আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি
আজ হতে প্রায় ২৮ বছর পূর্বে সম্ভবতঃ ১৯৩৫ সনে এই প্রশ্নটি বেশ জোরালোভাবেই উত্থাপিত হয়েছিল যে, মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নাস্তিক; নাস্তিকতা ভাবাপন্ন এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাসী ও তার প্রচারক এত অধিক সংখ্যায় বের হচ্ছে কেন? বিশেষ করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অভিযোগ ছিলো, এখান থেকে সনদপ্রাপ্ত শতকরা ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীই কেন নাস্তিকতা ও প্রকৃতিবাদের পূজারী? বিষয়টি নিয়ে সর্বত্রই যখন জল্পনা কল্পনা এবং দেশের পত্র-পত্রিকায় এর বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু হলো, তখন এ অভিযোগ খতিয়ে দেখা এবং এর প্রতিকারের উপায় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার উদ্দেশ্যে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হতে একটি কমিটি নিয়োগ করা হলো। কমিটি অনেক চিন্তা ভাবনা ও বিচার বিশ্লেষণের পর এ মর্মে সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, প্রচলিত সিলেবাসে ইসলামী উপাদান আগের তুলনায় কিছু বাড়িয়ে দিলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান নাস্তিকতা ও প্রকৃতিবাদের সয়লাবের মুখে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা সম্ভব।
১৯৩৬ সনের আগষ্ট সংখ্যা তরজামনুল কুরআনে মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (রঃ) এ অবস্থার প্রতিকারের নিমিত্তে গৃহীত কর্মপন্থা পর্যালোচনা করেন এবং তখনকার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটির প্রতি অংগুলি নির্দেশ করে তা দূর করার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিগত এপ্রিল ১৯৩৬ সনের বার্ষিক অধিবেশনে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন যা অনেক দিন থেকেই দৃষ্টি দেয়ার মতই গুরুত্ববহ। অর্থাৎ দীনিয়াত বা ইসলামী বিষয়গুলোর ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাদান পদ্ধতির সংশোধন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী জ্ঞান ও ভাবধারার স্ফূরণ।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গেলে একথা বলতে হয় যে, সরকার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এসব বিষয় শিক্ষাদানের অতি উত্তম ব্যবস্থা বর্তমান। অন্ততপক্ষে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপর্যায়ের তো বটেই। সুতরাং এ উদ্দেশ্যেই মুসলমানদের আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। যে কারণে মুসলমানদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ধারণা গড়ে উঠেছিল এবং যে কারণে তা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তা শুধু এই যে, মুসলমানগণ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুবিধা লাভের সাথে সাথে মুসলমান হিসেবেও বেঁচে থাকতে হয়। সরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালসমূহের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই এজন্য প্রয়োজন মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। যদি তাদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ও এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, সেখান থেকেও এমন সব গ্রাজুয়েট বের হয় যেমন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হতে বের হয়, যদি সেখান থেকেও স্বদেশী সাহেব অথবা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী অথবা সমাজতন্ত্রী নাস্তিক সৃষ্টি হয়, তাহলে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং তা পরিচালনা করার এমন কি বিশেষ প্রয়োজন থাকতে পারে?
