খিলাফতে রাশেদার আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা
খিলাফতে রাশেদার রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় ইসলামী সমাজ-সভ্যতা ও কৃষ্টি-তামাদ্দুনের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিস্পন্ন হইয়াছিল।ইহা একাধারে ছিল দ্বীন-ভিত্তিক ও বৈষয়িক উন্নয়নের একমাত্র নিয়ামক রাষ্ট্র। দ্বীন-ইসলামের উপরই উহার ভিত্তি স্থাপিত ছিল এবং কুরআনের অকাট্য মূলনীতি ও রাসূলে করীম(স)- এর সুন্নাত অনুযায়ী মানবতার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনই ছিল উহার যাবতীয় চেষ্টা-সাধনার একমাত্র লক্ষ্য।
খিলাফতে রাশেদার আমলে কুরআন মজীদ ও সুন্নাতে রাসূল মুতাবিকই যাবতীয় আইন-কানুন প্রণয়ন করা হইত। খুলাফায়ে রাশেদুন যদি এমন কোন সমস্যা বা জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হইতেন,যাহার প্রত্যক্ষ মীমাংসা কুরআন ও হাদীস হইতে লাভ করিতে পারিতেন না, তাহা হইলে নবী করীম(স)-এর কার্যাবলীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সম্মুখে রাখিয়া উত্তমভাবে উহার মিমাংসা করিয়া লইতেন এবং কোন দিক দিয়াই কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের মৌলিক আদর্শ লংঘিত হইতে দিতেন না।
ইসলামের মৌলিক বিধান অনুসারে গোটা উম্মতে মুসলিমা খলীফাদের আনুগত্য স্বীকার করিয়া চলিতে বাধ্য ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে এই মূলনীতিও সর্বাপেক্ষা সমর্থিত ছিল যে, আল্লাহ্ ও রাসূলের হুকুম-বিধানের বিরুদ্ধতা করিয়া কোন খলীফা বা রাষ্ট্রকর্তার আনুগত্য করা যাইতে পারে না। কুরআন-হাদীসের মূল সূত্র হইতে বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনের খুঁটিনাটি আইন-কানুন প্রনয়নের অধিকারের ক্ষেত্রে খলীফার কোন প্রাধান্য, বিশিষ্টতা ও অগ্রাধিকার স্বীকৃত ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে খলীফা বরং অন্যান্য সাহাবীদের নিকট কুরআন-হাদীস-ভিত্তিক রায় বা পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতেন। এই ব্যাপারে খলীফাদের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ারও পূর্ণ অধিকার ছিল। শুধু তাহাই নয়,খলীফাদের রায়ের ভুল-ভ্রান্তি ধরাইয়া দেওয়া এবং তাঁহাদের প্রকাশ্য সমালোচনা করার সাধারণ অধিকারও সর্বতভাবে স্বীকৃত ছিল।
জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রায় বা সম্মতি অনুযায়ী খলীফা নির্বাচিত হইতেন। জোরপূর্বক কিংবা বংশানুক্রমিক ধারা অনুযায়ী খলীফার পদ দখল করা শুধু ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থারই খেলাফ নহে, ইসলামী বিধানের দৃষ্টিতে উহা মারাত্মক অপরাধও বটে। খুলাফায়ে রাশেদুনের মধ্যে বাদশাহী শান-শওকাত কিংবা ডিকটেটরী স্বৈরতন্ত্রের কোন অস্তিত্তই বর্তমান ছিল না। তাঁহারা নিজদিগকে নাগরিকদের সমপর্যায়ভুক্ত মনে করিতেন। একমাত্র খিলাফত ভিন্ন অন্য কোন দিক দিয়াই তাঁহাদের ও সাধারণ জনগণের মধ্যে একবিন্দু পার্থক্য ছিল না। খলীফার দরবারে সরকারী কর্মচারী ও জনসাধারণের অবাধ যাতায়াত ছিল এবং এই ব্যাপারে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার অবকাশ ছিল না। এই কারণে জনগণের সাধারণ অবস্থা ও অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে ওয়াকিফহাল হওয়া এবং কোন প্রকার দীর্ঘসূত্রিতা ব্যতিরেকেই উহার প্রতিকার করা তাঁহাদের পক্ষে অত্যন্ত সহজ ছিল।