হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফত
হযরত উসমান (রা)-এর বয়স যখন চৌত্রিস বৎসর, তখন মক্কা নগরে দ্বীন-ইসলামের দাওয়াত সূচিত হয়। তদানীন্তন সামাজিক নিয়ম-প্রথা,আচার-আচরণ এবং আরবের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে হযরত উসমান (রা)-এর নিকট তওহীদের দাওয়াত প্রথম পর্যায়ে নিতান্তই অপরিচিত থাকিয়া গিয়াছিল। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি তাঁহার ব্যক্তিগত পবিত্রতা,সত্যানুসন্ধিৎসা ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে দ্বীন-ইসলামের দাওয়াত কবুল করার প্রস্তুত হইয়াছিলেন।
ইসলাম গ্রহন
নবুয়্যাতী মিশনের প্রথম পর্যায়েই হযরত আবূ বকর (রা) ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন।ইহার পরই তিনি ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমে তিনি তাঁহার বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের মধ্যে ইসলামী দাওয়াতের প্রচার শুরু করেন। হযরত উসমান (রা)-এর সাথে তাঁহার গভীর সম্পর্ক এবং পরিচিত ছিল। একদিন তিনি তাঁহার নিকট ইসলামী দাওয়াতের ব্যাখ্যা পেশ করেন। হযরত উসমান (রা)সবকিছুই শুনিয়া এই মহাসত্যের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করিলেন এবং নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া ইসলাম কবুল করার জন্য প্রস্তুত হইলেন। পথিমধ্যে নবী করীম (স) সহিত সাক্ষাৎ হইলে তিনিও উসমানকে ইসলাম কবুল করার জন্য মর্মস্পর্শী ভাষায় আহ্বান জানাইলেন। এই ঘটনার প্রসঙ্গে হযরত উসমান (রা) বলিলেনঃ “রাসূলে করীমের (স)-এর মুখ-নিঃসৃত কথা কয়টি শুনিবার সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদয়ে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হইল। তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমি শাহাদাতের কালেমা পাঠ করিতে শুরু করিয়া দিলাম এবং রাসূলে করীম (স)-এর হাতে হাত দিয়া ইসলাম গ্রহণ করিলাম’।
হযরত উসমান (রা) মক্কার অন্যতম শক্তিশালী উমাইয়া বংশের লোক ছিলেন। আর গোটা বংশটিই ছিল রাসূলে করীম (স)-এর বংশ বনু হাশিমের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিরুদ্ধবাদী। উমাইয়া বংশের লোকেরা রাসূলে করীম (স)-এর উত্তরোত্তর সাফল্য ও বিজয় লাভে বিশেষভাবে ভীত ছিল। কেননা উহার ফলে সমগ্র নেতৃত্ব ও প্রাধান্য উমাইয়া বংশের হস্তচ্যুত হইয়া বনু হাশিম বংশের হস্তগত হওয়ার প্রবল আশংকা ছিল। তদানীন্তন গোত্রবাদি সমাজে এই ব্যাপারটি যে কতটা সাংঘাতিক ছিল, গোত্রবাদের ধর্ম ও চরিত্র সম্পর্কে অবহিত লোকেরাই তাহা সহজেই অনুধাবন করিতে পারেন। কিন্তু হযরত উসমান (রা)-এর হৃদয়-দর্পণ বংশীয় ও গোত্রীয় হিংসাদ্বেষের কলুষ-কালিমা হইতে মুক্ত ও স্বচ্ছ ছিল বলিয়া শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ইসলাম গ্রহণ করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া দাড়ায় নাই। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন তখন মুসলমানদের মোট সংখ্যা ছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ কিংবা ছত্রিশ।
তাঁহার ইসলাম গ্রহণের পর নবী করীম (স) নিজেই আগ্রহী হইয়া তাঁহার কন্যা হযরত রুকাইয়া (রা)-র সহিত হযরত উসমান (রা)-এর বিবাহ সম্পন্ন করেন।
হিজরাত
