ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(স) আল্লাহ্ তা’আলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসাবে দুনিয়ায় প্রেরিত হইয়াছিলেন। দুনিয়ায় তাঁহার উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হইয়াছিল,ইসলামী পরিভাষায় সেই দায়িত্তের সরূপকে এক কথায় বলা যায়ঃ “ইক্কামতে দ্বীন”। আল্লাহ্র দ্বীন পুর্নাঙ্গরুপে কায়েম করাই ছিল সর্বশেষ নবীর মৌলিক দায়িত্ব। এই বাক্য হইতে স্বতঃই স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, তিনি “দ্বীন” নিজে রচনা করেন নাই, আল্লাহ্র নিকট হইতে গ্রহন করিয়াছেন। এই “দ্বীন”অহীর মাধ্যমেই তাঁহার প্রতি আল্লাহ্র নিকট হইতে নাজিল হইয়াছে। এই হিসাবে তিনি আল্লাহ্র রাসূল। আল্লাহ্র নিকট হইতে পাওয়া “অহী” মৌলিক প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে উহার যথাযথ ব্যাখ্যা দান এবং নিজের জীবনে বাস্তব অনুসরণের মাধ্যমে উহাকে সমুদ্ভাসিত করিয়া তোলাও ছিল নবী-রাসূল হিসাবেই তাঁহার দায়িত্তের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু “ইক্কামতে দ্বীন”-এর জন্য এইটুকু কাজই যথেষ্ট ছিলনা,আল্লাহ্র নাজিল করা আইন-বিধানকে ব্যক্তি জীবনে ও সমাজ-সমষ্ঠির সার্বিক ক্ষেত্রে পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করাও ছিল নবী-রাসূল হিসাবেই তাঁহার কর্তব্য। এই কারণে তাঁহাকে যে দ্বীনী দাওয়াতী প্রচেষ্টা চালাইতে হইয়াছে, তাহাই বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করিয়া একটি পুর্নাঙ্গ রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। এই হিসেবে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা এবং উহার জনগণের একচ্ছত্র নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র বলিতে যাহা বুঝায়,নবী করীম (স)-এর সাধনা-সংগ্রামের পরিণতিতে সেই জিনিসেরই পূর্ণ প্রতিফলন বিদ্যমান।“রাষ্ট্র” একটি রাজনৈতিক সংস্থা। মানব জীবনের প্রয়োজন পরিপূরণের উদ্দেশ্য এই সংস্থাটি গড়িয়া তোলা হয় এবং জীবনকে কল্যাণময় ও উন্নততর করিয়া তোলার জন্য ইহার অস্তিত্ব অক্ষুন্ন ও স্থায়ী করিয়া রাখা হয়।“রাষ্ট্র”মানব-শক্তির উন্নততর ফসল। যেখানে মানব জাতির একটা বিরাট সংখ্যা-সমষ্ঠি সাধারনতঃএকটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের দখলদার এবং বহু সংখ্যক লোকের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রেণীর ইচ্ছা তাহাদের সম্মিলিত শক্তির কারণে উহার বিরুদ্ধবাদীদের দমন-উদ্দেশ্য কার্যকর হইতে পারে; সেখানেই রাষ্ট্র অস্তিত্বশীল। আর সংক্ষিপ্ত ভাষায়, কোন বিশেষ ভূ-খণ্ডের রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গড়িয়া উঠা জাতীয় সত্তাকেই বলা হয় রাষ্ট্র বা State।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রদত্ত এই সংজ্ঞাসমূহ হইতে নিম্নোক্ত চারটি জিনিসই রাষ্ট্রের মৌল উপকরণ রূপে প্রমাণিত হইয়াছেঃ(১)জনতা(population),(২)নির্দিষ্ট ভূখন্ড(Territory),(৩)সার্বভৌমত্ব(Sovereignty)এবং (৪)প্রশাসন যন্ত্র বা সরকার(Government)।
রাসূলে করীম(স)-এর মদীনায় উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তাঁহার দায়িত্ব পালন প্রচেষ্টার যে ফসল ফলিয়ছিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সুক্ষাতিসুক্ষ বিচার-বিবেচনায়ও তাহাতে এই চারটি মৌল উপকরণ পূর্ণমাত্রায় বর্তমান ছিল-যদিও দৃষ্টিকোণ ও মৌল ভাবধারার দিক দিয়া উহার স্বরূপ ছিল অন্যান্য সব রাষ্ট্রবিজ্ঞান হইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।
রাষ্ট্রের প্রথম ভিত্তিস্থাপন
নবী করীম(স) আল্লাহ্র রাসূল ও নবীরুপে মনোনীত হওয়ার পর দ্বীন-ইসলামের যে বিপ্লবাত্মক আদর্শ প্রথমে গোপনে এবং পরে প্রকাশ্য প্রচার করিতে শুরু করিয়াছিলেন, তাহাতে তদানীন্তন কুরাইশদের ধর্মমত, নৈতিক চরিত্র, অর্থ ব্যবস্থা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রবল প্রতিক্রিয়া সূচিত হইয়া ছিল। সত্য কথা এই যে, ইহার দরুণ তাহাদের সর্ব প্রকার স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্খা এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইয়া পড়িয়াছিল। এই কারণে কুরাইশরা নবী করীম(স) এবং তাঁহার প্রতি ইমানদার মুসলমানদের জীবনকে দুঃসহ অত্যাচার ও নিপীড়নে জর্জরিত করিয়া তুলিয়াছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহ্ তা’আয়ালার নির্দেশানুক্রমে মক্কা ত্যাগ করিয়া মদিনায় চলিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এই সময় নবী করীম(স) হজ্জ উদযাপন উদ্দেশ্য আগত মদিনার মুসলমানদের নিকট হইতে দুই-দুইবার আনুগত্যর “বায়’আত”১ {শব্দটির ব্যবহারিক ও পারিভাষিক অর্থ “আনুগত্যর শপথ”।} ইতিহাসে এই “বায়আত”দুইটি “প্রথম আকাবা-বায়’আত”ও “দ্বিতীয় আকাবা-বায়’আত”২{‘আকাবা’ বায়’আতের পূর্ণ বিবরণ এইরূপঃ মদীনার লোকেরা রাত্রির তৃতীয় প্রহরে ‘আকাবা’ নামক স্থানে সমবেত হইয়া রাসূলে করীম(স)-এর আগমন প্রতীক্ষায় উদগ্রীব। একটু পরেই নবী করীম(স) তাঁহার চাচা আব্বাসকে(তিনি তখন ইসলাম গ্রহন করেন নাই)সঙ্গে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন।প্রথমেই আব্বাস বলিলেনঃ হে খাজরাজ গোত্রের লোকের! তোমরা ভাল করিয়াই জান, মুহাম্মদ (স) আমাদের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তি। তাঁহার শত্রুদের হইতে আমারাই তাঁহার সংরক্ষক। কিন্তু এক্ষণে তিনি নিজেই এই শহর(মক্কা) ত্যাগ করিয়া তোমাদের সহিত মিলিত হওয়ার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। কেননা তোমরা তাঁহাকে নিজেদের শহরে আহ্বান জানাইতেছ। তোমরা যদি তাঁহার পূর্ণ সংরক্ষনে শক্তিশালী হইয়া থাক এবং তাঁহার শত্রুদের হাত হইতে তাঁহাকে রক্ষা করার সাহস তোমাদের থাকে, তাহা হইলে তোমরা ইহা কর। অন্যথায় এখনি তোমাদের ‘না’ বলিয়া দেওয়া উচিৎ। কেননা মুহাম্মাদ এখন তো আমাদের হেফাজতে আছেন। তোমরা তাঁহাকে লইয়া গিয়া শত্রুদের হাতে ছাড়িয়া দিবে- এমনটি যেন না হয়। তাঁহারা বলিলেন, ‘আমরা আপনার কথা শুনিয়াছি। এখন সে রাসূল, আপনার বক্তব্য বলুন। আল্লাহ্র বিধান কিংবা আপনার নিজের সম্পর্কে আমাদের নিকট হইতে যদি কোন প্রতিশ্রুতি লইতে হয়, তবে তাহা গ্রহন করুন। ইহার পর নবী করীম(স) প্রথমে কুরআন মজিদের অংশ বিশেষ পাঠ করিলেন। আল্লাহ্র বন্দেগী কবুল করার এবং তাঁহার সহিত শিরক না করার শর্ত পেশ করিলেন। অতঃপর বলিলেনঃ ‘আমি তোমাদের নিকট হইতে প্রতিশ্রুতি লইতেছি যে, তোমরা আমার সাহায্য সহযোগিতা ও সমর্থন এমনভাবে করিবে,যেমন তোমরা তোমাদের স্ত্রীলোকদের ও তোমাদের সন্তানদের করিয়া থাক’। ইহার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলে করীম(স)-এর হাত ধরিয়া তাঁহারা বলিয়া উঠলেনঃ ‘হ্যাঁ,সেই মহান সত্তার শপথ,যিনি আপনাকে সত্য-সঠিক দ্বীনসহ পাঠাইয়াছেন,আমরা এমনিভাবেই আপনার সহায়তা ও সংরক্ষণ করিব, যেমন আমরা আমাদের পরিবারবর্গের করিয়া থাকি’। অতঃপর সকলেই সমবেতভাবে বলিলেনঃ ‘আমরা প্রতিশ্রুতি দিতেছি, আমরা সর্বাবস্থায় আপনার কথা শুনিব, আপনার আনুগত্য স্বীকার করিব- দুঃখ-বিপদ,স্বাচ্ছন্দ্য-সচ্ছলতা কিংবা অভাব-অনটন যাহাই হউক না কেন আর আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমরা সর্বসময় ও সর্বাবস্থায় সত্য বলিব;কাহাকেও ভয় করিব না এবং কোন উৎপীড়নেরও পরোয়া করিব না।
অতঃপর তাঁহার বলিলেনঃ ‘আমাদের মনে একটা প্রশ্ন জাগিতেছে। এমন তো হইবে না যে, আল্লাহ্ তা’আলা যখন আপনাকে বিজয় দান করিবেন,তখন আপনি আমাদিগকে ত্যাগ করিয়া আপনার নিজের জাতির লোকদের সহিত মিলিত হইয়া যাইবেন’? ইহা শুনিয়া নবী (স) স্মিত হাসি হাসিলেন এবং বলিলেনঃ
*******(আরবী)
না,এ বিষয়ে তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। তোমরা যাহার সহিত লড়াই করিবে,আমিও তাহাদের সহিত লড়াই করিব। তোমরা যাহাদের সহিত সন্ধি করিবে আমিও তাহাদের সহিত সন্ধি করিব। তোমাদের দায়িত্ব আমার দায়িত্ব। তোমাদের মর্যাদা-সম্ভ্রম আমার মর্যাদা ও সম্ভ্রম রুপে গণ্য হইবে। আর আমার জীবন ও মরন তোমাদের সঙ্গেই হইবে।
বস্তুতঃ আকাবায় এইরুপ কথোপকথনের মাধ্যমে প্রকারান্তরে একটি সামাজিক-সামষ্ঠিক চুক্তিই সম্পাদিত হইয়াছিল। ইহার মাধ্যমে মদিনাবাসীরা রাসূলে করীম(স)-কে নিজেদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্র-কর্তারুপে যুগপৎ মানিয়া লইলেন এবং তাঁহাদের আহ্বানে তিনি মদীনায় চলিয়া গেলেন। নবী করীম(স) হইলেন তাঁহাদের একচ্ছত্র নেতা।}নামে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রহিয়াছে। এই সময় দুইজন স্ত্রীলোকসহ মদিনার আওস ও খাজরাজ নামক দুই প্রধান বিবাদমান গোত্রের মোট প্রায় ৭৫জন মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হইয়া রাসূলে করীম(স)-এর হাতে ‘বায়’আত’ গ্রহন করেন। এই বায়’আতে তাঁহারা দ্বীন- ইসলামকে পুর্নাঙ্গভাবে মানিয়া ও অনুসরণ করিয়া চলার সঙ্গে সঙ্গে নবী করীম(স)-এর সার্বিক নেতৃত্ব মানিয়া লওয়ার,তাঁহার জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করার এবং তাঁহার নেতৃত্বে বিরুদ্ধ পক্ষের সহিত প্রাণ-পণ যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হওয়ার অঙ্গীকার দান করেন। শুধু তাহাই নয়, নবী করীম(স)-কে তাঁহার সঙ্গী-সাথীসহ মদীনায় যাইবার জন্য তাঁহারা আহ্বান জানান এবং সেখানে তাঁহাদিগকে বসবাসের জন্য স্থান দেওয়ার প্রতিশ্রুতিরও পুনরুল্লেখ করেন। মদীনাবাসীরা নবী করীম(স)-কে একজন ‘আশ্রয় গ্রহণকারী’(Settler-Asylum) রুপে নয়-আল্লাহ্র রাসূল ও প্রতিনিধি এবং তাঁহাদের সর্বাত্মক নেতা ও প্রশাসক হিসেবেই এই আহ্বান জানাইয়াছিলেন। নবী করীম(স) এই আহ্বান গ্রহন করিয়া সঙ্গিসাথী সমভিব্যহারে মদিনায় স্থানান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত ও এইখানে ঘোষণা করেন। বস্তুতঃ একটি রাষ্ট্রের দানা বাঁধিয়া উঠার মূলে সর্বপ্রথম যে সামাজিক-সামষ্ঠিক চুক্তি(Social Contract)-র অবস্থিতি প্রথম শর্ত, মদীনায় প্রতিনিধি স্থানীয় অধিবাসীদের নিকট হইতে নবী করীম(স)-এর গৃহীত আকাবার এই ‘বায়াআত’ সেই চুক্তিরই বাস্তব রূপ। প্রকৃতপক্ষে এই ‘বায়’আতে’র মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল। এই ‘বায়’আত’ মক্কার এক নির্জন পর্বতগুহায় অনুষ্ঠিত হইলেও উহার জন্য স্থান(Territory)নির্দিষ্ট হইয়াছিল মদীনা। ‘মদীনা’ এই সময় হইতেই ‘মদীনাতুর-রাসূল’- রাসূলের মদীনা কিংবা ‘মদীনাতুল-ইসলাম’- ইসলামের কেন্দ্রভূমি মদীনা-নামে অভিহিত হইতে শুরু করিয়াছিল।পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি রাষ্ট্র(State)-এর সর্বশেষ সংজ্ঞায় যে কয়টি জরুরী শর্ত উল্লেখিত হইয়াছে,সেই সব কয়টিই এখানে পুরাপুরি বর্তমান মদিনার মুসলমানগণ যে ‘বায়আত’ করিয়াছিলেন এবং এই প্রসঙ্গে উভয় পক্ষে যে কথোপকথন হইয়াছিল, তাহা হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, নবী করীম (স)-কে তাঁহারা মদীনা গমনের আহ্বান জানাইয়া এক কঠিন বিপদের ঝুঁকি মাথায় লইয়াছিলেন।তাঁহারা ইহা অবলীলাক্রমে সহ্য করিয়া যাইতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলেন। অন্যকথায়, একটি ক্ষুদ্রায়তন উপশহর যেন নিজেকে নিজে সমগ্র দেশের চূরান্ত শত্রুতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কটের মুখে ঠেলিয়া দিতেছিল। অবশ্য ইহার পরিনতিও ঠিক তাহাই হইয়াছিল।
অপরদিকে মক্কাবাসীদের জন্য ও এই বায়’আত বিশেষ অর্থবহ এবং বিপজ্জনক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। কেননা মুসলমানগণ মক্কার বাহিরে অন্য একস্থানে একত্রিত হইলেও- ইহারই মাধ্যমে একটি শক্তি, একটি রাষ্ট্ররূপে এবং মক্কাবাসীদের কুফর-শিরক, অরাজকতা-উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতি একটা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। অর্থাৎ মক্কাবাসীদের জন্য ইহা শুধু ধর্মীয় বিপদই নয়, ইহা একটি সুস্পষ্ট ‘রাজনৈতিক বিপদ’ হইয়া দেখা দিয়াছিল। মদিনা যেহেতু ইয়ামেন হইয়া সিরীয়া যাওয়ার বাণিজ্য পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান সেহেতু এখানে মুসলমানদের রাষ্ট্ররূপে পরিগ্রহের ফলে এই পথটি তাহাদের জন্য চিরতরে বন্ধ হইয়া যাইবার কিংবা অন্ততঃবিপদ-সঙ্কুল হইয়া পড়ার আশংকা দেখা দিয়াছিল। অথচ এই পথটি ছিল কুরাইশ ও অনন্যা বড় বড় গোত্রের লোকদের অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান যোগসূত্র। কুরাইশরা ইহার পরিণতি মর্মে মর্মে অনুধাবন করিতে পারিয়াছিল। সে কারণে তাহারা বিশ্বনবীর জীবন-প্রদীপ চিরতরে নির্বাপিত করিয়া ফেলার জন্য পূর্বাহ্ণেই ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করিয়াছিল।