এই কারণেই এ কথা উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা যাইতে পারে যে, খিলাফতে রাশেদাই হইতেছে বিশ্ব- ইতিহাসে একমাত্র ও সর্বপ্রথম রাষ্ট্র, যেখানে প্রকৃত গণ-অধিকার পুরাপুরিভাবেই রক্ষিত হইয়াছে।
বিচার বিভাগ
খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে বিবদমান দুইপক্ষের মধ্যে ইনসাফ বা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা খলীফার অন্যতম দায়িত্ব মনে করা হইত। এইজন্য প্রথম দিকে তাঁহারা প্রায় সব বিচারকার্য নিজেরাই সম্পন্ন করিতেন। অবশ্য দূরবর্তী স্থানসমূহের জন্য নিজেদের তরফ হইতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করিতেন। প্রথম খলীফার আমলে প্রত্যেক শহরের জন্য নিযুক্ত শাসনকর্তাই বিচার কার্য আঞ্জাম দিতেন। কিন্তু দ্বিতীয় খলীফা তাঁহার খিলাফত আমলে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র করিয়া দিয়াছিলেন। এইজন্য প্রত্যেক শহরেই স্বতন্ত্র মর্যাদাসম্পন্ন বিচারপতি বা কাজী নিয়োগ করা হইয়াছিল। বিচার বিভাগ প্রসাশন বিভাগের কর্তৃত্ব হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মর্যাদাসম্পন্ন ছিল। বিচারপতি রায়দানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন। খলীফার পক্ষ হইতে তাঁহাদিগকে এই নির্দেশ দান করা হইত যে, তাঁহারা বিচারে যে রায়ই দান করিবেন, তাহা যেন সর্বতোভাবে কুরআন ও সুন্নাতে-রাসূলের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। কোন দিক দিয়াই যেন উহা লংঘন করা না হয়। সংশ্লিষ্ট এলাকার শাসনকর্তা বিচারপতির উপর কোন প্রকার প্রভাব বিস্তার কিংবা প্রভুত্ব খাটাইতে পারিতেন না। কাজী বা বিচারপতি সরাসরি খলীফা কর্তৃত্ব নিযুক্ত হইতেন। সংশ্লিষ্ট শহরের শাসনকর্তাকেও অনেক সময় বিচারপতি নিয়োগের ইখতিয়ার দান করা হইত; কিন্তু তাহা ছাড়া বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হইত। চতুর্থ খলীফার প্রদত্ত একখানি নিয়োগপত্রের নিম্নোদ্ধৃত অংশ হইতে ইহার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। লোকদের মামলা –মুকাদ্দমা নিস্পত্তি করার জন্য এমন সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়োগ কর,যাহাদের রায় জনগণ অকুণ্ঠিত চিত্তে মানিয়া লইবে এবং কেহ উহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোন সাহস বা প্রয়োজন বোধ করিবে না। তাঁহারা হইবেন সকল প্রকার লোভ-লালসা ও মোহ-মাৎসর্য হইতে পবিত্র। তাঁহারা কাহারো বিশেষ মর্যাদার কারণে সন্ত্রস্ত ও প্রভাবান্বিত হইবেন না। সকল ব্যাপারেই তাঁহাদিগকে গভীর-সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বশীল হইতে হইবে। সন্দেহ-সংশয়পূর্ণ ব্যাপারে তাঁহারা অত্যন্ত সতর্ক হইবেন। পক্ষদ্বয়ের