জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি

ইসলামে হালাল হারামের বিধান

অন্তর্গতঃ উচ্চতর অধ্যয়ন, ফিকাহ
Share on FacebookShare on Twitter

সূচীপত্র

  1. অনুবাদকের কথা
    1. গ্রন্থকারের ভূমিকা
  2. প্রথম অধ্যায়
    1. সংজ্ঞা
      1. ১. সব জিনিসের ব্যাপারেই মৌল নীতি হচ্ছে– তা মুবাহ
      2. ২. হালাল–হারাম ঘোষণা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহ্‌র
      3. ৩. হালালকে হারাম ও হারামকে হালালকরণ শির্‌ক পর্যায়ে অপরাধ
      4. ৪. হারাম জিনিস ক্ষতিকর
      5. ৫. হালাল যথেষ্ট, হারাম অপ্রয়োজনীয়
      6. ৬. হারাম কাজের নিমিত্তও হারাম
      7. ৭. হারাম কাজে কৌশল অবলম্বনও হারাম
      8. ৮. নিয়ত ভাল হলেই হারাম হালাল হয় না
      9. ৯. হারাম থেকে দূরে থাকার জন্যে সন্দেহপূর্ণ কাজ পরিহার
      10. ১০. হারাম সকলেরই জন্যে
      11. ১১. প্রয়োজন নিষিদ্ধকে বৈধ করে
  3. দ্বিতীয় অধ্যায়
    1. মুসলিমের ব্যক্তিগত জীবনে হালাল–হারাম
      1. ব্রাহ্মণদের দৃষ্টিতে পশু যবাই করা ও খাওয়া
      2. ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের দৃষ্টিতে হারাম জন্তু
      3. ইসলাম পূর্ব যুগের আরবদের অবস্থা
      4. ইসলাম পবিত্র জিনিসগুলো মুবাহ করেছে
      5. মৃত জন্তুর হারাম হওয়ার কারণসমূহ
      6. প্রবাহিত রক্ত হারাম কেন
      7. শূকরের গোশত
      8. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্যে উৎসর্গিত জন্তু
      9. কয়েক প্রকারের মুর্দার
      10. এসব মুর্দার হারাম করার কারণ
      11. দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া জন্তু
      12. মাছ ও পঙ্গপাল সম্পর্কে স্বতন্ত্র বিধান
      13. মৃত জন্তুর চামড়া, অস্থি ও পশম ব্যবহার
      14. ঠেকার অবস্থায় স্বতন্ত্র হুকুম
      15. চিকিৎসার প্রয়োজনে
      16. সামষ্টিক পর্যায়ে প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা থাকলে ব্যক্তি–প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকে না
      17. যবেহ করার শরীয়তসম্মত পন্থা
      18. সামুদ্রিক জীব সবই হালাল
      19. স্থলভাগের হারাম জীব-জন্তু
      20. গৃহপালিত জন্তু হালাল হওয়ার জন্যে যবেহ করা শর্ত
      21. শরীয়ত অনুযায়ী যবেহ করা শর্ত
      22. যবেহ করার এ নিয়মের তাত্পর্য
      23. যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণের তাত্পর্য
      24. ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের যবেহ করা জন্তু
      25. ১. গির্জা ও মেলাতে হারের জন্যে যবেহ করা জন্তু
      26. ২. বিদ্যুত্ স্পর্শে যবেহ করা বা টিনবদ্ধ গোশত খাওয়া
      27. অগ্নি পূজক প্রভৃতির যবেহ করা জন্তু
      28. দৃষ্টির অন্তরালবর্তী জিনিসের খোঁজ করা অনাবশ্যক
    2. শিকার
      1. শিকারী সম্পর্কিত কথা
      2. শিকার প্রাণী সম্পর্কিত শর্ত
      3. শিকার করার উপায়
      4. শানিত অস্ত্র দ্বারা শিকার করা
      5. কুকুর দ্বারা শিকার করা
      6. তীর নিক্ষেপের পর শিকার মৃতাবস্থায় পাওয়া
    3. মদ্য
      1. সমস্ত মাদক দ্রব্যই হারাম
      2. মাদক দ্রব্য মাত্রই হারাম- অল্প হোক কি বেশি
      3. সুরার ব্যবসা
      4. মুসলমান সুরা উপঢৌকন দিতে পারে না
      5. সুরা পানের আসর পরিহার করা
      6. সুরা রোগ- ঔষধ নয়
      7. চেতানা নাশক দ্রব্যাদি
      8. ক্ষতিকর জিনিস মাত্রই হারাম
    4. পোশাক পরিচ্ছদ
      1. পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য বিধায়ক দ্বীন
      2. স্বর্ণ ও রেশমী কাপড় পুরুষদের জন্যে হারাম
      3. রেশম ও স্বর্ণ ব্যবহার পুরুষদের জন্যে হারাম করার কারণ
      4. মহিলাদের জন্যে তা হালাল কেন
      5. মুসলিম মহিলার পোশাক
      6. নারী ও পুরুষের মাঝে সাদৃশ্য সৃষ্টি
      7. খ্যাতি ও অহংকারের পোশাক
      8. মাত্রাতিরিক্ত সৌন্দর্যের জন্যে আল্লাহ্ সৃষ্টি বিকৃতকরণঃ
      9. দেহে চিত্র অংকন, দাঁত শানিতকরণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে অপারেশন করান
      10. ভ্রূ সরুকরণ
      11. চুলে জোড়া লাগান
      12. খেজাব লাগন
      13. দাড়ি বাড়ানো-লম্বাকরণ
    5. ঘর-বসবাসের স্থান
      1. বিলাসিতা ও পৌত্তলিকতার প্রকাশ
      2. স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্র
      3. ইসলামে প্রতিকৃতি হারাম
      4. ছবি ও প্রতিকৃতি হারাম করার কারণ
      5. মহাপুরুষদের স্মৃতিরক্ষার উপায়
      6. শিশুদের খেলনায় দেষ নেই
      7. অসম্পূর্ণ ও বিকৃত প্রতিকৃতি
      8. বিদেহী ছবি-প্রতিকৃতি
      9. ছবির প্রতি অমর্যাদাই তাকে জায়েয  করে
      10. ফটোগ্রাফীর ছবি
      11. ছবির উদ্দেশ্য
      12. ছবি-প্রতিকৃতি ও তার নির্মাতা সম্পর্কিত বিধানের সার-নির্যাস
      13. বিনা প্রয়োজনে কুকুর পালা
      14. শিকার ও পাহারাদারির জন্যে কুকুর রাখা
      15. আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কুকুর পালন
    6. উপার্জন ও পেশা
      1. কর্মক্ষম ব্যক্তির নিষ্কর্মা বসে থাকা হারাম
      2. ভিক্ষাবৃত্তি জায়েয হয় কখন
      3. শ্রম সম্মানজনক
      4. কৃষিকার্য দ্বারা উপার্জন
      5. হারাম কৃষিকার্য
      6. শিল্প ইত্যাদি
      7. নিষিদ্ধ কজ ও পেশা
      8. বেশ্যাবৃত্তি
      9. নৃত্য ও যৌন শিল্পকর্ম
      10. ভস্কর্য, প্রতিকৃতি ও ক্রুশ নির্মাণ মিল্প
      11. মাদক ও জ্ঞান-বুদ্ধির বিনষ্টকারী দ্রব্যাদি দশিল্প
      12. ব্যবসা করে উপার্জন করা
      13. ব্যবসা সম্পর্কে গির্জার ভূমিকা
      14. হারাম ব্যবসা
      15. চাকরি
      16. হারাম চাকরি
      17. উপার্জন পর্যায়ে সাধারণ নিময়
  4. তৃতীয় অধ্যায়
    1. স্বাভাবিক কামনা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রসীমা
      1. যৌন স্পৃহা পর্যায়ে মানুষের ভূমিকা
      2. জ্বেনার কাছেও যাবে না
      3. ভিন মেয়েলোকের সাথে নিভৃতে সাক্ষাৎ হারাম
      4. বিপরীত লিঙ্গের প্রতি লালসার দৃষ্টিতে তাকান
      5. লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ হারাম
      6. পুরুষ বা নারীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ
      7. নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ সমস্যা
      8. নারীদের সতর
      9. সাধারণ গোসলখানায় নারীর প্রবেশ
      10. নারীদের উলঙ্গতা-উচ্ছৃঙ্খলতা হারাম
      11. কোন্ অবস্থায় ‘তাবাররুজ’ হয় না
      12. স্ত্রীর স্বামীর মেহমানদের খেদমত করা
      13. প্রকৃতি বিরোধী কাজ কবীরা গুনাহ
      14. হস্তমৈথুন
      15. ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই
      16. প্রস্তাবিত কনেকে দেখা
      17. বিয়ের পয়গাম দেয়ার হারাম পন্থা
      18. কুমারী কন্যার অনুমতি, তার ওপর জোর না করা
      19. মুহাররম মেয়েলোক
      20. এ সব মেয়ে বিয়ে করা হারাম হওয়ার কারণ
      21. দুগ্ধ সেবনের কারণে বিয়ে হারাম হওয়া
      22. বৈবাহিক সম্পর্কের দরুন বিয়ে হারাম
      23. দুই বোনককে এক সঙ্গে স্ত্রী বানান
      24. পরস্ত্রী
      25. মুশরিক নারী
      26. আহলি কিতাব নারী
      27. অমুসলিম পুরুষের সাথে মুসলিম নারীর বিয়ে
      28. ব্যভিচারে অভ্যস্ত নারী
      29. সাময়িক বিয়ে
      30. একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ
      31. একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের শর্ত- সুবিচার
      32. একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতির যৌক্তিকতা
      33. স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক
      34. স্বামী-স্ত্রীর সংবেদনশীল সম্পর্ক
      35. গুহ্যদ্বার পরিহার
      36. স্বামী-স্ত্রীর গোপন তত্ত্ব সংরক্ষণ
      37. পরিবার পরিকল্পনা
      38. কোন্ অবস্থায় পরিবার পরিবার পরিকল্পনা জায়েয
      39. গর্ভপাত ঘটানো
    2. স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক অধিকার
      1. স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ধৈর্য ধারণ
      2. স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ দেখা দিলে
      3. কেবল এরূপ অবস্থায়ই তালাক দেয়া যেতে পারে
      4. ইসলামের পূর্বে তালাক প্রথা
      5. ইয়াহূদী ধর্মে তালাক
      6. খ্রিস্ট ধর্মে তালাক
      7. তালাকের ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্মের ভিন্নমত
      8. তালাকের ব্যাপারে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসৃত নীতির পরিণাম
      9. তালাক পর্যায়ে খ্রিস্ট ধর্মের স্বতন্ত্র ভূমিকা
      10. খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষা সাময়িক
      11. তালাকের ব্যাপারে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ
      12. হায়েয অবস্থায় তালাক দেয়া হারাম
      13. তালাকের কসম খাওয়া হারাম
      14. তালাকপ্রাপ্তা স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করবে
      15. এক তালাকের পর আর এক তালাক
      16. তালাক প্রাপ্তকে ইচ্ছামত বিয়ে করতে বাধা দেবে না
      17. স্বামীর প্রতি ঘৃণা সম্পন্না স্ত্রীর অধিকার
      18. স্ত্রীকে জ্বালাতন করা হারাম
      19. স্ত্রী পরিত্যাগের ‘কসম খাওয়া’ হারাম
    3. পিতামাতা ও সন্তানদের সম্পর্ক
      1. বংশ সংরক্ষণ
      2. নিজ সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করা জায়েয নয়
      3. পালক পুত্র গ্রহণ হারাম
      4. পালক-পুত্র ব্যবস্থার বাস্তবভাবে রহিতকরণ
      5. কৃত্রিম উপায় গর্ভ সৃষ্টি
      6. প্রকৃত পিতা ছাড়া অন্য কাউকে পিতা বলা
      7. সন্তান হত্যা করো না
      8. সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা
      9. মীরাস বন্টনে আল্লাহর আইন পালন
      10. পিতামাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্নকরণ
      11. পিতামাতাকে গালাগাল দেয়ার কারণ ঘটানোও কবীরা গুণাহ
      12. পিতামাতার অনুমতি ছাড়া জিহাদে যাওয়া
      13. মুশরিক পিতামাতার সাথে ব্যবহার
  5. চতুর্থ অধ্যায়
    1. আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মীয় অন্ধ অনুসরণ
      1. আল্লাহর সুন্নাতের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা
      2. কুসংস্কার ও ভিত্তিহীন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই
      3. গণকদারকে বিশ্বাস করা কুফর
      4. পাশার দ্বারা ভাগ্য জানতে চাওয়া
      5. যাদুবিদ্যা
      6. তাবীজ ব্যবহার
      7. খারাপ লক্ষণ গ্রহণ
      8. জাহিলী অন্ধ অনুসরণের বিরুদ্ধে জিহাদ
      9. বিদ্বেষমূলক ভাবধারা ইসলামের বিপরীত
      10. বংশ ও বর্ণের কোন গৌরব নেই
      11. মৃতের জন্যে বিলাপ
    2. পারস্পরিক কার্যাদি
      1. হারাম জিনিস বিক্রয় করা হারাম
      2. ধোঁকাপূর্ণ বিক্রয় হারাম
      3. দ্রব্যমূল্য লয়ে খেলা করা
      4. পণ্য মজুদকারী অভিশপ্ত
      5. বাজারের স্বাধীনতায় কৃত্রিম হস্তক্ষেপ
      6. দালালী জায়েয
      7. মুনাফাখোরি ও ধোঁকাবাজি হারাম
      8. যে ধোঁকাবাজি করল সে আমাদের নয়
      9. বারবার কিরা-কসম করা
      10. মাপে-ওজনে কম করা
      11. চোরা মাল ক্রয়
      12. সুদ হারাম
      13. সুদ হারামকরণের যৌক্তিকতা
      14. সুদদাতা ও সুদী দলিলের লেখক
      15. ঋণ লওয়া থেকে নবী পানা চাইতেন
      16. বেশি মুল্যে বাকী ক্রয়
      17. আগে মূল্য দেয়া ও পরে পণ্য গ্রহণ
      18. শ্রম ও মূলধনের পারস্পরিক সহযোগিতা
      19. বীমা কোম্পানী
      20. বীমা কোম্পানী কি পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা
      21. পরিবর্তন ও সংশোধনী
      22. ইসলামে বীমা পদ্ধতি
      23. কৃষি জমিতে ফসল উৎপাদন
      24. জমি কাজে লাগাবার নানা উপায়
      25. দ্বিতীয় পন্থা
      26. ভাগে জমি চাষ
      27. ভুল নীতিতে পারস্পরিক চাষাবাদ
      28. নগদ টাকায় জমি লাগানো
      29. নগদ মূল্যে জমি লাগানো নিষিদ্ধ হওয়ার যৌক্তিকতা
      30. পশুপালনে শরীকানা
    3. ক্রীড়া ও আনন্দ
      1. প্রতি মুহূর্তে একই অবস্থা থাকে না
      2. রাসূল তো মানুষ ছিলেন
      3. মন ক্লান্ত হয়ে পড়ে
      4. জায়েয ধরনের খেলা
      5. দৌড় প্রতিযোগিতা
      6. কুস্তি করা
      7. তীর নিক্ষেপ
      8. বল্লম চালানো
      9. ঘোড় সাওয়ারী
      10. শিকার করা
      11. পাশা খেলা
      12. দাবা খেলা
      13. গান ও বাদ্যযন্ত্র
      14. জুয়া-সুরা-সঙ্গী
      15. লটারীও এক প্রকার জুয়া
      16. সিনেমা দেখা
    4. সামাজিক সম্পর্ক
      1. মুসলমান ভাইর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না
      2. পারস্পরিক সন্ধি সমঝোতাকরণ
      3. অন্যদের বিদ্রুপ করা ঠিক নয়
      4. দুর্নাম করা, দোষী করা
      5. খারাপ উপাধিতে ডাকা
      6. খারাপ ধারণা
      7. দোষ খুঁজে বেড়ান
      8. গীবত
      9. গীবতের অনুমতি-সীমা
      10. চোগলখোরী
      11. মান-সম্মান সংরক্ষণ
      12. রক্তের মর্যাদা
      13. হন্তা ও নিহত উভয়েই জাহান্নামী
      14. চুক্তি সম্পন্ন ও যিম্মী ব্যক্তির রক্ত মর্যাদা
      15. রক্তের মর্যাদা কখন থাকে না
      16. আত্মহত্যা
      17. ধন-মালের মর্যাদা
      18. ঘুষ হারাম
      19. শাসক – প্রশাসকদের জন্যে উপটৌকন
      20. জুলুম বন্ধের জন্যে ঘুষ দেয়া
      21. নিজেদের ধন-মাল অপব্যয় করা
      22. অমুসলিমের সাথে সম্পর্ক
      23. আহলি কিতাবের প্রতি বিশেষ সুবিধা দান
      24. যিম্মি
      25. অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কের রূপ
      26. অমুসলমানের কাছে সাহায্য চাওয়া
      27. ইসলাম একটা সাধারণ রহমত
  6. উপসংহার