এক কথায়, এই ‘বায়’আত’ একদিকে যেমন ছিল প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র-সংস্থার ভিত্তিপ্রস্তর, অপরদিকে ইহার মাধ্যমে একটি আদর্শিক সমাজ-সংস্থার ভিত্তিও সংস্থাপিত হইয়াছিল। বস্তুতঃ জানা ইতিহাসে(Known History) পুরাপুরি আদর্শ-ভিত্তিক রাষ্ট্র বলিতে এইটিকেই বুঝায়।
মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র
আকাবার বায়’আত অনুসারে রাসূলে করীম(স)-এর হিজরাতের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম মদীনায় স্থানান্তরিত হইল। প্রথমে যাহা ছিল বীজ, এক্ষণে তাহাই হইল বৃক্ষ। যাহা ছিল থিওরী(Theory),এক্ষণে তাহাই হইল বাস্তব(Practical)। প্রথম যাহা ছিল নিছক মৌখিক আনুগত্যর মধ্যে সীমাবদ্ধ, এক্ষণে তাহাই দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে ও সামাজিক-সামষ্ঠিক বিষয়াদিতে অনুসৃত হইয়া শরীরী হইয়া উঠিল। মক্কায় যাহা ছিল সূচনা, মদীনায় তাহাই অগ্রগতির স্তরসমূহ অতিক্রম করিয়া ধাপে ধাপে পুর্নত্তের দিকে আগাইয়া যাইতে লাগিল।
মদীনায় পৌছিয়া নবী করীম(স) প্রথম পর্যায়েই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করিলেন। প্রথম কাজটি হইল, একটি মসজিদের ভিত্তিস্থাপন। এই মসজিদ কেবল পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার স্থানই নয়, ইহা মুসলিম জনতার মিলন-কেন্দ্রে পরিণত হইল। এই স্থানকে কেন্দ্র করিয়াই নবী করীম(স) ইসলামের জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত লোকদের লইয়া একটি আদর্শ-ভিত্তিক সামাজিক-সামষ্ঠিক শক্তির লালন ও বিকাশ সাধনের জন্য প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইতে শুরু করিলেন। তিনি ইসলামের মহান আদর্শের ভিত্তিতে একটি পুর্নাঙ্গ রাষ্ট্র পরিচালনের যোগ্য নাগরিক ও কর্মী-নেতৃবাহিনী গড়িয়া তোলার সর্বাত্মক সাধনায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন এই মসজিদকে কেন্দ্র করিয়া। এই মসজিদই ছিল রাষ্ট্রপ্রধান ভবন,সেনাধ্যক্ষর(Supreme Commander) হেড কোয়ার্টার এবং সর্বোচ্চ প্রশাসকের কেন্দ্রীয় অফিস।
দ্বিতীয় কাজ হইল, মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন। ইহা ছিল কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশের বাস্তব অনুসরণ। নির্দেশটি এইঃ
*******(আরবী)
মু’মিন লোকেরা পরস্পরের ভাই; অতএব তোমরা এই ভাইদের মধ্যে পারস্পরিক সন্ধি ও কল্যাণ স্থাপন কর। আর সকলে সম্মিলিতভাবে আল্লাহ্কে ভয় করিয়া চল; তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হইবে বলিয়া আশা করা যায়।
ইসলাম সমগ্র বিশমানবতার অভিন্ন ভ্রাতৃত্বের পয়গাম লইয়া আসা গতিশীল ও যুগোপযোগী এক মহান বিধান। বর্ণিত ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়া রাসূলে করীম(স) সেই বিরাট বিশ্বমানবিকতারই ভিত্তি স্থাপন ও কর্ম-ধারার সূচনা করিয়াছিলেন।ইহার মাধ্যমে তিনি স্থান-কাল-ভূগলের সীমা ও ভাষার পার্থক্য এবং বংশ-রক্ত-গোত্রের বিভেদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করিয়া দিলেন। এই ভ্রাতৃ-সম্পর্কের কারণে স্থানীয় ও অস্থানীয় ভেদাভেদো চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। সমস্ত বৈষয়িক-বস্তুগত পার্থক্য-বিভেদ নিঃশেষ করিয়া দিয়া নবী করীম (স) এক সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের সমাজ(Society of Universal Brotherhood) গড়িয়া তুলিতে শুরু করিয়াছিলেন।
এই ভ্রাতৃপ্রতীম সমাজের ভাবধারা ছিল এই যে, এখানে কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়। কেউ হীন নয়, কেউ মানী হয়। কেউ আশরাফ নয়, কেউ আতরাফ নয়। কেউ কুলীন নয়, কেউ অকুলীন নয়। এই সমাজের প্রতিটি মানুষ ইসলামের মহান আদর্শে সমান মর্যাদা ও অধিকারসম্পন্ন ভাই মাত্র। ‘মুসলমান’ ই ইহাদের একমাত্র পরিচয়। ইহা ছাড়া তাহাদের আর কোন পরিচয় নাই।
দ্বিতীয় পর্যায়ে এই ভ্রাতৃত্ববোধক নবী করীম(স) সমাজ পুনর্গঠনের ও পুনর্বাসনের একটি কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত করেন। তাহার গঠিত এই সমাজের প্রত্যেক ভাই তাহার অপর ভাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সর্ব প্রকার ত্যাগ স্বীকার করিতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। যাহার আছে সে সেই সব কিছুই দিবে তাহাকে,যাহার সেইসব নাই। কিন্তু ইহা ‘দান’ হইবেনা-হইবেনা ‘অনুগ্রহ’।গ্রহীতা তাহা গ্রহন করিয়া দাতার প্রতি হইবেনা অনুগ্রহীত,করুণার পাত্র-লাঞ্ছিত ও অবমানিত। ইহা তাহার কর্তব্য। একজন তাহার ভাইকে কিছু দিবে, দেওয়া তাহার কর্তব্য বলিয়া। ভাই তাহা গ্রহন করিবে তাহার ভাইয়ের কর্তব্য পালনে সহযোগিতা করার মানসিকতা লইয়া। ইহারই পরিণতিতে কল্পনাতীত স্বল্প সময়ে মক্কা হইতে নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হইয়া আসা বিপুল সংখ্যক লোকের পুনর্বাসনের কঠিন ও জটিল সমস্যার অনায়াসে সমাধান হইয়াছিল। শুধু তাহাই নয়, সামগ্রিকভাবে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র বিপুল সচ্ছলতায় সমৃদ্ধ এবং নূতন শক্তিতে বলিয়ান হইয়া উঠিয়াছিল। প্রতিটি নাগরিকই নিজের উপার্জনের প্রেরণা ও সুযোগ লাভ করিল। ফলে কেহ কাহারও উপর ‘বোঝা’ বা নির্ভরশীল(Dependent) হইয়া থাকিল না।
