সনদ বিতরণী সভার ভাষণ
(একবার কোন এক ইসলামিয়া কলেজের সনদ বিতরণী সভায় মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীকে ভাষণ দেয়ার জন্য দাওয়াত দেয়া হয়। সে অনুষ্ঠানে তিনি যে বক্তব্য পেশ করেন তা সর্ব শ্রেণীর মানুষের উপকারার্থে এখানে উল্লেখ করা হলো।)
সম্মানিত অধ্যাপকবৃন্দ, সমবেত ভদ্র মন্ডলী ও প্রিয় ছাত্রগণ, আপনাদের এই সনদ বিতরণী সভায় আমি নিজে কিছু বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পেয়ে সত্যিই অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আমার এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নেহায়েৎ আনুষ্ঠানিকতা নয় বরং সম্পূর্ণ বাস্তব। আর গভীর আন্তরিকতা নিয়েই আমার এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। কেননা যে শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে আপনাদের এই মহতী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং যেখানে শিক্ষা লাভ করে আপনাদের উত্তীর্ণ ছাত্ররা সনদ গ্রহণ করতে চলেছে আমি তার কট্টর দুশমন। আমার এ দুশমনীর কথা আমাকে যারা চেনেন তাদের অজানা নয়। ব্যাপারটা জানা থাকা সত্ত্বেও আমাকে যখন এ অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার জন্য দাওয়াত দেয়া হয়েছে, তখন দাওয়াত দানকারীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ করা আমার পক্ষে নিতান্তই স্বাভাবিক। যে ব্যক্তি তাদের মত ও পথের শত্রু, তার কথা শোনার মত উদারতা যাদের রয়েছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও মর্যাদার অনুভূতিতে আমার হৃদয় মন ভরে উঠবে এটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে আপনারা আমাকে এমন সময় ছাত্রদের সাথে কথা বলার সুযোগ দিয়েছেন যখন তারা এখান থেকে বেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এজন্য আমি আরো বেশি কৃতজ্ঞ।
সম্মানিত শ্রোতৃমন্ডলী, কিছুক্ষণের জন্য আপনাদের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে আজ যারা এখান থেকে সনদ নিতে যাচ্ছেন সেই স্নেহভাজন ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু বক্তব্য পেশ করার জন্য আমাকে অনুমতি দিন। কেননা সময় কম এবং আমার অনেক কথা বলার রয়েছে।
আমার প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা!
আপনারা এখানে জীবনের বেশ কটি মূল্যবান বছর কাটিয়ে শিক্ষা লাভ করেছেন। এতদিন বুকভরা আশা নিয়ে আপনারা আপনাদের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ডিগ্রী লাভের এই শুভ মুহুর্তটার প্রতীক্ষায় ছিলেন। এই শুভ মুহুর্তে আপনাদের আবেগ অনুভূতি যে কত গভীর হতে পারে তা আমি ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারি। আর এ কারণেই আপনাদের সামনে নিজের মতামত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে গিয়ে আমি বিশেষভাবে দুঃখ অনুভব করছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি যে কথা সত্য বলে জানি এবং যে সম্পর্কে আপনাদেরকে এক্ষণি অবহিত করা জরুরী মনে করি, তা যদি কেবল আবেগ অনুভূতির দিকে লক্ষ্য রেখে নিছক লৌকিকতার খাতিরে না বলি তাহলে সেটা হবে আমার মারাত্মক অন্যায়। কেননা আপনারা জীবনের একটি স্তর অতিক্রম করে অন্য স্তরের দিকে এগিয়ে চলেছেন।
