দাওয়াতে দীন ও তার কর্মপন্থা
মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী
অনুবাদঃ মুহাম্মদ মূসা
ভূমিকা
আমি এই পুস্তকে নবী-রসূলদের তাবলীদের পন্থা বিস্তারিতভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছি। বর্তমান কালে লোকদের মনে দ্বীন সম্পর্কে যেমন অসম্পূর।ণ ও অপূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রয়েছে, তেমনিভাবে দ্বীনের প্রচারের ব্যাপারেও তাদে মধ্যে অত্যন্ত সীমিত এবং ত্রুটিপুর্ণ ধারণো রয়েছে। এই পুস্তকে আমি দ্বীন ইসলামকে একটি জীবন ব্যবস্থা (বাস্তবেও তাই) হিসাবে উপস্থাপন করেছি। তদনুযায়ী এই জীবন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় এবং চেষ্টা-সাধনার যেসব দাবী পূরণ করতে হয়, তাও বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছি। আমি এই পুস্তকের প্রতিটি অধ্যায়ের ভিত্তি কুরআন মজীদের শক্তিশালী দলীল প্রমাণের ওপর স্থাপন করেছি। অতপর যেখানে প্রয়োজন মনে করেছি, সহীহ হাদীস সমূহের সাহায্যে এর ব্যাখ্যাও করে দিয়েছি। আমি আশা করি, যিনি গভীর মনোযোগ সহকারে এই পুস্তক পাঠ করবেন, তিনি কুরআন বুঝবার ক্ষেত্রেও এ থেকেও সাহায্য পাবেন।
আমার বিরুদ্ধে কোন কোন বন্ধুর অভিযোগ রয়েছে যে, আমি খুব সংক্ষেপে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে থাকি। প্রতিটি পাঠক ভালভাবে বক্তব্য বুঝতে পারবে কিনা, সে দিকে আমি লক্ষ্য রাখিনা। েএই পুস্তকের মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ দূর করার চেষ্টা করেছ। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাকে সফলতা দান করুন এবং লোকেরা যেন এ থেকে অধিকতর ফায়দা অর্জন করতে পারে।
বিনীত
আমীন আহসান
১
তাবলীদের প্রচলিত পন্থায় ত্রুটি
একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে ইসলারেম প্রচর ও প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব উপায় ও পন্থা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ও গৃহীত হয়ে আসছে, তাবলীগ (প্রচার) শব্দটি শুনা মাত্র লোকদের মন-মগজ ও চিন্তা-চেতনা ভাবেই সেদিকে ছুটে যায়। একটা দীর্ঘ সময়ের অনুশীলন যখন কোন কাজের জন্য কোন কর্মপন্থাকে সুপরিচিত করে দেয়, তখন হৃদয়ের ওপর এর ছাপ এমন ভাবে বসে যায় যে, লোকেরা তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু চিন্তা করতে পারে না। এই কাজ অঞ্জাম দেয়ার জন্য ঐ কর্মপন্থাকেই সম্পূর্ণ রূপে প্রকৃতিগত পন্থা বলে ধরে নেয়া হয়। যে ব্যক্তিই এই কাজ করতে অগ্রসহ হন তিনিও এই পন্থাই অবলম্বন করেন। এমনকি কখনো কখনো কোন ব্যক্তি তা থেকে বেঁচে থাকার সংকল্প নিয়ে ঘর থেকে বের হয়, কিন্তু পথ চলতে চলতে পাও আবার সেদিকেই ফরসকে যায় যা থেকে বাঁচার জন্য সে সংকল্প নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল। এ জন্য সর্বপ্রথম তাবলীগের বর্তমা পন্থার ভ্রান্তি সমূহ সংক্ষেপে বর্ণনা করা প্রয়োজন।
আমাদের মতে তাবলীগের প্রচলিত পন্থায় জ্ঞানগত এবং কার্যগত উভবিধ ভ্রান্তি রয়েছে। অন্য কথায় বুঝানো যেতে পারে যে, তাবলীগের এই পন্থা দার্শনিক দিক থেকেও ভ্রান্ত। অতএব এই কারণে ইসলামের তাবলীগের নামে এ পর্যন্ত যত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের দিক থেকে কেবল নিষ্ফলই প্রমানিত হয়নি, বরং এর দ্বারা ইসলারেম দাওয়াতের যথেষট ক্ষতিও হয়েছে। আমা প্রথমে এই পন্থার তত্ত্বগত ত্রুটি সমূহের দিকে ইংগিত করব।