মক্কা নগরে ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রসার ও শক্তি বৃদ্ধি ঘটিতে দেখিয়া মুশরিক সমাজ খুবই চিন্তান্বিত ও বিচলিত হইয়া পড়িল। তাহাদের ক্রোধ ও অসন্তোষ ক্রমশঃতীব্র হইতেও তীব্রতর হইয়া উঠিতে লাগিল। ইহার ফলে হযরত উসমান (রা)স্বীয় ব্যক্তিগত গুণগরিমা ও বংশগত মানমর্যাদা সত্ত্বেও ইসলামের জন্য অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করিতে বাধ্য হন। ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করার জন্য তাঁহার চাচা নিজে তাঁহাকে বাঁধিয়া রাখিত ও নির্মমভাবে প্রহার করিত। আত্মীয়স্বজনের মধ্য হইতে তেমন কেহই তাঁহাকে এই অবস্থা হইতে উদ্ধার করার জন্য আগাইয়া আসিতে প্রস্তুত হয় নাই। তাঁহার উপর এই অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশঃবৃদ্ধি পাইতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ইহা হযরত উসমান (রা)-এর পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠে। অবশেষে তিনি নবী করীম (স)-এর ইংগিতে একটি কাফেলা লইয়া সপরিবারে আবিসিনিয়ায় (ইথিওপিয়া) হিজরাত করিয়া গেলেন। কেবলমাত্র সত্য দ্বীন ও সত্য আদর্শের জন্য এই কাফেলাটি স্বদেশবাসীদের ত্যাগ করিয়া এক অজানা পথে রওনা হইয়া গেল।
আবিসিনিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইয়া যাওয়ার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত নবী করীম (স) তাঁহাদের সম্পর্কে কোন সংবাদ জানিতে পারেন নাই। এই কারণে তিনি খুবই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হইয়াছিলেন। কিছুদিন পর তিনি যখন তাঁহাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছার সংবাদ জানিতে পারিলেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলিয়া উঠিলেনঃ
*******(আরবী)
‘এই জাতির মধ্য হইতে উসমানই সপরিবারে সর্বপ্রথম হিজরাতকারী ব্যক্তি’।
হযরত উসমান (রা) আবিসিনিয়ায় কয়েক বৎসর পর্যন্ত অবস্থান করেন। সেখান হইতে প্রত্যাবর্তনের পর কিছুদিন যাইতে না যাইতেই মদীনায় হিজরাত করার আয়োজন সুসম্পন্ন হয়। তখন উসমান (রা)-ও সপরিবারে মদীনায় চলিয়া গেলেন। হযরত উসমান (রা) ইসলাম ও কুফরের প্রথম সম্মুখ-সংঘর্ষে অর্থাৎ বদর যুদ্ধে যোগদান হইতে ঘটনাবশতঃই বিরত থাকিতে বাধ্য হন। এই যুদ্ধের সময় তাঁহার স্ত্রী নবী-তনয়া রুকাইয়া (রা) কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়া পড়েন। এই কারণে নবী করীম (স)তাঁহাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি না দিয়া রোগিনীর সেবা-শুশ্রূষা করার দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু এই দুঃখে তিনি ভারাক্রান্ত হইয়া সারাটি জীবন অতিবাহিত করেন। ইসলামের প্রথম সমরে শরীক হইতে না পারার বেদনা তিনি জীবনে মুহূর্তের তরেও ভুলিতে পারেন নাই।
কিন্তু ইহার পর যে কয়টি যুদ্ধই সংঘটিত হইয়াছে, উহার প্রত্যেকটিতেই তিনি পূর্ণ সাহসিকতা ও বীর্যবত্তা সহকারে রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গী হইয়াছেন। ষষ্ঠ হিজরী সনে নবী করীম (স) কা’বা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সদলবলে মক্কার পথে রওয়ানা হইয়া যান। পথিমধ্যে হুদাইবিয়া নামক স্থানে কাফেলাটি প্রতিরুদ্ধ হইলে নবী করীম (স)উসমান (রা)-কে রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাফির মুশরিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার দায়িত্ব দিয়া মক্কায় প্রেরণ করেন। মক্কায় তাঁহাকে কাফির মুশরিকরা অবরুদ্ধ করিয়া ফেলে। কয়েকদিন পর্যন্ত তাঁহার সম্পর্কে কোন সংবাদ জানিতে না পারায় নবী করীম (স) এবং মুসলমানগণ বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হইয়া পড়েন। এই সময় চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়ে যে, হযরত উসমান (রা)-কে শহীদ করা হইয়াছে। এই খবর শুনা মাত্রই নবী করীম (স) ইহার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সঙ্গের চৌদ্দশত সাহাবীর নিকট হইতে বায়’আত গ্রহণ করেন।ইসলামের ইতিহাসে ইহা ‘বায়’আতে রিজওয়ান’- আল্লাহ্র সন্তোষলাভে চরম আত্মোৎসর্গের প্রতিশ্রুতি- নামে অভিহিত ও স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হইয়া রহিয়াছে।
