চতুর্থ অধ্যায়: ক্রয়-বিক্রয় ও মুনাফা
আল্লাহ তা’য়ালা সূরা আল-বাকারাহর ২৭৫ আয়াতে বলেছেন, “আল্লাহ বাইকে হালাল করে আল্লাহ তা’য়ালা সূরা আল-বাকারাহর ২৭৫ আয়াতে বলেছেন, “আল্লাহ বাইকে হালাল করেছেন, আর রিবাকে করেছেন হারাম”। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ এক শাশ্বত ও চিরন্তন প্রাকৃতিক সত্যের ঘোষণা দিয়েছেন। বাই হচ্ছে মানব জাতির জন্য অত্যাবশ্যকীয় ও কল্যাণকর; তাই হালাল। আর রিবা হচ্ছে মানুষের জন্য অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর এজন্যই রিবা হারাম। বাই ও রিবার পার্থক্য আলোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে আশা করা যায়। আল্লাহ তা’য়ালা প্রথমে বাই আর পরে রিবার কথা বলেছেন। একই ধারাবাহিকতায় আলোচনা করলে বিষয় দু’টি বুঝা সহজ হবে।
বাই বা ক্রয়-বিক্রয়
বাই অর্থঃ উক্ত আয়াতাংশে আল্লাহ আরবী বাই (********) শব্দ ব্যবহার করেছেন। ‘বাই’- এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়। মিলটন কাওয়ান বাই অর্থ লিখেছেন, “to sell, to buy and sale, to make a contract of purchase and sale; to offer for sale; to agree on the terms of sale; conclude a bargain”[ Cowan, John Milton (ed): A Dictionary of Modern Written Arabic, Third Printing, Macdonald & Evans Ltd., London, 1994, p. 86] বিক্রয় করা ক্রয়-বিক্রয় করা, ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি, বিক্রয়ের জন্য পেশ করা, বিক্রয়ের শর্তে সম্মত হওয়া, ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদন করা”।
“It is the word with two opposite meanings, i.e, purchase and sale; sale and purchase, respectively.”[Al Munjed on Words and Information, Catholic Church Group, Dar ElMashreque Publishers, Beirut, Lebanon, 1986, p., 57.]বাই এমন একটি শব্দ যার দু’টি বিপরীতমূখী অর্থ রয়েছে, অর্থাৎ যথাক্রমে ক্রয় এবং বিক্রয়, বিক্রয় এবং ক্রয়”।
‘Bai: To purchase; To sell (of goods).”[Arbi Bangia Ovidhan, Bangia Academy, 1984, Second Edition, Vol. 1, p. 745] “বাই (পণ্যদ্রব্য) ক্রয় করা; বিক্রয় করা”।
সুতরাং ‘বাই’ অর্থ হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়। ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমেই করা হয় ব্যবসা, আর ব্যবসা থেকে আসে লাভ বা মুনাফা। এজন্য কোন কোন অনুবাদক বাই-এর অর্থ করেছেন ব্যবসা; কেউ কেউ আবার এর তরজমা করেছেন মুনাফা। প্রকৃতপক্ষে ক্রয়-বিক্রয় যত ব্যাপক ব্যবসা ও মুনাফা তত ব্যাপক নয়। সুতরাং বাইকে অর্থে গ্রহণ করাই উত্তম।
বাই-এর সংজ্ঞাঃ ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ বেহেশতের বিনিময়ে মুমিনদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন”।[আল-কুরআনঃ ৯:১১১।] এখানে আল্লাহ শিরা (ক্রয়) শব্দ ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ বেহেশত দিবেন, আর জান-মাল নিয়েছেন। এ কথা স্পষ্ট ইঙ্গিত করে যে, ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে কিছু দিয়ে তার বিনিময়ে কিছু নেওয়া। ফকীহগণ বিভিন্ন ভাষায় ক্রয়-বিক্রয়ের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার কয়েকটি সংজ্ঞা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
a) “Bai is conveying the title through offer and acceptance when both of them are in the past form.”[Al-Fiqh ‘ala al-Madhahib al-Arba ‘ah, Abdal-Rahman ai-Jaziri, Beirut, Lebanon, Vol-2, p. 147.] অর্থাৎ “বাই হচ্ছে প্রস্তাব (ঈজাব) ও সম্মতি (কবুল) এর মাধ্যমে মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তর/বিনিময় করা; ঈজাব ও কবুল উভয়টি অতীত কালের শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হলে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য হয়”।
b) Bai is “to aquire the very ownership by payment of recompense/indemnity of the same” অর্থাৎ বাই হচ্ছে, “কোন কিছুর সমতুল্য বিনিময়/ক্ষতিপূরণ প্রদান পূর্বক এর মালিকানা গ্রহণ কার”।
c) “The terminology baai expresses the concept of exchange of goods against the other in the process of mutual consent or transfer of ownership against equivalent (value).”[ Shaokani, Muhammad, Nailul Awtar, Idaratul Quran al Ummul Islamiat, Karachi, Pakistan, vol. 5, p. 150.] অর্থাৎ “বাই শব্দটি পারস্পরিক সম্মতি ভিত্তিতে এক পণ্যের সাথে অপর পণ্যের বিনিময়কে বুঝায় অথবা বাই হচ্ছে সমমূল্যের বিনিময়ে কোন পণ্যের মালিকানা হস্তান্তর কারা”।
Bai is the reciprocal exchange of counter values. “ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে সমান সমান মূল্যের পারস্পরিক বিনিময়”।
বাইয়ের উল্লেখযোগ্য বিষয়ঃ উপরের সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়গুলো পাওয়া যায় তা হচ্ছেঃ
ক). মালিকানাঃ ক্রেতা-বিক্রেতার নিজ নিজ পণ্য, অর্থ বা সেবার ওপর তাদের মালিকানা থাকা ক্রয়-বিক্রয়ের অপরিহার্য শর্ত। মালিকানা নেই এমন কোন বস্তু ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। তবে চুক্তির শর্তানুসারে ভবিষ্যতে মাল উৎপাদন, তৈরী বা ক্রয় করে মালিকানা অর্জন করার পর অপর পক্ষকে সরবরাহ করাও বৈধ; এরূপ ক্ষেত্রে চুক্তিতে মালের স্পেসিফিকেশন নির্ধারণ করে নিতে হবে।
খ). মূল্য নির্ধারণঃ আসলে ক্রয়-বিক্রয়ে বিনিময়ের বস্তুর একটি অপরটি প্রতিমূল (counter-value)। চুক্তি করার পূর্বেই উভয় মূল্য নির্ধারণ করা বিধেয়। মূল্য নির্ধারণ ব্যতীত ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হয় না।
গ). উভয় মূল্য সমান সমান হওয়া (equality of value) ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে মূল্যের সাথে প্রতিমূল্যের বিনিময়, exchange of counter-values. কাউন্টার ভ্যালু বলতে সমান সমান মূল্য বুঝায়। অর্থাৎ উভয় পক্ষের মূল্য সমান না হলে ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হয় না।
ঘ). ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে পারস্পরিক ক্ষতিপূরণপূর্বক বিনিময় করাঃ ক্রয়-বিক্রয়ে পরস্পরের ক্ষতিপূরণ করে পণ্য-সামগ্রী, সেবা বা অর্থ বিনিময় করা হয়। ক্রেতা বিক্রেতার কাছ থেকে কোন জিনিস নিলে বিক্রেতার যে ক্ষতি হয়, ক্রেতা সমমূল্যের কোন জিনিস বা অর্থ দ্বারা বিক্রেতার উক্ত ক্ষতি পূরণ করে দেয়। অনুরূপভাবে বিক্রেতাকে মূল্য প্রদান করায় ক্রেতার যে ক্ষতি হয় বিক্রেতা সমমূল্যের জিনিস দিয়ে ক্রেতার সে ক্ষতি পূরণ করে দেয়। ফলে ক্রয়-বিক্রয়ের পূর্বে উভয়ের অর্থনৈতিক অবস্থা যে পর্যায়ে ছিল, ক্রয়-বিক্রয়ের পরেও ঠিক সেই একই অবস্খানে থাকে; ক্রয়-বিক্রয় বা বিনিময়ের ফলে কারও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয় না।
ঙ). পারস্পরিক সম্মতিঃ পারস্পরিক সম্মতি ক্রয়-বিক্রয়ের একটি অপরিহার্য শর্ত। আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশ হচ্ছে, “তোমনা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসা কর”। (৪:২৯) আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই ক্রয়-বিক্রয় পারস্পরিক সম্মতির ওপর ভিত্তিশীল”।[ফাতহুল বারি, ভলি-৪, পৃ: ২৩০।]
চ). ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ইনসাফপূর্ণঃ ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা বা বিক্রেতার কেউ ঠকে না, আর কেউ জিতেও না। এতে পূর্ণ ইনসাফ ও সুবিচার বহাল থাকে, কারও প্রতি কোন প্রকার জুলুম বা বে-ইনসাফী হয় না।এতে পূণ ইনসাফ ও সবিচার বহাল থাকে, কারও প্রতি কোন প্রকার জুলুম বা বে-ইনসাফী হয় না। ক্রয়-বিক্রয় বা বিনিময়ের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষ কেউ কারও ক্ষতি না করেই পরস্পর উপকৃত হয়ে থাকে।
ক্রয়-বিক্রয়ের মৌলিক শর্ত
উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, ক্রয়-বিক্রয়ের মৌলিক শর্ত হচ্ছে ২টিঃ
ক). মূল্যের সমতা (equality of Value), এবং খ). পারস্পরিক বিনিময় (reciprocity of exchange)। ক্রয়-বিক্রয়ে যাতে পূর্ণ ইনসাফ বহাল থাকে এবং কোন পক্ষের প্রতি কিছু মাত্র বেইনসাফী বা জুলুম না হয় সেজন্য এ দু’টি মৌলিক শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। অন্যথায় ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হবে না।
ক). মূল্যের সমতাঃ ক্রয়-বিক্রয়ে দু’টি পক্ষ_ বিক্রেতা ও ক্রেতা। বিক্রেতার কাছে কোন পণ্য, সেবা (service) অথবা মুদ্রা থাকতে পারে। অনুরূপথভাবে ক্রেতার নিকটও থাকতে পারে কোন পণ্য, সেবা বা মুদ্রা। উভয় পক্ষের পণ্য, সেবা বা মুদ্রা এই জাতের হতে পারে অথবা সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন জাতের হতে পারে। পণ্য, সেবা বা মুদ্রা যাই থাকুক এবং ওগুলো সমজাতের হোক বা অসমজাতের হোক, পরস্পর ক্রয়-বিক্রয় করতে হলে প্রথমেই উভয় পক্ষের পণ্য, সেবা বা মুদ্রার মূল্য সমান সমান করে নিতে হবে। একটি হতে হবে অপরটির কাউন্টার ভ্যালু। ইনসাফ বা সুবিচারের এটাই দাবী। কাউন্টার ভ্যালু বলতে মূল্যের সমতাকেই বুঝায়।
ড. উমর চাপরা বলেন, “Justice can be rendered only if the two scales of the balance carry the same value of goods.”[চাপরা, ড. এম, উমর: পূর্বোক্ত, পৃ: ১০।] সুবিচার কেবল তখনই সম্ভব হয় যখন দাঁড়িয়ে উভয় পাল্লায় একই সমান (মূল্যের) মাল-সম্পদ তোলা হয়”। তিনি বলেছেন, “The price and counter value should be just in all transactions …”[উপরোক্ত।] “সকল লেনদেন দাম এবং এর প্রতিমূল্য ন্যায়সঙ্গত হতে হবে”।
খ) পারস্পারিক বিনিময় (reciprocal exchange)ঃ ক্রয়-বিক্রয়ে দেওয়া ও নেওয়া উভয়টাই হয় পারস্পরিক (reciprocal)। বিক্রেতা জিনিস দেয়, অর্থ দেয়, অর্থ নেয়; আর ক্রেতা অর্থ দেয়, জিনিস নেয়। আধুনিক পরিভাষায় একেই বলা হয় eciprocal exchange; কেউ কেউ আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ‘’commutative contract [Nyazee, Imran Ihsan Khan, The Rules and Definition of Riba, [email protected], Dec. 2000, p. 5.] অথবা ‘synallagmatic contract’।]
ড. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী equivalence ও reciprocity কে ক্রয়-বিক্রয়ে সুবিচারের যমজ মানদণ্ড (Twin norms of justice) আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, (justice) relies on the notions of equality and reciprocity.”[সিদ্দিকী, এম, এন: পূর্বোক্ত, পৃ: ৭৩।] “(মূল্যের) সমতা এবং পারস্পরিক বিনিময়ের ওপরই সুবিচার (justice) নির্ভর করে”।
উপরের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ইনসাফপূর্ণ; আর ক্রয়-বিক্রয়ে এ দুটি মৌলিক শর্ত অবশ্যই প্রযোজ্য। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ক্রয়-বিক্রেয়ে দুটি সমান সমান বা কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণ এবং তা পরস্পর বিনিময় করার বিধান নির্দেশ করেছেন।
ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান
ক্রয়-বিক্রয়ে প্রথমে কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণ করতে হয়; অতঃপর কাউন্টার ভ্যালু দু’টি লেনদেন বা বিনিময় করতে হয়।
ইতোপূর্বে সুন্নাহর দৃষ্টিতে সুদ অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে যে, কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সমজাতের পণ্য, অর্থ ও সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে ২টি এবং অসমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ে একই বিধান নির্দেশ করেছেন; আর বিনিময়ের জন্য উভয় প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ে একই বিধান দিয়েছেন।
সমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ে কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণের বিধান ২টি হচ্ছেঃ
১. মিসলান বিমিসলিন (like for like) বা উভয় বস্তুর মানগত সমতা (qualitative equality) বিধান করা;
২. সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন (equal for equal) বা উভয় বস্তুর পরিমাণ সমান (quantitative equality) করা এবং বিনিময়ের বিধানটি হচ্ছেঃ
৩. ইয়াদান বিইয়াদিন (from hand to hand) বা পারস্পরিক বিনিময় (reciprocal exchange)করা।
আর ভিন্ন ভিন্ন জাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ে কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণের বিধানটি হচ্ছেঃ
১. পারস্পরিক সম্মতি বা “ফাবিয়ূ” কাইফা শি’তুম”- যে কোন দাম বা পারস্পরিক সম্মতিতে (mutual consent) নির্ধারিত যে কোন দামে বিক্রি করা বৈধ এবং এক্ষেত্রে বিনিময়ের বিধানটি হচ্ছেঃ
২. ইয়াদান বিইয়াদিন(from hand to hand) বা পারস্পরিক বিনিময় করা।
নিচে ব্যাখ্যা পেশ করা হলোঃ
সমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়
কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণের বিধান
১. মিসলান বিমিসলিন (like for like মানগত সমতা বা qualitative equality): ফক্বীহগণ সাধাণরভাবে মিসলান বিমিসলিন বা মানগত সমতাকে একটি স্বতন্ত্র ও পৃথক বিধান হিসেবে গণ্য করেননি। কখনও তাঁরা মিসল (মান) ও জিনিস (জাত)- কে এক মনে করেছেন; আবার কখনও মিসল ও মুসাওয়াতকে (পরিমাণগত সমতা) একই অর্থে গ্রহণ করেছেন।
কতিপয় হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মানগত তারতম্যের কারণে সমজাতের দু’টি বস্তু পরিমাণে কম-বেশি করে বিনিময় করা হলে একদিকের বাড়তি পরিমাণকে রিবা বলেছেন। তিনি এভাবে বিনিময় করতে নিষেধ করেছেন এবং নিম্ন মানের বস্তুটি অর্থ বা ভিন্নতর কোন পণ্যের বিনিময়ে বিক্রি করে প্রাপ্ত মূল্য দ্বারা একই জাতের উন্নত মানের বস্তু ক্রয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সুন্নাহর দৃষ্টিতে ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ শিরোনামে হাদীস নং ১৩-১৭ এবং ৭৫-৭৮।)
এসব হাদীস থেকে এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে, সমজাতের দুটি বস্তুর মধ্যে গুণ ও মানগত পার্থক্য থাকলে তা বিবেচনায় এনে এদের পরিমাণে কম-বেশি করা যাবে না; বরং সর্বাবস্থাতেই পরিমাণ ((volume), ওজন (weight) বা গণনার ভিত্তিতে উভয় বস্তুর পরিমাণ সমান সমান করে বিনিময় করতে হবে। হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ফক্বীহ ইমাম সারাখসী লিখেছেন, “মিসলান বিমিসিলিন অর্থ হচ্ছে পরিমাণগত সমতা বিধান করা, গুণগত নয়, যদিও সমতা শব্দ দ্বারা উভয় প্রকার সমতাকেই বুঝায়”।[সারাখসী: Al.Mabsut: ইংরেজী অনুবাদ, ইমরান, আহসান খান নিয়াজী, info@nyazee, 2000, p. 15] “gold dust and gold metal are the same”—উবাদা ইবনে সামিতের এই উক্তি তুলে ধরে তিনি বলেছেন, “এই কথা সুস্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, সমতা অর্থ হচ্ছে পারিমাণের সমতা, মানের সমতা নয়। কারণ স্বর্ণচূর্ণের মান আর স্বর্ণপিণ্ডের মান সমান নয়। অথচ ওপনে (পরিমাণে) সমান হলেই উভয়টি সমান (equal) হয়ে যায়”।[উপরোক্ত, পৃ: ৫।]
আল-মিসরি পরিষ্কার ভাষায় লিখেছেন, “দুটি খেজেুর যদি মানের দিক দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন হয় তবু উপযুক্ত মানদণ্ডের (standard) ভিত্তিতে এদের পরিমাণ সমান সমান হতে হবে। এভাবে উন্নত মানের (superior) পণ্যের অধিকারী নিম্নমানের (inferior) পণ্যের মালিকের প্রতি উদার (মুহসিন, generous) হবে। অন্যথায় তারা তৃতীয় কোন পণ্যের মাধ্যমে তাদের পণ্য বিনিময় করবে”।[রফিক ইউনিস আল-মিসরি, রিবা আল কুরুদ ওয়া আদিল্লাতু তাহরিমিহি, ১৯৮৭, পৃ: ৮, উদ্ধৃত, নুর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১০১]
