পঞ্চম অধ্যায়: রিবা বা সুদ
সুদের অর্থ, সংজ্ঞা, শ্রেণীবিন্যাস ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে প্রথমে তদানীন্তন জাহেলী আরবে যে রিবা প্রচলিত ছিল, যে রিবা উচ্ছেদ করার জন্য আল-কুরআনের আয়াত নাযিল করা হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যে রিবা উচ্ছেদ করেছেন, সেই রিবার ধরন-প্রকৃতি জানা দরকার।
জাহিলী যুগে রিবা
সম্মানিত মুফাসসিরীনে কিরাম,ফক্বীহবৃন্দ, গবেষক, স্কলার ও অর্থনীতিবিদগণ ইসলামপূর্ব যুগে বিশেষ করে, আরব দেশে প্রচলিত সুদী লেনদেনের চিত্র তুলে এনেছেন। এতে দেখা যায়, সে যুগে ঋণ, দেনা, এমনকি নগদ ক্রয়-বিক্রয়েও রিবা লেনদেন হতো। নিচে তার কতিপয় তথ্য পেশ করা হলো:
বাকি ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে রিবা
ঋণ বা কর্দের ওপর রিবা
জাহিলী যুগে ঋণের ওপর যে রিবা লেনদেন করা হতো সে ব্যাপারে ফখরউদ্দীন আল-রাযি লিখেছেন, “জাহিলী যুগে আরবরা অর্থ ধার দিতো এবং এর ওপর মাসে মাসে নির্ধারিত পরিমাণ রিবা আদায় করতো, কিন্তু আসল পরিমাণটা পাওনা থেকেই যেতো। অতঃপর মেয়াদ শেষ হলে ঋণদাতা তার আসল ফেরত চাইতো। ঋণগ্রহীতা আসল ফেরত দিতে না পারলে ঋণদাতা পাওনার পরিমাণ বৃদ্ধির বিনিময়ে সময় বাড়িয়ে দিতো। এটাই ছিল জাহিলী যুগের রিবা যা তারা লেনদেন করতো”।আল-রাযি: আল তাফসীর আল কবীর, ভলি-৭ম তেহরান, পৃ: ৯১: উদ্ধৃত উসমানী, মুহাম্মদ তকি, পূর্বোক্ত, পৃ: ২৫।]
আবু বকর আল জাসসাস লিখেছেন, “আরবরা যে রিবার সাথে পরিচিত ছিল এবং যে রিবা লেনদেনে তারা অভ্যস্ত ছিল তা হচ্ছে, তারা নির্ধারিত মেয়াদের জন্য দিরহাম ও দীনার ঋণ দিতো এবং পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে প্রদত্ত ঋণের ওপর অতিরিক্ত ধার্য করতো”। তিনি আবার বলেছেন, “এটা সুপরিজ্ঞাত যে, জাহিলী রিবা ঋণের ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত, আর এই অতিরিক্ত ধার্য করা হতো প্রদত্ত মেয়াদের বিনিময়ে”।[আল-জাসসাস, আহকামূল কুরআন, ভলি-১, লাহোর, ১৯৮০, পৃ: ৪৬৫।]
ইবনে জরীর আল-তাবারি যায়েদের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, “জাহিলী যুগে কোন ব্যক্তি যদি কারও কাছ থেকে উট ধার করত, তাহলে মেয়াদ শেষে ঋণগ্রহীতার নিকট গিয়ে বলতো, ‘তুমি আমার পাওনা পরিশোধ করবে, না এর পরিমাণ বৃদ্ধি করবে’? যদি ঋণগ্রহীতার কাছে কিছু থাকত সে তা নিয়ে নিতো, অন্যথায় ঋণদাতা তার পাওনা বাড়িয়ে এর পরবর্তী বয়সের উটে উন্নীত করে দিত; প্রদত্ত উটটি বিনতে মাখাদ’ হলে দ্বিতীয় বছর সে বিনতে লাবুন দাবী করত, তার পরবর্তী বছর দাবী করত হিক্কাহ. এর পরে জাযাআহ,[[বিনতে মাখদ হচ্ছে, যে উষ্ট্রী শাবকের (মাদী) বয়স এক বছর পূর্ণ হয়ে দ্বিতীয় বর্ষ শুরু হয়েছে; বিনতে লাবুন- যে উষ্ট্রী শাবকের বয়স দুই বছর পূর্ণ হয়ে তৃতীয় বর্ষ শুরু হয়েছে; হিক্কাহ- যে উষ্ট্রী শাবকের বয়স তিন বছর পূর্ণ হয়ে চতুর্থ বছর শুরু হয়েছে এবং গর্ভ ধারণক্ষম হয়েছে; জাযাআহ- যে উষ্ট্রী শাবকের বয়স চার বছর পূর্ণ হয়ে পঞ্চম বর্ষ শুরু হয়েছে। (সুনানে আবূ দাঊদ, ২য় খণ্ড, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা-২০০৭, পৃ: ৪৪৬।)]], এর পরের বছর পরিশোধ না করলে সে চার বছর বয়সের উট দাবী করত এবং এভাবে উটের বয়স বাড়াতে থাকত। দেনা যদি ‘আইন’ (দীনার বা দিরহাম) হতো পাওনাদার দেনাদারের কাছে গিয়ে বলতো, তুমি পাওনা পরিশোধ কর অথবা পরবর্তী এক বছর মেয়াদের জন্য তা দ্বিগুণ কর। এভাবে পরিশোধ করা না হলে প্রতি বছরই পূর্ববর্তী বছরেরর পাওনার পরিমাণকে দ্বিগুণ করা হতো। পাওনা যদি ১০০ হতো, দ্বিতীয় বছর তা দুশো করা হতো। পরের বছর এই পরিমাণ পরিশোধ না করলে দ্বিতীয় বছর একে চারশোতে উন্নীত করা হতো; এভাবে দাতা হয়তার পাওনা আদায় করে নিতো অথবা প্রতি বছর এর পরিমাণ দ্বিগুণ করে ধার্য করে দিত”।[ইবনে জারীর আল-তাবারি: জামি আল বয়ান, ভলি-৪, পৃ: ৫৯; উদ্ধৃত: বাদাবী, যাকি আল-দ্বীন: Theory of Prohibited Riba; ইংরেজী অনুবাদ: ইমরান আহসান খান নিয়াজী, [email protected], ডিসেম্বর ৪, পৃ: ৩৮-৩৯।]
আল-মুয়াফাক্বাতে উল্লেখ করা হয়েছে, “জাহিলী রিবা এমন ছিল যার মাধ্যমে মেয়াদ শেষে ঋণ পরিশোধ করা না হলে মূল দেনাকে বৃদ্ধি করে বড় আকারের নতুন দেনা সৃষ্টি করা হতো”।[আল-শাতিবী, আবূ ইসহাক, আল-মূয়াফাক্বাত, ভলি-৪, পৃ: ৪০; পৃ: উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৯।]
এ প্রসঙ্গে ইমাম শওকানী লিখেছেন, “সেকালে লোকেরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদী কারবার করত; তারা একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সুদের ভিত্তিতে মূলধন লগ্নি করত। সেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে মূলধনকে বাড়িয়ে ধরা হতো সেই মেয়াদ পর্যন্ত প্রাপ্য সুদকে মূলধনের সাথে যোগ করে। অতঃপর এই বাড়তি মূলধনের ওপর সুদের হিসাব করা হতো। এভাবে যতবারই মেয়াদ বৃদ্ধি করা হতো ততবারই মূলধন ও সুদের হিসাব বাড়িয়ে ধরা হতো”।
আতা’র সূত্রে আল-তাবারি আরও একটি বর্ণনা লিখেছেন যে, “জাহিলিয়্যাতের যুগে বনি মুগীরা গোত্র বনি সাকিফ গোত্রের কাছ থেকে ধার নিতো। মেয়াদ শেষে বনি সাকিফ গোত্র বনি মুগীরাকে বলতো, ‘তোমরা যদি আমাদের পাওনা পরিশোধ বিলম্বিত কর,তাহলে আমারা তোমাদের দেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেবো”।[আল-তাবারি: পূর্বোক্ত, পৃ: ৫; দার আল-মানসুর, ভলি-২, পৃ: ৭১; উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৯-৪০।]
দেনার ওপর রিবা
তাবারি কাতাদাহর সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, “নির্ধারিত সময়ে দাম পরিশোধ করার শর্তে কোন ব্যক্তি অপর কারও কাছে বাকিতে পণ্য-সামগ্রী বিক্রয় করত’ মেয়াদ শেষে ক্রেতা বকেয়া দাম পরিশোধ করতো ব্যর্থ হলে সে তার দেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতো আর অপর পক্ষ মেয়াদ বৃদ্ধি করে দিতো”।[আল-তাবারি: পূর্বোক্ত, ভলি-৩, পৃ: ৬৭; উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ:৪১।] আল-যাহহাকের সূত্রে তিনি আরও লিখেছেন, “জাহিলী যুগে তাদের ক্রয়-বিক্রয় থেকে রিবা উদ্ভূত হতো”।[উপরোক্ত।]
সুয়ূতি তাঁর আল-দূররু আল মানসুরে মুজাহিদের সূত্রে বর্ণনা করেছন, “তারা (জাহিলী যুগের আরবারা) বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করতো। দেনা পরিশোধের মেয়াদ শেষে এক পক্ষ তাদের দেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দিত আর অপর পক্ষ পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি করে দিত”।[আল-সুয়ূতি: পূর্বোক্ত, ভলি-২, পৃ: ৭১; উদ্ধৃত, বাদাবী, উপরোক্ত, পৃ:৪০।]
সাঈদ ইবনে যুবায়ের থেকে ইবনে আবি হাতিম বর্ণনা করেছেন, “কোন ব্যক্তির দেনা পরিশোধের সময় হলে দেনাদার পাওনাদারকে বলতো, “আমার জন্য দেনা পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দাও, আমি তোমার পাওনার পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেবো”। তাদেরকে যখন বলা হতো যে, এটা তো রিবা; উত্তরে তারা বলতো, “বাকি বিক্রয়ের সময়ে দাম বাড়িয়ে ধরা হোক বা মেয়াদ শেষে দেনার পরিমাণ বাড়ানো হোক উভয় বৃদ্ধি তো একই”।[আল-সুয়ূতি: পূর্বোক্ত, ভলি-১, পৃ: ৩৬৫; উদ্ধৃত, বাদাবী, উপরোক্ত, পৃ:৪০-৪১।]
মুজাহিদের সূত্রে তাবারি আরও বলেছেন যে, “জাহিলী যুগে কোন ব্যক্তির যদি অন্য কোন ব্যক্তির কাছে কোন দেনা থাকতো, তাহলে মেয়াদান্তে দেনাদার পাওনাদারকে বলতো, তুমি আমার কাছে এই পাবে। আমাকে পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দাও, আমি আমার দেনার পরিমাণ এত এত বাড়িয়ে দেবো”।[আল-তাবারি; পূর্বোক্ত, ভলি-৩, পৃ: ৬৭; উদ্ধৃত, ইবিদ, পৃ:৩৯।]
সুয়ূতি লিখেছেন, “ইবনে আবি হাতিম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবনে যুবায়ের বলেছেন, এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির কাছে কোন সম্পদ পাওনা থাকলে, মেয়াদান্তে পাওনাদার দেনাদারকে তার পাওনা পরিশোধ করতে বলতো। দেনাদার বলতো, আমাকে সময় বাড়িয়ে দাও, আমি আমার দেনার পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেবো। তারা উভয়ে এতে সম্মত হয়ে যেতো। এটাই ছিল দ্বিগুণ, বহুগুণ রিবা”।[জালাল আল-দ্বীন আল-সুয়ূতি: আল-দুররে আল মনসুর, ভলি-২, পৃ: ৭১ উদ্ধৃত, বাদাবী, উপরোক্ত, পৃ:৩৯।]
এভাবে বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে প্রথমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হতো যা আসল দামের সাথে একীভূত হয়ে যেত। অতঃপর দেনাদার দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রতিবার মেয়াদ বৃদ্ধি করার বিনিময়ে দেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হতো যাকে নির্ধারিত কাউন্টার ভ্যালুর ওপরে বিনিময়হীন বৃদ্ধি বা রিবা বলা হতো। এজন্য আল-শাফিঈ, আল-বায়হাকি ও আল-জারকানির ন্যায় ফক্বীহও হাদীসবেত্তাগণ বলেছেন যে, জাহিলী যুগের রিবা হতো ক্রয়-বিক্রয় বাই থেকে।
নগদ ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে রিবা
ইতিহাস ও হাদীস থেকে জানা যায় যে, তদানীন্তন আরবে আরও কতিপয় রিবার লেনদেন প্রচলিত ছিল। আরবরা সচরাচর সেসব লেনদেন করত; কিন্তু সেটা যে রিবা তা তারা জানতো না এবং একে রিবা বলতো না। রাসূলূ্ল্লাহ (সঃ) সেসব লেনদেনকে রিবা বলে ঘোষণা করেছেন এবং সেরূপ লেনদেন না করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এরূপ লেনদেনের কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছেঃ
ক) সমজাতীয় মুদ্রা নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে রিবাঃ জাহিলী যুগে আরব দেশে মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত ছিল দীনার ও দিরহাম। দীনার হলো স্বর্ণমুদ্রা আর দিরহাম রৌপ্য মুদ্রা। আরবরা দীনারের পরিবর্তে দীনার এবং দিরহামের পরিবর্তে দিরহাম পরিমাণে কম-বেশি করে নগদ ক্রয়-বিক্রয় করত। তারা এরূপ করত মুদ্রার গুণ ও মানগত পার্থক্যের কারণে। এরূপ কেনাবেচার কথা হাদীসেও উল্লেখ আছে। ফাদালা ইবনে উবাইদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, “খাইবারের দিন আমরা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাথে ছিলাম। আমারা ইহুদীদের সাথে এক উকিয়া স্বর্ণ দুই অথবা তিন দীনারের বিনিময়ে কেনাবেচা করতাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, তোমরা সমান সমান ওজন ছাড়া স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করো না”। (মুসলিম) (চল্লিশ দিরহামের সমান ওজনকে এক উকিয়া বলা হয়।)
খ) সমজাতের পণ্য নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে রিবাঃ জাহিলী যুগে আরব দেশের লোকেরা কোন একজাতের নিম্নমানের পণ্যের সাথে একই জাতের উন্নত মানের পণ্য পরিমাণে কম-বেশি করে বিনিময় করত। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে, নিম্নমানের খেজুরের সাথে উন্নত মানের খেজুর বিনিময়ের উল্লেখ বেশ কয়েকটি হাদীসে পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে সুন্নাহর দৃষ্টিতে সুদ অধ্যায়ে সুদ সংক্রান্ত হাদীসের ক্রমিক নং ৭৫ থেকে ৮০ নম্বরে উদ্ধৃত হাদীসগুলো দ্রষ্টব্য।
গ) অসমজাতের পণ্য নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে রিবাঃ হাদীস থেকে জানা যায় যে. জাহিলী যুগে আরবরা নিলামে মাল বেচাকেনা করত। এ ব্যাপারে কখনও কখনও বিক্রেতার পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত দালাল মিথ্যা ডাক দিয়ে নিলামের পণ্যের দাম বাড়িয়ে ডাক দিতে বাধ্য হতো। এভাবে দাম আদায় করে নিত। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এভাবে বর্ধিত দামকে রিবা আখ্যায়িত করেছেন এবং মিথ্যা ডাকদাতাকে ‘অভিশপ্ত রিবা গ্রহীতা’ বলে নিন্দা করেছেন।(হাদীস নম্বর ৮৭ দ্রষ্টব্য)
এ ছাড়া সুপারিশের বিনিময়ে উপহার গ্রহণ, প্রতারণা করে দাম বেশি নেওয়া এবং অনবহিত লোককে ঠকানো হলে তাকেও রিবা বলা হয়েছে।হাদীস থেকে একথাও পাওয়া যায় যে, রিবার ৭০/৭৩ টি ধরন রয়েছে। (হাদীস নম্বর ১১৪-১১৫ এবং ৮৬-৯৮ দ্রষ্টব্য।)
উল্লেখিত তথ্যাবলী থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, ইসলাম পূর্ব যুগে আরবরা অর্থ (দিরহাম-দীনার), সোনা-রূপা, অন্যান্য পণ্য-সামগ্রী এমনকি উট দ্বারা ঋণ লেনদেন করত এবং ঋণের ওপর রিবা ধার্য করত। দ্বিতীয়ত, তারা ভিন্ন ভিন্ন জাতের অর্থ ও পণ্য-সামগ্রী বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করত। ক্রেতা নির্ধারিত সময়ে উক্ত দেনা পরিশোধ করতে না পারলে বিক্রেতা পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির বিনিময়ে তার পাওনার পরিমাণ বাড়িয়ে দিত। তৃতীয়ত, একই জাতের অর্থ বা পণ্য পরিমাণে কম-বেশি করে নগদ বেচাকেনা করা হলে সেই বৃদ্ধিকেও রিবা বলা হয়েছে। চতুর্থত, প্রতারণামূলক বর্ধিত দাম ও সুপারিশের পারিতোষিককেও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) রিবা ঘোষণা করেছেন। হাদীস থেকে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, রিবার আরও বহু ধরন চালু ছিল।
