হযরত আলী (রা)-র খিলাফত
খলীফা নির্বাচন
হযরত উসমান (রা)-এর শাহাদাত বরণের পর তিনদিন পর্যন্ত খিলাফতের আসন শূন্য থাকে। এই সময় পরবর্তী খলীফার জন্য হযরত আলী (রা)-এর প্রতি জনগণের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। বহু লোক তাঁহাকে এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানায়। প্রথম দিকে তিনি স্পষ্ট ভাষায় অসম্মতি জানানো সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের পৌনঃপুনিক অনুরোধে এই দায়িত্ব গ্রহন করিতে তিনি সম্মত হন।
হযরত আলী (রা)-এর খলীফা নির্বাচিত হওয়ার বিবরণ ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবিস্তারে উল্লেখিত হইয়াছে। জনতা হযরত আলী (রা)র নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলঃ
*******(আরবী)
আমরা আপনার হাতে আনুগত্যের বায়’আত করিব, আপনি হাত প্রসারিত করিয়া দিন। কেননা এখন আমাদের একজন আমীর-রাষ্ট্রনায়ক-নিযুক্ত করা একান্তই অপরিহার্য। আর এই পদের জন্য আপনি অধিকতর যোগ্য ও অধিকারী।
হযরত আলী (রা) ইহার উত্তরে বলিলেনঃ
*******(আরবী)
এই ব্যাপারে কিছু বলার বা করার তোমাদের কোন অধিকার নাই। ইহাতো পরামর্শদানের যোগ্যতাসম্পন্ন ও বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী প্রাথমিক পর্যায়ের মুসলমানদের সম্মিলতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপার। তাঁহারা যাহাকে খলীফারূপে গ্রহণ করিবেন, তিনিই খলীফা হইবেন। অতএব চল, আমরা সকলে একত্রিত হই এবং বিষয়টি সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করি।
এই কথা শুনিয়া লোকেরা তাঁহার নিকট হইতে চলিয়া গেল। কিন্তু কিছুক্ষন পর তাহারা পুনরায় তাঁহার নিকট আসিয়া বায়’আত করার জন্য চাপ দিতে থাকে। তখন হযরত আলী (রা) বলিলেনঃ
******(আরবী)
তোমরা যদি ইহাই চাও যে, ‘আমি খলীফা হই ও তোমাদের নিকট হইতে আনুগত্যের বায়’আত গ্রহণ করি, তাহা হইলে মসজিদে নববীতে চল,সেখানেই এই বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা হইবে।
নিশ্চিন্ত কথা, আমাকে খলীফা নির্বাচন করা ও সেজন্য আনুগত্যের বায়’আত করা গোপনে অনুষ্ঠিত হইতে পারে না। ইহা অবশ্যই মুসলিম জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সন্তোষ ও অনুমোদনের ভিত্তিতেই হইতে পারে।
অতঃপর মসজিদে নববীতে সমবেত সর্বসাধারণ মুসলমানদের প্রস্তাবনা এবং স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও আনুমোদনের পর হযরত আলী (রা)-কেই পরবর্তী খলীফা নির্বাচিত করা হয় এবং ২১ শে যিলহজ্জ সোমবার দিন মসজিদে নববীতে বিপুল ইসলামী জনতার উপস্থিতিতে তাঁহারই হস্তে খিলাফতের সাধারণ বায়আত গ্রহণ করা হয়। তিনি বরিত হন খিলাফতে রাশেদার চতুর্থ খলীফা হিসাবে।
