মুসলমানদের জন্য নতুন শিক্ষানীতি ও কর্মসূচী
(এই প্রবন্ধটি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বীনিয়াত পাঠ্যসূচী সংস্কার কমিটি কর্তৃক প্রচারিত ও বিলিকৃত প্রশ্নমালার জবাব হিসেবে লিখে পাঠানো হয়েছিল। বাহ্যতঃ যদিও এটা আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে উদ্দেশ্য করেই লিখিত, তথাপি মুসলমানদের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এর লক্ষ্য। এ প্রবন্ধে যে শিক্ষানীতির ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা গ্রহণ করা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য্য। আলীগড় হোক, দেওবন্দ হোক, নদওয়া হোক কিংবা জামেয়া মিল্লিয়া হোক সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মপদ্ধতিই এখন সেকেলে হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান যদি তা পুনর্বিবেচনা না করে তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের উপযোগিতা নিঃসন্দেহে হারিয়ে যাবে।)
মৌলিক উদ্দেশ্য অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী উদ্দীপনা সৃষ্টির প্রতি নজর দিয়ে এবং তা কার্যকরী করার জন্য কমিটি নিয়োগ করে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব মুসলমানদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কার্যালয় থেকে এতদসংক্রান্ত যেসব কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে আমি খুব মনোযোগ সহকারে তা দেখেছি। দ্বীনিয়াত ও ইসলামী বিষয়সমূহ শিক্ষাদানের পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় তা আদৌ সম্মানজনক নয়। যে পাঠ্যসূচী অনুযায়ী বর্তমানে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু কমিটির সম্মানিত সদস্যদের পক্ষ থেকে যে প্রশ্নমাল তৈরী করে পাঠানো হয়েছে তা পাঠ করে মনে হয় কমিটির কাছে বর্তমানে পাঠ্যসূচী সংশোধনের বিষয়টিই বিবেচ্য এবং সম্ভবত মনে করা হচ্ছে যে, কয়েকখানা বই বাদ দিয়ে নতুন কিছু বই পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসলামী উদ্দীপনা সৃষ্টি করা যাবে। আমার অনুমান যদি সত্য হয় তাহলে আমি বলবো এটি প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ ধারণা নয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদেরকে আরো গভীরে প্রবেশ করে দেখা দরকার যে, কুরআন, হাদীস, ফিকহ ও আকায়েদের যে শিক্ষা বর্তমানে দেয়া হচ্ছে তা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী উদ্দীপনা সৃষ্টি না হওয়ার কারণ কি? যদি শুধুমাত্র দ্বীনিয়াতের পাঠ্যসূচীর ত্রুটিই এর কারণ হয়ে থাকে তাহলে এর কুফল হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাঠ্যসূচীর ত্রুটি দূর করাই যথেষ্ট হবে। কিন্তু এর কারণ যদি আরো ব্যাপক হয়, অর্থাৎ গোটা শিক্ষানীতিতেই যদি কোন মৌলিক ত্রুটি থেকে থাকে তাহলে শোধরানোর জন্য শুধুমাত্র দ্বীনিয়াতের পাঠ্যসূচীর সংশোধন কোনক্রমেই যথেষ্ট হতে পারে না। এর জন্য আপনাকে সংশোধন ও সংস্কারের ক্ষেত্রও ব্যাপক করতে হবে- তা যতই আয়াসসাধ্য এবং সমস্যাসংকুল হোক না কেন। সমস্যাটি সম্পর্কে এই দৃষ্টিকোণ হতে চিন্তাভাবনা করে আমি যা বুঝেছি তা যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্তাকারে পেশ করছি।
আমার এই কথাগুলো তিনটি অংশে বিভক্ত হবে। প্রথমাংশে সমালোচনার দৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষানীতির মৌলিক ত্রুটিগুলো ব্যাখ্যা করা হবে এবং মুসলমানদের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষার জন্য বর্তমানে আমাদের শিক্ষানীতি কি হওয়া উচিত তা দেখানো হবে। দ্বিতীয়াংশে সংস্কারমূলক প্রস্তাবালী পেশ করা হবে। আর তৃতীয়াংশে ঐসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের উপায় ও পন্থা সম্পর্কে আলোচনা হবে।
বর্তমানে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষা পদ্ধতি চালু আছে তা আধুনিক শিক্ষা এবং ইসলামী শিক্ষার একটি শংকর রূপমাত্র। এতে কোন সমন্বয় বা মিল নেই। দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ও সামঞ্জস্যহীন শিক্ষা উপাদানকে সংশ্লেষণহীনভাবে হুবহু একসাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। কোন একটি কালচারের সৃষ্টি ও লালনের মত শক্তিশালী করে এ দুটি পদ্ধতির সমন্বয়ে কোন সংশ্লেষ তৈরি করা হয় নি। একই স্থানে একই সাথে জুড়ে দেওয়া সত্ত্বেও দুটি উপাদান যে শুধু পৃথক পৃথক রয়ে গিয়েছে তাই নয় বরং একটি আরেকটির বিরুদ্ধে দ্বন্ধমুখর হয়ে শিক্ষার্থীদের মন মষ্তিষ্কেও দুটি বিপরীত মেরুর দিকে আকর্ষণ করছে। ইসলামী দৃষ্টিকোণের কথা বাদ দিয়ে যদি নিছক শিক্ষার দৃষ্টিকোণ হতেই বিচার করা যায়, তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, শিক্ষা ব্যবস্থার এ ধরনের বিপরীত ও পরস্পর বিরোধী উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটানো মূলতঃই ত্রুটিপূর্ণ এবং এভাবে কল্যাণকর কোন ফল লাভ করা আদৌ সম্ভব নয়।