাত- নিয়ম-কানুনে কোনরূপ পরিবর্তন বা ব্যতিক্রম দেখতে পাবে না।
কুরআন ও সুন্নাত মুসলমানকে শিক্ষা দিয়েছে যে, এসব প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনকে সম্মান করা- তার মর্যাদা রক্ষা করা কর্তব্য। কার্যকারণ প্রয়োগে ফলাফল লাভের জন্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাবে। কেননা আল্লাহ্ প্রতিটি কাজের মূলে ‘কারণ’ রেখেছেন এবং এ দুয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক সংস্থাপন করে নিয়েছেন। ইবাদতগাহের পরিচালক, ধোঁকা প্রতারণার পেশাধারী ও ধর্ম-ব্যবসায়ীরা নিজেদের সার্থোদ্ধারের মতলবে যে সব কাল্পনিক গোপন কার্যকারণকে উপার্জন উপায়রূপে অবলম্বন করেছে, তার প্রতি কোন মুসলমানই একবিন্দু ভ্রুক্ষেপ করতে ও তার গুরুত্ব মেনে নিতে পারে না।
কুসংস্কার ও ভিত্তিহীন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) যখন দুনিয়ায় আগমন করলেন, তখন তিনি সমাজে ধোঁকাবাজদের দল-কে দল দেখতে পেলেন। তারা গণকদার বা জ্যোতিষী নামে পরিচিত ছিল। গায়েবের অতীত বা ভবিষ্যতে সঙ্ঘটিত বা ব্যাপারাদি জ্বিনদের মাধ্যমে জেনে নিতে পারে বলে দাবি করত। এ ধোঁকা-প্রতারণা কুরআন ও সুন্নাতের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে নবী করীম (সা) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তিনি সকলকে আল্লাহর কালাম শোনালেনঃ ( আরবি******************)
আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যারাই রয়েছে তারা কেউই ‘গায়ব’ জানে না, সব কিছু জানেন একমাত্র আল্লাহ্। (সূরা নামলঃ ৬৫)
অতএব ফেরেশতা, জ্বিন বা মানুষ কেউই ‘গায়ব’ জানতে পারে না।
রাসূলে করীম (সা) আল্লাহর এ ঘোষণাও পাঠ করে শোনালেনঃ ( আরবি******************)
আমি (মুহাম্মাদ) যদি গায়ব জানতাম, তাহলে বেশি বেশি কল্যাণ ও মঙ্গল আমি নিজের জন্যে করে নিতাম এবং কোনরূপ খারাবী আমাকে স্পর্শ পর্যন্তও করতে পারত না। আমি তো শুধু প্রদর্শনকারী, সুসংবাদদাতা ঈমানদার লোকদের জন্যে।
হযরত সুলায়মানের খেদমতে নিয়োজিত জ্বিনদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা জানিয়ে দিলেনঃ ( আরবি******************)
ওরা যদি গায়ব জানতই, তাহলে তারা সেই অপমানকর আযাবে দীর্ঘদিন বন্দী হয়ে থাকত না। (সূরা সাবাঃ ১৪)
অতএব যে লোক প্রকৃত গায়ব জানার দাবি করে, সে আল্লাহ্, প্রকৃত ব্যাপারে এবং সমস্ত মানুষের ওপর সম্পূর্ণ ও সুস্পষ্ট মিথ্যা আরোপ করে।
নবী করীম (সা)-এর কাছে বিভিন্ন প্রতিনিধি দল এসে উপস্থিত হয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, নবী করীম (সা)-ও বুঝি গায়ব জানার দাবি করেছেন। এ ব্যাপারে তারা নবী করীম (সা)-এর পরীক্ষাকরণের উদ্দেশ্যে হাতের মুঠির মধ্যে কিছু গোপন করে জিজ্ঞেস করলঃ ‘বলুন তো আমাদের মুঠোর মধ্যে কি আছ।’ নবী করীম (সা) তাদের স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেনঃ ( আরবি******************)
আমি কোন গণকদার নই। জেনে রাখ, গণকদার, গণকদারী ও গণকদার গোষ্ঠী সকলেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
গণকদারকে বিশ্বাস করা কুফর
ইসলাম কেবল গণকদার ও ধোঁকাবাজ প্রতারকদের বিরুদ্ধে কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি। যারা নিজেদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ভ্রান্ত ধারণা সম্পন্ন হওয়ার দরুন তাদের কাছে যায়, জিজ্ঞস করে ও জানতে চায় এবং তাদের সত্য বলে বিশ্বাস করে, তাদেরকেও ইসলাম ওদের সঙ্গেই শরীক করে নিয়েছে এবং উভয় শ্রেণীর লোকদের অভিন্ন পরিণতির কথা ঘোষণা করেছে। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে লোক জ্যোতিষীর কাছে গেল, তাকে কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করল এবং সে যা বলল তাতে তাকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করে নিল, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার কোন নামাযই কবুল হবে না।
অপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
যে লোক গণকদারের কাছে গেল এবং সে যা বলল, ততে তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করল, সে হযরত মুহাম্মদের প্রতি অবতীর্ণ দ্বীনকে অবিশ্বাস করল- কাফির হয়ে গেল। (বাজ্জার)
তা এজন্যে যে, মুহাম্মাদ (সা)-এর প্রতি নাযিল হয়েছে যে, গায়েব কেবলমাত্র আল্লাহই জানেন, মুহাম্মাদ (সা) গায়ব জানেন না, অন্যরা তো বটেই। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
বল, আমি বলছি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভাণ্ডারসমূহ রয়েছে, আমি গায়বও জানি না, আমি তোমাদের একথাও বলছি না যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমি তো অনুসরণ করি শুধু তাই যা আমার কাছে ওহী হয়ে আসে।
