দ্বিতীয় অধ্যায়
মুসলিমের ব্যক্তিগত জীবনে হালাল–হারাম
– খাদ্য ও পানীয়
– পোশাক ও অলংকার–সৌন্দর্য
– ঘর–বাড়ি
– উপার্জন ও পেশা
মুসলিমের ব্যক্তিগত জীবনে হালাল–হারাম
খাদ্য ও পানীয়- বিশেষ করে পশুকুলের মধ্য থেকে খাদ্য গ্রহণ ব্যাপারে প্রাচীনতম কাল থেকেই জাতিসমূহের মধ্যে মতবিরোধ বা মতপার্থক্য চলে এসেছে। কোন্ কোন্ জিনিস জায়েয ও বৈধ এবং কোন্ কোন্ জিনিস নয়, এই নিয়েই মতবিরোধ দানা বেঁধে উঠেছে।
উদ্ভিজ খাদ্য ও পানীয়র ক্ষেত্রে মতবিরোধ খুব বেশি এবং ব্যাপক নয়। ইসলাম মদ্যপান হারাম করে দিয়েছে, তা আঙ্গুর দিয়ে বানান হোক, বা খেজুর, যব কিংবা অন্যকিছু দিয়ে। অনুরূপভাবে যেসব জিনিস মানুষের বিবেক-বুদ্ধি বিকৃত করে দেয় অথবা কোনরূপ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে, আর যা স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর তা সবই হারাম।
তবে পশু জাতীয় খাদ্যের ব্যাপারে দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মধ্যে তীব্র মতবিরোধ রয়েছে।
ব্রাহ্মণদের দৃষ্টিতে পশু যবাই করা ও খাওয়া
ব্রাহ্মণ ইত্যাদি ধর্মবিশ্বাসী ও কোন কোন দার্শনিক মতাবলম্বীদের দৃষ্টিতে পশু যবাই করা ও খাওয়া তাদের নিজেদের জন্যে হারাম। উদ্ভিদ বা শাক-সব্জিই তাদের একমাত্র খাদ্য। কেননা তাদের মতে পশু যবাই করা নিতান্তই মর্মান্তিক ও নির্দয়তার কাজ। ওদেরও বাঁচার অধিকার আছে এবং সে অধিকার থেকে বঞ্ছিত করা যেতে পারে না।
কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতির ওপর দৃষ্টিপাত করলে ও গভীর সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে, পশু যবাই করা একান্তই নির্দোষ কাজ। কেননা দুনিয়ার এসব জন্তু-জানোয়ার কোন নিজস্ব স্বতন্ত্র উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি নয়। ওদের বুদ্ধি-বিবেক ও নিজস্ব ইচ্ছা ও বাছাই করার শক্তি বলতে কিছু নেই। ওদের স্বাভাবিক দেহ সংস্থা স্বতঃই প্রমাণ করে যে, ওরা মূলত মানুষের খেদমতের কাজ সুসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট ও নিয়োজিত। মানুষ ওগুলোকে নিয়ন্ত্রণে এনে অনেক কার্য সম্পাদন করে। অনুরূপভাবে ওদের যবাই করে ওদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হলে তাতে আপত্তির কিছুই থাকতে পারে না। সৃষ্টিলোকে সদা কার্যকর আল্লাহ্র প্রদত্ত নিয়ম হচ্ছে, নিকৃষ্ট ও নীচ সৃষ্টি উত্তম ও উচ্চতর সৃষ্টির জন্য আত্মাহুতি দিচ্ছে। অনুরূপই জন্তু-জানোয়ার মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে নিরন্তন। অনুরূপই জন্তু-জানোয়ার মানুষের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মানব সমষ্টির নিরাপত্তার জন্যে ব্যক্তিকে হত্যা করা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে রয়েছে। মানুষের জন্য পশু যবাই করা না হলে ওরা যে মৃত্যু ও ধ্বংস থেকে রক্ষা পেতে পারছে, এমন তো নয়। অন্যান্য অধিক শক্তিশালী হিংস্র জন্তু-দানব কর্তৃক ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে ওদের খাদ্যে পরিণত হওয়া তো অবধারিত। অথবা ওরা স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হবে। আর তা ওদের গলদেশে শানিত অস্ত্র চালিয়ে যবেহ করার তুলনায় অধিক কষ্টদায়ক হওয়া নিশ্চিত।
ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের দৃষ্টিতে হারাম জন্তু
আসমানী কিতাবে বিশ্বাসীদের মধ্যে ইয়াহুদীদের প্রতি স্থল ও জলভাগের বহু জন্তু-জানোয়ারকে হারাম করে দেয়া হয়েছে। পুরাতন নিয়ম-এর লাভী পরিভ্রমণের একাদশ অধ্যায়ে তার বিস্তারিত বিবরণ উদ্ধৃত হয়েছে। এই পর্যায়ে কিছু কিছু কথা কুরআন মজীদেও উল্লেখ করা হয়েছে। ইয়াহূদীদের প্রতি যা যা হারাম করা হয়েছিল, তা এ থেকে জানা যায়। আর এই হারামকরণ কেবল যে তাদের নিজেদের জুলুম ও বিদ্রোহমূলক কার্যকলাপের কারণে শাস্তিদানের উদ্দেশ্যেই হয়েছিল, তা স্পষ্ট করেই বলে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ
وَعَلَى الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا كُلَّ ذِي ظُفُرٍ ۖ وَمِنَ الْبَقَرِ وَالْغَنَمِ حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ شُحُومَهُمَا إِلَّا مَا حَمَلَتْ ظُهُورُهُمَا أَوِ الْحَوَايَا أَوْ مَا اخْتَلَطَ بِعَظْمٍ ۚ ذَٰلِكَ جَزَيْنَاهُم بِبَغْيِهِمْ ۖ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ
আর যারা ইয়াহুদী হয়েছে তাদের প্রতি আমরা সব নখ্ধারী জন্তু হারাম করে দিয়েছিলাম। আর গরু ও ছাগলের চর্বিও- ওদের পৃষ্ঠ ও অন্ত্রের সাথে কিংবা অস্থির সাথে জড়িত, তা ছাড়া এ কাজটি করা হয়েছে তাদের আল্লাহ বিরোধী শাস্তিস্বরূপ। আর তা করায় আমি যথার্থ ভূমিকা গ্রহণকারী নিঃসন্দেহে। (সূরা আন’আমঃ ১৪৬)
এ হচ্ছে ইয়াহুদীদের সম্পর্কিত ব্যাপার। খ্রিস্টানদের ব্যাপারটি অনুরূপই বটে। কেননা এক্ষেত্রে তারা ইয়াহুদীদেরই অধীন। কেননা ইনজিল এ নির্দেশকে নাকচ করে দেয়নি। বরং ঘোষণা করেছেঃ ‘ঈসা মসীহ পূর্ববর্তী শরীয়ত নাকচ করা রজন্য আসেন নি। বরং এসেছে তাকে পূর্ণত্ব দানের জন্যে। কিন্তু খ্রিস্টানরা নিজেরাই শরীয়তের বিধি লংঘন করেছে এবং তওরাতে তাদের প্রতি যা যা হারাম করা হয়েছিল সে সবকেই তারা হালাল বানিয়ে নিয়েছে। খাদ্য-পানীর ব্যাপারে তারা পবিত্র ‘পোলস’- এর বিধি বিধান পালন করে এবং দেবতা মূর্তির জন্যে উৎসর্গীকৃত জন্তু ছাড়া আর সব কিছুকেই তারা হালাল ঘোষণা করল। পোলস্ তার কারণ দর্শিয়ে বলেছে, ‘পবিত্র লোকদের জন্য সব কিছুই পবিত্র। আর যা কিছুই মুখের মধ্যে চলে যায়, তা অপবিত্র করে না। বরং যা মুখ থেকে নির্গত হয়, তাই নাপাক করে দেয়।’ এ যুক্তির ভিত্তিতেই তারা শূকরের গোশ্তও জায়েয করে নিল অথচ তওরাতে কিতাবের সুস্পষ্ট ঘোষণুযায়ী তা আজ পর্যন্ত তাদের জন্যে সম্পূর্ণ হারাম হয়ে রয়েছে।
ইসলাম পূর্ব যুগের আরবদের অবস্থা
ইসলামের আগমণের পূর্বে জাহিলিয়াতের যুগে আরব সমাজ কোন কোন জন্তুকে নাপাক মনে করে এবং কোন কোনটিকে দেবদেবীর নৈকট্য লাভ ও কুসংস্কার অনুসরণের দরুন নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছিল। বহীরা, সায়েবা, অসীলা ও হাম প্রভৃতি এ পর্যায়ে হারাম জন্তু-পূর্বে এর ব্যাখ্যঅ দেয়া হয়েছে। আর তার বিপরীত মৃত জীব এ বহমান রক্ত প্রভৃতি অনেক নাপাক জিনিসই জায়েয ও হালাল ঘোষণা করেছিল।
ইসলাম পবিত্র জিনিসগুলো মুবাহ করেছে
ইসলাম আগমনকালে আরব দেশের লোকেরা পাশব খাদ্যের ব্যাপারে পূর্ববর্তিরূপে নানাভাবে বিপরীত চিন্তায় জর্জরিত ছিল। এ কারণে সমগ্র মানুষকে সম্বোধন করে ইসলাম বলেছেঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
হে জনগণ, জমিনে যে সব জিনিস হালাল পবিত্র তা ভক্ষণ কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। কেননা শয়তান তোমাদের জন্যে প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারাঃ ১৬৮)
অন্য কথায়, ইসলাম সর্বসাধাণেকে নির্বিশেষে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘হে লোকেরা তোমরা পৃথিবীর এ বিশাল-বিস্তীর্ণ দস্তুরখানা থেকে পবিত্র উৎকৃষ্ট জিনিসগুলো খাদ্য হিসেবে গ্রহণ কর। আর শয়তানের দেখানে পথে আদৌ চলবে না’। অর্থাৎ আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তাকে হারাম গণ্য করে বিভ্রান্তির গভীর গহ্বরে নিপতিত হবে না। অতঃপর মুমিনদের প্রতি বিশেষভাবে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ
……………… আরবী ……………
হে ঈমানদার লোকেরা! আমরা তোমাদেরকে যেসব পবিত্র জিনিস রিযিক স্বরূপ দিয়েছি তোমরা তা খাও ও আল্লাহ্র শোকর কর যদি তোমরা বিশেষ ও একান্তভাবে তাঁরই বন্দেগী করতে প্রস্তুত হয়ে থাক। তিনি তো তোমাদের জন্যে শুধু মৃত বস্তু, রক্ত ও শূকরের গোশ্ত এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নামে জবেহ দেয়া জন্তু হারাম করে দিয়েছেন। তবে যে কেউ চরমভাবে ঠেকায় পড়ে যায়- কিন্তু সে তার জন্যে ইচ্ছুকও নয়, তার পক্ষে তা ভক্ষণ করায় কোন গুনাহ হবে না। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, দয়াবান।
এই বিশেষভাবে সম্বোধন করে বলা কথার দ্বারা আল্লাহ্ ঈমানদার লোকদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন পবিত্র উৎকৃষ্ট আহার করে। সেই সঙ্গে দয়াবান দাতার যেন তারা শোকর আদায় করে, তাঁর নিয়ামতের দানসমূহের মর্যাদা রক্ষা করে হক্ আদায় করে। তারপর বলা হয়েছে, আয়াতটিতে যে চার ধরণের জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে, সে কয়টি ছাড়া অন্য কোন জিনিসই আল্লাহ্ হারাম করেন নি। বলা হয়েছেঃ
قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَن يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَّسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ رَبَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
বল, আমার প্রতি যে ওহী নাযিল হয়েছে তাতে তো কোন আহারকারীর প্রতি কোন জিনিস হারাম বলে চিহ্নিত হতে দেখি না- মৃত জন্তু, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের গোশত অথবা আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারোর উদ্দেশ্যে বলি দেয়া জন্তু ব্যতীত। কেউ যদি ঠেকায় পড়ে এসব থেকে কিছু আহার করে- আগ্রহী ইচ্ছুক বা প্রয়োজনের সীমালংঘনকারী না হয়ে তাহলে তোমার আল্লাহ্ নিশ্চয়ই ক্ষমাশীল দয়াবান। (সূরা আন’আমঃ ১৪৫)
সূরা আল–মায়িদায় এসব হারাম জিনিসের বিবরণ পেশ করার পর বলা হয়েছেঃ