তৃতীয় পর্যায়ে বিশ্লিষ্টটা ও বিশৃঙ্খলার বুক হইতে ঐক্য, সংহতি ও শৃঙ্খলা গড়িয়া তোলার কঠিন দায়িত্ব রাসূলে করীম (স)-এর সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিল। কার্যতঃ ইহা ছিল একটা পর্বততুল্য বিরাট সমস্যা। অতিতের নবি-রাসূলগণ ও এই সমস্যাটির সমাধানে সফল হইতে পারেন নাই। কিন্তু রাসূলে করীম(স)-কে তাহাই করিতে হইয়াছে এবং তিনি তাহা করিয়াছেন অপূর্ব সাফল্য ও যোগ্যতা সহকারে। দৌর্বল্য,অক্ষমতা ও শক্তিহীনতা বুক দীর্ণ করিয়া শক্তি ও সামর্থের বিরাট বৃক্ষ গড়িয়া তোলাই ছিল তাঁহার সাধনা। পারস্পরিক বিরোধ ও বৈষম্য দূরীভূত করিয়া নিঃছিদ্র একত্বটা ও ঐক্যবদ্ধটা সৃষ্টি করাই ছিল তাঁহার লক্ষ্য। মৃত্যুর তুহীন হিম অপসারিত করিয়া জীবনের উষ্ণতা,চাঞ্চল্য ও তৎপরতা নূতন জগত নির্মাণই ছিল তাহার কর্তব্য। আল্লাহ্ তা’য়ালা এই দিকে ইংগিত করিয়াই বলিয়াছেনঃ
********(আরবী)
এবং আমরা আপনার সেই দুর্বহ বোঝাটি আপনার উপর হইতে নামাইয়া দিলাম,যাহা আপনার পৃষ্ঠদেশ নিচু করিয়া দিয়াছিল।
চতুর্থ পর্যায়ে তাঁহার কর্তব্য ছিল ‘বাহির সামলানো’। এ পর্যন্ত তিনি যাহা কিছু করিয়াছেন তাহাকে বলা চলে ঘর সামলানোর কাজ। কিন্তু কেবল ঘর সামলাইলেই দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণ হয় না।ইসলামী সমাজের আভ্যন্তরীণ ঐক্য ও নিরাপত্তা বিধানের পর উহাকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত করার জন্য দুই পর্যায়ের কাজ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিল। একটি ছিল,ঘরের সংলগ্ন পরিমণ্ডলে অবস্থানকারী অমুসলিম ইয়াহুদি সমাজের নিত্য-নৈমিত্তিক-তথা প্রতি মুহূর্তের শত্রুতার আক্রমন হইতে ইসলামী সমাজের নিরাপত্তা বিধান। আর দ্বিতীয় কাজটি হইল, বহিঃশত্রুর সর্বাত্মক আক্রমণ হইতে ইসলামী রাষ্ট্রের এই নব নির্মিত প্রাসাদটির পুর্নাঙ্গ সংস্করণের সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহন আর সেই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বে ইসলামের ব্যাপক প্রচারের রাজপথ উন্মুক্ত করিয়া দেওয়া।
তখনকার মদীনা শহরে এক প্রকার নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা অবস্থা বিরাজ করিতেছিল।সেখানকার আওস ও খাজরাজ এই দুইটি বড় ও প্রধান গোত্র প্রায় চারটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। অপর দিকে ইয়াহুদিদের দশটি গোত্র ছিল তাহাদের হইতে স্বতন্ত্র। শতশত বৎসরের শত্রুতা তাহাদিগকে পরস্পরের প্রানের দুশমন বানাইয়া দিয়াছিল।সাধারনতঃ কয়েকটি আরব গোত্র তাহাদের শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করার উদ্দেশ্য ইয়াহুদিদের সহায়তা আদায় করিয়া লইত। অপর কতিপয় আরব গোত্র অন্য কয়েকটি বিরোধী গোত্রের সাহায্য লাভ করিত। অতঃপর যে রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হইয়া যাইত,তাহা বংশানুক্রমে ও শতাব্দীকাল ধরিয়া অব্যাহত থাকিত। ইহার ফলে আরবের সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দুঃখ ও কষ্ট নামিয়া আসিত। তাহারা এই প্রাণান্তকর অবস্থা হইতে মুক্তি লাভের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাইতেছিল। এই জন্য নবী করীম(স)-এর মদীনা আগমনের প্রাক্কালে মদীনাবাসীদের একটা বিরাট অংশ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুলকে নিজেদের বাদশাহ ও শাসক নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত লইয়াছিল। নবী করীম(স) মদীনার জনগনের এই অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য তিনি আকাবা বায়আত গ্রহনের পরই মদীনার বিভিন্ন গোত্রের বারো জন সদস্যকে ‘নকীব’ নিযুক্ত করিয়াছিলেন এবং এইভাবে তিনি পারস্পরিক সংঘর্ষলিপ্ত ও বিবাদমান গোত্রগুলির মধ্যে একটা মিলমিশ ও ঐক্য সৃষ্টির জন্য চেষ্টা চালাইয়াছিলেন। কিন্তু এই গোত্রবাদী সমাজের প্রতিটি গোত্রই ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন,স্ব-ব্যবস্থাপনার(Self-administration) অধিকারী এবং নিজেদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছানুবর্তী।এতদ্ব্যতীত সেখানে এই গোত্রসমূহকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ রাখিবার কোন প্রশাসন-ব্যবস্থা বা কার্যকর প্রতিষ্ঠান(Executive Institution)-ই ছিলনা। এতৎসত্ত্বেও নবী করীম(স) প্রেরিত ইসলাম প্রচারকদের চেষ্টায় মদীনাবাসীদের মধ্য হইতে বহু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহন করিয়া মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল,যদিও তখন পর্যন্ত মদীনায় ইসলাম কোন রাজনৈতিক শক্তির মর্যাদা লাভ করিতে পারে নাই।
নবী করীম (স) মদীনায় উপস্থিত হইয়া এই অরাজক পরিস্থিতির অবসান ঘটাইবার উদ্দেশ্য একটি ঘোষণাপত্র তৈয়ার করিলেন।১ {ইতিহাসে এই ঘোষণাই ‘মদিনা-সনদ’ নামে বিধৃত।} এই ঘোষণায় মদীনা একটি ‘নগর রাষ্ট্রের’(city state) মর্যাদা পাইল। উহার ভিত্তিতে সমগ্র বিচ্ছিন্ন দো বিক্ষিপ্ত গোত্রসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির জন্য যারপরনাই চেষ্টা করা হইল।
একথা সর্বজনবিদিত যে, এই লোকেরা অতিতে কখনই কোন রাষ্ট্রশক্তির(State-power/coercive power)নিকট মাথা নত করে নাই। কোন দিনই তাহারা কেন্দ্রীয় শক্তির নিয়ম-শৃঙ্খলা ও প্রভুত্বের অধীনতা পাশে আবদ্ধ ছিল না। নবী করীম(স) এই ঘোষণাপত্রের সাহায্যে তাহাদের সকলকে একটি আইন, তথা এক আল্লাহ্, এক নেতৃত্ব ও একই কিবলার উপর সুসংবদ্ধ ও সুসংহত করিয়া দিলেন। ব্যক্তিগত অধিকারের দিক দিয়া মদীনা-ঘোষণা(Medina Diclaration) ছিল একটি বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ। পূর্বে যে অধিকার এক ব্যক্তি বা একটি পরিবার কিংবা একটি গোত্র ভোগ করিত, এই ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পর তাহা সর্বসাধারণের অধিকার রূপে সাব্যস্ত হইল। এইভাবে একদিকে গোত্রবাদমূলক নৈরাজ্যের অবসান ঘটিল এবং অপরদিকে সঠিক অর্থে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হইল।
