হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর বৈশিষ্ট্য
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের ফলে যে ইসলামী সমাজ গঠিত হইয়াছিল, হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর পরে উক্ত সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাক্তি ছিলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)। তাঁহার এই শ্রেষ্টত্ত কেবল বিশ্বনবীর জীবদ্দশায়ই সমগ্র মুসলিম সমাজের নিকট সর্ববাদিসম্মত ছিল না, তাঁহার অন্তর্ধানের পরেও গোটা মুসলিম দুনিয়ায় তিনিই ছিলেন অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ পুরুষ। বস্তুতঃ এই বিষয়ে অতীত যুগে ইসলামী সমাজের কোন কেন্দ্রেই এবং কখনই এক বিন্দু মতবৈষম্য পরিলক্ষিত হয় নাই। এই ব্যাপারে মত বৈষম্যের কোন অবকাশও ছিল না।
কিন্তু এতৎসত্ত্বেও একথা স্বীকার না করিয়া উপায় নাই যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর এই অবিসংবাদিত শ্রেষ্টত্তের মূলীভূত কারণ এবং তাঁহার বিশেষ গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে খুব কম লোকই অবহিত রহিয়াছেন। নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশায় সমস্ত মুলসমানের দৃষ্টি তাঁহার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার প্রকৃত কারণ কি, তাহা মুসলিম মানসের এক অত্যন্ত জরুরী সওয়াল। অথচ একথা সর্বজনজ্ঞাত যে, ইসলামের পূর্বে আরব দেশে শ্রেষ্টত্তের মানদণ্ড হিসাবে যে কয়টি জিনিস সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল, তন্মধ্যে কোন একটি দিক দিয়াই হযরত আবূ বকর (রা)-এর একবিন্দু বিশেষত্ব ছিল না। তিনি কুরাইশের অভিজাত ও সমধিক মর্যাদাসম্পন্ন ‘তাইম’ গোত্রে জন্মগ্রহন করিয়াছিলেন। কিন্তু জাহিলিয়াতের যুগে সমগ্র আরব সমাজের কুরাইশ বংশের অপরাপর শাখা-প্রশাখা যতদূর সম্মান মর্যাদা লাভ করিয়াছিল, হযরত আবূ বকর (রা)-এর গোত্রটিও অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী হইয়াছিল;উপরন্তু সুবিজ্ঞ ব্যবসায়ী হিসাবেও তাঁহার যথেষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল; কিন্তু কুরাইশ বংশে তাঁহার অপেক্ষা অধিকতর ধনবান ব্যক্তি তখনো জীবিত ছিল। তাঁহার বংশ ও গোত্রের লোকদের আস্থা ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন তিনি। কুরাইশের জাহেলী সমাজ-ব্যবস্থায় হযরত আবূ বকর (রা) এবং তাঁহার বংশ ও গোত্রের লোক অন্যান্য লোকদের সমান শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য কখনই লাভ করিতে পারে নাই। ইসলাম-পূর্ব যুগে বাগ্মিতা,কবিত্ব,গণকতা,নেতৃত্বের কাড়াকাড়ি প্রভৃতি দিক দিয়া হযরত আবূ বকর (রা) বিশেষ অগ্রসর ছিলেন না বলিয়া তিনি তদানীন্তন সমাজের অন্যান্য লোকদের সমপরিমাণ ইজ্জত লাভ করিতে পারেন নাই; কিন্তু তৎসত্ত্বেও কোন সব গুন-বৈশিষ্ট্য ও জনহিতকর কাজের দরুণ মানবেতিহাসের সর্বাপেক্ষা উত্তম ও পবিত্র সমাজ হযরত আবূ বকর (রা)-কে নিজেদের নেতা ও প্রথম খলিফারুপে বরণ করিয়া লইয়াছিল এবং দ্বীন ও দুনিয়ার সমগ্র ব্যাপারে তাঁহার উপর অকুণ্ঠ আস্থা স্থাপন করিয়াছিল? সাধারণভাবে ইতিহাসের প্রতিটি ছাত্র-প্রতিটি মুসলিমের পক্ষেই এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু বর্তমানে যাঁহারা মুসলমান এবং আধুনিক বিশ্ববাসীকে ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত করিতে ইচ্ছুক, যাহারা নেতৃত্বের আদর্শ চরিত্র সম্পর্কে মুসলিম জনগণকে শিক্ষিত ও সজাগ করিয়া তুলিতে সচেষ্ট,তাহাদের নিকট এই প্রশ্নের গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুতঃইসলাম সমাজ ও ব্যক্তি গঠনের যে সর্বাঙ্গ সুন্দর আদর্শ ও মানদণ্ড উপস্থাপন করিয়াছে, তাহাই একদা কার্যকর ও বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা) প্রমুখের ন্যায় মহান নেতা লাভ করা মুসলমানদের ভাগ্যে সম্ভব হইয়াছিল।
বর্তমান প্রবন্ধে আলোচ্য প্রশ্নের জওয়াব দিতে চেষ্টা করা হইয়াছে। এই প্রবন্ধে হযরত আবূ বকর (রা)-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও অতুলনীয় জনহিতকর কাজকর্ম সম্পর্কে আলোকপাত করা হইয়াছে। পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজে নেতৃত্বের যে শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চতর মর্যাদা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর লাভ করিয়াছিলেন, তাহা লক্ষ্য করিয়াই হযরত উমর ফারুক (রা) অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক কণ্ঠে বলিয়াছিলেনঃ
শ্রেষ্ঠত্ব ও খিলাফতের সঠিক মাপকাঠি যদি ইহাই হয়, তাহা হইলে আপনার পরবর্তী খলীফাগণ তো কঠিন অসুবিধান পড়িয়া যাইবেন,কেননা আপনার সমকক্ষতা অর্জন করা কাহারো পক্ষে সম্ভব হইবে না।
পবিত্র স্বভাব-প্রকৃতি
হযরত আবূ বকর (রা)-এর জীবন চরিত আলোচনা করিলে সর্বপ্রথম আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত হইয়া উঠে তাঁহার হৃদয়-মনের পবিত্রতা,পরিশুদ্ধতা এবং নির্মলতা। এই কারণে ইসলাম ও নবী করীম (স)-কে সঠিক রূপে চিনিয়া লইতে তাঁহার বিশেষ কোন অসুবিধা বা বিলম্ব হয় নাই। তাঁহার সম্মুখে ইসলামের দাওয়াত ও হযরতের নবুয়্যাত পেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি উহা অকুণ্ঠিত চিত্তে গ্রহণ করিয়াছেন। কোন সংশয়, কোন দ্বিধা অথবা কোন শ্রেষ্ঠত্ববোধের জাহিলিয়াত আসিয়া এই পথে একবিন্দু প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করিতে পারে নাই। হযরত আবূ বকর (রা) তদানীন্তন সমাজের সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন লোক ছিলেন এবং একজন সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির পক্ষে অপর কাহারো নেতৃত্ব মানিয়া লইতে যে পর্বত-প্রমাণ বাধার সম্মুখীন হইতে হয়, তাহা এক মনস্তাত্ত্বিক সত্য। কিন্তু হযরত আবূ বকর (রা)-কে এই ধরনের কোন বাধার সম্মুখীন হইতে হয় নাই। ইহা হইতে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, তিনি একজন সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও নেতৃত্বের অহংকার ও সম্মানের অহমিকাবোধ হইতে তাঁহার হৃদয়-মন ছিল অত্যন্ত পবিত্র।
তিনি ছিলেন স্বভাবগতভাবে অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী ও সমালোচকের দৃষ্টিসম্পন্ন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁহার জাহিলী যুগের জীবন সাক্ষ্য প্রদান করে যে, সমালোচনার কষ্টি-পাথরে যাঁচাই-পরখ না করিয়া কোন বিষয়কে তিনি গ্রহণ করিতে কখনো প্রস্তুত ছিলেন না। কাজেই ইসলাম ও হযরতের নবুয়্যাতের প্রতি নিছক অন্ধভাবে বিশ্বাস স্থাপন করাও তাঁহার পক্ষে কিছুতেই সম্ভবপর ছিল না। এতৎসত্ত্বেও অনতিবিলম্বে ইসলাম কবুল করার একমাত্র কারণ এই যে, অসাধারণ মানসিক পবিত্রতা ও প্রকৃতির স্বচ্ছতার কারণে হযরতের সত্তবাদিতা ও তাঁহার কথাবার্তার যথার্থতা সম্পর্কে তাঁহার মন ছিল দিবালোকের মতই উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত। এই জন্যই ইসলামকে তিনি আপন মনের প্রতিধ্বনি হিসাবেই গ্রহণ করিয়াছেন। হযরত আবূ বকর (রা) সম্পর্কে জাহিলী সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তি ইবনূদ দাগনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘোষণা করিয়াছিলঃ “তুমি নিকট-আত্মীয়দের হক আদায় কর, সদা সত্য কথা বল, অভাবী লোকদের অভাব পূরণ কর, আহত,নির্যাতিত ও বিপদগ্রস্ত লোকদের তুমি সাহায্য কর”-এইরূপ ব্যক্তির স্বচ্ছ হৃদয়-পটে যে কোন প্রকার মালিন্য পুঞ্জিভূত হইতে পারে না এবং রাসূলের সত্যতা স্বীকার করিতে ও ইসলাম গ্রহণ করিতে একবিন্দু বিলম্ব হইতে পারে না, তাহা বলাই বাহুল্য। এইরূপ পবিত্র আত্মা ও স্বচ্ছ মনের অধিকারীর জন্য পয়গাম্বরের দাওয়াত ও তাঁহার উজ্জ্বল মুখমণ্ডল অনেকটা মুজিজার সমতুল্য। সত্যের আওয়াজ শোনামাত্রই তাহার চৈতন্য জাগ্রত হইয়া উঠে, হৃদয় অবনমিত হয়। বিশ্বনবী নিজেই হযরত আবূ বকর (রা)-এর এই গুন –বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সাক্ষ্যদান প্রসঙ্গে স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেনঃ
আমি যাহাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়াছি, প্রত্যেকেই ইসলাম কবুল করার ব্যাপারে কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংকোচ অনুভব করিয়াছে। কিন্তু আবূ বকর বিন আবূ কোহফা ইহার ব্যতিক্রম। আমি যখনি তাঁহার সম্মুখে এই কথা পেশ করিলাম তখন উহা কবুল করিতে যেমন তাহাকে কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইতে হয় নাই, তেমনি এই ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র ইতস্ততাও বোধ করেন নাই।
