উপসংহার
এই গ্রন্থে আমরা মুসলমানের কাজকর্ম ও বাহ্যিক আচার-আচরণের ক্ষেত্রে হালাল ও হারাম পর্যায়ের আলোচানা বিস্তারিতভাবে পেশ করার সংকল্প গ্রহণ করেছিলাম। আর তা আমাদের সাধ্যানুসারে সম্পন্ন করেছি। এ ছাড়া মন-মগজের কার্যাবলী, মনস্তত্ত্বের গতি-বিধি ইচ্ছা-বাসনা কল্পনা-এর মধ্যে কি হারাম, কি হালাল এবং কোন কোনটি তীব্রভবে হারাম- যেমন হিংসা-বিদ্বেষ-পরশ্রীকাতরতা, গৌরব-অহংকার, দেখানোপনা, মুনাফিকী, লোভ-লালসা-কৃপণতা প্রভৃতি বিষয়ে এ গ্রন্থে আলোচনা করার আমাদের কোন পরিকল্পনাই ছিল না। যদিও এ মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাসমূহ অতিবড় হারাম এবং ইসলাম এ সবের বিরুদ্ধে কঠিনভাবে যুদ্ধ ও মুকাবিলা করেছে, নবী করীম (সা) এ সবের অনিষ্ট সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, কোন কোনটিকে মুসলিম উম্মতের পক্ষে মারাত্মক রোগ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো নির্মূলকারী বলে অভিহিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো এই আলোচনার আওতার মধ্যে নিয়ে আসা হয়নি।
বস্তুত কুরআন মজীদ ও সুন্নাতে মুহাম্মদীয়া মানুষের অন্তর্জগতকে নির্মল নিষ্কলুষ করে গড়ে তুলে তাকে ব্যক্তি ও সমষ্টির সার্বিক কল্যাণ এবং ইহকাল ও পরকালীন মুক্তির ভিত্তি বানাতে চেয়েছে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই কুরআন মজীদে হলা হয়েছেঃ ( আরবি*******************)
লোকেরা নিজেদের মন-অন্তর-হৃদয়কে পরিবর্তিত না করা পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সমষ্টিক অবস্থারও কোন পরিবর্তন করবেন না।
( আরবি*******************) কিয়ামতের দিন ধন-মাল, পুত্র-সন্তানাদি কোন কল্যাণ দেবে না- কল্যাণ পাবে শধু সেই লোক, যে আল্লাহর কাছে সুস্থ নির্দোষ হৃদয়-অন্তর নিয়ে উপস্থিত হবে।
নবী করীম (সা) এ দৃষ্টিতেই তাঁর প্রখ্যাত হাদীসে বলেছেনঃ ( আরবি*******************)
হালাল স্পষ্ট, হারামও স্পষ্ট। এ দুটির মাঝে অনেকগুলো সন্দেহের ব্যাপার রয়েছে। যে লোক সেগুলোতে আত্মরক্ষা করবে- এড়িয়ে চলবে সে তার দ্বীন ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে। আর যে তার মধ্যে পড়ে যাবে, তার পক্ষে সুস্পষ্ট হারামের মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে আর প্রত্যেক রাজারই একটা সংরক্ষিত এলাকা থাকে। পৃথিবীতে আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হচ্ছে তাঁর হারাম করে দেয়া বিষয়গুলো।
অতঃপর মানবদেহে হৃদয়ের গুরুত্বের কথা বলেছেন। আর তা থেকে যেসব প্রতিরোধ, ঝোঁক-প্রবণতা ও ইচ্ছা-বাসনা উৎসারিত হবে যার প্রেরণায় মানুষের বাহ্যিক আচরণ গড়ে উঠে, সেদিকেও ইঙ্গিত করেছেন। বলেছেনঃ ( আরবি*******************)