মদীনা-চুক্তি(Medina Pact)-র ধারা অনুযায়ী সমগ্র প্রশাসনিক(Administrative),আইনগত(Legal)ও ফৌজদারি বা বিচার বিভাগীয়(Judicial) ক্ষমতা হযরত মুহাম্মাদ(স)-এর উপর অর্পিত হইয়াছিল। তবে এই ব্যাপারে বিশ্বনবী ও দুনিয়ার অন্যান্য শাসকদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। তিনি কোন স্বেচ্ছাচারী ও দুর্বিনীত শাসক রূপে এই ব্যাপক ও সর্বময় ক্ষমতা গ্রহন করেন নাই। কোনরূপে ব্যক্তি স্বার্থ,ব্যক্তি সার্বভৌমত্ব ও ব্যক্তি আধিপত্যের একবিন্দু ধারণাও তাঁহার সম্পর্কে করা যাইতে পারেনা;বরং তাঁহার রাষ্ট্রনীতি উন্নত নৈতিক ও মানবিক আদর্শের উপর ভিত্তিশীল ছিল। তিনি নিজেকে একজন সার্বভৌম(Sovereign) হিসাবে এক মুহূর্তের তরেও চিন্তা করেন নাই, জনসমক্ষে সেভাবে নিজেকে পেশও করেন নাই। যে আইন তিনি অন্যদের উপর প্রয়োগ করিতেন, তাহা অন্যদের ন্যায় নিজের উপরও প্রয়োগযোগ্য মনে করিতেন। বস্তুত দুনিয়ার রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে ইহার কোন দৃষ্টান্ত দেখানো যাইতে পারে না।
মদীনা-চুক্তি দুইটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশ ২৩টি ধারা সমন্বিত।উহা সম্পূর্ণ মুহাজির ও আনসারদের সহিত সংশ্লিষ্ট। আর দ্বিতীয় অংশ মদীনার ইয়াহুদীদের অধিকার ও কর্তব্য-দায়িত্ব সম্পর্কিত।
এই চুক্তি অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্ব ব্যাপারে নবী করিম (স)-এর ফয়সালা ও রায়ই ছিল চূরান্ত। বিচার বিভাগীয় সর্বোচ্চ মর্যাদা ও ছিল তাহাঁরই। মুহাজির ও আনসার জনগণ তো দ্বীন-ইসলাম কবুল করার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলে করীম(স)-কে শুধু ধর্মীয় নেতাই নয়- সমাজ-রাষ্ট্রকর্তা হিসাবেও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী রূপে স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। কজেই এই ধরনের চুক্তিতে তাহাদের কোনরূপ আপত্তি থাকার প্রশ্নই উঠিতে পারে না। কিন্তু ইয়াহুদী সমাজ তো সমগ্র আরবের উপরই নিজেদের সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের দাবিদার ছিল। এতৎসত্ত্বেও তাহাদের পক্ষে এইরুপ ধারা সমন্বিত চুক্তিতে সম্মত হওয়া ছিল বিশ্বনবীর রাষ্ট্রনীতির একটা বিরাট মুজিজা।
মদীনা-চুক্তির উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ
মদীনা-চুক্তির ধারাসমূহ বিস্তারিতভাবে উদ্ধৃত করা এখানে সম্ভবপর নয়। সংক্ষেপে উহার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারা এবং তৎসংক্রান্ত সাধারণ পর্যালোচনা এখানে পেশ করা যাইতেছে।
ঘোষণাপত্রের প্রথম অংশ হইতে যে রাষ্ট্ররূপ দানা বাঁধিয়া উঠে,তাহা মুহাজির,আনসার ও সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ অন্যান্য গোত্র এবং লোকদের সমন্বয়ে গঠিত। এই সমস্ত লোক সুস্পষ্ট ভাষায় নবী করীম(স)-এর নেতৃত্বে মানিয়া চলার ও তাঁহার সহিত একত্রিত হইয়া শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অঙ্গিকারবদ্ধ হইয়াছিল। নিজেদের মধ্যে শতধা-বিভক্তি ও বিভেদ থাকা সত্ত্বেও ইহারা সমগ্র বিশ্বসমাজ হইতে স্বতন্ত্র একটি একক(Unit)গড়িয়া তুলিয়াছিল।গোটা মুসলিম জনতা অধিকার ও কর্তব্যে সম্পূর্ণ অভিন্ন মর্যাদা গ্রহন করিয়াছিল। যুদ্ধ ও সন্ধি রাষ্ট্রীয় ও সামষ্ঠিক বিশয় রূপে গণ্য হইল। সামরিক দায়িত্ব সকলের জন্য অবশ্যই পালনীয় হইল। নিরাপত্তার অঙ্গীকার দেওয়ার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট হইল।চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার প্রত্যেকের এবং একজনের চুক্তি সকলের জন্য বাধ্যতামূলক হইয়া গেল। ইহার ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থায় পূর্ণ ভ্রাতৃত্ব,সাম্য ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার এক স্বর্ণযুগ সূচীত হইল।
এই চুক্তি অনুযায়ী মক্কার কুরাইশ পক্ষাবলম্বনে বা তাহাদের কোনরূপ সাহায্য ও আশ্রয়দানের অধিকার কাহার ও থাকিল না। উপরন্তু কুরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অগ্রাভিযানে কোন রূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কিংবা বিরুদ্ধতা করাও কাহারও পক্ষে সম্ভব থাকিল না।
সমস্ত ব্যাপারে সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ আদালতের মর্যাদা পাইলেন স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ(স)।
অতঃপর আদালতী ব্যবস্থা আর এক ব্যক্তি বা একটি গোত্রের ব্যাপার হইয়া থাকিল না,বরং ইহা একটি সামষ্ঠিক ও সামাজিক মর্যাদা লাভ করিল।গোটা বিচার বিভাগীয় ক্ষমতাই কেন্দ্রীয় মর্যাদা পাইল।ইহাও ছিল একটি বিপ্লবাত্মক সিদ্ধান্ত।এই সিদ্ধান্তের ফলে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা ও অবিমিশ্র সুবিচার সর্বত্র প্রাধান্য লাভ করিল।কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব কিংবা স্বজন-প্রীতি বা আত্মীয়-প্রীতির সামান্য পথ ও উন্মুক্ত থাকিল না। সমস্ত মুসলমান সামগ্রিকভাবে এই জন্য দায়ী হইল যে, কেহ কাহারও উপর অত্যাচার করিতে পারিবেনা;কেহ কাহারও অধিকার হরণ করিতে পারিবেনা।
মদীনা-চুক্তির দ্বিতীয় অংশ সম্পূর্ণরূপে ইয়াহুদীদের সহিত সম্পর্কিত ছিল।সমস্ত ইয়াহুদী জনগোষ্ঠী একটি সমষ্ঠি হিসাবে ফেডারেল পদ্ধতির ‘মদীনা নগর- রাস্ত্রের’সহিত যুক্ত হইয়াছিল।প্রথম ধারাটিতে বলা হইয়াছিল যে,ইয়াহুদী ও মুসলমানরা যুক্তভাবে যদি কোন যুদ্ধ করে, তাহা হইলে প্রত্যেকেই নিজের নিজের ব্যয়ভার বহন করিবে। উভয়ই নিজেদের ধর্ম পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। এভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারে ইয়াহুদীরা মুসলমানদের সমান অধিকার লাভ করিল। দেশ রক্ষার দায়িত্বে ইহারা পরস্পরের সাহায্যকারী হইল। অর্থাৎ মুসলমান যাহাদের বিরুদ্ধে লড়াই করিবে,ইয়াহুদীরাও তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে বাধ্য হইবে। মুসলমানরা যাহাদের সহিত সন্ধি করিবে,ইয়াহুদীরাও তাহাদের সহিত সন্ধি করিতে বাধ্য হইবে। এই সময় দেশরক্ষার-অর্থাৎ মদীনা নগর-রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে পরস্পরের কার্যকর সাহায্য করাও উভয়ের কর্তব্য হইবে। এই ধরনের চুক্তির ফলে প্রতিরক্ষা (Defense) ব্যাপারটিও কেন্দ্রীয় বিষয়ে গণ্য হইল।অতঃপর রাসূলে করীম(স)মুসলিম ও ইয়াহুদী সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত সেনাবাহিনীর প্রধান (Head and supreme) হইলেন। ইহাই রাসূলে করীম(স)-এর আর একটি বিরাট রাজনৈতিক সাফল্য।