মুসরমান যখন কুরআন মজীদ থেকে একথা স্পষ্ট ও অকাট্যভাবে জানতে পারল, তার পরও বিশ্বাস করল যে, কোন কোন সৃষ্টি- মানুষ বা জ্বিন্- তকদীরের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম এবং তারা গয়বী জগতের জ্ঞানের অধিকারী, তাহলে তারা হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর কাছে অবতীর্ণ দ্বীন-ইসলামকে সম্পূর্ণরূপেই অস্বীকার করল, তার প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করল।
পাশার দ্বারা ভাগ্য জানতে চাওয়া
পূর্বোল্লেখিত যুক্তির ভিত্তিতেই ইসলাম পাশার সাহায্যে ভাগ্য জানতে চাওয়াকে সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছে।
‘পাশা’ বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে, কতগুলো তীর। জাহিলিয়াতের যুগে আরবরা তার সাহায্যে ভাগ্য জানবার জন্যে চেষ্টা করত, সেজন্যে সেগুলোকে ব্যবহার করত। তার একটার উপর লেখা থাকত, ‘আমাকে আমার আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছেন’। দ্বিতীয়টির ওপর লেখা থাকত, ‘আমাকে আমার আল্লাহ্ নিষেধ করেছেন’। তৃতীয়টি থাকত সম্পূর্ণ খালি। তার ওপরু কিছুই লেখা থাকত না। তারা যখন বিদেশ যাত্রার ইচ্ছা করত কিংবা বিয়ে ইত্যাদি কাজের ইচ্ছা করত, তখন তারা মূর্তির ঘরে উপস্থিত হতো। আর তাতেই রক্ষিত থাকত এই তীরসমূহ। এখন তাদের ভাগ্যে কি লেখা আছে তা তারা জানতে চাইত। যদি প্রথম তীরটি- যাতে ‘আদেশ করেছেন’ লেখা রয়েছে- বের হতো, তাহলে তারা অগ্রসর হতো। আর যদি নিষেধ লেখা তীরটি বের হতো, তাহলে তারা প্রস্তাবিত কাজ থেকে বিরত থাকত। আর খালি তীরটি বের হলে তারা বারবার তীর বের করত- যেন সুস্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায়।
আমাদের সমাজে জাহিলিয়াতের ঠিক এ ধরনটি প্রচলিত না থাকলেও এর সাথে সাদৃশ্য সম্পন্ন বেশ কিছু কাজ প্রচলিত রয়েছে। যেমন ‘রমন’ কড়ি, কিতাব খুলে ফাল লওয়া। তাসের পাতা বা পেয়ালা পড়া ইত্যাদি এ পর্যায়ে যা কিছু করা হয়, ইসলামে তা সবই সম্পূর্ণ হারাম।
আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি যেসব খাদ্য হারাম করেছেন, তার উল্লেখের পর বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা তীরসমূহ দ্বারা ভাগ্য জানতে চাইবে, তা হারাম, তা আল্লাহর আইন লংঘনমূলক কাজ। (সূরা মায়িদাঃ ৩)
আর নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে লোক গণকদারী করল কিংবা তীর দ্বারা ভাগ্য জানতে চেষ্টা করল অথবা খারাপ ‘ফাল’ লওয়ার দরুন বিদেশ সফর থেকে ফিরে গেল, সে উচ্চতর মর্যাদা লাভ করতে পারবে না কখনও। (বুখারী, মুসলিম)
যাদুবিদ্যা
আনুরূপভাবে ইসলাম যাদুবিদ্যা ও যাদুকরদের মুকাবিলা করেছে। যারা যাদুবিদ্যা শিখে, তাদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
তারা এমন বিদ্যা শিখে যা তাদের ক্ষতি করে, কোন উপকার দেয় না।
নবী করীম (সা) যাদু কার্যকে ধ্বংসকারী কবীরা গুনাহর মধ্যে গণ্য করেছেন. তা ব্যক্তির পূর্বে জাতিকে ধ্বংস করে। পরকালের পূর্বে এ দুনিয়াই যাদুকররা চরমভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে নিয়ে যায়। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী কাজ থেকে বিরত থাক। সাহাবিগণ বললেনঃ হে রাসূল, সে সাতটি কি কি? তিনি বললেনঃ আল্লাহর সাথে শিরক করা, যাদুবিদ্যা, আল্লাহ্ যে প্রাণী হত্যা করাকে হারাম করেছেন- ইনসাফের ভিত্তিতে হত্যা করা ছাড়া- সেই নর হত্যা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীমের ধন-মাল ভক্ষণ-হরণ, যুদ্ধের ময়দান থেকে পৃষ্ঠ-প্রদর্শন এবং ঈমানদার অসতর্ক মহিলাদের সম্পর্কে মিথ্যা মিথ্যা ব্যভিচারের দোষারোপ করা। (বুখারী, মুসলিম)
কোন কোন ফিকাহবিদ যাদুবিদ্যা বা যাদুকার্যকে কুফরি বলেছেন, কিংবা বলেছেন, তা মানুষকে কুফরি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। অপর কোন কোন ফিকাহবিদ এ মত দিয়েছেন যে, যাদুকরের দুষ্কৃতি থেকে সমাজকে পবিত্র রাখার জন্যে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব।
কুরআন মজীদ আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যাদুকরদের দুষ্কৃতি ও ক্ষতি থেকে আল্লাহর কাছে পানা চাওয়ারঃ ( আরবি******************)
ফুঁ দিয়ে গিয়ে কসে বাঁধে যেসব নারী, তাদের দুষ্কৃতি ও ক্ষতি থেকে, হে আল্লাহ্ তোমার কাছে পানা চাই।
গিড়ের মধ্যে ফুঁ দেয়া যাদু করার একটা পদ্ধতি এবং এটা যাদুকরদের একটা বিশেষ ধরনের কাজ। হাদীসে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
যে লোক গিড়েতে ফুঁ দিল, সে যাদু করল। আর যে যাদু করল সে শিরক করল।
