দ্বিতীঁয় খণ্ড: সুদের কুফল
ভূমিকা
সুদের কুফল আলোচনার পূর্বে সুদী কারবারের স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করলে সুদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করা সহজ হবে। নিচে প্রাচীন ও আধুনিক কালের সুদী কারবারের স্বরূপ আলোচনা করা হলো।
প্রাচীন কালের সুদী কারবার
সুদী কারবারের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে আমাদের একটু পেছনে গিয়ে স্বর্ণমান ব্যবস্হা থেকে আলোচনা করতে হবে। পাশ্চত্য দেশে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে, দূর অতীতের এক সময়ে স্বর্ণ অর্থ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সে সময়ে সাধারণ মানুষ স্বর্ণ সঞ্চয় করলে নিরাপত্তার জন্য তা এলাকার ধনী স্বর্ণকারদের (Goldsmith) কাছে গচ্ছিত রাখত এবং এ মর্মে স্বর্ণকারদের নিকট থেকে রসিদ লিখে নিত। স্বর্নকরাগণ আমানতকারীদের স্বর্ণ হেফাযত করত, হিসাব সংরক্ষণ করত এবং কেউ তার স্বর্ণ ফেরত নিতে এলে তাকে তার স্বর্ণ যথাযথভাবে ফেরত দিত। প্রথমদিকে স্বর্ণকারগণ তাদের এসব কাজের জন্য স্বর্ণ আমানতকারীদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক নিত। কালক্রমে স্বর্ণকারদের দেওয়া রসিদগুলো ক্রয়-বিক্রয় ও লেনদেনের মাধ্যমে হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল।ফলে স্বর্ণকারদের কাছ থেকে কাঁচা সোনা তুলে নেওয়ার জন্য জমাদানকারীরা খুব একটা আসতো না। স্বর্ণকারগণ দেখলো যে, তাদের কাছে গচ্ছিত স্বর্ণের বিরাট অংশ সারা বছর তাদের সিন্দুকেই পড়ে থাকে এবং শতকরা মাত্র ১০-১৫ ভাগ লোক কোন বিশেষ প্রয়োজনে তাদের সোনা তুলে নিতে আসে। স্বর্ণকারগণ এই অবস্থাকে নিজেদের জন্য এক বিরাট সুযোগ মনে করল। তারা গচ্ছিত সোনার মাত্র ১০-১৫ ভাগ রেখে বাকি ৮৫-৯০ ভাগ সুদের বিনিময়ে ধার দিয়ে সুদ অর্জন করতে লগল। এভাবে তারা স্বর্ণ সংরক্ষণের বিনিময়ে একদিকে স্বর্ণের মালিকদের নিকট থেকে পারিশ্রমিক আদায় করত, অপরদিকে মালিকদের সোনা নিজেরা ধার দিয়ে সুদ উসূল করত।
স্বর্ণকারগণ এটুকুতেই ক্ষান্ত হয়নি। তাদের অর্থলিপ্সা ও চালবাজি আরও অনেক দূর গড়িয়ে গেল। তারা দেখলো যে, তাদের ধার দেওয়া স্বর্ণগুলো ঋণগ্রহণকারীরাও সকলেই তুলে নেয় না; বরং তাদের কাছেই গচ্ছিত রেখে রসিদ নিয়ে যায়। তারা এটাও দেখলো যে, স্বর্ণের প্রকৃত মালিককে দেওয়া রসিদের ন্যায় ঋণগ্রহীতাদের দেওয়া রসিদগুলোও বাজারে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণের সব কাজ করে যাচ্ছে। মালিক এবং ঋণগ্রহণকারিগণ সাধারণতঃ শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগের বেশি সোনা ফেরত নিতে আসে না। ফলে ধার দেওয়া স্বর্ণেরও শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ তাদের সিন্দুকেই পড়ে থাকে। অভিজ্ঞতা থেকে তারা যখন স্পষ্ট বুঝতে পারল যে, র্স্বণ ধার দিলে স্বর্ণ দিতে হয় না। কেবল রসিদ দিলেই চলে, তখন তারা একই সোনাকে বারবার ধার দিয়ে ঋণগ্রহীতাদের সোনা গচ্ছিত আছে বলে রসিদ দিতে এবং তার ওপর সুদ নিতে লাগল। বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। মনে করা যাক, কোন এক ব্যক্তি স্বর্ণকারের কাছে ১০ তোলা স্বর্ণ জমা করল এবং এ মর্মে একটা রসিদ নিল। এই রসিদটি প্রকৃত স্বর্ণ জমার রসিদ। এখন