পারস্পরিক কার্যাদি

আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে এমন প্রকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন যে, তারা পরস্পরের কাছে ঠেকা, পরস্পরের সাহায্যের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তির যা কিছু প্রয়োজন তা যোগাড় করা তার একার পক্ষে কখখনই সম্ভবপর হয় না। কেউ হয়ত কোন জিনিসের অধিকারী, যা অপর কারো প্রয়োজন পূরণ করে এবং কেউই হয়ত এমন জিনিসের মুখাপেক্ষী যা অপর কারো কাছে পাওয়া যায়। এ করণে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে পণ্য ও মুনাফা বিনিময় করণের ব্যবস্থা মেনে চলার ভাবধারা জাগিয়ে দিলেন। এভাবেই মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ হয়ে থাকে এবং এ করেই মানব জীবন দৃঢ়তা লাভ করে। এ শুধু ব্যক্তিগণের পারস্পরিক ব্যাপারই নয়, জাতি ও রাষ্ট্রসমূহও পারস্পরিক কল্যাণ ও উৎপাদনের ফসল বিনিময় করে চলতে পারে।

নবী করীম (সা) যখন প্রেরিত হলেন তখন আরব সমাজে নানা প্রকারের ক্রয়-বিক্রয় ও পারস্পরিক লেন-দেন চলছিল। তখন ইসলামী শরীয়তের অনুকূল ব্যবস্থা ও কার্যাদি চালু রাখা হলো, তা জায়েয বলে ঘোষিত হলো, এবং যা যা শরীয়তের পরিপন্থী ছিল, তা সবই হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। এ নিষেধ কয়েক পর্যায়ে বিভক্ত। যেমন কোন গুনাহের কাজে, ধোঁকা-প্রতারণার কাজে, অধিক মূল্য ও মুনাফা লুণ্ঠনের কাজে এবং চুক্তির পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোন এক পক্ষের ওপর জুলুম হওয়ার কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা করা।

হারাম জিনিস বিক্রয় করা হারাম

ক. নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষিত দ্রব্যাদি ব্যবহার করা ও তা থেকে উপকার গ্রহণও হারাম এবং গুহান পর্যায়ের কাজ। এ কারণে তা ক্রয় বা বিক্রয় করা কিংবা তার ব্যবসা করা হারাম। শূকর, মদ্য, হারাম খাদ্য-পানীয়, মূর্তি, ক্রুশ, প্রতিকৃতি (Statue) প্রভৃতি এ পর্যায়ে গণ্য। এসব জিনিসের ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা ‍যদি জায়েয করে দেয়া হতো তাহলে গুনাহের এসব কাজ ব্যাপক প্রসারতা লাভ করত। জনগণকে সেই কাজে উদ্বুদ্ধ করা হতো, তা করার জন্যে সহজতার সৃষ্টি করা হতো, লোকদের তার কাছে নিয়ে যাওয়া হতো। সেজন্যে লোকদের উৎসাহিত করা হতো। কিন্তু যেহেতু এসব জিনিসের ক্রয়-বিক্রয় ও তা অর্জন হারাম করে দেয়া হয়েছে। ফলে মানুষ এসব থেকে বেঁচে থাকতে পারে। এক্ষণে এসব জিনিসের দিকে লোকদের না দৃষ্টি পড়তে পারে, না তা স্মরণ করার কোন কারণ ঘটতে পারে। এসব জিনিসের সংস্পর্শ থেকেই মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাওয়া হয়েছে। এজন্যেই নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)

আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল মদ্য, মৃত জীব, শূকর ও মূর্তি বিক্রয় করা হারাম করে দিয়েছেন। (বুখারী, মুসলিম)

এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)

আল্লাহ্ যখন কোন জিনিস হারাম করেন তখন সে জিনিসের বিক্রয় মূল্যও হারাম করে দেন। (আহমদ, আবূ দাউদ)

ধোঁকাপূর্ণ বিক্রয় হারাম

খ. যে ধরনের বিক্রয়ে পণ্য অজ্ঞাত বা ধোকা হওয়ার কিংবা এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে ক্ষতি সাধনের সুযোগের কারণে পারস্পরিক ঝগড়া হওয়ার আশংকা থাকে, তা ‘কারণ বন্ধের’ নীতি অনুযায়ী নিষিদ্ধ। যেমন পুরুষ উষ্ট্রের পৃষ্ঠের যে জিনিস বা উষ্ট্রী গর্ভে যে বাচ্চা রয়েছে, তা বিক্রয় করা কিংবা উড়ন্ত পাখি বা পানির মধ্যে অবস্থিত মাছ অথবা এ ধরনের অজানা পণ্য ক্রয় ও বিক্রয় করা।

নবী করীম (সা)-এর সময়ে ক্ষেতের ফসল বা বাগানের ফল পাকার পূর্বেই বিক্রয় করে দেয়া হতো। বিক্রায় সাব্যস্ত হওয়ার পর অনেক সময় নৈসর্গিক কারণে ফল ধ্বংস হয়ে যেত, ফসল বিনষ্ট হতো, ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে ঝগড়ার সৃষ্টি হতো। বিক্রয়কারী বলত, আমি তো বেঁচে দিয়েছে। ক্রেতা বলত, যে ফল বিক্রয় করেছ, সেই ফল-ই নেই। এ কারণে নবী করীম (সা) ফল-ফসল পাঁকার পূর্বে বিক্রয় করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে ফল কাটা সাব্যস্ত হলে তা জায়েয হতে পারে। শস্যের মঞ্জরী বা শিষ সাদা হওয়া ও বিপদমুক্ত হওয়ার পূর্বে বিক্রয় করতেও নিষেধ করা হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)

তোমরা কি চিন্তা করেছ, আল্লাহই যখন ফল বন্ধ করে দিলেন, তখন তোমাদের ভাইর টাকা লওয়া তোমাদের জন্যে কিভাবে জায়েয হতে পারে?

অজ্ঞাত পণ্য মাত্রই যে ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ এমন কথা নয়। কোন কোন ব্যাপারে পণ্যের অনেকাংশ অজানা অন্ধকারে থেকে যায়। যেমন কেউ যদি কোন পাকা বাড়ি ক্রয় করে, তাহলে তার ভিত্তি ও প্রাচীরসমূহের ভিতরকার অবস্থা ক্রেতার অগোচরেই থেকে যায়। সে বিষয়ে কিছু জানা তার পক্ষে সম্ভবপর হয় না। কিন্তু তার অন্যান্য সবদিকই ক্রয়কারী ভাল করে দেখতে পারে। কাজেই যে জিনিস সম্পূর্ণরূপে অজানা, যার কারণে পরস্পরে ঝগড়া বিবাদ হতে পারে কিংবা যার মধ্যে বাতিল পন্থায় লোকদের মাল ভক্ষণ করার অবকাশ থাকে, তা-ই নিষিদ্ধ।

যদি কোন জিনিস সামান্যভাবে অজানা হয়, আর এ আংশিক অজানা জিনিসের ক্রয়-বিক্রয়ের রেওয়াজ থাকে, তাহলে তার ক্রয়-বিক্রয় যথা মূলা, গাজর, পিয়াজ প্রভৃতি কাকই ও ফুটি-তরমুজের ক্ষেত বিক্রয়। ইমাম মালিকের মতে প্রয়োজনের কারণে তা জায়েয। কেননা তাতে অজ্ঞানতার ক্ষেত্র খুব ব্যাপক নয়, অতি সাধারণ এবং সামান্য।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে ইমাম মালিকের নীতি অন্যান্যের নীতির তুলনায় উত্তম কেননা তাঁর নীতি সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিবের মতের ওপর ভিত্তিশীল। আর ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিষয়াদিতে তিনি বড় ফিকাহবিদ বলে মান্য। ( আরবি******************)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মতও এরই কাছাকাছি।

দ্রব্যমূল্য লয়ে খেলা করা

ইসলাম বাজার ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে ইচ্ছুক। হাট-বাজার স্বাভাবিকভাবে চলতে পারলেই দ্রব্যমূল্য আপনা থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে, বাজারে পণ্য আমদানী ও তার চাহিদা অনুপাতে দ্রব্যমূল্যে উত্থান-পতন হতেই থাকে। আমরা নবী করীমের যুগে তাই দেখতে পাই। তখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে লোকেরা এসে বললঃ ইয়া রাসূল, আমাদের জন্যে দ্রব্যমূল্য ‍নির্ধারিত করে দিন। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ ( আরবি******************)

প্রকৃতপক্ষে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণকারী হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলাই। তিনিই মূল্য বৃদ্ধি করেন, তিনি সস্তা করেন। রিযকদাতা তিনিই। আমি তো আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে চাই এ অবস্থায় যে, কোনরূপ জুলুম, রক্তপাত বা ধন-মালের অপহরণ ইত্যাদির দিক দিয়ে আমার ওপর দাবিদার কেউ থাকবে না। (আহমদ, আবূদাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

নবী করীম (সা) এ হাদীসের মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন যে, ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর কোনরূপ প্রয়োজন ছাড়াই হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ চাপান জুলুম এবং সেই জুলুম থেকে মুক্ত ও পবিত্র থেকেই তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে চান।

কিন্তু বাজারদরের ওপর ‍যদি অস্বাভাবিক অবস্থায় চাপ আসে, যেমন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুদকরণ শুরু হয়ে যায় এবং মজুদদাররা দ্রব্যমূল্য নিয়ে খেলা করতে শুরু করে, তাহলে সমষ্টির কল্যাণ স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে ‍দিতে হবে। তাতে অধিক মূল্য গ্রহণকারীর শোষণ থেকে জনগণকে বাঁচান সম্ভবপর হবে।

অতএব উপরিউক্ত হাদীসের অর্থ এই নয় যে, যে কোন পরিস্থিতিতেই দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ জুলুম ও তা নিষিদ্ধ- লোকদের কষ্ট দূর করা বা সুস্পষ্ট জুলুম থেকে লোকদের বাঁচানর জন্যে হলেও। বরং ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, মূল্য নির্ধারণ দুরকমের হয়। এক প্রকারের মূল্য নির্ধারণে লোকদের ওপর জুলুম হয় এবং তা হারাম। আর এক অবস্থায় মূল্য নির্ধারণ সুবিচার ও ন্যায়পরতার দাবি তা অবশ্যই জায়েয এবং জরুরী।

অতএব অন্যায়ভাবে লোকদের ওপর যদি এমন মূল্য চাপিয়ে দেয়া হয় যাতে তারা রাজি নয়, কিন্তু মুবাহ জিনিস থেকে জনগণকে বিরত রাখা হয়, তাহলে তা হবে হারাম। পক্ষান্তরে লোকদের মধ্যে সুবিচার ও ইনসাফ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে যদি মূল্য নির্ধারিত করে দেয়া হয়- প্রচলিত দামে (standardprice) বিক্রয় করতে বাধ্য করা হয় কিংবা প্রচলিত বিনিময় মূল্যের অধিক গ্রহণ থেকে তাদের বিরত রাখা হয়, তাহলে তা করা শুধু জায়েযই নয়, ওয়াজিবও।

প্রথম অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রথমোক্ত হাদীসটি উদ্ধৃত। কাজেই লোকরা যখন প্রচলিত নিয়মে কোনরূপ জুলুম ও বাড়াবাড়ি ব্যতীতই দ্রব্য বিক্রয় করে ও পণ্যদ্রবের স্বল্পতার বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির করণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে গোটা ব্যাপারটাই আল্লাহর উপর সোপর্দ করা কর্তব্য। এরূপ অবস্থায় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে বিক্রয় করতে বাধ্য করা অকারণ বাড়াবাড়ি বৈ কিছু নয়।

আর দ্বিতীয় অবস্থায়- লোকদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা যদি পণ্যদ্রব্য বিক্রয় না করে অথবা চলতি মূল্যের অধিক দাবি করে, এরূপ অবস্থায় প্রচলিত দামে দ্রব্য বিক্রয় করাও ওয়াজিব। এ সময় দ্রব্য মূল্য নির্ধারিত করে দেয়ার অর্থ, প্রচলিত দাম লোকদের জন্যে বাধ্যতামূলক করে দেয়া। এরূপ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের অর্থ, আল্লাহ্ তা’আলা যে ন্যায়বিচারকে জরুরী ও বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন, তা মেনে চলতে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা।

( আরবি******************)

পণ্য মজুদকারী অভিশপ্ত

ইসলাম ক্রয়-বিক্রয় ও স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা (natural competition)-এর পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও লোকেরা স্বার্থপরতার ও লোভের বশবর্তী হয়ে পরের ওপর টেক্কা দিয়ে নিজের ধন-সম্পদের পরিমাণ স্ফীত করতে থাকবে, তা কিছুতেই বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। খাদ্যপণ্য ও জনগণের সাধারণ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ইত্যাদি সব ব্যাপারেই ইসলামের এ কঠোরতা। এ জন্যেই নবী রকীম (সা) পণ্য মজুদকরণের ব্যাপারে নানাভাবে কঠোর ও কঠিন ভাষায় নিষেধবাণী উচ্চারণ করেছেন। একটি হাদীসে তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)

যে লোক চল্লিশ রাত্রি কাল খাদ্যপণ্য মজুদ করে রাখল, সে আল্লাহ্ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহও নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে। (আহমদ, হাকেম)

নবী করীম (সা) আরও বলেছেনঃ –  ( আরবি******************)

অপরাধী ব্যক্তি ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখার কাজ করে না। (মুসলিম)

এ ‘অপরাধী’ কথাটি খুব সহজ অর্থে নয়। ‘যে-ই পণ্য মজুদ রাখার কাজ করে সে-ই অপরাধী’ কথাটি যথার্থ। কুরআন মজীদে ফিরাঊন, হামান প্রভৃতি বড় বড় কাফির ও খোদাদ্রোহীদের সম্পর্কে এ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)

নিশ্চয়ই ফিরাঊন ও হামান ও সে দুজনার সৈন্য-সামন্ত বড় বড় অপরাধী ছিল।

পণ্য মজুদকারীর মনস্তত্ত্ব ও বীভৎস মনোভাবের ব্যাখ্যা দিয়ে নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)

পণ্য মজুদকারী ব্যক্তি অত্যন্ত খারাপ লোক হয়ে থাকে। সে যদি শুনতে পায় যে, পণ্যমূল্য কমে গেছে, তাহলে তার খুব খারাপ লাগে। আর যদি শুনতে পায় যে, মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তা হলে খুবই উল্লসিত হয়ে উঠে। (রাজিন)

তিনি আরও বলেছেনঃ ( আরবি******************)

বাজারে পণ্য আমদানীকারক রিযক প্রাপ্ত হয়। আর পণ্য মজুদকারী হয়ে অভিশপ্ত।

তার কারণ হচ্ছে ব্যবসায়ীর মুনাফা লাভ দুইটির কোন একটি কারণে সম্ভবপর হয়। একটি হচ্ছে, সে পণ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখবে অধিক মূল্যে বিক্রয় করার আশায় অর্থাৎ পণ্য আটক করে রাখলে বাজারে তার অভাব তীব্র হয়ে দেখা দেবে এবং লোকেরা খুবই ঠেকায় পড়ে যাবে। তখন তার যে মূল্যই দাবি করা হবে তা যত বেশি ও সীমালংঘনকারীই হোক না কেন। তাই দিয়েই লোকেরা তা ক্রয় করতে বাধ্য হবে।

আর দ্বিতীয় হচ্ছে, ব্যবসায়ী পণ্য বাজারে নিয়ে আসবে এবং অল্প স্বল্প মুনাফা নিয়েই তা বিক্রয় করে দেবে। পরে এ মূলধন দিয়ে সে আরও অন্যান্য পণ্য নিয়ে আসবে। তাতেও সে মুনাফা পাবে। এ ভাবে তার ব্যবসা চলতে থাকতে ও পণ্যদ্রব্য বেশি কাটতি ও বিক্রয় হওয়ার ফলে অল্প অল্প করে মুনাফা করতে থাকবে। মুনাফা লাভের এই নীতি ও পদ্ধতিই সমাজ সমষ্টির পক্ষে কল্যাণকর। এতে বরকত বাড়ে। আর নবী করীম (সা) যেমন বলেছেন, এই ব্যবসায়ীই রিযিক প্রাপ্ত হয়।

পণ্য মজুদকরণ ও পণ্যদ্রব্য নিয়ে খেলা করা যে কত বড় অপরাধ, তা রাসূলে করীমের অপর একটি বাণী থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে। হযরত মাকার ইবনে ইয়ামার (রা) বর্ণনা করেছেন, তিনি যখন রোগাক্রান্ত হলেন তখন উমাইয়া প্রশাসক উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ তাঁকে দেখতে এলেন। তাঁকে সম্বধন করে বললেন, হে মাকাল, আপনি কি জানেন, আমি কোন হারাম রক্তপাত করেছি? বললেন, আমি জানি না। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি জানেন আমি মুসলমানদের পণ্যদ্রব্যের মধ্যে কোন হস্তক্ষেপ করেছি? বললেনঃ তাও আমি জানি না। পরে মাকাল লোকদের বললেনঃ আমাকে বসিয়ে দাও। লোকেরা তাঁকে বসেয়ে দিলেন এবং বললেনঃ হে উবায়দুল্লাহ! শুনুন, আমি একটি হাদীস আপনাকে শোনাচ্ছি, যা রাসূলে করীমের কাছ থেকে আমি মাত্র এক-দুইবার শুনিনি। তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)

মুসলিম জনগণের জন্যে পণ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্য যদি কেউ কোনরূপ হস্তক্ষেপ করে, তাহলে আল্লাহ্ তা’আলার অধিকার রয়েছে তিনি কিয়ামতের দিন তাকে আগুনের ওপর বসাবেন। (আহমদ, তাবারানী)

