ষষ্ট অধ্যায়: বিভিন্ন প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ে উদ্ভুত রিবা
বস্তুতঃ ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এমন এক চুক্তি (Contract) যেখানে সমমূল্যের পণ্য, মুদ্রা বা সেবা পারস্পরিক বিনিময় করা হয়। অপরদিকে, রিবা হচ্ছে এমন চুক্তি যা দ্বারা ক্রেতা-বিক্রেতা কোন এক পক্ষ অপর পক্ষের দেয় কাউন্টার ভ্যালুর ওপর অতিরিক্ত ধার্য ও আদায় করে নেয়, কিন্তু সেই অতিরিক্তের দাম বা কাউন্টার ভ্যালু দেয় না। কোন লেনদেনে এই দু’টি চুক্তি একত্রিত হলেই তা সুদী লেনদেনে পর্যবসিত হয়। আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন। আর রিবাকে হারাম করেছেনে”- এ ঘোষণা দ্বারা আল্লাহ হালাল ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সাথে রিবা চুক্তি করতে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীসে বিভিন্ন দিক থেকে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “ এক বিক্রয়ে দুই লেনদেন নিষিদ্ধ”; “ যে এক লেনদেনে দুই বিক্রয় করে তার উচিত কেবল মূলটা গ্রহণ করা, অন্যাথায় সে সুদ খায়”; “যে এক লেনদেনে দুই বিক্রয় করে তাকে অবশ্যই কম দামটি গ্রহণ করতে হবে, অথবা সুদ খেতে হবে”। ইবনে মাসুদ বলেছেন, “এক ক্রয়-বিক্রয়ে দুই দাম সুদ জন্ম দেয়”। অধিকাংশ মাযহাবেও এই একই কথা বলা হয়েছে যে, “এক লেনদেনে দুই বিক্রয় করা হলে তা রিবা হয়”।[নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ২৪৪।] বিভিন্ন প্রকার হালাল ক্রয়-বিক্রয়ে কিভাবে সুদ উদ্ভুত হয় পরবর্তী আলোচনায় তা দেখানো হলো।
বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে রিবা
বাকি ক্রয়-বিক্রয় দুই রকমের হয়ঃ ১) সমজাতের বস্তু বাকি ক্রয়-বিক্রয় ও ২) অসমজাতের বস্তু বাকি ক্রয়-বিক্রয়। প্রথম ক্ষেত্রে বাকি থাকা কাউন্টার ভ্যালুকে বলা হয় ঋণ, কর্দ আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বাকি থাকা কাউন্টার ভ্যালুকে বলা হয় দেনা বা দাইন। নিচে কর্দ ও দেনার পার্থক্য, কর্দ ও দেনা কাকে বলে একং কর্দ ও দেনার ওপর পৃথক চুক্তি দ্বারা কিভাবে সুদ ধার্য করা হয় তা দেখানো হলোঃ
কর্দ ও দাইনের পার্থক্যঃ কর্দ ও দাইন শব্দ দুটি আরবী। কর্দ অর্থ হচ্ছে ঋণ, , loan, debt, liability; দাইনেরও অর্থ হচ্ছে দেনা, loan, debt, liability. কিন্তু এতদুভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। দাইন-এর পরিধি ও আওতা কর্দ অপেক্ষা (general): কর্দ (loan) হচ্ছে বিশেষ। অগ্রিম বিক্রয় (বাই সালাম), বাকি বিক্রয় (বাই-মোয়াজ্জাল) ইত্যাদি সবই দাইনের অন্তর্ভুক্ত। I Al-Raghib al-Ispahani, Ibn Athir and Wajhi al-Din al-Thanwi determined that dayn includes qard.[আল-জাসসাস, আহকাম আল কুরআন: উদ্ধৃত, বাদাবী, উপরোক্ত, পৃ: ৪৩।] “আল-রাগিব আল ইস্পাহানি, ইবনে আছির ওয়াজি আল-দ্বীন আল-থানবী এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, কর্দ দাইনের অন্তর্ভুক্ত”। It is obvious… about qard that the word dayn applies to it. This is maintained by the majority of the jurists, and those who oppose it are few.[বাদাবী, উপরোক্ত, পৃ: ৪২।] “এ ব্যাপারে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কর্দের জন্য দাইন শব্দটি প্রযোজ্য। অধিকাংশ ফিক্বাহবিদের এটাই মত; যারা ভিন্নমত পোষণ করেন তাঁদের সংখ্যা খুবই নগণ্য”। কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে বা কোন কাজে লিপ্ত হওয়ার দরুন অথবা অন্য কোন কারণে সেই ব্যক্তির ওপর যে আর্থিক বা অ-আর্থিক দায় বর্তায়, যা থেকে মুক্ত হওয়া তার জন্য বাধ্যতামূলক হয়, সেই সকল দায়কেই বলা হয় দাউন বা দেনা। ইবনে নাজিম বলেছেন, “কারো দায়িত্বে কোন হক (অধিকার) আদায় করা বাধ্যতামূলক হলে তাকে দাউন বলা হয়”।[ইবনে নাজিম: আল-মাউসুয়া আল-ফিক্বাহিয়্যাহ, কুয়েত।] সুতরাং আর্থিক, অ-আর্থিক সকল প্রকার দায়ই দাইনের অন্তর্ভুক্ত। এমনিক, আল্লাহর হক যেমন, অনাদায়ী ‘সালাত’ ‘যাকাত’ ও ‘রোযা’ হচ্ছে আল্লাহর নিকট মুমিনের দাইন। আল্লাহর হকজনিত এই দাইনকে বলা হয় ‘কাযা’। যেমন, কাযা রোযা, কাযা, নামায, কাযা হজ্জ ইত্যাদি। অপরদিকে কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ বা পণ্য ধার নিলে ঋণদাতার নিকট ঋনগ্রহীতার যে দেনা হয় তাকে বলা হয় কর্দ। “During the period between its delivery and satisfaction, it is established as a liability against a person and falls under the definition of dayn”.[ Al-Hamawi, উদ্ধৃত, বাদাবী, উপরোক্ত, পৃ: ৪৩।] “কর্দ গ্রহনের সময় হতে পরিশোধ করা পর্যন্ত তা গ্রহীতার ওপর দায় হিসেবে থাকে এবং দাইনের সংজ্ঞার আওতায় এসে যায়”। আবার কোন পণ্য-সামগ্রী বাকিতে বিক্রয় করা হলে ক্রেতার কাছে বিক্রেতার পণ্যের দাম পাওনা থাকে। এই পাওনা হচ্ছে ক্রেতার দাইন বা দায়, liability, debt or loan. সুতরাং সাধারণভাবে কোন পণ্য, অর্থ বা সেবা সমজাতের (similar or homogeneous) অর্থ, পণ্য বা সেবার বিনিময়ে বাকিতে বিক্রয় থেকে সৃষ্টি হয় কর্দ; আর কোন পণ্য বা সেবার বিনিময়ে বাকিতে বিক্রয় থেকে উদ্ভূত হয় দাইন। নিচে আলোচনা করা হলো।
কর্দ বা ঋণ
সমজাতের পণ্য, অর্থ বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের একমাত্র ধরন হচ্ছে ‘কর্দ’ বা ঋণ। অবশ্য সমজাতের পণ্য, অর্থ বা সেবা লেনদেনের আরও কতিপয় ধরন চালু আছে। যেমন, আমানত, ওয়াদীয়াহ, আরিয়্যাহ ইত্যাদি। তবে এসব লেনদেন যথার্থ অর্থে ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে পড়ে না এবং এসব ক্ষেত্রে সুদ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাও তেমন একটা নেই। যা হোক, ঋণ কি, ঋণে কিভাবে সুদের উদ্ভব ঘটে সে বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হচ্ছে। পরবর্তীতে ওয়াদিয়াহ ও আরিয়্যাহ সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।
কর্দের অর্থ ও সংজ্ঞাঃ কর্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কেটে আলাদা করা (to cut off)।[আব্দুল্লাহ আলভী হাজী হাসান; (১৯৯৪),Sales and Contracts in Early Islamic Law, Islamic Research Institute, IIUC, P. 117; উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১১৫।] সাধারণ অর্থে ভবিষ্যিতে অনুরূপ জিনিস ফেরত পাওয়ার শর্তে কোন কিছু অপরকে দেওয়া হচ্ছে কর্দ।[উমর বিন আব্দুল আজীজ মুত্রিকঃ Al-Riba Waf Muamalat Al-Masrafiyyah, 1st Edition, H. 1414, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১১৫।] ইংরেজীতে একে বলা হয় loan, credit, debt, liability; বাংলায় আমরা বলি ঋণ, ধার, হাওলাত ইত্যাদি। লেন-এর আরবী ইংরেজী অভিধানে কর্দের সংজ্ঞা নিম্ন ভাষায় দেওয়া হয়েছেঃ
“Loan in legal context is defined as a contract whereby one of the two parties transfers or passes the ownership of a definite amount of his property to the other party, so that the other party returns to the lender what is equivalent thereto in respect of quantity, kind and description.” [E. W. Lane, Arabic English Lexicon, Vol. 1, P. 25-151 উদ্ধৃত, ইবিদ, পৃ: ১১৬।] “ঋণের আইনী সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, ঋণ হচ্ছে দুইটি পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত এমন একটি চুক্তি যেখানে এক পক্ষ তার সম্পদের সুনির্দিষ্ট পরিমাণের মালিকানা অপর পক্ষের নিকট এই শর্তে হস্তান্তর বা প্রদান করে যে, অপরপক্ষ ঋণদাতাকে এমন বস্তু ফেরত দিবে যা জাতে, মানে ও পরিমাণে প্রদত্ত সম্পদের সম্পূর্ণ সমান”।
ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে “it is a contract by which the lender transfers something to the borrower in return for the latter’s liability to give back the same thing, or its equivalence, or price/value in the market.” [Nabel Saleh, Unlawful Gain and Legitimate Profit, 1992, p, 87, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১১৬।] “এটি (ঋণ) হচ্ছে এমন একটি চুক্তি যাতে ঋণদাতা কোন জিনিস এই শর্তে ঋণগ্রহীতার কাছে হস্তান্তর করে যে, এই দায়ের বিনিময়ে ঋণগ্রহীতা অনুরূপ জিনিস বা এর সমতুল্য অথাব বাজার অনুসারে এর দাম/মূল্য ঋণদাতাকে ফেরত দিবে”। “It is also defined as a contract by which the lender transfers the ownership of something in return for its real equivalent or consideration.”[ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১১৬।] “ঋণকে এভবেও সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে, “এটি একটি চুক্তি যা দ্বারা ঋণদাতা প্রকৃত সমতুল্য বস্তু বা এর মূল্য ফেরতের শর্তে কোন বস্তুর মালিকানা হস্তান্তর করে”। সম্মানিত ফক্বীহগণ বলেছেন যে, সাধারণভাবে কর্দ শব্দ দ্বারা অর্থ ও ফাঞ্জিবল পণ্যের ঋণকে বুঝায়; ঋণগ্রহীতা ব্যবহার করায় এ অর্থ বা পণ্য নিঃশেষ হয়ে যায়; ফলে তাকে যে পণ্য বা অর্থ ধার দেওয়া হয়েছেণ সেই একই পণ্য/অর্থ (same goods) সে ফেরত দিতে পারে না; বরং বিবরণ অনুযায়ী অনুরূপ পণ্য (goods of identical description) বা অর্থ ফেরত দেয়।[ফারুক, আবূ উমর এবং হাসান,এম, কবীর; The Time Value of Money Concept in Islamic Finance, The American Journal oflslamic Social Sciences, 23:1, পৃ: ৮৩।] “সুতরাং কর্দ বলতে পণ্যের মালিকানা হস্তান্তর করা এবং মেয়াদ শেষে অনুরূপ (similar) পণ্য ফেরত দেওয়া বুঝায়”।[ফারুক, আবূ উমর এবং হাসান, এম, কবীর : উপরোক্ত, p. 82.]
