প্রথম খণ্ড: সুদ ও ক্রয়-বিক্রয়
প্রথম অধ্যায়: আল-কুরআনের দৃষ্টিতে সুদ
সুদ নিষিদ্ধ করেছে আল-কুরআন। অবশ্য তার পূর্বে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সকল গ্রন্হেই সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। আর মহান আল্লাহর নাযিলকৃত সকলগ্রন্হই (দ্বীনই) হচ্ছে মূলত ইসলাম। অর্থাৎ ইসলামই হচ্ছে দুনিয়ার মানুষের জন্য আদি এবং একমাত্র জীবন বিধান; আর এই ইসলামেই সুদ নিষিদ্ধ। সুদ কি? কেন সুদকে হারাম করা হলো- এসব বিষয় যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে প্রথমেই এ বিষয়ে আল-কুরআনে কি বলে তা জানা দরকার।
আল-কুরআনে সুদকে বলা হয়েছে রিবা। আল-কুরআনের চারটি সূরার মোট ১৫ টি আয়াতকে রিবা সংক্রান্ত আয়াত বলা হয়। নাযিলের ক্রমিক ধারা অনুসারে সূরার নাম ও আয়াত নম্বরগুলো হচ্ছে:
১. সূরাতুর রূম, ৩৯;
২. সূরাতুন্নিসা, ১৬০-১৬১;
৩. সূরাতু আলে ইমরান, ১৩০-১৩৪ এবং
৪. সূরাতুল বাকারাহ, ২৭৫-২৮১;
এসব আয়াতে ‘রিবা’ শব্দটির উল্লেখ আছে মোট আট বার। সূরাতুর রূমের ৩৯ নম্বর আয়াতে ১ বার, সূরাতুন্নিসার ১৬০ আয়াতে ১ বার, সূরাতু আলে ইমরানের ১৩০ আয়াতে ১ বার এবং সূরাতুল বাকারাহর ২৭৫ আয়াতে ৩ বার, ২৭৬ আয়াতে ১ বার ও ২৭৮ আয়াতে ১ বার।
বস্তূত: আল-কুরআনের দৃষ্টিতে সুদ হচ্ছে পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা এবং একটি বড় জুলুম; আর আল-কুরআনের লক্ষ্য হচ্ছে মানবসমাজ, তথা ইসলামী রাষ্ট্র থেকে এ জুলুমের অবসান ও নির্মূল করে ক্রয়-বিক্রয়ে পূর্ণ ইনসাফ কায়েম করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আল্লাহ তা’য়ালা চারটি ধারাবাহিক পর্যায়ে উক্ত আয়াত গুলো নাযিল করেছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে শিক্ষা। এই পর্যায়ে আল্লাহ তাঁর বাণী নাযিল করে সুদের বাস্তব ও প্রকৃত চেহারা ও ফলাফল সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন। তৃতীয় পর্যায়ে আল্লাহ মুমিনদের সুদ খেতে নিষেধ করে পরিবেশ তৈরী করেছেন। ঈমানদারগণ যাতে সুদ বর্জন করে চলতে পারে সেজন্য তাঁদের অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। আর চতুর্থ বা সর্বশেষ পর্যায়ে আইন নাযিল করে সুদকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করেছেন। ফলে ইসলমী রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সুদী লেনদের আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং প্রক্রিত পক্ষে সুদ সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ হয়। নাযিলের ধারাবাহিকতা অনুসারে উক্ত আয়াতগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিম্নে পেশ করা হলোঃ
সূরাতুর রুম
সূরাতুর রূমের ৩৯ আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ
[وَمَا آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ اللَّهِ ۖ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ]
“মানুষের সম্পদের সাথে যুক্ত হয়ে বৃদ্ধি পায় এজন্য তোমরা যে সুদ দাও, আল্লাহর কাছে তা (সুদ) বাড়ে না; আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তোমরা যে যাকাত দাও, তারাই (সেই যাকাত দানকারীরই) তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করতে থাকে”।
পটভূমি
আল-কৃরআনের সুদ সংক্রান্ত আয়াতগুলোর মধ্যে এটিই সর্বপ্রথম, নববী ৫ম সাল তথা ৬১৫ খৃঃ নাযিল করা হয়। এ সময়ে সারা মক্কায় মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকশত লোক ঈমান এনেছেন। পরবর্তীকালে মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হলে সেখানে সুদকে আইনত নিষিদ্ধ এবং যাকাতকে ফরয করা হবে, এই লক্ষ্য সামনে রেখে মহামাহিম আল্লাহ এই প্রাথমিক পর্যায়েই ঈমানদারদেরক সুদ ও যাকাতের তাৎপর্য শিক্ষা দিয়েছেন। এই আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা সুদী অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা এবং যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যের একটা শাশ্বত চিত্র তুলে ধরেছেন।
মূল বক্তব্য
আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা প্রথমে সুদদাতাদের লক্ষ্য করে সুদ সম্পর্কে দু’টি কথা বলেছেনঃ ১) সুদদাতারা সুদ হিসেবে যা দেয় তা অপর লোকদের (সুদগ্রহীতাদের) সম্পদের সাথে যুক্ত হয়ে তাদের সম্পদ বুদ্ধি করে, তাদের ধনী বানায় এবং ২) কিন্তু তা (সেই সুদ) আল্লাহর কাছে বাড়ে না। আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তা’য়ালা যাকাতদাতাদের সম্বোধন করেছেন এবং যাকাত সম্পর্কেও দুটো কথা বলেছেনঃ ১) যাকাত দিলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন’ আর ২) যাকাতদাতারাই তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করতে থাকে। প্রথমে সুদ সংক্রান্ত দুটি এবং পরে যাকাত সংক্রান্ত দুটি কথার ব্যাখ্যা নিচে পেশ করা হলাঃ
সুদ
১. সুদ সম্পদ হস্তান্তর করে
সুদ লেনদেন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে দেখা যায়, সুদের মাধ্যমে সুদদাতদের সম্পদ সুদগ্রতীতাদের কাছে চলে যায় এবং তারা আরও ধনী হয়। সুদ সংক্রান্ত প্রথম কথায় আল্লাহ এই কথাই বুঝিয়েছেন। বর্তমানে সুদী বিশ্বে সুদভিত্তিক ঋণ গ্রহণের সাথে প্রধানত দুই শ্রেণীর মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এরা হচ্ছেঃ ১) অভাবের তাড়নায় সুদী ঋণ গ্রহণে বাধ্য জনগোষ্ঠী এবং ২) ব্যবসায়িক প্রয়োজনে সুদী ঋণগ্রহীতা। এছাড়া সরকারও দেশী-বিদেশী ঋণদাতার কাছ থেকে সুদী ঋণ নিয়ে থাকে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অভাবের তাড়নায় যারা সুদী ঋণ গ্রহণ করে তারা সে ঋণের সম্পদ তাৎক্ষণিকভাবে অভাব পূরণার্থে ব্যয় করে ফেলে। এ ঋণ উৎপাদন কাজে খাটানো হয় না। সুতরাং এ ঋণের দ্বারা আয় বা সম্পদ বর্ধিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। অতঃপর ঋণগ্রহীতাগণ এ ঋণের সুদ পরিশোধ করে তাদের পূর্বার্জিত বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ থেকে—ভিটে-মাটি-স্ত্রী-সন্তান বিক্রি করে। ফলে তাদের সম্পদ প্রদত্ত সুদের সমপরিমাণে হ্রাস পায় এবং সেই সম্পদ গিয়ে ঋণদাতা পুজিঁপতিদের সম্পদ সমপরিমাণে বৃদ্ধি করে তাদের ধনী বানায়; এই লেনদেন মোট জাতীয় সম্পদে কোন বৃদ্ধি ঘটায় না।
দ্বিতীয়ত, উদ্যেক্তাগণ তাদের নিজ নিজ ব্যবসা, শিল্প বা কৃষিতে বিনিয়োগের জন্য সুদ প্রদানের শর্তে যে ঋণ গ্রহণ করে সেসব ঋনের সুদ তারা নিজেরা দেয় না; বরং ধার্যকৃত সুদকে উৎপাদন ব্যয় হিসেবে পণ্য-সামগ্রীর দামের সাথে যোগ করে দেয়। বিষয়টা এভাবে প্রকাশ করা যায়ঃ Cost of Production = Rent+Wages + Interest + Profit = Price’.অতঃপর বিনিয়োগকারীগণ দ্রব্যমূল্যের আকারে এ সুদ চূড়ান্ত ক্রেতা-ভোক্তা জনগণের কাছ থেকে আদায় করে ঋণদাতা ব্যাংক বা মহাজনের হাতে তুলে দেয়। ফলে ভোক্তাগণ প্রতিদিন তাদের ক্রীত প্রতিটি পণ্য-সামগ্রীর দামের সাথে সুদ দিতে বাধ্য হয়। এভাবে ক্রেতাদের প্রদত্ত সুদ ঋণগ্রহীতা উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে ঋণদাতা পুজিঁপতিদের কাছে হস্তান্তরিত হয়, পুজিঁপতিদের সম্পদের অংক বৃদ্ধি পায়; আর ভোক্তাদের সম্পদ সমপরিমাণে হ্রাস পায়; মোট সম্পদ বৃদ্ধি পায় না।
তৃতীয়ত, সরকার তার বাজেট ঘাটতিপূরণ, দুর্যোগ মুকাবিলা ও উন্নয়নমূলক কাজের জন্য দেশী-বিদেশী ঋণদাতা পুজিঁপতিদের নিকট থেকে সুদের ভিত্তিতে যে ঋণ গ্রহণ করে তার সুদও সরকার বর্ধিত কর আকারে জনগনের কাছ থেকে আদায় করে এবং দেশী-বিদেশী পুজিঁপতিদের ধার্যকৃত সুদ পরিশোধ করে। ফলে করদাতাদের সম্পদ সুদ আকারে সরকারের মাধ্যমে দেশ-বিদেশী পুজিঁপতিদের কাছে চলে যায়। এতে পুজিঁপতিদের সম্পদ যে পরিমাণে বাড়ে করদাতাদের সম্পদ সমপরিমাণে হ্রাস পায়; মোট সম্পদ বাড়ে না। সাইয়েদ কুতুব শহীদ আয়াতের ব্যাখ্যায় এ কথাটিই নিম্নরূপে লিখেছেনঃ
“সুদের ভিত্তিতে সূলধন নিয়ে যারা কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলে, তারা সুদ নিজেদের মূলধন বা মুনাফা অংশ থেকে দেয় না, তারা সেটা পণ্যের মূল্যের ওপর চাপিয়ে দেয়। ফলে এই সুদ কার্যত ব্যবহারকারী বা ভোক্তাদেরই দিতে বাধ্য করে। অন্যদিকে, সরকার যখন উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক কাজে সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেয় কিংবা গ্রহণ করে, তখনও সুদ দেওয়ার কাজটি শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপরেই বর্তায় এবং পরিণামে তাদেরকেই সর্বস্বান্ত হতে হয়”। [সাইয়েদ কুতুব শহীদ: তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন, বাংলা অনুবাদ, ২য় খণ্ড, আল-কোরআর একাডেমী, লন্ডন, ৪র্থ সংস্করণ, ২০০১, পৃ. ৭০-৭২]
তাফসীরে আল-মারাগীতে বলা হয়েছে যে, “সুদখোরের মাল বাহ্যত বৃদ্ধি পেলেও তা বৃদ্ধি পায় অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে নিয়ে নেওয়ার কারণে। কতকগুলো লোকের সম্পদ একজনের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়, তাতে গোটা সমাজের সম্পদ অপরিবর্তিতই থেকে যায়”।[তাফসীরে আল-মারাগী, ৩য় খণ্ড,পৃ. ৭০-৭২]
আধুনিক অর্থনীতিবিদগণও বিষয়টি বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। এ ব্যাপারে জেমস রবার্টসনের বক্তব্য হচ্ছে, “The pervasive role of interest in the economic system results in the systematic transfer of money from those who have less to tho~e who have more …. .it applies universally. It is partly because those who have more money to lend get more interest than those who have less; it is ·partly because the cost of interest repayments now forms a substantial element in the cost of all goods and services and the necessary goods and services looms much larger in the finances of the rich”[ames Robertson: Transforming Economic Life: A Millennia/ Challenge, Green Books, Devon, 1998, p. 51-54] ”অর্থনৈতিক পদ্ধতিকে সুদের ব্যাপক ও বিস্তৃত ভূমিকার ফলে যাদের সম্পদ কম তাদের কাছ থেকে যাদের সম্পদ বেশি তাদের কাছে অর্থ নিয়মিতভাবে হস্তান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়া সর্বত্র সক্রিয় (universal)। এই হস্তান্তর অংশত এই কারণে হয় যে, যাদের ঋণ দেওয়ার মত বেশি অর্থ আছে তারা যাদের অর্থ কম তাদের ছেয়ে অধিক সুদ পায়; আর অংশত এ কারণেও হয় যে, বর্তমানে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয়কে সকল পণ্য-সামগ্রি ও সেবার উৎপাদন খরচের অন্যতম উপাদান হিসেবে ধরা হয়; আর বিত্তশালীদের অর্থায়ন দ্বারাই প্রয়োজনীয় যাবতীয় পণ্য-সামগ্রী ও সেবার ব্যাপক উৎপাদন হয়ে থাকে”।