উক্ত তথ্যাবলী থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, ঋণ ও দেনার ওপর রিবা ধার্য ও লেনদেন করার পদ্ধতি ও রূপও ছিল বিভিন্ন।
প্রথমত, ঋণদাতা ঋণ প্রদানের সময়ই তার পাওনার ওপর অতিরিক্ত দাবী করত এবং ঋণগ্রহীতা অতিরিক্ত দিতে রাজী হলে ঋণদাতা উক্ত বর্ধিত পরিমাণসহ ঋণ ফেরতের শর্তে ঋণ প্রদান করত। অতঃপর নির্ধারিত সময়ে অতিরিক্তসহ দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণদাতা তার মোট পাওনার (কাউন্টার ভ্যালু=অতিরিক্ত) ওপর আবার অতিরিক্ত ধার্য করে সময় বাড়িয়ে দিত।
দ্বিতীয়ত, ঋণদাতা মাসিক ভিত্তিতে অতিরিক্ত ধার্য করত এবং মাসে মাসে তা আদায় করত। আর ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত আসল পাওনার পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকত। অতঃপর মেয়াদান্তে ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে আবারও মাসে মাসে অতিরিক্ত পরিশোধের শর্তে ঋণদাতা ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দিত।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, “সকল প্রকার সুদী লেনদেনের সাধারণ যে বৈশিষ্ট্য ছিল তা হচ্ছে, দেনার আসলের ওপর একটি অতিরিক্ত পরিমাণ (ফদল) ধার্য করা। দেনা কখনও বাকি ক্রয়-বিক্রয় থেকে সৃষ্টি হতো, কখনও বা ঋণ বা কর্জ থেকে দেনা সৃষ্টি হতো। সব ক্ষেত্রেই বর্ধিত অতিরিক্ত অংশকে বলা হতো রিবা। কারণ, রিবা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি (ফদল)”।[উসমানী, মোহাম্মদ তকি: পূর্বোক্ত, পৃ: ২৮।] এমনকি, সমজাতের ও অসম জাতের নির্ধারিত দামের ওপর বর্ধিত অংশকেও বলা হয়েছে রিবা।
এতে আরও লক্ষণীয় যে, এই বৃদ্ধি ধার্য করা হতো ঋণগ্রহীতা বা দেনাদারের দেনার ওপর যার বিনিময়ে পাওনাদার দেনাদারকে কিছুই দিতো না; অর্থাৎ রিবা হচ্ছে বিনিময়হীন।
আর বিনিময় ছাড়া এই অতিরিক্ত (ফদল) দেনাদার পরিশোধ করতে বাধ্য হতো শুধুমাত্র তার সম্মতির কারণে। ঋণদাতা বা বাকি বিক্রেতা অীতরিক্ত দাবী করতো, ঋণগ্রহীতা বা বাকি ক্রেতা সম্মত হতো। এভাবে তাদের মধ্যে অতিরিক্ত ধার্য ও লেনদেনের চুক্তি হয়ে যেতো। এই চুক্তি হচ্ছে রিবার উৎস। রিবার ওপর ঋণদাতার অধিকার সৃষ্টি হতো চুক্তি বলে; আর ঋণগ্রহীতা রিবা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতো এই চুক্তির কারণেই (তার সম্মতির কারণ)।
সুতরাং ‘রিবার মৌলিক যে বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেল তা হচ্ছেঃ
তদানীন্তন রিবার বৈশিষ্ট্য
ক) নির্ধারিত মূল্যের ওপর (বাকি বা নগদ) বৃদ্ধি ধার্য করা;
খ) অপরপক্ষ এই বৃদ্ধির বিনিময় বা প্রতিমূল্য না দেওয়া; এবং
গ) ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষ এতে সম্মত হওয়া (চুক্তি করা)।
রিবার অর্থ, সংজ্ঞা, শ্রেণীবিন্যাস ও বৈশিষ্ট্য
রিবার অভিধানিক অর্থ
নির্ভরযোগ্য অভিধানসহ আল-কুরআনের তাফসীরকার, হাদীস বিশারদ, ফিক্বাহবিদ, স্কলার ও অর্থনীতিবিদ সকলেই একমত যে, রিবা শব্দের অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, বাড়তি, অতিরিক্ত, উদ্ধৃত্ত (surpls), বেশি, সম্প্রসারণ, প্রবৃদ্ধি, উচু হওয়া, ফুলে উঠা, লাভ (gain), বহুগুণ হওয়া, ছাড়িয়ে যাওয়া, পাওনার চেয়ে বেশি নেওয়া, একদিকে বৃদ্ধি অন্যদিকে বৃদ্ধি ছাড়াই ইত্যাদি।
বিখ্যাত আরবী অভিধান লিসান আল-আরব রিবার শাব্দিক অর্থ লিখেছে, “বৃদ্ধি, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ ও প্রবৃদ্ধি”। [ইবনে, মনযুর, লিসান আল-আরব, ১৯৬৮।] আল যাবিদি তাঁর তাজ আল-আরুস এবং ইমাম রাগিব আল ইস্পাহানি তাঁর মুফারাদাত আল-কুররতানও রিবার এই একই অর্থ লিখেছেন। এছাড়া প্রাচীন তাফসীরকারদের সকলেই রিবার অনুরূপ অর্থ করেছেন।[চাপরা, এম, উমর, Prohibition of Interest: Does it Make Sense? Islamic Dawah Movement (IDM) Publications, Southern Africa, 2001, p. 2, Foot note-3.]
Advanced-Learner Dictionary-তে (1989:564) রিবা শব্দের অর্থ লিখা হয়েছে, · “excess, addition and surplus” “মাত্রাতিরিক্ত, অতিরিক্ত সংযোজন, উদ্বৃত্ত”। আর ক্রিয়াপদে এর অর্থ করা হয়েছে, “to increase, to exceed, to exact more than was due, to practise usury.” [উদ্ধৃত, সিদ্দিকী, শহী, হাসান, Riba, Usury and Interest- Historical and Quranic Concept, Journal of Islamic Banking and Finance, Oct.-Dec., 1993, p. 44.] “বৃদ্ধি করা; মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া, পাওনার চেয়ে বেশি আদায় করা, সুদ খাওয়া”।
Lane’s Lexicon রিবার অর্থ লিখেছে, “to increase, to augment, swelling, forbidden, addition, to take more than what is given, the practising or taking of usury or the like, an excess, or an addition, an addition over and above the principal sum (that is lent or expended).”[Lane’s Lexicon 1874; উদ্ধৃত, ইবিদ।] “বৃদ্ধি করা, বাড়ানো, স্ফীত করা, নিষিদ্ধ-বিআইনী, অতিরিক্ত, সংযোজন, যা প্রদান করা হয়েছে তার চেয়ে অধিক গ্রহন করা, সুদ খাওয়া বা সুদ গ্রহণ করা অথবা অনুরূপ, অতিরিক্ত, বাড়তি সংযোজন, মূল পরিমাণের (যা ধার দেওয়া হয়েছিল বা ব্যয় করা হয়েছিল) ওপর অতিরিক্ত সংযোজন”।
আল্লামা মওদূদী বলেছেন যে, “রিবা শব্দের মূলে আছে আরবী ভাষার (রা’-বা-ওয়াও’) এই তিনটি হরফ। কুরআন মজীদে এই মূল থেকে নির্গত শব্দাবলী যত জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে সেই সকল স্থানেই এ থেকে বৃদ্ধি, উচ্চতা, বিকাশ ইত্যাদি অর্থ পাওয়া যায়”।[মওদূদী, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং, বাংলা অনুবাদ, আব্দুল মান্নান তালিব ও আব্বাস আলী খান, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ: ৮৪।] এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের শরীয়াহ আপীলেট বেঞ্চের ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয়েছে, “In the Quran, the word signifies ‘to rise’, ‘at a height’, ‘to increase’, ‘to prosper’, ‘to swell’, ‘tonurture’, ‘to raise’, ‘to grow’, and ‘augmentation’ or ‘increase in power’.” “আল-কুরআনে শব্দটি ওপরে উঠা, উচ্চতা, বৃদ্ধি করা, উন্নতি করা, স্ফীত হওয়া, পুষ্ট করে তোলা, উঁচু করা, বড় হওয়া এবং বাড়ানো বা শক্তি বেশি হওয়া ইত্যাদি অর্থ বুঝানো হয়েছে”। আবার বলা হয়েছে, “Federal Shariat Court records that the term riba, in its various linguistic forms, occurs. at about twenty places in the Quran.”[ Sharia Law Report, February, 2000, Lahore, Vol. 01, No. 02, Pakistan, p. 10] “ফেডারেল শরীয়ত আদালত লিখেছে যে, ভাষাগত বিভিন্ন রূপে রিবা শব্দটি কুরআন মজীদে বিশটির মত স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে”। নিম্নে এর কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হলোঃ
১. “যখন আমারা তার ওপর পানি বর্ষন করলাম তখন তা সতেজ হলো ও ফুলে উঠলো (রাবাত)”।(সূরা আল-হজ্জ-২২:৫)
২. “আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং সাদাকহকে ক্রমবৃদ্ধি (ইউরবি) দান করেন”।(সূরা আল-বাকারাহ- ২:২৭৬)
৩. “আবার যখন প্লাবন আসলো তখন উপরিভাগে (রাবিয়ান) ফেনাও জেগে উঠলো”।(সূরা আল-রায়াদ-১৩:১৭)
৪. “যেন এক জাতি অপর জাতি অপেক্ষা অগ্রসর (আরবা) হয়ে যায়”।(সূরা আল-নাহল- ১৬:৯২)
৫. “তিনি তাদেরকে কঠোর-কঠিনভাবে (রাবিয়াতান) পাকড়াও করলেন”।(সূরা আল- হাক্কাহ্- ৬৯:১০)
৬. “এবং তাদেরকে (মরিয়ম ও ঈসা) একটি উচ্চ স্থানে (রাবওয়াতেন) আশ্রয় দিলাম”।(সূরা আল-মুমিনুন-২৩:৫০)
৭. “লোকদের অর্থের সাথে শামিল হয়ে বৃদ্ধি (ইউরবি) পাবে এজন্য তোমরা যে সুদ দাও, তা আল্লাহর কাছে বাড়ে (ইয়ারবু) না”।(সূরা আল-রূম-৩০:৩৯)
উদ্ধৃত আয়াতসমূহে ব্যবহৃত শব্দাবলী থেকে তিন ধরনের বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যায়ঃ ১) নিজ পরিমাণে বৃদ্ধি, ২) তুলনামূলক বৃদ্ধি এবং ৩) মানগত বৃদ্ধি। সামি হামুদ বলেছেন, “এই বৃদ্ধি খাটিঁ ভাষাগত অর্থে কোন বস্তুর নিজ পরিমাণ বেড়ে যাওয়া হতে পারে, অথবা দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনামূলকভাবে একটির পরিমাণ অপেক্ষা অপরটির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া হতে পারে, অথবা গুণ-মানের তুলনায় একটি বস্তু অপর একটি বস্তু হতে উন্নততর হওয়াও অর্থ হতে পারে”।[Sami Hamaud (1985), Islamic Banking, Arabian Information, London, p. 67, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পুর্বোক্ত, পৃ: ২১।]
ইমাম আল-ওয়াহিদী ওপরে ১ নম্বরে উল্লেখিত আয়াত ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, এখানে মাটি ‘ফুলে-উঠলো’কে ‘রাবাত’ বলা হয়েছে। এ রাবাত থেকে মাটির নিজস্ব আকৃতি সম্প্রসারিত ও বৃদ্ধি পাওয়া অর্থ পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে ২ নম্বরে উল্লেখিত আয়াতে ‘ইউরবি’ শব্দ দ্বারা যাকাতের নিজস্ব পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া বুঝানো হয়েছে। অজর জাতি সংখ্যায় বেশি এবং মানে উন্নততর হওয়া বুঝা যায়। এখানে পরিমাণগত ও মানগত উভয় বৃদ্ধিকেই বুঝানো হয়েছে।[M. AI-Sharaf AI-Nawawi, al-Talzzib At-Asthma Walluglzat; Section-2, Vol. 1, p. 118, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পুর্বোক্ত, পৃ:২১।] এ প্রসঙ্গে আল-তাবারি বলেছেন, আরবীতে সাধারণত বলা হয় যে, অমুক ব্যক্তি অমুকের চেয়ে ভাল (আরবা); এই বাক্যে ‘আরবা’ শব্দ দ্বারা মানগত অগ্রসমতার কথাও বুঝানো হয়।[উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ:৩৪।] তৃতীয়ত, ৫ নম্বরে উল্লেখিত আয়াতে ব্যবহৃত ‘রাবিয়াতান’ শব্দ দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা অন্যান্য অপরাধীদের শাস্তির তুলনায় ফেরাউনের শাস্তি যে অধিক কঠিন ও কঠোর ছিল তাই বুঝিয়েছেন।[M. AI-Sharaf AI-Nawawi, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ:২১।] এ প্রসঙ্গে আল-তাবারি বলেছেন যে, পাহাড়কে ‘রাবিয়া’ বলা হয়; কারণ পাহাড় ভূমির চেয়ে উচ্চতায় বড়।[আল-তাবারি: আল-হাক্ব, আয়াত ১০, ভলি-১২, পৃ: ৩৪, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর পূর্বোক্ত, পৃ:২২।]
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাদীসেও রিবা শব্দের এইরূপ বিভিন্ন দিক থেকে বৃদ্ধি অর্থ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, এক হাদীসে কতিপয় সাহাবী বর্ণনা করেছেন যে, “একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেঁর খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। তাঁরা যখন খাচ্ছিলেন তখন দেখলেন, খাদ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁদের মধ্য একজন সাহাবী উল্লেখ করেছেন যে, পাত্র থেকে যে পরিমাণ খাবার তুলে নেওয়া হচ্ছিল, নিচ থেকে খাবার বৃদ্ধি পেয়ে তত পরিমাণ আবার পূরণ হচ্ছিল”।[আল-বুখারী, মুয়াক্বিত, পৃ: ৭৯; উদ্ধৃত, ই, এম, নূর; পূর্বোক্ত, পৃ: ২১।] উক্ত সাহাবী এখানে ‘রাবা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং এর দ্বারা খাদ্যের নিজস্ব পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে বুঝিয়েছেন। অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আল-ফেরদৌস হচ্ছে আল-রাবওয়াহ”।[উদ্ধৃত, ই, এম, নূর; পূর্বোক্ত, পৃ: ২১।] এখানে রাবওয়াহ শব্দ দ্বারা জান্নাতের অন্যান্য স্থানের তুলনায় ফেরদৌসের উত্তম ও সর্বোচ্চ হওয়া বুঝানো হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, রিবা শব্দের অর্থের মধ্যে উপরোক্ত তিন ধরনের বৃদ্ধিই সন্নিহিত আছে। অর্থাৎ রিবা অর্থ বৃদ্ধি; এই বৃদ্ধি পরিমাণগত হতে পারে, মানগত হতে পারে; বস্তুর নিজ পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া হতে পারে, আবার অপর বস্তুর তুলনায় পরিমাণ ও গুণগতভাবে বৃদ্ধি পাওয়াও এর অর্থ হতে পারে।
অপরাপর ভাষায় রিবার প্রতিশব্দ
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্হে ব্যবহৃত প্রতিশব্দ থেকেও রিবার এই একই অর্থ পাওয়া যায়। শ্রদ্ধেয় মুফাসসিরদের অনেকেই বলেছেন যে, ইহুদীদের ওপর যে রিবা নিষিদ্ধ ছিল তা তদানন্তীন আরবে প্রচলিত রিবার অনুরূপ ছিল। আল-তাবারি ইহুদীদের জন্য নিষিদ্ধ রিবার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, “তারা (ইহুদীরা) যে রিবা গ্রহণ করতো তা ঋণের আসল পরিমানের ওপর অতিরিক্ত হিসেবে ধার্য করা হতো”।[আল-তাবারি, জামি আল-বয়ান, ভলি-৬, পৃ:১৭; উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭৮।]…. ঋণ ও ক্রয়-বিক্রয় থেকে সৃষ্ট দায়ের ওপর ধার্য করা হতো”।[বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭৯-৮০।]
