দ্বিতীয় অধ্যায়: সুন্নাহর দৃষ্টিতে ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ
ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ সংক্রান্ত হাদীসের শ্রেণী প্রকরণ
সুন্নাহ হচ্ছে আল-কুরআনের ব্যাখ্যা ও বাস্তব রূপ। আল্লাহ তা’য়ালা কুরাআন মজীদে “ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল আর সুদকে হারাম করেছেন”। কিন্তু ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ সংক্রান্ত বিস্তারিত বিধি-বিধান ও ব্যাখ্যা আল-কুরআনে নেই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাদীসে ক্রয়-বিক্রয় ও সুদের বিস্তারিত বিধি-বিধান নির্দেশ করেছেন এবং ক্রয়-বিক্রয় থেকে সুদ কিভাবে উদ্ভুত হয় তা দেখিয়ে দিয়েছেন।
আল-কুরআনে সূরাতূল বাকারাহর ২৮২ আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা দুই প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ের উল্লখ করেছেন। এক প্রকার হচ্ছে, ‘দাইন-দেনা বা বাকি ক্রয়-বিক্রয়; দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, ‘তিজারাতন হাজিরাতান’ বা নগদ-উপস্থিত ক্রয়-বক্রয়। আর আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) হাদীসে দেখা যায় যে, সেখানে প্রধানত দুই ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে। ধরন দু’টি হচ্ছেঃ ১. সমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয় এবং ২. অসম জাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়। উল্লেখ্য যে, কোন কোন ক্ষেত্রে একই হাদীসে উভয় ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান বর্ণরা করা হয়েছে। আবার কোন কোন হাদীসে কেবল এক ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান আনা হয়েছে। কিছু হাদীসে নগদ-বাকির উল্লেখ না করেই ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান দেওয়া হয়েছে। কতিপয় হাদীসে আবার পৃথক পৃথক ভাবে নগদ ও বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের কথা বলা হয়েছে। অতঃপর বেশ কিছু হাদীসে ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান লংঘন করলে তাতে কিভাবে সুদ উদ্ভূত হয় তা দেখানো হয়েছে। কতিপয় হাদীসে সুদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আর কিছু হাদীসে গুনাহ, ইহ-পরকালীন পরিণতি ইত্যাদি বিষয়ে মানবজাতিকে সাবধান ও সতর্ক করা হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে নিম্নরূপে বিভক্ত করে পেশ করা যেতে পারে যদিও এই বিভক্তি চূড়ান্ত বলা যাবে না।*
*এখানে হাদীসগুলোর কেবল বাংলা তরজমা পেশ করা হলোঃ ক্রয়-বিক্রয় ও রিবা সংক্রান্ত হাদীসসমূহে ব্যবহৃত কয়েকটি পরিভাষার অর্থ নিয়ে অনুবাদকদের মধ্যে মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছেঃ ‘মিসলান বিমিসলিন’। কখনও এর অর্থ করা হয়েছে পণ্যের জাতগত মিল, কখনও বস্তূর পরিমানগত সমতা, কখনও আবার বৈশিষ্ট্যে এক রকম। এই আলোচনায় মিসলান বিমিসলিনকে বৈশিষ্ট্য বা মানে সমান সমান আর্থে গ্রহণ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় শব্দটি হচ্ছে, ‘সাওয়ায়িন’ : কোথাও কোথাও এর অর্থ লিখা হয়েছে বৈশিষ্ট্যে সমান সমান করা, তবে অধিকাংশ অনুবাদক এর অর্থ করেছেন, “পরিমাণে সমান সমান”। এখানে এই শেষোক্ত অর্থটি নেওয়া হয়েছে।
১. ক্রয়-বিক্রয় সংকক্রান্ত হাদীস
ক) এক সাথে সম ও অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
খ) সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত
১. সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই);
২. সমজাতের ভিন্ন ভিন্ন মানের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় (নগদ-বাকি উল্লখ নেই):
৩. সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয়।
গ) অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত
১. অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই);
২. অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয়;
২. সুদ সংক্রান্ত হাদীস
ক) এক সাথে সম ও অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ সংক্রান্ত (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
খ) সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ সংক্রান্ত
১. সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
২. সমজাতের ভিন্ন ভিন্ন মানের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ (নগদ বাকি উল্লখ নেই)
৩. সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ
[তৃতীয় পরিভাষাটি হচ্ছে, ‘ইয়াদান বিইয়াদিন’ ও ‘হা’আ ওয়া হা’আ’। প্রায় সকলেই এর অর্থ করেছন, নগদ হস্তান্তর। কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন উপস্থিত নির্ধারিত বস্তুর সাথে উপস্থিত নির্ধারিত বস্তুর বিনিময়। কেউ আবার এর অর্থ করেছেন, নির্ধারণ ও নিশ্চিত করা। এখানে এর অর্থ করা হয়েছে পারস্পরিক হস্তান্তার বা পারস্পরিক বিনিময়।
হাদীসে ব্যবহৃত আর একটি পারিভাষা হচ্ছে, ‘নাসীয়াহ’। অনুবাদকগণ সাধারণভাবে এর অর্থ করেছেন ঋণ, বাকি বা সময়। কিন্তু পরিভাষা হিসেবে ইয়াদান বিইয়াদিনের বিপরীত অর্থ বুঝানোর জন্যই নাসীয়াহ্ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং ইয়াদান বিইয়াদিন অর্থ পাস্পরিক বিনিময়হীন বা বিনিময় না দিয়ে নেওয়া।
হাদীসে ব্যবহৃত আর একটি পরিভাষা হচ্ছে ‘দায়নান’। এর সাধারণ অর্থ ধারে, বাকিতে। কুরআন মজীদে ‘দাইনিন’ শব্দের পরে আছে “ইলা আজালিম মুসাম্মা” (২:২৮২)। অর্থাৎ দাইন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হয়। মেয়াদ নির্ধারণ ব্যতীত বিক্রয় বৈধ নয়। হাদীসে দায়নান এর পরে মেয়াদ সম্পর্কে কিছু নাই। সুতরাং এর দ্বারা সম্ভবত মেয়াদ নির্ধানণ ছাড়া বাকি বিক্রয় নিষিদ্ধ হওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে।। সেজন্য শব্দটি তরজমায় লিখা হয়েছে (মেয়াদ নির্ধারণ ছাড়া) বাকিতে বিক্রয় করো না। ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়ে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।]
গ) অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ সংক্রান্ত
১. অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
২. অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ
৩. সাধারণ নির্দেশনা সংক্রান্ত হাদীস (সকল ক্রয়-বিক্রয় এ সুদের ক্ষেতে প্রযোজ্য)
৪. সুদের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত হাদীস
৫. সুদের ফলাফল ও পরিণতি সংক্রান্ত হাদীস।
১. ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত হাদীস
ক) এক সাথে সম ও অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত (নগদ বাকি উল্লেখ নেই)
১. উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “সোনা বিনিময়ে সোনা, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ, মানে এক রকম (মিসলান বিমিসলিন like for like), পরিমাণে সমান সমান (সাওয়ান বিসাওয়ায়িন equal for equal), হস্তান্তর পারস্পরিক (ইয়াদান বিইয়াদিন from hand to hand)। অতঃপর যদি জাত ভিন্ন ভিন্ন হয়, তাহলে তোমরা তোমাদের ইচ্ছামত (দামে) বেচতে পার, তবে হস্তান্তর পারস্পরিক (ইয়াদান বিইয়াদিন) হতে হবে”। [মুসলিম ১৫৮৭ (৮১); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪৪, নং ৩৯১৭।]
২. আব্দুর রহমান ইবনে আবূ বাকরাহ (রাঃ) থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, “পরিমাণে সমান সমান (সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন) না হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রূপার বিনিময়ে রূপা এবং স্বর্ণের বিনিমেয়ে স্বর্ণ বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু তিনি স্বর্ণের বিনিময়ে রূপা এবং রূপার বিনিময়ে স্বর্ণ আমরা যেভাবে চাই সেভাবেই ক্রয়-বক্রয় করার অনুমতি দিয়েছেন”। রাবী বলেন, এক ব্যক্তি তাকেঁ (মূল্য পরিশোধের ধরন সম্পর্কে) জিজ্ঞাসা করল। তিনি বললেন, “তা পারস্পরিক হস্তান্তার (ইয়াদান বিইয়াদিন) হতে হবে। আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে এরূপই শুনেছি”।[মুসলিম, ১৫৯০ (৮৮); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪৮, নং. ৩৯২৭ ও সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড পৃ: ৩৫০, ২০২৫।]
হাদীস দু’টিতে সমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ে প্রথমে বস্তু দু’টির মূল্য সমান সমান করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, উভয় বস্তুর-
১. মান এক রকম হতে হবে (Quality must be similar); একেই সংক্ষেপে বলা হয়েছে মিসলান বিমিসলিন (like for like বা এটা যেমন সেটা তেমন।) এবং
২. পরিমাণ সমান হতে হবে (Quality must be equal); সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন (equal for equal)
অতঃপর সেই সমান সমান দু’টি মূল্যের বিনিময় পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে,
৩. বিনিময় পারস্পরিক হতে হবে (Exchange must be reciprocal); ইয়াদান বিইয়াদিন (from hand to hand)
এখানে ক্রয়-বিক্রয় নগদ না বাকি তা বলা হয়নি। অর্থাৎ উপরোক্ত ৩টি বিধান নগদ-বাকি উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাস্তবে দেখা যায়, ১০০ টাকার ১টি নোট নগদ ভাঙ্গাতে দিলে গ্রহীতাকে ১০০ টাকাই ফেরত দিতে হয়; আর কেউ ১০০/- টাকা নিয়ে যদি ১ বছর পর ফেরত দেয়,তাহলে ১০০/- টাকাই ফেরত দেওয়া বিধেয়। অনুরূপভাবে ১ কেজি গম বা ১ কেজি লবণ বাকি নগদ উভয় ক্ষেত্রেই মান ও পরিমাণ সমান করেই বিনিময় করতে হয়। যদি বলা হয় বিনিময় কেবল নগদ নগদ করতে হবে; কিংবা কেবল নগদের ক্ষেত্রে বস্তু দু’টির মান ও পরিমাণ সমান সমান করতে হবে, তাহেল বাকির ক্ষেত্রে কি মান ও পরিমাণ সমান সমান না করলে চলবে? অথবা বাকি ক্রয়-বিক্রয় কি নিষিদ্ধ? এসব প্রশ্নের যুক্তিসংগত কোন উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।
হাদীসের শেষাংশে ভিন্ন ভিন্ন জাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বলা হয়েছে, “তোমরা ইচ্ছামত বেচতে পার”। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা পারস্পরিক স্বেচ্ছা সম্মতিতে ব্যবসা কর” (৪:২২)। আর অন্য এক হাদীসে (হাদীস নং ২৪) বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই ক্রয়-বিক্রয় করবে সেই দামই বৈধ গণ্য হবে; পারস্পরিক সম্মতিতে নির্ধারিত যে কোন দামই বৈধ। সুতরাং এখানে বিধান হচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন জাতের বস্তুর ক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বেচ্ছা সম্মতিতে দাম নির্ধারণ করতে হবে। অতঃপর বস্তু দু’টির বিনিময় অব্শ্যই পারস্পরিক হতে হবে, যা নগদ হতে পারে; আবার আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক (২:২৮) নির্ধারিত মেয়াদের জন্য বাকিতেও হতে পারে।
ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।
খ) সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত
i. সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
৩. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্য ওজনে সমান সমান, বৈশিষ্ট্যে এক ও পরিমাণে সমান সমান হওয়া ব্যতীত (ইল্লা ওয়াযনান বিওয়াযনিন, মিসলান বিমিসলিন, সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন) বেচা-কেনা করো না”। [মুসলিম, ১৫৮৪ (৭৭) ও সহীহ মুসলিম, খণ্ড, পৃ. ৩৪০, নং ৩৯১১।]
৪. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, মানে সমান (like for like) না হলে বিক্রি করো না এবং একদিকে অপরদিক অপেক্ষা বেশি করো না। আর রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য মানে সমান সমান (like for like) না হলে বিক্রি করো না এবং একদিকে অপরদিক অপেক্ষা বেশি করো না এবং যা নেই তার সাথে যা আছে তা বিক্রি করো না। [মুসলিম, ১৫৮৪ (৭৫); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৮, নং ৩৯০৮]।[বুখারী, কিতাবুল বূয়ো, তিরমিযী, নাসাঈ, মসিনাদে আহমদ, উদ্ধৃত, চাপরা, এম, উমর, Towards a Just Monetary System. The Islamic Foundation, U.K 1985, পৃ. ২৩৮।]
৫. নাফে থেকে বর্ণিত,…………আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) নিজের দুই আঙ্গুল দিয়ে নিজের দুই চোখ ও দুই কানের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, আমার দুই চক্ষু দেখেছে এবং দুই কান শুনেছে যে, রাসূলল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মানে সমান সমান (মিসলান বিমিসলিন) না হলে তোমরা স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বেচা-কেনা করো না। আর একদিক অপরদিক অপেক্ষা বেশি হলেও বেচা-কেনা করো না। এগুলোর মধ্যে যা নেই তার বিনিময়ে যা আছে তা বিক্রি করো না যদি বিনিময় পারস্পরিক না হয়”। [মুসলিম, ১৫৮৪ (৭৬) ও সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৯, নং ৩৯০৯।]
৬. আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, দীনারের বিনিময়ে দীনার কোন দিকে বেশি করো না”।[মুসলিম, ১৫৮৮ (৮৪); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৬, নং ৩৯২৩।]
৭. উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “ রাসুলূল্লাহ (সাঃ) বলেন, তোমনা এক দীনারেরর বিনিময়ে দুই দীনার এবং এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম বিক্রি করো না”। [মুসলিম, ১৫৫৮ (৭৮) এ সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪০. নং ৩৯১২।]
৮. “ফাদালা ইবনে উবনে উবাইদ আনসারী (রাঃ) বলেন, “খাইবারে অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে মুক্তা ও স্বর্ণ খচিত একটি হার আনা হলো। এটা গনীমতের মাল ছিল এবং তা বিক্রির জন্য রাখা হলো”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুনরায় তাদেঁর বললেন, “স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ সমান সমান ওজনে (ওয়াযনান বিওয়াযনিন) বিক্রি করতে হবে”।[মুসলিম, ১৫৯১ (৮৯) ও সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪৯, নং ৩৯২৯।]
৯. ফায়দা ইবনে উবাইদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “খাইবার বিজয়ের দিন আমি বারো দীনারে একটি হার খরিদ করলাম। এটা সোনার তৈরী ছিল এবং তাতে মুক্তা বসানো ছিল। আমি এর সোনা ও মুক্তা পৃথক করলাম এবং বারো দীনারের অধিক (সোনা) পেলাম। আমি এটা নবী (সাঃ) কাছে উল্লেখ করলাম”। তিনি বললেন, “পৃথক না করা পর্যন্ত তা বিক্রি করা যাবে না”।[মুসলিম, ১৫৯১ (৯০); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪৯, নং ৩৯৩০।]
১০. হানাশ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমরা ফাদালাহ ইবনে উবাইদের সঙ্গে এক যুদ্ধাভিযানে ছিলাম। আমার ও আমাদের সঙ্গীর ভাগে সোনা, রূপা ও মুক্তার সমন্বয়ে তৈরী একটি হার পড়ল। আমি তা বিক্রি করতে মনস্থ করলাম। আমি ফাদলা ইবনে উবাইদ (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তা থেকে সোনা পৃথক করে এক পাল্লায় রাখ এবং তোমরা সোনা অপর পাল্লায় রাখ। অতঃপর তুমি মানে সমান সমান ব্যতীত (ইল্লা মিসলান বিনিসলিন) গ্রহণ করো না। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন (স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য) মানে সমান সমান করা ব্যতীত ((ইল্লা মিসলান বিনিসলিন) গ্রহণ করো না”। [মুসলিম, ১৫৯১ (৯২) ও সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫০-১, নং ৩৯৩৩।]
১১. ফাদালা ইবনে উবাইদ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “খাইবারের দিন আমরা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাথে ছিলাম। আমরা ইহুদীদের সাথে এক উকিয়া স্বর্ণ (চল্লিশ দিরহামের সমান) তিন দীনারের বিনিময়ে কেনা-বেচা করতাম”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তোমরা সমান সমান ওজন ছাড়া (ইল্লা ওয়াযানান বিওয়াযনিন) স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করো না”। [মুসলিম, ১৫৯১ (৯১) ও সহীহি মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫০, নং ৩৯৩২।]
১২. আবু যুবাইর বলেন, “আমি যাবির ইবনে আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্তূপীকৃত খেজুর, যার পরিমাণ জানা নেই, নির্দিষ্ট পরিমাণ খেজুরের বিনিময়ে বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন”। [মুসলিম, ১৫৩০ (৪২) ও সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ২৫৫, নং ৩৭০৮।]
উপরোক্ত ৩-১২ নম্বর হাদীসে তথা সোনার বদলে সোনা, রূপার বিনিময়ে রূপা, দীনারের বিনিময়ে দীনার এবং দিরহামের বিনিময়ে ইত্যাদি সমজাতের দু’টি বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে উভয় বস্তুর মান এক রকম, পরিমান সমান সমান এবং বিনিময় পারস্পরিক না হলে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করা হয়েছে। ৫ নং হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, অনুপস্থিত বস্তুর বিনিময়ে উপস্থিত বস্তু বিক্রি করা যাবে না যদি এদের পারস্পরিক বিনিময় করা না হয় অর্থাৎ বিনিময় পারস্পরিক হলে তা বৈধ হবে।
ii. সমজাতের ভিন্ন ভিন্ন মানের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
১৩. মুহাম্মদ ইসহাক ইয়াযীদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে কাসিত হতে বর্ণিত। তিনি উবাদা ইবনে সামিত হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের নিষেধ করেছেন স্বর্ণচূর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যচূর্ণের বিনিময়ে রৌপ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে। তিনি আমাদের রূপার বিনিময়ে স্বর্ণচূর্ণ এবং সোনার বিনিময়ে রৌপ্যচূর্ণ ক্রয় করতে বলেছেন”।(হাদীস)[উদ্ধৃত, বাদাবী, যাকি আল-দ্বীন; Theory of Prohidited Riba, ইংরেজী অনুবাদ; ইমরান অহসান খান, ডিসেম্বর, ২০০০, [email protected], পৃ. ৯৬।]
১৪. আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জীবদ্দশায় বিভিন্ন প্রকার খেজুর মিশিয়ে আমাদের খেতে দেওয়া হতো। আমরা এক সা’ উন্নত মানের খেজুরের বিনিময়ে আমাদের নিম্ন মানের খেজুর দুই সা’ বিক্রি করতাম। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি ঘোষণা করলেন, এক সা’ খেজুরের বিনিময়ে দুই সা’ খেজুর, এক সা’ গমের বিনিময়ে দুই সা’ গম এবং দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম আদান-প্রদান করা যাবে না”।[মুসলিম, ১৫৯৫ (৯৮); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৪, নং ৩৯৩৯ ও সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৩১১, নং ১৯৩৫।]
১৫. আমার [বিলাল (রাঃ)] কাছে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জমাকৃত এক মুদ্দ খেজুর ছিল। আমি দেখলাম, উন্নত মানের এক সা’ খেজুর নিম্ন মানের দুই সা’ খেজুরের বিনিময়ে বিক্রয় করা হচ্ছে। আমি তা (উন্নত মানের) ক্রয় করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “বিলাল, তুমি এ খেজুর কোথায় পেলে? আমি বললাম, আমি দুই সা’র বিনিময়ে এক সা’ ক্রয় করেছি”। তিনি বললেন, “এ খেজুর ফেরত দাও এবং আমাদের খেজুর ফেরত নিয়ে আস”।(হাদীস)[সুহাইল, পৃ. ৫৫, সুনান আল-দারিমি সূত্রে।]
১৬. আবূ হুরায়রা ও আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনী আদী আল-আনসারী গোত্রের এক ব্যক্তিকে রাজস্ব আদায়ের জন্য খাইবার এলাকায় পাঠালেন। সে সেখান থেকে উন্নত মানের খেজুর নিয়ে ফিরে আসল”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “খাইবারের সব খেজুরই কি এরূপ?” সে বললো, “না, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা বিভিন্ন প্রকারের দুই সা’ নিম্ন মানের খেজুরের বিনিময়ে এক সা’ উন্নত মানের খেজুর ক্রয় করেছি”। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তা করো না, বরং মানে সমান সমান (মিসলান বিমিসলিন) হতে হবে। অথবা তোমার খারাপ খেজুর বিক্রি করে তার মূল্য দিয়ে উত্তম খেজুর খরিদ করবে। এভাবেই পরিমাপ (পূর্ণ হবে)।[মুসলিম, ১৫৯৩ (৯৪) এ সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫২, নং ৩৯৩৫।]
১৭. আবূ সাঈদ খুদরী ও আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক ব্যক্তিকে খাইবার এলাকায় (রাজস্ব বিভাগে) কর্মচারী নিযুক্ত করেন। সে ওখান থেকে উত্তম খেজুর নিয়ে ফিরে আসে”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “খাইবারের সব খেজুরই কি এরূপ (উত্তম)?” সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর শপথ! (খাইবারের সব খেজুরই) এরূপ নয়। বরং আমরা দুই সা’ (খারাপ) খেজুরের বিনিময়ে এরকমের এক সা’ এবং তিন সা’র বিনিময়ে দুই সা’ নিয়েছি। “রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “এরকম কাজ আর করবে না। বরং খারাপ খেজুর নগদ মূল্যে (দিরহামের বিনিময়ে) বিক্রি করে দাও। অতঃপর প্রাপ্ত দিরহাম দিয়ে উত্তম খেজুর খরিদ কর”। [মুসলিম, ১৫৯২ (৯৫) ও সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৩, নং ৩৯৩৬।]
১৮. ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর আমলে একটি উট জবেহ করা হলো এবং এর গোশত দশ ভাগে ভাগ করা হলো”। এক ব্যক্তি বললো, “আমার বকরীর বিনিময়ে একটি অংশ আমাকে দিন”। আবু বকর বললেন, “এটা সঠিক নয়”।[ইবনুল কায়্যিম, ই’লাম আল মুয়াক্কিয়িন, ভলি-১, পৃ. ৩০৬; উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোল্লেখিত, পৃ. ১৬০।]