তাবলীগের প্রচলিত পন্থায় বুদ্ধিবৃত্তিহক ত্রুটি
প্রথমত ত্রুটিঃ ইসলামকে পেশ করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ভুল যা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, দাওয়াত পেশকারীগণ নিজেদের এবং ইসলামের সঠিক ভুমিকা অনুধাবন করতে পারেননি। এ কারণে তারা ইসলামকে ঠিক সেভাবে তুলে ধরতে পারেনি যেভাবে কুরআন তা মানব জাতির সামনে তুলে ধরেছিল। কুরআন মজীদ ইসলামকে এভাবে উপস্থাপন করেছে যে, সৃষ্টির সূচনা থেকে ইসলামই হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত দীন। যখনই এবং যে জাতির কাছে আল্লাহ তায়ালা কোন নবী পাঠিয়েছেন, এই দীন সহকারেই পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন জাতি আল্লাহর মনোনীত এই দীনের মধ্যে অনবরত দোষত্রুটির অনুপ্রবেশ ঘটাতে থাকে । এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীদের মাধ্যমে এসব দোষত্রুটির সংশোধন করতে থাকেন। এমনকি তিনি তার সর্বশেষ রসূলকে পাঠিয়ে তাঁর সব নবী-রসূলদের দীনকে সম্পূর্ণ সঠিক এবং পুর্ণাংগ অবস্থায় নাযিল করে তাকে চিরকালের জন্য কোনরূপ মিশ্রণ, পরিবর্তন এবং বিকৃতিরর আশংকা থেকে সংরক্ষিত সরে দিয়েছেন। এই দীন কুরআন মজীদের আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। এটা কোন বিশেষ জাতির ধর্ম নয়, বরং গোটা মানব ধর্ম এবং আল্লাহর সব নবীদের আনিত দীন। যে ব্যক্তি তা মেনে নেবে সে মুসলমান নামে পরিচিত হবে। আর যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করবেনা সে অমুসলিম গণ্য হবে। এই দীন আল্লাহর নবীদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্যও করেনা, তাঁর প্রেরিত কোন কিতাবকেও প্রত্যাখ্যান করেনা এবং কারো ওপর নিজের একচ্ছত্র মর্যাদাও দাবী করেনা। এর দাবী শুধু এতটুকু যে, এটা সমস্ত নবীদের শিক্ষার নির্ভরযোগ্য সারসংক্ষেপ এবং তাদের শিক্ষার পূর্ণতা বিধানকারী।
কিন্তু আমাদের প্রচারক এবং লেখকগণ এর সম্পূর্ণ উল্টা এই দীনকে মুসলিম জাতির দীন এবং দুনিয়ার সমস্ত ধর্মের শত্রু হিসাবে পেশ করেছেন। এর সত্যতা প্রমাণ করার জন্য অন্যান্য আসমানী কিতা সমূহের শিক্ষাকে উপহাস করেছেন। তারা কখনো কখনো আবেগ ও উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করেছেন যে, মুসলমান হিসাবে এবং সমস্ত নবীদের প্রতি ঈমান আনার দাবীদার হিসাবে এই সব কিতাবের যেসব শিক্ষার প্রতি তাদের ঈমান আনার সর্বাধিক দায়িত্ব ছিল তারা এর প্রতিও ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অপরাপর নবীদের মধ্যে তুলনা করে তাঁদেরকে নীচ প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়ছে। অথচ কুরআন মজীদে এ ধরণের বিশেষ অগ্রাধিকা দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রত্যেক নবীকে কোন কোন দিক থেকে মর্যাদা দান করেছেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে দৃষ্টি কোন থেকে মর্যাদা দেয়া হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলে দেয়া