বাদাবী এ প্রসঙ্গে বনি ইসরাঈলদের মধ্যে প্রচলিত রিবা (তাওরাতে নিষিদ্ধ রিবা) এবং জাহিলী যুগে প্রচলিত (আল-কুরআনে নিষিদ্ধি) রিবার তুলনা করে দেখিয়েছেন যে, উভয় রিবা ছিল এক ও অভিন্ন। তিনি বলেছেনঃ
“আল-কুরআন সেই রিবাকেই নিষিদ্ধ করেছে যা ইহুদীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আর আজও ইহুদীদের মধ্যে সেই রিবাই চালু রয়েছে; কারণ প্রাচীনকালে রিবার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য যা ছিল এখনও তাই আছে-এতে কোন পরিবর্তন হয়নি। এভাবে ইহুদীদের মধ্যে বর্তমান যে রিবা চালূ আছে তা হচ্ছে, ঋণের ওপরে সময়ের ভিত্তিতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত, যদিও রিবার হারে পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং আল-কুরআন যে রিবাকে নিষিদ্ধ করেছে তা অতি প্রাচীনকাল থেকেই পরিচিত ছিল”। গবেষকগণ পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ধর্মগ্রন্হসমূহে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দ/পরিভাষায় অর্থের সাথে রিবার অর্থের মিল থাকার কথাও তুলে ধরেছেন।
এক্সোডাস ও ডিটারোনমিতে বাইবেলীয় হিব্রু ভাষায় সুদকে বলা হয়েছে ‘নেশখ’; আর লেভিটিকাসে ‘টারবিট’ বা ‘মারবিট’ শব্দের সাথেই ‘নেশেখ’ শব্দ বসানো হয়েছে।[বাদাবী, উপরোক্ত, মাহবুব উল হাসান, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭৫।] “নেশখ অর্থ হচ্ছে gain যা অর্থ, পণ্য-সামগ্রী বা যে কোন প্রকার সম্পদ-সম্পত্তি ঋণ দিয়ে তার ওপর অর্জন করা হয়”। [Siddiqui, Dr. Shahid Hasan, Riba, Usury and Interest – Historical & Quranic Concept, Journal of Islamic Banking & Finance, Vol. 10, No. 04, OctoberDecember 1993, p. 44.] এনসাইক্লোপেডিয়া জুডাইকায় নেশেখের অর্থ করা হয়েছে ‘bite’ আর শব্দটি সুদ খাওয়া অর্থে ব্যবহার করা হতো।[Cohn. H. Harvey, USURY: Encyclopedia Judaica, Jerusalem: Keter Publishing House, p. 17. উদ্ধৃত করেছেন, Mehboob ul Hassa, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭৫।]
রিবার ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে Interest ও Usury. Interest মধ্য যুগীয় ল্যাটিন শব্দ Interesse থেকে নির্গত হয়েছে। আর ল্যাটিন শব্দ usura থেকে এসেছে Usury।[ Qureshi. A. Iqbal, Islam and the Theory of Interest, Lahore: Ashraf Publication, 1991, p. 2.Intersse অর্থ হচ্ছে আসলের ওপর বৃদ্ধি। Usura মানে হচ্ছে প্রদত্ত ঋণ থেকে অর্জিত উপভোগ (enjoyment); ক্যানন ল’তে এর মান হচ্ছে অর্থ ধার দিয়ে তার বিনিময়ে আসল পাওনার ওপর অতিরিক্ত গ্রহণ করা।[Cohn, H. Harvey, পূর্বোক্ত।] Encyclopaedia of Religions and Ethics- এ বলা হয়েছে Usury ও lnterest শব্দ দুটি এক ও অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হতো”।[উদ্ধৃত করেছেন, সিদ্দিকী, শহীদ হাসান, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৪।]
এতে আরও বলা হয়েছে যে, অতীতে কখনও ইউসারীকে আধুনিক কালের ন্যায় উচ্চ হারের ইন্টারেস্ট অর্থে ব্যবহার করা হতো না। The New Encyclopaedia Britannica-য় যুক্তরাজ্যে প্রচলিত পূর্বতন আইন অনুসারে ইউসারীর অর্থ হচ্ছে অর্থ ব্যবহারের ক্ষতিপূরণ, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কম-বেশি যাই হোক”। Encyclopaedia Americana-International Edition ( 1970)- এ বরা হয়েছে, “ইন্টারেস্ট হচ্ছে অর্থ ব্যবহারের মূল্য (Charge)। মধ্য যুগের শেষ নাগাদ ঋণের ওপর আরোপিত যে কোন পরিমাণ অতিরিক্তকেই সাধারণত ইউসারী গণ্য করা হতো”। Encyclopaedia Americana-য় বলা হয়েছে “পূর্বে(previously) ইউসারী বলা হতো ইন্টারেস্টকে যা ঋণদাতাকে তার ক্ষতিপূরণ করা বাবত দেয়া হতো। অপরদিকে, অর্থ (বা কোন ফাঞ্জিবল পণ্য) ব্যবহারের বিনিময় হিসেবে প্রদত্ত মূল্যকে বলা হতো ইউসারী”। এভাবেই মূলতঃ (Originally) ইউসারী শব্দ দ্বারা ইন্টারেস্টের ভিত্তিতে ঋণ লেনদেন করাকেই বুঝাতো এবং সংস্কার আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত অর্থ ব্যবহারের বিনিময়ে গৃহীত কম-বেশি যে কোন পরিমাণ ইন্টারেস্টকে ইউসারী বলা হতো। সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, মূল অর্থের দিক থেকে ঋণের ওপর ধার্যকৃত ইন্টারেস্টই হচ্ছে ইউসারী, ইউসারী ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেকালে সকল ইন্টারেস্টকে ইউসারিায়াস বলে গণ্য করা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটলে ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং ইউসারীর সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা অপরিহার্য মনে করা হয়। ফলে ১৩শ শতকে যুক্তরাজ্যে সুদকে বৈধ করে আইন প্রণয়ন করা হয় এবং আইন দ্বারা বৈধকৃত এই সীমা পর্যন্ত ইউসারী হারকে ইন্টারেস্ট নাম দেওয়া হয়। সূত্র ধরেই The Concise Oxford Dictionary- তে উচ্চ হারের ইন্টারেস্টকে ইউসারী বলা হয়েছে। তাদেঁর প্রদত্ত ইউসারী সংজ্ঞা হচ্ছে, “the practice of lending money at exorbitant interest, especially at higher interest than is legal.” “অতি উচ্চ সুদের হারে অর্থ ধার দেওয়া, বিশেষ করে বৈধ হারের চেয়ে উচ্চতর সুদের হারে”। The New Encyclopaedia Britannica-য় ইন্টারেস্টের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ইন্টারেস্ট হচ্ছে “ঋণ অথবা অর্থ ব্যবহারের বিনিময়ে প্রদত্ত দাম”। আর ইউসারীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “মধ্য যুগের ন্যায় আর্থিক ঋণের ওপর অতি উচ্চ হারে ইন্টারেস্ট ধার্য করা হচ্ছে ইউসারী। মূলতঃ অতীতে সকল হারের ইন্টারেস্টকেই ইউসারিয়াস গণ্য করা হতো, কিন্তু ১৩শ শতকে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের সাথে সাথে ইউসারীকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা জরুরী হয়ে উঠে”।
সুতরাং ইন্টারেস্ট ও ইউসারীর মধ্যে মৌলিকভাবে কোন পার্থক্য কখনো ছিল না এবং নেই। ব্রিটিশ আইনে এতদুভয়ের মধ্যে যে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেটাও কেবল হারের পার্থক্য, চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যগত কোন পার্থক্য নয়।
সুদ শব্দটি এই একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আল্লামা মওদূদী লিখেছেন, “কুরআন মজীদে সুদের প্রতিশব্দ হিসেবে রিবা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে”।[মওদূদী, প্রাগুক্ত, পৃ: ৮৪।] সুদ অর্থ হচ্ছে ঋণ দিয়ে আসলের ওপর অতিরিক্তকে বুঝায়।[বাদাবী, যাকি আল-দ্বীন, পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৪।]
সুতরাং ব্যুৎপত্তি ও শব্দার্থের দিক থেকে রিবা, নেশেখ, টারবিট, মারবিট, ইন্টারেস্ট, ইউসারী ও সুদ সব কটি শব্দ সমার্থবোধক। “Riba, Usury and Interest, therefore, have one and the same meaning and have a common factor of pre-determined positiveness.”[সিদ্দিকী, শহীদ হাসান, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৭।] “সুতরাং রিবা, ইউসারী ও ইন্টারেস্ট এসব কয়টি শব্দর অর্থ এক ও অভিন্ন। আর এদের সবকয়টিরই একটি সাধারণ উপাদান রয়েছে; তা হচ্ছে, পূর্বনির্ধারিত ধনাত্মক বৃদ্ধি”। পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, “Biaj, neshec, sood, Interest, Usury or riba, whatever name be ascribed to an ‘increase’, ‘addition’, ‘excess’, or ‘gain’, accruing on the principal amount loaned, the notion is practically as old as civilization itself. Essence of the transaction has be.en and remains a fixed or pre-determined and thus predictable, return for the use of money lent or advanced in a purely time related arrangement” [শরীয়ত ল’ রিপোর্টস, লাহোর ফেব্রূয়ারী, ২০০০, পৃ: ৭।]
“বিয়াজ, নেশেখ, সুদ, ইন্টারেস্ট, ইউসারী বা রিবা যে নামই দেওয়া হোক, ঋণের আসলের ওপর বৃদ্ধি, সংযোজন, অতিরিক্ত বা লাভের ধারণা আদিকাল থেকে চলে আসছে। বস্তুতঃ মানব সভ্যতা যত পুরাতন এই ধারণাটিও ততই প্রাচীন। এরূপ লেনদেনের অপরিহার্য উপাদান আগে যা ছিল আজও তাই আছে। সেটা হলোঃ ঋণ বা অগ্রিম হিসেবে প্রদত্ত অর্থ ব্যবহারের বিনিময়ে নিখাদ সময়ের ভিত্তিতে পূর্বাহ্ণে স্থিরীকৃত বা নির্ধারিত এবং সেহেতু সুপরিজ্ঞেয় আয়”।
রিবার পারিভাষিক অর্থ
রিবার শব্দার্থ তথা আভিধানিক অর্থের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধে পূর্ণ ঐকমত্য রয়েছে; কিন্তু রিবার পারিভাষিক বা টেকনিক্যাল অর্থ নিয়ে তাপসীরকার, হাদীসবিশারদ, ফিক্বাহবিদ, বিশেষজ্ঞ স্কলার ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন মাযহাবে রিবাকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আর এর ফলে আল-কুরআনে বর্ণিত রিবা এবং হাদীসে বর্ণিত রিবা ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে রিবার আভিধানিক অর্থ এবং এর পারিভাষিক অর্থের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে; এমনকি, এক সংজ্ঞার সাথে অপর সংজ্ঞার এমন অসংগতি সৃষ্টি হয়েছে যে, যে কোন লোকের পক্ষে দুই পরস্পর বিরোধী ধারণার সম্মুখীন হয়ে হতবুদ্ধি হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কেউ কেউ আবার এমনভাবে রিবাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন যে, রিবা নাসীয়াহ সংজ্ঞার আওতায় এলেও রিবা ফদল সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয়েছে; তারা আবার ইন্টারেস্ট ও ইউসারীরর যে অর্থ, হুবহু সেই একই অর্থে রিবাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কোন কোন সংজ্ঞায় আবার রিবার আওতা-পরিধি এত ব্যাপকতা পেয়েছে যে, যা রিবা নয় তাও এর আওতায় এসে গেছে। যা হোক, এতসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এ লেখার সম্ভব নয়। এখানে কেবল বিশিষ্ট ফক্বীহদের সংজ্ঞা এবং তার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে।
রিবার সমন্বিত সংজ্ঞা
ফিক্বাহ ও বিশেষজ্ঞগণ রিবার যেসব সংজ্ঞা দিয়েছেন তন্মধ্যে ইমাম সারাখসী এবং তাঁর সাথে অপর কতিপয় ফক্বীহর প্রদত্ত সংজ্ঞাকেই সর্বব্যাপী, উত্তম ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা বলা যায়। তাঁরা রিবার অর্থ করেছেন অতিরিক্ত, বৃদ্ধি excess (ফদল), বিনিময়হীন বৃদ্ধি, excess without counter value, একদিকে বৃদ্ধি অপরদিকে বৃদ্ধি ছাড়াই ইত্যাদি। তাদেঁর মতে, “ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতিমূল্য (counter value) নাই এমন প্রতিটি বৃদ্ধিই হচ্ছে রিবা”।[সারাখসী, আল-মাবসুত, ভলি-১২, পৃ: উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৬৩-১৬৪] হানাফী মাযহাবের ফক্বীহ ইমাম সারাখসী সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “riba in Shariah is the stipulated excess in one of the two counter values without counter value in transaction of exchange (bay)”[সারাখসী, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৬৪।] অর্থাৎ “শরীয়তে রিবা হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়ে দুটি প্রতিমূল্যের কোন একটির ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত (ফদল) যার কোন বিনিময় নেই”। আল নিহায়া ফী শরহি হিদায়া-তে বলা হয়েছে, “Riba is a specific increase entitled to either party without counter value”[আল-নিহায়া ফী শরহি হিদায়া, ভলি-২, পৃ:৫২৪; উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ৩১।] অর্থাৎ “রিবা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট বৃদ্ধি যা কোন এক পক্ষ অপর পক্ষকে কাউন্টার ভ্যালু না দিয়েই গ্রহণ করে।
মালিকী মাযহাবের প্রখ্যাত ফক্বীহ ইবনে আরবী বলেছেন, “every increase which is without an ‘iwad’ or an equal counter value is riba” অর্থাৎ “বদলা বা সমান প্রতিমূল্য দেওয়া হয় না এমন প্রত্যেক বৃদ্ধিই রিবা”। তিনি আরও লিখেছেন, “riba literally means an increase and in the Qtir’ anic verse riba is meant every kind of increase ‘Ziadah’ in an exchange which is without an equivalent counter value or return ‘iwad.”[ইবনে আরবী, আহকামূল কুরআন, ভলি-১, প্রথম সংস্করণ, ১৯৫২, পৃ: ২৪১, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৬৪।] অর্থাৎ “রিবার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, আর কুরআনের আয়াতে রিবা দ্বারা ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৃদ্ধি ‘যিয়াদা’-কে বুঝানো হয়েছে যার সমমূল্যের কোন কাউন্টার ভ্যালূ বা বিনিময় ‘ইওয়ায’ নাই”।