এটি এমন একটি বিষয়, যার প্রতি শুরুতেই যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন ছিল। যে সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা-ভাবনা চলছিল তখন সর্বপ্রথম ভেবে দেখা উচিত ছিল যে, তাদের একটি আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন কেন? আর এ প্রয়োজন পূরণ করার পন্থাই বা কি? হ্যাঁ, বর্তমান যুগের মুসলমান সম্পর্কে কোন একজন সমালোচক হয়তো যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, “এরা কাজ করে আগে এবং পরে ভাবে।” যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনায় মগ্ন ছিলেন তাদের মন মগজে এ সম্পর্কে কোন পরিকল্পনাই ছিল না। একটা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হবে এবং কি কি বৈশিষ্ট্য থাকলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় তার কোন নকশা বা ধ্যান ধারণাই তাদের মন মগজে ছিল না। এই পরিকল্পনাহীন কাজের ফলশ্রুতিতে আলীগড়েও ঠিক আরেকটি এমন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো যার একটি ইতিপূর্বে আগ্রায়, দ্বিতীয়টি লাখনৌতে এবং তৃতীয়টি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মুসলিম শব্দটির প্রতি লক্ষ্য রেখে দ্বীনিয়াত বিষয়টি পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হলো। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম করণে মুসলিম শব্দটির সংযোজনের কারণ কেউ জানতে চাইলে তার সামনে ‘কুদুরী’ ‘মুনিয়াতুল মুসাল্লী’ এবং ‘হিদায়ার’ নাম ইসলামিয়াত বিষয়ের সনদ হিসেবে পেশ করা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এমন কোন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেল না যার ভিত্তিতে তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্বতন্ত্র হতে পারতো এবং প্রকৃত অর্থেই একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতো। হতে পারে প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অদম্য উৎসাহের কারণে এর সঠিক ও যথাযখ রূপরেখা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশ পাওয়া যায় নি। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পনেরটি বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে; এ সময়ের মধ্যেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কর্ণধারগণ একবারও অনুধাবন করতে পারলেন না, তাদের আসল লক্ষ্য কি ছিল? আর তাদের কাফেলা তা পেছনে ফেলে কোন লক্ষ্যের পেছনে ছুটে চলছে? প্রথম থেকেই অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছিলো, যে ঢংয়ে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চলা উচিত এটি সেভাবে চলছে না, আর যে ফলাফল আশা করা গিয়েছিলো তাও অর্জিত হচ্ছে না। একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ইসলামী চরিত্র, ইসলামী স্পিরিট এবং ইসলামী কর্মপদ্ধতি ও আচরণ তাদের চরিত্রে একেবারেই অনুপস্থিত। তাদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান-ধারণা ও ইসলামী মন মানসিকতা একেবারেই দুর্লভ। যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় হতে একজন মুসলমানের মত দৃষ্টিভঙ্গি এবং একজন মুসলমানের মতো জীবনোদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদীক্ষা যাদেরকে এতটুকু যোগ্যতাসম্পন্ন করেছে যে, জ্ঞান ও বিবেক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তারা ইসলামী মিল্লাতের মধ্যে নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চার করতে পারতো, কিংবা কমপক্ষে তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে স্বজাতির জন্য কোন উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম দিতে পারতো, এমন ছাত্রের সংখ্যা হয়তো শতকরা একজনও নয়। ফলাফল শুধু নেতিবাচক হলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয় হতে