নয়া শিক্ষাব্যবস্থা
(১৯৪১ সালের ৫ জানুয়ারী দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা লাখনৌর ছাত্র সমিতির অধিবেশনে এ ভাষণ দেয়া হয়)।
ভদ্র মহোদয়গণ!
আজ আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি যে এ যুগে যে জায়গায় সর্বপ্রথম ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার চিন্তা দানা বেঁধেছে, সেখানে বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পেলাম। শুধু চিন্তা দানা বাঁধেনি, সর্বপ্রথম পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে এখানেই। এ জন্য আমি শিক্ষা সংস্কার ও সংশোধনের বিষয়টাকেই আমার আলোচ্য বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছি। এটাকে আলোচ্য বিষয় হিসেবে বেছে নেয়ার একটা বড় কারণ এই যে, আজকাল আমাদের ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কারের পরিবর্তে কথাবার্তা খুব জোরেশোরেই চলছে। এ থেকে বুঝা যায়, সংস্কার প্রয়োজন যে আছে, তা বেশ অনুভব করা হচ্ছে। তবে কথাবার্তার হাবভাব থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, সংস্কার যারা চান তারা সমস্যাটা যে কি ধরনের সে সম্পর্কে তেমন পরিষ্কার ধারণা রাখেন না। তারা মনে করেন, পুরনো শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি শুধু এই যে, ওটা বড্ড সেকেলে এবং তাতে কোন কোন বিষয় অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় কম কিংবা বেশী। আধুনিক যুগের কোন কোন জরুরী বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও তারা এটাকে একটা ত্রুটি মনে করেন। এরূপ মনে করার কারণে তারা সংস্কার ও সংশোধনের আলোচনাকে খুবই সীমিত গন্ডিতে আবদ্ধ করেন। তাঁদের মতে কতকগুলো কিতাব পাঠ্যসূচী থেকে বাদ দিয়ে নতুন কতকগুলো কিতাব অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া উচিত। পাঠ্য বিষয়গুলোর মধ্যে কোনটার আনুপাতিক কমানো এবং কোনটার বাড়ানো উচিত। আর পুরনো বিষয়গুলোর সাথে সাথে ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে কিছু কিছু বই পুস্তক পড়ানো দরকার। শিক্ষাদানের পদ্ধতি এবং বিদ্যালয়সমূহের প্রশাসনিক ব্যাপারেও এই ধরনের কিছু আংশিক সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়ে থাকে। যারা একটু বেশী মাত্রায় আধুনিকমনা তাঁরা উপদেশ দেন যে, প্রত্যেক মৌলবীকে ম্যাট্রিক স্তরের ইংরেজী পড়িয়ে দাও যাতে কমপক্ষে টেলিগ্রাম পড়া ও লেখার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু এই যে আধুনিকতা আজ দেখানো হচ্ছে তাও বাসি হয়ে গিয়েছে। এ মনোভাব আপনাদের দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামারই সমসাময়িক। কিছু সংখ্যক মৌলবী আগের চেয়ে একটু বেশি যোগ্যতা হয়ে বেরুবে, এর চেয়ে বেশি কিছু উপকার এতে হবে না। তারা জার্মানী ও আমেরিকা সম্পর্কে কিছু কিছু কথা বলতে শিখবে। কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে বর্তমান দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আলেম সমাজের হাতে এসে যাবে এরূপ কখনও হতে পারে না। যে পৃথিবী অগ্নিকুন্ডের দিকে পরিচালনাকারী নেতৃবৃন্দের পিছনে চলছে তারা যে জান্নাতের দিকে আহবানকারী নেতাদের নেতৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হবে, তাও নয়। এরূপ ফল পেতে হলে পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবী সংস্কারের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে একটা নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। আজকের আলোচনায় আমি সেই নয়া শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই।
জ্ঞান ও নেতৃত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক
সর্বপ্রথম ভেবে দেখা দরকার যে দুনিয়ায় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব কিসের উপর নির্ভরশীল? কখনো মিশর নেতৃত্বে আসীন হয় এবং সারা দুনিয়া তার পেছনে চলতে আরম্ভ করে। কখনো ব্যাবিলনের হাতে চলে যায় নেতৃত্বের চাবিকাঠি এবং সমগ্র দুনিয়া তার অনুসরণ করে। কখনো গ্রীস নেতৃত্ব লাভ করে আর সারা দুনিয়া করে তার পদানুসরণ। কখনো ইসলাম গ্রহণকারী জাতিগুলোর হাত যায় নেতৃত্বের বাগডোর এবং সারা পৃথিবী তার বশ্যতা স্বীকার করে। আবার কখনো ইউরোপ পায় কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের লাগাম আর সারা দুনিয়ার মানুষ করে তার আনুগত্য। এ সব কেন হয়? কি কারণে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আজ একজন পায়, আবার কাল তার হাতছাড়া হয়ে অন্যের কাছে চলে যায়? এসব কি অনিয়মিত আকস্মিক