খলীফারূপে নির্বাচন
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর পর হযরত উমর ফারুক (রা) দীর্ঘ দশটি বৎসর পর্যন্ত ইসলামী খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অজ্ঞাতনামা আততায়ীর ছুরিকাঘাতে আহত হইয়া পড়িলে জীবনের সায়াহ্নকালে পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্য-বিশিষ্ট একটি বোর্ড গঠন করিয়া দেন। হযরত আলী, হযরত উসমান, হযরত জুবাইর, হযরত তালহা, হযরত সায়াদ, হযরত সায়াদ ইবনে আক্কাস এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) এই বোর্ডের সম্মানিত সদস্য ছিলেন। তিন দিনের মধ্যেই খলীফা নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করার জন্যও এই বোর্ডকে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর কাফন-দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া হয়। দুইদিন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ-আলোচনা, মত বিনিময়, জনমত যাচাই ইত্যাদি কাজে অতিবাহিত হইয়া যায়। তৃতীয় দিনে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা)-এর প্রস্তাবক্রমের হযরত উসমান (রা)-কে খলীফা নির্বাচন করা হয়। সমবেত সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হযরত আলী (রা) সর্বপ্রথম তাঁহার হাতে ‘বায়’আত’ করেন। অতঃপর উপস্থিত জনতা বায়’আতের জন্য ভাঙিয়া পড়ে। এইভাবে ২৪ হিজরী সনের মুহাররম মাসের ৪ তারিখ সর্বসম্মতিক্রমে হযরত উসমান (রা) খলীফা পদে বরিত হন এবং খিলাফতে রাশেদার শাসনভার গ্রহণ করে।
খিলাফতের দায়িত্ব পালন
হযরত উমর ফারুক (রা) তাঁহার খিলাফত আমলে সিরিয়া, মিশর ও পারস্য জয় করিয়া সুসংবদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইয়াছিলেন। উপরন্তু শাসন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসন ব্যাবস্থায় তিনি একটা শাসনতান্ত্রিক কার্যবিধি প্রবর্তন করিয়া গিয়াছিলেন। এই কারণে হযরত উসমান (রা)-এর পক্ষে খিলাফতের দায়িত্ব পালন অনেকটা সহজ হইয়াছিল। এই কাজে তিনি যুগপৎ হযরত সিদ্দীকের নমনীয়তা, কোমলতা ও দয়ার্দ্রতা এবং হযরত উমর ফারুক (রা)-এর প্রশাসনিক দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও কঠোরতা অনুসরণ করিয়া চলিতেন। এক বৎসরকাল পর্যন্ত তিনি পূর্ববর্তী প্রশাসন ব্যাবস্থা অপরিবর্তিত রাখিয়াছিলেন। প্রাক্তন খলীফার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি হযরত সায়াদ ইবনে আক্কাস (রা)-কে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ইহা ছিল খলীফা হযরত উসমান (রা) কর্তৃক সম্পাদিত প্রথম নিয়োগ। পরে অবশ্য ২৬ হিজরী সনে তিনি তাঁহাকে পদচ্যুতও করিয়াছিলেন।
উসমানীয় খিলাফতের প্রথম বৎসরের মধ্যেই ত্রিপলি, আলজিরিয়া ও মরক্কো অধিকৃত হয়। ইহার ফলে স্পেনের দিকে মুসলমানদের অগ্রগতির দ্বার উন্মুক্ত হয়। সাইপ্রাসের উপর হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত আমলেই কয়েকবার সৈন্য অভিযান পরিচালনা করা হইয়াছিল। ২৮ হিজরী সনে হযরত আমীর মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে ভূ-মধ্য সাগরে অবস্থিত এই গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপটির উপর মুসলিম বিজয়ের পতাকা উড্ডীন হয়। এইভাবে হযরত উসমান (আ)-এর খিলাফত আমলে ইসলামী রাজ্য সীমার বিপুলে বিস্তৃত ও সম্প্রসারন সাধিত হয়। কাবুল, হিরা, সিজিস্তান ও নিশাপুরে এই সময়ই ইসলামী খিলাফতের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