গণদারদের কাছে যাওয়া এবং গায়বী ও রহস্যাবৃত বিষয়াদি জানতে চেষ্টা করাকে যেমন ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে, তেমনি যাদু বা যাদুকরদের কাছে কোন রোগের চিকিৎসার্থে বা কোন সমস্যার সমাধানের জন্যে আশ্রয় গ্রহণকেও সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছে। নবী করীম (সা) এ কাজ থেকে সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্কতার কথা ঘোষণা করেছেন। বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে লোক গণকদারী করল বা যার জন্যে গণকদারী করা হলো, যে ফাল গ্রহণ করল কিংবা যার জন্যে ফাল গ্রহণ করা হলো কিংবা যে যাদুগিরি করল বা যার জন্যে যাদুগিরি করা হলো, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।
হযরত ইবনে মাসঊদ বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে লোক কোন গণকদার বা যাদুকর কিংবা গায়বী কথা বলার লোকের কাছে গেল, তাকে জিজ্ঞেস করল এবং সে যা বলল তা সে সত্য বলে বিশ্বাস করল, সে মুহাম্মাদ (সা)-এর প্রতি অবতীর্ণ দ্বীন-ইসলামকে অস্বীকৃতি জানাল, তা অবিশ্বাস করল।
রাসূলে করীম (সা) আরও বলেছেনঃ ( আরবি******************)
মদ্যপায়ী, যাদু বিদ্যায় বিশ্বাসী ও রক্তসম্পর্ক ছিন্নকারী কখনই জান্নাতে যাবে না।
এসব হাদীসের আলোকে জানা গেল যে, কেবল যাদুকরের কাজই হারাম নয়, যাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী এবং গণকদার বলে তাকে যে সত্য মানে, তার এ কাজও সম্পূর্ণ হারাম।
যদি মূলত হারাম কাজের উদ্দেশ্যে এ যাদুবিদ্যা ব্যবহৃত হয়, যেমন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি, দৈহিক ক্ষতি সাধন প্রভৃতি তাহলে আরও কঠিন হারাম হয়ে দাড়ায়, আর যাদুকররা যে সাধারণত এসব কাজ করে তা সকলেই জানেন।
তাবীজ ব্যবহার
তাবীজ-তুমার ব্যবহারও এ পর্যায়েরই কাজ। তাতে এ বিশ্বাস মনে নিহিত থাকে যে, তাবীজ বাঁধলেই রোগ সেরে যাবে বা রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এই বিংশ শতাব্দীর আলোকোজ্জ্বল যুগেও এমন বহু লোকই রয়েছে যারা নিজেদের ঘরের দুয়ারে ঘোড়ার ‘জুতা’ বাঁধে। আজকের দুনিয়ায় এমন লোকেরও অভাব নেই যারা জনগণের মূর্খতা-অজ্ঞতার সুযোগে বৈষয়িক অর্থনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করার কাজে দিন-রাত ব্যস্ত। তারা তাদের জন্যে তাবীজ লিখে। এসব তাবীজে রেখা ও ধাঁধা অঙ্কিত থাকে। তারা তাদের সম্মুখে কিরা-কসম করে নিজেদের সত্যতা ও দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করে। মন্ত্র পড়ে তাবীজের ওপর ফুঁ দেয়। দাবি করে যে, তাবীজ-তুমার বাঁধলে জ্বিনের কুপ্রভাব পড়তে পারে না, ভূত-প্রেত, কুদৃষ্টি বা হিংসা-পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু এসব ইসলাম সমর্থিত চিকিৎসা পদ্ধতি নয়।
রোগমুক্তি, রোগ প্রতিরোধ ও রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে ইসলাম পরিচিত পদ্ধতি বিধিবদ্ধ করেছে। যারা সে সব পরিহার-প্রত্যাখ্যান করে গুমরাহীর পথ অবলম্বন করে তাদের তিরষ্কার করেছে।
নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা রোগের চিকিৎসার্থে ঔষধ ব্যবহার কর। কেননা যিনি রোগ সৃষ্টি করেছেন, তিনি তার ঔষধও সৃষ্টি করেছেন। (বুখারী)
তিনি আরও বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমাদের এ সব ঔষধের মধ্যে তিনটি জিনিস খুবই উপকারী। তা হচ্ছে, মধু পান করা, রক্ত চুসার ছুরি কিংবা আগুনে দাগাঁনো। (বুখারী, মুসলিম)
একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে, রাসূলে করীমের বিশেষ উপকারী এ তিনটি ঔষধই চিকিৎসা প্রক্রিয়ার আধুনিক কালের চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে রয়েছে। মুখে খাওয়া ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা, অস্ত্রোপাচারের সাহায্যে রোগমুক্তি এবং দাগানো পন্থায় রোগের নিরাময়তা অর্জন। বিদ্যুৎ তাপ বা ছ্যাঁকের চিকিৎসা এই তৃতীয় পর্যায়ের মধ্যে শামিল এবং তা অত্যাধুনিক পদ্ধতি। অতএব এ সব চিকিৎসাই বৈধ।
রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তাবীজ বাঁধা কিংবা যাদু-মন্ত্র পাঠ সুস্পষ্ট মুর্খতা ও গুমরাহী এবং তা আল্লাহ্ প্রদত্ত সুন্নাত ও তওহীদী আকীদার পারিপন্থী। হযরত ওকবা ইবনে আমের (রা) বলেনঃ দশ ব্যক্তি সমন্বয়ে সঠিক এক প্রতিনিধিদল নবী করীমের খেদমতে উপস্থিত হলো, তন্মধ্যে নয়জনের কাছ থেকে তিনি বায়’আত গ্রহণ করলেন, একজনের বায়’আত নিলেন না। তাদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেনঃ ( আরবি******************)
ও লোকটির বাহুতে তাবীজ বাঁধা রয়েছে। এ কথা শুনে লোকটি তাবীজ ছিঁড়ে ফেলল। পরে নবী করীম (সা) তারও বায়’আত গ্রহণ করলেন, এবং পরে বললেনঃ যে লোক তাবীজ বাঁধে সে শিরক করে। (আহমদ, হাকেম)
অপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
যে লোক তাবীজ বেঁধেছে, আল্লাহ্ তাকে সাফল্যমণ্ডিত করবেন না। আর যে লোক মাদুলী বাধল, আল্লাহ্ তাকে একবিন্দু শন্তি ও স্বস্তি দেবেন না। (আহমদ)
ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) বলেন, নবী করীম (সা) এব ব্যক্তির বাহুতে পিতলের মাদুলি বা কবজ বাঁধা দেখতে পেলেন। বললেনঃ তোমার জন্যে আফসোস! তুমি ওটা কি বেঁধে রেখেছ? বললঃ এটা দুর্বলতা দূর করার উদ্দেশ্যে বেঁধেছি। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ ( আরবি******************)
ওটা তোমার দুর্বলতা অধিক বৃদ্ধি করবে, ওটা ফেলে দাও। নতুবা ওটা বাধা অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয়, তাহলে কস্মিনকালেও তুমি কল্যাণ পেতে পারবে না। (আহমদ, ইবনে হাব্বান)
এ সব শিক্ষা সাহাবিগণের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল বলে তাঁরা নিজেরাই এসব উপায়-উপকনণ ও বাতিল পন্থা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন।
ঈসা ইবনে হামযা বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে হুকাইমের কাছে গেলাম তাঁর বিসর্প (Erysipelas- an inflammation of the skim with redness) রোগ হয়েছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ আপনি এ রোগের জন্যে কোন তাবীজ-কবজ বাঁধেন না কেন? জবাবে তিনি বললেনঃ
( আরবি******************) আমি তা থেকে আল্লাহর কাছে পানা চাই।
অপর বর্ণনায় তাঁর উক্তি এইঃ ( আরবি******************)
তার অপেক্ষা মৃত্যু অতি নিকটবর্তী যে লোক কিছু একটা ঝুলাবে, বাঁধবে, তাকে তারই ওপর ছেড়ে দেয়া হবে।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ (রা) তাঁর স্ত্রীর কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন, তার গলায় কি যেন বাঁধা রয়েছে। তিনি তা টেনে ছিড়ে ফেললেন। পরে বললেনঃ ( আরবি******************)
আবদুল্লাহর বংশের লোকেরা শিরক করা থেকে বিমুখ হয়ে গেছে, যে বিষয়ে আল্লাহ্ কোন দলিল নাযিল করেন নি।
পরে তিনি বললেন, আমি নবী করীম (সা)-কে বলতে শুনেছিঃ ( আরবি******************)
তাবীজ-তুমার, কবজ, তাওলা ইত্যাদি সব শিরক। লোকেরা জিজ্ঞেস করলঃ ‘তাওলা’ কাকে বলে? তিনি বললেন, তা এমন একটা তদবীর ও আমল যা মেয়ে-লোকেরা স্বামীদের বেশি ভালবাসা পাওয়ার জন্যে ব্যবহার করে।
সহজকথায় ‘তাওলা’-ও এক প্রকার যাদু।
আলিমদের মত হচ্ছে, যে সব তাবীজ আরবী ভাষায় লিখিত নয়, তাতে কি লিখিত রয়েছে তা জানা বোঝা যায় না- তাতে যাদুও থাকতে পারে, কুফরি কথাবার্তাও থাকতে পারে। তাই তা নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি তার অর্থ ও মর্ম বোঝা যায় এবং তাতে আল্লাহর যিকির বা নাম উল্লেখ থাকে, তবে তা নিষিদ্ধ বা হারাম নয়। এরূপ অবস্থায় তাবীজ দো’আ পর্যায়ে গণ্য। চিকিৎসা নয়, ঔষধও নয়, আল্লাহর সাহায্যের আশা মাত্র। জাহিলিয়াতের যুগে ব্যবহৃত তাবীজে যাদু, শিরক বা রহস্যপূর্ণ কথাবার্তা থাকত, যার কোন অর্থ বোঝা যেত না। এ জন্যে তা হারাম ঘোষিত হয়েছিল।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা) তাঁর স্ত্রীকে জাহিলিয়াতের এসব মন্তর ও তাবীজ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি জবাবে একটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। বললেনঃ আমি একদিন বাইরে বের হলাম, তখন অমুক ব্যক্তি আমাকে দেখে ফেলল। আমার দুই চোখ থেকে অশ্রু ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করল।
পরে আমি মন্ত্র পড়লে চোখের পানি বন্ধ হয়ে গেল। মন্ত্র পড়া বন্ধ করলে আবার ফরফর বেগে পানি পড়তে শুরু করে। ইবনে মাসউদ বললেনঃ ( আরবি******************)
এ হচ্ছে শয়তান। তুমি যখন ওকে মেনে নাও, তখন সে তোমাকে ছেড়ে দেয়। আর তুমি যখন তার অবাধ্যতা কর তখন সে তার আঙ্গুলী দিয়ে তোমার চোখে খোঁচা দেয়। কিন্তু তুমি নবী করীম (সা) যা করতেন তাই যদি কর তাহলে তা তোমার জন্যে খুবই ভাল এবং সম্ভবত তুমি নিরাময়তাও লাভ করতে পারবে। তা হচ্ছে, নিজের চোখে পানি দাও এবং বল দো’আ। (ইবনে মাজাহ, আবূ দাউদ)
খারাপ লক্ষণ গ্রহণ
কোন কেন জিনিস থেকে খারাপ লক্ষণ গ্রহণ- তা কোন স্থান, কোন ব্যক্তি বা অন্য যে কোন জিনিস থেকেই হোক, তা ভিত্তিহীন কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। বহু আগের ও প্রাচীনতম কাল থেকেই তা মানব সমাজে চলে এসেছে এবং আরও বহুকাল অবধি হয়ত তা চলতেও থাকবে। বহু ব্যক্তি ও বহু মানব গোষ্ঠীকেই এর মধ্যে নিমজ্জিত দেখতে পাওয়া যায়। হযরত সালেহ্ নবীর সময়ের লোকেরা বলেছিলঃ ( আরবি******************)
