ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও তার বাস্তবায়ন
(লাহোরে বরকত আলী মোহামেডান হলে ছাত্রদের এক সমাবেশে ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর প্রদত্ত ভাষণ। ভাষণের অংশবিশেষ অনিবার্য কারণে সামান্য রদবদল করে অনুবাদ করা হলো-অনুবাদক)।
দেশে কি ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত সে প্রশ্ন একটা মুসলিম দেশের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অবাস্তব। এটা অবিসংবাদিত ব্যাপার যে, একটা মুসলিম দেশে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাই চালু হওয়া উচিথ। তবে কিভাবে ও কি পন্থায় ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা যায় বা কি পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী রূপ দেয়া যায়, কেবলমাত্র সেই বিষয় নিয়েই চিন্তাভাবনা করা দরকার।
এ প্রসঙ্গে সর্বাগ্রে আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যূতিগুলো বুঝতে হবে। বর্তমানে দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে তার দোষ ত্রুটি না জানা পর্যন্ত কিভাবে তার সংস্কার ও সংশোধন করা যেতে পারে, সেটা জানা সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে বর্তমানে দু’ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। একটা শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের প্রাচীন পদ্ধতির মাদ্রাসাগুলোতে। সে শিক্ষা আমাদের ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য আলেম তৈরী করে। আর দ্বিতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু রয়েছে, এটা ধর্মীয় পরিমন্ডলের বাইরে গোটা দেশ ও সমাজ পরিচালনার জন্য কর্মী তৈরী করে। আমি এই উভয় শিক্ষাব্যবস্থার দোষ ত্রুটি বিশ্লেষণ করতে চাই।
প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাঃ
আমাদের দেশে প্রচলিত প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা আজ থেকে কয়েখ শতাব্দী আগে প্রবর্তিত হয়। যখন এখানে বৃটিশ সরকার আসে এবং একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের পর আমরা তাদের গোলামে পরিণত হই। তখন যে শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের চালু ছিল সেটা আমাদের তৎকালীন প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট ছিল। সেই শিক্ষাব্যবস্থায় তৎকালীন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দরকারী সকল বিষয় পড়ানো হতো। এতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই ছিল না, বরং দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, সাহিত্য এবং অন্যান্য বিষয়ও ছিল। সে সময়কার সিভিল সার্ভিসের জন্য যে ধরনের বিদ্যা বুদ্ধির প্রয়োজন ছিল তা সবই পড়ানো হতো। কিন্তু যখন একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের কারণে আমরা গোলামে পরিণত হলাম তখন সেই গোটা শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেল। সেই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত লোকদের জন্য নতুন যুগের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন স্থানই থাকলো না। নয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য যে ধরনের বিদ্যা জানা দরকার ছিল, তা ঐ শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তুর্ভুক্ত ছিল না। আর ঐ শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধরনের বিদ্যা অন্তর্ভুক্ত ছিল, এই নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেসব বিদ্যা জানার কোন প্রয়োজন লোকদের ছিল না। তা সত্ত্বেও যেহেতু আমাদের শত শত বছরের জাতীয় উত্তরাধিকার ঐ শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং আমাদের ধর্মীয় চাহিদা ও প্রয়োজন মেটানোর জন্য কিছু উপকরণও তাতে ছিল (যদিও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না) তাই তৎকালে আমাদের জাতির একটা বিরাট অংশ অনুভব করল যে, ঐ শিক্ষাব্যবস্থাকে যে করেই হোক বহাল রাখতে হবে, যাতে আমরা পৈত্রিক উত্তরাধিকারের সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন না হয়ে যাই।
এ উদ্দেশ্যেই তারা এটাকে হুবহু রাখলো। কিন্তু ক্রমান্বয়ে অবস্থায় যতই পরিবর্তন ঘটতে লাগলো ততই তার কার্যকরিতা কমতে লাগলো। কেননা ঐ শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে যারা শিক্ষা লাভ করে বের হলো সমকালীন জীবন ধারা ও তার সমস্যাবলীর সাথে তাদের কোন সংশ্রব থাকলো না। আজ যারা ঐ শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে লেখাপড়া করে বের হচ্ছে তাদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে মসজিদে ইমামতি, মাদরাসায় শিক্ষকতা এবং জনগণকে নিজেদের প্রয়োজন উপলব্ধি করানোর জন্য নিত্য নতুন ধর্মীয় বিতর্ক তোলা। তাদের দ্বারা কিছু না কিছু উপকার আমাদের নিশ্চয়ই হয়ে থাকে। তাদের চেষ্টাতেই কুরআন ও ধর্ম সংক্রান্ত কিছু না কিছু জ্ঞান সমাজে বিস্তার লাভ করে। কিছুটা ধর্মীয় জ্ঞান ও সচেতনতা সমাজে বহাল থাকে। কিন্তু এটুকু উপকারের বিনিময়ে মুসলিম সমাজের যে ক্ষতি তাদের ধর্মীয় বিতর্কের কারণে হচ্ছে, সেটা কোন অংশে কম নয়। তারা যেমন ইসলামের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না, তেমনি বর্তমান জীবন সমস্যার উপর ইসলামের মূলনীতিগুলো প্রয়োগ করতেও সক্ষম নন। এখন তাদের মধ্যে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতাও নেই, আবার আমাদের জাতীয় সমস্যাবলীর কোন সমাধানও তারা দিতে সক্ষম নন। মোটের ওপর একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, তাদের কারণে ইসলামের সম্মান আদৌ বাড়ছে না, বরং আরো কমছে। তাদের দ্বারা ইসলামের যে ধরনের প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে তার কারণে আমরা জনগণকে ক্রমান্বয়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যেতে দেখছি এবং ইসলামের মর্যাদাও দিন দিন ক্ষুণ্ন হয়ে চলেছে। তাদের কারণে ধর্মীয় বিতর্কের এক নিরবিচ্ছিন্ন ধারা চালু হয়েছে। এ ধারার যেন আর শেষ নেই। কারণ জীবন জীবিকার প্রয়োজন তাদেরকে এসব বিতর্ক চালু রাখতে ও ক্রমে বাড়িয়ে তুলতে বাধ্য করে থাকে। এসব বিতর্ক যদি না থাকে তবে জাতি তাদের প্রয়োজনই অনুভব করবে না।