হযরত উসমান (রা)-এর দ্বাদশ বর্ষীয় খিলাফত আমলের প্রথম ছয়টি বৎসর পূর্ণ শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে অতিবাহিত হয়। বহু দেশ নিয়া গঠিত বিশাল এলাকা ইসলামী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। বায়তুলমালে আয়ের পরিমাণ বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। কৃষি, ব্যবসায় ও প্রশাসন ক্ষেত্রের অসাধারণ উন্নতি জন-জীবনে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি আনিয়া দেয়। হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফতের উল্লেখযোগ্য অবদান হইল ইসলামের বিশাল সাম্রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থা উতরোত্তর দৃঢ়তর করিয়া তোলা এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধিমত্তা, নির্ভুল ব্যবস্থাপনা ও উত্তম কর্মনীতির সাহায্যে বিজিত জাতিসমূহের বিদ্রোহাত্মক ভূমিকা ও তৎপরতা দমন করিয়া শান্তিপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠা করা।
খলীফা হিসাবে হযরত উসমান (রা)-কে বহু সংখ্যক বিদ্রোহ দমন করিতে হইয়াছে। তাঁহার আমলে মিশরে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উত্তোলিত হয়, আর্মেনিয়া ও আযারবাইজান অঞ্চলের অধিবাসীরা ‘খারাজ’ দেওয়া বন্ধ করিয়া দেয়, খোরাসানবাসিরাও বিদ্রোহের মস্তক উত্তোলন করে। এইসব বিদ্রোহ ছিল বিজিত জাতিসমূহের মনে ধুমায়িত বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসামূলক বিষ-বাষ্পের বিস্ফোরণেরই পরিণতি। কিন্তু হযরত উসমান (রা) বিশেষ সতর্কতা ও বিচক্ষণতা সাহায্যে উহা দমন করিতে সক্ষম। কঠোরতা-কোমলতা সমন্বিত কর্মনীতি ফলে এই সমস্ত এলাকার জনগণ ইসলামী খিলাফতের আনুগত্য স্বীকার করিয়া লয়।
সামুদ্রিক বিজয়াভিযান হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফত আমলের একটি বিশেষ অবদান। হযরত উমর (রা)-র সতর্কতামূলক নীতির ফলে সে আমলে মুসলমানদিগকে বিপদসংকুল সামুদ্রিক পথে অভিযানে প্রেরণ শুরু হইতে পারে নাই। কিন্তু হযরত উসমান (রা)-এর দুঃসাহসিকতা বিপদ-শংকাকে সহজেই অতিক্রম করা সম্ভবপর করিয়া দিয়াছিল। তাঁহার নিখুঁত সমর পরিকল্পনার ফলে রোমান সম্রাটের পাঁচশতটি যুদ্ধ জাহাজ সমন্বিত বিশাল নৌ বাহিনীকে চরম পরাজয় বরণ করিতে বাধ্য করা হয়।
খিলাফতে শাসন পদ্ধতি
খিলাফতে রাশেদার শাসন-পদ্ধতি পরামর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসাবে আরম্ভ হইয়াছিল। হযরত উমর ফারুক (রা)এই ব্যবস্থাকে অধিকতর সুদৃঢ় ও সুসংবদ্ধও করিয়া তোলেন। হযরত উসমান (রা)-ও তাঁহার প্রাথমিক আমলে এই ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখেন। তবে শেষ পর্যায়ে বনু উমাইয়্যাদের অভ্যুত্থানের ফলে ইহাতে অনেক বিপর্যয় সূচিত হয়। হযরত উসমান উহা রোধ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাইতে থাকেন এবং এই উদ্দেশ্যে দায়িত্বশীল লোকদের দেওয়া যে কোন কল্যাণমূলক পরামর্শ তিনি নির্দ্ধিধায় গ্রহন করেন।
প্রসঙ্গতঃউল্লেখ্য যে, খিলাফতী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের মৌলিক অধিকার রক্ষা শাসকদের কর্মনীতি ও কার্যাবলীর প্রকাশ্য সমালোচনা করার নিরংকুশ অধিকার লাভ করিয়া থাকে। এই অধিকার এতটুকু হরণ করার ইখতিয়ার স্বয়ং খলিফাকেও দেওয়া হয় নাই। ইহা অনস্বীকার্য যে, হযরত উসমান (রা)-এর শেষ পর্যায়ে পরামর্শ ভিত্তিক ব্যবস্থায় কিছুটা ফাটল ধরিতে শুরু করিয়াছিল। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও গণ-অধিকার কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হইতে দেওয়া হয় নাই।
আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই সাধারণতঃ দায়িত্বহীন ব্যক্তিদের তুলনায় অধিকতর উত্তম ও নির্ভুল মতামত প্রকাশে সক্ষ হইয়া থাকেন। এই কারণে বর্তমান কালেও বিভিন্ন সভ্য ও উন্নত দেশে এই ধরণের পরামর্শমূলক সংস্থা গঠন করা হইয়া থাকে। হযরত উসমান (রা) চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে এই প্রয়োজন অনুভব করিয়া দায়িত্বশীল সরকারী কর্মচারীদের সমন্বয়ে এই ধরণের একটি পরামর্শ মজলিস গঠন করিয়াছিলেন। এই সংস্থার সদস্যদের নিকট হইতে সাধারণতঃলিখিত প্রস্তাবাবলী চাওয়া হইত। কুফা অঞ্চলে সর্বপ্রথম যখন শাসন-শৃঙ্খলায় উচ্ছৃংখলতা ও বিপর্যয় দেখা দেয়, তখন উহা নির্মূল করার উদ্দেশ্যে মজলিশ সদস্যদের নিকট হইতে লিখিত প্রস্তাবাবলী চাওয়া হইয়াছিল। মূল রাজধানীতেও মাঝে মাঝে এই ধরণের মজলিসের অধিবেশন আহ্বান করা হইত। ২৪ হিজরী সনে সমগ্র দেশের সার্বিক অবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন সাধন উদ্দেশ্যে রাজধানীতে এই মজলিসের যে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইয়াছিল, উহাতে এই পর্যায়ের অভিমতদানে সক্ষম অধিকাংশ দায়িত্বশীল কর্মচারীরা যোগদান করিয়াছিলেন।
প্রশাসন ব্যবস্থাকে অধিকতর সক্রিয় ও সুদৃঢ় করিয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশের প্রদেশ ও জিলাভিত্তিক বিভাজন ও পুনর্গঠন ছিল অত্যন্ত জরুরী কাজ। হযরত উমর ফারুক (রা) সমগ্র সিরিয়া অঞ্চলের দামেশক, জর্ডান ও ফিলিস্তিন এই এই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করিয়াছিলেন। হযরত উসমান (রা) এই সমস্ত অঞ্চল একজন গভর্নরের অধীন করিয়া একটি বিশাল বিস্তীর্ণ প্রদেশ বানাইয়াছিলেন। প্রদেশের এই পুনর্গঠন শাসন-শৃঙ্খলার দৃষ্টিতে খুবই ফলপ্রসূ হইয়াছিল। শেষকালে সমগ্র দেশ যখন বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার লীলাভূমিতে পরিণত হইয়াছিল, তখন সিরিয়ার সহিত সংশ্লিষ্ট জিলাসমূহ এই বিপর্যয় হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল।
হযরত উসমান (রা) সেনাধ্যক্ষের একটা নূতন পদ সৃষ্টি করিয়াছিলেন। ইহার পূর্ব পর্যন্ত প্রাদেশিক গভর্নরই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে অবস্থিত সেনাবাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব ও পালন করিতেন। ইহাতে কাজের বিশেষ অসুবিধা হওয়া অবধারিত ছিল।
খিলাফতে রাশেদার শাসন পদ্ধতিতে খলীফাই রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি প্রশাসন বিভাগের সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন। অধিনস্থ সমস্ত শাসনকর্তা ও প্রশাসন কর্মকর্তাদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা খলিফারই অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ। হযরত উসমান (রা) স্বভাবতঃই দয়ার্দ্র-হৃদয় ও নরম মেজাজের লোক ছিলেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধৈর্য,সহিষ্ণুতা,ক্ষমা ও তিতিক্ষার বাস্তব প্রতিমূর্তি ছিলেন তিনি। কিন্তু দেশ শাসন ও রাষ্ট্রীয় কার্যাদি সুসম্পন্ন করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও ক্ষমাহীন। কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ, খোঁজ খবর লওয়া এবং দোষত্রুটি পরিলক্ষিত হইলে কঠোর হস্তে উহার সংশোধন করা তাঁহার স্থায়ী কর্মনীতি ছিল। এইক্ষেত্রে কোন সম্মানিত কর্মচারীরাও যদি তেমন কোন দোষ ধরা পড়িত, তাহা হইলে তাহাকে পদচ্যুত করিতেও তিনি একবিন্দু কণ্ঠিত হইতেন না। বায়তুলমালের সম্পদ অপচয় ও আত্মসাৎকরণ এবং শাসনকর্তাদের বিলাসপূর্ণ জীবন যাপন তাঁহার দৃষ্টিতে ছিল ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