ইমাম শাফিঈ, আল্লাম মওদূদী ও বিচারপতি তকি উসমানিসহ অনেকেই অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এমনকি, পাকিস্তানের ইসলামিক ইডিওলোজি কাউন্সিলের রিপোর্ট এবং ১৯৮৭ সালে Indexation- এর ওপর অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনার থেকেও এই একিই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতার সাথে এ ব্যাখ্যার সঙ্গতি নেই। বাস্তবে দেখা যায়, একই জাতের পণ্য হওয়া সত্ত্বেও গুণগত তারতম্যের দরুন দুটি বস্তুর উপযোগে ব্যাপক পার্থক্য সূচিত হয় এবং এদের দামে সৃষ্টি হয় বিরাট ব্যবধান। অথচ কেবল একই জাতি বা প্রজাতিভুক্ত হওয়ার করণে এদের পরিমান সমান সমান বিনিময় করতে হবে, সাধারণ বুদ্ধিও এতে সায় দেয় না। তাই আধুনিক গবেষকদের অনেকেই এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন।
এস, এ. তাহের এ প্রসঙ্গে বলেছেন, উক্ত হাদীসে সোনার পরিবর্তে সোনা বলার পর ‘মিসলান বিমিসলিন’ বলা হয়েছে। সোনার বদলে সোনা কথার দ্বারা পণ্যের জাতিগত মিলের কথাই তো বলা হয়েছে। সুতরাং মিসলান বিমিসলিন-এর অনুবাদ জাতিগত সমতা হতে পারে না।[১৫] এলমি মাহমুদ নুরও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “জাতিগত মিল অপেক্ষা অধিক ও ভিন্নতর অর্থ বুঝানোর জন্যই মিসকিন বিমিসলিন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে”।[১৬] অপরদিকে মিসলান বিমিসলিনকে পরিমানগত সমতার সাথে একই অর্থে গ্রহণ করাও সঙ্গত নয়। কারণ ভাষাগত দিক থেকে আল-মিসল জিনিসের গুণ-মানকে বুঝায়; কিন্তু তাসাভী (সাওয়ায়ান থেকে উদ্ভূত) কেবল পরিমাণগত সমতা বুঝায়। আর এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, মান ও পারিমণ এক ও অভিন্ন বিষয় নয়। অর্থাৎ দুটি জিনিস সদৃশ, একথা দ্বারা এটা বুঝায় না যে, জিনিস দু’টি পরিমাণে সমান সমান।
এলমি নূর এ ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছেন। আল-মুহিদুল মুহিদ ও An Advanced Learners Arabic Dictionary- এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন যে, সেখানে ‘মিসল’ অর্থ লিখা হয়েছে সাদৃশ্য, সদৃশ, অনুরূপ, ঐক্য (correspondence) ও সমতা (equivalence)। মিসল থেকে উদ্ভূত আল-মুমাসাল (similarity) ও সাওয়ায়ান থেকে উদ্ভূত আল-মুসাওয়াত (equivalence) শব্দদ্বয়ের আভিধানিক অর্থের তুলনা করে তিনি বলেছেন যে মিসল শব্দ পণ্যের গুণগত দিক প্রদর্শন করে; কিন্তু তাসাভী শব্দ জিনিসের পরিমাণগত দিক নির্দেশ করে। আল-মুজরা-এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন যে, দুটি পণ্যের অভিন্নতা বুঝানো ব্যতীতি অন্য কোন অর্থে আল-মুমাসালা ব্যবহৃত হয় না; কিন্তু আল-মুসাওয়াত অভিন্ন জিনিস এবং জাত বা সৃষ্টিগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন জিনিস ও উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়; কারণ ‘তাসাভী’ কেবল পরিমাণগত সমতা বুঝায়, যার অর্থ পরিমাণে বেশিও নয়, কমও নয়। তিনি বলেন, ইবনে মনসুরও লিসান আল-মুসাওয়াত সদৃশ ও বিসদৃশ উভয় পণ্যের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়, কারণ ‘আল-তাসাভী’ হচ্ছে কেবল গনণা বা পরিসংখ্যানগত সমতা যার দ্বারা বুঝা যায় যে, মিসল শব্দটি গুণকে বুঝায়, যেমন, উপযুক্ততা (fitness),যথার্থতা (suitability) এ অবস্থান (status) অথবা অবস্থা।
আল-কুরআনে ব্যবহৃত মিসল শব্দের অর্থ তুলে ধরে জনাব নূর লিখেছেন, আল্লাহ তাঁর নিজের ব্যাপারে বলেছেন, “তাঁর মত (কামিসলিহি) কিছুই নাই” (৪২:১১)। আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন; :তোমরা যেমন ঈমান এনেছ তারাও যদি ঠিক সেইরূপ (বিমিসলি) ঈমান আনে, তবে তারা সঠিক পথ পেল”। (২:১৩৭) এসব আয়াতে মিসল শব্দ দ্বারা গুণগত সমতাকেই বুঝানো হয়েছে।
জনাব নূর লিখেছেন, রিবা ফদলের ক্ষেত্রে সমজাতর বস্তুর গুণগত সমতা বিধান করার বিষয়কে বিবেচনার বাইরে রাখলেও সম্মানিত ফক্বীহগণ সাধারণভাবে মিসল সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, দু’টি জিনিস সদৃশ (মিসলিয়্যাত) হতে হলে দু’টি শর্ত পূরণ করতে হবেঃ প্রথমত, জিনস বা (genus) বা জাতিগতভাবে এদেরকে সমশ্রেণী বা দলভুক্ত হতে হবে; দ্বিতীয়ত, এদের মূল্য তথা বাজার দাম হতে হবে সর্বতোভাবে (absolutley) সমান।
জনাব নূর বলেছেন, প্রথম শর্তটি হাদীস থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। হাদীসে সোনার পরিবর্তে সোনা, রূপার পরিবর্তে রূপা ইত্যাদি বলে জেনস বা জাতগত মিসল এমন জিনিসকে বুঝায় যার অংশসমূহের দাম পরস্পর সমান। জনাব নূর বলেছেন, ইমাম তাইমিয়া, ইবনুল কায়্যিম, ইমাম গাজালী ও আবূ ইউসুফ প্রমুখ বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে যে, “দামের পার্থক্য পণ্যের সাদৃশ্য দূরীভূত করে দেয়”। ইবনে তাইমিয়া অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে, দু’টি পণ্য কেবল তখনি সদৃশ হবে যখন তাদের দাম সমান হয়; কিন্তু এদের বিনিময় মূল্যে পার্থক্য থাকলে এরা সমতুল্য (মিসল) হয় না”। আলী আল খফিফ এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, দু’টি বস্তু পূর্ণ সদৃশ (absolutely alike) হতে হলে এদের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যসমূহ (যা শ্রেণী বা জাত নিরূপণ করে) সর্বতোভাবে এক রূপ হতে হবে এবং এদের বাজার মূল্য হতে হবে সমান সমান করার লক্ষেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মিসলান বিমিসলিন-এর বিধান নির্দেশ করেছেন।
জনাব নূর লিখেছেন যে, ফক্বীহগণ সমজাতের দুটি বস্তু নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পণ্যের গুণ ও মানগত পার্থক্য বিবেচনায় আনতে নিষেধ করেছেন; কিন্তু ঋণ লেনদেনের ক্ষেত্রে এসে তাঁরা ‘মিসলিয়্যাত’ তথা পণ্যের গুণ ও মানগত সমতাকে ঋণের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং সদৃশ পণ্য ব্যতীত ঋণ প্রদান করা বৈধ নয় রায় দিয়েছেন।[নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১০৭-১১৮।] কারণ ঋণ হচ্ছে, কোন ফাঞ্জিবল পণ্য সমজাতের পণ্যের বিনিময়ে বাকিতে বিক্রি করা।
তাহলে আসল কথা এই দাঁড়ালো যে, এক জাতের পণ্য বাকিতে বিনিময় করা হলে পণ্যের মান সমান সমান হতে হবে; কিন্তু এই বিনিময়ই যদি উপস্থিত নগদ নগদ করা হয়, তাহলে উভয় পণ্যের মানগত পার্থক্য আমলে নেয়া যাবে না। এরূপ অভিমত পরস্পরবিরোধী, অযৌক্তিক ও বাস্তবতা পরিপন্হী। সুতরাং ঋণের ক্ষেত্রে যেমন নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও তেমনি মিসলিয়্যাতকে একটি স্বতন্ত্র ও অপরিহার্য শর্ত গণ্য করা জরুরী।
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) জাতগত মিল তথা সোনার পরিবর্তে সোনা, রূপার বদলে রূপা বলার পর ‘মিসলান বিমিসলিন’ শর্তের উল্লেখ করে এ কথাই বুঝিয়েছেন যে, বিনিময়ের পণ্য, অর্থ বা সেবা একজাতের হলে এদের গুণ ও মানগত সমতাও থাকতে হবে যাতে এদর দাম বা বিনিময় মূল্য সমান সমান করা যায় অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘আইনান বিআইনিন’ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। এক অর্থ হচ্ছে, “এটা যেমন সেটা তেমন”। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ‘মিসলান বিমিসলিন’ দ্বারা মানগত সমতার কথাই বলা হয়েছে।
এতদসংশ্লিষ্ট হাদীসগুলো একটু গভীরভাবে দেখলেই বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোথাও এ কথা বলেননি যে, “এক জাতের পণ্যের গুণ-মানগত পার্থক্যকে উপেক্ষা করতে হবে”।[নূর, ই, এম: উপরোক্ত, পৃ: ১০৩।] বরং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণীর আসল বার্তা (message) হচ্ছে, একজাতের দুটি পণ্যের গুণগত তারতম্যকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে এবং মানগত তারতম্যের কারণে উভয় পণ্যের দামে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয় তার সমন্বয় অবশ্যই করতে হবে”।[উপরোক্ত।] তবে তা সরাসরি বিনিময়ের দ্বারা সম্ভব নয় বিধায় তিনি এ ধরনের বস্তুর সরাসরি বিনিময় নিষিদ্ধ করেছেন এবং ভিন্নতর পন্হা অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণীতে এ কথা স্পষ্ট যে, একজাতের পণ্য, অর্থ বা সেবার পরস্পর বিনিময় রেশিও হচ্ছে ১:১। অর্থাৎ উভয়ের পরিমাণ সমান সমান করা- এক্ষেত্রে এটাই বিধান। কিন্তু গুণ-মনগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয় পণ্যের পরিমাণ সমান সমান করলে এদের পারস্পরিক মূল্য সমান হয় না। এ জন্যই তিনি এদের পরিমাণ সমান সমান করে সরাসরি বিনিময় করার নির্দেশ দেন নাই।
অপরদিকে মানের পার্থক্যের দরুন ভাল’র কত পরিমাণের বিনিময়ে মন্দের কত পরিমাণ দিলে বা কোন রেশিওতে বিনিময় করলে এদের প্রকৃত দাম পরস্পর সমান সমান হবে, সরাসরি বিনিময়ে তা নির্ধারণ করাও সম্ভব নয় ভালর বিভিন্ন স্তর এ শ্রেণী আছে; অনুরূপভাবে মন্দেরও পরিমাণ কত হলে তাদের পারস্পরিক মূল্য সমান হবে তা নিরূপণ করার কোন মানদণ্ড এক্ষেত্রে নেই। ফলে উভয় পণ্যের বিনিময়ের হার নির্ধারণ করতে হবে অনুমানের ভিত্তিতে এবং এতে রিবা থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। উপরে উল্লেখিত আবূ নাদনা বর্ণিত হাদীসের (ক্রমিক-৭৮) শেষে সহীহ মুসলিমে আবূ সাঈদ (রাঃ) নিজে এই কথাটাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
বস্তুতঃ জাহেনী যুগে আরব দেশে স্বর্ণ মুদ্রা হিসেবে দীনার এবং রৌপ্য মুদ্রা হিসেবে দিরহাম প্রচলিত ছিল। ইবনুল কায়্যিম লিখেছেন, “(আরবরা) দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম বিক্রয় করত। দিরহামের গুণগত পার্থক্য, এদর মুদ্রাংকন বৈশিষ্ট্য অথবা ওজনের তারতম্য ইত্যাদি কারণেই তারা এরূপ কম-বেশি করে বিনিময় করত। আর এটিই হচ্ছে প্রকৃত রিবা”।[উপরোক্ত, পৃ: ১০৯।] ড. নাজতুল্লাহ সিদ্দিকী লিখেছেন, “তৎকালে (আরব এলাকায়) প্রচলিত স্বর্ণ ও রূপার তৈরী মুদ্রার মধ্যে গুণগত মানে ছিল বেশ পার্থক্য; এছাড়া একই নামে প্রচলিত মুদ্রার ওজনেও ছিল কম-বেশি। ফলে যে কোন লোক অতি সহজেই অন্যকে প্রতারিত করে গুণগত মানের তারতম্যের অজুহাতে সোনার সাথে সোনা (পিণ্ড বা মুদ্রা) এবং রূপার সাথে রূপা (পিণ্ড বা মুদ্রা) কম পরিমাণের সাথে বেশি পরিমাণ বিনিময় করে নিতে পারত”।[সিদ্দিকী, এম, এন, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৯।] এ প্রসঙ্গে সাইয়ের মওদূদী লিখেছেন, “সে যুগে দিরহামের সাথে দিরহাম এবং দীনারের সাথে দীনারের বিনিময় করার প্রয়োজন কোন কোন সময় দেখা দিত। এ জাতীয় প্রয়োজনের সময় ইয়াহুদী মহাজন ও অন্যান্য অবৈধ মুনাফা অর্জনকারীর দু’হাতে অবৈধভাবে মুনাফা লুটতো, অনেকটা আজকের যুগে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের সময় বাট্রা গ্রহণ অথবা নিজ দেশে টাকার রোজগারী চাওয়া বা দশ টাকা পাঁচ টাকার নোট ভাঙ্গানোর সময় কিছু পয়সা উসূল করার মতো”।[মওদূদী, সাইয়েদ আবূল আ’লা: প্রাগুক্ত, পৃ: ১০২।]
প্রসঙ্গে ড. চাপরা বলেছেন, “একজাতের নিম্ন ও উন্নত মানের পণ্যের পারস্পরিক বিনিময় চালু থাকলে সমাজের অপেক্ষাকৃত স্বল্প বুদ্ধির লোকেরা চালাক লোকদের প্রতারণা ও ঠকবাজির শিকার হতে পারে। এরূপ বিনিময়ে নিঃসন্দেহে মানুষকে ধোকা দেওয়া ও এভাবে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করার আশংকা রয়েছে”।[চাপরা, এম উমর, প্রাগুক্ত, পু: ২১।] এলমি মাহমুদ নূরএ এই একই কথা বলেছেন নিম্ন ভাষায়ঃ
“It is hardly to find some one accepting inequality if the two items the same in quality, but there is every possibility that an undue quantitaive discrepancy may be acquired by either party through quality difference knwingly or unlnowingly and with the satisfaction of the both parties,”[নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১১৪।] “সমজাতের দু’টি পণ্যের মান এক রকম হওয়া সত্ত্বও এদের পরিমাণ অসমান করে গ্রহণ করতে রাজি হবে এমন কোন লোক খুজেঁ পাওয়া কঠিন; কিন্তু পণ্য দু’টির মানে তারতম্য থাকলে ক্রেতা-বিক্রেতার যে কোন এক পক্ষ এর সুযোগ গ্রহণ করবে এবং জেনে-বুঝে বা অজ্ঞাতসারে এমনকি, উভয় পক্ষের সম্মতিতেই পণ্য দু’টির পরিমাণ কম-বেশি করার মাধ্যমে অপরপক্ষকে ঠকিয়ে বেশি পরিমাণ নিয়ে যাবে এরূপ আশংকা খুবই প্রবল”। ই, এম, নূর আবার লিখেছেন,
“In other words, the price of an article in respect of itself is equivalent to itself only nothing else. In case the counterparts have different characteristics, presumably due to the existence of visible quality disparity, neither consideration will directly indicate the exact price of the other… hence the notion of price whether absolute or relative terms, is irrelevant to these counterparts in exchange of reciprocal identity.”[ নূর, ই, এম, উপরোক্ত, পৃ: ১৬৭।] “অন্যকথায়, সমজাতের জিনিসের অংকে কোন জিনিসের দাম কেবল মানগত অসমতার দরুন অপরপক্ষের জিনিসটি যদি ভ্ন্নিতর বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়, তাহলে এর কোন পরিমাণই সরাসরিভাবে অপর জিনিসটির প্রকৃত দাম নির্দেশ করবে না।……. সুতরাং সমজাতের ভিন্ন ভিন্ন মানের দু’টি বস্তু সরাসরি ক্রয়-বিক্রয়ে দামের ধারণা, নিরংকুশ (absolute) অর্থে হোক আর আপেক্ষিক অর্থে (relative), সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক”।
মূল্য তত্ত্বের মৌলিক নীতিমালা ব্যাখ্যা করে তিনি আবার লিখেছেন- “”Objects express their exchange values reciprocally against each other. However, in the case of a particular object against itself, the situation is totally different … the objects are silent to express their own exchange values. For the price of an article in respect to itself would be equivalent to itself only, no more no less. For instance in case the counterparts are of the same kind with different characteristics no either consideration will directly indicate the exact price of the other. Therefore, the theory of value necessitates that another item be introduced in assessing the exchange price of the object and accurately measuring the economic relations of the considerations. “[নূর, ই, এম, উপরোক্ত, পৃ: ২০৮।ক]
‘দুটি বস্তু পরস্পর একটি অপরটির অংকে তাদের বিনিময় মূল্য ব্যক্ত করে থাকে। কিন্তু বিনিময়ের বস্তু দু’টি যদি একই জাতের হয় তাহলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্নতর রূপ নেয়,… বস্তু দু’টি নিজ নিজ মূল্যে প্রকাশে সম্পুর্ণ নীরব হয়ে যায়। কারণ একই জাতের বস্তুর বিনিময়ে কোন বস্তুর বিনিময় মূল্য কেবল সেই বস্তুটির সমান হয়, তার চেয়ে বেশিও হয়না কমও হয় না। আর অপর বস্তুটি যদি একই জাতের কিন্তু ভিন্নতর মানের হয় তাহলে এর কোন পরিমাণই সরাসরিভাবে বস্তুটির সঠিক বিনিময় মূল্য নির্দেশ করবে না। সুতরাং মূল্য তত্ত্বের অপরিহার্য যথাযথ পরিমাণ করতে হলে তৃতীয় আর একটি বস্তু দ্বারা করতে হবে”।
এসব কারণে নবী করীম (সাঃ) নিম্ন মানের কোন পণ্যের বেশি পরিমাণের সাথে একই জাতের উন্নত মানের পণ্যের কম পরমাণের বিনিময় করতে নিষেধ করেছেন। একই সাথে এরূপ বিনিময়ে কিভাবে উভয় পণ্যের মূল্য সমান সমান করতে হবে তার পন্হাও তিনি নির্দেশ করেছেন। অর্থ বা ভিন্ন কোন পণ্যের বিনিময়ে খারাজ খেজুর কিনে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এভাবেই পরিমাপ (মীযান) পূর্ণ হবে”।[পূর্বোল্লেখিত হাদীস নং ১৫।খ] এ বাক্য দ্বারা আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যথার্থ পরিমাণ খেজুর লেনদেন হওয়ার কথাই বুঝিয়েছেন।
বস্তুতঃ এরূপ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তৃতীয় কোন পণ্য বা অর্থকে বিনিময়ের পণ্য, অর্থ বা সেবার মান ও দাম পরিমাপ করার মানদণ্ড বানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আর এভাবে এক্ষেত্রে যাবতীয় অন্যয্য (unfair) বিনিময়ের আশংকা দূর করে দিয়েছেন।
এলমি নূর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “If the two goods are homogeneous, they have observable quality difference, the only way to assess this difference is through their market prices. The prevailing price in the market in its normal condition can be the measuring rod of the qualitative discrepancy between any two commodities of similar kind”[নূর, ই, এম, উপরোক্ত, পৃ: ২০৩।] “সমজাতের দু’টি পণ্যের মধ্যে মানগত তারতম্য নিরূপন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে এদের বাজার দাম; স্বাভাবিক অবস্থায় বাজারে বর্তমান দামই সমজাতীয় দু’টি পণ্যের মানগত পার্থক্য পরিমাপ করার মানদণ্ড হতে পারে”।