হয়েছৈ। স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য নবীদের তুলনায় তাঁ বিশেষ মর্যাদা দাবী করতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। কিন্তু মুসলমানরা ইসলাম এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধর্মীয় অন্ধ গোড়ামীর আবেগে তাড়িত হয়ে পেশ করেছেন। কেবল সাধারণ পেশাদার বক্তা এবং প্রচারকগণই এই ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়নি, বরং আমাদে বিশিষ্ট লেখক, গ্রন্থকার এবং সংকলকগণও এই ভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়েছেন, যাদের রচিত বই-পুস্তক মুসলমান অমুসলমান উভয়ের জন্য ইসলামকে বুঝবার একক মাধ্যম ছিল। আপনি বিশিষ্ট গ্রন্থকারদের বই পুস্তক খুলে দেখুন যা ইসলামের ওপর লেখা হয়েছে। এ সব কিতাবে অন্যান্র নবীদে এবং তাদের শিক্ষা সম্পর্কে এমন বিষাক্ত কথাবার্তা পাবেন যা পাঠ করে পরিস্কার মনে হবে- ইহুদ-খ্রীষ্টানরা আল্লাহ এবং তাঁ রসূলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার যে রোগে আক্রান্ত হয়েছিল- মুসলমানরাও একই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মুসলমানরা এ ধরণের বই পুস্তক সম্মান ও মর্যাদার সাথে হাতে তুলে নিয়েছে এবং এ ধরণের ওয়াজ ও বক্তৃতা উৎসাহ সহকারে শুনে থাকে। কেননা এর দ্বারা তাদের অহংকার ও গৌরবের চাকচিক্য ফুটে উঠে।
পক্ষান্তরে যেসব লোকের রচনাবলী ও বক্তৃতার এই টক-মিষ্টির সংমিশ্রণ ছিলনা- তারা সর্বসাধারণের মধ্যেও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি এবং বিশেষ মহলেও কোন গুরুত্ব পায়নি। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, এই বিষাক্ত তাবলিগী সাহিত্য সৃষ্টিতে ইসলামের সমালোচনাকারীদেরও অনেকটা দখল রয়েছে। কিন্তু আমাদের মতে মুসলিম সাহিত্যিকরাই ভুল করেছেন। এই ভ্রান্ত জবাব পন্থা অবম্বনের পরিণতিতে অমুসলিমদের মনে পংকলিতা সৃষ্টি হয়ে গেছে এবং তারা ইসলামের ওপর এই দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করেনি যে আসলাম তাদেরকে তাদের ভুলে যাওয়া সত্যকে স্মরণ করিয়ে দিতে এবং তাদের নবী-রসূলদের উত্তরাধিকারীদেরকে তাঁদের দিকে প্রত্যাবর্তন করানোজন জন্য এসেছে। বরং এটাকে দুশমন এবং ডাকারেত মত ঘৃনা চোখে দেখেছে যা তাদের কাছ থেকে তাদের দীনধর্মকে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ওপর নিজেই বিজয়ী হতে চায়।
দ্বিতীয় ত্রুটিঃ ইসলামকে উপস্থাপন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে বুদ্ধিবৃত্তিক ভুল করা হয়েছে, তা হচ্ছে – ইসলামকে ইকটি জীবন-বিধান হিসাবে পেশ করা হয়নি, বা মানব জীবনের ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, কর্মগত এবং আকীদাগত সমস্যাবলীকে একটি ‘এককে’ কেন্দ্রীভূত করে এবং বুধ্ধি ও স্বভাব সুলভ পন্থায় তার সমাধান করে। বরং আমাদের মুবাল্লিগ এবং তার্কিকগণ তাদের সমস্ত শক্তি এমন কতগুলো বিষয়ের ওপর ব্যয় করেছেন যা খ্রীষ্টান এবং হিন্দুদের সাথে ধর্মীয় সংঘাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। যেমন আত্মা এবং জড় পদার্থের চিরন্তনতা ও অভিনবত্ব প্রসংগ, পুনর্জন্মবাদ, মসীহ্ আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রভুত্ব এবং ত্রিত্ববাদের ঝগড়া ইত্যাদি। প্রত্যেক ধর্মের একদল পেশাদার তার্কিক এ ধরণের বিষয়ে খুবই আকর্ষণ বোধ করে। তাদের আসল সাফল্য এই সমস্যাগুলো সমাধান নয়, বরং এগুলোকে আরো বেশী সংবেদনশীল করে তোলাই তাদের লক্ষ্য। এ ধরণের লোকদের লা-জওয়াব করার চেষ্টা করার অর্থ হচ্ছে নিজের শক্তি ও যোগ্যতাকে ক্ষয় করা এবং নিজের সময়কে বরবাদ করা।