হযরত উসমান (রা) দেশের প্রশাসনযন্ত্র নিয়ন্ত্রন ও দোষত্রুটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে একটি কেন্দ্রীয় ‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠন করিয়াছিলেন এবং রাজধানীর বাহিরে সর্বত্র উহাকে পাঠাইয়া দিতেন। কমিটি সমগ্র অঞ্চল ঘুরিয়া ঘুরিয়া প্রশাসন কর্মকর্তাদের কাজকর্ম ও জনগণের অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করিত। এতদ্ব্যতীত দেশের সাধারণ অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অবহিতি লাভের উদ্দেশ্যে হযরত উসমান (রা) জুম’আর দিন মিম্বারে দাঁড়াইয়া খুতবা শুরু করার পূর্বেই উপস্থিত জনতার নিকট দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন। উপস্থিত লোকদের কথা তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে শুনিতেন। উপরন্তু সমগ্র দেশবাসীর নিকট সাধারণভাবে ঘোষণা করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, কোন প্রশাসকের বিরুদ্ধে কাহারো কোনোরূপ অভিযোগ থাকিলে হজ্জের সময় তাহা যেন খলীফার সম্মুখে পেশ করা হয়। কেননা এই সময় ইসলামী খিলাফতের সমস্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে মক্কা শরীফে বাধ্যতামূলকভাবে উপস্থিত থাকিতে হইত। এইভাবে লোকদের নিকট হইতে সামনা-সামনি অভিযোগ শ্রবণ ও উহার প্রতিকার সাধনের একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা হযরত উসমান (রা)-এর আমলে কার্যকর ছিল।
উল্লেখ্য, সাধারণ প্রশাসন ও শাসন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় এবং বিভিন্ন শাসন বিভাগের হযরত উমর ফারুক (রা) প্রবর্তিত সংস্থাসমূহে হযরত উসমান (রা) কোনরূপ পরিবর্তন আনেন নাই। তিনি বরং উহাকেই অধিকতর সুসংবদ্ধ ও শক্তিশালী করিয়া তোলেন। ইহার পরিণতিতে রাজস্ব আদায়ে বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়। ইহা ছাড়া নূতন অধিকৃত এলাকা হইতে রাজস্ব আদায়ের মাত্রা অনেক গুন বৃদ্ধি পায়। ফলে বায়তুলমালে ব্যয়ের খাত পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশী সমৃদ্ধ হইয়া উঠে এবং বৃত্তি ও ভাতা হিসাবে বিপুল অর্থ জনসাধারণের মধ্যে বণ্টন করা হয়। হযরত উসমান (রা)-এর আমলে খিলাফতের পরিধি যতই সম্প্রসারিত হইয়াছে, উন্নয়ন ও পুননির্মাণের কাজ ততই ব্যাপকতা লাভ করিয়াছে। এই সময় প্রাদেশিক সরকারগুলিকে বিভিন্ন অফিসের জন্য বহুসংখ্যক ইমারত নির্মাণ করা হয়। ইহার পাশাপাশি সড়ক, পুল ও মসজিদ নির্মাণের কাজও ব্যাপকভাবে চলিতে থাকে। দূরগামী যাত্রীদের জন্য বহুসংখ্যক সাধারণ মুসাফিরখানা স্থাপন করা হয়।
রাজধানীতে যাতায়াতের সব কয়টি পথ অধিকতর সহজগম্য ও আরামদায়ক করিয়া তোলা প্রশাসন ব্যবস্থার সুষ্ঠুতা বিধান ও জনগণের চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য একান্তই অপরিহার্য ছিল। হযরত উসমান (রা) ইহার জন্য যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ইহা ছাড়া তাঁহার উদ্যোগে মদীনা ও নজদের পথে পুলিশ-চৌকি স্থাপন করা হয় এবং মিষ্টি পানির জন্য কূপ খনন করা হয়। খায়বরের দিক হইতে কখনো কখনো বন্যার পানি আসিয়া মদীনাকে প্লাবিত ও নিমজ্জিত করিয়া দিত। ইহার ফলে শহরবাসীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইত। এমনকি মসজিদে নববীরও উহার দরুণ ধসিয়া পড়ার আশংকা দেখা দিয়াছিল। এই কারণে হযরত উসমান (রা) মদীনার অদূরে একটি বিরাট বাঁধ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। সাধারণ জনকল্যাণের দৃষ্টিতে হযরত উসমান (রা) নির্মিত এই ‘মাহজুর’ বাঁধ তাঁহার একটি উল্লেখযোগ্য অবদান।
মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ ও পুননির্মাণে হযরত উসমান (রা)-এর হস্তে খুবই প্রশস্ত এবং সুদক্ষ ছিল। নবী করীম (স)-এর সময় এই উদ্দেশ্যে সংলগ্ন ভূমি খরীদ করিয়া তিনি মসজিদের জন্য ওয়াকফ করিয়া দিয়াছিলেন, এতদ্ব্যতীত তাঁহার নিজের খিলাফত আমলেও এই কাজটি পুনর্বার সম্পাদিত হইয়াছে। এই সময় মসজিদ সম্প্রসারণের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল;কিন্তু মসজিদ সন্নিহিত ঘর-বাড়ির মালিক ও অধিবাসীরা মসজিদের নৈকট্য হইতে বঞ্চিত হওয়ার আশংকায় ইহাতে কোনক্রমেই প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া শুনাইয়া সম্মত করিবার জন্য হযরত উসমান (রা) অব্যাহতভাবে প্রচেষ্টা চালাইতে থাকেন। এইভাবে সুদীর্ঘ পাঁচটি বৎসর অতিবাহিত হইয়া যায়। কোনোরূপ বল প্রয়োগ বা প্রশাসন যন্ত্রের সাহায্যে জমি অধিগ্রহনের কাজ করিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। ২৯ হিজরী সনে সাহাবীগণের সহিত এই বিষয়ে বিশেষভাবে পরামর্শ করা হয়। ইহার পরিপ্রেক্ষিত হযরত উসমান (রা) জুম’আর দিন অত্যন্ত সংবেদনশীল কণ্ঠে জনতার সম্মুখে ভাষণ পেশ করেন। ভাষণে তিনি নামাজীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও মসজিদের সংকীর্ণতা জনিত সমস্যা বিশেষভাবে বুঝাইয়া বলেন। ভাষণ শ্রবণের পর লোকেরা সানন্দ চিত্তে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের ঘরবাড়ী ছাড়িয়া দিতে প্রস্তুত হন।
হযরত উমর ফারুক (রা) সামরিক বিভাগের জন্য যে ব্যবস্থাপনা করিয়া গিয়াছিলেন, হযরত উসমান (রা) উহাকে আরও উন্নত ও সম্প্রসারিত করেন। সামরিক বিভাগকে তিনিই সর্বপ্রথম প্রশাসন বিভাগ হইতে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র করিয়া গড়িয়া তোলেন। তাঁহার উদ্যোগে প্রতিটি কেন্দ্রীয় স্থানে সেনা সংস্থাকে একজন বিশেষ সামরিক কর্মকর্তার অধীনে ন্যস্ত করিয়া দেওয়া হয়। ফলে দূরবর্তী যে কোন স্থানে সামরিক বাহিনী প্রেরণের প্রয়োজন অত্যন্ত তড়িৎবেগে পূরণ করার সুষ্ঠু ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এই সময় ত্রিপলি, সাইপ্রাস, তিবরিস্তান ও আর্মেনিয়া অঞ্চলেও সামরিক ঘাঁটি সংস্থাপন করা হয়।
হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফত আমলে ঘোড়া এবং উহার উষ্ট্র পালন এবং উহার সংরক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়। এই উদ্দেশ্যে সমগ্র শাসনাধীন অঞ্চলে বিশাল চারণ ভূমি গড়িয়া তোলা হয়। রাজধানীর আশেপাশেও অসংখ্য চারণ ভূমি তৈয়ার করা হয় এবং চারণ ভূমির নিকটেই পানির ব্যবস্থা করা হয়।
দ্বীন-প্রচারের কাজ
খলীফা মূলত নবী করীম (স)-এর উত্তরাধিকারী, স্থলাভিষিক্ত এবং যাবতীয় সামষ্টিক দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্বশীল। তাঁহার বড় কর্তব্য হইল দ্বীনের যথাযথ খেদমত এবং উহার ব্যাপক প্রচার সাধন। হযরত উসমান (রা) এই দায়িত্ব পালনে সদা-সচেতন ও বিশেষ কর্তব্যপরায়ণ হইয়া থাকিতেন। প্রত্যক্ষ জিহাদে যে সব অমুসলিম বন্দী হইয়া আসিত, তাহাদের সম্মুখে তিনি নিজে দ্বীনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও উহার সৌন্দর্য প্রকাশ করিতেন এবং দ্বীন-ইসলাম কবুল করার জন্য তাহাদিগকে আহ্বান জানাইতেন। ইহার ফলে শত শত লোক ইসলাম গ্রহণ করিয়া মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হইবার বিপুল সুযোগ লাভ করে।