সুতরাং কর্দ হচ্ছে এক ধরনের বিনিময় বা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি (contract) যেখানে সমজাত ও মানের (identical, similar or homogeneous) অর্থ (মুদ্রা), ফাঞ্জিবল পণ্য বা সেবা বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। 1 “both in common usage of the term or in jurists’ technical interpretation, the loan transaction represents a credit sale of this particular exchange (transference of the same good).”[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা: তরজমায়ে কুরআন মজীদ, ফালাহ-ই-আম ট্রাষ্ট, ডাকা, বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ, ১৯৮২, পৃ: ৬৮, টীকা: ১০২।] “সাধারণ্যে প্রচলিত অর্থ বা ফিক্বাহবিদদের প্রায়োগিক ব্যাখ্যা উভয় অর্থেই ঋণ হচ্ছে এই ধরনের (কোন বস্তু এই জাতের বস্তুর বিনিময়ে) বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়”।
সোনার বিনিময়ে সোনা, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ ইত্যাদি তথা যে কোন পণ্য, অর্থ বা সেবা একই জাতের পণ্য, অর্থ বা সোবার বিনিময়ে বাকিতে বিক্রয় করা হলে ক্রেতার কাছে এর কাউন্টার ভ্যালু বা বিনিময় মূল্য নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য বাকি বা পাওনা থাকে। এই বাকি বা পাওনা কাউন্টার ভ্যালুই হচ্ছে ক্রেতা বা গ্রহীতার কর্দ, ঋণ, দায়, debt, liability or deferred liability।
কর্দের শর্ত ও বৈশিষ্ট্য
উপরোক্ত সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে ঋণের যেসব শর্ত ও বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তা হচ্ছেঃ
১. বিনিময়ের পণ্য ফানজিবল বা মালে ফানি হওয়া;
২. মালিকানাসহ পণ্যটি ঋণগ্রহীতার কাছে হস্তান্তর করা;
৩. অনুরূপ পণ্য সমপরিমাণে (counter value) পরিশোধ করার শর্ত থাকা ও পরিশোধ করা;
৪. কাউন্টার ভ্যালু পরিশোধের মেয়াদ নির্ধারি থাকা;
৫. যাবতীয় ঝুঁকি গ্রহীতার ওপর থাকা;
৬. পাওনা কাউন্টার ভ্যালুর ওপর কোন বাড়তি বা উপহার-উপঢৌকনের শর্ত না থাকা।
নিচে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হলোঃ
১. বিনিময়ের পণ্য ফানজিবল বা মালে ফানি হওয়াঃ কর্দ বা ঋণের ক্ষেত্রে বিনিময়ের পণ্য দুটি সাধারণত ফানজিবল পণ্য হতে হয়। আরবী ‘মালে ফানিকে’ ইংরেজীতে ‘Fungible goods’ বলা হয়। Fungible goods এমন পণ্যকে বলা হয় যা নিঃশেষ না করে তা থেকে উপকারিতা (benefit) লাভ করা সম্ভব নয়। অন্য কথায়, যে পণ্য ব্যবহার করলে পণ্যের উপযোগ (utilty) বা usufruct এবং খোদ পণ্যটি একই দিকে চলে এবং উভয়টি একই সাথে নিঃশেষ হয়ে যায় সেই পণ্যই হচ্ছে ফানজিবল পণ্য। সহজ করে বলা যায়, যে পণ্য (একবার) ব্যবহার করলেই নিঃশেষ বা রূপান্তরিত হয়ে যায় সেই পণ্যই হচ্ছে ফানজিবল পণ্য। ফানজিনল পণ্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনটি। যথাঃ
১. (একবার) ব্যবহার করলেই নিঃশেষ বা রূপান্তরিত হওয়া;
২. সেবা প্রবাহ বা flow of service না থাকা এবং
৩. পণ্য থেকে সেবা (service) পৃথকযোগ্য না হওয়া।
উদাহরণস্বরূপ চালের কথা বলা যায়, একবার ব্যবহার করলেই চাল আর চাল থাকে না; নিঃশেষ বা রূপান্তরিত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, চালের সেবা আছে; কিন্তু সেবার প্রবাহ নেই; অর্থাৎ একই চাল একাধিকবার ভাত দিতে পারে না। তৃতীয়ত, চালের সেবাকে চাল থেকে পৃথক করা যায় না; অর্থাৎ চাল থেকে সেবা নেওয়া হলে চাল থাকে না; আর যতক্ষণ তা চাল থাক ততক্ষণ এ থেকে কোন সেবা নেওয়া যায় না। অর্থ বা মুদ্রা, যেমন, চাকা, দীনার, দিরহাম, ডলার ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। এসব পণ্য, অর্থ বা সেবা কাউকে দিলে গ্রহীতার পক্ষে এ থেকে একবারের বেশি উপকার নেওয়া সম্ভব হয় না। একবার ব্যবহার করার সাথে সাথেই এসব পণ্য নিঃশেষ বা রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং এর কাউন্টার ভ্যালু দায় হয়ে গ্রহীতার ঘাড়ে চেপে বসে। এই দায়কেই বলা হয় কর্দ বা ঋণ। গ্রহীতাকে পুনরায় সমপরিমাণের অনুরূপ পণ্য যোগাড় করে উক্ত ঋণ বা বাকি কাউন্টার ভ্যালু পরিশোধ করতে হয়; অন্যথায় ঋণের দায় থেকে মূক্ত হওয়া যায় না। ফানজিবল পণ্য না হলে এরূপ দায় সৃষ্টি হয় না।
২. মালিকানাসহ পণ্যটি গ্রহীতার কাছে হস্তান্তর করাঃ ঋণ বাবদ কোন অর্থ (মুদ্রা) বা পণ্য কাউকে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে পণ্যটির মালিকানা গ্রহীতার কাছে হস্তান্তর করে দেওয়া যাতে মালিক হয়ে নিজ ইচ্ছামাফিক সে পণ্যটি ব্যবহার করতে বা কাজে লাগাতে পারে। অবশ্য মালিকানা হস্তান্তরের ব্যাপারে কেউ কেউ দ্বিমত করেছেন। কিন্তু ঋণ হচ্ছে একই জাতের পণ্যের বিনিময়ে বাকিতে কোন ফানজিবল পণ্য বিক্রয় করা। আর পরস্পর মালিকানা হস্তান্তর ব্যতীত বাকি ক্রয়-ক্রিয় হয় না। ঋণ লেনদেনে ঋণদাতা মালিকানাসহ তার পণ্য, অর্থ বা সেবা তাৎক্ষণিক গ্রহীতার কাছে হস্তান্তর করে দেয়। ফলে প্রদত্ত পণ্য, অর্থ বা সেবার ওপর থেকে তার মালিকানা নিঃশেষ হয়ে যায় এবং এর কাউন্টার ভ্যালুর ওপর তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা নির্ধারিত মেয়াদের জন্য বাকি বা পাওনা হিসেবে গ্রহীতার জিম্মায় থাকে। অপরদিকে ঋণগ্রহীতা মালিক হয় গৃহীত পণ্য, অর্থ বা সেবার, যার কাউন্টার ভ্যালু হয় তার ঋণ, দেনা, debt, credit, liability। সুতরাং ঋণ বাবদ প্রদত্ত পণ্য, অর্থ বা সেবার মালিকানা হস্তান্তর করাই বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় তা ঋণ বা বাকি ক্রয়-বিক্রয় বলে গণ্য হয় না।
৩. অনুরূপ পণ্য সমপরিমাণে (counter value) পরিশোধ করার শর্ত থাকা ও পরিশোধ করাঃ ঋণ লেনদেনে সাধারণত ভবিষ্যতে আসল ফেরত দেওয়ার শর্তের কথা বলা বা লিখা হয়। এই আসল বলতে মূল প্রদত্ত অর্থ বা পণ্যের সমপরিমাণ বা কাউন্টার ভ্যালুকে বুঝায়। ঋণে প্রকৃত পক্ষে হুবহু আসল নয়, বরং আসলের দাম বা কাউন্টার ভ্যালু পরিশোধ করা হয়। আর যেহেতু লেনদেনের দুটি বস্তুই একজাতের সেহেতু উভয়ের মান ও পরিমাণ সমান হলেই কেবল এদের পারস্পরিক মূল্য সমান হবে। হাদীসে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) পণ্যের জাতগত মিল থাকলে অর্থাৎ সোনার পরিবর্তে সোনা, রূপার বদলে রূপা….. ইত্যাদি ক্ষেত্রে মিসলান বিমিসলিন (মানগত সমতা) ও সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন (পরিমাণগত সমতা) এই দুটি বিধান দিয়েছেন। এই বিধান নগদ ও বাকি উভয় ক্রয়-বিক্রয়েই প্রযোজ্য। সম্মানিত ফক্বীহগণ বলেছেন, ঋণে সমমানের (মিসলিয়্যাত) বস্তু সমপরিমাণে ফেরত না দিলে ঋণ বৈধ হয় না। সুতরাং ঋণে একজাতের, সমমান ও সমপরিমানের বস্তু দ্বারাই আসলের দাম পরিশোধ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
৪. কাউন্টার ভ্যালু পরিশোধের মেয়াদ নির্ধারিত থাকাঃ ঋণ লেনদেনে আসলের কাউন্টার ভ্যালু প্রদান ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত রাখা হয়; আর এজন্য তা ঋণে পরিণত হয়। ঋণগ্রহীতা ঋণের বস্তু তার প্রয়োজনে ব্যবহার করে নিঃশেষ করে ফেলে। অতঃপর এর কাউন্টার ভ্যালু যোগাড় করে পরিশোধ করতে হয়। সুতরাং কাউন্টার ভ্যালু সংগ্রহ করার জন্যই সময় বা মেয়াদ থাকা জরুরী। কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ নির্ধারিত হওয়া জরুরী নয়। কিন্তু ঋণ হচ্ছে বাই-মোয়াজ্জালের মত বাকি বিক্রয়। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, বাই-মোয়াজ্জালের মত বাকি বিক্রয়। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, বাই-মোয়াজ্জলে লেনদেনের বস্তু দুটি ভিন্ন জাতের হয়; আর কর্দে বস্তু দুটি হয় একই জাতের। দাম ও তা পরিশোধের মেয়াদ নির্ধারণ ব্যতীত বাকি বিক্রয় বৈধ হয় না। ঋণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আল্লাহ তা’য়ালা কুরআন মজীদে বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ, যদি কোন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তোমরা দাইনের লেনদেন কর, তাবে তা লিখে নিও (আল-বাকারাহ, ২৮২)”। “এর থেকে এ বিধান নির্গত হয় যে, দাইনের ব্যাপারে মেয়াদ (সময়-সীমা) নির্দিষ্ট থাকা আবশ্যক”।[আল-কাসানি; বাদাই, ভলি-৭, পৃ: ৩৯৫-৬।] আর ঋণও দাইনের অন্তর্ভূক্ত। হাদীসে বলা হয়েছে, “অজ্ঞাত মেয়াদের জন্য বাকিতে বেচা-কেনা বৈধ নয়”। সুতরাং ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদ নির্ধারিত থাকাই বাঞ্ছনীয়।
৫. যাবতীয় ঝুঁকি গ্রহীতার ওপর থাকাঃ যে কোন ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রীত মাল বুঝে নেওয়ার পর ক্রেতাই সে মালের মালিক হয় এবং এর যাবতীয় ঝুঁকি ও দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হয়; ঋণের ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা একজন ক্রেতা। সুতরাং ঋণ বাবদ গৃহীত পণ্য অর্থ বা সেবা বুঝে নেওয়ার পর ক্রেতা/গ্রহীতাই তার মালিক হয়, এটা হয় তারই সম্পদ এবং এর যাবতীয় ঝুঁকি তাকেই বহন করতে হয়। গৃহীত পণ্য বা অর্থ হারিয়ে যাওয়া, চোর-ডাকাতে নিয়ে যাওয়া, কোন দুর্যোগে বিনষ্ট বা ধ্বংস হওয়া অথবা লোকসানে খোয়া যাওয়া ইত্যাদি, গ্রহীতার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার আওতাভুক্ত বা আওতা বহির্ভূত, যে কোন কারণে অথবা তার নিজের অবহেলা ও ত্রুটির দরুন বিনষ্ট, ধ্বংস বা ক্ষতি হলে মালিক হিসেবে এর সকল দায়িত্ব ক্রেতা/গ্রহীতাকেই বহন করতে হয়, ঋণদাতা/বিক্রেতা এর কোন দায়িত্ব নেয় না, কারণ এ সম্পদ এখন তার নয়।
৬. পাওনা কাউন্টার ভ্যালুর ওপর কোন বাড়তি বা উপহার–উপঢৌকনের শর্ত না থাকাঃ পূর্বেই বলা হয়েছে, ঋণ লেনেদেনে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের পন্য, অর্থ বা সেবা একই জাত, একই মান ও পরিমাণে সমান সমান হওয়া বিধেয়। এই বিধান প্রাকৃতিক, চিরন্তন ও শাশ্বত। এই বিধানের ব্যতিক্রম করার এখতিয়ার-অধিকার মানুষকে দেওয়া হয় নাই। সুতরাং ঋণদাতা, আইন দ্বারা নির্ধারিত এই কাউন্টার ভ্যালু ভবিষ্যতে ফেরত পাবে এই শর্তেই ঋণ দেয়। এটাই তার নির্ধারিত পাওনা। এটাই তার অধিকার, হক; এর অতিরিক্ত কিছু তার পাওনা নয়, তাতর হক নয়। এমনকি, অতিরিক্ত যদি খড়-কুটার ন্যায় অতি তুচ্ছ ও নগন্য বস্তুও হয়, ঋণকে উপলক্ষ বানিয়ে কোন দান, উপহার-উপঢৌকন হয়, কোন সেবা-বেনিফিট হয়, তা নেওয়ারও অধিকার ঋণদাতার নেই। ইতোপূর্বে উল্লেখিত আনাস ইবনে মালিক বর্ণিত হাদীস থেকে এ প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পওয়া যায়। আনাস ইবনে মালিক থেকে অপর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যদি কাউকে ঋণ দেয়, তাহলে কোন উপহার গ্রহণ করা তার উচিত নয়”। (মিশকাত, কিতাবুল বুয়ূ)। এ ব্যাপারে শ্রদ্ধেয় ইমামগন কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করে গেছেন। সুতরাং ঋণের বিপরীতে কাউন্টার ভ্যালুর ওপরে কোন অতিরিক্ত নেওয়া তো বৈধ নয়ই, কোন উপহার-উপঢৌকন, তুচ্ছ নগণ্য দান, এমনকি, কোন সেবা, বেনিফিট নেওয়াও বৈধ নয়। সকল মাযহাবের ফক্বীহদের মধ্যে এ ব্যাপারে পূর্ন ঐকমত্য রয়েছে।
কর্দের বৈধতা
কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মতের ইজমা (ঐকমত্য) অনুসারে র্কদ লেনদেন করা সম্পূর্ণ বৈধ। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পরস্পর ‘দাইন’ লেনদেন কর, তবে তা লিখে নাও”। (২:২৮২) বিশেষজ্ঞদের মতে এখানে ‘দাইন’ শব্দ দ্বারা সকল প্রকার দায়কেই বুঝানো হয়েছে।[কামালি, মোহাম্মদ হাশিম; পূর্বোক্ত, পৃ: ১৪২।] আার ঋণ হচ্ছে এক প্রকার দায় বা দাইন।