সনদপ্রাপ্ত এবং শিক্ষারত ছাত্রদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা এমন, যাদের অস্তিত্বই ইসলামী তাহযীব এবং মুসলিম জাতির জন্য কল্যাণবহ নয় বরং ক্ষতিকর। এরা ইসলামী প্রাণশক্তি সম্পর্কে শুধু অজ্ঞই নয়, বরং পুরোপুরি বিরুদ্ধমনা। তাদের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে শুধু উদাসীনতাই নয় বরং ঘৃণার ভাবও সৃষ্টি হয়েছে। এমনভাবে তাদের মষ্তিষ্ক ধোলাই করা হয়েছে যে, তা সন্দেহের সীমা ডিঙ্গিয়ে অস্বীকৃতির পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। যেসব মূলনীতিমালার উপর ইসলামের ভিত্তি, তারা এখন তার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করছে।
সম্প্রতি খোদ মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হতে সনদপ্রাপ্ত একজন ছাত্র যিনি জন্মগতভাবে সত্যনিষ্ঠ হওয়ার কারণে মুরতাদ হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন-তার এক ব্যক্তিগত পত্রে প্রসংগক্রমে সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে কিছু ইংগিত দিয়েছেন। পত্রখানা প্রকাশ করার জন্য নয় এবং তা বিশেষ করে আলীগড়ের অবস্থা বর্ণনা করার জন্যও লেখা হয় নি। তাই আমরা মনে করি তাতে যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অবস্থার সঠিক চিত্র। পত্রলেখক তার মানসিক বিবর্তনের ঘটনাক্রম এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
“আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে ইসলামী দুনিয়ার বাইরের ফিতনা এবং ফিরিংগীপনার বিবর্তিত সর্বশেষ স্তর কম্যুনিজমের সাথে মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমি প্রথম প্রথম পাশ্চাত্যপনাকে ভয়ানক কিছু মনে করতাম না। কিন্তু আলীগড়ে লব্ধ অভিজ্ঞতা আমাকে বাস্তব সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে। ই যসলামী ভারতের এই কেন্দ্রে বেশ কিছু সংখ্যক এমন লোকও আছে যারা ইসলামকে বর্জন করে কম্যুনিজমের প্রচার ও প্রসারে একনিষ্ঠভাবে আত্মনিয়োগ করেছে। কম্যুনিজমের সেবক শিক্ষকরা সব মেধাবী ও ধী-শক্তি সম্পন্ন ছাত্রদেরকে তাদের দলে ফাঁদে আটকিয়ে ফেলেন। তারা এজন্য কম্যুনিজম গ্রহণ করেন নি যে, গরীব কৃষক এবং শ্রমিকদের সাহায্য সহযোগিতা করবেন। কেননা তাদের ব্যয় বাহুল্য ভরা বাস্তব জীবনে এসব গাল ভরা বুলির অন্তঃসার শূণ্যতাই প্রমাণ করে। বরং তাদের কম্যুনিজম গ্রহণ করার কারণ হলো, তারা চায় একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের ছত্র-ছায়ায় অবস্থান করে নিজেদের নৈতিক দুর্বলতা, নাস্তিক্যবাদী মন-মানসিকতা এবং নৈতিকতা বর্জিত কাজ কর্মকে (Loose thinking) যুক্তি সিদ্ধ (Justify) বলে প্রমাণ করা। কমকককম্যকম্যুনিজম প্রথমে আমাকেও ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছিল। আমি ধরে নিয়েছিলাম যে, এটা ইসলামেরই একটা অনোনুমোদিত (Unauthorized) সংস্করণ। কিন্তু গভীরভাবে পর্যালোচনা করার পর জানতে পারি যে, মৌলিক লক্ষ্যের দিক থেকে ইসলাম এবং কম্যুনিজমের মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ।”
এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু ত্রুটিপূর্ণই নয় বরং স্যার সাইয়েদ আহমদ খান, মুহসিনুল মুলক, ভিকারুল মুলক ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ যে সব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্য একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন এবং যে জন্য মুসলমানেরা তাদের সামর্থ্যের চেয়েও বেশি উৎসাহের সাথে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকে স্বাগত জানিয়েছিল, সেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উল্টো ফলাফলই এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এরূপ একজন ইঞ্জিনিয়ার সম্পর্কে আপনার মতামত কেমন হবে যার তৈরী মোটর গাড়ি সামনে চলার পরিবর্তে পেছনের দিকে