একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা
মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন সূচিত করার তাগিদ এখন মুসলিম জাহান জুড়ে আলোড়ন তুলেছে। মুসলিম তরুণদেরকে সারা দুনিয়ায় সঠিক ইসলামী লক্ষ্যাভিসারী নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নতুন ধরনের ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য কয়েকটি মুসলিম দেশে ইদানীং কথাবার্তা চলছে। এ উদ্দেশ্যে এ যাবত যে কয়টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেগুলোর পরিকল্পনা ও কাজের ধরণ দেখে মুসলিম জাহানের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের কেউ-ই সম্ভবত সন্তুষ্ট বলে মনে হয় না। বস্তুত এ সময় মুসলিম দুনিয়ার জন্য দারুল উলুম কিংবা শরীয়ত কলেজ ধরনের প্রাচীন আলেম সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। আবার পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ সরবরাহকারী কোন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও সার্থকতা নেই। এখন প্রয়োজন শুধু এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় যা দুনিয়ার জন্য ইসলামের ঝান্ডাবাহী তৈরী করতে পারে।
ইন্দোনেশিয়া হতে মরক্কো পর্যন্ত সব কটি মুসলিম দেশে বর্তমানে দু ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। একটা শিক্ষা ব্যবস্থা নিরেট পাশ্চাত্য মন-মানসিকতা ও চিন্তার অধিকারী এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও কৃষ্টির নিবেদিতপ্রাণ সেবক গড়ে তুলছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত লোকেরাই এখন মুসলিম দেশগুলোর শাসন ক্ষমতায় আসীন। তাদের হাতেই অর্থনীতির চাবিকাঠি। রাজনীতির বাগডোর এখন তাদেরই হাতে এবং সভ্যতা ও সমাজব্যবস্থার রূপকারও তারাই। তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসলাম সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ এবং পাশ্চাত্য ভাবধারার কাছে নতজানু। এ জন্য তারা সারা দুনিয়ার মুসলিম উম্মাহকে অত্যন্ত দ্রুতবেগে ইসলাম বিরোধী পথে টেনে নিয়ে চলছে। দ্বিতীয় শিক্ষাব্যবস্থা তৈরী করছে ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী আলেম সমাজ। তারা সাধারণত পার্থিব জ্ঞান বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনযাত্রার রক্ষণাবেক্ষণের কাজেই তারা ব্যস্ত। দুনিয়ার কোথাও তারা এতটা যোগ্য ও দক্ষ নন যে, সামগ্রিক জাতীয় জীবনের কান্ডারী ও চালক হতে পারেন। সব জায়গায় তারা কেবল গাড়ীর ব্রেকের কাজ করছেন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ মুসলিম উম্মাহর গাড়ীকে যে দ্রুততার সাথে বিপথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সেই উদ্দাম গতিতে বাধা সৃষ্টি করা ও গতি কমানো ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য তাদের নেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিটি মুসলিম দেশে এই ব্রেক প্রতিনিয়ত দুর্বল হয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, কোন কোন দেশে তো মাতাল ড্রাইভাররা এই ব্রেক ভেঙ্গে ফেলেছে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে নিজ জাতিকে নাস্তিকতা ও পাপ পঙ্কিলতার দিকে অতি দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে। অবশিষ্ট মুসলিশ দেশগুলোতেও এই ব্রেক ভেঙ্গে পড়ার আগেই আমাদের এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা করতে হবে যার সাহায্যে যুগপৎ দ্বীন ও দুনিয়াকে বুঝার মত যোগ্য শিক্ষিত লোক তৈরী হবে। যারা এই উম্মতের গাড়ী চালক হতে পারবে এবং তারা চারিত্রিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় ধরনের যোগ্যতার দিক দিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হবে।