১৯. সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পশুর গোশতের বিনিময়ে পশু বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন”।[মালিক, আল-মুয়াত্তা, ভলি-৩, পৃ. ৯২১, উদ্ধৃত, বাদাবী, উপরোক্ত, পৃ. ১৬০।](হাদীস)
২০. নাফে (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) তাকেঁ অবহিত করেছেন, “নবী (সাঃ) মুযাবানা পদ্ধতির লেনদের নিষিদ্ধ করেছেন”। মুযাবানা হচ্ছে এই যে, অনুমানে পরিমাণ নির্ধারণ করে শুকনো খেজুরের বিনিময়ে তাজা খেজুর (যা এখনও কাটা হয়নি) বিক্রি করা, শুকনো আঙ্গুর বা কিশমিশের বিনিময়ে তাজা আঙ্গুর (গাছে অবস্থিত) ক্রয়-বিক্রয় করা এবং গমের বিনিময়ে ক্ষেতের ফসল (গম) বিক্র করা। [মুসলিম, ২৫৪২ (৭৩) ও সহীহ মুসীলম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ২৭২, নং ৩৭৫০।]
২১. জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, “রাসূলল্লাহ (সাঃ) নিষেধ করেছেন মুহাকালা, মুযাবানা, মুখাবান ও মুআওয়ামা হতে”।[মুসলিম, ১৫৩৬ (৮৫)।]
(মুহাকালা ও মুযাবানা উভয়টি একই শ্রেণীর ক্রয়-বিক্রয়। সাধারণ শস্যের ক্ষেত্রে বলা হয় মুহাকালা; খেজুর ও আঙ্গুরের বেলায় এক বলা হয় মুযাবানা। মুখাবারা হচ্ছে জমি বর্গা [উল্লেখ্য যে, বর্গা চাষ সকল ইমামের মতে জায়েয। (মিশকাত)] দেওয়া আর মুআওয়ামা হচ্ছে নির্দিষ্ট বৃক্ষ বা বাগানের ফল দুই দিন বছরের জন্য অগ্রিম বিক্রি করা।)
উপরোক্ত ১৩-২১ নং হাদীসে বলা হয়েছে, সমজাতীয় দু’টি বস্তুর মান অবশ্যই সমান সমান হতে হবে (১৬ নং হাদীস) অন্যথায় খারাপটি তৃতীয় কোন বস্ত বা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে (হাদীস নং ১৬-১৭) প্রাপ্ত মূল্য দিয়ে উত্তম বস্তু ক্রয় করতে হবে যাতে বেচা ও কেনা উভয় ক্ষেত্রেই ভিন্ন জাতের বস্তুর মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় হয়। এরূপ ক্ষেতে উভয় বস্তুর মান ও পরিমাণ সমান সমান করার শর্ত নেই বরং পারস্পরিক সম্মতিতে যে কোন দামে ক্রয়-বিক্রয় করা বৈধ। আর এভাবেই সমজাতের খারাপ ও উত্তম মানসম্পন্ন বস্তু দু’টির যথার্থ প্রাপ্য পরিমাণ পাওয়া সম্ভব হবে (১৬ নং হাদীস)। উক্ত হাদীসসমুহে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, একই জাতের খারাপ ও ভালো মানের দু’টি বস্তুর মানগত তারতম্যকে বিবেচনায় নিয়ে অনুমানের ভিত্তিতে এদের পরিমাণে কম-বেশি করে সরাসরি বিনিময় করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, অবৈধ; এরূপ বাকি নগদ সকল ক্রয়-বিক্রয়ই অবৈধ। সমজাতের উভয় বস্তুর পরিমাণ অনুমানে নির্ধারণ করে বিক্রয় করা যে নিষিদ্ধ তা ১৬ ও ১৭ নং হাদীসে অত্যন্ত স্পষ্ট। ১৩ নম্বর হাদীসে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং স্বর্ণচূর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণচূর্ণ বলার দ্বারা উভয় ক্ষেত্রেই মান এক রকম হতে হবে তা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উবাদা ইবনে সামিতের (রাঃ) একটি উক্তি ইমাম সারাখসী উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে, “Gold metal and dust are the same.” এই উক্তির আলোকে সারাখসী লিখেছেন, “ওজনে সমান হলে স্বর্ণচুর্ণ উভয়টিই সমান হয়ে যায়”। এ মন্তব্য উল্লেখিত হাদীসের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। অথচ হাদীসটি উবাদা ইবনে সামিত থেকেই বর্ণিত।
iii) সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয়
২২. আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি উট ধার করলেন; অতঃপর একটি অধিক বয়সের উট ধারদাতাকে ফেরত দিলেন এবং বললেন’ “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে উত্তম রূপে তার ঋণ পরিশোধ করে”। [মুসলিম, ১৬০১ (১২১)।]
২৩. আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দুই বছর বয়সের একটি উট ধার করে সমবয়সের একটি উট ফেরত দিলেন এবং তার অতিরিক্ত আর একটি উট দিয়ে দিলেন”। (তিনি) বললেন, “তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে ভালভাবে তার ঋণ পরিশোধ করে”।(হাদীস)[সুহাইল, পৃ. ১০৬, জামি আল তিরমিযী, কিতাবুল বুয়ো, ভলি-৬।]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উট ধার নিয়ে তার চেয়ে অধিক বয়সের উট অথবা কোন কোন সময়ে অতিরিক্ত আর একটি উট ফেরত দিয়েছেন। এরূপ করার কারণও তিনি বলে দিয়েছেন।
গ) অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত
i) অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
২৪. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই ক্রয়-বিক্রয় পারস্পরিক স্বেচ্ছা সম্মতির ওপর ভিত্তিশীল”।[ফাতাহুল বারি, ভলি-৪, পৃ. ২৩০।](হাদীস)
২৫. আব্দুল্লাহ বিন উমর থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ক্রয়-বিক্রয় ও ঋণ, এক বিক্রয়ে দুই শর্ত, ঝুঁকি ছাড়া মুনাফা এবং যা নেই তা বিক্রি করা বৈধ নয়”।(হাদীস)[ইবনে কুদামা, আল-মুগনি, ভলি-৪, পৃ. ১৭৬; নূর, ই, এম: Riba versus Prfit Sharing: Theoretical Foundations and Policy Implications: A Dissertation Submitted to International Institute of Islamic University, Islamabad, Pakistan for the award of the Degree of Doctor of Philosophy in Economics, 1999 AD. পৃ. ২৪৪ আবূ দাউদ ও তিরমীযি।]
২৬. আমর ইবনে শোয়াইব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক বিক্রয়ে দুই লেনদেন নিষিদ্ধি করেছেন”।(হাদীস)[শাওকানি, নাইলুল আওতার, ভলি-৫, পৃ, ১৯০; উদ্ধৃত, নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৪।]
২৭. আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এক লেনদেনে দুই বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন”।(হাদীস)[সান-আনি, সুবুস সালাম, ভলি-৩, পৃ. ১৬, নাইলুল আওতার, ভলি-৫, পৃ. ৬, আহমদ; উদ্ধৃত, নূর, ই, এম, উপরোক্ত, পৃ. ২৪৪]
২৮. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত যে, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক ক্রয়-বিক্রয়ে (deal) দুই দাম নিষিদ্ধ করেছেন”। (হাদীস)[নাইলূল আওতার, ভলি-৫, পৃ. ১৬২।]
২৯. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) “সাফকাতাইনি ফিস সাফকতি” (ক্রয়-বিক্রয়ে (deal) দুই দাম নিষিদ্ধ করেছেন”)।(হাদীস)[উদ্ধৃত, নূর,ই, এম উপরোক্ত, পৃ. ২৪৪।]
৩০. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিষেধ করেছেন বাজারের বাইরে গিয়ে পণ্যবাহী কাফেলার সাথে মিলিত হয়ে পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করতে, শহরের অধিবাসীকে গ্রাম্য লোকদের কোন জিনিস বিক্রি করে দিতে, কোন নারীকে তার বোনের (অন্য নারীর) তালাক দাবী করতে, নকল ক্রেতা সেজে আসল ক্রেতাকে ধোঁকা দিতে, পশুর পালনে দুধ জমা করে রেখে (ক্রেতাকে) পালন ফুলিয়ে দেখাতে এবং কোন ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তির দাম-দস্তুর করার ওপর দাম-দস্তুর করতে”।[মুসলিম, ১৫১৫ (১২)।]
৩১. জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ গ্রাম্য লোকের পণ্যদ্রব্য শহরের লোকেরা বিক্রয় করে দেয়ার চাপ দিবে না। লোকদেরকে স্বাভাবিক অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও। কেননা আল্লাহ এক দলের মাধ্যমে অপর দলের বিযিকের ব্যবস্থা করেন”। (সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ২৪৬, নং ৩৬৮৪।)
৩২. ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নাজাশ করতে (খরিদ করার উদ্দেশ্য বতীত অযথা দরদাম করে মূল্য বৃদ্ধি) নিষেধ করেছেন”।[মসলিম, ১৫১৬ (১৩)।]
৩৩. আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “তোমরা পরস্পর ‘নাজাশ’ করো না”। (জামে আত-তিরমযী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৪১৭, নং ১২৪১।)
৩৪. সুয়াইদ ইবনে কায়েস (রাঃ) হাজার নামক স্থান থেকে কিছু কাপড় আমদানি করলাম। নবী (সাঃ) আমাদের কাছে এলেন। তিনি আমাদের কাছ থেকে একটি পাজামা ক্রয়ের জন্য দরদন্তর করলেন। আমাদের নিকটেই একজন কয়াল উপস্থিত ছিল। সে কয়ালকে বলেনঃ ওজন কর এবং (দাম) কিছুটা বেশি দাও”। (জামে আত-তিরমিযী, পৃ. ৪১৮, নং ১২৪৩।)
৩৫. আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) (উটের পিঠে বিছানোর) একটি চট (বা মোটা কাপড়) এবং একটি কাঠের পাত্র বিক্রয়ের ইচ্ছা করেন, এবং তিনি বলেন, কে এই চট ও পাত্রটি ক্রয় করবে?” “এক ব্যক্তি বলল, “আমি এ দু’টি এক দিরহামের ক্রয় করতে ইচ্ছুক”। নবী (সাঃ) বলেনঃ “কে এক দিরহামের বেশি দিবে, কে এক দিরহামের বেশি দিবে?” “এক ব্যক্তি তাকে দুই দিরহাম দিয়ে তাঁর কাছ থেকে জিনিস দু’টি ক্রয় করল”। (জামে আত-তিরমিযী, পৃ: ৩৬৯, নং ১২৫৬)
৩৬. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কেউ খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করলে তা গ্রহণ করার পুর্বে বিক্রি করা উচিত নয়”।[মুসলিম, ১৫২৬ (৩২); সহীহ আল-বুখারী, ২য়, খণ্ড, পৃ; ৩৩৫, নং ১৯৮৫, পৃ: ৩৩৩, নং ১৯৭৫।]
৩৭. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কেউ খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করলে তা গ্রহণ করার পূর্বে বিক্রি করা উচিত নয়”।[মুসলিম, ১৫২৬ (৩২); সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৩৩৫ নং ১৯৮৫, পৃ: ৩৩৩, নং ১৯৭৫।]
৩৮. ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কেউ খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করলে দখল নেওয়ার পূর্বে তা বিক্রি করা উচত নয়”। ইবনে আব্বাস বলেন, “অন্যান্য সকল জিনিসের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য”।[মুসলিম, ১৫২৫ (২৯-৩০)।]
৩৯. ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “যে কেউ খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করবে, সে যেন তা পুরোপুরি অধিকারে আনার আগে পুনারায় বিক্রি না করে”। ইবনে উমর (রাঃ) বলেন, “আমরা (অগ্রগামী হয়ে) পণ্যবাহী কাফেলার নিকট থেকে অনুমানের ভিত্তিতে খাদ্যশস্য খরিদ করতাম। তা ক্রয়ের স্থান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পূর্বে বিক্রি করতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের নিষেধ করেছেন”। [মুসলিম, ১৫২৬-১৫২৭ (৩৪)।]
৪০. ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “ক্রয়কৃত খাদ্যদ্রব্য পুরোপুরি নিজের অধিকারে আসার আগেই বক্রি করতে নিষেধ করেছে”। (তাঊস বলেন), “আমি ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞাস করলাম, এরূপ হবে কেন (পুরো অধিকারে আনার আগে বেচা যাবে না কেন)?” উত্তরে তিনি বলেন, “তা না হলে তো পণ্যের অনুপস্থিতিতে গিরহামের বিনিময়ে দিরহাম বিক্র করা হবে”। (সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল বুয়ু, পৃ: ৩৩৫, নং ১৯৮৪।)