ঘটনা মাত্র? না এর কোন সুনির্দিষ্ট নীতি আছে? এ বিষয় নিয়ে যত বেশি চিন্তা করা যায় ততই কেবল এ উত্তর পাওয়া যায় যে, এর একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে এবং সে নিয়মটা হলো নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সবসময় জ্ঞানের উৎসের উপর নির্ভরশীল। প্রাণী জগতে একমাত্র মানুষ জ্ঞানের কারণেই এ পৃথিবীর খলিফা হয়েছিল। তাকে চোখ, কান ও মন-মস্তিষ্ক দেয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রাণীকে এগুলো হয় আদৌ দেয়া হয় নি, নয়তো অপেক্ষাকৃত কম দেয়া হয়েছে। এ জন্য অন্য সমস্ত সৃষ্টির ওপর মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি করে দেয়া হয়েছে। এখন খোদ মানব জাতির মধ্যে যে শ্রেণী বা গোষ্ঠী জ্ঞান বা শিক্ষার গুণে অন্যদেরকে ছাড়িয়ে যাবে, তারাই সমগ্র মানব জাতির নেতা হতে পারবে। ঠিক যেমন সৃষ্টি জগতের মধ্যে মানুষ অন্য সব সৃষ্টির ওপর এই জ্ঞানের বদৌলতেই খলীফা হতে পেরেছিল।
নেতৃত্ব বন্টনের নিয়ম বা বিধি
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, এই জ্ঞান বস্তুটা কি এবং এতে এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকার অর্থ কি? এর জবাব হলো পবিত্র কুরআনে ‘সাম’আ শ্রবণ-শক্তি, ‘বাছার’ দৃষ্টিশক্তি ও ‘ফুয়াদ’ মন বা উপলব্ধি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ঐ তিনটি শব্দেই এ প্রশ্নের জবাব রয়েছে। কুরআনে ঐ তিনটি শব্দ শুধু দেখা, শোনা ও চিন্তা করার অর্থে ব্যবহৃত হয় নি।
‘সাম’ আ’ বা শ্রবণ শক্তি বলে বুঝানো হয়েছে অন্যের দেয়া তথ্য সংগ্রহ করা, ‘বাছার’ বা দৃষ্টি আকর্ষণ অর্থ নিজে পর্যবেক্ষণ করে তথ্য উদ্ধার করা এবং ‘ফুয়াদ’ বা চিন্তাশক্তির অর্থ ঐ দুই মাধ্যম দ্বারা অর্জিত তথ্য সমূহের সমন্বয় সাধন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এই তিনটি জিনিসের সমাবেশেই জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে যা কেবল মানুষকেই দেয়া হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে প্রত্যেক মানুষই এ তিনটি শক্তি ব্যবহার করছে। এ কারণে পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টির ওপর প্রত্যেক মানুষেরই প্রতিনিধিত্বমূলক আধিপত্য বজায় রয়েছে। একটু বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখলে জানা যাবে যে, ব্যক্তিগতভাবে যেসব মানুষ এই তিনটি শক্তিকে অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহার করে, তারা পরাজিত ও পর্যুদস্ত থাকে। তারা অন্যের অধীন ও অনুগ্রহে থাকতে বাধ্য হয়। অন্যের পেছন পেছন চলাই তাদের কাজ। পক্ষান্তরে যারা এই তিনটি শক্তিকে সর্বাধিক ব্যবহার করে, তারা হয় শ্রেষ্ঠ ও পরাক্রান্ত। নেতৃত্বের বাগাডোর তাদের হাতেই এসে যায়। তবে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করা ও হারানোর প্রাকৃতিক বিধান জানবার জন্য বিষয়টার প্রতি আরো সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিতে হবে। তা হলে দেখা যাবে, একটা গোষ্ঠী মানব জাতির নেতা হয় তখনই, যখন তারা একদিকে অতীত ও বর্তমানকালের মানুষের কাছ হতে যত বেশী তথ্য জোগাড় করে অপরদিকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আরো বেশি তথ্য সংগ্রহে নিয়োজিত থাকে, অতঃপর এই দুই রকম তথ্য সংগ্রহ করার পর তা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। তাদের পর্যবেক্ষণের নিরিখে আগের যেসব জিনিস ভুল বলে প্রমাণিত হয় তারা তার সংশোধন করে। যেগুলোর অসম্পূর্ণতা নিজের বুদ্ধি বিবেচনার আলোকে ধরা পড়ে, তাকে পূর্ণতা দান করে। আর যেসব নতুন তথ্য জানতে পারে, তা যথাসম্ভব বেশি করে কাজে লাগায়এ। এইএএই গুণাবলী যতক্ষণ ঐ গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যান্য মানবগোষ্ঠীর চেয়ে বেশি থাকে, ততক্ষণ সেই গোষ্ঠী সমগ্র মানবজাতির নেতৃত্ব দিতে থাকে। আর যে গোষ্ঠীর মধ্যে এসব গুণের সমাবেশ অপেক্ষাকৃত কম হয় তাদের জন্য আল্লাহর অকাট্য ফায়সালা হলো; তারা অন্যদের আনুগত্য করবে, অনুকরণও করবে। যদি সৌভাগ্যবশত অধীনতা থেকে বেঁচে যায়, তাহলেও অনুকরণ হতে তাদের রেহাই নেই। চাই সেটা জেনে বুঝে স্বেচ্ছায় করুক কিংবা না জেনে না বুঝে বাধ্য হয়ে করুক।
নেতৃত্বের পদে আসীন গোষ্ঠীটির উত্থানযুগ খতম হয়ে গিয়ে যখন পতনের যুগ ঘনিয়ে আসে তখন তারা ক্লান্ত হয়ে নিজেদের অতীতে অর্জিত জ্ঞানকে যথেষ্ট মনে করতে থাকে। নিজেদের পর্যবেক্ষণ দ্বারা আরো বেশি জ্ঞান অর্জন করা এবং মন মগজকে ব্যবহার করে আরো বেশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা ত্যাগ করে। তাদের সমস্ত জ্ঞানগত পুঁজি কেবল কান দিয়ে শোনা তথ্যাবলীর মধ্যেই সীমিত হয়ে যায়।