রবার্টসন অন্যএ লিখেছেন, “The transfer of revenue from poor people to rich people, from poor places to rich places, and from poor countries to rich countries by money and finance system is systematic …. One cause of the transfer of wealth from poor to rich is the way interest payments and receipts work through the economy.’’[James Robertson: Future Wealth: A New Economics for the 21.11 Century, Castle Publications, London, 1990, p. 130-131] অর্থাৎ “অর্থ ও আর্থিক পদ্ধতির মাধ্যমে গরীব লোকদের ধনী লোকদের কাছে, দরিদ্র এলাকা থেকে বিত্তশালী এলাকায়, এবং গরীব দেশ হতে ধনী দেশে নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে আয়/সম্পদ হস্তান্তরিত হয়ে থাকে…..। বিত্তহীনদের থেকে বিত্তশালীদের নিকট এইরূপে সম্পদ হস্তান্তরের অন্যতম কারণ হচ্ছে সুদের লেনদেন যা গোটা অর্থনীতিতে পরিব্যাপ্ত”।
একটি বাস্তব উদাহরণ দিলে বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট হবে। বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরের তথ্যে যে চিত্র পাওয়া যায় তা হচ্ছেঃ এদেশে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর বছরে সুদ বাবদ আয় হয় ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা। এই সুদ দেয় ভোক্তা-ক্রেতা জনগণ। আর তা পুজিঁপতিদের সম্পদ বৃদ্ধি করে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব দেশেই সুদের মাধ্যমে ভোক্তাদেরকে এভাবে শোষণ করে পুজিঁপতিরা তাদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদী ঋণব্যবস্থায় ধনী দেশগুলো এই একই পদ্ধতিকে গরীর, বিশেষ করে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছ থেকে সুদ আকারে সম্পদ শোষণ করে নিচ্ছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (OECD) মতে, ১৯৮২ হতে ১৯৯০ সময়কালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশসমুহের প্রতি মোট সম্পদ প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৯২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সম্পদের বেশির ভাগই ছিল ঋণ। স্বাভাবিকভাবেই এ ঋণের ওপর সুদ পাওনা হয়েছে। ১৯৮২-১৯৯০- এর একই সময়ে উন্নয়নশীল দেশসমূহ কেবল ঋণ পরিশোধ বাবদ (আসল ও সুদ) ঋণদাতা দেশগুলোকে ফেরত দিয়েছে ১,৩৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিত্তশালী দেশগুলোর অনুকূলে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৪১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অস্বাভাবিক (Extra ordinary) অধিক পরিমাণ অর্থ ফেরত প্রদান সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ কি বিন্দু মাত্রও হ্রাস পেয়েছে! দুর্ভাগ্য যে তা হয়নি। বরং ঋণগ্রহীতা দেশগুলো ১৯৮২ সালের তুলনায় শতকরা পূর্ণ ৬১ ভাগ অধিক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ১৯৯০ দশকের যাত্রা শুরু করেছে।“ [সূসান জর্জ: দি ডেবট বুমেরাং, হাউ দি থার্ড ওয়াল্ড ডেবট হারমস আস অল; প্লুটো প্রেস; লন্ডন, ১৯৯২]
উক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, আয়াতরে এই অংশের প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে, সুদ এর দাতা বহু লোক, বিশেষ করে ভোক্তা জনগনের কাছ থেকে সম্পদ হস্তান্তর করে কতিপয় পুঁজিপতির সম্পদ বর্ধিত করে তাদের ধনী বানায়। এই বৃদ্ধি আসলে বৃদ্ধি নয়, সম্পদরে হস্তান্তর মাত্র। সুদগ্রীতাদের সম্পদের বৃদ্ধি = সুদদাতাদের সম্পদের হ্রাস অথবা প্রদ্ত্ত সুদ = প্রাপ্ত সুদ। সুদহচ্ছে সম্পদ হস্তান্তরের একটি অতি বড় হাতিয়ার।
২. সুদ আল্লাহর কাছে বাড়ে না
কিছু কিছু লোক প্রশ্ন করেন, সুদের ভিত্তিতে ঋণ এনে বিনিয়োগ করার পর তাতে লাভ হয়; এই লাভ থেকে ঋণদাতার ধার্যকৃত সুদ পরিশোধ করা হয় এবং বিনিয়োগকারী ও এর অংশ পায়। এখানে সম্পদতো বাড়ছেই। সুতরাং ‘সুদ সম্পদ বাড়ায় না’—এ কথার প্রকৃত তাৎপর্য কি? কেউ কেউ আবার বলেন, সুদভিত্তিক অর্থনীতিতেও তো জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাহলে সুদ সম্পদ বৃদ্ধি করে না এ কথা কি যথার্থ?
সম্ভবত এসব প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন, “আল্লাহর কাছে সুদ বৃদ্ধি পায় না” – এর তাৎপর্য হচ্ছে, এর জন্য পরকালীন জীবনে কোন প্রতিদান পাওয়া যাবে না”।[উসমানী, মুহাম্মদ তকি: পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫] কেউ কেউ আবার বলেছেন, এর তাৎপর্য হচ্ছে সুদী কারবারে আল্লাহর আনুকূল্য ও বরকত থাকে না।[সিদ্দিকী, এম, এন: Riba Bank Interest and The Rationale of its Prohibition; Islamic Development Bank (IDB), Islamic Research and Training Institute, Jeddah, KSA, 2004, p.37 এবং উসমানী, উপরোক্ত, পৃ: ১৫]
তবে আল্লামা মওদুদী, সাইয়েদ কুতুব শহীদ ও ড. নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকীসহ বেশ সংখ্যক গবেষক মনে করেন যে, কেবল পরকাল নয়, বরং এ পার্থিব জীবনেও আল্লাহর উক্ত বাণীর বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়।[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা : সুদ ও আধুনিক ব্যাংক্যি, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯০, পৃ. ১৪-১৫: সিদ্দিকী : এম, এস, উপেরাক্ত, পৃ. ৪৪; সাইয়েদ কুতুব শহীদ : পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬৯-৪৭২]
আসলে আল্লাহই হচ্ছেন যাবতীয় সম্পদের মূল উৎস। এই উৎসে সম্পদের বৃদ্ধি না হলে বাস্তবে সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব নয়। তাই “ আল্লাহর কাছে সম্পদ বুদ্ধি পায় না” এর প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে উৎসে সম্পদ বাড়ে না, মূলে বাড়ে না, আসলে বাড়ে না তথা মোট সম্পদ বৃদ্ধি পায় না। এই দিক থেকে আল্লাহর এ কথার অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট ও বাস্তব।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে. পৃথিবীতে সম্পদ বৃদ্ধির একমাত্র পথ হচ্ছে উৎপাদন; আর উৎপাদন করতে হলে প্রয়োজন বিনিয়োগ। এক কথায়, সম্পদ বৃদ্ধি পায় বিনিয়োগের দ্বারা। কিন্দু সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হলে সেখানে কেবল গৃহীত ঋণের আসলটাই বিনিয়োগ করা হয়; এর ওপর ধার্যকৃত সুদ বিনিয়োগ করা হয় না—বিনিয়োগ করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, একজন বিনিয়োগকারী ১৫% সুদ প্রদানের শর্তে ১.০০ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে শিল্পে বিনিয়োগ করলো। এক্ষেত্রে সে কেবল ১.০০ লক্ষ টাকাই বিনিয়োগ করতে পারবে। ১৫% ধার্যকৃত সুদ ১৫,০০০/- টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে না। সুতরাং সম্পদ যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে সে বৃদ্ধি হয় আসল ঋণ ১.০০ লাখ টাকা বিনিয়োগের ফলে; সুদের কারণে নয়। বস্তুতঃ সুদের সাথে সম্পদ বৃদ্ধির সম্পর্ক শুধু এতটুকু যে, সুদ ধার্য করতে রাজী হওয়ার কারণে বিনিয়োগের জন্য ঋণ পাওয়া যায়। সুদের বিনিময়ে ঋণ পাওয়া যায় এজন্য সুদই সম্পদ বাড়ায় একথা বলা যায় না; কারন সুদ ছাড়াও পুঁজি সংগ্রহের আরও উপায় আছে। এছাড়া ঋণগ্রহীতার বিনিয়োগে যদি লোকসান হয় তাহলে তার পূর্বের সম্পদ থেকে পুঁজির লোকসানজনিত ঘাটতি পূরণ করে আসল ঋণসহ ধার্যকৃত সুদ পরিশোধ করতে হয়। এ অবস্থায় তার মোট সম্পদ অবশ্যই হ্রাস পায়। সুতরাং সুদের দ্বারা মোট সম্পদ কখনও বাড়ে না বরং সুদ ঋণগ্রহীতার সম্পদ কমিয়ে দেয়। সুদ সম্পদ বাড়ায় না, অর্থনীতিতে এর আরও অনেক কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
অর্থনীতিতে বলা হয়েছে সম্পদ বৃদ্ধির সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক ইতিবাচক (Positive) অর্থাৎ বিনিয়োগ বাড়লে সম্পদ বাড়ে; আর বিনিয়োগ কমলে সম্পদ কমে। কিন্তু সুদের হারের সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক পরস্পর বিপরীতমুখী। সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পায়; আর সুদের হার কমলে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
সর্বজনবিদিত এ বিধি অনুসারে এ সত্যই প্রতিভাব যে, সুদের হার শূন্যে থাকলে পরিমাণ বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হয়, সুদের হার শূন্য থেকে বেশি হলে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সেই সর্বোচ্চ স্তর থেকে নেমে যায় এবং সুদের হার শূন্য অপেক্ষা বেশি থাকা অবস্থায় আর কখনও তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছতে পারে না, অবশ্য যদি অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে। সেজন্য লর্ড কীনসের মতো অর্থনীতিবিদ সুদের হারকে শূন্যে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন এবং এ লক্ষ্যে সরকারকে তার Coercive power প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।[জে. এম. কীনস: জেনারেল থিওরী অব এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট এন্ড মানি,পৃ.৩৫১]
লর্ড কীনস পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতার সাথে সুদের হারের সমতা বিধির সাহায্যে দেখিয়েছেন যে, সুদের হার বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে দেয় না; বরং পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতা যেকানে সুদের হারের সমান হয়, বিনিয়োগ ও উৎপাদন সেখানেই থেমে যায়। অথচ সুদের হার শূন্য হলে পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতা শূন্য হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগ হতো। [জে. এম. কীনস: উপরোক্ত, পৃ. ৩৫১[]