জেনে রাখ, মানবদেহে একটা মাংসখণ্ড রয়েছে। তা যদি সুস্থ থাকে, তাহলে গোটা দেহই সুস্থ হয়ে যায়। আর সেটি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে গোটা দেহই অসুস্থ হয়ে যায়। জানো সেটি হচ্ছে হৃদয়- অন্তর।
এ হাদীস অনুযায়ী হৃদয়ই হচ্ছে প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অন্যান্য সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তারই নির্দেশে পরিচালিত হয়। এ চালক বা চালিকা শক্তি ভাল হলে সমগ্র দেহ-প্রজাবর্গও ভাল হবে। আর সেটি খারাপ হলে সবই খারাপ হয়ে যাবে। এতো অতি স্বাভাবিক কথা।
মানুষের আমল আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়ার মানদণ্ড হচ্ছে হৃদয়- মনোভাব বা নিয়ত। মানুষের বাহ্যিক আকার আকৃতি ও মুখের কথার কোন গুরুত্ব এক্ষেত্রে স্বীকৃত নয়। কেননা আল্লাহ্ তো মানুষের আকার-আকৃতির প্রতি দৃষ্টি দেয় না। তিনি দেখেন মনের আবস্থা- মানসিককা। রাসূলের হাদীসঃ সমস্ত কাজের মূল্যায়ন হয় নিয়তের ভিত্তিতে- এর অর্থও তাই। মানুষ তা-ই পায়, যা পাওয়ার সে নিয়ত করেছে।
অন্তর বা হৃদয় সংক্রান্ত সমস্ত কাজের প্রকৃত পজিশন এ-ই এবং ইসলামে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারাদির যে খুব বেশি গুরুত্ব, তা এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠে। কিন্তু আমরা তার উল্লেখ এ গ্রন্থে করিনি। কেননা তা নৈতিকতা পর্যায়ের বিষয়াদি। আর তাতেও হালাল-হারামের প্রশ্ন রয়েছে। মুসলিম নৈতিকতা বিশারদ ও তাসাউফপন্থিগণ তার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সে দৃষ্টিতে যা যা হারাম, তাসাউফের পরিভাষায় তার নাম দেয়া হয়েছে ‘আমরাজুল কুলুব’ ‘হৃদয়ের রোগ সমূহ’। তাঁরা তার কারণ নির্ধারণ করেছেন এবং তার প্রতিবিধানের জন্যে ব্যবস্থাপত্রও দিয়েছেন। তাতে কুরআন ও সুন্নাতকে ভিত্তি করা হয়েছ। ইমাম গাযযালীর ‘ইহায়াউল-উলুম’ গ্রন্থের এক-চতুর্থাংশ এ আলোচনা সমন্বিত। তিনি তার নাম দিয়েছেন ‘আল-মুহলিকাত’ – ধ্বংসকারী বিষয়াদি। কেননা এগুলোই তাসাউফের দৃষ্টিতে ইহকাল পরকাল সর্বত্র ব্যাপক ধ্বংস বিপর্যয় ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ।
আমরা যখন হারাম জিনিসসমূহের কথা বলি, তখন আমরা শুধু ইতিবাচক হারামসমূহই বোঝাতে চাই। কেননা হারাম দু’প্রকারের। একটি হচ্ছে অন্যায় কাজ করা। এগুলো নেতিবাচক। এ দ্বিতীয় প্রকারের বিষয়াদি মূলত এ গ্রন্থের আলোচ্য নয়। প্রসঙ্গত কখনও উল্লেখ হওয়া ভিন্ন কথা। সে বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদেরকে ভিন্নতর বিষয়ের দিকে চলে যেতে হতো। তখন আল্লাহ্ যত কর্তব্যের কথা বলেছেন, সেই সব বিষয়েরও উল্লেখ করার প্রয়োজন দেখা দিত। কেননা তা পরিহার কিংবা উপেক্ষা করা নিঃসন্দেহে হারাম। যেমন ইলম হাসিল করা প্রত্যেক মুসলিমেরই কর্তব্য। আর মসলমানকে মুর্খতার মধ্যে ফেলে রাখা হলে তার পক্ষে হারামের মধ্যে পড়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। আর