এই হলো আমাদের প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার হাল হাকিকত। আর স্পষ্ট করে বলতে গেলে আমি বলবো এটা পুরোপুরি ধর্মীয় শিক্ষা নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা আজ হতে আরো দুই আড়াইশো বছর আগেরকার সিভিল সার্ভিসের কোর্স হিসেবে চালু করা হয়েছিল। সে সময় ইসলামী ফিকহই ছিল দেশের কার্যকরী আইন এবং তার নির্বাহীদের জন্য ইসলামী ফিকহও তার উৎসসমূহ জানা অপরিহার্য ছিল। প্রধানত এ কারণেই এর সাথে এগুলো জুড়ে দেয়া হয়েছিল। আজ আমরা ওটাকে ধর্মীয় শিক্ষা হিসেবে মেনে নিয়ে তৃপ্তি বোধ করছি। কিন্তু এতে ধর্মীয় শিক্ষার উপাদান নিতান্তই কম। কোন আরবি মাদরাসাই এমন নেই যার পাঠ্যসূচীতে পুরো কুরআন মজীদ অন্তর্ভুক্ত আছে। এতে শুধু কয়েকটি সূরা মাত্র পড়ানো হয়। কোথাও পাঠ্যসূচীতে গোটা কুরআন মজীদ থাকলে শুধু তার অনুবাদই পড়ানো হয়। গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গীতে কুরআন মজীদ পড়ানোর পাঠ্যসূচী কোন মাদরাসাতেই নেই। হাদীসের অবস্থাও তথৈবচ। এরও যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা-যা কিনা মুহাদ্দিস হবার জন্য প্রয়োজন – কোথাও চালু নেই। হাদীস শিক্ষার যে পদ্ধতি আমাদের এসব মাদরাসায় চালু আছে তা হলো ফিকাহ কিংবা আকীদার সাথে সম্পৃক্ত কোন হাদীস পাওয়া গেলে তা নিয়ে একনাগাড়ে দুই তিন দিন ধরে বক্তৃতা দেওয়া হয়। কিন্তু যেসব হাদীস হতে দ্বীনের তাৎপর্য বুঝা যায় অথবা যেসব হাদীসে ইসলামের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা নৈতিক বিধান বর্ণিত হয়েছে, যাতে শাসনতান্ত্রিক বিষয়, বিচার ব্যবস্থা কিংবা আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে আলোকপাত করে, সেসব হাদীস এমনভাবে পড়ানো হয় যেন তাতে প্রয়োজনীয় কোন কথাই নেই। তারা এত দ্রুততার সাথে ঐ সব হাদীস অতিক্রম করে যান যে তাতে মনোযোগ দেয়ার মত কিছু আছে বলেই যেন তারা মনে করেন না। হাদীস ও কুরআনের তুলনায় ফিকাহ শাস্ত্রের দিকেই তাদের নজর বেশী। তাও বেশীরভাগ, বরং বলতে গেলে পুরোপুরিই ফিকাহ শাস্ত্রের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন। ফিকাহর ইতিহাস, তার ক্রমবিকাশ, তার বিভিন্ন মাযহাবের মৌল বৈশিষ্ট্য, এসব মাযহাবের সর্বসম্মত ও বিরোধীয় মূলনীতিসমূহ, মূলনীতির আলোকে প্রয়োজনীয় বিধি রচনায় মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসৃত নীতিমালা ইত্যাদি যা না জানলে সত্যিকার ফকীহ হওয়াই যায় না, এসব বিষয় মাদরাসার শিক্ষায় আদৌ বর্তমান নেই। ছাত্র তো দূরের কথা শিক্ষকরাও এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন।
সুতরাং যে ধর্মীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছিল, সে লক্ষ্য অর্জনেও তারা যথেষ্ট নয়। আর পার্থিব প্রয়োজনেরতো কথাই ওঠে না। কারণ তার সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাঃ
এরপর বিবেচনা করা যাক বৃটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার কথা। দুনিয়ায় যে শিক্ষাব্যবস্থাই চালু করা হোক, তার শুরুতেই এই মৌলিক প্রশ্নটি বিবেচনা করতে হয় যে, কি ধরনের মানুষ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এবং কোন মাপকাঠি অনুসারে মানুষ তৈরী করার উদ্দেশ্যে শিক্ষাব্যবস্থাটি প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে। এই মৌলিক প্রশ্নের আলোকে যদি বিচার বিবেচনা করা হয় তাহলে পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, মনুষ্যত্বের যে মাপকাঠি মুসলমানদের বেলায় প্রযোজ্য ও গ্রহণযোগ্য ব্রিটিশ সে মাপকাঠীতে বিশ্বাসী ছিল না। মুসলমানদের কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার ও তার উৎকর্ষ সাধনের জন্য কর্মী তৈরী করার উদ্দেশ্যে বৃটিশ এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে নি এবং তা করতেও পারে না। এমনকি তাদের মনুষ্যত্বের যে মাপকাঠিতে তারা বিশ্বাসী, সেটাও এখানে তাদের অভিপ্রেত ছিল না।
তারা নিজ দেশে নিজ জাতির জন্য যে উদ্দেশ্যে মানুষ তৈরী করে থাকে এখানে তারা সে উদ্দেশ্যে মানুষ গড়তে ইচ্ছুক ছিল না। একটা স্বাধীন দেশ চালাবার উপযুক্ত লোক তারা এখানে তৈরীই করতে চায় নি। সে ধরনের লোক তারা তাদের নিজ দেশেই কামনা করতো এ দেশে নয়। এদেশে তারা এমন লোক প্রত্যাশা করতো যারা একটি বিদেশী শাসকগোষ্ঠীকে সরকার চালাবার কাজে সাহায্য করতে পারে, যারা তাদের ভাষা জানে, যাদের সাথে তারা যোগাযোগ করতে জানে ও যেমন খুশী কাজ করতে পারে। তাদের দেশ শাসনের নীতি জানে ও বুঝে এবং তাদের উপযোগী হতে পারে, এমন লোকই তাদের প্রয়োজন ছিল। বস্তুত এটাই তাদের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়। এ জন্যই তারা এখানে এ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল।
খোদাহীন শিক্ষাঃ
