হযরত উসমান (রা)- এর চরিত্র বৈশিষ্ট্য
হযরত উসমান (রা) খিলাফতে রাশেদা’র তৃতীয় খলীফা। তাঁহার ব্যক্তিগত চরিত্রে ‘খলীফায়ে রাশেদ’ হওয়ার সব বৈশিষ্ট্যই পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান ছিল। তিনি স্বভাবতঃই পবিত্রচরিত্র,বিশ্বাসপরায়ণ,সত্যবাদী, ন্যায়নিষ্ঠ, সহনশীল এবং দরিদ্র-সহায় ছিলেন। জাহিলিয়াহ যুগের ঘোরতর মদ্যপায়ী সমাজে বসবাস করা সত্ত্বেও মদ্য ছিল তাঁহার অনাস্বাদিত। রাসূলে করীম (স)-এর পবিত্র সাহচর্য তাঁহার নৈতিক চরিত্রকে অধিকতর নির্মল,পরিচ্ছন্ন ও দীপ্তিমান করিয়া তুলিয়াছিল।
বস্তুত আল্লাহ্র ভয়ই নৈতিক চরিত্রের মূল উৎস। যাঁহার দিল আল্লাহ্র ভয়ে ভীত-কম্পিত নয়, সে না করিতে পারে হেন পাপ কার্যের উল্লেখ করা যায় না। হযরত উসমান (র) আল্লাহ্র ভয়ে সর্বদা কম্পিত ও অশ্রুসিক্ত থাকিতেন। কবর দেখিলে তিনি অস্থির হইয়া পড়িতেন। তিনি প্রায়ই রাসূলে করীম (স)-কে উদ্ধৃত করিয়া বলিতেনঃ কবর হইল পরকালীন জীবনের প্রথম পর্যায়। এই পর্যায়টি সহজে ও নিরাপদে অতিক্রম করা গেলে পরবর্তী সব কয়টি পর্যায়ই সহজে অতিক্রান্ত হইবে বলিয়া আশা করা যায়। পক্ষান্তরে ইহাতেই বিপদ দেখা দিলে পরবর্তী সব পর্যায়ই কঠিন হইয়া দাঁড়াইবে।
হযরত উসমান (রা) ইসলামের প্রায় সব কয়টি যুদ্ধে রাসূলে করীম (স)-এর সহগামী ছিলেন এবং সর্বক্ষেত্রেই তিনি তাঁহার জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত হইয়াছিলেন। দৈনন্দিন জীবনেও রাসূলে করীম (স)-এর দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করার জন্য তিনি সর্বদা সচেতন ও সজাগ-সক্রিয় থাকিতেন। রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা,ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শনে তিনি অতিশয় সচকিত থাকিতেন। তিনি যে হস্তে রাসূলে করীম (স)-এর হস্ত স্পর্শ করিয়া ইসলামের বায়’আত গ্রহণ করিয়াছিলেন, উহাতে জীবনে কোন দিন একবিন্দু মালিন্যও লাগিতে দেন নাই। তিনি আপন খিলাফত আমলে রাসূলে করীম (স)-এর পরিবারবর্গের প্রয়োজন পূরণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন, যেন তাঁহাদিগকে কোনরূপ দৈন্য ও অসুবিধার সম্মুখীন হইতে না হয়।
রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি তাঁহার এইরূপ অকৃত্রিম ও সুগভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠাপূর্ণ ভালোবাসা ও আন্তরিকতার অনিবার্য পরিণতি এই ছিল যে, তিনি ছোট-বড় প্রত্যেকটি ব্যাপারেই তাঁহাকে অনুসরণ করিয়া চলিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাইতেন। সাধারণ কথা, কাজ ও গতিবিধিতেও রাসূলে করীম (স)-এর হুবহু অনুসরণ করিবার জন্য তাঁহার চেষ্টার কোন ত্রুটি হইত না। নবী করীম (স)-কে তিনি যেভাবে অযু করিতে দেখিয়াছেন, নামায পড়িতে দেখিয়াছেন, লাশের প্রতি আচরণ করিতে দেখিয়াছেন, তিনিও এইসব কাজ ঠিক সেইভাবেই সম্পন্ন করিতেন। কাহাকেও রাসূলে করীম (রা)-এর সুন্নাতের বিপরীতে বা ভিন্নতর রীতিতে কোন কাজ করিতে দেখিলে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি উহাতে আপত্তি জানাইতেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিতেনঃ ‘তুমি কি রাসূলে করীম (স)-কে এই কাজ করিতে নিজ চক্ষে দেখ নাই’। বস্তুত রাসূলে করীম (স)-এর এইরূপ আক্ষরিক অনুসরণই ছিল একজন আদর্শবাদী সাহাবী হিসাবে তাঁহার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
লজ্জাশীলতা ও বিনয়-নম্রতা ছিল হযরত উসমান (রা)-এর এক বিশিষ্ট ধরণের গুণ। ঐতিহাসিক ও জীবনচরিত রচয়িতাগণ তাঁহার লজ্জাশীলতার কথা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করিয়াছেন। স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-ও তাঁহার এই লজ্জাশীলতাকে বিশেষ মর্যাদা দিতেন বলিয়া উল্লেখিত হইয়াছে।