চলে? আর আপনার দৃষ্টিতে এমন একজন ইঞ্জিনিয়ারকে কেমন বিশেষজ্ঞ বলে মনে হবে, যে তার তৈরী মোটরগাড়িকে একের পর এক এলোপাথাড়ি চলতে দেখেও উপলব্ধি করতে পারে না যে, তার পরিকল্পিত নকশায় নিশ্চয়ই কোন ত্রুটি আছে। এরূপ কোন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আপনি আদৌ দেখতে পাবেন না। তবে আপনার জাতির শিক্ষাব্যবস্থার ইঞ্জিনিয়াররা কিরূপ দক্ষ এই বাস্তব ঘটনা হতে তার পরিমাপ করতে পারবেন যে, তারা শিক্ষাব্যবস্থার একটি মেশিন তৈরি করেছেন যার উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলা। কিন্তু এজন্য তারা যে মেশিন তৈরি করেছেন তা সম্পূর্ণ উল্টো দিকে এগিয়ে চলতে শুরু করলো এবং এভাবে ক্রমাগত পনেরো বছর পর্যন্ত চললো। কিন্তু একদিনের জন্যও তারা অনুভব করতে পারলেন না যে, এর যন্ত্রপাতিতে ত্রুটি আছে বরং আদৌ ত্রুটি আছে কিনা তাও বুঝতে পারলেন না।
অনেক অঘটন সংঘটিত হওয়ার পর এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছেন যে, ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী স্পিরিট বা প্রাণ-শক্তি সৃষ্টি করা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্যসমূহের একটি।
আর এ উদ্দেশ্যে এখন তারা সাত ব্যক্তির সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে তাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন যে, সঠিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে হবে এবং দ্বীনিয়াত ও ইসলামী বিষয়সমূহ শিক্ষার জন্য এমন আধুনিক ও উন্নত উপকরণ ব্যবহারের সুপারিশ করতে হবে যা সময়ের দাবী পূরণ করতে সক্ষম এবং যা দ্বারা শিক্ষণীয় ইসলামী বিষয়সমূহ অধিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা যাবে।
অত্যন্ত খুশীর কথা, অতীব কল্যাণকর কথা, সকালের পথহারা যদি সন্ধ্যায় ফিরে আসে তবে তাকে পথহারা বলা চলে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নির্মাতারা এখনও যদি অনুভব করতে পারেন যে, তাদের শিক্ষাযন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনে নির্মিত হয়েছে এবং যে উদ্দেশ্যে তারা এ যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন তার উল্টো ফলাফল দানের মূল কারণ কোন দৈব দূর্ঘটনা নয় বরং মূল ডিজাইন ও তা বাস্তবায়নের কারণেই হচ্ছে, তাহলে আমরাও বলব, যা হওয়ার হয়েছে এখন এসো, পূর্বের ডিজাইনের ত্রুটি কি তা ভাল করে দেখে নাও এবং আরেকটি নির্ভুল ডিজাইন অনুসারে যন্ত্রটি পুনরায় নির্মাণ করো। কিন্তু আমাদের সন্দেহ, এখনও এসব ব্যক্তিবর্গ ত্রুট উপলব্ধি করতে সক্ষম হন নি। এখনও তারা এ বিষয়টি মানতে রাজি নন যে, তাদের ডিজাইনে মৌলিক গলদ রয়েছে। শুধুমাত্র ফলাফলের ভয়াবহ বাহ্যিক অবস্থা দেখেই তারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং হালকাভাবেই অবস্থা অবলোকন করছেন।
খোদা করুন, আমাদের এ সংশয় ভুল প্রমাণিত হোক। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার কারণে আমরা এরূপ সন্দেহ না করে পারছি না। দুই শতাব্দীর ক্রমাগত অধঃপতনের কারণে বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন তা একটি রাজনৈতিক বিপ্লবরূপে আত্মপ্রকাশ করলো তখন মুসলমানদের ডুবন্ত জাহাজকে সামলানোর জন্য গায়েবী সাহায্যে কয়েকজন সুদক্ষ নাবিক জন্ম নিলেন। সময়টা খুব একটা চিন্তা ভাবনা করে কাজ করার মত ছিল না। ভাঙ্গা ও জীর্ণ জাহাজের স্থলে নতুন ডিজাইন অনুসারে নতুন ও স্থায়ী জাহাজ নির্মাণ করে নেয়া যায়, এরূপ চিন্তার অবকাশই বা কোথায় ছিল? তখন সামনে একটিই মাত্র প্রশ্ন ছিল। তা’হলো এই ডু্বন্ত জাতিকে ধ্বংসের হাত হতে কিভাবে রক্ষা করা যায়? এই সব নাবিকের একটি অংশ তৎক্ষণাৎ তাদের সেই পুরাতন জাহাজটির মেরামত আরম্ভ করে দিলেন। এর পুরনো তক্তাগুলোই জোড়া দেয়া হলো, ফাটল ও ছিদ্রসমূহ বন্ধ করা হলো এবং ছেড়া ফাটা পাল রিপু করে যেমন তেমনভাবে হাওয়া লাগানোর ব্যবস্থা করা হলো। নাবিকদের