হযরত আলী (রা) যখন খিলাফতের দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে তুলিয়া নেন, তখন সমগ্র মুসলিম জাহান চরম অরাজকতা ও বিদ্রোহ-বিপ্লবের লীলাভূমিতে পরিণত হইয়াছিল। প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) কেও অনুরূপ এক অশান্তি ও বিদ্রোহ-বিপ্লবের সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল বটে; কিন্তু এই দুইটি অবস্থার মধ্যে বিরাট পার্থক্য ছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)কে যে বিপদের সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল,তাহা ছিল কাফিরী ও ইসলামত্যাগী এবং ইসলামের পারস্পরিক সংঘর্ষ। সমস্ত ইসলামী জনতা এই সংঘর্ষের খলীফার সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক ছিল। বিরুদ্ধবাদীরা ছিল বাতিলপন্থী,লালসা ও দুস্প্রবৃত্তির অনুসারী। তাহাদের মতের কোন স্থিতি বা দৃঢ়তা ছিল না। পক্ষান্তরে হযরত আলী (রা) কে যাঁহাদের বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল, তাঁহারা শুধু মুসলমানই ছিলেন না, বহু সংখ্যক সাহাবী এবং রাসূলে করীম (স)-এর সহধর্মিণী হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) পর্যন্ত তাঁহাদের মধ্যে শামিল ছিলেন। ইহাকে ভাগ্যের চরম পরিহাস ছাড়া আর কি-ইবা বলা যাইতে পারে।
কিন্তু এইসব বিপদ-আপদ, অশান্তি-উপদ্রব ও বিদ্রোহ-বিপ্লব সত্ত্বেও হযরত আলী(রা) অত্যন্ত দৃঢ়তা ও দুঃসাহসিকতা সহকারে খিলাফত তরুণীর হাল শক্ত করিয়া ধরিয়া রাখেন। এই সময় তিনি অপরিসীম ধৈর্য-সহিষ্ণুতা ও সুস্থ চিন্তা-বিবেচনার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন এবং নানাক্ষেত্রে ব্যর্থতার নিদর্শন লক্ষ্য করা সত্ত্বেও পরম বিশ্বাসপরায়ণতা, অবিচল আদর্শবাদিতা এবং ইসলামী শরীয়াত ও রাষ্ট্রনীতির মৌল বিধান হইতে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিও সহ্য করিতে সম্মত হন নাই। তিনি যদি নীতি ও আদর্শবাদ হইতে একচুল পরিমাণ বিচ্যুতিও সহ্য করিতে প্রস্তুত হইতেন, তাহা হইলে রাষ্ট্রনীতির বিচারে তিনি হয়ত সফলকাম বিবেচিত হইতেন;কিন্তু দ্বীন-ইসলামের মহান আদর্শ ক্ষুণ্ণ,বর্জিত ও পরিত্যক্ত হইত, ইহাতে কোনই সন্দেহ নাই। অথচ ইহাকে রক্ষা করাই হইল খলীফায়ে রাশেদ ও রাসূলে করীম (স)-এর স্থলাভিষিক্তের সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
খলিফারুপে হযরত আলী (রা)
খিলাফতের শাসন-ব্যবস্থা পরিচালনায় হযরত আলী (রা) হযরত উমর ফারুক (রা)-এর পদাংক অনুসরণের কৃত-সংকল্প ছিলেন এবং তৎকালে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাপনায় কোনোরূপ মৌলিক পরিবর্তন সাধনে কিছুমাত্র সম্মত ছিলেন না। হযরত উমর ফারুক (রা) সমগ্র হিজাজ হইতে নির্বাসিত যেসব ইয়াহুদীকে নাজরান নামক স্থানে পুনর্বাসিত করিয়াছিলেন, তাহারা হযরত আলী (রা)র নিকট উপস্থিত হইয়া অত্যন্ত কাতর ও বিনীত কণ্ঠে তাহাদের প্রাক্তন বসতিতে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি প্রার্থনা করে। কিন্তু হযরত আলী (রা) ইহাতে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকৃতি জানাইয়া বলিলেনঃ ‘হযরত উমর (রা) অপেক্ষা অধিক সুবিবেচক, বিচক্ষণ এবং সঠিক সিদ্ধান্তকারী আর কে হইতে পারে’?