কুরআন মজীদে কমপক্ষে ছয়টি স্থানে (২:২৪৫, ৫:১৩, ৫৭:১৮, ৬৪:১৭ এবং ৭৩:২০) করদে হাসনাহর কথা উল্লেখ করা হয়েছে; আর সব কয়টি আয়াতেই মানুষকে করদে হাসানাহ দেওয়া হলে তা আসলে মানুষকে নয়, বরং স্বয়ং আল্লাহকে কর্দ দেওয়া হয় বলে ঘোষনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা এই কর্দকে বহুগুণে বর্ধিত কর দাতাকে ফেরত দেবেন এবং তার সাথে উত্তম প্রতিফল (আজরুন কারীম) দান করবেন বলে তিনি ওয়াদা করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ কর্দের অনুমতি দিয়েছেন কেবল তাই নয়, বরং কর্দ প্রদানকে বিপুলভঅবে উৎসাহিত করেছেন।
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাদীসেও করদে হাসানাকে সাদাকাহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “প্রত্যেক কর্দই আসলে সাদাকাহ”। ইবনে মাসঊদ থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, No Muslim provides a Muslim a loan for two timed, if he does it is like charity of once”[উদ্ধৃত, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১১৬।] “অর্থাৎ কোন মুসলমান অপর কোন মুসলমানকে এক ঋণ দু’বার দেয় না, যদি দেয় তাহলে তা হয় একবার দানের মত”। রাসূল (সাঃ) নিজেও কর্দ নিয়েছেন এবং পরশোধ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জীবদ্দশায়, অতঃপর সাহাবয়ে কিরামের যুগ, তাবেয়ীন-তাবে তাবেয়ীদের আমল, মুজাতহেদীন এ আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীনের কাল, এমনকি আজ অবধি মুসলিম সমাজে ঋণ লেনদেন হয়ে আসছে; কিন্তু কোন দনি কেউ এ ব্যাপারে কোন আপত্তি করেননি। আত্মীয়-স্বজন, পাড়-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব ও নিকটজনদের মধ্যে ঋণের প্রচলন চিরদিনই ছিল এবং আছে। বলা যায় ঋণ লেনদেন একটি সাধারণ (common) ও সার্বজনীন (universal) বিষয়। সুতরাং কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার ভিত্তিতেই কর্দ বৈধ ও বিরাট সওয়াবের কাজ। “মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত”।[উপরোক্ত, পৃ: ১১৬।]
কর্দের ওপর রিবা
কর্দ হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। এ ক্ষেত্রে প্রদত্ত আসলের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর সরল বা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ লেনদেনের চুক্তি করা হলে গোটা লেনদেনটি হয়ে যায় কর্দর রিবা বা সুদ ভিত্তিক ঋণ। সুদখোর মহাজন, প্রচলিত ব্যাংক ও কিভাবে ঋণ চুক্তির সাথে রিবা চুক্তি সংযোজন করে প্রচলিত ব্যাংকের সুদী ঋণদান ও সুদী ডিপোজিট গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ধরা যাক, ক একজন ব্যবসায়ী; ব্যবসার প্রয়োজনে তার ৫.০০ লাখ টাকা দরকার; সে প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক খ-এর কাছে ৫.০০ লাখ টাকা দুই বছরের জন্য ঋণ চেয়ে একটি আবেদন করল (ঈজাব)। ব্যাংক খ তাকে জানালো যে, এ ধরনের ঋণের ওপর তারা ১৫% সরল সুদ নিয়ে থাকে (ঈজাব)। ক সুদ দিতে রাজী হলো (কবুল)। ব্যাংক ঋণ দিতে রাজী হলো (কবুল)। এভাবে ক ও খ- এর মধ্যে এই মর্মে কর্দুর রিবা সুদী ঋণ চুক্তি সম্পদিত হলো যে, খ ক-কে দুই বছর মেয়াদের বার্ষিক ১৫% সদের ভিত্তিতে ৫.০০ লাখ টাকা ঋণ প্রদান করছে; ক দুই বছরের মধ্যে ধার্যকৃত সুদসহ উক্ত আসল (আসলের কাউন্টার ভ্যালু যা সর্বতোভাবে আসলের সমান) পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।
লক্ষণীয় যে, এ চুক্তিতে দু’টি ঈজাব ও দু’টি কবুলের মাধ্যমে দু’টি চুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। প্রথম চুক্তিটি হচ্ছে ৫.০০ লাখ টাকা ঋণ দানের প্রস্তাব ও ব্যাক কর্তৃক তা কবুল করার মাধ্যমে কৃত ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। এতে ৫.০০ লাখ টাকার কাউন্টার ভ্যালু হচ্ছে ৫.০০ লাখ টাকা যা মিসলান বিমিসলিন ও সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িনের শর্ত পূরণ করেছে; আর দুই বছরের মধ্যে কাউন্টার ভ্যালু পরিশোধের চুক্তির দ্বারা ইয়াদান বিইয়দিন শর্তটিও পূর্ণ হয়েছে। “আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়েকে হালাল করেছেন’- এর দ্বারা এইরূপ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তিকে বুঝানো হয়েছে।
অতঃপর দুই বছরের জন্য বাকি ও গ্রহীতার জিম্মায় থাকা কাউন্টার ভ্যালু ৫.০০ লাখ টাকার ওপর বার্ষিক ১৫% সুদের কোন কাউন্টার ভ্যালু নেই। এক্ষেত্রে কাউন্টার ভ্যালুর জাত (জিনস), মান (মিসলান বিমিসলিন) সমান সমান করা এবং পারস্পরিক বিনিময় (ইয়াদান বিইয়াদিন) করা এর কোন শর্তই পূরণ হয়নি। সুতরাং এ চুক্তিটি হচ্ছে, বিনা মূল্যে পরের সম্পদ গ্রাস করার অবৈধ রিবা চুক্তি।“আর (আল্লাহ) রিবাকে হারাম করেছেন”- এ কথা দ্বারা এইরূপ চুক্তিকেই বুঝানো হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, অন্যান্য অন্যায় ভক্ষণের সাথে রিবার পার্থক্য এটাই যে, রিবা খাওয়া হয় কাউন্টার ভ্যালুর ওপর ধার্য করে।
হাদীসের আলোকে দেখালে দেখা যায় যে, এখানে ৫.০০ লাখ টাকার দুটি কাউন্টার ভ্যালু/দাম ধার্য করা হয়েছেঃ একবার বলা হয়েছে ৫.০০ লাখ টাকার দাম ৫.০০ লাখ টাকা; আবার বলা হয়েছে ৫.০০ লাখ টাকার দাম ৬.৫০ লাখ টাকা। প্রথমটি মূল ও কম। এটি গ্রহণ করতে হবে; অন্যথায় ২য় দামটি নিলে সুদ খাওয়া হবে ১৫% বর্ধিতাংশ। অন্যদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, এখানে ৫.০০ টাকাকে দু’বার বিক্রি করা হয়েছে। একবার ৫.০০ লাখ টাকার বিনিময়ে ৫.০০ লাখ টাকা; আবার ৫.০০ লাখ টাকাকে ১৫% বৃদ্ধির বিনিময়ে বিক্রি করা হয়েছে। একেই বলা হয়েছে Multipe sale of the samething. অথচ দ্বিতীয়বার এবং তৎপরবতীতে যা বিক্রি করা হচ্ছে তা আসলে বিক্রেতার কাছে নেই। থমাস একুইনস এই কথাই বলেছেন এবং একে ভণ্ডামি আখ্যায়িত করেছেন।
প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো তাদের সঞ্চয়ী ও মেয়াদী হিসাবসমূহে যে ডিপোজিট গ্রহণ করে সেখানেও এই একইভাবে ক্রয়-বিক্রয় ও রিবা চুক্তির সম্মিলন ঘটানো হয়। আসলে ডিপোজিট হচ্ছে ঋণ। ব্যাংক বিভিন্ন হারে নির্ধারিত সুদের ভিত্তিতে বিভিন্ন মেয়াদের জন্য এসব ঋণ গ্রহণ করে; (অবশ্য সঞ্চয়ী ডিপোজিটে মেয়াদ নির্ধারিত থাকে না।) অতঃপর ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হলে আসলের কাউন্টার ভ্যালু পরিশোধ করে দেয়; আর সুদ চুক্তি অনুসারে ধার্যকৃত সুদ দেয় যার কাউন্টার ভ্যালু ব্যাংক পায় না।
ঋণ লেনদেনের বস্তু যদি কোন পণ্য বা সেবা হয়, তাহলে একইভাবে দু’টি চুক্তি করা হলে তার একটি হবে সুদ চুক্তি। উদাহরণস্বরূপ কেউ যদি ৪০ কেজি নাজির শাইল ধান অপর কাউকে ১ মাসের জন্য ধার দেয়, তাহলে দাতার পাওনা কাউন্টার ভ্যালু হয় ৪০ কেজি সমমানের নাজির শাইল ধান। অতঃপর এই কাউন্টার ভ্যালুর ওপর যদি ৫ কেজি নাজির শাইল ধান বেশি ধার্য করা হয়, তাহেল প্রথম চুক্তিটি হয় বৈধ ক্রয়-বিক্রয় বা ঋণ চুক্তি; আর দ্বিতীয়টি হয় অবৈধ রিবা চুক্তি।
অনুরূপভাবে কেউ যদি কোন গাড়ীর (Car) মালিকের সাথে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, গাড়ীর মালিক আজ তাকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছে দেবে; আর এর বিনিময়ে ঠিক এক মাস (৩০ দিন) পরে সে উক্ত গাড়ীর মালিককে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌছেঁ দেওয়ার সার্ভিসের পারস্পরিক বিনিময় হবে সেবা লেনদেন বা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি যা দেওয়ার সার্ভিসের পারস্পরিক বিনিময় হবে সেবা লেনদেন বা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি যা বৈধ। আর ১০০/- টাকা অতিরিক্ত লেনদেন চুক্তিটি হবে কাউন্টার ভ্যালুর ওপর বিনিময় না দিয়ে নেওয়ার অবৈধ রিবা চুক্তি।
এই হচ্ছে, ঋণের ক্ষেত্রে মুদ্রা, পণ্য বা সেবা পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে সুদ কিভাবে উদ্ভূত হয় তার উদাহরণ। কিন্ত শুধু পরিামণ নয়, মুদ্রা, পণ্য বা সেবার মানে তারতম্য করা হলে অথবা বিদ্যমান তারতম্যের দরুন উভয় মুদ্রা, পণ্য বা সেবার বিনিময় রেশিওতে হ্রাস-বৃদ্ধি করা হলেও উভয় মূল্যের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হবে এবং এক পক্ষের বাড়তি মূল্যটুকু হবে বিনিময়হীন অতিরিক্ত বা রিবা।
সকল মাযহাবের সম্মনিত ফক্বীহগণ একে রিবা এবং অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, হানাফী মাযহাবে বলা হয়েছে, “নীতিগতভাবে কর্দ চুক্তিতে ঋণদাতাকে কোন সুবিধা দেওয়ার শর্ত করা উচিত নয়, অন্যথায় তা রিবা হবে”।[আল-কাসানি; বাদাই, ভলি-৭, পৃ: ৩৯৫-৬, উদ্ধৃত, নূর,ই, এম, উপরোক্ত, পৃ: ১২০।] হাম্বালী মাযহাবে বলা হয়েছে, “কর্দ হচ্ছে দান এবং তা দানই থাকা উটিত। এতে গুণগত বা পরিমাণগত কোন বৃদ্ধির শর্ত করা হলে তা ঋণের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করবে”।[ইবনে কুদামাঃ আল-মুঘনি, ভলি-৪, পৃ: ৩৫৪-৭, উদ্ধৃত, নূর,ই, এম, উপরোক্ত, পৃ: ১২০।] মালেকী মাযহাবে বলা হয়েছে, “কর্দ চুক্তিতে যদি বলা হয় যে, যে রূপ পণ্য দেওয়া হলো, তার চেয়ে ভাল পণ্য ফেরত দিতে হবে, অথবা “ঋণদাতাকে কোন উপহার দিতে হবে তাহলে তা অবৈধ হবে”।।[উপরোক্ত।] শাফেয়ী মাযহাবের মতে, “ঋণদাতাকে পরিমাণের বেশি ও মানগত দিক থেকে উত্তম পণ্য ফেরত দেওয়া ইত্যাদি কোন সুবিধা প্রদান করা বৈধ নয়”।[আল-সিরাজী, আল-মুজাযাহাব, ভলি-১, পৃ: ৩০৬, উদ্ধৃত, নূর, ই, এম, উপরোক্ত, পৃ: ১২৫।]
সিকিউরিটি, বন্ড, ডিবেঞ্চার ক্রয়–বিক্রয়ে রিবাঃ সিকিউরিটি, বিল, ব্যাংকের স্বীকৃতিপত্র, ডিপোজিট সার্টিফিকেট, বাণিজ্যিক পত্র, বন্ড, মর্টগেজ ইত্যাদি হচ্ছে বিভিন্ন ঋণপত্র। সরকার,কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি ও কোম্পানী এসব ঋণপত্র ইস্যু ও বিক্রয় করে। এগুলো আসলে ঋণের সার্টিফিকেপ বা দলীল। ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ এই সার্টিফিকেট দিয়ে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও জনসাধারণ, এক কথায়, ক্রেতাদের কাছ থেক সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করে। পত্রগুলো বিভিন্ন পরিমাণ ও মেয়াদের হয়ে থাকে। আর সে অনুসারে এদের সুদের হাও কম-বেশি নির্ধারিত থাকে। ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো এগুলো নিলামে বিক্রয় করে। ক্রেতাগণ সুদী আয় পাবার আশায় এগুলো ক্রয় করে, তথা এই সার্টিফিকেট গ্রহণ করে ইস্যুকারীকে ঋণ দেয়। নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হলে ক্রেতাগণ এগুলো ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করে এবং সুদসহ আসলের কাউন্টার ভ্যালু ফেরত পায়। প্রাপ্ত সুদ হয় তাদের আয়/মুনাফা। এসব ঋণপত্র হস্তান্তুযোগ্য; ক্রেতার নগদ অর্থের প্রয়োজন হলে ক্রীত ঋণপত্র বাজারে বিক্রয় করে ঋণ বাবদ প্রদত্ত তার অর্থের কাউন্টার ভ্যালু ফেরত পেতে পারে। অবশ্য চাহিদা ও যোগানের দ্বারা দাম নির্ধারিত হয় বিধায় ক্রেতা কখনও কখনও লোকসানেও এগুলো বিক্রয় করতে বাধ্য হয়; আবার কোনও কোনও সময় লাভেও বিক্রয় করতে পারে। ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ তাদের স্বল্প মেয়াদী আর্থিক প্রয়োজন পূরণার্থে, যেমন সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে ঋণপত্র ইস্যু করলে সেগুলোকে বলা হয় স্বল্প মেয়াদী ঋণপত্র। কিন্তু মেশিন, যা সাধারণত এক বছরের কম-বেশি সময় স্থায়ী হয়ে থাকে, ইত্যাদি ক্রয়ের প্রয়োজনে দীর্ঘ মেয়াদী পুঁজি সংগ্রহের লক্ষ্যে যখন এক বছর বা তার চেয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঋণপত্র বিক্রয় করা হয়. তখন একে বলা হয় অর্থ বাজার বা money market; আর দীর্ঘ মেয়াদী ঋণপত্রের বাজারকে বলা হয় মূলধন বাজার বা capital matket।