অন্য দলটি একলাফে একটা নতুন বাষ্প শক্তি চালিত জাহাজ ভাড়া করলেন এবং ডুবন্ত মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তাতে উঠিয়ে নিলেন। এভাবে উভয় দলই তাৎক্ষণিক এই বিপদকে দূর করতে আপাতত সক্ষম হলেন। কিন্তু তারা এ দুটি ব্যবস্থার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে ডুবন্তদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন মাত্র। এর অধিক তারা কিছু করতে পারেন নি। তাদের এ কাজে যে বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল ছিল তা শুধু এতটুকুই। তাই এ অবস্থা দূরীভূত হওয়ার পরে এখনো যারা এ দু’টো ব্যবস্থাকে হুবহু বহাল রাখতে চান তাদের কর্মপদ্ধতি বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিপন্থী। পুরনো পালের জাহাজখানাও এমন নয় যে, এতে আরোহণ করে মুসলমানরা সেই সব জাতির সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে পারে যাদের কাছে এর চেয়েও হাজার গুণ গতিসম্পন্ন যান্ত্রিক জাহাজ রয়েছে। আবার ভাড়া করা বাষ্পীয় শক্তিচালিত জাহাজখানাও এমন নয় যে, এতে আরোহণ করে মুসলমানরা তাদের মনযিলে মকসুদে পৌছতে পারে। কারণ যদিও এর সাজ সরঞ্জাম নতুন, গতি দ্রুত এবং যান্ত্রিকও বটে তথাপিও তা তো অন্যদের জাহাজ। এর ডিজাইনও তাদের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এর গতি নিয়ন্ত্রক ও নাবিক তারাই। সুতরাং এ জাহাজ দ্বারাও আমরা আশা করতে পারি না যে, তা আমাদের মনযিলে মকসুদে পৌছিয়ে দিবে। বরং দ্রুত গতি সম্পন্ন হওয়ায় এ আশংকা আছে যে, তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আমাদের বিপরীত দিকে নিয়ে যাবে এবং মনযিলে মকসুদ থেকে আমাদের দুরত্ব প্রতিদিনই বাড়তে থাকবে। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণের জন্য যারা পুরনো জাহাজ মেরামত করে নিয়েছিলেন তাদের ভূমিকা যথার্থ ভূমিকাই ছিল। আবার যারা ভাড়া করা জাহাজে আরোহণ করে প্রাণ বাঁচালেন তারাও কিন্তু ভুল করেন নি। তবে যারা এখনো পুরনো জাহাজের উপর জেঁকে বসেছেন, তারাও ভুল করেছেন আবার যারা ভাড়া করা জাহাজ ছাড়তে রাজি নন তারাও ভুল করেছেন।
প্রকৃত নেতা ও সমাজ সংস্কারকের পরিচয় হলো, তিনি চিন্তা ভাবনা ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে কাজ করেন এবং স্থান কাল ভেদে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে গৃহীত কোন ব্যবস্থাকে কেউ যদি সময় অতীত হওয়ার পরেও অনুসরণ করতে চায় তাহলে তাদেরকেই বলে অন্ধ সমর্থক। সময়ের দাবী অনুসারে সে যে কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছিলো সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যারা চোখ বন্ধ করে সেই পদ্ধতি গ্রহণ করে এবং এতটুকুও উপলব্ধি করতে পারে না যে, অতীতে যা উপযোগী ছিল বর্তমানে তা-ই অনুপযোগী। বিগত শতাব্দীর নেতাদের তিরোধানের পর তাদের অনুসারীগণ আজও তাদের পথ আঁকড়ে ধরে চলতে চায়; অথচ তারা যে সময়ের চাহিদা পূরণের জন্য ঐ সব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন সে সময় অতীত হয়ে গিয়েছে। এখন যা প্রয়োজন তা হলো চিন্তা ভাবনা ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে নতুন পন্থা অবলম্বন করা।
দুর্ভাগ্যবশত দুটি দলের কোনটিতেই আমরা একজন মুজাহিদও দেখতে পাই না। পুরনো জাহাজের আরোহীদের কেউ খুব সাহস করে ইজতিহাদ করলেও তা এতোটুকু মাত্র যে, ঐ পুরনো জাহাজেই কয়েকটি বৈদ্যুতিক বাল্ব লাগিয়ে নেন এবং কিছু নতুন ডিজাইনের আসবাবপত্র সংগ্রহ করে নেন এবং একটি ক্ষুদ্র স্টীম ইঞ্জিন খরিদ করে নেন; যার কাজ শুধু হুইসেল বাজিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেয়া যে, এ জাহাজ এখন একদম নতুন হয়ে গিয়েছে। পক্ষান্তরে নতুন জাহাজের আরোহীরা যদিও অন্যের জাহাজে আরোহণ করে দ্রুতগতিতে বিপরীত দিকে চলছে তথাপি কয়েকটি পুরনো পাল নিয়ে বিংশ শতাব্দীর এই আপটুডেট জাহাজে খাটিয়েছেন। যাতে তারা জাহাজটিকে ইসলামী জাহাজ বলে নিজেদেরকে এবং মুসলমানদেরকে প্রতারিত করছেন এবং ভায়া লন্ডন হজ্জের জন্য পথ অতিক্রম করছেন।