এ ব্যাপারে সানআনী লিখেছেন, “riba literally means any ‘fadal’ or excess which by stipulation does not bring any ‘iwad’ or any equivalent return to the other party in a contract of ‘muawada’ barter or exchange of commodities.and services.”[সানআনী, সুবুস সালাম, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৬৪।] অর্থাৎ “ভাষাগত অর্থে রিবা হচ্ছে ফদল বা অতিরিক্ত যা মুয়াবাদ বার্টার বা পণ্য-সামগ্রী ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির শর্ত অনুসারে অপরপক্ষের জন্য কোন বদলা (ইওয়ায) বা সমমূল্যের প্রতিদান বয়ে আনে না”।
সম্প্রতি এস. এ. চৌধুরীও রিবাকে একটি সাধারণ পরিভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ে মূল্যের ওপরে অতিরিক্তকে রিবা বলেছেন। তাঁরা ভাষায়, “riba is a generic Quranic terminology for all kinds of excess above the value of a thing.”[ M. A. Chowdhury, Riba, Financial Interest, Foundation for Islamic Economics, পৃ: ১০৩, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৫।] “রিবা হচ্ছে সামগ্রিক অর্থজ্ঞাপক একটি কুরআনী পরিভাষা জিনিসের মূল্যের ওপর আরোটিত সকল প্রকার অতিরিক্তকে বুঝায়”। ই, এম, নূরের মতে, এই সংজ্ঞানুসারে মূল্যের ওপর যে কোন বৃদ্ধি বা প্রবৃদ্ধিই হচ্ছে রিবার আওতাভূক্ত।[ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৫।]
উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রিবা উদ্ভুত হওয়ার ক্ষেত্র হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়। দুটি একজাতের অর্থ, পণ্য বা সেবা বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করলে স্থগিতকৃত কাউন্টার ভ্যালু হয় ঋণ, ঋণের ওপর সময়ের ভিত্তিতে ধার্যকৃত বিনিময়হীন (মাগনা) অতিরিক্তকে বলা হয়েছে রিবা। অনুরূপভাবে ভিন্ন ভিন্ন জাতের অর্থ, পণ্য বা সেবা বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করা হলে স্থগিতকৃত কাউন্টার ভ্যালু হয় দেনা/পাওনা। এই দেনা/পাওনার ওপর সময়ের ভিত্তিতে ধার্যকৃত অতিরিক্তেকেও বলা হয় রিবা। অপরদিকে একজাতের বস্তু নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে নির্ধারিত কোন কাউন্টার ভ্যালুর ওপর বিনিময়হীন বাড়তি নেওয়া হলে তাকে বলা হয়েছে রিবা। অনুরূপভাবে ভিন্ন ভিন্ন জাতের ক্রয়-বিক্রয়ে কোন কাউন্টার ভ্যালুর ওপর বিনিময় না দিয়ে বাড়তি নেওয়া হলে সেই বাড়তিকেও বলা হয়েছে রিবা। বস্তুতঃ রিবা হচ্ছে বাকি, নগদ উভয় ক্রয়-বিক্রয়ে এক পক্ষের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর বিনিময়হীন (মাগনা) বৃদ্ধি (ফদল যিয়াদা)। পার্থক্য হচ্ছে বাকির ক্ষেত্রে রিবা ধার্য করা হয়ে সময়ের কারণে, সময়ের ক্ষতিপূরণ বা মূল্য হিসেবে। আর নগদের ক্ষেত্রে রিবা ধার্য হয় সময় ছাড়া অন্যবিধ কারণে। উক্ত সংজ্ঞায় সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ে উদ্ভূত সকল সুদই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ক্রয়-বিক্রয় চুক্তিতে পৃথক শর্তের ফলে যে রিবা উদ্ভুত হয়, সে কথাও সংজ্ঞায় এসেছে। এক কথায়, রিবার সকল বৈশিষ্ট্যই উক্ত সংজ্ঞায় রয়েছে।
রিবার শ্রেণীবিন্যাস
ফিক্বাহ শাস্ত্রে রিবাকে প্রধানত রিবা নাসীয়াহ ও রিবা ফদল এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং প্রত্যেক প্রকার রিবার সংজ্ঞা পৃথক পৃথকভাবে দেওয়া হয়েছে। এরূপ বিভক্তি কুরআন ও সুন্নাহয় পাওয়া যায় না। আল-কুরআনে তো শুধু ‘রিবা’ ও ‘আল-রিবা’ আছে। আর হাদীসে বলা হয়েছে রিবা হচ্ছে ‘ফদল’ অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি; আবার বলা হয়েছে, ‘নাসীয়াহ ব্যতীত রিবা হয় না’, ‘যা নাসীয়াহ তাই রিবা’। বুঝা যাচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রিবা শব্দের অর্থ করেছেন ফদল। আর রিবা হওয়ার কারণ বলেছেন নাসীয়াহ যার অর্থ হচ্ছে বিনিময়হীন। এ থেকে রিবার দু’টি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাচ্ছে। একটি হচ্ছে ফদল বা বৃদ্ধি, অপরটি হচ্ছে নাসীয়াহ বা বিনিময়হীন। মূল কথা দাঁড়াচ্ছে যে, ফদল যখন বিনিময়হীন হয় তখনই তা রিবার পর্যবসিত হয়। ফদলের যদি বিনিময় দেওয়া হয় তাহলে তা রিবা হয় না। “নাসীয়াহ ব্যতীত রিবা হয় না” কথার তাৎপর্য এটাই। সুতরাং রিবা নাসীয়াহ হারাম করা হয়েছে আল-কুরআনে, আর রিবা ফদল নিষিদ্ধ করা হয়েছে হাদীসে, একথা যথার্থ নয়; বরং হাদীসে রিবার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বিনিময়হীন বৃদ্ধি হিসেবে। উল্লেখ্য যে, ইতোপূর্বে বলা হয়েছে যে, নাসীয়াহর অর্থ হচ্ছে বিনিময়হীন; এটাই হচ্ছে সকল প্রকার রিবার মূল বৈশিষ্ট্য। আর ফদল অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি বা অতিরিক্ত। এই দৃষ্টিতে সকল প্রকার রিবাই হচ্ছে ফদল ও বিনিময়হীন; এক কথায়, রিবা হচ্ছে বিনিময়হীন ফদল বা বৃদ্ধি। সুতরাং কিছু রিবাকে রিবা নাসীয়াহ আর কিছু রিবাকে রিবা ফদল হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা ঠিক নয়। তবে নাসীয়াহ শব্দের আর একটি অর্থ হচ্ছে, অবকাশ বা মেয়াদ, সেই হিসেবে ফিক্বাহশাস্ত্রের উক্ত বিভক্তিকে গ্রহণ করা যেতে পারে। এই অর্থেই এখানে প্রথমে রিবা নাসীয়াহ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে রিবা ফদলের অর্থ ও সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হচ্ছে।
রিবা নাসীয়াহঃ অর্থ
আরবী ‘নাসায়া’ শব্দ থেকে নাসীয়াহ শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে।[চাপরা, এম, উমর, Towards A Just Monetary Syst~m. Islamic Foundation, U.K., পৃ: ৫৭।] J. M. Cowan, A Dictionary of Modern Written Arabic- এ নাসায়া অর্থ লিখেছেনঃ
নাসা – to put off, postpone, delay, defer, procrastinate (নিভিয়ে দেওয়া-বতিল করা; স্থগিত করা, বিলম্বিত করা, মুলতবি করা, গড়িমসি করা।)
নাসাআ – to allow time to pay, grant credit (পরিশোধের জন্য সময় দেওয়া; ঋণ মঞ্জুর/প্রদান করা।)
নাসাআ- long life, longevity (দীর্ঘ জীবন, দীর্ঘায়ূ।)
আল-মুনজাদ- এ লিখা হয়েছে; নাসাআ কাউকে ঋণে অবকাশ দেওয়া। আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধানে ‘নাসীয়াহর’ অর্থ লিখা হয়েছে, পরিশোধে বিলম্ব, পরিশেধের জন্য প্রদত্ত সময়. বাকি, ধার।[ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আধুনিক আরবী বাংলা অভিধান, পৃ: ৮৮৪।]
ড. চাপরা লিখেছেন, নাসায়া শব্দের অর্থ হচ্ছে সময়, মেয়াদ বা অবকাশ। ঋণ বা দেনা পরিশোধ করার জন্য ধার্যকৃত/প্রদত্ত মেয়াদকে বলা হয়ে নাসায়া।[চাপরা, এম, উমর: উপরোক্ত, পৃ:৫৭।] ইংরেজীতে একে বলা হয় waiting আর বাংলায় বলা হয় প্রতীক্ষা। ঋণ ও বাকি প্রদান করে তার কাউন্টার ভ্যালু ফেরত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় এজন্য দেনা ও ঋণকে বলা হয় waiting বা প্রতীক্ষা। কর্দুর রিবা বা সুদী ঋণে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, ঋণ বা দেনা পরিশোধের জন্য নির্ধারিত মেয়াদ এবং পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে বর্ধিত মেয়াদের ওপর এত হারে সুদ ধার্য করা হবে। এভাবে সময় বা মেয়াদের বিনিময় হিসেবে এ রিবা ধার্য করা হয় বলে একে বলা হয় রিবা নাসীয়াহ বা মেয়াদী সুদ। ইংরেজীতে একে বলা হয় reward for waiting or time value of money (প্রতীক্ষার প্রতিদান বা অর্থের সময়ের মূল্য।)। বলা হয়েছে, “Riba in deferred transaction is nothing but a .. charge for the period of indebtedness … This charge is also called a time value of money.”[Muhammad Anwar: lslamicity of Banking and Modes of Islamic Banking, p. 2. The Article was received by the IERB for publication in its journal, Thoughts on Economics.] “বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে রিবা ঋণগ্রস্ত থাকা কাল/মেয়াদের দাম ছাড়া আর কিছুই না। ………. এই দামকে অর্থের সময়ের মূল্যও বলা হয়”। হাদীসে বলা হয়েছে, রিবা হয় নাসীয়াতে” “(riba is in nasiah)’ অথবা বলা হয়েছে, “নাসীয়াহ ব্যতীত রিবা হয় না”। “(There is no riba except in nasiah)”; অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, “যা ইয়াদান বিইয়াদিন তাতে কোন দোষ নেই, কিন্তু যা নাসীয়াহ তা রিবা”।[বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ।] সুতরাং ঋণ বা দেনার ওপর মেয়াদ বা সময়ের ভিত্তিতে ধার্যকৃত রিবা হচ্ছে রিবা নাসীয়াহ।
জাহিলী যুগে এই ধরনের রিবা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল এবং সকলেই একে রিবা বলে জানত। সেই জন্য কেউ কেউ একে বলেছেন রিবা আল-জাহিলিয়্যাত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণেও একে রিবা আল-জাহিলিয়্যাত আখ্যায়িত করেছেন, রিবা আল-কর্দ, কেউ কেউ আবার বয়েছেন রিবা আল-দাউন। আল-কুরআনে সূরাতুল বাকারায় সুদ চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করে যে বিধি-বিধান দেওয়া হয়েছে তাতে তদানীন্তনকালে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রিবা নাসীয়াহর প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল-কুরআন কেবল নাসীয়াকে নিষিদ্ধ করেছে। এজন্য অনেকেই একে রিবা আল-কুরআন আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং রিবা আল-জাহিলিয়্যাত, রিবা আল-কর্দ, রিবা আল-দাইন, রিবা আল-কুরআন দ্বারা আসলে রিবা নাসীয়াকেই বুঝায়।
রিবা নাসীয়াঃ সংজ্ঞা
তাফসীরকার, ফিক্বাহবিদ, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও স্কলারগণ রিবা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তারা সকলেই নিজ নিজ ভাষায় রিবা নাসীয়ার সংজ্ঞা দিয়েছেন। এখানে কতিপয় সংজ্ঞা পেশ করা হলো। এ কথা পূর্বেই বলা হয়েছে যে, অধিকাংশ স্কলারের সংজ্ঞায় কেবল রিবা নাসীয়াকেই রিবা বলা হয়েছে, রিবা ফদল এসব সংজ্ঞার আওতায় আসেনি। এজন্য এসব সংজ্ঞাকেও রিবা নাসীয়াহ শিরোনামের অধীনে পেশ করা হলো।
আল-কুরআনে বর্ণিত সুদ সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের আলোকে আল-জাসসাস তাঁর প্রখ্যাত তাফসীর আহকামুল কুরআনে নিম্ন ভাষায় রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেনঃ
“জাহিলিয়্যাত যুগের রিবা হচ্ছে, ঋণের আসলের ওপর ঋণগ্রহীতা কর্তৃক দেয় সেই অতিরিক্ত যার বিনিময়ে ঋণদাতা নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণ প্রদান করত”।[আল-জাসাস, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৬৯। উদ্ধৃত করেছেন, উসমানী, মুহাম্মত তকী, সুদ নিষিদ্ধঃ পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের ঐতিহাসেক রায়, বাংলা তরজমা, মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, পৃ: ২৮।]
প্রখ্যাত তাফসীরবিদ আল-কুরতুবী লিখেছেন, “মুসলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, ঋণের আসলের ওপর বৃদ্ধিই হচ্ছে রিবা, সে বৃদ্ধি যদি হয় এক মুঠো খড়, যেমন ইবনে মাসুদ বলেছেন, কিংবা যদি শস্যের একটি কণাও হয়, তাহলেও তা রিবাই”।[তাফসীর আল কুরতারী, ১৯৬৭, ৩য় খণ্ড, পৃ: ২৪১।]
আল্লামা রাগেব লিখেছেন, “ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে ঋণের শর্ত হিসেবে বা পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির বিনিময়ে মূল পরিমানের অতিরিক্ত যাই গ্রহণ করে তাই রিবা”।[তাফসীর আয়াতুল আহকাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৩৮৩।]
আল্লামা আব্দুর রহমান আল-জাযিরি বলেছেন, “রিবার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি; তবে ফিক্বাহর পরিভাষায় সমজাতীয় পণ্য বিনিময়কালে পণ্যের পরিমাণে কম-বেশি করা হলে এবং অতিরিক্ত অংশের বিনিময় বা মূল্য দেওয়া না হলে সেই বাড়তি অংশকে বলা হয় রিবা”। তিনি বলেছেন, উক্ত বৃদ্ধি যদি অন্য পক্ষের পণ্য প্রদান স্থগিত (deferred) বা বিলম্বিত (waiting) করার কারণে হয় তাহলে একে বলা হয় রিবা আল-নাসীয়াহ। উদাহরণ স্বরূপ, গ্রীষ্মকালে, ১.৫০ ইরদাব (পরিামাণ) গম প্রদানের শর্তে যদি শীতকালে ১ ইরদাব গম বাকিতে বিক্রয় করা হয়, তাহলে এই .৫০ ইরদাব অতিরিক্ত গম হবে রিবা আল-নাসীয়াহ; কারণ ১ ইরদাব গমের মূল্যের সাথে অতিরিক্ত .৫০ ইরদাব যুক্ত করা হয়েছে অথচ বিক্রিত ১ ইরদাব গমের সাথে এর কোন বিনিময় মূল্য দেওয়া হয় নাই; বরং এই অতিরিক্ত নেয়া হয়েছে কেবল বিলম্বে দাম পরিশোধ বা সময়ের কারণে”।[আব্দুর রহমান আল-জাযিরিঃ আল-ফিক্বহ আলা আল-মাযিহাব আল-আরাবায়াহ, উদ্ধৃত করেছেন, চাপরা, এম, উমর, Towards A Just Monetary System, The Islamic Foundation, U.K., p. 241.]
