তৃতীয় অধ্যায়: অপরাপর ধর্ম ও দার্শনিকদের দৃষ্টিতে সুদ
অপরাপর ধর্মের দৃষ্টিতে সুদ
আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওপর মহাগ্রন্হ আল-কুরআনে সুদ নিষিদ্ধ। ফলে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, কেবল ইসলামেই সুদ নিষিদ্ধ। কিন্তু এ কথা আদৌ সঠিক নয়; বরং প্রাচীন কাল থেকে দুনিয়ায় আসমানী ধর্ম হিসেবে প্রচারিত সকল ধর্মের নিষিদ্ধ ছিল। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের শরীয়াহ্ আপীলেট বেঞ্চের অন্যতম সদস্য বিচারপতি ওয়াজিউদ্দিন আহমদ বেঞ্চ কর্তৃক সুদের বিরুদ্ধে প্রদ্ত্ত রায়ে সংযোজিত তাঁর মন্তব্যে বলেছেন, “notion is practically as old as civilization itself, “Quranic prohibition against riba, in the background of pre-existing restrictions applicable to Ahle-Kitab (people of the scripture i.e. Jews and Christians), for “there is no change in religion” (Al-Quran), which, evolutionary processes and man-made deviations apart, has remained the same since Adam, was gradual, first as pointers and then as the strictest of the commandments”[SLR, Feb. 2000, Lahore, Vol. 1, No. 2, p, 7-8] “মানব সভ্যতা যতটা পুরাতন সুদের ধারণাটিও ততটাই প্রাচীন। সুদের ওপর আল-কুরআনের নিষেধাজ্ঞা কার্যতঃ আহলি কিতাবদের (ইহুদী ও খৃস্টান) ওপর এই বিষয়ে পূর্ব থেকে আরোপিত ও প্রযোজ্য বিধি- নিষেধের ধারাবাহিকতা মাত্র। আল-কুরআনের দৃষ্টিতে বিবর্তন প্রক্রিয়া ও মানুষের সৃষ্ট বিচ্যুতি ছাড়া ধর্মে কোনও পরিবর্তনন হয় না। হযরত আদম (আঃ) থেকে ধর্ম একই রয়েছে এবং সুদ সংক্রান্ত এর বিধি-বিধানসমূহ প্রথমত ছিল দিক-নির্দেশনামূলক, পরে ধারা পরিক্রমায় তা কঠোর অনুশাসনে পরিণত হয়”।
বস্তুতঃ আদম (আঃ) ছিলেন পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রথম মানুষ; আর তিনি ছিলেন আল্লাহর নবীও। অতঃপর যুগে যুগে দেশে দেশে আল্লাহ অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁরা সকলেই সেই একই আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করেছেন। সুতরাং আদি থেকে শুরু করে সকল যুগে সকল নবী-রাসূলের প্রচারিত দ্বীনে সুদ নিষিদ্ধ ছিল এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু সকল নবী-রাসূলের কাছে নাযিলকৃত আল্লাহর গ্রন্হ সংরক্ষিত নেই। আজকের দিনে যে কয়টি গ্রন্হকে আসমানী গ্রন্হ বলে মনে করা হয় তার মধ্যে একমাত্র আল-কুরআনই অক্ষত ও অবিকৃত অবস্থায় মওজুদ আছে। এছাড়া অন্যান্য সব কয়টি গ্রন্হেই আল্লাহর বাণীর সাথে মানুষের কথার সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। তার পরেও এসব গ্রন্হ থেকে যতটুকু জানা যায় তাতে ইহুদী ধর্মগ্রন্হ, খৃস্টান ধর্মগ্রন্হ ও হিন্দু ধর্মগ্রন্হে সুদ নিষিদ্ধ ছিল বলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বিচারপতি ওয়াজিউদ্দীন আহমদ বলেছেন, “While evidence of such transactions is found reflected, and perhaps not approved except with reservations, in the Code of Hammurabi (1712-1750 BC) of the Babylonian era, the practice was either controlled or consistently disapproved in the religious precepts and teachings of Hinduism (Code of Manu), Judaism and Christianity”[উপরোক্ত।]