নামায-রোযা-যাকাত-হজ্জ প্রভৃতি ফরয ইবাদতসমূহ ইমলামের প্রাথমিক পর্যায়ের রুকন। বিনা ওযরে তা ত্যাগ করা কোন মুসলমানের জন্যেই জায়েয নয়। তা সত্ত্বেও যদি কেউ তা তরক করে, তাহলে সে কবীরা গুনাহ করে। আর যে লোক সেগুলোর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে, সেসবকে ফরয বলে স্বীকার না করে, সে ইসলামের রুজ্জু নিজের গলদেশ থেকে খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে।
উম্মতের নিজের প্রতিরক্ষা এবং তার শত্রুকে ভীত শংকিত করে দেয়ার জন্যে যতটা সম্ভব শক্তি-সামর্থ্য অর্জন সমগ্র জাতির একটি অতিবড় ইসলামী কর্তব্য। বিশেষ করে জাতির দায়িত্বশীল রাষ্ট্রপ্রধানের এ কর্তব্য সর্বোপরি। এ কর্তব্য পালিত না হলে- উপেক্ষিত হলে একটা বড় হারাম- বড় অপরাধ করা হবে। জীবনের বিশেষ ও সাধারণ- সবগুলো কর্তব্য সম্পর্কেই এ কথা।
আমরা এ গ্রন্থে হালাল-হারাম পর্যায়ের ছোট বড় সবগুলো জরুরী বিষয়েই আলোচনা করেছে, এমন দিবি আমরা করছি না। তবে এ গ্রন্থে এমনভাবে আলোচনা করেছি, যার আলোকে মুসলিম মাত্রই বুঝতে পারবেন, তার জন্যে হালাল কি হারাম কি- তার ব্যক্তিগত জীবনে ও সামষ্টিক পর্যায়ে। সাধারণ মানুষ যেসব হালাল হারামের মৌল কার্যকরণ ও যুক্তি সম্পর্কে আদৌ কিছু জানে না, সেই পর্যায়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দেয়া হয়েছে, আমরা মনে করি এ গ্রন্থ তাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট।
আমি মনে করি, ইসলামের ঘোষিত হালাল হরামের মূলে যে নিবিড় গভীর কার্যকারণ নিহিত রয়েছে, এ গ্রন্থে সেই পর্যায়ে অনেক জরুরী কথাই বলা হয়েছে। এ থেকে দৃষ্টিমান প্রত্যেক ব্যক্তিই স্পষ্ট বুঝতে পারবেন যে, আল্লাহ যা হালাল করেছেন তার দ্বারা লোকদের লাঞ্ছিত করতে চেয়েছেন এবং যা হারাম করেছেন তার দ্বারা তাদের জীবনকে সংকীর্ণ করে দিয়েছেন, এমন কথা মনে করা কিছুতেই উচিত হতে পারে না। আসলে এটা সম্পূর্ণত আল্লাহর বিধান এবং তিনি মানুষের জন্যে যা কিছু কল্যাণকর মনে করেছেন, তারই ভিত্তিতে এ বিধান দান করেছেন। এর দ্বারা তিনি তাদের দ্বীনকে রক্ষা করেছেন, তাদের বৈষয়িক জীবনকেও সুন্দর করে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেছেন। তার দ্বারা তাদের মন, বিবেক-বুদ্ধি, চরিত্র, তাদের ইজ্জত-আবরু ও ধনমাল সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছেন। ব্যক্তি ও সমষ্টি উভয় দিক দিয়েই মানবতার উন্নয়ন ও অগ্রগতির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