এ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা যত জ্ঞান বিজ্ঞান শিখিয়েছে তার মধ্যে ইসলামের নামগন্ধও ছিল না এবং থাকার কথাও নয়। খোদ ইউরোপে ঐসব জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ যাদের হাতে রয়েছে তারা ছিল খোদাবিমুখ। সেখানকার ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আগেই চিন্তা ও কার্যক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত ও বিতাড়িত করা হয়েছিল। এ জন্য কি বিজ্ঞান, কি দর্শন, কি ইতিহাস, কি সমাজবিজ্ঞান সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানই এমন সব লোকদের হাতে রচিত ও বিকশিত হয়েছে যারা পুরোপুরি নাস্তিক না হলেও অন্তত পার্থিব জীবনে তারা আল্লাহর আনুগত্যের কোন প্রয়োজন অনুভব করতো না। বৃটিশ শাসকরা তাদের সেইসব জ্ঞান বিজ্ঞান তাদের প্রণীত বই পুস্তকসহ আমাদের দেশে চালু করে এবং আজ পর্যন্ত এখানে ঐসব জিনিসই তাদের অনুসৃত পদ্ধতিতে পড়ানো হচ্ছে। এ শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে যারা শিক্ষা লাভ করেছেন তাদের মন মগজ আপনা আপনি ইসলাম থেকে, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এবং ইসলামী নৈতিকতা ও চিন্তাধারা হতে ক্রমেই দূরে সরে গিয়েছে। এতে তাদের কোনও অপরাধও নেই এবং তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছারও কোন হাত ছিল না। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে ব্যক্তি তার শিক্ষার সূচনা বিন্দু থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পৃথিবী সম্পর্কে যত জ্ঞান লাভ করলো কোনটাই খোদার আনুগত্যের দৃষ্টিকোণ হতে শিখলো না, তার মন মগজে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস কিভাবে শিকড় গজাতে পারে? তার পাঠ্যপুস্তকে কোথাও আল্লাহর উল্লেখ নেই। তার ইতিহাস পুস্তকে সমগ্র জীবনকালব্যাপী মানুষকে নিজের ভাগ্য নিজেই ভাঙতে ও গড়তে দেখলো, তার দর্শন শিক্ষায় স্রষ্টাকে বাদ দিয়েই বিশ্ব জগত সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করা হলো। তার বিজ্ঞান শিক্ষায় সমগ্র বিশ্ব কারখানাকে কোন প্রজ্ঞ্য নির্মাতা এবং কুশলী ব্যবস্থাপক ও পরিচালক ছাড়াই পরিচালিত বলে দেখানো হলো। আর আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও অন্যান্য বিদ্যার পাঠ্যক্রমে মানুষের স্রষ্টা তার জন্য কি আইন বিধান দেন সে সম্পর্কে আদৌ কোন কথাই শেখানো হলো না। বরং তার সমস্ত বিদ্যার মূল কথা দাঁড়ালো এই যে, মানুষ নিজেই নিজের জীবন ব্যবস্থা রচনা করার অধিকারী। এ ধরনের শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কখনো বলার দরকার হয় না যে, তুমি আল্লাহকে অমান্য কর। সে আপনা আপনিই আল্লাহ সম্পর্কে বেপরোয়া হয়ে যাবে। আল্লাহকে নিয়ে তার মনে কোন রকম ভাবনা চিন্তার সৃষ্টি হবে না এটাই স্বাভাবিক।
নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষাঃ
এ শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যের ধারণা এবং ইসলামী নৈতিকতার সৃষ্টিতো হয়ই না, উপরন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, এ শিক্ষা তরুণ সমাজের মাঝে মৌলিক মানবীয় গুণাবলী পর্যন্ত তৈরী করে না। অথচ এই মৌলিক মানবীয় চরিত্র ছাড়া কোন জাতি দুনিয়ায় উন্নতি করা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকতেও পারে না। এ শিক্ষা নিয়ে যে বংশধারা গড়ে উঠেছে, তারা পাশ্চাত্য জাতিগুলোর যাবতীয় খারাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পুরোপুরিভাবে সজ্জিত হচ্ছে। কিন্তু তাদের উত্তম গুণাবলীর ছিটেফোঁটাও তাদের গায়ে লাগছে না। তাদের মধ্যে দায়িত্ব জ্ঞান, সার্বক্ষণিক সতর্কতা, কষ্টসহিষ্ঞুতা, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, দৃঢ়তা, ধৈর্য ও দৃঢ়সংকল্প, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, আত্মসংযম, উচ্চতর ব্যক্তিত্ব বা আদর্শের আনুগত্য ইত্যাকার গুণ সৃষ্টি হয় না। তারা একেবারেই ভুঁইফোড় উদ্ভিদের মত। দেখে মনেই হয় না যে তাদের কোন জাতীয় চরিত্র আছে। যত মর্যাদাপূর্ণ পদেই তারা আসীন হোক, হীন হতে হীনতর এবং নিকৃষ্ট হতে নিকৃষ্টতর দুর্নীতি ও দুষ্কর্মে লিপ্ত হতে তারা কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করে না। তাদের মধ্যে জঘন্যতম ঘুষখোর, স্বজনপ্রীতি, সুপারিশকারী ও সুপারিশ পূরণকারী, চোরাকারবারী, অবৈধ চোরাচালানী, ন্যায়-নীতি আইন কানুন ও নিয়মনীতি লংঘনকারী, কর্তব্যে অবহেলা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, মানুষের হক নষ্টকারী এবং নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে সমগ্র জাতির স্বার্থ ও কল্যাণের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাতকারী লোক একজন দুজন নয় জীবনের প্রতিটি বিভাগ ও অংগনে রয়েছে। তারা সর্বক্ষেত্রে খুব তৎপর। বৃটিশ শাসকরা বিদায় নেয়ার পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত লোকেরাই আগলে রেখেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এই চরিত্র বিবর্জিত লোকদের হাতে দেশের যে কি দশা হয়েছে তা আজ সবাই দেখতে পাচ্ছেন। যে নব বংশধর আজ এই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেছে তাদের স্বভাব চরিত্র ও আচার আচরণের কথা যদি জানতে চান তবে যে কোন সময় হোটেলে, প্রমোদ কেন্দ্রে ও জাতীয় উৎসব অনুষ্ঠানাদির সময়, অলিতে গলিতে প্রকাশ্যেই দেখতে পারেন।
প্রশ্ন জাগে যে, এই শিক্ষায় আল্লাহর আনুগত্য ও ইসলামী চরিত্র তৈরী না হোক কিন্তু যে চরিত্র বৃটিশ, জার্মান, আমেরিকান ও অন্যান্য উন্নত পাশ্চাত্য জাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ততটুকু চরিত্রও কেন গড়ে উঠে না? তাদের মধ্যে মৌলিক মানবীয় চরিত্রটা অবশ্যই পূর্ণমাত্রায় পাওয়া যায়। অথচ আমাদের এখানে তাও নেই। তাহলে এর কারণটা কি?
