হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)
ইসলামী গণ-রাষ্ট্রের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা)। ইসলামের ইতিহাসে রাসূলে করীম হযরত মুহাম্মাদ(স)-এর পরেই হযরত আবূ বকর (রা)-এর স্থান। ইসলামী ঐতিহ্যের দিক দিয়াও রাসূলের পর তিনিই সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তি। নবী করীম(স) তাঁহার তেইশ বৎসরকালীন সাধনার মাধ্যমে যেখানে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে আরবের কঠিন জাহিলিয়াতের প্রাসাদ চুরমার করিয়া উহার ধ্বংসস্তূপের উপর ইসলামের উজ্জ্বল আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন,সেখানে হযরতের ইন্তেকালের অব্যবহিত পরই জাহিলিয়াতের প্রতিবিপ্লবী শক্তির উত্তোলিত মস্তক চূর্ণ করিয়া দিয়া ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করিয়াছেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)। এই জন্য নবী জীবনের আলোচনা-পর্যালোচনার সঙ্গে প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা)-এর জীবনচরিত অধিকতর গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা আবশ্যক। বর্তমান প্রবন্ধে আমার হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী আলোচনা করিব না। তাঁহার গুন-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করাই এই প্রবন্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য।
কালের গতি-স্রোতে অতীত,বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এমনভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, ইহার কোন একটি পর্যায়কে অপরটি হইতে কিছু মাত্র বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখা যায় না। যে কোন জাতির ভবিষ্যত পথ-নির্দেশের জন্য উহার অতীতকে গভীর ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করাই সর্বাধিক উত্তম পন্থা। জাতীয় জীবনে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়, তাহা হইতে জাতিকে উদ্ধার করার জন্যও তাহার উজ্জ্বল অতীতকেই লোকদের সম্মুখে তুলিয়া ধরা আবশ্যক। রুগ্ন ব্যক্তির রোগ নির্ণয় ও নির্ধারণ এবং উহার চিকিৎসা বিধানের জন্য যেমন রোগপূর্বকালীন অবস্থা আদ্যপান্ত পর্যালোচনা করা আবশ্যক, অনুরুপভাবে জাতীয় রোগ নির্ধারণ ও চিকিৎসা বিধানের জন্য অতীত ইতিহাস আলোচনা এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের জীবন পর্যালোচনার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বর্তমান সময়ে বিশ্বের মুসলিম জাতি অধঃপতনের চরম সীমায় উপনীত। এই মুহূর্তে হযরত আবূ বকর (রা)-এর জীবনাদর্শ নিঃসন্দেহে মুসলিম জাতির জীবন-পথের দিশারী হিসেবেই মর্যাদা পাইবে।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা) পুরুষদের মধ্য সর্বপ্রথম হযরত মুহাম্মাদ (স)-কে সত্যিকার নবী বলিয়া বিশ্বাস স্থাপন করেন। তাঁহার এই ঈমানই উত্তরকালে তাঁহাকে ‘সিদ্দীক’ বা ‘সত্য-স্বীকারী’ উপাধিতে ভূষিত হইবার গৌরব দিয়াছে। নবুয়্যাতের দীর্ঘ তেইশ বৎসরে তিনি দ্বীন-ইসলামকে কায়েম করার প্রচেষ্টায় জান-মাল ও ইজ্জত পর্যন্ত কুরবান করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হন নাই; বরং এই ক্ষেত্রে তিনি অপরাপর সাহাবী এবং সমস্ত মুসলমানদের অপেক্ষা অধিক অগ্রসর ছিলেন। ইস্লাম্র কবুল করার পর হইতে রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত দীর্ঘকাল তিনি হযরতের সাহায্য-সহযোগিতা,দ্বীন-ইসলামের প্রচার ও কাফিরদের অত্যাচার-নিষ্পেষণ হইতে মুসলমানদের রক্ষা করার ব্যাপারে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত-সমস্ত থাকতেন। রাসূলের প্রতিটি নির্দেশকে তিনি নিজের সমস্ত কাজের উপর প্রাধান্য দান করিতেন। রাসূলের জন্য তিনি নিজ জীবনেরও কোন পরোয়া করেন নাই। কাফিরদের সহিত প্রতিটি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে তিনি রাসূলের কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া লড়াই করিয়াছেন। ঈমানের অভূতপূর্ব দৃঢ়তা ও ইস্পাত-তুল্য অনমনীয়তার পাশাপাশি তাঁহার উন্নত চরিত্র বিশ্ব-মুসলিমের জন্য এক অতুলনীয় আদর্শ। এই কারণেই তিনি ছিলেন অতীব জনপ্রিয় ব্যক্তি;তাঁহার প্রতি গোটা মুসলমানের ভালবাসা ছিল অপূর্ব।
হযরত আবূ বকর (রা)- দ্বীনী মর্যাদা এবং তাঁহার প্রতি জনগণের অসীম ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণেই, রাসূল করীম(স) যখন রোগশয্যায় শায়িত, তখন খোদ রাসূলই তাঁহাকে নামাযে ইমামতী করার জন্য নির্দেশ দান করেন। ইহা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। অতঃপর রাসূলের ইন্তেকালের পর তাঁহাকেই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম খলীফা নির্বাচিত করা হয়। মুসলমানদের সাধারণ পরিষদে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে তিনিই খলীফা নির্বাচিত হন। এই সময় খলীফা নির্বাচিত হইয়াই তিনি যে মূল্যবান ভাষণ দান করেন, বিশ্ব-মুসলিমের নিকট তাহা যেমন এক ঐতিহাসিক বিষয়, ইসলামী রাষ্ট্র-দর্শনের ক্ষেত্রেও উহা চিরন্তন পথ-নির্দেশক। তাঁহার এই ভাষণের পূর্ণাঙ্গ রূপ এখানে উদ্ধৃত করা যাইতেছে। তিনি সমবেত জনতাকে সম্বোধন করিয়া গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলেনঃ
০হে মানুষ!রাষ্ট্রনেতা হওয়ার বাসনা আমার মনে কোন দিনই জাগ্রত হয় নাই, আমি নিজে কখনও এই পদের আকাঙ্ক্ষী ছিলাম না। ইহা লাভ করার জন্য আমি নিজে আল্লাহ্র নিকট গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে কখনও প্রার্থনাও করি নাই।
০আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছি কেবলমাত্র এইজন্য যে, দেশে যেন কোন প্রকার বিপর্যয় সৃষ্টি হইতে না পারে।
০সরকারী ক্ষমতায় আমার মনে বিন্দুমাত্র শান্তি ও স্বস্তি নাই।
০আমার উপর এত বড় দায়িত্ব চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে যে, আল্লাহ্র সাহায্য না পাইলে আমি তাহা সুসম্পন্ন করিতে পারিব না।
০আমাকে তোমাদের পরিচালক নিযুক্ত করা হইয়াছে,অথচ আমি তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি নহি।
০আমি যদি সোজা ও সঠিক পথে চলি, তবে তোমরা আমার সাহায্য ও সহযোগিতা করিও। আর আমি যদি ন্যায়পথ পরিত্যাগ করি, তবে তোমরা আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করিও।
০সত্যতা হইতেছে আমানত আর মিথ্যা বিশ্বাসঘাতকতা।
০তোমাদের মধ্যে প্রভাবহীন ব্যক্তিই আমার দৃষ্টিতে হইবে প্রভাবশালী; তাহার সকল প্রকার অধিকার আমি আদায় করিয়া দিব।
০আর যে ব্যক্তি খুবই প্রভাবশালী, আমার নিকট তাহার কোন প্রভাবই থাকিবে না, তাহার উপর দুর্বল ব্যক্তির কোন ‘হক’ থাকিলে তাহা পুরাপুরি আদায় না করিয়া আমি ক্ষান্ত হইব না।
০যে জাতির মধ্যে অন্যায়, পাপ ও নির্লজ্জতা প্রসার লাভ করে, সে জাতির উপর আল্লাহ্র আযাব নাযিল হয়।