সত্যি বলতে কি, আমি আপনাদের এই শিক্ষাঙ্গনকে এবং বিশেষ করে এটি নয় বরং এ ধরনের অন্য সব শিক্ষাঙ্গনকেও শিক্ষাঙ্গনের পরিবর্তে বধ্যভূমি বলে মনে করি। আমার দৃষ্টিতে এখানে সত্যিই আপনাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। আর যে সনদ আপনারা লাভ করেছেন সেগুলো আসলে আপনাদের মৃত্যুর সার্টিফিকেট (Death Certificate)। হত্যাকারী নিজের ধারণায় আপনাদের মৃত্যু সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরই এ সার্টিফিকেট আপনাদের দিতে চাচ্ছে। এরূপ সুসংগঠিত বধ্যভূমি থেকেও যদি আপনারা প্রাণ বাঁচিয়ে যেতে পারেন তবে সেটা আপনাদের সৌভাগ্য বলতে হবে। আমি এখানে এই মৃত্যু সার্টিফিকেট লাভের জন্য আপনাদেরকে অভিনন্দন জানাতে আসি নি বরং কওমের একজন সদস্য হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আপনাদের প্রতি যে সহানুভূতি আমার রয়েছে সেই অনুভূতিই আমাকে এখানে টেনে এনেছে। কোন নির্বিচার গণহত্যায় কারো আত্মীয় স্বজন নিহত হলে সে যেমন লাশের স্তূপের ভেতর খুঁজতে থাকে কেউ এখনো প্রাণে বেঁচে আছে কিনা, আমার অবস্থাও তেমনি।
এ কথা কখনো মনে করবেন না যে, আমি অতিরঞ্জিত কিছু বলেছি। সংবাদ পত্রের পাতায় আমি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে চাই না। প্রকৃতপক্ষে এই শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে এটাই আমার দৃষ্টিভঙ্গি। আমি যদি একটু বিস্তারিতভাবে আমার এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবার কারণ বিশ্লেষণ করি তাহলে হয়তো বা আপনারাও আমার সাথে একমত না হয়ে পারবেন না।
আপনারা সবাই জানেন যে, একটা চারাগাছকে যদি তার জন্মস্থান হতে উপড়ে নিয়ে এমন জায়গায় লাগান হয় যেখানকার আবহাওয়া, মাটি ও সমগ্র পরিবেশ তার জীবন ধারণের জন্য প্রতিকুল, তাহলে গাছটির শিকড় গজাতে সক্ষম হবে না। তবে সেই জায়গায় যদি কৃত্রিমভাবে তার আসল জন্মস্থানের অনুরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু প্রতিটি চারা গাছ ল্যাবরেটরীর কৃত্রিম পরিবেশ সারা জীবন পেতে পারে না। এই ব্যতিক্রমী অবস্থার কথা বাদ দিলে সাধারণভাবে এই সত্য কথাটি বলা চলে যে, কোন চারা গাছকে তার আসল জন্মস্থান থেকে উপড়ে একটা ভিন্ন ধরনের পরিবেশে নিয়ে লাগিয়ে দেয়া তাকে হত্যা করারই নামান্তর।
এবার আরেকটি দুর্ভাগা চারা গাছের কথা কল্পনা করুন। যে গাছটিকে তার জন্মস্থান হতে উৎপাটিত করা হয় নি কিংবা তার জন্মগত পরিবেশ থেকেও উচ্ছেদ করা হয় নি। তার মাটি, পানি, বাতাস ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অপরিবর্তিতই রয়েছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক উপায়ে তার নিজের ভিতরে এমন পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে যে, নিজের জন্মস্থান থেকেও তার প্রকৃতি সেখানকার মাটি, পানি, বাতাস ও পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ও সম্পর্কহীন হয়ে আছে। ফলে সে সেখানে শিকড় গজাতে ও সেখানকার পানি ও বাতাস থেকে খাদ্য আহরণ করতে পারছে না, আর ঐ পরিবেশে তার কলেবরও বাড়তে পারছে না। অভ্যন্তরীণ এই পরিবর্তনের ফলে চারাগাছটির অবস্থা ভিন্ন মাটি থেকে উপড়ে এনে ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি এবং কৃত্রিমভাবে বেঁচে থাকার উপকরণ সংগ্রহ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ল্যাবরেটরীর এই কৃত্রিম পরিবেশ যদি তাকে তৈরী করে দেয়া না হয় তাহলে সে যেখানে জন্মেছে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং অচিরেই শুকিয়ে মরে যাবে।