অন্যান্য ঋণের ন্যায় এসব ঋণপত্রের মাধ্যমে গৃহীত ঋণও হচ্ছে সমজাতীয় মুদ্রার বাকি ক্রয়-বিক্রয়। ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ এসব পত্রের মাধ্যমে তাদেরকে নির্ধারিত মেয়াদের জন্য ঋণ প্রদানের প্রস্তাব (ঈজাব) করে; আর ক্রেতা মেয়াদপূর্তিতে কাউন্টার ভ্যালু ফেরত পাওয়ার শর্তে ঋণ প্রদানে রাজী (কবুল) হয়। এটি পরস্পর কাউন্টার ভ্যালূর বিনিময় বা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। দ্বিতীয়ত, ঋণগ্রহীতা গৃহীত অর্থের কাউন্টার ভ্যালুর ওপরে নির্ধারিত সুদ প্রদান করবে বলে ওয়াদা (ঈজাব) করে; আর ঋণদাতাগণ উক্ত সুদ গ্রহলে রাজী (কবুল) হয়ে ঋণ দেয়। এটি একতরফাভাবে সুদ প্রদান ও গ্রহণের চুক্তি। সুদ গ্রহীতা গৃহীত সুদের কোন কাউন্টার ভ্যালু দেয় না। সুতরাং এটি মাগনা প্রদান ও গ্রহণের চুক্তি। তাই অবৈধ।
বিল ক্রয়–বিক্রয় ও বাট্টাকরণে রিবাঃ বিল মানে হচ্ছে বিনিময় বিল বা Bill of Exchange। বিনিময় বিল প্রধানত দুই রকম হয়ে থকেঃ বিদেশী বিনিময় বিল বা Foreign Bills ও দেশী বিনিময় বিল বা Local Bills। দেশী মাল বিক্রেতা কর্তৃক বিদেশী ক্রেতার ওপর বিদেশী মুদ্রার অংকে কৃত বিলকে বলা হয় বিদেশী বিল। আর দেশী বিক্রেতা কর্তৃক দেশী ক্রেতার ওপর দেশীয় মুদ্রার অংকে বিল করলে তা হয় দেশী বিল। দেশী-বিদেশী উভয় প্রকার বিল আবার দুই ধরনের হয়; উপস্থাপন মাত্র পরিশোধযোগ্য বিল বা Demand Bills এবং মেয়াদী বিল। মেয়াদী বিলে পরিশোধের মেয়াদ নির্ধারিত থাকে। বণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এই সকল বিলই ক্রয় করে থাকে। সাধারণতঃ ডিমান্ড বিলের ক্ষেত্রে তারা বিল ক্রয় বা Purchase of Bills পরিভাষা ব্যবহার করে; আর মেয়াদী বিল ক্রয়কে তারা বিল ক্রয় বাট্টাকরণ বা Discounting of Bills বলে থাকে। উভয় ক্ষেত্রেই বিল বিক্রেতাগণ ব্যাংকের নিকট থেকে ঋণ হিসেবে তাৎক্ষণিভাবে বিলের অর্থ পেয়ে যায়, তাদেরকে ব্যাংক কর্তৃক বিলের অর্থ সংগ্রহ করা পর্যন্ত প্রতীক্ষা করতে হয় না।
ডিমান্ড বিল ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো তাদের মঞ্জুরকৃত মোট ঋণ থেকে সেবামূল্য ও কালেকশন ব্যয় কেটে রেখে বিলের অবশিষ্ট অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহককে (তার হিসাবে) পরিশোধ করে দেয়। অতঃপর স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট Drawee- এর কাছ থেকে ও সব বিলের অর্থ সংগ্রহ করে নেয়। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যাংক সাধারণত প্রদত্ত ঋণের ওপর কোন অতিরিক্ত বা সুদ নেয় না; ব্যাংক কর্তৃক ঋণ প্রদান এবং Drawee- র নিকট থেকে উক্ত বিলের মূল্য আদায় করে ঋণ সমন্বয় করার মাঝখানে সময়ের তেমন ব্যবধান না থাকান স্বল্প সময়ের বিনিময়ে সুদ ধার্য করা হয় না।
কিন্তু মেয়াদী বিলের ক্ষেত্রে মঞ্জুরকৃত ঋণ হতে ব্যাংক তাদের সেবামূল্য ও বিলের অর্থ সংগ্রহ খরচ ছাড়াও বিলের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার দিন পর্যন্ত সময়ের জন্য সুদ নিয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে দুটি চুক্তি হয়ঃ একটি বিল ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি; আর অপরটি হচ্ছে রিবা বা সুদ চুক্তি। প্রথম চুক্তি দ্বারা ব্যাংক বিলের প্রাপককে সমমুল্যের অর্থ বিলে নির্ধারিত মেয়দেন জন্য ঋণ দেয়; শর্ত থাকে যে, বিলদাতা নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হলে সমমুল্যের যে অর্থ পরিশোধ করবে তার দ্বারাই এই ঋণের কাউন্টার ভ্যালু পরিশোধ বা সমন্বয় করা হবে। আর দ্বিতীয় চুক্তি দ্বারা ঋণদাতা ব্যাংক বিলের বিপরীতে প্রদ্ত্ত ঋণের ওপর বিলে নির্ধারিত সময়ের জন্য সুদ ধার্য করে, আর ঋণগ্রহীতা তা পরিশোধে রাজী হয় ও পরিশোধ করে। এই সুদ হচ্ছে রিবা নাসীয়াহ। এক ‘বিল বাট্টাকরণ’ বলার করাণ হচ্ছে ব্যাংক বিলের প্রাপক ঋণগ্রহীতাকে বিলের মূল্যের সমপরিামাণ অর্থ ঋণ হিসেবে মঞ্জুর করে; অতঃপর সুদ-চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত মেয়াদের ওপর ধার্যকৃত সাকল্য সুদ কেটে রেখে মঞ্জুরকৃত মোট ঋণের অবশিষ্টাংশ বিলের প্রাপককে প্রদান করে। বিলের মোট মূল্য থেকে সুদ কেটে রাখাকেই বলা হয় বিল বাট্টকরণ। এখানে উল্লেখ্য যে, বৈদেশিক মুদ্রার বিল দেশীয় মুদ্রায় ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক সাধারণত ঋণ মঞ্জুর করার দিন বিদ্যমান হার অনুসারে বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারণ করে থাকে।
এখানে একটি কথা বলা জরুরী যাতে ব্যাংক ও বিল প্রাপক উভয়েই সুদের লেনদেন থেকে বাঁচতে পারে। বিদেশী মুদ্রার বিল যখন দেশীয় মুদ্রায় ক্রয়-বিক্রয় করা হয়, তখন ক্রয়-বিক্রয়ের বস্তু দুটি (মুদ্রা দুটি) আসলে ভিন্ন ভিন্ন জাতের হয়। এরূপ ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতার পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে মুদ্রা দুটির বিনময় হার নির্ধারণ করার সুযোগ রয়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতা পারস্পরিক সম্মতিতে যে কোন দামে তা ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। সুতরাং ঋণ ও সুদের দিকে না গিয়ে ব্যাংক পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিদেশী মুদ্রার দাম নির্ধারণ করে বিক্রেতাকে পুরো মূল্য নগদ পরিশোধ করে দিতে পারে এবং পরবতীতে বিলের বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ করে তা উচ্চতর হারে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করতে পারে।
উল্লেখ্য যে, পারস্পরিক সম্মতিতে বিনিময় হার নির্ধারণ কেবল অসম জাতের মুদ্রার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু উভয় মুদ্রা যদি সমজাতের হয়, অর্থাৎ দেশীয় মুদ্রার বিল যদি দেশীয় মুদ্রায় ক্রয়-বিক্রয় করা হয়, তাহলে বিলে লিখা মুদ্রার মোট পারিমাণ এবং এর মূল্য বা কাউন্টার ভ্যালু বাবদ প্রদত্ত মুদ্রার পরিমাণ অবশ্যই সমান সমান হতে হবে; এতে ব্যথায় ঘটানোর কোন এখতিয়ার ক্রেতা-বিক্রেতার নেই। এক্ষেত্রে মূল্য থেকে বাট্টা করে যদি মূল্য পরিমাণে কম দেওয়া হয়, তাহলে মোট বিলেরে পরিমান এর কাউন্টার ভ্যালুর পরিমাণের পার্থক্যটা হবে কাউন্টার ভ্যালুর ওপরে বাড়তি ও বিনিময়হীন; সুতরাং রিবা। এখানেও সামন সমান মূল্যের বিনিময় হবে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি; আর বাড়তি লেনদেন হবে রিবা চুক্তি।
দেশে-বিদেশে অনেক চাকুরীজীবী, বিশেষ করে, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক তাদের বেতনের বিল অগ্রিম কম পরিমাণ টাকায় বিক্রি করে নগদ টাকা সংগ্রহ করে থাকেন। এটা আসলে বিল বাট্টকরণ এবং সুদের মধ্যে শামিল।
আরিয়্যাহ ও রিবা
আরবী ‘আরিয়্যাহ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ধার, borrowing বা loan. কিন্তু আভিধানিক অর্থ অভিন্ন হলেও বাস্তবে কর্দ এবং আরিয়্যাহর মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। ইতোপূর্বে বলা হয়েছে যে, সমজাতের ফানজিনবল (Fungible) পণ্য, মুদ্রা বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয় থেকে ঋণের সৃষ্টি হয়। কিন্তু মালে গাইরে ফানি বা Non-Fungible পণ্য ব্যবহার করার জন্য বিনা মুল্যে ধার দেওয়া হলে তাকে বলা হয় আরিয়্যাহ।
মালে গাইরে ফানি বা non-fungible goods হচ্ছে সেই সব বস্তু, ব্যবহার করা সত্ত্বেও যার অস্তিত্ব বর্তমান থাকে, নিঃশেষ বা রূপান্তরিত হয়ে যায় না। সহজ কথায়, যেসব পণ্য, asset, property- কে এর নিজ রূপে বহাল রেখে বরাবার ব্যবহার করা এবং উপকার নেওয়া যায় সেসব পণ্য, এসেট ও প্রপার্টিকে বলা হয় non-fungible goods। যেমন, গাড়ী, বাড়ী, শাড়ী ইত্যাদি। ফানজিবল পণ্যের ন্যায় নন-ফানজিবল পণ্যেরও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনটি, যা ফানজিবল পণ্যের বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। নন-ফানজিবল পণ্যের বৈশিষ্ট্য ৩টি হচ্ছেঃ
১. ব্যবহার করার পরও অস্তিত্ব বহাল থাকে;
২. সেবা প্রবাহ বা flow of service আছে এবং
৩. বস্তু থেকে এর সেবা ((service) পৃথক (separate) করা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি গাড়ীর কথা ধরা যাক। একবার নয় বারবার ব্যবহার করার পরও গাড়ীটি যথাযথ (অবচয় ছাড়া) বিদ্যমান থাকে। যতদিন অস্তিত্ব থাকে ততনিদ গাড়ী থেকে সেবা গ্রহণ করে উপকৃত হওয়া যায়। সর্বোপরি গাড়ীটির অস্তিত্ব যথাযথ বহাল রেখেই এ থেকে সেবা নেওয়া যায়; এমনকি, গাড়ী বিক্রি না করেও আলাদাভাবে গাড়ীর সেবা বিক্রি করা যায়।
সুতরাং আরিয়্যাহ হচ্ছে, মূল্য বা বিনিময় ছাড়া কোন ‘মালে গাইরে ফানি’ বা নন-ফানজিবল বস্তু কাজ শেষে ফেরত দেওয়ার শর্তে কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া। যেমন, খ-এর কন্যার বিয়েতে মেহমান আপ্যায়নের জন্য ক তার ডাইনিং টেবিল ও চেয়ারগুলো অনুষ্ঠান শেষে ফেরত দেওয়ার শর্তে খ-কে ধার দিল। এরূপ ধারকে বলা হয় আরিয়্যাহ।
বস্তুতঃ “আরিয়্যাহ হলো এমন বস্তু ধার দেওয়া, যা নিঃশেষ না করেও তা থেকে উপকারিতা (benefit) নেওয়া সম্ভব”।[ফক্বীহ কুনুবী: আনিসুল ফুক্বাহা, পৃ: ৬২৫।] মিসর ইফতার শাইখ মুহাম্মদ ফাতের বলেছেন,”আরিয়্যাহ হচ্ছে বিনিময় ব্যতীত কোন বস্তুর উপকারিতার মালিকানা প্রদান করা, মূল বস্তুর নয়।…………. আরিয়াহর মূল কথা হচ্ছেঃ মূল বস্তুটি থেকে উপকারিতা নেওয়ার পর বস্তুটি ফেরত দেওয়া”।
আরিয়্যাহর মাল আরিয়্যাহ গ্রহীতার আছে আমানত হিসেবে গণ্য হয়; মালের মালিকানা তার কাছে হস্তান্তর করা হয় না। গ্রহীতা যে কাজের জন্য মালটি গ্রহণ করে সে কাজে ব্যবহার করার পরও বস্তুটি তার কাছে বর্তমান থাকে এবং শর্ত অনুযায়ী সে মালিককে তা ফেরত দিয়ে দেয়। এছাড়া মালটি ব্যবহার করে এ থেকে যে উপকার সে নেয় তারও কোন মূল্য বা বিনিময় তাকে দিতে হয় না। সুতরাং আরিয়্যাহয় গৃহীত মাল এবং মালের ব্যবহার ও উপকার এর কোনটার জন্যই কোন দায় গ্রহীতার ওপর বর্তায় না। অবশ্য সংরক্ষিত আমানত হিসেবে আরিয়্যাহর বস্তু যথাযথ হেফাজত করা তার দায়িত্ব। তবে যথাযথ হেফাজত করা সত্ত্বেও যদি তার নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোন কারণে মাল বিনষ্ট বা ধ্বংস হয়, তাহলেও এর ক্ষতিপূরণ করার দায়িত্ব গ্রহীতার ওপর বর্তায় না। অবশ্য তার গাফলতি বা ত্রুটির কারণে মালের ক্ষতি হলে তার দায়িত্ব তার ওপরই বর্তাবে। সুতরাং আরিয়্যাহ ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে শামিল নয়। এতে সুদ হওয়ার আশংকা নেই। এমনকি, মাল ব্যবহারের মূল্য নেওয়া হলে তা হয় আজর বা ভাড়া; আর চুক্তিটি হয়ে যায় ইজারাহ। ইজারাহ সম্পর্কে পরে আলোচনা আসছে।
আল-ওয়াদিয়াহ ও রিবা
আল-ওয়াদিয়াহ মানে নিরাপদ সংরক্ষণ। আল-ওয়াদিয়াহ হচ্ছে সম্পদের মালিক এবং জিম্মাদারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি যেখানে জিম্মাদার মালিকের গচ্ছিত সম্পদের নিরাপদ হেফাজত করে। ফিক্বাহ শাস্ত্রে আল-ওয়াদিয়াকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছেঃ ১) আল-ওয়াদিয়াহ আল-আমানাহ ২) আল-ওয়াদিয়াহ আল-জামানাহ।
১. আল–ওয়াদিয়াহ আল–আমানাহঃ সম্পদের মালিক যদি চাহিবা মাত্র হুবহু একই সম্পদ ফেরত দেওয়ার শর্তে কোন সম্পদ কারো কাছে নিরাপদ হেফাজতের জন্য গচ্ছিত রাখে, তাহলে সেই চুক্তিকে বলা হয় আল-ওয়াদিয়াহ আল-আমানাহ।