৪১. ইবনে উমার থেকে বর্ণিত। “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যবহারোপযোগী না হওয়া পর্যন্ত ফলের বেচা-কেনা নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কেই নিষেধ করেছেন”।[মুসলিম, ১৫৩৪ (৪৯)।
৪২. জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাকার পূর্বে ফল বিক্রি করতে আমাদের নিষেধ করেছেন”।[মুসলিম, ১৫৩৬ (৫৩)।]
৪৩. আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ (দুনিয়াতে) এমন কোন নবীকে পাঠাননি, যিনি ছাগল-ভেড়া চরাননি। তখন তাঁর সাহাবীগণ বলেন, আপনিও কি (চরিয়েছেন)? তিনি জবাব দিলেন, হাঁ, আমিও কয়েক কীরাতের বিনিময়ে মক্কাবসীদের ছাগল-ভেড়া চরাতাম”। (সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল ইজারাহ, পৃ: ৩৮৫, নং ২১২০।)
৪৪. আবূ মাসউদ আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে দান করার আদেশ করলে আমাদের কেউ কেউ বাজারে চলে যেত এবং বোঝা বহন করে এক মুদ্দ (প্রায় এক সের) মজুরী লাভ করত (এবং তা থেকে দান করত)। আর (আজ) তাদের কেউ কেউ লাখপতি”। বর্ণনাকারী (শকীক) বলেন, “আমার ধারণা, এর দ্বারা তিনি (আবু মসঊদ) নিজের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন”।(সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল ইজারাহ, পৃ: ৩৯৩, নং ২১১২।)
৪৫. ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উৎপাদিত ফল কিংবা ফসলের অর্ধেক ভাগের শর্তে খাইবারের জমি (ইহুদীদেরকে) বন্দোবস্ত দিয়েছিলেন”। (সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল হারসে ওয়াল মুযারেআহ, পৃ. ৪২৫, নং ২১৬১।)
৪৬. আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আনসার সাহবীগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- ক বললেন, “আমাদের এবং আমাদের ভাইদের (মুহাজির) মধ্যে খেজুরের বাগান ভাগ করে দিন”। তিনি বললেন, “না”। তখন তাঁরা (মুহাজিরদের) বললেন, “আপনারা আমাদের বাগানে মেহনত করুন, আপনাদের ফলের ভাগ দেব”। তাঁরা (মুহাজিররা) বললেন, “আমরা শুনলাম এবং মেরে নিলাম”। (সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল হারসে ওয়াল মুযারেআহ, পৃ” ৪২৩, নং, ২১৫৭।)
৪৭. রাফে ইবনে খাদীজ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার চাচারা আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। “রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যমানায় লোকেরা নালার পাশে উৎপন্ন ফসলের শর্তে কিংবা এমন কিছু শর্তে ভাগে জমি কেরায়া দিত যা জমির মালিক নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নিত। (যেমন ক্ষেতের কোন বিশেষ অংশ সে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নিত কিংবা উৎপাদিত ফসলের একটা বিশেষ অংশ সে পাবে- এ শর্তে জমি দিত)। কিন্তু নবী (সাঃ) এরূপ করতে নিষেধ করলেন”। (অধস্তন রাবী বলেন) আমি রাফে’কে জিজ্ঞেস করলাম, “দীনার ও দিরহামের বিনিময়ে জমি কেরায়া দেয়াটা কেমন?” রাফে (রাঃ) বলেন, “তাতে কোন দোষ নেই”। রাইস বলেন, “যে বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে হালাল ও হারাম সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তি সে বিষয়ে চিন্তা করলে তিনিও তা জায়েয মনে করবেন না। কেননা তাতে (ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার) আশংকা রয়েছে”। (সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল হারসে ওয়াল মুযারেআহ, পৃ: ৪৩৩, নং ২১৭৬।)
৪৮. আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “সাওয়ারীর পশু বন্ধক রাখলে তার পিঠে আরোহণ করা যাবে। দুগ্ধবতী পশু রাখলে তার দুধ পান করা যাবে। যে ব্যক্তি আরোহণ করবে এবং দুধ পান করবে পশুর ব্যয়ভারও তাকে বহন করতে হবে”। (জামে আত-তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৩৮৯-৩৯০, নং ১১৯১।)
ii) অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয়
৪৯. আবুল মিনহাল (রাঃ) বলেন, আমি বারাআ ইবনে আযিব (রাঃ) এবং যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ)- কে মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবসা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সময় আমরা দু’জন ছিলাম বণিক। আমরা সোনা ও রূপার মুদ্রা বিনিময় অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “যদি বিনিময় পারস্পরিক হয় তাহেল কোন দোষ নেই, কিন্তু যদি বিনিময় পারস্পরিক না হয় তাহলে তা জায়েয নয়”।(সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল বুয়ু, পৃ: ৩০৪, নং ১৯১৭।)
৫০. হাবীব থেকে বর্ণিত। তিনি আবূল মিনহালকে বলতে শুনেছেন, :আমি বারাআ ইবনে আযিবকে ‘সফর’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, “তুমি যায়েদ ইবনে আরকামেকে জিজ্ঞেস কর। তিনিই এ ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত”। অতএব আমি যায়েদকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, “তুমি বারাআর কাছে জিজ্ঞেস কর। সে আমার চেয়ে অধিক জ্ঞাত”। অবশেষে তারা উভয়েই বললেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বর্ণের বিনিময়ে রৌপ্য দায়নান বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন”।[মুসলিম, ১৫৮৯ (৮৭);সহীহ মসিলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪৮, নং ৩৯২৬। ]
৫১. জাফর ইবনে আবি ওয়াহশিয়াহ ইউসুফ ইবনে মাহিল হতে, তিনি হাকিম হিযাম হতে বর্ণনা করেছেন যে, “আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছে এসে এক ব্যক্তি আমাকে এমন একটি জিনিস তার কাছে বিক্রি করতে বলল যা আমার কাছে নেই। আমি উক্ত জিনিস (যা সে কিনতে চেয়েছিল) তার কাছে বিক্রি করলাম। অতঃপর বাজার থেকে তার জন্য জিনিসটি ক্রয় করলাম (তাকে হস্তান্তন করলাম)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “যা তোমার কাছে নেই তা বিক্রি করো না”।(হাদীস)[আবু দাঊদ: সুনানে আবু দাঊদ, ইংরেজী অনুবাদ, আহমদ হাসান, আশরাফ প্রেস, লাহোর, ১৯৮৪, উদ্ধৃত, কামালি, মুহাম্মদ হাশিম: Islamic Commercial Law: An Analysis of Futures and Options, Ilmiah Publishers, Kualampur, 2002, p. 112.]
৫২. ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বাকি নামক বাজারে উটের ব্যবসা করতাম। আমি কখনও স্বর্ণ মূদ্রার বিনিময়ে তা বিক্রয় করতাম এবং মূল্য গ্রহণকালে স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করতাম। আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-র কাছে এসে তাকেঁ হাফসার (রাঃ) ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। আমি ব্যাপারটি তাকেঁ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ “এরূপ মূল্য গ্রহণ করায় কোন দোষ নেই”।(জামে আত-তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৩৮৩, নং ১১৭৯।)
৫৩. ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মদীনায় এলেন,তিনি দেখলেন লোকেরা ফল এক বা দুই বছরের জন্য (বর্ণনাকারীর সন্দেহ যে, এক বা দুই বছর বলা হয়েছিল না দুই বা তিন বছর বলা হয়েছিল) ফলে অগ্রিম কেনা-বেচা করেছে”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “কেউ যদি খেজুরের ফল অগ্রিম অর্থ প্রদান করে (পরবর্তীতে খেজুরের সরবরাহ নেওয়ার শর্তে), তাহলে খেজুরের নির্দিষ্ট পরিমাণ, এর নির্দিষ্ট ওজন ও নির্ধারিত সময়ের জন্য অর্থ প্রদান করা উচিত”।[মুসলিম, ১৬৪০ (১২৭)।]
৫৪. আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি মারওয়ানকে বললেন,”আপনি কি সুদের কারবার হালাল করে দিয়েছেন?” মারওয়ান বললেন. “আমি তো তা করিনি”। আবু হুরায়ারা (রাঃ) বললেন, “আপনি তো হুন্ডির ব্যবসা হালাল করে দিয়েছেন অথচ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খাদ্যদ্রব্যের ওপর নিজের অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পুর্বেই তা বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন”। রাবী বলেন, “মারওয়ান লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিল এবং তাদেরকে এ ধরনের লেনদেন করতে নিষেধ করল”। সুলাইমান ইবনে ইয়াসার বলেন, “অতঃপর আমি দেখলাম, শান্ত্রীরা লোকদের হাত থেকে হুন্ডির কাগজগুলো কেড়ে নিয়ে নিচ্ছে”।[মুসলিম, ১৫২৮ (২)।]
৫৫. আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর লৌহ বর্মটি এক ইহুদীর কাছে বন্ধক রেখে ধারে খাদ্য-শস্য ক্রয় করেছিলেন’।[মুসলিম, ১৬০৩ (১৬৪)।]
৫৬. আ’মাশ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, “আমরা বন্ধক রেখে বাকিতে ক্রয়ের কথা ইবারাহীমের কাছে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, এরূপ করতে কোন দোষ নেই। অতঃপর তিনি আমাকে আসওয়াদের মাধ্যমে আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস শুনালেন যে, নবী (সাঃ) একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের বাকিতে এক ইহুদীর নিকট থেকে কিছু খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করেছিলেন এবং স্বীয় লৌহ বর্মটি তার কাছে বন্ধক রেখেছিলেন”। (সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল বুয়ূ, পৃ: ৩৫৮, নং ২০৪৫।]
৫৭. ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন ইন্তিকাল করেন তখন তাঁর লৌহ বর্ম বিশ সা’ খাদ্যশস্যের বিনিময়ে বন্ধক দেয়া ছিল। তা তিনি নিজ পরিবারের জন্য নিয়েছিলেন”। (জামে আত-তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৩৬৬, নং ১১৫৫।)
৫৮. “কোন ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জাবির (রাঃ) এর নিকট থেকে বাকিতে কূপ ক্রয় করেন এবং মদীনায় ফেরার পর তার মূল্য পরিশোধ করেন”।(বুখারী, হাদীস নং ২২৫৫।)
৫৯. জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিন বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার নিকট দেনা ছিলেন। তিনি তাঁর দেনা পরিশোধ করার সময় আমাকে কিছু অতিরিক্ত দিলেন”।(সুনান আবূ দাউদ)
৬০. জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি রাসূলূল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট গেলাম; সে সময়ে তিনি মসজিদে গিয়েছিলেন) নবী (সাঃ) আমাকে দু’রাকআত সালাত আদায় করার নির্দেশ দিলেন। শেষে তিনি তাঁর কাছে আমার যা পাওনা ছিল তা পরিশোধ করলেন এবং আরও অতিরিক্ত পরিমাণ দিলেন”।(সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ; ৪৫২, নং ২২১৯।)
৬১. জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “কোনো এক যুদ্ধে আমি নবী (সাঃ) এর সঙ্গে ছিলাম”। তিনি (সাঃ) বললেনঃ “তুমি কি তোমার উটটি আমার নিকট বেচা সমীচীন মনে কর?” আমি বললাম, “হাঁ”। “অতঃপর তাঁর নিকট আমি সেটি বিক্রি করলাম। তিনি মদীনায় পৌঁছলেন, আমি উট নিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে তার দাম দিয়ে দিলেন”। (সহীহ আল-বূখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল ইসতিকরাদ, পৃ: ৪৪৯,নং ২২১০।)