প্রথম কাজটি অর্থাৎ একটি চারাগাছকে তার জন্মস্থান হতে উপড়ে এনে নতুন ভিন্ন পরিবেশে রোপন করা একটি ছোটখাট জুলুম। তবে দ্বিতীয় কাজটি অর্থাৎ চারাগাছটিকে যেখানে জন্মেছে সেখানেই তার জন্য প্রতিকুল পরিবেশ সৃষ্টি করা নিঃসন্দেহে বড় রকমের জুলুম। আর যখন একটি দুটি নয় লক্ষ লক্ষ চারা গাছের ক্ষেত্রে এরূপ করা হয় এবং এত বিপুল সংখ্যক চারাগাছকে ল্যাবরেটরীর কৃত্রিম পরিবেশ যোগান দেয়াও যেখানে সম্ভব নয় তখন একে জুলুমের পরিবর্তে পাইকারী হত্যা বলা অতিরিক্ত হবে না।
আমি বাস্তব অবস্থার যে পর্যবেক্ষণ করেছি তাতে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে, এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপনাদের সাথেও একই আচরণ করা হচ্ছে। আপনারা ভারত ভূমির মুসলমান সমাজে জন্মগ্রহণ করেছেন। এখানকার মাটি, এই সমাজের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া ও পরিবেশেরই উৎপন্ন ফসল আপনারা। এই মাটিতে শিকড় গজানো এবং এই আবহাওয়া থেকেই জীবনী শক্তি আহরণ করা ছাড়া আপনাদের বেড়ে ওঠা এবং ফুলে ফলে সুশোভিত হওয়ার আর কোন পথ নেই। এ পরিবেশের সাথে আপনাদের যত বেশি সখ্যতা ও সঙ্গতিশীলতা গড়ে উঠবে, ততই আপনাদের পরিপুষ্টি আসবে এবং বাগানের সৌন্দর্য সুষমা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা কি? এখানে আপনারা যে শিক্ষা ও অনুশীলন লাভ করেছেন, যে মানসিকতা আপনাদের সৃষ্টি হচ্ছে, যে ধ্যান-ধারণা, যে প্রবণতা ও ইচ্ছা আকাঙ্খা ও কামনা বাসনা আপনাদের মধ্যে লালিত হচ্ছে, যে আদব অভ্যাস, রীতি প্রথা, আচার আচরণ ও স্বভাব চরিত্র আপনাদের মধ্যে বদ্ধমূল হচ্ছে এবং যে চিন্তা পদ্ধতি ও রুচিবোধ দিয়ে এবং যে জীবনধারায় আপনাদের গড়ে তোলা হচ্ছে, সে সব কিছু মিলে এ দেশের মাটি, আবহাওয়া ও সামাজিক পরিবেশের সাথে বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক থাকতে দেয় কি? এই দেশের সেই কোটি কোটি মানুষ যাদের মধ্যে আপনাদের বাঁচতে ও মরতে হবে এবং সে দেশের সমাজ জীবনে যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে রয়েছে তার সাথে এখানকার চাল-চলন, কথাবার্তা, লেবাস পোশাক ও জীবন রীতির কতখানি মিল আছে? এখানকার সামাজিক পরিবেশের সাথে আপনাদের যে কতবড় গড়মিল এবং আপনাদের জন্য এই সমাজ যে কত অসঙ্গত, আর এ অসঙ্গতির যন্ত্রণাও যে কত তীব্র, সেটা অনুভব করার মত সুস্থতাও যদি আপনাদের মধ্যে থাকতে দেয়া হতো, তাহলেও সেটা সৌভাগ্যের ব্যাপার হত।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরো ভাল করে বুঝা যাবে। কাঁচামালের উপর কারিগরি প্রক্রিয়া চালানো হয় তা ব্যবহারের উপযোগী দ্রব্যে পরিণত করার জন্য। কিন্তু যদি কোন কাঁচামালের ওপর কারিগরী প্রক্রিয়া চালানো সত্ত্বেও তা ব্যবহারের উপযোগী না হয়, তাহলে এ কাঁচামালটাও নষ্ট হলো, আর তার ওপর ব্যয়িত কারিগরী শ্রমও বৃথা গেল। কাপড়ের ওপর দর্জির কারিগরী যোগ্যতা এজন্য প্রয়োগ করা হয়, যাতে তা শরীরে ঠিকমত লাগে। এ উদ্দেশ্য সফল না হলে কারিগর দিয়ে কাপড়কে কেবল নষ্ট করাই সার হবে। একটা জিনিসের ওপর বাবুর্চিগিরীর বিদ্যা করা হয় তাকে খাবারে পরিণত করার জন্য। কিন্তু সেটা খাবারের যোগ্য না হলে বাবুর্চি ঐ জিনিসটাকে নষ্টই করল বলতে হবে।