আমার মতে এর কারণ হলো, মৌলিক মানবীয় চরিত্র গঠন করার পরিকল্পনা একমাত্র এমন শিক্ষাব্যবস্থাই করতে পারে যে শিক্ষাব্যবস্থা কোন স্বাধীন জাতি নিজেদের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রবর্তন করে। একটা স্বাধীন জাতিকে আপন সভ্যতা সংস্কৃতির স্থায়িত্ব ও বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত দৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য চরিত্রের কর্মী তৈরী করার কথা অবশ্যই ভাবতে হয়। বৃটিশ জাতির এরূপ চরিত্রের লোকের প্রয়োজন ছিল তাদের নিজেদের দেশে, এদেশে নয়। এদেশে বরং ইংল্যান্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত গোলামীর মন মানসিকতাই তৈরী করা তাদের অভিপ্রেত ছিল। এখানে তারা চেয়েছিল গোলামসুলভ চরিত্র সৃষ্টি করতে, এমন চরিত্রের লোক সৃষ্টি করতে যারা নিজেদের হাতে নিজেদের দেশ জয় করে তা আপন জাতির শত্রুদের হাতে সমর্পণ করতে পারে এবং তার পরে নিজেদের দেশের প্রশাসন নিজেদের কল্যাণার্থে নয়; অন্যদের সুবিধার্থে চালাতে পারে। এ কাজের জন্য যে ধরনের চরিত্র দরকার বৃটিশ শাসকরা ঠিক সেই ধরনের চরিত্রই এখানে গঠন করতে চেয়েছিল এবং সেই চরিত্র গঠনের জন্যই তারা এখানকার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল। তাদের প্রণীত সেই শিক্ষানীতিই আজ পর্যন্ত হুবহু চলে আসছে। এ শিক্ষানীতি দ্বারা কেউ যদি একটা স্বাধীন দেশের উপযোগী দৃঢ় চরিত্রের লোক তৈরী হওয়ার আশা করে থাকে তবে প্রথমে তার নিজের বিবেক বুদ্ধি ঠিক আছে কি না ভেবে দেখা দরকার।
আধুনিক শিক্ষার সাথে ধর্মীয় শিক্ষার লেজুড়ঃ
উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর যখন এই শিক্ষাব্যবস্থা এখানে চালু হলো এবং সেই সাথে এই শিক্ষা যারা গ্রহণ করবে না তাদের জন্য উন্নতি ও সুখ সমৃদ্ধির সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেল, তখন আমাদের সমাজের চিন্তাশীল জ্ঞানী লোকেরা এই ভেবে শংকিত হয়ে উঠলেন যেন আমাদের নবীন বংশধরদেরকে এই শিক্ষাব্যবস্থা হয়তো একেবারেই অমুসলমান বানিয়ে ছাড়বে। এজন্য তারা এই শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনেই নিজস্ব উদ্যোগে মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংকল্প গ্রহণ করলেন। পরিকল্পনা নেয়া হলো, সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যা পড়ানো হয় এসব প্রতিষ্ঠানেও তাই পড়ানো হবে। ইংরেজরা তাদেরকে যে কাজের জন্য তৈরী করতে চায় সে উদ্দেশ্যেই তাদেরকে ট্রেনিং ইত্যাদি দেয়া হবে। তবে এর সাথে কিছু ধর্মীয় শিক্ষাও যুক্ত হবে যেন ছাত্ররা একেবারেই কাফির হয়ে না যায়। এটা ছিল একটা সংস্কারমূলক পরিকল্পনা। মনে করা হচ্ছিল যে, এভাবে এইসব প্রতিষ্ঠানে যেসব মুসলিম তরুণরা পড়তে আসবে তাদেরকে ইংরেজি শিক্ষার সম্ভাব্য কুফল হতে কিছুটা রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণ হলো এবং বিচার বিবেচনা করলেও বুঝা যায় , এ ধরনের কলম লাগানোর চেষ্টা (গাছের ক্ষেত্রে সফল হলেও মানুষে ক্ষেত্রে) সফল হওয়ার নয়। জোড়াতালি দিয়ে মানুষ গড়ার এ উদ্ভট চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে গেল। বলা বাহুল্য স্বাভাবিক নিয়মেই এ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কথা।
এদিকে একজন ছাত্রকে যাবতীয় দুনিয়াদারী জ্ঞান বিজ্ঞান এমনভাবে শেখানো হচ্ছে যে, সে গোটা প্রকৃতির কারখানা খোদা ছাড়াই তৈরী করেছে এবং খোদা ছাড়াই সফলভাবে চলছে বলে অনুভব করে। যে জ্ঞান সে লাভ করে তার কোথাও সে অনুভব করতে পারে না যে, এই বিশাল দুনিয়া ও এ বিরাট কর্মক্ষেত্রের কোথাও আল্লাহর রসূল ও অহীর কোন স্থান বা প্রয়োজন থাকতে পারে। সব রকমের জীবন ব্যবস্থাকে সে এই দৃষ্টিভঙ্গীতেই দেখতে শেখে। এরপর হঠাৎ তাকে ধর্মীয় শিক্ষার শ্রেণীতে নিয়ে বলা হয় যে, আল্লাহও আছেন, রাসূলও আছেন এবং অহীও আসে আর কিতাবও নাজিল হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন ভেবে দেখুন, বিশ্বজগৎ ও জীবন সম্পর্কে তার যে সামগ্রিক ধারণাটা জন্মেছে, তা থেকে তাকে আলাদা ও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র এই জ্ঞানটা যে তাকে দেয়া হলো, একে সে অর্জিত সামগ্রিক জ্ঞান ও ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাসের সাথে কিভাবে খাপ খাওয়াবে এবং এটাকে সে কোথায় রাখবে? জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাকে তো খোদাহীন জ্ঞান দেয়া আছেই এবং দেয়া চলছেও। তার সাথে আলাদা করে ধর্মীয় শিক্ষার একটা পুঁটলিও দিয়ে দেয়া হলো। এখন এই পুটলি খুলে সে রোজ রোজ অন্যান্য জ্ঞানের সাথে এই ধর্মীয় জ্ঞান একটু একটু করে মিকচার করতে থাকবে এবং তাতে আপনা থেকেই তার মনে একটা ভিন্নতর ধারণা বিশ্বাস অর্থাৎ খোদায়ী ব্যবস্থাপনার ধারণা গজিয়ে উঠবে। এটা কি আশা করা যেতে পারে?