একথা শুনে উমাইয়া শাসক বললেনঃ আপনি কি নিজেই এই হাদীস রাসূলে করীম (সা)-এর মুখে শুনেছেন? বললেনঃ হ্যাঁ, এক-দুইবার নয়।

এসব হাদীস ও তার ইঙ্গিত-ইশারার ভিত্তিতে আলিমগণ এ মাসলা বের করেছেন যে, পণ্য মজুদকরণ দুটি শর্তে হারাম। একটি এইঃ

এমন এক স্থানে ও এমন সময় পণ্য মজুদ করা হবে যখন তার কারণে জনগণকে খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে।

আর দ্বিতীয় হচ্ছে, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হবে অধিক মূল্য হরণ, যার ফলে মুনাফার পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে।

বাজারের স্বাধীনতায় কৃত্রিম হস্তক্ষেপ

পণ্য মজুদকরণের মতো আরও একটি কাজ করতে নবী করীম (সা) নিষেধ করেছেন। আর তা হচ্ছে, শহরবাসীর গ্রামবাসীর কাছ থেকে মাল ক্রয় করে নেয়। তার রূপটা হচ্ছে, শহরের বাইরের লোক মাল নিয়ে শহরের বাজারে এল চলতি দামে বিক্রয় করে দেয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু শহরের লোক বললঃ এ মাল আমার কাছে রেখে যাও, পরে বেশি দামে বিক্রয় করে তোমাকে মূল্য ফেরত দেব। এমতাবস্থায় গ্রাম থেকে আশা লোকই যদি নিজে মাল বিক্রয় করত তাহলে তা সস্তায় বিক্রয় হতো। তাতে সে নিজেও মুনাফা লাভ করত এবং অন্যরাও- শহরের ক্রেতারাও লাভবান হতো।

সেকালের সমাজে এরূপ ক্রয়-বিক্রয়ের খুব বেশি ও ব্যাপক প্রচলন ছিল। হযরত আনাম বলেছেনঃ ( আরবি******************)

কোন শহরবাসী যেন গ্রামবাসীর পণ্য বিক্রয় না করে- এ বিষয়ে আমাদের নিষেধ করা হয়েছে। সে লোক তার নিজের ভাই, পিতা বা মাতাই হোক-না-কেন।

এ থেকে জানা গেল ইসলামে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও আত্মীয়তার চাইতে সামষ্টিক কল্যাণের গুরুত্ব অনেক বেশি।

নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)

কোন শহরের লোক যেন গ্রাম্য লোকের পণ্য বিক্রয় না করে। তোমরা লোকদের ছেড়ে দাও। আল্লাহ্ তাদের কারোর দ্বারা কাউকে রিযক দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।

রাসূলে করীম (সা)-এর এই কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে ব্যবসা পর্যায়ে একটা বড় মূলনীতি লাভ করা যাচ্ছে। তা হচ্ছে, বাজারে পণ্য ও স্বাভাবিক পন্থার বিনিময় প্রণালীকে নিজস্বভাবে কাজ করার অবাধ সুযোগ দিতে হবে। এ ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ না করা হলে স্বাভাবিক পন্থায়ই লোকেরা নিজের নিজের রিযক লাভ করতে সক্ষম হবে।

উপরিউক্ত হাদীসের সঠিক তাৎপর্য কি, তা হযরত ইবনে আব্বাসের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ ( আরবি******************)

বিক্রেতা ও ক্রেতার মাঝখানে কোন দালাল থাকবে না। (বুখারী)

তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, কেউ যখন তাকে মূল্য জানিয়ে দিল, তাকে উপদেশ দিল এবং  বাজারের অবস্থার সাথে তাকে পরিচিত করল এবং তাতে কোন মজুরী গ্রহণ না করল, তাহলে তাতে কোন দোষ নেই। কেননা তার এ উপদেশ দান একান্তভাবে আল্লাহর জন্যে। এ উপদেশ দান দ্বীনের অংশ; বরং তা-ই সম্পূর্ণ ও সমগ্র দ্বীন। সহীহ্ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছেঃ ( আরবি******************) দ্বীনই হচ্ছে নসীহত বা নসীহতই হচ্ছে দ্বীন।

অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)

তোমাদের কেউ উপদেশ চাইলে তার ভাইকে উপদেশ দেয়া তার কর্তব্য।

‘দালাল’ সাধারণতঃ তার মজুরী পাওয়ার জন্যেই লালায়িত হয়। আর এসব ব্যাপারে সে সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা প্রায়ই ভুলে যায়।

দালালী জায়েয

অন্যান্য কাজে দালালী করা হলে, তাতে কোন দোষ নেই। কেননা তা একপ্রকার পথ-প্রদর্শন, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন এবং মাধ্যম হওয়ার ব্যাপার। তার দরুন উভয় পক্ষই উপকৃত হয়। উভয় পক্ষেরই নিজের নিজের কাজে অনেক অসুবিধা হয়ে যায়। বর্তমান কালে আমদানী রফতানী ব্যবসায়ে এবং খুচরা বা পাইকারী ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতার বড় প্রয়োজন দেখা দেয়। অতীতের যে কোন কালের বা যুগের তুলনায় একালে ও এযুগে এ প্রয়োজন তীব্রতর। আর তাতে দালালের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তাই দালাল যদি তার নির্দিষ্ট মজুরী নগদ গ্রহণ করে কিংবা মুনাফা থেকে হার মতো কমিশন অথবা অন্য কোনভাবে উভয় পক্ষ সম্মত হয়ে নেয়, তবে তাতে কোন দোষ নেই। ইমাম বুখারী লিখেছেন- ইবনে সিরীন, আতা, ইবরাহীম, হাসান প্রমুখ প্রখ্যাত ফিকাহবিদ দালালীর মজুরী গ্রহণে কোন দোষ দেখতে পান নি। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ যদি একজন অপর জনকে বলে, ‘এ কাপড়টা বিক্রয় করে দাও। অতিরিক্ত যা পাওয়া যাবে তা তোমার’ তবে তা সম্পূর্ণ জায়েয। ইবনে সিরীন বলেছেনঃ এ জিনিসটি এ দামে বিক্রয় কর। আর বেশি যা পাবে, তা তোমার হবে কিংবা তা তুমি-আমি ভাগাভাগি করে নেব এবং এ ভিত্তিতে যদি তা বিক্রয় করে দেয়ার কাজ করা হয় তবে তাতে কোন দোষ নেই। এ দালালী ব্যবসা কমিশন এজেন্সী ধরনের কাজ সম্পূর্ণ জায়েয। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)

মুসলমান নিজেদের পারস্পরিক শর্ত মেনে চলতে বাধ্য। (বুখারী)

মুনাফাখোরি ও ধোঁকাবাজি হারাম

বাজার বা স্বাভাবিক দ্রব্যমূল্যের ওপর কৃত্রিমভাবে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করার সাথে সাথে নবী করীম (সা) মুনাফাখোরি ও ধোঁকাবাজি করতেও স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। হাদীসে এ কথাটি বোঝার জন্যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হযরত ইবনে উমর (রা) এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ পণ্যের ন্যায্য মূল্যের অধিক বুলি দেয়া অথচ তুমি তা কিনবার ইচ্ছা পোষণ কর না। আর তুমি তা কর এ জন্যে যে, তোমার বুলি শুনে অন্য লোকেরা তোমার অনুসরণ করবে। সাধারণত অন্যদের ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এরূপ করা হয়।

বেচা-কেনা কারবারটিকে মুনাফাখোরি থেকে এবং দ্রব্যমূল্যকে ধোঁকাবাজি থেকে মুক্ত ও পবিত্র রাখার উদ্দেশ্যে নবী করীম (সা) বাজারে মাল আসার পূর্বেই- বাইরে-বাইরে- ক্রয় করতে নিষেধ করেছেন নতুবা মূল বাজারেই পণ্যদ্রব্যের আমদানী ব্যাহত হয়ে পড়বে। আর তার ফলে সঠিক মূল্যও নির্ধারিত হতে পারবে না। কেননা সঠিক মূল্য নির্ধারণ বাজারে পণ্যের আমদানী ও তার চাহিদা (demand) অনুপাত সম্ভবপর হয়। কিন্তু উপরিউক্ত অবস্থায় বিক্রেতা বাজারের দর-দাম কিছু জানতে পারে না। এ কারণেই নবী করীম (সা) বাজারে পণ্য পৌঁছার পর পূর্ববর্তী সওদা ভঙ্গ করার অধিকার বিক্রেতার আছে বলে ঘোষণা করেছেন। ( আরবি******************)

যে ধোঁকাবাজি করল সে আমাদের নয়

ইসলাম ধোঁকা-প্রতারণার সবল রূপ ও পন্থাকে হারাম করে দিয়েছে। তা ক্রয় বিক্রয় সম্পর্কেই হোক কিংবা অন্যান্য মানবীয় ব্যাপারেই মুসলমান সততা ও ন্যায়পরতা অবলম্বন করবে। ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বপ্রকার বৈষয়িক কামাই-রোযগারের তুলনায় ‘দ্বীনের মধ্যে নসীহত’ অত্যধিক মুল্যবান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)

ক্রেতা-বিক্রেতার কথাবার্তা যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না। ততক্ষণে তাদের (চুক্তি ভঙ্গ করার) ইখতিয়ার থাকবে। ‍যদি তারা দুজনই সততা অবলম্বন করে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে, তাহলে তাদের দুজনের এই ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি তারা দুজন ‍মিথ্যার আশ্রয় নেয় ও দোষ গোপন করে, তাহলে তাদের এই ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত নির্মূল হয়ে যাবে। (বুখারী)

তিনি আরও বলেছেনঃ ( আরবি******************)

কোন পণ্য বিক্রয়ে পণ্যের দোষ-ত্রুটি বলে দেয়া না হলে হালাল হবে না কারো জন্যেই। আর যে তা জানে, কিন্তু জানা সত্ত্বেও যদি না বলে তবু তা তার জন্যে হালাল নয়। (হাকেম, বায়হাকী)

রাসূলে করীম (সা) বাজারে গিয়ে দেখলেন, এক ব্যক্তি শস্য বিক্রয় করছে। তা তাঁর খুব পছন্দ হলো। পরে তিনি স্তুপের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। দেখলেন হাত ভিজে গেল। তখন তিনি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘হে শস্য ব্যবসায়ী, এসব কি,? সে বললঃ ‘বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে।, তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ ( আরবি******************)

তাহলে তুমি এ ভিজা শস্যগুলো স্তুপের উপরিভাগে রাখলে না কেন, তাহলে ক্রেতারা তা দেখতে পেত?… এ তো ধোঁকা। আর যে আমাদের সাথে ধোঁকাবাজি করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (মুসলিম)

অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ নবী করীম (সা) অপর এক খাদ্য বিক্রেতার কাছে গেলেন। সে খুব ভাল পণ্য নিয়ে বসেছিল। তিনি তার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। দেখলেন খুব নিকৃষ্ট মানের খাদ্য নীচে রয়েছে। তখন তিনি তাকে বললেনঃ ( আরবি******************)

এ খাবার আলাদা বিক্রয় করবে এবং এ খাবার স্বতন্ত্রভাবে বিক্রয় করবে। জেনে রাখ, যে আমাদের সাথে ধোঁকাবাজি করবে, সে আমাদের মধ্যের কেউ নয়। (আহমদ)

আগের কালের মুসলমানরা এ নীতি অনুসরণ করে চলতেন। পণ্যদ্রব্যে যে দোষত্রুটি থাকত, তা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতেন। তার কিছুই গোপন করতেন না। আর ক্রয় বিক্রয়ে সদা সত্য কথা বলতেন, মিথ্যার প্রশ্রয় দিতেন না। তাঁরা লোকদের কল্যাণ চাইতেন, কাউকে ধোঁকা দিতেন না।

প্রখ্যাত ফিকাহবিদ ইবনে সিরীন একটি ছাগী বিক্রয় করলেন। ক্রেতাকে তিনি বললেন, ছাগীটির দোষ আছে তা তোমাকে বলে আমি দায়িত্ব মুক্ত হতে চাই। ওটি ঘাস পা দিয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে দেয়।

হাসান ইবনে সালেহ একটি ক্রীতদাসী বিক্রয় করলেন। ক্রেতাকে বললেন, মেয়েটি একবার থুথুর সাথে রক্ত ফেলেছিল। তা ছিল মাত্র একবারের ঘটনা। কিন্তুতা সত্ত্বেও তাঁর ঈমানদার অন্তর তার উল্লেখ না করে চুপ থাকতে পারল না, যদিও তাতে মূল্য কম হওয়ার আশংকা ছিল।

বারবার কিরা-কসম করা

ধোঁকাবাজির সাথে মিথ্যামিথ্যি কিরা-কসম করা হলে এ কাজ অধিক মাত্রায় হারাম হয়ে দাঁড়ায়। নবী করীম (সা) ব্যবসায়ীদের কিরা-কসম করতে সাধারণভাবে এবং বিশেষভাবে মিথ্যা কিরা-কসম করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। বলেছেনঃ ( আরবি******************)

কিরা-কসম দ্বারা পণ্য তো বিক্রয় করা যায়; কিন্ত বরকত পাওয়া যায় না।

বিক্রয়ে বেশি বেশি কিরা-কসম করা নবী করীমের আদৌ পছন্দ নয়। কেননা তাতে প্রথমতঃ চুক্তির পক্ষদ্বয়ের ধোঁকাবাজির মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আর দ্বিতীয়তঃ তাতে আল্লাহর পবিত্র নামের ইজ্জত নষ্ট হওয়ারও ভয় আছে।

মাপে-ওজনে কম করা

পণ্য বিক্রয়ে পাত্র দ্বারা মাপায় বা পাল্লা দ্বারা ওজন করে কম দেয়াও এক প্রকারের ধোঁকাবাজি। কুরআন মজীদে এ ব্যাপারটির ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং সূরা আল-আন’আম-এর শেষে দশটি উপদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আয়াতটি এইঃ ( আরবি******************)

তোমরা মাপার পাত্র ও ওজনের পাল্লা সুবিচার সহকারে পূর্ণ ভর্তি করে দাও। মানুষের সাধ্য-সামর্থ্যের অধিক আমরা কোন দায়িত্বই তার ওপর চাপিয়ে দিই না।

বলেছেনঃ ( আরবি******************)

আর তোমরা মাপার কাজ যখন করবে তখন পূর্ণ করে মাপবে। আর সুদৃঢ়-সঠিক দাঁড়ি-পাল্লার দ্বারা ওজন করবে। এ নীতি অতীব কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে খুবই ভাল ও উত্তম। (সূরা বনী-ইসরাঈলঃ ৩৫)

বলেছেনঃ ( আরবি******************)

মাপে ওজনে যারা কম করে তাদের জন্যে বড়ই দুঃখ। তারা যখন লোকদের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয়, তখন পুরোপুরি গ্রহণ করে। আর যখন তাদের মেপে বা ওজন জরে দেয়, তখন কম করে দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা সেই কঠিন দিনে পুনরুত্থিত হবে, যেদিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে যাবে। (সূরা মুত্বাফফিফীনঃ১-৬)

মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য এ ক্ষেত্রে সাধ্যমত পূর্ণ সুবিচার নীতি ও ন্যায়পরতা অবলম্বন করা। কেননা পুরামাত্রার ও প্রকৃত সুবিচার ন্যায়পরতা হয়ত কল্পনা করা কঠিন। এ কারণেই পূর্ণমাত্রায় পরিমাপ করার নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে কুরআন বলেছেঃ আমরা মানুষের সাধ্যের অতিরিক্ত কোন কাজের দায়িত্ব কারো ওপর অর্পণ করি না।

যে সব জাতি তাদের পারস্পরিক কার্যাদি ও লেন-দেনে জুলুম করেছে, বিশেষভাবে পরিমাপে ও ওজনে সুবিচারনীতি লংঘন করেছে এবং লোকদের পণ্য বিক্রয়ে তাদের ঠকিয়েছে, তাদের কিসসা কুরআন মজীদে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা এসব জাতির কাছে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন, তাঁরা তাদেরকে সংশোধন করতে ও সুবিচার নীতির দিক নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন, যেমন চেষ্টা করেছেন তাদের তওহীদে বিশ্বাসী বানাবার জন্যে।

এদের মধ্যে শুয়াইব নবীর লোকদের কথাও বলা হয়েছে। তিনি তাদের উচ্চস্বরে দাওয়াত দিয়েছেন, নাফরমানীর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেছেনঃ ( আরবি******************)

তোমরা পরিমাণ পূর্ণ কর এবং লোকদের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ো না তোমরা। আর সুদৃঢ় পাল্লায় ওজন কর ও লোকদের দ্রব্যাদি কম দিও না এবং পৃথিবীতে সীমালংঘন করে বিপর্যয়কারী হইও না। (সূরা শূআরাঃ ১৮১-১৮৩)