হযরত আবূ বকর (রা) তাঁহার অনন্য পবিত্র স্বভাব-প্রকৃতির দরুণ অসংখ্য পবিত্র স্বভাববিশিষ্ট ও সৎকর্মশীল লোকদিগকে নিজের চতুস্পাের্শ্ব একত্রিত করিয়া লইয়াছিলেন। তাহারা আবূ বকর (রা)- এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও গুন গরিমার জন্য তাঁহার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট ছিল। জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেই তাঁহার সিদ্ধান্তকে তাহার অকুণ্ঠিত চিত্তে মানিয়া লইত। তাহারা যখন দেখিতে পাইল যে, হযরত আবূ বকর (রা) ইসলাম কবুল করিয়াছেন, তখন তাহারা এই বিচক্ষণ সহযাত্রী ও আস্থাভাজন নেতার সিদ্ধান্তে অনুপ্রাণিত না হইয়া পারিল না। ফলে তাহাদেরও ইসলাম কবুল করিতে বিশেষ বিলম্ব হইল না।হযরত উসমান বিন আফফান, আবদুর রহমান বিন আউফ, তালহা বিন উবাইদুল্লাহ, সায়াদ বিন আবী অক্কাস, জুবাইর বিন আওয়াম ও আবু উবাইদাহ বিন জাররাহ ন্যায় বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকেরা হযরত আবূ বকর (রা)-এর দাওয়াতেই ইসলাম কবুল করিয়াছিলেন এবং এই মহান ব্যক্তিদের কারণে ইসলামী আন্দোলন প্রথম পর্যায়েই অত্যন্ত শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিল। ইঁহাদের এক একজন ছিলেন আপন যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার দিক দিয়া ইসলামের অপূর্ব সম্পদ আর এই ধরনের লোকদিগকে যে মহান ব্যক্তি ইসলামে দীক্ষিত করিয়াছিলেন, তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব ও বিরাটত্ব ভাষায় বলিয়া শেষ করা যায় না।
নৈতিক বল ও অসমসাহস
দুনিয়ায় আল্লাহ্র কালেমা প্রচার ও দ্বীন-ইসলামের পতাকা উড্ডীন করার জন্য হযরত আবূ বকর (রা)-এর নৈতিক বল ও অসম সাহসিকতা এক তুলনাহীন ব্যাপার। তিনি যে একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ী ছিলেন, তাহা সর্বজনবিদিত। একজন নেতার পক্ষে অপর কাহারো নেতৃত্ব স্বীকার করিয়া স্বীয় নেতৃত্বের পক্ষে বিপদ টানিয়া আনা অত্যন্ত কঠিন কাজ। উপরন্তু যে আন্দোলন যোগদান করার ফলে জনগণের নিকট ধিকৃত ও তিরস্কৃত হইতে হয় এবং যাহার পরিণতিতে নিজের ব্যবসায় বিনষ্ট হইতে পারে, তাহা কবুল করা দূরন্ত সাহস ও হিম্মতের উপর নির্ভর করে। কেননা তাহাতে বৈষয়িক স্বার্থ তথা রুজি-রোজগার কঠিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে। অন্ততঃসাধারণ ও ছোট মনের ব্যবসায়ীদের খুব বেশী দ্বারা এই কাজ কিছুতেই সম্পন্ন হইতে পারে না। এ ব্যাপারে কোন ব্যবসায়ী খুব বেশী দুঃসাহসের পরিচয় দিলেও এতটুকুই তাঁহার নিকট আশা করা যাইতে পারে যে, সে নিজ পছন্দমত কোন আন্দোলনকে অন্তর দিয়া সমর্থন করিবে ও যথাসম্ভব উহাকে আর্থিক সাহায্য দান করিবে; কিন্তু নীতিগতভাবে কোন আন্দোলনকে মন-মগজ দিয়া মানিয়া লওয়া এবং কার্যতঃউহার আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রবল প্রতিকূল শক্তির সহিত সর্বাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া, উপরন্তু স্বীয় ব্যবসায় ও রুজী-রোজগারকে কঠিন বিপদের মুখে ঠেলিয়া দেওয়ার মত দুঃসাহস খুব কম লোকেই করিতে পারে। কিন্তু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এইরূপ দুঃসাহস পূর্ণমাত্রায় প্রদর্শন করিয়াছেন। অতঃপর যে সব দুঃসাহসী অভিযাত্রী এই বিপদ-সংকুল পথে পদক্ষেপ করিয়াছেন, তাঁহাদের সকলেরই সম্মুখে একমাত্র আদর্শ ছিল হযরত আবূ বকর (রা)-এর অপূর্ব বিপ্লবী ভূমিকা।১ {আর্থিক কুরবানীর অনন্য দৃষ্টান্তঃইসলামের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিরক্ষা এই উভয় কার্যেই অর্থ ব্যয় করিতে হযরত আবূ বকর (রা) ছিলেন অত্যন্ত উদারহস্ত। এই ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের গোটা জামায়াতের মধ্যে তাঁহার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়-অনুকরণীয়। রাসূলে করীম (স) যখনই কোন কাজে সাহাবাদের নিকট আর্থিক কুরবানীর আহ্বান জানাইয়াছেন, হযরত আবূ বকর (রা) তখনই সর্বোচ্চ ত্যাগের মনোভাব লইয়া আগাইয়া আসিয়াছেন। তবুক অভিযানকালে রাসূলে করীম (স) সাহাবাদের নিকট সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানাইলে একমাত্র আবূ বকর (রা) তাঁহার সমগ্র বিত্ত-সম্পদ আল্লাহ্র রাহে দান করিবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, সমগ্র বিত্ত-সম্পদ দান করিয়া দিলে তাঁহার পরিবার পরজনের ভরণপোষণ কিভাবে চলিবে? জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ ‘তাঁহাদের জন্য আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলই যথেষ্ট’। হযরত আবূ বকর (রা) আল্লাহ্র রাহে কতখানি নিবেদিতচিত্ত ছিলেন,তাঁহার আর্থিক কুরবানীর এই অনন্য দৃষ্টান্ত হইতেই তাহা গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়।–সম্পাদক}
মজলুমকে সাহায্য ও সমর্থন দান
ইসলামী আন্দোলনকে প্রাথমিক পর্যায়ের কঠোর অগ্নিপরীক্ষাকালে সত্যপথের মজলুমদিগকে ইসলামের দুশমনদের নির্যাতন হইতে রক্ষা করার ব্যাপারে হযরত আবূ বকর (রা)-এর অর্থসম্পদ যে বিরাট কাজ করিয়াছে, ইতিহাসে তাঁহার দৃষ্টান্ত বিরল। বিলাল হাবশী (রা) ও ইবনে ফুহাইরা (রা)—র মত ক্রীতদাস শ্রেণীর লোক ইসলাম কবুল করার অপরাধে স্বীয় মালিক-মনিবদের অত্যাচার-নিষ্পেষণে নিতান্ত অসহায়ের মত নিষ্পেষিত হইতেছিল। হযরত আবূ বকর (রা)-এর সৌহার্দ্য ও দানশীলতার-দৌলতে তাঁহারা এই দুঃসহ আযাব হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন। এইজন্য তাঁহাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতে হইয়াছে। এই খাতে তাঁহাকে যে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতে হইয়াছে, একটি ব্যাপার দ্বারাই সে সম্পর্কে অনুমান করা যাইতে পারে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)যখন ইসলাম কবুল করেন,তখন তাঁহার নিকট চল্লিশ হাজার দিরহাম নগদ অর্থ সঞ্চিত ছিল; কিন্তু বারো-তেরো বৎসর পর যখন তিনি মদীনায় হিজরত করেন,তখন তাঁহার নিকট মাত্র পাঁচ হাজার দিরহাম অবশিষ্ট ছিল। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে তাঁহার ব্যবসায়ে অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে চলিয়াছে এবং তাহাতে প্রচুর মুনাফা অর্জিত হইয়াছে।২ {রাষ্ট্রীয় তহবিলের আমানতদারীঃখিলাফতের প্রশাসনিক ক্ষমতার ন্যায় রাষ্ট্রের অর্থ-সম্পদকে হযরত আবূ বকর (রা)এক বিরাট আমানত রূপে গণ্য করিতেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করিতেন বলিয়া প্রথম দিকে তিনি রাষ্ট্রীয় তহবিল হইতে কোন বেতন-ভাতাই নিতেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে খিলাফতের কার্যে সার্বক্ষণিক ব্যস্ততার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হইয়া পড়ায় তিনি রাষ্ট্রীয় তহবিল হইতে একজন সাধারণ নাগরিকের ন্যায় নামমাত্র ভাতা গ্রহণ করিতে শুরু করেন। ইহাতে তাঁহার পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের কাজ কোন প্রকারে চলিয়া যাইত। এই পরিস্থিতিতে কিছু কিছু খাদ্য-সামগ্রী বাঁচাইয়া একদা তাঁহার স্ত্রী একটি মিষ্টি খাবার তৈয়ার করেন। খলীফা অবাক হইয়া স্ত্রীকে প্রশ্ন করিলে তিনি নিয়মিত বরাদ্দ হতে কিছু কিছু খাদ্য বাচাইবার কথা খুলিয়া বলেন। ইহা শুনিয়া খলীফা মন্তব্য করেনঃযে পরিমাণ খাদ্য বাঁচাইয়া তার মিষ্টি তৈয়ার করা হইয়াছে,উহা আমাদের না হইলেও চলে। কাজেই ভবিষ্যতে বায়তুল মাল হইতে ঐ পরিমাণ খাদ্য কম আনা হইবে। রাষ্ট্রীয় তহবিলের আমানতদারীর ব্যাপারে তিনি কতখানি সতর্ক ছিলেন, এই ঘটনা হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়।–সম্পাদক}
হযরতের জন্য আত্মোৎসর্গ
বিশ্বনবীর ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের প্রাথমিক কাল হইতে শুরু করিয়া কঠোর বিপদ-মুসীবতের শেষ পর্যায় অবধি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তাঁহার জন্য আত্মোৎসর্গকৃত ও নিবেদিতচিত্ত হইয়া রহিয়াছেন। কুরাইশগণ যখনই বিশ্বনবীকে কোন প্রকার জ্বালা-যন্ত্রণা দিতে চেষ্টা করিয়াছে,হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা) তখনই স্বীয় প্রাণ ও ইজ্জত বিপন্ন করিয়া তাঁহার সাহায্য-সহযোগিতায় আগাইয়া আসিয়াছেন এবং সম্মুখে অগ্রসর হইয়া প্রত্যাসন্ন বিপদের মুকাবিলা রহিয়াছেন। ইসলামী দাওয়াতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও অগ্রগতির প্রত্যক্ষ আঘাতে যে সব নেতৃস্থানীয় লোকের মাতব্বরী ও নেতৃত্ব বিপন্ন হইয়াছিল, তাহারা একদিন কোন এক স্থানে একত্রিত হইয়া পারস্পরিক পরামর্শ করিতেছিল এবং আসন্ন বিপদ হইতে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উপায় নির্ধারণের ব্যতিব্যাস্ত হইয়া উঠিয়াছিল। তাহারা সকলেই ভয়ানক ক্রুদ্ধ,রুষ্ট ও আক্রোশান্ধ। ঠিক এই সময় নবী করীম (স) সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। ইসলামের এই দুশমন লোকগুলি তাঁহার উপর হটাৎ আক্রমণ করিয়া বসিল। তাহারা বলিলঃ ‘তুমিই তো আমাদের ধর্ম ও আমাদের উপাস্য দেবতাদের তিরস্কার ও ভৎসনা কর”। নবী করীম (স) উত্তরে বলিলেন, “হ্যাঁ আমিই তাহা করি”। সহসা একটি লোক হযরতের চাদর আঁকড়াইয়া ধরিল ও তাঁহাকে কঠিন আঘাত হানার উদ্দেশ্যে হস্ত প্রসারিত করি। তৎক্ষণাৎ হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি ইহাদের বদমতলব বুঝিতে পারিলেন। তিনি সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিজের মস্তকে লইয়া সম্মুখে অগ্রসর হইলেন ও ক্রুদ্ধ স্বরে বলিয়া উঠিলেনঃ “তোমরা কি একটি লোককে শুধু এই অপরাধেই হত্যা করিতে চাও যে, সে কেবল এক আল্লাহ্কেই নিজের রব্ব বলিয়া ঘোষণা করে?”