দেশের আভ্যন্তরীণ শাসন-ব্যবস্থায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হইল, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং তাহাদের কার্যাবলী ও আচার-ব্যবহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ। হযরত আলী (রা) এই বিশেষ বিষয়টির উপর সব সময় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিতেন। তিনি কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে কাহাকেও নিয়োগ দান করার সময় অতীব মূল্যবান ও কল্যাণময় উপদেশাবলী প্রদান করিতেন। ইহা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে এইসব কর্মকর্তাদের কার্যাবলী ও আচার-ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষভাবে তদন্ত করাইতেন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে একবার হযরত কায়াব ইবনে মালিক (রা) কে নিযুক্ত করিয়া নিম্নোক্ত ভাষায় তাঁহাকে নির্দেশ দিলেনঃ
********(আরবী)
তুমি তোমার সঙ্গীদের একটি দল লইয়া রওয়ানা হইয়া যাও এবং ইরাকের প্রতিটি জিলায় ঘুরিয়া ফিরিয়া কর্মচারীদের কাজকর্ম এবং তাহাদের স্বভাব-চরিত্র ও আচার-ব্যবহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য কর। তিনি সরকারী কর্মচারীদের অপচয় ও ব্যয়বাহুল্য এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপারে তাহাদের অনিয়মতান্ত্রিকতা কঠোর হস্তে দমন করিতেন। বায়তুলমাল হইতে গৃহীত ঋণ যথাসময়ে আদায় করার জন্য কর্মচারীদের বিশেষভাবে কড়াকড়ি করিতেন। এই ব্যাপারে তিনি তাঁহার নিকটাত্মীয়দের প্রতি এতটুকু নমনীয়তা বা প্রীতি দেখাইতে প্রস্তুত ছিলেন না।
হযরত আলী (রা) রাজস্ব বিভাগের বিশেষ সংস্কার সাধন ও উন্নয়নমূলক নীতির প্রবর্তন করেন। রাজস্ব আদায়ে পূর্ণ কঠোরতা সত্ত্বেও সাধারণ জনগণের সার্বিক কল্যাণ ও সাধারণ অবস্থার উন্নয়ন সাধনে তিনি প্রতিনিয়ত যত্নবান ছিলেন। অক্ষম ও দরিদ্র জনতার প্রতি তিনি সব সময় অনুকম্পামূলক নীতি গ্রহণ করিতেন।
বস্তুত হযরত আলী (রা) ছিলেন জন-মানুষের জন্য আল্লাহ্র অপার রহমতের বাস্তব নিদর্শন ও জ্বলন্ত প্রতীক। তাহার খিলাফত আমলে সমাজের সাধারণ দীন-দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্য রাষ্ট্রীয় বায়তুলমালের দ্বার ছিল সদা উন্মুক্ত। বায়তুলমাল-এ যাহা কিছুই সঞ্চিত ও সংগৃহীত হইত, অভাবগ্রস্ত ও পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে তাহা তিনি অনতিবিলম্বে ও উদার হস্তে বণ্টন করিয়া দিতেন। দেশের অমুসলিম নাগরিকদের সহিত তিনি অত্যন্ত সহৃদয়তা ও সহানুভূতিপূর্ন আচরণ অবলম্বন করিতেন। এমন কি, বিদ্রোহ ভাবাপন্ন ও ষড়যন্ত্রকারীদের কার্যকলাপও অতীব ধৈর্য-সহিষ্ণুতা সহকারে বরদাশত করা হইত।পারস্য অঞ্চলে খলীফার অনুসৃত এই উদার নীতির চমৎকার অনুকূল প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গিয়াছিল।
হযরত আলী (রা) নিজে একজন সুদক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সমর-নায়ক ছিলেন। সামরিক বিষয় ও ব্যাপারাদিতে তাঁহার দূরদর্শীতা ও বিচক্ষণতা ছিল তুলনাহীন। এই কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের সামরিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বহু নবতর ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন তাঁহার পক্ষে সম্ভবপর হইয়াছিল।