একটি বিষয় সর্বদা স্মরণীয়। মানবীয় আইন প্রণয়ন মানবীয় দুর্বলতার প্রতীক ও প্রতিচ্ছবি। তা হয় অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ। এ আইনের রচয়িতা ব্যক্তি হোক, সরকার হোক বা পার্লামেন্টই হোক, নিছক বৈষয়িক ও বস্তুগত কল্যাণের দৃষ্টিতেই আইন রচনা করে। কিন্তু দ্বীনের দাবি-দাওয়া ও চরিত্র-নৈতিকতার তাগিদ প্রভৃতির দিকে তখন তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় না। মানুষ সব সময়ই তার দেশমাতৃকা ও ভৌগোলিক জাতীয়তার সংকীর্ণ পরিবেষ্টনীর মধ্যে থেকে চিন্তা করে। বিশাল মানবতা ও বৃহত্তর পৃথিবীর উদার উন্মুক্ত পরিবেশে চিন্তা করা ও সেই প্রেক্ষিতে আইন রচনা করার ক্ষমতা মানুষের নেই।
মানুষ আইন রচনা করে উপস্থিত সমস্যা সমাধানের জন্যে, আজকের জন্যে, আগামীকালের-ভবিষ্যতের অনন্তকালের প্রয়োজন পূরণের জন্যে আইন রচনা করা মানুষের সাধ্যাতীত। সর্বোপরি মানুষ মানবীয় দুর্বলতায় সংকীর্ণতায় ভরপুর। তার অক্ষমতা, দৃষ্টি সংকীর্ণতা নিজস্ব স্পৃহা ঝোঁক-প্রবণতার স্পষ্ট ছাপ থাকতে বাধ্য মানুষের রচিত আইনে।
ফলে মানবীয় আইন যেমন সংকীর্ণ পরিবেশ সমন্বিত, তেমনি স্থুল দৃষ্টিসম্পন্ন বস্তুগত ও সাময়িক ভাবধারায় ভারাক্রান্ত। লক্ষণীয় যে, মানবীয় আইনে হালাল-হারাম নির্ধারণ হয় তাদের নিজস্ব কামনা-বাসনার দৃষ্টিতে, জনমতকে শান্ত ও তৃপ্ত করাই থাকে তাদের লক্ষ্য। তাতে কঠিন বিপদ আসতে পারে এবং বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, তা দেখে এবং বুঝেও সেই আইন রচনায় প্রবৃত্ত হয়। আমেরিকায় মদ্যপান নিষিদ্ধ আইন বাতিল করে মদ্যপান আইনসম্মত হওয়ার আইন পাশ হওয়ার ঘটনাটিই এ পর্যায়ে উপযুক্ত দৃষ্টান্তরূপে উল্লেখ করা যথেষ্ট। কিন্তু ইসলামী আইন প্রণয়নের মূলে এসব দোষত্রুটি অক্ষমতা ও সংকীর্ণতার কোনই স্থান নেই।
ইসলামী আইন মহান সৃষ্টিকর্তা রচিত আইন। সৃষ্টিকর্তা সব বিষয়ে পূর্ণ ও পুংখানুপুংখ অবহিত। মানুষের প্রকৃত কল্যাণ কিসে, তারা কিভাবে কল্যাণকর হতে পারে তাদের নিজেদের ও গোটা সৃষ্টিলোকের জন্যে তা সৃষ্টিকর্তাই ভালভাবে জানেন। তিনিই বলেছেনঃ ( আরবি*******************)
আল্লাহই জানেন বিপর্যয়কারী- বিধ্বংসী কি এবং কল্যাণকর কি।
সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টি সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে অবহিত হওয়াই তো স্বাভাবিক।
( আরবি*******************) জেনে রাখ, সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে অবহিত।
ইসলামী আইন মহাজ্ঞানী মহাবিজ্ঞানী আল্লাহর রচিত। তিনি নিরর্থকভাবে কোন কিছু হারাম করেন না, অনিয়মিতভাবে কোন কিছু হালাল করেন না। প্রতিটি জিনিসই তিনি পরিমিত মাত্রায় সৃষ্টি করেছেন, তুলাদণ্ডে ওজন করে করে তিনি তাঁর বিধান রচনা করেছেন।
মহা দয়াবান লালন পালনকারী আল্লাহর রচিত আইনই হচ্ছে ইসলামী আইন। এ আইন দ্বারা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্যে সহজ সুন্দর জীবন-ধারার ব্যবস্থা করেছেন। মানুষকে কোনরূপ কষ্টদান বা অসুবিধায় ফেলার তাঁর কোন ইচ্ছাই থাকতে পারে না। তিনি তো তাঁর সৃষ্টি মানুষের প্রতি পিতামাতার তুলনায়ও অধিক- আধিক মাত্রায় দয়াবান।