মুসলিম জাহানের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই প্রয়োজন পূরণ করতে পারছে না। মুসলিম জগতের সকল চিন্তাশীল ব্যক্তি আজ দিশেহারা। তারা ভাবছেন সময় থাকতে এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা যদি আজ গড়ে তোলা না যায় তাহলে মুসলিম জাতিকে সম্ভাব্য ধর্মীয় ও নৈতিক সর্বগ্রাসী ধ্বংস হতে রক্ষা করা যাবে না। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে উপায় উপকরণ দরকার তা কেবল সরকারই সরবরাহ করতে পারে। অথচ মুসলিম দেশসমূহের সরকারি ক্ষমতা কি ধরনের লোকদের হাতে রয়েছে তা কারো অজানা নেই। এমতাবস্থায় আমি শুধু এটুকুই করতে পারি যে, উক্ত প্রয়োজন পূরণ করার উপযুক্ত একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের যে পরিকল্পনা আমার মনে রয়েছে সেটা মুসলিম জগতের কাছে পেশ করি। হয়তো এটা চিন্তাশীল ও জ্ঞানীজনদের মনোপুত হবে এবং মুসলিম সরকার এটা বাস্তবায়িত করতে এগিয়ে আসবে অথবা আল্লাহ কিছু বিত্তশালী লোকদের চিত্তকে এজন্য উদ্যোগী হওয়ার তাওফীক দিবেন।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমার প্রস্তাবসমূহ সংক্ষেপে পেশ করছিঃ
সবার আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে এবং সেই অনুসারে এর সমগ্র নীতি ও ব্যবস্থা তৈরী করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা কর্মচারী থাকবেন, তারাও ঐ নীতি ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজ করবেন। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎপরতার বিচার করবেন তারাও ঐ মাপকাঠিতে যাছাই করে দেখবে যে বিশ্ববিদ্যালয় তার লক্ষ্য অর্জনে কতখানি সফল। আমার মতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিম্নরূপ হওয়া উচিতঃ
১। এমন সুযোগ্য ও সত্যনিষ্ঠ আলেম তৈরী করবে যারা এই আধুনিক যুগে খাঁটি ইসলামী আদর্শ মোতাবেক দুনিয়ার নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।
২। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার মধ্যে এর কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যান্য বিদ্যা কেবল এ উদ্দেশ্যেই পড়ানো হবে যাতে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য সহায়ক হয়। ঐ সব বিদ্যায় পারদর্শী ও বিশেষজ্ঞ তৈরী করার দায়িত্ব এ বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে।
৩। এটা অবশ্যই একটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া চাই। ছাত্র এবং শিক্ষকগণ সবসময় এখানেই অবস্থান করবেন।
৪। সারা দুনিয়ার মুসলিম ছাত্রের জন্য এর দরজা খোলা রাখা উচিত, যাতে সব দেশের ছাত্র এতে অবাধে ভর্তি হতে পারে।
৫। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ এরূপ হতে হবে যেন যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাকওয়া ও উন্নত নৈতিক চরিত্র বিকশিত হয় এবং তাদের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতি শিকড় গেড়ে বসে। একে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হবে যাতে পাশ্চাত্যের কাছে পরাভূত জাতিগুলোর মাঝে আজকাল সর্বত্র যে দাসসুলভ ও পরাজিত মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে তা তাদের মধ্যেও সৃষ্টি না হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাশ্চাত্য পোশাক পরিচ্ছদ নিষিদ্ধ হতে হবে। ছাত্রদের আমোদ প্রমোদ ও বিনোদনের জন্য পাশ্চাত্য ধাঁচের খেলাধুলার পরিবর্তে ঘোড় সওয়ারী, সাঁতার, চাঁদমারি, অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার, মোটর সাইকেল ও গাড়ী চালনার ট্রেনিং এবং এই জাতীয় অন্যান্য বিনোদন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এর সাথে সাথে তাদেরকে কিছু সামরিক ট্রেনিংও দিতে হবে।