হযরত আলী (রা)র মনীষা
হযরত আলী (রা) বাল্যকাল হইতেই নবুয়্যাতের শিক্ষা অঙ্গন হইতে সরাসরি জ্ঞান অর্জন ও প্রশিক্ষন লাভের সুযোগ পাইয়াছিল। রাসূলে করীম (স)-এর সহিত তাঁহার যে গভীরতর সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাহারই দৌলতে তিনি এই পর্যায়ের অন্যান্য সকলের তুলনায় অধিক সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। ঘরে-বাহিরে ও বিদেশ যাত্রাকালে তিনি নবী করীম (স)-এর নিবিড়তর নৈকট্য লাভ করিতে পারিয়াছিলেন বিধায় দ্বীন-ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানলাভ করা তাঁহার পক্ষে খুবই সহজ হইয়াছিল। নবী করীম (স) নিজেও তাঁহাকে এই বিশেষ জ্ঞান দান করার জন্য গুরুত্ব দিয়াছিলেন। তিনি নিজে তাঁহাকে কুরআন মজীদ শিক্ষা দিয়াছেন এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সঠিক তাৎপর্য বুঝাইয়া দিয়াছেন। এই কারণে অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামের তুলনায় তাঁহার মনীষা ছিল অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীরতর। রাসূলে করীম (স) তাঁহার এই মনীষার প্রতি ইঙ্গিত করিয়া বলিয়াছিলেনঃ
******(আরবী)
‘আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী উহার দ্বার বিশেষ’।
একটি হাদীস হিসাবে সনদ ইত্যাদির বিচারে এই কথাটি গ্রহণযোগ্য না হইলেও ইহার বাস্তবতা অবশ্যই স্বীকৃতব্য। সাধারণ লেখাপড়া হযরত আলী (রা) বাল্যকালেই শিখিয়া লইয়াছিলেন এবং অহী লেখকদের তালিকায় তাঁহার নামও শামিল রহিয়াছেন। রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ অনুযায়ী বহু রাষ্ট্রীয় ফরমানসহ হুদাইবিয়ার সন্ধিনামা হযরত আলী (রা)র হস্তেই সুলিখিত হইয়াছিল।
ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস কুরআন মজীদ। হযরত আলী (রা) এই কুরআনের মহাসমুদ্র মন্থন করার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিলেন। যে কয়জন সাহাবী নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশায় পূর্ণ কুরআন মজীদ মুখস্থ করিয়া লইয়াছিলেন, হযরত আলী (রা) তাঁহাদের অন্যতম। কুরআনের কোন সূরা বা কোন আয়াতটি কি প্রসঙ্গে ও কোন সময় নাজিল হইয়াছিল, এই বিষয়ে তাঁহার বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। তিনি এই কথা নিজেই দাবি করিয়া বলিয়াছিলেন। এই কারণে কুরআনের মুফাসসিরদের উচ্চতম স্তরে তিনি পরিগণিত। উত্তরকালে রচিত বড় বড় তফসীর গ্রন্থে হযরত আলী (রা)র ব্যাখ্যামূলক বর্ণনাসমূহ বিশেষভাবে উদ্ধৃত হইয়াছে। কুরআনের মজীদকে নাজিল হওয়ার পরম্পরায় সুসজ্জিত করা তাঁহার এক বিশেষ অবদান। সেই সঙ্গে কুরআন মজীদ হইতে ব্যবহারিক জীবনের জন্য জরুরী আইন-বিধান বাহির করা এবং বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ইসলামের নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত জানার জন্য ইজতিহাদ কর্যা তাঁহার অসাধারণ দক্ষতা ও প্রতিভা সর্বজনস্বীকৃত। খারিজী ফির্কার লোকেরা