মহাশক্তিমান বাদশাহর রচিত ইসলামী আইন। তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি মুখাপেক্ষী নন, নির্ভরশীল নন, তিনি কারো পক্ষপাতী নন, না কোন গোষ্ঠীর, জাতির, বংশের, সীমাবদ্ধও নন কোন কিছুতেই। অন্যদের জন্যে হালাল-হারামের বিধান করার যোগ্যাতা তাঁরই থাকতে পারে। কেননা তিনিই সবকিছুর রাব্বুল আলামীন।
মুসলমানদের জন্যে হালাল ও হারামের যে বিধান করা হয়েছে, যে বিষয়ে মুসলিম মাত্রেই আকীদা এই। এ আকীদা পুরাপুরি যুক্তিসঙ্গত, বিবেকসম্মত। মুসলমান পূর্ণ সন্তুষ্টি ও প্রত্যয় সহকারেই তা কুবল করে। এ বিধান কার্যকর করার পূর্ণ ইচ্ছা ও সংকল্প থাকা বাঞ্ছনীয়। মুসলমানের ঈমান হচ্ছে, দুনিয়ায় তার সৌভাগ্য এবং পরকালীন মুক্তি ও সাফল্য আল্লাহর আদেশ-নিষেধ নির্ধারিত সীমাসমূহ যথাযথভাবে রক্ষা ও পালন করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে একান্তভাবে।
এ কারণে তার সর্ব প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, সেই সীমা- হালাল-হারামসমূহই যথার্থভাবে জানা। তা জানলে ও ঠিকভাবে পালন করলেই উভয় জগতের কল্যাণ, সৌভাগ্য এবং সাফল্য লাভ করা সম্ভব।
এ কথাটির ব্যাখ্যার জন্যে প্রাথমিক কালের মুসলিম জীবনের দুটি দৃষ্টান্ত এখানে পেশ করতে চাই। তাঁরা কি ভাবে আল্লাহর হালাল-হারাম নির্ধারিত সীমা রক্ষা করতে ও আল্লাহর বিধানকে কার্যকর করতে প্রাণপণে চেষ্টা করতেন ও তাতে প্রতিযোগিতা করতেন, তা স্পষ্টভাবে জানা যাবে।
একটি দৃষ্টান্তের কথা আমরা ইতিপূর্বে মদ্যপান হারাম করণ পর্যায়ে উল্লেখ করে এসেছি। আরবরা ছিল মদ্যপানের জন্যে পাগল। মদ্য প্রীতি ছিল তাদের মজ্জাগত। সে জন্যে তারা বিশেষ পানপত্র ও বিশেষ পান-মজলিসের ব্যবস্থা করত। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের এ অবস্থা ভালভাবেই জানতেন। এ কারণে হারাম করণে তিনি ক্রমিক রীতি অবলম্বন করলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি চূড়ান্তভাবে হারাম করার ঘোষণা দিলেন। বললেনঃ ( আরবি*******************)
শয়তানী কাজের চরম কদর্যতা, অতএব তা পরিহার কর।
এ কারণে নবী করীম (সা) তা পান করা, বিক্রয় করা ও অমুসলমাদের জন্যে হাদিয়া হিসেবে দেয়া হারাম বলে ঘোষণা করলেন। এ সময় মুসলদমানদের কাছে প্রচুর পরিমাণ মদ্য ও পাত্র ছিল। তারা এ নিষেধ শোনামাত্রই মদীনার অলিতে গলিতে মদের স্রোত প্রবাহিত করলেন ও চিরদিনের তরে ত্যাগ করলেন।
শরীয়তের বিধান পালনের জন্যে তাদের মধ্যে একটা প্রবল আনুগত্যপূর্ণ ভাবধারার অপূর্ব নিদর্শন লক্ষ্য করা গেছে। নিষেধ ঘোষণা শ্রবণের সময় কারো হাতে মদ্যভর্তি পাত্র ছিল। তার কিছু অংশ পান করেছিল, কিছু অংশ তখনও পান করার জন্যে অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু তবুও নিষেধ ঘোষণা শোনার সাথে সাথে তা দূরে নিক্ষেপ করলেন। আল্লাহর জিজ্ঞাসাঃ ( আরবি*******************) – তোমরা কি তা থেকে বিরত হবে?