৬২. জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি একটি উটে চড়ে সফর করছিলাম। কিন্তু উটটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমি একে পরিত্যাগ করতে মনস্থ করলাম। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার নিকট আসলেন। তিনি আমার জন্য দোয়া করলেন এবং উটটিকে আঘাত করলেন; ফলে উটটি এত দ্রুত চলতে লাগলো যে অনুরূপ আর কখনো চলেনি”। তিনি(রাসূলুল্লাহ (সাঃ)) বললেন, “এটাকে এক উকিয়ায় আমার কাছে বিক্রি কর”। আমি বললাম, “না”। তিনি আবার বললেন, “এটাকে এক উকিয়ায় আমার নিকট বিক্রি কর”। “আমি তাঁর নিকট এটা বিক্রি করলাম এবং তাতে সওয়ার হয়ে আমার বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার শর্ত রাখলাম। বাড়ি পৌছেঁ আমি উটটি নিয়ে তাঁর কাছে আসলাম। তিনি আমাকে উটের দাম চুকিয়ে দিলেন। আমি ফিরে যেতে লাগলাম। তিনি একজন লোক পাঠিয়ে আমাকে পুনরায় ডাকলেন”। (আমি ফিরে এলে) তিনি বললেন, “মনে করেছিলে আমি তোমার উট নিয়ে তোমাকে কম মূল্য নিতে বলব; তোমার উট এবং দিরহাম নিয়ে নাও। এগুলো তোমারই”। (সহীহ মুসলিম, ৫ম, খণ্ড, পৃ: ৩৬২-৩৬৩, নং ৩৯৫২।)
৬৩. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “বারীরা এস বললো, আমি আমার মনিবের সাথে প্রতিবছর এক উকিয়াহ করে নয় উকিয়া প্রদানের (মাধ্যমে মুক্ত হওয়ার জন্য) চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। অতএব আমাকে সহযোগিতা করুন”। (বুখারী)
৬৪. “অজ্ঞাত মেয়াদের জন্য বাকিতে বেচা-কনা বৈধ নয়”।[ইবনে হাযম, আল-মুহাল্ল, বৈরুত, খ-৯, পৃ: ৬২৭।]
৬৫. আবু হুরায়ারা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কেউ যদি না দেখে কোন জিনিস ক্রয় করে তাহলে জিনিসটি দেখার পর চুক্তি বাতিল করার অধিকার তার থাকবে”।[উদ্ধৃত, কামালি,মোহাম্মদ হাশিম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১০৫।](হাদীস)
৬৬. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “তিনটি জিনিসের মধ্যে বরকত রয়েছে, (তার একটি হচ্ছে) বাকিতে বেচা-কেনা”।(সুনানে ইবনে মাজাহ)
২৪-৬৬ পর্যন্ত হাদীসসমূহে ভিন্ন ভিন্ন জাতের বস্তুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন অবস্থায় ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হয় না অথবা ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে কি কি করা নিষিদ্ধ তার বিস্তারিত উল্লেখও এখানে করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, নগদ-বাকি, অগ্রিম, নিলাম,শ্রম বিক্রি, মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়, কীরাতের বিনিময়ে জমি ইজারা দেওয়া, বাগানের ফলের ভিত্তিতে শ্রম নিয়োগ করা, জমি বর্গা দেওয়া ইত্যাদি সকল ক্রয়-বিক্রয়ই বৈধ।
এসব হাদীসি থেকে বুঝা যায় যে, ভিন্ন ভিন্ন জাতের বস্তুর সকল ক্রয়-বিক্রয়ের মৌলিক বিধান হচ্ছে, বস্তু ব্যবহার উপযোগী হতে হবে তথা এদের উপযোগ থাকতে হবে, পারস্পরিক স্বেচ্ছা-সম্মতিতে মূল্য নির্ধারণ করতে হবে; নিজ নিজ বস্তুর ওপর ক্রেতা-বিক্রেতার মালিকানা ও দখল/অধিকার থাকতে হবে; ধোকা-প্রতারণা,জালিয়াতি, অস্পষ্টতা ও অজ্ঞতা থাকা চলবে না। এ ছাড়া এক বিক্রয়ে দুই শর্ত, এক বিক্রয়ে দুই লেনদেন, এক লেনদেনে দুই বিক্রয়, এক বিক্রয়ে দুই দাম, ঝুকিঁ ছাড়া মুনাফা গ্রহণ, ঋণ ও ক্রয়-বিক্রয়কে একত্রিক করা, অযথা দরদাম করে মূল্য বৃদ্ধি করা, কারো দামের ওপর দাম করা ইত্যাদিক সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ।
বাকি ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হওয়ার ব্যাপারেও হাদীসে কোন অস্পষ্টতা নেই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং বাকিতে খাদ্যদ্রব্য ও কূপ ক্রয় করেছেন; এসব ক্ষেত্রে দাম বাকি ছিল, বস্তু নগদ হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর দাম ও বস্তু উভয়ই বাকি রাখা হয়েছে তার প্রমাণও হাদীসে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জাবিরকে (রাঃ) তাঁর উটটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে বিক্রয় করার প্রস্তাব করলেন; জাবির (রাঃ) প্রস্তাবে রাজী হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট তাঁর উট বিক্রয় করলেন এবং মদীনায় পৌছেঁ উট হস্তান্তর করার শর্ত রাখলেন। অতঃপর মদীনায় পৌছেঁ পরদিন সকালে জাবির (রাঃ) উট হস্তান্তন করলেন আর নবী (সাঃ) দাম পরিশোধ করলেন। সুতরাং উভয় পক্ষের মূল্য হস্তান্তর নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য স্থগিত রাখাও বৈধ। এমনকি পূর্বাহ্ন না দেখে ক্রয় করাও বৈধ। তবে এক্ষেত্রে দেখার পর চুক্তি বাতিল করার অধিকার থাকবে। বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত আছে বলেও হাদীসে বলা হয়েছে।
২. সুদ সংক্রান্ত হাদীস
ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে যে, সমজাতের পণ্য-সামগ্রী, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান হচ্ছে ৩টি। সেগুলো হচ্ছেঃ
১) মানগত সমতা বা Qualitative equality (মিসলান বিমিসলিন)
২) পরিমাণগত সমতা বা (সাওয়া Qualititative equality য়ান বিসাওয়ায়িন)
৩) পারস্পরিক বিনিময় বা (ইয়াদান বিইয়াদিন)
আর অসম জাতের পণ্য-সামগ্রী, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান হচ্ছে দু’টি। সেগুলো হচ্ছেঃ
১) পারস্পরিক সম্মতিতে মূল্য নির্ধারণ বা Mutual consent (কাইফা শি’তুম)
২) পারস্পরিক বিনিময় বা Reciprocal exchange (ইয়াদান বিইয়াদিন)
কোন ক্রয়-বিক্রয়ে উল্লেখিত কোন বিধান বা বিধানসমূহ লংঘন করলে সে ক্রয়-বিক্রয়ে অবশ্যই সুদ উদ্ভূত হবে। বিভিন্ন ক্রয়-বিক্রয়ে কিভাবে সুদ উদ্ভূত হয় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। নিচে কিছু হাদীস উল্লেখ করা হলোঃ
ক) এক সাথে ও অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ সংক্রান্ত (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
৬৭. আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, গমের বিনিময়ে গম, বার্লির বিনিময়ে বার্লি এবং লবণের বিনিময়ে লবণ মানে সমান সমান (মিসলান বিমিসলিন) এবং লেনদেন পারস্পরিক (ইয়াদান বিইয়াদিন) হতে হবে। যে ব্যক্তি বেশি প্রদান করল কিংবা গ্রহণ করল সে সুদী কারবারে লিপ্ত হলো। কিন্তু জিনিসের শ্রেণির মধ্যে (আলওয়ানুহু) পার্থক্য থাকলে স্বতন্ত্র কথা”।[মুসলিম, ১৫৮৮ (৮৩); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪৬ নং ৩৯২০।]
৬৮. উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত। “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ সোনার বিনিময়ে সোনা মানে সমান সমান হতে হবে; রূপার বিনিময়ে রূপা মানে সমান সমান হতে হবে; খেজুরের বিনিময়ে খেজুর মানে সমান সমান হতে হবে; গমের বিনিময়ে গম মানে সমান সমান হতে হবে; লবণের বিনিময়ে লবণ মানে সমান সমান হতে হবে এবং বার্লির (যবের) বিনিময়ে বার্লি মানে সমান সমান হতে হবে। এ সবের লেনদেন যে ব্যক্তি বেশি দেবে অথবা গ্রহণ করবে সে সুদ অনুষ্ঠানকারী সাব্যস্ত হবে। রূপার বিনিময়ে সোনা তোমাদের ইচ্ছামত পরিমাণ নির্ধারণ করে বিক্রয় করতে পার তবে বিনময় পারস্পরিক হতে হবে। খেজুরের বিনিময়ে গম তোমাদের ইচ্ছামত পরিমাণ নির্ধারণ করে বিক্রয় করতে পার তবে বিনিময় পারস্পরিক হতে হবে। খেজুরের বিনিময় পারস্পরিক হতে হবে”। উল্লেখিত হাদীসের অপর এক বর্ণনায় আছেঃ “গমের বিনিময়ে বার্লি তোমাদের ইচ্ছামত পরিমাণ নির্ধারণ করে (পরিমাণে কম-বেশি করে) বিক্রয় করতে পার তবে বিনিময় পরস্পবিক হতে হবে”।(জামে আত-তিরমিডী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৩৮০-৩৮১, নং ১১৭৭।)
উক্ত হাদীস দু’টিতে প্রথমে সমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বস্তু দু’টির মান সমান সমান এবং বিনিময় পারস্পরিক হতে হবে বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; অতঃপর কোন এক দিকে বস্তুর পরিমাণ বেশি (যিয়াদা) হলে সেই ‘যিয়াদ’কে (অতিরিক্ত) রিবা বলা হয়েছে। নগদ বাকি উভয় ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। অতঃপর উভয় হাদীসের শেষাংশে ক্রয়-বিক্রয়ের বস্তু দু’টির জাত ভিন্ন ভিন্ন হলে এদের পরিমাণ ইচ্ছে মত নির্ধারণ করে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে বলে বলা হয়েছে।
খ) সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ সংক্রান্ত
i. সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ সংক্রান্ত (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
৬৯. আবূ কিলাবা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,……… “আমি তাকে (আবুল আশআস) বললাম, আমাদের ভাইদের কাছে উবাদা ইবনে সামিত উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিষেধ করতে শুনেছি, “স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ বেচা-কেনা করতে। তবে পরিমাণে সমান সমান একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন (সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন, আইনান বিআইনিন) হলে কোন দোষ নেই। অতঃপর যে বেশি দিল কিংবা নিল সে সুদে (সুদ খাওয়ার অপরাধে) লিপ্ত হল”।[মুসলিম, ১৫৮৭ (৮০); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪২, নং ৩৯১৫।]
৭০. আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ মানে সমান সমান (মিসলান বিমিসলিন) এবং আদান-প্রদান পারস্পরিক (ইয়াদান বিইয়াদিন) হতে হবে। অতঃপর যে ব্যক্তি বেশি দিল কিংবা গ্রহণ করল সে সুদী কারবারে লিপ্ত হলো। গ্রহণকারী ও প্রদানকারী উভয়েই সমান অপরাধী”।[মুসলিম, ১৫৮৪ (৮২); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪৫, নং ৩৯৮১।]
৭১. আবূ সাঈদ খদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, সোনার বিনিময়ে সোনা মানে সামান সমান(মিসলান বিমিসলিন), বিনিময় পরস্পরিক (ইয়াদান বিইয়াদিন) এবং যা বেশি (ফদল) তা রিবা, রূপার বিনিময়ে রূপা মানে সমান সমান, বিনিময় পারস্পরিক এবং যা বেশি তা রিবা, গমের বিনিময়ে গম সমান সমান, বিনিময় পারস্পরিক এবং যা বেশি (ফদল) তা রিবা, লবণের বিনিময়ে লবণ সমান সমান, বিনিময় পারস্পরিক এবং যা বেশি (ফদল) তা রিবা, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর সমান সমান, বিনিময় পারস্পরিক এবং যা বেশি (ফদল) তা রিবা”।,[হাদীস, উদ্ধুত করেছেন, ইমাম সারাখ্সী, আল-মাবসুত, ইংরেজী অনুবাদ, ইমরান আহসান নিয়াজী [email protected], Dec. 9, 2000.]