এ অবস্থায় জ্ঞান বলতে তারা শুধুমাত্র অতীতের জানা তথ্যভান্ডারকেই বোঝে। অতীতে অর্জিত জ্ঞানই যথেষ্ট, তাতে কোন কিছু যোগ করার দরকার নেই এবং অতীতে গৃহীত মতামত সমূহই সম্পূর্ণ, তাতে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের প্রয়োজন নেই এই ভুল ধারণায় তারা ডুবে থাকে। এ পর্যায়ে উপনীত হয়েই এই গোষ্ঠী আপনা আপনি নেতৃত্বের আসন থেকে সরে যায়, আর সরতে না চাইলে জোর করে হটিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর দ্বিতীয় যে গোষ্ঠীটি অধিকতর তথ্য সংগ্রহ, অধিকতর মতামত গ্রহণ এবং অধিকতর গঠনমূলক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসে, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব তাদেরই অধিকারে আসে। তখন যারা আগে নেতা ছিল তারা নতুন নেতার অধিকারী হয়, আগে যারা স্বচ্ছ জ্ঞানের অধিকারী এবং দুনিয়ার উস্তাদ ছিল তাদেরকে প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সেখানে বসে তারা প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা প্রদান করতে থাকে।
প্রচলিত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি
বস্তুত নেতৃত্ব দোযখগামী কিংবা বেহেশতগামী যা-ই হোকনা কেন; যারা চোখ, কান ও মন-মগজের সদ্ব্যবহার করে অন্য সমস্ত মানবগোষ্ঠীর চাইতে বেশী করবে একমাত্র তাদের অধিকারে তা আসবে, এটা মানুষের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত অকাট্য ও শ্বাশ্বত নীতি। এ নীতিতে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। যে কোন মানব গোষ্ঠী এই শর্ত পূরণ করলে তারা দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করবেই, চাই সে আল্লাহর ফরমাবরদার হোক বা না ফরমান হোক। আর এ শর্ত পূরণ না করলে তাকে হতে হবে অনুগামী। এমন কি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরাধীন হওয়াও অবধারিত।
যে জিনিসটি আপনাদেরকে নেতৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে দিয়েছে এবং খোদাদ্রোহী পাশ্চাত্যবাদীদের সে আসনে বসিয়েছে তা এই অসহনীয় বিধান ছাড়া আর কিছুই নয়। দীর্ঘদিন ব্যাপী আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে বিরাজ করছিল শোচনীয় দুরবস্থা। আমাদের চোখ ও মন-মগজ ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ক্র্রিয়। কান যেটুকু সক্রিয় ছিল তাও পুরনো জ্ঞান অর্জন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ এই সময়ে জ্ঞানের জগতে এগিয়ে গেল খোদাদ্রোহী ইউরোপবাসী। তারা কানকেও কাজে লাগালো আমাদের চেয়ে বেশি। আর চোখ ও মন মগজের কাজ আড়াইশো তিনশো বছর ধরে তারাই এককভাবে করলো। আর অনিবার্য ফল হিসেবে তারা দুনিয়ার নেতৃত্ব লাভ করলো। আর আমরা হয়ে গেলাম তাদের পদানুসারী। পরিণতি এরূপ হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্রগুলো আজও ঐ সর্বনাশা ভুলকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাচ্ছে। অথচ আজকে আমাদের এই দুর্দশা সেই ভুলেরই পরিণতি। এ সব মাদরাসায় ইলম বা বিদ্যা যেটুকু পড়ানো হয় তা শুধু প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। নাদওয়া এবং আল আজহার সংস্কারের দিকে পা বাড়ি্য়েছে সত্য কিন্তু সেটা অতীতের সাথে সাথে বর্তমান কালের জ্ঞান আহরণের কাজটাকেও কানের দায়িত্বের আওতাভুক্ত করা পর্যন্তই। চোখ আর মন মগজ আগের মতই নিষ্ক্রিয় রয়ে গিয়েছে। এই বাড়তি জ্ঞানটুকুর উপকারিতা বড়জোর এতটুকুই হতে পারে যে মুসলমানেরা আগে যেখানে খুব নিচু মানের অনুসারী ছিল সেখানে একটু উন্নতমানের অনুসারী হয়ে যাবে। কিন্তু নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব তাদের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে। আজ পর্যন্ত যতগুলো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ আমি দেখেছি তার সবই ভালো মানের অনুসারী তৈরি করার প্রস্তাব। নেতৃত্ব সৃষ্টির মত প্রস্তাব আজও আসে নি। অথচ দুনিয়ায় আল্লাহর অনুগত একমাত্র মানব গোষ্ঠী হিসেবে মুসলিম জাতির উপর যে দায়িত্ব বর্তায় তা পালন করতে হলে খোদাদ্রোহীদের কাছ থেকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসন ছিনিয়ে নেয়া ও তা দখল করা অপরিহার্য। আর সেটা করার একমাত্র উপায় হলো আমাদেরকে পুরনো জ্ঞান ভান্ডারের ওপর সন্তুষ্টি পরিত্যাগ করতে হবে। চোখ ও মন-মগজকে সক্রিয় করে তুলতে হবে এবং দুনিয়ার অন্য সব মানবগোষ্ঠীর ওপর এ ব্যাপারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে।
কি ধরনের সংস্কার প্রয়োজন?