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সুদ দ্রব্যমূল্যের আকারে জনগণের সম্পদ শুষে নিয়ে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেয়। এর ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং পণ্য-সামগ্রীর চাহিদা কমে যায়; ফলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন হ্রাস করতে হয়; এমনকি এক পর্যায়ে মন্দা-মহামন্দা সৃষ্টি হয়ে অর্থনীতিকে স্থবির করে দেয়। বিনিয়োগ ও উৎপাদন প্রায় একবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বেকারত্বের ব্যাপক ভারের ফলে অর্থনীতি ন্যুজ্বু হয়ে পড়ে। এছাড়া সুদ ঝুকিবহুল বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে, বিনিয়োগকে ফটকা খাতে ঠেলে দেয় এবং বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করে। মানুষ ঝুঁকি গ্রহণপূর্বক পরিশ্রমের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা অপেক্ষা নির্ধারিত সুদে অর্থ লগ্নি করার দিকে বেশি ঝুকেঁ পড়ে। যা বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করে দেয়। (সুদের কুফল পর্যায়ে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।)
আল্লামা মওদূদী আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাই বলেছেন, “একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, এ দুনিয়াতেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ মতাদর্শটি একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ধন সঞ্চয় করে সুদী ব্যবসায় বিনিয়োগ করার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ চতুর্দিক থেকে ধন আহরিত হয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে আসবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা প্রতিদিন কমতে থাকবে। কৃষি, শিল্প ও ব্যবসার সর্বত্র মন্দাভাব দেখা দেবে। জাতীয় অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে। অবশেষে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যার ফলে পুজিঁপতিরাও নিজেদের সঞ্চিত ধন-সম্পদ অর্থ উৎপাদনের কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে না”।[মওদূদী, আবুল আ’লা: পূর্বোক্ত, পৃ.১৪-১৫] মওদূদী তাঁর এ বক্তব্যের সমর্থনে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। উক্ত হাদীসে বলা হয়েছে, “সুদের পরিমাণ যত বেশিই হোক না কেন অবশেষে তা কম হতে বাধ্য”।[উপরোক্ত, পৃ. ১৫ পাদটিকা-১](আহমদ)
আলোচনায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সুদ সম্পদ হস্তান্তর করে, মোট সম্পদ বাড়ায় না। সম্পদ বৃদ্ধি হয় বিনিয়োগের দ্বারা, আর সুদ বিনিয়োগ করা যায় না, সুতরাং সম্পদ বৃদ্ধিতে সুদের কোন ভূমিকা নেই; বরং যে বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পদ উৎপাদন ও বৃদ্ধি করা হয় সুদ সে বিনিয়োগকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌজতে দেয় না; নানাভাবে বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে ও নিম্ন তর স্তরে ঠেকিয়ে রাখে।
‘আল্লাহর কাছে সুদ বাড়ে না’, আল্লাহ প্রদত্ত সুদের এই প্রাকৃতিক (natural) বিধি সত্য ও যথার্থ এতে কোন সন্দেহ নেই। সুদী অথনৈতিক ব্যবস্থায় তা যথাবিহিত কার্যকর রয়েছে; অর্থনীতিবিদগণও সে বিধি খুজেঁ পেয়েছেন- আবিষ্কার করেছেন। সুতারাং এ কথা বিনা দ্বিধায় বলা যায় যে, সুদ সম্পদ বৃদ্ধিকে ঠেকিয়ে রাখে, বাড়তে দেয় না। তবে এ কথার অর্থ এটা নয় যে, অর্থনীতিতে বর্তমানে মোট যে পরিমাণ সম্পদ আছে তা আর কখনও বাড়বে না, বরং সুদ একে কমিয়ে দিবে। আসল কথা হচ্ছে, সুদী অর্থনীতিতে উদ্যোক্তাগণ প্রধানত সুদের ভিত্তিতে পুঁজি ধার নিয়ে বিনিয়োগ করে, অনেকেই নিজস্ব অর্থ বিনিয়োগ করে, আর অনেকেই আবার করযে হাসানাহ, অংশদারিত্ব ইত্যাদি পন্হায় পুঁজি সংগ্রহ করে কারবারে বিনিয়োগকরে। এসব বিনিয়োগিত অর্থের দ্বারা জমি ক্রয় বা ভাড়া নেয়া হয়, যন্ত্রপাতি কেনা হয়, শ্রম নিয়োগ করা হয়, কাঁচামাল ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়; ফলে পণ্য-সামগ্রী উৎপাদিত হয়। এতে মোট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া বা সম্পদ পূর্বের তুলনায় বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে তা হয় পুঁজি বিনিয়োগের ফলে; সুদের কারণে নয়। তাছাড়া, অর্থনীতির বিধির সাহায্যে দেখানো হয়েছে যে, সুদমুক্ত অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন সবোর্চ্চ সীমায় পৌছা সম্ভব যা সুদী অর্থনীতিতে কখনও সম্ভব নয়।
যাকাত
১. যাকাত দিলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন
বস্তুতঃ যাকাত হচ্ছে সুদের বিপরীত। সুদ সাধারণ মানুষের সম্পদ শোষণ করে এনে কতিপয় পুঁজিপতির হাতে কুক্ষিগত করে দেয়, তাদের আরও ধনী বানায়; আর সাধারণ মানুষ ক্রয়-ক্ষমতা হারিয়ে নিজেদের অভাব পূরণে অক্ষম হয়ে পড়ে। অপরদিকে, যাকাতে বিত্তশালী,ধনী, পুজিঁপতিদের কাছ থেকে সম্পদ তুলে নিয়ে যাদের সম্পদ নাই তাদের মধ্যে বন্টন করা হয়। ফলে গরীব লোকদের হাতে ক্রয়-ক্ষমতা আসে, তারা নিজেদের অভাব পূরণে সামর্থবান হয়ে উঠে, তারা উপকৃত হয়। আল্লাহর নিঃস্ব অভাবী বান্দাগণ উপকৃত হওয়ায় আল্লাহ খুশী হন, সন্তুষ্ট হন। আল্লাহর সম্তূষ্টি অর্জন করার জন্যই যাকাত দেওয়া হয়; একমাত্র এই নিয়তেই যাকাত দেওয়া বিধেয়।
২. যাকাত দাতারাই তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করতে থাকে
আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় যে, যাকাত যারা দেয় তাদের সম্পদ প্রদত্ত যাকাতের সমপরিমাণে হ্রাস পায়। কিন্তু মহামহিম আল্লাহ এখানে এর বিপরীত কথা বলেছেন। আল্লাহ সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন তারাই, মানে সেই যাকাত দানকারীরাই; অতঃপর সম্পদ বৃদ্ধি করে বলেননি, ‘বৃদ্ধি করতে থাকে’ (conrinuous) বলেছেন। যাকাতদাতারা কিভাবে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করতে থাকে সে বিষয়টি বুঝা দরকার। যাকাত লেনদেন ও তার বাস্তব ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয় না।
উপরে বলা হয়েছে, যাকাতের সম্পদ পাওয়ার ফলে যাকাত গ্রহীতা দারিদ্র জনসাধারণের হাতে ক্রয়-ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। তারা এ সম্পদ দ্বারা নিজেদের অভাব পূরণার্থে প্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রী ক্রয় করে। ফলে বাজারে পণ্য-সামগ্রীর কার্যকর চাহিদা (effective demand) বেড়ে যায়। পণ্য-সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পায় এবং অধিক মুনাফার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হয়; অধিক মুনাফা পাবার আশায় তারা দ্রুত পণ্য-সামগ্রী উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসে। আর বিনিয়োগ কেবল তারাই করে যারা যাকাত দেওয়ার যোগ্য- সাহিবে নিসাব। কারণ, বিনিয়োগ করার মত পুঁজি কেবল সাহিবে নিসাব কিছু লোকের কাছেই থাকে; যাকাত প্রদানে অযোগ্য লোকদের কাছে পুঁজি থাকে না। সুতরাং যাকাতদাতাদের মধ্যে যাদের হাতে পুজিঁ আছে তারাই বিনিয়োগ করে; পণ্য-সামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রি করে তারাই লাভ পায়। আর এসব প্রথম পণ্য-সামগ্রী যাকাত বাবদ প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা তারাই ক্রয় করে যারা যাকাতের সম্পদ পেয়েছে। সুতরাং যাকাতদাতাগণ যাকাত হিসেবে যে অর্থ প্রদান করে পণ্য-সামগ্রীর দাম আকারে তা আবার যাকাতদাতা বিনিয়োগ ও উৎপাদনকারীদের কাছেই ফিরে আসে। তাদের সম্পদ বৃদ্ধি পায়। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয় না; বরং প্রথমবার বিনিয়োগ ও উৎপাদন করতে বাড়তি শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। ফলে বেকার লোক যাদের আয়-রোজগার, ক্রয়-ক্ষমতা নেই, তাদের কর্মসংস্থান হয়; শ্রমের মজুরী পাওয়ায় তাদের হাতে ক্রয়-ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। সুতরাং এসব শ্রমিক তাদের অভাব পূরণার্থে প্রাপ্ত মজুরী ব্যয় করে পণ্য-সামগ্রী ক্রয় করে। ফলে পন্যের কার্যকর চাহিদা আবার বৃদ্ধি পায়। যাকাতদাতা বিনিয়োগকারীদেরকে আবার তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হয়। এভাবে পুনরায় তারা উৎপাদিত পণ্য-সামগ্রী বিক্রয় করে মুনাফা অর্জন করে। ঘটনা এখানেই শেষ হয় না। বরং দ্বিতীয়বার বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে আবার শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। আবার কিছু বেকার লোক কাজ পায়, মজুরী পায়। নতুন করে তাদেরও ক্রয়-ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। এই ক্রয়-ক্ষমতা ব্যয় করে তারা আবার পণ্য-সামগ্রী ক্রয় করে। যাকাতদাতা বিনিয়োগকারীগণ আবারও বিনিয়োগ-উৎপাদন বৃদ্ধি করে। তৃতীয়বার বিনিয়োগে আবার শ্রমিক লাগে। এইভাবে ধাপে ধাপে চলতে থাকে। মোট কথা, যাকাত ক্রয়-ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পণ্য-সামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি করে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে অপরিহার্য করে তোলে। অতঃপর যেহেতু বিনিয়োগ কেবল যাকাতদাতারাই করে সেহেতু আল্লাহ বলেছেন, ‘সেই যাকাত দানকারীরাই’। আর তারা একবার বৃদ্ধি করে থেমে যায় না, ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করতে থাকে। এজন্য বলেছেন, ‘বৃদ্ধি করতে থাকে’। আল্লাহর শব্দ প্রয়োগ যে কত বাস্তব তা অবশ্যই অনুধাবন করার বিষয়।
আল্লামা মওদুদী সংক্ষেপে অথচ অতি সুন্দরভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, “অর্থ-সম্পদ ব্যয় করলে এবং যাকাত ও সাদাকাহ দান করলে পরিণামে জাতির সকল বক্তির হাতে এ সম্পদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেক ব্যক্তি যথেষ্ট ক্রয়-ক্ষমতার অধিকারী হয়। শিল্পোৎপাদন বেড়ে যায়, সবুজ ক্ষেতগুলো শস্যে ভরে উঠে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়… সবার অবস্থা সচ্ছল হয় এবং সব পরিবারই হয় সমৃদ্ধিশালী।“[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা: পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫]