এখানে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, তৃতীয় কোন পণ্যের বিনিময়ে বিক্রয় এবং বাঞ্চিত পণ্য ক্রয় করার জন্য বাজারে যাওয়া-আসা ইত্যাদি বাড়তি ঝামেলা এবং অতিরিক্ত আর্থিক ব্যয় সাপেক্ষ ব্যপার। এ প্রসঙ্গে নূর লিখেছেন যে, এ ধরনের বাড়তি কাজ ও শ্রমের কোন প্রয়োজন হবে না। কারণ শরীয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের ওপর থেকে বোঝা লাঘব করা, বোঝা বৃদ্ধি করা নয়। ইসলাম মানুষের জন্য কাজকে সহজ করেছে, কঠিন করেনি। তাছাড়া অর্থনৈতিক দিক থেকে বাজারে যাওয়া-আসার ব্যয় বহন করারও কোন দরকার হবে না যদি পণ্যের বাজার দর জানা থাকে। তাঁর মতে বাজারে প্রচলিত দর জানা থাকলে তার ভিত্তিতে পণ্যের বিনিময় হার নির্ধারণ করা যেতে পারে।[উপরোক্ত, পৃ: ১৪৪।]
কিন্তু ওপরে উল্লেখিত আবূ নাদরা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে (ক্রমিক নং ৭৮) খেজুরের মান অনুসারে বাজার দামের উল্লেখ করে এই বাজার দরের ভিত্তিতেই মন্দ ও ভাল খেজুরের বিনিময় রেশিও নির্ধারণ করা হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তোমার অমঙ্গল হোক, তুমি তো সুদী কারবার করেছ”। সুতরাং বাজার দর জানা থাকলে সে অনুসারে খারাপ-ভালোর বিনিময় হার বিনিময় হার নির্ধারণ করা যাবে কিনা সে বিষয়ে আরও চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা হওয়া দরকার।
প্রতীয়মান হচ্ছে যে, মিসলান বিমিসলিন/আইনান বিআইনিন-এর প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে গুণ ও মানগত সমতা বিধান করা এবং সমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে একে অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র বিধান হিসেবে গন্য করতে হবে।
২. সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন (পরিমণগত সমতা): সমজাতের পণ্য, অর্থ ও সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণের দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন; এর অর্থ হচ্ছে পরিমানগত সমতা। ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের পণ্যের জাত ও মান এক রকম (identical or homogeneous) হওয়ার পর এদের পারস্পরিক মূল্য সমান হওয়া সম্ভব কেবল এদের পরিমাণের দ্বারা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উভয় পণ্যের মান এক রকম করার নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে এদের পরিমাণ সমান সমান করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং পরিমাণে কম-বেশি করলে রিবা হবে বলে সতর্ক করেছেন।
বাস্তবতা হচ্ছে যে, সমজাত ও সমমানের পণ্য, অর্থ বা সেবার উপযোগ সমান; এর চাহিদা ও যোগানও সমান। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১০০ টাকার উপযোগ ১০০ টাকার সমান; ১০০ টাকা থেকে ১০০ টাকার বেশি উপযোগ পাওয়া যায় না, তেমনি ১০০ টাকার উপযোগ ৯৯ টাকার সমানও হয় না। সুতরাং টাকায় ১০০ টাকার মূল্য ১০০ টাকাই, কমও নয়, বেশিও নয়। এই দাম সময়ের গতির সাথে হ্রাস-বৃদ্ধিও হয় না। অর্থাৎ টাকায় ১০০ টাকার দাম আজ ১০০ টাকা; আগামী কালও এর দাম ১০০ টাকা, এমনকি ১ বছর বা ৫ বছর পরও টাকায় ১০০ টাকার দাম ১০০ টাকাই। অনুরূপভাবে লেংড়া জাতের ১ কেজি আমের উপযোগ ১ কেজি সমমানের আমের সমান। সুতরাং আমে ১ কেজি লেংড়া আমের দাম একই মানের ১ কেজি আম। এই দাম আজকে যেমন ১ কেজি, কালও ১ কেজি এবং ভবিষ্যতের যে কোন সময়ে এর দাম ১ কেজি আম। এ প্রসঙ্গে ইবনে রুশদ লিখেছেন, “As for (fungible) goods measured by volume or weight, they are relatively homogeneous, and thus have similar benefits (utilities). Justice in this case is achieved by equating volume or weight since the benefits (utilities) are very similar.”[ইবনে রুশদ, বিদায়াতুল মুজাতাহিদ ওয়া নিহায়আতুল মুকতাসিদ, বৈরুত, দার আল-মারিফাত, ভলি-৩, পৃঃ ১৮৩-১৭৪।] “আর পরিমাণ (volume) ও ওজন দ্বানা পরিমাপযোগ্য ফারজিবল পণ্যের বেলায় বলা যায় যে, তুলনামূলকভাবে এসব পণ্য-সামগ্রী প্রায় সদৃশ হয় এবং এগুলোর উপকারিতাও (উপযোগ) হয় সমান সামান।……..এসব ক্ষেত্রে সুবিচার অর্জিত হয় এদের পরিমাণ ও ওজন সমান সমান করার মাধ্যমে, কারণ এদের উপকারিতা (উপযোগ) সমান সমান”।
মোট কথা, সমজাতের পণ্য, অর্থ বা সেবার দাম এদের মান এ পরিমাণগত সমতার দ্বারাই নির্ধারিত হয়। এটাই বিধান। এই বিধান প্রাকৃতিক (natural), চিরন্তন ও শাশ্বত। এক্ষেতে ক্রেতা-বিক্রেতা পারস্পরিক স্বেচ্ছা সম্মতির মাধ্যমে পণ্য, অর্থ বা সেবার পরিমাণে কম-বেশি করলে তাদের পারস্পরিক মূল্য আর কোনভাবেই সমান হওয়া সম্ভব নয়। তাই দাম নির্ধারণে পারস্পরিক সম্মতি তথা দর কষাকষি করে দাম নির্ধারণের বিধান এক্ষত্রে প্রযোজ্য নয়। এখানে ক্রেতা বা বিক্রেতা কারোই সে অধিকার নেই। ড. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী এই কথাই বলেছেন, “it (perception) cannot be acceptable between the same things, i.e., in exchange of money for money. It has to be measurable equality as there is no room for perception.”[সিদ্দিকী, এম, এন, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭৪।]
“সমজাতীয় বস্তু বিনিময়ের বেলায় এটা (প্রত্যক্ষণ) গ্রহণযোগ্য নয়, যেমন কোন মুদ্রার বিনিময়ে একই জাতের মুদ্রা। এক্ষেত্রে পরিমাপযোগ্য সমতা থাকতে হবে, কারণ প্রত্যক্ষণের সুযোগ এক্ষেত্রে নেই”। তিনি তাই বলেছেন, “সমজাতের পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে ইসলাম পণ্যের পরিমাণ সমান সমান করার শর্ত আরোজ করেছে”।[উপরোক্ত, পৃ: ৩৩।]
জনাব নূর একটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট করে তুলেছেন। তার ব্যাখ্যাটি সংক্ষেপে পেশ করা হলোঃ [নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৬৬-১৭০।]
চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে, ক ও খ দুই ব্যক্তির কাছে একই জাত ও মানের একটি মাএ পণ্য আছে যার নাম হচ্ছে Y। OM রেখাতে Y এর পরিমাণ দেখানো হয়েছে। ON রেখাতেও Y এর পরিমাণ দেখানো হয়েছে। আর MN রেখায় একই পণ্য Y- এর সাথে Y বিনিময়ের বিভিন্ন অনুপাত দেখানো হয়েছে। ক যদি OM পরিমাণ Y নেয় তাহলে খ এর জন্য আর Y থাকে না, সে কিছুই পায় না। অপরদিকে খ যদি ON পর্যন্ত Y নেয় তাহলে ক কিছুই পায় না। ৪৫° OC রেখা MN রেখাকে C বিন্দুতে সমান দুই ভাগে ভাগ করেছে। C বিন্দুতে ক পায় OYac পর্যন্ত Y এবং খ পায় OYbc পর্যন্ত Y; এখানে উভয়ে Y এর সমান সমান অংশ পায়। বিনিময়ের অনুপাত দাঁড়াচ্ছে ১:১। অতঃপর ক-এর অংশ বৃদ্ধি করলে খ-এর অংশ অবশ্যই কমে যাবে; আর খ-এর অংশ বৃদ্ধি করলে ক কম পাবে। অর্থাৎ C বিন্দু থেকে বিনিময়ের হার পরিবর্তন করা হলে উভয় পক্ষের মূল্য আর কোন ভাবেই সমান হবে না; বরং সেক্ষেত্র এক জনের ক্ষতির বিমিয়ে অপর জন লাভবান হবে। ফলে কোন না কোন পক্ষ অবশ্যই অবিচার ও জুলুমের শিকার হবে। তাই এক্ষেত্রে সুবিচারের প্রাকৃতিক (natural) বিধান হচ্ছে, পরিমাণ সমান সমান হওয়া। দুনিয়ার সর্বত্রই এ বিধান প্রচলিত ছিল, আছে এবং থাকবে। ইসলাম এই বিধানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।
ড. উমর চাপরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সেই বিখ্যাত হাদীসটির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের নাম উল্লেখ করে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে, “পাল্লার একদিকে যদি এর একটি পণ্য থাকে, পাল্লার অপরদিকেও একই জাতের সমপরিমাণ পণ্য থাকতে হবে। (like for like and equal for equal মানে এক রকম এবং পরিমাণে সমান সমান)”।[চাপরা এম, উমর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১০।]
বিচারপতি তকি উসমানী তাঁর ঐতিহাসিক রায়ে বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “অর্থের (মুদ্রার) সাথে একই জাতের অর্থের (মুদ্রার) বিনিময় করতে হলে উভয়ের মূল্য সমান হতে হবে। পাকিস্তানী ১০০০/- রূপীজ এক একটি নোটর সাথে একই দেশের অন্য নোটের বিনিময় করতে হলে অন্য নোটগুলোর মূল্য অবশ্যই ১০০০/- রূপীজের সমান হতে হবে। এখানে রূপীজের অংকে প্রথম ১০০০/- রূপীজের নোটটির দাম যেমন বুদ্ধি করা যাবে না, তেমনি এর দাম হ্রাস করাও যাবে না।
…………….একই জাতের মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মূল্য সমান হওয়ার এই বিধি নগদ তাৎক্ষণিক বিনিময় ক্ষেত্রে (spot exchange) যেমন প্রযোজ্য, তেমনি বাকি বিনিময় বা ঋণের ক্ষেত্রেও তা সমভাবে প্রযোজ্য।[উসমানী, মুহাম্মদ তকি, বিচারপতি মাওলানা: The Historic Judgement on Jnterest, Idaratul Maarif, করাচী, পাকিস্তান, ২০০০, পৃ: ১৪০।]
প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়, নগদ হোক বা বাকি, উভয় বস্তুর মান এক রকম করার পর এদের পরিমাণ অবশ্যই সমান সমান করতে হবে।
বিনিময়ের বিধান
১. ইয়াদান বিইয়াদিন (হাত থেকে হাতে/ Reciprocal Exchange)ঃ উবাদা ইবনে সামিত বর্ণিত উক্ত হাদীসে সমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ের তৃতীয় বিধান হচ্ছে ইয়াদান বিইয়াদিন (হাতের বিনিময়ে হাত)। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন জাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়েও দ্বিতীয় শর্ত হিসেবে এই একই বিধান- ইয়াদান বিইয়াদিনের কথা বলা হয়েছে। ইয়াদান বিইয়াদিনের তাৎপর্য বুঝানোর লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অন্যান্য হাদীসে আরও কতিপয় পরিভাষা ব্যবহার করেছেন বলে বলা হয়। যেমন, “উপস্থিত পণ্যের সাথে উপস্থিত পণ্য”, “এখানে তুমি, এখানে তুমি”, “যা উপস্থিত আছে তাকে যা উপস্থিত নেই তার সাথে বিনিময় করো না,” “যা তোমার কাছে নেই তা বিক্রি করো না,” “যা হাতে হাতে (ইয়াদান বিইয়াদিন) তাতে কোন দোষ নেই, কিন্তু যা নাসীয়াতে” “নাসীয়াহ ব্যতীত রিবা হয় না” ইত্যাদি।
হাদীসের এসব বক্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে অধিকাংশ ফিক্বাহবিদ ও গবেষক ইয়াদান বিইয়াদিনের অর্থ করেছেন তাৎক্ষণিক নগদ পারস্পরিক বিনিময়, উপস্থিত পারস্পরিক হস্তান্তর ও দখল।
লক্ষণীয় যে, ইয়াদান বিইয়াদিনের অর্থ করতে গিয়ে অধিকাংশ ফক্বীহ পারস্পরিক হস্তান্তরের সাথে নগদের শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। ফলে ক্রয়-বিক্রয় ও রিবার সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ব্যাপক মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপক বিস্তৃত ক্ষেত্রটি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে রিবা আল-নাসা, রিবা আল-ইয়াদা বা প্রচ্ছন্ন রিবা নামে অভিনব ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
ইয়াদান বিইয়াদিনের উক্তরূপ অর্থের প্রেক্ষিতে অধিকাংশ ফেক্বাবিদ বলেছেন, সমজাতের হোক বা অসম জাতের হোক, দুটি পণ্য বা অর্থ বাকি ক্রয়-বিক্রয় করা নিষিদ্ধ। এই বিধান লংঘন করে বাকিতে বিক্রি করা হলে বাকির মেয়াদ/সময় হবে রিবা নাসা যা হারাম। কোন কোন ফেক্বাহয় বলা হয়েছে, কোন পক্ষ তার ক্রীত মালের দখল নিতে বিলম্ব করলে বিলম্বিত সময়/মেয়াদ হবে রিবা আল-ইয়াদ। তবে সকল ফক্বীহ এ ব্যাপারে একমত যে, ঋণ ও দেনার ক্ষেত্রে ও বিধান প্রযোজ্য নয়। ঋণ হচ্ছে সাদাকাহ, তাই ঋণ বৈধ। আর তাদেঁর মতে, বাই-মোয়াজ্জল (বাকি ক্রয়-বিক্রয়), বাই-সালাম (অগ্রিম বিক্রয়), বাই-ইসতিসানা (আদেশ ক্রয়) ও ইজারাহকে বিশেষ বিবেচনায় অনুমোদন করা হয়েছে। ফক্বীহদের মতে মেয়াদ/সময় হচ্ছে ঋণ দেনার অপরিহার্য শর্ত। সুতরাং এই মেয়াদ রিবা নয়; বরং এই মেয়াদ বৈধ। কোন কোন গবেষক আবার সকল ঋণকে বৈধ বলতে রাজী নন। তাদেঁর মতে, সাধারণ ঋণ/কর্দ নিষিদ্ধ এবং কেবল কর্দে হাসানাহ বৈধ। সাধারণ ঋণের ক্ষেত্রে আসলের ওপর ধার্যকৃত বৃদ্ধিকে তাঁরা রিবা ফদল আখ্যায়িত করেছেন আর ঋণ পরিশোধের মেয়াদকে বলেছেন রিবা নাসা বা রিবা নাসীয়াহ। এতে একটি অপরটির counter value [নিয়াজী, ইমরান আহসান খান, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪২ ও ৪৬।]; রিবা ফদল হচ্ছে নাসার potential benefit-এর মূল্য।[উপরোক্ত, পৃ: ১০ ও ১২।] কোন কোন মাযহাবে সকল পণ্য ও মুদ্রার বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে নিষিদ্ধ না বলে শুধু হাদীসে উল্লেখিত ছয়টি পণ্যসহ ওজন, পরিমাপ এ গণনার মাধমে ক্রয়-বিক্রয় করা হয় এমর পণ্য ও অর্থকে রিবা বহনকারী পণ্য (Ribawi Materials) আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং কেবল এই সব পণ্য ও অর্থের বাকি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ বলে রায় দেওয়া হয়েছে। কোন কোন ফক্বীহ আবার ছয়টি পণ্যের মধ্য থেকে সোনাকে বাদ দিয়েছেন এবং সোনা দ্বারা ঋণ লেনদেন করা বৈধ বলে মত দিয়েছেন। বিশিষ্ট কয়েকজন ফক্বীহ আবার মুদ্রার বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে অবৈধ বলেছেন। রিবা নাসা হারাম হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, রিবা নাসা হচ্ছে প্রচ্ছন্ন (concealed, hidden)রিবা; আর ঋণ বা দেনার ওপর বর্ধিত অংশ হচ্ছে প্রকাশ্য (overt, menifest) রিবা। প্রকৃত নিষিদ্ধ রিবা হচ্ছে প্রকাশ্য রিবা; আর প্রকাশ্য রিবার দ্বার রুদ্ধ হবার জন্যই প্রচ্ছন্ন রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইয়াদান বিইয়াদিন-এর অর্থ সম্পর্কে ইমাম সারাখসী অবশ্য ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, ইয়াদান বিইয়াদিন-এর অর্থ হচ্ছে “এখন নির্ধারিত পণ্যের সাথে এখন নির্ধারিত পণ্য (present determined commodity (ayn) with present determined commodity (ayn). তিনি বলেছেন, এর অর্থ যদি দখল বা হস্তান্তর হতো তাহলে বলতে হতো, ‘মিন ইয়াদিন ইলা ইয়াদিন’ (এক হাত থেকে অন্য হাতে)। সুতারাং ইয়াদান বিইয়াদিন অর্থ হচ্ছে, “তাঈন এর বিনিময়ে তাঈন” (ascertained commodity for ascertained comniodity.)[সারাখসী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৫-৬]
সম্প্রতি এরমি মাহমুদ নূর বলেছেন, “ইয়াদানা বিইয়াদিনের প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে নির্ধারণ করা (ascertainment), বিনিময়ের পণ্য দু’টি চিহ্নিত করা (identification) এবং এদের গুণ-মান নিশ্চিত করা। ক্রয়-বিক্রয়ে উভয় পক্ষের মাল উপস্থিত থাকলে ক্রেতা-বিক্রেতা যার যার বাঞ্ছিত মাল দেখে, পরখ করে, এদের গুণ-মান নিশ্চিত করে, দাম-দস্তুর ঠিক এবং ওজন, পরিমাপ বা গণনা করে পরস্পর হস্তান্তর করতে পারে। কিন্তু কোন এক পক্ষ বা উভয় পক্ষের মাল যদি চুক্তিকালে অনুপস্থিত থাকেন তাহলে মালের নমুনা (sample) বা বিবরণের (specification) মাধ্যমে উক্ত কাজ সমাধা করতে হয়। সুতরাং ইয়াদান বিইয়াদিনের যথার্থ তাৎপর্য হচ্ছে নির্ধারণ করা যা পরিদর্শন (inspection) বা বর্ণনার (specification) মাধ্যমে করা হয়। অতঃপর পারস্পরিক হস্তান্তার তাৎক্ষণিক হতে পারে বা ভবিষ্যতের কোন নির্ধানিত সময়েও হতে পারে। জনাব নূরের মতে, ইয়াদান বিইয়াদিন শর্ত লংঘন করলে রিবা নয় বরং গারারের (অস্পষ্টতা) সৃষ্টি হয়।[নূর, ই এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৩৩-১৩৪।]
ফিক্বহবিদ ও গবেষকদের মধ্যে উক্তরূপ মতপার্থক্য স্বত:ই বলে দিচ্ছে, ক্রয়-বিক্রয় ও রিবা সম্পর্কিত উক্ত বক্তব্য বাস্তবতা পরিপন্হি, পরস্পরবিরোধী এ কুরআন-সুন্নাহর সাথে অসংগতিপূর্ণ।
প্রথমত, ঋণ হচ্ছে সমজাতের ফাঞ্জিবল পণ্য বা মুদ্রার বাকি ক্রয়-বিক্রয়। সুতরাং ঋণ বৈধ, আর সমজাতের পণ্য বাকি ক্রয়-বিক্রয় অবৈধ, এরূপ মন্তব্য পারস্পর বিরোধী ও বিভ্রান্তিকর। এতে একই ক্রয়-বিক্রয়কে একবার ঋণ আখ্যায়িত করে তাকে বৈধ বলা হয়েছে; আবার সমজাতের পণ্যের বাকি ক্রয়-বিক্রয় বলে একেই হারাম বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে অসমজাতের পণ্য ও অর্থের বাকি ক্রয়-বিক্রয় থেকে সৃষ্টি হয় দেনা। সুতরাং দেনা বৈধ আর অসম জাতের বস্তু বাকি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ; এ বক্তব্য স্ববিরোধী। তাছাড়া, বাই-মোয়াজ্জল, বাই-সালাম, বাই-ইসতিসনা ও ইজারাহকে অনুমোদন করার পর আর কোন ধরনের বাকি ক্রয়-বিক্রয় আছে যাকে নিষিদ্ধ বালা হয়েছে!
