ঘর-বসবাসের স্থান
ঘর কিংবা বসবাস করার স্থান লোকদের জন্যে এক সুরক্ষিত আশ্রায়স্থল। এ ঘরেই তাদের পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন জাপিত হয়ে থাকে। মানুষ নিজের ঘরে নিজেকে সর্বপ্রকার সামাজিক বিধিবন্ধন থেকে মুক্ত মনে করতে থাকে। মানুষ নিজের ঘরেই আরাম ও বিশ্রাম লাভ করে মনে পায় পরম প্রশান্তি। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহাবলীর উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ (আরবী******************)
আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্যে তোমাদের ঘরগুলোকে শান্তির আকর বানিয়েছেন। (সূরা নহলঃ৮০)
নবী করীম (সা) প্রশস্ত ঘর-বাড়ি পছন্দ করতেন। তিনি এ ধরনের ঘর-বাড়িকে বৈষয়িক সৌভাগ্যের নিমিত্ত মনে করতেন। তিনি বলেছেনঃ (আরবী************************)
চারিটি জিনিস কল্যাণের আকর। তা হচ্ছে, পবিত্র চরিত্রবতী স্ত্রী, প্রশস্ত ঘর, ভাল প্রতিবেশী এবং উত্তম যানবাহন।
নবী করীম (সা) প্রায়ই দো’আ করতেনঃ (আরবী*********************)
হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহ মাপ কর, আমার ঘরে আমার জন্যে প্রশস্ততা দাও এবং আমার রিযিক আমাকে বরকত দাও।
জনৈক লোক বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি প্রায়ই এই দো’আ কেন করেন? জবাবে তিনি বললেনঃ
(আরবী****************)
এই দো’আয় কি কোন একটি জিনিসও বাদ পড়েছে?
নবী করীম (সা) ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যেন এই পরিচ্ছন্নতা-পরিচ্ছন্নতাবাদী দ্বীন-ইসলামের একটা বাহ্যিক প্রকাশ ও বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং যেন এরই ভিত্তিতে মুসলমান সেসব লোক থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অভিসিক্ত হতে পারে, যাদের ধর্মে ময়লা-অপরিচ্ছন্নতাই হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একমাত্র মাধ্যম। রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী************************)
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র, তিনি পবিত্রতা পছন্দ করেন। তিনি দয়াবান, অনুগ্রহসম্পন্ন, দয়া অনুগ্রহ তিনি পছন্দ করেন। তিনি দাতা, দান তিনি পছন্দ করেন। অতিএব তোমরা সকলে তোমাদের ঘরের আঙ্গিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখ এবং ইয়াহুদীদের সাথে সাদৃশ্য রাখবে না। (তিরমিযী)
বিলাসিতা ও পৌত্তলিকতার প্রকাশ
মুসলমানদের জন্যে তাদের ঘর-বাড়ি তেল-বার্নিশ, চাকচিক্য ও বৈধ ধরনের রূপ-সৌন্দর্য দিয়ে সুসজ্জিত করা কিছুমাত্র নিষিদ্ধ নয়।
স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই বলেছেনঃ (আরবী**********************)
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্যে যেসব রূপ-সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন, তা কে হারাম করে দিতে পারে?
বস্তুত মুসলমান তার ঘর-বাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় জিনিস খুব সুন্দর সুগঠিত, সুসজ্জিত ও চাকচিক্যময় করে রাখবে, তা কিছু মাত্র নিষিদ্ধ নয়। কোন দোষ নেই তাতে।
নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবি****************)
যে লোকের হৃদয়ে একবিন্দু অহংকার থাকবে, সে বেহেশতে যেতে পারবে না। তখন একজন বললঃ ইয়া রাসূল! আমেদের একজন পছন্দ করে যে, তার কাপড়-জুতা খুবই সুন্দর হোক, এটাও কি অহংকারের মধ্যে পড়ে? রাসূল বললেনঃ মোটেই না। কেননা আল্লাহ্ সুন্দর, তিনি সুন্দর ও সৌন্দর্যকে ভালবাসেন। (মুসলিম)
অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ (আরবি****************)
একজন সুন্দর সুশ্রী ব্যক্তি নবী করীম (সা)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বলল? আমি সৌন্দর্য পছন্দ করি, আমাকে তার অনেক কিছুই দেয়া হয়েছে যেমন দেখছেন। এমনকি জুতার ফিতার ক্ষেত্রেও কেউ আমার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যাক, তাও আমি পছন্দ করি না। হে রাসূল, এটাও কি অহংকারের মধ্যে গণ্য হবে? তিনি বললেন, না বরং অহংকার হচ্ছে প্রকৃত সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং লোকদের হীন ও নগণ্য মনে করা। (আবূ দাঊদ)
অবশ্য ইসলামে জীবনের কোন দিকেই অতিশয় বাড়াবাড়ি ও সীমাতিরিক্ততা আদৌ পছন্দ নয়। মুসলমানের ঘর-বাড়ি বিলাসিতা ও জাঁকজমকের লীলাকেন্দ্র হোক, নবী করীম (সা) এটাও পছন্দ করেন নি। কুরআনে তা নিষেধ করা হয়েছে অথবা পৌত্তলিকতার প্রকাশ হওয়াও পছন্দনীয় নয়। কেননা আল্লাহ্ তওহীদী দ্বীন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তিতে লড়াই করেছে।
স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্র
ঠিক এ কারণেই মুসলমানদের ঘরে স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্র ও খাঁটি রেশমের শয্যা থাকাটাও হারাম করে দেয়া হয়েছে। এ নীতির বিরোধিতার জন্যে নবী করীম (সা) কঠোর ভাষায় কঠিন পরিণতির কথা শুনিয়েছেন। উম্মে সালমা (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ (আরবি****************)
যে লোক স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্রে পানাহার করবে, তার পেটে জাহান্নামের আগুন টগবগ করতে থাকবে। (মুসলিম)
(আরবি****************)
রাসূলে করীম (সা) স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্রে পানাহার করতে, রেশমী ও মখমলের কাপড় পরিধান করতে এবং তার ওপর আসন গ্রহণ করতে আমাদের নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ এগুলো কাফিরদের জন্যে দুনিয়ায় এবং আমাদের জন্যে আখিরাতে প্রাপ্য। (বুখারী)
আর যা ব্যবহার করা হারাম, তা তোহফা বা অর্ঘ-উপহার হিসেবে দেয়াও হারাম, সাজ-সজ্জা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তার ব্যবহারও হারাম।
স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্র ব্যবহার ও রেশমের শয্যা গ্রহণ পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যেই হারাম। ঘর-বাড়ি বিলাসদ্রব্য থেকে মুক্ত ও পবিত্রকরণই এগুলোকে হারাম করার একমাত্র উদ্দেশ্য। ইবনে কুদামা এ পর্যায়ে খুব সুন্দর লিখেছেনঃ
হাদীসে সাধারণভাবেই এ কথাগুলো এসেছে বলে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই তা সমানভাবে হারাম। কেননা এগুলোকে হারাম করার উদ্দেশ্য হচ্ছে অপচয়, বেহুদা খরচ-গৌরব-গর্ব ও দরিদ্রদের মনে আঘাত দান বন্ধ করা। আর তা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান। তবে স্ত্রীলোকদের জন্যে অলংকারাদির ব্যবহার জায়েয শুধু এজন্যে, যেন তারা তাদের স্বামীদের জন্যে সাজ-সজ্জা করতে পারে। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, হারাম করার এই যদি কারণ হয়ে থাকে তাহলে ইয়াকূত-হীরা জহরত- মহামূল্য পাথরের বর্তনাদি হারাম হল না কেন? তার জবাব হচ্ছে, গরীব লোকেরা এসব জিনিসের সাথে পরিচিত নয়। কাজেই ধনী লোকেরা যদি তা ব্যবহার করে তাহলে গরীব লোকদের মন কষ্ট পাওয়ার কোন কারণ হয় না। তাছাড়া এসব মহামূল্য পাথর পরিমাণে খুব কমই থাকে বলে তা দিয়ে পাত্র বানানর কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। এ কারণেতা হারাম করার কোন প্রয়োজনই অবিশষ্ট থাকে না। কিন্তু স্বর্ণ-রৌপ্যের ব্যাপারটি ভিন্নতর। (আরবি****************)
এসব কারণ ছাড়া অর্থনৈতিক কারণও নিহিত রয়েছে এসব জিপিহ্ন হারাম হওয়ার পেছনে। সেদিকে পূর্বেই ইঙ্গিত শরেছি। মূলতঃ স্বর্ণ ও রৌপ্য আন্তর্জাতিক দৃস্টষ্টতে নগদ মূলধন বলে গণ্য। আল্লাহ্ তা’আলা তাকে ধন-মালের মূল্যমানরূপে নির্দিষ্ট করেছেন। তাতে এক প্রকারের প্রকাশ শক্তি নিহিত রয়েছে। তা মূল্য সমূহের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য সৃষ্টি করে ও রক্ষা করে, তা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়েরও কাজ করে। আল্লাহ্ তা’আলা এভাবে তার ব্যবহারের পদ্ধতি বলে দিয়ে মানুষকে তাঁর নিয়ামত দানে ধন্য করেছেন। মানুষ যেন তাকে আবর্তনের মধ্যে রাখে, এটাই আল্লাহ্ চান। তকে নগদ সম্পদ হিসেবে ঘরে বন্ধ করে বা পাত্র সৌন্দর্য সামগী করে বেকার ফেলে রাখবে- তা আল্লাহ্ তা’আলা আদৌ পছন্দ করেন না।
ইমাম গাযযালী এ বিষয়ে খুব সুন্দরভাবে লিখেছেনঃ
যে লোক দিরহাম বা দীনার প্রভৃতি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্র নির্মাণ করবে (বা ক্রয় করে রাখাবে) সে আল্লাহর নিয়ামতের না-শোকরিয়া করে। ধন-সম্পদ মজুদ করে রাখার চাইতে বেশি অপরাধ সে করে। নগর প্রশাসককে কাপড় বোনা বা ঝাড়ু দেয়ার নগণ্য কাজ- যা সাধারণ মানুষ করতে পারে- লাগালে যেমন হয় এও ঠিক তেমনি। সেগুলোকে এভাবে ব্যবহার করার পরিবর্তে সঞ্চয় করে রাখা বরং ভাল। কেননা পাকা মাটি, লোহা, সীসা ও তামা প্রভৃতি প্রবহমান জিনিসকে সংরক্ষিত করার জন্যে স্বর্ণ-রৌপ্যের স্থলাভিষিক্ত। আর তৈজসপত্র প্রবহমান জিনিসগুলো সংরক্ষিত রাখার জন্যেই হয়ে থাকে। কিন্তু পাকা মাটি ও লোহা দ্বারা নগদ সম্পদ লাভের উদ্দেশ্য হাসিল করা যায় না। যে লোক এ তত্ত্বের সাথে পরিচিত নয়, তার কাছে আল্লাহ্ প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট হওয়া উচিত এবং তাকে এ হাদীস শুনিয়ে দেয়া উচিত যেঃ (আরবি****************)