অনুরূপভাবে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সমাজে যে সব মানুষগুলো জন্ম নিলো তাদের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা ও যোগ্যতা এখনও অপরিপক্ক ও অপরিণত অবস্থায় রয়েছে সেগুলোকে সর্বোত্তম পন্থায় লালন পালন ও পরিপুষ্ট করে যে সমাজে তারা জন্মগ্রহণ করেছে সেই সমাজের উপযোগী সার্থক সদস্য বানানো এবং ঐ সমাজের বিকাশ, কল্যাণ ও উন্নতির সহায়কে পরিণত করা। কিন্তু যে শিক্ষা ব্যক্তিকে সমাজ ও তার বাস্তব জীবন ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সে শিক্ষা সম্পর্কে একথা বলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না যে, তা সমাজকে গঠন করে না বরং ধ্বংস করে দেয়। শিশু-কিশোর ও তরুণরা প্রত্যেক জাতির ভবিষ্যত ভাগ্যলিপি স্বরূপ। স্বাভাবিকভাবে এসব শিশু-কিশোর ও তরুণদের আগমন ঘটে। আল্লাহর তরফ থেকে এ ভাগ্যলিপি অলিখিত পেটের আকারে এসে থাকে। জাতি নিজ হাতে ঐ পেটে তার ভবিষ্যত লিপিবদ্ধ করুক এই এখতিয়ার তাকে দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা এমন এক দুর্ভাগা জাতি যে, এই অলিখিত ভাগ্যলিপিতে নিজেদের ভবিষ্যত নিজেরা না লিখে অন্যদের হাতে তুলে দেই। এতে তারা তাদের ইচ্ছেমত যা খুশি লিখে দিক, এমনকি আমাদের মৃত্যু পরোয়ানাও যদি লিখে দেয় তবুও যেন আমাদের কিছু করার নেই।
এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে শিক্ষা সমাপ্ত করে যারা বেরিয়ে আসে তারা যখন নিজেদের সমাজে ফিরে যায় তখন তাদের অবস্থা হয় গায়ে দেয়ার অযোগ্য জামা কিংবা পেটে দেয়ার অযোগ্য খাবারের মত। ঐ সমাজের জন্য তারা যে উপযোগী হয় নি, সে কথা সমাজ যেমন বুঝে তেমনি তারা নিজেরাও বুঝে। ফলে সমাজ তাদেরকে নিজের কাজে লাগাতে না পেরে অগত্যা নিলামে চড়িয়ে দেয়। সদ্য পাশ করা ছাত্ররাও ভাবে, কোথাও যখন কাজ জুটছেনা তখন যেখানে হোক এবং যে দামেই হোক, বিক্রি হয়ে যাই। যে জাতি নিজের উৎকৃষ্টতম মানব সম্পদকে জুতো, কাপড় ও খাদ্যের বিনিময়ে বেচে দেয় সে জাতি যে কত বড় হতভাগা তা বাস্তবিকই ভেবে দেখার বিষয়।
আল্লাহ তায়ালা যে জনশক্তি ও মেধাশক্তি আমাদের নিজেদের কাজের জন্যই দিয়েছেন তা এখন অন্যদের কাজে লাগছে। আমাদের যুবকদের অমিততেজা দৈহিক শক্তি, তাদের মস্তিষ্কের রকমারি প্রতিভা ও বুকের এব বক্ষপিঞ্জরের মধ্যে যে শক্তি সঞ্চিত আছে তা আমাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। কিন্তু বড়জোর তা শতকরা এক কি দুই ভাগ আমাদের কাজে লাগে। অবশিষ্ট সবটুকুই অন্যরা কিনে নিয়ে যায়। আরো মজার ব্যাপার হলো মুনাফাবিহীন বিকি কিনিকেই আমরা বিরাট সাফল্য বলে মনে করছি। এ কথা কেউ-ই উপলব্ধি করে না যে প্রকৃত পুঁজিই হলো জনশক্তি। সুতরাং তা বিক্রি করা লাভজনক নয় বরং ষোল আনাই ক্ষতিকর।
উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে কিংবা সদ্য পাশ করে বেরিয়েছে প্রায়ই আমার এমন যুবকদের সাথে মেলামেশার সুযোগ হয়। তাদের নিকট আমি সবার আগে এটা জানতে চেষ্টা করি, তারা নিজেদের জীবনের কোন লক্ষ্য স্থির করেছে কিনা কিন্তু যখন দেখি যে, জীবনের কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য স্থির করেছে এমন যুবকের সংখ্যা হাজারে একজন পাওয়া দুষ্কর, এমন কি মানুষের জীবনের কোন লক্ষ্য আদৌ থাকা উচিত বা থাকতে পারে কিনা, সে বিষয়ে তাদের অধিকাংশেরই ধারণা পর্যন্ত নেই তখন আমার হতাশার শেষ থাকে না। জীবন লক্ষ্যের প্রশ্নকে তারা নিতান্তই দার্শনিক বা কবিসুলভ হেঁয়ালী মনে করে। পার্থিব জীবনে আমাদের কাজ কর্ম ও চেষ্টা সাধনার একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকা চাই কিনা সে ব্যাপারে কার্যতঃ কোন কিছু স্থির করে নেয়ার প্রয়োজনই তারা বোধ করে না। উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত যুবকদের এই দশা দেখে আমাদের মাথা ঘুরে যায়। আমি দিশেহারা হয়ে ভাবি, যে শিক্ষা ব্যবস্থায় পনেরো বিশজনের একটানা মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক অনুশীলনের পরও মানুষ নিজের শক্তি ও যোগ্যতাকে কোথায় ব্যয় করবে এবং তার চেষ্টা সাধনার উদ্দেশ্য কি হবে, তা ঠিক করার যোগ্যতাও অর্জন করে না, এমনকি জীবনের কোন লক্ষ্য আদৌ থাকার দরকার কিনা তাও উপলব্ধি করতে পারে না, সে শিক্ষা ব্যবস্থাকে কি নামে অভিহিত করা যায়। এই মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ দানকারী না মনুষ্যত্বকে ধ্বংসকারী শিক্ষা? উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপনতো জন্তু জানোয়ারদের কাজ। মানুষও যদি শুধু বাঁচার জন্যই বাঁচতে শেখে এবং নিজের শক্তি সামর্থ ব্যয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য প্রাণ রক্ষা ও সন্তান প্রজনন করাই বুঝে, তাহলে মানুষ ও অপরাপর জীবজন্তুর মধ্যে পার্থক্য থাকে কোথায়?
আমার এ সমালোচনার উদ্দেশ্য আপনাদের ভৎসর্না করা নয়। ভৎসর্না করা হয় অপরাধীকে। অথচ আপনারা অপরাধী নয়, আপনারা মজলুম। তাই আমি আপনাদের প্রতি সহানুভূতির মনোভাব নিয়েই এতসব কথা বলছি। আমি চাই কর্মজীবনে পদার্পণ করতে যাওয়ার প্রাক্কালে নিজেদের অবস্থাটা একবার পর্যালোচনা করে দেখুন যে, এই পর্যায়ে আপনাদের করণীয় কি? আপনারা মুসলিম উম্মতের অংশ। এ উম্মত কোন বর্ণ বা বংশগত জাতীয়তাভিত্তিক নয়। যে ব্যক্তি এর ভেতরে জন্ম নিবে সে আপনা আপনি মুসলমান বলে গণ্য হবে এমনও নয়। এটা কোন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীও নয় যে, এর সাথে কেবল সামাজিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়াই মুসলমান হওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হলো একটা আদর্শ। মানুষের সামাজিক জীবন তার সকল দিক ও বিভাগ এই আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠে। এ জাতির অন্তর্ভুক্ত যারা, তারা এর আদর্শকে বুঝবে, এর মর্ম ও তাৎপর্য উপলব্ধি করবে এবং নিজেদের সামষ্টিক জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে এই তাৎপর্যের বাস্তব ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ পদ্ধতির রূপায়ণ ঘটাবে। তবেই তাদের মুসলিম জাতীয়তা রক্ষা পাবে, নচেৎ নয়। বিশেষতঃ মুসলিম জাতির মধ্যে যারা শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি তাদের জন্যই সবচেয়ে বেশী দরকার এই জ্ঞান বুদ্ধি ও চরিত্রের। কেননা তারাই জাতির নেতা। আপন জাতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ছাপ শিক্ষিত সমাজের জীবনে পুরোপুরি থাকা প্রত্যেক জাতির জন্যই প্রয়োজন। কিন্তু মুসলিম জাতির জন্য এর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। কেননা ভৌগলিক, বংশগত কিংবা ভাষাগত ভিত্তিতে এ জাতির সদস্য হওয়ার উপায় নেই। মুসলিম জাতির সদস্য হতে হলে চাই কেবল পরিপূর্ণ ও পরিপক্ক ইসলাম তথা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, ইসলামী আমল ও ইসলামী চরিত্র। আমাদের জাতির সদস্যগণ বিশেষত শিক্ষিত শ্রেণীর ইসলামী চিন্তা বিশ্বাস ও ইসলামী আমল আখলাকের অধিকারী ছাড়া সামগ্রিকভাবে আমাদের জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও উন্নতি লাভ করা সম্ভব নয়। এ কারণে তাদের শিক্ষা ও অনুশীলনে যতটা ও যে ধরনের ত্রুটি ও দুর্বলতা থাকবে, আমাদের জাতীয় জীবনে তার তেমনি প্রভাব পড়া অনিবার্য। আর যদি তাদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান জ্ঞান ও আমল আখলাক একেবারেই না থাকে তবে সেটা হবে আমাদের ধ্বংস ও মৃত্যুর পূর্বাভাস।