০আমি যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করিব ততক্ষণ তোমরাও আমার আনুগত্য করিবে।
০আর আমি যদি আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসূলের নাফরমানী করি, তবে আমার আনুগত্য করা তোমাদের কর্তব্য হইবে না।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তাঁহার সংক্ষিপ্ত খিলাফতকালে ইসলামের শ্রেষ্টত্ত বিধানের জন্য যে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা চালাইয়াছেন, বিশ্ব-মুসলিমের ইতিহাসে তাহার কোন তুলনা নাই। প্রকৃতপক্ষে তাঁহারাই খিলাফতকালে ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার বুনিয়াদ সুদৃঢ় হয় এবং উহা বিশ্বের বিশাল অংশে সম্প্রসারিত হয়। এই বিরাট রাষ্ট্র এশিয়ার ভারতবর্ষ ও চীন পর্যন্ত এবং আফ্রিকার মিশর,তিউনিসিয়া ও মরক্কো পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। মোটকথা, এই রাষ্ট্রই মানবীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করিয়াছে-যাহার প্রত্যক্ষ প্রভাব দুনিয়ার শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত অব্যাহত থাকিবে।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা) ছিলেন রাসূলে করীম(স)-এর চিরন্তন সহচর, প্রাণ উৎসর্গীকৃত বন্ধু এবং অকৃত্রিম ও একনিষ্ঠ অনুগত। তাঁহার অন্তর ছিল অত্যন্ত দরদী। অতুলনীয় গুণ-বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন বিভূষিত।
প্রথম খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর ইসলামের উপর মুর্তাদ তথা ইসলাম ত্যাগকারীগণের প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডের চরম আঘাত আসে। বস্তুতঃএই সময় ইসলামী রাষ্ট্রের সম্মুখে এক নাজুক পরিস্থিতি দেখা দেয়। কিন্তু একমাত্র আবূ বকর (রা)-এর অতুলনীয় ব্যক্তিত্বই ইসলামী রাষ্ট্রের এই অংকুরকে প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডের আঘাত হইতে রক্ষা করিয়াছে এবং মুসলিম জনগণকে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের কবল হইতে বাঁচাইয়াছে। তিনি পারস্য ও রোমক রাষ্ট্রসমূহের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করিয়া ইসলামের সমস্ত শত্রুতা অংকুরেই খতম করেন এবং ইহার পর যে রাষ্ট্র গড়িয়া উঠে,বিশ্ব-জাতিসমূহের মানসপট হইতে উহার প্রভাব আজিও মুছিয়া যায় নাই এবং কোন দিনই তাহা মুছিয়া যাইতে পারে না।
হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফত যুগের ইতিহাস বড়ই বিস্ময়-উদ্দীপক। এই ইতিহাস হইতেই তাহার বিরাট ব্যক্তিত্তের আশ্চর্যজনক দিকগুলি আমাদের সম্মুখে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এই মহান সত্যসেনানী গরীব ও মিসকীনের সাহায্য কাজে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকিতেন। তাঁহার দরিদ্র-সেবার নমুনা দেখিলে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁহার ন্যায় গরীব-দরদী ভূ-পৃষ্ঠে দ্বিতীয় কেহ নাই। অপরদিকে ইসলাম প্রচার ও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাঁহার বীরত্বসূচক পদক্ষেপও জীর্ণ জাতির বুকে নব জীবনের স্পন্দন জাগায়। হযরত আবূ বকর (রা)-এর সাহস, হিম্মত, দৃঢ়তা ও বিরত্তের সম্মুখে তৎকালীন দুনিয়ার সম্মিলিত শক্তিও ছিল তৃণখণ্ডের ন্যায় হীন ও নগণ্য। সংকল্প ও দৃঢ়তার এই প্রতীক প্রবর কুণ্ঠা, সংকোচ ও ইতস্ততার সহিত কিছুমাত্র পরিচিত ছিলেন না। লোকদের অন্তর্নিহিত প্রতিভা, শক্তি ও যোগ্যতা সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা পোষণ করা এবং যোগ্যতা ও প্রতিভা অনুসারে বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করা ও তদানুযায়ী তাহাদের নিকট হইতে কাজ আদায় করার ব্যাপারে তাঁহার যোগ্যতা ও দূরদৃষ্টি ছিল নিঃসন্দেহে অতুলনীয়।