যে ব্যক্তি স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্রে পানাহার করে, সে নিজের পেটে জাহান্নামের আগুন ভর্তি করে। (ইহইয়াউ উলুম)
এভাবে হারামের বিধান দেয়ার ফলে মুসলমানদের ঘরের কাজকর্মে কোনরূপ সংকীর্ণতার উদ্ভুব হবে- এমনটা মনে করা ঠিক নয়। কেননা এর বাইরে পবিত্র ও হালাল জিনিসসমূহের ক্ষেত্র অনেক প্রশস্ত। কাঁচ-চিনামাটি, তামা এবং এ ধরনের বহু প্রকারের ধাতব পাত্র অনেক উত্তম ও ঝকঝকে। তুলা, সূতা ইত্যাদির বিছানা-বালিশ অনেক আরামদায়ক।
ইসলামে প্রতিকৃতি হারাম
মুসরমানদের ঘর-বাড়িতে জীবের প্রতিকৃতি (Statue) সংরক্ষণকে ইসলাম হারাম করে দিয়েছে। সম্মানিত ব্যক্তিদের ছবি বা প্রতিকৃতিও এর অন্তর্ভুক্ত। এসব জিনিস কারো ঘরে থাকলে সেখান থেকে আল্লাহর রহমতের ফেরেশতা পালিয়ে যায়। রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ (আরবি****************)
যে ঘরে ছবি বা প্রতিকৃতি অবস্থিত, সেখানে আল্লাহর রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করেন না।
বিশেষজ্ঞগণ তার কারণ নির্দেশ করে বলেছেন, ঘরের প্রাচীরে যারা জীবের ছবি ঝুলিয়ে রাখে, তারা কাফিরদের মতোই কাজ করে। কেননা কাফিররাই সাধারণত নিজেদের বাড়ি-ঘরের প্রাচীরের সাথে ছবি ও প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে রেখে থাকে এবং সেগুলোর প্রতি সম্মান ও ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে থাকে। ফেরেশতাগণ এ কাজ পছন্দ করেন না বলেই তাঁরা এসব ঘর ত্যাগ করে চলে যান এবং তথায় ফিরে আসেন না।
ইসলামে প্রতিকৃতি নির্মাণকেও হারাম করে দেয়া হয়েছে। অমুসলিমদের জন্যে বানান হলেও তা জায়েয হবে না। রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ (আরবি****************)
যে সব লোক এ সব ছবি ও প্রতিকৃতি রচনা বা নির্মাণ করে, কিয়ামতের দিন তারাই অধিক আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে।
অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ (আরবি****************)
এরা সেই লোক, যারা আল্লাহর সৃষ্টি কার্যের সাথে সাদৃশ্য করতে চেষ্টা করছে।
নবী করীম (সা) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেনঃ (আরবি****************)
যে লোক কোন জীবের ছবি আঁকবে বা প্রতিকৃতি নির্মাণ করবে, কিয়ামতের দিন তাতে রূপ ফঁকে দেয়ার জন্যে তাকে বাধ্য করা হবে। কিন্তু সে তা কখনই পারবে না। (বুখারী)
প্রকৃত রূহ দিয়ে সেটিকে জীবন্ত বানানর দায়িত্ব দেয়ার অর্থ এ অসম্ভব কাজ করতে চাওয়ার শাস্তি তাকে দেয়া হবে। কেননা এ কাজে সে কখনই সক্ষম হবে না।
ছবি ও প্রতিকৃতি হারাম করার কারণ
(ক) ছবি ও প্রতিকৃতি হারাম করার অনেকগুলো করণ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, তওহীদী বিশ্বাসের সংরক্ষণ এবং পৌত্তলিকতার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কার্যাবলি পরিহার। কেননা পৌত্তলিকরা নিজেদের হাতেই ছবি ও প্রতিকৃতি নির্মাণ করে এবং সিটিকেই পবিত্র মনে করে তার পূজা-উপাসনা করে, তারই সম্মুখে বিনয়াবনত হয়ে মাথা ঠেকায়, দাঁড়ায়।
তওহীদী আকীদার ব্যাপারে ইসলাম অনমনীয়, ক্ষমাহীন। আর সেরূপ পওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা যে সব জাতি তাদের আদর্শ পূর্বপুরুষ ও জাতীয় হিরো পর্যায়ের লোকদের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ছবি ও প্রতিকৃতি নির্মাণ করে, কিছুকাল অতিবাহিত হয়ার পর তারাই সেই ছবি-প্রতিকৃতিকে ‘মহান পবিত্র-শ্রদ্ধেয়’ মনে করতে শুরু করে। সেগুলোকেই উপাস্য দেবতা মনে করে সেগুলোর পূজা করতে আরম্ভ করে। অলক্ষ্যে সেগুলোকে ভয় করে, সেগুলোর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চেষ্টা করে, আশা-আকাঙ্খার পরিপূরণ করতে সচেষ্ট হয়। বরকত হাসিল করার উদ্দেশ্যে সেগুলোর সম্মুখে হাজির হতে শুরু করে। উদ্দ, সুয়া, ইয়াগুম, ইয়াউক ও নসর প্রভৃতি প্রতিমূর্তির পশ্চাতে এই ইতিহাসই নিহিত রয়েছে।
এ ব্যাপারে ইসলামের সতর্কতা কোন বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। কেননা ইসলাম তো সর্ব প্রকারের বিপর্যয় ও ভাঙ্গনের পথ রুদ্ধ করনতে বদ্ধপরিকর। যেসব ছিদ্রপথে প্রকাশ্য শিরক বা গোপনীয় শিরক মানুষের মন-মগজে প্রবেশ করতে ও স্থান দখল করে তাদের মুশরিক বানাতে পারে অথবা যেসব পথে সমাজে পৌত্তলিকতা ও ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ির প্রচলন হতে পারে, তা সব চিরতরে রুদ্ধ করে দেয়াই ইসলামের লক্ষ্য। এ ব্যাপারে ইসলামের অনমনীয় নীতি ও ভূমিক এজন্যও যে, ইসলামী শরীয়ত কোন এক কালের, এক যুগের বা এক দেশ ও বংশের লোকদের জন্যে নয়- তা সর্বকালের সকল মানুষের জন্যে জীবন-বিধান। তারা দুনিয়ার যে-কোন অংশে বা দেশেই বসবাস করুক না কেন, কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষই তা যথাযথ পালন করতে পারে।
(খ) ছবি ও প্রতিকৃতি রচনা হারাম হওয়ার আর একটি কারণ হলো প্রতিকৃতি বা ছবি নির্মাতা এ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়ে যে, সে বুঝি একটা জিনিসকে অনস্তিত্ব থেকে বের করে এনে অস্তিত্বসম্পন্ন করে দিতে সক্ষম হয়েছে অথবা মাটি, পাথর বা কালি-কলম দ্বারা একটা জীবন্ত সত্তা বানিয়ে ফেলেছে। বাস্তব ঘটনাবলীই এ ধারণার সত্যতা প্রমাণ করে। উল্লেখ করা যেতে পারে, একজন লোক একটি প্রতিকৃতি নির্মাণ করল। তার পরে সে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার তলায় অবস্থান করতে থাকল। প্রতিকৃতিটি যখন পূর্ণাঙ্গ তৈরী হয়ে গেল, তখন সে তার সম্মুখে দাড়িয়ে তার নাক-নকশা ও তার সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত সৌন্দর্য দেখে আত্মশ্লাঘায় মেতে উঠল ও অহংকারে স্ফীত হয়ে প্রতিমূর্তিটিকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলঃ ওরে কথা বল, কথা বল, (যেন ওটা একটা জীবন্ত সত্ত্বা)।
ঠিক এ কারণেই রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবি****************)
যে সব লোক এ ধরনের প্রতিকৃতি-প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে, কিয়ামতের দিন তাদের আযাব দেয়া হবে এবং বলা হবেঃ তোমরা যা কিছু সৃষ্টি করেছিলে, তা এখন জীবন্ত করে দাও। (বুখারী, মুসলিম)
হাদীসে বলা হয়েছে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবি****************)
যে আমার সৃষ্টির ন্যায় সৃষ্টি কর্ম করতে চায়, তার তুলনায় অধিক জালিম আর কে হতে পারে? ওরা যব বা গমের একটা দানা সৃষ্টি করে দিক না! (কেমন ক্ষমতা বুঝব)। (বুখারী, মুসলিম)
(গ) এ কর্মে যারা নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়, তারা কোন স্থানে গিয়েই থেমে যায় না। তারা নারীদেহের নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি ও প্রতিকৃতি বানাতে শুরু করে। পৌত্তলিকতা বোতপরস্তির প্রতীক ক্রুশ মূর্তি প্রকৃতি নির্মাণেও তারা একবিন্দু দ্বিধা বা সংকোচ করে না অথচ এ ধরনের জিনিস বানান মুসলমানের পক্ষে আদৌ জায়েয নয়।
(ঘ) এতে সন্দেহ নেই যে, প্রতিকৃতি বিলাসী জীবনের পরিচায়ক। বিলাসী ও জাঁকজমককারী ধনী লোকদের একটা চিরকালের রীতি, তারা নিজেদের প্রাসাদপম ঘর-বাড়িগুলোকে প্রতিকৃতি ও ছবি দিয়ে সজ্জিত করে রাখে। নিজেদের কক্ষসমূহের প্রাচীর ঢেকে দেয় ছবির পর ছবি লাগিয়ে। নানা ধাতু দিয়ে প্রতিকৃতি বানিয়ে শিল্প-দক্ষতা ও শিল্পপ্রিয়তা প্রমাণ ও প্রদর্শন করে। দ্বীন-ইসলাম সর্বপ্রকার বিলাস-ব্যসন সামগ্রী ও তার প্রকাশ প্রমাণের প্রতীকসমূহের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। মুসলমানদের ঘরে প্রতিকৃতির সমাবেশ বা অস্তিত্ব বরদাশত করা ইসলামের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয় এবং তা সম্পূর্ণ হারাম ঘোষিত হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।
মহাপুরুষদের স্মৃতিরক্ষার উপায়
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, জাতীয় ইতিহাসে যেসব মহাপুরুষ চিরস্মরণীয় কীর্তি রেখে গেছেন তাঁদের অবদান সমূহের কথা সকলের মনে চির জাগরুক করে রাখার জন্যে তাদের বস্তুগত প্রতিকৃতি (Statue) দাঁড় করিয়ে তাদের অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেবে না, অনাগত বংশধরদের সম্মুখে তাদের চিরভাস্বর করে রাখবে না? জাতির স্মরণশক্তি তো খুব তেজস্বী নয়, মানুষ তো ভুলে যায় সব কিছু। কালের স্রোত তাদের বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন করে দেয়। এরূপ অবস্থায় প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে দোষ কি?