আমি বলেছি যে, দুনিয়ায় আল্লাহর অনুগত একমাত্র মানব গোষ্ঠী হিসেবে আপনাদের (মুসলিম জাতির) উপর যে দায়িত্ব বর্তায় তা পালন করতে হলে খোদাদ্রোহীদের কাছ থেকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসন ছিনিয়ে নেয়া ও তা দখল করা অপরিহার্য। এ কথাটাই আমার সমগ্র আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়। তাই আমি এ কথাটা আরো বিশ্লেষণ করবো।
নিছক একটা মানবগোষ্ঠী হিসেবে যেনতেন প্রকারের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অর্জনই যদি কাম্য হয় তাহলে শিক্ষা সংস্কারের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। সোজা পথ খোলা রয়েছে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় অথবা মিসর, ইরান ও তুরস্কের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কারিকুলাম অনুসারে শিক্ষার ময়দানে অগ্রগামী হোন এবং ইউরোপ ও আমেরিকা যে ধরনের নেতৃত্বের অধিকারী, যে ধরনের নেতৃত্বের জন্য জাপানও আজকাল প্রতিযোগিতায় নেমেছে, সেই ধরনের নেতৃত্বের জন্য প্রার্থী হয়ে যান। কিন্তু আল্লাহর অনুগত মানবগোষ্ঠী হওয়ার কারণে আপনাদের অবস্থা তা নয়। নেতৃত্ব জান্নাতের পথের দিশারী কিংবা দোযখের পথের দিশারী হোক নেতৃত্বই প্রকৃত লক্ষ্য এরূপ অবস্থায় আপনাদের নয়। ইউরোপের সাথে আপনাদের বিরোধ শুধু এজন্য নয় যে, তারা নেতৃত্বের পথ থেকে সরে থাকুক আর আমরা তাদের জায়গা দখল করে নেতা হয়ে বসি। বরং তাদের সাথে আমাদের বিরোধ হলো আদর্শ ও লক্ষ্যের। তারা দুনিয়ার ওপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব চালাচ্ছে খোদাদ্রোহীতা ও নাফরমানীর ভিত্তিতে, আর দুনিয়াবাসীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জাহান্নামের দিকে। পক্ষান্তরে মুসলিমরা হচ্ছে আল্লাহর ফরমাবরদার মানবগোষ্ঠী। আল্লাহর আনুগত্যই তাদের নীতির ভিত্তি। ঈমানের অনিবার্য দাবি হিসেবে তাদের উপর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, নিজেরাও যেমন জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা করবে এব বেহেশতের পথে চলবে তেমনি সমগ্র দুনিয়াবাসীকেও সেই পথে চালাবে। পাশ্চাত্যবাসীর হাত থেকে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি ছিনিয়ে নিয়ে মুসলিম জাতির নেতৃত্ব নিজে দখল করা ছাড়া তার পক্ষে ঐ কর্তব্য পালন করা অসম্ভব। সে জন্যই পাশ্চাত্যবাসীর সাথে আামাদের বিরোধ। এ বিরোধ বর্ণ, বংশ অথবা ভৌগলিক কারণে নয়, সম্পূর্ণরূপে আদর্শিক কারণে। খোদাদ্রোহী নেতৃত্ব-চাই তা তুর্কী, ইরানী, মিশরী অথবা ভারতীয় যে জাতেরই হোক না কেন-বৃটিশ কিংবা জাপানী নেতৃত্বের মতই তাকে উৎখাত করা কর্তব্য। অনুরূপভাবে খোদামুখী নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা অবশ্য কর্তব্য-চাই তার নিশানবাহী কিংবা বৃটিশ অথবা অন্য কোন জনগোষ্ঠীর লোক হোক।
খোদাবিমুখ নেতৃত্বের পরিণামঃ
কোন নেতৃত্ব বেহেশতগামী না দোযখগামী তা নির্ভর করে ঐ নেতৃত্বের খোদামুখিতা অথবা খোদা বিমুখতার উপর। একটা খোদাবিমুখ মানবগোষ্ঠী যখন নিজেদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে ও জ্ঞানগত তৎপরতা ও উৎকর্ষের বদৌলতে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করে, তখন সে বিশ্ব-জগতকে খোদাহীন ঠাওরে নিয়ে সেই দৃষ্টীভঙ্গিকেই কান ও চোখের দ্বারা অর্জিত সমস্ত তত্ত্ব ও তথ্যের সমাবেশ ও সমন্বয় ঘটায়। তারা মনে করে, মানুষের কোন দায় দায়িত্ব ও কর্তব্য নেই। দুনিয়ার যেসব জিনিস তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন, সে সবের সে নিজেই মালিক। সব কিছুর উপর তার সার্বভৌম ক্ষমতা। সেগুলোকে কিভাবে কাজে লাগাবে এবং কি উদ্দেশ্যে লাগাবে সেটা স্থির করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তার। তার সমস্ত চেষ্টা সাধনা ও তৎপরতার চূড়ান্ত লক্ষ্য তার প্রবৃত্তির খায়েশ চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছু নয়। জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানের সমন্বয় সাধন যখন এই দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়, তখন তার ফল দাঁড়াবে এই যে, খোদাবিরোধী পথ ও প্রকৃয়ায় তত্ত্ব জ্ঞান ও পদ্ধতিগত কলা কৌশল উভয়েরই বিকাশ বৃদ্ধি ঘটে। সেই প্রক্রিয়া সারা দুনিয়ার মানুষের