আমানত ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে শামিল নয়, এতে বিনিময় নেই; একই বস্তু যে অবস্থায় রাখা হয় সে অবস্থাতেই সংরক্ষণ করা হয় এবং মালিক চাইলে তার বস্তু হুবহু তাকে ফেরত দেওয়া হয়। জিম্মাদার কেবল হেফাজত করার দায়িত্ব পালন করে; এজন্য সেবামূল্য গ্রহণ করলে তা হয় সেবা ক্রয়-বিক্রয়। অপরদিকে আমানতকারী বা মালিক তার গচ্ছিত সম্পদের নিরাপত্তা পায় এবং দরকার হলে তা ফেরত নিয়ে যায়। তাকে কোন অতিরিক্ত প্রদান করার প্রশ্নই আসে না। সুতরাং আমানতে সুদের উদ্ভব ঘটার কোন আশঙ্কা নেই।
২. আল–ওয়াদয়াহ আল–জামানাহঃ সাধারণতভাবে এটি জামানত হিসেবে পরিচিত। সম্পদের মালিক যখন ব্যবহারের অনুমতি ও চাহিবা মাত্র অনুরূপ সম্পদ সমপরিমানে ফেরত দেওয়ার শর্তে কোন অর্থ বা পণ্য কারও কাছে নিরাপদ হেফাজতের জন্য গচ্ছিত রাখে তখন তাকে বলা হয় আল-ওয়াদিয়াহ আল-জামানাহ বা জামানত। যে জামানত রাখার জন্য দেয় তাকে বলা হয় মালিক বা জামানতকারী, আর যে সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে তাকে বলা হয় জিম্মাদার।
আল–ওয়াদিয়া আল–জামানাহ ও ঋণঃ আল-ওয়াদিয়া আল-জামানাহ-এর সাথে ঋণ তথা একজাতের পণ্য বাকি ক্রয়-বিক্রয় এবং আরিয়্যাহর যথেষ্ট মিল আছে। তবে ঋণ ও ওয়াদিয়ার মধ্যে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, ঋণে দাতা বস্তুটি বিক্রয় করে এবং মালিকানাসহ তা গ্রহীতার নিকট হস্তান্তর করে দেয়; অতঃপর বস্তুর সকল প্রকার ঝুঁকি এর নতুন মালিক ঋণগ্রহীতার ওপর বর্তায়। কিন্তু ওয়াদিয়ায় মালিক বস্তুর ওপর তার মালিকানা বহাল রেখে শুধু দখল (possession) হস্তান্তর করে এবং গ্রহীতাকে তা ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। জিম্মাদার বস্তুর যাবতীয় ঝুঁকি বহন করে এবং বস্তু বা তার কাউন্টার ভ্যালু ফেরতের গ্যারান্টি দ্য়েও ফেরত দিতে বাধ্য থাকে; তাবে তার নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোন কারণে সম্পদ বিনষ্ট হলে তা ক্ষতিপুরণের দায়িত্ব তার ওপর বর্তায় না। কিন্তু ঋণের বেলায় এরূপ ঝুঁকি গ্রহীতাকেই বহন করতে হয়।
একেতো ফানজিবল পণ্য তারপর আবার ঋণের সাথে প্রায় মিলে যাওয়ার কারণে আল-ওয়াদিয়াহর বস্তু ব্যবহারের জন্য দাম নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। দাতা-গ্রহীতা যদি মালিকাকে এরূপ কোন অতিরিক্ত প্রদানের চুক্তি করে তাহলে চক্তিটি পরিণত হয় ঋণ চুক্তিতে আর অতিরিক্ত লেনদেন হয় রিবা চুক্তি।
দাইন বা দেনা
এখানে দাইন কি, দাইন কিভাবে সৃষ্টি হয় এবং এতে কিভাবে রিবা বা সুদের উদ্ভব ঘটে সে বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
দাইন অর্থঃ ইতোপূর্বে বলা হয়েছে যে, ‘দাইন’ শব্দটি আরবী; দাইন-এর অর্থ হচ্ছে দেনা, ঋণ, debt, liability.
দাইনের সংজ্ঞাঃ বাকি ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এমন বিক্রয় চুক্তি sale contract) যেখানে বিনিময়ের দুটি বস্তুর মধ্যে একটি অথবা দুটি বস্তই অনুপস্থিত থাকে এবং চুক্তিকালে এর/এদের হস্তান্তর ও সরবরাহ বুঝে (acquisition) নেওয়া হয় না; তবে সংশ্লিষ্ট পক্ষ/পক্ষদ্বয়ের ওপর যথাসময়ে তা পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক থাকে। এভাবে কাউন্টার ভ্যালু প্রদান স্থগিত রাখার সংশ্লিষ্ট পক্ষের ওপর তা পরিশোধের যে দায় বর্তায় তাকে বলা হয় দাইন।
হাশিম কামালি সূরা-আল-বাকারাহর ২৮২ আয়াতে ব্যবহৃত ‘দাইন’ শব্দের ব্যাখ্যা করে বলেছেন য, আয়াতে উল্লেখিত ‘তাদইয়ানতুম’ হচ্ছে ক্রিয়াপদ। শব্দটি বর্তমান কাল, বহুবচন ও পারস্পরি মুডে (reciproca; mood) ব্যবহৃত হয়েছে। ভায়াহত দিক থেকে এর দ্বারা একদিকে পারস্পরিকতা (reciprocity) এবং অপরদিকে স্থগিতকৃত দায়ের (deferred liability) ভিত্তিতে পণ্য-সামগ্রী এ সেবার ক্রয়-বিক্রয় বুঝায়। সুতরাং দাইন হচ্ছে স্থগিতকৃত দায় যা পণ্য-সামগ্রী, অর্থ ও সেবার বাকি ক্রয়-বিক্রয় থেকে সৃষ্টি হয়। ক্রয়-বিক্রয়ে দাম প্রদান যদি ভবিষ্যতে পরিশোধের জন্য স্থগিত রাখা হয়, অথবা বিক্রীত পণ্য ভবিষ্যতে প্রদান (delivery) করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তাহলে স্থগিত দায়কে (deferred liability) বলা হয় দাইন। “Dayn represents a charge or a personal commitment, on the dhimmah (legal personality) of its bearer”. “অর্থাৎ দাইন হচ্ছে দাবি বা ব্যক্তিগত অঙ্গীকার যা বাহকের (আইনানুগ ব্যক্তিত্ব) জিম্মায় থাকে”। ‘দাইন’ দ্বারা এমন বস্তুকে (asset) বুঝায় চুক্তিকালে যার বাস্তব অস্তিত্ব (tangible existence) থাকে না।
দাইন ক্রয়–বিক্রয়ের বৈধতা
দাইন ক্রয়-বিক্রয়ের বৈধতা আলোচনায়া হাশিম কামালি দেখিয়েছেন যে, দাইন ক্রয়-বিক্রয়ের বৈধতা আল-কুরআনের আয়াত দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত। সূরাতুল বাকারাহর ২৮২ আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে পরস্পর দাইন লেনদেনের কথা বলে তা লিখে নেওয়ার নির্দেশে দিয়েছেন। আয়াতে এ কথা স্পষ্ট যে, দায় ছোট হোক বা বড় হোক, তা অবশ্যই কোন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হতে হবে এবং এতদসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়সহ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের দায়িত্ব ও অধিকার সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে চুক্তিপত্র তথা দলীলে লিখতে হবে।
অতঃপর কামালি আইনবেত্তাদের বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেছেন; এর সারসংক্ষেপ হলোঃ
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন যে, আয়াতটি ‘সালাম’ (অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়) সম্পর্কে নাযিল হয়েছে এবং অন্যান্য বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এ আয়াত প্রযোজ্য নয়।
আর ইমাম রাযীর মতানুসারে এই আয়াত কেবল দুই ধরনের ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্যঃ এক প্রকার হচ্ছে বাকি বিক্রয় যেখানে দাম ভবিষ্যতের কোন দিনে পরিশোধ করা হয়; আর একক প্রকার হচ্ছে অগ্রিম বিক্রয় (বাই-সালাম)। এই উভয় প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ে কেবল কোন এক পক্ষের ওপর দায় বর্তায়। সুতরাং বাকি ক্রয়-বিক্রয় উভয় পক্ষের মূল্য প্রদান স্থগিত রাখা বৈধ নয়।
কামালি বলেছেন যে, প্রচলিত ফিক্বাহয় এ বিষয়ে এমন রুলিং দেওয়া হয়েছে যে, এর ফলে আসলে যাবতীয় রিয়েল (real) ও বাস্তব (tangible) বস্তু দাইন ক্রয়-বিক্রয়ের আওতা থেকে বাদ পড়ে গেছে। বলা হয়েছে যে, একটি গাড়ী বা একটি বাড়ী বিক্রয় করা হলে উভয় পক্ষের কাউন্টার ভ্যালু অবশ্যই তাৎক্ষণিকভাবে বিনিময় ও হস্তান্তর করে দিতে হবে। তবে কেবল ক্রেতা তার দাম প্রদান স্থগিত রাখতে পারে যদি বিক্রেতা তাতে সম্মত হয়। কিন্তু গাড়ী বা বাড়ীর বিক্রেতাকে কিছুতেই তার গাড়ী বা বাড়ী হস্তান্তর স্থগিত রাখার সুযোগ দেওয়া যাবে না। বরং তা অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে এর নতুন ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করতে হবে। হাশিম কামালি বলেনে, আইনহত এই অবস্থান খুব দৃঢ় ও অনমনীয়; ইজতেহাদী এ বিষয়টি পর্যালোচনা করা জরুরী; আর এজন্য নতুনভাবে গবেষণা হওয়া দরকার। তাছাড়া ফিক্বাহর এ সিদ্ধান্ত হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত বক্তব্যর পরিপন্হী। হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলের (সাঃ) অন্যতম সাহবী জাবির (রা) রাসূলের (সাঃ) কাছে তাঁর উট বিক্রি করলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর নবীকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তিনি কি মদীনায় পৌঁছার পর উটটি নবীর (সাঃ) নিকট হস্তান্তর করতে পারবেন? নবী (সাঃ) এতে সম্মতি দিলেন। হাদীসে উল্লেখ আছে যে, জাবির (রাঃ) মদীনায় পৌঁছার পর উক্ত উটটি রাসূলের (সাঃ) কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। এই হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনুল কায়্যিম বলেছেন যে, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে সম্মত হলে পণ্যের হস্তান্তরও বিলম্বিত করা যেতে পারে; এমনকি সমাজে যদি বিলম্বিত করার প্রথা চালু থাকে, তাহলে প্রথা মুতাবিকও তা বিলম্বিত করা যাবে।
ইবনে আবেদীন বলেছেন যে, আবেদীন বলেছেন যে, “কাউন্টার ভ্যালুদ্বয়ের তাৎক্ষণিক হস্তান্তর করাই হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়ের নিয়ম; তবে বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে পরিশোধের মেয়াদ যদি এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যে, তা কোন বিরোধের সৃষ্টি করবে না তাহলে বাকি ক্রয়-বিক্রয় অনুমোদিত।
মালিকী ষ্কুলের ফক্বীহবৃন্দও বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে বৈধ বলেছেন। তবে গারার (অস্পষ্টতা, দ্ব্যর্থবোধতা) ও রিবার আশাংকায় তাঁরা বেশ কতিপয় ধরনের বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমোদন দেন নাই। ইউসুফ আল-কারদাভী এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “এসব ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি কুরআন অথবা সুন্নাহর ভিত্তিতে করা হয়নি; বরং এর ভিত্তি হচ্ছে ইজতিহাদ। এ কারণে এ বিষয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে”।
হাম্বলী ফিক্বাহবিদগণও বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে বৈধ বলেছেন যদি তা রিবা ও গারারমুক্ত হয়। ইবনে তাইমিয়া এবং ইবনে আল-কায়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে বৈধ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি; বরং যাঁরা তাৎক্ষণিক হস্তান্তরকে ক্রয়-বিক্রয়ের মূল নিয়ম ও শর্ত বলে উল্লেখ করেছেন তাদের এ অভিমতের কঠোর সমালোচনাও করেছেন।
ইমাম শাফেঈ এ ব্যাপারে উদার দৃষ্টিভঙ্গি করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এ বিষয়ে আল-কুরআনের আয়াতটি হচেছ সাধারণ ও ব্যাপক। সকল প্রকার দাইনই এর মধ্যে শামিল। এর অর্থ হচ্ছে, যে কোন দায়ই (debt) বিলম্বিত করা বৈধ; যেমন, অগ্রিম বিক্রয়ের ক্ষেত্রে তা বৈধ হয়। ইবনে আব্বাসের বক্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন যে, (periodic loan) বা অন্য কিছু বুঝিয়ে থাকবেন। আমরা আয়াতের উদ্দেশ্য অনুসারে এনালজির (analogy) ভিত্তিতে কুরআনের উক্ত বিধানকে সকল দায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে পারে”।
ইবনে কাছিরও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এই আয়াত দ্বারা আল-কুরআন ঈমানদারদেরকে পরস্পর বিলম্বে পরিশোধের ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় করার অনুমতি এবং তা লিখে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
উপরোক্ত মতামত উদ্ধৃত করে হাশিম কামালি বলেছেন যে, “দাইন-এর ব্যাখ্যায় বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ দাইনকে সীমিত রেখেছেন। কিন্তু অন্যান্য স্কলারগণ দাইনকে সাধারণ ও ব্যাপক অর্থবোধক হিসেবে দেখেছেন এবং সকল প্রকার স্থগিত দায়ই দাইন-এর মধ্যে শামিল বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বস্তুতঃ আল-কুরআন ‘দাইন’ বা ‘মুদায়্যানাহ’-এর ব্যবহার সাধারণ অর্থেই কারেছে, এর অর্থ নির্দিষ্ট (specify) করে দেয়নি; আর এই সাধারণ অর্থের পরিবর্তে ভিন্নতর অর্থ গ্রহণে বাধ্য করে এমন কোন প্রমান নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের সুচিন্তিত অভিমত হচ্ছে যে, আল-কুরআনোর ভাষা হচ্ছে সাধারণ ও শর্তহীন (unqualified); আর এই অর্থেই দাইনকে গ্রহণ করা উচিত”। ইবনে আব্বাসরে ব্যাখ্যা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আয়াতটি বাই-সালাম সম্পর্কে নাযিল হওয়ার কথা যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলেও কোন অসুবিধা নেই। কারণ সেটা ছিল আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট বা শানে নুযূল। আর উসূলে ফিক্বাহর নিয়ম হচ্ছে, কোন নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে আয়াত নাযিল হতে পারে না। আয়াতটি বাই-সালাম সম্পর্কে নাযিল হয়ে থাকলেও এর অর্থ সাধারণ এবং সকল দায়ের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। সুতরাং সকল প্রকার দাইন-ই শরীয়তে বৈধ, অবশ্য যদি সুদ, জুয়া ও গারার সংক্রান্ত কুরআন ও সুন্নাহয় বর্ণিত কোন বিধি লংঘন করা না হয়।