এর জবাব হচ্ছে, ইসলাম ব্যক্তিত্বের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধা বা ভক্তি প্রদর্শন পছন্দ করে না। সে ব্যক্তিত্ব যত বড়, যত উঁচু এবং মৃত বা জীবিত- যাই হোক না কেন। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ
তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করো না, যেমন করে খ্রিস্টানরা ঈসা ইবনে মরিয়মের সীমালংঘনমূলক প্রশংসা করেছে। তোমরা বরং আমাকে বলবেঃ আল্লাহর দাস, তাঁর রাসূল।
সাহাবিগণ নবী করীম (সা)-এর সম্মানার্থে দাঁড়াতে ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই তাঁদের নিষেধ করে দিলেন। বললেনঃ (আরবি****************)
অনারব লোকেরা যেমন পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে দাড়িয়ে থাকে তোমরা সেরূপ দাঁড়িয়ে যেও না। (আবূ দাঊদ, ইবনে মাযাহ)
রাসূলে করীম (সা)-এর দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁর উম্মতের লোকেরা যেন তাঁর প্রতি মর্যাদা ও সম্মান বা ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে সীমা ছাড়িয়ে না যায়। বলেছেনঃ (আরবি****************)
আমার কবরকে কেন্দ্র করে তোমরা উৎসব করতে শরু করে দিও না।
তিনি আল্লাহর কাছে অহরহ দো’আ করতেনঃ (আরবি****************)
হে আল্লাহ্! আমার কবরকে তুমি পূজ্যমূর্তি হতে দিও না।
কিছুলোক রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলতে শুরু করলঃ
হে আল্লাহর রাসূল! হে আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব;
হে আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তিত্বের সুযোগ্য পুত্র;
হে আমাদের সরদার, হে আমাদের সরদার-তনয়;
এসব শুনে নবী করীম (সা) বললেনঃ (আরবি****************)
হে লোকেরা! তোমরা আজ পর্যন্ত আমাকে যেভাবে ডাকতে, সম্বোধন করতে, সেভাবে ডাক! শয়তান যেন তোমাদের ধোঁকায় ফেলতে না পারে। আমি তো মুহাম্মদ, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহ্ আমাকে যে স্থান ও মর্যাদা দিয়েছেন, তোমরা যেন তার চাইতে উঁচুতে আমাকে উঠিয়ে দিতে না চাও। (নিসায়ী)
ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি নির্মাণ করে মূর্তির ন্যায় স্থাপন করে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সেজন্যে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করা- সম্মান প্রদর্শনের এ রীতি ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়।
শ্রেষ্ঠত্বের মিথ্যা দাবিদাররা এবং বাতিল ও মনগড়া ইতিহাস সৃষ্টিকারীরা এসব ষড়যন্ত্রমূলক উপায়ে দুনিয়ার জাতিসমূহকে বিভ্রান্ত করছে আবহমানকাল ধরে। আর জাতির প্রকৃত খাদেম ও কল্যাণকারীদের তারা কখনই লোকদের সম্মুখে আসতে দেয়নি, দূরে লুকিয়ে রেখেছে। পরিচিত হওয়ার বা তাদের চিনবার কোন সুযোগই হতে দেয়নি।
ঈমানদার লোক যে চিরস্থায়িত্বের কামনা করে তা কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে থেকেই পাওয়া যেতে পারে। তিনিই জানেন সব গোপন ও লুকান কথা। আর তিনি কখনই কিছু ভুলে যান না। তাঁর কোন ভুল-ত্রুটি হতেই পারে না। কত শত বিরাট বিরাট ব্যক্তিত্বের নাম তাঁর কাছে স্থায়ী রেজিষ্টারে লিখিত হয়ে আছে, যদিও মানুষ তাদের জানে না, চিনে না। কেননা আল্লাহ্ নেক, মুত্তাকী ও অপরিচিত অজ্ঞাতনামা লোকদেরই পছন্দ করেন, কোন মজলিসে নেক, মুত্তাকী ও অপরিচিত অজ্ঞাতনামা লোকদেরই পছন্দ করেন, কোন মজলিসে আসীন থাকলে তাক চেনা যাবে না, অনুপস্থিত হলে তাকে কেউ সন্ধানও করবে না।
যদি চিরস্থায়িত্বই কাম্য হয়ে থাকে, তাহলে এ ধরনের প্রতিকৃতি বা মূর্তি দাঁড় করে তা লাভ করা সম্ভব হবে না। তার একটিমাত্র উপায় রয়েছে এবং সে উপায়ই ইসলামে পছন্দনীয়, সমর্থিত আর তা হচ্ছে, সে ব্যক্তিত্ব সমূহের স্মরণ লোকদের মন-মগজে দৃঢ়মূল করে বসিয়ে দিতে হবে। লোকদের মুখে মুখে তাদের গুণগান ও প্রশংসা উচ্চারিত ও ধ্বনিত হবে। তারা যেসব ভাল ভাল কল্যাণকর কাজ করেছেন, অতুলনীয় কৃতিত্ব রেখে গেছেন, সেসব দেখে অনাগত বংশধরেরা তাঁদের প্রশংসা ও গুণগান অনন্তকাল ধরে করতে থাকবে, তাই তো স্বাভাবিক।
রাসূলে করীম (সা), খুলফায়ে রাশেদুন, ইসলামের ঐতিহাসিক নেতৃবৃন্দ ও ইমাম মুজতাহিদগণের স্মৃতি কোন ছবি বা পাখন নির্মিত প্রতিকৃতি দিয়ে অক্ষয় ও চিরস্মরণীয় করে রাখা হয়নি। পাথর খোদাই করে তাঁদের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা হয়নি, বরং এক বংশের লোক তাদের পূর্ববংশের লোকদের- সন্তান, পিতা-মাতা-চাচা-দাদার কাছ থেকে তাদের অক্ষয়-অতুলনীয় কীর্তির কথা মুখে মুখে- স্মৃতিশক্তি থেকে স্মৃতিশক্তিতে স্থানান্তরিত হতে হতে এ পর্যন্ত চলে এসেছে, মুখে মুখে তাদের কল্যাণময় উল্লেখ হয়েছে, সভা সম্মেলনে তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে। মানুষের মন ও মগজ তাদের কীর্তি গাঁথায় ভরপুর হয়ে রয়েছে এবং তা অনন্তকাল পর্যন্ত চলতে থাকবে অব্যাহতভাবে। কোনরূপ ছবি প্রতিকৃতি রচনা ছাড়াই তাঁর চিরস্মরণীয় ও অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেনও চিরকাল।
[ দামেশক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়ত বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আল-উস্তাদ মুহাম্মদ আল-মুবারক জামে আজহারে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে যে আলোচনা পেশ করেছিলেন, তার একটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেছিলেনঃ বর্তমানে আমরা নতুন নতুন পরিবেশ পরিস্থিতি, সংগঠন ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের সম্মুখীন হচ্ছি। কিন্তু তার মধ্যে অনেকগুলোই এমন যা আমাদের নির্ভুল আকীদা-বিশ্বাস ও চিরাচরিত নিয়ম-নীতির সাথে কিছুমাত্র সামঞ্জস্যশীল নয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, জাতীয় ‘হিরো’ দের চিরস্মরণীয় করে রাখবার উদ্দেশ্যে ইউরোপ-আমেরিকায় অনুসৃত প্রতিমূর্তি নির্মাণ নীতি। আমরা যখন স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত দৃষ্টিতে চিন্তা করি, তখন দেখতে পাই যে, প্রাচীনকালের আরবরা তাদের বড় বড় লোকদের অপূর্ব ও ঐতিহাসিক কার্যকলাপ-যেমন জাতীয় স্বার্থে আত্মদান, তুলনাহীন দানশীলতা, বদান্যতা ও অপরিসীম সাহস-বীরত্বকে বিশেষ এক পন্থায় চিরস্মরণীয় করে রাখত। তাদের কিসসা-কিহিনীতে এবং সভা-সম্মেলনে এগুলোর ব্যাপক উল্লেখ হতো এবং বংশের পর বংশের লোকদের কাছে তা অবিস্মরণীয় করে রাখত। তাদের কাব্য-কবিতায় তাদের উচ্চ-প্রশংসা লিখিত হতো। ঐতিহাসিক হাতেম তায়ীর দানশীলতা ও উনশজার বীরত্ব কাহিনী এভাবেই চিরস্থায়ী হয়েছিল।
ইসলাম এসে এ পদ্ধতিকেই বলিষ্ট করে দেয়। আল্লাহর সেরা সৃষ্টি ও সর্বশেষ নবীকে একজন মানুষ হিসেবেই উপস্থাপিত করা হয়েছে। তাঁর নিজের মুখেই ঘোষণা করিয়েছেঃ (আরবি****************)
আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। তবে আমার কাছে ওহী আসে।
এর ফলে মানুষের মূল্য ও মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াল তাঁর আমল, তার দেহ নয়। রাসূলকে সকলেরই অনুসরণীয় আদর্শ ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করা হলো যেন সমস্ত মানুষ নিঃসংকোচে তাঁর অনুসরণ করতে পারে। সেই সঙ্গে ব্যক্তির পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন- তাকে এতটা বড় করে তোলা, যা ইবাদতে পর্যন্ত পৌঁছে যায়, পরিহার করা হলো। কেননা তাতে করে পরোক্ষভাবে মানুষকে হীন ও সামান্য-নগণ্য করা হয়।
এ কারণেই রাসূলে করীম (সা)-এর ইন্তেকাল হলে প্রথম খলীফা উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেনঃ (আরবি****************)
যে লোক মুহাম্মাদ (সা)-এর বন্দেগী করত, তার জানা উচিত যে, মুহাম্মাদ (সা) মরে গেছেন এবং যে লোক আল্লাহর ইবাদত করত, তার জানা উচিত, আল্লাহ চিরঞ্জীব, কখনই মরবেন না।
অতঃপর তিনি পাঠ করলেনঃ (আরবি****************)
মুহাম্মাদ (সা) রাসূল ছাড়া আর কিছুই নন। তাঁর পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। এখন যদি সে মরে যায় বা নিহত হয়, তাহলে তোমরা কি পাশ্চাদপসরণ করবে?
ইসলাম মানুষকে চিরস্মরণীয় করে রাখে তার জনকল্যাণমূলক নেক আমলের মাধ্যমে এবং চিরস্থায়ী করে রেখেছে মুসলিম জনগণের মনে। তাঁদের বড় ছোট সকলেই সমানভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের নেক আমলসমূহের স্মৃতির মাধ্যমে। হযরত উমর (রা) সুবিচারপূর্ণ বলিষ্ঠ রাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালন দক্ষতার দরুন, হযরত আবূ বকর দৃঢ় সংকল্প র নির্ভুল দূরদর্শিতার মাধ্যমে, হযরত আলী পরহেযগারী ও বীরত্বের মাধ্যমে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন লোকদের মনে-মগজে। তাদের চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যে পাথর নির্মিত প্রতিকৃতির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়নি। তাঁদের কীর্তিই তাঁদের চিরস্মরণীয় করেছে, করেছে তাদের তুলনাহীন পবিত্র চরিত্র।
বস্তুতঃ প্রতিকৃতি নির্মাণ করে বড় লোকদের চিরস্মরণীয় করে রাখার নীতি গ্রহণ করা হলে পিছনের দিকে ফিরে যাওয়া হবে, প্রগতি হবে না হবে পশ্চাদগতি এবং উন্নত মর্যাদা থেকে হবে অধোগতি। রোমান গ্রীকরাই এ নীতি গ্রহণ করেছেন প্রথমে। পরে ইউরোপীয়রা তা অনুসরণ করেছে। কেননা এরা স্বভাবের দিক দিয়ে সকলেই পৌত্তলিকতাবাদী। ররা ব্যক্তিদের অপলনীয় কার্যবলীকে কার্যবলীকে র্যথার্থ মূল্য দেয়নি। বরং এজন্যে তাদের দেবতার মর্যাদা দিয়েছে। দেবতাদেরই বানিয়েছে জাতীয় হিরো।]
শিশুদের খেলনায় দেষ নেই
কিছু কিছু মূর্তি-প্রতিকৃতি এমনও হয়ে থাকে যেগুলো দ্বারা কারো প্রতি অসীম ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখান হয় না, অতিশয় বিলাসিতা ও বড়লোকী দেখানও লক্ষ্য হয় না। তাছাড়া পূর্বোক্ত আলোচনায় যে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে, তারও কোন অবকাশ থাকে না। এ ধরনের মূর্তি-প্রতিকৃতি সম্পর্কে ইসলাম সংকীর্ণ মানসিকতা ও অসহনশীলতা প্রদর্শন করেনি। তাতে কোন দোষ্ণমনে করা হয়নি।
ছোট বালক-বালিকাদের খেলনা হিসেবে তৈরী মূর্তি-প্রতিকৃতিগুলো এ পর্যায়ে গণ্য। যেমন পুতুল, বিড়াল-কুকুর, পাখি প্রভৃতি জীব-জন্তুর মূর্তি। এগুলোর প্রতি কোনরূপ ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশ করার বা অন্তরে থাকার কোন প্রশ্ন উঠে না। শিশুরা, বালক-বালিকারা তা নিয়ে শুধু খেলা করে, তার পূজা করে না। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ (আরবি****************)
আমি রাসুলে করীম (সা)-এর উপস্থিতিতে মেয়েদের নিয়ে খেলা করতাম। আমার বান্ধবীরা আমার কাছে আসত ও রাসূলের ভয়ে লুকিয়ে যেত অথচ আমার কাছে ওদের আসা ও আমার সাথে খেলা করায় রাসূল খুশীই হতেন। (বুখারী, মুসলিম)
অপর একটি বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছে, একদা নবী করীম (সা) তাঁকে বললেনঃ এগুলো কি? তিনি বললেনঃ এগুলো আমার পুতুল। বললেনঃ ওগুলোর মাঝখানে ওটা কি? বললেন? ওটা ঘোড়া। জিজ্ঞেস করলেনঃ ও ঘোড়াটির উপর কি? বললেনঃ ওদুটো পাখা। বললেন? ঘোড়ার আবার পাখা হয় নাকি?