উক্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, আল্লাহ এই আয়াতের দ্বারা সুদ ও যাকাতের প্রকৃত অর্থনৈতিক তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। একদিকে আল্লাহ সুদের ভিত্তিমূলে আঘাত কারেছেন এবং তা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন; অপরদিকে, যাকাতের সুফলের কথা জানিয়ে যাকাতদাতাদের উদ্বুদ্ধ করেছে।
সূরাতুন্নিসা
সূরাতুন্নিসার ১৬০-৬১ আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ
فَبِظُلْمٍ مِّنَ الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَن سَبِيلِ اللَّهِ كَثِيرًا [٤:١٦٠]وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ ۚ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا [٤:١٦١
“ইহুদী নীতি অবলম্বনকারীদের জুলুমের কারণে আমরা তাদের জন্য এমন অনেক পবিত্র জিনিস হারাম করে দিয়েছি যা পূর্বে তাদের জন্য হালাল ছিল। আর এ কারণেও যে, তারা নিজেরা আল্লাহর পথ হতে বিরত রাখতো; আর এ কারণেও যে, সুদ গ্রহণ করতো যদিও তা থেকে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল; আর তারা মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতো। তাদের মধ্যে যারা কাফির তাদের জন্য আমরা পীড়াদায়ক আযাব তৈরী করে রেখেছি”।
পটভূমি এ মূল বক্তব্য
রাসূলূল্লাহ (সাঃ) মদীনায় হিজরত করার পর ৩য় হিজরী সালের শেষার্ধ থেকে ৪র্থ সালের শেষ অথবা ৫ম সালের ১ম ভাগের মধ্যেই সূরাতুন্নিসা নাযিল হয়েছে। মদীনায় সেকালে বেশ সংখ্যক ইহুদী গোত্র বাস করত। আর সেখানে ইহুদীরাই সুদী কারবার করত। এই প্রেক্ষাপটে এই আয়াত নাযিল হয়।
সূরাতুন্নিসার এই আয়াতে আল্লাহ ইহুদীদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলছেন যে, ইহুদীদের জন্য সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল; কিন্তু ইহুদীরা সে নিষেধাজ্ঞা লংঘন করে সুদ গ্রহণ করেছ আর পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়েছে। সুদ গ্রহণ ও অন্যায় ভক্ষণসহ অন্যান্য জুলুমমূলক কাজ করায় ইহুদীরা দুনিয়ায় আল্লাহর গযরে নিপতিত হয়েছে এবং পরকালে কঠিন পীড়াদায়ক আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে। দুনিয়া-আখেরাতে ইহুদীদের এই ভয়াবহ পরিণতির ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরে আল্লাহ মানব জাতিকে সজাগ, সচেতন ও সতর্ক করেছেন, যাতে মানুষ এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং ইহুদীদের আচরণ অনুসরণ না করে। বস্তুতঃ এ বিষয়ে প্রথম নাযিলকৃত আয়াতে সুদের বাস্তর চেহারা উন্মোচন করার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নাযিলকৃত এই আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা সুদের বাস্তব পরিণতির ঐতিহাসিক তথ্য-চিত্র তুলে ধরেছেন।
আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা’য়ালা সুদকে সুস্পষ্টভাবে অন্যায় ভক্ষণের মধ্যে শামিল করেছেন এবং একে অতি বড় জুলুম বলে অভিহিত করেছেন।
১. সুদ একটি অন্যায় ভক্ষণ ও জুলুম
জুলুম শব্দ দ্বারা সাধারনত অবিচার ও বেইনসাফীকে বুঝায়। শব্দটি ইনসাফ বা সুবিচার শব্দের বিপরীত। সুবিচার হচ্ছে ‘আদল’ বা ন্যায়বিচার। আদল বা ন্যায়বিচার অর্থ হচ্ছে, ভারসাম্য ও সুষমতা এবং ন্যায্য অংশ নিশ্চিত করা। এর বিপরীত কাজ করার নাম হচ্ছে জুলুম। আল্লামা মওদূদী লিখেছেন, জুলুম শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে, কারও অধিকার হরণ করা।[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা: তাফহীমূল কুরআন, সূরা লোকমান, টীকা-২১] সে হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অধিকার যথাযথভাবে ও সততার সাথে প্রদান করা হচ্ছে সুবিচার। আর এর বিপরীত, কোন ব্যক্তির প্রাপ্য বা তার কোন অধিকার ক্ষুণ্ন করা বা তা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হলে তাই হয় অবিচার বা জুলুম। আকরাম খান বলেছেন, “Zulm refers to all forms of inequity, injustice and exploitation” [Khan, Mohammad Akram: An Introduction to Islamic Economics, The International Institute of Islamic Thought and Institute of Policy Studies,Islamabd, 1994, p. 133.] অন্যায় ভক্ষণ একটি জুলুম; কারণ এতে অপরের সম্পদ নেওয়া হয়, অথচ যার সম্পদ নেওয়া হয় তাকে কোন বিনিময় বা দাম দেওয়া হয় না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ঘুষ, জুয়া এগুলো সবই অন্যায় ভক্ষণ ও জুলুম।
আল্লাহ তা’য়ালা সুদগ্রহণ ও অন্যায় ভক্ষণকে একই আয়াতে এনে সুদকে অন্যায় ভক্ষণের মধ্যে শামিল করেছেন।[চাপরা, এম, ওমর, The Nature ofRiba, Journal oflslamic Banking and Finance. Vol. 6, No.3, July-September, Summer Issue, 1989, p. 7.] কারণ, সুদ গ্রহণ করে গ্রহীতা তার বিনিময় দেয় না। ড. সিদ্দিকী লিখেছেন, “….riba amounting to unlawful appropriation of other people’s property is indicated in the verse.”[সিদ্দিকী, এম, এনঃ পূর্বোল্লেখিত, পৃ, ৪৩] আল-মারাগী বলেছেন, “সুদ বিনিময় ছাড়াই পরের ধন কেড়ে নেয়, এর চেয়ে বড় জুলুম আর কি হতে পারে”।[তাফসীরে আল-মারাগী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮৪-৮৭] তিনি বিনিময় ছাড়া মূলধনের অতিরিক্ত গ্রহণ করাকেই সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।[উপরোক্ত, উদ্ধৃত, আব্দুর রহীম: আল-কুরআরে অর্থনীতি, ১ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯০, পৃ. ২৪২] এ বিষয়ে আল্লামা ইবনুল কায়্যিম বলেছেন, “জাহেলিয়্যাতের যুগে নাসিয়া সুদর ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। তাতে ঋণ ফেরত দেওয়ার মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হতো এবং সেই হিসেবে ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি করে দেওয়া হতো। একশত টাকা কয়েক শত গুণ বেড়ে হাজার টাকায় পরিণত হতো। ফলে এ সুদে ক্ষতির মাত্র অত্যন্ত তীব্র ও সাংঘাতিক রূপ পরিগ্রহ করতো। ঋণগ্রহীতার স্পাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তিই গ্রাস হয়ে যেত এবং সে সুদ বাবদ বিপুল সম্পদ দিয়ে দিতে বাধ্য হতো তার দ্বারা কোনরূপ ফায়দা না দিয়েই। ফলে ভাইয়ের সম্পদ বাতিল ভক্ষণে পরিণত হতো; আর তার ভাই সে কারণে কঠিন বিপদে পড়ে যেত। এই প্রেক্ষিতে সুদ হারাম করা হয়েছে, যা জনগণের জন্য মারাত্মক জুলুম”।[উদ্ধৃত, আব্দুর রহীম: পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৪-২৫৫]
২. ইহুদী জাতির সুদখোরী
বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচলিত সুদী ব্যাংক ব্যাবস্থার গোড়াপত্তন ইহুদী স্বর্ণকারদের (Goldsmiths) হাতে হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকভাবে মনে করা হয়। সুদূর অতীতে এক সময়ে কেউ সোনা সঞ্চয় করলে নিরাপদ হেফাজতের জন্য তা ইহুদী গোল্ডস্মিথদের কাছে গচ্ছিত রাখত এবং এ মর্মে একটি রসিদ লিখে নিত। কালক্রমে এই রসিদগুলোই বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে উঠে। ফলে দরকার না হওয়ায় সোনা জমাকারীগণ তাদের গচ্ছিত স্বর্ণ তুলে নিতে আসতো না। সোনা সারা বছর গোল্ডস্মিথদের সিন্দুকই পড়ে থাকতো। এই সুযোগে গোল্ডস্মিথগণ গচ্ছিত সোনা ধার দিয়ে তার ওপর সুদ আদায় করতে লাগল। অতঃপর গোল্ডস্মিথগণ যখন বুঝতে পারল যে, ঋণগ্রহীতাই আসছে, তখন তারা আর এক ধাপ এগিয়ে গেল। এবার তারা একই সোনার বিপরীতে বহুসংখ্যক জাল জমার রসিদ তৈরী করে সেই (জাল) রসিদগুলো ধার দিয়ে তার ওপর সুদ গ্রহণ করতে লাগলো। গোল্ডস্মিথেরা এভাবেই সম্পূর্ণ ভূয়া মুদ্রার আকারে শতকরা ৯০ ভাগ জাল মুদ্র তৈরী করে তার মালিক সেজে প্রভূত পরিমাণে সুদ অর্জন করত।
নিঃসন্দেহে এটি একটি অতি বড় প্রতারণা ও জালিয়াতি ব্যবসা। কিন্তু দেশের রাজা, মন্ত্রী, আমীর-উমার সবাই পুজিঁপতিদের ঋণের জালে আটকা পড়েছিল। এমনকি, যুদ্ধ এবং অন্যান্য সংকট মুকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারও তাদের কাছ থেকে বড় বড় ঋণ নিয়েছিল। ফলে সুদখোরদের এই জালিয়াতি ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নৈতিক বল ও শক্তি-সাহস কারও ছিল না। এভাবেই এই বিরাট প্রতারণা ও জালিয়াতি কারবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে; শুধু তাই নয়, বরং সরকারসমূহের দুর্বলতার সুযোগে পুজিঁপতিগণ নানা কৌশলে একে আইনত বৈধ করে নিয়েছে এবং এতদসংক্রান্ত সকল আইন যাতে তাদের স্বার্থের পক্ষে থাকে তারও পাকাপোক্ত ব্যবস্থা তারা করে নিয়েছে। আধুনিককালে প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যাংকের জাদুকরী ক্ষমতা বলে খ্যাত Multiple creation- এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যা করছে তা গোল্ডস্মিথদের এ্ জালিয়াতি পদ্ধতি বৈ কিছু নয়।
ইহুদীরা যে সুদ গ্রহণ করতো, তা আরবে প্রচলিত সুদের অনুরূপ ছিল। আল-তাবারি এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, “তারা (ইহুদীরা) যে সুদ গ্রহণ করতো তা আসল পরিমাণের ওপর পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর বিনিময়ে অতিরিক্ত হিসেবে ধার্য করা হতো।[আল-তাবারি; জামে আল-বয়ান, ভলি-৬, পৃ. ১৭] এ ক্থার তাৎপর্য হচ্ছে সে কালে “ঋণ ও ক্রয়-বিক্রয় থেকে সৃষ্ট দায়ের ওপর রিবা ধার্য করা হতো”।[বাদাবী, যাকি আল দ্বীন : Theory of Prohibited Riba, ইংরেজী অনুবাদ, ইমরান আহসান খান নিয়াজী, [email protected], ২০০৪, পৃ; ৭৮]
বনি ইসরাঈলদের মধ্যে প্রচলিত সুদের বর্ণনা দিয়ে বাদাবী বলেছেন, “বনি ইসরাঈলদের সুদ মুদ্রার ওপর ধার্য করা হতো। আর সেকালে রৌপ্য ও খাদ্য-দ্রব্যই বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।[বাদাবী, যাকি আল-দ্বীনঃ উপরোক্ত, পৃ. ৭৯-৮০] তিনি বলেছেন, বনি ইসরাঈলদের মধ্যে প্রচলিত সুদ ও জাহেলী যুগে আরবে প্রচলিত সুদ ছিল এক ও অভিন্ন এবং আজও ইহুদীদের মধ্যে সেই সুদই চালু রয়েছে। বর্তমানে তাদের মাধ্যে প্রচলিত সুদ হচ্ছে , ঋণের ওপরে সময়ের ভিত্তিতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত, যদিও সুদের হারে পরিবর্তন হয়েছে”।[বাদাবী, যাকি আল-দ্বীনঃ উপরোক্ত, পৃ. ৭৯-৮০]