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে এই সংমিশ্রণ আরো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ হলো, প্রথমত শিক্ষা ব্যবস্থায় এ ধরনের সংমিশ্রণই ঠিক নয়। উপরন্তু আরো ক্ষতিকর দিক হলো এই সংমিশ্রণও অনুপাত ঠিক রেখে করা হয় নি। এতে পাশ্চাত্য শিক্ষার উপাদানকে অত্যন্ত শক্তিশালী করা হয়েছে এবং তার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষার উপাদানকে অত্যন্ত দুর্বল করা হয়েছে। পাশ্চাত্য উপাদানটির পয়লা সুবিধা হলো তা এমন একটি যুগোপযোগী উপাদান বার পেছনে রয়েছে যুগের গতিধারার আনুকুল্য আর যাকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী একটি শক্তিশালী সভ্যতা। অধিকন্তু তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় ঠিক ততটা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী করে গ্রহণ করা হয়েছে; যতটা পাশ্চাত্য কালচারের লালনের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে আছে এবং থাকা দরকার। এখানে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে যে, পাশ্চাত্যের আদর্শ ও মতবাদসমূহ সরলমনা মুসলমান ছেলেদের মানসপটে দৃঢ় বিশ্বাস রূপে ক্ষোদিত হয়ে যায় এবং তাদের মানসিকতা পুরোপুরি পাশ্চাত্য ধাঁচে গড়ে ওঠে।
তখন তারা পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে শুরু করে এবং পাশ্চাত্যের মগজ দিয়ে সবকিছু চিন্তা করে। সংগে সংগে তাদের মনে এ বিশ্বাসও বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, দুনিয়াতে যুক্তিসংগত ও গ্রহণযোগ্য কিছু থাকলে তা অবশ্যই পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণা ও আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এরপর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যত যেসব শিক্ষা দেয়া হয় তা তাদের অনুভূতি ও উপলব্ধিকে আরো শক্তিশালী করে। পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, আদব-লেহাজ, চলন-বলন, খেলা-ধূলা মোটকথা এমন কিছু কি আছে যার ওপর পাশ্চাত্য তাহযীব তমদ্দুন এবং পাশ্চাত্যপনার আধিপত্য নেই? পুরনো হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ শতকার পঁচানব্বই ভাগ সন্দেহাতীতভাবে পাশ্চাত্যের। আর এ ধরনের পরিবেশের প্রভাব ও ফলাফল যা হতে পারে এবং হয়ে থাকে তা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই বুঝতে অক্ষম। পক্ষান্তরে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী উপাদানকে একান্তই দুর্বল করে রাখা হয়েছে। একে তো তা স্বীয় সভ্যতা ও রাজনৈতিক শক্তি হারিয়ে স্বতঃই দুর্বল হয়ে পড়েছে, তদুপরি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যেসব বইয়ের সাহায্যে এই শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে তা এখন হতে কয়েকশ বছর পূর্বে লেখা হয়েছিলো। এর ভাষা, এর বিন্যাস এবং এর রচনাশৈলী বর্তমান যুগের মন মগজকে আবেদন করতে পারে না। এসব গ্রন্থে ইসলামের শাশ্বত স্থায়ী নীতিগুলোকে যেসব অবস্থা ও বাস্তব সমস্যার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে তার অধিকাংশই এখন আর বর্তমান নেই। আর বর্তমানে যেসব সমস্যা আছে নীতিগুলোকে সে ক্ষেত্রে প্রয়োগেরও চেষ্টা নেই। অধিকন্তু এই শিক্ষার পিছনে কোন প্রশিক্ষণ, জীবন্ত কোন পরিবেশ, কোন বাস্তব প্রয়োগ এবং প্রচলনও নেই। এভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার সাথে ইসলামী শিক্ষার সংমিশ্রণ আরো বেশী অকার্যকর ও প্রভাবহীন হয়ে পড়েছে। এ ধরনের অসম সংমিশ্রণের স্বাভাবিক ফল হলো শিক্ষার্থীদের মন-মগজে পাশ্চাত্য শিক্ষার উপাদানটি আরো দৃঢ়মূল হয়ে যাওয়া এবং ইসলামী শিক্ষার উপাদানটি একেবারেই তুচ্ছ হয়ে যাওয়া কিংবা খুব বেশী হলে অতীত যুগের স্মৃতিচিহ্নের মর্যাদা নিয়ে অবশিষ্ট থাকা।
আমি সাফ সাফ কথা বলছি বলে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে আমি যা কিছু দেখতে পাচ্ছি তা হুবহু তুলে ধরা নিজের কর্তব্য বলে মনে করছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বীনি এবং দুনিয়াবী শিক্ষার সমন্বয়টা সামগ্রিকভাবে এমন, যেন আপনি এক ব্যক্তিকে আপাদমস্তক অমুসলিম হিসেবে গড়ে তুলেছেন, এরপর তার বগলে এক বান্ডিল দ্বীনি বই গুঁজে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য আপনি তাকে অমুসলিম হিসেবে গড়ে তুলছেন কেউ যেন এ অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে। আর যদি সে ঐ ধর্মীয় পুস্তকের বান্ডিল বগল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, (যার মূল কারণ আপনার শিক্ষা ব্যবস্থা) তাহলে তাকেই যেন এজন্য অভিযুক্ত করা হয়। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে মুসলমান সৃষ্টি হবে বলে যদি আপনি আশা করেন তাহলে বুঝতে হবে আপনি অলৌকিক ও অতি অস্বাভাবিক কিছু আশা করে বসে আছেন। কারণ আপনার সরবরাহকৃত উপায় উপকরণ দ্বারা স্বাভাবিক নিয়মে এরূপ ফলাফল আশা করা যেতে পারে না। শতকার এক দু’জন শিক্ষার্থীর (আকীদা ও আমলের ব্যাপারে) পূর্ণ মুসলমান থেকে যাওয়া এ শিক্ষাব্যবস্থার বা আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার কোন প্রমাণ নয়। বরং এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এখনো যারা ঈমান আকীদা ও ইসলামকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হলো তারা আসলে ইব্রাহীমী স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল। এ ধরনের ব্যতিক্রম যেমন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্তদের মধ্যে দেখা যায় তেমনি ব্যতিক্রম ভারতের অন্যান্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় তথা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে সনদপ্রাপ্তদের মধ্যেও দেখা যায় যাদের পাঠ্যসূচীতে আদৌ কোন ইসলামী উপাদান নেই।