হযরত আয়েশা (রা) বললেনঃ ‘আপনি কি শুনেন নি, দাঊদ-পুত্র হযরত সুলায়মানের পাখাওয়ালা ঘোড়া ছিল?’ এ কথা শুনে নবী করীম (সা) হেসে উঠলেন। সে হাসিতে তাঁর দাঁত মুবারক প্রকাশ হয়ে পড়ল। (আবূ দাঊদ)
হাদীসে যেসব পুতুলের উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিয়ে বালক-বালিকারা খেলা করে। হযরত আয়েশা (রা) বিয়ের সময় খুবই অল্প বয়স্কা বালিকা ছিলেন।
ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ (আরবি****************)
উপরিউক্ত কথোপকথন সম্বলিত হাদীসটি প্রমাণ করে যে, বাচ্চাদের এ ধরনের প্রতিকৃতি দ্বারা খেলতে দেয়া জায়েয।
অবশ্য ইমাম মালিক (র) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এ ধরনের পুতুল ইত্যাদি খেলনা বাচ্চাদের জন্যে ক্রয় করে আনাকে মাকরূহ মনে করতেন। আর কাযী ইয়ায বলেছেন, ছোট ছোট মেয়েদের পুতুল দ্বারা খেলা করা জায়েয।
এ সব খেলনার মধ্যে সেসব পুতুলও শামিল, যা মিঠাই দ্বারা তৈরী করা হয় ও মেলা-তেহারে বিক্রয় হয়। বাচ্চারা তা নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করে। তারপর নিজেরাই তা খেয়ে ফেলে।
অসম্পূর্ণ ও বিকৃত প্রতিকৃতি
হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, হযরত জিবরাঈল (আ) নবী করীম (সা)-এর ঘরে প্রবেশ করা থেকে একবার বিরত রয়েছিলেন এজন্যে যে, তাঁর ঘরের দ্বারপথে একটা প্রতিকৃতি রক্ষিত ছিল। দ্বিতীয় দিন এসেও প্রবেশ করেন নি। তখন তিনি নবী করীম (সা)-কে বললেনঃ (আরবি****************)
প্রতিকৃতিটির মস্তক ছেদন করে দিন। ফলে সেটি গাছের আকৃতি ধারণ করবে। (আর তা হলে তাঁর প্রবেশে কোন বাধা থাকবে না।) (আবূ দাঊদ, নাসায়ী, তিরমিযী)
একদল বিশেষজ্ঞ এই হাদীসের ভিত্তিতে বলেছেন যে, যে ছবি বা প্রতিকৃতি সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ, কেবল তা-ই হারাম। কিন্তু যে ছবি-প্রতিকৃতির কোন অঙ্গ নেই,- যে অঙ্গ ভিন্ন একটা জীবন্ত দেহ বেঁচে থাকতে পারে না, তা জায়েয।
আসল কথা হচ্ছে, হযরত জিবরাইল (আ) মস্তক ছেদন করতে বলেছিলেন যেন সেটার আকৃতি গাছের মত হয়ে যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে, অঙ্গ ভিন্ন জীবন্ত দেহ বাঁচে না সেটার কথাই নয়। সেটাকে বিকৃত করাই হচ্ছে প্রকৃত কথা। যেমন সেটা এমন কোন আকার হয়ে না থাকে, যা দেখলে অন্তরে ভক্তি-শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠতে পারে।
একটু চিন্তা করলে ও ইনসাফের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে কোন সন্দেহ ছাড়াই আমরা বলতে পারি যে, ঘর সাজাবার উদ্দেশ্যে যেসব পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়, রাজা-বাদশাহ-রাষ্ট্রনেতা-সৈনিক-কবি-সাহিত্যিকদের সেসব অর্ধাঙ্গ প্রতিকৃতির খুব বেশি করে হারাম হতে হবে, যা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মাঠে-ময়দানে চৌরাস্তায় সংস্থাপন করা হয়।
বিদেহী ছবি-প্রতিকৃতি
প্রতিকৃতি পর্যায়ে ইসলামের দৃষ্টিকোণ একক্ষণ আলোচিত হলো। এক্ষণে কাগজ, কাপড়, পর্দা, প্রাচীর, মেঝে, মঞ্চ ও মুদ্রা ইত্যাদির ওপর অংকিত শৈল্পিক ছবিসমূহ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী কি সেটাই প্রশ্ন।
তার জবাবে বলতে চাই, মূলতঃ ছবিটা কিসের, কোথায় রাখা হচ্ছে, কিভাবে তার ব্যবহার হবে এবং শিল্পী সেটা কি উদ্দেশ্যে বানিয়েছে, ছবি সম্পর্কে শরীয়তের ফয়সালা জানাবার পূর্বে এসব কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার।
এসব শৈল্পিক ছবি যদি আল্লাহ্ ছাড়া যেসব মা’বুদ রয়েছে তাদের হয় যেমন ঈসা (আ)-এর ছবি, যাঁকে খ্রিস্টানরা নিজেদের মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে কিংবা গাভী বা গরুর ছবি হয়, যা হিন্দুদের দেবতা- এ সবের ছবি যেহেতু এ উদ্দেশ্যেই নির্মাতা নির্মাণ করেছে, আর তারা কাফির। ছবির মাধ্যমে কুফরী ও গুমরাহী প্রচার করাই তাদের লক্ষ্য। এ সব ছবি অংকনকারীদের সম্পর্কেই নবী করীম (সা) কঠিন কঠোর বাণী শুনিয়েছেন। এ পর্যায়ে তাঁর বাণী হচ্ছেঃ (আরবি****************)
ছবি নির্মাতারাই কিয়ামতের দিন কঠিনতম আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে। (মুসলিম)
তাবারী লিখেছেনঃ
এখানে সেই ছবি নির্মাতার কথা বলা হয়েছে যার বানান ছবির পূজা করা হয়। জেনে শুনে এ ধরনের ছবি বানান কুফরী কাজ। কিন্তু যে ব্যক্তি এ উদ্দেশ্যে নয়, অপর কোন উদ্দেশ্যে ছবি তোলে বা বানায়, সে শুধু গুনাহগার হবে।
যে লোক ছবিকে পবিত্র জ্ঞান করে প্রাচীরগাত্রে ঝুলায়, তার সম্পর্কে এই কথা। কোন মুসলিমই এ কাজ করতে পারে না। তবে যদি কেউ ইসলামই ত্যাগ করে, তবে তার কথা স্বতন্ত্র।
এরই অনুরূপ অবস্থা হচ্ছে এমন জিনিসের ছবি বানান, যার পূজা করা হয় না বটে, কিন্তু মূরত উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টিকর্মের সাথে সাদৃশ্য করা, অন্য কথায় ছবি নির্মাণ সে-ও যেন দাবি করছে যে, সেও আল্লাহরই মতো সৃষ্টি ও উদ্ভাবন ক্ষমতার অধিকারী।
এরূপ ব্যক্তি তার ইচ্ছা ও সংকল্পের কারণে দ্বীন-ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত। এ ধরনের ছবি নির্মাতাদের সম্পর্কেই হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবি****************)
কঠিনতম আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে সেসব লোক, যারা সৃষ্টিকর্মে আল্লাহর সাথে সাদৃশ্য করে। (মুসলিম)
ব্যাপারটির সম্পর্ক ছবি-নির্মাতার নিয়তের সাথে। নিম্নোদ্ধৃত হাদীস থেকেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে আল্লাহর কথা উদ্ধৃত হয়েছেঃ (আরবি****************)
যে লোক আমার সৃষ্টির মতই সৃষ্টিকর্ম করতে শুরু করে, তার চাইতে বড় জালিম আর কেউ হতে পারে না। এ লোকেরা একটা দানা বা একটা বিন্দুই সৃষ্টি করে দেখাক না।
হাদীসটির শব্দসমূহ থেকে বোঝা যায়, সাদৃশ্য করার ইচ্ছা করা এবং ইলাহ হওয়ার বিশেষত্ব-সৃষ্টিকর্ম ও নবোদ্ভাবনে সমতা করা বুঝান হচ্ছে। আল্লাহ্ তা’আলা এ কাজকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। বলেছেন, যদি বাস্তবিকই সাদৃশ্য করতে চাও, তাহলে একটা জীব বা দানা অথবা একটি বিন্দু সৃষ্টি করেই দেখাও না কেন? এ থেকে একথাও জানা যায় যে, সে লোক এ উদ্দেশ্য নিয়েই তা করেছিল। এ কারণে আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাদের এ শাস্তি দেবেন যে, জনগণের সম্মুখেই তাদের নিজেদের সৃষ্ট দেহে প্রাণের সঞ্চার করার জন্যে বলবেন। কিন্তু তা করতে তারা কখনই সক্ষম হবে না।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে যেসব ছবি বা প্রতিকৃতিকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয় কিংবা বৈষয়িক দৃষ্টিতে তাদের সম্মানযোগ্য মনে করা হয় সেগুলো বানান এবং সংরক্ষণ হারাম। প্রথম প্রকারের ছবি ও প্রতিকৃতি হতে পারে নবী-রাসূল, ফেরেশতা ও নেককার লোকদের। যেমন হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসহাক, হযরত মূসা, হযরত মরিয়ম ও হযরত জিবরাঈলের ছবি বা প্রতিকৃতি। খ্রিস্টানদের সমাজে এ পর্যয়ের ছবি ও প্রতিকৃতি সংরক্ষণের ব্যাপক রেওয়াজ রয়েছে। বহু বিদয়াতী মুসলমানও তাদের অনুসরণ করে। তারা হযরত আলী ও ফাতিমা (রা) প্রমুখের ছবি বা প্রতিকৃতি বানিয়ে থাকে।
আর দ্বিতীয় পর্যায়ের ছবি বা প্রতিকৃতি হয়ে থাকে রাজা-বাদশাহ, শাসক, ডিকটেটর ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের। প্রথম প্রকারের ছবি প্রতিকৃতি বানানর তুলনায় এদেরটা বানান কিছুটা কম গুনাহ। কিন্তু বড় বড় কাফির, জালিম ও ফাসিক-ফাজির ব্যক্তিদের ছবি প্রতিকৃতি বানালে এ গুনাহ অধিক তীব্র হয়ে দেখা দেয়। যেমন সেসব শাসকদের ছবি প্রতিকৃতি, যারা আল্লাহর বিধান মুতাবিক শাসন কার্য সম্পন্ন করে না। সেসব নেতাদের বড় ছবি প্রতিকৃতি যারা আল্লাহর দেয়া জীবনাদর্শকে বাদ দিয়ে অন্য কোন দিকে লোকদের ডাকে। সেসব শিল্পী-সাহিত্যিকদের ছবি ও প্রতিকৃতি, যারা বাতিল মতাদর্শ প্রচার করে এবং লোকদের মধ্যে নির্লজ্জতা, নগ্নতা ও চরিত্রহীনতা প্রসার ঘটায়।
রাসূলের সমসাময়িক যুগে প্রধানতঃ পবিত্রতা ও সম্মান প্রদর্শনার্থেই ছবি বা প্রতিকৃতি বানান হতো। আর সেগুলোর বেশির ভাগ রোমান পারসিক অর্থাৎ খ্রিস্টান ও অগ্নি পূজারীদেরই কাজ হতো। এ কারণে সে সবের ওপরে ধর্মীয় ভক্তি-শ্রদ্ধা ও শাসকদের প্রতি পবিত্রতাবোধের ছাপ প্রকট হয়ে থাকত। হযরত আবুদ্ দোহা বলেনঃ (আরবি****************)
আমি মাশরূকের সাথে একটি ঘরে ছিলাম। তাতে বহু প্রতিকৃতি ও ছবি রক্ষিত ছিল। সেসব দেখে মাশরূক আমাকে বললেনঃ এগুলো কি কিসরা’র প্রতিকৃতি? আমি বললামঃ না, এ হযরত মরিয়মের প্রতিকৃতি। সম্ভবতঃ মাশরূক মনে করেছিলেন, এসব প্রতিকৃতি অগ্নি পূজারীদের নির্মিত! কেননা তারা পাত্রে ইত্যাদিতে নিজেদের রাজা-বাদশাহদের ছবি বানিয়ে থাকে। কিন্তু জানা গেল যে, এসব প্রতিকৃতি খ্রিস্টানদের নির্মিত। এ পর্যায়ে মাশরূক বললেনঃ আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ আল্লাহর কাছে সর্বাধিক আযাব পাওয়ার যোগ্য সেসব লোক, যারা ছবি প্রতিকৃতি বানিয়ে থাকে।