হিজরতের কঠিন মুহূর্তে নবী করীম (স) হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-কেই সহযাত্রীরূপে গ্রহণ করিলেন। হযরতের এই সফর ছিল অত্যন্ত বিপদসংকুল এবং যে কোন মুহূর্তে তাঁহার জীবন বিপন্ন হইতে পারে-হযরত আবূ বকর (রা) ইহা ভাল করিয়াই জানিতেন। তিনি ইহাও জানিতেন যে, এই সফরে যতখানি বিপদ হযরতের উপর আসার আশংকা ছিল, তাঁহার সহযাত্রীর উপর তাহা অপেক্ষা কম বিপদ আপতিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলনা। কিন্তু এই সবকিছু সুস্পষ্টরূপে জানিয়া বুঝিয়া লওয়ার পরও তিনি নিজের জন্য বিরাট সৌভাগ্য বলিয়া মনে করিলেন এবং এই সফরে তিনি হযরতের সঙ্গী হইয়া সকল প্রকার বিপদের মুকাবিলা করার সুযোগ পাইবেন বলিয়া আল্লাহ্র শোকরিয়া আদায় করিলেন।
মক্কা হইতে মদীনা যাওয়ার পথে এই ক্ষুদ্র কাফেলা প্রথমে আশ্রয় গ্রহণ করে ‘সাওর’ নামক পর্বত গুহায়। এই গুহায় প্রবেশ করিবার সময় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)নবীগতপ্রাণ হওয়ার বাস্তব প্রমাণ উপস্থাপিত করেন। জনমানব বিবর্জিত শ্বাপদসংকুল পর্বত গুহায় সর্বপ্রথম হযরত আবূ বকর (রা)নিজে প্রবেশ করিয়া উহাকে পরিষ্কার করেন। উহার অসংখ্য ছিদ্রপথ বন্ধ করিয়া দেন। নবী করীম (স) এই গুহায় আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর জানুর উপর মস্তক স্থাপন করিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। এমন সময় একটি উন্মুক্ত ছিদ্রমুখ হইতে এক বিষধর সর্প বাহির হইয়া হযরত আবূ বকর (রা)-এর পায়ে দংশন করে। আবূ বকর (রা) বিষক্রিয়ায় জর্জরিত হইয়া পড়েন; কিন্তু হযরতের নিদ্রাভঙ্গ ও তাঁহার বিশ্রামে ব্যাঘাত সৃষ্টির ভয়ে তিনি একবিন্দু নড়াচড়া করেন নাই। কিন্তু বিষের দুঃসহ ব্যাথা তাঁহাকে এতদূর কাতর করিয়া ফেলে যে, তাঁহার চক্ষু কোটর হইতে দুই ফোঁটা অশ্রু-বিগলিত হইয়া রাসূলের গণ্ডদেশে পতিত হয়। রাসূল (স)-এর প্রতি কত অসীম ভালবাসা ও আন্তরিক ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকার কারণে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এইরূপ করিতে পারিয়াছিলেন, তাহা ধারণা করা আমাদের পক্ষে কঠিন ব্যাপার।
কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সমন্বয়
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর চরিত্রে কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়াছিল। ইহা ছিল তাঁহার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং এই কারণে তাহা ছিল নবীর প্রকৃতির সহিত গভীর সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেখানে কঠোরতা অবলম্বনের প্রয়োজন হইত, সেখানে তিনি ঠিক প্রয়োজনীয় মাত্রায় ইস্পাতকঠিন হইয়া দাঁড়াইতেন। পক্ষান্তরে যেখানে নম্রতা প্রদর্শন আবশ্যক হইত, সেখানে তিনি অকারণ ক্রোধ ও অন্তঃসারশূন্য আত্মসম্মানবোধের মোটেই প্রশ্রয় দিতেন না। সেখানে তিনি বিগলিত-দ্রবীভূত ধাতুর মত। ফখাচ নামক এক ইয়াহুদী একবার আল্লাহ্র নাম করিয়া বিদ্রুপ করিতেছিল; ইহাতে হযরত আবূ বকর (রা)-এর দেহে প্রবল রোষাগ্নি জ্বলিয়া উঠে। তিনি পূর্ণ শক্তিতে সেই ব্যক্তিকে এক চপেটাঘাত করেন এবং বলেন, “তোমাদের ও আমাদের মধ্যে ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি স্বাক্ষরিত না হইলে এখনি তোমার মস্তক ছিন্ন করিয়া দিতাম”। হুদাইবিয়ার সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় কুরাইশ প্রতিনিধিগণ বিদ্রুপ ও উপহাস করিয়া নবী করীম (স)-কে বলিয়াছিলেন যে, কঠিন বিপদের সময় আপনার সঙ্গীরা আপনার সহচর্য ত্যাগ করিবে। তখন হযরত আবূ বকর (রা) অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং এত কঠোর ভাষায় ইহার উত্তর দিয়াছিলেন যে, তাঁহার ন্যায় ধৈর্যশীল ব্যক্তির নিকট হইতে এইরূপ উক্তি সাধারণতঃ ধারণাও করা যায় না। কিন্তু সম্মান ও মর্যাদাবোধ তাঁহার মধ্যে এত তীক্ষ্ণ ছিল যে, ঐরুপ জওয়াব তাঁহার কণ্ঠ হইতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিঃসৃত হইয়াছিল। আর যাহাকে এইরুপ কঠোর ভাষায় উত্তর দান করা হয়, জাহিলিয়াতের যুগে সে ছিল হযরত আবূ বকর (রা)-এর অনুগৃহীত। সেই কারণে লোকটি উহা সহ্য ও হজম করিতে বাধ্য হয়।
অপরদিকে বদর যুদ্ধের সময় আল্লাহ্ যখন মুসলমানদিগকে বিজয় মাল্যে ভূষিত করেন ও বহুসংখ্যক কাফির সরদার বন্দি হইয়া আসে, তখনই তিনি ইহাদের প্রতি স্নেহ-অনুগ্রহের অতল সাগর রূপে নিজেকে তুলিয়া ধরেন;অথচ একথা তিনি এক মুহূর্তের তরেও ভুলিতে পারেন নাই যে, এই সব কুরাইশ সরদারই নিরীহ ও অসহায় মুসলিমদিগকে অত্যাচার-নিষ্পেষণে জর্জরিত করিয়া তুলিয়াছিল, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স) এবং তাঁহার সঙ্গী সাথীদের উপর অমানুষিক অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালাইয়াছিল ও তাঁহাদিগকে দেশত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছিল। স্বয়ং হযরত আবূ বকর (রা)ও নানাভাবে ইহাদের হাতে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হইয়াছিলেন। কিন্তু ইসলামের জন্য এই সবকিছুই তিনি অবলীলাক্রমে বরদাশত করেন। তথাপি এই করায়ত্ত লোকদের নিকট হইতে তিনি একবিন্দু প্রতিশোধ লওয়ার কথা চিন্তা করিতে পারেন নাই। সেইজন্য অপরাপর সাহাবীদের ন্যায় তিনি বিশ্বনবীকে বন্দীদের হত্যা করার পরামর্শ না দিয়া তাহাদিগকে বিনিময় গ্রহণপূর্বক মুক্ত করিয়া দিবারই পরামর্শ দিলেন। মুসলমানদের তরফ হইতে এই অপ্রত্যাশিত অনুগ্রহ লাভ করিয়া কাফির সরদারগন হয়তবা ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হইবে ও আল্লাহ্র সন্তোষ লাভে উদ্যোগী হইবে, ইহাই ছিল হযরত আবূ বকর (রা)-এর বিশ্বাস ও প্রত্যাশা।
দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতা
হুদাইবিয়ার সন্ধি ইসলামী ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যে পরিস্থিতিতে ও যে সব শর্তের ভিত্তিতে এই চুক্তি সম্পাদিত হইয়াছিল, তাহা দৃশ্যতঃমুসলমানদের পক্ষে ছিল অত্যন্ত নৈরাশ্যব্যঞ্জক ও মর্মবিদারক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইহার যে পরিণতি দেখা গিয়াছিল, তাহা ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে শুধু বিপুল উদ্দীপকই ছিল না, প্রকৃত পক্ষে তাহা ছিল মুসলমানদের জন্য ‘ফতহুমমুবীন-সুস্পষ্ট বিজয়। এই সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় হযরত আবূ বকর (রা)-এর ভূমিকা তাঁহার সূক্ষ্ম দূরদৃষ্টি,তীক্ষ্ণ বিচার-বুদ্ধি ও বিপুল প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অনস্বীকার্য পরিচয় বহন করে। এই সন্ধির শর্তসমূহ একজন সাহাবীও গ্রহণ করিতে প্রস্তুত ছিলেন না। হযরত উমর ফারুক (রা)সংশ্লিষ্ট শর্তসমূহের এতদূর বিরোধী ছিলেন যে, তিনি রাসূলের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া অত্যন্ত কঠোর ভাষায় কথাবার্তা বলিয়াছিলেন।(এজন্য অবশ্য আজীবন তিনি অনুতাপ করিয়াছেন)। কেবলমাত্র হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)ই এই ব্যাপারে আগাগোড়া রাসূলের সমর্থক ছিলেন। তিনি কেবল পূর্ণ শক্তিতে এই সন্ধি-চুক্তিকে সমর্থনই করেন নাই, স্বীয় প্রভাব খাটাইয়া অন্যান্য মুসলিমদেরও নিশ্চিন্ত করিয়াছিলেন। এইসব চেষ্টার ফলেই শেষ পর্যন্ত হযরত উমর ফারুক (রা)-এর অসন্তোষ প্রশমিত হয়।