এখন যদি আপনি এই পরিস্থিতি ও শিক্ষা পদ্ধতি অবিকল অক্ষুণ্ন রাখেন এবং শুধু দ্বীনিয়াতের বর্তমান পাঠ্যসূচী পরিবর্তন করে আরো বেশী শক্তিশালী পাঠ্যসূচী অন্তর্ভুক্ত করেন তাহলেও যে ফলাফল দাঁড়াবে তা হলো ইসলাম ও ফিরিংগীপনার মধ্যে সংঘাত আরো তীব্রতর হবে। তাতে প্রতিটি ছা্ত্রের মন মস্তিষ্ক হয়ে উঠবে এক একটি যুদ্ধক্ষেত্র যাতে পরস্পরবিরোধী দুটি শক্তি পূর্ণ শক্তিতে নিরন্তর যুদ্ধরত থাকবে এবং পরিণামে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তিনটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়বে।
এক গোষ্ঠী এমন হবে যাদের ওপর পূর্ণমাত্রায় ফিরিংগীপনার প্রভাব থাকবে। সে ফিরিংগীপনা বিলেতী সাহেবদের ঢংয়েও হতে পারে, ভারতীয় স্বদেশ পূজার ঢংয়েও হতে পারে কিংবা নাস্তিকতাবাদী সমাজতন্ত্রের রূপ নিয়েও হতে পারে।
দ্বিতীয় গোষ্ঠী হবে এমন যাদের ওপর পূর্ণ প্রভাব থাকবে ইসলামের। তা ইসলামের প্রভাব গভীরভাবে প্রভাবিত হতে পারে অথবা ফিরিংগীপনার প্রভাব দুর্বলও হতে পারে।
তৃতীয় আরেক গোষ্ঠী হবে এমন-যারা না হবে পুরোপুরি মুসলমান, না হবে পুরোপুরি ফিরিংগী। আর এটা স্পষ্ট যে, শিক্ষাব্যবস্থার এই ফলাফল কোন সন্তোষজনক ফলাফল নয়। নিরেট শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকেও এ দুটি পরস্পর বিরোধী উপাদানের সংমিশ্রণকে কল্যাণপ্রসূ বলা যেতে পারে না। আর জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার অস্তিত্ব বৈধ প্রমাণ করতে পারে না যার অর্জিত ফলাফলের দুই তৃতীয়াংশ জাতীয় স্বার্থ বিরোধী এবং জাতীয় তাহজীব তমদ্দুনের সমূহ ক্ষতিরই নামান্তর। অন্তত গরীব মুসলমান কওমের জন্য তা খুবই দুর্মূল্য। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এমন একটি টাকশাল চালু করা হলো যার থেকে সবসময় শতকার তেত্রিশ ভাগ অচল মুদ্রা তৈরী হয়ে আসে, আর তেত্রিশ ভাগ আমাদের ব্যয়ে তৈরি হয়ে অন্যের ঝুলিতে চলে যায়-তথা চূড়ান্তভাবে আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়।
উপরোক্ত আলোচনা হতে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রথমত শিক্ষার ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী উপাদানের সংমিশ্রণ কোন ভাবেই ইসলামী স্বার্থের জন্য কল্যাণকর নয়। তা এ পর্যন্ত যা হয়ে আসছে, সে ধরনের অসম সংমিশ্রণ হলে কল্যাণকর নয়। আবার যা করার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে সে ধরনের সুষম সংমিশ্রণ হলেও কল্যাণকর নয়।
এসব বিষয় বিশ্লেষণ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষানীতি কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমি আমার বক্তব্য পেশ করতে চাই।
এটা সর্বজন বিদিত যে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কোন না কোন কালচারের লালন করে থাকে। কোন উদ্দেশ্য বা পদ্ধতি নেই এমন নিরেট শিক্ষা আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়নি এবং এখনো হচ্ছে না। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে দেয়া হয়ে থাকে। বিশেষ কালচারের লালন ও প্রতিপালনের জন্য তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গভীর চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি নিরূপিত হয়। এখন প্রশ্ন হলো আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কালচার সংস্কৃতির লালন ও বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? যদি তা পাশ্চাত্যের কালচার হয়ে থাকে তাহলে এটিকে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বলা ঠিক হবে না, কিংবা এর সিলেবাসের কিছু অংশে দ্বীনিয়াত শিক্ষার ব্যবস্থা রেখে শিক্ষার্থীদের মানসিক দ্বন্ধ বাড়ানো যাবে না। আর যদি ইসলামী কালচার হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোই পরিবর্তন হওয়া দরকার। আর গোটা সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এমনভাবে পুণর্গঠন করা দরকার যেন সামগ্রিকভাবে উক্ত সংস্কৃতির মেজাজ ও ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর তা যেন ইসলামী সংস্কৃতির রক্ষকই না হয় বরং এর উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য একটি উত্তম সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