৭২. আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ ওজনে ও মানে সমান সমান (ওয়াযনান বিওয়াযনিন, মিসলান বিমিসলিন) এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য ওজনে ও মানে সমান সমান (ওয়াযনান বিওয়াযনিন, মিসলান বিমিসলিন) হলে বিনিময়ে কোন দোষ নেই। তবে যে ব্যক্তি বেশি দিল কিংবা বেশি নিল সেই সুদের কারবার করল”।[মুসলিম, ১৫৮৮ (৮৪); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪৬, নং ৩৯২২।]
৭৩. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বলেছেন, “খেজুরের পরিবর্তে খেজুর….যবের পরিবর্তে যব…… ইয়াদান বিইয়াদিন, মিসলান বিমিসলিন, এবং যাতে কোন কম-বেশি থাকবে না। যেই বেশি বা কম করবে নিশ্চয়ই সে সুদ লেনদেনে লিপ্ত হলো। ওজন অথবা পরিমাপযোগ্য বস্তু (এর বেলায় এটা প্রযোজ্য)”। (হাদীস)[আল-বায়হাকি: আল-সুনান আল-কুবরা, ভলি-৫, পৃ: ২৮২; আল-মুস্তাদরাক, ভলি-৩, পৃ: ৪২; উদ্ধৃত, নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১০৫।]
৭৪. ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “দুই দীনারের বিনিময়ে এক দীনার, দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম, দুই সা’র বিনিময়ে এক সা’ বিক্রি করো না; কারণ এতে তোমরা রিমায় (রিবায়) জড়িত হয়ে পড়বে”। এক ব্যক্তি দাড়িয়ে বলল, “ আল্লাহর রাসূল! কেউ যদি একাধিক ঘোড়ার বিনিময়ে একটি ঘোড়া বিক্রি করে, সে ব্যাপারে আপনার মত কি?” উত্তরে তিনি বললেন, “এতে কোন ক্ষতি নেই, যদি তা পারস্পরিক বিনিময় (ইয়াদান বিইয়াদিন) হয়”। (মুসনাদে আহমদ)[উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৬০।]
সমজাতের দু’টি বস্তু (মুদ্রা বা পণ্য) ক্রয়-বিক্রয়ে ক্ষেত্রে উভয় বস্তুর মুল্য সমান সমান করার শর্ত ভঙ্গ করে পরিমাণে কম-বেশি করা হলে সেই বাড়তিকে (ফদল) বলা হয়েছে রিবা। বলা হয়েছে “ফদল (বাড়তি) হচ্ছে রিবা”। ইমাম সারখসী বলেছেন, এই “বাড়তি পরিমাণের তুলনা দ্বারা নিরূপিত বাড়তি হতে পারে অথবা মুদ্রার পরিমাণগত তারতম্য এবং মূল্যের আনুপাতিক পার্থক্য দ্বারা নিরূপিত হতে পারে”। (সারাখসী, পূর্বোক্ত)
ii. সমজাতের ভিন্ন ভিন্ন মানের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ (নগদ-বাকি উল্লখ নেই)
৭৫. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। বিলাল (রাঃ) উন্নত মানের খেজুর নিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: “এগুলো কোথা থেকে এনেছো?” বিলাল (রাঃ) বললেন, “আমাদের কাছে কিছু খারাপ খেজুর ছিল। নবীকে (সাঃ) খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে এর এক সা’-এর বিনিময়ে আমাদের দুই সা’ (নিম্ন মানের) বিক্রি করেছি”। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হায়! এতো একেবারে সুদ। এরূপ করো না; বরং যখন তুমি (উত্তম) খেজুর খরিদ করতে চাও, তখন তোমার (খারাপ) খেজুর ভিন্নভাবে বিক্রি করে দাও (ফাবে’হু বিবাইয়িন আখারা)। অতঃপর তার মূল্য দিয়ে এগুলো খরিদ কর”। [মুসলিম, ১৫৯৪ (৯৬); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৩-৫৪, নং ৩৯৩৭।]
৭৬. আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট কিছু খেজুর উপস্থিত করা হলো। তিনি বললেন, “এ খেজুর তো আমাদের (মদীনার) খেজুরের বিনিময়ে আমাদের খেজুরের দুই সা’ বিক্রি করেছি”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “এটা তো সুদ। কাজেই এটা ফেরত দিয়ে দাও। অতঃপর আমাদের খেজুরগুলো বিক্রি করে (এর মূল্য দিয়ে) এগুলো খরিদ কর”।[মুসলিম, ১৫৯৪ (৯৭); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৪, নং ৩৯৩৮।]
৭৭. আবু নাদরাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি ইবনে আব্বাসকে (রাঃ) সরফ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম”। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তা কি পারস্পরিক (ইয়াদান বিইয়াদিন) বিনিময়? আমি বললাম, “হ্যাঁ”। তিনি বললেন, “এতে কোন দোষ নেই”। আমি আবু সাঈদ খুদরীকে (রাঃ) এ সম্পর্কে অবহিত করলাম এবং বললাম আমি ইবনে আব্বাসকে (রাঃ) সোনা-রূপার (সরফ) ক্রয়-বিক্রয় সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন তা পারস্পরিক বিনিময় (ইয়াদান বিইয়াদিন) কিনা? আমি বললাম, “হ্যাঁ”। তিনি বললেন, “তাতে কোন দোষ নেই”। আবূ নাদরাহ বলেন, “আমার কথা (আব্বাস (রাঃ) এর মত) শুনে আবূ সাঈদ (রাঃ) বললেন”, “আচ্ছা, আমরা অচিরেই তাকে লিখব তিনি যেন তোমাদের এই ফতোয়া না দেন”। অতঃপর আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন, “আল্লাহর শপথ! একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোন গোলাম তাঁর নিকট কিছু খেজুর নিয়ে আসে। কিন্তু ৭৮. তিনি তা গ্রহণ করতে অসম্মতি জানান এবং বলেন, “মনে হচ্ছে এগুলো আমাদের এলাকার খেজুর নয়”। গোলামটি বললো, “এ বছর মদীনায় খেজুরের ফলন ভাল হয়নি এবং প্রাকৃতিক দোষ পড়েছে, তাই পুষ্ট হয়নি। আমি এগুলো অন্যের থেকে নিয়েছি এবং যে পরিমাণ গ্রহণ করেছি, বিনিময়ে আমাদের খেজুর থেকে তার চেয়ে কিছু অধিক দিয়েছি”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তুমি অধিক প্রদান করে সুদী কারবারে লিপ্ত হয়েছ। আর কখনও এরূপ লেনদেনের কাছেও যাবে না। যখন তুমি নিজের খেজুর নিয়ে সন্দেহে পতিত হও (এর মান নির্ণয়ে) তখন তা নগদ মূল্যে বিক্রি করে দাও। অতঃপর এই অর্থ দিয়ে তোমার পছন্দসই খেজুর কিনে নাও”।[মুসলিম, ১৫৯৪ (৯৯); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৫-৫৬, নং ৩৯৪০।]
৭৮. আবূ নাদরাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে সরফ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তাঁরা উভয়েই এত কোন দোষ মনে করেন না”। একদা আমি আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর নিকট বসা ছিলাম। “আমি তাকেঁ সরফ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম”। তিনি বললেন, “যা অতিরিক্ত হবে তা সুদ”। আমি তাদেঁর দু’জনের অভিমতের প্রেক্ষিতে তাঁর এ কথা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালাম। জবাবে তিনি বললেন, “আমি কেবল সে কথাই তোমাকে বলব যা আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে শুনেছি”। তা হলো এই: “এক খেজুর বাগানের মালিক উন্নত মানের এক সা’ খেজুর নিয়ে তাঁর নিকট আসলো অথচ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেজুর ছিল ভিন্ন রঙ্গের”। নবী (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এগুলো কোথায় পেয়েছ?” সে বললো, “আমি দু’ সা’ খেজুর নিয়ে (বাজারে) গিয়েছিলাম এবং তা দিয়ে এই এক সা’ খরিদ করেছি। বাজারে এগুলোর প্রচলিত দাম এই এবং ঐগুলোর (উন্নত মানের খেজুর) প্রচলিত দাম এই”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তোমার অমঙ্গল হোক! তুমি তো সুদী কারবার করেছ। তুমি যখন এরকম করতে চাও প্রথমে তোমার খেজুরগুলো নগদ মূল্যে (বিসিয়ালয়াতে) বিক্রি করে দাও। অতঃপর সে মূল্য দিয়ে তোমার পছন্দসই খেজুর খরিদ করে নাও”।
আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন, “খেজুরের বিনিময়ে (মানের ভিত্তিতে ওজনের তারতম্যে) খেজুর ক্রয়-বিক্রয় করা মধ্যে সুদের উপাদান থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। অথবা সোনার বিনিময়ে সোনা (ওজনের তারতম্যে) লেনদেন করার মধ্যে সুদ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক”।
আবূ নাদরা বলেন, “পরে আমি ইবনে উমরের কাছে আসলাম। তিনিও আমাকে ঐ রূপে কেনাবেচা করতে নিষেধ করলেন। তবে আমি ইবনে আব্বাসের (রাঃ)-এর নিকট যাইনি”। আবূ নাদরাহ বলেন, আবূ সাহাবা’ আমাকে বর্ণনা করেছেন যে, “তিনি এই মাসয়ালা সম্পর্কে ইবনে আব্বাসের (রা) কাছে জিজ্ঞেস করেছেন, তিনিও এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় অনুমোদন করেননি”।[[মুসলিম, ১৫৯৪ (১০০); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৬-৫৭, নং ৩৯৪১।]
৭৯. এক ব্যক্তি এক সা’ ভাল খেজুর দিয়ে দুই সা’ খারাপ খেজুর ক্রয় করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন, ‘তুমি সুদ নিয়েছ, কারণ, তুমি দ্বিগুণ করেছ”।(হাদীস)[উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০]
৮০. ইবনে ইয়াসার থেকে তাঁর কতিপয় প্রতিবেশী এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবী সূত্রে বর্ণিত, তাদের একজন হলেন সাহল ইবনে আবূ হাসমা (রাঃ), “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শুকনো খেজুরের বিনিময়ে তাজা খেজুর বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন, এটা সুদভিত্তিক লেনদেন এবং এটাই হচ্ছে মুযাবানা”।[মুসলিম, ১৫৪০(৬৭)
৭৫-৮০ নম্বর হাদীসগুলোতে সমজাত কিন্তু মানে ভিন্ন ভিন্ন দু’টি বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কিভাবে সুদ উদ্ভূত হয় তা বলা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, উভয় বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান মানগত তারতম্য বিবেচনায় এনে অনুমানের ভিত্তিতে এদের পরিমাণে কম-বেশি করা হলে সেই বাড়তি অংশকে রিবা বলা হয়েছে। কারণ অনুমান তো অনুমানই, তা কখনও নিশ্চিত নয়। তাছাড়া, এটা হচ্ছে মৌলিক ও স্বাভাবিক/প্রকৃতিক বিধানের লংঘন, কেননা সমজাতের দু’টি বস্তুর মান ও পরিমান সমান করা হলেই কেবল এদের মূল্য সমান হতে পারে না। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মানের পার্থক্যসহ দু’টি বস্তুর পরিমাণ সমান সমান করে বিনিময় করার নির্দেশ দেন নাই বরং তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মানে সমান সমান হতে হবে’; অন্যথায় খারাপ পণ্যটিকে তৃতীয় কোন পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে প্রাপ্ত মূল্য দ্বারা পছন্দমত উন্নত মানের পণ্য ক্রয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এটাও বলেছেন যে, এভাবেই পরিমাণ (পূর্ণ হবে)”।
iii. সমজাতের বস্তু, মুদ্রা বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ
৮১. আবূ বুরাদা ইবনে আবি মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি মদীনায় এলাম এবং আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম এর সাথে সাক্ষাত করলাম। তিনি বললেন, “তুমি এমন এক দেশে বাস কর, যেখানে সুদের লেনদেন ব্যাপক। সুতরাং কেউ যদি তোমার নিকট ঋণী থাকে এবং তোমাকে এক বোঝা খড়, কিছু বাল্যি বা এক আঁটিঁ শুষ্ক তৃণ উপহার দেয়, তাহলে তুমি তা গ্রহণ করবে না, কারণ তা রিবা”।(বুখারী)