এটা এমন একটা বাস্তবতা যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলিম জাতির নতুন বংশধরদের শিক্ষা দীক্ষার যে ব্যবস্থা করা হয়, তা মূলত তাদেরকে জাতির নেতৃত্ব দেবার জন্য নয়, জাতিকে ধ্বংস করার জন্যই তৈরি করা হয়। এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রদেরকে পড়ানো হয় দর্শন, অর্থনীতি, আইনশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং এ ধরনের অন্যসব বিদ্যা যার চাহিদা বাজারে আছে। কিন্তু ইসলামী দর্শন, ইসলামী বিজ্ঞানের মৌলিকত্ব, ইসলামী আইন বিজ্ঞান, ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ এবং ইসলামের ইতিহাস ও ইতিহাস দর্শনের বিন্দু বিসর্গও তারা জানতে পারে না। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, তাদের মন মগজে মানব জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অ-ইসলামী ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায়। আর অ-ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনের প্রতিটি বিষয়কে দেখে ও ভাবে তথা দেখতে ও ভাবতে বাধ্য হয়। কেননা, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি কখনও তাদের সামনে তুলে ধরাই হয়না। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে ইসলামের কিছু কিছু তত্ত্ব ও তথ্য জানতে পারলেও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় নিতান্তই ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ। এমন কি অনেক ক্ষেত্রে তা হয় কুসংস্কার এবং কাল্পনিক ও উদ্ভট ধ্যান ধারণার আধার। এসব তত্ত্ব ও তথ্য জানার ফলে তাদের মন মগজ ইসলাম থেকে আরো দূরে সরে যায়। যারা নিছক বাপ দাদার ধর্ম হবার কারণে ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি রাখে, তারা মন মগজের দিক থেকে অমুসলিম হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মনকে এই বলে সান্তনা দিতে থাকে যে, আমি বুঝতে না পারলেও ইসলাম নিশ্চয়ই একটা সত্য ধর্ম। আর যারা এই ভক্তি শ্রদ্ধাটুকুও হারিয়ে বসেছে, তারা ইসলামের ওপর নানা রকমের আপত্তি তুলতে এবং ক্ষেত্র বিশেষে তা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপও করতে দ্বিধা করে না।
এ ধরনের শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব অনুশীলনের যে সুযোগ পাওয়া যায় তা একই রকম। যে পরিবেশে তারা থাকে এবং বাস্তব জীবনের যেসব নমুনার সাক্ষাত তারা লাভ করে, তাতে কোথাও কোন ইসলামী চরিত্র ও ইসলামী আচার আচরণের নাম নিশানাও পাওয়া যায় না। এভাবে যারা বিদ্যাগতভাবেও ইসলামের জ্ঞান পেলো না, বাস্তব অনুশীলনেও সাক্ষাত পরিচয় পেলো না, তারা তো আর ফেরেশতা নয় যে আপনা আপনি মুসলমান হয়ে গড়ে উঠবে। তাদের ওপর তো আর অহী নাযিল হয় না যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মনে ইসলামের জ্ঞান সৃষ্টি হবে। তারা পানি আর বাতাস থেকে তো ইসলামের জ্ঞান পেতে পারে