হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত
হযরত উমর ফারুক (রা)-এর দশ বৎসরকালীন শাসন আমলে ইসলামী খিলাফত চরম উৎকর্য ও অদৃষ্টপূর্ব অগ্রগতি লাভ করে। রোম ও পারস্যের ন্যায় শক্তিশালী রাষ্ট্রদ্বয় এই সময়ই মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হয়। বস্তুতঃমুষ্টিমেয় মরুবাসী অতি অল্প সময়ের মধ্যে যে বিপ্লব সৃষ্টি করিয়াছিল, ইতিহাস উহার দৃষ্টান্ত পেশ করিতে অক্ষম। আলেকজান্ডার দি গ্রেট, চেঙ্গিস খান ও তৈমূর লং সমগ্র পৃথিবী গ্রাস করিবার জন্য উদ্যত হইয়াছিলেন এবং ভূ-পৃষ্ঠকে তাঁহারা তছনছ করিয়া দিয়াছিলেন; কিন্তু দ্বিতীয় খলীফার আমলের দেশজয় ও রাজ্যাধিকারের সহিত উহার কোন তুলনা হইতে পারে না। প্রথমোক্ত ব্যক্তিগণ এক সর্ব-বিধ্বংসী ঝড়ের ন্যায় একদিক হইতে উথিত হইয়া অত্যাচার-নিষ্পেষণ ও রক্তপাতের সয়লাব সৃষ্টি করিয়া অন্যদিকে চলিয়া গিয়াছেন। আলেকজান্ডার সিরীয় রাজ্যর “ছুর” নগর অধিকার করিয়া এক সহস্র নাগরিক নির্মমভাবে হত্যা করেন। সেই সঙ্গে তিনি ত্রিশ সহস্র নাগরিককে দাস-দাসীতে পরিণত করিয়া বিক্রয় করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই।
কিন্তু হযরত উমর ফারুক (রা)-এর আমলে যে সব দেশ ও শহর-নগরের উপর ইসলামী খিলাফতের পতাকা উত্তোলিত হয়, সেইসব স্থানে জুলুম-নিষ্পেষণ ও নির্যাতনের একটি দৃষ্টান্তও খুঁজিয়া পাওয়া যাইতে পারে না। ইসলামী সৈন্যবাহিনী বিশেষভাবে আদিষ্ট হইয়াছিল এই জন্য যে, তাহারা যেন শিশু, বৃদ্ধ ও নারীর উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করে। ব্যাপক ও সাধারণ নরহত্যা তো দূরের কথা,সবুজ-শ্যামল বৃক্ষরাজি পর্যন্ত কর্তন করাও ইসলামী সেনাদের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। মুসলিম শাসকগণ বিজিত অঞ্চলে ইনসাফ,ন্যায়পরায়ণতা ও সৌজন্যের যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতেন, তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া সকলেই মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হইত। ফলে ইসলামী খিলাফতী শাসনকে তাহার অপূর্ব রহমত বলিয়া মনে করিত এবং এই রহমত অবিলম্বে তাহাদের দেশ ও জাতির উপর বর্ষিত হইবার জন্য তাহারা রীতিমত প্রার্থনা করিত। এমনকি, তাহারা কৃতজ্ঞতার আতিশয্যে বিজয়ী মুসলমানদিগকে বিশেষ সাহায্য ও সহযোগিতা করিতেও কুণ্ঠিত হইত না। সিরিয়া বিজয়ের ব্যাপারে স্বয়ং সিরিয়াবাসী অমুসলিম জনগণই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া মুসলমানদের পক্ষে সংবাদ সরবরাহ ও খোঁজ-খবর দেওয়ার কাজ করিয়াছেন। ইরাক বিজয়-কালে তথাকার অনারব জনতা ইসলামী সৈনিকদের জন্য স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া পুল নির্মাণ করে এবং প্রতিপক্ষের গোপন তথ্যাদি সংগ্রহ করিয়া পরিস্থিতির মুকাবিলা করিবার জন্য প্রস্তুত হইবার সুযোগ দেয়। এই সকল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে হযরত উমর ফারুক (রা)-এর সহিত আলেকজান্ডার দি গ্রেট ও চেংগীজ খানের মত রক্তপাতকারীদের যে কোন তুলনাই হইতে পারে না,তাহা বলাই বাহুল্য।
আলেকজান্ডার ও চেংগীজের রক্তপাত হয়ত তদানীন্তন সমাজে সাময়িকভাবে কোন ফল দান করিয়া থাকিতে পারে; কিন্তু যে রাষ্ট্রের বুনিয়াদই স্থাপিত হয় অত্যাচার-নিষ্পেষণ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের উপর,তাহা সাধারণভাবে মানব সমাজের জন্য কোন স্থায়ী কল্যাণ বহন করিয়া আনিতে পারে না, তাহা নিঃসন্দেহে। বিশেষতঃউল্লেখিত ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে এই কথাটি পুরাপুরি প্রযোজ্য হইতে পারে। বর্তমানে এইসব বিশ্ববিজয়ী বীরদের নাম-নিশানা পর্যন্ত কুত্রাপি পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু উমর ফারুক (রা) যে সুবিশাল ইসলামী-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, সুবিচার, ইনসাফ, সহনশীলতা, সাম্য ভ্রাতৃত্ব, উদারতা ও সহানুভূতির মহত গুণরাজি তাহাতে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হইয়াছিল। এই কারণে বিশ্ব-ইতিহাসে ফারুকী খিলাফত যথার্থই এক স্বর্ণ-যুগ ও মানবতার প্রকৃত কল্যাণের যুগে বলিয়া অভিহিত হইতেছে।
খিলাফতের রাষ্ট্র-রূপ
ইসলামের খিলাফতী শাসন ব্যবস্থা যদিও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর সময় হইতেই সূচিত হয় এবং তাঁহার সংক্ষিপ্ত শাসনকালে ইহার ভিত্তি রচনা করা হয়; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক (রা) এর সময়ই সূচিত হয় একটি সুষ্ঠু ও সুসংবদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই সময়ই খিলাফতের বিকশিত রূপ বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে। তাঁহার আমলে কাইসার ও কিসরার বিরাট রাষ্ট্রদ্বয়ই যে মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হইয়াছিল তাহাই নয়, সেই সঙ্গে ইসলামী খিলাফতী রাষ্ট্র ও সরকার নিজ নিজ মর্যাদা ও দায়িত্ব সহকারে পূর্ণমাত্রায় কার্য সম্পাদনের সুযোগ লাভ করে। বস্তুতঃএকটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রের যতগুলি দিক ও বিভাগ থাকিতে পারে, ফারুকী খিলাফতে উহার প্রায় সব কয়টিই যথাযথরূপে বর্তমান ছিল।
হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতকালে পাক-ভারত উপমহাদেশের সীমান্ত হইতে মিশর ও সিরিয়া পর্যন্ত সমগ্র এলাকার উপর ইসলামী পতাকা উড্ডীন হইয়াছিল। এই বিশাল অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষাভাষী লোক বসবাস করিত। হযরত উমর (রা)-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা নিয়োজিত ছিল আরব ও অনারব মুসলমানদিগকে সর্বতোভাবে একজাতি ও এক মনা রূপে গড়িয়া তোলার উদ্দেশ্য। ইসলামী জীবন-দর্শন ও ঈমানী ভাবধারা এই বিরাট অঞ্চলের অধিবাসীদিগকে একই সূত্রে গ্রথিত করিয়া দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহাদের গোত্রীয় জীবনের ধারা তখনো পুর্ববৎই উদ্দাম গতিতে প্রবাহিত ছিল। হিংসা-দ্বেষের জাহিলী ভাবধারা কোন কোন ক্ষেত্রে মাথাচাড়া দিয়া উঠিতেও চেষ্টা করিতেছিল। কিন্তু উমর ফারুক (রা)-এর কঠোরতর আদর্শনিষ্ঠা ও নীতিবাদিতা জাহিলিয়াতের স্তূপীকৃত আবর্জনা অপসারিত করিবার জন্য প্রতি মুহূর্ত চেষ্টিত ছিল। হযরত উমর (রা) সমগ্র ইসলামী রাজ্যের অধিবাসীদিগকে একদিল, একমগজ ও এক লক্ষ্যাভিসারী একটি জাতি রূপে গড়িয়া তুলিতে এবং ইসলামের দুশমনদের মুকাবিলায় তাহাদিগকে সুসংবদ্ধ ও সংগ্রামমুখর করিয়া গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছিলেন। পরন্তু যেসব মুসলমান বিভিন্ন কার্যব্যাপদেশে দুনিয়ার অন্যান্য দেশ ও জাতির মধ্যে গিয়া বসবাস করে, তাহারা যাহাতে নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও সান্তত্র্য নষ্ট করিয়া ভিন্ন জাতির সহিত মিলিয়া একাকার হইয়া না যায়, সেদিকে তাহার সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। তিনি সমগ্র আরব দেশকে ইসলাম-দুশমন লোকদের পঙ্কিলতা হইতে সম্পূর্ণ পবিত্র করিয়া তোলেন। তিনি তাঁহার বিশেষ দূরদৃষ্টির ফলে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বুনিয়াদ সুদৃঢ়করণ ও মুসলমানদের অর্থনৈতিক উন্নতি বিধানের জন্য কৃষিব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন সাধন করেন। এই জন্য তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে কৃষিজমির ক্রয়-বিক্রয় ও বিলি-বিতরণ বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত ভিন্ন জাতির চাল-চলন, রীতি-নীতি ও সভ্যতা-সংস্কৃতি গ্রহন করা সম্পর্কে তিনি মুসলমানদিগকে সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন। তাহাদের জীবন রাসূলে করীম (স)-এর জীবন অনুসারে গড়িবার জন্য সাধারনভাবেই তিনি সকলকে উপদেশ ও নির্দেশ দিতেন
ফারুকী খিলাফতের কাঠামো
হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত ছিল পূর্ণ মাত্রায় একটি গন-অধিকার-ভিত্তিক রাষ্ট্র। তাঁহার আমলে দেশের যাবতীয় সমস্যা মজলিসে শু’রার সম্মুখে পেশ করা হইত। কুরআন সুন্নাহ ও প্রথম খলীফার অবলম্বিত রীতিনীতিকে সম্মুখে রাখিয়া প্রতিটি বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা করা হইত। মজলিসে শু’রায় কখনো সর্বসম্মতভাবে আর কখনো অধিকাংশ লোকের মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হইত। নিম্নলিখিত সাহাবীগণ তাঁহার মজলিসে শু’রার প্রধান সদস্য ছিলেনঃহযরত উসমান (রা), হযরত আলি(রা), হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা), হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা),হযরত উবাই ইবনে কায়াব (রা) ও হযরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা)।
এই মজলিসে শু’রা ব্যতীত একটি সাধারণ মজলিসও তাঁহাকে পরামর্শদান ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মীমাংসার জন্য বর্তমান ছিল। মুহাজির ও আনসারদের সকল সাহাবী ছাড়াও গোত্রীয় সরদারগণও ইহাতে যোগদান করিতেন। বিশেষ গুরুত্ববহ ও সংকটপূর্ণ মুহূর্তে এই সাধারণ মজলিসের অধিবেশন আহ্বান করা হইত। অন্যথায় দৈনন্দিন কার্য সম্পাদনের জন্য কেবলমাত্র মজলিসে শু’রার ফয়সালার উপরই তাঁহাকে নির্ভর করিতে হইত এবং উহার ফয়সালাই চূড়ান্ত বলিয়া বিবেচিত হইত। এই মজলিসদ্বয় ব্যতীত আরো একটি মজলিস তখন কার্যরত ছিল, যাহাকে ‘মজলিসে খাস’ বলিয়া অভিহিত করা যাইতে পারে। ইহাতে কেবলমাত্র মুহাজির সাহাবিগণই যোগদান করিতেন।
গণ-অধিকারসম্মত রাষ্ট্র বলিতে সেই ধরণের রাষ্ট্র-সরকার বুঝায়, যেখানে প্রতিটি নাগরিকই তাহার যাবতীয় অধিকার ভোগের সুযোগলাভ করিতে পারে;যেখানে প্রত্যেকই নিজস্ব মতামত প্রকাশ করিতে ও অন্যদের জানাইতে পারে। হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতে এই সকল বৈশিষ্ট্য পুরামাত্রায় কার্যকর ছিল। সেখানে প্রতিটি ব্যক্তিই পূর্ণ স্বাধীনতা সহকারে নিজ নিজ অধিকার দাবি করিতে পারিত।
হযরত উমর ফারুক (রা) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁহার খিলাফতের মৌল-নীতিমালা ঘোষণা করিয়া যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছিলেনঃ
*********(আরবী)
তোমাদের ধন-সম্পদে আমার অধিকার ততটুকু যতটুকু অধিকার স্বীকৃত হয় ইয়াতীমের মালে উহার মুতাওয়াল্লীর জন্য। আমি যদি ধনী ও সচ্ছল অবস্থায় থাকি, তবে আমি কিছুই গ্রহন করিব না আর যদি গরীব হই, তবে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী জরুরী পরিমাণ গ্রহন করিব। ১ {অপর একটি বর্ণনার ভাষা এই ****(আরবী) ‘আমি আমার নিম্নতম প্রয়োজন গ্রহন করিব’।}
হে লোকসকল, আমার উপর তোমাদের কতকগুলি অধিকার রহিয়াছে, আমার নিকট হইতে তাহা আদায় করা তোমাদের কর্তব্য। প্রথম, দেশের রাজস্ব ও গণিমতের মাল যেন অযথা ব্যয় হইতে না পারে, দ্বিতীয় তোমাদের জীবিকার মান-উন্নয়ন ও সীমান্ত সংরক্ষণ আমার কর্তব্য। আমার প্রতি তোমাদের এই অধিকারও রহিয়াছে যে, আমি তোমাদিগকে কখনও বিপদে নিক্ষেপ করিব না।
অপর এক ভাষণে তিনি বলিয়াছেনঃ ‘তোমাদের যে কেহ আমার মধ্যে নীতিবিচ্যুতি দেখিতে পাইবে, সে যেন আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করিতে চেষ্টা করে’। উপস্থিত শ্রোতৃবৃন্দের মধ্য হইতে একজন দাঁড়াইয়া বলিলঃ ‘আল্লাহ্ শপথ, তোমার মধ্যে আমার কোন নীতিবিচ্যুতি দেখিতে পাইলে এই তীব্রধার তরবারি দ্বারা উহাকে ঠিক করিয়া দিব’।
হযরত উমর (রা) এই জওয়াব শুনিয়া শোকর আদায় করিলেন ও বলিলেনঃ ‘আল্লাহ্ এই জাতির মধ্যে এমন লোক তৈয়ার করিয়াছেন,যাহারা তাঁহার নীতিবিচ্যুতির সংশোধন করিতে পারেন। এই জন্য আমি আল্লাহ্র শোকর আদায় করিতেছি’।
এই ভাষণ কতকগুলি আকর্ষণীয় শ্লোগান তেজব্যঞ্জক শব্দেরই সমষ্টি নহে; বস্তুতঃইহাই হইতেছে ইসলামী খিলাফতের মেনিফেষ্টো বা নীতিমালা। খলীফা ফারুকে আযম (রা) এই নীতিমালা খুব দৃঢ়তা সহকারেই পালন করিতেন। তাই দেখা যায় আমীরুল মু’মিনীন অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন; কিন্তু ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করার জন্য বায়তুল মাল হইতে সামান্য পরিমাণ মধুও কেবলমাত্র এইজন্য গ্রহণ করিলেন না যে, পূর্বাহ্ণে জনগণের নিকট হইতে উহার অনুমতি লওয়া হয় নাই। মসজিদে নববীতে উপস্থিত হইয়া সমবেত জনতার নিকট হইতে প্রকাশ্যভাবে অনুমতি লওয়ার পরই তিনি তাহা গ্রহণ করিতে সম্মত হইয়াছিলেন। পৃথিবীর বড়বড় শাসকদের ইতিহাস অনুরূপ কোন দৃষ্টান্ত পেশ করিতে পারে কি?
হযরত উমর ফারুক (রা) জনগণকে সমালোচনার অবাধ অধিকার প্রদান করিয়াছিলেন। ফলে একজন সাধারণ নাগরিকও খলীফার সমালোচনা করিতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করিত না। কেবল পুরুষ নাগরিকগণই এই সুযোগ ভোগ করিতে পারিত তাহা নহে, নারী সমাজও এই ক্ষেত্রে কিছুমাত্র পাশ্চাদপদ ছিল না। স্ত্রীর মোহরানা নির্ধারণ বিষয়ে খলীফা মতের প্রতিবাদ করিয়া যখন একজন স্ত্রীলোক বলিয়া উঠিলঃ ‘হে উমর!আল্লাহ্র ভয় কর,’ তখন উমর ফারুক (রা)ও নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া তাহা পরিহার করেন এবং কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী উক্ত স্ত্রী লোকটির মত অঙ্কুন্ঠিত চিত্তে মানিয়া লইলেন। বস্তুতঃহযরত উমর (রা)-এর খিলাফতের অভূতপূর্ব সাফল্যের মূলে এই ধরণের ইনসাফ ও ন্যায়নীতিই কার্যকর রহিয়াছেন।
ফারুকী খিলাফতের আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা
হযরত উমর (রা) গোটা ইসলামী রাজ্যকে মোট আটটি প্রদেশে বিভক্ত করিয়া লইয়াছিলেন। মক্কা, মদীনা, সিরিয়া, বসরা, কুফা,মিসর ও ফিলিস্তিন। এই কয়টি এলাকা তখন সতন্ত্র ও ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ হিসাবে গণ্য হইত। এতদ্ব্যতীত খোরাসান,আযারবাইজান ও পারস্য এই তিনটি প্রদেশও তাঁহার খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। প্রতিটি প্রদেশের জন্য আলাদাভাবে গভর্নর, বেসামরিক ও সামরিক বিভাগের চীফ সেক্রেটারী, প্রধান কালেক্টর, পুলিশ বিভাগের ডিরেক্টর, প্রধান খাজাঞ্জী, প্রধান বিচারপতি প্রভৃতি উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিযুক্ত করা হইয়াছিল।
সাধারণতঃমজলিসে শু’রার পরামর্শক্রমেই এই সব দায়িত্বপূর্ণ পদে লোক নিযুক্ত করা হইত। খলীফার প্রধান কাজ ছিল প্রদেশসমূহের শাসনকর্তাদের প্রতি তীক্ষ্ণ ও সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং তাঁহাদের স্বভাব-চরিত্র ও আদত-অভ্যাসকে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গড়িয়া তোলা। খলীফা উমর (রা) এই কাজ বিশেষ দক্ষতা সহকারেই সম্পন্ন করিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রের এক অতন্দ্র প্রহরী। প্রশাসনে ইসলামী আদর্শের একবিন্দু বিচ্যুতি তিনি বরদাশত করিতে মাত্রই প্রস্তুত ছিলেন না। শাসনকর্তা ও দায়িত্বপূর্ণ পদে লোক নিয়োগের সময় তাঁহাদের নিকট হইতে তিনি এই প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করিতেন যে তাঁহারা কঠোরভাবে ইসলামী আদর্শ মানিয়া চলিবেন এবং বিলাসিতা অথবা জাহেলী সভ্যতার কোন প্রভাবই কবুল করিবেন না। সেই সঙ্গে তাঁহাদের যাবতীয় ধন-সম্পদের একটি পূর্ণ তালিকাও তৈয়ার করিয়া লইতেন; উত্তরকালে কাহারো ধন-সম্পদে অস্বাভাবিক স্ফীতি পরিলক্ষিত হইলে পূর্বাহ্ণে রচিত তালিকার সহিত উহার তুলনা ও যাচাই করিয়া দেখিতেন। কাহারো সম্পত্তি অকারণে স্ফীত হইতে দেখিলে তাহার অর্ধেক পরিমাণ বায়তুলমালে ক্রোক করিয়া লইতেন।
শাসক ও পদস্থ অফিসারগণ যাহাতে কোথাও সীমানা লঙ্ঘন করিতে না পারে, সেদিকে খলীফা উমর (রা)-এর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। এইজন্য তিনি প্রত্যেক হজ্জের সময়ই সাধারণভাবে ঘোষণা করিয়া দিতেন, কোন সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কাহারো কোন অভিযোগ থাকিলে তাহা অনিতিবিলম্বে খলীফার গোচরীভূত করিতে হইবে। সেই সঙ্গে তিনি সকল অভিযোগের যথোচিত প্রতিকারেরও সুষ্ঠু ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন, যেন কোন অভিযোগ শুধু অভিযোগের পর্যায়েই থাকিয়া না যায়, বরং প্রতিটিরই যেন আশু প্রতিকার গ্রহণ করা হয়।
শাসকদের দ্বার জনগণের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত রাখার জন্য খলীফাতুল মুসলিমীন বিশেষ তাকিদ করিতেন। জনগণের ফরিয়াদ শাসকদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করার পথে কোথাও বিন্দুমাত্র বাঁধার সৃষ্টি হইতে দেখিলে তিনি অবলিম্বে তাহা দূরীভূত করিয়া দিতেন। তিনি দায়িত্বশীল সরকারী কর্মচারীদিগকে দৈনন্দিন কর্তব্য পালনে সদা তৎপর থাকার জন্য সব সময় তাকীদ করিতে থাকিতেন। এই পর্যায়ে হযরত আবূ মূসা আশয়ারী(রা) কে যে উপদেশ পাঠাইয়াছিলেন, তাহা সর্বকালের সর্বদেশের সরকারী কর্মচারীদের জন্য মহামূল্য দিক-নির্দেশনারূপে গণ্য হইবে। তিনি লিখিয়াছিলেনঃ
*******(আরবী)
অতঃপর জানিবে, সুষ্ঠু কর্মপন্থা এই যে, অদ্যকার কাজ আগামী কালের জন্য ফেলিয়া রাখিবে না। এইরূপ করিলে তোমাদের নিকট অনেক কাজ জমিয়া যাইবে। ফলে কাজের চাপে তুমি দিশাহারা হইয়া পড়িবে। কি করিবে, কোনটা করিবে, কোনটা করিবে না, তাহার দিশা পাইবে না। পরিনামে সব কাজই বিনষ্ট করিয়া ফেলিবে।
জনগণের নৈতিক মান সংরক্ষণ
শাসকদের ছাড়াও ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসী সাধারণ জনগণের নৈতিক চরিত্র ও ধর্মীয় মর্যাদা সংরক্ষণের জন্য খলীফা বিশেষ দায়িত্ব সহকারে অবিরাম কাজ করিতেন। বস্তুত তিনি নিজে যেরূপ ইসলামী নৈতিকতার বাস্তব প্রতীক ছিলেন, সমষ্টিগতভাবে গোটা মুসলিম জাতিকে এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি মুসলিমকে অনুরূপ গড়িয়া তোলার জন্য তিনি আপ্রাণ চালাইয়া যাইতেন। তৎকালে বংশীয় আভিজাত্যের ঐতিহিক গৌরব এবং ব্যক্তিগত অহংকার আরবদের হাড়ে-মজ্জায় মিশ্রিত ছিল, মনীব ও নওকরের মাঝে ছিল মানুষ-অমানুষের পার্থক্য। কিন্তু দ্বিতীয় খলীফা ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিক ভাবধারার গতি-প্রবাহে এইসবের কলংক ও আবর্জনারাশি ধুইয়া-মুছিয়া নিঃশেষ করিয়া দিয়াছিলেন। তিনি নিজে খাদ্য গ্রহণকালে ফকীর-মিসকিন ও ক্রীতদাসদের নিজের সঙ্গে বসাইয়া খাওইতেন। তিনি বলিয়াছেনঃ ‘ক্রীতদাস ও ফকীর-মিসকীনের সঙ্গে একত্রে আহার করাকে যাহারা লজ্জাকর ও মর্যাদাহানিকর মনে করে, তাহাদের উপর আল্লাহ্র অভিশাপ’। বস্তুত দুনিয়ার ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এইরূপ সাম্যবাদী শাসকের অন্য কোন দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া পাওয়া যাইতে পারে না।
তৎকালীন সমাজের লোকদের উপর কবি ও কবিতার খুব প্রভাব ছিল। যেসব কবি লোকদের প্রতি অশ্লীল গালাগালমূলক কবিতা রচনা করিত, রাষ্ট্রীয় ফরমান প্রচার করিয়া খলীফা উমর (রা) সেসব বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন।লোকদের পরস্পরের মধ্যে হিংসা ও বিদ্বেষাগ্নি দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়া মুসলিম ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় প্রাসাদকে যাহাতে ভস্ম করিয়া দিতে না পারে এবং জনসাধারণ যাহাতে জাতীয় লক্ষ্য ও আদর্শ ভুলিয়া গিয়া আয়েশ-আরাম, জাঁকজমক, বিলাসিতা ও ভোগ-সম্ভোগে লিপ্ত হইয়া না পড়ে, সেদিকে তাঁহার বিশেষ নজর ছিল।
মোটকথা, মুসলমানদিগকে সকল প্রকার নৈতিক পতনের হাত হইতে রক্ষা করিয়া তাহাদিগকে উন্নত নৈতিক চরিত্রে ভূষিত করার জন্য তিনি বিশেষ যত্ন গ্রহন করিয়াছিলেন। সমাজের লোকদের মধ্যে পরিপূর্ণ সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন, তাহাদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ ও দায়িত্বজ্ঞান জাগ্রত করার জন্য তিনি কখনো চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদিগকেও এ সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক করিয়া রাখিতে চেষ্টা করিতেন।
আভ্যন্তরীণ শাসন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা
সিরিয়া ও ইরান দখলে আসার পর পর বিজিত অঞ্চলের কৃষি-জমি বিজয়ী সেনানীদের মধ্যে বণ্টন করার দাবি উঠিলে খলীফা তাহা অস্বীকার করেন। মজলিসে শুরার অধিবেশনে বিস্তারিত আলোচনার পর উমর ফারুক (রা)-এর মতের অনুকূলেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
ফারুকী খিলাফতের আমলেই ইরাকের বিরাট এলাকার জরিপ গ্রহণ করা হয় সেখানকার চাষোপযোগী সমস্ত জমি জনসাধারণের মধ্যে বণ্টন করা হয়। তাহাদের নিকট হইতে উশর ও খারাজ আদায়ের ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। সিরিয়া ও মিসরে রাজস্ব আদায় শুরু করা হয়। ব্যবসায় শুল্ক(duty tax) আদায় করা খলীফা উমর ফারুক (রা)-এর একটি ইজতিহাদী ফয়সালা এবং ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় তাঁহার আমলেই সর্বপ্রথম ইহার সূচনা হয়। বলাবাহুল্য, ইহা ইসলামের অর্থ-বিজ্ঞানের সহিত পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।
দ্বিতীয় খলীফা সমগ্র মুসলিম জাহানের আদমশুমারী গ্রহণ করেন। তাঁহার আমলে জিলাসমূহে রীতিমত আদালত ও ফৌজদারী কোর্ট স্থাপিত হয়। বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয়। বিচারকদের জন্য উচ্চহারে বেতন নির্ধারণ করা হয়, যেন ঘুষ-রিসওয়াতের প্রশ্রয় দেওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ না ঘটে। ইহা ছাড়া বিভিন্ন জটিল বিষয়ের মীমাংসার জন্য তখন ফতোয়া বিভাগও খোলা হয়।
দেশের আভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য তিনি পুলিশ বিভাগ স্থাপন করেন। হযরত আবূ বকর (রা)-কে বাহরাইনের সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মচারী নিযুক্ত করিয়া পাঠাইবার সময় তাঁহাকে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের নৈতিক চরিত্রের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার জন্য তিনি বিশেষ নির্দেশ দিয়াছিলেন। দোকানদারগণ যেন পরিমাপ ও ওজনের দিক দিয়া ক্রেতাকে বিন্দুমাত্র ঠকাইতে না পারে, রাজপথের উপর যেন কেহ ঘর-বাড়ি নির্মাণ না করে, ভারবাহী জন্তুর উপর দুর্বহ কোন বোঝা যেন চাপানো না হয় এবং শরাব উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় হইতে না পারে, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিবার জন্য পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল। বস্তুত জনস্বার্থ ও শরীয়াতের নির্দেশ যাহাতে কিছুমাত্র ব্যাহত হইতে না পারে, বরং উভয়েরই মর্যাদা পুরাপুরি রক্ষা পাইতে পারে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখাই ছিল পুলিশের মৌলিক দায়িত্ব।
ফারুকে আযম (রা)-এর পূর্বে আরব জাহানে কারাগারের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তিনিই প্রথমবার মক্কা শরীফে কারাগার স্থাপন করেন। উত্তরকালে জিলাসমূহে কেন্দ্র-স্থলেও অনুরূপ কারাগার স্থাপন করা হয়।
বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা
ফারুকী খিলাফতের পূর্বে সরকারী ধন-সম্পদ সঞ্চিত রাখার কোন স্থায়ী প্রতিষ্ঠান বর্তমান ছিল না। যাহাকিছুই আমদানী হইত, সঙ্গে সঙ্গে তাহা প্রয়োজনীয় কাজে কিংবা অভাবগ্রস্তদের সাহায্যার্থে ব্যয় হইয়া যাইত। হযরত আবূ বকর (রা) যদিও একখানি ঘর বায়তুলমাল কায়েমের জন্য নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা প্রায় সবসময় বন্ধ থাকিত; তাহাতে সঞ্চয় করিয়া রাখার মত কোন সম্পদই তখন ছিল না। তাঁহার ইন্তেকালের সময় বায়তুলমালে তল্লাসী চালানো হইতে উহাতে একটি মাত্র মুদ্রা অবশিষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। হযরত উমর (রা) সম্ভবতঃ ১৫হিজরী সনে সর্বপ্রথম বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন ও মজলিসে শু’রার মঞ্জুরীক্রমে মদীনা শরীফে বিরাটাকারে বায়তুলমাল প্রাসাদ নির্মাণ করেন। রাজধানীতে বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জিলা কেন্দ্রসমূহেও অনুরূপ বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিটি স্থানেই এই বিভাগের জন্য সতন্ত্র অফিসার নিযুক্ত করা হয়। শাখা বায়তুলমালসমূহের বার্ষিক আয় হইতে স্থানীয় খরচ নির্বাহ করার পর যাহাকিছু উদ্ধৃত্ত থাকিত, তাহা কেন্দ্রিয় বায়তুলমালে-মদীনা তাইয়্যেবায়-প্রেরণ করা হইত। বায়তুলমালের দায়িত্ব ও ব্যয়ভার সম্পর্কে সঠিক অনুমান করার জন্য এই কয়টি কথাই যথেষ্ট যে, রাজধানীর অধিবাসীদের জন্য যে বেতন ও বৃত্তি নির্দিষ্ট ছিল, তাহার পরিমাণই ছিল তিন কোটি দিরহাম। বায়তুলমালের হিসাব রক্ষার জন্য সতন্ত্র বিভাগ ও হিসাবের বিভিন্ন জরুরী খাতাপত্রও যথাযথভাবে চালু করা হইয়াছিল। আরবে তখনো সুষ্ঠুভাবে কোন বৎসর গণনা প্রচলিত ছিল না; হযরত উমর ফারুক (রা) ১৬ হিজরীতে হিজরী সনের হিসাব চালু করিয়া এই অভাব পূরন করিয়া দেন।
গৃহ নির্মাণ ও পূর্তবিভাগীয় কাজ
ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধি যতই বিশাল আকার ধারণ করিতে থাকে, বিভিন্ন দালান-কোঠা নির্মাণের কাজ ততই বৃদ্ধি পাইতে থাকে। হযরত উমর (রা)-এর শাসনামলে এই কার্য সম্পাদনের জন্য স্বতন্ত্র কোন বিভাগ ছিল না। তাহা সত্ত্বেও প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দায়িত্বে এই কাজ সুষ্ঠুরূপে অগ্রসর হইতে থাকে। প্রতিটি স্থানেই অফিসারদের বসবাসের জন্য সরকারী দালান-কোঠা ও জনগণের সুখ-সুবিধার জন্য পুল, সড়ক ও মসজিদ নির্মিত হয়। অনুরূপভাবে সামরিক প্রয়োজনে দুর্গ, ক্যাম্প ও বারাকসমূহ নির্মাণ করা হয় এবং রাজকোষের হেফাজতের জন্য বায়তুলমাল বা খাজাঞ্জীখানার দালান তৈয়ার করা হয়। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে হযরত উমর (রা)-এর ব্যয়-সংকোচন নীতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাহা সত্ত্বেও বায়তুলমালের প্রাসাদ সাধারণতঃ বেশী মজবুত ও জাঁকালভাবে তৈয়ার করা হয়।
মক্কা ও মদীনার মধ্যে বিশেষ সম্পর্কের কারণে উভয় শহরের যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত সুগম ও শান্তিপূর্ণ হওয়া আবশ্যক ছিল। হযরত উমর (রা) মদীনা হইতে মক্কা পর্যন্ত দীর্ঘ পথের পার্শ্বে অনেকগুলি পুলিশী পাহারা, সরাইখানা ও ঝর্ণাধারা নির্মাণ করেন।
কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন ও উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য খলীফা সমগ্র দেশে কূপ বা খাল খনন করিয়া সেচকার্য সম্পাদনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করিয়া দেন। বসরায় মিষ্টি পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে দজলা নদী হইতে খাল খনন করা হয়। এই খালের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় নয় মাইল।এই প্রসঙ্গে নহরে মা’কাল, নহরে মায়াদ ও নহরে আমীরুল মু’মিনীন-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শহর নির্মাণ
আরবের উষর-ধূষ্র মরুভূমির বুক হইতে বিশ্ব-বিজয়ী শক্তি হিসাবে মুসলিমগণ যখন বহির্বিশ্বে পদার্পণ করিল, তখন অন্যান্য দেশের সবুজ-শ্যামল ও মনোরম দৃশ্য তাহাদিগকে মুগ্ধ করে। ইসলামী আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের তরফ হইতে বিভিন্ন সরকারী কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে তাহারা রাজধানী মদীনা হইতে বহু দূর দূরাঞ্চলে বসবাস অবলম্বন করিতে বাধ্য হয়। ইহার ফলে তাহাদের দ্বারা প্রতিবেশী দেশসমূহ বিভিন্ন শহর ও নগর গড়িয়া উঠে। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত কালে বসরা,কুফা, ফুস্তাত, মুসেল প্রভৃতি ইতিহাস-বিখ্যাত নগরসমূহ স্থাপিত হয়। বসরা শহরে প্রথমে মাত্র আটশত লোক বসবাস শুরু করে; পরে অল্পদিনের মধ্যেই অধিবাসীদের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার পর্যন্ত পৌঁছে। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে এই শহর শতাব্দী কাল পর্যন্ত মুসলমানদের গৌরবের বস্তু হইয়া থাকে। ইরাকের জৈনক আরব শাসনকর্তা রাজধানী পুনঃনির্মাণ করায় কুফা নগরের সৃষ্টি হয়। এই শহরে চল্লিশ হাজার লোকের বাসোপযোগী গৃহাদি নির্মাণ করা হয়। হযরত উমর (রা)-এর নির্দেশক্রমে ইহার সড়কসমূহ চল্লিশ হাত প্রশস্ত করিয়া তৈয়ার করা হয়। এখানে যে জামে মসজিদ নির্মিত হয়, তাহাতে এক সঙ্গে চল্লিশ হাজার মুসলমান নামায আদায় করিতে পারে। জ্ঞান-বিজ্ঞান-কেন্দ্র হিসাবে এই শহরের ঐতিহাসিক মর্যাদা সর্বজনবিদিত।
ফুস্তাত শহর নির্মাণের ইতিহাস অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। মিসর বিজয়ী হযরত আমর ইবনুল আস (রা) নীল দরিয়া ও মাকতাম পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই সময় ঘটনাবশতঃএকটি কবুতর তাঁহার তাঁবুতে নীড় রচনা করে। হযরত আমর (রা) যখন এই স্থান ত্যাগ করিয়া যাইতেছিলেন, তখন এই আসমানী অতিথির শান্ত-নীড় জীবনে যেন কোনরূপ ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয় সেই চিন্তায় তিনি তাঁবুকে যথাযথভাবে দাঁড় করিয়া রাখিলেন। উত্তরকালে এই তাঁবুকে কেন্দ্র করিয়াই ফুস্তাত শহর গড়িয়া উঠে। চতুর্থ শতাব্দীর জৈনক পর্যটক এই শহর সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
এই শহর বাগদাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পাশ্চাত্যের কেন্দ্র ও ইসলামের গৌরব। এখানকার জামে মসজিদ অপেক্ষা মুসলিম জাহানের আর কোন মসজিদে জ্ঞান-বিজ্ঞান আলোচনার এতো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় না। এখানকার সামুদ্রিক বন্দরে দুনিয়ার অধিক সংখ্যক জাহাজ নোঙর করিয়া থাকে।
মুসেল শহর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যর সংগমস্থলে অবস্থিত; এই দৃষ্টিতেই সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশে নির্মিত এই শহরের নামকরণ হইয়াছে। ইহা একটি অজ পাড়াগাঁকে বিরাট শহরে পরিণত করার এক বাস্তব নিদর্শন। হযরত উমর (রা)-এর নির্দেশে এখানে একটি বিশাল জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের পর হযরত আমর ইবনুল আস(রা) সমুদ্রোপকূলে কিছু সংখ্যক সৈন্য রাখিয়া দেন। কেননা সমুদ্র-পথে রোমান শত্রুদের আক্রমণের ভয় ছিল। উত্তরকালে এখানে একটি বিরাট উপনিবেশ গড়িয়া উঠে।
সামরিক ব্যবস্থাপনা
ইসলাম যখন রোমান সাম্রাজ্য অপেক্ষাও অধিক বিশাল রাজ্যের মালিক হইয়া বসিল এবং কাইসার ও কিসরার বিশাল বিস্তীর্ণ রাজ্যসমূহ উহার অধিকারভুক্ত হইল, তখন একটি সুসংবদ্ধ সামরিক ব্যবস্থাপনা উহার জন্য অপরিহার্য হইয়া পড়ে। হযরত উমর (রা) ১৫ হিজরী সনে ে সম্পর্কে কার্যকর নীতি অবলম্বন করেন এবং সমগ্র মুসলিম জাহানকে সামরিক জাতি রূপে গড়িয়া তোলার চেষ্টা শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে আনসার ও মুহাজির মুসলমানদিগকে লইয়া কাজ আরম্ভ করা হয়। তাহাদের প্রত্যেকের জন্য মর্যাদানুপাতে বেতন ধার্য করা হয়। এই ব্যাপারে বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, যাহাদের জন্য যত পরিমাণ বেতন ধার্য করা হয়, তাহাদের ক্রীতদাসদের জন্যও সম পরিমাণ বৃত্তি নির্দিষ্ট করা হয়।
কিছুদিন পর এই নীতি আরো অধিক ব্যাপক আকারে ধারণ করে। আরবের সমগ্র গোত্র ও কবীলার লোকদিগকেও ইহার অন্তর্ভুক্ত করিয়া লওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত দুগ্ধপোষ্য শিশুদের জন্যও বৃত্তি নির্ধারণ করা হয়। ইহার অর্থ এই ছিল যে, আরবের জাহানের প্রতিটি শিশুকে জন্মদিন হইতেই ইসলামী সৈন্যবাহিনীর একজন সিপাহীরুপে গণ্য করা হইল।
সৈনিকদিগকে বিশেষভাবে ট্রেনিং দানের দিকে হযরত উমর (রা)-এর সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল; এমনকি বিজিত এলাকাসমূহের কেহ যেন সামরিক জীবন পরিত্যাগ করিয়া কৃষিকার্য ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে লিপ্ত হইয়া না পড়ে, সে জন্য বিশেষ তাকীদী ফরমান প্রচার করা হইয়াছিল। কেননা তাহা করা হইলে মুসলিম মুজাহিদদের সামরিক যোগ্যতা প্রতিভা, বীরত্ব ও সাহসিকতা বিলুপ্ত হইয়া যাওয়ার সমূহ আশংকা ছিল।
দ্বিতীয় খলীফার আমলে সৈনিকদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিশেষ যত্ন লওয়া হইত; সৈনিকদের ক্যাম্প তৈয়ার করার ব্যাপারে আবহাওয়ার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হইত। বসন্তকালে সৈনিকদের সবুজ-শ্যামল অঞ্চলে প্রেরণ করা হইত। প্রায় সকল বড় বড় শহরের উপকণ্ঠে সামরিক কেন্দ্র স্থাপন করা হইয়াছিল। শত্রু শিবির হইতে গোপন সংবাদ সংগ্রহের জন্য সামরিক গোয়েন্দা বিভাগকে বিশেষ তৎপর করিয়া তোলা হইয়াছিল। বস্তুতঃহযরত উমর ফারুক (রা) তেরোশত বৎসর পূর্বে যে সামরিক রীতি-নীতি নির্ধারণ করিয়াছিলেন, মূল-নীতির দিক দিয়া প্রায় দেড় হাজার বৎসর পরও তাহাতে কিছুমাত্র রদ-বদল হওয়াতো দূরের কথা, তাহাতে কিছু পরিবর্ধন করাও আজ পর্যন্ত সম্ভব হয় নাই। আরবদের শানিত তরবারি বিজয় লাভের ব্যাপারে কখনো অপর কাহারো অনুগ্রহভাজন হইতে প্রস্তুত হয় নাই; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও শত্রুপক্ষকে তাহাদেরই স্বগোত্রীয় জাতিসমূহের সহিত সংগ্রামে লিপ্ত করিয়া দেওয়া সমর কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি বলিয়া হযরত উমর (রা) বিশেষ কৃতিত্ব সহকারেই এই রণকৌশল কার্যকর করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ফলে অনারব, রোমান ও গ্রীক জাতির অসংখ্য বীর-যোদ্ধা ইসলামী সৈন্যবাহিনীতে শামিল হইয়া নিজ নিজ জাতির লোকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছেন, ইতিহাসে ইহা চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিব।
ইসলামের প্রচারের কাজ
হযরত উমর ফারুক (রা) ধর্ম-প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ বিশেষ মনোযোগ সহকারেই সম্পন্ন করিতেন। লোকদিগকে ইসলামে দীক্ষিত করার ব্যাপারে তিনি কখনো তরবারি কিংবা রাষ্ট্র-শক্তি প্রয়োগ করেন নাই; বরং ইসলামী জীবনাদর্শের বৈশিষ্ট্য, ইহার অতুলনীয় সৌন্দর্য এবং অন্তর্নিহিত মর্মস্পর্শী ভাবধারায় মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করিয়াই তিনি লোকদিগকে মুসলিম বানাইতে চেষ্টা করিতেন। তিনি তাঁহার ক্রীতদাসকে ইসলাম কবুল করার আহ্বান জানাইলে উহা গ্রহণ করিতে সে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করে। তখন তিনি বলিলেন ‘লা-ইকরাহা ফিদ্বীন’- ‘দ্বীন ইসলাম কবুল করার ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি করা যাইতে পারে না’।
কাফিরের সহিত সংগ্রাম ক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া শেষবারের তরে ও সর্বশেষ সুযোগ হিসাবে তিনি ইসলাম কবুল করার দাওয়াত পেশ করিয়াছেন। কেননা ঠিক সেই মুহূর্তেও কেহ ইসলাম কবুল করিলে তাদের সহিত যুদ্ধ করা হারাম হইয়া যায়। যুদ্ধ ও রক্তপাত পরিহার করার জন্য ইহা ছিল মুসলমানদের শেষ প্রচেষ্টা। হযরত উমর (রা) সমগ্র মুসলমানকে ইসলামী নৈতিকতার জীবন্ত প্রতীকরূপে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। ফলে যে পথ ও জনপদের উপর হইতেই তাহারা অগ্রসর হইত, সেখানেই তাহাদের নৈতিক-চরিত্র ও মধুর ব্যবহারের প্রভাব প্রতিফলিত হইত এবং সত্য-সন্ধ জনতা তাহাতে মুগ্ধ ও বিমোহিত হইয়া ইসলামে দীক্ষিত হইত। রোমান সম্রাটের রাষ্ট্রদূত ইসলামী সৈন্য-কেন্দ্রে আগমন করিলে সেনাপতির সরল জীবন-যাত্রা, অকপটতা ও উদার ব্যবহার দেখিতে পাইয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন। মিসরের জনৈক প্রভাশালী ব্যক্তি মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যের সাথে লোকমুখে শুনিতে পাইয়া এতদূর মুগ্ধ হন যে, দুই সহস্র জনতাসহ অনতিবিলম্বে ইসলাম কবুল করেন।
ইসলাম প্রচারের পর সর্বাপেক্ষা জরুরী কাজ ছিল স্বয়ং মুসলমানদিগকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তোলা ও ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির বাস্তব প্রতিষ্ঠা করা। এই পর্যায়ে হযরত উমর (রা)-এর প্রচেষ্টা প্রথম খলীফার আমল হইতেই বিশেষভাবে শুরু হইয়াছিল। ইসলামের উৎস ও একমাত্র মূলসূত্র কুরআন মজীদ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার মূলে উমর ফারুক (রা)-এর প্রচেষ্টা সর্বজনবিদিত। খলীফা হইয়া তিনি পূর্ণ শক্তিতে উহার ব্যাপক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। এই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত শিক্ষকদিগের জন্য সম্মানজনক বেতন নির্ধারণ করা হয়। সিরিয়ার কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবিকে কুরআন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। কুরআন মজীদকে পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নির্ভুলরূপে অধ্যয়ন করার জন্য চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে কুরআন চর্চা শুরু হইয়া যায়।
ইসলামী জীবন-ব্যবস্থায় কুরআনের পরই হইতেছে হাদীসের স্থান। হাদীসের খেদমত করার ব্যাপারেও হযরত উমর ফারুক (রা)-এর আন্তরিক প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না। তিনি নবী করীম (স)-এর বহু সংখ্যক হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া প্রদেশসমূহের শাসনকর্তাদের নামে পাঠাইয়াছিলেন এবং সাধারণ্যে তাহা প্রচার করার নির্দেশ দিয়াছিলেন। ইহা ছাড়া বিভিন্ন সাহাবীকে হাদীস শিক্ষাদানের জন্য কুফা,বসরা ও সিরিয়া প্রভৃতি এলাকায় তিনি প্রেরণ করিয়াছিলেন।
হযরত উমর ফারুক (রা) অবশ্য হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। কেননা মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে সকল সাহাবীই বিশস্ত ও নির্ভরযোগ্য হইলেও তাঁহারা কেহই মানবীয় বৈশিষ্ট্য ও গুনাগুণের ঊর্ধ্বে ছিলেন না, একথা তিনি খুব ভালো করিয়া জানিতেন। এই কারণে তিনি বেশী পরিমাণে হাদীস বর্ণনা করা সম্পর্কে লোকদিগকে বিশেষভাবে সতর্ক করিয়া দেন এবং লোকেরা যাহাতে প্রথমেই কুরআনের দিকে লক্ষ্য আরোপ করে এবং ইহার পর হাদীস গ্রহন করে, সেজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকেই সতর্ক করিয়া দেন।
হাদীসের পরই হইতেছে ফিকাহর স্থান। খলীফা উমর (রা) নিজেই বিভিন্ন খোতবা প্রসঙ্গে ফিকাহর মসলা-মাসায়েল বর্ণনা করিতেন এবং দূরবর্তী স্থানের শাসকদের নামেও ফিকাহর জরুরী মুসলাসমূহ সময় সময় লিখিয়া পাঠাইতেন। যে সব বিষয়ে মতবৈষম্যের সৃষ্টি হইত, তাহা সাহাবীদের প্রকাশ্য মজলিসে তিনি পেশ করিতেন ও যথাসম্ভব সর্বসম্মতভাবে মিমাংসা করিয়া লইতেন। জিলার পদস্থ কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে লোকদের ইসলামী বিধান ও আইন-কানুন সম্পর্কিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দিকে তিনি বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন এবং সমগ্র মুসলিম জাহানে ইসলামী আইনের ব্যাপক প্রচারের জন্য ফিকাহবিদগণকে উচ্চমানের বেতনে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। সংক্ষেপ কথা এই যে, দ্বিতীয় খলীফার শাসন আমলে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক শিক্ষা ও প্রচারের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। দ্বিতীয় খলীফার আমলে সমগ্র এলাকায় মসজিদ নির্মাণ এবং তাহাতে ইমাম মুহাযযিন নিযুক্ত করা হয়। লোকদের সুবিধার্থে হেরেম শরীফ অধিক প্রশস্ত করিয়া দেওয়া হয়। মসজিদে নববীকেও অনেক বড় করিয়া তৈয়ার করা হয়। তিনি প্রত্যেক বৎসরই নিজে হজ্জে গমন করিতেন ও হাজীদের যাবতীয় সুখ-সুবিধা বিধানের দিকে নিজেই লক্ষ্য রাখিতেন।
সাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজ
১৮ হিজরীতে আরবদেশে যখন সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন হযরত উমর (রা) গভীরভাবে উদ্বিগ্ন,সন্ত্রস্ত ও বিচলিত হইয়া পড়েন। তিনি নিজে এই সময় সকল প্রকার সুখ-সম্ভোগ, আরাম-আয়েশ ও চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য পেয়র স্বাদ আস্বাদন পরিহার করেন। তাঁহার নিজের পুত্রকে ফল খাইতে দেখিয়া খলীফা ক্রুদ্ধঃহইয়া বলিলেনঃ ‘সমগ্র দেশবাসী বুভুক্ষু, ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছে আর তুমি সুমিষ্ট ও পুষ্টিকর ফলের স্বাদ গ্রহন করিতেছ? এই সময় জনগণের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করার জন্য তিনি যে প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছেন,ইতিহাসে তাহা চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। এই সময় বায়তুলমালের সমস্ত ধন-সম্পদ তিনি অকুণ্ঠিত চিত্তে ব্যয় করেন এবং চারিদকে হইতে খাদ্য আমদানী করিয়া দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িতদের মধ্যে বণ্টন করেন। তিনি লা-ওয়ারিস শিশুদিগকে দুগ্ধ-পান ও লালন-পালন করার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেন এবং গরীব-মিসকীনদের জন্য জীবিকার সংস্থান করেন। তবে তাহার এই ব্যবস্থা সাধারণভাবে সকল গরীব ও মিসকীনদের জন্য ছিল না, বিশেষভাবে যাহারা উপার্জনে অক্ষম ছিল, তাহাদের জন্যই ছিল এই ব্যবস্থা।
হযরত উমর (রা)-এর আশ্চার্যজনক কর্মনীতি এই ছিলে যে, তিনি আঙ্গুর ফসলের উপর অতিরিক্ত কর ধার্য করিতেন এই জন্য যে, তাহা ছিল তখনকার যুগে একমাত্র ধনীদের খাদ্য আর খেজুরের উপর অপেক্ষাকৃত কম কর ধার্য করিতেন; কেননা তাহা ছিল অপেক্ষাকৃত গরীব ও সাধারণ জনগণের খাদ্য।
দেশের দূরবর্তী এলাকাসমূহের আভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি অবস্থা সম্পর্কেও হযরত উমর (রা) বিশেষভাবে অবহিত থাকিতেন এবং কোন কিছুই তাঁহার অজ্ঞাত ও দৃষ্টির অগোচর থাকিতে পারিত না। এমন কি, লোকদের পারিবারিক জীবনের বদ্ধ পরিবেশেও কোন প্রকার শরিয়াত-বিরোধী অনাচারের সৃষ্টি হইলে অথবা কেহ অভাব-দারিদ্রের নিষ্ঠুর আঘাতে জর্জরিত হইয়া থাকিলে তাহাও খলীফা উমর ফারুক (রা)-এর অজ্ঞাত থাকিয়া যাইত না। এইজন্য তিনি সমগ্র দেশে রিপোর্টার ও বিবরণকারী লোক নিযুক্ত করেন। ঐতিহাসিক তাবারী লিখিয়াছেনঃ
******(আরবী)
উমর ফারুক (রা) কোন বিষয়েই অনবহিত থাকিতেন না। ইরাকে যাহারা বিদ্রোহ করিয়াছিল এবং সিরিয়ায় যাহাদিগকে পুরস্কৃত করা হইয়াছিল, সেইসব কিছুর বিস্তৃত বিবরণ তাঁহাকে লিখিয়া পাঠান হইয়াছিল।
হযরত উমর (রা)-এর গোয়েন্দা বিভাগ এক শাসনকর্তা গোপন বিলাস জীবনের বিবরণ তাহার এক পত্রের মাধ্যমে জানিতে পারে। খলীফা এই বিষয়ে অবহিত হইয়া তাহাকে পদচ্যুত করেন এবং লেখেন যে, তোমার বর্তমান জীবন ধারণ আমি সহ্য করিতে পারি না।
বিচার ইনসাফ
ফারুকী খিলাফতের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দিক তাঁহার নিরপেক্ষ, সুবিচার ও পক্ষপাতহীন ইনসাফ। তাঁহার শাসন আমলে এক বিন্দু পরিমাণ না-ইনসাফীও অনুষ্ঠিত হইতে পারিত না।
ফারুকে আযম (রা)-এর এই ঐতিহাসিক বিচার-ইনসাফ কেবল মুসলমান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁহার সুবিচারের দ্বার ইয়াহুদী,খৃস্টান,মাজুসী প্রভৃতি অমুসলিম নাগরিকদের জন্যও অবারিত ও চির-উন্মুক্ত ছিল। হযরত উমর (রা) জনৈক অমুসলিম বৃদ্ধ ব্যক্তিকে ভিক্ষা করিতে দেখিয়া ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে উত্তরে সে বলিলঃ ‘আমার উপর ‘জিজিয়া’ ধার্য করা হইয়াছে, অথচ আমি একজন গরীব মানুষ’। হযরত উমর (রা) তাহাকে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন ও কিছু নগদ সাহায্য করিলেন এবং বায়তুলমালের ভারপ্রাপ্তকে লিখিলেনঃ ‘এই ধরণের আরও যত ‘যিম্মী’ গরীব লোক রহিয়াছে, তাহাদের সকলের জন্য বৃত্তি নির্দিষ্ট করিয়া দাও। আল্লাহ্র কসম, ইহাদের যৌবনকাল কাজ আদায় করিয়া বার্ধক্যে ইহাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা কিছুতেই ইনসাফ হইতে পারে না’। বস্তুত দুনিয়ার মানুষের দুঃখ মোচনের জন্য উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত চিরদিনের জন্য এক উজ্জ্বল আদর্শ।