কিন্তু আমাদে মুবাল্লিগগণ এ ধরণের দ্বন্দ্বক্ষেত্রে নিজেদের জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন। তারা এ কথা চিন্তা করার প্রয়োজনও অনুভব করেননি যে, এগুলো কেবল তর্কপ্রিয় লোকদের আকর্ষণীয় বিষয়- যারা এগুলোর সমাধান চায়না বরং একে আরো জটিল করে তোলাই তাদের উদ্দেশ্য। বাকি দুনিয়া আজ ভিন্নরূপ সমস্যার সম্মুখীন্ এগুলোর সমাধান করার জন্য দুনিয়অ আজ অস্থির হয়ে পড়েছে এবং এগুলোর সমাধান হওয়ার ওপরই দুনিয়ার মুক্তি নির্ভর করছে। যে ধর্মই সামনে অগ্রসহর হয়ে এসব সমস্যার গ্রহণ যোগ্য সমাধান পেশ করতে পারেবে তাই হবে সারা দুনিয়ার আগামী দিনের ধর্ম। এমন একটি জগত যা নিজের উদ্ভাবিত পন্থায় পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে এবং জীবনের সংস্কৃতিক এবং সামগ্রিক সমস্যার কোন সমাধারন খুজে পাচ্ছেনা সেখানে ইসলামকে যদি কয়েকটি আকীদা-বিশ্বস ও রীতিনীতির আকারে পেশ না করে বরং একটি পূর্ণাংগ জীবন-বিধান হিসাবে পেশ করা হত তাহলে আজ দুনিয়ার চিত্র ভিন্নরূপ হত।
কিন্তু আমাদের মধ্য যেসব ব্যক্তি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন, অথবা যারা ইসলামের ওপর বই-পুস্তক রচনা করেছেন সম্ভবত ধর্মের খ্রীষ্টবাদী দর্শনই তাদের সামনে ছিল, যা কয়েকটি দাবীর সমষ্টি- জীবনের বাস্তব সমস্যার সাথে এর কোন ইতিবাচক সম্পর্ক নেই। ফল হচ্ছে এই যে, খ্রীষ্টবাদের অনর্থক বাচালতরা প্রতি দুনিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায় যেভাবে কোন আকর্ণণ অনুভব করেনি, অনুরূপভাবে ইসলামের এই সমস্যাবলীর ইসলামী সমাধানের দিকও শিক্ষিত সমাজ কোন মনোযোগ দেয়ীন। ফলে ইসলারেম প্রচারকার্যের এই গোটা তৎপরতা অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্মের নগণ্য সংখ্যক অনুসারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। ফলে সময় এবং সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কোন বিশেষ ফল পাওয়া যায়নি।
তৃতীয় ত্রুটিঃ এ ব্যাপারে আরেকটি বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রান্তি হচেছ এই যে, আমাদের এখানে আজ পর্যন্ত ইসলারে ওপর যেসব কিতাব পত্র লেখা হয়েছে তা হয় তাত্ত্বিক ধরণের অথবা বিতর্কমূলক অথবা নতিস্বীকার মূলক অথবা কালাম শাস্ত্রের ঢংএ পেশ করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটি সম্পর্কে নির্দ্বিধায় বলা যায়, দীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে এর কোনটিই উপকারে আসেনি। তাত্বিক আলোচনা কেবল এমন লোকদের উপকারেই আসতে পারে যাআ ইসলামের কোন বিশেষ দিকে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করতে চায়। কিন্তু দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্য নিয়ে তা লেখাও হয়না এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের যোগ্যতাও তাদের মধ্যে পাওয়া যায়না। বিতর্কমূলক আলোচনা প্রথমত বিশেষ ধরণের কয়েকটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। এর সাতে ইসলামের দৃষ্টিভংগীর কোন সম্পর্ক থাকে না। দ্বিতীয়ত, যেসব জিনিস হৃদয়-মনকে ইসলামেতর নিকটবর্তী করা পরিবর্তে বরং আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় সেসব দোষ এর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান রয়েছে। নতিস্বীকার মূলক প্রকাশভংগীতে লেখা জিনিস বলতে আমরা পাশ্চাত্য প্রভাবিত লোকদের ধর্মীয় বিষয়ের ওপর রচিত বইপুস্তকের দিকে ইশারা করেছি, ইউরোপবাসীদের কাছে যা প্রশংসিত হয়েছে। তারা পাশ্চাত্য প্রভাবিত চিন্তা ধারাকে ইসলামের মধ্যেও প্রবেশ করানো চেষ্টা করে। যদিও এর সাথে ইসলামের দুরতম সম্পর্কও নেই। অনুরূপভাবে ইসলামের যেসব জিনিস পাশ্চাত্যের কাছে নিন্দনীয় হয়েছে তাকে ইসলাম বহির্ভূত প্রমান করার দলীলও তারা একত্র করেছে- তা ইসলামের রুকন বা মূল নীতির অন্তর্ভুক্তই হোকনা কেন। এই ধরণের দুর্বলচেতা এবং পরাজিত মানসিকতা সম্পন্ন লোকেরা যা কিছু লিখেছে- তা না ইসলামের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করছে, আর না তার মধ্যে এমন বলিষ্ঠ আস্থা রয়েছে যা মনকে ইসলামের দিকে টেনে আনতে পারে এবং বিবেকের কাছে বলিষ্ঠ আবেদন রাখতে পারে।
দার্শনিক দৃষ্টিকোন থেকে যা কিছু লেখা হয়েছে তা আরো অধিক হতাশাজনক। কালাম শাস্ত্রবিদদের যুক্তির পদ্ধতি বুদ্ধি বিবেক এবং স্বভার প্রকৃতির পরিপন্থী। এর দ্বারা কোন সমস্যার গিট বৃদ্ধি করা যেতে পারে, কিন্তু কোন গিঠ খোলা সম্ভব নয়। যুক্তির এই ধরণ বক্র বিতর্কের জন্যই উপযুক্ত হতে পারে। এর মধ্যে না আছে কোন আকর্ষণ, না আছে সৌন্দর্য। সুস্থ বিবেক ও মানব প্রকৃতির সাতে এর কোন সামঞ্জস্য নেই। একে ইসলামকে উপস্থাপন করার মাধ্যম বানানোর অর্থ হচ্ছে লোকদেরকে ইসলাম থেকে পলায়নমুখী করা এবং তাদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণর সৃষ্টি করা ।
ইসলামকে দুনিয়ার সামনে পেশ করার একক পন্থা ছিল তাই- যা আল্লাহর কিতাব এবং রসূল (সা) অবলম্বন করেছেন। কিন্তু আমাদের কালাম শাস্ত্রবিদগণ গ্রীক দর্শনের দ্বারা এতটা প্রবাবিত হয়ে পড়েন যে, তারা কুরআনের যুক্তি পদ্ধতিকে শুধু উপেক্ষাই করেনি বরং আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে তার সমালোচনা করেছে এবং তাকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। আমাদের প্রাচীন পন্থী কালামশাস্ত্রবিদগণও এই ভুল করেছেন এবং আমদের আধুনিক কালামশাস্ত্রবিদরাও তার শিকার হয়েছেন। এরফল হয়েছে এই যে, অমুসলিমদের সামনে পূর্ণাংগ ও যেসব শিক্ষিত মুসলমান নিজেদের মুসলমান হিসেবে টিকিয়ে রাখতে অথবা অন্ততপক্ষে মুসলমানদের মধ্যে পরিগণিত হতে চেয়েছিল তারা বলতে শুরু করল যে, ইসলাম অন্তরে মেনে নেয়ার জিনিস মাত্র। বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে বুঝবার মত জিনিস তা নয়। যারা নির্ভিক এবং বগ্রাহীন- তারা প্রকাশ্যেই ইসলামের ঠাট্টাবিদ্রুপ শুরু করে দিল। এবং শুধু নাম ছাড়া আর সব ব্যাপারেই তারা ইসলামের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ আযাদ হয়ে গেল।