৬। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নির্বাচন শুধু মাত্র বিদ্যার যোগ্যতার ভিত্তিতে না হওয়া চাই। সকল শিক্ষক আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা ও মতামত এবং বাস্তব জীবনের দিক দিয়ে সৎ ও খোদাভীরু হওয়া চাই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মুসলিম জাহানের বিভিন্ন দেশ হতে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে এমন সব শিক্ষক নির্বাচন করতে হবে যারা উচ্চমানের বিদ্যার যোগ্যতার অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে চিন্তা ও আকীদা-বিশ্বাসে খাঁটি মুসলমান ও ইসলামী বিধানের যথার্থ অনুসারী হবে এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কাছে পরাজিতমনা হবে না। এমনকি আমি এটাও জরুরী মনে করি যে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা শিক্ষক হবেন তাদের পরিবারভুক্ত লোকদেরও শরীয়তের পাবন্ধ হওয়া চাই। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই নিয়োগদান করা উচিত হবে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যদি ছাত্রদের সাথে এমন শিক্ষক থাকেন যাদের পরিবারে অ-ইসলামী চালচলনে অভ্যস্ত এবং যাদের ঘর হতে গানের সুর লহরী উত্থিত হয়, তাহলে সে রকম শিক্ষকের কাছ হতে ছাত্ররা ভাল শিক্ষা পাবে না।
৭। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ট্রেনিং দিয়ে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত গুণাবলী সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবেঃ
(ক) ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ এবং দুনিয়ায় তাকে বিজয়ী করার দৃঢ়সংকল্প।
(খ) ইসলামী চরিত্র সৃষ্টি এবং ইসলামী বিধান মেনে চলার অভ্যাস।
(গ) ইসলামী বিধান সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান এবং প্রয়োজনে ইসলামী বিধান প্রণয়নের যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন।
(ঘ) শরীয়তের বিধান নিয়ে সংকীর্ণ দলাদলি ও বিভেদ হতে দূরে থাকা।
(ঙ) লেখা, বক্তৃতা ও বিতর্কে ভালো যোগ্যতা থাকা এবং ইসলাম প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা।
(চ) কষ্টসহিষ্ঞুতা, পরিশ্রম, চৌকশ ও সচকিত থাকার অভ্যাস এবং নিজের হাতে সব রকমের কাজ করার যোগ্যতা।
(ছ) সাংগঠনিক, প্রশাসনিক ও নেতৃত্বের যোগ্যতা।
৮। একমাত্র মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণ ছাত্ররাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে। আরব দেশসমূহ হতে আগত ছাত্ররা সরাসরি ভর্তি হতে পারবে কিন্তু অনারব ছাত্ররা আরবী ভাষায় যথেষ্ট পারদর্শী না হলে তাদের জন্য এক বছরের আলাদা কোর্স ঠিক করতে হবে। এই ভাবে তাদেরকে আরবী ভাষায় লেখা বই পুস্তক পড়ে বুঝবার যোগ্য করে তোলা যাবে।
৯। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকাল হবে ৯ বছরের। প্রথম স্তরে ৪ বছর, দ্বিতীয় স্তরে ৩ বছর এবং তৃতীয় স্তরে ২ বছরের শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে।
১০। প্রথম স্তরে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ৪ বছরের উপযোগী করে ৪ ভাগে ভাগ করে শিক্ষা দিতে হবে।
ক) ইসলামী আকায়েদঃ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামের আকীদা কি কি এবং তার স্বপক্ষে কি কি যুক্তি প্রমাণ আছে, মুসলমানদের মধ্যে আকীদাগত বিরোধ কিভাবে ও কি ধারাক্রমে উদ্ভূত হয়েছে এবং বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে কয়টি আকীদাগত মাযহাব রয়েছে তার ব্যাখ্যাও তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। এ বিষয়গুলোর নেহায়েত বিদ্যাগত সীমায় সীমিত থাকতে হবে এবং আকীদা বিশ্বাস নিয়ে তর্ক বিতর্ক একেবারেই পরিহার করতে হবে।