রাসূলে করীম (স)- এর জিবদ্দশায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) একনিষ্ঠ রাসূল-প্রেমিক হিসেবেই জীবন যাপন করিয়াছেন। দুর্ধর্ষ কুরাইশগণ যখন রাসূলে করীম(স)-এর উপর নানাবিধ অমানুষিক অত্যাচার-উৎপীড়ন করিত, তখন হযরত আবূ বকর (রা)ই তাহাদের মুকাবিলায় বুক পাতিয়া দিতেন। রাসূলুল্লাহর ইসলামী দাওয়াত সর্বপ্রথম তিনিই কবুল করিয়াছেন এবং হিজরাতের কঠিন ও নাজুক অবস্থায় ‘সওর’ পর্বত-গুহা হইতে মদীনা পর্যন্ত মরু ও পর্বত-সংকুল বন্ধুর পথে পূর্ণ প্রাণোৎসর্গ সহকারে রাসূলুল্লাহর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে রহিয়াছেন। মদিনায় রাসূলে করীম(স)-কে ইয়াহুদীদের ষড়যন্ত্র ও মুনাফিকদের কুটিলতার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল এবং মক্কার কুরাইশ ও মদীনার ইয়াহুদীদের উপর্যুপরি শত্রুতামূলক তৎপরতার ফলে সমস্ত আরব দেশ রাসূলের প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিয়াছিল। এই জটিল সময়ে হযরত আবূ বকর (রা) ই নবী করীম(স)-এর বিশেষ সহচর ও পরামর্শদাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করিয়াছেন।বস্তুত ইসলামের শ্রেষ্টত্ত প্রতিষ্ঠার জন্য আবূ বকর (রা) যে ভূমিকা অবলম্বন করিয়াছেন এবং রাসূলের জীবদ্দশায় তিনি এই প্রসঙ্গে যে বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়াছেন, সমষ্টিগতভাবে তাহা কেবল স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়া রাখার বস্তুই নহে, উহার প্রতিটি বিষয়ে এককভাবে তাঁহার জীবনকে চিরদিনের তরে জীবন্ত করিয়া রাখার জন্য যথেষ্ট। প্রকৃতপক্ষে হযরত আবূ বকর (রা)-এর শ্রেষ্টত্ত ও মর্যাদা ভাষায় বর্ণনা করা এক সুকঠিন ব্যাপার। কেননা ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যে ত্যাগ ও কুরবানী দান করিয়াছেন, তাহা মূলতঃই হৃদয় ও ঈমানের ব্যাপার। তাঁহার হৃদয়ে ইসলাম ও রাসূলে করীম (স)-এর জন্য যে গভীর ভালবাসা বিদ্যমান ছিল, তাহা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই ভাল জানেন। রাসূলের ইন্তেকালের পর হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফত আমলে যে সব ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে এবং তাহাতে তিনি যে নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহন করিয়াছেন, তাহা হইতেই প্রথম খলীফার সুতীক্ষ্ণ বিচক্ষণতা,দূরদৃষ্টি এবং গভীর ও সূক্ষ্ম জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁহার খলীফা নির্বাচিত হওয়ার অব্যবহিত পরই মুর্তাদগণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠিলে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তাসহকারে তাহাদের মুকাবিলা করেন এবং কঠিন হস্তে বিদ্রোহীদের মস্তক চূর্ণ করিয়া দেন। অতঃপর তিনি পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। এই দুইটি রাষ্ট্রের ব্যাপারে তিনি যে সাম্যের অস্ত্র প্রয়োগ করিয়াছিলেন তার কবল হইতে আত্তরক্ষা করার মত কোন অস্ত্রই উহাদের নিকট ছিল না। পারস্য