বস্তুতঃ ইহুদীরা সুদী কারবারে এতটাই অভ্যস্ত ও মত্ত হয়ে পড়েছিল যে, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সুদের নিষেধাজ্ঞাকে নিজেদের পক্ষে পরিবর্তন করে নেওয়ার দুঃসাহস দেখাতেও কুন্ঠিত হয়নি। সুদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, অর্থ সঞ্চয়ের আকাঙ্খা থেকে শুরু করে সুদী কারবারের বিভিন্ন পর্যায়ে যাবতীয় কর্মকাণ্ড স্বার্তন্ধতা, কার্পণ্য, সংকীর্ণমনতা, মানসিক কাঠিন্য ও অর্থপূজার পাদর্শিতার প্রভাবাধীনে পরিচালিত হয়। ফলে সুদ মানুষের মধ্যে অর্থলিপ্সা, লোভ, স্বার্থপরতা ও সহানুভূতিহীন মানসিকতার জন্ম দেয়।[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা: প্রগুক্ত, পৃ. ৮২] ঝুকিঁমুক্ত, নির্ধারিত ও নিশ্চিত আয় পাবার লোভ মানুষের বিবেচনা, আচার-আচরণ, এমনকি বিবেককে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং মানুষের ন্যায়-অন্যায়বোধকে বিকৃত করে দেয়। স্বার্থের কারণে মানুষ যে কোন ন্যায়কে অন্যায় এবং অন্যায়কে ন্যায় ঘোষণা করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হয় না। ইহুদী জাতির এই অবস্থাই হয়েছিল।
৩. ইহুদী জাতির শাস্তি
সুদের নিষেধাজ্ঞা লংঘন করে সুদ গ্রহণ ও পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস ইত্যাদি জুলুম করার কারণে আল্লাহ এ দুনিয়াতে ইহুদীদের জন্য কতিপয় পবিত্র ও হালাল খাদ্য হারাম করে দিয়েছেন। এ নিষেধাজ্ঞা কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে এবং শেষ দিন পর্যন্ত তারা এ শাস্তি ভোগ করবে।
কুরআন মজীদের অন্য আয়াত থেকে জানা যায় ইহুদীদের জন্য যেসব হালাল জিনিস হারাম করা হয়েছিল সেগুলো ছিল খুর বিশিষ্ট সকল জন্তুর গোশত এবং গাভী ও ছাগলের চর্বি (৬:১৪৬)। আল-কুরআন এ কথাও জানিয়ে দিয়েছে যে, তাওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইসরাঈল (ইয়াকুব আঃ ) নিজে এসব জিনিস ব্যবহার করতেন না(৩:৯৩)। এ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তাঁর নবীর কাছে আয়াত নাযিল করে ইহুদীদের জন্য এসব খাদ্য হারাম করেছেন- ব্যাপার আসলে তা নয়; বরং নবী ব্যবহার না করায় পরবর্তী বংশধরেরা তা বর্জন করেছে। কালক্রমে তাদের আলেম ও ফকীহগণ এসবকে হারাম মনে করতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া জুলুমবাজ, কৃত্রিম ও জাল আইন প্রণেতারা এসব ভাল ও পাক্ জিনিস হারাম করে আইন প্রণয়ন করে আল্লাহর বিধান বলে জারি করে দিয়েছে এবং পরবর্তীতে তাওরাতে সংযোজন করে নিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বর্তমান ইহুদী শরীয়াত লিপিবদ্ধ করার কাজ দ্বিতীয় খৃস্টাব্দের শেষের দিকে …………. ইয়াহুদার হাতে সম্পন্ন হয়েছে।[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লাঃ তাফহীমূল কুরআন, ৩য় খণ্ড, ১ম সংস্করণ, আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৯৪, পৃ. ১৭৬-১৭৭]
উপরোক্ত শাস্তি ছাড়াও সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ দুনিয়াতে ইহুদীদের ওপর নিপতিত গযবের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছেঃ
“এরা যেখানে গিয়েছে সেখানেই এদের ওপর অপমানের মার পড়েছে, আল্লাহর দায়িত্বে কিংবা মানুষের দায়িত্বে কোথাও কিছু আশ্রয় পেয়ে থাকলে ভিন্ন কথা। আল্লাহর গযব তাদেরকে একেবারে ঘিরে রেখেছে; তাদের ওপর অভাব, দারিদ্র্য ও পরাধীনতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এসব কিছু এজন্য হয়েছে যে, তারা আল্লাহর আয়াতকে অমান্য করেছে এবং পয়গাম্বরদের অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। বস্তুতঃ এটা তাদের নাফরমানি ও অত্যাধিক বাড়াবাড়ির ফল”। (৩:১১২)
আল্লাহর আদেশ অমান্য, আল্লাহর নাফরমানি ও বাড়াবাড়ি করার কারণেই ইহুদীরা উক্ত গযবে নিপতিত হয়েছে আয়াতে স্পষ্ট করেই সে কথা বলা হয়েছে। আর সুদের নিষেধাজ্ঞা লংঘন, সুদ গ্রহণ ও পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খাওয়াও আল্লাহর আদেশ অমান্য, আল্লাহর নাফরমানি ও বাড়ারাড়ি করার মধ্যে শামিল। ইহুদীরা সুদের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে সুদ খেয়েছে শুধু তাই নয়, তারা সুদের আয়াত পরিবর্তন করার ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করেছে।
বস্তুতঃ দুনিয়ায় যারা সুদ খায় তারা সামাজে সুদখোর-শোষক বলে ঘৃণিত ও নিন্দিত হয়। দুনিয়ার সর্বত্র সুদখোর মাহাজনদের দিকে তাকালে এর সত্যতা পাওয়া যায়। ইহুদীরা জাতি হিসেবে সুদখোর; আল্লাহর নফরমানির ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা তাদের বৈশিষ্ট্য। তাদের শাস্তি অনেক বেশি ও ব্যাপক। মার্চেন্ট অব ভেনিসের শাইলক হচ্ছে ইহুদীদের প্রতিভূ-শোষক-ঘৃণ্য। “পৃথিবীর অন্যানা জাতি দুনিয়ায় যে সব উত্তম জীবিকা উপভোগ করে, সুদীর্ঘকাল ইহুদীদের সেসব থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। [২৭] দুই হাজার বছর পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও তারা সম্মানজনক আশ্রয় পায়নি। দুনিয়ায় তাদেরকে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। অগাধ ধন-দৌলত থাকা সত্ত্বেও দুনিয়ার কোথাও তাদের এক বিন্দু শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়নি। দুনিয়ার বুকে এ জাতিকে না-মৃত্যু না-জীবন-এরা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। এদের ইতিহাস যেন চিরদিন দুনিয়াকে এ শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর কিতাব নিজের হাতে থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক আচরণ অবলম্বন করার দুঃসাহসের পনিণতি কি হয়। এরপর পরকালের আযাবতো আরও অধিক ভয়ঙ্কর হবে”।[২৮] বস্তুতঃ সুদ দুনিয়ায় ঘৃণা অপমান, জিল্লাতি আর পরকালীন আযাবের বাহক। ইহুদী জাতি তার সাক্ষী।
সুরাতু আলে-ইমরান
সূরাতু আলে ইমরানের ১৩০-১৩৪ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ [٣:١٣٠]وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ [٣:١٣١]وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ [٣:١٣٢]۞ وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ [٣:١٣٣]الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ [٣:١٣٤]
“হে ঈমানদারগণ, দ্বিগুণ-চতুর্গুণ-বহুগুণ বর্ধিত সুদ খেয়ো না; আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে। আর সেই আগুনকে ভয় কর যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, সম্ভবত তোমাদের প্রতি রহম করা হবে। তোমার রবের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাও, যা আকাশ এ পৃথিবীর ন্যায় বিস্তৃত এবং যা সেই মুত্তাকীদের জন্য তৈরী করা হয়েছে যারা সচ্ছল-অসচ্ছল সর্বাবস্থাতেই নিজেদের ধন-মাণ খরচ করে, যারা ক্রোধ হজম করে এবং মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়। আল্লাহ মুহসিন লোকদের ভালবাসেন”।
পটভূমি
বিশিষ্ট তাফসীরকারদের মতে, আল-কুরআনের সুদের আয়াতগুলোর মধ্যে উল্লেখিত আয়াত কয়টি তৃতীয় পর্যায়ে উহুদ যুদ্ধের পরে নাযিল করা হয়েছে। উহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রথমে বিজয়ী হয়েছিল; কিন্তু শেষে মুসলিমগণ পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন। সুরা আলে ইমরানে আল্লাহ নিজে উহুদ যুদ্ধের পর্যালোচনা করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে- সম্পদের লোভ এই লোভ তাদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করেছে, এই লোভই তাদেরকে নেতা তথা নবীর (সাঃ) আদেশ লংঘনে ঠেলে দিয়েছে; এই লোভই মহাবিপর্যয় বয়ে এনেছে (৩:১৫২)। আল্লামা মওদূদী এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “প্রকৃত সাফল্য ও বিজয় লাভের সময়ে মুসলিম সৈনিকগণ দুনিয়ার ধন-সম্পত্তির লোভে পড়ে গিয়েছিলেন এবং শক্র সৈন্যদেরকে খতম করে নিজেদের বিজয়কে পূর্ণ করার পরিবর্তে গনীমতের মাল সংগ্রহে লেগে গিয়েছিলেন। যে তীরন্দাজ বাহিনীকে পশ্চাৎ দিকের প্রতিরক্ষার জন্য নবী করীম (সাঃ) মোতায়েন করেছিলেন তারা যখন দেখলেন যে, শক্রসৈন্য পলায়ন করছে, আর মুসলিম সৈনিকগণ শক্রদের ফেলে যাওয়া ধন-মাল সংগ্রহ করছেন, তখন তারা এই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন যে, গনীমতের মাল সবই বুঝি সেই সংগ্রহকারীরাই নিয়ে যাবেন; আর তারা নিজেরা গনীমত থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন। এই চিন্তা করে নবীর (সাঃ) আদেশ স্মরণ করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাদের অধিকাংশ লোক নির্ধারিত স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেন।[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা: পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৬,৭৮,৮০] আর এই গিরিপথ দিয়ে মুসলমানদের ওপর বিপর্যয় নেমে এলো। শক্রবাহিনী গিরিপথ দিয়ে ঢুকে পেছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীর ওপর ঝাপিয়েঁ পড়লো; আর সামনে যারা পালিয়ে যাচ্ছিল তারাও ফিরে দাঁড়ালো। এই সাঁড়াশী আক্রমণের মুকাবিলায় গনীমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত অপ্রস্তুত মুসলিম বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। তাদের অর্জিত বিজয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হলো।[সিদ্দিকী, নাঈম, মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ রাসূলূল্লাহ (সাঃ), বাংলা অনুবাদ, আকরাম ফারুক, সম্পাদনা, আব্দুস শহীদ নাসিম, শতাব্দী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ৩৫১-৩৫৪]