৮২. আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যদি কাউকে ঋণ দাও অতঃপর ঋণগ্রহীতা যদি তাকে খাবার সাধে, ঋণদাতার তা গ্রহণ করা উচিত নয়; ঋণদাতাকে তার পশু-বাহনে ভ্রমণ করার প্রস্তাব করে তাহলে তাতে উঠা ঋণদাতার উচিত নয় যদি তারা পূর্ব থেকে অনুরূপ আনুকূল্য পরস্পর বিনিময়ে অভ্যস্ত না হয়”।(সুনান আল-বয়হাকি)
৮৩. আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যদি অন্যকে ধার দেয়, তাহলে কোন উপহার-উপঢৌকন গ্রহন করা তার উচিত নয়”।(বায়হাকি সুত্রে মিশকাত; মুনতাকা, ইবনে তাইমিয়া।)
৮৪. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ঋণ কোন সুবিধা বয়ে আনলে তা রিবা”।(হাদীস)[উদ্ধৃত নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত পৃ. ২৫২]
৮৫. ফাদালাহ ইবনে উবায়েদ বলেছেন, “ঋণ থেকে আহৃত (derived) সুবিধা হচ্ছে সুদের বিভিন্ন ধরনের একটি”।(সুনান আল-বায়হাকি)
ঋণের ক্ষেত্রে দাতা যে জাতের পণ্য বা মুদ্রা গ্রহীতাকে প্রদান করে নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হলে সেই একই জাতের পণ্য বা মুদ্রা ফেরত নেয়। অর্থাৎ ঋণে লেনদেনের বস্তু দু’টি হয় একই জাতের। সুতরাং এক্ষেত্রে সমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ের বিধানই প্রযোজ্য। অর্থাৎ যে মানের যত পরিমাণ বস্তু দেওয়া হয়েছে সেই একই মানের সমপরিমাণ বস্তু ফেরত নেয়ার পর তার ওপর ঋণের শর্ত হিসেবে যদি অতি তুচ্ছ নগণ্য জিনিস উপহার উপঢৌকন বা কোন সুবিধা গ্রহণ করা হয়, তাহলে সেটাই হবে বিনিময় ছাড়া অতিরিক্ত বা রিবা। হাদীস কয়টিতে এই ব্যাপারেই সতর্ক করা হয়েছে।
গ) অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ
i. অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ (নগদ-বাকি উল্লেখ নেই)
৮৬. আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কোন মুসতারসালকে (বাজার সম্পর্কে অনবহিত ব্যক্তি) ঠকানো হচ্ছে রিবা”। (সুনান আল-বায়হাকি সুত্রে সুয়ূতি কর্তৃক তাঁর জামি আল সগীর-এ উদ্ধৃত।)
৮৭. আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “নাজিশ (নিলামে ডাক বাড়ানো জন্য যে দালাল হিসেবে কাজ করে) হচ্ছে অভিশপ্ত সুদখোর”।(হাদীস) (তাবারানির আল-কবীর থেকে ইবনে হাজার আল-আসকালানি তাঁর ফাতহুল বারি এবং সুয়ুতি তাঁর জামি আল-সগীরে উদ্ধৃত করেছেন।)
৮৮. “যে ইজাবে লিপ্ত হয় সে সুদ খায়”। (ইজাব হচ্ছে ফল পাকা শুরু হওয়ার পূর্বে ফল বিক্রি করা।) (উদ্ধৃত, বাদাবী, প্রগুক্ত, পৃ. ৩২।)
৮৯. আবূ উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কেউ যদি তার কোন ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করে, অতঃপর তার দেওয়া কোন উপহার/উপঢৌকন গ্রহণ করে, তাহলে সে সুদের বড় বড় দরজাসমূহের মধ্যে কোন একটি দরজা দিয়ে সুদের মধ্যে প্রবেশ করল”। (মুসনাদে আহমদ ও আবূ দাঊদ।)
অসম জাতের বস্তুর ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার স্বেচ্ছা সম্মতিতে নির্ধারিত যে কোন পরিমাণে/দামে ক্রয়-বিক্রয় করা বৈধ। তবে এরূপ ক্ষেত্রে ধোকাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতির মাধ্যমে দাম বেশি নিলে তা বিনিময়হীন হয়ে যায় বিধায় এ বাড়তি আংশকে রিবা বলা হয়েছে।
ii. অসমজাতের বস্তু, মুদ্রা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ
৯০. আবূল মিনহাল থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমার এক অংশীদার হজ্জ মওসুমে অথবা হজ্জের দিনগুলোতে মূল্য পরিশোধের শর্তে কিছু রূপা ধারে বিক্রি করল। অতঃপর সে আমার নিকট আসল এবং আমাকে অবহিত করল”। আমি বললাম, “তোমার এই লেনদেন বাঞ্ছিত নয়”। সে বলল, “আমি তা বাজারে বিক্রি করলাম। কিন্তু কেউ আমার এ কাজে আপত্তি করেনি”। অতঃপর আমি বারাআ ইবনে আযিবের (রাঃ) কাছে এসে তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে তিনি বললেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) (হিজরত করে) মদীনায় আসলেন। তখন আমরা এ ধরনের বেচা-কেনা করতাম”। তিনি বলেন, “এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে যেটা পারস্পরিক বিনিময় হবে (ইয়াদান বিইয়াদিন) তার মধ্যে কোন দোষ নেই। কিন্তু যে (লেনদেন) বিনিময় ছাড়া হবে (নসীয়াতান) তা রিবা। “তবে তুমি (ব্যাপারটি) যায়েদ ইবনে আরকামের (রাঃ) নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করে নাও। কেননা, তিনি আমার চেয়ে বড় ব্যবসায়ী। অতএব, আমি তাঁর নিকট এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনিও অনুরূপ কথা বললেন”।[মুসলিম, ১৫৮৯ (৮৬); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৪৭, নং ৩৯২৫।]
৯১. মালিক ইবনে আওস ইবনে ইবনুল হাদাসান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি বলতে বলতে আসলাম, কে (আমার স্বর্ণের সাথে) দিরহাম বিনিময় করবে? তখন উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন”। তালহা ইবনে উবায়েদ বললেন, তোমার স্বর্ণ আমাদের দেখাও এবং (পরে এক সময়ে) আমাদের কাছে আস। পরে যখন আমাদের খাদেম আসবে তখন তোমাকে তোমার দিরহাম দিয়ে দিব”। উমর ইবনূল খাত্তাব (রাঃ) বললেন, “কক্ষণো না! আল্লাহর শপথ। হয়তো তুমি এখনই তাকে (দিরহাম) রৌপ্য দিয়ে দাও অথবা তার স্বর্ণ তাকে ফেরত দাও। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “স্বর্ণের বিনিময়ে রৌপ্য লেনদেন পারস্পরিক (হা’য়া ওয়া হা’য়া) না হলে সুদ হবে এবং খেজুরের বিনিময়ে খেজুর (হা’য়া ওয়া হা’য়া) না হলে তাও সুদে পরিণত হবে”।[মসুলিম, ১৫৮৬ (৭৯)]
৯২. মালেক ইবনে আওস (রাঃ) হতে বর্ণিত। “(এক সময়ে) তিনি একশ’ দীনার বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলে (তিনি বর্ণনা করেন) তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ আমাকে ডাকলেন। আমরা (দীনার বিনিময়ের বিষয়ে) কথাবার্তা শেষ করলাম। এমনকি বিনিময়ের বিষয়টি তিনি স্থির করে আমার হাত থেকে স্বর্ণ দীনারগুলো নিয়ে স্বীয় হাতের ওপর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে থাকলেন এবং বললেন, গাবা (নামক জায়গা) থেকে আমার কোষাধ্যক্ষ ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। উমর (রাঃ) এসব কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি, যতক্ষণ তার (তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ) নিকট থেকে দীনার-এর বিনিময় গ্রহণ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ লেনদেন পারস্পরিক না হলে সুদে পরিণত হবে, যবের বিনিময়ে যব লেনদেন পারস্পরিক না হলে সুদে পরিণত হবে, গমের বিনিময়ে গম লেনদেন পারস্পরিক না হলে তাও সুদে পরিণত হবে”। (সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল বুয়ূ, পৃ: ৩৫০, নং ২০২৪।)
৯০ নম্বর হাদীস থেকে বুঝায় যে, ধারে রূপা বিক্রয়ে যদি বিনিময় পারস্পরিক হয় তাহলে তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু পরবর্তী দু’টো হাদীসে ইয়াদান বিইয়াদিন-এর পরিবর্তে হা’আ ওয়া হা’আ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। আর এর বরাত দিয়ে উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন, “এখনই তাকে দিরহাম দিয়ে দাও অথবা তার স্বর্ণ ফেরত দাও”; “যতক্ষণ তার কাছ থেকে দীনারের বিনিময় গ্রহণ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। হা’আ ওয়া হা’আ- এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, “এখানে তুমি ও এখানে তুমি- “here you are and you are”। (উদ্ধৃত সারাখসী, পূর্বোক্ত) ইমাম সারাখসী এর অর্থ লিখেছেন, “This for this”- “এটার বদলে এটা”। (সারাখসী, পূর্বোক্ত।) পারস্পবিক বিনিময় বা reciprocal exchange অর্থেই পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়েছে। হাদীস দু’টির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এত দীনারের সাথে দিরহাম বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতে নির্ধারিত দাম-দস্তুর যেমন নেই তেমনি পরিশোধের সময়ও সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। হযরত উমর (রাঃ) সম্ভবত এ কারণেই বলেছেন যে, এখনই দাও, ‘বিচ্ছিন্ন হয়ো না’। লক্ষণীয় যে, উমর (রাঃ) যে হাদীসের বরাত দিয়েছেন তাতে সোনার সাথে রূপা বিনিময়ের কথা বলার পরেই গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব ইত্যাদি সমজাতীয় বস্তু বিনিময়ের কথাও বলেছেন। আর একথা ঠিক যে, গম-যবের বাকি বিনিময় অবৈধ নয়; সুতরাং এর থেকে পৃথক করে কেবল সোনা রূপা ও মুদ্রার বাকি ক্রয়-বিক্রয় অবৈধ একথা কিভাবে বলা যেতে পারে? বিশেষ করেম আল-কুরআন যেখানে দাইন ক্রয়-বিক্রয় থেকে সোনা-রূপা ও মুদ্রার বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে পৃথক করার অবকাশ রাখেনি সেখানে তো এরূপ বলার প্রশ্নই আসে না।
৩. সাধারণ নির্দেশনা সংক্রান্ত হাদীস (সকল ক্রয়-বিক্রয় ও সুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)
i. ইয়াদিন বিইয়াদিন
৯৩. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “বিনিময় পরস্পরিক হলে তাতে রিবা হয় না”।(মুসলিম, ১৫৯৬ (১০৩)) [মুসলিম নাসাঈ; উদ্ধৃত, চাপরা, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৭।]
৯৪. ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “(মুদ্র ও দ্রব্য-সামগ্রীর) পারস্পরিক (ইয়াদান বিইয়াদিন) হলে তাতে সুদ হবে না”।[মুসলিম, ১৫৯৬ (১০৩)]{ইয়াদান বিইয়াদিনের বিপরীত অর্থ বুঝানোর জন্য নাসীয়াহ্ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ইয়াদান বিইয়াদিন অর্থ নগদ বিনিময হলে নাসীয়াহ অর্থ বাকি বিনিময় হতে পারে। কিন্তু ইয়াদান বিইয়াদিন অর্থ যদি পারস্পরিক বিনিময় হয়, তাহলে নাসীয়াহ অর্থ হবে পারস্পবিক বিনিময় না করা বা বিনিময় না দিয়ে নেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই অর্থেই পরিভাষা দু’টি ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয়। তবে নাসাঈীয়াহর সাধারণ অর্থ ঋণ, বাকি ক্রয়-বিক্রয়; ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই অর্থেই ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, সুদ কেবল ঋণের সাথে সম্পৃক্ত, নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে সুদ হয় না। পরবর্তীতে তিনি তাঁর এই মত প্রত্যাহার করেনে বলে জাবির (রা) জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ইবনে আব্বাস (রা) সুদ ও মুতআ বিয়ে সম্পর্কিত তাঁর মত থেকে প্রত্যাবর্তন করেন”। অনুরূপভাবে ইমাম হাকেমও বলেছেন যে, “ইবনে আব্বাস (রাঃ) পরবর্তীকালে সেই ফতোয়া থেকে তওবা ও ইস্তেগফার করেন এবং রিবা আল-ফদলকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে থাকেন। (সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৮, টিকা)। অবশ্য এ সম্পর্কে ভিন্নতর বর্ণনাও আছে। তবে এ কথা ঠিক যে, তাঁর অনুসারী সবাই তাদেঁর এ মত প্রত্যাহার করেছিলেন। ইয়াদান বিইয়াদিন বিষয়ে আলোচনায় এ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।}