দ্বিতীয়ত, সাধারণ কর্দ থেকে কর্দে হাসানাহকে পৃথক করার চেষ্টা করা হয়েছে কেবল এই যুক্তিতে যে, সাধারণ কর্দে মেয়াদ নির্ধারিত থাকে কিন্তু কর্দে হাসানায় মেয়াদ নির্ধারণ করা বৈধ নয়। কিন্তু বিশিষ্ট ফিক্বহবিদগণ বলেছেন, কর্দ হচ্ছে এক প্রকার দাইন বা দেনা। আর আল-কুরআন সকল প্রকার দাইনের মেয়াদ নির্ধারণকে শর্ত করে দিয়েছে (২:২৮২)। তাছাড়া কর্দে হাসানাহ হচ্ছে এক ধরনের বাকি ক্রয়-বিক্রয়। আর সকল প্রকার বাকি ক্রয়-বিক্রয়েই বাকি পরিশোধের মেয়াদ নির্ধারণ করা অপরিহার্য। সুতরাং কর্দ অবৈধ, আর কর্দে হাসানাহ বৈধ এরূপ বলার কোন যুক্তি নেই।
তৃতীয়ত, রিবা ফদলকে ঋণের মেয়াদের potential benefit-এর মূল্য তথা রিবা ফদল ও রিবা নাসাকে পরস্পরের কাউন্টার ভ্যালু বলা হলে অর্থের সময়ের মূল্য (time value of money) প্রত্যাখ্যান করার পক্ষে আর কোন যুক্তি অবশিষ্ট থাকে না। তাছাড়া, কাউন্টার ভ্যালু না থাকাই হচ্ছে সুদ হারাম হওয়ার মূল ও একমাত্র কারণ। সময়ের/মেয়াদের potential benefit আছে এবং তা রিবার কাউন্টার ভ্যালু- এরূপ কথা রিবা হারাম হওয়ার মূল কারণকেই তিরোহিত করে দেয়।
চতুর্থত, হাদীসে ছয়টি পণ্যের উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে দেখা যায়, সকল পণ্য, মুদ্রা ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রেই সুদ হয় যদি ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সাথে রিবা চুক্তি করা হয়। সুতরাং রিবাবী (ribawi materials) পণ্য বলে নির্দিষ্ট কোন পণ্য নেই।
পঞ্চমত, রিবা, নাসা/রিবা আল-ইয়াদ হচ্ছে প্রচ্ছন্ন রিবা এবং তা হারাম, এটি একটি অভিনব ধারণা; আল-কুরআনে এমন কোন কথা নেই। কেউ কেউ বলেছেন, এটা সুন্নাহর দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু হাদীসে যা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, ‘যা নাসীয়াহ তা রিবা’, ‘রিবা হয় কেবল নাসীয়াতে’ ইত্যাদি। হাদীসের এসব বর্ণনায় একথা বুঝায় না যে, সময় বা মেয়াদেই রিবা। বস্তুতঃ সারা দুনিয়ায় কোথাও কখনও সময় বা মেয়াদকে রিবা মনে করা হয় না। সুতরাং মেয়াদ নিষিদ্ধ নয়। তবে অজ্ঞাত মেয়াদের জন্য বাকি বিক্রি নিষিদ্ধ।
ষষ্ঠত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মিসলান বিমিসলিন বলে সমজাতের পণ্য, অর্থ ও সেবা ক্রয়-বিক্রয়কালে উভয় মালের গুণগত মান সমান সমান করার বিধান দিয়েছেন। আর সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন বলে উভয় মালের পরিমাণ সমান সমান করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর অসম জাতের পণ্য, মুদ্রার সেবার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করতে বলেছেন। এতেই মান পরিমাণ ও দাম নির্ধারণ হয়ে যায়; এরপর ইয়াদান বিইয়াদিন দ্বারা আবার তিনি নির্ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, এটা স্বাভাবিক নয়। তাছাড়া হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ইয়াদান বিইয়াদিন হলে তাতে কোন দোষ নেই; কিন্তু যা নাসীয়াহ তা রিবা। সুতরাং ইয়াদান বিইয়াদিন সুদ নয় গারারের সাথে সম্পৃক্ত, এ কথা সঠিক নয়।
সর্বোপরি, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইসলাম কখনও ঋণ লেনদেন ও বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে নিষিদ্ধ করেনি। বরং আল-কুরআনে কর্দে হাসানাহ প্রদানকে উৎসাহিত করা হয়েছে; বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে লিখে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্দকে সাদাকাহ আখ্যায়িত করেছেন; কর্দ প্রদানকে অতি বড় সওয়াবের কাজ ঘোষণা করেছেন। বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত রয়েছে বলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিজে ঋণ লেনদেন করেছেন; আর নিজের বর্ম বন্ধক রেখে এক ইহুদীর কাছ থেকে বকিতে খাদ্যদ্রব্য কিনেছিলেন যা দেনা হয়ে মৃতুকালেও তাঁর ওপর চেপে ছিল। সাহাবায়ে কেরামও ঋণ লেনদেন এবং বাকি ক্রয়-বিক্রয় করেছেন। বস্তুতঃ সারা দুনিয়ায় সর্বকালে ঋণ ও বাকি লেনদেন চালু ছিল, আছে এবং আশা করা যায় থাকবে। এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমা (ঐকমত্য) সুপ্রতিষ্ঠিত।[নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১১৬। কর্দ ও বাকি ক্রয়-বিক্রয়ক অবৈধ হতে পারে না।
ফিক্বাহশাস্ত্রে সুদ তথা ইয়াদান বিইয়াদিন প্রসঙ্গে এসে বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে নিষিদ্ধ বলা হলেও অন্যত্র প্রায় সকল মাযহাবেই বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে অনুমোদন করা হয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা ও মালিকী ফক্বীহদের একটা অংশ স্পেসিফিকেশন ছাড়া হলেও বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে বৈধ বলেছেন। মালিকী মাযহাবের অধিকাংশ ফক্বীহ অবশ্য মালের স্পেসিফিকেশন করা হলে বাকি ক্রয়-বিক্রয় বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইমাম ইবনে হাযম এর সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন।[উপরোক্ত, পৃ: ১৩৫।]
আল-কাসানি বলেছেন, নিষিদ্ধ জিনিস হচ্ছে মূল্যের ওপর বাড়তি যা আল-ফদল হিসেবে পরিচিত। ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতা ঋণ প্রদানকালেই চুক্তির মাধ্যমে আসলের ওপর অতিরিক্ত (ফদল) ধার্য করার অধিকার সৃষ্টি করে। কিন্তু স্বাভাবিক ক্রয়-বিক্রয়ে কোন পক্ষের বস্তু হস্তান্তর স্থগিত (deferred) করা হলে এতে অতিরিক্ত (ফদল) থাকে না; সুতরাং সুনির্দিষ্ট (specification/standard) মান ও পরিমাণের কোন পণ্য বাকিতে বিক্রয় করলে এত কোন রিবা হয় [আল-কাসানি: বাদাই লি সানাই ফী আল-তরতীব আল শরঈ, ভলি- ৭ পৃধ ৩৯, উদ্ধৃত নূর, ই, এম পূর্বোক্ত, পৃ: ১৩৪।] এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ফক্বীহগণ একমত যে, সমস্যা ক্রয়-বিক্রয়ে নয়; বরং সমাস্যার প্রকৃতকারণ হচ্ছে আসল পরিমাণের ওপর অতিরিক্তের (ফদল) উপস্থিতি। একারণে বিন আব্দুল আযীয মুত্রিক বলেছেন, সুনির্দিষ্ট মানের (standardized) কোন পণ্য একই জাতের পণ্যের বিনিময়ে বাকিতে বিক্রয় করা হলে এতে সুদ হয় না। আল-কুরআন সকল প্রকান ক্রয়-বিক্রয়কে অনুমোদন করেছে। আল-কুরআনের এই সাধারণ বিধান থেকেই উক্ত বিধান বের করা হয়েছে।[ওমর বিন আব্দুল আযীয মুত্রিক: Al-Riba wal Mu’amalat Al-Masrafiyya, 1st ed., H. 1414, p. 34, উদ্ধৃত, নূর, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৩৫।] ইবনুল কায়্যিম এ পর্যন্ত বলেছেন যে, “আইনের ব্যতিক্রম হিসেবে নয়, বরং নীতিগত বিধান হিসেবেই বাকি ক্রয়-বিক্রয়কে অনুমোদন করা হয়েছে”।[Ibn Qayyim: I’lam, 1,359, উদ্ধৃত: কামালি, মোহাম্মদ হাশিম, পূর্বোক্ত, পৃ: ১০৮।] সুতরাং ইয়াদান বিইয়দিন দ্বারা অবশ্যই এ কথা বুঝায় না যে, ক্রয়-বিক্রয়ের দুটি বস্তু তাৎক্ষণিক নগদ বিনিময় করতে হবে, অন্যথায় তা রিবার পর্যবসিত হবে।[ই, এম, নূর: উপরোক্ত, পৃ: ১৩৪।]
প্রতীয়মান হয়েছে যে, ইয়াদান বিইয়াদিন অর্থ নির্ধারণ করা নয়; এর অর্থ নগদ বিনিময়ও হতে পারে না। তাহলে ইয়াদান বিইয়াদিনের অর্থ করেছেন পারস্পরিক হস্তান্তর বা বিনিময়; তবে এর সাথে তাঁরা তাৎক্ষণিক নগদের শর্ত আরোপ করেছেন। আলোচনায় দেখানো হয়েছে, সকল সমস্যা, জটিলতা ও মতপার্থক্যের কারণ হচ্ছে নগদের এই শর্ত। এই শর্ত তুলে দিয়ে ইয়াদান বিইয়াদিন অর্থ যদি কেবল পারস্পরিক বিনিময় বা পারস্পরিক হস্তান্তন করা হয় তাহলে আর কোন সমস্যা থাকে না। সুতরাং ইয়াদান বিইয়াদিন; হা’য়া ওয়া হা’য়া এর প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে পারস্পরিক বিনিময় বা reciprocal exchange যা বাকি নগদ উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ইয়াদান বিইয়াদিন-এর বিপরীত অর্থ বুঝানোর জন্য হাদীসে নাসীয়াহ পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে এ বিষয়ে আলোচনা করা দরকার।
২. নাসীয়াহর তাৎপর্যঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “রিবা হয় কেবল নাসীয়াতে”, “নাসীয়াহ ব্যতীত রিবা হয় না”, “যা নাসীয়াতান তা রিবা”, “যা ইয়াদান বিইয়াদিন তাতে কোন দোষ নেই, কিন্তু যা নাসীয়াতান তা রিবা”।
নাসীয়াহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ধারে (credit), বিলম্বে মূল্য প্রদান (delay of payment); আর নাসীয়াতান অর্থ হচ্ছে ধারে (on credit)।[Cowan, J. M. পূর্বোল্লেখিত।] এই অর্থের আলোকে হাদীসের উপরোক্ত বর্ণনা থেকে ধরে নেওয়া হয়েছে যে, নাসীয়াই রিবা, অথবা রিবা কেবল ঋণ ও ধারে ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু হাদীসে নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে একদিকের অতিরিক্ত অংশকেও রিবা বলা হয়েছে। অর্থাৎ একদিকে বলা হয়েছে রিবা হয় কেবল বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে; অপরদিকে বলা হয়েছে, নগদ ক্রয়-বিক্রয়েও রিবা হয়। এরূপ পরস্পর বিপরীতমুখী কথার সমন্বয় করতে গিয়ে কেউ কেউ বলেছেন যে, উক্ত হাদীস কয়টিতে নাসীয়াহ বা নাসীয়াতান শব্দ দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একথা বুঝিয়েছেন যে, নাসীয়াহ হচ্ছে রিবার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অন্যত্র বলেছেন, “হজ্জ হচ্ছে আরাফাত”। নসীয়াহ সংক্রান্ত উপরোক্ত হাদীসগুলোকে ঠিক এই অর্থেই বুঝতে হবে।[নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৫।] আরবরা সাধারণত বলে যে, “যায়েদ ছাড়া শহরে আর কোন স্কলার নেই _ এর দ্বারা যায়েদের প্রতিভার গুরুত্ব বুঝানোর হয়েছে। তেমনি নাসিয়াহ্ ছাড়া অন্য কিছুতে রিবা নেই কথার দ্বারা রিবা নাসিয়াহ্ যে গুরুতর অপরাধ এবং এর সাজা যে ভংকর কঠোর হবে তাই বুঝানো হয়েছে। কেউ কউ আবার বলেছেন যে , রিবা নাসীয়াহ্ হচ্ছে স্বাভাবিক রিবা , এটাই হচ্ছে পারফেক্ট (parfect) রিবা। উক্ত কথার দ্বারা রিবার পূর্ণাঙ্গ রূপ বুঝানো হয়েছে।
এখানে উল্লেখ যে, সাহাবীদের (রাঃ) যুগে প্রখ্যাত ফক্বীহ-সাহাবী ইবনে আব্বাসসহ কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) কেবল ঋণ ও দেনার ওপর ধার্যকৃত আতিরিক্তকেই রিবা বলতেন ; সমজাতের পন্য ও অর্থ নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে পরিমাণে কম-বেশী করলে সেই বৃদ্ধিকে তাঁরা রিবা মনে করতেন না এবং এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়কে তাঁরা বৈধ বলতেন। অন্যান্য সকল সাহাবী (রাঃ) অবশ্য তাঁদের এ মতকে অপছন্দ করতেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে সরাসরি ইবনে আব্বাসকে (রাঃ) প্রশ্ন করেছেন। (হাদিসে তাঁর উল্লেখ আছে ) তবে বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, ভিন্নমত পোষণকারী সাহাবীদের ( রাঃ) সকলেই তাঁদের মত প্রত্যাহার করায়, এটাই প্রমাণিত হয় যে, তাদেঁর ভিন্নতর মত সঠিক ছিল না।
তাছাড়া স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও ইয়াদান বিইয়াদিন ও নাসীয়াহ্ এ দু’টি পরিভাষাই ব্যবহার করেছেন। আবুল মিনহাল থেকে বর্ণিত ৯০ ক্রমিকে উল্লেখিত হাদীসে দেখা যায়, হজ্জের মওসুমে দাম পরিশোধ করার শর্তে বাকিতে রূপা বিক্রয় সম্পর্কে বারাআ ইবনে আযিবের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিণ। উত্তরে বারাআ ইবনে আযিব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর বক্তব্য পেশ করেছেন যাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “এ ধরণের ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে যেটা ইয়াদান বিইয়াদিন তার মধ্যে কোন দোষ নেই; কিন্তু ক্রয়-বিক্রয়কে বুঝানো হয়ে থাকে, তাহলে ইয়াদান বিইয়াদিনকে আবার নগদের অর্থে ব্যবহার করা স্বাভাবিক নয়’ তেমনি বাকিতে বিক্রয় বুঝানোর জন্য নাসীয়াহ্ পরিভাষা ব্যবহার করাও অস্বাভাবিক।
হাদীস থেকে এটা স্পট যে, ইয়াদান বিইয়াদিনের বিপরীত অর্থ বুঝানোর জন্যই নাসীয়াহ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সেদিক থেকে ইয়াদান বিইয়াদিন অর্থ নগদ বিনিময় করা হলে নাসীয়াহ অর্থ অবশ্যই বাকিতে বিনিময় করা হতে হবে। কিন্তু ইয়াদান বিইয়াদিন অর্থ যদি পারস্পরিক বিনিময় (যা নগদ বাকি উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) করা হয়, তাহলে এর বিপরীতে নাসীয়াহ অর্থ দাঁড়ায় বিনিময়হীন (যা নগদ বাকি উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে)। অর্থাৎ ইয়াদান বিইয়াদিন হচ্ছে বিনিময় দিয়ে নেওয়া; আর নাসীয়াহ হচ্ছে বিনিময় না দিয়ে নেওয়া। রিবার ব্যাখ্যা থেকেও এটা স্পষ্ট হয়েছে, বিনিময় বা counter value না থাকাই হচ্ছে সুদ হওয়ার মূল ও একমাত্র কারণ।
ক্রয়-বিক্রয়ে কোন পণ্য, অর্থ বা সেবার সেই অংশই রিবা যার বিনিময় দেওয়া হয় না। ঋণ ও দেনার ওপরে বর্ধিত অংশ সুদ, কারণ অপরপক্ষ সেই অংশের বিনিময় দেয় না’ তেমনি নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে এক পক্ষের বর্ধিত অংশ সুদ, কারণ তা বিনিময়হীন। অপরদিকে, বাকি মূল্যের ওপর বাড়তি অংশ বা নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে এক পক্ষের নেয়া অতিরিক্ত অংশের দাম দেওয়া হলে সেই বাড়তি/অতিরিক্ত অংশ আর রিবা থাকে না।