রাসূলে করীম(স)ইয়াহুদিদের একান্ত আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কিছুমাত্র হস্তক্ষেপ করিতেননা।ইহার ফলে তাহাদের মনে যে বিদ্বেষ ও আশঙ্কার কালোমেঘ পুঞ্জিভূত হইয়াছিল,তাহা অতি সহজেই বিলীন হইয়া গেল। তাহারা নিজেরাই সোৎসাহে নিজেদের যাবতীয় ব্যাপারে রাসূলে করীম(স)-কেই সর্বোচ্চ বিচারক হিসাবে মানিয়া ইয়াছিল।আত্মীয়তার ভিত্তিতে তাহাতে কোনরূপ প্রভাব বিস্তার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়া গেল। এইভাবে জাহিলিয়াত যুগের সমস্ত বাতিল নীতির নিদর্শনাদি নিঃশেষে মুছিয়া ফেলা হইল। অবস্থা এই দাঁড়াইল যে,ইয়াহুদীরা নবী করীম(স)-কে শুধু নিজেদের প্রশাসক মানিয়াই ক্ষান্ত হইল না, সমস্ত মদীনাকে তাহারা একটি ‘হারাম’(সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত এলাকা)ও বানাইয়া লইল।ইহাও রাসূলে করীম(স)-এর রাষ্ট্রনৈতিক প্রজ্ঞা ও ধীশক্তির একটা বিরাট পরাকাষ্ঠা ছিল।( পরবর্তী সময়ে অবশ্য ইয়াহুদিরা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার দরুণ মদীনা হইতে শেষ পর্যন্ত নির্বাসিত হইতে বাধ্য হইয়াছিল।)
মদিনা নগর-রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও উহার সংরক্ষণ ব্যবস্থার জন্য আভ্যন্তরীণ দৃঢ়তা বিধানের সঙ্গে সঙ্গে নগরীর উপকণ্ঠে বসবাসকারী গোত্রসমূহের সহিত মিত্রতার সম্পর্ক গড়িয়া তোলাও অপরিহার্য ছিল। এই উদ্দেশ্যে নবী করীম(স) পশ্চিম অঞ্চল ও সীমান্তবর্তী জিলাসমূহ পরিভ্রমণ ও পরিদর্শন করিয়া সেখানকার গোত্রসমূহের সহিত বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করনে। ফলে এইসব গোত্র মুসলমানদের সহিত প্রতিরক্ষার ব্যাপারে মিত্র শক্তি হইয়া দাঁড়াইল।অতঃপর মদীনার চতুর্দিকের গোত্রগুলি মুসলমানদের সহিত শত্রুতা করার পরিবর্তে বিশেষ সাহায্যকারী হইয়া উঠিল।
চূড়ান্ত পদক্ষেপ
মদীনার আভ্যন্তরীণ ও পারিপার্শ্বিক দিক দিয়া পূর্ণ নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা লাভ করার পর নবী করীম(স) মক্কার কুরাইশদের সহিত দশ বছরের জন্য সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি “হুদাইবিয়া’ নামক স্থানে সম্পাদিত হওয়ায় ইতিহাসে ইহা ‘হুদাইবিয়া সন্ধি’ নামে পরিচিত।এই চুক্তি প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের জন্য ‘ফতহুম-মুবীন’-‘সুস্পষ্ট ও সমুদ্ভাসিত বিজয়’-নামে আল্লাহ্র কালাম কুরআন মজীদেই অভিহিত হইয়াছে। এই সন্ধি-চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর নবী করীম(স) সমগ্র আরব দেশে ব্যাপক ও সর্বাত্মকভাবে ইসলাম প্রচারের অবাধ ও নির্বিঘ্ন সুযোগ লাভ করিলেন। সেই সঙ্গে ইয়াহুদীদের শক্তি কেন্দ্র খায়বর হইতেও তাহাদিগকে চিরতরে ও সমূলে উচ্ছেদ করার উপায় হইয়া গেল।খায়বরের দুর্ভেদ্য দুর্গপ্রাকার জয় করার পর নবী করীম(স) সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও রক্তপাতহীন নিয়মে মক্কা শরীফ জয় করিতে সমর্থ হইলেন। অষ্টম হিজরী সনে মক্কা বিজয়ের পর নবী করীম(স) সমগ্র আরব উপদ্বীপটিকে ইসলামের একক ও নিরংকুশ শাসনাধীনে ঐক্যবদ্ধ করিয়া লইতে সমর্থ হইলেন। এইভাবে তিনি নিজের জীবনেই ইসলামী রাষ্ট্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সংস্থাপিত করিয়া দিয়াছিলে।
বলা বাহুল্য,রাসূলে করীম(স) প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রটি নিছক একটি রাষ্ট্রমাত্র ছিল না। ইহা ছিল বাস্তবে অস্তিত্বহীন একটি আদর্শবাদের পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন।যে বীজটি আরব ভূ-খন্ডেরই একটি নির্জন স্থানে অতিশয় গোপনে উপ্ত হইয়াছিল একুশ বৎসর পূর্বে, উত্তরকালে তাহাই এক বিরাট মহীরুপে পরিণত হইয়া সমগ্র আরব দেশকে নিজের সুশীতল ছায়াতলে আনিয়া বিশ্বমানবতার জন্য চিরস্থায়ী এক আলোক কেন্দ্র(Light House)স্থাপন করিয়া দিয়াছিল। অনন্তকাল পর্যন্ত দুনিয়ার মানুষের জীবনে এই আলক-কেন্দ্র হইতে অজস্র ধারায় আলোকচ্ছটা বিচ্চুরিত হইতে থাকিবে এবং অত্যাচার-নিপীড়নে জর্জরিত দিশাহারা মানুষ উহা হইতেই মুক্তি ও কল্যাণ পথের নির্ভুল সন্ধান লাভ করিতে থাকিবে।
নবী-প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
এইখানে নবী করীম(স) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা আবশ্যক। সংক্ষেপে তাহাই পেশ করা যাইতেছে।
(১)নবী-প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র সামাজিক-সামষ্ঠিক চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির(Social Contract)ভিত্তিতে গড়িয়া উথা পৃথিবীর সর্বপ্রথম রাষ্ট্র ব্যবস্থা। মানব ইতিহাসে এই ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোন দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বৎসর মদীনার লোকেরা স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে নবী করীম(স)-এর হাতে যে ‘বায়’আত’ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে নিজেদের ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও শাসকও মানিয়া লইয়াছিলেন, উত্তরকালে তাহাই পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছিল একটি পূর্নাঙ্গ সর্বাত্মক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়।