আল্লাহ তা’য়ালা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নেতৃত্বে সংগঠিত ঈমানদারদের এই দলটিকে বিশ্বনেতৃত্বের আসনে সমাসীন করবেন এবং বিশ্বমানবতার কল্যাণে তাদের নিয়োজিত করবেন। কিন্তু মনের কোণে সম্পদের মোহ ও লোভ, উদ্দেশ্যের প্রতি একাগ্রতার অভাব, অনৈক্য ও নেতার আদেশ পালনে নিষ্ঠার অভাব বিদ্যমান থাকলে কোন দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে মানুষের কল্যাণার্থে মহৎ ও বৃহৎ কিছু করা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ তা’য়ালা উহুদের পরীক্ষার মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে যাদের অন্তরে এইসব রোগ ছিল তাদের সে রোগ বের করে আনার ব্যবস্থা করেছেন। অতঃপর আল্লাহ নিজে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন, তাদের বিপর্যয়ের কারণ কি, কোন কোন দুর্বলতার কারণে তাদের এই বিপর্যয় হলো; তারা মর্মাহত ও অনুতপ্ত হয়েছেন। এই মনস্তাত্ত্বিক ও বাস্তব অবস্থায় ঈমানদার এ বাহিনীকে সম্পদের মোহমুক্ত, নির্লোভ, পরকালমূখী ও একমাত্র আল্লাহনির্ভর, সুসংহত, ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সুদরূপী অতি লোভনীয় জিনিস থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়ে আয়াত কয়টি নাযিল করা হয়।
মূল বক্তব্য
এই আয়াতগুলোর শুরুতেই মহান প্রভূ আল্লাহ ঈমানদারদের সম্বোধন করেছেন এবং সুদ খেতে মানা করেছেন; কারণ সুদ দ্বিগুণ-চতুর্গুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি পায় যা অতি বড় শোষণ, অবিচার ও জুলুম। অতঃপর ঈমানদারগণ যাতে সফল হতে পারেন আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত পেয়ে ইহ-পরকালীন জীবনে কল্যাণ লাভ করতে পারেন সে লক্ষ্যে আল্লাহ কতিপয় হেদায়াত দিয়েছেন। হেদায়াতগুলো হচ্ছেঃ
১. আল্লাহকে ভয় করা তথা তাকওয়া অবলম্বন করা;
২. জাহান্নাম তথা আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করা;
৩. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা;
৪. আল্লাহর ক্ষমা ও বেহেশত পাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করা;
৫. নিজের সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা এবং
৬. ক্রোধ হজম ও অপরকে ক্ষমা করা।
দেখা যাচ্ছে, সুদ বর্জনে মুমিনদের অথস্ত করা এবং পরিবেশ গড়ে তোলাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। নিচে কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা পেশ করা হলো :
১. আদয়াফাম মুদয়াফাহ
আলোচ্য আয়াত কয়টি প্রথমেই আল্লাহ সুদ খেয়ো না বলেছেন এবং ‘আদয়াফাম মুদযাফাহ’ বিশেষণ দ্বারা সুদকে বিশেষায়িত (qualify) করেছেন। কোন কোন তাফসিরকার ও অনুবাদক এর অর্থ করেছেন চক্রবৃদ্ধি সুদ।[আব্দুর রহীমঃ পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৬। সাইয়েদ কুতুব শহীদ: পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৫ , শাফী মুফতী মুহাম্মদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৯] এতে কিছু কিছু লোক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করে থাকে। তারা বলে আল-কোরআনতো কেবল চক্রবৃদ্ধি ও উচ্চ হারের সুদ নিষিদ্ধ করেছে , সরল ও নিম্ন হারের সুদ হারাম করেনি। তারা এপর্যন্ত বলে যে,ব্যাংক ঋণে সুদের হার যদি সরল ও নিম্ন হয়, তাহলে তা নিষিদ্ধ সুদের আওতায় পড়বে না।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ এখানে সুদের কোন বিশেষ ধরন নয় বরং সুদের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য তথা স্বভাবধর্ম (Nature) কে বুঝিয়েছেন। সুদের স্বভাব হচ্ছে, সময়ের গতির সাথে ধাপে ধাপে গুণে গুণে বৃদ্ধি পাওয়া। ইমাম শাওকানী লিখেছেন, শব্দ দুটি বুঝিয়ে দেয় যে, সুদের মাত্রা বারবার বৃদ্ধি করা হতো।[উদ্বৃত, আব্দুর রহীম: তফসীরে মাআরেফুল কুরআন, বাংলা অনুবাদ ও সম্পাদনা, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, পৃ. ৩৫৪-৩৫৫] একইভাবে সাইয়েদ কুতুব শহীদ লেখেছেন, “সুদী কারবার একদিক দিয়ে পুনরাবৃত্তিসম্পন্ন ব্যবস্থা, আর অপরদিক দিয়ে তা যৌগিকও; তা সময়ের অগ্রগতির সাথে বারবার আবর্তিত হওয়ার দরুন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। বস্তুতঃ এটা সুদী ব্যবস্থার স্বভাবধর্ম”।[সাইয়েদ কুতুব শহীদ: পূর্বোক্ত. ২৩৪-২৩৫] ইংরেজীতে রচিত তাফসীর ও তরজমা গ্রন্হসমূহে ‘আদয়াফাম মুদায়াফাহ’ –এর অর্থ করা হয়েছে, Double, Redouble, Multiple. এর দ্বারা সুদ বৃদ্ধি পাওয়া তথা দ্বিগুণ, চর্তুগুণ, বহুগুণ হওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে। ড. হাসানুজ্জামান বলেছেন যে, সুদের হার যত কমই হোক, সময়ের সাথে তা দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ- এই গতিতে বাড়তে থাকে। সুদ যদি সরলও হয় তা হলেও এভাবেই বৃদ্ধি পায়। তিনি অতি নিম্ন হার ও সরল সুদের হিসাব কষে দেখিয়েছেন যে, বার্ষিক সরল সুদের হার যদি মাত্র ২.০০ টাকা হয় তাহলে ১০০.০০ টাকার ১ বছরে সুদ হবে ২.০০ টাকা, দুই বছরে ৪.০০ টাকা, তিন বছরে ৬.০০ এবং চার বছরে সুদ হবে ৮.০০ টাকা; অর্থাৎ প্রথম বছর একগুণ, দ্বিতীয় বছরে এর দ্বিগুণ, তৃতীয় বছরে তিনগুণ, ৪র্থ বছরে চারগুণ। প্রতিবছর একগুণ করে বৃদ্ধি পেতে থাকবে সুদ এভাবে এই গতিতে বাড়তে গতি আরও বেশি হবে সন্দেহ নেই।[হাসানুজ্জামান, এন, এম: Conceptual Foundations of Riba in Quran, Hadith on Fiqh, জার্নাল অব ইসলামিক ব্যাংকিং এন্ড ফাইন্যান্স, জানু-মার্চ, ১৯৯৪, পৃ. ১১-১২] সুতরাং ‘আদয়াফাম-মুদায়াফাহ’-এর অনুবাদ চক্রবৃদ্ধি সুদ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়ার পরিবর্তে এর অনুবাদ গুণে গুণে বৃদ্ধি পাওয়া করাই ভাল। এটাই হচ্ছে সুদের স্বভাব, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও পরিচিতি।
২. তাকওয়া
বস্তুতঃ তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহভীতি। আল্লাহ সর্বশক্তিমান (Omnipotent), আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান (Omnipresent) এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ এই ধারণা মনে বদ্ধমূল করে নেওয়া, সর্বদা আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা ও ভয় জাগরূক রাখা এবং দুনিয়ার কেউ না দেখলেও আল্লাহ দেখেন, দুনিয়ার কেউ না জানলেও আল্লাহ জানেন, দুনিয়ার কোন পুলিশ ধরতে না পারলেও আল্লাহর কাছে ধরা পড়তে হবে, দুনিয়ার আদালত থেকে বাঁচলেও আল্লাহর আদালত থেকে নিস্তার নেই- এই অনুভূতিই হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া মানুষকে স্বতস্ফূর্তভাবে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনে উদ্বুদ্ধ ও পরিচালিত করে। কোন লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি ও দুর্বলতাই তাকে আল্লাহর হুকুম পালন থেকে বিরত রাখতে পারে না। অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং সৎ কাজে আত্মনিয়োগ করার মূল প্রেরণা ও চালিকাশক্তি হচ্ছে তাকওয়া। মানব জীবনে সফল, বিশেষ করে, সুদ খাওয়ার ন্যায় লোভনীয় কাজ বর্জনে সফল হওয়ার (ফালাহ লাভ করার ) জন্য আল্লাহ এখানে তাকওয়ার বলে বলীয়ান হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
৩. জাহান্নামের ভয় ও বেহেশতের আশা
আল্লাহ তা’য়ালা জাহান্নামের আগুন তথা আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচা এবং আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছে কাফেরদের জন্য; আর জান্নাত তৈরী করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে। অতঃপর আল্লাহ সচ্ছল-অসচ্ছল সর্বাবস্তাতেই নিজেদের সম্পদ ব্যয়, ক্রোধ সংবরণ এবং মানুষকে ক্ষমা করা ইত্যাদি গুণাবলী অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
৪. আল্লাহর পথে ব্যয়
বস্তুতঃ সুদ ও আল্লাহর পথে ব্যয় পরস্পর বিপরীতমুখী। সুদ হচ্ছে বিনিময় না দিয়ে জনসাধারণের সম্পদ শোষণ করে কতিপয় পুজিঁপতির সম্পদ ফাপিয়েঁ তোলা;
স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, কৃপণতা ও কাঠিন্য হচ্ছে সুদের উৎস। অপরের অভাব ও প্রয়োজনকে পুজিঁ করে নিজ সম্পদ বুদ্ধির মানবতাবিরোধী ও পৈশাচিক মানসিকতা তথা পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সম্প্রীতি ও উদারতা ইত্যাকার মানবিক গুণের প্রচণ্ড অভাবই হচ্ছে সুদের চালিকাশক্তি। সুদ লোভ-লালসা, কার্পণ্য ও স্বার্থপরতাকে লালন ও বিস্তৃত করে; আর মানবিক ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করার মাধ্যমে পারস্পরিক স্বার্থ-দ্বন্দ্ব. ঘৃণা-বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়।
অপরদিকে, আল্লাহর পথে ব্যয়, তথা যাকাত, সাদাকাহ, দান-খয়রাত হচ্ছে, যাদের াছে তাদের কাছ থেকে যাদের নেই তাদের কাছে সম্পদ পৌঁছানোর এক মহৎ প্রক্রিয়া। বস্তুতঃ আল্লাহর সংরক্সিত আমানত আল্লাহকে ফেরত দেওয়ার গভীর অনুভূতি, আর সহ-যাত্রী মানবকুলের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা এবং পরস্পরিক সাহায্য- সহযোগিতার মানবতাবাদী উদার মানসিকতা হচ্ছে আল্লাহর পথে ব্যয়ের চালিকাশক্তি। আল্লাহর পথে ব্যয় মানবাতাবোধ, সহৃদয়তা, সম্প্রীতি, মানবপ্রেম, উদারতা ইত্যাকার মহৎ গুণকে লালন, সম্প্রসারণ ও বিস্তৃত করে দেয়; সামাজিক বন্ধন হয় সুদৃঢ়, ঐক্য ও সংহতি হয় মজবুত। ক্রোধ, স্বার্থ-দ্বন্দ্ব, ঘৃণ-বিদ্বেষ এ প্রতিহিংসা হয় বিরল। সমাজের ব্যক্তিরা হয়ে উঠে মুহসিন। আর এই মুহসিনদেরই আল্লাহ ভালবাসেন বলে ঘোষণা দেওয় হয়েছে।
সুরাতুল বাকারাহ
সুরাতুল আল-বাকারাহর ২৭৫-২৮১ আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ۗ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ۚ فَمَن جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَنْ عَادَ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ [٢:٢٧٥]يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ [٢:٢٧٦]إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ [٢:٢٧٧]يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ [٢:٢٧٨]فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَإِن تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ [٢:٢٧٩]وَإِن كَانَ ذُو عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَىٰ مَيْسَرَةٍ ۚ وَأَن تَصَدَّقُوا خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ [٢:٢٨٠]وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ۖ ثُمَّ تُوَفَّىٰ كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ [٢:٢٨١]