এসব ব্যতীত উদ্ভিদ-গাছ, নদী, জাহাজ, পাহাড়, চন্দ্র, সূর্য, তারকা প্রভৃতি প্রাণহীন নৈসর্গিক দৃশ্যাবলীর ছবি বানান ও রাখায় কোন দোষ নেই। এ ব্যাপারে কোন দ্বিমতের অবকাশ নেই।
কিন্তু প্রাণীর ছবি হলে আর তাতে পূর্ববর্ণিত ভাবধারার আশংকা না থাকলে- শ্রদ্ধা – ভক্তি, সম্মান পবিত্রতার ভাবধারা জাগানর ছবি না হলে এবং তাতে আল্লাহর সৃষ্টিশক্তির সাথে সাদৃশ্যকরণ উদ্দেশ্য না হলে এ গ্রন্থকারের মতে তাতে কোন গুনাহ নেই, তা হারাম নয়। নিম্নোদ্ধৃত হাদীসদ্বয় থেকে তার সমর্থন পাওয়া যায়ঃ (আরবি****************)
আবূ তালহা সাহাবী থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম (সা) বলেছেন, ফেরেশতা এমন ঘরে প্রবেশ করে না, যেখানে ছবি রয়েছে। এই হাদীসের বর্ণনাকারী বুসর বলেছেন, পরে যায়েদ অসুস্থ হলে আমরা তাকে দেখতে গেলাম। দেখলাম, তার ঘরের দরজায় ঝুলান পর্দায় ছবি রয়েছে। রাসূলের বেগম মায়মুনার লালিত-পালিত উবায়দুল্লাহ খাওলানীকে জিজ্ঞেস করলাম, যায়েদ ছবি সম্পর্কে প্রথম দিন আমাদের কি বলেছিলেন? উবায়দুল্লাহ্ জবাবে বললেন, তিনি যে সময় ছবি হারম বলেছিলেন, তখন এই ব্যতিক্রমের কথাও বলেছিলেন যে, কাপড়ে অংকিত হলে দোষ নেই।
উতবা থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ তালহা আনসারীকে দেখতে গেলেন। তথায় তিনি সহল ইবনে হানীফকে উপস্থিত পেলেন। আবূ তালহা এক ব্যক্তিকে বললেন, নিচ থেকে বিছানাটা বের করে আন। এ কথা শুনে সহল বললেন, ওটাকে কেন বের করে নিচ্ছ? তিনি বললেনঃ এজন্যে যে, ওটাতে ছবি রয়েছে। আর নবী করীম (সা) ছবি সম্পর্কে কি কি বলেছেন, তা তো আপনার জানাই আছে। সহল বললেন, তিনি এও বলেছেন যে, কাপড়ে অংকিত হলে দোষ নেই। আবূ তালহা ঠিকই বলেছেন, কিন্তু আমি মনে করি, ওটা সরিয়ে দেয়াই ভাল।
এ দুটো হাদীস থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, হারাম ছবি বলতে প্রতিকৃতি (Statue) বোঝায়। কিন্তু যেসব ছবি কাষ্ঠফলক, তক্তা বা শক্ত কাগজ বা কাপড়, বিছানা বা প্রাচীরের ওপর অংকিত করা হয়, সেগুলো যে হারাম, তা কোন সহীহ স্পষ্ট ও অকাট্য হাদীস থেকে প্রমাণিত নয়।
তবে সহীহ্ হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত যে, নবী করীম (সা) এ ধরনের ছবির প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কেননা তাতে বিলাসিতা, বড়লোকী ও বৈষয়িক স্বার্থপূজার সাথে পূর্ণ সাদৃশ্য ও একত্মতা লক্ষ্য করা যায়।
হযরত আবূ তালহা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ আমি রাসূলে করীম (সা) কে বলতে শুনেছি, তিনি বললেনঃ (আরবি****************)
যে ঘরে কুকুর বা প্রতিকৃতি রয়েছে, তাতে ফেরেশতা প্রবেশ করে না।
তিনি বলেন, পরে আমি হযরত আয়েশা (রা)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম। এই লোকটি বলেছেনঃ রাসূলে করীম (সা) নাকি বলেছেন যে, যে ঘরে কুকুর বা প্রতিকৃতি থাকবে, তাতে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। আপনি কি শুনেছেন, রাসূল করীম (সা) এরূপ বলেছেনঃ তিনি বললেনঃ না। তবে আমি নিজে তাকে যা যা করতে দেখেছি, তা তোমার কাছে বর্ণনা করছি। রাসূলে করীম (সা) যুদ্ধে বের হয়ে গেলেন। তখন একটা চাদর দিয়ে দরজায় পর্দা করলাম। তিনি ফিরে এসে দরজায় সেই চাদরটি ঝুলতে দেখতে পেলেন। তাঁর চেহারায় অস্বস্তি ও অপছন্দের ভাব প্রকট হয়ে উঠল। পরে তিনি চাদরটি টেনে নিয়ে ছিড়ে ফেললেন এবং বললেনঃ আল্লাহ্ আমাদের পাথর ও মাটি সমূহ কাপড় দিয়ে সজ্জিত করার নির্দেশ দেন নি। হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ আমি সে কাপড় দিয়ে দুটি বালিশ বানালাম এবং তাতে খেজুর গাছের ছাল ভরে দিলাম। শেষে তিনি এ ব্যাপারে কোন আপত্তি করেন নি।
এই হাদীসটি থেকে খুব বেশি যা প্রমাণিত হয়, তা হচ্ছে এই যে, প্রাচীর ইত্যাদিকে ছবি যুক্ত কাপড় দ্বারা সাজ্জিত করা মাকরূহ তানজীহী মাত্র। ইমাম নববী লিখেছেনঃ (আরবি****************)
হাদীসটিতে এমন কোন কথা নেই, যা হারাম প্রমাণ করে। কেননা হাদীসের কথা ‘আল্লাহ্ আমাদের এর নির্দেশ দেন নি’ কথাটি দ্বারা না ওয়াজিব প্রমাণিত হয়, না হয় মুস্তাহাব। আর হারামও প্রমাণিত হয় না।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীস থেকেও এরূপ জানা যায়। হাদীসটি হচ্ছেঃ (আরবি****************)
আমার একটা পর্দার কাপড় ছিল। তার ওপর একটি পাখির ছবি অংকিত ছিল। কেউ ঘরে প্রবেশ করতে গেলে সেটার ওপর তার নজর পড়ত। এই দেখে নবী করীম (সা) আমাকে বললেনঃ ওটা সরিয়ে রাখ। কেননা আমি যখন ঘরে প্রবেশ করি, তখন ওটার ওপর আমার দৃষ্টি পরে ও দুনিয়া চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে।
নবী করীম (সা) পর্দার কাপড়টি ছিড়ে ফেলতে বলেন নি, সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। এ কারণে যেসব জিনিস বৈষয়িকতা ও বৈষয়িক জাঁকজমক সুখ-স্বাচ্ছন্দের দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়, তার প্রতি আকর্ষন বৃদ্ধি করে নবী করীম (সা) সেসব জিনিস চোখের সুন্নাত ও নফল নামায সাধারণত নিজের ঘরেই পড়তেন। উপরিউক্ত ধরনের ছবি ও প্রতিকৃতি সম্বলিত চাদর ও পর্দা মানুষকে নিজেদের প্রতি নিরন্তর আকর্ষণ করতে থাকে। তার প্রভাবে আল্লাহর প্রতি ঐকান্তিক নতি স্বীকার ও একনিষ্টভাবে প্রার্থনা-মুনাজাতে নিমগ্ন হওয়া অনেকটা ব্যাহত হয়ে পড়ে। অন্তর গাফিল হয়ে যায়। হযরত আনাস (রা) বলেছেনঃ
হযরত আয়েশা (রা)-এর কাছে একটি পর্দার কাপড় ছিল। সেটা তিনি ঘরের একদিকে লাগিয়ে রাখতেন। নবী করীম (সা) তাঁকে বললেনঃ ওটাকে সরিয়ে রাখ। কেননা ওটার ওপর অংকিত ছবিগুলো নামাযে আমার সামনে পড়ে।
এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, একটি পাখি ও অন্যান্য ছবি সম্বলিত কাপড়টির অস্তিত্ব নবী করীম (সা) বরদাশত করেছিলেন। কাপড় দুটি ছিড়ে ফেলার নির্দেশ দেন নি।
এ সব হাদীস ও এ ধরনের অপরাপর হাদীসের ভিত্তিতে সেকালের লোকদের মত হচ্ছে, যে ছবি বা প্রতিকৃতির ছায়া পড়ে- অন্য কথায় যা দেহসত্তা সম্পন্ন, কেবল সেগুলোই হারাম। পক্ষান্তরে যেগুলোর কোন ছায়া পড়ে না, তাতে কোন দোষ নেই।
ইমাম নববী মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যায় এই মতের প্রতিবাদ করে লিখেছেন, এ ধরনের মত বাতিল, গ্রহণ-অযোগ্য। কিন্তু হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী ইমাম নববীর সমালোচনা করে বলেছেন, এই মতটি মদীনার সেকালের বিশিষ্ট ফিকাহবিদ কাসেম ইবনে মুহাম্মদ ঘোষণা করেছেন এবং সহীহ সনদ সহকারে বর্ণিত হয়েছে।
শায়খ বখীত ইমাম খাত্তাবীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। সে উক্তি এইঃ
যে ব্যক্তি জীব-জন্তুর আকৃতি বানায় আর যে শিল্পী বৃক্ষাদির ছবি আঁকে আমি মনে করি উপরিউক্ত কঠোর বাণী তাদের জন্যে নয়। যদিও এ পর্যায়ের সমস্ত কাজই অপছন্দনীয় এবং তাতে মানুষের লক্ষ্য অপ্রয়োজনীয় কাজকর্মের দিকে নিবদ্ধ হয়ে যায়।
খাত্তাবীর এই উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে শায়খ বখীত লিখেছেনঃ
তার কারণ হচ্ছে, যে ব্যক্তি জীবের আকৃতি রচনা করে, সে আসালে জীবের আ্কৃতি উদ্ভাবন করে না, আকার-আকৃতির একটা রূপ-রেখার তৈয়ার করে মাত্র। এভাবে যেসব ছবি আঁকা হয়, তাতে তার এমন বহু রূপ-প্রত্যঙ্গই উহ্য থেকে যায়, যা না হলে কোন জীবেরই জীবিত যাক সম্ভব হয় না। বরং আসলে দেহটাই অনুপস্থিত থাকে। কাজেই তা জীবের সেই ছবি নয়, যার অংকনকারী কিয়ামতের দিন রূহ ফুঁকে দেয়ার শাস্তির যোগ্য বিবেচিত হতে পারে অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না। যে ছবি আঁকা সম্পর্কে কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে, তা হচ্ছে দেহসম্পন্ন প্রতিকৃতি নির্মাণ, যার ছায়া হয়ে থাকে, যার কোন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা না হলে জীবিত থাকতে পারে না- অনুপস্থিত থাকে না। যে প্রতিকৃতি এ ধরনের হবে, তাতেই রূহ ফুঁকে দেয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু ছবি অংকনকারী তাতে রূহ দিতে অক্ষম। তাহলে তার অর্থ এ নয় যে, প্রতিকৃতিটিএত জীবন গ্রহণের যোগ্যতাই নেই। বরং এটা ছকি অংকনকারীর অক্ষমতা। কাজেই তাতে অক্ষম হওয়ার দায়িত্ব তার ওপরই বর্তায়।
বিদেহী ছবি বানান যে জায়েয, নিম্নোদ্ধৃত হাদীস থেকেও তার সমর্থন পাওয়া যায়। আল্লাহর তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
(আরবী******************)
তার তুলনায় অধিক জালিম আার কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির ন্যায় সৃষ্টিকর্ম করে এদের তো উচিত একটা কণা সৃষ্টি করা, এদের তো উচিত একটা গমের দানা সৃষ্টি করা।
আসলে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি- আমরা যেমন দেখছি- শুধু সমতল স্থানের ওপর রেখা মাত্র নয়, বরং তা দৈর্ঘ-প্রস্থসম্পন্ন দেহবিশিষ্বট সৃষ্টি। যেমন আল্লাহ নিজেই বলেছৈন:
(আরবী*****************)
সেই আল্লাহ্ই মাতৃগর্ভে যেমন চাহেন তেমন তোমাদের আকার-আকৃতি দিয়ে থাকেন।
এ মতের বিরুদ্ধে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসটিই দলিল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে। হাদীসটি হচ্ছেঃ
(আরবী****************)