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ
তোমাদের প্রতি মৃত জীব, রক্ত, শূকরের মাংস, যা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য দেবদেবীর জন্যে উৎসর্গীকৃত হয়েছে, যা গলায় ফাঁস লেগে মরেছে, যা আঘাত পেয়ে মরেছে, যা উপর থেকে পড়ে গিয়ে মরেছে, যা শিং-এর গুতা খেয়ে মরেছে, যা কোন হিংস্র জন্তু কর্তৃক ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে, যা তোমরা যবেহ করতে পেরেছ তা ব্যতীত আর যা কোন দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হয়েছে। (সূরা আল মায়েদাঃ ৩)
এ আয়াতে দশটি হারাম জন্তুর উল্লেখ করা হয়েছে। তার পূর্ববর্তী আয়াতে মাত্র পাঁচটি হারাম জিনিসের উল্লেখ ছিল। তাই এ দুয়ের মাঝে কোন বৈপরীত্য নেই। বরং একটি আয়াত অপর আয়াতের ব্যাখ্যা বিশেষ। কেননা গলায় ফাঁস লেগে, আঘাত পেয়ে, ওপর থেকে পড়ে গিয়ে, শিং- এর গুতায় হিংস্র জন্তু কর্তৃক ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে মৃত- এ সব জন্তুই আসলে মৃত, মৃতেরই বিভিন্ন রূপ মাত্র। দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেয়া জন্তুও অ-আল্লাহ্র নামে যবেহ করা জন্তুর পর্যায়ে গণ্য। ফলে প্রকৃত পক্ষে চার প্রকারের জন্তুই হারাম।
মৃত জন্তুর হারাম হওয়ার কারণসমূহ
কুরআনের যেসব আয়াতে হারাম খাদ্যসমূহ উল্লেখ রয়েছে তন্মধ্যে সর্বত্র প্রথম উল্লেখিত হয়েছে আল-মায়তা-তা’র। অর্থাৎ সে জন্তু ও পাখি যা স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছে। অন্য কথায় যে জীব বা পাখির মৃত্যু যবেহ বা শিকার করার ফলে সঙ্ঘটিত হয়নি।
কিন্তু এ জন্তু খদ্য হিসেবে ব্যবহার করতে নিষেধ ও হারাম করার এবং সেটিকে নিষ্ফল ও বিনষ্ট হতে দেয়ার মূলে কি কারণ থাকতে পারে, এ হচ্ছে আধুনিক মন মানসের জিজ্ঞাস্য। উত্তরে বলতে চাই, মৃত জন্তু ও পাখি হারাম হওয়ার ও তাকে বিনষ্ট হয়ে যেতে দেয়ার মূলে কতগুলো কল্যাণমূলক কারণ নিহিত রয়েছেঃ
ক. সুস্থ মানব প্রকৃতি মৃত জীব ঘৃণা করে। বিবেকবান মানুষ মুর্দার খাওয়াকে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ বলে মনে করে। তা মানুষের জন্যে নিতান্তই অশোভন ও হীন কাজ বলে বিশ্বাস করে। এ কারণেই সমস্ত আসমানী গ্রন্থে ও ধর্মে মুর্দার খাওয়াকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে ও সর্বত্র জবেহ করা জন্তু খাওয়াকে পছন্দ করা হয়েছে। যবেহ করার পদ্ধতি ও নিয়ম যতই বিভিন্ন হোক না কেন।
খ. মানুষ যা লাভ করার ইচ্ছা করেনি, মনে কামনাও জাগেনি, তা সে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করুক, সেটা আল্লাহ্র পছন্দ নয়। মুর্দারের অবস্থা ঠিক তেমনই। তবে যে জন্তু যবেহ করা হয় কিংবা যা শিকার করা হয়, তাতে মানুষের সংকল্প ও চেষ্টা-যত্নের কোন অংশ শামিল থাকে বলে তা পছন্দনীয় হয়ে থাকে।
গ. যে জন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছে, তার সম্পর্কে আশংকা থাকে, হতে পারে সেটি চিরন্তন রোগাক্রান্ত বা কোন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কিংবা বিষাক্ত ঘাস বা উদ্ভিদ খেয়ে মরেছে। আর তাহলে তা খাওয়ার দরুন বিরাট ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। অথবা হতে পারে তা খুব বেশি দুর্বল বা স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার দরুন সেটি মরেছে।
ঘ. মানুষের জন্যে মুর্দার হারাম করে আল্লাহ তা’আলা পশু-পাখিগুলোর জন্য বিশেষ রহমতে খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কেননা সেগুলোও আমাদের ন্যায় আল্লাহ্র সৃষ্টি।
ঙ. আরও একটি দিক হলো এই যে, মানুষ তার মালিকানাধীন জন্তুগুলোকে রোগাক্রান্ত বা দুর্বল হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার জন্যে ফেলে না রাখে। বরং হয় চিকিৎসা করাবে অবিলম্বে কিংবা যবেহ করে চিরশান্তি দান করবে।
প্রবাহিত রক্ত হারাম কেন
হারাম জিনিসগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় স্থান হচ্ছে প্রবাহিত রক্তের। হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিল্লী (প্লীহা) সম্পর্কে শরীয়তের হুকুম কি? তিনি বললেনঃ খেতে পার। লোকেরা বলল, তা তো আসলে জমাট বাধা রক্ত মাত্র? জবাবে বললেন, আল্লাহ্ তা’আলা মাত্র প্রবাহিত রক্ত হারাম করেছেন। কেননা তা অপবিত্র ময়লাযুক্ত, ন্যাক্কারজনক (Filth)। পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ ও সুস্থ মানব প্রকৃতি তা ঘৃণা না করে পারে না। তাছাড়া মৃত জন্তুর ন্যায় তাতেও ক্ষতিকর জীবাণু থাকা খুবই সম্ভব।
জাহিলিয়াতের যুগে কারো তীব্র ক্ষুধা অনুভূত হলে অস্থি বা কোন ধারাল জিনিস উষ্ট্র কিংবা অন্য জন্তুর গাত্রে বসিয়ে দিত। তাতে যে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ত, সে তা সাগ্রহে পান করত। এ ধরণের কাজের ফলে জন্তুগুলো মর্মান্তিক জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করতে বাধ্য হতো। রক্ত বের হয়ে যাওয়ার ফলে সেটার দুর্বল হয়ে পড়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিত। এ সব কারণে আল্লাহ্ তা’আলা প্রবহমান রক্ত হারাম করে দিয়েছেন।
শূকরের গোশত
এ তালিকার তৃতীয় জিনিস হচ্ছে শূকরের গোশত। সুস্থ স্বভাব-প্রকৃতি মাত্রই তা ঘৃণা করে। কেননা তা না-পাক। শূকরের গোশতের প্রতি সুস্থ রুচি কোন মানুষ আকর্ষণ বোধ করতে পারে বলে কল্পনাও করা যায় না। কেননা শূকরের অতি লোভনীয় খাদ্য হয় সব রকমের পায়খানা ও ময়লা-আবর্জনা। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও তা খাওয়া সর্বত্রই বিশেষ করে, গ্রীষ্ম প্রধান দেশে খুবই ক্ষতিকর। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ থেকেও প্রমাণিত হয়েছে যে, শূকরের গোশত আহার করা হলে দেহে এমন এক প্রকারের পোকার সৃষ্টি হয়, যা স্বাস্থ্যকে কুরে কুরে খায়।
{বিজ্ঞানের সর্বশেষ পরীক্ষণে জানা গেছে, শূকর গোশতে এসব জীবাণু জন্মিতে পারেঃ Cysticerus teunicallis, Cysticereus cellulosae Spargamune mousoni, Echinococeus podymorphus, paragonimus weater manall- অনুবাদক}
ভবিষ্যতে তার ক্ষতির আরও অনেক দিক- অনেক কারণ- আবিষ্কৃত হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে শূকরের গোশত সব সময় আহার করলে মানব চরিত্রে নির্লজ্জতা জাগে, আত্মমর্যাদা বোধ শেষ হয়ে যায়।
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্যে উৎসর্গিত জন্তু
চতুর্থ হারাম জন্তু হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া কারো জন্যে উৎসর্গীকৃত জন্তু-জানোয়ার ভক্ষণ করা। তাও হারাম। অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নামে কোন জন্তু যবাই বা বলি দেয়া হলে, তাতে অপর কারো নাম উচ্চারণ করা হলে তা মুসলমান মাত্রের জন্যেই হারাম হয়ে যায়। মূর্তিপূজারীরা তাদের দেবদেবী ও প্রতিমার জন্যে জন্তু-জানোয়ার উৎসর্গ করত বা এখনও করছে। বলি দিত বা যবেহ করত। যেহেতু তা এক আল্লাহ্ ছাড়া দেবদেবীদের জন্যে উৎসর্গীকৃত হয়েছে এবং তা করে সে সবের নৈকট্যলাভ করতে চাওয়া হয়েছে, তার বন্দেগী করতে চাওয়া হয়েছে এবং তা চরম শির্ক- এর কাজ। এ কারণে এক আল্লাহর প্রতি ঈমানদার মানুষ সে সব জন্তু খেতে পারে না। তওহীদী দ্বীনের দৃষ্টিতে তা খাওয়া পরিষ্কার শির্ক। এ কারণেই তা হারাম। তওহীদী আকীদা-বিশ্বাসের পরিবত্রতা সংরক্ষণ এবং শিরক ও বতু-পরস্থি থেকে মানুষকে দূরে রাখা, তার প্রতি মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলাই এর উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তা’আলাই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তার জন্যে পৃথিবীর সব কিছু নিয়ন্ত্রিত করেছেন। জন্তু-জানোয়ারও মানুষের অধীন, মানুষের খিদমতে নিয়োজিত। মানুষের কল্যাণের জন্যে তা যবেহ করা সম্পূর্ণ জায়েয। তবে শর্ত এই যে, যবেহ করার সময় এক আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করতে হবে, বলতে হবেঃ ‘আল্লাহু আকবর’। তাহলে তা থেকে প্রমাণিত হবে যে, একটি জীবন্ত সৃষ্টিকে যবেহ করে তার প্রাণ সংহার করার এই কাজটি করা হচ্ছে সেই আল্লাহ্রই দেয়া অনুমতিক্রমে। কিন্তু যবেহ করার সময় অন্য কারো নাম উচ্চারিত হলে আল্লাহ্র এই অনুমতিকে কার্যত নাকচ করে দেয়া হয়। এ কারণে এই জন্তুটিকে হারাম ঘোষণা করে তা থেকে লোকটিকে দূরে রাখতে চাওয়া হয়েছে।
কয়েক প্রকারের মুর্দার
মোটামুটি এই চারটি জিনিসই মূলত হারাম। তবে সূরা আল–মায়িদায় তার যে কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ এসেছে, সে দৃষ্টিতে তার সংখ্যা দশ হয়ে যায়। অবশিষ্টগুলো এইঃ
৫. মুনখানিকাতুঃ গলায় ফাঁস লেগে মরা জন্তু;
৬. মওকুয়াতুঃ লাঠি বা অন্য কোন শক্ত জিনিসের আঘাতে মরে যাওয়া জন্তু;
৭. মুতারাদ্দিয়াতুঃ উচ্চস্থান থেকে পড়ে গিয়ে বা কূয়া কিংবা খালে পড়ে মরে যাওয়া জন্তু;
৮. নতীহাতুঃ অপর কোন জন্তুর শিং-এর গুঁতায় মরে যাওয়া জন্তু;
৯. হিংস্র জন্তু কর্তৃক ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া জন্তু- যার দেহের কোন অংশ খেয়ে ফেলেছে, আর এ কারণে তার মৃত্যু ঘটেছে; এই পাঁচ প্রকারের জন্তুর উল্লেখ করার পর আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন- এই সবের মধ্য থেকে কোন জন্তুকে জীবিত পেয়ে সেটিকে যবেহ করা হলে তা হারাম নয়; বরং তা তোমরা খেতে পার। যবেহ করার জন্যে জীবনের ধুঁকধুঁকি থাকাই যথেষ্ট। হযরত আলী রা. বলেছেনঃ
………. (আরবী)………………..