সূরাতুল বাকারাহর ২৭৫ আয়াত “আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম.” এর উদ্ধৃতি দিয়ে কামালি লিখেছেন যে, আয়াতে ব্যবহৃত ‘বাই’ শব্দটি হচ্ছে এক বচনে বিশেষ্য পদ, আর এর পূর্বে সংযুক্ত করা হয়েছে ‘আল’ (আলিফ লাম); ফলে এখানে বাই এর অর্থ হয়েছে সাধারণ বা আ’ম। এর দ্বারা সকল প্রকার বাইকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং সকল বাই-ই বৈধ।
আল-কুরআনের এই সাধারণ বিধানের মধ্যে সকল প্রকার বাই যেমন, এক পণ্যের বিনিময়ে আর এক পণ্য বিক্রয় (barter) এক মুদ্রার বদলে অন্য মুদ্রা ক্রয় (al-Sarf), অর্থের বিনিময়ে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় (cash sale), অগ্রিম বিক্রয় বা সালাম, খরচ দামে বিক্রয় (al-Tawliyah), লাভে বিক্রয় (মুরাবাহা), লোকসানে বিক্রয় (al-Wadiah), মোট দামে বিক্রয় (মুসাওয়ামাহ) এবং নিলামে বিক্রয় (al-Muzayadah) সবই শামিল রয়েছে। এ সব বাই-ই বৈধ, এমনকি ফিউচারস ক্রয়-বিক্রয় যদি সুদ ও গারারমুক্ত হয়, তাহলে তাও বৈধ। তাছাড়া সুন্নাহ দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয় নাই এমন সকল বাই-ই বৈধ।[কামালি, মোহাম্মদ হাশিম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৩১-১৪৪।]
দাইনের ওপর রিবা
ভিন্ন ভিন্ন জাতের পণ্য, অর্থ ও সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের প্রচলিত প্রধান প্রধান ধরন হচ্ছে, বাই-মোয়াজ্জল (বাকি বিক্রয়), বাই-মুরাবাহা বিল আজল (বাকি মুরাবাহা), বাই-সালাম (অগ্রিম বিক্রয়), বাই-ইসতিসনা (আদেশ ক্রয়), ইজারাহ (ভাড়া)। এছাড়া আধুনিক কালে ব্যাপকভাবে চালু হওয়া ফিউচারস ও অপশনস ক্রয়-বিক্রয়কেও বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে শামিল বলে গণ্য করা হয়। এসব বাকি ক্রয়-বিকয়ে কিভাবে সুদ উদ্ভূত হয় সে বিষয়ে আলোচনা নিচে পেশ করা হলোঃ
বাই–মোয়াজ্জাল/বাই–মুরাবাহা ও রিবাঃ শরয়ী দিক থেকে দাম নির্ধারণের বেলায় বাই-মোয়াজ্জল-এ ক্রয় মূল্য ও মুনাফা আলাদা করে উল্লেখ করা জরুরী নয়; কিন্তু বাই-মুরাবাহায় ক্রয় মূল্য ও মুনাফা পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করার শর্ত রয়েছে। এছাড়া এদের মধ্যে পদ্ধতিগত আর কোন পার্থক্য নেই। সেজন্য এ দুটি এক সাথে আলোচনা করা হচ্ছে।
বাই-মোয়াজ্জল ও বাই-মুরাবাহা ক্রয়-বিক্রয়ের বস্তু ভিন্ন ভিন্ন জাতের হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার পরস্পরিক সম্মতিতে কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণের বিধান প্রযোজ্য। বাই-মোয়াজ্জল ও বাই-মুরাবাহা পদ্ধতিতে বিক্রীত পণ্য তাৎক্ষণিকভাবে ক্রেতার কাছে সরবরাহ করা হয়; কিন্তু নির্ধারিত দাম বা খরচ + মুনাফা হস্তান্তর ভবিষ্যতের কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত বা বাকি রাখা হয়। উল্লেখ্য যে, ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার সাথে সাথে বিক্রীত পণ্যের ওপর বিক্রেতার মালিকানা থাকে না, সে মালিক হয় নির্ধারিত দামের যা ক্রেতার কাছে পাওনা থাকে। আর নির্ধারিত দামের ওপর ক্রেতার মালিকানা থাকে না, সে মালিক হয় ক্রীত পণ্যের যা সে তাৎক্ষণিক বুঝে নেয়। যেহেতু বিক্রীত পণ্যের ওপর বিক্রেতার মালিকানা নেই, সেহেতু এই পণ্য আবার বিক্রি করা বা এর দাম বৃদ্ধি করার কোন অধিকার বিক্রেতার থাকতে পারে না। এতদসত্ত্বেও যদি বিক্রেতা তার পাওনা কাউন্টার ভ্যালুর ওপর কোন অতিরিক্ত ধার্য করে তাহলে সেই অতিরিক্ত হয় রিবা।
উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক ক চালের একজন বিক্রেতা আর খ চালের একজন ক্রেতা। তারা উভয়ে দরকষাকষি ও পারস্পরিক সম্মতিতে প্রতি কেজি ৩০/- টাকা দরে ৪০ কেটি চালের মোট দাম ১,২০০/- টাকা ধার্য করলো; তারা আরও স্থির করলো যে, এক মাসের মধ্যে দাম পরিশোধের শর্তে ক খ-এর কাছে ৪০ কেজি চাল বাকিতে বিক্রি করবে, তবে খ যদি নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে তার দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে পরবতীতে বর্ধিত মেয়াদের জন্য উক্ত দেনার ওপর বার্ষিক ১৫% সুদ ধার্য হবে এবং খ তা পরিশোধে বাধ্য থাকবে।
এখানে পারস্পরিক সম্মতিতে নির্ধারিত ৪০ কেজি চাল হচ্ছে ১,২০০/- টাকার কাউন্টার ভ্যালু, আর ১,২০০/- টাকা হচ্ছে ৪০ কেজি চালের কাউন্টার ভ্যালু। এখানে মূল্যের সমতা ও পারস্পরিক লেনদেন, ভিন্ন ভিন্ন জাতের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের দুটি শর্তই পূর্ণ হয়েছে। সুতরাং এই চুক্তিটি হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। কিন্তু পরিশোধে ব্যর্থ হলে বার্ষিক ১৫% সুদ ধার্য করার চুক্তিটি হচ্ছে স্বতন্ত্র আর একটি চুক্তি- রিবা চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে খ তার দেনার ওপর বছরে ১৫% অতিরিক্ত ক-কে দেবে, আর ক তা নেবে কিন্তু তার কোন বিনিময় বা কাউন্টার ভ্যালু দেবে না। সুতরাং এই চুক্তিতে কাউন্টার ভ্যালুর সমতা নেই (খ দিচ্ছে ১৫%, ক দিচ্ছে ০%) আর পারস্পরিক লেনদেনের শর্তও পূরণ হয়নি (খ দিচ্ছে, কিন্তু ক কিছুই দিচ্ছে না)। সুতরাং এ চুক্তিটি পরের সম্পদ মাগনা নেওয়ার অবৈধ রিবা চুক্তি।
অনুরূপভাবে বলা যায় যে, মুরাবাহা চুক্তিও বাকি ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। কিন্তু বাকি থাকা খরচ+লাভ তথা দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে সময়ের ভিত্তিতে তার ওপর অতিরিক্ত ধার্য করার চুক্তি করা হলে সেই চুক্তি হয় রিবা চুক্তি এবং হারাম। এই চুক্তি দ্বারা পাওনাদার তার মালিকানায় নেই এমন জিনিস বিক্রি করেছে এবং তার নির্ধারিত পাওনার চেয়ে অন্যায়ভাবে বেশি নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে এবং অপরের সম্পদের ওপর অবৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠত করে নিয়েছে।
বাই–সালাম ও রিবাঃ বাই-সালাম মানে অগ্রিম বিক্রয়। বাই-সালামে নির্ধারিত দাম তাৎক্ষণিক নগদ পরিশোধ করা হয়; কিন্তু নির্ধারিত (specified) পণ্য ভবিষ্যতের কোন নির্দিষ্ট সময়ে পরেশোধের জন্য বাকি রাখা হয়।
বাই-সালামে দুটি ভিন্ন ভিন্ন জাতের বস্তু বিনিময় করা হয়। সুতরাং এক্ষেত্রেও ক্রেতা-বিক্রেতা পারস্পরিক সম্মতিতে যে পারিমাণ পণ্য এবং যে দাম নির্ধারণ করে তাই হয় পরস্পর বৈধ কাউন্টার ভ্যালু। অতঃপর ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদনের পর কাউন্টার ভ্যালুদ্বয়ের মালিকানা পরিবর্তিত হয়ে যায়; অর্থৎ নির্ধারিত পণ্যের মালিক হয় ক্রেতা, আর নির্ধারিত দামের মালিক হয় বিক্রেতা। বিক্রেতা তাৎক্ষণিকভাবে দাম নগদ বুঝে নেয়,কিন্তু পণ্য নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রেতার জিম্মায় বাকি থাকে। এই পণ্যই হচ্ছে বিক্রেতার দেনা আর ক্রেতার পাওনা। প্রদত্ত দামের ওপর ক্রেতার মালকানা নেই শুঘু তাই নয়, তা বিক্রেতাকে বুঝিয়ে দেওয়াও হয়ে গেছে; সুতরাং দাম আবার হ্রাস করা তথা পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করার অধিকার ক্রেতার থাকতে পারে না। এতদসত্ত্বেও দেনাদার ও পাওনাদার সম্মত হয়ে যদি দেনা-পাওনার (বাকি পণ্য) ওপর কোন বাড়তি ধার্য করে, তাহলে সেই বাড়তি হবে কাউন্টার ভ্যালুর ওপর অতিরিক্ত একতরফা ও মাগনা, সুতরাং রিবা।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ক একজন ধান বিক্রেতা এবং খ ধানের একজন ক্রেতা। তারা উভয়ে স্থির করল যে, প্রতি কেজি ২০ টাকা দরে ৪০ কেজি ধানের দাম ৮০০/- টাকা। তারা আরও সিদ্ধান্ত করলো যে, খ ৪০ কেজি ধানের কাউন্টার ভ্যালু ৮০০/- টাকা তাৎক্ষণিক নগদ ক-কে পরিশোধ করে দেবে; আর ক ক্ষেতের ধান তোলার পর ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখে খ-কে ৪০ কেজি ধান সরবরাহ করবে। তবে ক যদি নির্ধারিত তারিখে ধান হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হয় তাহলে প্রতি বিলম্বিত দিনের জন্য ১ কেজি ধান বা ২০/- টাকা করে অতিরিক্ত ধার্য করা হবে এবং ক তা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। এখানে প্রথম চুক্তিটি অর্থাৎ ৮০০/- টাকার বিনিময়ে ৪০ কেজি ধান অগ্রিম বিক্রয় চুক্তি হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রোতার মধ্যে সম্পাদিত বাই-সালাম চুক্তি। কাউন্টার ভ্যালুর সমতা এবং পারস্পরিক লেনদেনের শর্ত পূর্ণ হওয়ায় এই চুক্তিটি সম্পূর্ণ বৈধ। কিন্ত প্রতি বিলম্বিত দিনের জন্য ১ কেজি ধান বা ২০ টি টাকা ধার্য করার চুক্তি হচ্ছে ভিন্নতর আর একটি চুক্তি যা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদনের পর (প্রথমটির পরই দ্বিতীয়টি হয়) পাওনাদার ক এবং দেনাদার খ এর মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে। এই চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত মেয়াদের পর যতদিন ক ৪০ কেজি ধান পরিশোধ না করবে ততদিন পর্যন্ত প্রত্যহ ১০ কেজি ধান বা ২০ টাকা হারে খ-কে দিতে থাকবে; আর খ তা নেবে কোন বিনিময়, কাউন্টার ভ্যালু বা দাম না দিয়ে। সুতরাং এই চুক্ত রিবা চুক্তি এবং সম্পূর্ণ অবৈধ।
বাই–ইসতিসনা ও রিবাঃ এক কথায় বাই-ইসতিসনাকে বলা হয় আদেশ ক্রয় (order sale)। নির্ধারিত দামে সুনির্দিষ্ট পণ্যের আদেশ গ্রহণ পূর্বক আদিষ্ট পণ্য উৎপাদন বা প্রস্তু করে সরবরাহ করা হলে সেই ক্রয়-বিক্রয়কে বলা হয় বাই-ইসতিসনা বা আদেশ ক্রয় (order sale)। ইতোপূর্বে বলা হয়েছে, বাই-মোয়াজ্জল ও বাই-মুরাবাহায় বিক্রীত পণ্য তাৎক্ষণিক নগদ সরবরাহ করা হয়, কিন্তু দাম বাকি থাকে; আর বাই-সালামে দাম নগদ পরিশোধ করা হয়, কিন্তু পণ্য বাকি থাকে। বাই-ইসতিসনায় আদিষ্ট পণ্য উৎপাদন বা তৈরী করতে সময় লাগে, সুতরাং পণ্য সরবরাহ বিলম্বিত করতে হয়; আর ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মত হলে দামও বাকি রাখা যায়। সুতরাং ইসতিসনায় পণ্য ও দাম উভয় কাউন্টার ভ্যালুর বাকি থাকতে পারে।
বাই-ইসতিসনাতে ক্রয়-বিক্রয়ের বস্তু ভিন্ন ভিন্ন জাতের বিধায় এক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক সম্মতিতে কাউন্টার ভ্যালু নিরূপণ ও নির্ধারণ করা বিধেয়। অন্যান্য বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের ন্যায় কাউন্টার ভ্যালু নিরূপণ ও নির্ধারণ এবং ক্রয়-বিক্রয় চু্ক্তি সম্পাদনের পর কাউন্টার ভ্যালুদ্বয়ের মালিকানা পরস্পর হস্তান্তরিত হয়ে যায়। ফলে বিক্রেতার দেনা হয় আদিষ্ট পণ্য, আর ক্রেতার দেনা হয় নির্ধারিত দাম। বিক্রেতা আদেশমত প্রস্তুত করে পণ্য সরবরাহ করলে ক্রেতা চুক্তির শর্ত মতে দাম পরিশোধে বাধ থাকে। সুতরাং বিক্রেতা (প্রস্তুতকারক) তার মালিকানা নেই সেই পণ্যের পরিমাণে কম-বেশি করতে পারে না।
কিন্তু প্রস্তুতকারক (আদেশ গ্রহীতা) নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে তার নির্ধারিত পাওনা দাম হ্রাস করা বা তার ওপর জরিমানা আরোজ করা যাবে কিনা?