মন মগজকেও আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর এ থেকেই জন্ম নেয় নিরেট জড়বাদী ও ভোগবাদী চরিত্র। এ থেকেই উদ্ভূত হয় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের সমস্ত নীতি ও বিধি। মানুষ তার যাবতীয় শক্তি ও ক্ষমতা কোথায় কিভাবে প্রয়োগ করবে তাও নির্ণয় করে ঐ দৃষ্টিকোণ থেকেই। এক কথায়, সমগ্র মানব জীবনের প্রবাহ ঐ পথেই এগিয়ে চলে এবং তার শেষ স্তরে পৌঁছে এই দুনিয়া থেকেই জাহান্নামের আযাব শুরু হয়ে যায়। সে আযাবের নমুনা আপনারা আজ স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছেন। * (ঐ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল-অনুবাদক)।
এই খোদাবিমুখ জ্ঞান বুদ্ধি ও কলা কৌশল যতদিন দুনিয়ার চিন্তাধারা, নৈতিকতা এবং সভ্যতা ও কৃষ্টির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে ততদিন খোদার অনুগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেই দৃষ্টীভঙ্গি প্রসূত নৈতিকতা ও সভ্যতার জন্য আকাশ ও পৃথিবীর কোথাও কোন স্থান থাকে না। মানুষের চিন্তা ভাবনা করার নিয়ম পদ্ধতি তার বিরোধী হয়ে যায়। মানুষের মেজাজ, স্বভাব প্রকৃতি ও রুচি তার বিরুদ্ধে চলে। মানুষের অর্জিত জ্ঞানের বিকৃতি বিন্যাস তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। সমস্ত চারিত্রিক নীতিমালা এবং মূল্যমান নিরূপণের যাবতীয় মাপকাঠি তার পরিপন্থী হয়ে যায়। জীবন যাপনের রীতি নীতিতে এবং মানবিক চেষ্টা ও কর্মের সকল ময়দানে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায। এমতাবস্থায় খোদানুগত্যের নীতির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটা জিনিস অগ্রাহ্য ও অবাঞ্চিত সাব্যস্ত হয়। এমনকি যারা খোদানুগত্যের পথে চলার দাবী করে তারাও কার্য্ত সে পথে চলতে সক্ষম হয় না। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের স্রোত প্রবাহ তাদেরকে জবরদস্তি করে নিজ গতিপথে টেনে নিয়ে যায়। এর বিরুদ্ধে তারা যত ধস্তাধস্তিই করুক কার্য্কর কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় না। তারা বড় জোর এতটুকু সংগ্রাম করতে পারে যে, মাথা নিচের দিকে তলিয়ে যেতে না দিয়ে কোন রকমে তা উপরমুখী রেখে ভেসে যেতে থাকবে।
চিন্তার জগতে যারা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও আধিপত্য বিস্তার করে এবং জাগতির শক্তিগুলোকে বিজ্ঞানের শক্তি বলে করায়ত্ব করে কাজে লাগায়, তাদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য শুধু চিন্তার জগতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, জীবনের গোটা পরিমন্ডলেই বিস্তৃত হয়। ভূ-খন্ডের উপর তার প্রগতি জন্মে। জীবন জীবিকার চাবিকাঠি তাদের অধিকারে আসে। সার্বভৌম শাসন ক্ষমতা তাদের হস্তগত হয়। এ জন্য সমাজ জীবনের সমস্ত কায়কারবার ও রীতিপ্রথা ঐ পরাক্রান্ত গোষ্ঠীটির দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব অনুসারে এবং তাদের মনোনীত নীল নকশা ও নিয়ম কানুন অনুযায়ী চলতে থাকে। এমতাবস্থায় দুনিয়ার যাবতীয় জীবন ও তার কায়কারবারে আধিপত্যশীল ঐ গোষ্ঠীটি যদি খোদার অবাধ্য হয় তাহলে তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধীনে খোদার প্রতি আনুগত্যশীল কোন গোষ্ঠী সংগতি রক্ষা করে জীবন যাপন করতে পারে না। গাড়ীর ড্রাইভার যদি গাড়ী কলকাতার দিকে নিয়ে যেতে থাকে তবে যাত্রী সেই গাড়ীতে করে ঢাকায় যাবে কেমন করে? ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক তাকে গাড়ী যেখানে যাচ্ছে সেখানেই যেতে হবে। যাত্রী যদি খুব বেশী বিগড়ে যায় তাহলে বড়জোর নিজের মুখখানা ঢাকার দিকে ফিরিয়ে বসতে পারে। কিন্তু লাভ হবে না কিছুই । একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গন্তব্য স্থানের বিপরীত ঠিকানাতে পৌঁছে যাওয়া ছাড়া তার উপায় নেই।
বর্তমান পরিস্থিতিঃ