মুসলিম সমাজের জন্যে এ নির্দেশ অবশ্য পালনীয়। তাদের জীবনে লোকদের সাথে সম্পর্কে ও সমস্ত পারস্পরিক কাজকর্মে এ নীতিই তাদের পালন করতে হবে। অতএব দুই রকমের পরিমাণ ও দুই ধরনের পাল্লায় ওজন করে বেচা-কেনা করা তাদের জন্যে জায়েয নয়। একটা নিজের জন্যে মানদণ্ড আর একটা অন্যান্য লোকদের জন্যে সাধারণ মানদণ্ড, তার নিজের জন্যে ও তার প্রিয়জনদের জন্যে এক রকমের আচরণ এবং অন্যান্য সাধারণ মানষের জন্যে ভিন্ন রকমের মানদণ্ড ইসলামে সম্পূর্ণ অচল। কেননা এরূপ হলে সে নিজের ও নিজের অনুসারীদের প্রাপ্য পুরামাত্রায় আদায় করবে, বেশিও নিয়ে বসবে। আর অপর লোকদের জন্যে কম দেবে এবং তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু এর মতো অবিচার আর কিছু হতে পারে না।

চোরা মাল ক্রয়

ইসলাম অপরাধ ও অপরাধ প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করেছে। অপরাধীদের সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে পরিবেষ্টিত করে দিয়েছে। তাই যে মাল অপহৃত বা চুরি করে আনা হয়েছে কিংবা মালিকের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে নিয়ে নেয়া হয়েছে তা শুনে ক্রয় করা মুসলমানের জন্যে জায়েয নয়, কেননা তা করা হলে অপহরণকারী, চোর ও ছিনতাইকারীকে তার কাজে সাহায্য করা হবে। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)

যে ব্যক্তি জেনে-শুনে চুরির মাল ক্রয় করল, সে তার গুনাহ্ ও অন্যায় কাজে শরীক হয়ে গেল। (বায়হাকী)

চুরি করা মালের যদি দীর্ঘদিনও অতিবাহিত হয়, তাহলেও তার গুণাহ্ দূর হয়ে যায় না। কেননা ইসলামে সময়ের দীর্ঘতা হারামকে হালাল করে দেয় না। প্রকৃত মালিকের হক নাকচ করে না। মানব রচিত আইনেও এ নীতিই অবলম্বিত হয়েছে।

সুদ হারাম

ব্যবসায়ের মাধ্যমে মুলধনের মুনাফা লাভ ইসলামে সম্পূর্ণ জায়েয। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)

হে ঈমানদার লোকেরা! তোমারা পরস্পরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে না। তবে তোমাদের সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মতিতে ব্যবসায় হলে দোষ নেই।

যারা দুনিয়ায় ব্যবসায় লিপ্ত হয় এবং দুনিয়ায় দেশ-বিদেশে সফর করে, তাদের প্রশংসা করে কুরআনে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)

আর অন্যান্য যারা পৃথিবীতে চলাফেরা করে ও আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধান করে বেড়ায়। (সূরা মুজাম্মিলঃ ২০)

কিন্তু সুদের পন্থায় ‘মুনাফা’ লাভ করার সবল পথকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ও হারাম করে দিয়েছে। তার পরিমাণ কম হোক, কি বেশি, ইসলামে তা সবই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।

তার পরিমাণ কম হোক বেশি হোক- সবই হারাম। ইয়াহূদীদের এ সুদী কারবার করতে নিষেধ করা হয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তা করেছে। এজন্যে তাদের ওপর ভর্ৎসনা করা হয়েছে। কুরআনের সর্বশেষ নাযিল হওয়া আয়াত সমূহের মধ্যে এ আয়াত একটিঃ ( আরবি******************)

হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা ভয় কর আল্লাহকে এবং সুদের অবশিষ্টাংশ পরিহার কর ‍যদি তোমরা ঈমানদার হও। আর তা যদি না-ই কর, তাহলে আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হও। আর তোমরা যদি তওবা কর, তাহলে তোমাদের মূলধন তোমরা ফেরত পেতে পার। তোমরা জুলুমও করবে না, তোমরা মজলুমও হবে না। (সূরা বাকারাঃ ২৭৮-২৭৯)

রাসূলে করীম (সা) সুদ ও সুদখোর, সুদী কারবারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এ সুদের ফলে সমাজ জীবনের ওপর যে বিপদ ঘনীভূত হয়ে আসে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেনঃ ( আরবি******************)

সুদ ও ব্যভিচার যখন কোন দেশে-শহরে ব্যাপক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাদের ওপর আল্লাহর আযাব আসা অনিবার্য হয়ে পড়ে। (হাকাম)

আসমানী ধর্মসমূহের মধ্যে ইসলামে এটা কোন একক ঘোষণা নয়। ইয়াহূদীদের ধর্মগ্রন্থে পুরান নিয়ম-এ বলা হয়েছেঃ

তুমি যদি আমার প্রজাদের মধ্যে তোমার স্বজাতীয় কোন দীন-দুখীকে টাকা ধার দাও, তবে তাহার কাছে সুদ গ্রাহীর ন্যায় হইও না, তোমরা তাহার উপরে সুদ চাপাইবে না। (যাত্রা পুস্তক-২২ অধ্যায়, ২৫ স্তোত্র)

আর খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছেঃ

তোমরা আপন আপন শত্রুদিগকে প্রেম করিও, তাহাদের ভাল করিও এবং কখনও ‍নিরাশ না হইয়া ধার দিও, তাহা করিলে তোমাদের মহা পুরস্কার হইবে। (নূতন নিয়ম-লুক, ৩৫ স্তোত্র, ৬ অধ্যায়)

বড়ই দুঃখের বিষয় ‘পুরাতন নিয়ম’ গ্রন্থে পরিবর্তন করে সুদে টাকা না দেয়ার কথাকে কেবল ইয়াহূদী লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ‘ভাই’ বলতে কেবল তাদেরই মনে করা হয়েছে এবং অপর লোকদের জন্যে সুদের ভিত্তিতে টাকা দেয়ার কারবার চালাবার অবাধ সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।

সুদ হারামকরণের যৌক্তিকতা

ইসলাম সুদের ব্যাপারে খুবই কঠোরতা অবলম্বন করেছে এবং তাগিদী ভাষায় হারাম করে দিয়েছে। এতে করে সামগ্রিকভাবে মানুষের কল্যাণ সাধন করেছে। তাদের নৈতিকতা, সমাজ ও অর্থনীতেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে।

সুদ হারাম হওয়ার যৌক্তিকতা দেখান প্রসঙ্গে আলিমগণ কয়েকটি গুরুতর কারণের উল্লেখ করেছেন, আধুনিক বিশ্লেষণ ও চিন্তা-ভাবনার ফরে তা প্রকট হয়ে উঠেছে।

ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে এ পর্যায়ে যা লিখেছেন, তার উল্লেখকেই আমরা যথেষ্ট মনে করছি। তিনি লিখেছেনঃ

প্রথম কথা এই যে, সুদ লোকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে কোনরূপ বিনিময় ব্যতিরেকেই। কেননা যে লোক একটি টাকা দুই টাকায় বিক্রয় করে, সে একটি টাকা অতিরিক্ত গ্রহণ করে; কিন্তু সেজন্যে তাকে কিছুই দিতে হয় না। আর মানুষের টাকা তো তাদের প্রয়োজন পুরণার্থেই লাগে। তার একটি বিশেষ ও বিরাট মর্যাদাও রয়েছে। হাদীস শরীফে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)

মানুষের রক্তের যে মর্যাদা, মানুষের ধন-মালেরও ঠিক সেই মর্যাদা।

এ কারণে কোনরূপ বিনিময় না দিয়ে তা গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হারাম হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

দ্বিতীয়তঃ সুদের মাধ্যমে অর্থাগমের ওপর নির্ভরশীলতা মানুষকে শ্রম করে উপার্জন করা থেকে বিমুখ ও অনুৎসাহী বানিয়ে দেয়। সুদী করবার বা সুদ ভিত্তিক লগ্নির ফলে যখন অতিরিক্ত অর্থ পাওয়াই যাচ্ছে, তা নগদ হোক বা বাকী, তখন শ্রম করে, ব্যবসায় ও শিল্পোৎপাদনের খাটাখাটুনির কোন প্রয়োজন বোধই লোকদের মধ্যে জাগবে না এবং তার দরুন সামষ্টিক কল্যাণ ব্যবস্থা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। আর ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কৃষি ও নির্মাণ প্রভৃতি কার্য সম্পন্ন না হলে মানব-সাধারণের কোন কল্যাণের চিন্তা বা আশাই করা যায় না।

আমাদের মতে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে সুদ হারাম হওয়ার এ-ই হচ্ছে কারণ।

তৃতীয় কথা, সমাজের লোকদের মধ্যে প্রচলিত নিয়মে ঋণ দেয়া-নেয়ার ব্যবস্থা এর দরুন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। কেননা সুদ যখন হারাম গণ্য করা হবে, তখন মানুষের মন এজন্যে প্রস্তুত হবে যে, তারা এক টাকা ঋণ বাবদ গ্রহণ করলে সেই এক টাকাই ফেরত দেবে। কিন্তু ‍সুদ যদি হালাল বা প্রচলিত হয়, তাহলে প্রয়োজন মানুষকে এক টাকার পরিবর্তে দুই টাকা দিতে ও গ্রহণ করতে বাধ্য করবে। তার ফলে লোকদের পারস্পরিক সহৃদয়তা, কল্যাণ কামনা ও দয়া অনুগ্রহ বলতে কোন জিনিসের অস্তিত্বই থাকবে না।

আর এ হচ্ছে সুদ হারাম হওয়ার নৈতিক কারণ।

চতুর্থ, সাধারণত ঋণদাতা ধনী এবং ঋণগ্রহীতা দরিদ্র ব্যক্তি হয়ে থাকে। এক্ষণে সুদ-ভিত্তিক ঋণ-দান ব্যবস্থা চালু থাকলে ধনী ব্যক্তিকে গরীব দুর্বল ব্যক্তির কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের অধিকারী বানিয়ে দেয়া হবে। কিন্ত মহান দয়াময় আল্লাহর অনুগ্রহমূলক ব্যবস্থায় তা কিছুতেই জায়েয হতে পারে না।

এ হচ্ছে সামাজিক দৃষ্টিতে সুদ হারাম হওয়ার কারণ এবং তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সুদ ব্যবস্থায় শক্তিমানের স্বার্থে দুর্বলকে শোষণ করার অবাধ সুযোগ ঘটে। তার ফলে ধনী আরও ধনী হয়ে যায় এবং গরীব আরও গরীবীর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয় এবং সমাজের এক শ্রেণীর লোক দিন দিন মোটা হয়ে উঠে অন্যান্য বহু কয়টি শ্রেণীর লোককে পেশাষণ করে, শেষ করে। আর তার ফলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ তীব্র হতেও তীব্রতর হয়ে উঠে। সমাজের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের আগুন জ্বালাতে থাকে দাঊ দাঊ করে। শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি দেখা দেয় চরম ধ্বংস ও সামষ্টিক বিপর্যয়। আধুনিক কালের সমাজ ইতিহাস থেকেও এ কথার সত্যতা ও যথার্থতা প্রমাণিত। দেখা যায়, এ সুদ ও সুদখোর লোকেরাই রাজনীতির, রাষ্ট্র, প্রশাসন ও শান্তি নিরাপত্তার পক্ষে বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুদদাতা ও সুদী দলিলের লেখক

ধনী লোকেরাই সুদ খায় ও সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেয়। সে ঋণী ব্যক্তিকে টাকা দেয়া, যেন মূলধনের ওপর সে বাড়তি টাকা ফেরত দেয়। এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর কাছেও যেমন অভিশপ্ত হয়ে থাকে, তেমনি জনগণের কাছেও। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে কেবল সুদখোররাই অপরাধী হয় না, যারা সুদ দেয়, সুদ খাওয়ায়, তারাও এই অপরাধে শরীক রয়েছে। সুদের দলিল যারা লেখে এবং তাতে যারা সাক্ষী হয়, তারাও কোন অংশে কম অপরাধী নয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)

যে সুদ খায়, সুদ খাওয়ায়, তার সাক্ষী হয় এবং তার দলিল লেখে, তাদের সকলেরই ওপর আল্লাহ্ তা’আলা অভিশাপ করেছেন। (মুসনাদে আহমদ, আবূদাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)

অবশ্য সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করার যদি তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে শুধু সুদখোরই গুনাহগার হবে। তবেঃ

১. যদি বাস্তবিকই তার প্রয়োজন থাকে। নিছক নিজের প্রয়োজন পূরণ বা উন্নয়নমূলক কাজের ব্যাপকতা বিধান তার লক্ষ্য হবে না। প্রয়োজনের অর্থ, মানুষ তা থেকে বাঁচতে চেয়েও বাঁচতে পারে না, নিজেকে ধ্বংস করতে প্রস্তুত হওয়া ছাড়া। যেমন খাদ্য, কাপড়, চিকিৎসা প্রভৃতি অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের জন্যে এ সুদভিত্তিক ঋণ গ্রহণ করতে মানুষ বাধ্য হয়ে পড়ে অনেক সময়।

২. কেবলমাত্র নিজের প্রয়োজন পূরণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হবে। যথা দশ টাকার প্রয়োজন হলে সেখানে এগারো টাকা গ্রহণ করা হবে না।

৩. সুদ থেকে মুক্তি লাভের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে হবে। এমন ঠেকায় পড়া ব্যক্তির সাহায্য করা মুসলিম জনগণের কর্তব্য। কিন্তু ঠেকায় পড়া ব্যক্তি যদি সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায়ই না পায়, তাহলে সে সুদ ভিত্তিক ঋণ গ্রহণ করতে পারে, তবে শর্ত হচ্ছে তার জন্যে তার মনে কামনা-বাসনা জাগতে পারবে না, সে ব্যাপারে সীমাও লংঘন করা চলবে না। এরূপ অবস্থা হলে হয়ত আল্লাহ্ তাকে মাপ করে দেবেন।

৪. আর ঠেকায় পড়ে এ কাজ করতে হলে অত্যন্ত ঘৃণা সহকারে এ কাজ করবে। তাতে সে সন্তুষ্ট থাকবে না, অসন্তোষ প্রকাশ করবে। যতদিন না আল্লাহ্ তার জন্যে অন্য কোন ব্যবস্থা করে দেন, শুধু ততদিনই এ কাজ করা যাবে।

ঋণ লওয়া থেকে নবী পানা চাইতেন

মুসলমান মাত্রেই একথা জানা উচিত যে, ইসলাম জীবনে ভারসাম্য সৃষ্টি ও অর্থনীতিতে মধ্যম পন্থা অনুসরণ করার হেদায়েত দিয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ ( আরবি******************)

তোমরা সীমালংঘন করো না। কেননা আল্লাহ্ সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না।

( আরবি******************) বেহুদা খরচ করো না। কেননা বেহুদা অর্থ ব্যয়কারী লোকেরা শয়তানের ভাই ও দোসর হয়ে থাকে। (সূরা বনী-ইসরাঈলঃ ২৬-২৭)

কুরআন মজীদ মুসলমানদের আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর দেয়া সম্পূর্ণ ধন-সম্পদই ব্যয় করে দিতে বলেনি, তা থেকে তার অংশ ব্যয় করার কথাই বলেছে। আর যে লোক নিজ উপার্জন থেকে কিছু অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, সে সম্ভবত কখনই দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়বে না। এ মধ্যম ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অবলম্বনের অনিবার্য দাবি এই যে, কোন মুসলমান ঋণ প্রহণ করতে কখনই বাধ্য হবে না। বিশেষ করে নবী করীম (সা) মুসলমানের ঋণ গ্রহণ করাকে কখনই পছন্দ করেন নি। কেননা স্বাধীন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্যে ঋণ রাতের দুশ্চিন্তা ও দিনের বেলার লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নবী করীম (সা) সব সময় এ ঋণ গ্রহণ থেকে আল্লাহর কাছে পানা চেয়েছেন। তিনি এই দো’আ করতেনঃ ( আরবি******************)

হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই ঋণের বোঝা বৃদ্ধি ও রুদ্র রোষ থেকে।

বলতেনঃ ( আরবি******************)

আমি কুফরি ও ঋণ থেকে আল্লাহর কাছে পানা চাই।

এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলঃ হে রাসূল! আপনার মতে কুফরি ও ঋণ কি সমান ব্যাপার? উত্তরে তিনি বললেনঃ হ্যাঁ।

তিনি নামাযে প্রায়ই দো’আ পড়তেনঃ ( আরবি******************)

হে আল্লাহ্, আমি তোমার কাছে গুনাহ ও ঋণ থেকে পানা চাই।

এক সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হলোঃ ( আরবি******************)

হে রাসূল! আপনি ঋণগ্রস্ততা থেকে খুব বেশি বেশি পানা চান কেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ মানুষ যখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন সে কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা বলে এবং ওয়াদা করে তার খেলাফ করে। (নিসায়ী, হাকেম)

ঋণগ্রস্ততা নৈতিকতার দৃষ্টিতে যে কতখানি মারাত্মক তা এসব হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণ ও দিনের মতো ভাস্বর হয়ে উঠে।

কোন মৃতের লাশ জানাযা পড়ার জন্যে নবী করীম (সা)-এর কাছে নিয়ে আসা হলে; যদি জানতে পারতেন যে, সে ঋণগ্রস্ত হয়ে মরেছে এবং তা শোধ করার মতো কিছুই রেখে যায়নি, তখন তিনি তার জানাযা নামায পড়তেন না। জানাযা না পড়ে তিনি লোকদের এই ঋণগ্রস্ততার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে চাইতেন মাত্র। উত্তরকালে রাসূলে করীম (সা)-এর হাতে যখন বিপুল গনীমতের মাল-সম্পদ জমা হলো, তখন তিনি তা থেকেই মৃতের ঋণ শোধ করার ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)

শহীদের সব গুনাহই মাফ হয়ে যায়। কিন্তু ঋণ ক্ষমা হয় না। (মুসলিম)

এসব কথার আলোকে বলতে হয়, মুসলমানের কখনও ঋণ গ্রহণ করা উচিত নয়। তবে নিতান্ত ও কঠিন ধরনের ঠেকায় পড়ে গেলে অন্য কথা। আর এ অবস্থায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে তা শোধ করার মনোভাব প্রবল রাখতে হবে সব সময়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ ( আরবি******************)

যে লোক অন্যদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করল এবং তা আদায় করে দেয়ার মনোভাব রাখল, তার ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা আল্লাহ্ তা’আলা করে দেবেন। আর যে লোক ঋণ গ্রহণ করে তা না দেয়ার বা নষ্ট করার মনোভাব নিয়ে, আল্লাহও তাঁকে বিনষ্ট করবেন। (বুখারী)

বস্তুত মুসলমান যখন নেহায়েত ঠেকায় না পড়ে কখনও ‍ঋণ গ্রহণ করতে প্রস্তুত হতে পারে না, তখন তাকে সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করতে কি করে বাধ্য করা যেতে পারে?