নাসীয়াহ শব্দটি ‘নাসা’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। অভিধানে ‘নাসা’ –এর অর্থ লিখা হয়েছে, to put off, postopne, delay, defer, procrastinate. [Cowan, J.M. পূর্বোক্ত।] দেখা যাচ্ছে, নাসাআ- এর প্রথম অর্থ হচ্ছে to put off. আর Put off মানে হচ্ছে, বাতিল করা ( to cancel); বিরত রাখা (put somebody off something); বাতি নিভিয়ে দেওয়া (to switch something off); বিলম্বিত করা (to delay); স্থগিত করা (postpone)। সুতরাং ‘নাসাআ’ অর্থ বতিলও হতে পারে, স্থগিত করাও হতে পারে, বিলিম্বিত করাও হতে পারে। তবে কোন কাজ স্থগিত বা বিলম্বিত করতে হলে বিলম্বের মেয়াদ অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে; অন্যথায় তা বাতিল বুঝাবে। সেই জন্যই কুরআন মজীদে ঋণ/বাকি লেনদেনের সাথে নির্ধারিত সময়ের জন্য (ইলা আজালিম্মুছাম্মাহ) বলা হয়েছে। হাদীসে অজ্ঞাত মেয়াদের জন্য বাকি ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয় বলে জনিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বাকি ক্রয়-বিক্রয় বা ঋণ সর্বদাই নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হতে হবে। অনির্ধারিত সময়ের জন্য বাকি দেওয়া আর মূল্য না নিয়ে দেওয়ার মধ্যে তেমন কোন তফাৎ নেই।রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নাসীয়াহ শব্দ দ্বারা বিনিময় না নিয়ে দেওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন- এটাই এর যথার্থ তাৎপর্য। সুতরাং পূর্ণাঙ্গ বাক্যটির অর্থ হচ্ছে, যা বিনিময় দিয়ে নেওয়া হয় তাতে কোন দোষ নেই; কিন্তু যা বিনিময়হীন তা রিবা; বিনিময়হীনতাই রিবা, বিনিময়হীন না হলে রিবা হয় না ইত্যাদি।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক জাতের পণ্য, অর্থ বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে তিনটি বিধান দিয়েছেন। তা হচ্ছে, মিসলান বিমিসলিন, সাওয়ায়ান বিসাওয়ায়িন ও ইয়াদান বিইয়াদিন। আলোচনায় এটাও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, মিসলান বিমিসলিন দ্বারা উভয় পক্ষের পণ্য, অর্থ বা সেবার গুণ ও মানগত সমতা বিধান করতে বলা হয়েছে; সাওয়া বিসাওয়ায়িন দ্বারা এদের পরিমাণ সমান সমান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; এই শর্ত দু’টি পালন করলে সমজাতের পণ্যের মূল্য সমান হয়। অতঃপর ইয়াদান বিইয়াদিন দ্বারা উভয় পণ্য, অর্থ বা সেবা পারস্পরিক ও বাস্তব হস্তান্তরের বিধান দেওয়া হয়েছে। এই তিনটি বিধান নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের বেলাতেও তা সমভাবে প্রযোজ্য।
অসমজাতের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়
কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণের বিধান
ক্রয়-বিক্রয়ের বস্তু যদি ভিন্ন ভিন্ন জাতের (different kinds/heterogeneous) হয় যেমন, সোনার বদলে রূপা, খেজুরের পরিবর্তে লবণ, টাকার বিনিময়ে গম, মার্কিন ডলারের বিনিময়ে সৌদী রিয়েল, কাজের বিনিময়ে টাকা ইত্যাদি, সে ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ), “তোমরা ইচ্ছা মতো (দামে) বিক্রয় করতে পার, তবে হাত হতে হাতে (ইয়াদান বিইয়াদিন)”। সম্মানিত ফক্বীহগণ এখানে একটি মাত্র শর্ত আছে বলে বলেছেন, আর সেটি হচ্ছে হাত হতে হাতে (ইয়াদিন বিইয়াদিন) যার অর্থ তাঁরা করেছেন, তাৎক্ষণিক নগদ বিনিময়। কিন্তু এখানে শর্ত একটি নয়, দু’টিঃ একটি হচ্ছে যে কোন দাম অর্থাৎ পারস্পরিক সম্মতিতে দাম নির্ধারণ করা; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইয়াদান বিইয়াদিন বা পারস্পরিক বিনিময়।
১. পারস্পরিক সম্মতি (Mutual Consent): “তোমরা যে কোন (দামে) বিক্রি করতে পার”- সম্মানিত ফক্বীহগণ হাদীসের এই অংশকে ক্রয়-বিক্রয়ের শর্ত হিসেবে গণ্য করেননি। প্রকৃতপক্ষে বিক্রেতা যে কোন দামে তার পণ্য বিক্রি করতে পারে না, সে যে কোন দাম হাঁকতে পারে মাত্র, এ অধিকার তার আছে। অতঃপর ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই যে দামে সম্মত হয় সেই দামে বেচাকেনা হয়ে থাকে। বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এখানে এই নীতিই তুলে ধরেছেন যে, ক্রেতা-বিক্রেতা পারস্পরিক সম্মতিতে যে দাম নির্ধারণ করবে সেটাই বৈধ দাম, সেই দামের বেচাকেনা করা বৈধ। ‘ফাবিয়ূ কাইফা শি’তুম’ – তোমরা যেভাবে খুশী বিক্রি করতে পার – হাদীসের এই বাক্যাংশ আল- কুরআরে বর্ণিত বিধানের ব্যাখ্যা। আল-কুরআনের নির্দেশ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না; বরং পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসা কর”। (৪: ২৯) এই আয়াতে দুটি নির্দেশ হচ্ছেঃ এক, পারস্পরিক সম্মতি ব্যতীত কারও সম্পদ নেওয়া হচ্ছে বাতিল পন্হায় পরের সম্পদ ভক্ষণ করা; এটা অবৈধ বা নিষিদ্ধ; দুই, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে সম্পদ লেনদেন করা বৈধ- এট করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে যা পূরণ করা না হলে ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হয় না। হাদীসে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বলা হয়েছে, “অবশ্যই ক্রয়-বিক্রয় পারস্পরিক সম্মতির ওপর ভিত্তিশীল”।[ফাতহুল বারি, ভলি-৮, পৃঃ ২৩০, উদ্ধৃত, ই, এম, নূর, প্রগুক্ত, পৃঃ ২০০।] অন্যত্র বলা হয়েছে, “Someone’s property will not be lawfully acquired by another unless it was given to him willingly.” [ইবদ।] অর্থাৎ “কারও সম্মত নেওয়া আইনত বৈধ হবে না যতক্ষণ না তা স্বেচ্ছা সম্মতিতে প্রদান করা হয়”। অর্থনৈতিক দৃষ্টিতেও পারস্পরিক সম্মতিতে ক্রয়-বিক্রয়ের একটি অপরিহার্য বিষয় বলে মনে করা হয়।
অর্থনীতিতে বলা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতের (dissimilar, differnt or heterogeneous) বস্তু ক্রয়-বিক্রয় কালে ক্রেতা এই চিন্তা করে যে, সে যে পণ্য, অর্থ বা সেবা কিনতে যাচ্ছে তা থেকে সে যে পরিমাণ উপযোগ , বেনিফিট বা তৃপ্তি পাবে তার মূল্য, আর এজন্য বিক্রেতা যে দামে (অর্থ, পণ্য বা সেবা) দাবী করছে তার মূল্য সমান হচ্ছে না, তাহলে সে বিক্রেতার প্রস্তাবিত দামে বস্তুটি ক্রয় করতে অসম্মতি জানায় এবং দাম কমানোর জন্য বিকল্প প্রস্তাব করে। অনুরূপভাবে বিক্রেতাও চিন্তা করে, সে যে পণ্য, অর্থ বা সেবাটি বিক্রি করছে তার মূল্য আর ক্রেতা যে দাম প্রস্তাব করেছে তার মূল্য সমান কিনা। যদি তার মনে হয় যে, তার পণ্য অর্থ বা সেবার মূল্য এবং ক্রেতা কর্তৃক প্রস্তাবিত মূল্য সমান নয়, তাহলে সে পণ্য, অর্থ বা সেবাটি প্রস্তাবিত দামে বিক্রি করতে অসম্মতি জানায় এবং দাম আরও বাড়ানোর জন্য বিকল্প প্রস্তাব দেয়। আধুনিক ভাষায় ক্রেতা ও বক্রেতার মধ্যে এরূপ প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাবকে বলা হয় দরকষাকষি (bargaining)। শরয়ী ভাষায় এক বলা হয়েছে, ঈজাব ও কবুল। বস্তুতঃ ক্রয়-বিক্রয়ের বস্তু দু’টির চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতেই ক্রেতা-বিক্রেতা দরকাষাকষি করে। ইবনে আল আরবী এ সম্পর্কে বলেছেন, “If the need of the seller for the price or money is relatively stronger he would add more of his commodity or services for a given price. If on the other hand the relative need of the buyer for the commodity is stronger, he would add more of his price for a given commodity or service”[ Isrriail, Abdul Halim: Deferred ·Transaction in the Quran, in Introduction to Islamic Finance, Sh. Ghazali Sh. Ahud et (eds), 1992, উদ্ধৃত, নূর, ই, এম,পূর্বোক্ত, পৃ; ৭৫।]
“বিক্রেতা যদি তার পণ্য বা সেবার তুলনায় এর দাম তথা অর্থের প্রয়োজন অধিক বলে মনে করে তাহলে নির্দিষ্ট দামে সে বেশি পণ্য বা সেবা প্রদানে প্রস্তুত হয়ে যায়; অপরদিকে ক্রেতা যদি তার অর্থের তুলনায় বাঞ্ছিত পণ্যটি প্রয়োজনীয়তা বেশি বলে অনুভব করে, তাহলে সেই পণ্য বা সেবাটি পাওয়ার জন্য সে বেশি দাম দিতে রাজী হয়ে যায়”।
এইভাবে দরকষাকষির মাধ্যমে এক পর্যায়ে ক্রেতা যখন মনে করে যে, পণ্য, অর্থ বা সেবাটি এই দামে কিনলে তার প্রদত্ত দামের ক্ষতিপূরণ হবে, তখন সে সেই দামে কিনতে রাজী হয়ে যায়। অনুরূপভাবে বিক্রেতাও যখন মনে করে যে, প্রস্তাবিত দাম দ্বারা তার পণ্য বা সেবা হারানোর ক্ষতি পূরণ হচ্ছে, তখন সে সেই দামে তার পণ্য, অর্থ বা সেবা বিক্রি করতে রাজী হয়ে যায়। বিক্রেতা বলে দিলাম, আর ক্রেতা বলে নিলাম; অতীতকালের শব্দ দ্বারা তাদের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পদিত হয়। অর্থনীতিতে এই অবস্থাকে বলা হয়েছে ভারসাম্য অবস্থা equilibrium point। আর এই দামকে বলা হয়েছে equilibrium price বা ভারসম্য দাম।
“The great philosophers, i.e. Hegel, Simmel etc. also recognized that the commodity exchange is such that the exchangeability of goods ultimately rests on the complementary acts of will by which the commodity owners choose to trade what each other owns. Of course to be exchangeable the goods must have conventional qualities of being objects existingto satisfy specific market needs.”[ Richard D. Windfield, ‘The Just Economy’, Routledge, New York, 1988, p. 109: Quoted by Nur, E. M. পূর্বোক্ত, পৃ: ১৪৭।] “What then gives the traded commodities both the common quality of exchangeability and Specific exchange values are (is) nothng but the mutual acts by which the owners render them equivalently exchangeable.” [নূর, ই, এম, এন, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৪৭-১৪৮।] “হেগেল, সিমেল প্রমুখ বড় বড় দার্শনিকও স্বীকার করেছেন যে, পণ্য-সামগ্রীর ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এমন একটি কাজ যেখানে পণ্য-সামগ্রীর বিনিময়যোগ্যতা পরস্পর সম্পূরক ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এই ইচ্ছার দ্বারা চালিত হয়েই পণ্য-সামগ্রীর মালিকগণ তাদের নিজ নিজ পণ্য পরস্পর বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এক্ষেত্রে বিনিময়ের পণ্যটির মধ্যে অবশ্যই বাজারের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন পূরণ করার মত গুণ-বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে”। “সুতরাং ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্য সামগ্রীর মধ্যে সাধারণ দু’টি বৈশিষ্ট্য, বিনিময়যোগ্যতা ও সুনির্দিষ্ট বিনিময় মূল্য আর কিছু নয়, বরং স্বেচ্ছা সম্মতির দ্বারাই সৃষ্টি হয়। এই স্বেচ্ছা সম্মতির মাধ্যমে পণ্য-মালিকগণ তাদের নিজ নিজ পণ্য-সামগ্রীকে বিনিমেয় বানিয়ে দেয়”।
সুতরাং আল-কুরআন, সুন্নাহ, অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিকদের মতে, ভিন্ন ভিন্ন জাতের পণ্য, অর্থ বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারণ করার বিধান হচ্ছে, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করা। ড. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকিী এই কথাই বলেছেন নিম্ন ভাষায়ঃ “Perception in equality is acceptable in place of objective equality in exchange of dissimilar things, as money and commodity.” [সিদ্দিকী, এম, এন, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭৪] “সমজাতের দু’টি বস্তু বিনিময়ের ক্ষেত্রে এদের বস্তুগত সমতা বিধান করা জরুরী। কিন্তু অসম জাতের পণ্য-সামগ্রীর ক্ষেত্রে, যেমন অর্থের বিনিময়ে পণ্য, বস্তুগত সমতার স্থলে প্রত্যক্ষণগত সমতা গ্রহণযোগ্য”।
২. পারস্পরিক সম্মতি বৈধ হওয়ার শর্তঃ ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক সম্মতিতে দাম নির্ধারণ করার জন্য শরীয়াতে আরও কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়েছে যা পরিপালন না করলে পারস্পরিক সম্মতিতে নির্ধারিত দাম বৈধ হয় না। শর্তগুলো হচ্ছেঃ
১) ক্রেতা-বিক্রিতা উভয়কেই প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক ও বুদ্ধিমান হতে হবে (Age of puberty, sound mind and intelligence) যাতে তারা চুক্তির ফলাফল ও পরিণতি উপলদ্ধি করতে পারে;
২) ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই পূর্ণ স্বাধীন হতে হবে যাতে তারা স্বেচ্ছায় প্রস্তাব গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে; অর্থাৎ এমন কোন চাপ, বাধ্যবাধকতা, জবরদস্তি থাকবে না যাতে ক্রেতা-বিক্রেতার কেউই বা উভয়েই প্রস্তাব গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়;
৩) কোন প্রকার মিথ্যা, ধোকা-প্রতারণা, জালিয়াতি বা চালাকি না থাকা এবং
৪) কোন প্রকার গারার বা অস্পষ্টতা, দ্ব্যর্থবোধতা ও অজ্ঞতা না থাকা।