প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে এই পরিস্থিতিই বিদ্যমান। মুসলিম জাতির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হারানোর পর ইউরোপ শিক্ষার ময়দানে অগ্রগামী হলো। অনিবার্য কিছু কারণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী হয়ে উঠলো খোদাদ্রোহী (Theophobia)। এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই তারা সংগ্রহ করলো শ্রুতিলব্ধ জ্ঞান পুঁজি। ঐ দৃষ্টিভঙ্গীতেই প্রাকৃতিক জগতকে পর্যবেক্ষণ করে নবতর জ্ঞান অর্জন করলো। আর এই উভয় জগতের সমন্বয় ও বিন্যাস ঘটিয়ে তার নির্যাস গ্রহণ করলো একই দৃষ্টিভঙ্গীতে। মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নৈতিক নীতিমালা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের নিয়ম-বিধি ও রীতি-প্রথা এবং ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনের আচার আচরণের পদ্ধতিও ঐ দৃষ্টিভঙ্গীতেই রচনা করলো। স্বাধীন গবেষণা ও তত্ত্বানুসন্ধানের ফলে অর্জিত বৈজ্ঞানিক শক্তির প্রয়োগ ক্ষেত্রও নির্ণয় করলো তারা ঐ একই দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে। অবশেষে এই জ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে যখন তারা আধিপত্য বিস্তারে অগ্রসর হলো তখন একদিকে দেশের পর দেশ এবং জাতির পর জাতি তাদের কাছে নতজানু হতে লাগল। অপরদিকে সেই জ্ঞান বিজ্ঞান, সেই মানসিকতা, সেই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, সেই চিন্তাধারা, সেই নৈতিক আচরণ পদ্ধতি, সেই সামাজিক ও তামাদ্দুনিক রীতি নীতি এক কথায় এই বিজয়ী জাতির কাছে যা কিছু ছিল সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো। ক্রমে অবস্থা এতদূর গড়ালো যে, যে সময় একটি শিশুর বোধ-শক্তির উন্মেষ ঘটে ঠিক সে সময় থেকেই তার মন মগজ ও স্বভাব চরিত্রকে ইউরোপবাসীর মনোনীত ও পরিকল্পিত নীল নকশা অনুসারে গঠন করা শুরু হয়ে যায়। কেননা তারা বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। পারিপার্শ্বিকতা হতে লব্ধজ্ঞান তাদেরই ধারাক্রম অনুসারে বিন্যস্ত হয় শিশুর মন মগজে। পর্যবেক্ষণের জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গীর প্রয়োজন, তাও সে পায় সমন্বয়লব্ধ ঐ ইউরোপবাসীর কাছ থেকেই। আর মতামত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যে ট্রেনিং ও অনুশীলনের প্রয়োজন তাও তাদেরই পন্থায় অর্জিত হয়ে থাকে। হক ও বাতিল, শুদ্ধ ও অশুদ্ধ এবং গ্রহণীয় ও বর্জনীয় নিরূপনের জন্য সে তাদেরই মানদন্ডকে সহজলভ্য মনে করে। নৈতিক, আদর্শ জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং চেষ্টা সাধনা ও কাজ কর্মের যে পথ ও পন্থা তার সামনে উদ্ভাসিত হয় তাও তাদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়। তবে আশেপাশের গোটা কারখানাকে সেই পরাক্রান্ত ইউরোপের রীতিনীতি অনুসারেই চলতে দেখে। আর এই মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠার পর যখন সে কর্মজীবনে পদার্পন করতে যায়, তখন তাকে বাধ্য হয়ে ঐ কারখানারই যন্ত্রাংশ হয়ে যেতে হয়। কেননা দুনিয়ায় ঐ একটা কারখানাই চালু আছে এবং তাহলো ইউরোপীয় সভ্যতার কারখানা। এছাড়া আর কোন কারখানা চালু নেই। খোদাবিমুখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই সর্বব্যাপী আধিপত্যের আওতায় খোদামুখী জীবন-দর্শন, চারিত্রিক আদর্শ ও জীবন লক্ষ্যের মন মগজে স্থান পাওয়াই কঠিন। কেননা যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার সমগ্র বিন্যাস প্রক্রিয়া ও বাস্তব জীবনের গোটা জীবনের গোটা গতিধারাই তার সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে ধাবমান। কিন্তু কিছু লোক যদি এমন অবস্থাতেও মন মগজে খোদায়ী বীজ ধারণ করে তথাপি আশে পাশের গোটা পরিবেশ তাদেরকে অঙ্কুরোদগমে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। চলতি জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে যেমন তারা সমর্থন পায় না, জীবন সংক্রান্ত তৈরী ও বাস্তব রূপ কাঠামোও যেমন তাদের সহযোগিতা করে না, তেমনি দুনিয়ার চলতি ঘটনাবলীতেও কোথাও তার স্থান হয় না। বিগত পাঁচশো বছরে মানব-জাতি যত জ্ঞান লাভ করেছে, তাকে বিন্যস্ত করা ও তার সময়লব্ধ জ্ঞান থেকে সিদ্ধান্ত ও মতামত গ্রহণের যাবতীয় কাজ খোদাবিমুখ লোকদের দ্বারাই হয়েছে। খোদার আনুগত্যের দৃষ্টিভঙ্গীতে তার বিন্যাস ও তা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজ আদৌ হয় নি। যে সব জাগতিক ও প্রাকৃতিক শক্তি এই সুদীর্ঘ সময়ে মানুষের আয়ত্বে এসেছে এবং জড় বিজ্ঞানের অধিকতর আবিষ্কার উদ্ভাবন দ্বারা যা কিছু সুফল অর্জিত হয়েছে তার দ্বারাও খোদার