বেশি মুল্যে বাকী ক্রয়

এখানে আরও একটি কথার ব্যাখ্যা হওয়া আবশ্যক মনে হচ্ছে। নগদ দামে পণ্যদ্রব্য ক্রয় করা যেমন জায়েয, তেমনি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বাকী মূল্যে ক্রয় করাও নাজায়েয নয়। তবে তাতে একটা মেয়াদ নিদিষ্ট থাকতে হবে। নবী করীম (সা) নিজে ইয়াহূদীর কাছ থেকে তাঁর ঘরের লোকদের জন্যে বাকীতে খাদ্যপণ্য ক্রয় করেছেন। তবে সেজন্যে তিনি তাঁর লৌহবর্ম বন্ধক রেখেছিলেন।

কিন্তু বিক্রেতা যদি নগদ মূল্য না দেয়া ও বাকীতে ক্রয়ের দরুন পণ্য মূল্য বেশি ধার্য করে- অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে ও কিস্তিতে আদায় করার শর্তে পণ্য বিক্রয় করে থাকে- অনেক ফিকাহবিদই মনে করেন, এ ধরনের বিক্রয় হারাম। কেননা মূল্য আদায় করণে যে বিলম্ব করা হচ্ছে, তার বিনিময়েই বেশি মূল্য ধার্য করা হচ্ছে। আর তা এক ধরনের সুদই বটে। তবে সাধারণ আলিম ও ফিকাহবিদগণ এরূপ বিক্রয়কে জায়েয মনে করেন। তারা বলেন, ক্রয়-বিক্রয় মূলত তো হালাল এবং জায়েয। তা হারাম বলার পক্ষে কোন দলিলই পাওয়া যেতে পারে না। আর এরূপ ক্রয়-বিক্রয় সবদিক দিয়ে সুদী কারবারের মতোও নয়। তাঁরা মনে করেন, অনেক কয়টি দিকের দিকের বিবেচনায় বিক্রেতা বাকী মূল্যে বিক্রয় করে বলে পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য ধার্য করতে পারে, তার সে অধিকার রয়েছে। তবে তা অবশ্যই সাংঘাতিকভাবে বেশি মূল্য হওয়া উচিত নয়, তাতে ক্রেতার ওপর জুলুম হওয়ার মতো কোন অবস্থাও সমর্থনীয় নয়। নতুবা তাও হারাম হবে।

ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ বাহ্যত এরূপ ক্রয়-বিক্রয় জায়েযই হবে। কেননা এ পর্যায়ের কতগুলো সাধারণ দলিল প্রমাণ রয়েছে। আর শাফেয়ী, হানাফী ও যায়দ ইবনে আলী প্রমুখ ফকিহর মতেও তা জায়েয। ( আরবি******************)

আগে মূল্য দেয়া ও পরে পণ্য গ্রহণ

নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য অগ্রিম বিক্রেতাকে দেয়া ও নির্দেষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তার বিনিময়ে পণ্য গ্রহণকে ইসলামী পরিভাষায় ‘সিলম’ বিক্রয় বলা হয় এবং তা জায়েয। মদীনায় এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। কিন্তু নবী করীম (সা) এতে কতগুলো শর্ত আরোপ করেছেন, যা পালন করা হলে তাতে শরীয়তের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্য রক্ষা পায়।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ নবী করীম (সা) মদীনায় উপস্থিত হলেন, যখন তিনি দেখতে পেলেন যে, মদীনার লোকেরা মূল্য অগ্রিম দিচ্ছে যেন এক বছর বা দুই বছর পর তার বিনিময়ে ফসল লাভ করতে পারে।

তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ ( আরবি******************)

যে লোক অগ্রিম মূল্য দিয়ে কোন কিছু কিনবার সাব্যস্ত করবে, সে যেন তার ওজন, পরিমাণ ও সময় সব কিছুই নির্দিষ্ট করে নেয়।

এভাবে পরিমাণ, ওজন ও সময় পূর্বেই নির্দিষ্ট হয়ে থাকলে পারস্পরিক ঝগড়া ও গণ্ডগোল হওয়ার আশংকা থাকে না। ধোঁকাবাজি করার অবকাশও অনেকটা কম হয়ে যায়। বিশেষ গাছের ফলের অগ্রিম সওদা করা থেকে নবী করীম (সা) এ জন্যেই নিষেধ করেছেন। কেননা তাতে ধোঁকা ও ঠকবাজির ভয় রয়েছে। অনেক সময় নৈসর্গিক বিপদে পড়ার দরুন গাছে আদৌ ফলই ধরে না। তখন তা সাংঘাতিক অবস্থা দেখা দেয়।

এ পর্যায়ের কারবারের সঠিক পন্থা এ হতে পারে যে, বিশেষ গাছ বা বিশেষ জমির ফসলের শর্ত লাগানো উচিত নয়। কেবল ওজন ও পরিমাণ নির্ধারণ করে সওদা করা যেতে পারে। কিন্তু গাছ বা জমির মালিকের কাছ থেকে যদি অবৈধভাবে স্বার্থ উদ্ধার করা হয়। অর্থাৎ সে যদি এ সওদা করতে বাধ্য হয়, তাহলে তা হারাম হওয়ার সম্ভাবনা।

শ্রম ও মূলধনের পারস্পরিক সহযোগিতা

কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি কৌশল অনুযায়ী মানুষকে স্বীয় অফুরন্ত নিয়ামতে ধন্য করেছেন। কত মানুষই এমন, যাদের মধ্যে জ্ঞান-প্রতিভা ও কর্মক্ষমতা অসীম, কিন্তু তাদের কাছে অর্থ নেই। পক্ষান্তরে বহু লোক এমনও রয়েছে, যাদের অর্থের কোন পরিমাপ সীমা নেই, কিন্তু যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা থেকে বঞ্চিত। এক্ষণে প্রশ্ন উঠে, যাদের কাছে ধন-সম্পদ রয়েছে, তারা তাদের ধন-সম্পদ কর্মক্ষমতা সম্পন্ন লোকদের হাতে সঁপে দেয় না কেন? তারা তা পেলে শ্রম মেহনত করে সেই ধন-সম্পদকে অধিক কল্যাণময় রাখতে পারে। আর ধনমালের অধিকারীরা নিজেদের ধনের বিনিময়ে বিপুল মুনাফার অংশীদারও হতে পারে।

এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলব, ইসলামী শরীয়ত মূলধন ও কর্মক্ষমতা অথবা মূলধন ও শ্রমের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার পথে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। বরং ইনসাফ ও সুবিচারের ভিত্তিতে ও নির্ভুল সঠিক ব্যবস্থাপনার অধিন সহযোগিতার পন্থা উদ্ভাবন করেছে। অতএব ধনশালী ব্যক্তি যদি তার সঙ্গীর সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কোন মুনাফামূলক কারবার করতে চায় তাহলে এ অংশীদারিত্বের সমস্ত ফলাফলকে দায়িত্ব সহকারে তাকে তা গ্রতণ করতে হবে। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় তাকে বলা হয় ‘মুজারিবাত’ কিংবা ‘কিরাজ’। ফিকাহবিদগণ এ কাজে শর্ত আরোপ করেছেন যে, কারবারের উভয় পক্ষকেই লাভ বা লোকসান সব কিছুতেই শরীক হতে হবে এবং তার হার নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। তা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ, এক-তৃতীয়াংশ কিংবা এক-চতুর্থাংশ এক পক্ষের জন্যে হবে, আর অবশিষ্ট হবে অপর পক্ষের। মূল কারবার এভাবে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তাতে মুনাফা হলে চুক্তি অনুযায়ী তা পক্ষদ্বয়ের মধ্যে বন্টন হবে। আর লোকসান হলে মুনাফা থেকে তা বাদ দিয়ে নিয়ে হার মতো ভাগ করে নিতে হবে। আর মুনাফার তুলনায় লোকসান যদি বেশি হয় তাহলে এ অতিরিক্ত লোকসান মূলধন থেকে নিয়ে নেয়া হবে। মূলধনের মালিককে লোকসানের অংশ তার মূলধন থেকে কেটে দেয়া কর্তব্য, এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। কেননা তার অংশীদারকেও শ্রম ও মেহনতের ক্ষতিটা মেনে নিতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে এ-ই ইসলামের বিধান। মূলধনের মালিকের জন্যে মুনাফার সীমা নির্ধারণ ও তার নিরাপত্তা দেয়া- সে লাভ হোক, লোকসান হোক, তাকে মুনাফা দিয়ে যাওয়াই হবে, তা সুবিচার নীতি ও ইনসাফ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাতে যোগ্যতা ও শ্রমের ওপর মূলধনকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ও অকারণ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। উপরন্তু তা সেই জীবন পদ্ধতিরও বিরোধী যা মানুষের জন্যে যেমন মুনাফার ব্যবস্থা করে, তেমনি ক্ষতিকরও। শুধু তা-ই নয়, তদ্দরুন উপার্জনকে নিশ্চিতকরণের ঝোঁক-প্রবণতাকেও সমর্থন দেয়া হয়। তার জন্যে না শ্রম করার প্রয়োজন, না ক্ষতির ঝুঁকি মাথা পেতে নেয়ার কোন কারণ দেখা দেয়। ফলে তা প্রকৃতপক্ষে সুদ ও সুদী কারবারের মতোই হয়ে দাঁড়ায়।

নবী করীম (সা) এ রকম ভাগে জমি চাষ করতে দিতে নিষেধ করেছেন যে, জমির একটা নির্দিষ্ট অংশের ফসল এক পক্ষ পাবে আর অপর পক্ষ পাবে অপর নির্দিষ্ট অংশের ফসল। ফসলের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের ওপরও ভাগ চাষ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এটা ঠিক সুদ বা জুয়ার মতোই ব্যাপার। হতে পারে যে, জমির সেই নির্দিষ্ট অংশে কোন ফসলই হলো না অথবা সেই নির্দিষ্ট পরিমাণের অধিক ফসলও হলো না। তাতে এক পক্ষের সম্পূর্ণ বঞ্চিত থেকে যাওয়ার অবস্থা হতে পারে। অথচ অপর পক্ষ পূর্ণভাবে লাভবান হয়ে যাবে। আর এ অবস্থা কোনক্রমেই ইনসাফপূর্ণ হতে পারে না।

মুজারিবাত ইসলামে জায়েয। কিন্তু সেজন্যে শর্ত এই যে, মূল বারবারের লাভ-লোকসানের দিক খেয়াল না রেখে এক পক্ষের জন্যে নিশ্চিত মুনাফার ব্যবস্থা থাকতে পারবে না। এ মতের ওপর ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে শর্ত হলে ‘মুজারিবাত’ জায়েয হবে না ঠিক যে কারণে ‘মুজারিবাত’ জায়েয হয় না। পারস্পরিক জমি চাষের ব্যাপারটিও অনুরূপ কারণে নাজায়েয হয়ে যায়। ফিকাহবিদগণ বলেন, এক পক্ষ যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকাই মুনাফা লাভের শর্ত ধার্য করে, আর কারবারের ফলে অতটা পরিমাণ টাকাই মুনাফা হয়, তাহলে তার অর্থ হবে, সমস্ত মুনাফা এক পক্ষই পেয়ে গেল; বরং আদপেই মুনাফা না হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি বেশি মুনাফা পাওয়ার শর্তে কারবার করেছে সে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য হবে। ( আরবি******************)

উপরের বর্ণিত কারণটি ইসলামের মৌলিক ভাবধারার সাথে পুরা মাত্রায় সঙ্গতিপূর্ণ। বস্তুত ইসলামের সকল নীতি ও বিধানই সুদৃঢ়, সুস্পষ্ট ও নিরেট ইনসাফের ওপর ভিত্তিশীল।

মূলধনের পারস্পরিক অংশীদারিত্ব

ব্যক্তিগতভাবে নিজের মূলধন নিজের ইচ্ছামত কোন মুবাহ কাজে বিনিয়োগ করা ও তা থেকে মুনাফা লাভ করা, উপরন্ত কোন অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে মুজারিবাতের ‍বিধান অনুযায়ী কারবার করার জন্যে দেয়া যেমন জায়েয, অনুরূপ মূলধন বিনিয়োগকারী লোকেরা একত্র ও পারস্পরিকভাবে সম্মত হয়ে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ফার্ম বা সংস্থা গড়ে তোলা অথবা অন্য কোন কারবারে পারস্পরিক শরীকদারীর ভিত্তিতে কাজ করাও সম্পর্ণ জায়েয। কেননা অনেক ধরনের কারবার এমন হয়ে থাকে, যার জন্যে বহু সংখ্যক হস্তের বুদ্ধিমানের ও বিরাট পরিমাণ মূলধনের একত্র সমাবেশ একান্তই অপরিহার্য। আর তা পারস্পরিক সহযোগিতা ও শরীকদারীর মাধ্যমেই পূরণ হতে পারে। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)

তোমরা কল্যাণময় পুণ্যময় ও আল্লাহ্ ভীতির কাজে পরস্পর সহযোগিতা কর।

আর যে কাজই ব্যক্তি বা সমাজ-সমষ্টির কল্যাণ সাধন বা অকল্যাণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে করা হবে, তা-ই কল্যাণময় এবং আল্লাহ্ ভীতির কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। তবে শর্ত এই যে, তা অবশ্যই ভাল নিয়্যত ও মন-মানসিকতা সহকারে সম্পন্ন করতে হবে।

পারস্পরিক শরীকদারীকে ইসলাম শুধু জায়েয ও সঙ্গত ঘোষণাই করেনি; বরং তাতেই বরকত নিহিত বলেছে। তাতে যেমন দুনিয়ায় আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার ওয়াদা রয়েছে, তেমনি পরকালেও তাতেই বিপুল সওয়াব পাওয়ার আশা। তবে তা জায়েয সীমার মধ্যে থেকে ও সুদ, ধোঁকা,প্রতারণা, জুলুম, লোভ-লালসা ও খিয়ানতকরণ থেকে সযত্নে দূরে থেকে শরীকদারীর কারবার করতে হবে। নবী করীম (সা) এরূপ শরীক ব্যবসায়ীদের সম্পর্কেই বলেছেনঃ ( আরবি******************)

শরীকদ্বয়ের প্রতি আল্লাহর সাহায্য থাকে, যতক্ষণ না তাতে একজন অপর জনের সাথে অবিশ্বাসের কাজ করবে। যদি একজন অপর জনের সাথে খিয়ানত করে, তহলে আল্লাহ্ সে সাহায্য তুলে নেন ও বন্ধ করে দেন।

রাসূলে করীম (সা) আল্লাহর কথা উদ্ধৃত করেছেন এ ভাষায়ঃ ( আরবি******************)

দুই শরীকী কারবারীদের মধ্যে আমি তৃতীয়, যতক্ষণ একজন অপরজনের খিয়ানত করবে না। যদি একজন অপর জনের খিয়ানত করে তাহলে আমি তাদের দুজনের মধ্য থেকে বের হয়ে যাই আর সেখানে শয়তান এসে যায়।

বীমা কোম্পানী

ব্যবসায়ের এক অতি আধুনিক রূপ হচ্ছে বীমা কোম্পানী। বীমা নানা রকমের হয়ে থাকে। জীবন-বীমা, দুর্ঘটনা বীমা, অগ্নি বীমা ইত্যাদি  উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এ ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তের হুকুম কি, তা-ই আলোচ্য। ইসলামে কি এ ধরনের ব্যবসা চলতে দেয়া হবে? এ প্রশ্নের জবাবের পূর্বে বীমা কোম্পানীসমূহের প্রকৃতি জানতে হবে। বীমা  যে করায় বীমা কোম্পানীর সাথে তার সম্পর্ক কি ধরনের হয়, তাও জানা আবশ্যক। অন্য কথায়, বীমাকারী কি কোম্পানীর মূল সংস্থায় একজন অংশীদার হিসেবে বিবেচিত? যদি তা-ই হয় তাহলে বীমাকারীকে মূল ব্যবসায়ের লাভ লোকসানে সমানভাবে শরীক হতে হবে। দুর্ঘটনা সংক্রান্ত বীমায় বীমাকারীকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বার্ষিক হিসাবে কোম্পানীকে দিয়ে দিতে হয়। যে ব্যবসায়ের বীমা করানো হয়েছে, তা যদি কোন দুর্ঘটনার শিকার না হয়, তাহলে সে ব্যবসায়ের মালিককে দেয়া সব টাকাই কোম্পানী নিয়ে নেবে ও হজম করে ফেলবে, তা থেকে কিছু ফেরত দেয়া হবে না। অবশ্য দুর্ঘটনা কবলিত হলে নির্ধারিত পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ আদায় করা হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থা শরীকদারী কারবার বা ব্যবসায়ের প্রতিকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