খ) ইসলামী জীবন পদ্ধতিঃ এ পর্যায়ে ছাত্রদেরকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ইসলামের মৌলিক মতবাদ ও চিন্তাধারা এই মতবাদ ও চিন্তাধারার ভিত্তিতে সে মানুষের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব কিভাবে গঠন করে, এরপর দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন থেকে নিয়ে অর্থনীতি, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যন্ত মুসলিম সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগকে কোন কোন মূলনীতির ভিত্তিতে সংগঠিত ও বিন্যস্ত করে এবং এভাবে সমগ্র ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপকাঠামোটা কি রকম দাঁড়ায় তা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
গ) কুরআনঃ চার বছর সময়ের মধ্যে সমগ্র কুরআন সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ পড়িয়ে দিতে হবে। এ জন্য তাফসীরের কোন নির্দিষ্ট গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে এমনভাবে কুরআনের দারস দেবেন যাতে ছাত্ররা কুরআনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও বক্তব্য ভালমত বুঝতে পারে এবং তাদের মন-মগজে যেসব সন্দেহ সংশয় ও প্রশ্ন জাগবে তা নিরসন করবেন।
ঘ) হাদীসঃ ছাত্রদেরকে সংক্ষেপে হাদীসের ইতিহাস, উসূলে হাদীস এবং হাদীস যে ইসলামী আইনের একটা অপরিহার্য উৎস, তা ছাত্রদেরকে যুক্তি প্রমাণসহ বুঝিয়ে দিতে হবে। এরপর হাদীসের যে কোন একটা সংকলন আগাগোড়া পড়িয়ে দিতে হবে যথা মুনতাকাল আখবার, বুলুগুল মুরাম অথবা মিশকাতুল মাসাবীহ।
ঙ) ফিকাহঃ ফিকাহ শাস্ত্রের ইতিহাস ও মূলনীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পুস্তক পড়ানোর পর ছাত্রদেরকে ফিকাহ শাস্ত্রের শিক্ষা এমনভাবে দিতে হবে যেন, ফিকাহ শাস্ত্রবিদদের বিভিন্ন মাযহাব এবং মতসহ ফিকাহ শাস্ত্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ মাসলা মাসায়েল ছাত্ররা জানতে পারে। অতঃপর মুজতাহিদ ইমামগণ কিভাবে স্বাধীন বিচার বিবেচনার দ্বারা মূল উৎস থেকে শরীয়তের বিস্তারিত বিধি বিধান রচনা করেছেন তাও যেন তারা অবগত হয়।
চ) ইসলামের ইতিহাসঃ নবীদের ইতিহাস দিয়ে ইসলামের ইতিহাস আরম্ভ করতে হবে। বিশেষত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন ইতিহাস বিস্তারিতভাবে পড়িয়ে ইসলামের সমগ্র ইতিহাসটা মোটামুটিভাবে ছাত্রদের গোচরে আনতে হবে।
ছ) সমাজ বিজ্ঞানঃ এ পর্যায়ে বিশেষভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান পড়াতে হবে। এসব বিষয় পড়ানোর জন্য এমন সব অধ্যাপক নিয়োগ করতে হবে যারা শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে সমালোচনা করতে পারবেন এবং পাশ্চাত্য মতবাদ ও চিন্তাধারাকে হুবহু ছাত্রদের মাথায় প্রবিষ্ট করাবেন না।
জ) বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্ম বিশেষত ইহুদীধর্ম, খৃস্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান দান করার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঝ) আধুনিক পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও তার প্রধান প্রধান শাখা, বিশেষতঃ পাশ্চাত্য গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসীবাদ প্রভৃতি।
ঞ) ইংরেজী, জার্মান ও ফরাসী ভাষার যে কোন একটা শেখাতে হবে।
১০। দ্বিতীয় স্তরে পাঁচটি অনুষদ থাকবে। যথাঃ তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, কালামশাস্ত্র বা ইলমুল কালাম এবং ইতিহাস।
১১। তাফসীর অনুষদে নিম্নলিখিত বিভাগগুলো থাকবেঃ
ক) কুরআন
খ) তাফসীর শাস্ত্রের ইতিহাস, তাফসীরকারকদের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং তাদের বৈশিষ্ট্যাবলী।
গ) কুরআনের বিভিন্ন পঠনরীতি।
ঘ) তাফসীর শাসেত্রর মূলনীতি তথা উসূলে তাফসীর।
ঙ) কুরআনের বিস্তারিত ও গভীর অধ্যয়ন।