নিতান্ত আক্ষরিক অর্থে কোন ব্যক্তিকে মীমাংসাকারী বা পারস্পরিক বিবাদ মিটাইবার জন্য মানিয়া লইতে অস্বীকৃতি জানাইল এবং তাহারা দলীল হিসাবে কুরআনের আয়াত ****(আরবী) ‘এক আল্লাহ্ ছাড়া মীমাংসাকারী আর কেহ হইতে পারে না’ পেশ করিল, তখন তিনি এইরূপ যুক্তি উপস্থাপনের অযৌক্তিকটা ও অবান্তরতা প্রমাণ করিয়া বলিলেনঃ ‘আল্লাহই যে চূড়ান্ত বিচারক তাহাতে আর সন্দেহ কি! কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিবাদ মিমাংসা করার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা নিজেই যখন জনসমাজের লোককে সালিশ মানিবার জন্য নির্দেশ দিয়া বলিয়াছেনঃ
*******(আরবী)
স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে বিবাদ-বিরোধের আশংকা দেখা দিলে স্বামীর পক্ষ হইতে একজন এবং স্ত্রীর পক্ষ হইতে একজন মিমাংসাকারী প্রেরণ কর।
তখন মুসলিম জাতি ও জনতার পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার জন্য জনসমাজ হইতেই কাহাকেও নিযুক্ত করা ও মানিয়া লওয়া হইলে তাহা অন্যায় বা কুরআন-বিরোধী কাজ হইবে কেন? আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব ও সর্ব বিষয়ে তাঁহার চূড়ান্ত ক্ষমতা তো কোন-না-কোন মানুষের দ্বারাই কার্যকর ও বাস্তবায়িত হইবে। গোটা মুসলিম জাতির পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের ব্যাপারটি কি একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোকের তুলনায়ও নগণ্য ব্যাপার?বস্তুতঃকুরআনের তাফসীর ও আয়াতসমূহের তাৎপর্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পর্যায়ে হযরত আলী (রা)-র এত মূল্যবান বর্ণনাসমূহ উদ্ধৃত হইয়াছে যে, তাহা একত্র সন্নিবেশিত করা হইলে একখান বিরাট গ্রন্থের রূপ পরিগ্রহ করিতে পারে।
এক শ্রেণীর প্রতারক তাসাউফপন্থী প্রচার করিয়া বেড়ায় যে, রাসূলে করীম (স) হযরত আলী (রা)-কে দ্বীন-ইসলাম সংক্রান্ত মৌল জ্ঞান ও বিদ্যা ছাড়াও এমন কিছু জ্ঞানও তাঁহাকে শিক্ষা দিয়া গিয়াছিলেন যাহাকে বর্তমানে ‘তাসাউফ’ নামে অভিহিত করা হয়। তাহারা হযরত আলী (রা)-কে তাসাউফ শাস্ত্রের ‘আদি পিতা’ বলিয়াও প্রচারনা চালাইতেছে। কিন্তু ইহা কতবড় মিথ্যা অপবাদ এবং কতখানি ভিত্তিহীন কথা, তাহা একটি সহীহ হাদীসে উদ্ধৃত তাঁহার নিজের উক্তি হইতেই অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। লোকেরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলঃ ‘আপনার নিকট কুরআন ছাড়া আরও কোন ইলম আছে নাকি?’ তিনি জওয়াবে বলিলেনঃ ‘সেই মহান সত্তার শপথ, যিনি বীজ ও আঁটিকে দীর্ণ করিয়া বৃক্ষ উৎপাদন করেন এবং যিনি দেহের ভিতরে প্রানের সঞ্চার করেন, আমার নিকট কুরআন ছাড়া অন্য কোন জিনিসই নাই। তবে কুরআনের সমঝ-বুঝের শক্তি-সামর্থ্য ও যোগ্যতা-প্রতিভা আল্লাহ্ যাহাকে ইচ্ছা দিয়া থাকেন। ইহা ছাড়া কয়েকটি হাদীস আমার নিকট রহিয়াছে’। (বুখারী, মুসনাদে আহমাদ)