এর চেয়েও পরিতাপের ব্যাপার এই যে, মুসলিম জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে তাতেও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মতই ধর্মহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ছাত্র ইংরেজীতে কথা বলুক ও ইংরেজীতে পোশাক পরিধান করুক এ চেষ্টাতো করা হয়েছেই। এমনকি ইংরেজদের কৃষ্টি, তাদের চাল চলন ও আচরণ সম্পূর্ণরূপেই ছাত্রদেরকে রপ্ত করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। খেলাধুলায়, উঠাবসায়, চালচলনে, বিতর্ক বক্তৃতায় মোট কথা সব কিছুতেই বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোন অংশেই সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে পিছিয়ে না থাকে তার চেষ্টা করা হয়েছে। অবিকল সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমমানের লোক এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও বের হোক এবং কেউ যেন বলতে না পারে যে, ইংরেজী মানদন্ডের বিচারে এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া ছাত্ররা সরকারী প্রতিষ্ঠান হতে বের হওয়া ছাত্রদের চেয়ে নিম্নমানের। এ জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মুসলিম জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার কর্ণধারদের শিক্ষার উদ্দেশ্যই যখন এই এবং এর খাতিরে সম্পূর্ণ ফিরিঙ্গিপনার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে তখন এ ধরনের পরিবেশে ইসলামের ঐ কলম লাগানো পরগাছা চারাটা কি উপকার দর্শাতে পারে? একে তো শিক্ষাগত দিক থেকে ওটা ছিল নিতান্তই দুর্বল। অন্য কোন পাঠ্যসূচীর সাথে তার কোন সংশ্রব ও সামঞ্জস্য ছিল না। যতগুলো যুক্তি প্রমাণ আল্লাহর আনুগত্য সৃষ্টির সহায়ক হতো তা সবই খোদাহীনতা ও খোদাবিরোধী মনোভাব সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। অধিকন্তু বেসরকারী কলেজগুলোতেও সরকারী কলেজের অনুরূপ জীবন যাপনের পরিবেশ এবং বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ গোটা ব্যবস্থা এমন করে তৈরী করা হয়েছে যে, তা ইসলামের দুর্বল জোড়াতালির সহায়ক হওয়ার পরিবর্তে ফিরিঙ্গিপনা ও নাস্তিকতারই উপযোগী ও অনুকূল হয়েছে। এই জোড়াতালিকে শক্তিশালী করার মত কোন একটা উপকরণও সেখানে ছিল না। বরং সব কিছুই তার প্রকৃতির বিরোধী ছিল। এতসব প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেও আমাদের শিক্ষা কর্ণধাররা অলৌকিকভাবে ধর্মীয় জাগরণ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি, ইসলামী মূল্যবোধের উদ্ভব ও ইসলামী প্রেরণার বিকাশ ও ইসলামী চরিত্র গঠনের আশায় বিভোর ছিলেন। অথচ প্রাকৃতিক বিধান মতে এর যে অনিবার্য ফল দেখা দেয়ার কথা ছিল এবং বাস্তবে দেখা দিয়েছে, তা হলো, যেসব ছাত্রকে এই প্রণালীতে ইসলামী শিক্ষা দেয়া হয়েছে তাদের দৃষ্টিতে ইসলামের গুরুত্ব ও মর্যাদা আরো কমে গিয়েছে, তাদের ধর্মীয় অবস্থা মিশনারী কলেজ ও সরকারী কলেজের ছাত্রদের চেয়েও খারাপ হয়ে গিয়েছে। এটা তো বাস্তব সত্য যে, আজকাল কলেজগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার ঘন্টাটা সাধারণভাবে আমোদ প্রমোদ ও তামাসা উপহাসের ঘন্টা বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এর দ্বারা অন্তরে ঈমানী তেজ সৃষ্টি হওয়ার পরিবর্তে যেটুকু ঈমান ছিল তাও নিঃশেষ করার মত খেদমত হচ্ছে। নিজেরাই যখন তাদের সামনে ইসলামকে অন্যান্য পাঠ্য বিষয়ের চেয়ে নগন্য করে পেশ করছি তখন আল্লাহর তরফ থেকে কমপক্ষে এতটুকু শাস্তি না হয়ে পারে না যে, আমাদের ছেলেরা আমাদের চোখের সামনেই নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহী হয়ে আবির্ভৃত হবে এবং যেসব শিক্ষক খোদা, রাসূল ও আখিরাতে বিশ্বাসী তাদেরকে বেওকুফ ও নির্বোধ মনে করবে।
সংস্কার সাধনের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাঃ
আজ থেকে ১৭-১৮ বছর আগে (বক্তৃতাকাল ১৯৫২) এই কুফল অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছিল। আমার মনে পড়ে, ১৯৩৪ হতে ৩৫ সালে একবার হঠাৎ চাঞ্চল্যকর একটা প্রশ্ন উঠলো যে, আমাদের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে এত অধিক পরিমাণে ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক্যবাদের প্রচারক বের হচ্ছে কেন? বিশেষ করে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এই প্রশ্ন ছিল আরো তীব্র। সাধারণ ধারণা মতে সেখানে শতকরা নব্বই জন ছাত্র খোদাদ্রোহিতা ও নাস্তিকতায় বিশ্বাসী ছিল। বিষয়টি যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগলো এবং সারা দেশে এ সম্পর্কে লেখালেখি শুরু হলো, তখন একটা কমিটি গঠন করা হলো, ঐ কমিটি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলো। অবশেষে ধারণা করা হলো যে, ইসলামী শিক্ষার পরিমাণ আর একটু বাড়িয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ঐ কমিটি কিছু সংশোধনী প্রস্তাব দিল এবং একটা নতুন পাঠক্রম প্রণয়ন করা হলো। কিন্তু সে সংশোধন কিছু মাত্র লাভজনক হলো না। ফলে আজও অবস্থা অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে।
আমি তখনই অনুমান করেছিলাম এবং মাসিক তরজমানুল কুরআনে লিখেওছিলাম যে, এসব পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হবে না। আজ আমি এ প্রসঙ্গ আবারও তুলছি এজন্য যে, আমাদের যেসব কর্তাব্যক্তিদের হাতে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করার ক্ষমতা তারা যথাসাধ্য আমাদেরকে ইসলামী শিক্ষা কায়েমের সুসংবাদ দিয়ে থাকেন। অথচ তারা পুনরায় একই ভুল করতে চলেছেন। তারাও বৃটিশ আমল থেকে চালু থাকা শিক্ষা ব্যবস্থাকে হুবহু বহাল রেখে তার আওতাধীন ইসলামী শিক্ষার আনুপাতিক পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে দিতে চান। তাদের চিন্তা ভাবনায় এর চেয়ে বেশি কিছু নেই। এ জন্য যে কথা আমি তখন বলেছিলাম আজ আবার তার পুণরাবৃত্তি করছি।
আমার মতে একটা শিক্ষাব্যবস্থায় পরস্পর বিরোধী দুটি উপাদান অন্তর্ভুক্ত করার চেয়ে মারাত্মক ভুল কাজ আর কিছু হতে পারে না। আর তাও এমন দুটো উপাদান যা পরস্পর সাংঘর্ষিক এবং একটি আরেকটির নাসিকায় ঘুষি বর্ষণকারী। এ ধরনের মিশ্রণ শিক্ষার্থীর মন মগজকে নষ্ট করা ছাড়া আর কোন ফল দর্শাতে পারে না।
ধরে নেয়া যাক, এই ভেজাল এমনভাবে করা হলো যে, এতে ইসলামী শিক্ষার উপকরণ শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাড়িয়ে দেয়া হলো। বাকী পঞ্চাশ ভাগ ইংরেজরা যেভাবে তৈরী করে গিয়েছে ঠিক তেমনি থাকলো। তাহলেও এর অনিবার্য ফল দাঁড়াবে এই যে, প্রত্যেক ছাত্রের মন-মগজ এক একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে। শুধুমাত্র মন-মগজ কেন, তাদের গোটা জীবনই হয়ে দাঁড়াবে রণক্ষেত্র। আর এই ইসলামী পুঁথিগত শিক্ষার পরিমাণ ৫০ ভাগ করে দেয়ার পরও শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষাঙ্গনের গোটা জীবনধারা যদি ইংরেজদের আমলের মত ফিরিঙ্গী ধাঁচেরই থেকে যায় এবং দেশের শাসন ব্যবস্থাও ইংরেজদের ভিত্তির উপরই যথারীতি বহাল থাকে তাহলে এর অনিবার্য পরিণতি দাঁড়াবে এই যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তিন ধরনের লোক বের হবে। প্রথম শ্রেণী হবে ইসলামী শিক্ষা পাওয়া সত্ত্বেও নাস্তিক ও ইসলামবিরোধী। কেননা শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম বিরোধী যে অংশটি রয়েছে, তার পৃষ্ঠপোষকতায় থাকবে কলেজের সার্বিক পরিবেশ। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক আনুকূল্য এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক পরিবেশ হবে তাদের পুরো অনুকূলে। দ্বিতীয় শ্রেণীটা হবে ইসলামী শিক্ষার প্রভাবাধীন। তারা ইসলাম প্রিয় ও ধর্মপরায়ণ হবে। আর তৃতীয় গোষ্ঠী হবে আংশিক মুসলমান ও আংশিক অমুসলমান। ইসলাম ও কুফরীর মধ্যে তারা দ্বিধান্বিত হয়ে ঝুলতে থাকবে।
ভেজাল মিশ্রিত ব্যবস্থার এ পরিণতি অনিবার্য্। পরীক্ষা করলেই দেখতে পারেন যে, জাতির মধ্যে সত্য সত্যেই এই তিন রকমের লোক তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এরা কোন সংস্কৃতি সভ্যতা এবং কোন জীবন ব্যবস্থার বিকাশ ও লালনে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে সহযোগিতা করতে পারবে না। এখন জিজ্ঞাসা হলোঃ এ রকম বহুবিধ মানসিকতার লোক লালন পালনের একটা গারদ তৈরীর জন্যই কি একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা রচনা করা হয়ে থাকে?