উপস্থাপিত যুক্তিপূর্ণ প্রমাণ ও সাক্ষ্য সন্দর্শনে কিছুমাত্র ঘাবড়াইয়া যাইবেন না, প্রতিটি ব্যাপারের গভীর তলদেশে পৌঁছিবার জন্য পরিপূর্ণ সতর্কতা ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে কাজ করিবেন। এইভাবে তাঁহারা কোন চূরান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়া গেলে তাহা পুরাপুরি দৃঢ়তা সহকারে কার্যকর করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হইবেন না। কোন প্রকার সুপারিশ ও কোনরূপ পদ-মর্যাদাকেই তাঁহারা ফয়সালা কার্যকর করার পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইতে দিবেন না। যদিও এই ধরনের লোকদের সংখ্যা বেশী হয় না কখনো, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও বিচারপতিকে অবশ্যই উল্লেখিত গুণে ভূষিত হইতে হইবে। তোমরা যখন কাহাকেও বিচারপতি নিযুক্ত করিবে, তখন তাহার যথেষ্ট পরিমানে বেতন ধার্য করিবে; তাহা হইলে তাহার জীবনযাত্রা নির্বাহের দাবি তাহাকে ঘুষ লইতে বাধ্য করিবে না। উপরন্তু তোমাদের মন-মানস ও সমাজ-সম্মেলনে তাহার মর্যাদা উন্নত হওয়া বাঞ্ছনীয়, যেন তাহার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাইবার সাহস কাহারো না হয়।
বিচারকগণ ছাড়াও প্রত্যেক শহরেই ইসলামী আইন সম্পর্কে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন একটি জনগোষ্টী সব সময়ই মওজুদ থাকিত। কোন ব্যাপারে বিচারকদের অসুবিধা বা সমস্যা দেখা দিলে ইহাদের নিকট হইতে সাহায্য গ্রহণ করা হইত।
এই সময় নবী করীম(স)-এর হাদীসসমূহ গ্রন্থাবদ্ধ ছিল না, তাহা ছিল লোকদের স্মৃতিপটে রক্ষিত। কেহ একটি হাদীস জানিত আর কাহারো স্মরণ ছিল অন্য একটি হাদীস। সমস্ত হাদীস এককভাবে বিশেষ কাহারো স্মরণ ছিল না আর ইহাই ছিল সেকালের একটি কঠিন সমস্যা। বিচারকদের সম্মুখে উপস্থিত ব্যাপারের মীমাংসা করার জন্য কোন হাদীসের প্রয়োজন হিলে তাঁহারা বিভিন্ন লোকের নিকট জিজ্ঞাসা করিতেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলে করীম(স)-এর নির্দেশ বা কর্মনীতি জানিতে চেষ্টা করিতেন। ফলে তাঁহারা রাসূলের যে হাদীসি পাইতেন, সেই অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করিতেন; কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন হাদীস পাওয়া না গেলে ইসলামের সামগ্রিক ব্যবস্থা ও উহার ধারাকে সম্মুখে রাখিয়া তাঁহারা ইজতিহাদ করিতেন। এই কারণে অনেক সময় কোন নির্দিষ্ট ব্যাপারে বিচারকের বিভিন্ন প্রকার হইত। বিচারকদের ফয়সালাসমূহ লিপিবদ্ধ করিয়া রাখার তখনো শুরু হয় নাই। ফলে পরবর্তীকালের লোকেরা উহা হইতে কিছুমাত্র ফায়দা লাভ করিবার সুযোগ পাইত না।
এই যুগের যাবতীয় বিচার কার্য কেবলমাত্র ইজতিহাদের উপর নির্ভরশীল ছিল বলিয়া কাহারো কাহারো মনে প্রশ্ন জাগিতে পারে; কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তাহা নহে। কেবলমাত্র শরীয়াতের খুঁটিনাটি আইন জানিবার ও যুগের বিশেষ অবস্থা ও ঘটনার উপর উহাকে প্রয়োগ করার ব্যাপারেই ইজতিহাদ-নীতি ব্যবহার করা হইত। স্মর্তব্য যে,ইসলামী আইনসমূহ ছিল কতকগুলি মূলনীতির সমষ্টি; উহার খুঁটিনাটি বিধান তখনো রচিত হয় নাই। বস্তুত চিরকাল ও সমগ্র মানবতার জন্য প্রদত্ত আইন-বিধান এইরূপ হওয়াই স্বাভাবিক। কালের প্রতিটি পর্যায়ে ও পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলেই উহার বাস্তব প্রয়োগ কেবলমাত্র এই ভাবেই সম্ভব ও সহজ হইতে পারে।