এব জবাবে তারা কার্যত বললেনঃ হ্যাঁ আল্লাহ্ আমরা বিরত হয়ে গেলাম।
ইসলামী সমাজে মদ্যপানের বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম এবং তার ওপর চূড়ান্ত ফয়সালার ইতিহাসকে যদি আমেরিকার মদ্যপান নিষিদ্ধকরণের ঘটনার সাথে তুলনা করা যায়, তাহলে স্পষ্ট প্রমাণিত হবে যে, আল্লাহর আইন ছাড়া মানব-প্রকৃতির সাথে আর কোনটিরই কোন সামঞ্জস্য নেই। সেই আইনেই মানব-মনের স্বস্তি ও স্থিতি লাভ সম্ভব। শক্তি ও আধিপত্য কর্তৃত্ব ছাড়া শুধু ঈমানই এ ব্যাপারে অধিকতর সফল হাতিয়ার- তা বুঝাতে একটুও কষ্ট হয় না।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি হচ্ছে, প্রাথমিক কালের মুসলিম মহিলাদের পর্দা পালনের জন্যে প্রস্তুত হওয়া। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের ওপর জাহিলিয়াতের যুগের ন্যায় উচ্ছৃঙ্খলতা ও অবাধে চলাফেরা হারাম করে দিলেন। আত্মমর্যাদা রক্ষা ও দেহাবয়ব আবৃত করে চলাফেরা করা তাদের জন্যে ফরয করা হয় অথচ জাহিলিয়তের যুগে মেয়েরা বক্ষ উন্মুক্ত করে ঘরের বাইরে চলাফেরা করত। দেহের কোন অঙ্গই তারা আবৃত করত না। গলা-গ্রীবা খোলাই থাকত। চুল পিছনের দিকে পিঠের ওপর মেঘের মতোই ভেসে থাকত, কর্ণে স্বর্ণদ্যুতি চিকচিক করত। আল্লাহ্ তা’আলা এভাবে চলাফেরা করাকে হারাম ঘোষণা করলেন। তাদের সেকালের থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর নীতি অনুসরণ করতে হবে। জাহিলিয়াতকে অনুসরণ-অনুকরণ করা বন্ধ করতে হবে। নিজেদের দেহাবয়ব পূর্ণ মাত্রায় আবৃত করেই চলতে হবে। বক্ষের ওপর আচল বা দোপট্টা চেপে রাখতে হবে। মাথায়ও কাপড় রাখতে হবে। মুহাজির ও আনসার ঘরের মেয়েরা আল্লাহর এ আইন কিভাবে সম্বর্ধনা জানালেন এবং ইসলামী সমাজে তা নির্বিঘ্নে ও দ্রুততার সাথে কিভাবে কার্যকর করলেন, হযরত আয়েশা (রা) তা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর এই আইন ও আদেশ নারী জীবনে মৌলিক পরিবর্তনের দাবি নিয়ে এসেছিল। আর তার প্রভাব পড়েছিল তাদের রূপ-শোভা ও সৌন্দর্যের ওপর। হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ প্রাথমিক কালের মুহাজির মেয়েদের প্রতি আল্লাহ্ রহমত বর্ষণ করুন। কুরআনের আয়াতঃ ( আরবি***************) – তারা যেন তাদের আচল তাদের কাঁধে ও বক্ষের ওপর শক্ত করে বেঁধে নেয়। যখন নাযিল হল তখন দেখা গেল, তারা গায়ের চাদর দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে নিল। (বুখারী)
একদিন কতিপয় মহিলা তাঁর কাছে বসেছিলেন। তখন কুরাইশ বংশের মহিলাদের এবং তাদের মান-মর্যাদার বিষয়ে আলোচনা হলো। তখন তিনি বললেনঃ কুরাইশ-বংশের মহিলাদের মর্যাদা তো আছেই। তবে আমি আল্লাহর কসম, আনসার বংশের মহিলাদের চাইতে উত্তম কোথাও দেখিনি। তাঁরা আল্লাহর কিতাব বাস্তবায়িত করেছেন এবং যা কিছু নাযিল হতো তার প্রতি তাঁরা সাথে সাথেই ঈমান আনতেন। সূরা নূর-এর উপরিউক্ত আয়াত নাযিল হওয়র পর তাদের পুরুষরা সে আয়াতটি তাদের কাছে পড়ে