বর্তমান অবস্থায় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী সংস্কৃতির নয় বরং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সেবা করে যাচ্ছে। আমি আগেই একথা প্রমাণ করেছি। এই অবস্থায় দ্বীনিয়াতের বর্তমান সিলেবাস বদলিয়ে একটু উন্নত করলে এবং শিক্ষার অন্যান্য বিভাগসমূহে পাশ্চাত্যপনা পুরোপুরি বহাল রাখলে শুধু এতটুকু পরিবর্তনের দ্বারা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ইসলামের সেবক হতে পারবে না। ইসলামের বুনিয়াদী বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে আপনা থেকেই একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পার্থিব ও দ্বীনি শিক্ষাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা এবং প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে সংমিশ্রণ তৈরী করা একেবারেই নিরর্থক। খৃষ্টধর্মের মত ইসলাম নিছক এমন ধর্ম নয় যেখানে দ্বীন ও দুনিয়া পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে বর্তমান। দুনিয়াকে দুনিয়াদারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ইসলাম শুধু আকীদা বিশ্বাস ও নৈতিকতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে না। এ কারণে খৃষ্টধর্মের ধর্মীয় বিষয়গুলোর মত ইসলামে দ্বীনি বিষয়গুলোকে দুনিয়াবী বিষয় হতে আলাদা করা যায় না। ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মানুষকে দুনিয়ায় টিকে থাকতে এবং দুনিয়ার সমুদয় কাজ আঞ্জাম দিতে এমন এক পদ্ধতি গড়ে তোলা যা এই পার্থিব জীবন থেকে নিয়ে আখেরাতের জীবন পর্যন্ত প্রসারিত এবং সেটিই নিরাপত্তা, মর্যাদা ও মহত্ত্বের সোপান। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারাকে পরিশুদ্ধ করে, তার নৈতিক মূল্যবোধসমূহ পরিশীলিত করে, তার জীবনধারাকে একটি বিশেষ ছাঁচে ঢেলে নির্মাণ করে, তার অধিকার ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দেয় এবং সামাজিক জীবনের জন্য একটি বিশেষ বিধান রচনা করে দেয়। ব্যক্তির চিন্তাগত ও বাস্তব প্রশিক্ষণ, সমাজের বিনির্মাণ ও সংগঠন এবং জীবনের সকল বিভাগের প্রশিক্ষণ ও ভারসাম্যের জন্য ইসলামের মূলনীতি ও আইন কানুন অন্য যে কোন বিধান থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। এসব মূলনীতি ও আইন কানুনের কারণে ইসলামী সভ্যতা একটি স্বতন্ত্র ও অনুপম সভ্যতার রূপ পরিগ্রহ করে। একটি জাতি হিসেবে মুসলমান জাতির বেঁচে থাকা এই সব মূলনীতি ও আইন-কানুনকে মেনে চলার ওপর নির্ভরশীল। যদি জীবন ও জীবনের বিভিন্ন কর্মতৎপরতার সাথে এর সম্পর্কই না থাকে, তা হলে সেক্ষেত্রে ইসলামী দ্বীনিয়াত পরিভাষাটি একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে। যে সব আলেম এবং পন্ডিত ইসলামের ‘আকায়েদ’ এবং মূলনীতিসমূহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিন্তু তার সাহায্যে জ্ঞান ও কর্মের জগতে এগিয়ে যেতে পারেন না এবং জীবনের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পরিবেশ ও সমস্যায় যেগুলো প্রয়োগ করতে জানেন না, ইসলামী সংস্কৃতির সেবা ও লালনে সেসব আলেম ও পন্ডিতবর্গ একেবারেই অযোগ্য। তেমনি যারা পার্থিব জ্ঞান সমৃদ্ধ, যারা অন্তরে ইসলামী সভ্যতার প্রতি ঈমান পোষণ করে কিন্তু তাদের মস্তিষ্ক অ-ইসলামী নীতির ভিত্তিতেই এর বিন্যাস ঘটায়, পার্থিব জ্ঞানে সমৃদ্ধ সেই সব আলেম এবং পন্ডিতবর্গও ইসলামী সাংস্কৃতির লালন ও সেবায় অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে মুসলিমজাতির মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে শুধু এই দুই ধরনের পন্ডিত ও বিদ্বানই তৈরী হচ্ছে। তাই ইসলামী কৃষ্টি ও সভ্যতার এমন অধঃপতন ঘটেছে। এ কারণে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে পার্থিব জ্ঞান বিজ্ঞানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আজ আবার যদি আমরা চাই যে, ইসলামী কালচার পুনরায় তারুণ্য লাভ করুক এবং যুগের পেছনে পেছনে না চলে তা আগে চলুক তাহলে এই ছিন্ন সম্পর্ক আবার বহাল করতে হবে। পুনর্বহাল করার পন্থা এটা নয় যে, শিক্ষারূপ দেহের গলায় তা হারের মত লটকিয়ে দিবেন কিংবা ঘন্টির মত কোমরে ঝুলিয়ে দিবেন। কোন অবস্থাতেই তা যথেষ্ট হবে না। বরং গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে তা এমনভাবে অন্তর্লীন করে দিবেন যাতে তা তার রক্তপ্রবাহ, প্রাণ চাঞ্চল্য, দৃষ্টি শক্তি, শ্রবণ শক্তি, অনুভূতি উপলব্ধি ও চিন্তা ভাবনায় অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং সাথে সাথে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্প কলার উত্তম উপাদানগুলো আত্মস্থ করে স্বীয় তাহযীবের অংগীভূত করতে থাকে। এভাবে মুসলিম দার্শনিক, মুসলিম বৈজ্ঞানিক, মুসলিম অর্থনীতিবিদ, মুসলিম আইনবিদ, মুসলিম প্রশাসক, মোটকথা জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পকলার সকল অঙ্গনের জন্য মুসলিম বিশেষজ্ঞ তৈরী করা সম্ভব হবে যারা জীবনের সব সমস্যার সমাধান ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে করবে। তারা আধুনিক সভ্যতার অন্যতম উপায় উপকরণকে ইসলামী সভ্যতার সেবায় নিয়োজিত করবে এবং ইসলামী ধ্যান-ধারণা, মতবাদ ও জীবন যাপনের আইন কানুন ও নিয়ম নীতিকে যুগ চাহিদার আলোকে পুনর্বিন্যস্ত করবে। এমনকি জ্ঞান ও কর্মক্ষেত্রে আলোর সন্ধান দিতে ইসলাম পুনরায় নেতৃত্বের আসীনে সমাসীন হবে-যার তার সৃষ্টির অভিষ্ট লক্ষ্য।