এছাড়া বাজারে চাহিদা ও যোগান যাতে স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল থাকে, সকল প্রকার বিকৃতি ও কলুষতামুক্ত হয় এবং মানুষ কেবল স্বাভাবিক চাহিদা-যোগানের দ্বারা নির্ধারিত দামে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে সেজন্য ইসলাম আরও কতিপয় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সেগুলো হচ্ছে: ১. সুদ নিষিদ্ধ করা; ২. জুয়া নিষিদ্ধ করা; ৩. সকল প্রকার মুততার বা জরুরী প্রয়োজনের সুযোগ চড়া দাম হাঁকা ইত্যাদি।[সিদ্দিকী, এম, এন, পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ৩২।]
বিনিময়ের বিধান
ইয়াদান বিইয়াদিন (হাত থেকে হাতে/eciprocal exchange): ইয়াদান বিইয়াদিন শর্তের বিষয়ে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বিশেষজ্ঞদের আলোচনার ভিত্তিতে দেখানো হয়েছে যে, ইয়াদান বিইয়াদিন দ্বারা কেবল তাৎক্ষণিক নগদ হস্তান্তর বুঝায় না; বরং এর দ্বারা উভয় পণ্যের পারস্পরিক হস্তান্তর নিশ্চিত করা এবং বাস্তব হস্তান্তর করা বুঝায়। বড় কথা হচ্ছে, বাস্তব হস্তান্তর ছাড়া অন্য সবগুলো কাজ করতে হয় ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদনের পর যা সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকও করা যেতে পারে অথবা শর্ত অনুসারে পরবতী কোন সময়েও করা যেতে পারে। ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পাদনকালে যদি কোন একটি বা উভয় পণ্য অনুপস্থিত থাকে, তাহলে নমুনা বা স্পেসিফিকেশনের মাধ্যমে পণ্যের নাম, পরিচিতি, গুণ-মান, পরিমাণ, দাম হস্তান্তরের নিশ্চয়তা, (security, guarantee ইত্যাদি), হস্তান্তরের স্থান, সময় ইত্যাদি নিশ্চিত করে নিতে হবে। অতঃপর যথাসময়ে পণ্যের বাস্তব হস্তান্তর সম্পন্ন করতে হবে।
বাই-এর আওতা ও পরিধি
হানাফী স্কুলের প্রখ্যাত ফক্বীহ ইমাম আল-সারাখসী বাইকে ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ বলে উল্লেখ করেছেন এবং এর সংজ্ঞা দিয়ে তিনি লিখেছেন, “Permitted sale (bay halal) is the exchange of wealth having a value with wealth also having a value” [সারাখসী, পূর্বোল্লেখিত।] “অনুমোদিত বা হালাল ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে, মূল্য আছে এমন সম্পদের সাথে মূল্য আছে এমন সম্পদ বিনিময় করা”। এই অর্থে ফিক্বহবিদগণ ইজারাহকেও বাই বলেছেন। কারণ ইজারহয় বেনিফিট বিক্রয় করা হয়। এমনকি, তাঁরা সকল প্রকার ঋণ ও দেনার লেনদেনকেও ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে শামিল বলে গণ্য করেছেন।
সম্প্রতি ইমরান আহসান খান লিখেছেন, “Any transaction between two people that is an exchange of two counter-values is bay.” “This meaning is not restricted to customary sale, but includes all that is included in this definition, and among these is debt whatever is its source, sale or loan.”[নিয়াজী, ইমরান আহসান খান, পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ৫] “দুই ব্যক্তির মধ্যে যে কোন বিনিময় তথা দু’টি প্রতিমূল্যের পারস্পরিক বিনিময়ই হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়”। “ক্রয়-বিক্রয়ের এই অর্থ কেবল প্রথাগত ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং উক্ত সংজ্ঞার আওতায় পড়ে এমন সকল লেনদেনই ক্রয়-বিক্রয়ের শামিল; এমনকি, দায়ও, দায়ের উৎস যাই হোক, তা ক্রয়-বিক্রয় থেকে সৃষ্টি হোক অথবা ঋণ থেকে উদ্ধূত হোক”।
“আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন, আর রিবাকে করেছেন হারাম” –এই আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে হাশিম কামালি লিখেছেন যে, আয়াতে ব্যবহৃত ‘বাই’ শব্দটি হচ্ছে এক বচনে বিশেষ্য পদ, আর এর পূর্বে যুক্ত করা হয়েছে আল (আলিফ লাম); ফলে এখানে বাই-এর অর্থ হয়েছে সাধারণ বা আম। এর দ্বারা সকল প্রকার বাইকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং সকল বাই-ই বৈধ। ইউসুফ আল-কারদাভীর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, আল-কুরআনের সাধারণ বিধানের মধ্যে সকল প্রকার বাই যেমন, এক পণ্যের বিনিময়ে আর এক পণ্য বিক্রয় (বার্টার), এক মুদ্রার বদলে অন্য মুদ্রা বিক্রয় (আল-সরফ), অর্থের বিনিময়ে পণ্য-সামগ্রী বিক্রয় (নগদ বিক্রয়), অগ্রিম বিক্রয় (সালাম), খরচ দামে বিক্রয় (আল-তাওয়ালিয়া)হ, লাভে বিক্রয় (মুরাবাহা), লোকসানে বিক্রয় (আল-ওয়াদিয়াহ), মোক্তাদামে বিক্রয় (মুসাওয়ামাহ) এবং নিলামে বিক্রয় (আল-মুযাইয়াদাহ) সবই শামিল রয়েছে। এসবই বৈধ, এমনকি ফিউচারস ও অপশন্স ক্রয়-বিক্রয় যদি সুদ ও গারারমুক্ত হয়, তাহলে তাও বৈধ। তাছাড়া, সুন্নাহ দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয় নাই এমন সকল বাই-ই বৈধ।[কামালি, মোহাম্মদ হাশিম, পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ১৪৩।]
মুনাফা বা লাভ
উপরের আলোচনা থেকে জানা গেল যে, বাই বা ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ক্রেতা কর্তৃক বিক্রেতার এবং বিক্রেতা কর্তৃক ক্রেতার ক্ষতিপূরণ করা যাতে কারও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন না হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে মুনাফা বা লাভ কি এবং তা কিভাবে হয়?
মুনাফা অর্থ ও সংজ্ঞাঃ আল-কুরআনে লাভকে বলা হয়েছে ‘রিবহুন’ (২:১৬) কোন কোন স্থানে আবার লাভকে বলা হয়েছে ‘নাফা’। (৮৭:৯) শব্দ দুটির অর্থ হচ্ছে প্রবৃদ্ধি, উদ্বৃত্ত, অবশিষ্টাংশ, বাড়তি অংশ ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে লাভ হচ্ছে পূজিঁর বর্ধিতাংশ; আর এর বিপরীতে লোকসান হচ্ছে পুজিঁর ক্ষয়-প্রাপ্ত অংশ। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ রিকার্ডোর মতে লাভ হচ্ছে, “the return to capital and its organization in production.”[David Ricardo: Works and Correspondence, Vol. 4, p. 4.] “মুনাফা হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত পুঁজি ও সংগঠনের আয় (return)”। Exploitation তত্ত্ব অনুসারে লাভ হচ্ছে, “residue after deducting the rental interest.[ Marks, K.: Theories of Surplus Value, Vol. 1, p. 48-49.] “মোট আয় থেকে চুক্তিবদ্ধ দায় মিটানোর পর যা থাকে সেই অবশিষ্টাংশ হচ্ছে লাভ”। Sraffa-এর মতে লাভ হচ্ছে, “Surplus value”.[. Sraffa: Production of Commodities by Means of Commodities, Cambridge University Press, 1960, p. 3-5.] “মুনাফা হচ্ছে উদ্বৃত্ত মূল্য”। ফিক্বাহবিদদের মতে লাভ হচ্ছে পুজির প্রবৃদ্ধি বা বৃদ্ধি যা ব্যবসার মাধ্যমে হয়ে থাকে। ইবনে আরাবী বলেছেন, “লাভ হচ্ছে কোন সেবা বা পণ্যের বিক্রয় মূল্য ও ক্রয় মূল্যের ব্যবধান”।নূর,ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭১।] সুতরাং লাভ হচ্ছে, “increase of value of assets actually realized in exchange. It is an incremental value accrued to the original capital or additional value of the initial capital.”[ইবিদ, পৃ: ৭১।] “ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে বাস্তবেও প্রাপ্ত সম্পদের বর্ধিত মূল্য। এটা হচ্ছে মূল পুজিঁ থেকে উদ্ভূত বর্ধিত মূল্য অথবা প্রারম্ভিক পুজিঁর অতিরিক্ত মূল্য”।
মুনাফার উৎস উৎপাদনঃ অর্থনীতিতে মুনাফার অনেক কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। কেই বলেছেন, মুনাফা হচ্ছে উদ্যেগ ও ঝুকিঁ গ্রহণের পারিতোষিক। কেউ বলেছেন লাভ হচ্ছে বিনিয়োগ ও পরিশ্রম করার পুরস্কার। আসলে মুনাফা আসে উৎপাদন থেকে। মানুষ উৎপাদন করে, উৎপাদিত সম্পদ বিক্রি করে লাভ পায়। উৎপাদন হচ্ছে সম্পদ বৃদ্ধি ও মুনাফা অর্জনের একমাত্র পথ।
উৎপাদন কাকে বলেঃ উৎপাদন করা মানে হচ্ছে সৃষ্টি করা। But man cannot create anything and man cannot destroy anything. What man can create? Man can create utility only. “কিন্তু মানুষ কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, কিছু ধ্বংস করার ক্ষমতাও মানুষের নেই। মানুষ যা পারে তা হচ্ছে, মানুষ কেবল উপযোগ সৃষ্টি করতে পারে”। সুতরাং “Producing means putting utility into” (fraser) and thereby adding value. “উৎপাদন মানে উপযোগ সৃষ্টি-সংযোজন করা” (ফ্রেশার) এবং মাধ্যমে মূল্য সংযোজন করা। আর এই সৃষ্ট উপযোগ থেকে প্রাপ্ত মূল্যই হচ্ছে মুনাফা। উপযোগ বিভিন্ন পন্হায় সৃষ্টি করা যায়।
উপযোগ সৃষ্টি বা উৎপাদনের পন্হাঃ উপযোগ সৃষ্টি বা উৎপাদন তিনভাবে করা যায়ঃ
১. আকৃতি ও রূপ পরিবর্তন করেঃ বস্তুর আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে উপযোগ সৃষ্টি বা সংযোজন করা যায়। মানুষ গাছ সৃষ্টি করতে পারে না; কিন্তু বিনিয়োগ করে গাছ কিনে কাঠ বানিয়ে টেবিল তৈরী করতে পারে। মনে করা যাক, গাছ খরিদ বাবদ ২,০০০/- এবং অন্যান্য খরচ বাবদ ১,০০০/- মোট ৩,০০০/- টাকা খরচ হলো। এটাই হলো মোট বিনিয়োগ। যদি উক্ত টেবিল ৫,০০০/- টাকায় বিক্রি হয়, তাহলে অতিরিক্ত ২,০০০/- টাকা পাওয়া গেল গাছের উপযোগের চেয়ে টেবিলের উপযোগ বেশি হওয়ার কারণে। এটাই হচ্ছে মুনাফা যা উৎপাদন বা সংযোজিত/বর্ধিত উপযোগের দাম।
২. সময় বা কাল পরিবর্তন করেঃ সময় পরিবর্তনের মাধ্যমে উপযোগ সৃষ্টি/বৃদ্ধিকরা যায়। যেমন, মওসুমের সময় প্রতি কেজি গোল আলুর দাম হয় ৫.০০ টাকা। এ সময়ে বিনিয়োগকারী যদি অর্থ বিনিয়োগ করে আলু ক্রয় ও কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করে এবং অমওসুমে এই আলু বাজারজাত করে, তাহলে দেখা যায় গ্রাহকরা প্রতি কেজি ৪০.০০ টাকা দরে আলু ক্রয় করছে। অর্থাৎ সময়ের ব্যবধানে গোল আলুর উপযোগ বেড়ে গেছে। এটাই হচ্ছে উৎপাদন। ধরা যাক, আলু ক্রয় সংরক্ষণ ও অন্যান্য যাবতীয় ব্যয় বাবদ বিনিয়োগকারীর কেজি প্রতি ৩৫.০০ টাকা খরচ হয়েছে। ফলে সে প্রতি কেজিতে ৫.০০ টাকা বেশি পাচ্ছে সংযোজিত উপযোগের দাম হিসেবে। এটাই তার লাভ- সৃষ্ট উপযোগ তথা উৎপাদনের মূল্য।
৩. স্থান পরিবর্তন করেঃ স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমেও উপযোগ সৃষ্টি বা বৃদ্ধি করা যায়। যেমন, মালয়েশিয়াতে খুব উন্নত মানের সিমেন্ট পাওয়া যায়। কোন ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করে উক্ত সিমেন্ট আমদানি করলে এদেশের সিমেন্ট ব্যবহারকারীদের কাছে এর উপযোগ সৃষ্টি হয়। ধরা যাক, তারা প্রতি বস্তা সিমেন্ট ৫৫০/- টাকায় বিক্রি করলো; অপরদিকে বিনিয়োগকারীর প্রতি বস্তায় খরচ হয়েছে ৫০০/-। দেখা যাচ্ছে যে, প্রতি বস্তায় ৫০/- টাকা বেশি। এটাই বিনিয়োগকারীর মুনাফা; বিনিয়োগের মাধ্যমে সৃষ্ট/বর্ধিত উপযোগের দাম। দেখা যাচ্ছে পদ্ধতি যেটাই হোক উৎপাদন করতে হলে দরকার বিয়োগ।
বিনিয়োগ কাকে বলে
বিনিয়োগ হচ্ছে, উৎপাদন করার উদ্দেশ্যে কোন পণ্য-সামগ্রী, অর্থ বা সেবা ক্রয় করা; অতঃপর উৎপাদিত সম্পদ বিক্রি করে লাভ করা। অন্য কথায়, বিনিয়োগ মানে হচ্ছে অর্থ বা পুজিকেঁ ভিন্নতর অর্থ, পণ্য বা সেবায় রূপান্তর করা। অর্থ বা পুজিঁ যতক্ষণ তার নিজস্ব রূরে থাকে ততক্ষণ এতে কোন হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না- তা সম্ভব নয়। কিন্তু এর দ্বারা ভিন্নতর কিছু ক্রয় করলে ক্রীত পণ্য, অর্থ বা সেবার উপযোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। আর উপযোগ বৃদ্ধি বা উৎপাদন করার উদ্দেশ্যে কিছু ক্রয় করাই হচ্ছে বিনিয়োগ। কৃষক, শ্রমিক, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীগণ বিনিয়োগ ও বর্ধিত উৎপাদনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে থাকে। কৃষক তার অর্থ (পুজিঁ) ব্যয় করে বীজ, সার, লাঙ্গল, শ্রম ক্রয় করে, জমি কর্ষণ করে এবং বীজ বজন করে। এতে তার অর্থ এসব পণ্য ও সেবায় রূপান্তরিত হয়ে যায়; অতঃপর তা আবার রূপান্তরিত হয়ে হয় ফসল। মনে করা যাক, কৃষক বিনিয়োগ বাবদ মোট ৫,০০০/- টাকা ব্যয় করেছে; আর এ থেকে ধান পেয়েছে মোট ১৫ মন। অর্থাৎ ৫,০০০/- টাকা ১৫ মন ধানে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে বিনিয়োগকৃত অর্থ ও উৎপাদিত ধানের জাত ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে এর কোনটি বেশি, কোনটি কম তথা এত লাভ হয়েছে না লোকসান, তা নিরূপন করা সম্ভব নয়। সেজন্য উৎপাদিত ধান বিক্রি কর মূল পুজিঁ অর্থাৎ টাকায় ফিরিয়ে আনা হলে উভয় টাকার পরিমাণের পার্থক্য দ্বারাই জানা যাবে লাভ হয়েছে না লোকসান, নাকি আসল আসল আছে।
এমনিভাবে শিল্পপতি প্রথমে ব্যবসায়ী, সেবা কারবারী, মুদ্রা ব্যবসায়ী তথা সকল বিনিয়োগকারীকেই তাদের পুজিঁকে ভিন্নতর অর্থ, পণ্য বা সেবায় রূপান্তর করতে এবং সর্বশেষ পর্যায়ে আবার একে প্রথম বিনিয়োজিত পুজিঁর আকারে ফিরিয়ে আনতে হয়। এভাবেই লাভ ক্ষতি বের হয়। এই গোটা প্রক্রিয়াকে ইংরেজীতে নিম্নরূপে প্রকাশ করা হয়েছেঃ
‘Investment means transformation of money/capital into another kind of money or goods and again transformation of that money/goods into original money. The difference between the quantity/amount of the last money received and the 1st money spent is the profit/loss.’