বিচারক নিয়োগের পরও জনগণের ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করার ব্যাপারে খলীফাদের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহনে কোন বাধা ছিল না; বরং অনেক ক্ষেত্রে তাঁহারা নিজেরাই অনেক ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করিতেন। সেইসব ক্ষেত্রে নিযুক্ত বিচারকগন শুধু খলীফাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করিতেন মাত্র।
দেশরক্ষা বিভাগ
খিলাফত আমলে যুদ্ধ বা সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করার মূল ক্ষমতা খলীফার হস্তেই নিবদ্ধ থাকিত। কেননা নবী করীম (স)-এর জামানায়ও এই রীতিই কার্যকর ছিল। তিনি নিজেই সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শাসন পরিধি যখন বিশালতর হইতে লাগিল, তখন খলীফাগণ সর্বশ্রেষ্ঠ বীর ও যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও পৃথকভাবে সেনাধ্যক্ষের নিযুক্তি শুরু হইল। তাহাকে মানিয়া চলা স্বয়ং খলীফাকে মানিয়া চলার মতই অবশ্যই কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যুদ্ধের অবসান হইলে সামরিক ব্যাপারসমূহ পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যতের জন্য তাহাদিগকে ট্রেনিং দান করিই হইত সেনাধ্যক্ষদের একমাত্র কাজ।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)- এর খিলাফত আমলে সমগ্র সৈন্যবাহিনী অবৈতনিক ও স্বেচ্ছামূলক ছিল। কোন রেজিস্ট্রি বহিতে তাহাদের নাম লিপিবদ্ধ ছিল না। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত কালেই সৈন্য বিভাগ সুষ্ঠু ও সুসংবদ্ধভাবে গঠিত হয় ও প্রতিটি সৈনিকের নাম রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়। ইহার ফলে সৈন্যবাহিনীতে শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়। কোন সৈনিক পলায়ন করিলে কিংবা পশ্চাতে থাকিয়া গেলে অতি সহজেই তাহা ধরা পড়িত। পলাতক সৈনিকদের জন্য তখন একটি বিশেষ ধরনের শাস্তি নির্দিষ্ট ছিল। পলাতকের নিজ মহল্লার মসজিদে তাহার নাম প্রকাশ ও প্রচার করিয়া ঘোষণা করা হইত যে,এই ব্যক্তি জিহাদের ময়দান হইতে পলাইয়া আসিয়াছে;আল্লাহ্র পথে আত্মদান করার ব্যাপারে সে কুণ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছে। বস্তুতঃ এতটুকু ভৎসনা আরবের জন্য মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষাও সাংঘাতিক ছিল। কেননা সমগ্র বিশ্ব-জাতির মাঝে আরবদের যে অতুলনীয় বীরত্ব ও বিস্ময়কর সাহসিকতার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হইয়াছিল, তাহাতে কোন ব্যাক্তিকে অপৌরুষ ও ভীরুতার দায়ে অভিযুক্ত কয়া এবং প্রকাশ্যভাবে উক্তরুপে ঘোষণা দেওয়া মৃত্যু অপেক্ষাও অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। অতঃপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে সমাজে মুখ দেখাইবার কোন স্থান আর অবশিষ্ট থাকিত না।