হযরত উসমান (রা) তাঁহার স্বভাবসুলভ লাজুকতা, বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা এবং সীমাহীন পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে লালিত-পালিত হওয়ার কারণে উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ ও উৎকৃষ্ট খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্থ ছিলেন। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর ন্যায় কষ্ট-সহিষ্ণুতা ও প্রকৃতিগত কঠোরতা তাঁহার ছিলনা। কিন্তু তাই বলিয়া তিনি জাঁকজমক ও বিলাস-ব্যসনপুর্ণ জীবন যাপন করিতেন, এমন কথা মনে করিবার কোন কারণ নাই।সত্য কথা এই যে, তিনি নিজে বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী হইয়াও কিছুমাত্র বড়লোকী জীবন-মান গ্রহণ করেন নাই। এই কারণে বিলাসিতা ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবনধারা ছিল তাঁহার নিকট অত্যন্ত অপছন্দনীয়।
তিনি স্বভাবগতভাবে অতি বিনয়ী ও নিরহংকার ছিলেন। তাঁহার পারিবারিক কাজকর্মের জন্য বহু সংখ্যক লোক নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও নিজের যাবতীয় কাজকর্ম তিনি নিজেই সম্পাদন করিতেন এবং ইহাতে কোনরূপ লজ্জা বা অপমান বোধ করিতেন না। ব্যক্তিগত জীবনে কার্পণ্য কাহাকে বলে তাহা তিনি জানিতেন না। তিনি ছিলেন তদানীন্তন আরবের সর্বাধিক ধনাঢ্য ব্যক্তি। সেই কারণে দানশীলতা ছিল তাঁহার চরিত্রের প্রধান ভূষণ। তিন নিজের ধন-সম্পদ নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে নয়- সাধারণ জনকল্যাণেই ব্যয় করিতে থাকিতেন। ইসলামের কাজে তাঁহার ধন-সম্পদ যতটা ব্যয়িত হইয়াছে, তদানীন্তন সমাজে এই দিক দিয়া অন্য কেহই তাঁহার সমতুল্য হইতে পারে না।
মদীনায় পানির সমস্ত কূপ লবনাক্ত ছিল। শুধু ‘রুমা’ নামক একটি কুপ হইতে মিষ্টি পানি পাওয়া যাইত; কিন্তু উহার মালিক ছিল জনৈক ইয়াহুদী। হযরত উসমান (রা) জনগণের প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে উক্ত কূপটি বিশ হাজার দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করিয়া জনসাধারণের জন্য ওয়াকফ করিয়া দেন। নগরীতে মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ার দরুণ মসজিদে নববী সম্প্রসারিত করা অপরিহার্য হইয়া পড়িলে তিনি বিপুল অর্থ ব্যয় করিয়া এই অত্যাবশ্যকীয় কাজটি সম্পন্ন করিয়া ফেলেন। অনুরূপভাবে তাবুক যুদ্ধকালে নিজস্ব তহবিল হইতে অর্থব্যয় করিয়া তিনি সহস্র মুজাহিদকে সশস্র ও সুসংগঠিত করিয়া দেন। অথচ এই সময় মুসলমানদের দৈন্য ও দারিদ্র তাঁহাদিগকে নির্মমভাবে পীড়িত ও উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছিল।এক কথায় বলা যায়, উসমান (রা) ছিলেন এক অতুলনীয় দানশীল ব্যক্তি। ব্যক্তি-মালিকানার ধন-সম্পদ হওয়া সত্ত্বেও তাঁহার হস্তে উহা সাধারণ জনগণের কল্যাণে ব্যাপকভাবে ব্যয়িত হইয়াছে। পুঁজিবাদী বিলাস-ব্যাসন কিংবা শোষণ-পীড়নের মালিন্য তাঁহার ব্যক্তি মালিকানাকে কিছুমাত্র কলুষিত করিতে পারে নাই।