আল্লামা মোহাম্মদ আসাদ বলেছেন, “ভাষাগত দিক থেকে রিবা শব্দ দ্বারা কোন জিনিসের মূল আয়তন বা পরিমাণের ওপরে অতিরিক্ত (addition) বা বৃদ্ধিকে (increase) বুঝায়। আর আল-কুরানের পরিভাষা হিসেবে কোন ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ঋণ হিসেবে প্রদত্ত অর্থ বা পণ্য-সামগ্রীর ওপর সুদ (Interest) হিসেবে ধার্যকৃত অবৈধ অতিরিক্তই হচ্ছে রিবা”।[আসাদ, মোহাম্মদ, The Message of the Quran।]
আল্লামা মওদূদী রিবার ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “আরবী ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি। পারিভাষিক অর্থে আরবরা এমন এক বর্ধিত অংশের অর্থকে রিবা বলতো যা ঋণদাতা ঋণগ্রহীতিার কাছ থেকে একটি স্থিরীকৃত হার অনুযায়ী ঋণ বাবদ প্রদত্ত মূল অর্থের বাইরে আদায় করত। আমাদের ভাষায় আমরা একেই বলি সুদ। কুরআন নাযিলের সময় আরবে নিম্নোক্ত তিন ধরনের সুদী লেনদেনের প্রচলন ছিলঃ
১. এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির নিকট কোন জিনিস বিক্রি করতো এবং দাম পরিশোধের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতো। সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার পর যদি দাম পরিশোধ না হতো, তাহলে তাকে আবার অতিরিক্ত সময় দিতো এবং প্রাপ্য দামের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতো।
২. একজন অন্যজনকে ঋণ দিতো। ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে চুক্তি হতো যে, অমুক সময়ের মধ্যে আসল থেকে এত পরিমাণ অর্থ বেশি ফেরত দিতে হবে; এবং
৩. ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে একটি বিশেষ সময়সীমার জন্য একটি বিশেষ হার স্থিরীকৃত হয়ে যেতো। সেই সময়সীমার মধ্যে বর্ধিত অর্থসহ আসল অর্থ পরিশোধ না হলে পূর্বের চেয়ে বর্ধিত হারে পরিশোধেল শর্তে অতিরিক্ত সময় দেওয়া হতো।[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আলা; তাফহীমুল কুরআন; সুরাতুল বাকারাহ, টীকা-৩১৫।]
অন্যত্র তিনি লিখেছেন যে, সুদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ৩ টি:
“১. ঋণের আসল পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া;
২. সময়ের অনুপাতে আসল বৃদ্ধির সীমা, পরিমাণ বা হার নির্ধারিত হওয়া এবং
৩. উপরের দুটিকে শর্ত হিসেবে গ্রহণ করা”।
তিনি বলেছেন, “ঋণ সংক্রান্ত যে কোন লেনদেনের ক্ষেত্রে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য পওয়া গেলে তা নিঃসন্দেহে সুদী লেনদেনে পরিণত হবে। এতে ঋণের উদ্দেশ্য এবং ঋণগ্রহীতা ধনী বা দরিদ্র যাই হোক তাতে কারবারের আসল চরিত্রে কোন পার্থক্য হবে না”।[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং; বাংলা অনুবাদ, আব্বাস আলী খান ও আব্দুল মান্নান তালিব, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ: ৮৮।]
ড. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী আল-বাদাবীর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, “এটা সর্বসম্মত যে, রিবা অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি বা প্রবৃদ্ধি।….. তবে অধিকাংশের মত হচ্ছে যে, রিবা হচ্ছে ঋণ প্রদান-গ্রহণ কালে কৃত চুক্তি অনুসারে আসলের ওপর ধার্যকৃত সুদ (Interst) ; এ ছাড়া দেনাদার যদি ঋণ বা দেনার চুক্তিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ/দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রতি বর্ধিত মেয়াদের জন্য ঋণ/দেনার আসলের ওপর আরোপিত সকল অতিরিক্তই রিবার মধ্যে শামিল”।[সিদ্দিকী, এম, এন; পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৭-৩৮।]
এ প্রসঙ্গে সাইয়েদ কুতুব শহীদ লিখেছেন, “যে রিবা সুদ জাহেলী যুগে পরিচিত ছিল এবং যা উচ্ছেদ করার জন্য আল-কুরআনের আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে তা ছিল প্রধানত ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে প্রদত্ত অর্থ বা দ্রব্য ফেরত নেয়ার সময়ে বেশি নেয়া।লেনদেনের সময় একই জিনিস বেশি নেয়া বা বেশি দেওয়া, আসল পণ্যের ওপর অধিক গ্রহণ করা। আর অবকাশ বলতে সেই সময়কে বুঝায় যার জন্য অতিরিক্তটা নেওয়া হয়। আর এই ফায়দা লেনদেনের শর্ত হিসেবে বিবেচিত হলে তখন তা সুদ হয়ে যায়। অর্থাৎ কোন মালের পরিবর্তে সমশ্রেণীর মাল কিছু বেশি নেয়া হতো তো এই সময়ের কারণেই”।[সাইয়েদ, কুতুব শহীদ : তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন : বাংলা অনুবাদ, আল-কুরআন একাডেমী, লন্ডন, ৪র্থ খণ্ড, ২০০১, পৃ: ৪৬৯-৪৭২।]
ড. উমর চাপরা লিখেচেন, “রিবার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ বা প্রবৃদ্ধি। আর শরয়ী পরিভাষায়, রিবা সেই অতিরিক্তকে (premium) বুঝায় যা ঋণের আসলসহ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়”।[চাপরা ড. উমর : The Nature of Riba, Journal of Islamic Banking and Finance, Vol. 6, No.3, July-Sept., 1989; p. 7.]
আধুনিক বিশ্বের প্রখ্যাত উলামায়ে কিরাম, বিশেষজ্ঞ ও স্কলারদের বিভিন্ন সম্মেলন ও বৈঠক হতেও সর্বসম্মতিক্রমে রিবার অনুরূপ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ড. চাপরা লিখেছেন, প্রাথমিক যুগ থেকেই মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ রিাবাকে সর্বসম্মতভাবে এই অর্থেই বুঝে আসছেন। আধুনিক কালে ইসলামী আইনবেত্তাদের বেশ কয়টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্টিত হয়েছে। এসব সম্মেলনের মধ্যে মুতামার আল-ফিক্বহ আল-ইসলামীর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসে ১৯৫১ সালে; আর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে কায়রোতে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (OIC) ও রাবেতা ফিক্বহ কমিটির সম্মেলনসহ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সকল সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতবভাবে রিবা সম্পর্কে উক্তরূপ রায় দেওয়া হয়েছে। সুতরাং রিবাকে ভিন্নতর অর্থে ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই”।[ চাপরা, ড. উমর : Prohibition of Interest : Does it Make Sense? Islamic Da’wa Movement, IDM Publications, South Africa, 2001, pp. 2-3.]
পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের শরীয়াহ আপিলেট বেঞ্চ-এর রায়ে বলা হয়েছেঃ বিচারপতি খলিলুর রহমান খান, বিাচারপতি ওয়াজীহুদ্দীন আহমদ ও বিচারপতি মাওলানা মুহাম্মদ তকী উসমানী কর্তৃক লিখিত পৃথক পৃথক তিনটি রায়ে বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ কারণসমূহের প্রেক্ষিতে এ মর্মে ঘোষণা করা যাচ্ছে যে, ভোগ বা উৎপাদন যে উদ্দেশ্যেই হোক, নির্বিশেষে সকল ঋণ বা দেনার চুক্তিতে আসলের ওপর ধার্যকৃত কম হোক বেশি হোক, যে কোন অতিরিক্তই হচ্ছে আল-কুরআনে হারাম ঘোষিত রিবা”।[উসমানী, মুহাম্মদ তকী, পূর্বোক্ত, পৃ: ১২৭।]
ড. জিয়াউল হক লিখেছেন, মুসলিম আইনবেত্তাগণ একে রিবা নাসীয়াহ বলে উল্লেখ করছেন। এটা হচ্ছে স্থগিত বৃদ্ধি (deferred increase) বা সময়ের ভিত্তিতে অতিরিক্ত (excess in time), ঋণগ্রহীতা যার কোন ক্ষতিপূরণ (recompense)বা সমমূল্য (equivalence) (/wad, Badal) পায় না; সুতরাং “সুদ হচ্ছে অনুপার্জিত আয়, যাতে ঋণগ্রহীতাকে কোন বিনিময় (return) বা কাউন্টার ভ্যালু দেওয়া হয় না। মুসলিম আইনবেত্তাদের এটাই অভিমত”।[হক, ড. জিয়াউল : Riba and Interest, Journal of Islamic Economics, Banking and Finance, Vol. 6, No.4, October-December, 1989, Autumn Issue, p. 8, 9.]
বিশেষজ্ঞদের উল্লেখিত সংজ্ঞাসমূহের ভিত্তিতে বলা যায় যে, ঋণ ও দেনার ওপর চুক্তি অনুসারে ধার্যকৃত যে কোন অতিরিক্ত, যার কোন বিনিময় দেওয়া হয় না, যা সময়ের সাথে গুণে গুণে বৃদ্ধি পায় এবং কারবারের সাথে যার কোন সম্পর্ক নাই তাই হচ্ছে রিবা নাসীয়াহ। এক কথায়, সময়ের কারণে ঋণের কাউন্টার ভ্যালু/দেনার ওপর বৃদ্ধিই (ফদল/যিয়াদা) হচ্ছে রিবা নাসীয়াহ।
অন্য কথায় ঋণকে যখন অতিরিক্তের কারণ বানানো হয়, তথা অতিরিক্তকে ঋণের বিনিময়, ঋণের দাম বা price of credit বানানো হয় অথবা অতিরিক্ত দেওয়ার শর্তে যখন ঋণ দেওয়া হয় তখন সেই অতিরিক্ত হয় রিবা নাসীয়াহ বা মেয়াদী সুদ। এই বৃদ্ধি বা অতিরিক্ত যে আকারেই হোক, একই জাতের অর্থ বা পণ্যের অতিরিক্ত কোন পরিমাণ হোক বা অন্য কোন অর্থ বা পণ্যের কোন পরিমাণ হোক, এমনকি, যদি কোন সেবা, বেনিফিট (benefit) উপহার, উপঢৌকন বা দানও হয়, তাহলেও তা সুদ বলে গণ্য হবে। সুতরাং ঋণের শর্তে ধার দেয় যে, ঋণগ্রহীতা ১ বছর পর ১০০/- টাকা পরিশোধ করবে এবং তার সাথে আরও ১০/- টাকা বেশি দেবে অথবা ১০০/- টাকার সাথে ১ কেজি পেঁপে দেবে বা তার গাড়ীতে করে ঋণদাতাকে তার বাসায় পৌঁছে দেবে, তাহলে অতিরিক্ত এই ১০ টাকা বা ১ কেজি পেঁপে বা গাড়ীর সেবা হবে রিবা নাসীয়াহ বা মেয়াদী সুদ।
ঋণের অতিরিক্ত যাই হোক, তা হবে বিনিময়হীন বা মাগনা, আর মাগনা বলেই এই ১০/- টাকা বা ১ কেজি পেঁপে বা গাড়ীর সেবা হবে রিবা বা সুদ। ঋণগ্রহীতা যদি এক বছর নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে আসলের কাউন্টার ভ্যালু ও এর সাথে মাগনা বা অতিরিক্ত হিসেবে ১০% সুদ পরিশোধ করতে না পারে তাহলে অতিরিক্ত সময়ের জন্য চুক্তি অনুসারে বার্ষিক ১০/- টাকা হিসেবে প্রতিদনি সুদের অংক বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং যতদিন ঋণগ্রহীতা তার মূল ঋণ পরিশোধ করতে না পারবে ততদিনই বৃদ্ধির গতি অব্যাহত থাকবে। এমনকি তা দ্বিগুণও হয়ে যেতে পারে। আর এই সকল বর্ধিত অংশই হবে মাগনা ও একতরফা (unilateral)। অনুরূপভাবে কোন ঋণদাতা যদি ঋণগ্রহীতাকে ১ কিলো লবণ এই শর্তে ধার দেয় যে, ঋণগ্রহীতা এক মাস পর ১.৫০ কিলো লবণ ফেরত দেবে, তাহলে এই .৫০ কিঃ লবণ হবে মূল লবণের কাউন্টার ভ্যালুর ওপরে অতিরিক্ত ও মাগনা, সুতরাং রিবা।
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীস থেকেও এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যদি অন্য কাউকে ঋণ দেয়, অতঃপর ঋণগ্রহীতা যদি ঋণদাতার সামনে খাবার ডিশ পেশ করে, তাহলে ঋণদাতার উচিত সেটা গ্রহণ না করা; আর ঋণগ্রহীতা যদি ঋণদাতাকে তার বাহন পশুর ওপর আরোহণ করার প্রস্তাব করে, তাহলে ঋণদাতার উচিত তা গ্রহণ না করা, যদি না তারা পূর্ব থেকেই পরস্পর অনুরূপ আনুকূল্যও সুবিধা বিনিময়ে অভ্যস্ত হয়”। (সুনান আল-বায়হাকি)
হাদীস থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে, যদি এমন হয় যে, ঋণগ্রহীতা ঋণ গ্রহণ করার পূর্বে জীবনে কখনও ঋণদাতাকে খাওয়ায় নাই, অথবা কখনও তার ঘোড়ায় উঠে ভ্রমণ করার সুযোগ দেয় নাই; কিন্তু তার নিকট থেকে ঋণ নেওয়ার পর সে তাকে খাবার সেধেছে এবং তার বাহনে ভ্রমন করার প্রস্তাব করেছে, এতে স্বাভাবিকভাবেই আশংকা হয় যে, ঋণ দেওয়ার কারণেই সে এখন ঋণদাতাকে এই সব সুযোগ-সুবিধা দিতে আগ্রহী। আর যদি তাই হয়, তাহলে ঋণ হবে এই সুবিধাগুলোর কারণ। আশংকা যে, এ অবস্থায় সুবিধাগুলো রিবা হয়ে যাবে। কিন্তু ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতার মধ্যে যদি পূর্ব থেকেই পরস্পরকে খাওয়ানো বা একজন আর একজনের বাহনে উঠার ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে থাকে, তাহলে ঋণ গ্রহণের পরে খওয়া বা বাহনে উঠার প্রস্তাব করলে তা ঋণের কারণে নয় বরং পারস্পরিক সম্পর্ক ও অভ্যাসের কারণে করা হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং সুদ পরিণত হওয়ার আশংকা থাকবে না। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পূর্ব থেকে অভ্যস্ত না হলে উল্লেখিত অফার (offer) গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, অতিরিক্ত যদি ঋণের কারণে বা ঋণের শর্ত হিসেবে হয়, তাহলে তা হয় রিবা।
অন্য একটি হাদীসে আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণিত আছে, নবী (সাঃ) বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যদি কাউকে ঋণ দেয়, তাহলে (ঋণগ্রহীতার পক্ষ থেকে দেয়া) কোন উপহার (gift) গ্রহণ করা তার উচিত নয়”।(মিশকাত, বোখারীর সূত্রে উদ্ধৃত।)
আবূ বুয়াদ ইবনে আবূ মূসা থেকে অন্য একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, “আমি মদীনায় এসে আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি (আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম) বলেছেন, “আপনি এমন এক দেশে বাস করেন যেখানে অবাধে এবং ব্যাপকভাবে (rampant) রিবা লেনদেন চালু আছে। সুতরাং আপনার কাছে ঋণী কোন ব্যক্তি যদি আপনাকে এক বোঝা খড় অথবা সামান্য কিছু যব, অথবা এক আটিঁ শুষ্ক তৃণ উপহার দেয়, তাহলে আপনি তা গ্রহণ করবেন না, কারণ এটা রিবা”।(মিশকাত, বোখারীর সূত্রে উদ্ধৃত।)
উল্লেখিত হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঋণের শর্তে অতি তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসও যদি আসলের অতিরিক্ত হিসেবে দেওয়া হয়, তাহলে তা অবশ্যই রিবা; রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ফাদালাহ ইবনে উবাইদা সম্ভবত এজন্যই বলেছেন যে, “The benfit derived from any loan is one of the different aspercrs of riba” “ঋণ থেকে আহৃত (derived) সুবিধা হচ্ছে সুদের বিভিন্ন ধরনের একটি”। -সুনান আল বায়হাকি)।