স্বর্ণকার যেহেতু অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছে যে, স্বর্ণের প্রকৃত মালিক উক্ত দশ তোলা স্বর্ণের মধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে কেবল ১ তোলা অর্থাৎ ১০% সোনা তুলে নিতে পারে; বাকি ৯ তোলা অর্থাৎ ৯০% তার কাছে সারা বছর পড়ে থাকবে। অতএব, স্বর্ণকার এ ৯ তোলা স্বর্ণ ধার দিল। এ স্বর্ণের প্রথম ঋণগ্রহীতা উক্ত ৯ তোলা স্বর্ণ তুলে নিল না, নিল একটা রসিদ, আর স্বর্ণ স্বর্ণকারের কাছেই থাকল। স্বর্ণকার সুদ পাবার লোভে এ ৯ তোলা স্বর্ণ আবারও ধার দিল এবং ঋণগ্রহীতাকে আর একটা রসিদ লিখে দিল। এভাবে স্বর্ণকার উক্ত ৯ তোলা স্বর্ণের কমপক্ষে দশটা রসিদ তৈরী করে দশজনকে (৯×১০=৯০ তোলা) ধার দিল এবং এর বিনিময়ে সুদ আদায় করল। স্বর্ণের প্রকৃত মালিকরা স্বর্ণকারদরে চালাকি বুঝতে পেরে যাতে তাদের স্বর্ণ তুলে না নেয়, সেজন্য মালিকদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক নেওয়ার পরিবর্তে স্বর্ণকারগণ এবার তাদের সুদ দিতে শুরু করল। এভাবেই স্বর্ণকাররা সম্পূর্ণ ভূয়া মুদ্রার আকারে শতকরা ৯০ ভাগ জাল মুদ্রা তৈরী করত এবং তার মালিক সেজে প্রভূত পরিমাণে সুদ অর্জন করত।
নিঃসন্দেহে এ ব্যবসা ছিল একটা বিরাট প্রতারণা ও জালিয়াতি। কিন্তু দেশের রাজা, মন্ত্রী, আমীর-উমারা সবাই এ পুঁজিপতিদের ঋণের জালে আটকা পড়েছিল। এমনকি, যুদ্ধ এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সংকট মুকারিবলার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারও তাদের কাছ থেকে বড় বড় ঋণ নিয়েছিল। এমতাবস্থায় এ ধনীদের জালিয়াতি ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মত সাহস-শক্তি কারও ছিল না। এভাবেই একটা বিরাট প্রতারণা ও জালিয়াতি কারবার আইনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে, এমনকি, আইন একে বৈধ বলে স্বীকার করে নিয়েছে।[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ: ৭৪-৭৫।] এ হলো পুরাতন যুগের স্বর্ণকার ও ধনিক গোষ্ঠীর সুদী কারবারের স্বরূপ। হালে এসব স্বর্ণাকর ও ধনিক গোষ্ঠিীর স্থান পুঁজিপতি শ্রেণী ও ব্যাংকারগণ দখল করে নিয়েছে। আর এদের সুযোগ্য হাতের স্পর্শে সুদের অস্ত্র সকল যুগের চেয়ে অধিকতর ধ্বংসকর ক্ষমতা লাভ করেছে।[উপরোক্ত, পৃ: ৭২।]
আধুনিক ব্যাংকের সুদী কারবার
আধুনিক ব্যাংক-ব্যবসার স্বরূপ আলোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে কিভাবে ব্যাংকগুলো দেশের প্রায় সকল পুঁজি কুক্ষিগত করে নেয় এবং কিভাবে এরা গোটা অর্থনীতির ওপর প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে থাকে।
উপরে স্বর্ণকার ও ধনীদের সুদী কারবারের যে স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে, তা ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং বিক্ষিপ্ত। অর্থনৈতিক কায়-কারবার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে এ সুদী কারবারগুলো বিরাট বিরাট প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয় এবং দূর-দূরান্তরে ওগুলোর শাখা-প্রশাখা কায়েম করা হয়। ক্রমে আরও বড় প্রতিষ্ঠান এবং আরও ব্যাপক পুঁজির প্রয়োজন দেখা দেয়। এ পর্যায়ে পুঁজিপতিরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য শাখর ন্যায় অর্থ-ব্যবসাতেও যৌথ পুঁজির ভিত্তিতে বড় বড় গঠন করল। এরই নাম হলো ব্যাংক।