হযরত আয়েশা (রা) একটা বালিশ ক্রয় করেছিলেন। তার ওপর ছবি ছিল। রাসূলে করীম (সা) সেটা বাইরে থেকে দেখতে পেয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন না, দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকলে হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আমি রাসূলে করীমের চেহারা মুবারকে অস্বস্তি ও অসন্তুষ্টির চিহ্ন লক্ষ্য করে নিবেদন করলাম: হে রাসূলুল্লাহ! আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করছি, আমার দ্বারা কি অপরাধ হয়ে গেল? বললেন: এ বালিশটি কোত্থেকে আলে? হযরত আয়েশা বললেন্: এ ধরনের ছবি যারা বানায়, কিয়ামতের দিন তাদের আযাব দেয়া হবে এবং তাদের বলা হবে, এখন তোমাদের সৃষ্টির মধ্যে প্রাণ দাও। পরে তিনি বললেন: যে খরে ছবি থাকে, ফেরেশতা সে ঘরে প্রবেশ করে না।
মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত বর্ণনায় অতিরিক্ত কথা এটুকু:
(আরবী****************)
পরে আমি সেটা কেটে দুটি ছোট ছোট বালিশ বানালাম। রাসূলে করীম (সা) তার ওপর হেলান দেয়ার জন্যে ঘরে ব্যবহার করতে থাকলেন। হযরত আয়েশার কথার অর্থ হচ্ছে, ছবি সম্বলিত বালিশটিকে দুটি ছোট বালিশ বানিয়ে নিয়েছিলেন।
কিন্তু নিম্নোক্ত কয়েকটি ব্যাপার এ হাদীসের বিপরীত:
১. এক হাদীসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত। বর্ণনাগুলো পরস্পরে বৈপরীত্য রয়েছে। কোন কোন বর্ণনা বলা হয়েছে, ছবি সম্বলিত বালিশটি কেটে দুটি ছোট বালিশ বানান হলো, যা তিনি ব্যবহার করতেন। কিন্তু অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিনি তা ব্যবহার করেননি।
২. কোন কোন বর্ণনা থেকে তা ব্যবহ৮ার করা শুধু মাকরূহ মনে হয়। আর তাও ছবি সম্বলিত কাপড় দ্বার প্রাচীর সজ্জিত করা প্রসঙ্গে। তা এক প্রকারের বিলাসিতা ও বড়লোকি চাল। এ চাল রাসূলের আদৌ পছন্দ ছিল না। তিনি বলেছেন:
(আরবী*************)
পাথর ও মাটিকে পোশাক পরাবার কোন আদেশই আল্লাহ আমাদের দেননি।
৩. মুসলিম শরীফে স্বয়ং হযরত আয়েশা (রা) থেকেই ছবি সম্বলিত পর্দা সম্পর্কে যে হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে নবী করীম (সা) নিজেই বলেছেন: ‘ওটা সরিয়ে রাখ, কেননা আমার নযর যখন ওর ওপর পড়ে তখন দুনিয়া আমার স্মরণে এসে যায়। এ কথা থেকে চূড়ান্ত ভাবে হারাম প্রমাণিত হয় না।
৪. সেই হাদীসটির বিপরীত, যাতে বলা হয়েছে, হযরত আয়েশা’র ঘরে যে পর্দা ছিল, রাসূলে করীম (সা) সেটাকে সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। কেননা তাতে যে ছবি আঁকা রয়েছে, তা নামাযের সময়ে তাঁর সম্মেোখ এসে পড়ে। হাফেজ ইবনে হাজার বলেন: এ হাদীস ও হযরত আয়েশা’র বালিশ সম্পর্কিত হাদীস- এ দুটোর মধ্যে সমন্বয় সাধন কঠিন। কেননা এ হাদীস থেকে জানা যায়, পর্দাটি সরিয়ে ফেলার জন্যে নবী করীম (সা) আদেশ করেছিলেন এজন্যে যে, নামাযের সময় ছবিটি একেবারে চোখের সম্মুখে এসে পড়ে। নতুবা শুধু ছবির কারণে এ নির্দেশ তিনি দেন নি।
অতঃপর দুটি হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে তিন বলেছেন: প্রথম হাদীসে যেসব ছবির কথা রয়েছে তা প্রাণীর ছবি। আর এ হাদীসে যে ছবির উল্লেখ, তা প্রাণীর নয়।
কিন্তু এ সামঞ্জস্য বিধান যথার্থ নয়। কেননা পর্দা সম্পর্কি হাদীসে পাখির ছবির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
৫. আবূ তালহা বর্ণিত হাদীসও উপরিউক্ত হাদীসের বিপরীত। তাতে কাপড়ের ওপর অংকিত ছবিকে হারাম বলা হয়নি।
আল্লাম কুরতুবী লিখেছেন:
দুটো হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের একটি উপায় হচ্ছে একথা বলা যে, হযরত আয়েশা বর্ণিত হাদীসে শুধু মাকরূহ বলা হয়েছে এবং আবূ তালহা বর্ণিত হাদীস থেকে শুধু জায়েজ প্রমাণিত হয়। আর তা মাকরূহ হওয়ার পরিপন্থী নয়।
হাফেজ ইবনে হাজারের মতে এ সমন্বয় উত্তম।
৬. হযরত আয়েশার ঠেসবালিশ সম্পর্কিত হাদীসের বর্ণনাকারী তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র কাসেম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর। তাঁর মতে যে ছবির ছায়া পড়ে না, তা জায়েয ছিল। ইবনে আউন বলেন: আমি কাসেমের কাছে গেলাম। তিনি মক্কার উচ্চাংশে নিজের ঘরে অবস্থান করছিলেন। আমি তাঁর ঘরে একটা সুসজ্জিত কোঠা দেখলাম। তার ওপর ‘কুন্দুস’ নামক এক প্রকারের জলজন্তু ও উমকা নামক এক প্রকারের পাখির ছবি অংকিত ছিল।
হাফেজ ইবনে হাজার বলেন:
সম্ভবতঃ যে হাদীসে (আরবী*********) তবে কাপড়ে অংকিত হলে (নাজায়েয নয়)’ কথাটি থেকে তিনি সাধারণভাবে জায়েয বুঝেছেন। আর সম্ভবনত হযরত আয়েশার ঘরের পর্দা সম্পর্কি হাদীসের ব্যাখ্যা তাঁর মতে এই ছিল যে, তার পর্দার কাপড়টি বিত্রিতও ছিল এবং তা প্রাচীল ঢাকার কাজেও ব্যবহার করা হতো। এ সম্পর্কেই রাসূলের কথা:” ‘মাটি ও পাথরকে কাপড় পরাবার আদেশ আমাদের দেয়া হয়নি।’ কাসেম ইবনে মুহাম্মদ মদীনার তদানীন্তন সাতজন বিশিষ্ট ফিকাহবিদের অন্যতম। তিনি হেলান দেয়ার বালিশ সম্পর্কিত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি যদি ‘সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠ’ ধরনের ক্ষেত্রে ছবি থাকা জায়েয মনে না করতেন, তাহলে সেখানে তিনি নিশ্চয়ই তা ব্যবহার করতেন না। (ফাতহুল বারী)
কিন্তু ছবি ও ছবি অংকনকারী পর্যায়ে বর্ণিত এসব হাদীস থেকে একটি সম্ভবতক এই প্রকাশ পায় যে, রাসূলে করীম (সা) প্রথমদিকে- যখন শির্ক, বুতপরস্তি ও ও ছবিকে পবিত্র মনে করার কাল অতীত হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি- ছবির ব্যাপারে খুব কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছেন। কিন্তু উত্তরকালে তওহীদী আকীদা যখনে লোকদের মনে মগজে সুদৃঢ় হয়ে বসে গেছে, তখন বিদেহী ছবি রাখার অনুমতি দিয়েছেন- যা আসলে শুধু নকশা ও রেখামাত্র। তা-ই যদি না হবে, না হবে, তাহলে তাঁর নিজের ঘরে কোন ছবি সম্বলিত পর্দার অস্তিত্ত্বকেও তিনি আদৌ বরদাশ্ত করতেন না। আর কাপড়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি স্বরূপ অংকিত ছবিকে জায়েয বলতেন না। কাগজ ও প্রাচীরগাত্রে আঁকা ছবি সম্পর্কে এ থেকেই ধারণা করা যায়।
হানাফী মাযহাবের অন্যতম চিন্তাবিদ (ইমাম) তাহভী লিখেছেন: শরীয়তের বিধানদাতা শুরুতে সর্বপ্রকার ভচি-প্রকৃতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কাগজ বা কাপড়ে অংকিত চিত্র পর্যন্ত এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। কেননা মূর্তি-প্রতিকৃতি পূজার সময়কাল অতিবাহিত হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। তখনো। এ কারণে সর্বপ্রকারের ছবি-চিত্রই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ নিষেধ ঘোষণা কার্যকর হয়ে যাওয়ার পর তিনি কাপড়ে অংডিকত নক্শা-চিত্র ও নিষেধের আওতার বাইরে ঘোষণা করেন সাধারণ প্রয়োজনের দৃষ্টেোত। সেসব ছবিও জায়েয করে দেয়া হয়, যার প্রতি তেমন কোন সম্মান বা মর্যাদা দেখানো হয় না। যেসব ছবির অসম্মান করা হয় সেগুলোর প্রতি সম্মান বা মর্যদা দেখানোর আশংকা থাকে না। তবে সেসব ছবির প্রতি সাধারণতঃ অমর্যাদা দেখান হয় না, যে সবের ওপর নিষিধ পূর্ববৎ বহাল থেকে যায়। (আল জাওয়াবে শাফী)
ছবির প্রতি অমর্যাদাই তাকে জায়েয করে
কোন ছবিতে যদি এতটা পরিবর্তন সাধন করা হয়, যার দরযুন তা মর্যাদাযোগ্য থাকে না- অমর্যাদা সম্পন্ত হয়ে থাকে, তা বৈধতার আওতার মধ্যে এসে যায়। হাদীসে বলা হয়েছে, হযরত বিরাঈল (আ) ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলে নবী করীম (স) বললেন:
(আরবী***************)
আসুন, জিরাঈল বললেন: আমি কি করে ঘরে প্রবেশ করব, আপনার ঘরে ছবি সম্বলিত পর্দা ঝুলছে! ওটা যদি রাখতেই হয়, তাহলে ছবির মাথা কেটে দিন কিংবা পর্দার কাপড়টি ছিড়ে বালিশ বা বিছানা বানিয়ে নিন।
এ কারণেইা হযরত আয়েশা (রা) যখন হেলান দেয়ার বালিশটির কারণে নবী করীম (স)-এর চেহারায় অস্বস্তির লক্ষণ দেখলেন, তখন ছিড়ে দুটো ছোট ছোট বালিশ বানিয়ে নিয়েছিলেন। এতে করে ছবির প্রতি গুরুত্বহীনতা প্রদর্শন করা হলো এবং কোনোরূপ সম্মান দেখানর আশংকা থাকে না।
আগের কালের লোকদের সম্পর্কে উদ্ধৃত হয়েছে যে, মর্যাদাহীন ছবি ব্যবহার করাতে তাঁরা কোন দোষ মনে করতেন না। ওরওয়া থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি পাখি ও মানুষের চিত্র সম্বলিত বালিশের ওপর হেলান দিতেন। ইকরামা বলেন, বলেন, ছবিকে প্রতিষ্ঠিত করা- উঁচু করে রাখাকে আলিমগণ পছন্দ করতেন না। আর যেসব ছবি সাধারণত পদদলিত হয়, তাতে তিনি দোষ মনে করতেন না। বালিশ-বিছানায় অংকিত ছবি তো পদদলিত হয়ই, এজন্যে তা জায়েয।
ফটোগ্রাফীর ছবি
এ কথা সুস্পষ্ট যে, প্রতিকৃতি নির্মাণ ও প্রতিকৃতি নির্মাতা পর্যায়ে যে সব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, তা সবই প্রতিকৃতি সম্পর্কে, যা খোদাই করা হয় কিংবা যা হাতে আঁকা হয়। কিন্তু ক্যামেরার দ্বার প্রতিবিম্বের সাহায্যে গৃহীত আলোক চিত্রের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নবোদ্ভাবিত। এ ফটোগ্রাফী রাসূলে করীমের যুগে ছিল না। এখানে প্রশ্ন ওঠে, প্রতিকৃতি ও প্রতিকৃতি নির্মাতা সম্পর্কে যেসব আইন-বিধান উদ্ধৃত হয়েছে, তা কি এই ফটোগ্রাফীর ওপর প্রযোজ্য?