জীবন বীমার নিয়ম হচ্ছে, যদি দুই হাজার টাকার বীমা করানো হয় এবং প্রথম কিস্তি দিয়ে দেয়ার পর মৃত্য সঙ্ঘটিত হয়, তাহলে বীমাকারী ব্যক্তি পূর্ণ দুই হাজার টাকা পাওয়ার অধিকারী কিন্তু সে যদি মূল ব্যবসায়ের অংশীদারের মতো হতো, তাহলে দেয়া কিস্তির পরিমাণ টাকা ও সেই হারে মুনাফাটুকুই তার পাওয়া উচিত। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, বীমাকারী যদি কোম্পানীর নিয়মাবলী লংঘন করে ও কিস্তি দিতে অক্ষম হয়, তাহলে দেয়া সব টাকা বা তার অংশ-বিশেষ থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। আর এ নিয়মটা যে অন্যায়, জুলুম ও অসত্য শর্ত, তা বলাই বাহুল্য।

আর উভয় পক্ষ যদি নিজ নিজ সম্মতিক্রমে এ শর্ত মেনে নেয় এবং এরূপ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়- নিজ নিজ স্বার্থ ভাল করে বুঝে-শুনেই হোক-না কেন, তবু তা জায়েয হবে না। কেননা সুদখোর ও সুদ গ্রহীতারাও পারস্পরিক সম্মতিক্রমেই এ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। জুয়া খেলে যারা, তাদেরও পারস্পরিক সম্মতি থাকে, তাতেই হারাম কখনই হালাল হয়ে যেতে পারে না। এ ধরনের সম্মতি গ্রহণযোগ্য নয়। এটা এমন নয় যে, এতে ধোঁকাবাজি ও সীমালংঘনের সামান্য অংশও নেই। এতে এক পক্ষের মুনাফা নিশ্চিত আর অন্য পক্ষের লাভবান হওয়া সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এসব ক্ষেত্রে আসল ভিত্তি হতে হবে সম্পূর্ণ নির্ভেজাল সুবিচার ও ন্যায়পরতা। সর্ব ব্যাপারেই তা এমনভাবে নিশ্চিত হতে হবে যে, না নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, না অন্যরা ক্ষতির মধ্যে পড়বে।

বীমা কোম্পানী কি পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা

বীমাকারী ও বীমা কোম্পানীর মধ্যে সম্পর্ক অংশীদারী কারবারের মতো নয়। তাহলে সে সম্পর্কের রূপটা কি? তাদের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্যের সম্পর্ক কি এটা? এসব প্রতিষ্ঠান কি পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা যা দানকারীদের সহযোগিতা বা অংশীদারিত্বে চালান হয়? আর আর্থিক অংশীদারিত্ব হয় পরস্পরের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে?…তা যে নয়, তাতো সুস্পষ্ট।

পারস্পরিক সাহায্যের জন্যে নির্ভুল কর্মপন্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। বিপন্ন লোকদের সাহায্য করা তার লক্ষ্য হওয়া উচিত এবং এ উদ্দেশ্যেই অর্থ জমা হওয়া উচিত। এজন্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবেঃ

১. ব্যক্তি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদ ভ্রাতৃত্বের খাতিরে দান হিসেবে দেবে এবং এ ফাণ্ড থেকে কেবলমাত্র প্রয়োজন ক্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাহায্য করতে হবে।

২. ফণ্ড থেকে উপকৃত হওয়ার জন্যে কেবলমাত্র বৈধ পন্থাই অবলম্বন করতে হবে।

৩. কেউ যেন এ উদ্দেশ্যে দান না দেয় যে, দুর্ঘটনা সঙ্ঘটিত হলে সে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লাভ করবে। বরং প্রতিষ্ঠানের ফাণ্ড থেকে সাধ্যমত একটা দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেন তা দিয়ে সম্পূর্ণ বা যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। ( আরবি******************)

৪. দান দানই। তা ফেরত নেয়া সম্পূর্ণ হারাম। কাজেই যখন কোন দুর্ঘটনা ঘটবে তখন তাতে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিচার বিবেচনা করতে হবে।

এ শর্তসমূহ কেবলমাত্র এমন কতিপয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ওপরই প্রযোজ্য হতে পারে, যা ঠিক এ উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাতে ব্যক্তিরা দান হিসেবে নিজেদের মাসিক অংশ আদায় করে দেবে, তা ফেরত নেয়ার তাদের কোন অধিকার থাকবে না। এ শর্ত ধার্য থাকে না যে, বিপদকালে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তাদের পেয়ে যেতে হবে।

কিন্তু বীমা কোম্পানীসমূহ এবং বিশেষ করে জীবন বীমায় নিম্নোক্ত শর্তসমূহ আদৌ আরোপ করা হয় না। তার অবস্থা সম্পর্ণ স্বতন্ত্র।

১. বীমাকারীরা (policy Holdders) দান হিসেবে কিস্তি দেয় না। তার চিন্তাও তাদের মনে জাগে না।

২. বীমা কোম্পানীসমূহ নিজেদের মূলধন হারাম সুদী করবারে বিনিয়োগ করে মুনাফা কামাই করে। কিন্তু কোন মুসলমানই সুদী কারবারে শরীক হতে পারে না। এ ব্যাপারে সুবিধাবাদী ও কঠোরতাবাদী সকলেই একমত।

৩. বীমাকারী চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সমস্ত কিস্তির টাকা ফেরত নিয়ে নেয়। সেই সাথে সে আরও অতিরিক্ত টাকা পেয়ে যায়। তা হলে এ অতিরিক্ত টাকা সুদ ছাড়া আর কি মনে করা যেতে পারে?

অনুরূপভাবে ধনী সামর্থবান ব্যক্তিকে অভাবগ্রস্ত দরিদ্র ব্যক্তির তুলনায় বেশি টাকা দেয়াও পারস্পরিক সাহায্যমূলক ভাবধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা দেখা যায়, অর্থশালী ব্যক্তি মোটা টাকার বীমা করায়। এ জন্যে মৃত্যু বা দুর্ঘটনা কালে তাকে সেই অনুপাতে অনেক বেশি টাকা দেয়া হয়। কিন্তু সাহায্য করার ভাবধারা টাকা দেয়া হবে।

৪. যে ব্যক্তি বীমার চুক্তি শেষ করতে ইচ্ছুক হয়, তাকে দিয়ে দেয়া অংশের টাকায় বড় ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। কিন্তু এরূপ ক্ষতি স্বীকার করার শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন বৈধ কারণ নেই।

পরিবর্তন ও সংশোধনী

এ সব সত্ত্বেও বর্তমানে প্রচলিত ‍দুর্ঘটনা সংক্রান্ত বীমা ব্যবস্থার সংশোধন করে তাকে ইসলামী নিয়ম নীতির খুব কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভবপর। আর তার জন্যে এ ব্যবস্থা নিতে হবে যে, বিনিময়ের শর্তের ভিত্তিতে দানসমূহ গ্রহণ করার নীতি অবলম্বন করতে হবে। বীমাকারী কোম্পানীকে আর্থিক সাহায্য দেবে এ শর্তে যে, দুর্ঘটনা ঘটলে কোম্পানী তাকে ক্ষতিপূরণ দেবে, তাতে তার সাহায্য হয়ে যাবে, বিপদের মাত্রা লাঘব হবে। কোন কোন ফিকহী মতে এরূপ চুক্তি জায়েয। বীমার ক্ষেত্রে যদি এরূপ পরিবর্তন ও সংশোধনী কার্যকর করে নেয়া হয় আর বীমা কোম্পানীসমূহের কার্যাদি সুদমুক্ত হয়, তাহলে তা জায়েয হবে বলে মনে করা যায়। কিন্তু জীবন-বীমার সমস্ত ব্যাপার শরীয়তের বিধান থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থিত।

ইসলামে বীমা পদ্ধতি

বীমা কোম্পানীসমূহ বর্তমানে ইসলামী বিধান অনুযায়ী চলছে না, তা আমরা দেখতে পেলাম। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, মূল বীমা ব্যাপারটাই বুঝি ইসলামের পরিপন্থী। আসলে তা নায়। তার বর্তমান প্রচলিত নীতিগুলোই শুধু ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ, এ হচ্ছে আসল কথা। তাতে ‍যদি ইসলাম অনুকূল নিয়ম-নীতি অবলম্বন করা হয়, তাহলে তা ইসলামের দৃষ্টিতে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে।

সত্যি কথা এই যে, ইসলামী জীবন-বিধান মুসলিম জনগণ ও ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন বসবাসকারী লোকদের জন্যে সামষ্টিক ভরণ-পোষণ ব্যবস্থা বা সরকারী অর্থ ভাণ্ডার তথা বায়তুলমালের সাহায্যে বীমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর করেছে। ইসলামের বায়তুলমাল প্রকৃতপক্ষে জনগণের জন্যে বীমা কোম্পানিই বটে। যারাই তার অধীন বসবাস করবে তাদের সকলের জন্যেই তা কাজে আসবে।

দুর্ঘটনা ও বিপদ-আপদকালে ব্যক্তিদের সাহায্য সহযোগিতা করার দায়িত্ব ইসলাম গ্রহণ করেছে। কেউ যদি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে সে সরকারী দায়িত্বশীলের কাছে নিজের সমস্যা পেশ করতে পারে। সরকার সেই অনুযায়ী তার ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মৃত্যুর পর অসহায় উত্তরাধিকারীদের জন্যেও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।

নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ ( আরবি******************)

প্রত্যেকটি মুসলিমের সাথে আমার সম্পর্ক তার নিজের তুলনায়ও অনেক বেশি নিকটবর্তী। যে মুসলমান ধন-মাল রেখে যাবে তা তার উত্তরাধিকারীই পাবে। আর যে লোক ঋণ বা অক্ষম শিশু সন্তান রেখে যাবে সেই ঋণ শোধ ও শিশুদের লালন-পালনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমার ওপরই বর্তিবে।

ইসলাম মুসলিম জনগণের জন্যে যে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা হচ্ছে ফরয যাকাত ব্যয়ের জন্যে নির্দিষ্ট করা ক্ষেত্র ( আরবি******************) ঋণগ্রস্ত লোকগণ। পূর্বকালের কোন কোন তাফসীরকার এ শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ ( আরবি******************)

যার ঘরবাড়ি সব পুড়ে গেছে কিংবা বন্যা-বাদল যার সব ধন-সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সে-ই এ গারেমীন-এর মধ্যে গণ্য।

কৃষি জমিতে ফসল উৎপাদন

মুসলমান কৃষি জমির মালিকানা শরীয়ত মুতাবিক লাভ করলে সে জমি চাষ করে ফসল লভ করা বা গাছপালা লাগিয়ে ফল ফলাদি হাসিল করা তার একান্ত কর্তব্য হয়ে পড়ে। বিনা চাষে জমিকে বেকার ফেলে রাখা ইসলামে অবৈধ কাজ। কেননা তা করা হলে আল্লাহর দেয়া নিয়ামতের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হবে। ধন-সম্পত্তির অপচয়ও বলা যায় তাকে। অথচ নবী করীম (সা) ধন-সম্পত্তি বিনষ্ট করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। জমি মালিক জমি থেকে উপকৃত হওয়ার জন্যে নানাবিধ পন্থা ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে পারে।

জমি কাজে লাগাবার নানা উপায়

জমির মালিক নিজেই জমি চাষাবাদ করবে। গাছপালা লাগিয়ে তাতে পানি সেচ করার সুষ্ঠ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তার ফলে সে জমিতে ফসল ফলবে বা গাছ পালায় ফলন ধরবে। এটা বস্তুতই খুব পছন্দনীয় কাজ। যেসব মানুষ, পাখি ও জীবজন্তু এসব ক্ষেত বাগান থেকে উপকৃত হবে, তার সওয়াব সেই মালিকই পাবে। রাসূলে করীম (সা)-এর বড় বড় সাহাবী যে কৃষি ও বাগান রচনার কাজ করেছেন, তা তো সকলেই জানা কথা।

দ্বিতীয় পন্থা

জমি মালিক নিজ জমি চাষাবাদ করতে পারছে না। তখন সে নিজের জমি এমন ব্যক্তিকে ধার হিসেবে দিয়ে দেবে, যে নিজের যন্ত্রপাতি, শ্রমিক, বীজ ও জন্তু লাগিয়ে চাষাবাদের কাজ সম্পন্ন করবে। কিন্তু জমি মালিক নিজে তা থেকে কিছুই নেবে না। এভাবে ধারে জমিদান ইসলামে কাম্য ও প্রশংসিত। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)

যার জমি আছে, সে নিজে তা চাষাবাদ করবে, নতুবা তার ভাইকে তা চাষাবাদের জন্যে দিয়ে দেবে।

হযরত জাবির (রা) বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)

আমরা নবী করীম (সা)-এর যুগে ‘মুজাবিরাত’ নিয়মে জমি চাষাবাদ করতাম। ফলে আমরা কাটাই হওয়ার পর শীষের মধ্যে অবশিষ্ট দানাগুলো এখান-ওখান থেকে পেয়ে যেতাম। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ যার জমি আছে, সে যেন নিজে তা চাষাবাদ করে কিংবা তার ভাইকে বিনিময় ব্যতিরেকেই চাষ করতে দিয়ে দেয়। আর তা-ও না করলে তা ছেড়ে দেবে।

‘মুজাবিরাত’ অর্থ জমির একাংশের ভিত্তিতে তা চাষাবাদ করা।

কোন কোন লোক এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থের ভিত্তিতে বলেছেন, জমি দ্বারা উপকার গ্রহণের এ দুটি পন্থাই শরীয়তসম্মত, হয় নিজেই তা চাষ করবে নতুবা কোনরূপ মূল্য বা বিনিময় ছাড়াই কাউকে জমি চাষ করতে দিয়ে দেবে। আর তা হতে পারে এভাবে যে, জমি হবে তার, যে তার মালিক আর ফসল হবে তার, যে তার চাষাবাদ করবে।

( আরবি******************)

টাকা বা পয়সার বিনিময়ে জমি লাগিয়ে দেয়া ঠিক নয়। অন্য কোন প্রকান চুক্তিতেও জমি দেয়া যায় না। শুধু একটি উপায়ই আছে। হয় মালিক নিজে তা চাষাবাদ করবে, না হয় কোনরূপ বিনিময় ছাড়াই অন্যকে তা দিয়ে দেবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন, এ সব হাদীসে জমি দিয়ে দিতে যে বলা হয়েছে, তার অর্থ এ নয় যে, দিয়ে দেয়া ওয়াজিব। আসলে তা মুস্তাহাব মাত্র। এভাবে দিয়ে দেয়াটা বেশ পছন্দনীয় কাজ। আমার ইবনে দীনার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ হযরত ইবনে আব্বাসের প্রখ্যাত ছাত্র তায়ূসকে জিজ্ঞেস করলামঃ আমি যদি ‘মজাবিরাত’ (জমি ভাগে চাষ) পরিহার করি, তাহলে কেমন হয়? জবাবে তায়ূস বললেনঃ সবচেয়ে বড় আলিম হযরত ইবনে আব্বাস (রা) আমাকে বলেছেন যে, নবী করীম (সা) তা নিষেধ করেন নি। তিনি কথাটি বলেছেন এভাবেঃ ( আরবি******************)

তোমরা নিজের ভাইকে বিনিময় ছাড়াই জমি দিয়ে দেয়া তার কাছ থেকে ‘কর’ আদায় করার চেয়ে উত্তম। (বুখারী)

ভাগে জমি চাষ

তৃতীয় পন্থা হচ্ছে, যে লোক নিজের যন্ত্রপাতি বীজ ও জন্তু দ্বারা চাষের কাজ করবে, জমি মালিক তাকে জমি দেবে এ শর্তে যে, জমি ফসলের উভয়ের সম্মত পরিমাণ অংশ যেমন অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ সে পাবে। জমি মালিক জমি চাষকারীকে বীজ যন্ত্রপাতি ও জন্তু দিলে তাও জায়েয হবে। এ পন্থায় জমি চাষাবাদে ব্যবস্থা করলে তাকে পারস্পরিক জমি চাষ, ভাগে জমি চাষ, মুখাবিরা, মুসাকাত ইত্যাদি বলা হয়।