ব্যাংক দু’ধরনের পুঁজি খাটিয়ে থাকে; এক, অংশীদারদের পুঁজি; আর দুই. আমানতকারীদের জমাকৃত অর্থ। ব্যাংক প্রথমে অংশীদারদের পরিশোধিত স্বল্প পরিমাণ মূলধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। অতঃপর আমানতকারীদের কাছ থেকে কম সুদের হারে এবং বিনাসুদে আমানত গ্রহণ করে এবং এই সাকল্য অর্থ অধিক সুদে লগ্নি করে বিপুল পরিমান সুদ অর্জন করে থাকে।
ব্যাংক সাধারণতঃ তিন ধরনের আমনত গ্রহণ করে; মেয়াদী আমানত (Fixed Deposit), সঞ্চয়ী আমানত (Savings Deposit) এবং চলতি আমানত (Current Deposit)।
মেয়াদী আমানত কমপক্ষে তিন মাস বা তদূর্ধ সময়ের জন্য রাখা হয়। আমানতকারীগণ মেয়াদ শেষ হবার আগে মেয়াদী আমানতের অর্থ তুলে নিতে পারে না। ব্যাংক মেয়াদী আমানতের ওপর সময়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন হারে সুদ দেয়। মেয়াদ যত দীর্ঘ হয় সুদের হার তত বেশি হয় এবং সময় যত কম হয় সুদের হারও তত কম হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে মেয়াদী আমানতের ওপর শতকরা ৯.০০ টাকা থেকে ১৩.০০ টাকা হারে সুদ দিয়ে এ ধরনের আমানতকারীদের আকৃষ্ট করা হয়। আমানতকারীগণ প্রধানতঃ নির্দিষ্ট হারে সুদ ধরনের আমানতকারীদের আকৃষ্ট করা হয়। আমানতকারীগণ প্রধানতঃ নির্দিষ্ট হারে সুদ পাওয়ার লোভেই মেয়াদী হিসাবে অর্থ জমা করে।
সঞ্চয়ী আমানত হতে সাধরণতঃ সপ্তাহে একবার বা দু’বার কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত অর্থ উঠানো যায়। এই পরিমাণের বেশি অর্থ উঠাতে হলে পূর্বাহ্নে নোটিশ দিতে হয়। এরূপ আমানতের ওপর সাধরণতঃ শতকরা ৫ থেকে ৯ ভাগ সুদ দেওয়া হয়। আমানতকারীগণ সাধারণতঃ নিরাপত্তা এবং সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যেই এ ধরনের হিসাব খুলে থাকে।
চলতি আমানত থেকে আমানতকারীগণ যে কোন সময়ে যে কোন পরিমাণ অর্থ তুলে নিতে পারে। ব্যাংক সাধারণতঃ এরূপ আমানতের ওপর কোন সুদ দেয় না, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাংক এরূপ আমানতকারীদের কাছ থেকে হিসাব সংরক্ষণের পারিশ্রমিক আদায় করে। নিরাপত্তা এবং লেনদেনের সুবিধার্থেই আমানতকারীগণ চলতি হিসাব খুলে থাকে।
এভাবে ব্যাংক এর মোট পুঁজির শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ অর্থ আমানতের মাধ্যমে সংগ্রহ করে। অবশিষ্ট ৫-১০ ভাগ পুঁজি আসে শেয়ার মূলধন থেকে। ব্যাংক জনগনের আমানতের ওপর যে সুদ দেয় মোট আমানতের ওপর তার গড় হার ৫% থেকে ৭% এর বেশি হয় না। অথচ ব্যাংক এই সাকুল্য অর্থ ১৫% থেকে ২০% সুদে খাটিয়ে বিপুল মুনাফা অর্জন করে। নিম্নের উদাহরণ থেকে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
১৯৮৬ সালে (ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড এর) পরিশোধিত মূলধন ছিল ৮,০০,০০,০০০.০০ (আট কোটি) টাকা। এ বছর উক্ত ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ ছিল ২৭১,১৯,০০,০০০.০০ (দুইশত একাত্তর কোটি ঊনিশ লক্ষ) টাকা। এছাড়া, অন্যান্য কোম্পানী থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৬,০০,৩০,০০০.০০ (ছত্রিশ কোটি ত্রিশ হাজার) টাকা। অর্থাৎ মূলধন, আমানত ও ঋণের মোট পরিমাণ ছিল ৩১৫,১৯,৩০,০০০.