না। কাজেই চিন্তা ও কর্মে তাদের মধ্যে যদি অ-ইসলামী ভাবধারা দেখা দেয় তবে সেটা তাদের দোষ নয়। বরং তা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাঙ্গনের দোষ। তাই আমি আবারো বলতে চাই নিজের দিব্য জ্ঞান থেকে আমি উপলব্ধি করি যে, এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যত আপনাদের জবাই করা হয় এবং সমগ্র মুসলিম জাতির কবর রচনা করা হয়। যে সমাজে আপনারা জন্মগ্রহণ করেছেন, যে সমাজ আপনাদের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছে, যার ভাল মন্দের সাথে আপনার ভাল মন্দ এবং যার জীবনের সাথে আপনার জীবন এক সুতায় গাঁথা, সেই সমাজের জন্য আপনাদেরকে সম্পূর্ণ অকর্মণ্য করে দেয়া হয়েছে। এ সমাজের কল্যাণের জন্য কোন কাজ করার যোগ্য করে আপনাদেরকে তৈরী করা হয়নি। শুধু তাই নয়, বরং আপনাদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যে, আপনাদের ইচ্ছা না থাকলেও আপনাদের প্রতিটি কাজ মুসলিম জাতির জন্য বিপদজনক হবে। এমনকি আপনারা যদি এ জাতির কল্যাণের জন্যও কিছু করতে চান তাও হবে তার জন্য ক্ষতিকর। কেননা আপনাদেরকে মুসলিম উম্মাতের স্বভাব ধর্ম তথা ইসলাম ও তার প্রাথমিক মূলনীতিগুলো থেকে পর্যন্ত অজ্ঞ রাখা হয়েছে। আপনাদের সমগ্র বুদ্ধিভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন সম্পন্ন হয়েছে মুসলিম জাতির জাতীয় রূপরেখার সম্পূর্ণ বিপরীত বিন্দু থেকে।
নিজেদের এই অবস্থাটা যদি আপনারা বুঝতে পেরে থাকেন এবং কি বিপজ্জনক অবস্থায় পৌছিয়ে দিয়ে আপনাদেরকে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দেয়া হচ্ছে তা যদি উপলব্ধি করতে পেরে থাকেন, তাহলে আপনারা কিছু না কিছু ক্ষতিপূরণের চেষ্টা যে করবেনই, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। পুরোপুরি ক্ষতিপূরণ করা অত্যন্ত দুষ্কর। তবে আমি আপনাদেরকে তিনটে কাজ করার পরামর্শ দেবো। এ তিনটি কাজ করলে আপনাদের যথেষ্ট উপকার হবে।
প্রথমতঃ আপনারা যতটা সম্ভব আরবী ভাষা শিখতে চেষ্টা করুন। ইসলামের আসল উৎস কুরআনের ভাষা আরবী। কুরআনকে যতক্ষণ তার নিজের ভাষায় না পড়বেন, ততক্ষণ ইসলামের মূল চিন্তাধারা বুঝতে পারবেন না। আরবী ভাষার প্রাচীন জটিল পদ্ধতি এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। নতুন পদ্ধতিতে মাত্র ছ’মাসেই কুরআন বুঝার মত আরবী শেখা সম্ভব।
দ্বিতীয়তঃ পবিত্র কুরআন, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন কথা এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবন চরিত্র অধ্যয়ন করা ইসলামকে বুঝবার জন্য অপরিহার্য। জীবনের বার চৌদ্দটি বছর যখন রকমারি বিষয় পড়ে নষ্ট করে দিয়েছেন, তখন যে জিনিসের উপর জাতির অস্তিত্ব নির্ভরশীল এবং যে জিনিস না জানলে আপনারা এ জাতির কোন কাজেই লাগতে পারবেন না, সে জিনিসের জন্য অন্তত অর্ধেক বা সিকিভাগ সময় ব্যয় করুন।
তৃতীয়তঃ অসম্পূর্ণ ও বিক্ষিপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে ইসলাম সম্পর্কে ভালোমন্দ যে মতামতই পোষণ করে থাকুননা কেন, তা মন মগজ হতে ঝেড়ে ফেলুন। এরপর ইসলাম সম্পর্কে ধারাবাহিক ও নিয়মিতভাবে পড়াশুনা করুন। পড়াশুনার পর আপনি যে জ্ঞানই অর্জন করুন তার গুরুত্ব থাকবে। শিক্ষিত লোকদের পক্ষে কোন জিনিস সম্পর্কে ভালো করে না জেনেই একটা মত পোষণ করা কোনক্রমেই সঙ্গত নয়। আল্লাহ আপনাদেরকে সাহায্য করুন, এই দোয়া করেই আমার ভাষণ শেষ করছি।