নবী করীম (সা) নিজে খায়বরের জমি অর্ধেক ফসলের শর্তে চাষ করতে দিয়েছিলেন। (বুখারী, মুসলিম) এ ধরনের পারস্পরিক ‘চাষাবাদকে’ যে সব ফিকাহবিদ জায়েয মনে করেন, রাসূলে করীম (সা)-এর উপরিউক্ত কাজ তাঁদের দলিল। তাঁরা বলছেনঃ এ এক প্রখ্যাত সর্বজনপরিচিত ও সহীহ ব্যাপার। রাসূলে করীম (সা) জীবনভর মৃত্যু পর্যন্ত এ পন্থায় আমল করেছেন। তাঁর পরবর্তীকালের লোকেরাও তা-ই করেছেন। তার পরে খুলাফায়ে রাশেদুনও শেষ পর্যন্ত তাঁরই পদাংক অনুসরণ করেছেন। মদীনার এমন কোন ঘরই ছিল না, যে ঘরের লোকেরাও এ পন্থায় চাষাবাদের কাজ করেন নি। নবী করীম (সা)-এর বেগমরা এ নীতিরই অনুসরণ করেছেন। এ এমন একটা ব্যাপার যা নাকচ বা প্রত্যাহার করা যেতে পারে না। কেননা প্রত্যাহার বা নীতি বদল তো কেবলমাত্র নবী করীম (সা)-এর জীবদ্দশাতেই হতে পারত। কিন্তু যে কাজ তিনি মৃত্যু পর্যন্ত করলেন, তাঁর পর খলীফাগণও করলেন, সাহাবিগণ যে ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত ও সর্বসম্মতভাবে আমল করেছেন, একজনও যে নীতি বিরোধিতা বা প্রতিবাদ করেন নি, তা কি করে পরিত্যাক্ত ও নাকচ হয়ে যেতে পারে? আর রাসূলে করীম (সা)-এর জীবদ্দশায়ই যদি তা পরিত্যক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তার পর তাঁর অনুসারী লোকেরা এ পন্থায় কি করে চাষাবাদ করলেন? এ বিষয়টি গোপন থাকলই বা কি করে যে, খুলাফায়ে রাশেদুন পর্যন্ত তা জানলেন না? অথচ খায়বারের ব্যাপারটি তো সর্বজনবিদিত। পরিত্যক্ত পওয়ার কথা যিনি বর্ণনা করেন তিনি-ই বা তখন কোথায় ছিলেন যে, তিনি কাউকে কিছু জানালেন না? ( আরবি******************)

ভুল নীতিতে পারস্পরিক চাষাবাদ

নবী করীম (সা)-এর সময়ে আর এক ধরনের চাষাবাদ প্রচলিত ছিল। কিন্তু তাতে ধোঁকা, প্রতারণা ঠকবাজি ও অজ্ঞতার অবকাশ ছিল, যার দরুন পক্ষদ্বয়ের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হতো। এজন্যে নবী করীম (সা) চাষাবাদের এ পন্থাকে নিষেদ্ধ ঘোষণা করেন। দ্বিতীয়ত, ইসলাম সুস্পষ্ট ন্যায়পরতা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে চায়; কিন্তু উপরিউক্ত পন্থায় চাষাবাদে সেই ন্যায়পরতা ও ইনসাফের পরিপন্থী কাজ হলেই তিনি তা নিষেধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

সে পন্থা ছিল এই যে, জমি মালিক চাষকারীর উপর এ শর্ত চাপিয়ে দিত যে, নির্দিষ্ট জমির এক-চতুর্থাংশ তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে ও তা সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। সমগ্র চাষের !ব্দর সে সেই নির্দিষ্ট জমিটুকুরই ফসল পাবে, তা যতটাই হোক। অথবা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল মাপা বা ওজন করা সে পাবে। আর অবশিষ্ট ফসল থাকবে একা চাষকারীর জন্যে, অথবা তা দুজসের মধ্যে আধা-আধি ভাগ করে দেয়া হবে।

কিন্তু নবী করীম (সা) দেখলেন যে, ন্যায়পরতা ও সুবিচারের দাবি হচ্ছে এই যে, সর্বমোট ফসলেই- তা কম হোক বেশি হোক, উভয় পক্ষকে শরীক হতে হবে। তাদের দুজনের একজনের জন্যে একটা পরিমাণ জমি বা ফসল পূর্বেই নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়া ঠিক কাজ নয়। কেননা অনেক সময় জমির সেই অংশ হয়ত কোন ফসলই দিল না। তাহলে তো একজনই মাত্র যা পাওয়ার পেয়ে যাবে। আর অপর জন প্রতারিত ও বঞ্চিত হয়ে থাকবে। কেননা নির্দিষ্ট খণ্ড জমিতে হয়ত কোন ফসলই ফললো না। তাহলে সে তো কিছুই পেল না অথচ অপর পক্ষ পুরোপুরি পেয়ে গেল। এরূপ অবস্থায় ইনসাফ পূর্ণ পন্থা এই হতে পারে যে, পারস্পরিক চুক্তি অনুযায়ী সমস্ত জমির সমস্ত ফসল থেকেই প্রত্যেক পক্ষ নিজ অংশ গ্রহণ করবে। যদি জমির ফসল বেশি হলো তাহলে তার ফায়দা উভয় পক্ষই পেলো। আর যদি কম হয় তাহলে উভয়ই কম কম করে পেয়ে গেল। আর যদি কোন ফসলই না হয়, সে বঞ্চনায়ও উভয় পক্ষই শরীক থাকবে। পক্ষদ্বয়ের জন্যে এ পন্থাই যে উত্তম, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

হযরত রাফে ইবনে খদীজ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ ( আরবি******************)

আমাদের মধ্যে যাদের জমি ছিল তারা বেশির ভাগ পারস্পরিক চাষাবাদের নীতিতে কাজ করত। তারা জমি এ শর্তে কেরায়া দিত যে, তার এক কোণের জমির ফসল জমির মালিকের জন্যে নির্দিষ্ট করা হতো। কিন্তু অবস্থা এই হতো যে, জমির সেই নির্দিষ্ট অংশে কোন ফসল হতো না, হতো অপর ভাগে। আর কখনও জমির সেই নির্দিষ্ট অংশে ফসল হতো অপর অংশে হতো না। এই কারণে এ রূপ চাষাবাদের কাজ করতে আমাদের নিষেধ করে দেয়া হয়।

এই হযরত রাফে বলেছেনঃ ( আরবি******************)

নবী করীম (সা)-এর লোকেরা খালের কিনারে ও পানি প্রবাহের মুখের স্থানে ফল-ফসলের শর্তে চাষাবাদের চুক্তি করত কিংবা ফসল থেকে কিছু দেয়ার বিনিময়ে করত। পরে দেখা যেত এ অংশের ফসল নষ্ট হয়েছে, এ অংশের ফসল রক্ষা পেয়েছে অথবা এর বিপরীতটা হতো। আর লোকদের জন্যে এ পন্থা ভিন্ন জমি লাগানো আর কোন নিয়ম ছিল না। এ কারণে তা নিষেধ করা হয়। (মুসলিম)

নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ ( আরবি******************)

তোমাদের চাষের জমি-ক্ষেত লাগান-পরানের কাজ তোমরা কিভাবে কর?

লোকেরা বললঃ ( আরবি******************)

আমরা এক-চতুর্থাংশ এবং খেজুর ও গমের একটা পরিমাণের বিনিময়ে পারস্পরিক চাষের চুক্তি করি।

এ কথা শুনে তিনি বললেনঃ তোমরা তা করবে না। এর অর্থ তখন একটা নির্দিষ্ট মাপের পরিমাণ ঠিক করে দিত, তারা তার ওপর থেকে নিয়ে নিত। পরে চাষকারীদের মধ্যে অবশিষ্ট ফসল ভাগ করা হতো। কেউ এক-চতুর্থাংশ কেউ চার ভাগের তিন ভাগ নিয়ে নিত।

এসব ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, নবী করীম (সা) তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাত্মক সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠার জন্যে বিশেষভাবে উদগ্রীব থাকতেন। আর যে যে কারণে পারস্পরিক ঝগড়া-বিসম্বাদের সৃষ্টি হতে পারে বলে আশংকা করতেন, তিনি মুমিনদের সমাজ থেকে সেই সবকিছু দূর করে দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।

হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা) বর্ণনা করেছেনঃ নবী করীম (সা)-এর সামনেই দুই ব্যক্তি জমি নিয়ে ঝগড়া করল। তখন তিনি বললেনঃ ( আরবি******************)

তোমাদের অবস্থা যদি এ-ই হয়ে থাকে, তাহলে তোমরা চাষ জমি ভাড়ায় দিও না।

অতএব প্রত্যেক জমি মালিকের উচিত তার সঙ্গী ও সাথীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ও মর্যাদা দানকারী হওয়া। এজন্যে জমি মালিক যেন ফসলের বেশির ভাগই দাবি করে না বসে। পক্ষান্তরে চাষকারীও জমি মালিককে তার জমির দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ না করে। এ প্রেক্ষিতে হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ ( আরবি******************)

পারস্পরিক ভিত্তিতে জমি চাষাবাদ করাকে নবী করীম (সা) হারাম করে দেন নি। বরং তিনি তো পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেককে অপরের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ অবলম্বন করতে বলেছেন। (তিরমিযী)

এজন্যে তায়ূসকে যখন বলা হলো, হে আবূ আবদুর রহমান! এ ‘মুখাবিরা’ যদি ত্যাগ করি তাহলে তো ভাল হয়। কেননা লোকেরা মনে করে যে, নবী করীম (সা) তা করতে লোকদের নিষেধ করেছেন। তখন তিনি বলেছিলেনঃ

আমি তাদের সাহায্য করব, আমি তাদের দেব।

তারা নিজেদের জমি থেকে বেশি বেশি কামাই করার চিন্তিই করত না। যারা জমিতে শ্রম-মেহনত করে, তারা ক্ষুধায় কাতর হয়ে থাক, তা-ই তারা চাইত না। বরং তারা তাদের সাহায্য করত, তাদের দিত। আর বস্তুত এই হচ্ছে মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য।

অনেক সময় জমি মালিক জমিকে বেকার ফেলে রাখে। তাতে চাষাবাদও করে না, গাছ-পালাও লাগায় না। কিন্তু কোন চাষাবাদকারীকেও স্বল্প বিনিময়ে জমি দিতে প্রস্তুত হয় না। এ কারণে পযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ তাঁর খিলাফতের বিভিন্ন দায়িত্বশীলদের নির্দেশ দিয়েছিলেনঃ এক-চতুর্থাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ অথবা এক-পঞ্চমাংশ ফসলের বিনিময়ে লোকদের জমি চাষ করতে দাও, দশমাংশ পর্যন্তও দিতে বলেছিলেন এবং জমিকে অনাবাদী করে রাখতে নিষেধ করেছিলেন।

নগদ টাকায় জমি লাগানো

চতুর্থ পন্থা এই হতে পারে যে, চাষাবাদকারীকে জমি চাষ করতে দেয়া হবে এ শর্তে যে, সে নগদ টাকায় মূল্য আদায় করবে।

বহু প্রখ্যাত ফিকাহবিদই এ পন্থাকে জায়েয বলেছেন। অবশ্য অপর কিছু সংখ্যক ফিকাহবিদ তা নিষেধ করেছেন। তাঁদের দলিল হচ্ছে নবী করীম (সা) জমি কেরায়ায় দিতে নিষেধ করেছেন- এটি সহীহ্ বর্ণনা। হযরত আবূ বকর, হযরত উমর, হযরত রাফে ইবনে খদীজ, হযরত জাবির, আবূ সায়ীদ, আবূ হুরায়রা ও ইবনে উমর (রা) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাঁরা সকলেই বলেন যে, নবী করীম (সা) জমিকে কেরায়ায় লাগাতে অকাট্যভাবে নিষেধ করেছেন।

( আরবি******************)

জমি কেরায়া লাগানোর ভিন্নতর পন্থা ভাগে চাষ করানো। নবী করীম (সা) তাঁর জীবদ্দশায় খায়বর অধিবাসীদের সাথে এ চুক্তিই করেছেলেন এবং তার ওপর তিনি শেষ পর্যন্ত অবিচল রয়েছিলেন। খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলেও তার ব্যতিক্রম কিছু করা হয় নি।

এ পর্যায়ে ইসলামী আইনের ক্রমবিবর্তন যারা লক্ষ্য করেছেন, তাঁদের কাছে ইবনে হাজমের কথার যথার্থতা খুবই স্পষ্ট হয়ে থাকবে। তিনি লিখেছেন, নবী করীম (সা) যখন তাদের মধ্যে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁরা তাঁদের চাষের জমি কেরায়ায় লাগাতেন। রাফে ইবনে খদীজ (রা) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। আর জমি কেরায়ায় লাগানোর ব্যাপারটা রাসূলে করীম (সা)-এর উপস্থিতির পূর্বেও যেমন চলত, তার পরও তাতে পরিবর্তন আসেনি। এ ব্যাপারে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারেন না। এরপর হযরত জাবির, আবূ হুরায়রা, আবূ সায়ীদ, রাফে, যহীর (রা) ও বদর যুদ্ধে শরীক হওয়া সাহাবী এবং হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ ( আরবি******************)

নবী করীম (সা) জমি কেরায়া লাগাতে সার্বিকভাবে নিষেধ করেছেন।

এ হাদীসের দ্বারা পূর্বের মুবাহ নীতি যে বাতিল হয়ে গেল, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। অতএব নগদ টাকায় জমি কেরায়া লাগানো যাঁরা জায়েয বলেন, তাঁরা ভুল কথা বলেন। তাঁদের কথা কখনই সহীহ প্রমাণিত হতে পারে না। তবে উৎপন্ন ফসলের নির্দিষ্ট অংশ দেয়ার বিনিময়ে তা কেরায়ায় লাগানো যায়েয হতে পারে। কেননা নবী করীম (সা) থেকে এবথা প্রমাণিত যে, তিনি কেরায়ায় জমি লাগাতে নিষেধ করার পর খায়বরে ফসলের ভাগের ভিত্তিতে জমি চাষ করে দেয়ার চুক্তি করেছিলেন এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত এ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অপরিবর্তীত ছিল। ( আরবি******************)

প্রাথমিককালের অনেক ফিকাহবিদই এ মত পোষণ করতেন। ইয়েমেনের প্রখ্যাত ফিকাহবিদ ও মহামান্য তাবেয়ী তায়ূস স্বর্ণ-রৌপ্যের বিনিময়ে জমি চাষ করতে দেয়াকে মাকরূহ মনে করতেন। কিন্তু ফসল ভাগে দেয়ায়- তা এক তৃতীয়াংশ হোক বা চতুর্থাংশ- কোন দোষ মনে করতেন না। কেউ কেউ যখন এ বিষয়ে আপত্তি প্রকাশ করলেন এবং বললেন যে, নবী করীম (সা) জমি কেরায়া লাগাতে নিষেধ করেছেন, তখন তিনি বললেনঃ আমাদের কাছে হযরত মু’আয উপস্থিত হলেন- নবী করীম (সা)-ই তাঁকে ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন, তখন তিনি এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ ফসলের শর্তে জমি চাষ করতে ‍দিয়েছিলেন। আর আজ পর্যন্ত তাই করে যাচ্ছি।

এ থেকে বোঝা যায়, তায়ূসের মতে নগদ মূল্যে জমি কেরায়া লাগানোই নিষেধ। তবে ফসল ভগের শর্তে জমি চাষ করতে দেয়ায় কোন অসুবিধা নেই।

মুহাম্মদ ইবনে সিরীন, কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবূ বকর সিদ্দীক থেকেও এ কথাই জানা গেছে। তবে তাবেয়ীনের মধ্য থেকে কিছু লোক জমি যে-কোন ভাবে কেরায়ায় দেয়াকে নিষিদ্ধ বলে মনে করেন, তা নগত মূল্যেই হোক আর ফসল ভাগের ভিত্তিতেই হোক। কিন্তু এ মত খুব বলিষ্ঠ নয়। কেননা নবী করীম (সা) খূলাফায়ে রাশেদুন ও হযরত মু’আয (রা) নিজেরা ফসল ভাগের শর্তে জমি চাষাবাদ করেছেন, করিয়েছেন। তাতে এই পন্থার জায়েয হওয়ার কথা নিঃসন্দেহে জানা যায়। প্রাক্তন কালসমূহে মুসলমানদের জন্যে কার্যত এ নীতি অনুযায়ীই আইন প্রণয়ন করা হতো। তবে নগদ মূল্যের বিনিময়ে জমি কেরায়ায় দেয়া যে নিষেধ, তা হাদীস থেকেই প্রমাণিত। আর তা যে ‍যুক্তিসঙ্গত, তাও নিঃসন্দেহ।

নগদ মূল্যে জমি লাগানো নিষিদ্ধ হওয়ার যৌক্তিকতা

ইসলামের মৌলনীতি ও আদর্শের দৃষ্টিতে চিন্তা-বিবেচনা করলে খালি জমি নগদ টাকার বিনিময়ে লাগানো নাজায়েয হওয়াই বাঞ্ছনীয় মনে হবে।

ক. নবী করীম (সা) উৎপন্ন ফসলের একটা নির্দিষ্ট অংশের বিনিময়ে জমি কেরায়া লাগাতে নিষেধ করেছেন। কেবলমাত্র ফসলের হারের ভিত্তিতে লাগানোটাই জায়েয অর্থাৎ উৎপাদনের তিন ভাগের এক ভাগ বা চার ভাগের একভাগের ভিত্তিতে জমি লাগানো যেতে পারে। শতকরা হারে (percentage) ভাগ ঠিক করলে খুবই ভাল হয় বলে আমরা মনে করি। তাহলে উৎপন্ন ফসলের অংশ লাভ করার ব্যাপারে উভয় পক্ষই সমানভাবে উপকৃত হবে। কোন বিপদের ফলে যদি ফসলের কোন ক্ষতি হয়, তাহলে সে ক্ষতিতেও দুই পক্ষ সমান হারে শরীক থাকবে। কিন্তু এক পক্ষের পাওনা যদি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, তাহলে সে তো ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে; কিন্তু অপর পক্ষের অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে যাওয়া একান্তই অবধারিত। তার ভাগে ঘাস শুকানো ছাড়া আর কিছু মিলবে না। এটা তো সুদ ও জুয়ার সাথে পুরোমাত্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাপার। এ দুয়ের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য থাকে না।