“বেবিলনীয় যুগে (খৃস্টপূর্ব ১৭৫০-১৭১২) হাম্মুরাবি সংহিতায় সুদ লেনদেন সংক্রান্ত দৃষ্টান্তের অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয়, সম্ভবতঃ এর অনুকূলে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, ধর্মীয় অনুমোদন ছিল না। তবে হিন্দু ধর্ম (মনুসংহিতা) এবং ইহুদী ও খৃস্ট ধর্মে সুদকে হয় নিয়ন্ত্রণ করা হতো, না হয় রীতি মাফিক তা নিষিদ্ধ ছিল”। নিচে এ সংক্রান্ত তথ্য পেশ করা হলোঃ
ইহুদী ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ
বনি ইসরাঈলদের মধ্যে আল্লাহ বহু সংখ্যক নবী প্রেরণ করেছিলেন। এই নবীদের (আঃ) কাছে আল্লাহ বেশ কয়টি গ্রন্হও নাযিল করেছেন। মূসা (আঃ)- এর ওপর নাযিল করেছিলেন তাওরাত এবং দাঊদ (আঃ)- এর ওপর নাযিল করেছিলেন যাবূর। তাদের কাছে নাযিলকৃত গ্রন্হে সুদ নিষিদ্ধ ছিল। এছাড়া, ইহুদীদের মৌলিক আইন গ্রন্হ ‘তালমূদ’ এবং ‘মিশনাহ’-তে ইহুদীদের সুদী লেনদেন করতে নিষেধ করা হয়েছে; এমনকি, ইহুদীদের মধ্যে পরস্পর সুদ লেনদেনের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা, গ্যারান্টি প্রদান করা অথবা সাক্ষী হতেও নিষেধ করা হয়েছে।[Hassan, Mahbob ul: An Explanation of Rationale behind the Prohibition of Riba in the Dotrines of three major Religions with special reference to Islam, [email protected]. o. 75]
মূসার (আঃ) কাছে নাযিলকৃত তাওরাতের ৫টি পুস্তকের মধ্যে ৩ টিতেই সুদ নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আয়াত পাওয়া যায়; সেগুলো হচ্ছেঃ
১. লেভিটিকাস (Leviticus): ২৫: ৩৫-৩৭ (তাওরাত)
“If your brother meets with difficult times, you shall give him shelter and lodging, though he be a stranger or a sojourner, that he may live ith you. Do not exact from him any interest (riba) over and above that which you have spent on him. You have the anger of God to fear. See to it that your brother has freedom to live with you. It is not permissible for you to receive interest (riba) on what you spend, or what you write off.”[উদ্ধৃত, ইমরান, এন, হোসেইন, The Prohibition of Riba in the Quran and Sunnah, p. 64।]
“তোমার ভাই যদি দুঃসময়ে নিপতিত হয়, তাহলে তুমি তাকে বাসস্থান ও আশ্রয় দেবে, সে যদি বিজাতীয় হয় তবুও। তাকে তোমার সাথে বাস করতে দাও। আর তার জন্য যা কিছু ব্যয় করবে তার ওপর সুদ গ্রহণ করবে না। প্রভুকে ভয় কর। তোমার ভাই-এর অধিকার আছে তোমার সাথে বাস করার। তুমি যা খরচ কর বা মাফ করে দাও, তার ওপরে সুদ গ্রহণ করা বৈধ নয়”। (লেভিটিকাস-এ ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে টারবিট অথবা মারবিট: এর অর্থ হচ্ছে ঋণদাতা কর্তৃক ঋণের ওপর আদায়কৃত সুদ।)
২. Exodus-২২: ২৪(তাওরাত)
“তোমরা যদি আমার কোন লোককে অর্থ ধার দাও যারা গরীব, তবে তোমরা তার উত্তমর্ণ মহাজন হবে না এবং তার কাছ থেকে সুদ আদায় করবে না”।[উদ্ধৃত, মুঃ শরীফ হুসাইন ও এস, এম, হাবিবুর রহমান, ইসলামী ব্যাংক কি ও কেন, বাংলা অনুদিত, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ, পৃ: ৮৬।]
৩. Deuteronomy- ২৩: ১৯-২০ (তাওরাত)
“তোমরা তোমাদের স্বজাতীয় ভাইকে সুদের ধার দিবে না – অর্থের ওপর সুদ, খাদ্য- সামগ্রীর ওপর সুদ এবং সুদ এবং যে কোন জিনিস যা ধার দেওয়া হয়, তার ওপরে সুদ”।[উপরোক্ত, পৃ: ৮৬।]
৪. Psalms: IS: I, 2, 5
“প্রভূ! আপনার তাঁবুতে স্থান পাবে কে? আপনার পবিত্র পর্বত গিরিতে কে বাস করবে? যে ন্যায় পথে চলে, পুণ্যের কাজ করে এবং সর্বান্তকরণে সত্য কথা বলে; যে তার অর্থ সুদের খাটায় না অথবা নিরীহ লোকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করে না”।[উদ্ধৃত, তকি উসমানী, পূর্বোক্ত পৃ. ২৩।]
৫. Proverbs: 28: 8
“যে সুদ এবং অন্যায় উপার্জনের দ্বারা তার সম্পদ-সম্পত্তি বৃদ্ধি করে, সে তা নিজের জন্য পুঞ্জীভূত করে যা দরিদ্রদের দুর্দশা বাড়ায়”।[উদ্ধৃত, তকি উসমানী, পূর্বোক্ত পৃ. ২৩।]
৬. Nehemiah: 5: 7
“অতঃপর আমি বিবেকের সাথে বুঝাপড়া করেছি এবং সম্ভ্রান্তদের ভৎসনা করেছি এবং তাদের নীতি-ব্যবস্থাকেও; তাদের বলেছি, তোমরা জবরদস্তি সুদ আদায় কর তার সব ভাই থেকে এবং আমি তাদের বিরুদ্ধে এক মহা-সম্মেলনের ব্যবস্থা রেখেছি”।[উদ্ধৃত, তকি উসমানী, উপরোক্ত, পৃ: ২৪।]
বনি ইসরাঈলের নিকট প্রেরিত আল্লাহর এক নবী ছিলেন যুলকিফল, যাকে এযিকেল বলা হয়। তার কাছে আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেন তাতেও সুদ নিষিদ্ধ ছিল। কেউ কেউ মনে করেন যুলকিফল একজন আর এযিকেল আর একজন নবী ছিলেন।
৭. a) Ezekiel: 18: 8
“যে সুদে ধার দেয় না এবং সুদ গ্রহণও করে না, সে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে, যে বিবদমান পক্ষের মধ্যে ন্যায়পরায়ণাতার সাথে মীমাংসা করে দেয়, যে আমার নির্দেশিত পথে চলে এবং আমার বিধি-নিষেধ পরিপালনে যত্নবান হয়, সেই হচ্ছে পুণ্যবান, নিশ্চয়ই সে পরিত্রাণ লাভ করবে, বললেন সদা প্রভূ”।[উদ্ধৃত, তকি উসমানী, উপরোক্ত, পৃ: ২৪।]
b) Ezekiel: 22: 12
“এখানে তারা রক্তপাত করার জন্য উপঢৌকন গ্রহণ করেছে, তারা সুদ খেয়েছে এবং বুদ্ধি আদায় করেছে, তারা লোভাতুর ও স্বার্থপর হয়ে জোরপূর্বক প্রতিবেশীদের পম্পদ কেড়ে নিয়েছে এবং তারা আমাকে ভূলে গেছে, বললেন সদা প্রভূ”।[উদ্ধৃত, তকি উসমানী, উপরোক্ত, পৃ: ২৪।]
খৃস্টান ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ
ঈসা (আঃ) ছিলেন আল্লাহর নবী। খৃস্টানগণ তাকে যীশুখৃস্ট বলে থাকে। তাঁর কাছে নাযিলকৃত গ্রন্হ he Gospel of Jesus- তে সুদ নিষিদ্ধ ছিল।
a) Gospel of St. Luke: 6: 35
“না, তোমাদের শক্রদের অবশ্যই ভালবাসবে এবং তাদের সাহায্য করবে; এবং তাদের ধার দিবে তবে কোন বিনিময় নেবে না; আর তোমরা ‘অতি বড়’ পুরস্কার লাভ করবে। আর তোমাদের অবস্থান হবে ‘অতি উচ্চে’। কেননা তিনি বড়ই দয়াশীল, এমনকি, অকৃতজ্ঞ ও পাপীদের প্রতিও”। [উদ্ধৃত, ইমরান, এন, হোসেইন, পূর্বোক্ত, পৃ: ৬৯।]
আবার বলা হয়েছে, “ধার দাও, তার বিনিময়ে কিছু আশা না করে” (Lend, hopping for nothing again)।[উদ্ধৃত, আফজালুর রহমান, ইকোনমিক ডকট্রিনস অব ইসলাম, ৩য় খণ্ড, পৃ: ২১।]
b) Gospel of St. Mathew: 21: 12-13
“যীশু আল্লাহর ঘরে (মাসজিদুল আকসা) প্রবেশ করলেন এবং সেখানে যা কিছু বেচাকেনা হচ্ছিল তা সব বাইরে ছুড়ে ফেলে দিলেন এবং অর্থ বিনিময়কারীদের টেবিলগুলো উল্টিয়ে ফেললেন (যারা মানুষের সম্পদ শোষণ (ripping off) করে নিচ্ছিল) এবং বললেন, “এটা লিখিত আছে যে, আমার ঘরে ইবাদত করা হবে, কিন্তু তোমরা এক চোরদের আড্ডাখানা বানিয়ে নিয়েছ”।
“উল্লেখ্য যে, তৎকালে দুই রকমের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। এক ধরনের মুদ্রা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রোমান মু্দ্রা; এবং ওপর রোমান সম্রাট মূর্তি খোদাই করা ছিল; এজন্য মসজিদের ভেতরে বসে এ মুদ্রা লেনদেন বৈধ ছিল না। আর দ্বিতীয়ি প্রকার মুদ্রা ছিল যার ওপর কোন ছবি ছিল না। অর্থ বিনিময়কারীরা এই উভয় মুদ্রা পরস্পর বিনিময় করত এবং মানুষকে প্রতারণা করে (রেশিও কম-বেশি করে) লাভবান হতো। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল সুদ। এজন্য যীশু এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন”।[ইমরান, এন, হোসাইন, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭০-৭১]
হিন্দু ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ
a) হিন্দুধর্মে ‘মনু’-এর (২য় শতাব্দী, AD) বিধিমালায় সুদ লেনদেন অবৈধ বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।[বিচারপতি ওয়াজিউদ্দীন, SLR, February, 2000, Lahore, Vol. 01, No. 02, পৃ: ৮।]
b) বেদঃ (2000-1400 BC) বেদে কুষীন্দিনব (সুদখোর) শব্দটি বেশ কয়েকবার উল্লেখ আছে। এর দ্বারা ঋণদাতা কর্তৃক সুদ গ্রহণকে বুঝানো হয়েছে।
c) সূত্রঃ (900-100 BC)) এত বারবার এবং বিস্তৃতভাবে সুদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে।
d) ভাসিশখাঃ তদানীন্তন কালের একজন প্র্রখ্যাত হিন্দু আইন প্রণেতা একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করেন; এত ব্রাক্ষ্মণ ও ক্ষত্রীয়দের জন্য সুদ খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
প্রাচীন হিন্দু সমাজে একটি প্রবাদ চালু ছিল যে, “নগচ্ছেৎ শুন্ডিকায়লং”; অর্থাৎ সুদখোরের বাড়ীতে যেয়ো না।
বৌদ্ধ ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ
‘জাতাকাস’- এ (600-400 BC) (বুদ্ধধর্মে) সুদকে ঘুণা করা হয়েছে এবং সুদখোরদের ‘ভণ্ড তপস্বী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “hypocritical ascetics are accused of practicing it.”
হাম্মারাবি মতবাদে সুদ নিষিদ্ধ
প্রাচীন বেবিলনে হাম্মুরাবি মতবাদেও সুদ নিষিদ্ধ ছিল।
উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে, কেবল ইসলামই সুদ নিষিদ্ধ করেনি, বরং পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ কয়েছে।
দার্শনিকদের দৃষ্টিতে সুদ
প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক প্ল্যাটো-এ্যারিস্টোটল থেকে শুরু করে আধুনিক দার্শনিকদেন অনেকেই সুদকে ক্ষতিকর মনে করেছেন, একে ঘৃণা করেছেন এবং এর নিন্দা করেছেন। নিচে কতিপয় দার্শনিকের মত পেশ করা হলোঃ
প্ল্যাটোঃ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক প্ল্যাটো তাঁর ‘লজ’ নামক পুস্তকে সুদের নিন্দা করেছেন। তিনি সুদকে মানবতাবিরোধী, অন্যায় ও জুলুম এবং কৃত্রিম ব্যবসা বলে তীব্রভাবে সুদের বিরোধিতা করেছেন।[প্ল্যাটো: ‘লজ’, বুক-৫।]
এ্যারিস্টোটলঃ প্ল্যাটোর ন্যায় এ্যারিস্টোটলও কঠোর ভাষায় সুদের নিন্দা ও বিরোধিতা করেছেন। তিনি অর্থকে বন্ধ্যা মুরগীর সাথে তুলনা করেছেন যা ডিম দিতে পারে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, “A piece of money cannot beget another piece”। তার মতে, অর্থের একমাত্র স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে মানুষের তার মতে, অর্থের একমাত্র স্বাভাবিক হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে মানুষের পারস্পরিক অভাব পূরণে সাহায্য করা। তাঁর বিবেচনায় অর্থ ধার দিয়ে তার ওপর সুদ আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার জন্য অর্থেন ব্যবহার করা উচিত নয়। তিনি সুদকে কৃত্রিম ও জালিয়াতি ব্যবসা”। তিনি তাঁর পলিটিক্স শীর্ষক গ্রন্হে লিখেছেন, “The most hated sort (of wealth), and with the greatest reason, is usury, which makes gain out of money itself, and from the natural objects of it. For money was intendeded to be used in exchange, and not increase at interest of all modes of getting wealth, this is the most unnatural.”[ Aristotle: Politics, 1258.] “সঙ্গত কারণেই সবচেয়ে ঘৃণিত হচ্ছে সুদ যার দ্বারা অর্থ নিজ থেকে অর্থ উপার্জন করে এবং অর্থের স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত উদ্দেশ্য থেকেও। কারণ কারণ অর্থের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা, সুদের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাওয়া নয়; সম্পদ অর্জনের পন্হা-পদ্ধতিসমূহের মধ্যে এই পদ্ধতিটি সবচেয়ে অস্বাভাবিক”।
থমাস একুইনাসঃ সুদের বিরুদ্ধে থমাস একুইনাসের যুক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, অর্থ থেকে অর্থের ব্যবহার পৃথক করা যায় না। তাই অর্থ ব্যবহার করা মানে অর্থকে নিঃশেষ বা খরচ করে ফেলা। এক্ষত্রে একবার অর্থের দাম নেওয়ার পর পুনরায় অর্থের মূল্য নেওয়া হলে, একই পণ্যকে দু’বার বিক্রয় করার অপরাধ হবে, অথবা দ্বিতীয়বার এমন জিনিসের দাম নেওয়া হবে, যা প্রকৃপক্ষে বিক্রেতার দখলে নেই। তাঁর মতে, নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় অবিচার ও জুলুম।
সুদকে যারা সময়ের মূল্য বলে দাবী করেন তাদের যুক্তি খণ্ডন করে তিনি বলেছেন, “সময় হচ্ছে একটি সাধারণ (common) সম্পদ; সময়ের ওপর ঋণদাতার যেমন অধিকার আছে, ঋণগ্রহীতারও ঠিক তেমনি অধিকার রয়েছে; অন্যান্য সকল মানুষেরই সময়ের ওপর একই সমান অধিকার আছে। এমতাবস্থায় ঋণদাতা কর্তৃক ঋণগ্রহীতার নিকট সময়ের মূল্য দাবী করা একটা ভণ্ডামি ও অসাধু ব্যবসা”।[বোম বাওয়ার্ক: দি পজিটিভ থিওরী অব ইন্টারেস্ট, পৃ: ৩৪।]
মিসাব্যুঃ ইটালীয় লেখক মিসাব্যু সুদকে অযৌক্তিক বলেছেন; তিনি বলেছেন, “একদিকে অর্থ হচ্ছে একটি প্রতীক মাত্র- এর নিজস্ব কোন ব্যবহার নেই; অপরদিকে বাড়ী-ঘর ও আসবাবপত্রের ন্যায় অর্থের কোন ক্ষয়-ক্ষতিও নেই”।[Ibid, p. 34.]
অন্যান্য দার্শনিকঃ ক্যাটোস, কাইসীরো, সেনেকা এবং পোটাস প্রমুখ দার্শনিকগণও অর্থকে বন্ধ্যা আখ্যায়িত করেছেন এবং অর্থের ওপর সুদ ধার্য করাকে অযৌক্তিক বলে অভিমত দিয়েছেন।
এছাড়া রোমের আইন প্রনেতাগণ, হিন্দু দার্শনিকবৃন্দ, ইহুদী ও খৃস্টান যাজকগণও সুদকে ঘৃণা করতেন। খৃস্টান ধর্মের শুরু থেকে সংস্কার আন্দোলনের অভ্যুদয় এবং রোমে পোপ নিয়ন্ত্রিত চার্চ হতে অন্যান্য চার্চে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সুদ নিষদ্ধ ছিল।