লাঠির আঘাতে, উপর থেকে পড়ে, শিং-এর গুঁতোয় মরে যাওয়া এসব জন্তুকে জীবিত থাকা অবস্থায়- যখন হাত বা পা নাড়ায়-যবেহ করা হলে তা তোমরা খাবে।
‘দাহ্হাক’ বলেছেনঃ জাহিলিয়াত যুগের লোকেরা এসব জন্তু যবেহ না করেই ভক্ষণ করত। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা ইসলামে এসব খাওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন। তবে এর মধ্য থেকে যেটির সামান্য আয়ু থাকতেও- পা, লেজ বা চক্ষু নড়াচড়া করা অবস্থায় যবেহ করা গেলে তা হালাল হবে।
(কোন কোন ফিকাহ্বিদের মতে তার মধ্যে জীবনের স্থিতি থাকা আবশ্যক। যা রক্ত প্রবাহিত হওয়া ও হাত-পা শক্তভাবে নড়াচড়া করতে থাকলে তবে যবেহ করার পর হালাল হবে।)
এসব মুর্দার হারাম করার কারণ
এসব মুর্দার হারাম হওয়ার মূলে সেসব কারণ ও উদ্দেশ্যই নিহিত রয়েছে যা ইতিপূর্বে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষভাবে বলা চলে, মানুষ জন্তু-জানোয়ারের প্রতি দয়াশীল এবং ওসবের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ অনুকম্পা সম্পন্ন হয়ে উঠুক- শরীয়তের এটাই লক্ষ্য। মানুষ যেন জন্তুগুলোকে অসহায় করে ছেড়ে না দেয়। এ রকম যে, কোনটি গলায় ফাঁস লাগিয়ে মরল, আর কোনটি উঁচুস্থান থেকে পড়ে গিয়ে মরল, আর কোনটি অন্য জন্তুর সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে শিং-এর গুঁতা খেয়ে মরে গেল, জন্তুর মালিক সে ব্যাপারে নিজের কোন দায়িত্বই অনুভব করে না, তা আল্লাহ্র আদৌ পছন্দ নয়। জন্তুগুলোকে কেউ এমন নির্মমভাবে মারধোর করে, যার ফলে সেটির মরে যাওয়া অবধারিত হয়ে পড়ে। তা আল্লাহ্র অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জন্তুর লড়াই লাগিয়ে অনেকে আনন্দ পায় বা জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে। তাতে একটি জন্তু অপর জন্তুটিকে গুঁতিয়ে আহত ও রক্তরঞ্চিত করে দেয় এবং তার ফলে সেটির মরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এই কাজও আল্লাহ পছন্দ করেন না।
হিংস্র জন্তুর ছিন্নভিন্ন করে দেয়া পশু খাওয়াও হারাম। তাতে মানুষের মর্যাদা রক্ষাই আসল লক্ষ্য। কেননা, পশুর উচ্ছিষ্ট খাওয়া মানুষের জন্যে শোভন হতে পারে না। তা থেকে মানুষকে দূরে রাখতে চাওয়া হয়েছে। জাহিলিয়াত যুগে এসব জন্তুকে লোকেরা নিঃসংকোচে খেত। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা হিংস্র জন্তুর উচ্ছিষ্ট খাওয়া মুমিনদের জন্যে হারাম করে দিয়েছেন।
দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া জন্তু
হারাম জন্তুগুলোর মধ্যে দশম হচ্ছে সেই জন্তু, যা কোন দেবতার উদ্দেশ্যে বলিদানের জন্যে নির্দিষ্ট স্থানে হত্যা করা হবে। যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হবে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কোন শক্তি, ব্যক্তি বা দেবতার পূজা করা। জাহিলিয়াত যুগে কাবা ঘরের চতুর্দিকে এ রকমের অনেক ‘স্থান’ নির্মিত হয়েছিল। আর তখনকার লোকেরা তাদের উপাস্য দেবতাদের পূজা করা ও সে সবের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সেসব স্থানে পশু যবাই করত। এক কথায় এটাও অ-আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে বলিদান মাত্র। উভয় ক্ষেত্রেই অ-আল্লাহ্ শক্তির প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা জানানো ও তা বড় করে তোলা- তার বড়ত্ব দেখানোই চরম লক্ষ্য। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, ‘অ-আল্লাহ্র নামে যবেহ করা জন্তু’ কথাটি সে জন্তুর জন্যে ব্যবহৃত হতে পারে যেটিকে যবেহ করার সময় কোন ‘বুত’ সম্মুখে নেই। বরং কোন বুতের নামে যবেহ করা হলেই হলো। কিন্তু স্থান- এ যবেহ করা জন্তু আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহ না করা হলেও তা হারাম হবে। অন্য কথায় প্রথমাবস্থায় ‘স্থান’ নির্দিষ্ট থাকে না। আর দ্বিতীয় অবস্থায় স্থান সুনির্দিষ্ট থাকে।
কাবাঘরের চতুর্দিকে যেসব ‘স্থান’ নির্মিত হয়েছিল, লোকদের ধারণা ছিল, এসব স্থানে জন্তু যবেহ করা হলে তাতে আল্লাহ্র ঘরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে। কুরআন এই ভুল ধারণার অপনোদন করেছে এবং এই কাজটিকে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। নতুবা অ-আল্লাহ্র জন্যে যবেহ করা জন্তু বলতে ‘স্থান’-এ যবেহ করা জন্তুটিও শামিল রয়েছে।
মাছ ও পঙ্গপাল সম্পর্কে স্বতন্ত্র বিধান
ইসলামে মাছ ও এ ধরণের জলজ জন্তু সম্পর্কে স্বতন্ত্র বিধান দেয়া হয়েছে। তাকে হারাম করা জন্তুগুলোর মধ্যে গণ্য করা হয়নি। নবী করীম সা. সমুদ্র-পানি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি জবাবে ইরশাদ করলেনঃ
……….. আরবী ……………
সমুদ্রের পানি পবিত্র এবং তার মুর্দার হালাল।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
……….. আরবী ……………
সমুদ্রের শিকার এবং তার খাদ্য তোমাদের জন্যে হালাল করা হয়েছে।
হযরত উমর রা. এ আয়াতাংশের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
‘সমুদ্রের শিকার’ বলতে সমুদ্রে যা কিছু শিকার করা হয় সে সব জীব বোঝান হয়েছে। আর সমুদ্রের খাদ্য বলতে বুঝিয়েছে তা যা সমুদ্র নিজেই ওপরে নিক্ষেপ করে।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. ও বলেছেনঃ সমুদ্রের খাদ্য বলতে সমুদ্রের ‘মৃত জীব’ বুঝান হয়েছে।
বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থে হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত এই হাদীস খানি উদ্ধৃত হয়েছেঃ
……….. আরবী ……………
নবী করীম সা. সাহাবীদের একটি বাহিনীকে কোন বিশেষ অভিযানে প্রেরণ করেন। তাদের হাতে একটি বড় মাছ পড়ে। সমুদ্র মাছটিকে ওপরে নিক্ষেপ করেছিল অর্থাৎ সেটি ছিল মৃত। তারা মাছটিকে বিশ দিনেরও বেশি সময় ধরে আহার করতে থাকেন। পরে তাঁরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন তাঁরা নবী করীম সা. কে এ বিষয়ে অবহিত করলেন। তিনি তাঁদের বললেনঃ ‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্যে যে রিয্ক বের করেছেন, তোমরা তা খাও। সে মাছটির কোন অংশ তোমাদের কাছে অবশিষ্ট থাকলে তা আমাদেরও খাওয়াও।’ তখন কেউ কেউ সে মাছের কিছু অংশ নবী করীম সা. এর খেদমতে পেশ করেন। তিনি তা আহার করেন। (বুখারী)
পঙ্গপাল সম্পর্কেও শরীয়তের এই বিধানই কার্যকর। নবী করীম সা. মৃত পঙ্গপাল আহার করার অনুমতি দিয়েছেন। কেননা তা যবেহ করা যায় না। হযরত ইবনে আবু লাইলা বলেছেনঃ
……….. আরবী ……………
আমরা রাসূলে করীম সা. এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধাভিযানে গিয়েছি। আর তখন তাঁর সঙ্গে আমরা পঙ্গপাল আহার করেছি।
মৃত জন্তুর চামড়া, অস্থি ও পশম ব্যবহার
‘মুর্দার হারাম’ অর্থ তা খাওয়া হারাম। কিন্তু মৃত জন্তুর চামড়া, শিং, অস্থি ও পশম ব্যবহার করায় কোন দোষ নেই। শুধু তাই নয়, তা কাম্যও বটে। কেননা তা এমন সম্পদ যা ব্যবহার করা ও কাজে লাগানো সম্ভব। অতএব বিনষ্ট করা জায়েয হতে পারে না।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেছেনঃ
উম্মুল মু’মিনীন হযরত মায়মুনার ক্রীতদাস দানস্বরূপ একটা ছাগল লাভ করে। পরে সেটি মরে যায়। নবী করীম সা. তা দেখতে পেয়ে বললেনঃ তোমরা এটির চামড়া তুলে নিচ্ছ না কেন, তা পরিচ্ছন্ন ও পরিপক্ক করে তোমরা কাজে লাগাবে। লোকেরা বলল, ওটা তো মরে গেছে। রাসূল সা. বললেনঃ মুর্দার খাওয়াটাই শুধু হারাম।
নবী করীম সা. মৃত জন্তুর চামড়া পবিত্র পরিচ্ছন্ন করার নিয়ম জানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেনঃ
……….. আরবী ……………
চামড়া দাবাগাত করে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করা জন্তুটিকে যবেহ করার শামিল। (আবু দাউদ, নিসায়ী)
অপর একটি বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছেঃ
‘দাবাগাত’ চামড়ার ময়লা অপবিত্রতাকে দূর করে দেয়। (হাকেম)
‘মুসলিম প্রভৃতি গ্রন্থে নবী কারীম সা. এর এ উক্তিটি উদ্ধৃত হয়েছেঃ
……….. আরবী …………….