এটাই মুসলমানদের নতুন শিক্ষানীতির মূল বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। স্যার সাইয়েদ আহমদ আমাদেরকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন যুগ সেখান থেকে আরো বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। এখন কথা হলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত যদি আমরা এখানেই অবস্থান করি তাহলে মুসলিম জাতি হিসেবে আমাদের উন্নতি তো দূরের কথা বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।
ইসলামী শিক্ষানীতির মূল বিষয় যা আমি উপরে বর্ণনা করেছি তাকে কিভাবে বাস্তবে রূপ দেয়া যেতে পারে আমি এখন সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।
(১) মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দী থেকে ফিরিংগীপনার মূলোৎপাটন একান্ত জরুরী। আমরা যদি আমাদের জাতীয় তাহযীব-তমদ্দুনকে নিজ হাতে ধ্বংস করতে না চাই তাহলে ফিরিংগীপনার প্রতি আমাদের নতুন বংশধরদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ সৃষ্টি করার কারণ নির্ণয় ও তার দ্বার রুদ্ধ করা আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য। এই আগ্রহ ও আকর্ষণ প্রকৃতপক্ষে আমাদের গোলামী মানসিকতা ও প্রচ্ছন্ন হীনমন্যতা বোধের সৃষ্টি। কিন্তু পোশাক পরিচ্ছদ, সামাজিকতা, আচার আচরণ, চলন বলন এবং সামগ্রিকভাবে গোটা সামাজিক পরিবেশে বাস্তবে যখন এর প্রকাশ ঘটে তখন তা বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিক থেকে আমাদের মন মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং জাতীয় মর্যাদাবোধ আর নামমাত্রও অবশিষ্ট থাকে না। এমতাবস্থায় ইসলামী সভ্যতার পক্ষে বেঁচে থাকা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কোন সভ্যতাই নিছক তার মূলনীতি এবং মৌলিক ধ্যান ধারণার তাত্ত্বিক অস্তিত্ব থেকে জন্মলাভ করে না বরং তা ব্যবহারিক আচরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং এভাবেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যদি তার কোন অস্তিত্ব না থাকে তাহলে সেই সভ্যতা স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবে এবং তত্ত্বগতভাবেও টিকে থাকতে পারবে না। সুতরাং সর্বপ্রথম যে সংস্কার প্রয়োজন তা হলো বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে একটি প্রাণবন্ত ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি করা। এখানে শিক্ষাদান এমনভাবে হওয়া উচিত যা মুসলমানদের নবীন বংশধরদেরকে নিজেদের জাতীয় সভ্যতা নিয়ে গর্ব করতে শেখাবে। তাদের মধ্যে জাতীয় বৈশিষ্ঠ্যের প্রতি মর্যাদাবোধ বা গভীর অনুরাগের সৃষ্টি করবে। তাদের মধ্যে ইসলামী চরিত্র ও উন্নত জীবনবোধের প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি করবে, তাদেরকে এমন যোগ্য করে গড়ে তুলবে যা তাদেরকে জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও পরিশীলিত চিন্তা শক্তি দ্বারা নিজের জাতীয় তমদ্দুনকে রুচি ও শিষ্ঠাচারের উচ্চতম শিখরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
(২) শিক্ষাঙ্গনে ইসলামী চেতনা ও প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি বেশীরভাগ নির্ভর করে শিক্ষকদের জ্ঞান ও তার বাস্তব অনুশীলনের ওপর। যে শিক্ষকের নিজের মধ্যেই এ চেতনা নেই বরং সে চিন্তা ও কর্মে এর বিরোধী, এরূপ শিক্ষকের অধীনে থেকে শিক্ষার্থীর মন মগজে কি করে ইসলামী চেতনা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে পারে? আপনি বিল্ডিংয়ের নকশা বা প্ল্যান তৈরি করতে পারেন মাত্র, কিন্তু আসল নির্মাতা তো আপনি নন। আসল নির্মাতা হলেন শিক্ষক স্টাফের সদস্যগণ। ফিরিংগী রাজ মিস্ত্রিরা ইসলামী নকশা অনুযায়ী বিল্ডিং তৈরি করবে এ আশা করা উচ্চে গাছে আঙ্গুর গুচ্ছ আশা করারই নামান্তর। অন্যান্য বিষয় শিক্ষাদানের জন্য অ-মুসলিম বা অ-ইসলামী চিন্তাধারার অধিকারী মুসলিম নামধারী শিক্ষক নিয়োগ করে শুধু দ্বীনিয়াত পড়ানোর জন্য কয়েকজন মৌলবী নিয়োগ করা একেবারেই নিরর্থক। কারণ ঐসব শিক্ষক জীবন ও তার সমস্যা ও বাস্তব কাজকর্মের ক্ষেত্রে ছাত্রদের ধ্যান ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরিয়ে দিবে এবং শুধু দ্বীনিয়াতের কোর্স সংযোজন দ্বারা এ বিষের বিষনাশক সরবরাহ করা যাবে না। সুতরাং দর্শন কিংবা বিজ্ঞান হোক, অর্থনীতি বা আইন হোক, ইতিহাস বা অন্য কোন বিষয় হোক, মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার জন্য কোন ব্যক্তির বিশেষজ্ঞ হওয়াই যথেষ্ট নয় বরং তার পাকা মুসলমান হওয়া জরুরী। বিশেষ অবস্থার কারণে যদি কোন অমুসলিম বিশেষজ্ঞ এর সাহায্য নিতেও হয় তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু সাধারণ নীতি এমন হবে যাতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ বিশেষজ্ঞ হওয়া ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক উদ্দেশ্য তথা ইসলামী সংস্কৃতির জন্য ধ্যান ধারণা ও কাজ কর্ম উভয় বিচারেই উপযুক্ত বিবেচিত হন।