বৈপ্লবিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাঃ
আমাদের সত্যিই যদি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার ইচ্ছা থেকে থাকে তাহলে কেবল জোড়াতালি ও মেরামত দ্বারা কার্যসিদ্ধি হবে না, বরং সেজন্য একটা বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই কথাটা উপলব্ধি করানোর জন্যই আমাদের এ আলোচনার অবতারণা। আসলে প্রচলিত দু’টো শিক্ষাকেই অর্থাৎ পুরনো ধর্মীয় শিক্ষা এবং বৃটিশ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাকে বাতিল করে দেয়া এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই উভয় ব্যবস্থার পরিবর্তে একটা নতুন একক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রচলিত দুটো শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় দোষত্রুটি থেকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত হতে হবে এবং একটা মুসলিম স্বাধীন ও উন্নয়নকামী জাতি হিসেবে আমাদের যাবতীয় চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা তার আওতাভুক্ত থাকতে হবে। এই নয়া শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি এখন আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণঃ
এই নয়া শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা প্রণয়নে সর্বপ্রথম যে জিনিসটা আমাদের ফায়সালা করা প্রয়োজন তা হলো, আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি? কারো কারো মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু জ্ঞান অর্জন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তারা বলেন, শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ হওয়া দরকার যাতে শিক্ষার্থী জীবন ও জগত সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্ব, সমস্যা ও ঘটনাবলীর সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ও বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু আমার মতে এ ধরনের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ একমাত্র ক্যামেরার পক্ষেই সম্ভব মানুষের পক্ষে নয়। মানুষ শুধু চোখ দিয়ে দেখেই না, তার পেছনে একটা মগজও থাকে। এটা কখনোও নিষ্কিৃয় থাকে না। তার একটা দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামত থাকে, জীবনের একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সে ঠিক করে সমস্যাবলী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার একটা প্রণালী সে তৈরী করে এবং মানুষ যা কিছু শেখে, শোনে ও জানে তাকে তার ভেতরের মৌলিক চিন্তা ও ধ্যান ধারণার সাথে সামঞ্জস্যশীলতার সাথে সাজিয়ে নেয়। তারপর সেই চিন্তা ও ধ্যান ধারণার ভিত্তিতে তার জীবন পদ্ধতি গড়ে ওঠে। এই জীবন পদ্ধতিকেই আমরা সংস্কৃতি বলি। এখন আমরা যদি একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকীদা বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য লক্ষ্যের অধিকারী জাতি হয়ে থাকি এবং আমাদের আলাদা জীবনাদর্শ থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের নতুন বংশধরগণকে ঐ সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার বিকাশ ও উন্নয়নের যোগ্য করে গড়ে তোলা কর্তব্য। দুনিয়ার সকল জাতি এ উদ্দেশ্যেই নিজেদের স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে থাকে। পৃথিবীতে এমন একটা জাতিও আছে বলে আমার জানা নেই যারা আদর্শ নিরপেক্ষ কোন শিক্ষাব্যবস্থা নিজেদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং আপন নতুন বংশধরগণকে নিজ সংস্কৃতির ছাপ নেই এমন শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করছে।
অনুরূপভাবে একটা বিজাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে হুবহু গ্রহণ করেছে এবং তাতে নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে কোন রদবদল না করেই সে অনুসারে আপন নতুন বংশধরগণকে লেখাপড়া শিখিয়েছে এমন কোন জাতিও পৃথিবীতে কোথাও আছে বলে আমি শুনিনি। এমন বোকামী আমরা যদি আগে দুর্বলতাবশত ও নিরুপায় হয়ে করে থাকি, তাহলে এখনও তা হুবহু চালু রাখার কোন অর্থ থাকতে পারে না। এখন তো আমাদের জীবন ব্যবস্থা আমাদেরই এখতিয়ারে, কাজেই অবশ্যই আমাদের কাছে শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আমাদের জাতীয় সংষ্কৃতি তথা ইসলামের যথার্থ সেবক ও রক্ষকরূপে নতুন বংশধর তৈরী করা। তাদেরকে এমনভাবে তৈরী করতে হবে যেন তারা ইসলামকে ভাল করে বুঝে, তার ওপর খাঁটি ঈমান রাখে, ইসলামের আদর্শ ও মূলনীতিকে ভাল করে জানে, সে অনুসারে সুদৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য চরিত্রের অধিকারী হয় এবং আমাদের সামগ্রিক জীবনের সমগ্র কর্মক্ষেত্রকে আমাদের সাংস্কৃতিক মূলনীতির ভিত্তিতে চালাতে ও তার উন্নয়ন বিধান করতে সক্ষম হয়।
ধর্ম ও দুনিয়াদারীর পার্থক্য ঘোচাতে হবেঃ