এ দৃষ্টিতে যখন নগদ টাকায় জমি লাগানোর ব্যাপারটা বিবেচনা করা যায়, তাহলে তাতেও উপরি উল্লিখিত নিষিদ্ধ ধরনের পারস্পরিক চাষের মধ্যে কোন পার্থক্যই ধরা পড়ে না। জমি মালিক নগদে তার পাওনাটা নিশ্চিত রূপেই পেয়ে যায়। কিন্তু যে লোক এ টাকা দিয়ে চাষের জন্যে জমি নিল, সে তো নিজের শ্রম, যায়। কিন্তু যে লোক এ টাকা দিয়ে চাষের জন্যে জমি নিল, সে তো নিজের শ্রম, মেহনত ও মূলধন সবকিছুই কঠিন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। সে জমি থেকে কিছু পাবে কি না, তার কোন নিশ্চয়তাই তার থাকে না। তাতে ফসল ফলবে কি না, তার কিছুই জানা নেই।

খ. উপরন্তু একজন যখন কোন জিনিস কেরায়ার ভিত্তিতে কাউকে দেয় সে তো তার মালিক। সে তার কেরায়া পাওয়ার অধিকারী হয় এ কারণে যে, সেই জিনিসটিকে ব্যবহার করে ফায়দা লাভের উপযুক্ত করে কেরায়ায় গ্রহণকারীর হাতে সোপর্দ করে দেয়। তা ব্যবহার করার দরুন তাতে যে অপচয় (Depercition) দেখা দেয় তার বিনিময় মূল্য পাওয়ার তার অধিকার রয়েছে। কিন্তু জমিকে কেরায়ায় লাগাতে কোনরূপ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। জমিতে উৎপাদন শক্তি তো জমি মালিক সৃষ্টি করেন না, তা তো সম্পূর্ণ আল্লাহরই দান। দ্বিতীয়, চাষাবাদ করা হলে জমির কোন ‘অপচয়’ হয় না, যন্ত্রপাতির ন্যায় তাতে ময়লাও ধরে না, দালান-কোঠার ন্যায় তা পুরাতনও হয়ে যায় না।

গ. এও সত্য যে, কেউ যখন কোন বাড়ি কেরায়ায় গ্রহণ করে, তখন সে তাতে অবস্থান ও বসবাস করে, তা থেকে সরাসরি উপকৃত হয়। মাঝখানে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকে না। এমনিভাবে কোন যন্ত্র ভারা করলেও ঠিক সেই আসল জিনিসটার দ্বারাই উপকৃত হওয়া যায়। কিন্তু জমি থেকে সরাসরি উপকার পাওয়া সম্ভব হয় না, আর তা থেকে উপকার লাভ নিশ্চিতও কিছু নয়। জমির ব্যাপারটা ভাড়াটে বাড়ির মতো নয়, তা থেকে ফায়দা লাভ এক অনিশ্চিত ব্যাপার। বরং জমি যখন কেরায়ায় গ্রহণ করে কেউ, তখন সে তা থেকে উপকৃত হওয়ার আশাতেই করে। আর এ আশায়ই সে তাতে শ্রম মেহনত করে, পয়সা ও সময় ব্যয় করে, তারপরও সে তা থেকে কখনও ফায়দা লাভ করে, কখনও তা করে না। কাজেই জমি ভাড়ায় গ্রহণকে বাড়ি ইত্যাদি কেরায়ায় লওয়ার মতো মনে করা ঠিক নয়।

ঘ. সহীহ্ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছেঃ

ফল-ফলাদি পরিপক্ক হওয়ার পূর্বে ক্ষেতে ও বাগানে থাকা অবস্থায় ক্রয়-বিক্রয় করতে নবী করীম (সা) নিষেধ করেছেন। আর তার কারণ স্বরূপ বলেছেন, ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ্ যদি ফল থেকে বঞ্চিত করে দেন, তাহলে তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে নেয়া টাকা তোমার জন্যে হালাল হতে পরবে কেমন করে? ফলগুলো পাকতে শুরু করেছে, কিন্তু এখনও তা সুরক্ষিতভাবে পেয়ে যাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই। কেননা তা কোন বিপদের কারণে নাও পাকতে পারে- এই যখন অবস্থা, তখন খালি জমি- যাতে কোদাল পর্যন্ত লাগান হয়নি, তাতে বীজও ফেলা হয়নি- কেরায়ায় দেয়া নিষিদ্ধ হবে না কেন? আসলে সঠিক ও ইনসাফপূর্ণ পন্থা হচ্ছে ফসলের হার ভাগের ভিত্তিতে পারস্পরিক চাষাবাদ। তাতে কাজের উভয় পক্ষই মুনাফা বা ফায়দায় সমানভাবে শরীক থাকে, ক্ষতি হলেও তা দুজনেরই ভাগে পড়ে।

( আরবি******************)

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ফসলের হার ভাগের ভিত্তিতে জমি চাষ করানোই হচ্ছে ইসলামী শরীয়তের মৌলনীতি ও সুবিচার ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পন্থা। আর কেরায়ায় দেয়ার তুলনায় ফসল ভাগের ভিত্তিতে চুক্তি অধিকতর সুবিচার ও ন্যায়পরতা সম্পন্ন। কেননা এ পন্থাতেই উভয় পক্ষ লাভ ও লোকসান উভয়তেই শরীক থাকে। জমি কেরায়ায় দেয়ার ব্যাপারটি ভিন্নতর। তাতে জমি-মালিক কেরায়া তো পেয়ে যায়, কিন্তু কেরায়াদারের ভাগে কখনও ফসল উঠে আর কখনও তাকে তা থেকে বঞ্ছিত থাকতে হয়।

( আরবি******************)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেনঃ

যে ধরনের পারস্পরিক চাষাবাদ ইনসাফপূর্ণ, মুসলমানরা তদানুযায়ী রাসূলে করীম (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদুনের আমল থেকেই কাজ করে আসছে। আবূ বকর-উমর- উসমান-আলী (রা)-এর বংশধররাও তাই করেছেন। বড় বড় সাহাবী সাটাকেই জায়েয মনে করতেন। হযরত ইবনে মাসউদ, উবাই ইবনে কা’ব, যায়দ ইবনে সাবিত প্রমূখ সাহাবী (রা) এ মতই পোষণ করতেন। মুহাদ্দিস-ফিকাহবিদ ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে বাহওয়াই, ইমাম বুখারী, দাঊদ ইবনে আলী, ইবনে খুজাইমা, আবূ বকর ইবনুল মুনযির, মুহাম্মদ ইবনে নছর মরোজী প্রমুখও এ মতকেই যথার্থ ঘোষণা করেছে। আর মুসলমানদের নামকরা ফিকাহবিদ লাইস ইবনে সা’দ ইবনে আবূ রাইলা, আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ ইবনে ইমাম হাসান প্রমুখও এ মতই প্রকাশ করেছেন।

ইবনুল কাইয়্যেমের সময়ে কৃষিজীবীদের ওপর প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর লোকদের পক্ষ থেকে যে জোর-জুলুম চালান হয়েছে, তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ এ প্রশাসক ও সৈন্যবাহিনীর লোকেরা যদি আল্লাহ্ ও রাসূলের দেয়া শরীয়তের বিধান অনুযায়ী চাষীদের সাথে ব্যবহার করত, তাহলে তারা সকলে উপর ও নিচ থেকে দেয়া আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামত লাভ করতে পারত। আসমান ও জমিনের বরকতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হতো। তারা জুলুম ও নির্যাতন করে যা পায়, এক-চতুর্থাংশ গ্রহণ করলে তাও তার চাইতে অনেক বেশি হতো। কিন্তু ওরা মূর্খ, ওরা জালিম। তাই জুলুম ও পাপ ‍ভিন্ন ওদের করার আর কিছুই নেই। ফলে ওরা বরকত ও রিযকের প্রশস্ততা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর তার দরুন তাদের জন্যে পরকালীন আযাবই পুঞ্জীভূত হয়ে থাকল। দুনিয়ার কোন বরকত তাদের ভাগ্যে জুটবে না।

যদি প্রশ্ন করা হয়, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল এ পর্যায়ে কি বিধান দিয়েছেন এবং সাহাবিগণই বা কোন্ নীতি মেনে চলেছেন?

উত্তরে বলা যাবে, ঠিক যে পন্থা পারস্পরিক ইনসাফপূর্ণ, যাতে জমি মালিক ও চাষী সুবিচারের এক ও অভিন্ন মানে উত্তীর্ণ হতে পারে, প্রচলিত নিয়মে যেমন হয় তেমন বিশেষ এক পক্ষকে তার ভাগ্য সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয়ে অপর পক্ষকে অনিশ্চয়তার ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করা হয় না, তা-ই। দুনিয়ায় সাধারণভাবে প্রচলিত রসম-রেওয়াজ ভুইফোঁড় নীতিতে চলছে। তা-ই যত বিপর্যয় এনেছে পৃথিবীতে। জনগণকেও নিক্ষেপ করেছে কঠিন সংকটের মধ্যে। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়েছে, বরকত উঠে গেছে। প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর অধিকাংশ লোক হারাম খেতে শুরু করেছে। আর হারাম খাদ্যে তাদের দেহে যে গোশত জমেছে, তার জন্যে তো জাহান্নামই উপযুক্ত স্থান।

এই ইনসাফপূর্ণ কৃষি ব্যবস্থাই ছিল মুসলিম জনগণের অনুসৃত নীতি। নবী করীম (সা)-এর যুগেও যেমন, তেমন খুলাফায়ে রাশেদুন ও তৎপরবর্তীকালেও। স্বয়ং নবী করীম (সা) খায়বরবাসীদের সাথে এ নীতির ভিত্তিতেই জমি চাষের চুক্তি করেছিলেন। হযরত উমর (রা) তাদের নির্বাসিত না করা পর্যন্ত তদানুযায়ী কাজ হয়েছে। তাতে কথা ছিল তারই জমি চাষাবাদ করবে নিজেদের খরচ, বীজও তারাই দেবে।

এ কারণে আলিমদের মতে বীজ চাষির দেয়া উচিত হলেও দুজনের যে কোন একজন দিলেও জায়েয হবে। হযরত উমর (রা) এভাবে চুক্তি করেছিলেন যে, তিনি বীজ দিলে অর্ধেক ফসল পাবেন। আর চাষকারী যদি তা দেয়, তবে সেও তাই পাবে অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি।

পারস্পরিক জমি চাষ পর্যায়ে যত হাদীসের বর্ণনাই পাওয়া যায়, তাতে চাষকারী যে অর্ধেকের কম পাবে, তার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না; বরং তারও বেশি পাওয়ার কথা কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে।

এ প্রেক্ষিতে মন বলছে, চাষকারীর অংশ অর্ধেকের কম হওয়া উচিত নয়। নবী করীম (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদুন খায়বারের ইয়াহূদীদের সাথে তাই করেছেন। অতএব ফসল বন্টনের সময় মানুষের (চাষকারীর) অংশের তুলনায় পাথরের- জমির- অংশ বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

পশুপালনে শরীকানা

আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে আর একটা কাজের প্রচলন রয়েছে তা হচ্ছে পশু-জন্তু পালনে শরীকী ব্যবস্থা। এক পক্ষ সম্পূর্ণ বা কতক মূলধন দেয় আর অপর পক্ষ দেখা-শোনার দায়িত্ব পালন করে। আর ফল বা মুনাফা দুজনে ভাগ করে নেয়।

এ সম্পর্কে শরীয়তের রায় জানার পূর্বে এ কাজের বিভিন্ন ধরন বিশ্লেষণ করা আবশ্যক।

১. একটি ধরন এই যে, নিছক ব্যবসায়ী উদ্দেশ্যে উভয় পক্ষ একত্রিত হবে। বাছুর মোটা করার উদ্দেশ্যে পালন বা গাভী-মহিষ থেকে দুগ্ধ লাভের উদ্দেশ্যে পালন।

এতে এক পক্ষ মূলধন দেয় আর অপর পক্ষ দেয় শ্রম ও দেখা-শোনার কাজের দায়িত্ব। পশুগুলোর খাদ্য পানীয় দিতে যা ব্যয় হবে তা দুজনই বহন করবে। আর তা বিক্রয় করা হলে যে মূল্য পাওয়া যাবে, তা থেকে খরচ বাদ দেয়া হবে। তার পরে যা মুনাফা দাঁড়াবে তা দুজনে নিজেদের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী বন্টন করে নেবে।

যদি এক পক্ষই সমস্ত খরচ বহনে বাধ্য হয়, আর তার বিনিময়ে সে কিছু না পায়, অথচ মুনাফা দুজনের মধ্যে সমান হারে ভাগ করা হয়, তবে তা ইনসাফপূর্ণ ব্যবসা হতে পারল না।

২. দ্বিতীয় ধরন এই হয় যে, এক পক্ষ মূল্য দেবে আর অপর পক্ষ খরচ ও দেখাশোনার দায়িত্ব বহন করবে। আর জন্তুর দুগ্ধ নিয়ে কিংবা চাষাবাদ বা পানি বহনের কাজে সে পশু ব্যবহার করে উপকৃত হবে।

হ্যাঁ, এরূপ করায় কোন দোষ নেই, যদি জন্তু আকারে বড় হয়, তার থেকে দুধ পাওয়া যায় কিংবা তার দ্বারা কাজ করানো যায়। একথা ঠিক যে, দ্বিতীয় পক্ষ যে খরচ পত্র বহন করে, তার সে সব ব্যয় বহনের তুলনায় দুগ্ধ ইত্যাদি পাওয়াটা সমান মনে হয় না, তাতে ক্ষতির আশংকাটাও থাকে, কিন্তু আমরা ভাল মনে করেই তা জায়েয বলেছি এবং ক্ষতির এ সামান্য আশংকাকে তেমন গুরুত্ব দিই নি। কেননা শরীয়ত এ ধরনের জিনিস সহ্য করে নিতে অসুবিধাবোধ করে না। রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ ( আরবি******************)

বন্ধকী বাবদ রাখা জন্তুর খরচাদি বহনের বিনিময়ে তাতে সওয়ার হওয়া যায় এবং তার দুগ্ধও পান করা যেতে পারে। সওয়ারী যে করে ও দুগ্ধ যে পান করে খরচাদি তাকেই বহন করতে হবে। (বুখারী)

এ হাদীসে নবী করীম (সা) জন্তুর খাদ্য ইত্যাদি বাবদ খরচের সমান বিনিময় ধরেছেন সেটিকে সওয়ারী ‍রূপে ব্যবহার করা ও সেটির দুগ্ধ পান করাকে।

জন্তুর জন্যে খরচাদি তার ওপর সওয়ার হওয়ার ও তার দুগ্ধ পান করার তুলনায় অনেক বেশি হতে পারে, কমও হতে পারে। কিন্তু প্রচলনের দৃষ্টিতে যখন বন্ধকীর ক্ষেত্রে এ অবস্থাকে জায়েয মনে করা হয়েছে তখন জন্তু পালনের আলোচ্য শরীকী ব্যবসাকেও প্রয়োজনের দৃষ্টিতে জায়েয মনে করতে কোনরূপ দ্বিধা বোধ হয় না।

উপরিউদ্ধৃত হাদীস থেকে যে প্রতিপাদ্য আমরা বের করেছি তা একান্তভাবে এ গ্রন্থকারের মত। আল্লাহ্ এ মতটিকে নির্ভুল করুন।

কিন্তু ছোট বাছুর জাতীয় জন্তু পালনে- যাতে তার ওপর সওয়ার হওয়াও যায় না, তার দুগ্ধও পান করা যায় না- ‍যদি এক পক্ষ মূল্য দেয় আর অপর পক্ষ খরচাদি বহন করে, তাহলে তা ইসলামের মৌলনীতির দৃষ্টিতে মুবাহ মনে করা যায় না। কেননা যে পক্ষকে খরচাদি বহন করতে হবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর অপর পক্ষ কেবল সুবিধা ও লাভই লাভ পাবে। অতএব তা যেমন ন্যায়ভিত্তিক নয়, তা সুস্পষ্ট অথচ ইসলাম সর্ব ব্যাপারে ইনসাফ ও ন্যায়পরতাকে কার্যকর দেখতে চায়। তবে খরচাদি বহনকারী পক্ষের ফায়দা পাওয়ার সময় হওয়া পর্যন্ত সমস্ত খরচ যদি উভয় পক্ষ পারস্পরিক বন্টনের মাধ্যমে বহন করে, তাহলে আমরা মনে করি, তা জায়েয হবে।

Page 13 of 16
Prev1...121314...16Next

© Bangladesh Jamaat-e-Islami

  • আমাদের সম্পর্কে
  • প্রাইভেসি পলিসি
  • যোগাযোগ
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস

@BJI Dhaka City South