বস্তুতঃযে সন্ধি চুক্তি প্রকাশ্যভাবে ও বাহ্যদৃষ্টিতে মুসলমানদের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল-তাহাদের মর্যাদার পক্ষে ছিল হানিকর ও ভবিষ্যতের জন্য অন্ধকারের ইঙ্গিতবহ এবং যে কারণে গোটা মুসলিম সমাজের মদ্য হইতে একব্যক্তিও উহার সমর্থক ও সে সম্পর্কে নিঃসংশয় ছিল না, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) উহার সুফল প্রকাশিত হওয়ার কয়েক বৎসর পূর্বেই আপন জ্ঞানচক্ষু দ্বারা উহার সুদূরপ্রসারী কল্যাণকারিতা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। স্বয়ং নবী করীম (স) তো অহী ও ইলাহামের সাহায্যে হুদাইবিয়া সন্ধির অন্তর্নিহিত কল্যাণকারিতা ও বিরাট সুফল সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত ছিলেন এবং এই জন্য ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়-অচল-অটল। কিন্তু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)ঐরূপ সাহায্য ছাড়াই এ সম্পর্কে যে সমর্থন ও দৃঢ়টা প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহা বাস্তবিকই বিস্ময়কর। ইহা যদি ঈমানের স্বতঃস্ফূর্ত আলোক প্রভাব সফল হইয়া থাকে তবে বলিতেই হইবে যে, এইরূপ ঈমান-ঈমানের এই সুউচ্চতম মান একমাত্র আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এরই অর্জিত ছিল। আর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি ও বিচক্ষণতার দৌলতে সন্ধির অন্তর্নিহিত ইতিহাসে ইহার বাস্তবিকই কোন তুলনা পাওয়া যাইবে না।
আল্লাহ্, রাসূল ও মুসলিমদের নিকট সমান প্রিয়পাত্র
হযরত আবূ বকর (রা) তাঁহার ঐকান্তিক ও নিষ্ঠাপূর্ণ খিদমতের কারণে আল্লাহ্, রাসূল ও মুসলিম জনগণের নিকট সমান প্রিয়পাত্র ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই জনপ্রিয়তার মর্যাদা এতদূর উন্নত ছিল যে, বিশ্বনবীর পর অন্য কেহই এই ক্ষেত্রে তাঁহার সমতুল্য ছিল কিনা সন্দেহ। ইসলামের ইতিহাসের ইহার কোন দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া পাওয়া যায়না। এইখানে উহার কয়েকটি কারণের উল্লেখ করা যাইতেছে।
নবী করীম (স) যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন,তখন লোকদের নামায পড়াইবার দায়িত্ব তিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর উপর অর্পণ করেন।এ ব্যাপারে অন্যান্যদের সম্পর্কে হযরতকে যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়,তিনি তাহা সবই অত্যন্ত দৃঢ়তা সহকারে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর উপর অর্পণ করেন। এই ব্যাপারে অন্যান্যদের সম্পর্কে হযরতকে যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়, তিনি তাহা সবই অত্যন্ত দৃঢ়তা সহকারে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) রীতিমত নামায পড়াইতে থাকেন। একদা তিনি ঠিক সময় মসজিদে উপস্থিত হইতে পারেন নাই বলিয়া হযরত বিলাল (রা) হযরত উমর ফারুক (রা)-কে নামাযে ইমামত করিতে অনুরোধ জানান। নামাযের দেরী হওয়ার আশংকায় হযরত উমর ফারুক (রা) নামায পড়াইতে শুরু করেন। তাঁহার কণ্ঠস্বর ছিল অত্যন্ত উচ্চ ও দূরপ্রসারী। তাঁহার তকবীর ধ্বনি মসজিদ-সংলগ্ন হুজরা মুবারকে শায়িত বিশ্বনবীর কর্ণকূহরে প্রবিষ্ট হইতেই তিনি চকিত হইয়া উঠিলেন ও জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ আবূ বকর কোথায়……… এই ব্যাপারটি না আল্লাহ্ পছন্দ করিবেন আর না মুসলিম জনগণ।
শুধু তাহাই নয়, বিশ্বনবীর দৃষ্টিতে হযরত আবূ বকর (রা)-এর যে অপূর্ব মর্যাদা ও আস্থা ছিল, তাহাও অতুলনীয়। নবী করীম (স)নিজেই তাঁহার এক বানীতে সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করিয়াছেনঃ
সমগ্র সাহাবীর মধ্যে তাঁহার ন্যায় অনুগ্রহ আর কাহারো নাই। মানব সমাজের কাহাকেও যদি আমি বন্ধুরুপে বরণ করিতাম,তাহা হইলে আবূ বকর (রা) কেই আমার বন্ধু বানাইতাম। অবশ্য আমাদের বন্ধুত্ব,সাহচর্য্য,ভ্রাতৃত্ব ও ঈমানের দৃঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান রহিয়াছে এবং ইহা থাকিবে ততদিন,যতদিন না আল্লাহ্ আমাদিগকে পুনরায় একত্রিত করেন।(বুখারী)
বিশ্বনবীর দরবারে হযরত আবূ বকর (রা)-এর যে কতখানি মর্যাদা ছিল, তাহা রাসূলের জীবনব্যাপী কর্মধারা হইতে সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায়। মক্কা শরীফে নবী করীম (স) প্রায়শঃহযরত আবূ বকর (রা)-এর ঘরে যাতায়াত করিতেন। মদীনা শরীফেও অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেই তাঁহার উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল। একদিন তিনি নিজ ঘরে তিনজন দরিদ্র সাহাবীকে খাওয়ার দাওয়াত দিয়াছিলেন;কিন্তু অধিক রাত্র পর্যন্ত তিনি রাসূলের দরবারে বিশেষ জরুরী কাজে এমনভাবে আটক ছিলেন যে, যথাসময়ে ঘরে ফিরিয়া মেহমানদারী করিতে পারেন নাই। হযরত উমর ফারুক (রা) নিজেই বলিয়াছেন যে, হযরত আবূ বকর (রা) ছিলেন বিশ্বনবীর নিত্য-সহচর। মুসলমানদের যাবতীয় সামগ্রিক ও তামাদ্দুনিক ব্যাপারে তাঁহার সাহায্য ও পরামর্শ অত্যন্ত জরুরী ছিল। অনেক গোপন বিষয় সম্পর্কেই তিনি অবহিত হইতেন। হযরতের ইন্তেকালের পূর্বে মসজিদের চৌহদ্দির মধ্যে যতগুলি দ্বার রক্ষিত ছিল,তন্মধ্যে কেবলমাত্র আবূ বকর (রা)-এর দরজা ব্যতীত আর সবই বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। নবী করীম (স)-কে কখনো অস্বাভাবিক রূপে রাগান্বিত দেখিলে সাহাবায়ে কিরাম হযরত আবূ বকর (রা)-এর মাধ্যমেই প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে অবহিত হইতেন এবং প্রয়োজন হইলে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেন।
চরিত্র বৈশিষ্ট্য
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) স্বভাবতঃই উন্নত ও মহৎ চরিত্রে বিভূষিত ছিলেন। জাহিলিয়াতের যুগেও পবিত্রতা,সততা, দয়াশীলতা, অনুগ্রহ, ন্যাপরায়ণতা ও বিশ্বাসপরায়ণতার গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন। তদানীন্তন সমাজে তিনি ছিলেন একজন আমানতদার ব্যক্তি। যে সমাজে মদ্যপান,ব্যাভিচার ও ফিসক-ফুজুরী সর্বগ্রাসী রূপে ধারণ করিয়াছিল,আবূ বকর সিদ্দীক (রা)সেই সমাজের একজন মর্যাদাবান লোক হওয়া সত্ত্বেও উহার সমস্ত কলুষতা ও পঙ্কিলতা হইতে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। বস্তুতঃএই গুনগুলি তাঁহার মধ্যে স্বভাবগতভাবেই বর্তমান ছিল। উত্তরকালে কুরআনের নৈতিক শিক্ষা ও হযরতের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যের ফলে এই গুণগুলি তাঁহার চরিত্রে অধিকতর চমকিত হইয়া উঠে।
কাহারো মধ্যে তাকওয়া পূর্ণ পরিণত হইয়া উঠে তখন, যখন একদিকে তাহার মন-মগজ সকল প্রকার বাতিল চিন্তা ও মতাদর্শ হইতে মুক্ত এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সকল অন্যায় ও পাপ কাজ হইতে বিরত হয়। বিশ্বনবীর পরে এই রূপ তাকওয়া হযরত আবূ বকর (রা)-এর চরিত্রে যত প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়, তত আর কাহারো মধ্যে নয়।
নেতৃত্ব,কর্তৃত্ব,মাতব্বরি,দুনিয়া-প্রীতি ও সম্মান-স্পৃহার প্রতি হযরত আবূ বকর (রা)স্বভাবতঃই ঘৃণাবোধ করিতেন। তিনি তাঁহার ধন-সম্পদ আল্লাহ্র পথে অকাতরে ও উদার-উন্মক্ত হতে ব্যয় করিয়াছেন। এমন কি খিলাফতের যুগে তিনি ছয় হাজার দিরহাম ঋণী হইয়া পড়েন। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও তিনি জনগণের একটি ক্রান্তি পরিমাণ অর্থ নিজের জন্য ব্যয় করিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই ইন্তেকালের পূর্বে তাঁহার নিজস্ব বাগান বিক্রয় করিয়া বায়তুলমালের ঋণ শোধ করার অসীয়াত করিয়া অর্থ উদ্ধৃত্ত যাহা কিছু থাকিলে,তাহা পরবর্তী খলীফার নিকট পাঠাইয়া দেওয়ার উপদেশ দেন।
দৃঢ়তা ও স্থিরতা
হযরত আবূ বকর (রা)-এর জীবনে সর্বাধিক কঠিন বিপদ ও অগ্নিপরিক্ষা দেখা দেয় বিশ্বনবীর ইন্তেকালের সময়।আঁ-হযরতের প্রতি তাঁহার যে দরদ ও আকর্ষণ ছিল, উহাকে ‘প্রেমের’ পর্যায়ভুক্ত বলা যাইতে পারে। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও তিনি বিশ্বনবীর ইন্তেকালের সংবাদ শ্রবণ করিয়া যে অপরিসীম ধৈর্য ও স্থৈর্যের পরিচয় দান করিয়াছিলেন, ইতিহাসে উহার তুলনা বিরল।শুধু তাহাই নয়,ইসলামের এই কঠিন মুহূর্তে হযরত আবূ বকর (রা)-এর অচল-অটল দৃঢ়তা ও প্রবল স্থিরতা যদি মুলিমদিগকে সঠিক পথ নির্দেশ না করিত,তাহা হইলে গোটা উম্মতে মুসলিমাই যে এক কঠিন ও সর্বাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইত তাহাতে সন্দেহের লেশমাত্র নাই। বস্তুতঃআঁ-হযরতের ইন্তেকালের সংবাদ পাইয়া সর্বসাধারণ মুসলমান অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়ে,অনেকে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাইয়া ফেলে। হযরত উমর (রা)-এর ন্যায় বলিষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন দিল-দিমাগের অধিকারী লোকও এতদূর বিহবল হইয়া পড়েন যে, মসজিদে নববীতে দাঁড়াইয়া মুসলিম জনসাধারণকে লক্ষ্য করিয়া তিনি বক্তৃতা করিতে লাগিলেন যে,আঁ-হযরত (স) ইন্তেকাল করেন নাই,বরং হযরত মূসা যেমন চল্লিশ দিনের জন্য আল্লাহ্র নিকট চলিয়া গিয়াছিলেন এবং পুনরায় প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন, হযরত মুহাম্মাদ(স)ও অনুরুপভাবে নিকট চলিয়া গিয়াছেন, আবার তিনি ফিরিয়া আসিবেন। এমনকি যদি কেহ বলিত যে, হযরত ইন্তেকাল করিয়াছেন,তাহা হইলে তিনি তাহাকে রীতিমত খুন করার ভীতি প্রদর্শন করিতেন এবং বলিতেন যে, নবী করীম (স) আবার ফিরিয়া আসার পর এইরূপ উক্তিকারীদের কঠিন শাস্তি দান করা হইবে।