উপমার ভাষা ছেড়ে এখন আমি স্পষ্ট করে বলব, স্যার সাইয়েদ আহমদ খানের (আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন) নেতৃত্বে আলীগড় হতে যে শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিলো মুসলমানরা যেন সেই নতুন সময়ের চাহিদার আলোকে নিজের পার্থিব স্বার্থ রক্ষা করার মত যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে উঠে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থাকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করতে সক্ষম হয় এবং দেশের আইন কানুন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা হতে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে অন্য জাতি হতে পশ্চাদপদ থেকে না যায়। সেই সময় হয়তো এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবার অবকাশই ছিলো না। যদিও এই আন্দোলনে লাভের পাশাপাশি ভয়ংকর দিকও ছিল। কিন্তু তখন চিন্তা ভাবনা করে ক্ষতিমুক্ত সার্বিকভাবে কল্যাণকর কোন সুষ্ঠু শিক্ষানীতি গ্রহণ করার মত অবকাশ ছিলো না। তখন এমন কোন উপায় উপকরণও ছিলো না যা দিয়ে এ ধরনের শিক্ষানীতি অনুসারে কাজ করা সম্ভব হতো। সুতরাং তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণার্থে মুসলমানদেরকে ইতিপূর্বেই দেশে চালু হয়ে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হলো। তবে এর বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার নিমিত্তে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণের স্বল্প পরিমাণ এমন কিছু উপকরণও এতে রাখা হলো, আধুনিক শিক্ষানীতি ও প্রশিক্ষণের সাথে যার আদৌ কোন সম্পর্ক ছিল না। এটা ছিল একটা সাময়িক পদক্ষেপ যা আকস্মিক বিপদের মোকাবিলা করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে যে সময়ে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, সে সময় এখন অতীত হয়ে গিয়েছে। এ পদক্ষেপের আকাংখিত সুফলও তখন পাওয়া গিয়েছে এবং যে বিপদ তখন ছিল আশংকা আকারে এখন তা রূঢ় বাস্তব হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ আন্দোলন একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমাদের পার্থিব ও বৈষয়িক স্বার্থ হাসিলে সহায়ক হয়েছে। তবে এর মাধ্যমে আমরা পার্থিব স্বার্থ যতটা উদ্ধার করেছি, আমাদের দ্বীনকে তারচেয়ে অনেক গুণে বেশি বিকৃত করে ফেলেছি। এ ভাবেই আমাদের মধ্যে কৃষ্ঞবর্ণের ফিরিংগীদের আবির্ভাব ঘটেছে। এংলো মোহামেডান ও এংলো ইন্ডিয়ান জন্ম লাভ করেছে তাও আবার এমন যাদের মানসিকতায় “মোহামেডান” ও “ইন্ডিয়ান” হওয়ার অনুপাত নামে মাত্র বিদ্যমান।
যে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদেরকে আমাদের সমাজের মেরুদন্ড বলা চলে, এ শিক্ষা ব্যবস্থা তাদেরকে শুধুমাত্র কয়েকটা পদ ও খেতাবের বিনিময়ে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিক থেকেই ইউরোপের বস্তুবাদী সভ্যতার গোলামে পরিণত করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এ শিক্ষানীতি কি স্থায়ীভাবে আমাদের শিক্ষানীতি হয়ে থাকবে? এটাই যদি স্থায়ীভাবে আমাদের শিক্ষানীতি হয়ে থাকে তাহলে এখন আর আলীগড়ের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ, ভারতবর্ষের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটি করে এ ধরনের আলীগড় রয়েছে, যেখান থেকে প্রতিনিয়ত ‘এংলো মোহামেডান’ ও ‘এংলো ইন্ডিয়ান’ তৈরি হয়ে বের হচ্ছে। উপরন্তু এ ধরনের বিষাক্ত ফসল উৎপাদন করার জন্য আমাদের খামার ভূমি রাখার প্রয়োজনীয়তাই বা কি? যদি প্রকৃতই এ অবস্থার পরিবর্তন সাধন করা আমাদের লক্ষ্য হয়, তাহলে একজন চিকিৎসকের দৃষ্টি নিয়ে দেখুন, বিকৃতির মূল কারণগুলি কি এবং তা সংশোধনের উপায়ই বা কি?