আমাদের মতে তো তুমি এবং তোমার সঙ্গী সাথী খারাপ লক্ষণ বিশেষ।
ফিরাঊন ও তার লোকদের ওপর কোন বিপদ ঘনীভূত হয়ে এলেঃ ( আরবি******************)
তারা মূসা ও তাঁর সঙ্গীদের কুলক্ষণ মনে করতে শুরু করে দিত।
চরম গুমরাহীতে নিমজ্জিত বিপুল সংখ্যক কাফিরের ওপর সেকালে নবী-রাসূলগণের দাওয়াত অস্বীকার করার দরুন যখন কোন বিপদ আপতিত হতো, তখন তারা বলতঃ
( আরবি******************) আমরা তোমাদেরকে কুলক্ষণে মনে করি।
এর জবাবে নবী-রাসূলগণ বলতেনঃ
( আরবি******************)- তোমাদের কুলক্ষণ তো তোমাদের সঙ্গে লেগে আছে।
অর্থাৎ তোমাদের দুর্ভাগ্যের কারণ তোমাদেরই সঙ্গী। আর তা হচ্ছে, তোমাদের কুফরি, আল্লাহর সাথে তোমাদের শত্রুতা এবং আল্লাহ্ ও রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
খারাপ লক্ষণ গ্রহণে জাহিলিয়াতের যুগের আরবদের বিশ্বাস ছিল ভিন্নতর। কিন্তু ইসলাম এসে সেই সবকে বাতিল ঘোঘণা করে এবং তাদের চালিত করে সুদৃঢ় ও বিবেক বুদ্ধিসম্মত পথে।
নবী করীম (সা) কুলক্ষণ গ্রহণকে গণকদারী ও যাদুক্রিয়ার সাথে একই সুত্রে গেঁথেছেন। তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে লোক নিজে কুলক্ষণ গ্রহণ করবে বা যার জন্যে কুলক্ষণ গ্রহণ করা হবে বা গণনা করা হবে কিংবা যাদু করবে যার জন্যে যাদু করা হবে সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়। (তিবরানী)
তিনি আরও বলেছেনঃ ( আরবি******************)
রমল, পাখির উড়ানো কুলক্ষণ গ্রহণ ও পাথরকুচি নিক্ষেপ করে খারাপ লক্ষণ গ্রহণ- এ সবই কুসংস্কার বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত।
এ কুলক্ষণ গ্রহণ কোন জ্ঞান-বুদ্ধির ওপর ভিত্তিশীল নয়। এর সাথে বাস্তবতারও কোন সম্পর্ক নেই। এটা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি ও মানসিক দুর্বলতার ফসল। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন-মানসিকতার দরুনই মানুষ লক্ষণ- তা কু হোক বা শুভদ্বারা চালিত হতে প্রস্তুত হয়ে থাক। নতুবা কোন বিশেষ ব্যক্তিকে, কোন নির্দিষ্ট স্থানকে কিংবা গ্রহ-তারকার কোন কক্ষে প্রবেশ করাকে কুলক্ষণের প্রতীক মনে করার কি অর্থ থাকতে পারে? কোন পাখির আওয়াজ শুনলেই যাত্রা অশুভ হয়ে যাবে কিংবা চোখের পাতার কম্পনে ভাল বা মন্দ নিহিত থাকবে অথবা কোন বিশেষ শব্দ শুনলেই সমস্ত সংকল্প নড়বরে হয়ে যাবে, এমন কথার সাথে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।
আসলে মানুষের ভিতরে স্বভাবগতভাবে নিহিত দুর্বলতার দরুনই কোন কোন জিনিস থেকে ‘লক্ষণ’ গ্রহণ করে। অতএব বুদ্ধিমান সচেতন মানুষের কর্তব্য কোনরূপ দুর্বলতার কাছে মাথা নত না করা।
একটি মরফু হাদীসে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)
তিনটি জিনিস এমন রয়েছে, যা থেকে খুব কম লোকই রক্ষা পেতে পারে। তা হচ্ছেঃ কুধারণা, কুলক্ষণ গ্রহণ এবং হিংসা। অতএব তোমার মনে যদি কুধারণা জাগে, তাহলে তুমি তাতে প্রত্যয় নিও না, কুলক্ষণ যদি তোমার মনে দ্বিধার সৃষ্টি করে, তাহলে মাঝপথ থেকে ফিরে যেও না। আর যদি হিংসার উদ্রেক হয়, তাহলে তুমি তেমনটা চাইবে না। (তিবরানী)
রাসূলের শেখানো এই পদ্ধতির অনুসরণ করা হলে এ তিনটি মনের পটেই জেগে উঠা ভিত্তিহীন চিন্তা-কল্পনা ও শয়তানের ওয়াসওয়াসা ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না এবং বাস্তব কাজের ওপর তার কোন প্রভাব প্রতিফলিত হবে না। এরূপ অবস্থায় আল্লাহ্ তা’আলা এসব ক্ষমা করে দেবেন। হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)
কুলক্ষণ গ্রহণ শিরক, কুলক্ষণ গ্রহণ শিরক, কুলক্ষণ গ্রহণ শিরক।
ইবনে মাসউদ বলেছেনঃ আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার মনে কুলক্ষণ সংক্রান্ত চিন্তার উদ্রেক হয় না। কিন্তু আল্লাহর ওপর নির্ভরতা গ্রহণ করলে এ ধরনের ভাবধারা সবই নিঃশেষ হয়ে যায়। (আবূ দাউদ, তিরমিযী)
জাহিলী অন্ধ অনুসরণের বিরুদ্ধে জিহাদ
ইসলাম যেভাবে জাহিলী আকীদা-বিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে,- কেননা এগুলো বিবেক-বুদ্ধি, নৈতিকতা ও সুস্থ আচার-আচরণের পরিপন্থী, অনুরূপভাবে জাহিলিয়াতের অন্ধ অনুকরণ-অনুসরণের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছে। কেননা তা হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার-গৌরব ও গোত্রীয় আত্মাভিমানের ওপর ভিত্তিশীল।
বিদ্বেষমূলক ভাবধারা ইসলামের বিপরীত
এ পর্যায়ে ইসলাম সর্বপ্রথম বিদ্বেষমূলক ভাবধারার ওপর কুঠারাঘাত করেছে এবং তার সব রূপ ও ধরনকে মাটির তলায় দাফন করেছে। সেই সাথে বিদ্বেষাত্মক ভাবধারা সৃষ্টি ও তার দিকে জনগণকে আহ্বান করাকে হারাম ঘোষণা করেছে। নবী করীম (সা) উদার কণ্ঠে ঘোষণা করেছেনঃ ( আরবি******************)