ii. নাসীয়াহ
৯৫. আবূ সালেহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি আবূ সাঈদকে (রাঃ) বলতে শুনেছি। দীনারের বিনিময়ে দীনার এবং দিরহামের বিনিময়ে দিরহাম, মানে সমান সমান (মিসলান বিমিসলিন) বিক্রি করা যেতে পারে। কিন্তু যে কেউ বেশি নিল বা দিল সে সুদের কারবার করল”। আবূ সালেহ বলেন, “তখন আমি তাকে বললাম, ইবনে আব্বাস তো এর বিপরীত বলেন”। জবাবে আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন, “আমি ইবনে আব্বাসের সাথে সাক্ষাত করলাম এবং তাকে বললাম, “আপনি যে কথাটি বলছেন তা কি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাছে শুনেছেন, না মহান পরাক্রমশালী আল্লাহর কিতাবে পেয়েছেন?” উত্তরে তিনি বললেন, “এর কোনটিই নয়। আমি তা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছেও শুনিনি এবং আল্লাহর কিতাবেও পাইনি। বরং উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কেবলমাত্র বিনিময় না থাকলেই (নাসীয়াতে) সুদ হয়”। [মুসলিম, ১৫৯৬ (১০১); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৭, নং ৩৯৪২।]
৯৬. আতা ইবনে আবূ রাবাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ সাঈদ খূদরী (রাঃ) ইবনে আব্বাসের (রাঃ) সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি তাকেঁ জিজ্ঞেস করলেন, (মুদ্রা এবং দ্রব্য-সামগ্রীর) লেনদেন সম্পর্কে কি বলেছেন? আপনি কি তা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে শুনেছেন, না কি কিছু আল্লাহর কিতাবে পেয়েছেন?” উত্তরে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, “এর কোনটি আমি বলি না। আপনার তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে অধিক বেশি জানেন। আর আল্লাহর কিতাব তাও আমি অধিক বেশি জানি না। আমাকে বরং উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “জেনে রাখ! কেবলমাত্র বিনিময়হীনতার (নাসীয়াহ) সাথে সুদী লেনদেন সম্পৃক্ত”।[মুসলিম, ১৫৯৬ (১০৪); সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৯-৬০, নং ৩৯৪৫।]
৯৭. উবায়দুল্লাহ ইবনে ইয়াযীদ থেকে বর্ণিত। তিনি ইবনে আব্বাসকে (রাঃ) বলতে শুনেছেন, “উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) আমাকে অবিহিত করেছেন যে, নবী (সাঃ) বলেছেন, “কেবলমাত্র বিনিময়হীনতার (নাসীয়াহ) সাথে সুদী লেনদেন সম্পৃক্ত”।[মুসলিম, ১৫৯৬ (১০২)।]
৯৮. উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “বিনিময়হীন না হলে রিবা হয় না”। (বুখারী, কিতাবুল বুয়ূ, মুসলিম ও মুসনাদে আহমদ।)
৯৯. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই রিবা হচ্ছে বিনিময়হীন”।[মুসলিম, ১৫৯৬ (১০১)।]
iii. এক লেনদেন (deal) দুই দাম
১০০. ইবনে মাসূদ বলেন, “এক লেনদেনে দুই দাম সুদ জন্ম দেয়”।[২১]
১০১. আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে এক লেনদেনে দুই বিক্রয় করে তার উচিত কেবল মূলটা (Principal) গ্রহণ করা, অন্যথায় সে সুদ খায়”।[২২]
iv. বিশেষ
১০২. সাঈদ ইবনে যায়েদ থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কোন মুসলমানের মান-সম্মান হানিকর অন্যায় কিছু বলা হচ্ছে সর্বাধিক প্রচলিত ধরনের একটি”।(সুনানে আবূ দাঊদ)
৪. সুদের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত হাদীস
১০৩. জাবিন ইবনে আব্দূল্লাহ নবীর (সাঃ) বিদায় হজ্জের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) লোকদের সম্বোধণ করে বললেন, “জাহিলিয়্যাত যুগের সকল সুদ বাতিল করা হয়েছে। সর্ব প্রথম আমি আমাদের রিবা বাতিল করছি, তা হচ্ছে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের (নবী করীমের সাঃ চাচা) পওনা সুদ। তা সম্পর্ণ বাতিল করা হলো”।[মুসলিম: কিতাবুল হজ্জ, মুসনাদে আহমদ, উদ্ধৃত, চাপরা, এম, উমর, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৬।]
৫. সুদের ফলাফল ও পরিণতি সংক্রান্ত হাদীস
১০৪. আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, মানুষের জন্য অবশ্যই এমন একটি সময় আসবে যখন প্রত্যেকেই সুদ গ্রহণ করবে। আর কেউ যদি সুদ গ্রহণ না করে তাহলে সুদের ধুলা হলেও তার কাছে পৌছবে”।(আবু দাঊদ, ইবনে মাজাহ)
১০৫. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সুদ গ্রহণকারী ও সুদ প্রদানকারী উভয়কেই অভিসম্পাত করেছেন”। বলেন, “আমি বললাম এর লেখক ও সাক্ষীদ্বয়?” আব্দুল্লাহ (রাঃ) বললেন, “আমরা শুধু এতটুকু বলব যা শুনেছি”।[মুসলিম, ১৫৯৮ (১০৫)]
১০৬. জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সুদ গ্রহণকারী, সুদ প্রদানকারী, এর হিসাব (বা চুক্তিপত্র) লেখক এবং এর সাক্ষীদ্বয় সবাইকে অভিসম্পাত করেছেন। এরা সবাই সমান অপরাধী”।[মুসলিম, ১৫৯৮ (১০৬)]
১০৭. ইবনে মাসূদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “সুদের পরিমাণ যদি খুব বেশিও হয়, তাহলেও শেষ পর্যন্ত তা অতি নগণ্য ও তুচ্ছ হতে বাধ্য”।(ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ।)
১০৮. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সুদ (ভিত্তিক অর্থনীতি) সমৃদ্ধি আনে, কিন্তু সুদের চুড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে অভাব এবং সংকোচন”।(মুসনাদে আহমদ)
১০৯. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যিনা ও সুদ জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়”।(মুসনাদে আহমদ)
১১০. আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা (রাঃ) হতে বর্ণিত। “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, জেনে-শুনে সুদের একটি দিরহাম গ্রহণ করা ছত্রিশ বার যিনা করার চেয়েও জঘন্য”।[মিশকাত আল-মাসাবিহ, কিতাব আল-বুয়ু, বাবুর-রিবা, মুসনাদে আহমদ ও দারা কুতনি সূত্রে; উদ্ধৃত, চাপরা, এম উমর, উপরোক্ত, পৃ. ২৩৭।] বায়হাকি নিচে উল্লেখিত অংশসহ হাদীসটি শু’য়াব আল-ঈমানে উদ্ধৃত করেছেন, “অন্যায় ভক্ষণের দ্বারা যার শরীরে গোশত তৈরী হয়েছে তার জন্য দোযখই উপযুক্ত স্থান”।
১১১. আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মিরাজের রাতে আমি এমন কিছু লোকের দেখা পেলাম যাদের পেট ঘরের মত এবং পেটগুলো সাপে ভর্তি যা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিব্রাঈলকে (আঃ) জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা?” উত্তরে তিনি বললেন, “এরা হচ্ছে সেই সব লোক যারা সুদ গ্রহণ করত”।(ইবনে মাজাহ)
১১২. সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আজ রাতে আমি স্বপ্নে দু’জন লোককে দেখলাম, তারা আমার নিকট এসে আমাকে নিয়ে একটি পবিত্র ভূমিতে গেল। আমরা চলতে চলতে একটা রক্ত-নদীন তীরে পৌছেঁ গেলাম। নদীর মধ্যখানে একজন লোক দাড়িয়েঁ ছিল, আর নদীর তীরে একটি লোক দাড়িয়েঁ ছিল যার সামনে ছিল কিছু পাথর। এরপর নদীর মাঝে দাঁড়ানো ব্যক্তি তীরের দিকে অগ্রসর হলে তীরে দাঁড়ানো লোকটি তার মুখমণ্ডল লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করল এবং সে আগে যেখানে ছিল সেখানে ফিরে যেতে বাধ্য হলো। এভাবে যখনই যে উঠে আসার চেষ্টা করছে তখনই তীরের লোকটি তার মুখ লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারছে, যার ফলে সে (পূর্বস্থানে) ফিরে যাচ্ছে এবং পূর্ববৎ অবস্থান গ্রহণ করছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ লোকটি কে (কি কারণে তার এ শাস্তি হচ্ছে বা তার এ অবস্থা কেন)? তারা (আমার সাথের লোক দু’জন) বলল, নদীর মধ্যে দাঁড়ানো যে লোকটিকে দেখলেন, সে এক সুদখোর”।(সহীহ আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, কিতাবুল বুয়ূ, পৃ: ৩১৩-১৪, নং ১৯৪০)
১১৩. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “চার শেণীর লোককে আল্লাহ যুক্তি সঙ্গত কারণেই বেহেশতে প্রবেশ করতে দিবেন না। এমনকি বেহেশতের সুগন্ধও তারা পাবে না। যারা অভ্যাসবশত মদ পান করে, যারা সুদ খায়, যারা ইয়াতীমের সম্পদ অধিকার ছাড়া অন্যায়ভাবে ভোগ করে এবং যারা পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য অবহেলা করে”। (মসতাদরাক, আল-হাকিম)
১১৪. আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “রিবার সত্তরটি স্তর রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম মন্দটি হচ্ছে, নিজ মায়ের সাথে যিনা করার সমান”।(ইবনে মাজাহ)
১১৫. ইবনে মাসূদ সূত্রে হাকিম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “সুদের তিয়াত্তরটি ধরন রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম মন্দটি হচ্ছে, নিজ মায়ের সাথে যিনা করার সমান; মুসলিমদের মধ্যে যে সুদী কারবার করে সে পাগল”।(হাদীস)
১১৬. ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, “আল-কুরআনের সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াত হচ্ছে, রিবা সংক্রান্ত আয়াত”।[বুখারী, ভলি-৬, কিতাব-৬, নং ৬৭।]
১১৭. উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, “সুদ সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হয়েছে সর্বশেষে; আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ বিষয়ে আমাদের কাছে পুরোপুরি ব্যাখ্যা কারার পূর্বেই আল্লাহ তাঁকে নিয়ে গেছেন। সুতারাং তোমরা সুদ পরিত্যাগ কর আর যা সন্দেহজনক তাও পরিহার কর”।(ইবনে মাজাহ)
১১৮. উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যদি তিনটি বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা পেশ করতেন, তাহলে তা আমার কাছে পৃথিবী এবং তার মধ্যস্থিত যাবতীয় বস্তূ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হতো। বিষয় তিনটি হচ্ছে, কালালা, রিবা ও খিলাফা”।(সুনানে ইবনে মাজাহ)