(৩) আরবী মুসলিম সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও প্রতীক ভাষা। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় আরবীকে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইসলামের মূল উৎসের সাথে যোগাযোগের জন্য এটাই একমাত্র মাধ্যম। মুসলমানদের শিক্ষিত শ্রেণী যতদিন পর্যন্ত কোন মাধ্যম ছাড়াই কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান আহরণ করতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত তারা ইসলামের মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারবে না। তাদের পক্ষে ইসলাম সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি লাভ ও সম্ভব হবে না। সুতরাং সব সময়ই তাদেরকে অনুবাদক ও টীকাকারদের উপর নির্ভর করতে হবে।
এভাবে তারা সরাসরি সূর্য হতে সূর্যের আলো লাভ করতে পারবে না। বরং বিভিন্ন প্রকার রঙ্গিন গ্লাসের মাধ্যমে সূর্যের আলো পেতে থাকবে। বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ইসলামী বিষয়ে এমন সব ভুল ভ্রান্তি করছেন যা দেখে বুঝা যায়, তারা ইসলাম সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানও রাখেন না। এর কারণ হলো সরাসরি কুরআন এবং সুন্নাহ হতে জ্ঞান আহরণের কোন সুযোগ তাদের নেই। ভবিষ্যতে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসিত অর্জিত হলে ভারতবর্ষের আইনসভা আইন প্রণয়নের জন্য অধিক ব্যাপক এখতিয়ার লাভ করবে এবং সামাজিক পুনর্গঠনের জন্য নতুন নতুন আইন কানুন রচনার প্রয়োজন হবে, তখন যদি ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এবং পাশ্চাত্যের নৈতিক, সামাজিক ও আইনগত ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী ও আস্থাবান লোক আইন সভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে তাহলে নতুন নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মুসলমানদের সামাজিক পুনর্গঠনের পরিবর্তে বরং উল্টো সামাজিক বিকৃত ঘটবে এবং মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা তার মূলনীতি থেকে আরো দূরে সরে যাবে। সুতরাং আরবী শিক্ষাদানের বিষয়টিকে শুধু ভাষা শিক্ষাদানের ব্যাপার মনে করা যাবে না। বরং মনে করতে হবে, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সম্পৃক্ত। আর যা মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সম্পৃক্ত তা শেখানোর জন্য সুযোগের অপেক্ষা করা যেতে পারে না। বরং তার জন্য সর্বাবস্থায় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
মাধ্যমিক শিক্ষা
মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের নিম্নবর্ণিত বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ক) আকায়িদঃ এ পর্যায়ে এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় জটিলতার নিরস বিস্তারিত আলোচনা পরিহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বরং ঈমানিয়াত সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করে শিক্ষার্থীর হৃদয়াঙ্গম করাতে হবে যা স্বাভাবিক অনুভূতি ও বুদ্ধি বিবেকের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। ইসলাম যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান সৃষ্টি করতে বলে তা আসলে বিশ্বজাহানের মৌলিক সত্য ছাড়া যে আর কিছু নয় আর এসব বিষয়গুলো যে আমাদের জীবনের সাথে অটুট বন্ধনে বাঁধা শিক্ষার্থীদের জন্য তা জানার অবকাশ সৃষ্টি করতে হবে।
(খ) ইসলামী আখলাকঃ এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কেবল নৈতিকতার তাত্ত্বিক ধারণা পেশ করলে চলবে না। বরং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কিরামের বাস্তব জীবন থেকে এমন কিছু ঘটনা নির্বাচিত করে তুলতে হবে, যা দ্বারা শিক্ষার্থীরা একজন মুসলমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ কি এবং একজন মুসলমানের জীবন কেমন তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
(গ) ফিকাহ শাস্ত্রীয় বিধিমালাঃ এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আল্লাহর হক, বান্দার হক এবং ব্যক্তি-জীবনের আচরণ সম্পর্কে ইসলামী আইনের এমন কিছু প্রাথমিক এবং প্রয়োজনীয় আহকাম তুলে ধরতে হবে যা জানা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। তবে পুরনো ফিকাহ গ্রন্থসমূহের অনুসরণ করে কুপে ইঁদুর পতিত হলে কত বালতি পানি তুলে ফেলে পানি পবিত্র করতে হবে এ ধরনের টুকিটাকি ও বিস্তৃত বিষয় এতে না থাকাই উচিত। এসব বিষয়ের পরিবর্তে ইসলামী ইবাদত ও আহকাম সমূহের যৌক্তিকতা এর মূল স্পিরিট এবং এর উপযোগিতা যুক্তিসহ শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা উচিত। তাদেরকে বরং জানার সুযোগ দেয়া উচিত যে ইসলাম ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের জন্য কি কর্মসূচী পেশ করে এবং এই কর্মসূচী কিভাবে একটি সৎ ও নিষ্কলুষ সমাজ গঠন করে?