এ ব্যাপারে আধুনিক ফক্বীহগন বাই-ইসতিসনার আদেশকে কার্যাদেশ হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং যথাসময়ে কাজ না করার শাস্তিস্বরূপ (punishment for non performance) জরিমানা আরোপ করা যাবে বলে অভিমত দিয়েছেন। এই জরিমানা রিবা নয় বলে তারা মনে করেন। তবে বিষয়টির ওপর আরও গবেষণা হওয়া দরকার। তাছাড়া, একদিকে আদিষ্ট পণ্য অন্যদিকে অর্থ; একটি অপরটির কাউন্টার ভ্যালু। অর্থ পরিশোধে বিলম্ব করলে এবং এজন্য তার ওপর কোন বৃদ্ধি করার হলে তা হয় রিবা; কিন্তু আদিষ্ট পণ্য (অপর কাউন্টার ভ্যালু) প্রদানে বিলম্ব করণে তার ওপর ধার্যকৃত জরিমানা রিবা নয়। এ বিষয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
অপরপক্ষে চুক্তিতে যদি শর্ত করা হয় যে, ক্রেতা নির্ধারিত সময়ে তার দেনা (নির্ধারিত দাম) পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে বিলম্বিত সময় কালের জন্য উক্ত দেনার ওপর নির্দিষ্ট হারে অতিরিক্ত আরোপ করা হবে, তাহলে এই শর্তটি হচ্ছে রিবা চুক্তি যাতে বিনিময়হীন অতিরিক্ত একতরফাভাবে লেনদেন করার কথা স্থির করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, মনে করা যাক, ক সেগুন কাঠের একটি ডাইনিং টেবিল আর সাথে ৮টি চেয়ার বানিয়ে নিতে চায়। সে কাঠ মিস্ত্রি খ-এর কাছে তার প্রস্তাব পেশ করলো। উভয়ে সম্মত হয়ে টেবিল-চেয়ারের মোট দাম (মজুরীসহ) নির্ধারণ করলো ৫০,০০০/- টাকা। খ এক মাসের মধ্যে তা তৈরী করে ততে রাজী হলো। আর ক সরবরাহ নেয়ার এক মাসের মধ্যে দাম পরিশোধ করবে বলে স্থির করা হলো। অতঃপর উভয়ে সম্মত হয়ে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদন করলো। তারা পরস্পর এই শর্ত করলো যে, টেবিল-চেয়ার বুঝে নেয়ার এক মাসের মধ্যে ক্রেতা পুরো দাম পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে বিলম্বিত সময়-কালের জন্য তাকে শতকরা বার্ষিক ১৫/- টাকা হারে অতিরিক্ত দিতে হবে।
এখানে প্রথম চুক্তিটি হচ্ছে ইসতিসনা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। এক্ষেত্রে বিক্রেতা খ-এর দনো হলো টেবিল-চেয়ার যা সে এক মাসের মধ্যে প্রস্তুত করে দিবে এবং ক্রেতা ক এর দেনা হলো নির্ধারিত দাম ৫০,০০০/- টাকা। যদি খ নির্ধারিত এক মাসের মধ্যে আদেশ অনুসারে প্রস্তুতকৃত টেবিল সরবরাহ করে এবং ক সরবরাহ গ্রহণের পর থেকে এক মাসের মধ্যে দাম পরিশোধ করে তাহলে তাদের পরস্পরের দেনা-পাওনা চুকে যাবে এবং লেনদেন সমাপ্ত হবে।
কিন্তু দ্বিতীয় চুক্তিটি হচ্ছে দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে কৃত রিবা চুক্তি। ক্রেতা যদি সরবরাহ নেয়ার এক মাসের মধ্যে তার দেনা শোধে ব্যর্থ হয় তাহলে বিলম্বিত সময়ের জন্য মূল্যের ওপর শতকরা বার্ষিক ১৫ টাকা হারে প্রদত্ত সাকুল্য অতিরিক্ত হবে বিনিময়হীন আর এজন্য রিবা।
মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ে (সরফ) রিবা
ভিন্ন ভিন্ন জাতের মুদ্রা, যেমন বাংলাদেশী টাকার বিনিময়ে আমেরিকার ডলার, সৌদী রিয়েলের বিনিময়ে যুক্তরাজ্যের পাউন্ট স্টারলিং ইত্যাদি বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ ও গারার থাকার আশঙ্কা করেই সম্মানিত ফক্বীহগণ এরূপ ক্রয়-বিক্রয় নগদে নগদে (on the spot) করার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু ইতোপূর্বে ক্রয়-বিক্রয় আলোচনায় আধুনিক গবেষক হাশিক কামালির অভিমত তুলে ধরে দেখানো হয়েছে যে, রিবা ও গারারমুক্ত হলে ভিন্ন ভিন্ন জাতের মুদ্রার বাকি ক্রয়-বিক্রয় করা বৈধ। ভিন্ন ভিন্ন জাতের মুদ্রা বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে কিভাবে রিবা হয় সে বিষয়টি জানা থাকা দরকার।
ক্রয়-বিক্রয়ের দুটি মুদ্রা ভিন্ন ভিন্ন জাতের হলে সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসারে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে এদের বিনিময় রেশিও বা কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণ করতে হবে। অতঃপর কোন একটি কাউন্টার ভ্যালু প্রদান নির্ধারিত মেয়াদের জন্য স্থগিত রাখা হলে তা হবে বাকি ক্রয়-বিক্রয় যা অবৈধ হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মত হয়ে স্থগিতকৃত কাউন্টার ভ্যালুর ওপর বিলম্বিত সময়ের ভিত্তিতে যদি অতিরিক্ত ধার্য ও লেনদেন করে তাহলে সেই অতিরিক্ত হবে একতরফা ও বিনিময়হীন লেনদেন; সুতরাং রিবা যা হারাম।
ইজারাহ ও রিবাঃ ইজারাহ মূলতঃ দুই প্রকার। এক প্রকার হচ্ছে মানুষ (human beings) ও পশুর (animals) শ্রম বা ব্যবহার বিক্রি করা; শরয়ী পরিভাষায় এক বলা ইজারাহ আল-জিম্মাহ; আর এক প্রকার হচ্ছে নন-ফানজিবল পণ্য বা সস্পদ-সম্পত্তির সেবা (service) (usufruct) বিক্রি করা; শরীয়তের ভাষায় একে বলা হয় ইজারাহ আল-আইন; ইংরেজীতে ‘leasing’ ও বাংলায় ‘ভাড়া’ হচ্ছে এর প্রতিশব্দ। কোন নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্ধারিত মজুরী বা বেতনের বিনিময়ে শ্রমিক ভাড়া করা, অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে, চিকিৎসার জন্য ডাক্তর মামলার জন্য উকিল, শিক্ষার জন্য শিক্ষক ইত্যাদি ভাড়া করা অথবা বিশেষ কোন কাজের জন্য কোন পশু ভাড়া করা হচ্ছে ইজারা আল-জিম্মাহর উদাহরণ। আর জমি, গাড়ী, বাড়ী, মেশিন, যন্ত্রপাতি, পোশাক ইত্যাদি ভাড়া করা হচ্ছে ইজারাহ আল-আইন। বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল ইত্যাদি সার্ভিস বিক্রি করা হচ্ছে ইজারাহ আল-আইনের অন্তর্ভূক্ত।
মোটকথা, ভাড়াদাতা ও ভাড়াগ্রহীতার পারস্পরিক সম্মতিতে নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে কোন মানুষ, পশু বা সম্পদ সুনির্দিষ্ট কাজে ব্যবহারের জন্য কাউকে প্রদান করা হলে তাকে বলা হয় ইজারহ। এখানে ভাড়া ও ব্যবহার হচ্ছে একে অপরের কাউন্টার ভ্যালু। কিন্তু যথাসময়ে ভাড়া পরিশোধে ব্যর্থ হলে এবং বিলম্বিত সময়ের জন্য ভাড়ার ওপর কোন অতিরিক্ত ধার্য করা হলে সেই অতিরিক্ত হয় কাউন্টার ভ্যালুহীন অতিরিক্ত বা রিবা।
উদাহরণস্বরূপ, বাড়ীর মালিক ক এবং ভাড়াটিয়া খ পারস্পরিক সম্মতিতে মাসিক ২০,০০০/- টাকা ভাড়া ধার্য করে প্রতি পরবর্তী মাসের ১ তারিখে ভাড়া পরিশোধের শর্তে বাড়ীতে বসবাস করার উদ্দেশ্যে ক খ-এর কাছে তার বাড়ী ভাড়া দিল। তারা আরও শর্ত করলো যে, ভাড়া কার্যকর হওয়ার দিন থেকে প্রত্যেক মাসের ১ তারিখে পূর্ববর্তী মাসের ভাড়া পরিশোধ না করলে বিলম্বিত প্রতি দিনের জন্য খ ভাড়ার ওপর ১% অতিরিক্ত পরিশোধে বাধ্য থাকবে। এখানে প্রথম চুক্তিটি হচ্ছে পরস্পর কাউন্টার ভ্যালুর বিনিময় তথা ইজারাহ বা বাড়ীর সেবা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। এই চুক্তিটি বৈধ। কিন্তু দ্বিতীয় চুক্তিটি হচ্ছে রিবা চুক্তি বা ভাড়াটিয়া খ-এর সম্পদ বিনামূল্যে হস্তগত করার অবৈধ চুক্তি।
অনুরূপভাবে পারস্পরিক সম্মতিতে নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল বা ইন্টারনেটের ব্যবহার হচ্ছে ইজারাহ চুক্তি। কিন্তু ভাড়া বিলম্বে পরিশোধের কারণে মূল্যের ওপরে আবার জরিমানা, সুদ ইত্যাদি নামে কোন অতিরিক্ত ধার্য ও আদায় করা হলে সেই অতিরিক্ত লেনদেন হবে কাউন্টার ভ্যালুহীন বাড়তি বা রিবা।
ফিউচার্স, অপশনস ক্রয়–বিক্রয় ও রিবাঃ ফিউচার্স ও অপশনস ক্রয়-বিক্রয় সাম্প্রতিক কালের উদ্ভাবন। বর্তমানে ফিউচার্স ও অপশনস ব্যাপকভাবে লেনদেন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এরকম অনেক ধরন চালু করা হয়েছে। ফিউচার্স ও অপশনস কাকে বলে, এর মোডাস অপারেন্ডি (Modus Operandi) কি এবং এতে রিবা কিভাবে উদ্ভূত হয়, এসব বিষয়ে ইনশাআল্লাহ পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
নগদ ক্রয়–বিক্রয়ে রিবা
আল-কুরআনের পরিভাষায় নগদ ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ‘তেজারাতান হাজিরাতান’; অর্থাৎ উপস্থিত ক্রয়-বিক্রয়; ইংরেজীতে একে বলা হয় spot exchange বা cash transaction. এ ক্ষেত্রে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি এবং পণ্য লেনদেনের মাঝে কোন সময় থাকে না। তাছাড়া কাউন্টার ভ্যালু নেওয়া ও দেওয়ার মাঝেও সময় থাকে অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে কোন বিলম্ব না করে ক্রেতা-বিক্রেতা তাদের নিজ নিজ পণ্য সেবা বা অর্থ পরস্পর হস্তান্তর করে। এক কথায় এখানে চুক্তি ও উভয় পক্ষের পারস্পরিক হস্তান্তরের কাজ একই বৈঠকে সম্পন্ন করে ক্রয়-বিক্রয় সমাপ্ত করা হয়। এজন্য এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় লিখে নেওয়া বা এর দলীল দস্তাবেজ তৈরী করার প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে এরূপ ক্রয়-বিক্রয় লিখে নেওয়ার দায়িত্ব থেকে রেহাই দিয়েছেন। (আল-কুরআনঃ ২:২৮২) নগদ ক্রয়-বিক্রয় দুই রকম হতে পারেঃ সমজাতের বস্তু নগদ ক্রয়-বিক্রয় এবং অসম জাতের বস্তু নগদ ক্রয়-বিক্রয়।