যে চামড়াই ‘দাবাগাত’ (Tanning) করা হবে সেটিই পবিত্র হয়ে যাবে।
এ এক সাধারণ বিধান। সকল প্রকার জন্তুর চামড়া সম্পর্কেই এ বিধান প্রযোজ্য। কুকুর ও শূকরের চামড়ার ব্যাপারও ভিন্নতর কিছু নয়। ফিকাহবিদদের এই মত।
উম্মুল মুমিনীন হযরত সওদা রা. বলেছেনঃ
আমাদের একটি ছাগল মরে গেল। তখন আমরা তার চামড়া দাবাগাত করে নিই। পরে আমরা সব সময় তাতে ‘নবীয’ (খেজুরের শরবত) তৈরী করতে থাকি। এভাবে সেটি আমাদের একটি পুরাতন মশক পাত্রে পরিণত হয়ে গেল। (বুখারী)
ঠেকার অবস্থায় স্বতন্ত্র হুকুম
এখানে যে হারামের বিধান ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, আসলে তা সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থায় স্বাধীন ইচ্ছায় গ্রহণীয় নীতি। কিন্তু ঠেকার অবস্থা তা থেকে স্বতন্ত্র। পূর্বে এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আল্লাহ্ বলেছেনঃ
وَقَدْ فَصَّلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ
আল্লাহ্ তা’আলা ভিন্ন ভিন্ন করে তোমাদের বলে দিয়েছেন, যা কিছু তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন। তবে ব্যতিক্রম রয়েছে যদি তোমরা ঠেকায় পড়ে গিয়ে তার কোনটি গ্রহণ করতে বাধ্য হও। (সূরা আন’আমঃ ১১৯)
‘ঠেকায় পরে গ্রহণ করতে বাধ্য হওয়া’ একটা সর্ববাদী সম্মত ও সমর্থিত ব্যাপার। খাদ্যের পর্যায়ে এই ‘ঠেকায় পড়াটা’ কে অনেক সময় লক্ষ্য করা যায়। যেমন কেউ ক্ষুধায় খুব বেশি কাতর হয়ে পড়ল। (কোন কোন ফিকাহ্বিদের মতে) এই ক্ষুধার্তবস্থায় তার একটি দিন ও একটি রাত অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে সে এমন কিছু পেল না, যা খেয়ে সে তার ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে পারে। এ সময় তার সম্মুখে সহজলভ্য হয়ে আছে শুধু হারাম খাদ্য। তখন সে ন্যূনতম পরিমাণ গ্রহণ করে প্রয়োজন পূরণ করতে পারে ও নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে সক্ষম হতে পারে। শরীয়তে তার জন্যে এ অনুমতি রয়েছে। ইমাম মালিক র. বলেছেনঃ
………… আরবী …………
ঠেকায় পড়ে হারাম খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ হচ্ছে পেট পূর্ণ হওয়া (Satisfaction) এবং হালাল খাদ্য পাওয়ার সময় পর্যন্ত তা থেকে পাথেয় গ্রহণ।
কিন্তু অন্যান্যরা বলেছেনঃ
………… আরবী …………
এ ঠেকায় পড়া লোকটি শুধু এতটা পরিমাণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করতে পারে, যতটা শেষ শ্বাস-প্রশ্বাসটা চলমান রাখার জন্যে যথেষ্ট হতে পারে।
সম্ভবতঃ এ মতটিই কুরআনের ঘোষণার- (আরবী) ‘অধিক ইচ্ছুক-আগ্রহী ও সীমালংঘনকারী না হয়ে’- সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ক্ষুধার ব্যাপারটিকে সুস্পষ্ট করে দেয়ার জন্যে কুরআনে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছেঃ
………… আরবী …………
যে লোক ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয় কোন হারাম জিনিস খায়, গুনাহর প্রতি কোনরূপ প্রবণতা ও আগ্রহ ব্যতীতই, তাহলে আল্লাহ্ নিশ্চয়ই ক্ষমাশীল ও দয়াবান।
চিকিৎসার প্রয়োজনে
চিকিৎসা পর্যায়ে ঠেকে যাওয়ার রূপটি হচ্ছে, কোন হারাম জিনিস ঔষধ হিসেবে গ্রহণ করার ওপরই যদি কারো রোগমুক্তি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে এ সম্পর্কে শরীয়তের হুকুম কি হবে তাই প্রশ্ন। ফিকাহবিদগণ এ বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কোন কোন ফিকাহ্বিদ চিকিৎসার ব্যাপারটিকে খাদ্যের মতো অতটা তীব্র কঠিন অনিবার্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন না। এ মতের সমর্থনে তাঁরা রাসূলে কারীম সা. এর একটি বাণীরও উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি হচ্ছেঃ
………… আরবী …………
তোমাদের প্রতি যা যা হারাম করা হয়েছে, তাতে আল্লাহ্ তোমাদের রোগমুক্তির ব্যবস্থা রাখেন নি। (বুখারী)
অনেক ফিকাহ্বিদ আবার চিকিৎসার প্রয়োজনটিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছেন এবং ওষুধ বা চিকিৎসার ব্যাপারটিকেও খাদ্যের সমান প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছেন। কেননা মূলত জীবনের জন্যে যেমন খাদ্য প্রয়োজনীয়, তেমনি ঔষধের প্রয়োজনও কোন ক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। তাই এ নিষিদ্ধ দ্রব্যাদি প্রয়োজনে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা তাঁদের মতে নিশ্চয়ই মুবাহ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দলিল হিসেবে তাঁরা আরও বলেছেন, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ ও জুবাইর ইবনুর আওয়াম রা. চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। নবী করীম সা. তাঁদের জন্যে রেশমী পোশাক ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন- যদিও তা সাধারণভাবে নিষিদ্ধই ছিল এবং তা পরার ওপর নবী করীম সা. অভিশাপ বর্ষণ করেছেণ।
সম্ভবতঃ এ মতটিই ইসলামের মৌল ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল। কেননা মানুষের জীবন রক্ষার জন্যে যে-কোন কার্যকর পন্থা গ্রহণ প্রতিটি শরীয়তী ব্যবস্থারই মূল লক্ষ্য।
কিন্তু হারাম দ্রব্য সম্বলিত ঔষধ চিকিৎসার্থে ব্যবহার করার অনুমতি কতিপয় শর্তের ওপর ভিত্তিশীল। শর্তগুলো হচ্ছেঃ
১. সে ঔষধটি ব্যবহার করা না হলে স্বাস্থ্যের ওপর প্রকৃতই কোন বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে বলে নিশ্চিতভাবে বিবেচিত হতে হবে।
২. সে ঔষধটি ছাড়া তার স্থলাভিষিক্ত বা বিকল্প হতে পারে হালাল দ্রব্য সম্বলিত এমন কোন ঔষধ পাওয়াই যায় না- এমন অবস্থা হতে হবে।
৩. এ বিষয়ে আল্লাহ্ বিশ্বাসী মুসলিম চিকিৎসকের কাছ থেকে সুস্পষ্ট অনুমোদন পেতে হবে।
আমাদের নিজস্ব জ্ঞান তথ্য ও বিশ্বাসযোগ্য চিকিৎসাবিদদের থেকে প্রাপ্ত বর্ণনাসমূহের ভিত্তিতে একটি কথা আমরা অতিরিক্ত বলতে চাই। তা হচ্ছে, কোন হারাম দ্রব্য সম্বলিত ঔষধ ব্যবহার করা জীবন রক্ষার জন্যে একেবারে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে, এমন অবস্থা আসলেই নয়। তবু নীতিগতভাবে ও সতর্কতার ভিত্তিতে আমরা এ ধরণের ঔষধ ব্যবহারের অনিবার্যতাকে অস্বীকার করছি না। কেননা কোন মুসলিমের এমন স্থান বা অবস্থায় পড়ে যাওয়া- যেখানে এসব হারাম ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না- একেবারে অসম্ভব মনে করা ঠিক নহে।
সামষ্টিক পর্যায়ে প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা থাকলে ব্যক্তি–প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকে না
এক ব্যক্তি তার নিজ দেশে খাদ্যবস্তু পায় না বা তার কাছে তা নেই, এটা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে সে সব দিক দিয়ে চরম ঠেকায় পড়ে গেছে এবং এখন সে হারাম খাদ্য না খেলে তার প্রাণ বাঁচে না, একথাটি গ্রহণীয় হতে পারে না। কেননা সে যে দেশের নাগরিক ও যে সমাজের একজন, সে দেশ ও সমাজের বা তার লোকজনের কাছে তো বিপুল খাদ্যসম্ভার মজুদই রয়েছে। এরূপ অবস্থায় ঠেকায়-পড়া ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ করতে হবে অন্যান্য লোকের উদ্বৃত্ত খাদ্যসম্ভার থেকে। এরূপ ব্যবস্থার সাহায্যে এ লোকটিকে হারাম খাওয়া থেকে রক্ষা করা যেতে পারে এবং তা একান্তই কর্তব্য। বস্তুত পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্যে সে ইসলামী সমাজের পূর্ণত্ব বিধান করতে হবে। এ সমাজের প্রত্যেকে অপর প্রত্যেকের জন্যে দায়ী। এ সমাজের সমস্ত ব্যক্তিসত্তার সমষ্টি এক অভিন্ন ব্যক্তিসত্তায় পরিণত হয়ে থাকে। এ ধরণের সমাজই হতে পারে শিশাঢালা প্রাচীর বিশেষ। তার প্রতিটি ইট খণ্ড অপরাপর ইট খণ্ডসমূহের জন্যে পৃষ্ঠপোষক। (হাদীসের মর্ম)
সামষ্টিক দায়িত্ব পালন পর্যায়ে ইমাম ইবনে হাজম-এর একটি উদ্বৃতি ইসলামের ফিকাহবিদদের জন্যে দিশারী হয়ে আছে। তিনি লিখেছেনঃ