আমাদের দ্বিতীয় যে সিদ্ধান্তটি নিতে হবে তাহলো দ্বীন ও দুনিয়া অর্থাৎ ধর্মীয় জীবন ও দুনিয়াবী জীবনের পার্থক্যের অবসান ঘটাতে হবে। এ জিনিসটাকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় একটি আদর্শ মূলনীতি হিসেবে স্থান দিতে হবে এবং এরই ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা রচনা করতে হবে। ধর্ম ও দুনিয়াদারীর পার্থক্য একটি খৃস্টবাদী কুসংস্কার। বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম এবং যোগী ঋষীদের ধর্মেও এই কুসংষ্কার পরিলক্ষিত হয়। ইসলামের ধারণা বিশ্বাস এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মুসলিম জাতির শিক্ষাব্যবস্থায়, সমাজব্যবস্থায় ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্ম ও দুনিয়াদারীর এ পার্থক্যকে যদি আমল দেয়া হয়, তাহলে এর চেয়ে মারাত্মক ভুল আর কিছু হতে পারে না। আমাদের একটা শিক্ষা হবে ধর্মীয় এবং একটা শিক্ষা হবে দুনিয়াবী, এটা আমাদের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের মতে, আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা একই সাথে ধর্মীয় ও দুনিয়াবী-দুই’ই হওয়া চাই। দুনিয়াবী এই হিসেবে যে, এই শিক্ষা গ্রহণ করে দুনিয়াকে বুঝবে এবং দুনিয়ার কাজ কারবার চালাবার যোগ্য হবে। আর ধর্মীয় এই হিসেবে যে, দুনিয়াকে তারা ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতেই বুঝবে এবং ইসলামী বিধান অনুসারে দুনিয়ার যাবতীয় কাজ কারবার সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে। ইসলাম সেই ধর্ম নয়, যা মানুষকে দুনিয়ার কাজকর্ম বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারিতার সাথে চালাতে অনুমতি দিয়ে তার সাথে শুধুমাত্র গুটিকয়েক আকীদা- বিশ্বাস ও আনুষ্ঠানিক ইবাদত উপাসনার লেজুড় লাগিয়ে রাখতে বলবে। ইসলাম জীবনের শুধু একটা লেজুড় হয়ে আগেও তুষ্ট ছিল না, আজও এভাবে থাকতে চায় না। ইসলাম মানুষের সমগ্র জীবনের জন্য পথপ্রদর্শক ও কর্মপন্থা নির্দেশক হবার দাবীদার। সে পার্থিব জীবন বহির্ভূত অতীন্দ্রিয় জগতের কথাই শুধু বলে না বরং গোটা দুনিয়াবী জীবন নিয়েই সে আলোচনা করে। ইসলাম দুনিয়াবী জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে। দুনিয়ায় মানুষের আগমনের উদ্দেশ্য কি, তার জীবনের লক্ষ্য কি, বিশ্বজগতে তার প্রকৃত অবস্থান কি এবং এই দুনিয়ায় তারা কি পন্থায়, কোন কোন মূলনীতির ভিত্তিতে কাজ করা উচিত তাও জানিয়ে দেয়। ইসলামের মতে ইহকাল হচ্ছে পরকালের কর্মক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রে যে রকম বীজ রোপন করা হবে পরকালে ঠিক তেমনি ফল পাওয়া যাবে। এই ক্ষেতে কিভাবে চাষ দিতে হবে তাও সে শিক্ষা দেয়। পরকালে উত্তম ফল পেতে হলে দুনিয়ায় মানুষের কার্যপ্রণালী কি হওয়া উচিত তাও জানিয়ে দেয়। মুসলমানদের একটা শিক্ষা হবে দুনিয়াবী আর একটা হবে ইসলামী অথবা ইসলামকে একটা দুনিয়াবী শিক্ষার নেহায়েত লেজুড় বানিয়ে রাখা হবে। এ ধরনের একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা কখনো তা বরদাশত করতে পারে না। সে বরং চায় মানুষের গোটা শিক্ষাই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে হোক। যে ব্যক্তি দর্শন পড়বে সে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতেই তা পড়ুক যাতে সে একজন মুসলিম দার্শনিক হতে পারে। ইতিহাস পড়লে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে পড়ুক যেন সে একজন মুসলিম ঐতিহাসিক হতে পারে। যে বিজ্ঞান পড়ে সে যেন মুসলিম বিজ্ঞানী হয়ে গড়ে ওঠতে পারে। যে অর্থনীতি পড়বে সে যেন নিজ দেশের গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলামী অর্থনীতির আলোকে সুগঠিত-পুনর্বিন্যস্ত করার যোগ্য হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়লে সে যেন নিজ দেশের শাসনব্যবস্থাকে ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে চালাতে সক্ষম হয়। আইন পড়লে যেন ইসলামের ইনসাফ ও ন্যায়নীতির মানদন্ডে মামলা মোকদ্দমার বিচার করতে সমর্থ হবে। এভাবে ইসলাম, ধর্ম ও দুনিয়াদারীর পার্থক্য খতম করে দিয়ে পুরো শিক্ষাকেই ইসলামী শিক্ষায় পরিণত করতে চায়। এরপর আলাদা কোন ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনই থাকে না। আজকের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ই যেমন একদিকে ইমাম, মুফতি ও আলেম তৈরি করবে, অপরদিকে সরকারি প্রশাসন চালাবার জন্য সেক্রেটারী এবং ডাইরেক্টরও সরবরাহ করবে।
চরিত্র গঠনঃ
নয়া শিক্ষা ব্যবস্থার তৃতীয় মৌলিক জিনিস হলো, এতে চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠনকে পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। শুধুমাত্র বই পুস্তক পড়ানো এবং জ্ঞান বিজ্ঞান শেখানোতে আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। অমাদের প্রতিটি যুবকের মধ্যে ইসলামী চরিত্র, ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও ইসলামী মানসিকতা গড়ে উঠা প্রয়োজন, চাই সে ইঞ্জিনিয়ার হোক, বৈজ্ঞানিক হোক, সমাজ বিজ্ঞানী হোক অথবা বেসামরিক প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা হোক তার মধ্যে ইসলামী মন মগজ এবং ইসলামী চরিত্র অবশ্যই গড়ে উঠতে হবে। আমাদের শিক্ষা নীতিতে এ জিনিসটি প্রধান লক্ষ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। যে ব্যক্তির ইসলামী চরিত্র নেই, সে আর যাই হোক, আমাদের জন্য কোন কাজেরই নয়।