চ) বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত কুরআনের বিরুদ্ধে যে আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তার চুলচেরা পর্যালোচনা এবং দাঁতভাঙ্গা জবাব দান।
ছ) কুরআনে বর্ণিত শরীয়তের বিধিবিধানসমূহ।
১২। হাদীস অনুষদঃ এই অনুষদে থাকবে-
ক) হাদীস সংকলেন ইতিহাস
খ) হাদীস সংক্রান্ত বিভিন্ন শাস্ত্র ও তার সকল শাখা।
গ) প্রধান হাদীস গ্রন্থসমূহের কোন একখানা গ্রন্থ বিস্তারিত সমালোচনা ও পর্যালোচনাসহ পড়িয়ে দিতে হবে যাতে ছাত্ররা মুহাদ্দিসের মত হাদীসের প্রমাণ্যতা যাছাই করার ভালো ট্রেনিং পেতে পারে।
ঘ) শীর্ষ স্থানীয় ছয়খানা বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থের সামগ্রিক মোটামুটি জ্ঞান।
ঙ) হাদীসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলের উত্থাপিত আপত্তিসমূহের বিস্তারিত পর্যালোচনা ও তার জবাব।
১৩। ফিকাহ অনুষদঃ
এ অনুষদে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো থাকবেঃ
ক) ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি বা উসূলে ফিকাহ
খ) ফিকাহ শাস্ত্রের ইতিহাস।
গ) আধুনিক আইনতত্ত্ব বা এর দার্শনিক পটভূমি।
ঘ) রোমান ও ইরানী আইন, ইহুদী আইন, আধুনিক মানব রচিত আইন ও ইসলামী আইনের তুলনামূলক অধ্যয়ন।
ঙ) মুসলিম ফিকাহশাস্ত্রকারদের বিভিন্ন মাযহাব ও তার মূলনীতি।
চ) মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি আইন রচনার অনুশীলন।
ছ) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের চার মাযহাবের ফিকাহ, সেই সাথে জাহেরী ফিকাহ, যায়দী ফিকাহ ও জা’ফরী ফিকাহ।
১৪। কালাম শাস্ত্র অনুষদঃ (আকীদা শাস্ত্র) এতে থাকবেঃ
ক)যুক্তি বিদ্যার মৌলতত্ত্ব।
খ)প্রাচীন ও আধুনিক দর্শন।
গ) মুসলমানদের মধ্যে কালাম শাস্ত্রের উন্মেষ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্তকার ইতিহাস এবং বাইরের ও ভেতরের প্রভাব থেকে উদ্ভূত মুসলমানদের বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব ও মতবাদ।
ঘ) কালাম শাস্ত্রের বিধান ও তাতে কুরআন ও সুন্নাহর অবদান।
ঙ) ইসলামের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধবাদীদের নানারকম আপত্তি ও প্রশ্নাবলীর বিস্তারিত পর্যালোচনা ও জবাব।
চ) বিভিন্ন ধর্মমতের তুলনামূলক অধ্যয়ন। বিশেষতঃ খৃস্টবাদের ইতিহাস, খ্রিষ্টানদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও তাদের আকীদা শাস্ত্রের বিবরণ ও বিস্তারিত পর্যালোচনা।
ছ) খৃস্টান মিশনারীদের প্রচার কার্য এবং তাদের পদ্ধতি ও কৌশল।
১৫। ইসলামের ইতিহাস অনুষদঃ
ক) ইতিহাস দর্শন, ইতিহাস অধ্যয়নের উদ্দেশ্য এবং কুরআনের আলোকে ইতিহাস পড়ার নিয়ম-পদ্ধতি।
খ) ইবনে খালেদুন থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাস দর্শনের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা।
গ) ইসলাম প্রতিষ্ঠার পূর্ব যুগের আরব জগত ও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস।
ঘ) চিন্তাধারা, নৈতিকতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা, রাজনীতির বিবর্তনের আলোকে বিশ্ব নবীর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ইসলামে ইতিহাস।
ঙ) ইসলামী পুনর্জাগরণের আন্দোলনসমূহ।
চ) মুসলিম দেশসমূহের উপর পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের আধিপত্যের ইতিহাস এবং তার পরিণতি ও ফলাফল।
১৬। তৃতীয় স্তরের ছাত্ররা উল্লেখিত অনুষদগুলোর কোন একটিতে কোন একটি নির্দিষ্ট দু’বছর গবেষণা করার পর একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে দাখিল করবে এবং তা ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ পরীক্ষা করে দেখার পর ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করবেন।