যে লোক বিদ্বেষাত্মক ভাবধারার দিকে লোকদের আহ্বান জানায়, যে লোক বিদ্বেষাত্মক ভাবধারার ওপর লড়াই করে এবং যে লোক বিদ্বেষাত্মক ভাবধারা নিয়ে মরে, তারা কেউই আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়। (আবূ দাঊদ)
অতএব ইসলামের দৃষ্টিতে চামড়ার বিশেষ বর্ণের কোন গুরুত্ব বা বিশেষত্ব নেই, লোকদের বিশেষ কোন জাতির প্রাধান্য স্বীকৃত নয়। পৃথিবীর কোন ভুখণ্ডেরও বিশেষত্ব নেই অপরাপর অংশের ওপর। কোন বর্ণের পক্ষেও অপর বর্ণের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা মুসলমানের জন্যে হালাল নয়। কোন জাতির ওপর অপর জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠারও কোন অধিাকর নেই। বিশেষ বিশেষ অঞ্চল বা রাজ্য-সম্রাজ্য সম্পর্কেও ইসলামের এ কথা। বর্ণে-বংশে-জাতিতে-অঞ্চলের পার্থক্যের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য করতে ইসলাম আদৌ প্রস্তুত নয়। অতএব মুসলমান বর্ণ, জাতি বা দেশভিত্তিক হিংসা-বিদ্বেষের ভিত্তিতে কোন কাজ করতে পারে না। আর ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, জুলুম-ইনসাফ- সর্বাবস্থাই নিজ জাতির সমর্থন করে যাওয়াও কোন মুসলমানের কর্ম নয়। ওয়াসিলা ইবনে আসকা (রা) বলেনঃ ( আরবি******************)
আমি বললাম, ইয়া রাসূল, ‘আসবিয়াত’ কাকে বলে? জবাবে তিনি বললেনঃ তোমার জাতি জুলুমের ওপর হওয়া সত্ত্বেও তুমি তার সাহায্য-সহযোগিতা করবে, এটাই ‘আসবিয়াত’ (বিদ্বেষাত্মক ভাবধারা অপর জাতির বিরুদ্ধে।
আল্লাহ্ তা’আলার ঘোষণা হচ্ছেঃ ( আরবি******************)
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা ইনসাফ ও সুবিচারের জন্যে দাঁড়িয়ে যাও। আল্লাহর সাক্ষ্যদাতা হয়ে- যদিও তা তোমাদের নিজেদের পিতামাতার ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধেই হোক। (সূরা নিসাঃ ১৩৫)
( আরবি******************) কোন বিশেষ জাতির শত্রুতা যেন তোমাকে অবিচার করতে প্রবৃদ্ধ না করে।
নবী করীম (সা)-এর সুবিচার নীতি এ অর্থেই জাহিলিয়াতের যুগে সর্বত্র বিস্তীর্ণ ছিল, তা বাহ্যিক অর্থেই গৃহীত। তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তুমি তোমার ভাইয়ের সাহায্য কর, সে জালিম হোক, কি মজলুম।
উত্তরকালে সাহাবীদের মধ্যে ইসলামী ঈমান যখন দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হলো তখন উপরিউক্ত কথাটির খারাপ অর্থ লোকদের সম্মুখে ভেসে উঠল এবং তদ্দরূন তাদের মনে আতঙ্ক ও বিস্ময় জেগে উঠল। তাঁরা প্রশ্ন করলেনঃ ( আরবি******************)
হে রাসূল! আপনার কথানুযায়ী আমার ভাই মজলুম হলে তাকে তো সাহায্য করতে পারি এবং এ পর্যায়ে আপনার কথার তাৎপর্য বুঝতে পারি। কিন্তু সে জালিম হলে তাকে আমরা কিভাবে সাহায্য করতে পারি?- এ কথাটির অর্থ বুঝতে পারি নি। জবাবে তিনি বললেনঃ ( আরবি******************)
তুমি তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখবে আর এটাই তাকে সাহায্য করতে বলার অর্থ।
এ থেকে আমরা স্পষ্ট জানতে পারি যে, মুসলিম সমাজে কোন আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কিংবা কোন জাতীয়তার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি চলতে পারে না। দেশ মাতৃকার দোহাই বা আঞ্চলিক কিংবা শ্রেণী-বংশ-বর্ণ ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তার দোহাই ও আত্মম্ভরিতা জাহিলিয়াতের দাবি। এর সাথে ইসলাম, রাসূল বা আল্লাহর কিতাবের কোনই সম্পর্ক থাকতে পারে না।
বস্তুত ইসলাম তার আকীদা পরিপন্থী কোন বন্ধুতা-সংস্থা বা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বাইরে কোন ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সমর্থন করে না। ঈমান ও কুফর ভিন্ন মানুষে-মানুষে পার্থক্য করার অপর কোন ভিত্তিকেও ইসলাম স্বীকার করে না। অতএব ইসলামের শত্রু- কাফির মুসরমানেরও শত্রু, সে তার স্বদেশী, স্বজাতীয় ও প্রতিবেশী হলেও। শুধু তা-ই নয়, তার আপন ভাই, পিতা, জননী যেই হোক, সেও তার আপন নয়, যদি ইসলামের দুশমন হয়। আল্লাহ্ তা’আলা এ কথাই বলেছেন নিম্নের এ আয়াতেঃ ( আরবি******************)
আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার জাতিকে আল্লাহ্ ও রাসূলের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব পোষণকারী রূপে পাবে না, তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই ও বংশীয় লোকই হোক না কেন। (সূরা মুজাদালাঃ ২২)
বলেছেনঃ ( আরবি******************)
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা তোমাদের পিতৃস্থানীয় লোক ও ভাই সদৃশ লোকদের বন্ধু, পৃষ্ঠপোষক রূপে গ্রহণ করবে না, যদি তারা ঈমানের ওপর কুফরিকে অগ্রাধিকার দেয়। (সূরা আত্ তাওবাঃ ২৩)