“যারা সুদ খায়, তাদের অবস্থা হচ্ছে সেই ব্যক্তির মত যাকে শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা পাগল ও সুস্থজ্ঞানশূন্য করে দিয়েছে। তাদের এই অবস্থা হওয়ার কারণ এই যে, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয়তো সুদের মতই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন, আর সুদকে করেছেন হারাম। যে ব্যক্তির নিকট তার রবের কাছ থেকে এই নির্দেশ পৌছেঁছে, আর সে তা (সুদ খাওয়া) ছেড়ে দিয়েছে, সে পূর্বে যা খেয়েছে তা তো খেয়েই ফেলেছে, সে ব্যাপারটি আল্লাহর ওপরই সোপর্দ। কিন্তু যারা (সুদ খাওয়া) পুনারাবৃত্তি করবে তারা নিঃসন্দেহে জাহান্নামী হবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে। (২৭৫)
আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন আর সাদাকাহকে ক্রমবৃদ্ধি দান করেন; আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে মোটেই পছন্দ করেন না। (২৭৬) যারা ঈমান আনবে ও নেক কাজ করবে, সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে তাদের প্রতিফল তাদের রবের নিকট রয়েছে; আর তাদের কোন ভয় ও চিন্তা নেই। (২৭৭) হে ঈমানদারগণ ! আল্লাহকে ভয় কর, আর তোমাদের যে সুদ পাওনা আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। (২৭৮)
অতঃপর তোমরা যদি তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে রাখ। আর তোমরা যদি তাওবা কর (ফিরে আস), তাহলে তোমাদের আসল তোমাদের (আসল ফেরত পাবে)। তোমরা জুলুম করবে না, আর তোমাদের প্রতি ও জুলুম করা হবে না। (২৭৯)
আর ঋণগ্রহীতা যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তবে সচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত তাদের সময় দাও। আর যদি সাদাকাহ করে দাও তবে তা তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর, যদি তোমরা বুঝতে পার। (২৮০) আর সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে; অতঃপর সেখানে প্রত্যেককে তার উপার্জনের ফলাফল পুরোমাত্রায় দিয়ে দেওয়া হবে এবং কারও প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না”। (২৮১)
পটভূমি
আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সুদ সংক্রান্ত আয়াতসমূহের মধ্যে উল্লেখিত আয়াত কয়টি চতুর্থ বা শেষ পর্যায়ে মক্কা বিজয়ের পর নাযিল করা হয়েছে। ড, উমর চাপরা বলেছেন, “রাসূল (সাঃ)-এর মিশন পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি পর্যায়ে এই আয়াত কয়টি নাযিল হয়েছে।[চাপরা, ড. এম, উমর: পূর্বোক্ত , পৃ. ৭-৮] ইতোপূর্বে তিন পর্যায়ে সুদের আয়াত নাযিল করে এ বিষয়ে শিক্ষাদান, সতর্কীকরণ ও পরিবেশ তৈরীতে ১৬/১৭ বছর চলে গেছে। ইতোমধ্যে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ মজবুত হয়েছে। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে এ রাষ্ট্রের স্থায়ী বিজয় সাধিত হয়েছে। ইসলাম মদীনা-মক্কার বাইরে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রীয় আইন জারী করে তা বাস্তবায়ন করার পরিবেশ ও ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। মুমিন নারী-পুরুষ ইতোমধ্যে সুদ বর্জন করে চলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আশা করা যাচ্ছিল যে, সুদ নিষিদ্ধ করে আইন জারী করা হলে তাঁরা তার পূর্ণ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে সফল হবেন। এমনি সময়ে মহাবিজ্ঞ আল্লাহ সুদকে আইনত নিষিদ্ধ করে উক্ত আয়াতগুলো নাযিল করলেন।
মূল বক্তব্য
সুদকে আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং এতদসংক্রান্ত বিধি-বিধানই হচ্ছে আলোচ্য আয়াত কয়টির মূল বিষয়। ক্রয়-বিক্রয় ও সুদের মধ্যে বিদ্যমান প্রকৃতিগত পার্থক্যের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় হালাল ও সুদ হারাম বলে জানিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি আল্লাহ এখানে সুদখোরদের তিরস্কার করেছেন। তাদের অযৌক্তিক কথার প্রতিবাদ করেছেন, তাদেরকে বুদ্ধিভ্রষ্ট-পাগল আখ্যায়িত করেছেন। এই আইন নাযিলের পরেও যারা সুদ লেনদেন অব্যহত রাখবে তাদেরকে জাহান্নামের চিরন্তন আযাবের ভীতি প্রদর্শন করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। অপরদিকে, উল্লেখিত বিধি-বিধান মেনে চলার জন্য মুমিনদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন; ঈমান আনা, নেক আমল করা, নামায কায়েম করা ও যাকাত প্রদানের প্রতিফল ও পুরস্কার দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এবং এই শ্রেণীর লোকদের কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই বলে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ দ্বার্থহীন ভাষায় আবারও জানিয়ে দিয়েছেন, সুদের পরিণাম ধ্বংস আর সাদাকাহর সুফল হচ্ছে ক্রমবৃদ্ধি। পরিশেষে, শেষ বিচার দিনে সকল মানুষের আল্লাহর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ন্যায়বিচার অনুসারে প্রত্যেকের প্রতিফল প্রাপ্তির অবশ্যম্ভাবিতার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
১. বিধি-বিধান
এ আয়াতগুলোতেই আল্লাহ সুদ আইনত নিষিদ্ধ বলে জানিয়ে দিয়েছেন এবং এ সম্পর্কিত মৌলিক আইন-বিধান নাযিল করেছেন। মুফতি শাফী বলেছেন, “এখানে রিবা অর্থাৎ সুদের অবৈধতা এবং তার বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে”।[শাফী, মুফতী মুহাম্মাদ; পুর্বোক্ত, পৃ. ১৪৮-১৪৯] এখানে বর্ণিত সুদের বিধি-বিধানগুলো হচ্ছেঃ
১. ক্রয়-বিক্রয় বৈধ: সুদ নিষিদ্ধ;
২. এই আইন জারী হওয়ার সাথে সাথে সুদ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সুদ লেনদের শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে;
৩. এই নিষেধাজ্ঞা নাযিলের পূর্বে খাওয়া সুদের ব্যাপারে ফায়সালার বিষয়টি আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করতে হবে। দুনিয়ায় এ বিষয়ে অভিযোগ, দাবী-দাওয়া বা মামলা-মোকাদ্দমা করা যাবে না;
৪. সুদের চলমান চুক্তিসমূহ বাতিল এবং এসব চুক্তির বলে পাওনা সুদের সাকুল্য দাবী অবৈধ বিবেচিত হবে;
৫. এই আইন জারী ও প্রয়োগ করার দায়িত্ব আল্লাহ ও রাসূলের (সাঃ) পক্ষের শক্তি সরকারের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আল্লাহ প্রদত্ত এই এখতিয়ার ও ক্ষমতা বলে সরকার প্রয়োজনে সুদের আইন লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত ঘোষণা করতে পারবে;
৬. ঋণদাতাগণ তাদের প্রদত্ত মূল্যের কাউন্টার ভ্যালু ফেরত পাওয়ার অধিকারী হবে; তবে শর্ত হচ্ছে তাদের সুদ থেকে তাওবা করতে বা ফিরে আসতে হবে;
৭. প্রতিমূল্যের বেশি নিলে ঋণদাতা জুলুমকারী (সুদ গ্রহণকারী) হিসেবে শাস্তি পাবে;
৮. ঋণগ্রহীতা যদি আসলের প্রতিমূল্যের চেয়ে কম দেয় বা আসল মোটেই না দেয়, তাহলে সেও জুলুম করার অপরাধে (সুদগ্রহীতা) অপরাধী হিসেবে শাস্তি পাবে
৯. ঋণগ্রহীতা যদি অসচ্ছল হয়ে পড়ে এবং যথাসময়ে গৃহীত ঋণের কাউন্টার ভ্যালু পরিশোধ করতে অক্ষম হয়, তাহলে সামর্থ ফিরে আসা পর্যন্ত তাকে সময় দিতে হবে; আদালত এ মর্মে ঋণদাতাকে নির্দেশ দিতে পারবে।
১০. আর আদালতের কাছে যথার্থ বিবেচিত হলে আদালত ঋণদাতাকে তার পাওনা মাফ করে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে পারবে।
২. সুদখোর বুদ্ধিভ্রষ্ট পাগল
মহাজ্ঞানী আল্লাহ এখানে সুদখোরদের বুদ্ধিভ্রষ্ট-পাগল আখ্যায়িত করেছেন। কোন কোন স্কলার মনে করেন, “এই আয়াতে সুদখোরদের যে ছবি আঁকা হয়েছে, তা পরকালীন জীবনে শেষ বিচারের দিন ঘটবে, পার্থিব জীবনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই”।[সিদ্দিকী, Riba, Bank Interest and the Rationale of its Prohibition, IslamicResearch and Training Institute, Islamic Development Bank, Jeddah, KSA, 2004, পৃ· 88] কিন্তু দুনিয়াতেও সুদখোরদের মধ্যে এরূপ পাগলামি লক্ষ্য করা যায়। বস্তুতঃ শয়তান সুদখোরদেরকে সম্পদের মোহে এমন আচ্ছন্ন করে দেয় যে, তারা ক্রয়-বিক্রয় ও সুদের পার্থক্যটুকুও বুঝতে পারে না, বুঝতে চায় না। এটাই হচ্ছে সুদুখোরদের ব্যক্তিত্বের ওপর সুদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বস্তুতঃ সুদ সুদখোরদের ব্যক্তিত্বকে হ্রাস (diminishes) ও (demeans) করে দেয়। [সিদ্দিকী, উপরোক্ত, পৃ. ৩৬] তারা পাগল হয়ে অর্থ-সম্পদের পেছনে ছুটে বেড়ায় আর ভারসাম্যহীন কথা ও কাজের মহড়া দেয়। তারা ক্রয়-বিক্রয়, মুনাফা ও সুদকে একাকার ও সমান মনে করে; আর বলে ‘ক্রয়-বিক্রয়তো সুদের মতই’। এটি তাদের একটি “যুক্তিহীন কথা (Flimsy argument), একটি ফাঁদ (a trap), একটি খাটিঁ প্রতারনা (pure hoodwinking) ও একটি পুরাতন চালবাজি (old trick)”।[সিদ্দিকী, উপরোক্ত, পৃ. ৪৪ ও ৪৭] মক্কার কাফের নেতারা তাদের জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এই চালবাজির আশ্রয় নিয়েছিল। আজকের দিনেও সুদখোরদের মধ্যে এমনি পাগলপারা অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। তারা চায় লাভ, সুদের মাধ্যমে নিশ্চিত লাভ। তাদের স্বার্থেই তারা বলে, সুদ হচ্ছে অর্থনীতির চালিকাশক্তি, সুদ ছাড়া অর্থনীতি অচল, সুদই উন্নয়নের চাবিকাঠি ইত্যাদি।
কিন্তু তাদের সুদখোরীর কারণে অর্থনীতির ওপর কিরূপ ধ্বংসকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো, কত লোকের ধ্বংস ও দুরাবস্থার বিনিময়ে তাদের সুদী আয় অর্জিত হলো, মানবিক প্রেম-প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতির মূলে কি আঘাত পড়লো, সামষ্টিক কল্যাণের ওপর কি ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়লো ইত্যাদি বিষয় তাদের বুদ্ধিতে ধরে না, এজন্য কোন মাথা ব্যথাও তাদের নেই। এই অবস্থায়ই তারা বাচেঁ, এই অবস্থায়ই তারা মরে এবং এই অবস্থাতেই তারা কবর থেকে উত্থিত হবে। সুতরাং “আল্লাহর এ বাণী ইহকাল-পরকাল উভয় জীবনের জন্যই বাস্তব ও সত্য”।[সিদ্দিকী, উপরোক্ত, পৃ. ৪৪]
৩. ক্রয়-বিক্রয় হালাল, সুদ হারাম
এটি হচ্ছে আল্লাহর একটি প্রাকৃতিক (natural), স্বাভাবিক, শাশ্বত ও চিরন্তন বিধান। হালাল মানে বৈধ আর হারাম হচ্ছে অবৈধ। মানুষের জন্য অকল্যাণকর সব কিছুকে হারাম করেছেন।