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এর বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তা ইসলামের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ উল্টো। সুতরাং আমরা যদি তা হুবহু গ্রহণ করি এবং আমাদের নবীন বংশধরদের এর আলোকে গড়ে তুলি তাহলে চিরদিনের জন্য তাদেরকে হারিয়ে ফেলবো।
যে দর্শন আল্লাহকে বাদ দিয়ে বিশ্ব সমস্যা সমাধানের প্রয়াসী, আপনি সে দর্শনশাস্ত্রই তাদেরকে শেখাচ্ছেন, যে বিজ্ঞান যুক্তিকে পরিহার করে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের দাস হয়ে গিয়েছে, আপনি তাদেরকে সেই বিজ্ঞানই পড়াচ্ছেন। আপনি তাদেরকে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন ও সমাজ বিজ্ঞানের এমন সব বিষয় শিক্ষা দিচ্ছেন যা মূল বিষয় হতে নিয়ে শাখা প্রশাখা এবং তত্ত্বগত পর্যায় থেকে নিয়ে বাস্তব কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত ইসলামের তত্ত্ব ও সমাজ বিজ্ঞানের মৌলিক নীতির বিরোধী। আপনি এমন একটি সভ্যতার ছত্রছায়ায় তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছেন যা মূল স্পিরিট, লক্ষ্য এবং কাঠামোগত দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে ইসলামী সভ্যতার বিরোধী। এ সত্ত্বেও কিসের উপর নির্ভর করে আপনি আশা পোষণ করেন যে, এর দৃষ্টিভঙ্গি হবে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি, এর চরিত্র হবে ইসলামী চরিত্র এবং এর জীবন হবে ইসলামী জীবন? প্রাচীন পদ্ধতিতে কুরআন হাদীস ও ফিকাহর শিক্ষাদান এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থার সাথে একেবারেই বেমানান। এ ধরনের শিক্ষা হতে উত্তম কোন ফল লাভ করা যাবে না। একটি ফিরিংগী স্টীমারকে এর উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যেতে পারে, যাতে শুধু দেখানোর উদ্দেশ্যে একটি পাল রাখা হয়েছে। এই ফিরিংগী স্টীমার কিয়ামত পর্যন্ত কোনদিনও ইসলামী স্টীমারে রূপান্তরিত হবে না।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিই যতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে হয়, তাহলে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান হুবহু শিক্ষা দান প্রক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করুন। এসব জ্ঞান বিজ্ঞান অবিকল গ্রহণ করাটাই ঠিক নয়। প্রচলিত বর্তমান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর সরল মানসপটে এটি এমনভাবে অংকিত হয়ে যায় যে, তারা পাশ্চাত্যের সব কিছুর উপরই দৃঢ় আস্থা স্থাপন করে বসে। তাদের মধ্যে ভাল এবং মন্দ যাচাই করার যোগ্যতাই সৃষ্টি হয় না। আর সৃষ্টি হলেও তা হাজারে একজনের মাঝে মাত্র। তাও আবার এখান হতে শিক্ষা সমাপনান্তে বহু বছরের গভীর পড়াশোনার পর যখন তারা জীবনের শেষ সীমায় পৌছে যায় এবং বাস্তবে কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন হওয়া দরকার। পাশ্চাত্যের সব জ্ঞান বিজ্ঞানকে শিক্ষার্থীদের সামনে সমালোচনার আলোকে উপস্থাপন করা দরকার। এই সমালোচনা হবে নিখাদ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে যাতে শিক্ষার্থীরা প্রতি পদক্ষেপে এর ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো পরিহার করতে পারে এবং কার্যকর দিকগুলো গ্রহণ করতে পারে।