বংশ ও বর্ণের কোন গৌরব নেই
বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত বিলাল হাবশী ও আবূ যর গিফারী (রা) দুজনেই প্রাথমিক কালের সাহাবী। দুজন পরস্পরের ওপর ক্রোধান্ধ হয়ে গালাগাল করতে শুরু করেন। ক্রোধের তীব্রতায় হযরত আবূ যর (রা) হযরত বিলাল (রা)-কে সম্বোধন করে বললেনঃ ( আরবি******************)- ‘হে কালোর পুত্র’। হযরত বিলাল নবী করীম (সা)-এর কাছে এ কথা বলে অভিযোগ করলেন। তিনি হযরত আবূ যরকে বললেনঃ ( আরবি******************)
তুমি ওর মাকে মন্দ বললে? দেখা যায় তোমার মধ্যে জাহিলিয়াতের স্বভাব-চরিত্র এখনও অবশিষ্ট কয়েছে।
হযরত আবূ যর (রা) থেকেই বর্ণিত, নবী করীম (সা) তাঁকে বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তুমি নিজ সম্পর্কে ভেবে দেখ। লাল বা কালো বর্ণের লোকদের অপেক্ষা তুমি কোন অংশেই উত্তম ব্যক্তি নও। তুমি ওর ওপর কেবল মাত্র তাক্ওয়ার ভিত্তিতেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পার। (আহমদ)
নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমরা সকলেই আদমের সন্তান। আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি দিয়ে।
এ সবের সাহায্যে মুসলমানের বংশ বর্ণ পিতৃপুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার ভিত্তিতে গৌরব করা ও অন্যদের তুলনায় নিজেদের বড়ত্ব প্রমাণ করতে চেষ্টা করাকে ইসলাম সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছে। কেননা এগুলোই হচ্ছে জাহিলিয়াতের উপকরণ। নিতান্ত লালসার দাসত্ব করতে গিয়েই মানুষ এ কাজ করতে পারে। কাজেই আমি অমুকের ছেলে, আমি অমুকের বংশধর আর তুমি অমুক হীন বংশের লোক, আমি শ্বেতকর্ণ, আর তুমি কৃষ্ণাঙ্গ, আমি আরব আর তুমি অনারব ইত্যাদি ধরনের বিদ্বেষাত্মক ও হিংসাত্মক কথাবার্তা পরস্পরে বলার কোন অবকাশ ইসলামে নেই।
বস্তুত সমস্ত মানুষ যখন এক ও অভিন্ন মূল থেকে উৎসারিত, তখন পরবর্তী লোকদের পক্ষে বংশ গোত্র বা রক্ত নিয়ে গৌরব করার ও অপরের তুলনায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানর কোন অর্থ হয় না, তার অধিকারও কারো থাকতে পারে না। বংশের কোন গুরুত্ব আছে যদি ধরেও নেয়া যায়, তবু তার বংশে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তির নিজের কি শ্রেষ্ঠত্ব থাকতে পারে বা তার কি অপরাধ মনে করা যেতে পারে? নবী করীম (সা) ওজস্বিনী কণ্ঠে ঘোষণা করেছেনঃ ( আরবি******************)
তোমাদের এসব বংশ নিয়ে অপরের ওপর কোন শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পার না। কেননা তোমরা সমস্ত মানুষই আদমের সন্তান- বংশধর। দ্বীনদারী ও আল্লাহ্ ভীতি ছাড়া তোমাদের কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই অপর লোকদের ওপর। (আহমদ)
তিনি আরও বলেনঃ ( আরবি******************)
সমস্ত মানুষই তো আদম-হাওয়ার বংশধর। কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তোমাদের বংশ বা আভিজাত্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন না। আসলে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাবান সে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহ্ ভীরু।
বাপ-দাদার বা বংশের উচ্চতা নিয়ে গৌরবকারী লোকদেরকে কঠোর ভাষায় সাবধান করে দিয়ে নবী করীম (সা) বলেছেনঃ
হে লোকেরা! বাপ-দাদাদের নিয়ে গৌরব করা ত্যাগ কর-সেসব বাপ-দাদা যারা মরে জাহান্নামের কয়লা হয়ে গেছে। নতুবা তারা পোকা-মাকড়ের তুলনায়ও অধিক দীন ও লাঞ্ছিত হবে। আল্লাহ্ তা’আলা জাহিলিয়াতের আত্মম্ভরিতা ও বংশ গৌরব নির্মূল করে দিয়েছেন। এক্ষণে মানুষ হয় মুমিন মুত্তাকী হবে অথবা হবে পাপী দুশ্চরিত্র। সব মানুষই আদমের সন্তান। আর আদম মাটি থেকে সৃষ্ট। (আবূ দাউদ, তিরমিযী, বায়হাকী)
এ হাদীসে বড় গুরুত্বপূর্ণ দিক্ষা রয়েছে তাদের জন্যে, যারা নিজেদের প্রাচীন বাপ-দাদা পূর্ববংশ, আবরী-আজমী জাহিলিয়াতের অগ্রনায়ক ফিরাউন ও কাইজার কিসরাকে নিয়ে গৌরব করে অথচ নবী করীমের ঘোষণার দৃষ্টিতে তারা জাহান্নামের কয়লা ছাড়া আর কিছুই নয়।
হুজ্জাতুল বিদা’র সময় হজ্জের মাসে সম্মানিত মক্কা নগরে লক্ষাধিক মুসলিম সমবেত হয়ে রাসূলে করীমের উদাত্ত ভাষণ শুনছিলেন। তিনি শুরুতেই ঘোষণা করলেনঃ ( আরবি******************)
হে জনগণ! তোমাদের আল্লাহ্ এক। কোন আরববাসীর কোন শ্রষ্ঠত্ব নেই কোন অনারবের ওপর, কোন অনারবের কোন শ্রেষ্টত্ব নেই কোন আরবের ওপর। লাল-ধলা বর্ণের লোকের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই কালো বর্ণের লোকের ওপর। কালো বর্ণের লোকেরও কোন শ্রেষ্ঠত্ব-বৈশিষ্ট্য নেই লাল-ধলা লোকদের ওপর তাকওয়া ছাড়া। আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে সেই লোক আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান, যে তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহ্-ভীতি সম্পন্ন। (বায়হাকী)