ও রোমক সাম্রাজ্যের জনগন ব্যক্তিগত তথা রাজতন্ত্রের নিষ্ঠুর পেষণে নিষ্পেষিত হইতেছিল। উভয় সাম্রাজ্যের প্রজাসাধারণ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। বংশীয়-গোত্রীয় বৈষম্য ও পার্থক্যের অভিশাপ উভয় জাতির উপরই জগদ্দল পাথরের ন্যায় চাপিয়াছিল। শাসকগণ জনসাধারণকে নীচ বলিয়া মনে করিত এবং তাহাদিগকে সকল প্রকার মান-মর্যাদা ও অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখাই নিজেদের কর্তব্য বলিয়া মনে করিত। ঠিক এই সময়ই হযরত আবূ বকর (রা) ইসলামের বিচার,ইনসাফ ও সাম্যের পতাকা উড্ডীন করেন। তিনি পারস্য ও রোম আক্রমণকারী সেনাধ্যক্ষগণকে সুবিচার, ইনাসাফ ও সাম্যের মানদণ্ড এক মুহূর্তের তরেও হস্তচ্যুত না করার জন্য বিশেষ হেদায়েত প্রদান করেন এবং বিজিত দেশের সমস্ত জনগণের প্রতি জাতি,ধর্ম, বংশ নির্বিশেষে সাম্যের আচরণ অবলম্বন করার সুস্পষ্ট নির্দেশ দেন। ফলে যুগান্তকালব্যাপি জুলুম-পীড়ন, নির্যাতন-নিষ্পেষণ ও অসাম্য-অবিচারে জর্জরিত জনতা ইসলামের উদার সাম্য ও সুবিচার নীতির আলোকচ্ছাটায় মুগ্ধ হইয়া বাঁধভাঙ্গা বন্যার ন্যায় উচ্ছসিত হইয়া উঠে এবং উক্ত রাষ্ট্রদ্বয়ের বিরাট সামরিক শক্তি ও দুর্জয় সশস্ত্র বাহিনী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের মুষ্টিমেয় অস্ত্র-শক্তিহীন বীর মুজাহিদীনের নিকট পরাজয় বরণ করিতে বাধ্য হয়।
রাসূলে করীম (স)-এর জীবনকাল ও খিলাফতের দ্বিতীয় পর্যায় তথা হযরত উমর (রা)-এর খিলাফত কালের মধ্যে হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফতের একটি বিরাট স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্ট মর্যাদা বিদ্যমান। রাসূলের যুগ মূলত পথ-নির্দেশ ও সংশোধন সংস্কারের পর্যায়। শরীয়াতের পবিত্র বিধানসমূহ তখন নাজিল হয়। আল্লাহ্র তরফ হইতে মানবতার চিরন্তন হেদায়েতের জন্য রাসূলের মারফত ক্রমাগতভাবে আইন-কানুন নাজিল হইতেছিল। পক্ষান্তরে হযরত উমর ফারুক (রা)-এর যুগ হইতেছে সাংগঠনিক পর্যায়। তখন নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা ও যাবতীয় কার্য সম্পাদনের জন্য নিয়ম-কানুন রচিত হইতেছিল; খিলাফতের শাসন-কার্যে শৃঙ্খলা বিধানের জন্য বিভিন্ন বিভাগ গঠন করা হইতেছিল। প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফতকালে উল্লেখিত দুই পর্যায়ের মধ্যবর্তী হইলেও এই সময় উদ্ভুত অসাধারণ ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দরুণ তাহা এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সমুজ্জল।
হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফত কালে যে সব দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়, তাহাতে গোটা ইসলামই এক কঠিন বিপদের সম্মুখীন হইয়া পড়ে। নবী করীম (স) এর তেইশ বৎসরকালীন সাধনা ও সংগ্রামের ফলে গঠিত ঐক্যবদ্ধ জাতি এক মারাত্মক বিশৃঙ্খলার আঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া যাইবার উপক্রম হয়। মূলতঃ রাসূলের জীবনকালে শেষ ভাগেই রাষ্ট্রীয় উচ্ছৃঙ্খলতার সূচনা হয়। মুসাইলামা বিন হাবীব নামক জনৈক ভণ্ড ইয়ামামা হইতে নবী হওয়ার দাবি করিয়া দূত মারফত অর্ধেক আরব তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়ার পয়গাম প্রেরণ করে। অতঃপর আসওয়াদ আনাসী নামক অপর এক ভণ্ডও যাদুখেলা দেখাইয়া ইয়ামনবাসীদিগকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করিতে