বস্তুতঃযে কঠিন দুর্ঘটনার ফলে হযরত উমর ফারুক (রা)-এর মন-মগজে এতখানি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়াছিল, তাহা অন্যান্য সাহাবীদের উপর কত দুঃসহ হইয়াছিল, উহার সঠিক ধারণা করা সম্ভব নয়। উপরন্তু বিশ্বনবীর চিরন্তন সহচর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর উপর হযরতের ইন্তেকাল সংবাদের কি সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, উহার কিঞ্চিৎ হত আঁচ করা যাইতে পারে। বিশেষতঃ হযরত আবূ বকর (রা) সম্পর্কে যখন একথা জানাই আছে যে, নবী করীম (স)-এর সামান্য কষ্টেও তিনি অস্থির হইয়া পড়িতেন,তখন তাঁহার মৃত্যু সংবাদ যে তাঁহার নিকট কতখানি মর্মান্তিক হইতে পারে, তাহা ভাবিলেও শরীর শিহরিতে উঠে। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) বিশ্বনবীর মৃত্যু-সংবাদ শ্রবণ করিয়া কিভাবে ধৈর্যধারণ করেন, কিভাবে এই মর্ম-বিদারী ঘটনার মুকাবিলা করেন এবং কুরআনের আলোকে মুসলিম জনগণকে কিভাবে চরম অন্ধকার হইতে রক্ষা করেন,তাহা সত্যই বিস্ময়কর। হযরতের ইন্তেকালের মুহূর্তে আবূ বকর সিদ্দীক (রা)মদীনা শহরে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন মদীনার অদূরে ‘সানাহ’ নামক স্থানে। ইন্তেকালের সংবাদ পাইয়া তিনি দ্রুত শহরে উপস্থিত হইলেন। তিনি সমস্ত মানুষকে দুঃখ-ভারাক্রান্ত ও চিন্তাক্লিষ্ট দেখিতে পাইলেন। আর দেখিলেন হযরত উমর ফারুরুক (রা)কে মসজিদে নববীতে দাঁড়াইয়া বক্তৃতা করিতে। তিনি কোথাও মুহূর্তের জন্য থামিলেন না-সোজা হযরত আয়েশা (রা) ঘরে পৌঁছিলেন ও আঁ হযরতের মুখ-মণ্ডলের আচ্ছাদন সরাইয়া চেহারা মুবারকে চুম্বন দান করিলেন। তিনি হযরতকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃকত মহান পবিত্র ছিলেন জীবনে আর কত পবিত্র আজ মৃত্যুর পর! তিনি সমবেত জনতার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলেনঃ
যাহারা হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর উপাসনা করিতেছিল তাহাদের জানিয়া রাখা আবশ্যক যে, মুহাম্মাদ (স)মরিয়া গিয়াছেন। আর যাহারা আল্লাহ্র উপাসনা-আরাধনা করিত, তাহাদের এই কথা মনে রাখিতে হইবে যে, আল্লাহ্ চিরদিনের জন্য জিন্দা ও জীবিত, তাঁহার মৃত্যু নাই।
অতঃপর তিনি কুরআন মজীদের এই আয়াত পাঠ করেনঃ
*******(আরবী)
মুহাম্মাদ রাসূল ছিলেন, অন্য কিছু নহেন। তাঁহার পূর্বে আরো অনেক রাসূল গত হইয়াছেন। তিনিও যদি মরিয়া যান কিংবা নিহত হন তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করিবে।
হযরত উমর (রা) এই আয়াত শুনিয়া বুঝিতে পারিলেন যে, রাসূলের ইন্তেকাল নিঃসন্দেহ। যখনি এই অনুভূতি তাঁহার মন-মগজে তীব্রভাবে জাগিয়া উঠিল,তখনি তিনি দুঃখভারে যারপরনাই কাতর হইয়া মাটিতে ঢলিয়া পড়েন। ইহার পর তিনি ও অন্যান্য মুসলিমগণ ব্যাপারটির গভীরতা ও ব্যাপকতা এবং ইহার সুদূরপ্রসারী পরিণতি সম্পর্ককে গভীরভাবে চিন্তা করিতে শুরু করিলেন। বস্তুতঃহযরতের ইন্তেকালে গণমনে যে আঘাত লাগিয়াছিল, তাহাতে প্রায় সকলেরই চিন্তা ও বিবেচনা শক্তি লোপ পাইয়া গিয়াছিল। হযরত আবূ বকর (রা)-এর বক্তৃতার কষাঘাতে ঘনীভূত তমিস্রা অচিরেই শূন্যে বিলীন হইয়া গেল। মুসলিম মিল্লাত ইহা দ্বারা যে কত বড় কঠিন বিপদ হইতে উদ্ধার পাইয়া ছিল, তাহা সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাসম্পন্ন ব্যক্তি ও উপলব্ধি করিতে পারেন।
রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা
রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞায় হযরত আবূ বকর (রা)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য হযরতের ইন্তেকালের অব্যবহিত পরের একটি ঘটনাই যথেষ্ট। হযরত ইন্তেকাল করিয়াছেন,তাঁহার দাফন-কাফনের কাজ তখনো সম্পূর্ণ হয় নাই। ইতিমধ্যেই মদীনার আনসারগণ ‘সকীফায়ে বনী সায়েদা’য় একত্রিত হইয়া রাসূল পরবর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও খিলাফত সম্পর্কে পর্যালোচনা ও চিন্তা-ভাবনা শুরু করিয়া দিয়াছেন। এই আলোচনা ব্যাপদেশে এই প্রশ্নও মাথাচাড়া দিয়া উঠে যে, অতঃপর খিলাফতের অধিকারী কাহারা,আনসারগণ না মুহাজিরগণ?আনসারগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন,মুহাজিররাও কিছুমাত্র পশ্চাদপদ ছিলেন না। ফলে এমন একটা পর্যায় আসিল, যখন কেহ কেহ বলিয়া উঠিল*******(আরবী) আমাদের মধ্য হইতে একজন আমীর হইবে আর একজন আমীর হইবে তোমাদের মধ্য হইতে’। পরিস্থিতি এতদূর ঘোলাটে ও উত্তেজনাপূর্ণ হইয়া পড়ে যে, যে কোন মুহূর্তে অসংখ্য শানিত তরবারী কোষমুক্ত হইতে পারিত।
একদিকে এই কঠিন অবস্থা। অপরদিকে হযরত উমর,হযরত আবূ উবাইদাহ (রা)প্রমুখ নেতৃস্থানীয় মুহাজিরগণ মসজিদে নববীতে হযরতের ইন্তেকাল-পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর আলোচনায় মগ্ন। এ সময় হযরত আবূ বকর (রা) হযরত আলী (রা) সমভিব্যহারে ছিলেন হযরতের কাফন-দাফনের ব্যবস্থাপনায় ব্যতিব্যস্ত। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি সকীফায়ে বনী সায়েদায় আয়োজিত উক্ত সম্মেলনের সংবাদ হযরত উমর ফারুক (রা)-এর নিকট পৌঁছায়। সেই সঙ্গে আনসার নেতৃবৃন্দের বক্তৃতার কথাও তাঁহাকে জানানো হয়। তিনি এই সংবাদ পাইয়া হযরত আবূ বকর (রা)কে বাহিরে ডাকিয়া পাঠাইলেন। হযরত আবূ বকর (রা)নিজের ব্যস্ততা প্রকাশ করিলেন। কিন্তু যখন তাঁহাকে পরিস্থিতির গুরুত্ত সম্পর্কে অবহিত করা হইল, তখন তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন যে, অবিলম্বে পরিস্থিতি আয়ত্তাধীন না হইলে উম্মতে মুসলিমা টুকরা টুকরা হইয়া যাওয়ার পূর্ণ আশংকা রহিয়াছে। তিনি ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া রাসূলের দাফন-কাফনের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ মুলতবী রাখেন। অতঃপর মুসলিম জাতিকে আসন্ন ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করার উদ্দেশ্য তিনি হযরত উমর ও আবূ উবাইদাহ (রা) সমভিব্যহারে সকীফায়ে বনী সায়েদায় গমন করেন।
সকীফায়ে বনী সায়েদায় পৌঁছিয়া প্রথমে তিনি সমস্ত পরিস্থিতির মূল্যায়ন এবং উহার সঠিক রূপ উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করেন। তিনি স্পষ্টত অনুভব করিতে পারেন যে, কাহারো কাহারো বক্তৃতার তীব্রতায় উপস্থিত লোকদের মন বিশেষভাবে আহত হইয়াছে। অনেকেরই মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হইয়া গিয়াছে। এই পরিস্থিতি দর্শনেও তিনি কিছুমাত্র হতাশ হইলেন না। তিনি অবস্থা আয়ত্তে আনিতে ও লোকদের পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি দূর করিতে লাগিলেন। প্রথম হযরত উমর ফারুক (রা) বক্তৃতা করিতে চাহিলে আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তাহাকে বিরত করিলেন।কেননা তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে হযরত উমর ফারুক (রা)-এর বক্তৃতা পরিস্থিতিকে অধিকতর ঘোলাটে করিয়া তুলতে পারে। অতঃপর তিনি নিজেই দাঁড়াইয়া বক্তৃতা শুরু করিলেন। তাঁহার এই বক্তৃতা ছিল অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ,হৃদয়গ্রাহী,মর্মস্পর্শী ও উঁচুমানের ভাষায় অলংকারে সমৃদ্ধ। তাঁহার বক্তব্য ছিল সর্বদিক দিয়া ইনসাফ-ভিত্তিক,বিজ্ঞান ও যুক্তিমূলক। উহা উপস্থিত জনমণ্ডলীর মর্মস্পর্শ করিল, হৃদয় বিগলিত করিয়া দিল। আনসারদের কেহ কেহ এই বক্তৃতার প্রত্যুত্তর দিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য তাহা কিছুমাত্র সম্ভবপর ছিল না। আনসারদের সম্পর্কে প্রশংসামূলক কথাবার্তা যাহা কিছু বলা সম্ভব ছিল,তিনি তাহা সবই উত্তমরূপে বলিয়াছিলেন এবং সে সঙ্গে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বীয় দৃষ্টিকোণও অত্যন্ত অকাট্য যুক্তির ভিত্তিতে পেশ করেন। ফলে সকল কুজ্ঝটিকা,আশংকা ও সংশয়ের সকল গোলক-ধাঁধাঁ নিমেষে বিলীন হইয়া গেল। তিনি যখন দেখিলেন যে, অবস্থা শান্ত হইয়াছে, কলহ-ফাসাদের সকল ঘনঘটা শুন্য মিলাইয়া গিয়াছে, তখন তিনি একজন যোগ্যতম রাষ্ট্রনেতা হিসেবেই প্রস্তাব করিলেনঃ ‘হযরত উমর ও হযরত আবূ উবাইদাহ বিন জাররাহ (রা) তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিদের অন্যতম, তাঁহাদের মধ্যে যাহার হাতেই ইচ্ছা তোমরা- ‘বায়’আত’ কর’।
