বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস
আব্বাস আলী খান
[প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ]
গ্রন্থকারের কথা
প্রায় দেড় যুগ পূর্বে বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়। কথা ছিল বাংলায় মুসলমানদের প্রথম আগমন থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ পর্যন্ত এ সুদীর্ঘ কালের ইতিহাস লেখার। তবে বিশেষভাবে বলা হয় যে, ইংরেজদের শাসন ক্ষমতা হস্তাগত করার পর মুসলমানদের প্রতি বৃটিশ সরকার ও হিন্দুদের আচরণ কেমন ছিল তা যেন নির্ভরযোগ্য তথ্যাদিসহ ইতিহাসে উল্লেখ করি। Government of India Act-1935 পর্যন্ত ইতিহাস লেখার পর আর কলম ধরার ফুরসৎ মোটেই পাইন। সম্প্রতি কয়েক বছরের শ্রম ও চেষ্টা সাধনার ইতিহাস লেখার কাজ সমাপ্ত করতে পেরেছি বলে আল্লাহ তা’য়ালার অসংখ্য শুকরিয়া জানাই।
এ ইতিহাসের কোথাও কণামাত্র অসত্য, স্বকপোলকল্পিত অথবা অতিরঞ্জিত উক্তি করিনি। অনেকের কাছে তিক্ত হতে পারে, কিন্তু আগাগোড়া সত্য ঘটনাই লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।
আমি ইতিহাসের একজন একনিষ্ঠ ছাত্র ছিলাম বলে তখন থেকেই সত্য ইতিহাস জানা ও লেখার প্রবণতা মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। রংপুর কারমাইকেল কলেজের বিএ চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে আকবর ও আওরংজেবের উপরে ইংরেজীতে এক গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করি। কিছু বিরোধিতা ও বাধা সত্ত্বেও প্রবন্ধটি কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
শিক্ষা জীবন শেষ করার পর সরকারী ও বেসরকারী চাকুরীতে জীবন পঁচিশটি বছর কেটে যায়। ইতিহাসের উপর কোন গবেষণামূলক কাজ করার সুযোগ থেকে একেবারে বঞ্চিত হই। বরঞ্চ ইতিহাসই ভুলে যেতে থাকি। দেড় যুগ পূর্বে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নতুন করে ইতিহাস চর্চার সুযোগ হয়েছে।
ইতিহাস একটা জাতির মধ্যে জীবনীশক্তি সঞ্চার করে। কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার অতীত ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে হবে অথবা বিকৃত করে পেশ করতে হবে। একজন তথাকথিত মুসমলমান যদি ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের সুযোগ না পায় এবং তার জাতির অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, তাহলে তার মুখ থেকে এমন সব মুসলিম ও ইসলাম বিরোধী কথা বেরুবে যেসব কথা একজন অমুসলমান মুখ থেকে বের করতে অনেক সাতপাঁচ ভাববে। এ ধরনের হস্তীমূর্খ মুসলমানের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে এবং মুসলমানদের জাতশত্রুগণ তাদেরকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করছে।
মুসলিশ জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে তাদের সঠিক অতীত ইতিহাসের সাথে ইসলামেরও সঠিক জ্ঞান ও ধারণা নতুন প্রজন্মের মধ্যে পরিবেশনের ব্যাপন উদ্যোগ গ্রহণ একেবারে অপরিহার্য। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসে প্রসংগক্রমে ইসলামের মূলনীতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদী শক্তির পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে হলে ইতিহাসের পর্যালোচনা ও ইসলামী সংস্কৃতিক মর্মকথঅ সর্বস্তরে তুলে ধরতে হবে।
মুসলমানী জীবনটাই এক চিরন্তন সংগ্রামী জীবন। সংগ্রাম বিমুখতার ইসলামে কোন স্থান নেই। তাই ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম অগ্রগামীর ভূমিকা পালন করতে হবে। নতুবা জাতিকে শক্রর নির্যাতনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে।
‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসে’ প্রায় দু’শ’ বছর যাবত মুসলমানদেরপ্রতি হিন্দুদের উৎপীড়ন অবিচারের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অতীতের কথা কেউ কেউ মনগড়া মতে করতে পারেব। বর্তমান সময়ে ভারতে কি হচ্ছে তা কি তাঁরা দেখছেন না? সেখানে প্রতিনিয়ত সংঘটিত লোমহর্ষক গাংগায় যে মুসলমানদেরকে নির্মূল করা হচ্ছে তা কি তাঁদের চোখে পড়েনা? সম্প্রতি বোম্বাইয়ে সংঘটিত দাংগার জন্য যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল, তার রায় প্রকাশিত হয়েছে। কমিশনের রায়ে দাংগাকারিদের সহযোগীতা করার জন্য পুলিশকে দায়ী করা হয়েছে। রাজ্য সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর বৈষম্যমূলক আচরণেরও সমালোচনা করা হয়েছে। এরপর উগ্র মুসলিম বিদ্বেষীদের দেশ ভারতে মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা কোথায়? ভবিষ্যতে হয়তো এসবের সঠিক ইতিহাস প্রণীত হবে।
পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, একটা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে জাতির নতুন প্রজন্মকে তাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ রাখা হয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের ভূত বিভাগোত্তর কালের পাকিস্তানী শাসকদের ঘাড়েও শক্ত করে চেপে বসেছিল। পাকিস্তান কি কারণে হয়েছিল, এর আদর্শিক পটভূমি কি ছিল, কেন সুদীর্ঘ সাত বছর নিরলস ও আপোষহীনভাবে পাকিস্তান আন্দোলন করা হলো, কেন লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু খুনের দরিয়া সাঁতার দিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল, তার কোন কিছুই নতুন প্রজন্মকে জানানো হয়নি।
আমাকে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তখনকার পাঠ্য ইতিহাসে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসের কোন উল্লেখ ছিলনা। যার ফলে পাকিস্তানের ভিত আরও নানা কারণে দুর্বল হতে থাকে। পাকিস্তান ও তার শাসকদের প্রতি জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভ বাড়তে থাকে যার পরিণামে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
অত্র ইতিহাসটিতে মুসলিম জাতির গৌরবময় অতীত ইতিহাসের দিকে নতুন প্রজন্মের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। মুসলিম জাতির ইতিহাস কালের কোন এক বিশেষ সময় থেকে শুরু হয়ে কোন এক বিশেষ সময়ে গিয়ে শেষ হয়নি। এ ইতিহাসের সূচনা দুনিয়ায় প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ) এর আগমন থেকে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এ ইতিহাস অবিচ্ছিন্নভাবে চলে এসেছে সময়, কাল ও পরিবেশ পরিস্থিতির চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে এবং চলতে থাকবে যতোদিন দুনিয়া বিদ্যমান থাকবে। মুসলমানদেরকে অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই সামনে অগ্রসর হতে হবে।
এ ইতিহাস লেখার জন্য বহু খ্যাতনামা ঐতিহাসিকের গ্রন্থ থেকে মালমশলা সংগ্রহ করেছি। তার জন্য তাঁদের সকলের নিকটে চির কৃতজ্ঞ রইলাম। অতঃপর বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার গ্রন্থখানার প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছেন বলে এর ডাইরেক্টর আমার পরম শ্রদ্ধেয় বন্ধু অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমদ সাহেবকে জানাই আমার অশেষ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
শ্রদ্ধেয় পাঠকবৃন্দ এ গ্রন্থ থেকে কিছু শিক্ষা ও ইসলামী প্রেরণা লাভ করতে পারলে আমার কয়েক বছরের অধ্যবসায় ও শ্রম সার্থক হয়েছে মনে করব। আল্লাহ তায়ালা এ গ্রন্থখানা কবুল করুন –আমীন।
ঢাকা, ১৫ই জমাদিউল আউয়াল
১৭ই কার্তিক
পয়লা নভেম্বর ১৯৯৩ সাল।
গ্রন্থকার