লক্ষণীয় যে, কোন কোন বিশেষজ্ঞের সংজ্ঞায় সমজাতের অর্থ বা পণ্য বিনিময়কালে পরিমাণে কম-বেশি করা হলে রিবা উদ্ভুত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ কথা ঠিক যে, সমজাতের অর্থ বা পণ্যের বাকি ক্রয়-বিক্রয় থেকে ঋণের সৃষ্টি হয় এবং এই ঋণের ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্তও রিবা হয়। আর দেনার সৃষ্টি হয় ভিন্ন ভিন্ন জাতের মুদ্রা বা পণ্যের বাকি ক্রয়-বিক্রয় থেকে। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক ক একজন চাল বিক্রেতা আর খ হচ্ছে চালের ক্রেতা। খ ক- এর কাছ থেকে ৪০ কেজি চাল এক মাসের জন্য বাকিতে কিনতে চাইলো। ক বাকিতে চাল বিক্রি করতে রাজী হলো। উভয়ে দরকষাকষি করে স্থির করলো প্রতি কেজি চালের দাম হবে ৩০/- টাকা অর্থাৎ ৪০ কেজি চালের মোট দাম দাঁড়ালো ১,২০০/- টাকা। এই ১,২০০/- টাকা হলো ৪০ কেজি চালের কাউন্টার ভ্যালু, ক-এর পাওনা এবং খ-এর দেনা। এই বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের সময়ে অথবা পরবর্তীতে ক ও খ সম্মত হয়ে এটাও স্থির করলো যে, খ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তার দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী বর্ধিত সময়ের মধ্যে উক্ত দেনার ওপর বার্ষিক ১০% হিসেবে সুদ ধার্য করা হবে এবং খ তা পরিশোধে বাধ্য থাকবে। অতঃপর খ যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তার দেনা সম্পূর্ণ পরিশোধ করে দেয়, তাহলে লেনদেন শেষ হয়ে যাবে এবং খ-কে কোন সুদ দিতে হবে না। কিন্তু যদি তার দেনা সম্পূর্ণ বা এর কোন অংশ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে নির্ধারিত এক মাস পর হতে তার অপরিশোধিত দেনার ওপর প্রতিদিন সুদের অংক যোগ হতে থাকবে যত দিন সে সম্পূর্ণ মূল দেনা ও সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে নির্ধারিত এক মাস পর হতে তার অপরিশোধিত দেনার ওপর প্রতিদিন সুদের অংক যোগ হতে থাকবে যত দিন সে সম্পূর্ণ মূল দেনা ও সুদ পরিশোধ না করবে। সুতরাং একজাতের অর্থ বা পণ্যের বাকি ক্রয়-বিক্রয় তথা ঋণের ক্ষেত্রে রিবা উদ্ভূত হয় একথা যেমন যথার্থ তেমনি ভিন্ন ভিন্ন জাতের অর্থ, পণ্য বা সেবার বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে সৃষ্ট দেনার ওপর অতিরিক্ত ধার্য করা হলে তাও রিবা হয়, একথাও সত্য।
রিবা ফদলঃ অর্থ
আরবী ফদল শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত, বাড়তি, বেশি ইত্যাদি। হাদীস থেকে জানা যায় যে, এক দীনারের বদলে দুই দীনার, এক দিরহামের পরিবর্তে দুই দিরহাম, এক সা’ খেজুরের বিনিময়ে দুই সা’ খেজুর, হাতে হাতে নগদ ক্রয়-বিক্রয় করা হলে দীনার, দিরহাম বা খেজুরের অতিরিক্ত পরিমাণ হয় রিবা (মুসলিম)। এছাড়া নিলামে প্রতারণামূলক ডাকের মাধ্যমে দাম বাড়ানো হলে, পারিতোষিকের বিনিময়ে কারও জন্য সুপারিশ করা হলে অথবা প্রতারণা করে দাম বেশি নেওয়া হলে দামের সেই সব বর্ধিত অংশ ও পারিতোষিককেও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) রিবা ঘোষণা করেছেন। ফিক্বাহ শাস্ত্রে এই ধরণের যাবতীয় রিবাকে বলা হয়েছে রিবা ফদল।সুতরাং রিবা নাসীয়ার ন্যায় ঋণ ও দেনার ক্ষেত্রে নয়, বরং হাতে হাতে নগদ বিনিময় ও ক্রয়-বিক্রয়ে রিবা ফদলের উদ্ভব ঘটে। অর্থাৎ রিবা নাসীয়াহ ও রিবা ফদলের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, রিবা নাসীয়াহ হয় ঋণ ও দেনার ক্ষেত্রে তথা বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে; অপরদিকে রিবা ফদল হয় নগদ বিনিময় ও ক্রয়-বিক্রয়ে। আরও স্পষ্ট করে বলা যায় যে, রিবা নাসীয়ায় নেওয়া ও দেওয়ার মাঝে থাকে সময়ের ব্যবধান তথা রিবা নাসীয়াহ হচ্ছে সময়ের বিনিময়; কিন্তু রিবা ফদলে নেওয়া ও দেওয়ার মাঝে সময়ের ব্যবধান থাকে অনুপস্থিত। নগদ বিনিময় বা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এই রিবা হয়, এজন্য কেউ কেউ একে রিবা আল-বূয়ূ বা ক্রয়-বিক্রয়ের রিবা আখ্যায়িত করেছেন। কেউ কেউ আবার একে রিবা আল-নকদ বা নদগ রিবা বলে উল্লেখ করেছেন। এই ধরনের রিবায় সময় নাই, শুধু বৃদ্ধি আছে। এজন্য কেউ কেউ একে বলেছেন রিবা আল-ফদল। এই বিরার উল্লেখ হাদীসে করা হয়েছে; এই জন্য কেউ কেউ একে বলেছেন রিবা আল-সুন্নাহ। সুতরাং রিবা আল-বুয়ূ, রিবা আল-নকদ, রিবা আল-সুন্নাহ ও রিবা আল-ফদল একই ধরনের রিবা অর্থাৎ রিবা আল-ফদলেরই বিভিন্ন নাম মাত্র।
রিবা ফদলঃ সংজ্ঞা
উলামায়ে কিরাম ও বিশেষজ্ঞগণ রিবা ফদলকে নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করেছেন। উল্লেখ্য যে, রিবা ফদলের সংজ্ঞায় সকলেই সমজাতের পণ্য বা অর্থের নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে রিবা ফদল উদ্ভূত হওয়ার কথা বুঝিয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন জাতের পণ্য বা অর্থ নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে রিবার বিষয়টি কারও কাছেই গুরুত্ব পায়নি। উদাহরণ স্বরূপ, ইবনে হাজার আস-কালানী লিখেছেন, “পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই হচ্ছে রিবা। যেমন, এক দীনারের বিনিময়ে দুই দীনার”।[উদ্ধৃত, আফজালুর রহমান, ইকোনমিক ডকট্রিনস অব ইসলাম।] এখানে বিনিময় বলতে তিনি কেবল নগদ হাতে হাতে বিনিময়কে বুঝিয়েছেন।
একইভাবে সাইয়েদ কুতুব শহীদ তার ফী যিলালিল কুরআনে লিখেছেন, “হযরত বিলাল (রাঃ) এর ঘটনায় তা পরিষ্কাকর হয়ে গেছে। তিনি খারাপ দুই সা’ খেজুরের বিনিময়ে এক সা’ভাল খেজুর নিয়েছেন। যেহেতু একই খেজুর থেকে অন্য খেজুরের জন্ম হলো, সেজন্যেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এটাকে রিবা বলে ঘোষণা করেছেন”।[সাইয়েদ কুতুব শহীদ, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৭১।]
সাইয়েদ মওদূদীও রিবা ফদলের অনুরূপ সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “একই জাতিভুক্ত দুটি জিনিসের হাতে হাতে লেনদেনের ক্ষেত্রে যে বৃদ্ধি হয় তাকে বলা হয় রিবা আল-ফদল”।[মওদূদী, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৭১,পৃ: ৯৬।]
আল্লামা আব্দুর রহমান আল-জাযিরি বলেছেন, “লেনদেনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান না থাকা সত্ত্বেও যদি (একই জাতের পণ্য) কম পরিমাণের বিনিময়ে বেশি পরিমাণ নেওয়া হয় এবং অতিরিক্ত অংশের মূল্যের ক্ষতিপূরণ করা না হয়, তাহলে সেই বাড়তি অংশ হয় রিবা আল-ফদল”।[আল্লামা আব্দুর রহমান আল-জাযিরি, আল-ফিক্বহ আলা আল মাযাহিব আল-আরবায়াহ, উদ্ধৃত, চাপরা, প্রাগুক্ত, পৃ: ২৪১।]
পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের শরীয়াহ আপীলেট বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছে যে, “নবী করীম (সাঃ) কতিপয় লেনদেনকে রিবা আখ্যায়িত করেছেন যা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
১. অর্থের বিনিময়ে অর্থ লেনদেনে উভয় পক্ষের অর্থ যদি একই জাতের ও শ্রেণীভুক্ত হয় এবং উভয় পক্ষ যদি সমান সমান পরিমাণের অর্থ লেনদেন না করে, তাহলে বিনিময় তাৎক্ষণিক হাতে হাতে নগদ হোক (spot transaciton) অথবা বাকির ভিত্তিতে হোক, সে লেনদেন হবে রিবা।
২. বার্টার বা পণ্যের সাথে পণ্য বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো যদি ওজন বা পারিমাপযোগ্য হয় এবং একই জাত ও শ্রেণীভুক্ত হয় এবং যদি উভয় পক্ষের পণ্যের পরিমাণ অসমান হয় অথবা এক পক্ষ যদি তার পণ্য প্রদান ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত বা বাকি রাখে, তাহলে এরূপ লেনদেন রিবা লেনদেনে পর্যবসিত হবে।
৩. বার্টার বা পণ্যের সাথে পণ্য বিনিময়ে পণ্য যদি ভিন্ন ভিন্ন জাত ও শ্রণীভুক্ত হয় এবং সেগুলো যদি ওজন ও পরিমানযোগ্য হয় আর কোন এক পক্ষ যদি তার পণ্য প্রদানস্থগিত বা বাকি রাখে, তাহলে তা রিবা লেনদেনেন অন্তর্ভুক্ত হবে”।[উসমানী, মুহাম্মদ,তকী, পূর্বোক্ত, পৃ: ১২৭-১২৮।]
হানাফী ফক্বীহদের মতে, “একই জাতের (similarily) বস্তুগত সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তিতে, আইনত গ্রহনযোগ্য পরিমাপের ভিত্তিতে, কোন অতিরিক্ত পরিমাণ ধার্য করা হলে সেই অতিরিক্ত হচ্ছে রিবা ফদল”। “It is an excess of tangible prorerty stipulated in the exchange contract on the basis of legal criteria in the similarity of two items.”[উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৫।]
শাফেয়ী আইনবেত্তাদের মতে, It is an exchange with an increase in one of the trade items over the other.” অর্থাৎ “ক্রয়-বিক্রয়ে দুটি পণ্যের কোন একটির পরিমাণ অপরটির চেয়ে বেশি করে ক্রয়-বিক্রয় করাই হচ্ছে রিবা ফদল”।[উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৬।]
হাম্বালী মাযহাবের ফক্বীহদের দৃষ্টিতে, “It is an increase in one of the exchange items identical in kind of measurable and weighable goods.” অর্থাৎ “রিবা ফদল একই জাতের পরিমাপ ও ওজনযোগ্য পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ে কোন একটি পণ্যের পরিমাণ বেশি করা”।[ইবিদ, পৃ: ৩৬।]
উক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হানাফী মাযহাবের মতে রিবা হচ্ছে, বাস্তব অর্থে অতিরিক্ত (excess) বা বৃদ্ধি (increase)। যথা, এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম বিক্রি করা। এখানে এক পক্ষের অতিরিক্ত এক দিরহাম হচ্ছে রিবা। আর ‘without a corresponding counter value’ কথার তাৎপর্য হচ্ছে, উক্ত বাড়তি এক দিরহামের কোন কাউন্টার ভ্যালু নেই বা দেওয়া হয় নাই বা তা মাগনা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, সংজ্ঞাতে বাকির মেয়াদকেও রিবা বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে পূর্বেই বিশিষ্ট ফিক্বাহবিদদের মত উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, নিষিদ্ধ হচ্ছে ফদল বা বৃদ্ধি যা বিনিময়হীন; সময় নিষিদ্ধ নয়, সময় বা মেয়াদ রিবা নয়। সর্বোপরি এইসব সংজ্ঞা অনুসারে রিবা ফদল উদ্ভূত হয় সমজাতের পণ্য-সামগ্রী নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে দালাল কর্তৃক মিথ্যা ডাকের মাধ্যমে দাম বাড়ানো হলে, প্রতারণার মাধ্যমে দাম বেশি নিলে, বাজার সম্পর্কে অনবহিত লোককে ঠকিয়ে দাম ও পারিতোষিকের বিনিময়ে কারও পক্ষে সুপারিশ করা হলে, এসব বর্ধিত দাম ও পারিতোষিককে রিবা বলা হয়েছে। এসব ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন জাতের পণ্যের নগদ ক্রয়-বিক্রয়। এসব রিবাকেও সংজ্ঞার আওতায় আনা উচিত।
সুতরাং নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতিমূল্যের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত যার কোন বিনিময় দেওয়া হয় না তাই হচ্ছে রিবা ফদল। এই সংজ্ঞায় নগদ ক্রয়-বিক্রয় বলতে সমজাতের পণ্য, অর্থ ও সেবার নগদ ক্রয়-বিক্রয় এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতের পণ্য, অর্থ ও সেবার নগদ ক্রয়-বিক্রয় সবই শামিল রয়েছে।
আল-রিবা অর্থ
আল্লাহ তা’য়ালা আল-কুরআনে বলেছেন, “ওয়া আহাল্লাল্লাহুল বাইয়া ওয়া হররামার রিবা” অর্থাৎ আল্লাহ বাইকে হালাল করেছেন, আব রিবাকে করেছেন হারাম। এই আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা ‘বাই’ শব্দের পূর্বে ‘আল’ যোগ করে ‘আল-বাই’ বলেছেন; আর রিবা শব্দের পূর্বে ‘আল’ বসিয়ে বলেছেন ‘আল-রিবা’। সকল বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে একমত যে, ‘বাই’ শব্দের পূর্বে সংযোজিত ‘আল’ দ্বারা সমগ্র বা জাতি বুঝানো হয়েছে। বাই-এর সংজ্ঞার আওতাভুক্ত সকল বাইকে বুঝানোই এর উদ্দেশ্য। সুতরাং আয়াতের এই অংশে আল্লাহ সকল প্রকার বাইকে (ক্রয়-বিক্রয়কে) হালাল ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ‘রিবা’ শব্দের পূর্বে বসানো ‘আল’- এর অর্থ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞগণ প্রধানত তিন ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
দাঊদ আল-যাহিরী, তকি আল-দ্বীন আস-সবকি, আত-তাহাভী, আব্দুল হামিদ আল-বায়যাবী, আত-তাবারী, শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী ও ইবনুল কায়্যিম আল- জাওযিয়াহ প্রমৃখ তাফসীরকার, হাদীসবেত্তা ও ফিক্বাহবিদগণ বলেছেন, রিবা শব্দের পূর্বে রিবা লেনদেন করত, যে রিবার সাথে তারা পরিচিত ছিল, সেই বিশেষ পরিচিত (Previous Familiarity) রিবাকে বুঝানোর জন্যই ‘আল’ শব্দ বসানো হয়েছে। এই রিবাকে রিবা নাসীয়াহও বলা হয়। অর্থাৎ আয়াতের এই অংশে মহান আল্লাহ কেবল রিবা আল-জাহিলিয়্যাত বা রিবা নাসীয়াকেই হারাম ঘোষণা করেছেন। উক্ত বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য সকল প্রকার রিবা নিষিদ্ধ করা হয়েছে হাদীস দ্বারা।
অপর এক দল বিশেষজ্ঞের অভিমত হচ্ছে যে, এখানে রিবার পূর্বে যুক্ত ‘আল’ শব্দটি সমষ্টি, সাধারণ (general/mujmal) ও জাত (genus) ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, পূর্ব পরিচিতি অর্থে নয়। আল-কিয়া আল-হারিসী, ইমাম শাফেয়ী প্রমুখ বিশিষ্ট আইনবেত্তগণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মতে, এখানে আল-রিবা বলতে সকল প্রকার রিবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আল-জাসসাস, আল-ফখর আল-ইসলাম, আল-বাদাবী, ইবনে রুশদ আল-মালিকী হানাফী স্কুলের ফক্বীহগণ ভিন্নতর আর এক অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের মতে, আল-কুরআনে ব্যবহৃত রিবা শব্দটি হচ্ছে অস্পষ্ট (Ijmal/obscure/undetailed); আইন প্রণেতা কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা ব্যতীত এর প্রকৃত অর্থ বুঝা সম্ভব নয়।
তাঁরা বলেছেন, রিবার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি। কিন্তু শরীয়তে সকল প্রকার বৃদ্ধিকে রিবা বলা হয়নি; বরং এক বিশেষ ধরনের বৃদ্ধিকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল-জাসসাস এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, আরবরা নির্ধারিত সময়ের জন্য দিরহাম ও দীনার ধার দিতো এবং ঋণের আসলের ওপর সময়ের বিনিময় হিসেবে ‘অতিরিক্ত’ ধার্য করতো। শরীয়তে এই বৃদ্ধিকে রিবা বলা হয়েছে। অপরদিকে সোনার সাথে সোনা বা রূপার সাথে রূপা পরিমাণে কম-বেশি করে নগদ বিনিময় করা হলে এক পক্ষের বাড়তি অংশ যে রিবা হয়, আরবরা তা জানতো না। তাছাড়া, সোনার বদলে সোনা, রূপার বদলে রূপা বাকিতে বিক্রয় করা হলে বাকির মেয়াদ যে রিবা (রিবা আল নাসা) হয় সেটাও তাদের জানা ছিল না।কিন্তু আইনে বাড়তি অংশ ও বাকির মেয়াদ এ দুটোকেই রিবা বলা হয়েছে। বস্তুতঃ রিবা শব্দটি অন্যান্য অস্পষ্ট বিশেষ্য পদের শব্দের ন্যায় একটি অস্পষ্ট বিশেষ্য পদের শব্দ; একে যথার্থ অর্থ বুঝতে হলে শরীয়ত প্রণেতার পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা ছাড়া বুঝা সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর অভিপ্রায় অনুযায়ী সুস্পষ্ট নির্দেশনার মাধ্যমে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। সুতরাং হাদীসে যত প্রকার রিবার কথা বলা হয়েছে তার সবই আল-রিবার অন্তর্ভুক্ত।
আল-কুরতুবী এই একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন ভিন্নতর যুক্তিতে। তাঁর মতে, “আয়াতে ব্যবহৃত আল শব্দটি পূর্ব পরিচিতি বুঝাচ্ছে, আর তা হচ্ছে, আরবরা যে রিবা লেনদেন করতো সেই রিবা; অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যেসব রিবা নিষিদ্ধ করেছেন সেগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত………”।[তাফসীর আল-করতুবী, ভলি-৩, পৃ: ৩৫৭, উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বক্ত, পৃ: ১২৪।]
আল-শাতিবী বলেছেন যে, “এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ জাহিলিয়্যাতের রিবাকে নিষিদ্ধ করেছেন। অতঃপর রিবার একটি ধরন ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, কাউন্টার ভ্যালুর ওপর বিনিময়হীন অতিরিক্ত থাকার কারণেই এই ক্রয়-বিক্রয়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আর সুন্নাহ একই অর্থে সকল প্রকার রিবাকে এর সাথে শামিল করেছে”।[আল-মুয়াফফাক্বাত, ভলি-৪, পৃ: ৪১; উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোক্ত,পৃ: ১২৭।]
বাদাবী দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিমতের মধ্যে তুলনা করে বলেছেন যে, এই দুই মতের প্রকাশভঙ্গিতে পর্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয় মতে একই কথা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে সকল প্রকার রিবাই আল-রিবা শব্দের অন্তর্ভুক্ত। তবে তিনি নিজে প্রথম অর্থাৎ আল-কুরআন কেবল রিবা আল-জাহিলিয়্যাত বা রিবা আল-নাসীয়াকে নিষিদ্ধি করেছে, এই মতকে অধিকতর পছন্দনীয় বলে অভিমত দিয়েছেন।[বাদাবী, ইবিদ, পৃঃ ৫৫।]
বস্তুতঃ তাফসীরকার, হাদীসবেত্তা ও ফিক্বাহবিদদের ব্যাখ্যা অনুসারে আল-কুরআনে নিষিদ্ধ রিবা ও আল-হাদীসে নিষিদ্ধ রিবা ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করার কারণেই আল-রিবার অর্থ ও আওতা-পরিধি নিয়ে উক্ত মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, ফিক্বাহ শাস্ত্রে বাকির মেয়াদকে রিবা বলার কারণে এই রিবাকে আল-রিবার মধ্যে শামিল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া আল-কুরআন কেবল রিবা আল-ফদল ও রিবা আল-নাসাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে হাদীসের দ্বারা।
শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী বলেছেন, রিবা হচ্ছে দুই প্রকারঃ এক প্রকার হচ্ছে প্রকৃত রিবা এবং অপরটি হচ্ছে রূপক রিবা (figurative/metaphorical); প্রকৃত রিবা হচ্ছে দেনার ওপর রিবা যা জাহিলী যুগে আরবরা ব্যাপকভাবে লেনদেন করতো; প্রকৃত রিবাকে নিষিদ্ধ করেছে আল-কুরআন; আর দ্বিতীয় প্রকারের রিবা হচ্ছে ‘রিবা আল-ফদল’। রিবা আল-ফদলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে হাদীসে। রিবা-ফদল হচ্ছে আসল রিবার সম্প্রসারণ (extension); একে কেবল রূপক অর্থে রিবা (as a metaphor/figurative) বলা হয়েছে।[ Hujjat Allah Al-Balighah, Vol-2,p. 106-107, উদ্ধৃত, বাদাবী, পৃ: ৩৩, টীকা নম্বর :১২।]
এ ব্যাপারে দাঊদ আল-জাহিরী বলেছেন, “প্রকৃতপক্ষে রিবা হচ্ছে কোন বস্তুর নিজস্ব পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (excess in the thing itself); তাই প্রতিমূল্যের ওপর বৃদ্ধি রিবা নয় বরং এরূপ বৃদ্ধিকে রূপক অর্থে রিবা বলা যায়।[উদ্ধৃত, বাদাবী, পৃ: ৩৩, টীকা নম্বর :১১।]
বস্তুতঃ ঋণের ওপর বৃদ্ধিকে একই বস্তুর নিজ পরিমাণের বৃদ্ধি গণ্য করে তাকে বলা হয়েছে প্রকৃত রিবা।কিন্তু নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে একই জাতের অর্থ বা পণ্যের বেশি পরিমাণকে বলা হয়েছে কাউন্টার ভ্যালুর ওপর বৃদ্ধি; একে বলা হয়েছে রূপক অর্থে রিবা। এটি একটি পরস্পরবিরোধী অবস্থা। কারণ, ঋণগ্রহীতা, ঋণ হিসেবে যে জাতের অর্থ বা পণ্য গ্রহণ করে তা খরচ করে নিঃশেষ করে ফেলে। অতঃপর অনুরূপ অর্থ বা পণ্য যোগাড় করে ফেরত দেয়। সুতরাং ঋণে একই বস্তু লেনদেন হয় একথা আদৌ ঠিক নয়; বরং একই জাতের ভিন্ন ভিন্ন বস্তু লেনদেন হয় যার একটি হয় অপরটির কাউন্টার ভ্যালু। আর ঋণের ক্ষেত্রে এই কাউন্টার ভ্যালুর ওপর অতিরিক্ত ধার্য করা হলে তা হয় রিবা নাসীয়াহ। একইভাবে কোন বস্তু ভিন্ন জাতের অপর কোন বস্তুর বিনিময়ে বাকিতে বিক্রি করা হলে বাকি দাম হয় এক পক্ষের দেনা, অপর পক্ষের পাওনা কাউন্টার ভ্যালু। এই কাউন্টার ভ্যালুর অতিরিক্ত ধার্য করা হলে তাকেও বলা হয় রিবা নাসীয়াহ। সুতরাং প্রকৃত রিবা আসলে কাউন্টার ভ্যালুর ওপরেই ধার্য করা হয়। অনুরূপভাবে কোন অর্থ বা পণ্য একই জাতের অর্থ বা পণ্যের বিনিময়ে নগদ ক্রয়-বিক্রয় করা হলে তার একটি হয় অপরটির কাউন্টার ভ্যালু। আর কোন একটি কাউন্টার ভ্যালুর ওপর অতিরিক্ত ধার্য করা হলে (পরিমাণে বেমি করা হলে) তা হয় রিবা ফদল। ঋণ ও বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের ন্যায় নগদ লেনদেনেও অতিরিক্ত আসলে কাউন্টার ভ্যালুও ওপরই ধার্য করা হয়, মূল বস্তুর ওপর নয়। একথা ঋণসহ সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রেই সত্য। সুতরাং ঋণে মূল বস্তু বৃদ্ধি পায়, আর অন্যান্য ক্রয়-বিক্রয়ে কাউন্টার ভ্যালুর ওপর বৃদ্ধি ধার্য করা হয় এই পার্থক্য সঠিক নয়।
প্রকৃত কথা হচ্ছে ঋণও এক ধরনের ক্রয়-বিক্রয়; আর ঋণসহ যে কোন ক্রয়-বিক্রয়ে কাউন্টার ভ্যালুর ওপর অতিরিক্ত ধার্য করা হলে কাউন্টার ভ্যালুর পরিমাণ বেড়ে যায়। এটাই হচ্ছে কাউন্টার ভ্যালুর নিজ পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া- excess in the thing itself. রিবা দ্বারা কাউন্টার ভ্যালুর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়; মূল বস্তুর পরিমাণ নয়।
উল্লেখ্য যে, হাদীস বা সুন্নাহ হচ্ছে আল-কুরআনের ব্যাখ্যা। রাসূলের (সাঃ) দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহ যা কিছু ‘ওহী’ করেন তার সবটুকু, কোন প্রকার বাড়তি-কমতি না করে, দুনিয়াবাসীর কাছে হুবহু পৌঁছে দেওয়া এবং নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে তার যথার্থ অর্থ ও ব্যাখ্যা মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া। আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, “আমারা তোমার ওপর এই যিকর নাযিল করেছি যাতে তুমি মানুষকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে পার যা তাদের জন্য নাযিল করা হয়েছে”। (“And we have sent down unto thee Message (dhikr) that thou Mayest explain clearly to men what is sent for them.”) (আল-কুরআন)। বস্তুতঃ আল-কুরআনে নেই এমন কোন রিবাকে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিষিদ্ধ করেননি। সুতরাং কুরআনে ব্যবহৃত ‘রিবা শব্দের পূর্বে আল-বসিয়ে আল্লাহ তা’য়ালা রিবার সংজ্ঞার আওতার মধ্যে পড়ে এমন সব রিবাকেই বুঝিয়েছেন; আর এই রিবা নিষিদ্ধ করে মৌলিক বিধি-বিধান আল্লাহ নিজে নাযিল করেছেন। তারই ভিত্তিতে রাসূল (সাঃ) এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিধি-বিধান তুলে ধরেছেন। তিনি ক্রয়-বিক্রয়ের বিধি-বিধান প্রদান করেছেন এবং এসব বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা হলে বিভিন্ন ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ে কিভাবে রিবা উদ্ভূত হয় তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
বস্তুতঃ ‘বাই’ যেমন এক ধরনের চুক্তি তেমনি রিবাও আর এক ধরনের চুক্তি। উবাদা ইবনে সামিত বর্ণিত হাদীসে উল্লেখিত শর্ত মুতাবেক চুক্তি করা হলে তা হয় বাই বা ক্রয়-বিক্রয়, চুক্তি, যা আল্লাহ হালাল করেছেন। আর এর কোন একটি, দুটি বা তিনটি শর্ত লঙ্ঘন করে চুক্তি করা হলে তা হয় রিবা চুক্তি, আল্লাহ যাকে হারাম করেছেন। হাদীসে বর্ণিত বাই সংক্রান্ত সকল বিধি-বিধান আল-কুরআনে নেই; তেমনি রিবার যাবতীয় আইন-বিধানও আল-কুরআনে নেই। আল-কুরআন ও আল-হাদীসের বক্তব্য মিলেই আল-বাই এবং আল-কুরআন ও আল-হাদীসের ব্যাখ্যা মিলিয়েই আল-রিবা। সুতরাং আল-রিবার মধ্যে কুরআনে বর্ণিত রিবা যেমন আছে, তেমনি হাদীসে বর্ণিত রিবাও এর অন্তর্ভুক্ত। ‘Al-Riba is all inclusive.’ অর্থাৎ “সকল রিবাই আল-রিবার অন্তর্ভুক্ত”।
আয়াতে ব্যবহৃত ‘বাই’ ও ‘রিবা’ দুটি শব্দই হচ্ছে এক বচনে (singular number), বিশেষ্য পদ (noun); আর উভয় শব্দের পূর্বে বসানো হয়েছে ‘আল’।[কামালি, এম, হাশিম: পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ১৪২।] তাছাড়া পারস্পরিক তুলনামূলক অর্থে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, “a singular noun with a confined meaning preceeded by the definite article denotes generalilty.”[উদ্ধৃত, বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৫৫, টীকা নম্বর: ৪৭।] “অর্থাৎ সীমাবদ্ধ অর্থ জ্ঞাপক এক বচনে ব্যবহৃত কোন বিশেষ্য পদের পূর্বে নির্দিষ্ট আর্টিকেল বসালে তা সমগ্র অর্থ নির্দেশ করে”। যেমন আল-হামদু-সকল প্রশংসা। পূর্বে ক্রয়-বিক্রয় আলোচনায় বলা হয়েছে যে, এখানে বাই অর্থ হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়; আর এর পূর্বে আল যোগ করায় এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয়; অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয়ের সংজ্ঞার আওতাভূক্ত যাবতীয় ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ‘আল-বাই’। অনুরূপভাবে তুলনামূলক অর্থে আল-রিবার অর্থও সকল প্রকার রিবা হওয়া বাঞ্ছনীয়; সুতরাং রিবার সংজ্ঞার আওতায় আসে এমন সকল রিবার সমষ্টিই হচ্ছে ‘আল-রিবা’। এখানে আল-রিবার অন্যবিধ অর্থ করা যুক্তিযুক্ত নয়।
সুদের বৈশিষ্ট্য
পূর্বে উল্লেখিত সুদের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে সুদের কতিপয় অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছেঃ
১. সুদের ক্ষেত্র ক্রয়-বিক্রয়;
২. সুদ অবৈধ চুক্তির ফল;
৩. সুদ ক্রয়-বিক্রয়ে একদিকের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর আরোপিত অতিরিক্ত;
৪. সুদের কোন বিনিময় বা কাউন্টার ভ্যালু বা মূল্যের সমতা নেই (no equivalence);
৫. সুদে পারস্পরিক লেনদেন নেই (no reciprocity);
৬. সুদ গুণে গুণে বাড়ে;
৭. কারবার বা কারবারের ফলাফলের সাথে সুদের কোন সম্পর্ক নেই;
৮. সুদ পূর্বে নির্ধারিত ও নিশ্চিত;
৯. সুদে কোন বাণিজ্যিক ঝুঁকি নেই।
নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলোঃ
১. সুদের ক্ষেত্রে ক্রয়-বিক্রয়ঃ উপরের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, সুদের সংশ্লিষ্টতা হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে। ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে বিনিময় দিয়ে নেওয়া; কিন্তু সুদ হচ্ছে বিনিময় না দিয়ে নেওয়া। বিনিময় না দিয়ে পরের সম্পদ নেওয়ার বহু ধরন আছে। যেমন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, জবর-দখল,ধোকাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, মজুদদারী, মুনাফাখোরী, চোরা-কারবারী, ঘুষ, দুর্নীতি, জুয়া, চোরাচালানী ইত্যাদি। এসবই হচ্ছে পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ বা গ্রাস করা। কিন্তু এর কোনটাকেই রিবা বলা হয়নি। রিবা হচ্ছে কেবল সেই অন্যায় ভক্ষণ যা ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে একদিকের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর ধার্য করে বিনিময় না দিয়ে নেওয়া হয়।
২. সুদ অবৈধ চুক্তির ফলঃ সুদী লেনদেনে প্রকৃত পক্ষে দুটি চুক্তি সম্পাদিত হয়ঃ একটি ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি আর দ্বিতীয়টি রিবা বা সুদ চুক্তি। ক্রেতা-বিক্রেতা যখন কোন নির্ধারিত পণ্য, অর্থ বা সেবা নির্ধারিত কাউন্টার ভ্যালুর বিনিময়ে পরস্পর লেনদেন করে তখন তা হয় ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি; কিন্তু ক্রেতা-বিক্রতা যদি ক্রয়-বিক্রয়ে নির্ধারিত কাউন্টার ভ্যালুদ্বয়ের কেবল একটির ওপর কোন অতিরিক্ত ধার্য ও লেনদেন করতে রাজী হয় তখন সেই চুক্তি হয় সুদ বা রিবা চুক্তি। এই চুক্তিতে এক পক্ষের দেয় কাউন্টার ভ্যালুর ওপর অতিরিক্ত ধার্য ও লেনদেনের কথা বলা হয় কিন্তু অপর পক্ষের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর অনুরূপ অতিরিক্ত ধার্য ও বিনিময় করার কথা বলা হয় না। ফলে রিবা চুক্তির বলে এক পক্ষের ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত হয়ে পড়ে বিনিময়হীন বা মাগনা। আর এজন্যই তা হয় সদ বা রিবা। উদাহরণস্বরূপ, ঋণ লেনদেনের ক্ষেত্রে দাতা বা মহাজন ঋণ প্রার্থীর কাছে প্রস্তাবিত ঋণের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর কখনও দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক বা বার্ষিক সরল বা চক্র বৃদ্ধি হারে সুদ দাবী করে (সুদ প্রদানের ঈজাব বা প্রস্তাব করে); আর প্রার্থী উক্ত প্রস্তাবে রাজী (কবুল) হয়। এভাবে তাদের মধ্যে ঋণ তথা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সাথে রিবা চুক্তি সম্পাদিত হয়। অনুরূপভাবে ভিন্ন ভিন্ন জাতের পণ্য, অর্থ বা সেবা বাকি ক্রয়-বিক্রয়কালে বিক্রেতা স্থগিতকৃত বা বাকি কাউন্টার ভ্যালুর ওপর স্থগিত মেয়াদ ও অপারগতায় পরবর্তী বর্ধিত মেয়াদের জন্য যদি সুদ দাবী করে আর ক্রেতা যদি তাতে সম্মত হয়, তাহলে তাদের মধ্যে বাকি ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সাথে রিবা চুক্তিও সম্পাদিত হয়ে যায়। অতঃপর রিবা চুক্তির শর্তানুসারে ঋণগ্রহীতা ও বাকি ক্রেতা কর্তৃক দেয় নির্ধারিত কাউন্টার ভ্যালুর ওপর প্রতিদিন সুদ যোগ হতে থাকে। ঋণগ্রহীতা কোন কাউন্টার ভ্যালু না পাওয়া সত্ত্বেও একমাত্র চুক্তির কারণেই এই সুদ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়।
এ প্রসঙ্গে খান ও মিরাখোর বলেছেন, “Interest is regarded as representing an unjustified creation of instantaneous property rights: unjustified, because interest is a property right claimed outside the legitimate framework or recognized property rights; instantaneous, because as soon as the contract for lending upon interest is concluded, a right to the borrower’s property is created for the lender”[Khan Mohsin S, and Abbas Mirakhor, (Editors) 1987, Theoretical Studies in Islamic Banking and Finance, The Institute for Research and Islamic Studies, p, 4, quoted by Siddiqui, M, N,, Riba, Bank Interest and the Rationale of its Prohibition, Islamic Research and Training Institute, 2004, Islamic Development Bank, Jeddah, KSA, P, 43,]
অর্থাৎ “সুদ হচ্ছে সম্পদের ওপর সৃষ্ট অন্যায় ও তাৎক্ষণিক অধিকার; এ অধিকার অন্যায় (unjusified) এজন্য যে, ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার যাবতীয় বৈধ ও স্বীকৃত পন্হা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র এক পদ্ধতিতে সম্পদের ওপর এ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়; আর এ অধিকার তাৎক্ষণিক সৃষ্ট এজন্য যে, সুদের ভিত্তিতে ঋণ প্রদান চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার সাথে সাথেই ঋণগ্রহীতার সম্পদের ওপর ঋণদাতার এ অধিকার সৃষ্টি হয়”।এটা ঠিক জুয়ার চুক্তির মত। জুয়াতে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয় এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, খেলায় যে পক্ষ হারাবে সে পক্ষ অপর পক্ষকে, ধরা যাক, ১০,০০০/- টাকা দিতে বাধ্য থাকবে। অতঃপর যে হারে সে অপর পক্ষকে ১০,০০০/- টাকা দিয়ে দেয়; এমনকি, অনেক সময় জমি-জমা, বাড়ী-ঘর, স্ত্রী-সন্তান বিক্রি করে হলেও জুয়ার অর্থ পরিশোধ করতে দেখা যায়। এভাবে কেবল চুক্তির কারণে একজনের সম্পদ বিনামূল্যে অপরের কাছে চলে যায়। সুদের বেলাতেও ঠিক তাই হয়। বস্তুতঃ সুদ ধার্য ও পাওনা হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে রিবা চুক্তি। এই চুক্তির বলেই অনধিকারকে অধিকার বলে চালানো হয়। সুতরাং সুদ হচ্ছে অবৈধ চুক্তির ফল।
এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, আল্লাহ তো পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুদি কারবার এক ধরনের ব্যবসা।দাতা-গ্রহীতার পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই সুদ-চুক্তি করা হয়। তাহলে এ চুক্তি অবৈধ কেন?
একথা ঠিক যে, ব্যবসা-বানিজ্যে পারস্পরিক সম্মতি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।কিন্তু মনে রাখতে হবে পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে কোন হালালকে হারাম বা কোন হারামকে হালাল বানানো যায় না।উদাহারণস্বরূপ, যিনা ও জুয়া ইসলামে হারাম; কোন নারী-পুরুষ যদি পরস্পর সম্মত হয়ে যিনায় লিপ্ত হয় অথবা কতিপয় খেলোয়াড় একমত হয়ে যদি জুয়ার আড্ডা বসায়, তাহলে এই যিনা ও জুয়াকে হালাল হয়ে যায় না। এমনকি, দুনিয়ার সকল মানুষ একমত হয়েও যদি যিনা ও জুয়াকে হালাল বলে তাহলে এসব হারাম কখনও হালাল হয় না। অনুরূপভাবে ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় মানব জাতির জন্য কল্যাণকর ও হালাল। আর পারস্পরিক সম্মতি ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে একজনের সম্পদ বিনিময় না দিয়ে কেবল চুক্তির বলে আর এক জনে নিয়ে গেলে তাকে ক্রয়-বিক্রয় বলা যায় না। বরং একে বড় জোর পরের সম্পদ মাগনা নেওয়া, বাতিল পন্হায় পরের সম্পদ ভক্ষণ করা বলা যেতে পারে। এই ব্যবস্থা মানব সমাজের জন্য কিছুতেই হিতকর হতে পারে না; তাই হালাল হতে পারে না। আল-কুরআনের যে আয়াতে আল্লাহ পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা করার কথা বলেছেন সেই আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ এটাও বলেছেন যে, “তোমরা কেউ অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না”। ব্যবসা করতে হলে ক্রয়-বিক্রয় জরুরী; আর ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে উভয় পক্ষের সম্পদের পারস্পরিক বিনিময়। সুদে পারস্পরিক বিনময় নেই; সুদ ক্রয়-বিক্রয়ই নয়; পারস্পরিক সম্মতির প্রশ্নই এখানে অবান্তর।
৩. সুদ ক্রয়-বিক্রয়ে একদিকের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর আরোপিত অতিরিক্তঃ রিবার সংজ্ঞা আলোচনা পর্যায়ে বিভিন্ন মাযহাবের নেতৃস্থানীয় ফক্বীহ, বিষেশ করে, ইমাম সারখসীর উদ্ধৃতি দিয়ে দ্বার্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে. “রিবা হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়ে দুটি প্রতিমূল্যের কোন একটির ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত যার কোন কাউন্টার ভ্যালু নেই”।অতঃপর বিভিন্ন প্রকার ও ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ে কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণের বিধান উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে যে,বিধান অনুসারে নির্ধারিত কোন একটি কাউন্টার ভ্যালুর ওপরে, সময়ের কারনে হোক, অথবা ধোকা প্রতারণার মাধ্যমে হোক, কোন প্রকার অতিরিক্ত ধার্য করা হলে এবং অপরপক্ষ সেই অতিরিক্তের বিনিময় না দিলে,সেই অতিরিক্ত হয়ে যায় রিবা। এখানে আবার সেই আলোচনার পুনারাবৃত্তি না কেবল এতটুকু বলে রাখা যায় যে,রিবা হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের অতিরিক্ত যা ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে কেবল এক পক্ষের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর আরোপ করে আদায় করা হয়, আর অপর পক্ষ এর কাউন্টার ভ্যালু দেয় না।
৪. সুদের কোন বিনিময় বা কাউন্টার ভ্যালু নেই (no equiavalace)ঃ উপরের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, সুদ চুক্তিতে কেবল এক পক্ষের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর অতিরিক্ত ধার্য করা হয় অপর পক্ষের কাউন্টার ভ্যলুর ওপর সমমূল্যের বৃদ্ধি ছাড়াই।তাই সুদের কোন বিনিময় থাকে না। সুতরাং সুদ/রিবা হচ্ছে বিনিময়হীন বৃদ্ধি।এখানে উল্লেখ্য যে, অর্থনীতিবিদগন নানা ধরনের যুক্তি দিয়ে সুদ কেন দিতে হবে তার যৌক্তিকতা দেখানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছন। এসব যুক্তি দ্বারা সাময়িকভাবে কিছু লোককে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয়ে থাকতে পারে ; কিন্তু এর দ্বারা সুদের যৌক্তিকতা তথা সুদের কাউন্টার ভ্যালু আছে , সে কথা প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। এসব যুক্তির অসারতা বুঝতে হলে দীর্ঘ আলোচনা দরকার। তাই পৃথকভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রইলো ইনশাআল্লাহ।
৫. সুদে পারস্পরিক লেনদেন নেইঃ সুদ এক পক্ষ দেয় , অপর পক্ষ নেয়। যে নেয় সে এর বিনিময়ে কিছু দেয় না ; আর যে দেয় সে এর বিনিময়ে কিছু পায় না। সুদ হচ্ছে একতরফা দেওয়া ও একতরফা নেওয়া। এর বিপরীতে ক্রয়-বিক্রয়ে উভয় পক্ষ দেয় এবং উভয় পক্ষ নেয়। এখানে লেনদেন উভয়টাই পারস্পরিক ; কিন্তু সুদে পারস্পরিক লেনদেন হয় না।সকল প্রকার সুদেরই এটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৬. সুদ গুণে গুণে বাড়েঃ সুদ , বিশেষ করে , রিবা নাসিয়ার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সময়ের সাথে গুণে গুণে বৃদ্ধি পাওয়া। সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ তায়ালা ‘আদয়াফাম মুদায়াফাহ’ শব্দ দ্বারা সুদের এই প্রবণতার কথা বর্ণনা করেছেন। সুদের হার খুব নিম্ন হোক বা খুব উচ্ছ হোক , সময়ের সাথে তা গুণে গুণে বৃদ্ধি পাবেই , এমনকি , সুদ যদি সরল হারের হয় তবুও। আর চক্রবৃদ্ধি হারের ক্ষেত্রে সুদের বৃদ্ধি আরও বেশি হবে তাতে সন্দেহ নেই।
৭. কারবার বা কারবারের ফলাফলের সাথে সুদের সম্পর্ক নেইঃ কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে অর্জিত প্রকৃত ফলাফল তথা লাভ-লোকসানের ওপর ভিত্তিশীল নয়। বরং লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে সকল অবস্থাতেই সুদ অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া, সুদ কোন উৎপাদনশীল ও বাণিজ্যিক ঋণের ওপরই ধার্য করা হয় তা নয়; বরং চরম অভাবে নিপতিত লোকদেন ভোগ্য ঋণ, এমনকি, রাজনৈতিক কারণে গৃহীত ঋণের ওপরও সুদ ধার্য করা হয়।সর্বোপরি, শুধু ঋণ ও দেনা নয়, বরং সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয়েই সুদ নির্ধারণ করা যেতে পারে। সুতরাং ক্রয়-বিক্রয়ের ধরন, উদ্দেশ্য ও ফলাফল সুদের শর্ত নয়।
৮. সুদ পূর্বনির্ধারিত ও নিশ্চিতঃ সুদ হচ্ছে এক ধরনের চুক্তি; আর চুক্তিতে সুদ নির্ধারিত থাকাটাই স্বাভাবিক। এজন্যই বলা হয় সুদ পূর্বনির্ধারিত ও নিশ্চিত। আধুনিককালে প্রচলিত সুদের ভাসমান হার (fliating rate) সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। কারণ, এরূপ ক্ষেত্রে চুক্তিতে একথাই বলা হয় যে, এ ঋণে fliating rate অনুসারে সুদ ধার্য করা হবে। এখানে fliating rate-ই সদের পূর্বনির্ধারিত; কারণ, এরূপ ক্ষেত্রে সুদ চুক্তি যখন করা হয় তখনই সুদ নির্ধারণ করা হয়। সুতরাং সুদ পূর্বনির্ধারিত ও নিশ্চিত।
৯. সুদে কোন বাণিজ্যিক ঝুকিঁ নেইঃ পূর্বে বলা হয়েছে যে, উৎপাদন ও লাভ করাই হচ্ছে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে; কিন্তু চাহিদা-যোগানের হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগে কখনও আশাতীত লাভ যেমন হয়, তেমনি আবার লোকসান, এমনকি, অস্বাভাবিক লোকসানও হয়ে থাকে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লোকসানের এই ঝুকিকেঁ বলা হয় বাণিজ্যিক ঝুকিঁ। কিন্তু সুদ হচ্ছে কাউন্টার ভ্যালুর ওপর আরোপিত বৃদ্ধি যা সর্বদাই ধনাত্মক (positive)। সুতরাং সুদে বাণিজ্যিক ঝুঁকি নেই।