(ঘ) ইসলামী ইতিহাসঃ এ পর্যায়ে ইসলামী ইতিহাস শিক্ষাদানের পরিসর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবন চরিত ও সাহাবায়ে কিরামের যুগ পর্যন্ত সীমিত থাকবে। ইসলামী ইতিহাস শিক্ষাদানের লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদেরকে নিজের আদর্শ ও জাতীয়তার উৎস সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করা এবং তাদের মনে সঠিক ইসলামী মর্যাদাবোধ সৃষ্টি করা।
(ঙ) আরবিঃ এ পর্যায়ে আরবি ভাষার নিছক প্রাথমিক জ্ঞান দান করতে হবে যা আরবি সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করবে।
(চ)কুরআনঃ কুরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে এ স্তরে এতটুকু জ্ঞান দান করতে হবে যাতে শিক্ষার্থী কুরআন শরীফ দেখে ভালোভাবে পড়তে পারে। সহজ সরল আয়াতগুলোকে কিছুটা বুঝতে পারে এবং কয়েকটা সুরা মুখস্তও করে নিতে পারে।
কলেজ স্তরের শিক্ষাঃ
কলেজ স্তরে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে একটা সাধারণ পাঠ্যসূচী থাকবে যা সব শিক্ষার্থীকে পড়ানো হবে। এই পাঠ্যসূচীতে নিম্ন বর্ণিত বিষয়গুলো থাকবেঃ
(ক) আরবিঃ উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আরবি সাহিত্য সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দান করতে হবে। কিন্তু বি.এ. বা স্নাতক পর্যায়ে গিয়ে এ বিষয়টাকে কুরআন শিক্ষার সাথে একীভূত করে নিতে হবে।
(খ) কুরআনঃ উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীকে কুরআন বুঝার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। এই স্তরে কয়েকটা বিষয় হৃদয়ঙ্গম করিয়ে নিতে হবে। তা হলো কুরআন মজীদের সুসংরক্ষিত হওয়া এবং ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হওয়া, আল্লাহর ওহী হওয়া, সমস্ত ধর্মগ্রন্থের তুলনায় এর মর্যাদা, নজিরবিহীন বিপ্লবী শিক্ষা এবং তার প্রভাব শুধু আরবদের ওপর নয় বরং দুনিয়ার ধ্যান ধারণা ও জীবন প্রণালীর ওপর এর বাচনভঙ্গি ও যুক্তি ধারা এবং এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও সারকথা।
বি.এ. স্তরে মূল কুরআন শিক্ষা দিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা পদ্ধতি হবে এমন যাতে শিক্ষার্থীরা নিজে নিজেই কুরআন মজীদ পড়ে বুঝতে চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ শুধু জটিল বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে বুঝাবেন, প্রশ্নের জবাব দেবেন এবং সন্দেহ নিরসন করবেন। যদি বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও খুঁটিনাটি আলোচনা পরিহার করা হয়, তাহলে দু’বছরের মধ্যেই অতি সহজেই পুরো কুরআন মজীদ পড়ানো সম্ভব হবে।
(গ) ইসলামী শিক্ষাঃ এ বিষয়টি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকে গোটা ইসলামী জীবন বিধান সম্পর্কেই অবহিত করাতে হবে। কি কি মৌলিক ধ্যান ধারণার উপরে ইসলামের বুনিয়াদ রচিত হয়েছে, সে-সব ধ্যান ধারণার ভিত্তিতে ইসলাম আখলাক ও চরিত্র কিভাবে গঠন করে এবং এর অধীনে সমাজ জীবনে লেনদেন, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কোন নীতিমালা অনুসারে বিন্যস্ত করে, তা অনুধাবন করাতে হবে। এর সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি এবং সমষ্টির মধ্যে অধিকার ও কর্তব্য কিভাবে কোন দৃষ্টিকোণ হতে বর্ণিত হয়েছে, হুদুদুল্লাহ বা আল্লাহর দেয়া আদেশ নিষেধ কি এবং এই আদেশ নিষেধের মধ্যে অবস্থান করে একজন মুসলমান চিন্তা ও কাজে কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করবে, আর এই আদেশ নিষেধের গন্ডির বাইরে পদার্পণ করলে ইসলামী বিধানের উপর আর কিকি প্রতিক্রিয়া হয় এ সব বিষয় অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও সুবিন্যস্তভাবে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তা চার বছরের শিক্ষা স্তরে ভারসাম্যপূর্ণভাবে বন্টন করতে হবে।
সাধারণ বাধ্যতামূলক বিষয়গুলো ছাড়াও ইসলামী বিষয়গুলোকে ভাগ করে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞ তৈরীর কোর্সসমূহে ছড়িযে দিতে হবে এবং প্রত্যেক বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল ইসলামী বিষয়কে তার অঙ্গীভূত করতে হবে। পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সবকিছুই যথাস্থানে কল্যাণপ্রসূ। তাই এর কোনটার সাথেই ইসলামের শত্রুতা নেই। বরং আমি এতটুকু ইতিবাচক কথা বলতে চাই যে, জ্ঞানগত বাস্তবতা থাকলে ইসলাম ও পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান পরস্পরের বন্ধু। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান বিজ্ঞান ও ইসলামের মধ্যে কোন বৈরীতা নেই। বৈরিতা হলো ইসলাম ও পাশ্চাত্যপনার মধ্যে। জ্ঞান বিজ্ঞানের অধিকাংশ শাখায় পাশ্চাত্যবাসীরা বিশেষ কিছু মৌলিক ধারণা, স্বতঃসিদ্ধ কল্পনা, কিছু সূচনা বিন্দু (Starting Point) এবং কিছু বিশেষ দৃষ্টিকোণ পোষণ করে যা প্রকৃতপক্ষে কোন প্রমাণিত বিষয় না। বরং ঐগুলো তাদের নিছক বিশেষ মানসিকতা মাত্র। তারা জ্ঞানলব্ধ বাস্তবতাকে ঐ বিশেষ মানসিকতার ছাঁচে ঢেলে তদানুযায়ী ঐগুলোকে বিন্যস্ত করে একটি বিশেষ নীতিমালা বা আদর্শিক রূপদান করে থাকে। ইসলামের বৈরিতা ঐ বিশেষ মানসিকতার সাথে। ইসলাম বাস্তবতার দুশমন নয়। বরং এই বিশেষ ধাঁচের মানসিকতার দুশমন, জ্ঞানলব্ধ বাস্তবতাকে যে মানসিকতার আদলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কারণ ইসলাম একটি লক্ষ্য কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা, একটি দৃষ্টিকোণ, চিন্তাধারার সূচনা বিন্দু এবং বিশেষ মানসিকতা পোষণ করে যা মৌলিক ও প্রকৃতিগত দিক থেকে পাশ্চাত্য ধাঁচের সম্পূর্ণ বিরোধী। এখন একটা কথা ভাল ভাবে বুঝে নিন। তাহলো পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের বাস্তবতাকে গ্রহণ করাটাই ইসলামের দৃষ্টিতে গোমরাহীর মূল কারণ নয়। বরং গোমরাহীর মূল কারণ হলো আপনি পাশ্চাত্যের নিকট থেকেই তাদের বিশেষ ধাঁচের মানসিকতা হুবহু গ্রহণ করেছেন। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, আইন-কানুন, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যান্য সব বিভাগেও আপনি নিজেই নবীন সরলমতি শিক্ষার্থীদের মন মগজে পাশ্চাত্যের মৌলিক ধ্যান ধারণা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদেরকে সব কিছু দেখতে শেখাচ্ছেন, পাশ্চাত্যের অনুমান নির্ভর বিষয়গুলোকে তাদের সামনে সর্ববাদী সম্মত সত্য হিসেবে পেশ করছেন, যুক্তি প্রমাণ ও যাচাই বাছাইয়ের জন্য পাশ্চাত্যবাসীদের গৃহীত সূচনাবিন্দুকেই মানদন্ড হিসেবে পেশ করছেন এবং যাবতীয় জ্ঞানলব্ধ বাস্তবতা ও সমস্যাবলীকে পাশ্চাত্যবাসী যে ভঙ্গিতে বিন্যস্ত করে থাকে আপনি ঠিক সেভাবেই বিন্যস্ত করে পাশ্চাত্যবাসীদের মন মগজে প্রবিষ্ট করে দিচ্ছেন। আর এসব কিছু করার পর আপনি চাচ্ছেন, শুধু দ্বীনিয়াত বিষয়টি তাদের মুসলমান বানিয়ে দিক। এটা কি করে সম্ভব? যে দ্বীনিয়াত বিভাগে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়, জ্ঞানগত বাস্তবতা ও জীবন সমস্যা সমাধানে যার কোন বাস্তব প্রয়োগ নেই। বরং এসব তাত্ত্বিক জ্ঞান যদি শিক্ষার্থী কর্তৃক লব্ধ জ্ঞানের সম্পূর্ণ বিপরীত হয় তাহলে সেই দ্বীনিয়াত বিভাগ কি করতে পারে? গোমরাহীর মূল উৎস এখানেই। যদি আপনি এই গোমরাহীর পথ রোধ করতে চান তাহলে উৎসমূখেই এর গতিপথ পাল্টিয়ে দিন এবং এমন সূচনা বিন্দু, দৃষ্টিকোণ ও মৌলিক নীতি দিয়ে শুরু করুন যা কুরআন হতে আপনি লাভ করেছেন। যখন সব রকমের লব্ধ জ্ঞান এই প্রজ্ঞা কাঠামোর অধীনে সন্নিবিষ্ট ও বিন্যস্ত হবে এবং সেই দৃষ্টিতেই গোটা বিশ্ব জাহান ও জীবন সমস্যার সমাধান করা হবে, তখনই আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুসলমান ছাত্র হবে। আর তখনই আপনি বলতে পারবেন আমরা তাদের মধ্যে ইসলামী স্পিরিট বা প্রাণ প্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। অন্যথায় শুধু একটি বিভাগে ইসলাম আর অন্যসব বিভাগে অ-ইসলামী শিক্ষা বহাল রাখার পরিণাম এছাড়া আর কি হতে পারে যে, এখান হতে সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা দর্শন ক্ষেত্রে অ-মুসলিম, রাজনীতি শিক্ষার ক্ষেত্রে অ-মুসলিম, ইতিহাস দর্শন শিক্ষার ক্ষেত্রে অ-মুসলিম এবং অর্থনীতি শিক্ষার ক্ষেত্রে অ-মুসলিম হয়ে গড়ে উঠবে। আর তাদের কাছে ইসলাম হবে নিছক কিছু আকীদা বিশ্বাস ও কিছু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ।
বিশেষ পাঠক্রম
ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশেষ বিভাগগুলোকে আলাদাভাবে শিক্ষা দেয়ার দরকার নেই। এর প্রত্যেকটিকে একই ধরনের পাশ্চাত্য বিষয়ের শেষ পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া উচিত যেমন ‘ইসলামী দর্শন’ ইসলামী দার্শনিক চিন্তাধারার বিকাশে মুসলমানদের অবদান এবং ইসলামী হিকমতকে দর্শন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ইসলামের ইতিহাস এবং ইসলামী ইতিহাসের দর্শনকে ইতিহাস বিভাগে, ইসলামী আইনের মূলনীতি এবং ফিকাহ শাস্ত্রের ব্যবহারিক কার্য্যকলাপ সংক্রান্ত অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ সমূহকে আইন বিভাগে, ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতিসমূহ ও অর্থনৈতিক লেনদেন সংক্রান্ত ফিকাহ শাস্ত্রীয় অধ্যায় সমূহকে অর্থনীতি বিভাগে এবং ইসলামী রাজনৈতিক মতবাদসমূহ, ইসলামী রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাস এবং দুনিয়ার রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশে ইসলামের অবদানকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অন্যান্য বিষয়ও একইভাবে পাশ্চাত্য বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
গবেষণা ও ডক্টরেট বিভাগ
এই পাঠক্রমের পর ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চতর গবেষণার জন্য একটা বিশেষ বিভাগ থাকা উচিত। এ বিভাগ হতে পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মত উচ্চতর তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য ডক্টরেট ডিগ্রী দেয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ বিভাগ হতে তৈরী হবে এমন সব লোক যারা জ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে মৌলিক ও স্বাধীন প্রক্রিয়া অনুসরণের ট্রেনিং লাভ করবে। অতঃপর তারা শুধু মুসলমানদের নয় বরং ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে সারা দুনিয়ার তাত্ত্বিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।