চেষ্টা করে। এমনকি শক্তি সঞ্চয়ের পর সে ইয়ামনের দক্ষিণ অংশ হইতে রাসূলে করীম (স)-এর নিযুক্ত কর্মচারীদের বিতাড়িত করিয়া উহা নিজের শাসনাধীন করিয়া লয়। এই সময় রাসূলে করীম (স) ইয়ামনে সৈন্য প্রেরণ করিয়া তাহার মস্তক চূর্ণ করার ব্যবস্থা করিতে বাধ্য হন। বস্তুতঃআরবের জনগণ যদিও তওহীদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিয়া মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করিয়াছিল; কিন্তু ইসলামের ধর্মীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক শাসন-সংস্থার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সম্বন্ধে তাহাদের অনেকেই সম্পূর্ণ অবহিত ছিল না। আরববাসীগণ এমনিতেই ছিল জন্মগতভাবে স্বাধীনতাপ্রিয়; কোন প্রকার সুসংগঠিত রাষ্ট্র-সরকারের অধীনতা স্বীকার করা ও প্রাণ-মন দিয়া উহার আনুগত্য করিয়া যাওয়া তাহাদের ধাতে সহিত না। এই জন্য রাসূলের ইন্তেকালের পর মুহূর্তেই আরবের বিভিন্ন গোত্র মদীনার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিতে শুরু করে। বিদ্রোহের আগুন তীব্র গতিতে আরবের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়ে। মুর্তাদদের পাশাপাশি অনেকে আবার বায়তুল মালে যাকাত প্রদান করিতে অস্বীকৃত জ্ঞাপন করে। মদীনায় এই সংবাদ পৌঁছিলে লোকদের মধ্যে সাংঘাতিক দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দেখা দেয়। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কি করা উচিত, তাহা তাঁহারা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। কোন কোন সাহাবী-এমনকি হযরত উমর ফারুক (রা)ও-এই মত পোষণ করিতেন যে, যাকাত অস্বীকারকারী লোকদের বিরুদ্ধে এই কঠিন মুহূর্তে কোন সশস্ত্র পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত হইবে না, বরং তাহারা যতক্ষণ পর্যন্ত কালেমায়ে তাইয়েবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়িবে ততক্ষন তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করাই সমীচীন। তাঁহারা মনে করিতেন যে, বিদ্রোহীদের সঙ্গে সঙ্গে যাকাত অস্বীকারকারীদেরও দমন করার চেষ্টা করিলে যুদ্ধক্ষেত্র অধিকতর বিশাল ও ব্যাপক হইয়া পড়িবে, যাহার পরিণাম ভাল হইবে বলিয়া মনে করা যায় না। কিন্তু বীর খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)সকল প্রকার বিপদ-শঙ্কা উপেক্ষা করিয়া মুর্তাদ বিদ্রোহীদের ন্যায় যাকাত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করার সংকল্প প্রকাশ করিলেন এবং এই পদক্ষেপ হইতে তাঁহাকে কোন শক্তিই বিরত রাখিতে পারিল না।
ইসলামের ইতিহাসে মুর্তাদদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই যুদ্ধের গুরুত্ব খুবই অপরিসীম। বস্তুতঃএই যুদ্ধ ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রকে চির ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছে বলিলেও কিছু মাত্র অত্যুক্তি হইবে না। কেননা, একথা সুস্পষ্ট যে, মদীনার অধিকাংশ লোকের রায় অনুযায়ী হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যদি মুর্তাদদের বিরুদ্ধে এই জিহাদ না করিতেন,তাহা হইলে ফিতনা-ফ্যাসাদ কিছুমাত্র প্রশমিত হইত না।আর এই যুদ্ধে ইসলামী ফৌজ যদি জয়যুক্ত না হইত, তাহা হইলে পরিস্থিতির অবর্ণনীয় রূপে অবনতি ঘটিত এবং উহার ফলে ইসলাম ও মুসলমান উভয়ই একেবারে ধ্বংসের সম্মুখীন হইয়া পড়িত।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে, হযরত আবূ বকর (রা) মুর্তাদদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিয়া অপূর্ব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে ইহার দ্বারা তিনি বিশ্ব-ইতিহাসেরই দিক পরিবর্তন করিয়াছেন এবং নূতনভাবে মানবীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন।