হযরত আলী (রা) তাঁহার কথার শুরুতে যে শপথ করিয়াছেন, উহা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁহার এই কথা হইতে বুঝা গেল, কুরআনের আয়াতসমূহ আঁটি ও দেহের মত। আর উহার অর্থ, তাৎপর্য ও তত্ত্ব বৃক্ষের মত- যাহা সেই আঁটি ও বীজ হইতে নির্গত হয়। আর উহা সেই প্রাণের মত, যাহা দেহে প্রচ্ছন্ন হইয়া থাকে। অর্থাৎ একটা ক্ষুদ্রাকার বীজ ও আঁটি হইতে যেমন শাখা-প্রশাখা সমন্বিত একটি বিরাট বৃক্ষের উদগম হইতে পারে-যাহা মূলতঃসেই বীজ ও আঁটির মধ্যেই লুক্কায়িত ছিল; আর প্রানশক্তি হইতে-যাহা দেহে প্রচ্ছন্ন হইয়া থাকে-যেমন সমস্ত মানবীয় কর্ম ও কীর্তিকলাপ প্রকাশিত হয়, কুরআনের শব্দসমূহ হইতেও-যাহা দেহের মতই-বিপুল অর্থ ও তাৎপর্য বাহির হইতে পারে।
বস্ততঃ হযরত আলী (রা) যে কুরআনের তত্ত্ব ও দর্শনে বিশেষ বুৎপত্তির অধিকারী ছিলেন, ইহা তাঁহার উক্ত কথাটি হইতেই প্রমাণিত হয়।
হাদীসের ক্ষেত্রেও হযরত আলী (রা)র মনীষা ও বৈদগ্ধ্য ছিল অসাধারণ, বিশাল ও গভীর মহাসমুদ্র সমতুল্য। বাল্যকাল হইতে পূর্ণ ত্রিশটি বৎসর তিনি নবী করীম (স)-এর সাহচর্যে ও নিবিড় সান্নিধ্যে কাটাইয়াছেন। এই কারণে ইসলামের পূর্ণ আইন-বিধান ও রাসূলের বাণী সম্পর্কে হযরত আবূ বকর (রা)-এর পর তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ বিশারদ। ইহাছাড়া নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর সমস্ত বড় বড় সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। রাসূলে করীম (স)-এর পর প্রায় ত্রিশটি বৎসর পর্যন্ত তিনি কুরআন, হাদীস এবং দ্বীন ও শরীয়াত প্রচারে নিরন্তর ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। প্রথম তিনজন খলীফার আমলেও এই দায়িত্ব তাঁহার উপর ন্যস্ত ছিল। তাঁহার নিজের খিলাফত আমলেও নানা ফিতনা-ফাসাদ ও রক্তাক্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ সত্ত্বেও জ্ঞান বিস্তারের এই স্রোত কখনো বন্ধ হয় নাই; বরং ইহা অব্যাহত ধারায় প্রবাহমান ছিল। এই কারণে প্রথম তিনজন খলীফার তুলনায় হাদীস বর্ণনায় অধিক সুযোগ তিনিই লাভ করিয়াছেন। কিন্তু এইসব সত্ত্বেও হাদীস বর্ণনায় তিনি অত্যন্ত বেশী সতর্ক ও কঠোর প্রকৃতির ছিলেন। এই কারণে তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুব বেশী হয় নাই। মাত্র ৫৮৬টি হাদীস তাঁহার সূত্রে গ্রন্থাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছে। নবুয়্যাতের জমানায় যে কয়জন সাহাবী হাদীস লিখিয়া রাখিতে অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে হযরত আলী (রা)ও একজন। তাঁহার লিখিয়া রাখা হাদীস সম্পদকে তিনি “সহীফা” নামে উল্লেখিত করিতেন এবং এই ‘সহীফা’ তাঁহার তরবারির খাপের মধ্যে ঢুকাইয়া রাখিতেন। এই হাদীসসমূহ হইতে ব্যবহারিক জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মসআলা জানা যায়।
ফিকাহ ও ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তাঁহার যোগ্যতা ও প্রতিভা সর্বজনস্বীকৃত। বড় বড় সাহাবীগণ- এমন কি তাঁহার বিরুদ্ধবাদীরাও-বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার নিকট হইতে শরীয়াতের সিদ্ধান্ত জানিয়া লইবার প্রয়োজনবোধ করিতেন। এই ক্ষেত্রে তাঁহার বিশেষ বুৎপত্তির বড় কারণ এই ছিল যে, তিনি নিজে অনেক বিষয়ে রাসূলে করীম (রা)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইতেন।
বিচারপতি হিসাবে হযরত আলী (রা)