অনুগত লোকেরা কাজ নেয় নি। কাজ নিয়েছে কেবল খোদাদ্রোহীরা। এজন্য মানবীয় সমাজ ও সভ্যতায় এগুলোর প্রয়োগ ক্ষেত্র নির্বাচনের প্রশ্ন যখন উঠবে তখন ইউরোপীয়দের জীবন লক্ষ্য ও নৈতিক আদর্শের সাথে যা সামঞ্জস্যশীল, তাই নির্বাচিত হবে। এটাই স্বাভাবিক ও অনিবার্য। সমষ্টিগত জীবনের কার্য্কলাপ সংগঠনের জন্য পাঁচশো শতাব্দীতে যেসব আদর্শগত ফর্মূলা চিন্তা করা হয়েছে এবং যেসব বাস্তব কর্মপন্থা কার্যকরী করা হয়েছে, তাও কোন খোদানুগত মানুষের চিন্তা ও কর্মের ফসল নয়। ওগুলোর পরিকল্পনাকারী ছিল খোদাদ্রোহীদের মন মগজ এবং তা পরিচালিত হয়েছিল খোদাদ্রোহীদেরই হাতে। এ জন্য তাদের পরিকল্পনাই আজকের সকল মতবাদ ও বাস্তব অবস্থার ওপর ক্রিয়াশীল। খোদার ফরমাবরদারীর ভিত্তিতে প্রস্তুত কোন নকশা বা পরিকল্পনা কার্যকরী থাকাতো দূরের কথা, নিছক তাত্ত্বিক আদর্শ বা মতবাদের আকারেও এমন সুবিন্যস্তভাবে বর্তমান নেই যা এ যুগের অবস্থার সাথে সংগতিশীল এবং যা আজকের জীবন জিজ্ঞাসার পুরোপুরি জবাব দিতে সক্ষম।
এমতাবস্থায় খোদার আনুগত্যের বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি যদি সংসার বৈরাগী হয়ে সমাজ সংস্কার হতে বিচ্চিন্ন হয়ে কোন নির্জন জায়গায় গিয়ে আস্তানা গাড়ে এবং পাঁচশো বছরের আগেকার অবস্থায় নিজেদেরকে নিক্ষেপ করে তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। তা না হলে আজকের দুনিয়ায় যে পরিস্থিতি, তাতে একজন মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে গেলেই তার সামনে পদে পদে কেবল সমস্যা আর সমস্যাই দেখা দেয়। অত্যন্ত আদর্শনিষ্ঠ ও খাঁটি বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও বারবার তাকে জেনেশুনে তার আদর্শের পরিপন্থী চিন্তা ও কর্মে লিপ্ত হতে হয়। নতুন জ্ঞান ও অভিনব তথ্যাবলীর সম্মুখীন হতেই সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এসব তত্ত্ব ও তথ্যকে (Facts) এর মূল উদ্ভাবক, বিন্যস্তকারী ও সিদ্ধান্তকারীদের দৃষ্টিভঙ্গী ও সিদ্ধান্ত হতে আলাদা করা এবং স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে ভিন্নতর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তার পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এ অসুবিধার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে এইসব নতুন তথ্যের সাথে সাথে তার মূল মতবাদগুলো ও সিদ্ধান্তগুলোকেও হজম করে ফেলে। সে টেরই পায় না যে, অমৃতের সাথে সে কি পরিমাণ বিষ পান করে ফেললো। অনুরূপভাবে জীবনের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে উপনীত হলে সে কোন্ পথ অবলম্বন করবে তা নিয়ে পড়ে যায় উভয় সংকটে। এমন বহু সামাজিক মতবদা তার মন মগজকে দখল করে বসে যা মূলত তার মনোপূত আদর্শের পরিপন্থী। মন-মগজকে দখল করে এজন্য যে, দুনিয়ার সর্বত্র ঐ মতবাদই প্রচলিত ও বিজয়ী। অনেক কার্যকর বিধি ব্যবস্থা এমন রয়েছে যাকে সে ভুল বুঝেও কেবল তার বিকল্প না পেয়ে গ্রহণ করে নিতে বাধ্য হয়। নেহায়েত নিরুপায় হয়েই অনেক ভ্রান্ত পথে পা বাড়াতে হয়।
বিপ্লবী নেতৃত্বের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব অনিবার্যঃ
আমি বর্তমান পরিস্থিতির যে বিশ্লেষণ করলাম তাতে যদি আপনারা কোন ভুলত্রুটি দেখতে পান তবে অনুগ্রহপূর্বক আমাকে জানাবেন যাতে আমি পুনর্বিবেচনা করতে পারি। কিন্তু যদি এ সিদ্ধান্ত সঠিক হয়ে থাকে তবে এ থেকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
১-খোদাবিমুখ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের প্রভাবাধীন থেকে খোদামুখী ও খোদানুগত মত ও আদর্শ বেঁচে থাকতে পারে না। এই মত ও পথে যারা বিশ্বাসী তাদের আকীদা ও ঈমানের সরাসরি দাবীই হলো সেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে উৎখাত করে সেই জায়গায় পৃথিবীতে খোদানুগত নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাওয়া।
২-যে শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল প্রাচীন ঐতিহ্যলব্ধ জ্ঞান বিজ্ঞান শেখানো হয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানোর জন্য মানুষকে প্রস্তুত করার কোন শক্তি সেই শিক্ষার নেই। সুতরাং খোদাভীতি ও খোদার আনুগত্যের আদর্শ দুনিয়া হতে উৎখাত হতে হতে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক, এ যদি কারো কাম্য হয় তবে সে বর্তমান এই শিক্ষাব্যবস্থাকে খুশী মনে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে। অন্যথায় এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলাতেই হবে।