০০ (তিনশত পনের কোটি ঊনিশ লক্ষ ত্রিশ হাজার) টাকা। শতকরা হিসাবে পরিশোধিত মূলধনের হার দাঁড়াচ্ছে মোচ পুঁজির ২.৫৩%; আর মোট পুঁজির ৯৭.৪৭% হচ্ছে আমানত ও ঋণ। এ বছর ব্যাংক আমানতকারী ও ঋণদাতাদের সুদ দিয়েছে ২১,২০,৫৬,০০০.০০ (একুশ কোটি বিশ লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার) টাকা।মোট আমনত অর্থাৎ ৩০৭ কোটি টাকার ওপর গড়ে সুদের হার দাঁড়ায় ৬.৯০%। অতঃপর ব্যাংক করপূর্ব নীট মুনাফা দেখিয়েছে ৯,৫০,১৬,০০০.০০ টাকা।[ন্যাশনাল ব্যাংক লিঃ বাংলাদেশ, বার্ষিক প্রতিবেদন, ১৯৮৬।] মোট পরিশোধিত মূলধনের ওপর মুনাফার হার দাঁড়ায় ১১৮.৭৭%।
আধুনিক ব্যাংকের ঋণদার পদ্ধতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, প্রাচীন স্বর্ণকারদের ন্যায় এরও গচ্ছিত আমানতের নয় গুণ অর্থ ঋণ দিয়ে তার ওপর সুদ অর্জন করে থাকে। অর্থনীতিরি ভাষায় একে বলা হয় ‘বহুগুণ ঋণ সৃষ্টি’ বা Multiple Credite Creation।
প্রাচীন স্বর্ণকারদের ন্যায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পেরেছে যে, যারা ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে, তারা সকলেই এক সাথে তাদের অর্থ তুলে নেয় না; বরং কেবল ১০% লোক তাদের অর্থ তুলে নিতে আসে, আর বাকি ৯০% অর্থ সর্বদা ব্যাংকের তহবিলেই থাকে। ফলে ব্যাংকগুলো তাদের কাছে গচ্ছিত আমানতের ১০% নগদ অর্থ হাতে রেখে বাকি ৯০% অর্থ সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেয়। নিম্নের উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারেঃ
মনে করা যাক, ক একটি ব্যাংক। আরও মনে করা যাক যে, কোন একজন আমানতকারী ক ব্যাংকে ১০০০.০০ (এক হাজার) টাকা আামনত রাখল। ক ব্যাংক এই আমানতের ১০% বা ১০০.০০ টাকা নগদ হাতে রেখে বাকি ৯০% বা ৯০০.০০ টাকা সুদের ভিত্তিতে লগ্নি করবে। এ ক্ষেত্রে ক ব্যাংকের দেনা-পাওনার হিসাব দাঁড়াবে নিম্নরূপঃ
দেনা | পাওনা | ||
আমানত | ১,০০০.০০ | সংরক্ষিত নগদ | ১০০.০০ |
ঋণ | |||
মোট | ১,০০০.০০ | মোট | ১,০০০.০০ |
প্রত্যেক ব্যাংকেই এককভাবে এর কাছে গচ্ছিত আমানতের ৯০% অর্থ ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থা সার্বিকভাবে বা সকল ব্যাংক সম্মিলিতভাবে যখন ঋণ দেয়, তখন প্রত্যেকটি ঋণই নতুন আমানতের সৃষ্টি করে এবং এ ধরনের ঋণ-সৃষ্ট আমানতের ৯০% অর্থ আবারও ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণও আবার আমানত সৃষ্টি করে এবং আবারও এর ৯০% ঋণ দেওয়া হয়। এভাবে ঋণ-আমানত-ঋণ-আমানতের এধারা চলতে থাকে মূল আমনত দশগুণ না হওয়া পর্যন্ত।
বিষয়টি সহজ করার জন্য বলা যায় যে, কোন ঋণগ্রহীতা যখন কোন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তখন উক্ত ব্যাংক ঋণগ্রহীতাকে হাতে হাতে নগদ অর্থ দেয় না; বরং ঋণগ্রহীতার নামে একটি ব্যাংক হিসাব খুলে এবং ঋণের অর্থ উক্ত হিসাবে জমা লিখে রাখে। অথবা অন্য কোন ব্যাংকে উক্ত ঋণগ্রহীতার হিসাব থেকে থাকলে সে হিসাবে উক্ত ঋণের অর্থ জমা করে দেয়। এভাবে ঋণগ্রহীতার ঋণের এই অর্থ ঋণদানকারী ব্যাংক অথবা অন্য কোন ব্যাংকে নতুন আমানতরূপে জামা হয়; আর ব্যাংক নতুন জমা পাওয়ার এই জমার ৯০% আবার ঋণ দেয়। এভাবে যতবার ঋণ দেওয়া হয়, ততবারই নতুন আমানত সৃষ্টি হয় এবং আবার নতুন ঋণ দেওয়া সম্ভন হয়। নিম্নের উদাহরণে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হতে পারেঃ