এর সাথে সাথে একথাও মনে রাখতে হবে যে, ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান ইসলামের প্রাচীন গ্রন্থাবলী হতে হুবহু গ্রহণ করা ঠিক হবে না। বরং এসব জ্ঞান বিজ্ঞানে শেষ যুগের পন্ডিতগণ যে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন ইসলামের স্থায়ী মূলনীতি, সঠিক আকীদা-বিশ্বাস এবং অপরিবর্তনীয় আইন কানুনকে তা থেকে ঝেড়ে মুছে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মন মগজে ইসলামের প্রকৃত স্পিরিট এবং ধ্যান ধারণা সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য রেডিমেড কোন সিলেবাস আপনি কোথাও পাবেন না। সব কিছু একেবারে নতুন করে তৈরি করতে হবে। কুরআন এবং রাসূলের (সাঃ) সুন্নাতের শিক্ষা সবচাইতে অগ্রগামী হবে। তবে এর পাঠদানকারী শিক্ষকবৃন্দ হবেন এমন, যিনি কুরআন সুন্নাহকে যথাযথভাবে বুঝতে পেরেছেন। ইসলামী আইনশাস্ত্রও অবশ্যই শিক্ষা দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রেও প্রাচীন গ্রন্থাবলী বড় একটা কাজে আসবে না। অর্থনীতি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইসলামী দর্শনের মতবাদসমূহ, ইতিহাস শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইতিহাস দর্শনের মর্মকথা এবং এভাবে প্রতিটি বিষয় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইসলামী উপাদানসমূহকে ফলপ্রসূ, যুক্তি নির্ভর ও প্রাধান্য বিস্তারকারী উপাদান হিসেবে অংগীভূত করতে হবে।
শিক্ষক স্টাফ হতে যে সব নাস্তিক ও ফিরিংগীপনা শিক্ষক অনুপ্রবেশ করেছে তাদের সরিয়ে দিতে হবে। সৌভাগ্যবশত ভারতবর্ষে এখন এমন একদল লোক তৈরি হয়েছে যারা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে অভিজ্ঞ হওয়ার সাথে সাথে মন-মস্তিষ্ক ও ধ্যান ধারণার দিক হতেও পুরোপুরি মুসলমান। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব জ্ঞানী লোকদেরকে একত্রিত করুন যাতে তারা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে ইসলামী ডিজাইন অনুযায়ী একটি নতুন জাহাজ নির্মাণ করে দিতে পারেন।
আপনি হয়তো বলবেনঃ ইংরেজ সরকার এরূপ একটি জাহাজ নির্মাণ করার অনুমতি দিবেন না। কথাটা যদিও কতকটা সত্য কিন্তু আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন যে, একজন খাটি মুসলমান এবং একজন খাঁটি কমিউনিস্ট এর মধ্যে কাকে সে বেশী ভাল মনে করবে? দুটির মধ্যে যে কোন একটি তাকে গ্রহণ করতেই হবে। ১৯১০ সালের ‘এংলো মোহামেডান’ ধরনের মুসলমান এখন আর বেশিদিন পাওয়া যাবে না। মুসলমানদের নবীন বংশধরদেরকে যদি তুমি কম্যুনিষ্ট হিসেবে দেখতে চাও তাহলে তোমার চিরন্তন মুসলিম দুশমনী চালিয়ে যাও। ফল অবশ্যই দেখতে পাবে। আর যদি তা পছন্দ না হয় এবং কম্যুনিজমের ক্রমবর্ধমান সয়লাব রোধ করতে হয়, তাহলে শুধু একটি শক্তি তা করতে পারে সেটি হলো ইসলাম।
(তরজামুল কুরআন, আগষ্ট, ১৯৩৬; জমাদিউল উলা-১৩৫৬ হিজরি)।