মৃতের জন্যে বিলাপ
ইসলাম জাহিলিয়াত যুগের যেসব আচার-আচরণের অনুকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জাহিলিয়াতের আচরণ।
মৃতের জন্যে বিলাপ করা, খুব বেশি দুঃখ ও মনোকষ্ট প্রকাশে বাড়াবাড়ি করা তার মধ্যে অন্যতম।
ইসলাম তার অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছে যে, মৃত্যু এক জগত থেকে আর এক জগতে যাত্রা করা বা স্থানান্তর গ্রহণ ভিন্ন আর কিছুই নয়। তা কোন চূড়ান্ত ধ্বংস, বিনাশ ও বিলুপ্তি নয়। উপরন্তু বিলাপ করলেই মৃত জীবন্ত হয়ে যাবে না। আল্লাহর ফয়সালা বদলে যাবে না অন্য কোন ফয়সালার দরুন। অতএব মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে, প্রতিটি বিপদকে যেমন ধৈর্য সহকারে মুকাবিলা করতে হয়, মৃত্যুর ব্যাপারেও তারা তেমনি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করবে। তা থেকে বরং সবক গ্রহণ করবে। মনে মনে এ আশা পোষণ করবে যে, আল্লাহর শিখান উক্তি বারবার বলবেঃ ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন- ‘আমরা আল্লাহরই জন্যে এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব।’
তাই জাহিলিয়াতের যুগে মৃতের জন্যে যে বিলাপ করা হতো, ইসলামে তা হারাম- পরিত্যাজ্য। রাসূলে করীম (সা) তা থেকে নিঃসম্পর্কতার কথা ঘোঘণা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে লোক মৃতের জন্যে বিলাপ করতে গিয়ে নিজের মুখমণ্ডল আহত করে, পরনের কাপড় ছিন্নভিন্ন করে ও জাহিলিয়াতের ন্যায় চিৎকার আর্তনাদ করে, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়। (বায়হাকী)
মৃতের জন্যে শোক করতে গিয়ে মাতামী পোশাক পরা, অলংকারাদি পরিহার করা ও সাধারণ পরিধেয় ত্যাগ করা এবং আকার-আকৃতিতে পরিবর্তন সাধন করা কোন মুসলমানের জন্যে হালাল বা জায়েয নয়। তবে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর জন্যে যা করণীয়, তা অবশ্য করতে হবে। যেমন চার মাস দশদিন ইদ্দত পালন করা তার কর্তব্য। স্বামীর জন্যে স্ত্রীর এ বিধিবদ্ধ শোককাল এটা দাম্পত্য জীবন অবসানের কারণে কর্তব্য। তাদের দুজনের মধ্যে যে প্রেম-প্রীতির বন্ধন ছিল, স্বামীর মৃত্যুতে তা ছিন্ন হয়ে গেল বলে তার এতটুকু শোক প্রকাশ করা উচিত। তাতে সেই পবিত্র সম্পর্কের প্রতিই সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কাজেই এ সময় তার কোন অলংকার ব্যবহার করা উচিত নয়, যেন ইদ্দত যাপন কালে বিবাহেচ্ছু বহু লোকের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয়া হয়ে না উঠে।
কিন্তু মৃত ব্যক্তি স্বামী ছাড়া অন্য কেউ হলে- যেমন পিতা, ভাই, পুত্র, মা ইত্যাদি তিন দিনের বেশিকাল শোক প্রকাশ করা স্ত্রীলোকদের জন্যে জায়েয নয়। যয়নব বিনতে আবূ সালমা থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি নবী করীমের বেগম উম্মে হাবীবা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, তাঁর পিতা আবূ সূফিয়ান ইবনে হারম মারা গেলে এবং যয়নব বিনতে জাহাশের ভাই মারা গেলে তাঁরা দুজনই সুগন্ধি ব্যবহার করলেন এবং বললেনঃ সুগন্ধি লাগাবার এখন কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)
যে নরী আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাসী, তার পক্ষে মৃতের জন্যে তিন রাতের অধিক শোক করা জায়েয নয়। তবে স্বামীর জন্যে শোক করতে হবে চার মাস দশদিন পর্যন্ত। (বুখারী)
স্বামীর জন্যে এই শোক ওয়াজিব। এর প্রতি অবজ্ঞা দেখানো চলবে না। একজন মহিলা নবী করীমের খেদমতে হাযির হয়ে বলল, আমার মেয়ের স্বামী মরে গেছে। এখন কি আমি তার চোখে সুরমা লাগাতে পারি? নবী করীম (সা) বললেনঃ না, দুবার তিনবার এই একই জবাব দিলেন। এ কথা দ্বারা স্পষ্ট বোঝা গেল, স্বামী মরে গেলে স্ত্রীকে সৌন্দর্যের উপকরণাদি ও অলংকার ব্যবহার করা ইদ্দত কাল শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়ের জন্যে হরাম।
তবে কোন রূপ অস্থিরতা প্রকাশ ছাড়া শুধু শোক বা দুঃখ করা এবং চিৎকার না করে কান্নাকাটি করা- এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার। এজন্যে কোন গুনাহ্ হবে না। হযরত উমর (রা) শুনতে পেলেন, খালিদ ইবনে ওয়ালীদের জন্যে মেয়েরা কান্নাকাটি করছে। তখন কোন কোন পুরুষ তাদের নিষেধ করার ইচ্ছা করল। তা দেখে হযরত উমর (রা) বললেনঃ ( আরবি******************)
ছেড়ে দাও ওদের। ওরা আবূ সুলায়মান- খালিদের জন্যে কান্নাকাটি করুক, যতক্ষণ না মাথায় মাটি তুলছে বা উচ্চস্বরে চিৎকার করছে।