ধরা যাক, কোন একজন জমাকারী ক ব্যাংকে ১০০০.০০ টাকা জমা রাখল। আরও ধরা যাক যে, ক ব্যাংক এই আমানত থেকে ১০০.০০ টাকা নগদ হাতে রেখে বাকি ৯০০.০০ টাকা ঋণ দিল এবং ঋণগ্রহীতা এই ৯০০.০০ টাকা খ ব্যাংকে জমা রাখল। এখন খ ব্যাংক এই জমার ১০% অর্থাৎ ৯০.০০ টাকা নগদ রেখে বাকি ৮১০.০০ টাকা ঋণ দেবে; পরবর্তী ঋণগ্রহীতা এই ৮১০.০০ টাকা, আবার ধরা যাক, গ ব্যাংকে জমা রাখল, গ ব্যাংক এর ৯০% অর্থাৎ ৭২৯.০০ টাকার নতুন ঋণ দেবে। এই ঋণ আবার কোন ব্যাংকে জমা হবে এবং এর ৯০% আবার ঋণ দেয় হবে। এভাবে সর্বশেষ ঋণ যখন এত ক্ষুদ্র হবে যে, তা থেকে আর নতুন ঋণ সৃষ্টি সম্ভব নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঋণ ও আমানত বর্ধিত হতে থাকবে। এতে গোটা ব্যাংক ব্যবস্থায় উক্ত ১০০০.০০ টাকার মূল আমানত থেকে সৃষ্ট সর্বমোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়াবে ৯০০+৮১০+৭২৯….=৯০০০.০০ টাকা এবং গোটা ব্যাংক ব্যবস্থার সর্বশেষ অবস্থা হবে নিম্নরূপঃ
দেনা | পাওনা | ||
আমানত (মূল) | ১,০০০.০০ | সংরক্ষিত নগদ (মূল আমানত থেকে) | ১০০.০০ |
আমানত (সৃষ্ট) | ৯,০০০.০০ | সংরক্ষিত নগদ (সৃষ্ট আমানত থেকে) | ৯০০.০০ |
ঋণ (মূল আমানত থেকে) | ৯০০.০০ | ||
ঋণ (সৃষ্ট আমানত থেকে) | ৮,১০০.০০ | ||
মোট | ১০,০০০.০০ | মোট | ১০,০০০.০০ |
দেখা যাচ্ছে যে, যে আমানতের অর্থ ব্যাংকের কাছে কেবল খাতা-কলমে আছে, বাস্তবে নেই, তাকেও আমানত পণ্য করে ব্যাংকগুলো প্রকৃত অর্থের চেয়ে বহুগুণ বেশি ঋণ দেয় এবং তার ওপর সুদ অর্জন করে, যেমন স্বর্ণকারগণ করত। এভাবেই ব্যাংকব্যবস্থা শূন্যের ওপর ঋণের বুদবুদ সৃষ্টি করে এবং প্রকারান্তরে ঋণগ্রহীতা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মাধ্যমে ভোক্তা জনগণেন কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সুদ আদায় করে নেয়।
উল্লেখ্য যে, পূর্বকালে প্রচলিত মহাজনী সুদ দুনিয়ার সর্বত্রই নিন্দিত ও ঘৃণিত হয়েছে; একে ভাল বলার দুঃসাহস এখন আর কেউ করে না। কিন্তু আধুনিককালে মহাজনেরা একত্রিত হয়ে গদির পরিবর্তে যৌথ কোম্পানী গঠন করেছে যাকে বলা হয় ব্যাংক। এখন বলা হয় যে, সুদের এ আধুনিক পদ্ধতি দ্বারা সমগ্র জাতিরই উপকার হয়। কেননা, যে জনগণ নিজের টাকা দ্বারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে জানে না, কিংবা স্বল্প পুঁজির কারণে করতে পারে না তাদের সকলের টাকা-পয়সা ব্যাংকে জমা হয় এবং প্রত্যেকেই অল্প হলেও কিছু না কিছু মুনাফা পেয়ে যায়। বড় বড় ব্যবসায়ীরাও ব্যাংক থেকে সুদের ওপর ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। এতে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায় জাতির অলস সঞ্চয়সমূহের উৎপাদনশীল ব্যবহার সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা যায় “এটি একটি প্রতারণা বৈ কিছুই নয়”। চক্ষুষ্মান ব্যক্তিদের সমনে একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, চরিত্র বিধ্বংসী অপরাধসমূহকে আধুনিক পোশাক পরিয়ে দেওয়ার ফলে এসব অপরাধের ব্যাপকতা যেমন পূর্বের চেয়ে বেড়ে গেছে, সুদখোরীর এ নতুন পদ্ধতিও তেমনি একদিকে সুদের বেইনসাফীকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে, অপরদিকে সুদের কুফল ও ধ্বংসও ব্যাপক ও মারাত্মক রূপ নিয়েছে।