১ {বদান্যতার প্রবাদ পুরুষঃ বদান্যতা বা দানশীলতা ব্যাপারে হযরত উসমান (রা) ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের উদারহস্ত। তাঁহার দান খয়রাতের এক-একটি ঘটনা ছিল রূপকথার মত। একদা জনৈক অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি সাহায্যের প্রত্যাশায় হযরত উসমান (রা)-এর শরণাপন্ন হইল। লোকটি যখন হযরত উসমান (রা)-এর বাড়ীর সন্নিকটে পৌঁছিল, তখন তিনি (উসমান)নিবিষ্টচিত্তে মাটি হইতে সরিষার দানা খুঁটিয়া খুঁটিয়া তুলিতেছিলেন। এই দৃশ্য অবলোকন করিয়া আগন্তুক লোকটি ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্ত হইয়া পড়িল। সে উসমান (রা)-কে এক নিকৃষ্ট কৃপণ ব্যক্তি ভাবিয়া ফিরিয়া যাইতে উদ্যত হইল। সহসা উসমান (রা) আগন্তুক লোকটিকে দেখিতে পাইলেন। তিনি তাহাকে কাছে ডাকিয়া এইভাবে ফেরত যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। লোকটি সব ঘটনা আদ্যপান্ত খুলিয়া বলিল। উসমান (রা)লোকটির কথা শুনিয়া একটু মুচকি হাসিলেন। ঘটনাক্রমে এই সময় পণ্য-সামগ্রী বোঝাই সাতটি উট আসিয়া সেখানে থামিল। উসমান (রা)উটসহ সমগ্র পণ্য-সামগ্রীই আগন্তুককে দান করিয়া দিলেন। এই ঘটনায় লোকটি একেবারে হতবাক হইয়া গেল এবং উসমান (রা) সম্পর্কে তাহার বিরুপ ধারণার জন্য বারবার অনুশোচনা প্রকাশ করিতে লাগিল।–সম্পাদক}
হযরত উসমান (রা) ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতার বাস্তব প্রতীক। দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুছিবত যত বড় এবং যত মারাত্মকই হউক না কেন, সবর,ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার শানিত অস্ত্রে তিনি উহার সব কিছুই ছিন্ন-ভিন্ন করিয়া দিতেন এবং সমস্ত প্রতিকূলতার মুকাবিলায় তিনি পর্বতের ন্যায় অবিচলরূপে দাঁড়াইয়া থাকিতেন।
তাঁহার জীবনধারা ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, পরিমিত ও সংযত। দিনের বেলায় খিলাফতের দায়িত্ব পালনে গভীরভাবে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রাত্রের বেশীর ভাগ সময় তিনি নামায ও আত্মিক সাধনায় নিমগ্ন থাকিতেন। অনেক সময় তিনি সমগ্র রাত্রিও জাগিয়া কাটাইতেন এবং এক রাকয়াতেই পূর্ণ কুরআন মজীদ পড়িয়া ফেলিতেন। এই ধরণের ঘটনা তাঁহার জীবনে বহুবার সংঘটিত হইয়াছে।যে কয়জন সাহাবী ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতের জামানায় লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন, হযরত উসমান (রা) ছিলেন তাঁহাদের অন্যতম। এই কাজে তাঁহার যোগ্যতা ও দক্ষতা স্বয়ং নবী করীম (স) কর্তৃকও স্বীকৃত ও প্রশংসিত হইয়াছে। এই জন্য অন্যান্যের সঙ্গে তাঁহাকেও অহী লেখার কাজে নিযুক্ত করা হইয়াছিল। হযরত রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি যখনই অহী নাযিল হইত, তখনই উহা লিখিয়া রাখার সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইয়াছিল। হযরত উসমান (রা)এই কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
অবশ্য লেখার কাজে পারদর্শী হইলেও বক্তৃতা-ভাষণে তিনি অতটা সক্ষম ছিলেন না। খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর সর্বপ্রথম মিম্বারের উপর আরোহণ করিয়া তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কোন ভাষণ না দিয়া শুধু বলিলেনঃ
আমার পূর্ববর্তী খলীফাদ্বয়-আবূ বকর ও উমর (রা) পূর্বেই প্রস্তুতি লইয়া আসিতেন। আমিও ভবিষ্যতে প্রস্তুত হইয়াই আসিব। কিন্তু আমি মনে করি, বক্তৃতা-ভাষণে সক্ষম ইমামের (নেতার) চেয়ে কর্মদক্ষ ইমামই তোমাদের জন্য প্রয়োজন।
এই কথাটুকু বলিয়া তিনি মিম্বারের উপর হইতে নীচে অবতরণ করিলেন। অবশ্য ইহার পর তিনি বিভিন্ন সময় প্রয়োজন মত বক্তৃতা-ভাষণ দিয়াছেন এবং উহাতে তাঁহার যোগ্যতারও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যাইত। তাঁহার ভাষণসমূহ খুবই সংক্ষিপ্ত,জ্ঞানগর্ভ এবং উচ্চমানের হইত।