হযরত আলী (রা) জীবনের বেশীর ভাগ সময় মদীনায় অতিবাহিত করিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহার খিলাফতের পুরা সময়টি তিনি কুফায় অবস্থান করিয়াছেন। এই কারণে তাঁহার ফিকাহ সংক্রান্ত মত ও ইজতিহাদ ইরাকেই বেশী প্রচার লাভ করিয়াছে। হানাফী মযহাবের ভিত্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা) পরে হযরত আলী (রা)-র মত ও তাঁহার গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের উপরই সংস্থাপিত হইয়াছে। হযরত আলী (রা)-র এই যোগ্যতার কারণে শরিয়াত অনুযায়ী মামলা-মুকাদ্দমার বিচার করার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তাঁহার দক্ষতাও সর্বজন স্বীকৃত ছিল। হযরত উমর ফারুক (রা) বলিয়াছেনঃ
********(আরবী)
আমাদের মধ্যে বিচারক হিসাবে অধিক যোগ্য ব্যক্তি হযরত আলী এবং অধিক কুরআন-বিশারদ হযরত উবাই ইবনে কায়াব।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) বলিয়াছেনঃ ‘আমরা পরস্পরে বলিতাম যে, মদিনায় সর্বাধিক বিচার-ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি হইতেছেন হযরত আলী (রা)।
স্বয়ং নবী করীম (স)-ও অনেক সময় বিচারকার্যের দায়িত্ব হযরত আলী (রা)র উপর অর্পণ করিতেন। নবী করীম (স) তাঁহাকে ইয়েমেনের বিচারপতির দায়িত্বে নিযুক্ত করিলে তিনি নিজের অযোগ্যতা ও অক্ষমতার কথা বলিয়া সেই দায়িত্ব গ্রহণ হইতে নিষ্কৃতি পাইতে চাহিয়াছিলেন। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
আল্লাহ্ তা’আলাই তোমার মুখকে সঠিক পথে এবং তোমার দিলকে দৃঢ় ও ধৈর্যসম্পন্ন করিয়া রাখিবেন।
হযরত আলী (রা) নিজেও বলিয়াছেনঃ
অতঃপর বিচার কার্যে আমি কখনও কোনোরূপ সংশয় বা কুণ্ঠাগ্রস্ত হই নাই।
বিচারকার্য পরিচালনা সম্পর্কে নবী করীম (স) তাঁহাকে বহু মূলনীতি ও নিয়ম-পদ্ধতি শিক্ষা দিয়াছিলেন। একবার তাঁহাকে বলিয়াছিলেনঃ
হে আলী! তুমি যখন দুই ব্যক্তির বিবাদ মীমাংসা করিতে বসিবে, তখন কেবল একজনের কথা শুনিয়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে না এবং দ্বিতীয় জনের বক্তব্য না শুনা পর্যন্ত তোমার সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থগিত রাখিবে।
মামলা বিচারের ক্ষেত্রে সন্দেহমুক্ত দৃঢ় প্রত্যয় লাভের জন্য মামলার দুইপক্ষ এবং সাক্ষীদের জেরা করা ও এই ব্যাপারে তাহাদিগকে প্রশ্ন না করা হযরত আলী (রা)-এর সুবিচার নীতির অপরিহার্য অংশরূপে নির্দিষ্ট। অপরাধ স্বীকারকারী(confessor)বার বার প্রশ্ন ও জেরা করার পরও নিজের স্বীকৃতির উপর অবিচল না থাকিলে তিনি এই স্বীকৃতির ভিত্তিতে তাহাকে কোন শাস্তি দিতেন না। সাক্ষীদিগকে নানাভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত করার পর সাক্ষ্য-উক্তিতে তাহাদের অবিচল না পাইলে সে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনি কোন ফয়সালা করিতেন না। হত্যাসংক্রান্ত মামলার বিচারে তিনি দুর্ঘটনা ও হত্যার ইচ্ছা(Motive)-র মধ্যে পার্থক্য করিতেন। ১ {১.