কোন মুসলিম ব্যক্তির জন্যে চরম ঠেকায়-পড়া অবস্থায়ও মুর্দার বা শূকরের মাংস আহার করা কোন ক্রমেই জায়েয হতে পারে না। কেননা তার মুসলিম বা অমুসলিম প্রতিবেশির কাছে অতিরিক্ত খাদ্যবস্তু মজুদ রয়েছে। এমতাবস্থায় তার কর্তব্য হচ্ছে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দেয়া। এ প্রেক্ষিতে ঠেকায়-পড়া লোকটির জন্যে মুর্দার বা শূকরের মাংস খেতে বাধ্য মনে করা যায় না। তার পক্ষে তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে খাদ্য-পানীয়ের অতিরিক্ত অংশ হাসিল করা সম্পূর্ণ বৈধ- তার এ অধিকার রয়েছে। এ উদ্দেশ্যে তাকে যদি লড়াইও করতে হয় এবং তাতে সে মৃত্যুও বরণ করে, তাহলে হত্যাকারীর ‘কিসাস’ হতে হবে। আর এ অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের পথে বাধাদানকারীকে যদি হত্যাও করতে হয় তবু তা করা যাবে এবং নিহত ব্যক্তির ওপর আল্লাহ্র অভিশাপ বর্ষিত হবে। কেননা এ নিহত ব্যক্তি একজন ঠেকায়-পড়া ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে তার বৈধ অধিকার লাভের পথে বাধা দিয়েছে। এ কারণে সে বিদ্রোহী লোকদের মধ্যে গণ্য হবে। আর তার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেনঃ
فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ
পরে তাদের একটি পক্ষ যদি অপর পক্ষের ওপর আক্রমণ চালায়, তাহলে এ সীমালংঘনকারীদের ওপর যুদ্ধ চালাও, যেন শেষ পর্যন্ত তারা আল্লাহ্র বিধানের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। (সূরা হুজুরাতঃ ৯)
সত্যি কথা, যে ভাইর অধিকার হরণ বা অস্বীকার করা হয় কিংবা তার পথে বাধার সৃষ্টি করে মূলত সে-ই বিদ্রোহী। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এ কারণেই যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
যবেহ করার শরীয়তসম্মত পন্থা
সামুদ্রিক জীব সবই হালাল
জীব, জন্তু তাদের অবস্থান ও বসবাস স্থানের দৃষ্টিতে দুটি ভাগে বিভক্ত। হয় তারা সামুদ্রবাসী, না হয় স্থল অধিবাসী।
সামুদ্রিক জীব বলতে বেঝায় যেসব প্রাণী যা পানিতে অবস্থান ও বসবাস করে এবং পানি ভিন্ন যাদের জীবন অকল্পনীয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে মূলত তা সবই হালাল, তা যেখানেই পাওয়া যাক না কেন। তা পানির মধ্য থেকে জীবিতই ধরা হোক, কি মৃত মরে উঠুক আর নাই উঠুক। ক্ষুদ্রাকার ও বিরাটকার মাছসমূহ এর মধ্যে পড়ে। আর সামদ্রিক কুকুর কিংবা সামুদ্রিক শূকর বলতে যে জীবগুলোকে বোঝায় তাও এবং এ ধরনের অপরাপর মাছ জাতীয় জীব- সবই হালাল পর্যায়ে গণ্য। তাকে ধরেছে বা মেরেছে কিংবা শিকার করেছে- সে মুসলিম কি কাফির- সে প্রশ্ন এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অবান্তর। বস্তুত সমুদ্রে যা কিছু এবং যত কিছুই রয়েছে তা সব হালাল করে দেয়ে আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশাল পর্যায়ের অনুগ্রহ দান করেছেন। সামুদ্রিক জীবদের মধ্য থেকে বিশেষ কোন শ্রেনীকে হারাম ঘোষণা করা হয়নি এবং তাদের যবেহ করার কোন শর্তও আরোপ করা হয়নি। বরং মানুষকে এক্ষেত্রে অবাধ অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সে নিজের কষ্ট ও অভাব লাঘবের জন্য যতটা ইচ্ছা সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে পারে। আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর বন্দাদের প্রতি তার বিষেশ অনুগ্রহের কথা প্রকাশ প্রসঙ্গেই ইরশাদ করেছেন :
(আরবী***********)
সেই মহান আল্লাহই নদী-সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রিত ও নিয়োজিত করে রেখেছেন, যেন তোমরা তা থেকে তাজা গোশত গ্রহণ করতে পার।
বলেছেন :
(আরবী*******************)
তোমাদের জন্যে সমুদ্রের শিকার ও খাদ্য হালাল করে দেয়া হয়েছে। তা তেমাদের ও পরিভ্রমণকারীদের জন্যে সামগ্রী। (সূরা মায়িদা : ৯৬)
এ দুটি আয়াতে সব সামুদ্রিক জীবকেই সাধারণভাবে ও নির্বিশেষে হালাল করার কথা ঘোষিত হয়েছে।
স্থলভাগের হারাম জীব-জন্তু
স্থলভাগের জীব-জন্তু ও প্রাণীকূলের মধ্যে কেবলমাত্র শূকর মাংস, মৃত, রক্ত এবং অ-আল্লাহর নামে উত্সর্গীকৃত বা যবেহকৃত ছাড়া আর কোনটিকেই হারাম ঘোষনা করা হয়নি। এ পর্যায়ের কথা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে।
কিন্তু কুরআন মজীদেই হালাল-হারাম ঘোষণার কিছু দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলা হযরত মুহাম্মদ (সা) এর উপর অর্পন করেছেন। তাঁর দায়িত্ব বর্ণনা পর্যায়ে বলা হযেছে :
(আরবী*******************)
তিনি লোকদের জন্যে পবিত্র উত্কৃষ্ট দ্রব্যাদি হালাল করেন এবং খারাপ পচা-নিকৃষ্ট জিনিসসমূহ হারাম করেছেন। (সূরা আল-আরাফ : ১৫৭)
খবীস’ বলতে বোঝায় তা, যা সাধারণভাবে মানব সমষ্টির সুস্থ রুচিতে জঘন্য মনে হয়- কিছু সংখ্যক লোক যদি তা পছন্দ করেও।
এ পর্যায়েরই একটি হাদীস হচ্ছে :
(আরবী**********************)
নবী করীম (সা) খায়বর যুদ্ধের দিনে গার্হাস্থ্য গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী)
বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে : (আরবী**********************)
নবী করীম (সা) নখরধারী সব হিংস্র জীব এবং সব ছিড়ে খাওয়া পাখির গোশত খেতে নিষেধ করেছেন।
বাঘ, শৃগাল, চিতা ইত্যাদি প্রথম পর্যায়ের জন্তু। আর চিল, শকুণ, বাজ প্রভৃতি নখরধারী পাখিগুলো দ্বিতীয় পর্যায়ের।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এর মত হচ্ছে, কুরআন মজীদের যে চারটি জীব হারাম বলে উল্লিখিত হয়েছে, তাছাড়া আর কোনটিই হারাম নয়। মনে হচ্ছে, হাদীসে যেসব জন্তুর গোশত খেতে নিষেধ করা হয়েছে তাঁর মতে তা খাওয়া হারাম নয়, মাকরূহ মাত্র। অথবা এও হতে পারে যে, তিনি হয়ত এ হাদীস কয়টি জানতেই পারেন নি।
তিনি বলেছেন : (আরবী************************)
ইসলাম-পূর্ব যুগে লোকেরা অনেক কিছু খেত, আর অনেক কিছু খারাপ মনে করে খেত না। পরে আল্লাহ তার নবীকে পাঠালেন এবং তাঁর কিতাব নাযিল করলেন। তাতে তাঁর হালাল ও হারাম সংক্রান্ত ঘোষণা প্রকাশ করলেন। কাজেই তাতে যা হালাল, তা হালালই আর তাতে যা হারাম তা হারামই। আর যে বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে, তা সবই নির্দোষ ও মাফ।
অতপর তিনি সূরা আল আনয়াম এর পূর্বোদ্ধৃত ১৪৫ নং আয়াতটি পাঠ করেন। এ আয়াতের আলোকেই হযরত ইবনে আব্বাস (রা) মনে করেন যে, গৃহপালিত গাধার গোশত খাওয়া হালাল। ইমাম মালিক (রা) ও এর মতই গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, হিংস্র ও ছিন্ন-ভিন্ন করে আহারকারী জন্তুগুলোর গোশত খাওয়া হারাম নয়, বড়জোর মাকরূহ।
তবে এ কথা চুড়ান্ত যে, হারাম জন্তুগুলো যবেহ করলেই তা হালাল হয়ে যাবে, এমন কোন কথা নেই। যবেহ করা হলে চামড়া ট্রেনিং না করেই পবিত্র বিবেচিত হতে পারে মাত্র।
গৃহপালিত জন্তু হালাল হওয়ার জন্যে যবেহ করা শর্ত
যে সব স্থলভাগের জন্তু-জানোয়ার খাওয়া জায়েয, তা দুভাগে বিভক্ত।
কতগুলো জন্তু এমন, যা মানুষের নিয়ন্ত্রনাধীন। উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি ধরনের গৃহপালিত জন্তু এবং হাঁস-মোরগ ইত্যাদি যেসব পাখি গার্হাস্থ পর্যায়ে লালন-পালন করা হয়, তা এক প্রকার। আর অপর প্রকারের জীব হচ্ছে সেসব, যা মানুষের নিয়ন্ত্রনে আসে না বা যেসবের উপর নিয়ন্ত্রণ চালান মানুষের সাধ্যাতীত।
প্রথম প্রকারের জন্তু ও পাখিগুলোর গোশত খাওয়া হলাল। তাবে তার জন্যে শর্ত, হচ্ছে, তাকে শরীয়তের প্রথা অনুযায়ী যবেহ করতে হবে।
শরীয়ত অনুযায়ী যবেহ করা শর্ত
শরীয়ত অনুযায়ী যবেহ করার জরুরী শর্ত হচ্ছে :
১. জন্তু যবেহ বা নহর করতে হবে ধারাল অস্ত্র দ্বারা। যেন রক্ত প্রবাহিত হতে পারে ও রগগুলো যেন ভালভাবে কেটে যায়। সে অস্ত্র পাথরেরও হতে পারে, লৌহ বা কাষ্ট নির্মিতও হতে পারে কিংবা হযরত আদী ইবনে হাতেম তায়ী বলেন:
(আরবী******************)
আমি বললাম, হে রাসূল! আমরা জন্তু শিকার করি, কিন্তু তখন আমাদের কাছে ছুরি-চাকু থাকে না, থাকে শানিত পাথর বা বাশের খণ্ড। তখন আমরা কি করব? রাসূল (সা) বললেন : রক্ত প্রবাহিত কর যে জিনিস দ্বারাই সম্ভব হোক এবং তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)
২. গলদেশে ছুরি চালাতে হবে অথবা গলার নিচের অংশে ছুরি বসিয়ে দিতে হবে, (প্রচলিত ভাষায় এটাই নহর) যার ফলে জন্তুটির মৃত্যু সঙ্ঘটিত হবে।
যবেহর পূর্ণতার পন্থা হচ্ছে, খাদ্যনালী ও গলার মধ্যের বড় দুটি রগ কেটে দিতে হবে। কিন্তু যখন নির্দিষ্ট স্থানে ছুরি চালান অসম্ভব হয়ে পড়বে, যেমন একটা গুরু কুয়ার মধ্যে পড়ে গেছে, তার মাথা ভিতরে, পায়ের দিকটা বাইরে রয়েছে স্বাভাবিক নিয়মে যথাস্থানে যবেহ করা যাবে না। তখন তার অবস্থা হবে শিকার করা জন্তুর মতো। তখন ধারাল অস্ত্র সাধ্যমত যে কোন স্থানে চালিয়ে রক্ত প্রবাহিত করেত হবে। তা করা হলে হালাল হয়ে যাবে।
বুখারী-মুসলিমে হযরত রাফে ইবনে খদীজা (রা) থেকে হাদীস উদ্বৃত হয়েছে। তিনি বলেন:
(আরবী**************)
এক পরিভ্রমণে আমরা নবী করীম (সা) এর সঙ্গে ছিলাম। সহসা একটি উট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। তখন লোকদের সঙ্গে ঘোড়া ছিল না বলে দ্রুত গতিতে গিয়ে সেটাকে ধরা গেল না। এক ব্যক্তি তীর নিক্ষেপ করে উটকে বেঁধে ফেলল। তা দেখে নবী করীম (সা) বললেন : এসব চতুষ্পদ জন্তু এভাবে আয়াত্তের বাইরে চলে গেলে তখন তোমরাও তার অনুরূপ আচরণই করবে।
৩. যবেহ করার সময় আল্লাহ ছাড়া আর কারো নাম উচ্চারণ করা যাবে না। এ এক সর্ববাদী সম্মত কথা। তার কারণ হচ্ছে, জাহিলিয়াত যুগে লোকেরা তাদের উপাস্যদের দেবী দেবতা-মূর্তির নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে জন্তু যবেহ করত। যবেহ করার সময় তারা সে সব দেব-দেবীর নাম উচ্চারণ করত অথবা নির্দিষ্ট স্থানে বলিদান করত। কুরআন মজিদে এসব হারাম করা হয়েছে। পূর্বেই এতদসংক্রান্ত আয়াতের উল্লেখ করা হয়েছে।
৪. যে জন্তুটি যবেহ করা হচ্ছে, তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে হবে। কুরআনের আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে এ ভাষায় : (আরবী**********************)
তোমরা যদি আল্লাহর আয়াতসমূহের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাক, তাহলে যেসব জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে তোমরা সেগুলো খাও। (সূরা আন’আম : ১১৮)
ইরশাদ হয়েছে : (আরবী******************)
যেসব জন্তু যবেহকালে আল্লাহরও নাম উচ্চারণ করা হয়নি, তোমরা তা খেও না। কেননা তা খাওয়া ফাসিকী (ইসলামের সীমালংঘনমূলক কাজ।
রাসূলে করীম (সা) বলেছেন: (আরবী*************************)
যে জন্তুর রক্ত প্রবাহিত করা হয়েছে এবং তখন তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে, তোমরা তা খাও। (বুখারী)
যেসব হাদীসে শিকার করার উদ্দেশ্যে তীর নিক্ষেপ করার এবং শিক্ষা দেয়া কুকুরকে শিকারের উদ্দেশ্যে পাঠাবার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার কথা বলা হয়েছে, তা উপরিউক্ত মতেরই সমর্থক। কোন কোন আলেমের মতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ তো জরুরী; কিন্তু ঠিক যবেহ করার মূহুর্তেই এ নাম নিতে হবে, এমনটা প্রয়োজন নয়। খাওয়ার সময় নাম উচ্চারণও যথেষ্ট। কেননা যে লোক খাওয়ার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে সে তো নিশ্চয়ই এমন জিনিস খায় না, যার উপর আল্লাহ নাম উচ্চারণ করা হয়নি। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন : (আরবী***********************)
নতুন ইসলাম গ্রহণকারী কিছু লোক নবী করীম (সা) কে জিজ্ঞাসা করলেন, লোকেরা আমাদের নিকট গোশত নিয়ে আসে, তারা তার ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেছিল কিনা, তা আমাদের জানা নেই। এক্ষণে আমরা তা খাব, না খাব না? নবী করীম (সা) জবাবে বললেন : তামরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর এবং খাও। (বুখারী)
যবেহ করার এ নিয়মের তাত্পর্য
জন্তু যবেহ করার এরূপ বিধিবদ্ধ করার মৌল কারণ হচ্ছে, জন্তুটির প্রাণ যেন এমনভাবে সংহার করা হয়, যাতে করে সেটির কম সে কম কষ্ট ভোগ হয়। যবেহর অস্ত্রটি খুব ধারাল হওয়ার ও গলদেশে যবেহ করা শর্ত এ জন্যেই করা হয়েছে। কোননা এসব জিনিস দ্বারা যবেহ করা হলে জন্তুটির কণ্ঠদেশ রুদ্ধ করার মতো অবস্থা হয়। নবী করীম (সা) ছুরিটিকে অতিশয় ধারাল বানানো এবং জন্তুটিকে শান্তি দাদের নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন : (আরবী************************)
আল্লাহ তা’আলা প্রতিটি ব্যাপারে এ ক্ষত্রে দয়াশীলতা অবলম্বন ফরয করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা যখন হত্যা করবে, তখন অবশ্যই দয়াশীলতা সহকারে হত্যা করবে। আর যখন যবেহ করবে, তখনও সুন্দর ও উত্তমভাবে যবেহ করবে। তোমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য যবেহ করার সময় যার যার ছুরিকে খুব ধারাল বানিয়ে নেয়া এবং যবেহ করার পর সেটাকে ধীরে ধীরে প্রশান্তি লাভ করার সুযোগ দেয়া। (বুখারী)
এ সহানুভূতি ও দয়াশীলতা পর্যায়ে হযরত ইবনে উমর বর্ণিত একটি হাদীসে উল্লেখ্য। তিনি বলেন :
(আরবী**********)
নবী করীম (সা) আদেশ করেছেন ছুরি শানিত করতে এবং অপরাপর জন্তু থেকে গোপন রাখতে। তাই বলেছেন: তোমাদের কেউ যখন যবেহ করার কাজ করবে, তখন তা যেন সম্পূর্ণতায় পৌছায়। (ইবনে মাযাহ)
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন, এক ব্যক্তি একটি বকরী শোয়ায়ে তার ছুরিতে ধার দিতেছিল্ তা দেখে নবী করীম (সা) বললেন : (আরবী***********************)
তুমি কি বকরীটিকে কয়েকবার মারতে চাও? ওটিকে শোয়াবার আগে কেন তুমি তোমার ছুরিকে শানিত করে নাও নি। (হাকেম)
হযরত উমর (রা) দেখতে পেলেন, এক ব্যক্তি তার পা দিয়ে চেপে ধরে তার বকরীটিকে হেঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যবেহ করার উদ্দেশ্যে। তখন তিনি লোকটিকে বললেন : (আরবী**********************)
তোমার জন্যে দু:খ! তুমি বকরীটিকে খুব ভালভাবে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাও।
এ পর্যায়ে ইসলামী চিন্তাধারা সাধারণভাবে এরূপেই আমরা পাচ্ছি। আর তা হচ্ছে, বোবা জন্তুর প্রতি দয়াশীলতা এবং ওটিকে সব রকমের কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি দেয়া – যতটা সম্ভব।
জাহিলিয়াতের যুগে লোকেরা উষ্ট্রের ঝুটি (Hamp) জীবন্ত অবস্থায় কেটে নিয়ে খেতে খুব ভালবাসত। আর তারা জীবন্ত অবস্থায় দুম্বার পিছণে ঝুরে থাকা চাকতি কেটে নিয়ে যেত। তাতে করে ওদের কষ্টের সীমা থাকত না। এ করণে নবী করীম (সা) জীবন্ত জন্তুর দেহাংশ কেটে নেয়াকে হারাম করে দিয়েছেন । বলেছেন :
(আরবী*******************)
জন্তুর জীবন্ত অবস্থায় তার দেহাংশ কেটে নেয়া হলে সেটাকে মৃত মনে করতে হবে (এবং তা হারাম) । (আহম্মদ আবু দাউদ, তিরমিযী)
যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণের তাত্পর্য
যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার অপরিহার্যতার মূলে গভীর সূক্ষ্য কারণ নিহিত। সে বিষয়ে অবহিত হওয়া ও সে দিকে লক্ষ্য দেয়া বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
মূর্তিপূজারী ও জাহিলিয়াতের লোকেরা যবেহ করার সময় তাদের মা’বুদদের নাম উচ্চারণ করত। ইসলামে তদস্থলে আল্লাহর নাম উচ্চারণের বিধান দেয়া হয়েছে। কেননা মুশরিকরা যখন যবেহ করার সময় তাদের উপাস্যদের নাম লয়, তখন এক আল্লাহর প্রতি ঈমানদার লোকেরা অনুরূপ সময়ে তা না করে কি থাকতে পারে?