এখানে আল্লাহ আল-বাই শব্দ ব্যবহার করে সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয়কে বুঝিয়েছেন। ক্রয়-বিক্রয়ের মূল ক্থা হচ্ছে সমান মূল্য ও পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে সকলের কৱসখল অভাব পুরণ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সুতরাং বিনিময় বা ক্রয়-বিক্রয় মানব জাতির জন্য কেবল জরুরী নয়, মানব সমাজের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। বস্তুতঃ ক্রয়-বিক্রয় মানুষের জন্য উপকারী, অপরিহার্য, ইনসাফপূর্ণ এবং হালাল। অতঃপর আল্লাহ আল-রিবা শব্দ ব্যবহার করে সকল প্রকার রিবায়েছেন। রিবা অর্থ হচ্ছে ‘বৃদ্ধি’, বিনিময় ছাড়া বৃদ্ধি, এক পক্ষের দেয়া মূল্যের ওপরে বৃদ্ধি অপরপক্ষের দেয়া মূল্যের উপর বৃদ্ধি ছাড়াই। এমতাবস্থায়, এক পক্ষ সেই অতিরিক্ত দেয় যার কোন বিনিময় সে পায় না; আর অপরপক্ষ সেই অতিরিক্ত নেয় যার ভ্যালু সে দেয় না। এটা হয় বিনিময় না দিয়ে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস বা ভক্ষণ করা। সুতরাং পরিমানে কম-বেশি যাই হোক পরের সম্পদ অন্যায় ভক্ষণে মানব সমাজের জন্য কোন উপকার ও কল্যাণ থাকতে পারে না; বরং তা অবশ্যই ক্ষতিকর, অকল্যাণকর এবং ধ্বংসের বাহন। সুতরাং হারাম।
মূলকথা দাঁড়াচ্ছে যে, ক্রয়-বিক্রয় চিরদিনই মানুষের জন্য অপরিহার্য ও কল্যাণকর এবং হালাল; অপরদিকে সুদ সর্বদাই মানব জাতির জন্য অকল্যাণকর, ক্ষতিকর ও হারাম।
“আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম”- এই বাক্য দ্বারা আল্লাহ উক্ত প্রাকৃতিক (Natural), শাশ্বত ও চিরন্তন সত্যেরই ঘোষণা দিয়েছেন। পরবর্তীতে ক্রয়-বিক্রয়, মুনাফা, ভাড়া ও সুদের বিস্তারিত তুলনা করা হবে।
৪. সুদ একটি জুলুম
২৭৯ আয়াতে আল্লাহ সুদ লেনদেনকে জুলুম এবং শস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, ঋণদাতার পাওনা হচ্ছে তার প্রদত্ত আসল মূল্যের কউন্টার ভ্যালু; এটাই তার অধিকার। অপরদিকে, ঋণগ্রহীতার দেনা হচ্ছে তার গৃহীত আসলের কাউন্টার ভ্যালুর চেয়ে অতিরিক্ত, কম হোক বেশি হোক নেয়] তাহলে সেই বেশিটা হবে বিনিময়হীন রিবা, অনধিকার চর্চা ও জুলুম। আর গ্রহীতা যদি তার দেনার চেয়ে কম মূল্য দেয় অথবা দেনা আদৌ পরিশোধ না করে, তাহলে সেটাও হবে বিনিময়হীন, অতিরিক্ত, অনধিকার চর্চা, রিবা এবং জুলুম। তোমরা জুলুম করবে না; তোমাদের ওপরও জুলুম করা হবে না- এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই জুলুম থেকে বিরিত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ অভাবগ্রস্ত ঋণগ্রহীতার কাছে পাওনা সাদাকাহ করে দেওয়ার জন্য ঋণদাতাকে উপদেশ দিয়েছেন।
৫. সুদের পরিণাম ধ্বংস
পূর্বে সূরা আর-রূমের অন্তর্ভূক্ত সুদ ও যাকাত সংক্রান্ত আয়াতের আলোচনায় সুদ কিভাবে ধ্বংস ডেকে আনে এবং যাকাত কিভাবে সমৃদ্ধি বয়ে আনে সে বিষয়ে সম্যক আলোকপাত করা হয়েছে। পরবর্তীতে সমাজ ও অর্থনীতির ওপর সুদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ধ্বংসকর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
সুদ হারাম করার কারণ
আল্লাহ তা’য়ালা সুদকে হারাম করেছেন কেন? এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর পবিত্র কালামে যে কয়টি কারণ উল্লেখ করেছেন সেগুলো হচ্ছে: ১) সুদ একটি অন্যায় ভক্ষণ ও জুলুম; ২) সুদ শোষণ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে; ৩) সুদ সম্পদ বৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়; ৪) সুদ স্বার্থপরতা, ঘৃণা ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে; ৫) সুদ অর্থনীতি ও সমাজকে ধ্বংস করে এবং ৬) সুদ গযব ও শাস্তির বাহন।
বস্তুতঃ পরের সম্পদ বিনা মূল্যে ভক্ষণ এবং তজ্জনিত জুলুমই হচ্ছে সুদ নিষিদ্ধ করার প্রধান ও মূল কারণ। অন্যান্য কারণগুলো অন্যায় ভক্ষণ ও জুলুম থেকেই উদ্ভূত, জুলুমেরই পরিণতি।
১. সুদ একটি অন্যায় ভক্ষণ ও জুলুমঃ উপরের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, ক্রয়-বিক্রয় পৃথিবীতে মানব সমাজের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য এবং সমাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। আর এজন্য ক্রয়-বিক্রয়কে সকল প্রকার জুলুম, অবিচার ও বেইনাসাফী থেকে মুক্ত রাখা জরুরী। আলোচনায় এটাও দেখানো হয়েছে যে, সুদ হচ্ছে একটি অন্যায় ভক্ষণ জুলুম। সূরাতুর রূমের সুদ সংক্রান্ত আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, সুদ বিনিময় ছাড়াই দাতাদের সম্পদ গ্রহীতাদের কাছে হস্তান্তর করে দেয়। সূরাতুন্নিসায় বলেছেন, সুদ হচ্ছে অন্যায় ভক্ষণ, পরের সম্পদ গ্রাস করা। সূরা আলে ইমরানে সুদ খেতে মানা করেছেন। আর সব শেষে সূরাতুল বাকারায় স্পষ্ট ভাষায় সুদকে জুলুম আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ ঋণদাতাকে নির্দেশ দিয়েছেন ঋণগ্রহীতার ওপর জুলুম না করতে ,আর ঋণগ্রহীতাকে নির্দেশ দিয়েছেন ঋণদাতার ওপর জুলুম না করতে।
বস্তূতঃ সুদ হচ্ছে বিনিময়হীন অন্যায় ভক্ষণ এবং তা আবার সময়ের সাথে গুণে গুণে বৃদ্ধি পায় সেজন্য সুদ কেবল জূলুম নয়, অতি জুলুম। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে, ছোট হোক বড় হোক, সুদরূপী অন্যায় ভক্ষণ ও জুলুম থাকা উচিত নয়। এই জুলুমের অবসানকল্পেই আল্লাহ সুদ হারাম করেছেন।
২. সুদ শোষণ ও বৈষম্য সৃষ্টি করেঃ সূরা রূমের সুদ সংক্রান্ত আয়াতের তাৎপর্য আলোচনায় দেখানো হয়েছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদ এর দাতাদের সম্পদ শোষণ করে গ্রহীতাদের কাছে হস্তান্তর করে দেয়, তাদের ধনী থেকে আরও ধনী বানায়। অপরদিকে সুদদাতারা দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়ে পড়ে। সুদ এভাবেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক শোষণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে প্রকট করে তোলে। ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠির জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। মানুষ মানুষের শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হোক আল্লাহ তা’য়ালা তা চান না; এজন্যই আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন।
৩. সুদ সম্পদ বৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়ঃ সূরাতুর রূমে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “সুদ আল্লাহর কাছে বাড়ে না”। আল্লাহর এ বাণীর সুস্পষ্ট তাৎপর্য হচ্ছে. সুদ সম্পদ বৃদ্ধির পথে একটি বড় বাধা। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা পূর্বে পেশ করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে যে, সম্পদ বৃদ্ধি পায় বিনিয়োগ ও উৎপাদনের মাধ্যমে। আর সুদ বিনিয়োগ করা হয় না- বিনিয়োগ করা যায় না।
সুতরাং সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সুদের কোন সম্পর্ক নেই। বরং সুদের বিনিয়োগের সম্পর্ক বিপরীতমুখী হওয়ার কারণে সুদের হার বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে দেয় না। এছাড়া পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা যেখানে সুদের হারের সমান হয় বিনিয়োগ উৎপাদন সেখানেই থেমে যায়। ক্রেতা সাধারণের ক্রয়-ক্ষমতা শোষণ করে নিয়ে পণ্য-সামগ্রীর কার্যকর চাহিদা হ্রাস কারার মাধ্যমে সুদ বিনিয়োগ-উৎপাদনকে কমিয়ে বেকার সমস্যাকে প্রকট করে তোলে এবং এক সময়ে মন্দা ও মহামন্দা সৃষ্টি করে অর্থনীতিকে স্হবির করে দেয়। আর ও নানা পদ্ধতিতে সুদকে হারাম করেছেন যাতে মানুষ তাদের বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
৪. সুদ স্বার্থপরতা, হিংসা ও ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করেঃ কুরআন মজীদে সুদ সংক্রান্ত আয়াতগুলোর সাথে সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাকাত-সাদাকাহ্, দান-খায়রাত ও আল্লাহর পথে ব্যয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সুদের আয়াতগুলোর আগে অথবা পরে একইভাবে দান-খায়রাত ও আল্লাহর পথে ব্যয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সুদ ও আল্লাহর পথে ব্যয় পরস্পর বিপরীতমুখী। লোভ-লালসা, কার্পণ্য, স্বার্থ-দ্বন্দ্ব, ঘৃণা-বিদ্বেষ হচ্ছে সুদভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সম্প্রীতি ও উদারতা ইত্যাকার মানবিক গুণাবলী সেখানে হয় বিরল। আল্লাহ সুদকে হারাম করে একদিকে মানব সমাজকে এ অবস্থা থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছেনে। অন্যদিকে, যাকাত-সাদাকাহ, দান-খয়রাত ও আল্লাহর পথে নিজ সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়ে মানবতাবোধ, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও উদারতা ইত্যাদি মহৎ গুণকে লালন ও সম্প্রসারণ করার ব্যবস্থা করেছেন যাতে সামোজিক বন্ধন হয় সুদৃঢ় এবং মানবিক ঐক্য হয় মজবুত- মানুষ হয়ে উঠে মুহসিন।
৫. সুদ অর্থনীতি ও সমাজকে ধ্বংস করেঃ সূরাতুল বাকারাহর ২৭৬ আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, “আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন”। আল্লাহর নবী (সাঃ) বলিষ্ঠ কন্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন, সুদের আসল পরিণতি হচ্ছে অভাব ও সংকোচন।[মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৩৭৫৪] সুদের এই পরিণতি এখন আর ব্যাখ্যা করে বুঝানোর প্রয়োজন হয় না; মানুষ নিজের চোখে সুদের এই ধ্বংসকর ফলাফল প্রত্যক্ষ করেছে এবং করছে। সুদের এই পরিণতি থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করার লক্ষ্যেই আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন।
৬. সুদ গযব ও আযাবের বাহনঃ সুদ দুনিয়ায় আল্লাহর গযব নিয়ে আসে। আল্লাহ ইহুদী জাতির উদাহরণ দিয়ে দুনিয়ার মানুষকে এ সত্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর দুনিয়ায় সুদ লেনদেনের কারণে পরকালের কঠিন আযাবে পড়তে হবে এ কথাও আল্লাহ মানব জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন, “স্থল ও জলভাগে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে মানুষের নিজেদের কৃতকর্মের দরুন, যাতে (আল্লাহ) তাদেরকে তাদের কর্মফল কিছূটা আস্বাদন করাতে পারেন। আশা করা যায়, এর ফলে হয়তো তারা ফিরে আসবে”। (৩০:৪১) এখানে নিজেদের কৃতকর্ম বলতে সাধারণভাবে আল্লাহর নাফরমানি ও হুকুম অমান্য করাকে বুঝানো হয়েছে। সুদের নিষেধাজ্ঞা লংঘনও এর মধ্যে শামিল।