হযরত উসমান (রা)-এর বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হইয়াচেঃ ‘কুরআন মজীদ পড়া ও পড়ানো অতি উত্তম সওয়াবের কাজ’। এই হাদীস অনুযায়ী তিনি নিজে জীবনের শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত আমল করিয়াছেন। সম্ভবতঃ এই কারণেই তিনি অধিকাংশ সময় কুরআন মজীদ তিলাওয়াতে অতিবাহিত করিতেন। তিনি পূর্ণ কুরআনেরও হাফিয ছিলেন। কুরআনের সহিত তাঁহার অন্তরের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। জীবনের শেষ মুহূর্তে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা যখন তাঁহাকে চতুর্দিক হইতে পরিবেষ্টন করিয়া ফেলিয়াছিল, তখনও তিনি সর্বদিক হইতে নিজেকে গুটাইয়া আনিয়া গভীর তন্ময়তা সহকারে কুরআন তিলাওয়াতে নিমগ্ন হইয়াছিলেন।
তিনি অহী-লেখক ছিলেন বিধায় কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞানে তাঁহার অতুলনীয় পারদর্শিতা ছিল। বিভিন্ন জটিল বিষয়ে কুরআন হইতে দলীল পেশ করা এবং কুরআন হইতে শরীয়াতের বিধান খুঁজিয়া বাহির করায় তিনি বিশেষ দক্ষতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিয়াছেন। কুরআন-বিরোধীদের ষড়যন্ত্র হইতে কুরআন মজীদকে সুরক্ষিত করার ব্যাপারেও তাঁহার অবদান চির অম্লান হইয়া থাকিবে। হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে তিনি অন্যান্য সাহাবীদের চেয়ে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। এই কারণে তিনি মাত্র ১৪৬টি হাদীস রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। অবশ্য এই সতর্কতা অনেকটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। ব্যক্তিগত রুচি ও দৃষ্টিকোণ হইতেই ইহা উৎসারিত। এই কারণে একই নবীর সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও বর্ণিত হাদীসের সংখ্যার দিক দিয়া সাহাবীদের মধ্যে বিরাট তারতম্য হইয়াছে এবং ইহা ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
হযরত উসমান (রা) হযরত আবূ বকর (রা) হযরত উমর ফারুক (রা) এবং হযরত আলী (রা)-র ন্যায় বড় বড় মুজতাহিদদের মধ্যে গণ্য না হইলেও শরীয়াতের বহু ব্যাপারে তিনি ইজতিহাদ করিয়াছেন। এই ধরণের ইজতিহাদ এবং বিভিন্ন মিমাংসা ও ফয়সালা ইসলামের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখিত হইয়াছে। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। তিনি নিজে প্রত্যেক বৎসরই হজ্জ উদযাপন করিতেন ও ‘আমীরে হজ্জ’-এর দায়িত্ব পালন করিতেন। খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পরও তিনি একটিবারও হজ্জ উদযাপন হইতে বিরত থাকেন নাই। শরীয়াতের ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন সময় যেসব রায় দিয়াছেন ও বিচার-ফয়সালা করিয়াছেন, তাহা ইসলামী শরীয়াতের বাস্তব ব্যাখ্যার দৃষ্টিতে চিরকাল অতীব মূল্যবান সম্পদ হইয়া থাকিবে। বিভিন্ন ইজতিহাদী ব্যাপারে অন্যান্য সাহাবীদের সহিত তাঁহার মতবৈষম্য ঘটিয়াছে। কিন্তু তিনি কুরআন-হাদীস যুক্তির ভিত্তিতে যে রায় দিতেন, তাহাতে তিনি সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসের দরুণই অবিচল হইয়া থাকিতেন। হযরত উসমান (রা) একজন সফল ও সার্থক ব্যবসায়ী ছিলেন বলিয়া হিসাব জ্ঞানে তাঁহার বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। এই কারণে ‘ইলমুল-ফারায়েজ’ বা উত্তরাধিকার বণ্টন-বিদ্যায় তাঁহার বুৎপত্তি ছিল সর্বজনস্বীকৃত। এই বিদ্যার মৌলিক নীতি প্রণয়নে হযরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা)-এর সঙ্গে তাঁহার অবদান অবশ্য স্বীকৃতব্য। সাহাবীগণ মনে করিতেন, ফারায়েজ বিদ্যায় এই দুইজন পারদর্শীর অন্তর্ধানের পূর্বে ইহার সঠিক প্রণয়ন না হইলে এই বিদ্যাই বিলুপ্ত হইয়া যাইবে।