(২)এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার সার্বভৌমত্বের(Sovereignty) উৎস ছিল মহান আল্লাহ্র সত্তা-সম্পূর্ণ নিরক্কুশভাবে।সার্বভৌমত্ব বলিতে যাহা বুঝায়,তাহাতে অন্য কাহারও-স্বয়ং নবী করীম(স)-এর কোন অংশ ছিল না। হযরত মুহাম্মাদ(স) আল্লাহ্র রাসূল হিসাবে কুরআনী বিধানের ভিত্তিতে আইন প্রবর্তন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করিতেন।সার্বভৌমত্বের এই প্রশ্নটিই ইসলামী রাষ্ট্র ও দুনিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র দর্শনের মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্যের ভিত্তিপ্রস্তর। রাসূলে করীম(স) আল্লাহ্র নিকট হইতে ‘অহী’পাইতেন। সেই অহীই ছিল আইনের মূল সূত্র।কিন্তু সার্বভৌমত্বের অধিকার হিসাবে তিনি নিজেকে কস্মিনকালেও পেশ করেন নাই।‘অহীর’ ব্যাখ্যা তিনিই প্রদান করিতেন। কিন্তু উহার বাস্তবায়নে নিজেকে কখনো বাদ(Exempted)দেন নাই। বরঞ্ছ অহীর মাধ্যমে তাঁহার নিজের কাজের ‘ত্রুটি’ও জনগনের সম্মুখে উদঘাটিত হইয়াছে। তিনি নিজেই নিজের ‘অপরাধ’ বিচারের জন্য লোকদের নিকট নিজেকে বারবার পেশ করিয়াছে। ইহার ফলে ‘বাদশাহ’কে বা ‘সর্বোচ্চ প্রশাসক’কে আল্লাহ্র আসনে বসাইবার সকল ধারণা ও নীতিমালা(‘বাদশাহ কখনও ভুল করিতে পারেন না’-বাদশাহকে কখনও অভিযুক্ত করা যাইতে পারে না ইত্যাদি)সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া গেল। ইহাতে এই সত্যও প্রতিষ্ঠিত হইল যে,আল্লাহ্র নিরংকুশ সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে কোন ব্যক্তি ‘বাদশাহ’ বা স্বৈরতন্ত্রী হইতে পারে না। কোন দল বা গোষ্ঠীর পক্ষেও তাহা সম্ভব নয়। মানুষকে গোলাম বানাইবার অধিকার কাহারও থাকিতে পারে না।
(৩) ইহা একটি পুর্নাঙ্গ আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র(Ideological State)।নবী করীম(স)-ই ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত শাসনতন্ত্রের(Written Constitution) ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন। ইহা বংশ, দেশমাতৃকা,বর্ণ,ভাষা ও নিছক অর্থনৈতিক একাত্নতা-ভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল না। ইহা ছিল ইসলামী জীবনাদর্শের ধারক ও বাহক জাতিধর্ম নির্বিশেষে গোটা বিশ্ব মানবতাকে ইসলামের প্রতি আহ্বানকারী প্রথম রাষ্ট্র। ইসলামী আদর্শের পূর্ণ বাস্তবায়ন ও উহার সর্বাত্মক বিজয় অর্জন এবং ইহার মাধ্যমে জনগনের সার্বিক কল্যাণ বিধানই এই রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল।
উল্লেখ্য যে, ইসলামী রাষ্ট্র পাশ্চাত্ত্যের ফ্যাসিবাদী বা তথাকথিত গণতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রের মত স্বতঃই কোন লক্ষ্য নয়-অর্থাৎ রাষ্ট্রের জন্য রাষ্ট্র নয়;বরং একটি আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উন্নততর ও মহত্তর লক্ষ্য অর্জনই ইহার উদ্দেশ্য। আর তাহা হইল আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের পরিপূর্ণ আনুগত্য এবং আল্লাহ্র পরম সন্তুষ্টি অর্জন।একটি ধর্মহীন(Secular) গণতান্ত্রিক বা জাতীয় রাষ্ট্র কোন উচ্চতর নৈতিক বিধানের অনুগত হয় না। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র হয় উহার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইহাতে ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক যাবতীয় ব্যাপার আল্লাহ্র বিধানের ভিত্তিতে সুসম্পুন্ন হইয়া থাকে।
(৪) ইসলামে ধর্ম ও রাষ্ট্র একই জিনিসের পার্থক্যহীন দুইটি দিক মাত্র। পার্থক্য শুধু শব্দের,মূল জিনিসের বা ভাবধারা দিক দিয়া ইহাতে কোন পার্থক্য নাই।এখানে যাহা ধরম,তাহাই রাজনীতি আর যাহা রাজনীতি,তাহাতেই ধর্ম নিহিত। ইসলাম স্বতঃই এক পুর্নাঙ্গ দ্বীন। মানব জীবন ও বিশ্ব-প্রকৃতির এমন কোন দিক নাই, যে বিষয়ে ইসলামের বিধান অনুপস্থিত। রাসূলে করীম(স) একই সঙ্গে আল্লাহ্র প্রতিনিধি হিসাবে জীবনের সর্বদিকে ও সর্বক্ষেত্রে অবিসংবাদিত নেতা। জীবনের বিভিন্নতা ও দ্বৈততা ইসলামের পরিপন্থী। বস্তুতঃরাষ্ট্রীয় ধর্মহীনতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা উনবিংশ শতকের পোপতন্ত্রের প্রতিক্রিয়ার ফসল। বর্তমানে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ইহা সম্পূর্ণরূপে অতীত।ইহার ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বর্তমানে যুগে অসম্ভব। কেননা সংশয়বাদ,মানসিক অস্থিরতা ও স্বার্থবাদ(Utilitarianism) ছাড়া উহা বিশ্বমানবতার জন্য অন্য কোন অবদানই রাখিতে পারে নাই।
(৫) ইসলামী রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থেই একটি গণ-অধিকারসম্পন্ন এবং জনমত ভিত্তিক কার্যকর রাষ্ট্র ব্যবস্থা।এখানে সমস্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাপার জনগণের সমর্থন ও অনুমোদনের ভিতিতেই সুসম্পন্ন হইয়া থাকে বলিয়া রাষ্ট্রীয় মৌল নীতির বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সাথে পরামর্শ ভিন্ন কার্যকর হইতে পারে না। এই নীতি রাসূলে করীম(স) কর্তৃক পুরাপুরি অনুসৃত।
ব্যক্তি স্বাধীনতা, সাম্য ও সুবিচার গণ- অধিকারসম্পন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি বিশেষ।এইগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন ব্যতিত গণ-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবতা ধারণাতীত। রাসূলে করীম(স) প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাই সর্বপ্রথম মানুষের প্রকৃত আজাদী কার্যকর হয়। ইসলামের কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ ঘোষণায়ই ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিপ্লবী ভাবধারা এক অপূর্ব চেতনায় বিধৃত। এক আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাহারোই –কোন-কিছুরই-একবিন্দু গোলামী করিতে প্রস্তুত না থাকার ইহা এক বিপ্লবাত্মক ঘোষণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আল্লাহ্র নির্ধারিত সীমার মধ্যে মানুষ ইসলামী রাষ্ট্রে সম্পূর্ণ আজাদ ও স্বাধীন।এখানে প্রত্যেকরই অধিকার সুনির্দিষ্ট।কোন অবস্থায়ই কাহারও অধিকার হরণ করার কাহারও অধিকার নাই। ইসলামের সোনালি যুগে কোন ব্যক্তিকে কোন অবস্থায়ই তাঁহার মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্ছিত করা হইত না। কাহারও ব্যক্তিগত মত প্রকাশ ও প্রচার, পেশা-গ্রহন,সভা-সম্মেলন অনুষ্ঠান বা যত্রতন্ত্র যাতায়াতে শরীয়াত-ভিত্তিক কোন কারণ ছাড়া কখনও কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা বা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হইত না। কেননা এইরুপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট জুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই কারণেই রাষ্ট্রপ্রধান রাসূলে করীম(স)-র সহিত মতবিরোধ করিয়া ভিন্নতর মত প্রকাশ করার অধিকারও প্রত্যেকেরই ব্যক্তিই পাইয়াছে।