সে সব আলিম মনে করেন, দেহ সম্পন্ন প্রতিকৃতি নির্মাণই হারাম, তাঁদের মতে ফটোগ্রাফীর ছবিতে কোন দোষ নেই, বিশেষ করে, যখন তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় থাকে।
অপরাপর আলিমদের মত যা, সে পর্যায়ে প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রতিবিম্ব সৃষ্ট ছবি কি সেই ছবির সমতুল্য, যা শিল্পী তার ব্রাশ দ্বারা নিজে আঁকে? কিংবা কোন কোন হাদীসে যেমন ‘ইল্লাত’ (Reason) হিসেবে বলা হয়েছে: প্রতিকৃতি নির্মাতা আল্লাহর সৃষ্টি কর্মের সাথে সাদৃশ্য করে, ফটোগ্রাফীতে কি তা উপস্থিত নেই? আর ফিকাহ্ দর্শনের দৃষ্টিতে ‘ইল্লাত’ (Reason)-ই যখন থাকে না, তখন তার ভিত্তিতে যে হুকুক-নির্তেষ করা হয়েছে তাও অবশিষ্ট থাকে না। (অর্থাৎ মূলত সাদৃশ্যই যখন নেই, তখন তা হারাম হতে পারে না।)
এ পর্যায়ে মিশরের মুফতি শায়খ মুহাম্মাদ বখীত মরহুম প্রদত্ত ফতোয়া অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তিনি লিখেছেন: ফটোগ্রাফীর সাহায্যে গৃহীত ছবি- যা আলোর প্রতিবিম্বকে বিশেষ উপায়ে আটকে নেয়ার দরুন সম্ভবপর হয়- সেই ছবি প্রতিকৃতির অন্তর্ভুক্ত নয়, যা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। কেননা যে ধরনের ছবি-প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ছবি-প্রতিকৃতি উদ্ভাবন ও নির্মাণ করা প্রসঙ্গে, যা পূর্বে বর্তমান বা নির্মিত ছিল না, যা বানানর ফলে আল্লাহর সৃষ্ট কোন জীবন্ত জিনিসের সাথে সাদৃশ্য করা হয়। কিন্তু ক্যামেরার সাহায্যে গৃহীত ফটো সেই পর্যায়ে পড়ে না।
(আরবীঁ*****************)
বস্তুত ফটোর মূলকথা এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে সে বিষয়ে হুকুম এই। তবে বহু আলিমই ছবি সম্পর্কে- তা যে ধরনেরই হোক না কেন- খুব কড়াকড়ি করে থাকেন এবং তা মাকরূহ (অনেকে স্পষ্ট হারাম) মনে করেন। ফটোগ্রাফীকে নাজায়েয মনে করেন। এতদসত্ত্বেও আলিমগণও প্রয়েঅজন ও জাতীয় বা তমদ্দুনিক কল্যাণে ছবি তোলা জায়েয বলেন, যেমন পরিচিত কার্ড বা পাসপোর্ট ইত্যাদির। বিশেষ করে সন্ধিগ্ন ব্যক্তিদের ছবি এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা তওজীহর জন্যে ব্যবহৃত ছবি প্রভৃতি। এই ধরনের ছবি দ্বারা না কারো প্রতি কোনো শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন লক্ষ্য হয়, না এতে আকীদা খারাপ হওয়ার কোন আশংকা থাকতে পারে। কাপড়ে অংকিত চিত্রকে রাসূলে করীম (সা) হারামের মধ্যে গণ্য করেন নি। তাই তার তুলনায় অধিক বেশি প্রয়োজনীয় এ ধরনের ছবি তো অবশ্যই হারামের আওতা বহির্ভূত হবে।
ছবির উদ্দেশ্য
ছবি কি উদ্দেশ্যে বানান হচ্ছে, ছবির হারাম হওয়া না হওয়া এ প্রশ্নের খুব বেশি গুরুত্ব রয়েছে এবং এরই ভিত্তিতে তা নির্ধারণ করা সম্ভব, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেসব ছবির উদ্দেশ্য ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস, তার শরীয়ত এবং তার সংস্কৃতি ও রীতি-নীতির পরিপন্থী, তার হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন মুসলমানই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন না। অতএব নারীদেহের নগ্ন বা অর্ধ নগ্ন ছবি এবং নারী বিশেষত্ব সম্পন্ত ও যৌন-উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে যেসব অঙ্গ দর্শনে, সেসবের ছবি, সেসবের রেখাচিত্র বানাও সম্পূর্ণ হারাম। মানুষের মধ্যে যৌন-স্পৃহা ও তার উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং হীন মন-মানসিকতাকে দাউ দাউ করা আগুনের মতো উত্তপ্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে পত্র-পত্রিকাদিতে যে ধরনের ছবি বা স্কেচ প্রকাশ করা হয়, তা যে হারাম এবং তা যে অত্যন্ত মারাত্মক তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না। এ ধরনের ছবি বা চিত্রের ব্যাপক প্রচার করা, ছাপানো ও সংরক্ষণ করা, ঘর অফিস ও প্রকাশ্য স্থানে ঝুলিয়ে রাখা, তার প্রদর্শনী করা, প্রাচীর গাত্রে তা লাগিয়ে রাখা- ইচ্ছা ও আগ্রহের বশবর্তী হয়ে তা দেখা ও পর্যবেক্ষণ করা সবই এ হারাম পর্যায়ের মধ্যে গণ্য।
কাফির-ফাসিক ও জালিম লোকদের ছবি সম্পর্কেও এ কথা। এ পর্যায়ের লোকদের ছবি প্রতিকৃতি রচনা বা সংরক্ষণ করা কোন মুসলমানের পক্ষেই শোভন নয়, উচিত নয়। যেসব নাস্তিক নেতা আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে, আল্লাহর শরীয়তকে অগ্রাহ্য করে কিংবা যেসব মূর্তিপূজারী আল্লাহর সাথে শিরক করার কাজে লিপ্ত, ইয়াহুদী ও খ্রিস্টন- যারা হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর নবুয়্যাতকে অস্বীকার করে কিংবা যেসব লোক মুসলিম হওয়ার দাবি করা সত্ত্বেও আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র শাসন, নীতি নির্ধারণ ও বিচার ফয়সালার কাজ করছে-স যারা সমাজের নির্লজ্জতা ও বিপর্যয় ছড়াচ্ছে- যেমন অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা ও নর্তক-নর্তকী ইত্যাদিদের ছবিও সম্পূর্ণ হারাম।
যারা মূর্তিপূজার প্রসার ঘটায়, ইসলামের বিপরীত ধর্মের নিদর্শন- মূর্তি প্রতিকৃতি ও ক্রুশ ইত্যাদির ছবি কোনক্রমেই জায়েয নয়। রাসূলে করীম (স)-এর যুগে সম্ভবতঃ বেশির ভাগ বিছানার চাদর ও পর্দা-বালিশের কাপড়ে এ ধরনের ছবি চিত্রিত হতো। এ কারণে হাদীসে বলা হয়েছে:
(আরবী*************)
নবী করীম (সা) তাঁর ঘরে এমন কোন জিনিস রাখতেন না, যার ওপর ক্রুশ ইত্যাদির ছবি আছে। এরূপ জিনিস থাকলে তা ছিড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে:
(আরবী***************)
মক্কা বিজয় বছরে যখন নবী করীম (সা) হারামের মধ্যে ছবি দেখতে পেলেন, তখন তিনি প্রবেশ করলেন না পরে তা মুছে ফেলা হয় এবং তার পরই তিনি তথায় প্রবেশ করেন।
সেখানে যেসব ছবি ছিলত তা থেকে মক্কার মুশরিকদের মূর্তিপূজা ও তাদের প্রাচীন গুমরাহীই প্রকট হয়ে উঠেছিল।
হযরত আলী (রা) বর্ণিত, নবী করীম (সা) একদা জানাযায় শরীক হয়েছিলেন। তখন বললেন:
(আরবী***********)
তোমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে মদীনায় গিয়ে প্রতিটি কবর সমতল করে দেবে এবং কোন একটি ছবিও রাখবে না, প্রত্যেকটিকেই বিকৃত করে দেবে?
এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসূল, আমি এ আঞ্জাম দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। এ কথা শুনে মদীনাবাসীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো।…. পরে সেই লোকটি ফিরে এসে নিবেদন করলেন:
(আরবী****************)
হে রাসূল! আমি একটি মূর্তিও রাখি নি, চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছি। কোন একটি কবরকেও বাদ দেই নি, সবগুলোকে সমতল করে দিয়েছি এবং প্রতিটি ছবিকে আমি বিকৃত করে দিয়েছি, কোনটিকেই রেহাই দেইনি।
এ কথা শুনে নবী করীম (সা) ঘোষণা করলেন:
(আরবী*********)
অতঃপর যে লোকই এ কাজগুলোর মধ্যে থেকে কোন একটি কাজও করবে সে সেই হেদায়েতের অমান্যকারী হবে, যা মুমাহম্মাদ (সা) এর প্রতি নাযিল হয়েছে। (মুসনাদে আহমদ)
এ হাদীসে নবী করীম (স) যেসব ছবি বিকৃত করতে ও নির্মূল করতে নির্দেশ দিয়েছেন, সেগুলো জাহিলিয়াতের যুগের কুফরী ও শিরকের প্রতীক ও নিদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। এ কারণেই নবী করীম (স) এসব থেকে মদীনাকে মুক্ত ও পবিত্র করতে চেয়েছিলেন। আর এজন্যেই এসব কাজের মধ্যে কোন একটিও পুনরায় করাকে আল্লাহর নাযিল করা বিধানের প্রতি কুফরী ও অমান্য করার শামিল বলে ঘোষণা করেছন।
ছবি-প্রতিকৃতি ও তার নির্মাতা সম্পর্কিত বিধানের সার-নির্যাস
ছবি-প্রতিকৃতি ও তার নির্মাতা সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের যে বিধান বিস্তারিতভাবে আলোচিত হলো, তার সার-নির্যাস এইঃ
ক. আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্য দেবতারূপে গৃহীতদের ছবি-প্রতিকৃতি সর্বাধিক কঠিন হারাম এবং তার গুনাহর সব চাইতে বেশি। খ্রিস্টানদের মাবুদ হযরত মসীহর (তাঁর মা মেরির) ছবি তার বড় দৃষ্টান্ত। এ ধরনের ছবি নির্মাণ সুস্পষ্ট কুফরী। কেউ যদি জেনে শুনে ইচ্ছা করে এ ধরনের ছবি নির্মান করে, তাহলে বুঝতে হবে, সে কাফির হয়ে গেছে। এ ধরনের ছবির প্রতিকৃতি নির্মান কঠিনতম গুনাহের কাজ ও অত্যন্ত জগণ্য ও ঘৃণ্য। আর যে ব্যক্তিই এ ধরনের ছবির প্রচলন করবে কিংবা কোন না কোনভাবে সে সবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, সে নিজের পরিমাণ অনুপাতে গুনাহে শরীক হলো।
খ. তার চাইতে কম গুনাহ হচ্ছে এমন সব ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি নির্মান, যার পুজা করা না হলেও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। যেমন কোন দেশের রাজা-বাদশা, সর্বোচ্চ নেতা, প্রশাসক, ডিকটেটর ইত্যাদি-এদের স্মৃতিস্তম্ভ স্বরূপ প্রতিকৃতি নির্মান করে উন্মুক্ত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। প্রতিকৃতি অসম্পূর্ণ বা সম্পুর্ণ হওয়ার দিক দিয়ে গুনাহে কোন তারতম্য হয় না।
ঘ. এর চেয়েও কম গুনাহ হচ্ছে এমন সব ব্যক্তির প্রতিকৃতি নির্মাণ, যাদের তাযীম ও পবিত্রতা প্রদর্শন করা হয় না। তবে তাও হারাম, এ সম্পর্কে কোন দ্বিমত নেই। তবে যাদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য জ্ঞাপন করা হয়, তা এ পর্যায়ে পড়ে না। যেমন বাচ্চাদের খেলনা ও মিঠাই মণ্ডা দিয়ে কোন প্রতিকৃতি বানান- যা খেয়ে ফেলা হয়।
ঙ. এর পরে আসে বিদেহী ছবিগুলোর প্রশ্ন। অর্থাৎ শৈল্পিক ছবি সেসব ব্যক্তিত্বের যাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়, যেমন প্রশাসক, জননেতা, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতা প্রমুখের ছবি। বিশেষ করে যদি তা কোথাও স্থাপন করা বা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। হারামের মাত্রা আরও কঠিন ও তীব্র হয়ে ওঠে যদি জালিম, ফাসিক-ফাজির-নাস্তিক ইত্যাদি ধরনের লোকদের ছবি হয়। কেননা এসব লোকের প্রতি তাযীম-সম্মান-উক্তি দেখান ইসলামকে নির্মূল করার সমান অপরাধ।
চ. গুনাহর দৃষ্টিতে তার চেয়ে কম মাত্রার হচ্ছে সেসব ছবি তোলা, যা অঙ্গ-সৌষ্ঠব ও দেহসম্পন্ন হয়, সেসব প্রাণীর ছবিও যাদের প্রতি কোন সম্মান প্রদর্শন কর হয় না বটে। তবে তা বিলাসিতার প্রকাশক। এ ধরনের ছবি সম্বলিত কাপড় দ্বারা দরজা ও প্রাচীর আবৃত করা মাকরূহ ছাড়া আর কিছুই নয়।
ছ. অ-প্রাণীদের ছবি-যেমন খেজুর গাছ, নদী, জাহাজ, পাহাড়, চন্দ্র-সূর্য ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্যাবলীর ছবি বানান ও সংরক্ষণ কোনটাইতেই গুনাহ নেই যদি তা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী থেকে মানুষকে গাফিল করে না দেয় কিংবা নিছক বিলাসিতার প্রতীক না হয়। অন্যথায় এ ধরনের ছবি মাকরূহ।
জ. এর পরে আসে প্রতিবিম্ব রচিত ছবি-অর্থাৎ ফটোর কথা। তা মূলতঃ মুবাহ- যদি তার মূলে কোন হারাম কাজ লক্ষ্য হয়ে না থাকে যেমন যে ব্যক্তির ছবি তার ধর্মীয় পবিত্রতা বা বৈষয়িক সম্মান প্রদর্শনমূলক। বিশেষ করে সে ব্যক্তি যদি কাফির হয়- যদি সে মূর্তি পূজারী হয় বা কমিউনিস্ট কিংবা পথভ্রষ্ট কোন শিল্পী, তাহলে তা জায়েয নয়।