“বিনিয়োগ মানে হচ্ছে কোন মুদ্রা/পুজিকেঁ ভিন্নতর কোন মুদ্রা/পণ্যে রূপান্তর করা এবং পরবর্তীতে সেই মুদ্রা বা পণ্যকে মূল মূদ্রা/পুজিতেঁ ফিরিয়ে আনা। এভাবে সর্বশেষে প্রাপ্ত মুদ্রা/পুজিঁ এবং সর্বপ্রথম বিনিয়োজিত মুদ্রা/পুজিঁর পরিমাণের পার্থক্যই হচ্ছে মুনাফা/লোকসান”। সুতরাং “The aspect that matters is the conversion of, for example $1000.00, into an asset, in which that $1000.00 asset may be worth more or less in the future, a condition that will lead to a profit or loss.” [আহমদ, আবূ উমর ও হাসান, এম, কবীর: The Time Value of Money Concept in Islamic Finance, in the American Journal of Islamic Social Science, 23:1, p. 85.] “আসল বিষয় হচ্ছে, রূপান্তর, এটি এমন একটি শর্ত যা লাভ অথবা লোকসান বয়ে আনে। উদাহরণস্বরূপ, ১০০০/- মার্কিন ডলারকে ভিন্ন কোন সম্পদে রূপান্তর করা হলে ভবিষ্যতে এই সম্পদের মূল্য মার্কিন ডলারের অংকে বেশি হতে পারে বা কম হতে পারে”। “Islamic injunctions have clearly shown that the transformation process of objects and trading of goods one for another is itself the objective matter and it is considered as a necessary condition for seeking profit.”[নূর, ই, এম, পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ১৫৯।] “ইসলামী বিধানে সুস্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে যে, বস্তুসমূহের রূপন্তর প্রক্রিয়া এবং এক পণ্য বা সেবাকে ভিন্নজাতের মুনাফা অর্জনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে বিবেচিত”।
উদ্যোক্তা বিনিয়োগকারীগণ তাদের বিনিয়োগ ব্যয়ের সাথে উক্ত সংযোজিত মূল্য যোগ করে দাম ধার্য করে পণ্যটি বাজারজাত করে এই মূল্যটা পেতে চায়। ড. সিদ্দিকীর ভাষায়, “Trade facilitates exchanges, exchange creates value. Traders try to capture part of value so created.”[সিদ্দিকী, এম, এন, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৫।] “ব্যবসা বিনিময়ের সুযোগ করে দেয়, আর বিনিময় মূল্য সৃষ্টি/সংযোজন করে। ব্যবসায়ী এভাবে সৃষ্ট/সংযোজিত মূল্যের অংশ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে”।
সুতরাং উৎপাদন বা উপযোগ সৃষ্টি করা কেবল বিনিয়েগের মাধ্যমেই সম্ভব। আর বিনিয়োগের মাধ্যমে সৃষ্ট/সংযোজিত উপযোগই হচ্ছে মুনাফার উৎস। বস্তুতঃ বর্ধিত উপযোগের মূল্য বা counter value হচ্ছে মুনাফা। সুতরাং মুনাফার কাউন্টার ভ্যালু হচ্ছে বিনিয়োগের মাধ্যমে সৃষ্ট/সংযোজিত/বর্ধিত উপযোগ। মুনাফা দামের অংশ এবং দামের ভেতরেই থাকে।
বিনিয়োগের বৈশিষ্ট্যঃ উপরের আলোচনায় পরিষ্কার হয়েছে যে, রূপান্তর এবং পুনঃরূপান্তর হচ্ছে বিনিয়োগের অপরিহার্য প্রক্রিয়া। এতে পুজিঁ বৃদ্ধি পেয়ে ফিরে আসতে পারে আবার তা হ্রাস পাওয়াও অসম্ভব নয়; এমনকি, সম্পূর্ণ পুজিঁ খোয়া যাবার আশংকাও রয়েছে। সুতরাং লোকসানের ঝুকিঁ গ্রহণ ব্যতীত বিনিয়োগ সম্ভব নয়। এক কথায় লাভ-লোকসান উভয়টাই বিনিয়োগের স্বাভাবিক পরিণতি”। এজন্যেই হাদীসে বলা হয়েছে, “আল-খারাজু বিযযামান”- মুনাফা ঝুকিঁর সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং বিনিয়োগ কখনও ঝুকিঁমুক্ত হয় না এবং বিনিয়োগ ফেরতের কোন গ্যারান্টি নেই। কেউ যদি ফেরতের গ্যারান্টি দেয়, তাহলে তা বিনিয়োগ নয়, ঋণে পরিণত হবে। আর তার ওপর মুনাফা সুদ হবে।
লোকসান হয় কেনঃ মুনাফা হচ্ছে বিনিয়োগের মাধ্যমে সৃষ্ট বা সংযোজিত উপযোগের দাম। এ অবস্থায় মুনাফা তো নিশ্চিত হওয়ারই কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কখনও কখনও বিনিয়োগকারী তার সৃষ্ট বা সংযোজিত উপযোগের মূল্য পায় না; বরং লোকসানের মাধ্যমে তার মূল পুজিঁও খোয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্য সংযোজন করা সত্ত্বেও লোকসান হয় কেন? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, দুনিয়ায় কোন পণ্যেরই দাম নির্ধারণ করা নেই; বস্তুতঃ কোন পণ্যের দাম মানে সেই পণ্যের উপযোগের দাম। আর স্থান,কাল ও পাত্র ভেদে একই পণ্যের উপযোগ ভিন্ন ভিন্ন হয়। Utility differs from person to person, time to time and place to place. বিনিয়োগকারী পণ্য উৎপাদন করে তার খরচ মূল্যের সাথে সংযোজিত উপযোগের মূল্য যোগ করে বাজারজাত করে। এতে স্থান, কাল ও পাত্র সবই ভিন্নতর হয়; এতে উপযোগের হ্রাস-বৃদ্ধি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ক্রেতাদের কাছে উপযোগ বেড়ে গেলে আশাতীত লাভ যেমন হতে পারে, তেমনি আবার উপযোগ হ্রাস পেলে লোকসানও হতে পারে। লাভ ও লোকসানের আসল কারণ এখানেই। তবে কখনও কখনও উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বিনিয়োগকারীর বর্থ্যতার দরুনও লোকসান হতে পারে।
মুনাফার বৈশিষ্ট্য
১. মুনাফা সংযোজিত মূল্যের বিনিময়ঃ উপরের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, বিনিয়োগের মাধ্যমে সৃষ্ট/সংযোজিত উপযোগের মূল্যই হচ্ছে মুনাফা যা মোট মূল্যের মধ্যেই থাকে।
২. মুনাফা হচ্ছে বিক্রয় মূল্য ও ক্রয় মূল্যের পার্থক্যঃ “The margin between the price they paid and the price they charge, the difference between the sale price and the purchase price is called profit. The same is described as the difference between total revenue (TR) and total cost (TC), in order to cover things made/prepared by the seller as in the handicraft and manufacture. A peasant selling agricultural products grown on his own land can also be covered by the same, and so on.”[ইবিদ, পৃ: ৪৫।] “তাদের প্রদত্ত দাম ও ধার্যকৃত দামের ব্যবধান তথা বিক্রয় মূল্য এবং ক্রয় মূল্যের পার্থক্যকে বলা হয় মুনাফা। (অর্থনীতিতে) এক মোট আয়ের (TR) সাথে মোট ব্যয়ের (TC) ব্যবধান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কোন পণ্য বিক্রি করে বিক্রেতার মোট যে আয় (TR) হয়, আর পণ্যটি তৈরী/প্রস্তুত করতে সে যা ব্যয় করে (TC), যেমন কৃষক যে তার নিজ জমিতে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে তার বেলায় এবং অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে এই একইভাবে মুনাফা অর্জিত হয়”।
পাশ্চাত্য অর্থনীতির মতে ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন উৎপাদনের এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে উৎপাদন করার পর উৎপাদিত পণ্য বা সেবা বিক্রয় করে প্রাপ্ত মোট আয় Total Revenue (TR) হতে ভূমিকে দেওয়া হয় পূর্ব নির্ধারিত ভাড়া, শ্রমকে দেওয় হয় পূর্ব নির্ধারিত মজুরী আর ধারকৃত মূলধনের জন্য দেওয়া হয় পূর্ব নির্ধারিত ভাড়া, শ্রমকে দেওয়া হয় পূর্ব নির্ধারিত মজুরী আর ধারকৃত মূলধনের জন্য দেওয়া হয় পূর্ব নির্ধারিত সুদ; চুক্তিবদ্ধ এসব দেনাকে বলা হয় Total Cost (TC). এই TC পরিশোধ করার পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে বলা হয় মুনাফা যা সংগঠন পেয়ে থাকে। সুতরাং মুনাফা হচ্ছে অবশিষ্টাংশ বা TR-TC=Profit. কিন্তু ইসলাম সুদ নিষিদ্ধ। ইসলামী অর্থনীতিতে তাই পুজিঁর জন্য সুদ দিতে হয় না; বরং ভূমি ও শ্রমের পাওনা পরিশোধ করার পর যা অবশিষ্ট থাকে পুজিঁর মালিক ও উদ্যোক্তা চুক্তি অনুসারে তা ভাগ করে নেয়। সুতরাং ইসলামী অর্থনীতিতেও মুনাফা হচ্ছে অবশিষ্টাংশ তবে ভিন্নতর অর্থে।
৩. মুনাফা ঝুঁকিপূর্নঃ এ কথা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই যে, সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোন কারণে বাজারে চাহিদা হ্রাস পাওয়ার অথবা যোগান বেশি হওয়ার কারলে পণ্যের বাজার পড়ে গেলে বিনিয়োগকারী তার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং তাকে লোকসান দিতে হয়। অপরদিকে, কোন কারণে যদি পণ্যটির দাম বৃদ্ধি পায় এবং তাকে লোকসান দিতে হয়। অপরদিকে, কোন করণে যদি পণ্যটির দাম বৃদ্ধি পায় এবং বাজার দর উঠে যায় তাহলে বিনিয়োগকারী তার আশার চেয়েও বেশি লাভ পেয়ে যায়। ড. সিদ্দিকী বলেছেন, “Sometimes the difference between the sale price and the purchase price i.e., that between revenue and cost is negative. In that case it is called loss. Trade is subject to profits as well as losses. No language has different words for loss making trade and profit making trade. It is the nature of this activity to be subject to occasional losses.”[সিদ্দিকী, এম, এন, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৫।] “কখনও কখনও বিক্রয়মূল্য ও ক্রয়মূল্যের পার্থক্য তথা মোট আয় ও মোট ব্যয়ের পার্থক্য ঋণাত্মক হয়; এক বলা হয় লোকসান। ব্যবসা লাভ-লোকসান সাপেক্ষ। কোন ভাষাতেই লোকসানী কারবার ও মুনাফাজনক কারবারের জন্য আলাদা আলাদা কোন শব্দ/পরিভাষা নেই। এটাই হচ্ছে ব্যবসার প্রকৃতি, স্বভাবধর্ম ও বৈশিষ্ট্য যে, কখনও ক্খনও এতে লোকসানও হতে পারে”।
৪. মুনাফা বাজারের দানঃ লাভ-লোকসানের বিষয়টি আসলে বাজারের ওপরই নির্ভরশীল। এজন্যই ব্যবসায়ে ঝুঁকি বহনের প্রশ্ন আসে। অন্যথায় বিনিয়োগ করা, বিনিয়োগে মেধা ও শ্রম খাটানো, উপযোগ সৃষ্টি করা ও মূল্য সংযোজনের বিনিময় হিসেবে মুনাফা তো নিশ্চিত হবারই কথা। সুতরাং চূড়ান্তভাবে লাভ ও লোকসান হচ্ছে বাজারের দান বা Gift of market or Result of market। আল-কুরআনের পরিভাষায় একেই বলা হয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ বা ফদল।
৫. মুনাফা পূর্বনির্ধারিত হয় নাঃ “Profit is residual, a surplus determined post facto and could very well be negative.”[ইবিদ, পৃ: ৬৩।] মুনাফা হচ্ছে উদ্বৃত্তাংশ, এমন একটি উদ্বৃত্ত যা কেবল ঘটনা শেষেই নিরূপণ করা সম্ভব এবং তা ঋণাত্মক হওয়াও স্বভাবিক”। মুনাফ কখনও ইতিবাচক, কখনও নেতিবাচক হতে পারে। সুতরাং লাভ কখনও পূর্বনির্ধারিত (Predetermined) হয় না। অর্থাৎ পূর্বাহ্নেই চুক্তির মাধ্যমে মুনাফার পরিমাণ বা হার নির্ধারণ করা যায় না।
৬. মুনাফা প্রতিমূল্যের অন্তর্ভূক্তঃ আলোচনায় দেখা গেল যে, মুনাফা বা লাভ হচ্ছে বিনিয়োগকারী কর্তৃক সংযোজিত উপযোগ, মূল্য এবং ঝুঁকির দাম যা বাজার উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। বাজার ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দর কষাকষির দ্বারা পণ্য-সামগ্রীর যে দাম নির্ধারিত হয়, মুনাফা বা লোকসান তার অন্তর্ভূক্ত, দাম বহির্ভূত বা অতিরিক্ত কিছু নয়।
৭. মুনাফা বিনিময়হীন নয়ঃ মুনাফা মুল্যের (counter-value) একটা অংশ বা উপাদান যার বিনিময় হচ্ছে সংযোজিত উপযোগ। আল্লামা মাওদুদী, এ ব্যাপারে বলেছেন, “ব্যবসায় ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সমান সমান মূল্যের বিনিময় হয়। ক্রেতা বক্রেতার কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করে মুনাফা অর্জন করে। অন্যদিকে বিক্রেতা যে বুদ্ধি, শ্রম ও মেধা ব্যয় করে ক্রেতার জন্য পণ্যটি জোগাড় বা উৎপাদন করে সে তারই মূল্য গ্রহণ করে”।[মওদূদী, সাইয়েদ আবূল আ’লা: তাফহীমুল কুরআন, বাংলা অনুবাদ, মুহাম্মদ, আব্দুর রহীম, ১ম জেলদ, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৫, সূরা আল-বাকারাহ্, টীকা-৩১৮ক।] এ প্রসঙ্গে ড. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী বলেছেন, “মুনাফা সুদের ন্যায় কোন অতিরিক্ত (excess) নয়। ক্রয়-বিক্রয়ে উভয় পক্ষেই তাদের নিজ নিজ স্বাধীন পর্যবেক্ষণ, বুঝ ও উপলব্ধি অনুসারে সুনির্দিষ্ট উপকার (advantage) পেয়ে লাভবান হয়। “In other words, there is always a counter valueto profit in trade whereas there is no counter value to interest.”[৬৯] “অন্য কথায়, কারবারে অর্জিত মুনাফার প্রতিমূল্য সর্বদাই আছে, কিন্তু সুদের কোন প্রতিমূল্য নেই”।
উপরের আলোচনার সার কথা হলো, ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে দুটি কাউন্টার ভ্যালুর বিনিময়; যার মধ্যে লাভ-লোকসানও অবশ্যই অন্তর্ভূক্ত থাকে। লাভ উৎপাদন খরচ বা ক্রয়-মূল্যের সাথে সংযোজিত মূল্য এবং counter-value- এর অংশ। কিন্তু কোন অবস্থাতে তা কাউন্টার ভ্যালুর ওপরে ধার্যকৃত অতিরিক্ত (excess) ও কাউন্টার ভ্যালুহীন (without counter-value) নয়।
মুনাফার সীমা
পাশ্চাত্য অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকে (Profit maximization) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তি গণ্য করা হয়। এই অর্থনীতিতে বলা হয়েছে যে, কোন ফার্মের প্রান্তিক আয় (MR) যোখানে এর প্রান্তিক ব্যয়ের (MC) সমান হয় সেখানে ফার্মের মুনাফা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে। এইা মুনাফা অর্জনই হচ্ছে উদ্যোক্তার লক্ষ্য।
কিন্তু এ বিষয়ে ইসলামী অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ বলেছেন পুীজিঁবাদী অর্থনীতি হচ্ছে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ (secular/positive)। এ অর্থনীতিতে মানুষকে মনে করা হয় ‘পূর্ণ’ স্বাধীন র্যাশনাল ইকোনমিক ম্যান’। সেখানে মনোপলি, কার্টেল ইত্যাদি সৃষ্টির মাধ্যমে ভোক্তাদের শোষ করে অস্বাভাবিক মুনাফা লুটে নেওয়া হয়। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি ইসলামী মূল্যবোধের ওপর ভিত্তিশীল। এখানে মানুষ হচ্ছে ‘ইসলামিক র্যাশনাল ম্যান’। তাঁদের মতে মুনাফা সর্বোচ্চকরণ- পুজিঁবাদী এই দর্শনের স্থান ইসলামী অর্থনীতিতে নেই। সুতরাং ইসলামী অর্থনীতিতে মুনাফার সীমা নির্ধারিত থাকা উচিত। তাদের মতে, “এই সীমা মোট পুজিঁর ১০% বা ৩৩% এর অধিক হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ইসলামী শরীয়াতে এই মতের পক্ষে কোন দলিল-প্রমাণ পাওয়া যায় না”।[নূর, ই, এম, উপরোক্ত, পৃ: ৭৬]
ইসলামী অর্থনীতিতে মুনাফার সীমা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ড, মান্নান বলেছেন যে, ইসলাম মুনাফার অনুমোদন দিয়েছে সীমাবদ্ধ অর্থে। সুতরাং ইসলামে মুনাফা হবে স্বাভাবিক (normal) মুনাফা যেখানে কোন নতুন ফার্মের জন্য কারবারে প্রবেশের প্রবণতা থাকেবে না; আবার পুরাতন কোন ফার্মও কারবার থেকে বেরিয়ে যাবে না।[Mannan, M. A. : Introduction of Islamic Economics, p. 168, উদ্ধৃত, নূর, ই, এম, উপরোক্ত, পৃ: ৭৮।] ড. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী এক্ষেত্রে সন্তোষজনক (Satisfactory profiits) মুনাফার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।তাঁর মতে, ইসলামী অর্থনীতিতে ইসলামের কোন বিধি-বিধান লংঘন না করে সর্বোচ্চ যে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব সেটাই হবে মুনাফার উর্দ্ধতন সীমা। অপরদিকে উৎপাদনকারীর জন্য ভালভাবে জীবন যাপন এবং অতীত লোকসান পূরণের জন্য যথেষ্ট মুনাফাই হচ্ছে লাভের নিম্নসীমা। তাঁর মতে এই উর্ধ্বতন ও নিম্নতম সীমার মধ্যবতী যে কোন পরিমাণ মুনাফাই হচ্ছে ‘সন্তোষজনক মুনাফা’।[সিদ্দিকী, এম, এন, উদ্ধৃত, ইবিদ।] কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক অর্থনীতিবিদ মুনাফার এসব ধারণাকে আত্মকেন্দ্রিক (subjective) ও অস্পষ্ট বলে সমালোচনা করেছেন।
মুনাফার সীমা সম্পর্কে ড. আরীফের অভিমত হচ্ছে, MR=MC নয়, বরং কোন ফার্মের AR (বা গড় আয়) যেখানে AC- এর (বা গড় ব্যয়ের) সমান হবে ইসলামী অর্থনীতিতে সেটাই হবে ভারসাম্য বিন্দু এবং এই পর্যায়ে যে পরিমাণ মুনাফা পাওয়া যাবে একজন মুসলিম উদ্যোক্তার মুনাফা সেই পরিমাণেৱই হওয়া উচিত।[M. Ariff (ed), Monetary and Fiscal Economics of Islam, ICRIE, 1982, p. 8, উদ্ধৃত, ইবিদ, পৃ: ৭১।] এলমি নূরের মতে, সামাজিক বিচারে এসবই হচ্ছে সদিচ্ছা (good wishes); কিন্তু এর মৌলিক যুক্তি ও অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা প্রশ্নাতীত নয়।তাঁর মতে, মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টাকে ভ্রাতৃত্বসুলভ, মানবিক বিবেচনা বা এহসান ও বদান্যতার সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। কারণ ইহসান হচ্ছে ব্যবসায়িক কার্যাবলী ও প্রচেষ্টা থেকে আলাদা। আর ব্যবসায়িক কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জন করা।[নূর, ই, এম, ইবিদ, পৃ: ৭৯।]