হযরত উমর (রা)এই প্রস্তাব শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় কর্তব্য স্থির করিয়া লইলেন। তিনি অপর কাহারো নাম আলোচ্য বিষয়ে পরিনত হওয়ার পূর্বেই অতীব প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সহকারে হযরত আবূ বকর (রা)-এর দিকে হাত বাড়াইয়া দিলেন এবং বলিলেনঃ
হস্ত প্রসারিত করুন, আমরা আপনার হস্তেই ‘বায়’আত’ করিব। রাসূলে করীম (স) আপনাকেই নামাযের জন্য তাঁহার স্থলাভিষিক্ত করিয়াছিলেন। এই কারণে মুসলিম সমাজের খলিফা হওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি আপনিই। আমারা আপনার হস্তে ‘বায়’আত’ করিয়া প্রকৃতপক্ষে রাসূলের প্রিয় লোকদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তির হস্তেই ‘বায়’আত’ করার সুযোগ লাভ করিব।
হযরত আবূ উবাইদাহ (রা) সম্মুখে অগ্রসর হইয়া হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-কে সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ
সমগ্র মুজাহিদদের মধ্যে আপনিই উত্তম ব্যক্তি। সাওর-গহবরে আপনিই নবী করীম(স)-এর একক সঙ্গী ছিলেন। মুসলিমদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরয হইতেছে নামায, তাহাতে আপনিই রাসূলে করীম (স)-এর প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত। সুতরাং আপনার বর্তমানে আপনি ব্যতিত খলীফার পদাধিকারী আর কেহই হইতে পারে না।
বস্তুত মুজাহিদদের দুই শীর্ষস্থানীয় নেতা উল্লেখিত ভাষায় নিজেদের মনের কথা ব্যক্ত করায় গোটা মুসলিম উম্মতেরই প্রতিনিধিত্ব করা হইল। তাঁহারা এমন ব্যক্তিকে খলীফা নির্বাচনের প্রস্তাব ও সমর্থন করিলেন, সাম্প্রতিক সমাজে যিনি যথার্থই সর্বাধিক আস্থাভাজন, যোগ্যতাসম্পন্ন ও সর্বোত্তম ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত হযরত আবূ বকর (রা)জাতির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহনে রাযী হইলেন। উপস্থিত জনতা তাঁহার সম্মতি বুঝিতে পারিয়াই তাঁহার হস্তে ‘বায়’আত’ করার জন্য উদ্বেল হইয়া পড়ে। বস্তুতঃ ইসলামের ইতিহাসে ‘সকীফায়ে বনী সায়েদার’ এই সম্মেলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা,প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব,বিচক্ষণতা,অবিচল দৃঢ়তা এবং ইস্পাত কঠিন অনমনীয়তা প্রদর্শন না করিলে ইসলামি মিল্লাত তখনি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যাইত, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই।
বিশ্বনবীর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার যোগ্যতা
হযরত আবূ বকর (রা) যাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইলেন, তিনি কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন মহান আল্লাহ্ তা’আলার সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত সর্বশেষ পয়গাম্বর। আল্লাহ্ নিজেই সরাসরি অহী প্রেরণ করিয়া তাঁহাকে পথ-প্রদর্শন করিতেন। ফেরেশতাদের দ্বারা সর্বক্ষণ তাঁহার সাহায্য করিতেন। মু’জিজা দ্বারা তাঁহার প্রতিপত্তি স্থাপন করিতেন। তাঁহার চরিত্র ও যাবতীয় গুনাবলি সরাসরি আল্লাহ্র দীক্ষা ও লালনের প্রভাবে বিকশিত হইয়াছিল। এই জন্য কোন দিক দিয়াই তাঁহার মধ্যে একবিন্দু অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল না; বরং তিনি ছিলেন সর্বতোভাবে বিকশিত পরিপূর্ণতার সর্বশেষ স্তরে উপনীত মানুষ। এইরূপ মহান ও বিরাট মর্যাদাসম্পন্ন অগ্রনায়কের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দায়িত্ব যথাযথরূপে পালন করা কিছুমাত্র সহজ কাজ নহে। নবীর সার্বিক সৌন্দর্য মাহাত্ন্য বিমুগ্ধ দৃষ্টি পরবর্তী কালের দায়িত্তসম্পন্ন ব্যক্তিকে যত কম মানের তুলাদণ্ডেই ওজন করুক না কেন, তবুও তাহা এতদূর উচ্চ ও উন্নত হইবে যে, সে তুলাদণ্ডে নিজেকে ওজন করার সাহস খুব কম লোকের মধ্যেই হইতে পারে এবং তাহাতে পুরাপুরি উত্তীর্ণ হওয়াও অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। বিশেষতঃএই ওজনকারী লোকেরা নিজেরাই যখন উচ্চ হইতেও উচ্চতর মানদণ্ডে ওজন হইবার যোগ্যতা রাখে, তখন এই কাজটি অধিকতর কঠিন হইয়া দাঁড়ায়। হযরত আবূ বকর (রা) এইরুপ কঠিন মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হইয়াই মানব জাতির শ্রেষ্টতম পুরুষ ও মহান ব্যক্তিসম্পন্ন অগ্রনেতার স্থলাভিষিক্ত হইয়া ছিলেন এবং নিজের প্রথম নীতিনির্ধারক ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় এই কথাই বলিয়া দিয়াছিলেন। খলীফা নির্বাচিত হওয়ার অব্যবহিত পরে প্রদত্ত তাঁহার ভাষণের প্রধান অংশ এখানে পেশ করা যাইতেছেঃ
হে জনগণ,আমাকে তোমাদের খলীফা নিযুক্ত করা হইয়াছে, অথচ আমি তোমাদের অপেক্ষা উত্তম ব্যক্তি নহি। কাজেই আমি যদি সঠিক কাজ করি, তাহা হইলে তোমরা আমার সাহায্য ও সহযোগিতা করিও। আর যদি ভুল করি, তবে আমাকে সংশোধন ও সঠিক পথানুসারি করিয়া দিবে।………… তোমাদের মধ্যে প্রতিপত্তিহীন লোক আমার নিকট হইবে প্রতিপত্তিশালী। আমি তাহাদের হক লুণ্ঠনকারীদের নিকট হইতে আদায় করিয়া দিব। পক্ষান্তরে প্রতিপত্তিশালী লোক আমার নিকট হবে প্রতিপত্তিহীন। আমি তাহাদের নিকট হইতে অপরের দ্রব্যাদি (যাহা তাহারা লুণ্ঠন করিয়া লইয়াছে) উসুল করিয়া দিব। ………আমি যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসূলের ফরমাবরদারী করিব, ততক্ষন তোমরাও আমার আনুগত্য করিবে। কিন্তু আমি যদি আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসূলের নাফরমানী করি, তাহা হইলে আমার আনুগত্য করা তোমাদের কর্তব্য নহে।
এই ভাষণে হযরত আবূ বকর (রা)আপন সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেন। ইহাতে ক্ষমতা প্রয়োগের সীমাও তিনি নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন। এই সীমা সামান্য মাত্র লংঘন করিলে তাঁহার সহিত কিরুপ ব্যবহার করিতে হইবে,তাহা ও নির্দেশিত করেন। সেই সঙ্গে এই মহান সত্যও তিনি উজ্জ্বল করিয়া তোলেন যে, একটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হিসাবে রাসূলে করীম (স)-এর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য তিনি সর্বতোভাবে দায়ী এবং মুসলিম জনগণ তাঁহার আনুগত্য করিয়া চলিতে ঠিক ততক্ষন পর্যন্ত বাধ্য থাকিবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজে আল্লাহ্র রাসূলের আনুগত্য করিয়া চলিবেন; পরন্তু তিনি ইহার একবিন্দু বরখেলাফ করিলে ইসলামী জনতা শুধু তাঁহার আনুগত্যই অস্বীকার করিতে পারিবে তাহা নহে, তাহার বিরুদ্ধে স্পষ্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করাও তাহাদের অধিকার থাকিবে। বস্তুত নবী শ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দায়িত্ব যথাযথরূপে পালন করা, সেই যুগে হযরতের কথা ও কাজের আলোকে নিজের কথা ও কাজের হিসাব মিলাইবার জন্য সাধারণভাবে সকলকে আহবান জানান সাধারণ ব্যাপার নহে। বিশেষতঃ যাহারা প্রত্যক্ষভাবেই রাসূলে করীম (স)-এর কথা ও কাজ সম্পর্কে পূর্ণরূপে ওয়াকিফহাল এবং যাহাদের মধ্যে কোন বিরাট ব্যক্তিসম্পন্ন লোকেরও সমালোচনা করার দুরন্ত সাহস ও যোগ্যতা পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান রহিয়াছে,তাহাদের সম্মুখে উক্তরুপ চ্যালেঞ্জ পেশ করা অত্যন্ত দুঃসাহসের ব্যাপার, সন্দেহ নাই। কিন্তু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) প্রকৃতই এই দুঃসাহস প্রদর্শন করিয়াছেন এবং তিনি যে বিশ্বনবীর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দায়িত্ব যতখানি পালন করা সম্ভব ততখানিই করিয়াছেন, ইতিহাসই তাহার অকাট্য সাক্ষী। ইহার সত্যতা প্রমাণের জন্য হযরত আবূ বকর (রা)-এর পরবর্তী শ্রেষ্ট মানব হযরত উমর (রা)-এর একটি বাক্য উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁহার (আবূ বকর সিদ্দীকের) অপূর্ব কীর্তিকলাপ দর্শনে মুগ্ধ-বিহম্বল হইয়া অত্যন্ত আফসোস মিশ্রিত কণ্ঠে বলিলেনঃ
ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমত করার বাস্তব নমুনা ও মাপকাঠি যদি ইহাই হয় যাহা আপনি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, তাহা হইলে আপনার পরবর্তী লোকদের মধ্যে আপনার সমান মর্যাদা অর্জনের হিম্মত কাহারো হইবে না।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যখন খলীফা নিযুক্ত হইলেন, তখন তিনি কোন সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন নাই। সত্য কথা এই যে, নবুয়্যাত যুগের পরে স্বয়ং তাহাকেই নূতনভাবে ইসলামী হুকুমতের গোড়া পত্তন করিতে হইয়াছে। এই জন্যই একটি নব-প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সম্মুখে যত সমস্যা, জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হইতে পারে, উহার সবই তাঁহার সম্মুখে পর্বতসমান উঁচু হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই সব জটিলতার সুষ্ঠু সমাধান করা সকল শাসকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে আল্লাহ্র নিকট হইতে রাষ্ট্র পরিচালনার বিশেষ যোগ্যতাপ্রাপ্ত লোকেরাই ইহা সঠিকরুপে সম্পন্ন করিতে পারে। প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) স্বভাবতই এইরুপ যোগ্যতার ধারক ছিলেন। এই কারণে বিশ্বনবীর ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই মুসলিম মিল্লাত যে কঠিন সমস্যাবলীর সম্মুখীন হইয়াছিল, হযরত আবূ বকর (রা) তাঁহার অপরিসীম যোগ্যতা-দক্ষতার বদৌলতে উহার সব কিছুরই সুষ্ঠু সমাধান করিয়া লইয়াছিলেন। তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে যেভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক পর্যায়ের যাবতীয় হুমকি ও চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, প্রশাসনিক বিষয়াদিতে যে অপূর্ব দক্ষতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন,রাষ্ট্রপরিচালনার ইতিহাসে উহার দৃষ্টান্ত নিঃসন্দেহে বিরল। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা করা এখানে সম্ভব নয়;তবে সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা যাইতেছে।
(১) বিশ্বনবীর ইন্তেকালের যে প্রতিক্রিয়া আনসারদের উপর প্রতিফলিত হইয়াছিল এবং হযরত আবূ বকর (রা) যে গভীর বুদ্ধিমত্তা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের দ্বারা সমগ্র প্রতিকূল ও বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আয়ত্তে আনিয়াছিলেন, ইতিপূর্বে আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করিয়াছি। সকিফায়ে বনী সায়েদায় হযরত আবূ বকর (রা)-এর হস্তে খিলাফতের বায়’আত গ্রহণের পর যদিও আনসারদের পক্ষ হইতে কোনরূপ বিদ্রোহাত্মক পদক্ষেপের আশংকা ছিল না; কিন্তু আনসার নেতা সায়াদ-বিন-উবাদার বায়’আত গ্রহণে অস্বীকৃতির পরিণাম মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করিতে পারে বলিয়া মনে করা হইয়াছিল। কোন কোন লোক অনতিবিলম্বে তাঁহার সম্পর্কে নিবর্তনমূলক নীতি গ্রহণেরও পরামর্শ দিয়াছিল। কিন্তু হযরত আবূ বকর (রা) ইহাকে সাময়িক আবেগ-উচ্ছ্বাস মনে করিয়া উপেক্ষা করার নীতিই গ্রহন করেন। তিনি তখনি এই ধারণা করিয়াছিলেন যে, সায়াদের বিরুদ্ধে কোনরূপ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হইলে সমগ্র আনসার গোত্র বিক্ষুব্ধ হইয়া পড়ার আশংকা রহিয়াছে আর তাহা না করিলে কেবলমাত্র ছায়া ভিন্ন তাহার সঙ্গী আর কেহই হইবে না। হযরত আবূ বকর (রা)-এর এই চিন্তা তখনকার অবস্থায় বাহ্যতঃভুল মনে করা হইয়াছিল; কিন্তু উত্তরকালে অবস্থার গতিধারা প্রমাণ করিয়াছিল যে, হযরত আবূ বকর (রা)-এর মত-ই ছিল নির্ভুল ও সঠিক। উপরন্তু এই অবস্থায় তাঁহার সিদ্ধান্তের বিপরীতে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হইলে উহার পরিণতি অত্যন্ত মারাত্মক হইত।
(২) আঁ-হযরতের ইন্তেকালের পর নবী করীম (স)-এর পরিবারের মনে হযরত আবূ বকর (রা) এবং তাঁহার হুকুমত সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণার সৃষ্টি হইয়াছিল। উহার ফলে বেশ কিছু রাজনৈতিক জটিলতাও মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছিল। রাসূল পরিবারের লোকদের সহিত মুসলিম জনগণের সম্পর্ক অত্যন্ত নাজুক আবেগময়(emotional) ও সংবেদনশীল(Sensitive)ছিল। হযরত আবূ বকর(রা) ও এই দিক দিয়া কিছুমাত্র পশ্চাদপদ ছিলেন না। কিন্তু এই সব সম্পর্কেরই ঊর্ধ্বে ছিল তাঁহার একটি বিরাট কর্তব্যবোধ, যাহার সংরক্ষণের জন্য তিনি আল্লাহ্ ও জনগণ উভয়ের নিকটই দায়ী ছিলেন। এই দ্বিমুখী ভাবধারার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে হযরত আবূ বকর (রা)-এর যে মানসিক উদ্বেগ প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল, উহা তাঁহার তৎকালীন কয়েকটি ভাষণ হইতে সুস্পষ্টরুপে বুঝিতে পারা যায়। তিনি হযরত ফাতিমা (রা), হযরত আলী(রা) ও হযরত আব্বাস (রা)-এর সহিত সাধারণ রাজনৈতিক কলা-কৌশল অবলম্বন করিতে পারিতেন না। কেননা তাহা করা হইল মুসলমানদের আবেগ-উচ্ছ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত হইত বলিয়া রাজনৈতিক দৃষ্টিতেও অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করিত। আর একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ব্যক্তি হিসাবে তিনি নিজেও তাহা কামনা করিতে পারিতেন না। অপর দিকে খিলাফত ইত্যাদির ব্যাপারে তাঁহাদের দৃষ্টিকোণ সমর্থন করাও তাঁহার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেননা তাহা করিলে তিনি শরীয়াতের খেলাফ করিবেন বলিয়াই তাঁহার বিশ্বাস ছিল। সর্বোপরি, রাসূল পরিবারের কোন কোন সদস্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর হস্তে তহন পর্যন্ত বায়’আত করেন নাই বলিয়া খিলাফতের মর্যাদা অনেকখানি ব্যাহত হইতেছিল। উপরন্তু এইরূপ পরিস্থিতিতে ইসলামের দুশমনদের পক্ষ হইতে যে কোন মুহূর্তে কঠিন বিপর্যয় সৃষ্টিরও আশংকা একেবারে কম ছিল না। এইসব কিছুই দিবালোকের মত সুস্পষ্ট ছিল;কিন্তু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যেমন গণ-আবেগের বিপরীত কিছু করেন নাই, তেমনি শরিয়াতের দৃষ্টিতে যে কর্মনীতি গ্রহন করা উচিত ছিল, তাহাই তিনি অবলম্বন করিয়াছেন। এই দিক দিয়া সর্বাপেক্ষা সান্তনার ব্যাপার এই ছিল যে, এই বিরোধে বনু হাশিম গোত্রের নেতা ছিলেন হযরত আলী(রা) আর তিনি কোন ব্যাপার মতবিরোধ ত করিতে পারেন; কিন্তু তাঁহার দ্বারা কোন প্রকার বিপর্যয় সৃষ্টি যে সম্ভব ছিল না, তাহা ছিল সন্দেহাতীত। ঠিক এই কারণেই হযরত আবূ বকর (রা) অসীম উদার নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন। আর তাঁহার অবলম্বিত নীতিই যে পূর্ণ মাত্রায় বিজ্ঞান-ভিত্তিক ও সত্যাশ্রয়ী ছিল, ইতিহাসই তাহার সাক্ষী।