১৭। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি উঁচুমানের লাইব্রেরী থাকবে-যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখিত প্রয়োজনসমূহ পূরণের জন্য বিপুলসংখ্যক পুস্তক থাকবে।
১৮। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বিভিন্ন স্তর ও বিভাগের জন্য যথোপযুক্ত পাঠ্য বই নির্বাচনের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি নিয়োগ করতে হবে।
১৯। প্রয়োজনীয় বই পুস্তক রচনার জন্য একটা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নারী শিক্ষা
(নিম্নলিখিত প্রবন্ধটি মাওলানা মওদূদীর তদানীন্তন পাকিস্তান শিক্ষা কমিশনকে দেয়া সুদীর্ঘ স্মারকলিপির অংশ। প্রয়োজন ও উপযোগিতার বিচারে এর অনুবাদ করা হলো।– অনুবাদক।)।
নারীর শিক্ষা পুরুষের মতই জরুরী। নারীদের অজ্ঞ ও অনগ্রসর রেখে পৃথিবীতে কোন জাতিই উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। এজন্য মুসলিম পুরুষদের মত মুসলিম নারীদের শিক্ষার জন্যও যতদূর সম্ভব উন্নত ব্যবস্থা করা উচিত। এমনকি তাদের সামরিক ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা আমাদেরকে এমন সব অত্যাচারী ও আধিপত্যবাদী জাতির সাথে পাল্লা দিয়ে থাকতে হচ্ছে, যারা মানবতার কোন সীমানা লংঘনেই সংকোচবোধ করে না। খোদা না করুন, তাদের সাথে কোন যুদ্ধ বিগ্রহ বেধে গেলে তারা কি কি ধরনের বর্বরতার পরিচয় দিবে, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কাজেই আমাদের কর্তব্য নারীদেরকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত করা। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা মুসলিম। সুতরাং আমরা যা কিছু করবো তা যেন আমাদের ঈমানের পরিপন্থী না হয় এবং যেসব মূল্যবোধ ও সভ্যজনোচিত বিধি-নিষেধ মানতে আমরা ইসলাম কর্তৃক আদিষ্ট, তারও খেলাফ না হয়।
পাশ্চাত্য সভ্যতা ও আমাদের সভ্যতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, সে কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। এ দুটোর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য এই যে, নারী যতক্ষণ পুরুষ সেজে পুরুষোচিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে না আসে, ততক্ষণ পাশ্চাত্য সভ্যতা নারীকে সম্মান দেয় না এবং তার কোন অধিকার স্বীকার করে না। কিন্তু আমাদের সভ্যতা ও শিক্ষা নারীকে নারী রেখেই তার যথোচিত সম্মান ও অধিকার প্রদান করে। তার উপর শুধুমাত্র সেইসব সামাজিক দায়িত্বই অর্পণ করে যা স্বয়ং প্রকৃতি তার উপর স্বাভাবিক নিয়মে অর্পণ করেছে। সুতরাং আমাদের নারীদের শিক্ষাব্যবস্থাটা তাদের স্বভাবের দাবী ও প্রয়োজন অনুসারে হতে হবে এবং পুরুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্নস্তর থেকে নিয়ে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত কোথাও সহশিক্ষার প্রশ্নই উঠতে পারে না।
নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব আনুষঙ্গিক সংস্কারমূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষদের অনুরূপ হওয়া দরকার। প্রাইমারী থেকে বিশেষজ্ঞীয় স্তর পর্যন্ত যেসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়ার কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রেও তা অপরিবর্তিত থাকবে।
এ ছাড়া নারীদের শিক্ষায় এ কথাটা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, তাদের আসল ও স্বাভাবিক দায়িত্ব হলো গার্হস্থ্য জীবন পরিচালনা ও মানুষ গড়া, কৃষি খামার, কল-কারখানা, অফিস আদালত চালানো নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হবে নারী জাতিকে একটা সাচ্চা মুসলিম জাতি গঠনের যোগ্য করে তোলা যে জাতি দুনিয়ার সামনে স্রষ্টার রচিত কল্যাণকর ও স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।
………সমাপ্ত ……