দ্বিতীয়ত : জন্তুগুলোও তো মানুষেরই মতো এক আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষ যে ওগুলোর প্রাণ হরণ করবে, তাতে আল্লাহর অনুমতি থাকা একান্তই আবশ্যক। যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হলে এই অনুমতি লাভেরই ঘোষণা হয়ে যায়। এ সময় সে যেন বলছে, আমি এ কাজটি করছি এ জন্যে নয় যে, ওগুলো দুর্বল, অক্ষম ও অসহায়ক। আমি ওগুলোর ওপর জুলুম করতে চাইলে। বরং যবেহ করার এই যে কাজটি আমি করছি, তা একমাত্র আল্লাহর অনুমতিক্রমেই করছি। তার নাম নিয়েই আমি শিকার করছি এবং তাঁরই নাম সহকারে আমি তা খাচ্ছি।
ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের যবেহ করা জন্তু
জন্তু যবেহ করার ব্যাপারে ইসলাম কত কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা আমরা এর পূর্বে দেখেছি। বস্তুত ইসলামে এ ব্যপারটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আরব মুশরিক ও জাহিলিয়াতের লোকেরা জন্তু যবেহ করার ব্যাপারটিকে তাদের আকীদা অনুযায়ী ধর্মের অঙ্গ ও পূজা-উপাসনার অপরিহার্য অনুষ্টানের মধ্যে গণ্য করে নিয়েছিল। তারা জন্তু যবেহ করে আসলে তাদের দেবদেবী-উপাস্যদের সন্তুষ্টি ও নৈকট্যই অর্জন করতে চেয়েছে। এই কারণে দেবদেবীর উদ্দেশ্যে বলিদানের জন্যে নির্দিষ্ট স্থানেই তারা জন্তু যবেহ করত। আর তখন তাদের দেবদেবীর নাম উচ্চারণ করত।
ইসলাম এসব বন্ধ করে দিয়ে যবেহ করার সময় একমাত্র আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার ব্যবস্থা দৃঢ়ভাবে স্থাপিত ও কার্যকর করল। আল্লাহ ছাড়া অপর কারো নাম লওয়াকে সম্পূর্ণ নিষেধ করে দিল। ওসব নির্দিষ্ট স্থান সমূহে জন্তু যবেহ করা এবং এক আল্লাহ ছাড়া অন্যদের নামে উত্সর্গীকৃত জন্তু হারাম করে দিয়েছে।
আহলি কিতাব- ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানরা- মূলত তাওহীদে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু পরে তাদের ঈমানী আকীদায় শিরক অনুপ্রবেশ করে। কেননা তাদের কাছে সে দ্বীনের দাওয়াত পৌছেছিল এমন সব লোকের মাধ্যমে, যারা শিরক-আকীদায় দোষ ও মালিন্য থেকে নিজেদের বিশ্বাস ও মনমানসকে মুক্তি করে নিতে পারেনি। এ কারণে মুসলিমদের মনে এ ভাবটা জেগে উঠার খুব বেশি সম্ভাবনা ছিল যে, ওদেরকে মূর্তিপূজারী মুশরিক মনে করে তদনুরূপ আচরণই ওদের সাথে অবলম্বন করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ওদের ব্যাপারে মূর্তিপূজারীদের থেকে ভিন্নতর রীতি অবলম্বন করার নির্দেশ দিলেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে ওদের সাথে একত্রিত হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, যেমন অনুমতি দেয়া হয়েছে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের। আল্লাহ তাআলা কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াতে ইরশাদ করেছেন : (আরবী********************)
আজকের দিনে তোমাদের জন্যে সব পবিত্র উত্কস্ট খাদ্য হালাল করে দেয়া হলো, আর তাদের খাদ্যও, যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে- তোমাদের জন্যে হালাল এবং তোমাদের খাদ্যও হালাল তাদের জন্যে। (সূরা মায়িদা : ৫)
এক কথায় এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে সকল প্রকার পবিত্র উত্কৃস্ট খাদ্য সম্পূর্ণ হালাল। অতএব বহীরা‘ সায়েরা‘ আসীলা, বা হাম‘ বলতে আর কিছু নেই। আর ইয়াহুদী খ্রিস্টান আহলি কিতাব জাতিগুলোর খাদ্য মৌলিকভাবে তোমাদের জন্যে হালাল। আল্লাহ তা কখনই হারাম করেন নি। তোমাদের খাদ্যও তাদের জন্যে হালাল। তাহলে তাদের যবেহ করা বা শিরক করা জন্তুর গোশত খাওয়াও তোমাদের জন্যে জায়েয। অনুরূপভাবে তোমরা যা যবেহ কর বা শিরক কর তা তাদের খাওয়াতেও কোন নিষেধ নেই।
তবে আরবের মুশরিকদের ব্যাপারে ইসলাম খুব বেশি কঠোরতা অবলম্বন করেছে। কিন্তু আহলি কিতাবের সাথে নম্র আচরণ গ্রহণ করেছে। তার কারণ হচ্ছে, আহলি কিতাব লোকেরা ওহী, নবুওয়্যাত এবং মোটামুটি দ্বীনের মৌলিক নিয়ম নীতিগুলো মানে। এ কারণে তারা ঈমানদারদের খুবই নিকটে অবস্থিত। খাওয়া-দাওয়ায় তাদের সাথে শরীক হওয়া, তাদের কন্যা বিয়ে করা এবং তাদের সাথে মিলমিশ করা শরীয়তসম্মত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে তাদের জন্যে সুযোগ দেয়া হয়েছে যে, তারা ইসলামকে লোকদের ঘরে, কথা ও কাজ, নৈতিকতা ও লেনদেনের ক্ষেত্রে তা আসল রূপে প্রত্যেক্ষ করার সুযোগ পাবে। এ উপায়েই তারা জানতে পারবে যে, মূলত ইসলাম এমন এক দ্বীন, যা উচ্চতর তত্ত্ব ও সত্য, পূর্ণাঙ্গ নিয়মাদি, অতীব উত্তম বিশ্বাস ব্যবস্থা সমূহের ওপর ভিত্তিশীল। এতে শিরক ও অর্থহীন কথাবার্তার কোন স্থান নেই।
কুরআনে ঘোষণা : (আরবী*****************)
কিতাবপ্রাপ্ত লোকদের খাদ্য।
কথাটি খুবই সাধারণ ও ব্যাপক অর্থ জ্ঞাপক। সর্বপ্রকারের খাদ্যই এর অন্তর্ভূক্ত। ওদের যবেহ করা জন্তুর গোশত এবং অন্যান্য খাদ্য সবই হালাল। কাজেই এ সবকিছুই আমাদের স্থায়ীভাবেই হালাল। তবে যদি হারাম করে দেয়া হয়ে থাকে যেমন মৃত জন্তু, প্রবাহিত রক্ত শূকরের গোশত- এগুলো খাওয়া জায়েয নয়। এটা সর্ববাধিসম্মত মত। তা যে কোন কিতাবী লোকের কাছেই হোক কিংবা হোক কোন মুসলিমের কাছে- তাতে কোন পার্থক্য নেই।
তবে এখানে কতগুলো বিষয় বিশেষভাবে মুসলমানদের জন্যে বিবেচনা প্রয়োজন।
১. গির্জা ও মেলাতে হারের জন্যে যবেহ করা জন্তু
কোন কিতাবী লোক সম্পর্কে যতক্ষন না জানা যাবে যে, সে যবেহ করার সময় ঈসা-মসীহ বা উজাইর প্রভৃতি অ-আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তা যবেহ করা জন্তুর গোশত খাওয়া হালাল। কিন্তু যখন জানা যাবে যে, সে যবেহ করার সময় অ-আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেছে, তখন সেই বিশেষ জন্তুটি হারাম হয়ে যাবে বলে ফিকাহবিদগণ মত প্রকাশ করেছেন।
তবে কেউ কেউ বলেছেন : আল্লাহ তো ওদের খাদ্য আমাদের জন্যে হালাল করেই দিয়েছেন। এখন তারা যবেহ করাকালে কি বলে, কার নাম উচ্চারণ করে তা আল্লাহই ভাল জানেন। (সেদিকে লক্ষ্য দেয়ার প্রয়োজন নেই)
আহলি কিতাবের ঈদ উত্সব ও গীর্জা ইত্যাদি অনষ্ঠান উপলক্ষে যবেহ করা জন্তু সম্পর্কে ইমাম মালিকের কাছে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন : (আরবী***********)
আমি তা খাওয়া মাকরূহ মনে করি না। [ইমাম মালিকের মাযহাবে এটাই ফতোয়া। তিনি এ কালের কোন কোন আলেমের ন্যায় হারাম ঘোষণায় খুব তাড়াহুড়া করতেন না। শুধু মাকরূহ বলেই ক্ষন্ত থাকতেন।]
তাঁর এই মাকরূহ মনে কারাটা তাঁর নিজস্ব অতিরিক্ত তাকওয়ার ব্যাপার। তাঁর সন্দেহ হয়েছে অ-আল্লাহর নামে যবেহ হওয়ার। তাই তিনি তা খাওয়া মাকরূহ মনে করেছেন। কিন্তু তিনি তা হারাম মনে করেন নি। কেননা তাঁর মতে আহলি কিতাবের ক্ষেত্রে অ-আল্লাহর নামে যবেহ করার অর্থ হচ্ছে তারা তাদের উপাস্যদের উপাসনা ও তাদের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যে জন্তু যবেহ করে সে জন্তু তারা নিজেরা খায় না। তাবে যেসব জন্তু তারা নিজারা খাওয়ার উদ্দেশ্যে যবেহ করে তা তাদের খাদ্যের মধ্যে গণ্য আর তা আমাদের জন্যে হালাল বলে নিজেই ঘোষনা করেছেন। [মুগনী কিতাবে আছে যে, যদি কোন আহলি কিতাব যবেহ করার সময় জ্ঞাতসারে আল্লাহর নাম উচ্চারণ না করে তবে তার যবেহ করা পশু খাওয়া হালাল নয়। হযরত আলী (রা) থেকে এটাই বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম শাফেয়ী, নাখয়ী, হাম্মাদ, ইসহাক এবং হানাফী মতাবলম্বিগণের মতও এটাই। আহলি কিতাবের খাদ্য হালাল হওয়া সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতের মর্ম এই যে, তাদের যবেহ করা ঐসব পশু খাওয়া হালাল যাতে যবেহের নির্ধারিত শর্তগুলো পূর্ণ করা হয়েছে- যেমনিভাবে মুসলমানদেরকেও পূর্ণ করতে হয়। হাঁ তবে একথা সঠিকভাবে জানা যায় যে, যবেহকারী আল্লাহর নাম নিয়েছে বা নেয়নি কিংবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নাম নিয়েছে অথবা নেয়নি তবে তার যবেহ করা পশু খাওয়া হালাল। কেননা আমাদের জন্যে আল্লাহ তা‘আলা মুসলমান এবং আহলি কিতাবের যবেহ করা পশু হালাল করেছেন। বন্তুত আল্লাহ তা’আলা জানেন যে, আমরা প্রত্যেক যবেহকারী ব্যক্তির অবস্থঅ সম্পর্কে অবগত হতে পারি না। (আল-মুণনী : ৮ম খণ্ড, পৃ. ৫৭১)]
২. বিদ্যুত্ স্পর্শে যবেহ করা বা টিনবদ্ধ গোশত খাওয়া
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, আহলি কিতাব- ইয়াহুদ-খ্রিস্টানদের যবেহ করার নিয়ম কি আমাদের নিয়মের অনুরূপ হতে হবে? আমারা যেমন তীক্ষ্ণ অস্ত্র দ্বারা গলা কেটে দিই, ওদের যবেহেও কি এ রকমেরই হতে হবে?