বিধর্মীদের নিকট ইসলাম প্রচার ছাড়াও স্বয়ং মুসলিম জনগণের ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার জন্যও তিনি ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন। দ্বীন সংক্রান্ত জরুরী মসলা-মাসায়েল তিনি নিজেই জনগণকে জানাইয়া দিতেন। কোন বিষয়ে দ্বীনের হুকুম তাঁহার নিকট অস্পষ্ট থাকিলে অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সাহাবীদের নিকট তিনি জিজ্ঞাসা করিয়া লইতেন ও তদনুযায়ী আমল করিতেন এবং লোকদিগকেও তাহা অনুসরণ করিয়া চলিবার জন্য নির্দেশ দিতেন। এই ব্যপারে তিনি কোনোরূপ দ্বিধা-সংকোচের প্রশ্রয় দিতেন না।
প্রয়োজনে তাগিদে ইসলামের মূল বিধানের উপর নির্ভর করিয়া নবতর ব্যবস্থা প্রবর্তন করিতেও হযরত উসমান(রা) দ্বিধা করিতেন না। মদীনার লোকসংখ্যা যখন বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাইল, তখন মসজিদের অভ্যন্তরে ইমামের সম্মুখে জুম’আর নামাযের একটি মাত্র আযানই যথেষ্ট মনে হইল না। এই কারণে তিনি উহার পূর্বে এক উচ্চস্থানে দাঁড়াইয়া জুমায়ার আর একটি আযান দেওয়ার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন।
এই পর্যায়ে হযরত উসমান (রা)-এর বড় অবদান হইল কুরআন মজীদকে সর্বপ্রকার মতবিরোধ ও বিকৃতি হইতে চিরকালের জন্য সুরক্ষিত করিয়া তোলার এক অতুলনীয় কার্যক্রম। আর্মেনিয়া ও আযারবাইজান অভিযানে মিশর, সিরিয়া, ইরাক প্রভৃতি অঞ্চলের মুজাহিদগণ একত্রিত হইয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই নও-মুসলিম, অনারব বংশোদ্ভুত এবং আরবী ভাষায় অনভিজ্ঞ ছিলেন। হযরত হুজাইফা ইবনে ইয়ামান (রা)-ও এই জিহাদে শরীক ছিলেন। তিনি নিজে এই দুই জিহাদে অংশ গ্রহণকারী মুসলিম মুজাহিদদের কুরআন পাঠের ধরণ ও ভঙ্গিতে মারাত্মক রকমের পার্থক্য ও বৈষম্য লক্ষ্য করিলেন। দেখা গেল, প্রত্যেক এলাকার লোকেরা নিজস্ব ইচ্ছানুসারে কুরআন পড়ে এবং উহাকেই কুরআন পড়ার একমাত্র ধরণ ও ভঙ্গী মনে করিয়া লইয়াছে। যুদ্ধ শেষে তিনি মদীনার উপস্থিত হইয়া খলীফা হযরত উসমান (রা)-এর নিকট সমস্ত ব্যাপার বিস্তারিতভাবে পেশ করিলেন। তিনি গভীর আশংকা প্রকাশ করিয়া বলিলেন, অনতিবিলম্বে এই বিরোধ ও পার্থক্য সম্পূর্ণ দূরীভূত করিয়া এক অভিন্ন ধরণ ও ভঙ্গীতে কুরআন পাঠের ব্যবস্থা করা না হইলে মুসলিম সমাজও খৃস্টান রোমানদের ন্যায় আল্লাহ্র কিতাবের ব্যাপারে নানা বিভেদ ও বিসম্বাদের সৃষ্টি করিয়া ছাড়িবে। হযরত হুযাইফা(রা)-এর দৃষ্টি আকর্ষণে হযরত উসমান (রা) ইহার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে বুঝিতে পারিলেন। তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রা)-এর নিকট হইতে কুরআন মজীদের মূল গ্রন্থ আনাইয়া হযরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) ও হযরত সায়াদ ইবনুল আ’স(রা) কর্তৃক উহার বহু সংখ্যক কপি তৈয়ার করাইয়া বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চলে পাঠাইয়া দিলেন এবং উহাকেই কুরআন মজীদের চূরান্তরুপ হিসাবে গ্রহণ ও অনুসরণ করার জন্য সর্বসাধারণকে নির্দেশ দিলেন। সেই সঙ্গে লোকদের ব্যক্তিগতভাবে লিখিয়া লওয়া কুরআনের সব কপি তিনি নিশ্চিহ্ন করিয়া ফেলিলেন।
বস্ততঃ হযরত উসমান (রা) যদি এই পদক্ষেপ গ্রহণ না করিতেন, তাহা হইলে তওরাত, ইনজিল ও অন্যান্য আসমানী গ্রন্থের ব্যাপারে উহাদের প্রতি বিশ্বাসী লোকেরা যে মারাত্মক ধরণের মতভেদ ও বৈষম্যে নিমজ্জিত হইয়াছে, শেষ নবীর উম্মতরাও অনুরূপ বিভেদ ও বৈষম্যে পড়িয়া যাইত এবং কুরআন মজীদেরও অনুরূপ দুর্দশা ঘটিত, ইহাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ নাই। তাই ইসলামের ইতিহাসে হযরত উসমান (রা)-এর এই মহান কীর্তি চিরকাল স্বর্ণক্ষরে লিখিত থাকিবে।