সুদী কারবারের প্রাচীন ও আধুনিক স্বরূপ থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আধুনিক কালে সুদী কারবারের প্রকৃতিগত স্বভাব তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। তবে একালে জনগণের অর্থ কুক্ষিগত করায় ব্যাংকগুলোর ক্ষমতা প্রাচীনকালের স্বর্ণকার ও পুঁজিপতিদের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহঃ) লিখেছেন, ‘পুজিঁপতিদের সংগঠন কায়েম হবার পর প্রথম যুগের একক ও বিক্ষিপ্ত মহাজনদের তুলনায় বর্তমান একীভূত ও সংগঠিত পুঁজিপতিদের মর্যাদা, প্রভাব ও আস্থা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আজকের দিনে এক একটি ব্যাংকে শত শত কোটি টাকা জমা হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রভাবশালী পুঁজিপতি এগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। তারা কেবল নিজেদের দেশে নয়, বরং সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের ওপর চরম স্বার্থান্ধতাসহকারে কর্তৃত্ব করে থাকে। অতঃপর এ শক্তির জোরে তারা বিভিন্ন দেশ ও জাতির ভাগ্য নিয়ে খেলা করে। তারা ইচ্ছামত যে কোন দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে, ইচ্ছামত দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধায়, আবার ইচ্ছামত যে কোন সময় সন্ধি স্থাপন করায়। নিজেদের অর্থলিপ্সার দৃষ্টিতে যে জিনিসকে বাঞ্চনীয় মনে করে তার প্রচলন বাড়ায় ও বিকাশ সাধন করে। আবার যেটিকে অবাঞ্চনীয় মনে করে তার বিকাশ লাভের সকল পথই বন্ধ করে দেয়। তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কেবল বাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগর, সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মচর্চা কেন্দ্র ও রাষ্ট্রিয় পার্লামেন্ট সর্বত্রই তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। কারণ দেশেরও জাতির সমুদয় অর্থ তাদের ভৃত্যে পরিণত হয়েছে”।[মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা, পূর্বোল্লেখিত, পৃঃ ৮২।]
তিনি আরও লিখেছেন, “এ মহা বিপর্যয়ের ধ্বংসলীলা দেখে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণ শিউরে উঠেছেন। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চস্বরে ধ্বনি উত্থিত হচ্ছেঃ “একটি অতি ক্ষুদ্র দায়িত্বহীন স্বার্থান্ধ শ্রেণীর হাতে ধনের ও বিপুল শক্তি কেন্দ্রীভূত হওয়া সমগ্র সমাজ ও জাতীয় জীবনের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর”। [ইবিদ, পৃ: ৮২।]
সুদের কুফল অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদুর প্রসারী। সমাজ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ এবং ধর্মবিশারদগণ সুদের অশুভ ফল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এসব আলোচনায় দেখা যায় যে, সুদের অনিষ্ট কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এর ক্ষতি ও ধ্বংসকারিতা মানবজীবনের নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মারাত্মক আঘাত হানে। সুদের কুফলগুলো নিম্নলিখিত চারটি শিরোনামে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারেঃ
-নৈতিক ও সামাজিক কুফল;
-অর্থনৈতিক কুফল;
-রাজনৈতিক কুফল ও
-আন্তর্জাতিক কুফল।