সমজাতের বস্তু নগদ ক্রয়–বিক্রয়ে রিবাঃ প্রথমত, এক জাতের পণ্য, সেবা ও অর্থ নগদ বিনিময়ে এদের মানগত সমতার বিধি লংঘন করা হলে এদের মূল্যে অবশ্যই পার্থক্য সৃষ্টি হবে। মনে করা যাক, একজন ক্রেতা ২৪ ক্যারেটের ১ তোলা সোনা বিক্রেতাকে দিল; আর বিক্রেতা ২০ ক্যারটের ১ তোলা সোনা ক্রেতাকে তাৎক্ষণিক হস্তান্তর করল। এখানে পরিমাণে (ওজন) সমান সমান হওয়া সত্ত্বেও মানগত পার্থক্যের দরুন উভয় সোনার দাম সমান নয়। ফলে উভয় সোনার দামের ব্যবধানটাই হচ্ছে রিবা। কিন্তু পূর্বেই বলা হয়েছে যে, একই জাতের দুটি পণ্যের পরস্পর সরাসরি বিনিময় হয় বলে এদের দামের পার্থক্য জানা যায় না। সেজন্য এখানে রিবা কি পরিমাণ তা বলাও সম্ভব নয়। আর একারণেই উভয় পণ্যের মানগত পার্থক্য উল্লেখযোগ্য হলে, সেক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এদের সারাসরি বিনিময় করতে নিষেধ করেছেন এবং ভিন্নতর কোন পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে খারাপ পণ্য (খেজুর) বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ পণ্য বা অর্থ দ্বারা উন্নত মানের পণ্য (খেজুর) ক্রয় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, একই জাতের দুটি পণ্যের মধ্যে বিদ্যমান মানগত পার্থক্যকে বিবেচনায় নিয়ে এদের বিনিময় রেশিওতে কম-বেশি করা হলেও এতে রিবা হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। যেমন দুই সা’ খারাপ খেজুরের বদলে ১ সা’ উন্নত মানের খেজুরের সরাসরি বিনিময়ে উভয় খেজুরের দাম সমান হয়েছে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সুতরাং সম্মানিত ফক্বীহগণ সকলেই এই বর্ধিত ১ সা’ খারাপ খেজুরকে রিবা বলেছেন। হাদীসে বলা হয়েছে, “এতো রিবার মতই, এতো রিবাই”।
তৃতীয়ত, একজাতের দুটি পণ্যের মান এক রকম হওয়া সত্ত্বেও যদি এদের পরিমাণে কম-বেশি করা হয় যেমন, ১ কেজি লেংড়া আমের বিনিময়ে ১.৫০ কেজি লেংড়া আমের ক্রয়-বিক্রয় হলে ১ কেজি আমের দাম হবে ১ কেজি আম। এটাই পারস্পরের কাউন্টার ভ্যালু। এদের পারস্পরিক বিনিময় হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। অতঃপর এক পক্ষ তার প্রদত্ত কাউন্টার ভ্যালুর ওপরে .৫০ কেজি বেশি দিয়েছে; এর কোন বিনিময় বা কাউন্টার ভ্যালু সে পায় নাই। অপরপক্ষে গ্রহীতা তার প্রদত্ত ১ কেজি আমের বিনিময়ে প্রাপ্য কাউন্টার ভ্যালুর ওপর .৫০ কেজি আম বেশি নিয়েছে যার কোন কাউন্টার ভ্যালু সে দেয় নাই; এটি রিবা চুক্তি। এখানেও দুটো চুক্তি কার্যকর রয়েছে।
অসমজাতের বস্তু নগদ ক্রয়–বিক্রয়ে রিবাঃ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেছেন, অসমজাতের পণ্য, অর্থ বা সেবা নগদ ক্রয়-বিক্রয় করার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু ইতোপূর্বে সুন্নাহর দৃষ্টিতে সুদ শিরোনামে প্রতারণা, সুপারিশ, ঈজাব, নাজিশ ইত্যাদি বিষয়ে উদ্ধৃত হাদীস কয়টি থেকে জানা যায় যে, ভিন্ন ভিন্ন জাতের বস্তু নগদ ক্রয়-বিক্রয়েও রিবা উদ্ভূত হতে পারে। নিচে আলোচনা করা হলোঃ
প্রতারণাঃ কেউ যদি প্রতারণা করে দাম বেশি নেয়, তাহলে সেই বর্ধিত অংশটুকু তার জন্য রিবা। উদাহরণস্বরূপ, মনে করা যাক একজন ক্রেতা একটি জিনিসেরে দাম বললো ১০০/- টাকা এবং জানিয়ে দিল এর বেশি সে দেবে না। এ অবস্থায় বিক্রেতা মিথ্যা কথা বললো যে তার কেনা দাম আছে ১০৫/- টাকা; অতএব ক্রেতা যদি আর ৫/- টাকা দেয়, তাহলে অন্তত আসল দামে জিনিসটি তাকে দিতে পারে। ক্রেতা অগত্যা ১০৫/- টাকা দিয়ে জিনিসটি ক্রয় করলো। উদাহরণে এটা স্পষ্ট যে, ১০০/- টাকা হচ্ছে জিনিসটির দাম; অতঃপর বর্ধিত ৫/- হচ্ছে মিথ্যা কথার দাম। বিক্রেতার জন্য এই ৫/- টাকা হচ্ছে রিবা।
অনুরূপভাবে বাজার দর সম্পর্কে ধারণা নেই এমন কোন লোকের কাছ থেকে কোন পণ্য ক্রয়কালে তার অজ্ঞতার সুযোগে যদি দাম কম দিয়ে তাকে ঠকানো হয় তা হলে প্রদত্ত সেই দামে বাজার দর অনুসারে যে পরিমাণ পণ্য হয় তার ওপরে পণ্যের বর্ধিতাংশ হবে কাউন্টার ভ্যালুর ওপর বিনিময়হীন বৃদ্ধি বা রিবা।
একইভাবে নাজাশ করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়াও এক ধরনের প্রতারণা। নাজিশ ক্রয় করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পণ্যের দাম করে যাতে প্রকৃত ক্রেতা উক্ত প্রস্তাবিত দামের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে ক্রয় করতে বাধ্য হয়। এভাবে নাজিশ কর্তৃক মিথ্যা দরদামের মাধ্যমে বর্ধিত দামটুকু হয় প্রকৃত দামের ওপার বিনিময়হীন বৃদ্ধি; সুতরাং রিবা।
সুপারিশঃ সুপারিশের বিনিময়ে উপহার/উপঢৌকন গ্রহণ করলে সেই উপহার/উপঢৌকন হয় বিনিময়হীন। আর বিনিময়হীন হলেই তা হয় রিবা।
ঈজাবঃ পাকার পূর্বে ফল বিক্রি করা হলে, অপরিপক্বতার দরুন সে ফল ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আর যদি তা হয় তাহলে ফলের বিনিময়ে গৃহীত দাম বিনিময়হীন রিবা পর্যবসিত হবে।
প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ভিন্ন ভিন্ন জাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা কর্তৃক পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণকালে ধোকা, প্রতারণা, জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে কোন পক্ষের প্রকৃত দামে হ্রাস-বৃদ্ধি করা হলে দামের ওপর বর্ধিত অংশ হয় রিবা।
উপরে বিভিন্ন প্রকার ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সাথে কিভাবে রিবা চুক্তি করা হয় এবং তার ফলে কিভাবে রিবা উদ্ভূত হয় তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ক্রয়-বিক্রয়ে কোন একটি কাউন্টার ভ্যালুর ওপর অতিরিক্ত ধার্য করা হলে এবং এই অতিরিক্তের বিনিময় বা কাউন্টার ভ্যালু দেওয়া না হলে সেই বিনিময়হীন অতিরিক্ত হচ্ছে রিবা বা সুদ।
এক নজরে ক্রয়–বিক্রয়, ভাড়া মুনাফা ও সুদের তুলনা
ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, মুনাফা ও সুদ সম্পর্কে আলোচনার পর এখানে এগুলোর মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত তুলনা পেশ করা হলোঃ
ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, মুনাফা ও সুদের সংক্ষিপ্ত তুলনা
বিষয় | ক্রয়–বিক্রয় | ভাড়া | মুনাফা | সুদ | ||
১) উৎস | ক্রয়-বিক্রয়ের উৎস বৈধ চুক্তি। | ভাড়ার উৎস উৎপাদন। | মুনাফার উৎস উৎপাদন। | সুদের উৎস অবৈধ চুক্তি। | ||
২) প্রয়োগ ক্ষেত্র | সকল বৈধ পণ্য, মুদ্রা ও সেবা। | সকল নন-ফানজিবল পণ্য, মানুষ ও পশুর সেবা। | সকল বৈধ উৎপাদন কাজ তথা কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উৎপাদন। | সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয়েই সুদের চুক্তি করা যায়। | ||
৩) ধরন | সমান সমান মূল্যের বিনিময়। | সমান সমান মূল্যের বিনিময়। | ক্রয়-বিক্রয়ে নির্ধারিত কাউন্টার ভ্যালুর অন্তর্ভূক্ত। | ক্রয়-বিক্রয়ে একদিকের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর ধার্য করা হয়। | ||
৪) মূল্য বা বিনিময় | বিনিময় দিয়ে পণ্য বা মুদ্রা নেওয়া হয় তথা বিনিময় আছে। | বিনিময় দিয়ে সেবা নেওয়া হয় তথা বিনিময় আছে। | বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত বা সংযোজিত উপযোগ হচ্ছে মুনাফার কাউন্টার ভ্যালু। | বিনিময় না দিয়ে নেওয়া হয়; কাউন্টার ভ্যালু বা বিনিময় নেই। | ||
৫) লেনদেন | লেনদেন পারস্পরিক। | লেনদেন পারস্পরিক। | লেনদেন পরস্পরিক। | লেনদেন পারস্পরিক। একতরফা দেওয়া ও একতরফা নেওয়া হয়। | ||
৬) নির্ধারণ | কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারিত হওয়া আবশ্যকীয়। | কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারিত হওয়া আবশ্যকীয়। | নির্ধারিত কাউন্টার ভ্যালুতে লাভ থাকতেও পারে নাও থাকতে পারে; মুনাফা অনিশ্চিত। | পূর্ননির্ধারিত ও নিশ্চত। | ||
৭) ঝুঁকি | ঝুঁকিপূর্ণ। | ঝুঁকিপূর্ণ। | ঝুঁকিপূর্ণ। | ঝুঁকি নেই। | ||
৮) পরিণতি | পূর্ণ ইনসাফ বহাল থাকে; ক্রেতা-বিক্রেতার কেউ ঠকে না, কেউ জিতে না। | পূর্ণ ইনসাফ বহাল থাকে; ক্রেতা-বিক্রেতার কেউ ঠকে না, কেউ জিতে না। | পূর্ণ ইনসাফ বহাল থাকে; ক্রেতা-বিক্রেতার কেউ ঠকে না, কেউ জিতে না। | বেইনসাফী কায়েম হয়। এক পক্ষের ক্ষতির বিনিময়ে অপর পক্ষ লাভবান হয়। | ||
৯) গুরুত্ব | মানব সামজের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। | মানব সামজের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। | জীবিকার উৎস, অর্থনীতির চালিকাশক্তি, অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। | মানব সমাজের জন্য অকল্যাণ ও ধ্বংসের বাহন। | ||
১০) বৈধতা | বৈধ বা হালাল | বৈধ বা হালাল | বৈধ বা হালাল | অবৈধ বা হারাম। | ||
তুলনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, ক্রয়-বিক্রয়ে বিনিময় দিয়ে নেওয়া হয় এজন্য ক্রয়-বিক্রয় হালাল; মুনাফা বিনিময় মূল্যের অংশ-মুনাফার বিনিময় আছে এজন্য মুনাফা হালাল। সুদ বিনময় না দিয়ে নেওয়া হয় এজন্য সুদ হারাম।