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই এ ব্যাপারে এ শর্তটি আরোপ করেছেন। তবে মালিকী মাযহাবের আলেম জামায়াত ফতোয়া দিয়েছেন যে, তা জরুরী শর্ত নয়।
কাযী ইবনুল আরাবী সূরা আল-মায়িদার আয়াতের তাফরীরে বলেছেন :
একথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, আহলি কিতাবের শিকার ও খাবার আল্লাহর জায়েয হলে ঘোষিত জিনিসগুলোর মধ্যে গণ্য। তা নি:শর্তে হালাল। একথাটি বিশেষভাবে বলা হয়েছে, যেন এ ব্যাপারে সব শোবাহ সন্দেহ দূরীভূত হয়ে যায়, ভুল ধারণার লেশমাত্র অবিশষ্ট না থাকে। আমার নিকট জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, খ্রিস্টানরা মুরগীর গলা মুচড়িয়ে দিয়ে মারে। পরে তারা তা রান্না করে। এরূপ অবস্থায় কি আমরা তাদের সাথে খাবারে শরীক হতে পারি? ওদের খাবার কি খাওয়া যেতে পারে? আমি বললাম, খাওয়া যেতে পারে। কেননা তা খ্রিস্টান এবং তাদের পাদ্রী-পণ্ডিতদের খাবার। যদিও আমাদের মতে যবেহ করার এ নিয়াম ঠিক নয়। কিন্তু আল্লাহ তো ওদের খাবার আমাদের জন্যে সাধারণভাবে হালাল করে দিয়েছেন। আর ওরা ওদের দ্বীনে যেখানেই জায়েয মনে করে, তা আমাদের জন্যেও হালাল। তবে সে সব আহার্য আল্লাহ তাআলা ওদেরকে মিথ্যাবাদী বলেছেন, সেগুলো খাওয়া যাবে না। আমাদের বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, এ আহলি কিতাবরা ওদের কন্যাদের আমাদের কাছে বিয়ে দেয়। তাদের সাথে সঙ্গম জায়েয। এমতবস্থায় ওদের যবেহ করা জন্তু আমরা খাব না কেন? হালাল-হারামের দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হলে যৌন সঙ্গমের তুলনায় খাদ্য খাওয়ার ব্যাপারটি অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
এ তাফসীরকারই অপর এক স্থানে লিখেছেন :
ওরা যবেহ করে না, গলায় ফাঁস দিয়ে বা মাথা নিষ্পেষিত করে মারে । তারপর ওরা তা খায়। এ কারণে তা আমাদের জন্য মুর্দার ও হারাম। কিন্তু ও (নাজায়েয হওয়া ও উপরে বর্ণিত জায়েয হওয়ার) ব্যাপারদ্বয়ের মাঝে কোন বৈপরীত্য নেই। কেননা আহলি কিতাব যেটিকে সঠিক যবেহ মনে করে তা খাওয়া আমাদের জন্যে অবশ্যই হালাল হবে। যদিও আমাদের দৃষ্টিতে ওদের যবেহ করার এ নিয়ম ঠিক নয়। কিন্তু যে সম্পর্কে ওরা নিজেরাই মনে করে, এ যবেহটা ঠিক নয়, তা আমাদের জন্যেও হালাল নয়। যবেহ অর্থ জন্তুটির প্রাণ বের করা হবে ওটি খাওয়া হালাল-করণের ইচ্ছায়।’
মালিকী মাযহাবের অনুসারী একটি জামায়াতের এই মত।
এ আলোচনার আলোকে আমরা আহলি কিতাব লোকদের টিনবন্দী ও সংরক্ষিত মোরড় বা গরুর গোশত সম্পর্কিত শরীয়তের নির্দেশ বুঝতে পারি। ওদের দেশে মোরগগুলো বিদ্যুত্ স্পর্শে যবেহ করার কাজ করা হয়। এ গুলোকে ওরা নিজেরা যতক্ষণ হালাল খাদ্য মনে করতে থাকবে, আয়াতটির সাধারণ ঘোষণা অনুসারে তা আমাদের জন্যে হালাল বিবেচিত হতে থাকবে। [কিন্তু এ কথাটি সর্ববাদীসম্মত নয়। সাধারণভাবেই জানা আছে যে, টিনবন্দী গোশত শরীয়ত মুতাবিক যবেহ করা জন্তু বা প্রাণীর নয়। এক কোপে কাটা বা যবেহ করার সময় সচেতনভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি, তা কেবলমাত্র আহলি কিতাব লোকদের মনে করলেই আমাদের জন্যেও হালাল হতে পারে না। সাধারণত যে রকমটা হয়ে থাকে, সে দৃষ্টিতে ফতোয়া দেয়া আবশ্যক। তাই যে জন্তু শরীয়তসম্মত নিয়মে যবেহ করা হয়নি তা খাওয়া জায়েয নয়। তার যবেহকারী মুসলিম হলেও নয়। -(অনুবাদক)]
তবে কমিউনিষ্ট দেশসমূহে তৈরী টিনবন্দী গোশত খাওয়া আমাদের জন্যে আদৌ জায়েয হতে পারে না। কেননা ওরা ধর্ম নামের সব কিছুকেই অবিশ্বাস ও অস্বীকার করেছে। কাজেই ওরা আহলি কিতাব এর মধ্যে গণ্য নয়।
অগ্নি পূজক প্রভৃতির যবেহ করা জন্তু
অগ্নিপূজক বা প্রাচীন পারসিক ধর্মাবলম্বীদের যবেহ করা জন্তুর গোশত খাওয়া সম্পর্কে ইলমওয়ালারা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। অনেকেই তা খেতে নিষেধ করেছেন কেননা ওরা আসলে মুশরিক। অপরাপর মণীষীরা বলেছেন, তা খাওয়া হালাল। কেননা নবী করীম (সা) বলেছেন : (আরবী******************)
ওদের সাথে আহলি-কিতাব সুলভ আচরণ করো। (মালিক, শাফী)’
এ কারণেই হিজর নামক স্থানের অগ্নিপূজারীদের কাছ থেকে জিযিয়া নেয়া হয়েছিল। (বুখারী)
ইবনে হাজম তাঁর আল-মুহলা গ্রন্থে লিখেছেন : (আরবী**********************)
ওরাও আহলি কিতাব। অতএব সর্ব ব্যাপারে ওদের সাথে আহলি কিতাবের ন্যায় আচরণ গ্রহণ করতে হবে। [জমহুর আলিমদের মতে মজুসী- অগ্নিপূজক বা পারসিকদের যবেহ করা জন্তু খাওয়া জায়েয নয়। হযরত ইবনে মাসউদ, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত আলী, হযরত জাবির, ইমাম মালিক, ইমাম জুহরী, ইমাম শাফিয়ী, হানাফী ফিকাহবিদগণ এবং ইমাম আহমদ প্রমুখ এ মত প্রকাশ করেছেন। ইবনে কুদামাহর মতে নবী করীম (সা) এর উপরিউক্ত উক্তি ‘ওদের সাথে আহলি কিতাবের ন্যায় আচরণ গ্রহণ কর‘ কথাটি কেবলমাত্র জিযিয়া ধার্য করা পর্যায়ে প্রযোজ্য। ওদের যবেহ করা জন্তু খাওয়া ও ওদের মেয়ে বিয়ে করার ব্যাপারে এ নির্দেশ নয়। (আরবী************************)
আল্লামা জাসসাস বলেন, মুজসীদের সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ ফিকাহবিদের মতে ওরা আহলি কিতাব নয়। খুব কম লোকই ওদের আহলি কিতাব মনে করে। কুরআনে মাত্র দুটি সম্প্রদায়কে আহলি কিতাব বলা হয়েছে। মজুসীদেরও আহলি কিতাব গণ্য করে দুটির পরিবর্তে তিনটি সম্প্রদায়ের কথা বলা হতো। নবী করীম (সা) ও ওরা আহলি কিতাব একথা বলেনে নি। আহলি কিতাবের ন্যায় আচরণ করতে বলেছেন মাত্র। আর তাও ওদের কাছ থেকে জিযিয়া আদায় করার ব্যাপারে । (আরবী*********) – অনুবাদক।]
ইমাম আবু হানিফার মতে ছাবী ধর্মাবলম্বীরা আহলী কিতাব। (অনেকে ব্রাহ্মণদেরও আহলি কিতাব মনে করে। বলা হয়, ওদের প্রতি কিতাব নাযিল হয়েছিল, যদিও তারা হারিয়ে ফেলেছে।)
দৃষ্টির অন্তরালবর্তী জিনিসের খোঁজ করা অনাবশ্যক
যা চোখের অন্তরালে অবস্থিত, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা ও খোঁজ খবর লওয়ার জন্যে চেষ্টা করা- কিভাবে যবেহ করা হয়েছে, যবেহের সব কয়াটি শর্ত পূর্ণ হয়েছে কিনা, যবেহ কালে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে কিনা- এ ধরণের অজানা বিষয়সমূহ জানতে চেষ্টা করা মুসলিম ব্যক্তির দায়িত্বভুক্ত নয়। কেননা মুসলিম ব্যক্তি যবেহ করে থাকলে অপরাপর অজানা বিষয়াদি- সে অজ্ঞ-মূর্খ, ফাসিক বা কিতাবী- যাই হোক না কেন, তা খাওয়া সম্পূর্ণ হালাল। পূর্বেই বলা হয়েছে, সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূল, লোকেরা আমাদের কাছে গোশত নিয়ে আসে, তারা যবেহ কালে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেছে, কি করেনি তা আমরা জানি না, এ অবস্থায় কি করব? রাসূল বললেন : তোমরা বিসমিল্লাহ বলে আহার কর।
এ হাদীস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন :
এ হাদীসটি প্রমাণ করে যে, কাজ কর্ম ও হস্তক্ষেপ ইত্যাদি সব কিছুই যথার্থ ও ঠিকঠাক আছে মনে করতে হবে, যতক্ষণ তার খারাপ বা বাতিল হওয়ার অকাট্ট দলিল পাওয়া যাবে।