এই রাষ্ট্রের সাম্য ও সততা দুইটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। একটি আদম সন্তান হওয়া-ইহার কারণে সমস্ত মানুষই মূলগতভাবে সমান। আর দ্বিতীয় ভিত্তি ভ্রাতৃত্ব। সমস্ত মুসলমান পরস্পরের ভাই এবং সর্বতোভাবে অভিন্ন।
সুবিচার এই রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সমদৃষ্টি ও নিরপেক্ষতা এই রাষ্ট্রের স্থায়ী নীতি।নবী করীম(স) নিজে সবসময় সুবিচার নীতিকে ভিত্তি করিয়াই ফয়সালা করিতেন। তাঁহার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে আইনের প্রয়োগ ছিল নির্বিশেষ।এমন কি,একটি বিচার কার্যের সময় ‘ফাতিমা চুরি করিলে উহার দণ্ডস্বরূপ তাঁহারও হাত কাটা যাইবে’ বলিয়া ঘোষণা করিয়া তিনি বিচার ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমস্ত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মূলোৎপাটন করিয়া দিয়াছেন।
(৬)ইসলামী রাষ্ট্র সঠিক অর্থে একটি জনসেবক ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র (Welfare State)ছিল। রাসূলে করীম(স) প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রে জনগনের কেবল আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাই করা হইত না,ইতিবাচকভাবে গন-অধিকার আদায় করা ও জনগনের দারিদ্র্য নির্মূল করার জন্যও চেষ্টা চালান হইত।পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মত ‘অর্থোপার্জনের প্রতিযোগিতায় পরাজিত’দের সম্পূর্ণ অসহায় করিয়া রাখা এই রাষ্ট্রে মোটেই সম্ভবপর ছিল না। সকল লোকের সম্মুখে অর্থনৈতিক সুজগ-সুবিধার দ্বার সমানভাবে উন্মুক্ত করিয়া দেওয়ার পরও পিছনে পড়িয়া থাকা লোকদের আর্থিক নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহন করা ছিল একমাত্র এই রাষ্ট্রেরই বিশেষত্ব। শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নয়, জনগনের নৈতিক মান উন্নতকরণ,তাহাদের মনে আল্লাহ্র ভয় জাগানো এবং দ্বীন ও শরীয়াত সম্পর্কে তাহাদিগকে সুশিক্ষিত করিয়া তোলার জন্যও নিরন্ততর গুরুত্ব সহকারে চেষ্টা চলানো হইত।
(৭)এই রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হইল আল্লাহ্র নিকট জবাবদিহির তিব্রতম চেতনা।যাহা কিছুই করি না কেন,ব্যক্তিগত কাজ কিংবা জাতীয়-রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন-যে ধরনেই কাজ হউক না কেন-তাহা নিজের ঘরে গোপনে করা হউক,কি প্রকাশ্য-সব কিছুর মূলেই এই চেতনাটি প্রবল হইয়া থাকে। আর এই কারনেই এ রাষ্ট্রের কোন ক্ষেত্রেই আল্লাহ্র নাফরমানী,গণঅধিকার হরণ এবং জুলুম-নির্যাতনের কোন একটি ঘটনাও সংঘটিত হইতে পারিত না। এই দিকটির উপর আতদূর গুরুত্ব আরোপ করা হইত যে, রাষ্ট্রপ্রধান হইতে শুরু করিয়া নিম্নতম সহকারী কর্মচারী নিয়োগে সর্বাধিক আল্লাহভীরু ব্যক্তিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হইত। ******(আরবী) ‘তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহ্ভীরু ব্যক্তিই তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্র নিকট সর্বাধিক সম্মানার্হ’ এই মূলনীতিই ছিল এই কাজের ভিত্তি।কেননা রাষ্ট্রনেতা বা সরকারী দায়িত্বশীল লোকেরা আল্লাহ্ভীরু না হইলে গোটা জাতিই চরম নাফরমান হইয়া যাইবে। তাহারা নীতিবান না হইলে গোটা জাতিই দুর্নীতিপরায়ণ হইয়া যাইবে-ইহা স্বাভাবিক। রাষ্ট্রনেতা ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং সরকারী কর্মচারীগণ দুর্নীতিপরায়ণ না হইলে সাধারণ মানুষের পক্ষে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া কক্ষনই সম্ভব হইতে পারে না। এমনকি তাহার ধারণাও করা যায় না। এই কথাটি যেমন সত্য, তেমনি ইহার বিপরীত কথাটিও সত্য। বিশ্বনবী প্রতিষ্ঠিত আদর্শ রাষ্ট্রের এই বৈশিষ্ট্যসমূহ ঐতিহাসিক। ইতিহাসে এইরূপ বৈশিষ্ঠ্যের অধিকারী অন্য কোন রাষ্ট্রেরি নাম খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।
বিশ্বনবী প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ঠ্যসমূহ সম্মুখে রাখিয়া তুলনামূলক আলোচনা করিলে প্রমাণিত হইবে যে, দুনিয়ার অন্যান্য রাস্ত্রের-তাহা রাজনৈতিক হউক কি তথাকথিত ধর্মহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র,পুজিবাদি রাষ্ট্র হউক কিংবা সমাজাতান্ত্রিক তথা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র-কোন একটির সাথেও ইহার কোন তুলনা হয়না। একালের কোন ধরনের রাষ্ট্রই সার্বিক মানবিক কল্যাণের দিক দিয়া বিশ্ব নবী প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রের সমতুল্য হইতে পারে না। দুনিয়ার এসব রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেসব নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং মানব-কল্যাণের যেসব বড় বড় দাবি করা হয়, উহার অবৈজ্ঞানিকতা,যুক্তিহীনতা, অমানবিকতা ও অন্তঃসারশূন্যতা বহু পূর্বেই প্রমানিত হইয়াছে। সেসবের ব্যর্থতা সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু বিশ্বনবী প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি যেমন স্বভাবসিদ্ধ,তেমনি শাশ্বত,চিরন্তন।ব্যক্তি মানুষ ও মানবসমষ্ঠির প্রকৃত কল্যাণ কেবল এই ধরনের রাষ্ট্র-ব্যবস্থার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। অন্য কোন ধরনের রাষ্ট্র দ্বারাই ইহা সম্ভব হইতে পারে না।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(স) এই আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচালনা করিয়া গিয়াছেন।‘খিলাফতে রাশেদা’ এই রাষ্ট্রেরই পরবর্তী নাম, ইহারই যথার্থ উত্তরাধিকারী।