ঝ. আর সর্বশেষ কথা এই যে, হারাম প্রতিকৃতি ও ছবি বিকৃত করে দেয়া হলে কিংবা অসম্মানিত ও হীন বানিয়ে দেয়া হলে তা হারামের তালিকা থেকে খারিজ হয়ে হালাল পর্যায়ে গণ্য হয়ে যায়। যেমন বিছানার চাদরে বা মেঝেতে অংকিত চিত্র, যা পা জুতা দিয়ে দলিত করা হয় ইত্যাদি।
বিনা প্রয়োজনে কুকুর পালা
নবী করীম (সা) বিনা প্রয়োজনে ঘরে কুকুর পালতে নিষেধ করেছেন।
দুনিয়ার এমন কুরুচিসম্পন্ন লোকের অভাব নেই, যারা কুকুর লালন-পালনে দু’হাতে অর্থব্যয় করে; কিন্তু মানব সন্তানের জন্যে এক ক্রান্তি ব্যয় করতেও কার্পণ্য ও কুণ্ঠা দেখায়। অনেকে আবার কুকুরের মান-অভিমান রক্ষার জন্যে অর্থ ব্যয় করেই ক্ষেন্ত হয় না, তার সাথে হৃদয়াবেগকে জড়িত করে। আর তা হয় তখন, যখন নিজের আত্মীয় স্বজনের প্রতি মনের টান অনুভব করে না এবং নিজের প্রতিবেশী ও ভাইকে ভুলে যেতে বসে (অথচ কুকুরের প্রতি এক বিন্দু উপেক্ষা সহ্য হয় না)।
মুসলমানের ঘরে কুকুর স্থান পেলে আশংকা হয়, তা খাবার, পাত্র ইত্যাদি চেটে নাপাক করে দিতে পারে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী**********************)
কুকুর কারো পাত্রে মুখ দিলে সেটাতে সাতবার ধুতে হবে- একবার অবশ্যই মাটি দিয়ে মাজতে হবে।
কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ঘরে কুকুর পালা নিষেধ এজন্যে যে, তা অতিথি-আগন্তককে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। ভিখারীকে ভয় পাইয়ে দেয় এবং পথিককে কামড়াতেও কসুর করে না।
নবী করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী**********************)
আমার কাছে হযরত জিবরাঈল (আ) এসে বললেনঃ আমি গত রাতে আপনার কাছে এসেছিলাম; কিন্তু ধরে প্রবেশ করিনি এজন্যে যে, দরজায় একটা প্রতিকৃতি ছিল, ঘরে ছবি সম্বলিত পর্দা ছিল, এ ছাড়া ঘরে কুকুরও ছিল। এক্ষণে আপনি ঘরের প্রতিকৃতিটির মাথাটি কেটে ফেলার আদেশ করুন, তাহলে ওটা গাছের আকৃতি ধারণ করবে, আর পর্দার কাপড়টি কেটে দুটো বালিশ বানাবার হুকুম দিন, যা দিনরাত দলিত হতে থাকবে এবং কুকুরটি বহিষ্কার করে দিন।
এখানে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা এই বিনা প্রয়োজনে রক্ষিত কুকুর সম্পর্কে।
শিকার ও পাহারাদারির জন্যে কুকুর রাখা
যে কুকুর কোন প্রয়োজনে পালা হবে- যেমন শিকারী কুকুর এবং ক্ষেত-খামার বা গৃহপালিত পশুর রক্ষণাবেক্ষণ ও পাহারাদারীর জন্যে পালিত কুকুর- তা এই নিষেধ-নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত নয়। রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবরী***************)
শিকার বা ক্ষেত-খামার, বাড়ি বা পশু পাহারাদারির উদ্দেশ্য ছাড়া যে লোক কুকুর লালন করবে ও রাখবে, প্রতিদিন তার নেক আমল থেকে এক কীরাত পরিমাণ লাঘব হতে থাকবে।
কোন কোন ফিকাহবীদ এই হাদীস থেকে কুকুর রাখা নিষেধ বলে যে মত প্রকাশ করেছেন, তা মাকরূহ মাত্র, হারাম নয়। কেননা কুকুর পালা যদি হারাম হত তাহলে সর্বাবস্থায়ই তা হারাম হতো এবং সব সময়ই তা বর্জন করে চলতে হতো- আমল লাঘব হোক আর না হোক।
ঘর-বাড়িতে কুকুর পালতে যে নিষেধ করা হয়েছে, তার অর্থ এই নয় যে, তার প্রতি নির্মমতা অবলম্বিত হবে কিংবা তাদের নির্মূল করা বা নিধন করার জন্য এই আদেশ নয়। কেনান নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবী********************)
কুকুর যদি আল্লাহর সৃষ্ট একটি প্রজাতি না হতো যেমন আরও অনেক প্রজাতি রয়েছে, তাহলে আমি তা হত্যা করার নির্দেশ দিতাম।
রাসূলে করীম (সা) এ কথাটি দ্বারা উপরিউক্ত গুরুত্বপূর্ণ মতেরই সমর্থন দিয়েছেন। আর প্রকৃত ও বড় সত্য হল, খোদ কুরআন মজীদই এ দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেঃ (আরবী************************)
পৃথিবীতে বিচরণশীল যত জন্তু আছে এবং যত পাখি, তার দুই ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ায়, ওরা সবাই তোমাদের মতো ভিন্ন ভিন্নভাবে সৃষ্ট এক-একটা প্রজাতি। (সুরা আন’আমঃ৩৮)
নবী করীম (সা) তাঁর সাহাবীদের সম্মুখে এক ব্যক্তির কাহিনী বর্ণনা করেছেন। লোকটি মরূভূমির মধ্যে একটি কুকুর দেখতে পেল। কুকুরটি হাপাচ্ছিল ও পিপাসার তাড়নায় মাটি চাটছিল। লোকটি তা দেখে কুপের নিকট গিয়ে বালতি ভরে পানি তুলল ও কুকুরটিকে পানি খাইয়ে পরিতৃপ্ত করে দিল। আল্লাহ তা’আলা তার এই কাজকে কবুল করলেন এবং তার গুনাহ মাফ করে দিলেন।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কুকুর পালন
আমরা এমন ধরনের লোক দেখতে পাই, যারা পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রেমে অন্ধ হয়ে নিজেদের দয়ার্দ্র হৃদয়, উচ্চ মানবতাবাদী ও সর্বজীবে দয়াশীল মনে করে। তারা ইসলামের দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করে এই বলে যে, তাতে এমন বুদ্ধিমান, বন্ধুসুলভ ও বিশ্বস্ত জন্তু থেকে বিরত থাকতে বলা হলো কি করে? এ ধরনের লোকদের গোচরে আমরা এ জার্মান মনীষীর লিখিত ও জার্মানীর এ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রচনা পেশ করতে চাই। এই রচনায় কুকুর পালা কুকুরের সংস্পর্শ গ্রহণের দরুন যে সব বিবাদ অবশ্যম্ভাবী, তা ব্যক্ত করা হয়েছে। রচনাটি এইঃ
বিগত কয়েক বছরে লোকদের কুকুর পালনের আগ্রহ খুব বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে এর পরিণামে কি বিপদ ঘটতে পারে সেদিকে লোকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করা একান্ত ই জরুরী মনে হচ্ছে। বিশেষ করে যখন লোকেরা শুধু কুকুর পালন করেই ক্ষান্ত হয় না, তার সাথে খেলা করে, তাকে চুম্বন করে। উপরন্তু কুকুর এমনভাবে মুক্ত করে দেয়া হয় যে, ছোট বড় সকলেরই হাত চাটে। অনেক সময় উদ্বৃত্ত খাবার নিজেদের পাত্রে বা থালায় করেই কুকুরের সামনে ধরে দেয়া হয়। এছাড়া এ অভ্যাস এতই খারাপ যে, সুস্থ বিবেক ও সরুচি তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয় না। তা পরিচ্ছন্নতার নিয়ম-কানুনেরও পরিপন্থী।
স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিচার করলে কুকুর পালা ও তার সথে হাস্যরসকরণে যে বিপদ মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের ওপর ঘনীভূত হয়ে আসতে পারে, তাকে সামান্য ও নগন্য মনে করা কিছুতেই উচিত হতে পারে না। অনেক লোক নিজের অজ্ঞতার খুব ভারী মাশুল দিতে বাধ্য হয়। তার কারণ এই যে, কুকুরের দেহে এমন এমন জীবানু রয়েছে যা এমন রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা স্থায়ী এবং যা চিকিৎসা করে সারান যায় না। কত লোক যে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন দিতে বাধ্য হয় তা গুণে শেষ করা যায় না।
এ জীবাণুর আকৃতি ফিতার ন্যায়। তা মানবদেহে ফোঁড়া-পাঁচড়ার ন্যায় রোগ সৃষ্টি করে। এ ধরনের জীবাণু গৃহপালিত পশু ও বিশেষ করে শূকরের দেহেও পাওযা যায়; কিন্তু লালিত-পালিত হয়ে বড় হওয়ার গুণ কেবল কুকুর দেহের জীবানূরই রয়েছে।
শকুন ও শৃগালের দেহেও জীবানু থাকে। তবে বিড়ালের দেহে বড় একটা দেখা যায় না। এই জীবাণু অন্যান্য ফিতা-আকৃতির জীবানু থেকে ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। তা এতই সূক্ষ্ম ও সরু হয় যে, দেখাই যায় না। এ সম্পর্কে বিগত কয়েক মাসের মধ্যে কিছু তথ্য জানা গেছে।
প্রবন্ধ রচয়িতা পরে লিখেছেনঃ
এসব জীবানূ মানুষের কলিজায় প্রবেশ করে। আর তথায় নানাভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তা অনেক সময় ফুসফুসে, ডিম্ব, তিল্লি, গুর্দা ও মস্তকের ভিতরে প্রবেশ করে। তখন এগুলোর আকৃতি অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, বিশেষজ্ঞগণও তা ধরতে ও চিনতে অক্ষম হয়ে পড়েন।
সে যাই হোক, এ জীবানুর দরুন যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তা দেহের যে অংশেই হোক না কেন, স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর ও মারাত্মক। এসব জীবাণুর কোন চিকিৎসা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি। এ করনে চিকিৎসা-অযোগ্য রোগের মুকাবিলা করার জন্যে আমাদের পূর্ণ শক্তিতে চেষ্টা করতে হবে। এ বিপদ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে।
জার্মান চিকিৎসাবিদ নুললর বলেছেন , কুকুরের জীবণুর দরুন মানব দেহে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তার সংখ্যা শতকরা এক-এর কম নয় কিছুতেই। আর কোন কোন দেশে শতকরা বারো পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ রোগের প্রতিরোধ করার সর্বোত্তম প্রন্থা হচ্ছে, এ জীবনুগুলোকে কুকুর দেহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ করে রাখা, তাকে ছড়িয়ে পড়তে না দেয়া।…..
মানুষ যদি নিজের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে ও জীবন বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে কুকুরের সঙ্গে গলাগলি ও চুমাচুমি করা পরিহার করতে হবে। তাকে নিকটে ঘেষতে দেয়া যাবে না, বাচ্চাদের তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। কুকুরকে তখন নিজেদের হাত চাটতে দেয়া উচিত হবে না। বাচ্চাদের খেলা, বেড়ান ও আনন্দ স্ফূর্তি করার স্থানে কুকুরকে থাকতে দেয়া ও তথায় ময়লা ছড়াবার সুযোগ দেয়া চলবে না। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, ছেলে মেয়েদের খেলার জায়গাতেই খুব বেশি সংখ্যক কুকুর থাকতে দেখা যায়।
কুকুরের খাবার পাত্র সম্পর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হওয়া আবশ্যক। মানুষ নিজেদের খাবারের জন্যে যেসব পাত্র ব্যবহার করে, সেসব কুকুরকে চাটবার জন্যে দেয়া খুবই অনুচিত। সেগুলোকে হাটে-বাজারে ও হোটেলে-রান্নাঘরে প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয়। মোটকথা, কুকুরের ব্যাপারে সতর্কতাবলম্বন করে পানাহারের সব কিছু থেকে ওদের সরিয়ে রাখতে হবে।
একজন বিধর্মী চিন্তাবিদের এ চিন্তামূলক বর্ণনা সম্মুখে রেখে বিবেচনা করে দেখা আবশ্যক যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা) যে কুকুরের সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করতে নিষেধ করেছেন, তা কতখানি বাস্তব ভিত্তিক এবং একান্তই বিজ্ঞানসম্মত। পানাহার সংক্রন্ত পাত্রগুলোতে কুকুর যাতে মুখ লাগাতে না পারে, সেজন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনেরও নির্দেশ দিয়েছেন। উপরন্তু বিনা প্রয়োজনে কুকুর পালতেও নিষেধ করেছেন। উপরিউক্ত বিবরণের আলোকে চিন্তা করলে রাসূলে করীম (সা) এর দেয়া বিধানে বিশ্বমানবতার জন্যে যে কি বিরাট কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা সুস্পষ্ট অনুধাবন করা যায়।
বস্তুত নবী করীম (সা) ছিলেন একজন উম্মী। কিন্তু তা সত্ত্বে তাঁর উপস্থাপিত শিক্ষা এ কালের- এ চৌদ্দশত বছর পরে অতি আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যের সাথে যে কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ তা দেখলেই বিস্ময়াভিভূত হতে হয়। এ সত্য দেখার সাথে সাথে আমাদের কণ্ঠে স্বতঃ স্ফূর্তভাবে কুরআন মজীদের এ ঘোষণা ধ্বনিত হয়ে উঠেঃ (আরবী***************)
নবী নিজের ইচ্ছামত কিছুই বলেন না, যা বলেন তা ওহী ভিন্ন আর কিছু নয়।