(৩) হযরত আবূ বকর (রা) যখন খলীফা নিযুক্ত হন, তখন দেশের সার্বিক অবস্থা যারপরনাই খারাপ ছিল। বাহির হইতে রোমকদের আক্রমণের যেমন ভয় ছিল প্রতিটি মুহূর্তে, তেমনি আভ্যন্তরীণ দিক হইতে মক্কা, মদীনা ও তায়েফ ব্যতীত অবশিষ্ট প্রায় সমগ্র আরবে ইসলাম-ত্যাগ ও যাকাত অস্বীকার করার হিড়িক পড়িয়া গিয়াছিল। এতদ্ব্যতীত বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা নবুয়্যাতের দাবিদার ও ধন-সম্পত্তির লোভী ব্যক্তিরাও মাথাচাড়া দিয়া উঠে। দেখিতে দেখিতে ইহাদের সমর্থক সংখ্যাও বৃদ্ধি পাইতে থাকে। অপরদিকে তাবুক ও মূতা’র যুদ্ধ মুসলমান ও রোমকদের মধ্যে এক অন্তহীন সংঘাতের সূচনা করে। রোমকগণ প্রতি মুহূর্তেই মুসলমানদের উপর আক্রমন-উদ্যত হইয়াছিল;মুতা’র যুদ্ধে মুসলমানদের পশ্চাদপসারণের কারণে তাহাদের হিম্মত অধিকতর বৃদ্ধি পায়। এইরূপ অবস্থায় খিলাফতের আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং দেশের প্রধান অঞ্চলসমূহে বিদ্রোহের অগ্নুৎগীরণের সংবাদ প্রচারিত হইলে তাহারা অনতিবিলম্বেই যে মদীনার উপর আক্রমন করিতে পারে, তাহা ছিল এক সাধারণ সত্য কথা। মূলতঃএই দুইটি বিপদ ছিল পূর্ব হইতেই বর্তমান এবং হযরত আবূ বকর (রা)-এর খলীফা নিযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাকে এই উভয় বিপদের সহিত মুকাবিলা করিতে হইয়াছে। এই পরিস্থিতিতেকি অসাধারণ সাহস-হিম্মত ও কি অপূর্ব বুদ্ধি-বিবেচনা সহকারে বিপ দুইটির মুকাবিলা করিয়া তিনি বিপুলভাবে জয়লাভ করেন, তাহা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।।
তিনি খলীফা নিযুক্ত হইয়াই সর্বপ্রথম রোমকদের উপর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত সৈন্যবাহিনীকে রওয়ানা করাইয়া দিলেন। বস্তুতঃহযরত নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশায়ই এই বাহিনীকে হযরত উসামা বিন জায়েদের নেতৃত্বে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; কিন্তু হযরতের আকস্মিক রোগাক্রান্ত হইয়া পড়ার কারণে তখনকার মত যাত্রা স্থগিত রাখা হয়। হযরতের ইন্তেকালের পর এই বাহিনী প্রেরণের ব্যাপারে বিপুল সংখ্যক সাহাবী বিপরীত মত পোষণ করিতে শুরু করেন। কেহ কেহ বিদ্যমান আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দিক দিয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে এইরূপ বাহিনীকে রাজধানীর বাহিরে প্রেরণ করা অদূরদর্শীতার কাজ হইবে বলিয়া যুক্তি প্রদর্শন করে। কাহারও পক্ষ হইতে আবার ক্রীতদাস বংশজাত হযরত উসামার অধিনায়কত্ব সম্পর্কেও আপত্তি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এই সব বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অবিচলভাবে স্বীয় নীতিতে দণ্ডায়মান রহিলেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিলেনঃ ‘যে ঝাণ্ডা রাসূলে করীম নিজে উন্নত করিয়াছেন, আমি তাহা অবনমিত করিতে পারিব না’। তিনি বিরোধী মত পোষণকারীদের প্রস্তাবের জওয়াবে বলিলেনঃ ‘কুকুর ও শৃগালও যদি আমাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলে,তবুও আমি রাসূলের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাতিল করিতে পারিব না। রাসূল যাহাকে নিযুক্ত করিয়াছেন, আমি তাহাকে কিরূপে পদচ্যুত করিব।
মোটকথা, এইসব বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও হযরত আবূ বকর (রা) হযরত উসামার নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী রওয়ানা করাইয়াই ছাড়িলেন। বস্তুতঃখলিফাতুল মু’মিনীনের এই অপরিসীম দৃঢ়তা ও মনোবলের ফলেই আল্লাহ্র অসীম রহমত নাজিল হয়। উসামার নেতৃত্বে প্রেরিত সৈন্যবাহিনী বিপুল শান-শওকতপূর্ণ জয়লাভ করিয়া মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে। ইহার ফলে আভ্যন্তরীণ দুশমনগণ অত্যন্ত বিস্মিত ও সন্ত্রস্ত হইয়া পড়ে এবং বৈদেশিক শত্রুগণও হইয়া পড়ে অত্যন্ত ভীত ও শঙ্কিত। আরবের বিদ্রোহী গোত্রসমূহ যখনরোমকদের বিরুদ্ধে এই সৈন্য প্রেরণের সংবাদ শুনিতে পাইল, তখন তাহারা মদীনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত বিরাট শক্তির পরিচয় পাইয়া প্রকম্পিত না হইয়া পারিল না।। অপর দিকে হিরাকল স্বীয় রাষ্ট্রের সীমান্ত সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িল।এক কথায়, হযরত আবূ বকর (রা) একই প্রস্তর নিক্ষেপে দুইটি শিকার করিলেন এবং একথা অনস্বীকার্য যে, তাঁহার এই পরিকল্পনা পূর্ণমাত্রায় সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছিল।
বহিরাক্রমণের বিপদ দূরীভূত হওয়ার পর অবশিষ্ট শক্তি প্রয়োগ করিয়া হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) অত্যন্ত দৃঢ়তা সহকারে আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ-প্রতিবিপ্লব চূর্ণ করিয়া দেন-যদিও সাহাবীদের এক প্রভাবশালী দলের কিছু লোক এই ব্যাপারে উদার নীতি পোষণ করা ও কঠোরতা অবলম্বন না করারই পক্ষে মত পোষণ করিতেন। তাঁহারা বলিতেনঃযাহারা নিজদিগকে মুসলমান বলিয়া পরিচয় দেয়, তাহারা শুধু যাকাত দিতে অস্বীকার করে বলিয়াই তাহাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করা ও জানমালের হেফাজত হইতে তাহাদিগকে বঞ্চিত করা উচিত হইবে না। কিন্তু হযরত আবূ বকর (রা) তাঁহাদের এই দৃষ্টিকোণ কিছুতেই সমর্থন করিতে পারিলেন না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলিলেনঃইসলামে নামায ও যাকাত সমপর্যায়ভুক্ত ইবাদত, কাজেই নামায কায়েমের জন্য যদি যুদ্ধ করা যায় তাহা হইলে যাকাত অনাদায়কারীদের বিরুদ্ধে কেন লড়াই করা যাইবে না?তিনি ঘোষণা করিলেনঃ ‘আল্লাহ্র শপথ, যাহারাই নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি করিবে (নামায পড়িবে ও যাকাত দিবেনা), রাসূলের যুগে যে সব জিনিসের যাকাত দেওয়া হইত তাঁহার একটি রশিও আজ দিতে যাহারা অস্বীকার করিবে,আমি তাহাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করিব। ‘তিনি আরো বলিলেনঃ ‘এই জিহাদে যদি কেহই আমার সঙ্গী না হয়, তবুও আমি একাকীই লড়াই করিব’।
হযরত আবূ বকর (রা)-এর এই নিরাপোষ ও অনমনীয় মনোভাবের ফলেই সমগ্র মুসলমানের হৃদয়ে নবতর কর্মপ্রেরণা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং অত্যল্প কালের মধ্যেই খিলাফত-রাজ্য হইতে সকল প্রকার বিদ্রোহ-প্রতি বিপ্লব মূলোৎপাটিত হয়। এই প্রসঙ্গে সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় ব্যাপার এই যে, বিদ্রোহের পরিধির অত্যন্ত ব্যাপক আকার ধারণ, মদীনীয় সরকারের চারদিকে বহুবিধ জটিল সমস্যার পরিবেষ্টন এবং সর্বোপরি বিদ্রোহীদের প্রতি বিপুল সংখ্যক আপন লোকদের উদার নীতি অবলম্বনের পক্ষপাতী হওয়া সত্ত্বেও হযরত আবূ বকর (রা) এক বিন্দু দমিত হন নাই, বরং সমঝোতা ও উদার নীতি গ্রহণের সকল প্রস্তাবই তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। কতখানি আত্মবিশ্বাস ও আল্লাহ্র প্রতি নিঃশংক ভরসা থাকিলে এই রূপ সাংঘাতিক পদক্ষেপ গ্রহন করা যাইতে পারে, তাহা সুধীমাত্রেই অনুভব করিতে পারেন।বস্তুত এহেন সংকটপূর্ণ মুহূর্তে হযরত আবূ বকর (রা) যদি এইরূপ অটল মনোভাবের পরিচয় না দিতেন বরং ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ-প্রতিবিপ্লবে ভীত শঙ্কিত হইয়া বিদ্রোহী ও ইসলাম-ত্যাগীদের সম্মুখে অস্ত্র সংবরণ করিতেন, তাহা হইলে ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার নাম পর্যন্ত ইতিহাসের পৃষ্ঠা হইতে মুছিয়া যাইত, তাহাতে একবিন্দু সন্দেহ থাকিতে পারে না। আর তাহাই যদি হইত-তাহা হইলে বিশ্ব-সভ্যতার ইতিহাস আজ সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে লিখিত হইত;বরং বিশ্ব-সভ্যতার গতিই স্তদ্ধ হইয়া যাইতে বাধ্য হইত, তাহা সন্দেহাতীত। হযরত আবূ বকর (রা)-এর এই কঠোরভাবে ভূমিকা ও অনমনীয় আদর্শবাদী পদক্ষেপের ফলে ইসলামী সভ্যতায় যে প্রবল জোয়ার আসিয়াছিল, মাত্র সোয়া দুই বৎসরের শাসনকালেই তাহা সমগ্র আরব দেশকে পরিপ্লাবিত করিয়া এবং প্রতিবেশী ইরাক রাজ্যকে পরিসিক্ত করিয়া ও অন্যান্য দেশের উপর হইতে প্রবাহিত হইতে শুরু করিয়াছিল। একটি নবতর সভ্যতার এত আকস্মিক ও সল্পসময়ের মধ্যে এইরূপ ব্যাপকতা,সম্প্রসারণ ও অগ্রগতি লাভের কোন দৃষ্টান্তই বিশ্ব-ইতিহাসে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।
বস্তুতঃহযরত আবূ বকর (রা)-এর নায় মহান চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি যখন কোন রাষ্ট্রের পরিচালক হয় তখনই সেই রাষ্ট্রের অধিবাসী কোটি জনগণের উন্নতি ও সার্বিক কল্যাণই শুধু নয়, ইসলামেরও সমৃদ্ধি ও প্রতিপত্তি অর্জন সম্ভব হইতে পারে।