নায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সচেতনতাঃ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিন্ত করার লক্ষ্যে হযরত আলী (রা) সর্বদা সচেতন থাকিতেন। বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার জন্য রাষ্ট্র-ক্ষমতার অপব্যবহারকে তিনি জঘন্য অপরাধ বলিয়া মনে করিতেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি মুসলিম ও অমুসলিম মধ্যেও কোনোরূপ ভেদনীতিকে প্রশ্রয় দিতেন না। এই ব্যাপারে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। একদা জনৈক ইয়াহুদী আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা)র লৌহবর্মটি চুরি করিয়া লইয়া গেল। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও ইনি সরাসরি এ ব্যাপারটি কোন পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণ করিলেন না; বরং প্রচলিত নিয়মনুযায়ী আদালতে গিয়া অভিযোগ দায়ের করিলেন। আদালতের বিচারক তাঁহাকে অভিযোগের সপক্ষে দুইজন সাক্ষী হাজির করার আদেশ দিলেন। হযরত আলী (রা) তাঁহার দুই পুত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন(রা)-কে সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত করিলেন। কিন্তু বিচারক অভিযোগকারীর নিকটাত্মীয় বলিয়া ইহাদের সাক্ষ্য গ্রহণ না করিয়া বরং মামলাটিই খারিজ করিয়া দিলেন। এই ঘটনায় অভিভুক্ত হইয়া অভিযুক্ত ইয়াহুদী নিজেই তাহার অপরাধ স্বীকার করিল এবং পবিত্র কালিমা পড়িয়া ইসলামের কাফেলায় শরীক হইল।–সম্পাদক}
হযরত আলী (রা)-র বিচার-ফয়সালা আইনের দৃষ্টান্তরূপে গণ্য। এই কারণে মনিষীগণ উহা লিপিবদ্ধ করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু উত্তরকালে দুষ্ট লোকেরা উহাতে নানারুপ বিকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটায়। ইহার ফলে আইন বা বিচার জগতে উহা সম্পূর্ণ অকেজো হইয়া যায়।
ব্যাক্তিগত জীবনের কৃচ্ছ্র সাধনা
হযরত আলী (রা) ব্যক্তিগত জীবন অত্যন্ত কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনার ভিতর দিয়া অতিবাহিত করিয়াছেন। দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি মুহূর্তের তরেও বিচলিত হইয়া পড়েন নাই। সময় ও সুযোগ মত শ্রম ও দিন-মজুরী করিয়া জীবিকা সংগ্রহ করিতে তিনি বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করিতেন না। খলীফার মসনদে আসীন হওয়ার পরও তাঁহার এই কৃচ্ছ্র সাধনায় সামান্য পার্থক্যও সূচিত হইতে পারে নাই। তাঁহার তুচ্ছাতিতুচ্ছ খাবার দেখিয়া লোকেরা স্তম্ভিত ও হতবাক হইয়া যাইত। লোকদের তিনি বলিতেনঃ ‘মুসলমানদের খলীফা রাষ্ট্রীয় বায়তুলমাল হইতে মাত্র দুইটি পাত্র পাইবার অধিকারী। একটিতে নিজে ও নিজের পরিবারবর্গ মিলিয়া খাইবে। আর অপরটি জনগণের সামনে পেশ করিবে’।
তাঁহার ঘরের কাজ সম্পন্ন করার জন্য বাড়তি কোন লোক ছিল না। নবী সম্রাট-তনয়া স্বহস্তেই সমস্ত কাজ সম্পন্ন করিতেন। বৈষয়িক ধন-সম্পদের দিক দিয়া হযরত আলী (রা) শূন্যপাত্র ছিলেন। কিন্তু আত্তার দিক দিয়া তিনি ছিলেন বিপুল সম্পদের অধিকারী। কোন প্রার্থী তাঁহার দুয়ার হইতে খালি হাতে ফিরিয়া যাইতে পারিত না। এমন কি নিজেদের জন্য তৈয়ার করা খাদ্যও তিনি অবলীলাক্রমে ক্ষুধার্ত ভিখারীর হাতে তুলিয়া দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করিতেন না।
— সমাপ্ত —