মুর্তাদ বিরোধী এই জিহাদে হযরত আবূ বকর (রা) জয়ী না হইলে পারস্য ও রোমক সাম্রাজ্যদ্বয়ের মুকাবিলায় মুসলমানদের সাফল্য লাভ তো দূরের কথা, ইরাক ও সিরিয়ার দিকে মুসলমানদের অগ্রসর হওয়া পর্যন্ত সম্ভব হইত না। তখন এই বিরাট ইসলাম-বিরোধী রাষ্ট্রদ্বয়ের ধ্বংসস্তূপের উপর খৃস্টানদের সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিবর্তে ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুনের প্রতিষ্ঠা কোনক্রমেই সম্ভব হইত না।
এই বিরাট জিহাদ সংগঠিত না হইলে সম্ভবতঃহযরত উমর ফারুক (রা) কুরআন মজীদকে গ্রন্থাকারে সন্নিবেশিত করার জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-কে কোন পরামর্শ দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করিতেন না।
পরন্তু মুর্তাদদের এই বিদ্রোহকে অংকুরেই ধ্বংস করা সম্ভব না হইলে হযরত আবূ বকর (রা) মদীনায় কোন প্রকার মজবুত রাষ্ট্র-সরকারই পরিচালনা করিতে পারিতেন না এবং তাহাঁরই পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর এক গগনচুম্মি প্রাসাদ তৈয়ার করা হযরত উমর (রা)-এর পক্ষে কখনই সম্ভব হইত না।
বস্তুতঃই এ বিরাট ও বিপ্লবাত্মক ঘটনাবলী মাত্র সাতাইশ মাসের এক সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সংঘটিত হইয়াছিল। এই স্বল্পকালীন খিলাফতকে এর শ্রেণীর লোক বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাহে না; বরং তাহারা খুলাফায়ে রাশেদুন, এমন কি ইসলামী রাষ্ট্র বলিতে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফতকেই বুঝিয়া থাকে এবং জনসমক্ষে উহাকেই পেশ করে। তাহারা মনে করে যে, হযরত আবূ বকর (রা) এই সংকীর্ণ সময়ের মধ্যে খুব বিরাট কোন বিপ্লবাত্মক কাজ সম্পন্ন করিতে পারেন নাই এবং তাহার সংক্ষিপ্ত কর্মকাল এইরূপ কোন কাজের জন্য যথেষ্টও নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা মোটেই সত্য নহে। বিশ্ব-ইতিহাসের যে সব বিপ্লব মানবতার সম্মুখে উত্তরোত্তর উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে, উহার অধিকাংশই অতি অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হইয়াছে। ইতিহাসে ইহার দৃষ্টান্তের কোন অভাব নাই। বিশ্ব-ইতিহাসে যে ইসলামী রাষ্ট্র-বিপ্লবের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহার প্রথম ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন হযরত রাসূলে করীম (স)। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) উহাকে প্রতি-বিপ্লবী আক্রমণের আঘাত হইতে রক্ষা করিয়াছেন এবং হযরত উমর (রা) উহাকে উন্নতির উচ্চতম পর্যায়ে উন্নীত করিয়াছেন। কাজেই উমর ফারুক (রা)-এর উন্নত খিলাফত-রাষ্ট্রকে যথাযথরূপে অনুধাবন করিতে হইলে তাঁহার পূর্ববর্তী এবং নবী করীম (স)-এর পরবর্তী হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফতকাল বিস্তারিতরুপে পর্যালোচনা করা একান্তই আবশ্যক। আমরা এই দিকে পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করিব।