জেড, হাসানের উদ্ধৃতি দিয়ে জনাব নূর লিখেছেন যে, আপাতদৃষ্টিতে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যকে অর্থ-লিপ্সা এবং ইসলামী নৈতিক বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়; কিন্তু তার পরেও ইসলামী অর্থনীতিতে এ তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, মুনাফা সর্বোচ্চকরণ ধারণার একটি সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য আছে; সেজন্য মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণ এবং এ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ ধারণা (presictive) করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মুনাফা তত্ত্বই যথার্থ তত্ত্ব বলে গণ্য হতে পারে। পরিবর্তনশীল (dynamic) অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুকাবিলায় এই ধারণাই কোন ফার্মকে সৃজনশীল এ সম্প্রসারিত হতে প্রেরণা যোগায়।[ইবিদ, পৃ: ৭৯।]
বস্তুতঃ ইসলাম মুনাফার কোন সীমা নির্ধারণ করে দেয়নি। এমনকি, হাদীসে দেখা যায় যে, বিশেষ অবস্থায় প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পণ্য-সামগ্রীর দাম বেঁধে দিতেও রাজী হননি; বরং তিনি দ্বার্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, “দাম তো আল্লাহ নির্ধারণ করেন, সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা দানকারী একমাত্র তিনিই এবং তিনিই রিযিকদাতা”।[মিশকাত শরীফ, হাদীস নং ২৭৬৮, এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা, ২য় সংষ্করণ এবং তিরমিযী, আবূ দাঊদ, দারেমী।] এ ছাড়া উবাদা ইবনে সামিত বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) “তোমরা যে কোন দামে বিক্রি করতে পার” বলে ক্রেতা-বিক্রেতা কর্তৃক নির্ধারিত যে কোন দামকেই বৈধ করে দিয়েছেন। এই বাণী দ্বারা তিনি বাজারে চাহিদা ও যোগানের দ্বারা নির্ধারিত দামের প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। আর এই পদ্ধতিতে নির্ধারিত দামে যখন যে পরিমাণ মুনাফা আসে সেই মুনাফাই হচ্ছে স্বাভাবিক ও অনুমোদিত মুনাফা। অন্য আর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে, “জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ কোন শহরবাসী যেন কোন পল্লীবাসীর পক্ষে কেনাবেচা না করে। লোকদের স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দাও। আল্লাহ তা’য়ালা তাদের একের দ্বারা অপরের রিযিকের ব্যবস্থা করেন”।[মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ: ২৪৬, হাদীস নং ৩৬৮৪।]
এই হাদীস থেকে জানা যায় যে, কুরবানীর বকরী কিনতে গিয়ে এক সাহাবী (হাকিম বিন হিযাম রাঃ) শতকরা ১০০ ভাগ মুনাফা করেন; এর পরেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর ব্যবসায় বরকত দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন।[জামে আত-তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৩৯২, হাদীস নং ১১৯৫, আবূ দাউদ; উদ্ধৃত, নূর, ই, এম, উপরোক্ত, পৃ: ৭৬।]
প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সম্পদের ব্যক্তি মালিকানাকে অনুমোদন করেছে, ইসলামী মূল্যবোধের আওতায় উদ্যম-উদ্যোগের স্বাধীনতা দিয়েছে, মুনাফাকে আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহ ঘোষণা করেছে, দামের (price) মাধ্যমে সম্পদ বরাদ্দ বন্টন ও বিনিময়ের ব্যবস্থা করেছে, বাজারে চাহিদা-যোগানকে স্বাভাবিক রাখার জন্য যথোপযুক্ত বিধি-বিধান দিয়েছে এবং সুদসহ সকল প্রকার জুলুমমূলক লেনদেন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ইসলামের ইত্যাকার সীমার মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা হলে তা অবৈধ হওয়ার কোন কারণ নেই। তাছাড়া মুনাফাই হচ্ছে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, উৎপাদন, উন্নতি ও সুমৃদ্ধির আসল চাবিকাঠি। সুতরাং মুনাফার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া ইসলামের কাম্য নয়। সর্বোপরি প্রত্যেক কারবার তথা বিনিয়োগে সর্বোচ্চ লাভের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি লোকসানের মাধ্যমে সাকল্য পুজিঁ খোয়া যাওয়ার আশংকাও রয়েছে। আর একথা সত্য যে, লোকসানের কোন সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং এর বিপরীতে লাভের কোন সীমা না থাকাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, ন্যায় ও সুবিচার কায়েম করাই ইসলামের উদ্দেশ্য। সুতরাং কোন ব্যক্তি যাতে তার ন্যায্যা পাওনা থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে; সে জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল ভিত্তি হতে হবে পারস্পরিক সহযোগিতা, পারস্পরিক কল্যাণ, সামষ্টিক স্বার্থ এবং ন্যায়সঙ্গত লেনদেন ও ক্রয়-বিক্রয়।
ক্রয়-বিক্রয়ের শ্রেণীবিন্যাস
স্কলারগণ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সামনে নিয়ে বিভিন্নভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের শ্রেণী-বিন্যাস করেছেন। তবে স্বয়ং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) ক্রয়-বিক্রয়ের শ্রেণী-বিন্যাস করার যে ইঙ্গিত দিয়েছেন আমাদের আলোচনার জন্য সেটিই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক এবং রিবা বুঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সূরাতুল বাকারাহর ২৮২ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যাবতীয় ক্রয়-বিক্রয়কে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেনঃ সমজাতের পণ্য, অর্থ ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় যেমন, সোনার বদলে সোনা ইত্যাদি এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতের পণ্য, অর্থ ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় যেমন, সোনার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে খেজুর ইত্যাদি।
সুতরাং আল-কুরআর ও হাদীসের মর্ম অনুসারে সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয়কে নিম্নোল্লেখিত চার প্রকার শ্রেণীবদ্ধ করা যায়ঃ
১). সমজাতের পণ্য, সেবা ও অর্থ নগদ ক্রয়-বিক্রয় (Spot transaction of goods, services or currencies of same kind or same species under same genus); যেমন, সোনার বদলে সোনা, টাকার বদলে টাকা, খেজুরের বদলে খেজুর ইত্যাদি।
২). সমজাতের পণ্য, সেবা ও অর্থ বাকি ক্রয়-বিক্রয় (Deferred sale of goods, services or currencies of same kind or same species under same genus) যেমন, আজ সোনা দিয়ে এক মাস পর নেওয়া, আজ টাকা দিয়ে এক মাস পর টাকা নেওয়া, আজ খেজুর দিয়ে এক মাস পর খেজুর নেওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে আসলে ঋণ বা ধার; কারণ, ঋণ হচ্ছে কোন ফাঞ্জিবল পণ্য একই জাতের পণ্যের বিনিময়ে বাকিতে বিক্রয় করা।
৩). অসম জাতের পণ্য, সেবা ও অর্থ নগদ ক্রয়-বিক্রয় (Spot sale of dissimilar, different or heterogeneous kinds of goods, services or currencies); যেমন, সোনার বদলে রূপা, টাকার বদলে ডলার অথবা খেজুরের বদলে গম ইত্যাদি।
৪). অসম জাতের পণ্য, সেবা ও অর্থ বাকি ক্রয়-বিক্রয় (Deferred sale of dissimilar, differnt or hetergeneous kinds of goods, services or currencies); যেমন, আজ সোনা দিয়ে এক মাস পর রূপা নেওয়া, আজ টাকা দিয়ে এক মাস পর টেবিল নেওয়া, আজ টাকা দিয়ে এক মাস পর ডলার নেওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের বাকি ক্রয়-বিক্রয়ে যে কাউন্টার ভ্যালু প্রদান স্থগিত রাখা হয় তাকেই বলা হয় দাইন বা দেনা।
ক্রয়-বিক্রয় ও মুনাফার গুরুত্ব
১) ক্রয়-বিক্রয় মানব সমাজের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্যঃ ক্রয়-বিক্রয় ও মুনাফা মানব সমাজের অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয়। দুনিয়ায় মানুষের অভাব অসীম ও বহুমুখী। কিন্তু পৃথিবীতে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতিই তার সকল অভাব পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় পণ্য-সামগ্রী ও সেবা একা নিজেই উৎপাদন করতে পারে না। এজন্য যে বহুমুখী যোগ্যতা-প্রতিভা, উপায়-উপকরণ ও পরিবেশ দরকার তাও এককভাবে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জাতির আয়ত্তে নেই। এখানে প্রত্যেকে কেবল সেই পণ্য-সামগ্রী বা সেবা উৎপাদন করে যা উৎপাদন করায় তার সর্বাধিক যোগ্যতা-প্রতিভা রয়েছে, যার প্রতি তার ঝোঁক-প্রবণতা বেশি, যার উপায়-উপকরণ তার জন্য সহজলভ্য এবং পরিবেশ সবচেয়ে বেশি অনুকূল। এক কথায়, প্রত্যেক ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জাতি কেবল সেই সব পণ্য-সামগ্রী ও সেবা উৎপাদন করে যা সে সর্বাধিক দক্ষতার সাথে এবং তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম খরচে উৎপাদন করতে সক্ষম। অতঃপর সে তার উৎপাদিত পণ্য-সামগ্রীর উদ্বৃত্তাংশের বিনিময়ে অন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতির কাছ থেকে অপরাপর পণ্য-সামগ্রী ও সেবা ক্রয় করে তার যাবতীয় অভাব পূরণ করে থাকে। এভাবে সর্বনিম্ন খরচে সর্বাধিক উৎপাদন সম্ভব হয়। আর পারস্পরিক বিনিময় ও ক্রয়-বিক্রয় হয়ে ওঠে অত্যাবশ্যকীয়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডোই হচ্ছেন পাশ্চাত্যের সর্বপ্রথম অর্থনীতিবিদ যারা বাণিজ্যের মাধ্যমে সকল পক্ষের উপকৃত হওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন এবং তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্বের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। বস্তুতঃ দ্রব্য-সামগ্রী ও সেবার পরস্পর বিনিময় ও ক্রয়-বিক্রয়ের অনুপস্থিতিতে ব্যক্তির অস্তিত্বও কল্পনা করা যায় না। সুতরাং ক্রয়-বিক্রয় কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য।
২) ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে অর্থনীতির ভিত্তিঃ ক্রয়বিক্রয় হচ্ছে মানব সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় বিষয়। ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমেই উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধিত হয় এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে বাজার অর্থনীতির ভিত্তি ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
৩) মুনাফা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তিঃ মুনাফা হচ্ছে যাবতীয় অর্থনৈতিক তৎপরতার চালিকাশক্তি; কেবল জীবিকা অর্জন নয়, বরং উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বাহনও হচ্ছে মুনাফা। কৃষক হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে জমি চাষ ও বীজ বপন করে। আশা যে, বিনিময়ে সে অধিক ফসল পাবে। শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার শ্রম বিনিয়োগ করে; বিনিময়ে মজুরী পায়, যার দ্বারা সে জীবিকা নির্বাহ করে। শিল্পপতি তার মেধা ও অর্থ খাটিয়ে ছোট-বড় কারখানা গড়ে তোলে; উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে লাভ করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। ব্যবসায়ী পণ্য-সামগ্রী ক্রয় করে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়তো লাভ পাবার উদ্দেশ্যেই। অপরপক্ষে লক্ষ্য করা যায় যে, মুনাফার সম্ভাবনা নেই এমন কাজে হাত দিতে কেউ উৎসাহবোধ করে না; সেসব কাজে বিনিয়োগ করতে কেউ এগিয়ে আসে না।
৪) মুনাফা উন্নাতি ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠিঃ বাজার অর্থনীতিতে মুনাফার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুনাফাই হচ্ছে জীবিকা অর্জনের বৈধ ও সম্মানজনক পথ। মুনাফাই অর্থনৈতিক কাজে উৎসাহ যোগায় ও উদ্বুদ্ধ করে। দক্ষতা বৃদ্ধি ও নতুন নতুন আবিষ্কার-উদ্ভাবনের মূল প্রেরণাই হচ্ছে মুনাফা। মুনাফা ছাড়া অর্থনৈতিক কাজকর্ম স্থবির ও অচল হয়ে পড়তে বাধ্য।
৫) মুনাফা কল্যাণকর ও অত্যাবশ্যকীয়ঃ জীবিকা অর্জন ও সম্পদ আহরণের পথ হিসেবে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুনাফার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং সবচেয়ে মহৎ কাজ বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে একটি সামাজিক দায়িত্ব (Social obligation)।
৬) ব্যবসা-বাণিজ্য ফরজে কিফায়াঃ ইসলামী আইনবেত্তাগণ ব্যবসা-বাণিজ্যকে ফরজে কিফায়া [নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ৬৯] ঘোষণা করেছেন। এ দায়িত্ব পালন করা মুসলমানদের ওপর সামগ্রিকভাবে অবশ্যপালনীয়। সমাজের সকল ব্যক্তি অথবা সকলের পক্ষ থেকে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে এ দায়িত্ব অবশ্যই আঞ্জাম দিতে হবে; অন্যথায় সমাজের সকলকেই এ দায়িত্ব অবহেলা করার দায়ে দায়ী হতে হবে।
৭) মুনাফা আল্লাহর অনুগ্রহঃ মহাগ্রন্হ আল-কুরআনে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’য়ালা মুনাফাকে আল্লাহর অনুগ্রহ আখ্যায়িত করেছেন এবং মানব জাতির উপকারার্থে নদী, সাগর ও মহাসাগরে জাহাজ, নৌকার মাধ্যমে মালামাল পরিবহনের ওপর বারবার গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং একে জীবিকা অর্জনের অন্যতম উপায় বলে ঘোষণা করেছেন।
৮) জীবিকা অর্জন করা ফরজঃ আল-কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে আল্লাহর অনুগ্রহ রূপে মুনাফা অর্জনে উৎসাহ প্রদান করেছেন। আল-কুরআন বারবার মানুষকে স্মরণ করিয়েছে যে, আল্লাহ তাদেরকে জাহাজ তৈরীর উপকরণ দান করেছেন এবং নদী, সাগর ও মহাসাগরকে তাদের জন্য নদী-সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন, যেন তোমরা তা হতে নতুন তাজা গোশত আহরণ করে খেতে পার এবং এমন সব সৌন্দর্য-শোভার জিনিস বের করে নিতে পার যা তোমরা পরিধান কর। তোমরা দেখছ যে, নৌকা-জাহাজ নদী-সমুদ্রের বুক বিদীর্ণ করে চলাচল করে। এসব কিছু এজন্য যে, তোমরা তোমাদের আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করে নিবে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে”। (১৬:১৪) আবার সূরা বনি ইসরঈলে আল্লাহ বলেছেন, “তোমাদের রব তো তিনিই যিনি নদী-সমুদ্রে তোমাদের নৌকা-জাহাজ চালাচ্ছেন যেন তোমরা তার অনুগ্রহ করতে পার। আসল কথা হচ্ছে, তিনি তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু”।(১৭:৬৬)
এছাড়া মানুষ যাতে তাদের জীবনোপকরণ সংগ্রহ করতে পারে সেজন্য আল্লাহ তা’য়ালা পৃথিবীর যমীনকে মানুষের অধীন করে দেওয়ার কথাও বলেছেন। সূরা আল-মূলক-এ বলা হয়েছে, “সেই আল্লাহই তো তোমাদের জন্য ভূগোলককে অধীন বানিয়ে রেখেছেন, যাতে তোমরা এর বক্ষের ওপর চলাচল কর এবং তা থেকে আল্লাহর দেয়া রিযক খাও”। (৬৭:১৫) বস্তুতঃ ইসলাম প্রত্যেক উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে তার নিজের এবং অধীনস্থদের জন্য জীবিকা অর্জন করা ফরজ করে দিয়েছে।
৯) পার্থিব জীবন ও আধ্যাত্মিক জীবন পৃথক নয়ঃ সর্বোপরি ইসলাম মানবজীবনের আধ্যাত্মিক আর বস্তুগত দিককে আলাদা আলাদা অংশে বিভক্ত করে দেয়নি; বরং আধ্যাত্মিক পিপাসার পাশাপাশি বস্তুতগত প্রয়োজনকে সমান গুরুত্ব প্রদান করেছে। আল-কুরআর দিনের বেলার সময়কে মুনাফা অর্জনের কাজে ব্যবহার করার জন্য তাকিদ করেছে। একদিকে সময়মত নামায, বিশেষ করে, জুময়ার নামায আদায় এবং জুময়ার নামাযের আযান হলেই বেচাকেনা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে; অন্যদিকে নামায সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে জীবিকা অন্বেষণের কাজে লেগে যাওয়ার জন্য আদেশ করেছে। বলা হয়েছে, “ওহে যারা ঈমান এনেছ, জুময়ার দিন যখন নামাযের জন্য ডাক দেওয়া হবে, তখন আল্লাহর স্মরণের দিকে দৌঁড়াও এবং কনাবেচা ছেড়ে দাও। এটা তোমাদের জন্য অধিক উত্তম, যদি তোমরা জান। পরে যখন নামায সম্পূর্ণ হবে তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর”।(আল-কুরআন: ৬২:৯-১০)
১০) হাদীসের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্যঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাদীসেও ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুনাফার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “কোন ব্যবসায়ী দল যদি সত্য কথা বলে এবং উপদেশ দেয়, তাহলে তাদের ব্যবসায় বরকত হয়’ কিন্তু যদি তারা ঠকায় এবং মিথ্যা বলে তাহলে তাদের ব্যবসা বরকত বঞ্চিত হয়”।[বুখারী ও মুসলিম, উদ্ধৃত, নূর, ই, এম, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭৬।] নবী (সাঃ) আরও বলেছেন, সত্যবাদী, আমানতদার,বিশ্বাসী ব্যবসায়ী ব্যক্তি (কেয়ামতের দিন) নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের দলে থাকবেন”।[তিরমিযী, পৃ: ৩৬৭, হাদীস নং ১১৪৭, দারেমী, দারা কুতনী, উদ্ধৃত, মিশকাত শরীফ, ২৬৭৪।] সুতরাং ইসলামে গুরুত্বের দিক থেকে ব্যবসা আর জিহাদকে আলাদা করে দেখার কোন অবকাশ নেই।