শোনালেন। প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্ত্রী-কন্যা ও বোনকে শোনালেন। এখানে প্রত্যেক পুরুষই তাঁর নিকটাত্মীয়া মহিলাকে আল্লাহর এ হুকুম জানালেন। তখন আনসার বংশের প্রতিটি মহিলা নিজের ছবি খচিত ও চাকচিক্যপূর্ণ দোপাট্টা শক্ত করে নিজের মাথায় বেঁধে নিলেন। এভাবে তাঁরা আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়িত করলেন এবং পরের দিন ফজরের নামাযে যত মহিলা শরীক হয়েছেলেন, তাঁরা সকলেই দোপাট্টা দিয়ে শক্ত করে মাথা আবৃত করেছিলেন।
আল্লাহর বিধানের প্রতি মুমিন মহিলাদের আচরণ ছিল এরূপ। তাঁরা অনতিবিলম্বে আল্লাহর হুকুম পালনে তৎপর হতেন। যা করতে নিষেদ করা হতো, পরিত্যাগ করতেন; এতে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ বা ইতস্তত ভাব পর্যন্ত দেখা যেত না। এজন্যে তাঁরা অপেক্ষাও করতেন না, অনুসরণ বিলম্বিত করতেন না। একদিন বা দুইদিন বা ততোধিক সময় অতিবাহন করতেন না এই বলে যে, আচ্ছা, পরে নতুন কাপড় কিনে তদনুযায়ী পরা হবে। বরং ঠিক তখনই যে কাপড় তাদের ছিল, যে বর্ণের বা রঙের কাপড় পাওয়া গেল, তাকেই তাঁরা আল্লাহর হুকুম পালনে ব্যবহার করলেন। তেমন কাপড় পাওয়া না গেলে যে কাপড় আছে, তাই ছিড়ে মাথার ওপর শক্ত করে বাঁধলেন।
এ পর্যায়ে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে হালাল-হারাম শুধু জানলে বুঝলেই চলবে না। প্রকৃতপক্ষে হালাল-হারাম সুস্পষ্ট ব্যাপার- তার কোন কিছুই কোন মুসলমানের অজানা নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও বহু মুসলমানই হারামের আবর্তে পড়ে যায়। আর তার পরিণতিতে জাহান্নামের ইন্ধন হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে সব দেখে-শুনে ও জেনে বুঝেও।
আসলে প্রয়োজন হচ্ছে তাকওয়ার- আল্লাহর ভয় অন্তরের মধ্যে থাকা। এ তাকওয়াই হচ্ছে আল্লাহর শরীয়ত পালনের মৌখিক চালিকাশক্তি। আর আজকের ভাষায় বলতে গেলে প্রয়োজন হচ্ছে জীবন্ত মন-মানসিকতার। তা-ই মুসলিমকে হালালের সীমার মধ্যে ঠেকিয়ে রাখতে পারে এবং হারাম কাজ করা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম। আর এ ধরনের মন-মানসিকতা কেবলমাত্র আল্লাহর ও পরকালের প্রতি ঈমানের প্রশিক্ষণ দ্বারাই হতে পারে।
তখন একদিকে যদি মুসলমান দ্বীন ও শরীয়তের সীমাসমূহ সম্পর্কে অবগতি প্রবল হয় এবং অপরদিকে জাগ্রত মন-মানসিকতা ও সীমাসমীহের পাহারাদারী করে- তা অতিক্রম করতে বা তার কাছেও পৌঁছতে না দেয়, তাহলেই তার জন্যে সামগ্রিক কল্যাণেরই দ্বার উন্মুক্ত হতে পারে। নবী করীম (সা) সত্যিই বলেছেনঃ ( আরবি*******************)
আল্লাহ্ যখন কোন ব্যাক্তির কল্যাণ চাহেন, তখন তার নিজের মধ্যেই তার জন্যে একজন উপদেশদাতা সৃষ্টি করেন।
( আরবি*******************)
হে আল্লাহ্! আমাদের বাঁচাও তোমার হালাল দ্বারা তোমার হারাম থেকে, তোমার আনুগত্য দ্বারা তোমার নাফরমানী থেকে, তোমান অনুগ্রহ দ্বারা- তুমি ছাড়া অন্য সব কিছু থাকে।
— সমাপ্ত —