৩-যে শিক্ষাব্যবস্থা সকল জ্ঞান বিজ্ঞানকে আল্লাহর অবাধ্য নেতৃত্বের রচিত ধারাক্রম অনুসারে সাজায় এবং সেই নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে গ্রহণ করে, এবং যে শিক্ষাব্যবস্থা গোমরাহী ও খোদাদ্রোহিতার পথ প্রদর্শকদের বানানো যন্ত্রের নাটবল্টু হিসেবে মানুষকে তৈরী করে, সে শিক্ষাব্যবস্থা আসলে ধর্মান্তরিত করারই পরীক্ষিত ব্যবস্থা। এ জাতীয় কোন শিক্ষাঙ্গনের ওপর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিয়া কলেজ অথবা ইসলামিয়া হাইস্কুল নামের সাইনবোর্ড টাঙ্গানোর মত ধোঁকাবাজি আর হতে পারে না। এ ধরনের শিক্ষার সাথে দ্বীনিয়াতের কিছু পাঠ্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া শতকরা ৯৫ ভাগ সম্পূর্ণ বৃথা। বাকী ৫ ভাগ স্বার্থকতা অর্জিত হলেও তা শুধুমাত্র এরূপ যে, কিছু লোক একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কুফরীর কাজে আল্লাহর নাম জপতে জপতে চলতে থাকবে।
৪-ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের লেজুড় জুড়ে দিয়ে সংস্কার সাধনের পরিকল্পনাও মানুষকে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানোর যোগ্য করতে পারে না। কেননা আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও অন্যান্য যেসব শাস্ত্র ও বিদ্যা আজ রচিত ও সাজানো গোছানো অবস্থায় পাওয়া যায়, সেসবও খোদাদ্রোহী ও খোদাবিমুখ লোকদের গবেষণা ও তত্ত্বানুসন্ধানের ফসল। এসব বিষয়ের প্রণয়ন ধারা বিন্যাসে এর রচয়িতা ও প্রণেতাদের দৃষ্টিভঙ্গী এমন গভীরভাবে বদ্ধমূল যে, বস্তুনিষ্ঠ তথ্যসমূহকে দার্শনিক চিন্তাজাত মতবাদ ও আদর্শ হতে পৃথক করা যায় না। আর কল্পিত ধ্যান ধারণা বিশিষ্ট পক্ষপাতিত্ব, সংকীর্ণতা, প্রবৃত্তিপূজা ও ঝোঁক প্রবণতা থেকে ছাটাই বাছাইও করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় খোদানুগত দৃষ্টিভঙ্গীতে এগুলো স্বাধীনভাবে সাজানো ও বিন্যস্ত করা এবং তার ভিত্তিতে ভিন্ন মত ও পথ উদ্ভাবন করা। কি ছাত্র, কি শিক্ষক কারো পক্ষেই এটা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় যদি প্রাচীন শাস্ত্রগুলোকে তাদের প্রাচীন ধারাক্রমে এবং আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে প্রচলিত নির্দিষ্ট ধারাক্রমে একত্রে মিলিয়ে পড়ানো হয়, তাহলে এ দু’ পরস্পর বিরোধী শক্তির সংমিশ্রণে নানা ধরনের অদ্ভূত মিকচার তৈরী হবে। কেউ প্রাচীন শাস্ত্রসমূহের প্রভাবে অধিকতর প্রভাবিত হলে মৌলবী হয়ে যাবে। কেউবা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে যাবে এবং এভাবে সে হবে ধর্মহীন ‘মিষ্টার’ অথবা নাস্তিক ‘কমরেড’। আবার কেউবা উভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থান থেকে ভারসাম্যহীন হয়ে ‘না ঘরকা না ঘটকা’ হয়ে যাবে। এ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষালাভ করে উভয় শিক্ষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে একটা বিশুদ্ধ মিকচার বানাতে পারবে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। আর তা বানাতে পারলেও চিন্তা ও কর্মের জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করা এবং তার গতিধারাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার মত শক্তি অর্জন করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার।
অবস্থার পর্যালোচনা করে আমি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি-আমি পুনরায় বলছি, এর মধ্যে কোন ত্রুটি থাকলে আপনারা আমাকে অবহিত করুন। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তকে যদি সঠিক বলে মনে করেন তাহলে আমি বলব নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করার একমাত্র পথ হলো, উল্লেখিত তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা শিক্ষা ব্যবস্থা রচনা করা। সে শিক্ষাব্যবস্থা হবে প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ঐ তিন রকম শিক্ষাব্যবস্থা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন।