খিলাফতে রাশেদা
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর ইন্তেকালের পর যে চারজন প্রধান সাহাবী ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করিয়াছেন, ইতিহাসে তাহাদিগকেই “খুলাফায়ে রাশেদুন”নামে অভিহিত করা হয় এবং তাঁহাদের পরিচালিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকেই বলা হয় “খিলাফতে রাশেদা”। ‘খুলাফায়ে রাশেদুনে’র শাসন দীর্ঘকাল স্থায়ী না থাকিলেও বিশ্বের ইতিহাসে তাহা সর্বাধিক মর্যাদা লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে। শুধু মুসলিম ঐতিহাসিকগণই নহেন,অমুসলিম-এমন কিন মুসলিম-দুশমন ঐতিহাসিকগণও –খুলাফায়ে রাশেদুনের শাসন আমল্কে মানব-ইতিহাসের ‘স্বর্ণ-যুগ’ বলিয়া শ্রদ্ধা জানাইতে বাধ্য হইয়াছেন। বর্তমান পর্যায়ে আমরা ‘খিলাফতে রাশেদার’ বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য ও বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে আলোচনা করিব।
খিলাফত
‘খিলাফত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘প্রতিনিধিত্ব’।ইহার ব্যবহারিক অর্থ, ‘অন্য কাহারো অপসৃত হওয়ার পর তাহার স্থানে উপবেশন করা’। এই শব্দটি স্বতঃই এই কথা প্রমাণ করা যে,উহাই আসল নয়, আসলের প্রতীক মাত্র;কায়া নয় ছায়া,দর্পণের প্রতিবিম্ব।অন্য কথায় মূল পদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ারই নাম খিলাফত। ‘ইমাম’ শব্দও এই অর্থেই ব্যবহৃত হয় এবং ‘খলীফা’ ও ‘ইমাম’ এই শব্দদ্বয় একই ব্যক্তির দুইটি স্বতন্ত্র দিককে প্রকাশ করে। পূর্ববর্তী দায়িত্বশীলের প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দিক দিয়া সে খলীফা এবং সমসাময়িক যুগের জনগণের অনুসরণীয় ও সর্বাধিক গণ্যমান্য হওয়ার কারনে সে ‘ইমাম’ ও ‘নেতা’।বস্তুতঃ পয়গম্বরের স্থলাভিষিক্ত হওয়া এবং তাঁহার অন্তর্ধানের পর গোটা উম্মতের নেতৃত্ব দানকেই বলা হয় ‘খিলাফত’ ও ‘ইমামত’। নবী করীম(স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ “তোমাদের পূর্বে বনী ইসরাইল গোত্রের নবী ও পয়গম্বরগণই নেতৃত্ব দান ও রাষ্ট্র পরিচালনা করিতেন;এক পয়গম্বরের অন্তর্ধানের পর আর এক পয়গম্বর আসিয়া তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইতেন। কিন্তু এখন(আমার পর) নবুয়্যাতির ক্রমিকধারা সম্পূর্ণ হইয়াছে(এখন আর কেহ নবী বা রাসূল হইবে না)।অতঃপর তোমাদের মধ্য হইতে খলিফাগণই অগ্রগামী হইবে”।
এই হাদিস হইতে এ কথা পরিস্ফুটিত হইয়া উঠে যে, পয়গম্বরীর প্রতিনিধিত্ব করাকেই খিলাফত বলা হয় এবং ইসলামে নবুয়্যাতের পর ইহাই সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন,শ্রদ্ধাভাজন ও পবিত্র দায়িত্বপূর্ণ পদ। এইজন্য ইসলামের ‘খলিফা’গন কুরআন ও সুন্নাতের মূলকে ভিত্তি করিয়া রাষ্ট্র পরিচালনা ও মানব-সমস্যার সমাধানের জন্য যেসব বিধান ও নির্দেশ দান করেন, তাহা অবশ্যই সর্বজনমান্য হইবে। রাসূলে করীম (স) পূর্বাহ্ণেই একথা ঘোষণা করিয়াছেনঃ ‘আমার পর আমার ‘হেদায়েতপ্রাপ্ত’ খলিফাগণকে মানিয়া চলিবে’। এই কারণেই খলীফা নির্বাচন করার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও শাসনতান্ত্রিক জজ্ঞতা-দক্ষতার দিকে যত-না দৃষ্টি দেওয়া উচিত,তদপেক্ষা অধিক লক্ষ্য আরোপ করিতে হইবে নবীর সংস্পর্শে(কিংবা নবীর অবর্তমানে তাঁহার আদর্শ অনুসরণে) তিনি নিজেকে কতখানি পরিশুদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছেন এবং তাঁহার আধ্যাত্মিক জ্ঞান-বিদ্যা ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য কতটুকু আছে,সেই দিকে। হযরত আবূ বকর সিদ্দিক,হযরত উমর ফারুক,হযরত উসমান গনী ও হযরত আলী মুরতাজা(রা)-এই চারজনকে পর্যায়ক্রমে খলীফার পদে নির্বাচন করায় উপরোক্ত নীতির নিগূঢ় তাৎপর্য ও যথার্থতা সুপরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।
বস্তুতঃইসলামে খিলাফতের দায়িত্ব কর্তব্য অত্যন্ত ব্যাপক ও সর্বাত্মক। যাবতীয় বৈষয়িক,ধর্মীয় ও তামাদ্দুনিক লক্ষ্য উহারই মাধ্যমে অর্জিত হইয়া থাকে।পয়গম্বরের আরব্ধ কার্যাবলীকে সচল ও প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং সকল প্রকার সংমিশ্রণ হইতে উহার সংরক্ষণ ও উৎকর্ষ সাধন করা-এই সংক্ষিপ্ত বাক্য দ্বারাই খিলাফতের দায়িত্ব মোটামুটিভাবে ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে।আর একটিমাত্র যুক্ত শব্দ দ্বারা ইহা বুঝাইতে হইলে বলা যায়-‘ইক্কামতে দ্বীন’।এই শব্দটিও এত ব্যাপক অর্থবোধক যে,দ্বীন ও দুনিয়ার সব রকমের কাজই উহার মধ্যে শামিল হইয়া যায়। নামায-রোযা,হজ্জ-যাকাত,আইন-কানুন,শাসন-শৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও প্রচলন-এক কথায় সমস্ত তামাদ্দুনিক ও আধ্যাত্মিক কাজ সম্পাদনই খিলাফতের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। নবী করীম(স)-এর পবিত্র জীবন এই সব মহান দায়িত্ব সম্পাদনেই অতিবাহিত হইয়াছে। তাঁহার পর যাঁহারা তাঁহার প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হইয়াছেন,তাঁহারা নিজেদের সমগ্র জীবন এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্নই সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করিয়াছেন।নবী করিম(স)-এর জীবনকাল হইতেই এইসব কাজে বিভিন্ন লোক জিম্মাদার হিসাবে নিযুক্ত ছিল। নামাযের ইমামতি করার জন্য,সাদকা ও যাকাত আদায় করার জন্য আলাদাভাবে লোক নিয়োগ করা হইয়াছিল। অন্যায় কাজের প্রতিরোধ ও ন্যায় কাজের প্রচার প্রসার এবং জনগণের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের নিরপেক্ষ বিচার ও ফয়সালার কাজ যোগ্যতাসম্পন্ন লোক দ্বারা সমাধা করা হইত।শত্রুর সহিত মোকাবিলা ও হইত। শত্রুর সহিত মোকাবিলা ও সৈন্য পরিচালনা এবং কুরআন শরীফ শিক্ষাদানের দায়িত্ব স্বতন্ত্র লোকের উপর অর্পিত ছিল। কিন্তু যেহেতু এই যেহেতু এই সমস্ত কাজই খিলাফতের মূল দায়িত্বের মধ্যে শামিল, সেইজন্য স্বতন্ত্রভাবে এইসব দায়িত্ব পালনের উপযোগী যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য সবই এককভাবে এক খলীফার মধ্যে বর্তমান থাকা একান্তই আবশ্যকীয় ছিল। শুধু তাহাই নয়,আধ্যাত্মিক গুন-বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া খলীফার মধ্যে নবীসুলভ শিক্ষা ও প্রজ্ঞা বলিষ্ঠভাবে বর্তমান থাকা জরুরী এবং নবী যাহাদের মধ্যে এই ধরনের আধ্যাত্মিক দক্ষতা দেখিতে পান, তাহাদিগকেই নিজের স্থলাভিষিক্ত করার কথা জীবিতাবয়স্থায়ই ইশারা-ইঙ্গিতে প্রকাশ করিয়া যান।অবশ্য অনাকাঙ্ক্ষিত বিশৃঙ্খলা,রক্তপাত ও অবস্থার পরিবর্তন খিলাফতের মূল লক্ষ্যকে চল্লিশ বৎসর পরই ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে এবং উহার কর্তৃত্বভার এমন সব লোকের হস্তে অর্পিত হইয়াছে,যাহারা কোন দিক দিয়াই এই গুরুত্বপূর্ণ পদের যোগ্য ছিল না, একথা অবশ্যই স্বীকার্য। কিন্তু বিশ্বনবীর হেদায়েত অনুযায়ী পরবর্তী খলীফা ও শাসকদের নির্বাচন করা হইলে মানব সমাজের চেহারা সর্বতোভাবে ভিন্ন রকমের হইত,তাহাতে সন্দেহ নাই।
কুরআন ও হাদীস হইতে খলীফার যোগ্যতা-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যাহা কিছু জানা যায়, উহার দৃষ্টিতে যাচাই করিলে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ‘খুলাফায়ে রাশেদুন’ই ছিলেন মুসলিম জাহানের খলীফা হওয়ার সর্বাধিক উপযোগী। কুরআন হাদীসের বর্ণিত গুন-বৈশিষ্ট্য তাঁহাদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় মওজুদ ছিল এবং সেই কারনে তাঁহারা খিলাফতকে সুষ্ঠু নীতিতে পরিচালিত করিতে পারিবে বলিয়া জনমনে পূর্ণ আস্থা বিদ্যমান ছিল।খিলাফতে রাশেদার দায়িত্ব পালনের জন্য কুরআনের দৃষ্টিতে নিম্নলিখিত গুন-বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য মনে করা হইয়াছে। অতএব,নবী করীম(স)-এর পরে যাহাদের মধ্যেই এই গুণাবলী পরিস্ফুট হইবে,তাহারাই সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য হইবে।
(১)খলীফাকে প্রথম পর্যায়ের ‘মুহাজির’ হইতে হইবে এবং হোদাইবিয়ার সন্ধি,বদর ও তবুক যুদ্ধে শরীক ও সূরায়ে নূর অবতীর্ণ হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন-এমন হইতে হইবে;
(২)বেহেশতবাসি হইবার সুসংবাদপ্রাপ্তদের মধ্যে গণ্য হইতে হইবে;
(৩)সিদ্দীক,শহীদ প্রভৃতি ইসলামী সমাজের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের মধ্যে গণ্য হইতে হইবে।
(৪)নবী করীম(স)-এর কোন ব্যাবহার, কাজ বা কথা দ্বারা একথা প্রমাণিত হইতে হইবে যে,তিনি নিজে কাহাকেও খলীফা নিযুক্ত করিলে তাহাকেই নিযুক্ত করিতেন।
(৫)আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলের নিকট যেসব ওয়াদা করিয়াছেন, তাহা তাঁহার সত্তা দ্বারা বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব হইতে হইবে।
(৬)তাঁহার কথা ইসলামী শরীয়াতে প্রমাণিত হইতে হইবে।
এই গুণাবলির বিচ্ছিন্নভাবে অসংখ্য সাহাবীর মধ্যে বর্তমান ছিল; কিন্তু এইগুলির পূর্ণ সমন্বয় ঘটিয়াছিল মাত্র চারজন সাহাবীর মধ্যে।ইঁহারা প্রথম পর্যায়ের মুহাজির ছিলেন,হোদাইবিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় ইঁহারা উপস্থিত ছিলেন;বদর,ওহোদ,তবুক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ-সংগ্রামে ইঁহারা ছিলেন অগ্রবর্তী।এইভাবে খিলাফতের যোগ্যতার জন্য অপরিহার্য গুণাবলির মধ্যে কোন একটি হইতেও ইঁহারা বঞ্চিত ছিলেন না। উপরন্তু ইঁহাদের প্রত্যেকেই সম্পর্কেই রাসূলে করীম(স)-এর সুস্পষ্ট মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে।হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) সম্পর্কে নবী করীম (স)বলিয়াছেনঃ ‘আমার উম্মাতের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশ করিবে। ‘হাওযে-কাওসারে’ তুমিই হইবে আমার সঙ্গী;কেননা পর্বত গহ্বরে তুমিই আমার সাথী ছিলে’। হযরত উমর(রা) সম্পর্কে নবী করীম(স)-এর এই উক্তি বর্ণিত হইয়াছেঃ ‘উমরের কামনায়ই অসংখ্য আয়াত নাজিল হইয়াছে’।হযরত উস্মান(রা) সম্পর্কে রাসূল (স) বলিয়াছেনঃ ‘ফিরেশতাও যাহাকে সম্মান-শ্রদ্ধা জানায়,আমি কি তাঁহাকে সম্মান না জানাইয়া পারি?’ আরও বলিয়াছেনঃ ‘প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে,বেহেশতে উসমান হইবে আমার বন্ধু’।হযরত আলী(রা) সম্পর্কে নবী করীম(স)ইরশাদ করিয়াছেনঃ ‘তোমার সঙ্গে আমার হারুন ও মূসার ন্যায় সম্পর্ক স্থাপিত হউক, ইহা কি তুমি চাও না?আল্লাহ্ ও রাসূল যাহার প্রিয়পাত্র, আমি আগামীকাল তাঁহার হস্তেই ঝাণ্ডা তুলিয়া দিব’। এতব্দ্যতীত নবী করীম (স) ইহাদের গুণ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরো অনেক মূল্যবান কথাই বলিয়াছেন।সেইসব কথা দ্বারা একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে,হযরতের দৃষ্টিতে তাঁহার অন্তর্ধানের পর ইঁহারাই ছিলেন খিলাফতের পদে নির্বাচিত হইবার সর্বাধিক উপযুক্ত এবং অধিকারী।
খিলাফতের মৌল আদর্শ
খিলাফত সম্পর্কিত আলোচনাকে গভীর ও ব্যাপকভাবে অনুধাবন করার জন্য উহার রাষ্ট্র-রূপকে যাচাই করা অত্যন্ত জরুরী। এই ব্যাপারে সর্বপ্রথম নেক চরিত্রবিশিষ্ট লোকদের প্রতিই এই ওয়াদা ঘোষিত হইয়াছে। তাই রাষ্ট্রের প্রতিটি(মুসলিম) নাগরিকই খলীফা মর্যাদাসম্পন্ন এবং খিলাফতের দায়িত্ব পালনের সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র ব্যাক্তিগত চরিত্র,মানবীয় গুন-বৈশিষ্ট্য ও তাকওয়ার-পরহেজগারীর ভিত্তিতেই মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা যাইবে।
তৃতীয়তঃ মানবতার ইতিহাসে যখনি আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে কোন খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেখানেই সমাজের মধ্য হইতে কেবলমাত্র সর্বাধিক নেক ও পরহেজগার এবং উন্নত-আদর্শ চরিত্রবান লোকেরাই খলীফা হওয়ার-রাষ্ট্র পরিচালনা করার সুযোগ লাভ করিয়াছে। আর সাধারণ জনতা আল্লাহ্র দেওয়া মৌলিক অধিকার পূর্ণ ইনসাফ ও নিরপেক্ষভাবে ভোগ করিতে পারিয়াছে। কাহারও ক্ষেত্রে সেই অধিকারের এক বিন্দু হরণ করা কিংবা সংকুচিত করা হয় নাই,কাহারো স্বাভাবিক কর্মপথে বিন্দুমাত্র প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি করা হয় নাই;বরং প্রত্যেকের স্বাভাবিক ক্ষমতা ও প্রতিভাকে আল্লাহ্র আইনসম্মত পন্থায় উৎকর্ষ ও ক্রমবিকাশ লাভের সুযোগ করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক বাক্তিই আল্লাহ্র নিকট জওয়াবদিহি করিতে বাধ্য। এই ব্যাপারে কাহাকেও অতি-মানবের আসনে বসাইয়া আল্লাহ্র সহিত শরীক করা যাইতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান,খলীফা বা ‘আমিরুল মু’মিনীন’ পদে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে প্রত্যেক মুসলিম নাগরিকেরই সমান অধিকার রহিয়াছে। এক্ষেত্রে পদপ্রার্থী হওয়ার কিংবা পদলাভের জন্য চেষ্টা করার অধিকার যেমন কাহারো নাই, তেমনি নাগরিকদের অবাধ সম্মতিতে নির্বাচিত হইলে দায়িত্ব পালনেও সকলেই বাধ্য। খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁহার মর্যাদায় শুধু এতটুকু পার্থক্য ঘটে যে,জনগন নিজ নিজ খিলাফতের মর্যাদা ও অধিকার তাঁহার হস্তে অর্পণ করিয়াছে মাত্র।কেবল সে-ই খলীফা, অন্য কেহ খলীফা নয়, ইসলামী আদর্শবাদের দৃষ্টিতে একথা কিছুমাত্র সত্য নয়। খিলাফতের শক্তি নাগরিকদের সামাজিক ও সামগ্রিক নিয়ম-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও অপরিহার্য আইন-কানুন জারিকরণের দায়িত্ব পালনে সর্বতোভাবে নিয়োজিত থাকে। এই শক্তির সংহতি বিধান ও ইহাকে সুনিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য ইহা সাধারনের নির্বাচিত ও সর্বাধিক যোগ্যতম ব্যক্তির সত্তায় কেন্দ্রিভূত হওয়া আবশ্যক।
খলীফা বা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের সময় ব্যক্তির জ্ঞান-বুদ্ধি, শিক্ষা-দীক্ষা,মন-মানস,বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক-যোগ্যতাই শুধু দেখিলে চলিবে না, তাহার চরিত্র কত পবিত্র,নির্ভরযোগ্য ও আস্থাভাজন,বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তাহাও লক্ষ্য করিতে হইবে।
ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা খলীফাকে ‘মাসুম’ বা নিস্পাপ ঘোষণা করে নাই।খলীফাকে নিস্পাপ ও নির্ভুল মনে করিয়া লওয়ারও কোন যুক্তি নাই। প্রতিটি মুসলিমই তাহার কেবল সরকারী দায়িত্ব পালন ও কার্য সম্পাদন সম্পর্কেই নহে,তাহার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন-ধারারও সমালোচনা করিতে পারে।আইনের দৃষ্টিতে তাহার মর্যাদাও হইবে সাধারণ নাগরিকের সমান।আদালতে তাহার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করা যাইতে পারে এবং সে সাধারণ নাগরিকদের মতই বিচারকের সম্মুখে হাযির হইতে বাধ্য। সেখানে তাহাকে তথায় কোন প্রকার বিশিষ্টতা দান করা হইবে না।
খলীফার প্রতি আল্লাহ্র কোন অহি নাজিল হয় না; সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা-বাস্তবায়নের ব্যাপারে সে কোন বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার দাবি করিতে পারে না।
খলীফা কেবল নিজস্ব মত অনুসারেই কার্য সম্পাদন করিতে পারে না,জনসমর্থিত ও যোগ্য-সুদক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত মজলিসে শূরা’র(Parliament) সহিত পরামর্শ করিয়াই তাহাকে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করিতে হইবে। মজলিসে শূরার সংখ্যাগরিষ্ঠ মত অনুসারেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করিতে হয়,এ কথা ঠিক;কিন্তু তাহা সত্ত্বেও সংখ্যাধিক্য খিলাফতী শাসন-ব্যবস্থায় ভাল-মন্দবা করনীয়-বর্জনীয় নির্ধারণের কোন স্থায়ী মানদণ্ড নহে। তাই খলীফা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে সংখ্যাগুরুর ফয়সালার সহিতও দ্বিমত পোষণ করিতে পারে এবং সে কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে যাহা সত্য বলিয়া প্রত্যয় করিবে,তদনুযায়ী কাজও করিতে পারে।অবশ্য এই সমগ্র ক্ষেত্রেই মুসলিম জনতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিবেঃখলীফা সামগ্রিকভাবে কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে কাজ করে, না নিজস্ব খেয়ালখুশী অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে।দ্বিতীয় অবস্থার খলীফা ইসলামী জনতার নিকট হইতে একবিন্দু আনুগত্য পাইবার অধিকার রাখে না,বরং তাহার পদচ্যুতির ব্যবস্থা করাই তাহাদের কর্তব্য হইয়া পড়ে। এইদিক দিয়াও পাশ্চাত্য রাষ্ট্রদর্শন ও শাসনতন্ত্রের সহিত ইসলামী রাষ্ট্রদর্শন ও খিলাফতী গণ-অধিকারবাদের মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য সুস্পষ্ট।
খুলাফায়ে রাশেদুন
ইতিহাসের যে পর্যায়টি হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের(রা) খিলাফত হইতে শুরু করিয়া হযরত আলী(রা) পর্যন্ত বিস্তৃত, ইতিহাসে তাহাই হইতাছে ‘খিলাফতে রাশেদা’র যুগ। আর ৬৩২ ঈসায়ী(১১ হিজরী) হইতে ৬৬১ ঈসায়ী (৪০ হিজরী) পর্যন্ত মুসলিম জাহানের যাঁহার রাষ্ট্রনেতা ছিনেল,তাহাদিগকেই ‘খুলাফায়ে রাশেদুন’ বলিয়া অভিহিত করা হয়।ইঁহাদের মোট সংখ্যা চার এবং ইঁহাদের খিলাফত কালের মোট মুদ্দৎ ত্রিশ বৎসর মাত্র।(অবশ্য উমার ইবনে আব্দুল আজীজ (র)ও ইসলামী খিলাফতের নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচিত ও দায়িত্ব পালনে সক্ষম হওয়ায় তিনিও ‘খুলাফায়ে রাশেদ’ রূপে গণ্য)
নবী করীম (স) যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত নবুয়্যাত,আইন প্রণয়ন,সর্ব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দান,বিচার বিভাগ ও সৈন্য বাহিনী পরিচালনা এবং দেওয়ানী সরকারের যাবতীয় দায়িত্বপূর্ণ পদ হযরতের একক ব্যক্তিসত্তায় কেন্দ্রীভূত ছিল; তিনি একাই এই সমস্ত কাজের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব করিতেন।তাঁহার ইন্তিকালের পর তাঁহার স্থলাভিষিক্ত কে হইবে, এই প্রশ্ন ইসলামী জনতার সম্মুখে অত্যন্ত প্রকট হইয়া দেখা দেয়।যেহেতু নবুয়্যাতের সমাপ্তি হইয়া গিয়াছে-অতঃপর কেহই নবী হইবেন না; কিন্তু রাসূলের স্থলাভিষিক্ত যে হইবে তাহাকে এই নবুয়্যাত ছাড়া ও নবুয়্যাত ব্যতিত আর সমস্ত দায়িত্বই পূর্বানুরুপ আঞ্জাম দিতে হইবে-এই কারনেও এই প্রশ্ন অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব সহকারে নেতৃস্থানীয় ভাবিত ও বিব্রত করিয়া তোলে।নবী করীম(স)-এর নবুয়্যাত ও স্বভাব সুলভ নেতৃপদের উত্তরাধিকারী কেহই হইতে পারে না।অন্যদিকে তাঁহার কোন পুত্র-সন্তানও জীবিত ছিলনা।থাকিলেও তাহাতে খলীফা নির্বাচন সমস্যার কোন সমাধানই হইতে পারিত না। কাজেই এই দুইটি প্রশ্ন জটিলভাবে মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছিলঃ
১-খলীফা কোন পরিবার বা গোত্র হইতে হইবে?
২-খলীফা নিয়োগের পন্থা কি হইবে?
কুরআন মজীদের কোথাও খিলাফতকে কোন বংশ বা গোত্রের জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয় নাই। হাদীসে যেখানে *****(আরবী)- ‘নেতা বা খলীফা কোরাইশদের মধ্য হইতে নিযুক্ত করিতে হইবে’ বলিয়া উল্লেখ পাওয়া যায়,সেখানেও স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ রহিয়াছেঃ
‘তোমাদের উপর কোন হাবশী গোলামও শাসক নিযুক্ত হইলে তোমারা তাহার অবশ্যই আনুগত্য করিবে’। কাজেই এতদুভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পন্থা অনুসন্ধান করা আবশ্যক। একটু গভীর ও সুক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করলেই বুঝিতে পারা যায় যে,মূলতঃএই দুইটি হাদিসই সত্য ও বাস্তব তত্ত্ব-ভিত্তিক ঘোষণা।ইসলামে খিলাফতকে কোন বংশ-গোত্র পরিবার কিংবা কোন ব্যক্তি বা শ্রেণীর জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয় নাই, এ-কথা চিরন্তন সত্য। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সকল সময় ও অবস্থায়ই এই মূলনীতি অনুযায়ী কাজ হইতে হইবে,ইহাতে সন্দেহ নাই;কিন্তু নবী করীম (স)যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, তাহাঁরই অব্যবহিত পড়ে উহার দায়িত্বভার পালনের জন্য কুরাইশ বংশের লোক অপেক্ষা অপর কোন বংশের লোক যে কিছুমাত্র যোগ্য বা দক্ষতাসম্পন্ন ছিল না, তাহাও এক অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য।খিলাফতে রাশেদার ও ইহার পরবর্তী কালের ইতিহাসই এই কথার সত্যতা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে।কাজেই খিলাফতে রাশেদার চারজন খলীফাই কুরাইশ বংশের লোকদের মধ্য হইতে নির্বাচিত হওয়া সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত হইয়াছে। কেননা তাহা না হইলে তদানীন্তন আরব-সমাজের মধ্য হইতে বিশেষ যোগ্যতা ও দক্ষতা সহকারে খিলাফতের দায়িত্ব পালন করা অপর কাহারো পক্ষেই সম্ভব হইত না। কিন্তু ইহা কোন চিরন্তন ও শাশ্বত নিয়ম নহে; ‘খিলাফতে রাশেদা’র পরও খলীফার কুরাইশ বংশোদ্ভূত হওয়ার কোন শর্তই ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় স্বীকৃত নয়।১ {বলা বাহুল্য, ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও এই ধরনের কোন শর্তের কথা উল্লেখ করেন নাই।}
খলীফা নির্বাচনের বাস্তব ও সুস্পষ্ট কোন পদ্ধতি কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত হয় নাই।মনে হয়,সেজন্য কোন বিশেষ পন্থাকে স্থায়ীভাবে স্বীকার করিয়া লওয়া এবং যুগ-কাল-স্থান-নির্বিশেষ সর্বত্র উহার অনুসরণকেই গোটা উম্মতের উপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপাইয়া দেওয়া ইসলামের শাশ্বত বিধানের লক্ষ্য নয়। এই জন্য নির্বাচনের কোন বিশেষ পদ্ধতির(Form or Process) পরিবর্তে একটি শাশ্বত মূলনীতি পেশ করা হইয়াছে।বলা হইয়াছেঃ*****(আরবী) “ইসলামী আদর্শবাদীগণ নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে সম্পন্ন করিয়া থাকে’। আর রাষ্ট্রপ্রধান বা খলীফা নির্বাচনই যে মুসলিম সমাজে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও সামষ্ঠিক ব্যাপার এবং মুসলিম জনতার অবাধ রায় ও পরামর্শের ভিত্তিতেই যে ইহা সুসম্পন্ন হওয়া উচিত,তাহাতে কাহারো দ্বিমত থাকিতে পারে না। অতএব, জনমতের ভিত্তিতে খলীফা নির্বাচন করিতে হইবে- ইহাই হইল ইসলামী নির্বাচনের একমাত্র মূলনীতি। এই নীতিকে মুসলিম উম্মত বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে প্রয়োগ করিয়াছে ও নির্বাচন-সমস্যার সমাধান করিয়া লইয়াছে,এখন তাহাই আমাদের বিচার্য।
খুলাফায়ে রাশেদুনের নির্বাচন
খলীফা নির্বাচনের উপরোল্লেখিত মূলনীতিকে খুলাফায়ে রাশেদুনের নির্বাচনের ব্যাপারে নিম্নলিখিত রূপে প্রয়োগ করা হইয়াছেঃ
(১)নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম উম্মতের দায়িত্বশীল নাগরিকগন ‘সকীফায়ে বনী সায়েদা’ নামক(টাউন হল কিংবা পরিষদ ভবনের সমমর্যাদাসম্পন্ন)স্থানে মিলিত হন এবং প্রকাশ্যভাবে দীর্ঘ ও বিস্তারিত আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে হযরত আবূ বকর(রা)-কে খলীফা নির্বাচিত করেন।উপস্থিত জনতা তখন-তখনি অকুণ্ঠিতভাবে তাঁহার আনুগত্যর শপথ(বায়’আত) গ্রহন করে এবং খলীফা নির্বাচিত হইয়াই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব,কর্তব্য ও নীতি-নির্ধারকমূলক ভাষণ দান করেন।
(২)হযরত উমর ফারুক(রা)-এর নির্বাচনে স্বতন্ত্র পদ্ধতি অবলম্বিত হইয়াছে।প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা) তাঁহার গোটা ইসলামী জিন্দেগী ও খলীফা-জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী তথা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝিতে পারিয়াছেন যে, তাঁহার পর খলীফা হওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি সমগ্র জাতির মধ্যে হযরত উমর(রা)অপেক্ষা দ্বিতীয় কেহ বর্তমান নাই।তাঁহার খিলাফতকালীন যাবতীয় ঘটনা ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ও বেসরকারী কাজে হযরত উমর(রা)নিবিড়ভাবে শরীক ছিলেন;কুরআন মজীদ সঞ্চয়ন ও গ্রন্থাবদ্ধকরণও কেবলমাত্র তাহাঁরই ঐকান্তিক আগ্রহ,চেষ্টা ও পরামর্শে সম্পন্ন হইয়াছিল।হযরত আবূ বকর(রা)নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রধান সাহাবাদের সহিত পরামর্শক্রমে হযরত উমর ফারুক(রা)-কেই পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের জন্য মুসলিম জনতার নিকট সুপারিশ করিয়া গেলেন।মুসলিম জনসাধারন প্রথম খলীফার সুপারিশ ও নিজেদের নিরপেক্ষ ও অকুণ্ঠ রায়ের ভিত্তিতে হযরত উমর(রা) –কেই খলীফা হিসাবে নির্বাচিত করিল ও তাঁহার হস্তে বায়আত গ্রহন করিল।উমর (রা) খলীফা নির্বাচিত হইয়াই তাঁহার পূর্বসূরীর ন্যায় মুসলিম জনতাকে সম্বোধন করিয়া নীতি-নির্ধারণী ভাষণ দান করেন।
(৩)দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর(রা) যখন বুঝিতে পারিলেন যে,তাঁহার জীবন-পাত্র সম্পূর্ণ হইতে চলিয়াছে,তিনি আর বেশিক্ষন বাঁচিয়া থাকিতে পারিবেন না, তখন তিনি নিজের স্থলাভিষিক্ত ও পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। সে জন্য তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পদ্ধতি অবলম্বন করেন।তিনি ছয়জন শ্রেষ্ঠ ও নেতৃস্থানীয় সাহাবীর সমন্বয়ে একটি ‘নির্বাচনী বোর্ড’- আধুনিক পরিভাষায় ‘নির্বাচন কমিশন’-নিযুক্ত করিলেন।অন্যান্যদের ছাড়াও হযরত উসমান ও হযরত আলী(রা)ও এই বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।তাঁহার দৃষ্টিতে এই ছয় জনই খিলাফতের জন্য যোগ্য ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি আদেশ করিলেন যে,তাঁহার অন্তর্ধানের পর তিন দিনের মধ্যেই যেন এই বোর্ড নিজেদের মধ্য হইতে সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকে খলীফা নির্বাচন করে।বোর্ড সুষ্টুরূপে তাহার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে এবং এই ব্যাপারে নিকটবর্তী ও দূরবর্তী মুসলিম নাগরিকদের রায় সংগ্রহ করে।মদীনার প্রতিটি ঘরে উপস্থিত হইয়া পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী লোকদেরও রায় জিজ্ঞাসা করা হয়।দূরাগত ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের নিকটও রায় জিজ্ঞাসা করিতে ত্রুটি করা হয় নাই।এইভাবে ইসলামী নাগরিকদের সর্বাধিক রায় ও আলাপ-আলোচনার পর হযরত উসমান(রা)-কেই তৃতীয় খলীফা পদে নির্বাচিত করা হয়।
(৪)তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান(রা)-এর শাহাদাতের পর মদীনার পরিবেশ ফিতনা-ফাসাদের ঘনঘটায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া পড়ে। মিশর,কুফা ও বসরার বিদ্রোহীগণ মদীনায় প্রবল তাণ্ডবের সৃষ্টি করে।তখন প্রধান সাহাবীদের অধিকাংশই সামরিক ও সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের জন্য রাজধানীর বাহিরে অবস্থান করিতেছিলেন।এই অবস্থায় হযরত উসমান (রা)-এর শাহাদাতের পর ক্রমাগত তিন দিন পর্যন্ত খলীফার পদ শূন্য থাকে।শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর হযরত আলী(রা)-কেই খলীফা নির্বাচিত করা হয়।
এই বিশ্লেষণ হইতে একথা প্রমাণিত হয় যে, খুলাফায়ে রাশেদুনের নিয়োগ ও নির্বাচনের ব্যাপারে একই ধরনের বাহ্যিক পদ্ধতি(Form Of Election)অনুসৃত না হইলেও প্রতিটি পদ্ধতিতেই জনমতকে নির্বাচনের ভিত্তিরূপে স্বীকার করা হইয়াছে এবং কোন ক্ষেত্রেই জনমতকে উপেক্ষা করা হয় নাই।বস্তুতঃপ্রকৃত খিলাফতের ইহাই মৌলিক ভাবধারা এবং জনগণের অধিকার সংরক্ষণ ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য প্রতিটি যুগে ও অবস্থায়ই ইহা কার্যকর হওয়া একান্ত অপরিহার্য। উপরন্তু মৌলিক ভাবধারাকে যথোপযুক্ত মর্যাদা ও গুরুত্ব সহকারে রক্ষা করিয়া রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের যে কোন বাহ্যিক পদ্ধতি গ্রহন করা যাইতে পারে।কেননা ইসলামে বাহ্যিক অবয়ব ও আকার-আকৃতির বিশেষ গুরুত্ব নাই;বরং জাতীয় ও তামদ্দুনিক ব্যাপারে উহার মৌলিক ভাবধারাই হইতেছে একমাত্র লক্ষ্য রাখার বস্তু।
খিলাফতে রাশেদার বৈশিষ্ট্য
ইতিহাস দর্শনের দৃষ্টিতে খিলাফতে রাশেদার ত্রিশ বৎসরকালীন শাসন ব্যবস্থার পর্যালোচনা করিলে উহার নিন্মলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ গোটা মানব জাতিকে আকৃষ্ট ও বিমোহিত করেঃ
(১)খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে বিশ্বনবীর পবিত্র আদর্শ উজ্জল অনির্বাণ প্রদীপে পরিণত হইয়াছিল এবং সমগ্র পরিমণ্ডলকে উহ্য নির্মল আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করিয়া রাখিয়াছিল। খলীফাদের প্রতিটি কাজ ও চিন্তায় উহার গভীর প্রভাব বিদ্যমান ছিল।চারিজন খলীফাই বিশ্বনবীর প্রিয়পাত্র,বন্ধু ও বিশিষ্ট সহকর্মী ছিলেন।অপরাপর সাহাবীদের তুলনায় রাসূলের সাহচর্য ইঁহারাই সর্বাধিক লাভ করিয়াছিলেন।ইঁহারা ছিলেন হযরতের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত এবং তাঁহার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত প্রাণ।একমাত্র হযরত আলী(রা) ব্যতিত আর তিনজন খলীফাই নবী করীম(স)-এর দ্বিতীয় কর্মকেন্দ্র ও শেষ শয্যাস্থল মদীনায় রাজধানী রাখিয়াই খিলাফতের প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করিয়াছিলেন।
(২)খিলাফতে রাশেদার অন্তর্ভুক্ত কোন খলীফার বংশ-গোত্র কিংবা পরিবার-ভিত্তিক অধিকার,উত্তরাধিকার বা প্রাধান্যের কোনই অবকাশ ছিল না। চারিজন খলীফা তিনটি স্বতন্ত্র পরিবার হইতে উদ্ভুত ছিলেন।বস্তুতঃইঁহারাই ছিলেন গোটা ইসলামী জনতার সর্বাপেক্ষা অধিক আস্থাভাজন।ক্রমিক পর্যায়ে ইঁহাদের নির্বাচনে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বের মৌলিক ভাবধারা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় নাই;বরং উহাই রক্ষিত হইয়াছে সর্বতোভাবে।তখন আধুনিক কালের পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলেও কেবলমাত্র তাঁহারাই যে সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত হইতেন,তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।
(৩)খিলাফতে রাশেদার আমলে আইন রচনার ভিত্তি ছিল কুরআন ও সুন্নাহ।যে বিষয়ে তাহাতে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যাইত না,সে বিষয়ে ইজতিহাদ পদ্ধতিতে রাসূলের আমলের বাস্তব দৃষ্টান্ত ও অনুরূপ ঘটনাবলির সামঞ্জস্যের প্রতি লক্ষ্য রাহিয়া ইহার সমাধান বাহির করা হইত এবং এই ব্যাপারে কুরআন ও হাদীস পারদর্শী প্রতিটি নাগরিকেরই রায় প্রকাশের সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল।কোন বিষয়ে সকলের মতৈক্যের সৃষ্টি হইলেই,সে সম্পর্কে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হইত।ফিকাহ-শাস্রের পরিভাষায় ইহাকেই বলা হয় ইজমা। ইসলামী শরিয়াতে ইহা সর্বজনমান্য মূলনীতি বিশেষ।আর কোন বিষয়ে মতবৈষম্যের সৃষ্টি হইলে খলীফা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে নিজস্ব রায় অকুণ্ঠিতভাবে প্রকাশ করিতেন এবং তদানুযায়ী কার্য সম্পাদন করিতেন।
(৪)খুলাফায়ে রাশেদুন অধিকাংশ ব্যাপারেই দায়িত্বশীল সাহাবীদের সহিত পরামর্শ করিতেন।সাধারণ ব্যাপারে তাঁহারাই মনোনয়ন অনুযায়ী ‘মজলিসে শুরা’র সদস্য নিযুক্ত হইতেন।কিন্তু রায়দানের অধিকার কেবলমাত্র নিযুক্ত সদস্যদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল না।
(৫)খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে রাজকীয় জাঁক-জমক ও শান-শকাতের কোন স্থান ছিল না।সাধারণ নাগরিকদের ন্যায় অতি সাধারণ ছিল খলীফাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।তাঁহারা প্রকাশ্য রাজপথে একাকী চলাফেরা করিতেন;কোন দেহরক্ষী তো দূরের কথা,নামে মাত্র পাহারাদারও ছিল না।প্রতিটি মানুষই অবাধে খলীফার নিকট উপস্থিত হতে পারিত।তাহাদের ঘরবাড়ি ও সাজ-সরঞ্জাম ছিল সাধারণ পর্যায়ের।
(৬)খুলাফায়ে রাশেদুন ’ বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রের অর্থ ভাণ্ডারকে জাতীয় সম্পদ ও আমানতের ধন মনে করিতেন।রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মঞ্জুরী ব্যতীত নিজের জন্য এক করা-ক্রান্তি পর্যন্তও কেহ খরচ করিতে পারিতেন না।এতব্দ্যতীত নিজেদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের জন্যও তাঁহারা নিজেদের ক্ষমতা ও পদাধিকার বলে বায়তুল মাল হইতে কিছুই ব্যয় করিতেন না।
(৭)তাঁহারা নিজেদেরকে জনগণের খাদেম মনে করিতেন।কোন ক্ষেত্রেই তাঁহারা নিজদগকে সাধারণ লোকদের অপেক্ষা শ্রেষ্ট ধারণা করিতেন না। তাঁহারা কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই জননেতা ছিলেন না, নামায ও হজ্ব প্রভৃতি ধর্মীয় ব্যাপারেও যথারীতি তাঁহারাই নেতৃত্ব দিতেন।
খিলাফতে রাশেদার আমলে ধর্মীয় কাজের নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় কাজের কর্তৃত্ব বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত ছিল না;বরং এই উভয় প্রকার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বই একজন খলীফার ব্যক্তি সত্তায় কেন্দ্রীভূত ও সমন্বিত হইয়াছিল।বস্তুতঃধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণ এবং ধর্মীয় কাজ ও রাষ্ট্রীয় কাজে দ্বৈতবাদ যেমন আধুনিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, অনুরুপভাবে এতদুভয়ের একত্রীকরণ ও সর্বতোভাবে একমুখীকরণই ছিল খিলাফতে রাশেদার বৈশিষ্ট্য।