হযরত উমর(রা) সমস্ত সৈনিকদের জন্য বায়তুলমাল হইতে বেতন নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। এই বেতনের কোন নির্দিষ্ট হার ছিলনা। ইসলামী আদর্শ অনুসরণের ক্ষেত্রে শ্রেষ্টত্ত ও প্রাধান্যই ছিল মুজাহিদদের বেতন নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি। অবশ্য শেষ পর্যায়ে হযরত আলী (রা) এই পার্থক্যও খতম করিয়া দিয়া সকলের জন্য সমান মানের বেতন চালু করিয়াছিলেন।
ইসলামী বাহিনীতে প্রত্যেক দশজন সৈনিকের উপর একজন ‘প্রধান’ নিযুক্ত হইত।আরবী সামরিক পরিভাষায় তাহাকে বলা হইত ‘আরীফ’। এই আরীফদের হস্তেই সকল সৈনিকদের বেতন অর্পণ করা হইত; তাহারা অধীনস্থ সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিত।
সৈন্যবাহিনী সংগঠনের ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়। প্রাক-ইসলাম যুগে আরবগণ শত্রুপক্ষকে কখনো সারিবদ্ধভাবে আর কখনো বিচ্ছিন্নভাবে মুকাবিলা করার জন্য অগ্রসর হইত। প্রথমে উভয় পক্ষ হইতে এক-দুইজন বীরপুরুষ সম্মুখ-সমরে লিপ্ত হইত,তাহার পর সাধারণ হামলা পরিচালিত হইত এবং শেষ পর্যন্ত এলোমেলোভাবে আক্রমণ ও অস্ত্র পরিচালনা করা হইত। মুসলমানগণও ইসলামী জিহাদের প্রথম পর্যায়ে এই রীতিরই অনুসরণ করিতেছিলেন। কিন্তু উত্তরকালে তাহারা যখন পারস্য ও রোমানদের সুসংগঠিত সৈন্য বাহিনীর মুখামুখী হইতে আরম্ভ করিলেন, তখন তাঁহারা সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারিলেন যে, আধুনিক পদ্ধতিতে এই সংগঠিত সৈন্যবাহিনী ও সমর নীতির মুকাবিলা করিতে হইলে প্রাচীন রীতি অবশ্যই পরিহার করিতে হইবে। অতঃপর তাহারা নূতনভাবে নিজেদের সৈন্যবাহিনী গড়িয়া তোলেন ও সম্পূর্ণ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করিতে শুরু করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনীকে সুষ্ঠুরূপে সারিবদ্ধ করা হইতে লাগিল, কেহ অগ্রে বা পশ্চাতে পড়িয়া থাকিত না। গোটা সৈন্যবাহিনীকে মোটামুটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হইত। সকলের অগ্রবর্তী বাহিনীকে বলা হইত ‘মুকদ্দমা’, যুদ্ধের সূচনা করাই হইত ইহার দায়িত্ব। মধ্যবর্তী বাহিনীকে বলা হইত ‘কলব’, মূল সেনাধ্যক্ষ ইহাদের দ্বারাই পরিবেষ্টিত থাকিতেন। ডান পার্শ্বে স্থাপিত বাহিনীকে বলা হইত ‘মায়মানা’ এবং বাম পার্শ্বে অবস্থিত ‘মায়সারা’। আর সকলের পশ্চাতে অবস্থিত বাহিনীর নাম দেওয়া হইত ‘সাকাহ’।
যে সৈন্যবাহিনী এই পাঁচটি উপ-বাহিনীতে বিভক্ত হইত, উহাকে ‘খামীস’ বলা হইত। ইহার প্রত্যেক অংশেরই একজন করিয়া ‘আমীর’ হইতেন এবং তিনি মূল সেনাধ্যক্ষের ফরমান অনুসারে নিজ নিজ বাহিনী পরিচালনা করিতেন।অশ্বারোহী বাহিনীর আমীর হইতেন স্বতন্ত্র। পশ্চাদ্দিক সংরক্ষণের জন্য মুসলিম সৈনিকগন বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করিতেন,যেন শত্রু-সৈন্য কোন সুযোগেই পশ্চাদ্দিক হইতে তাহাদের উপর হামলা করিতে সমর্থ না হয়। নৈশকালীন আক্রমণ হইতে গোটা বাহিনীকে হেফাজত করার জন্য তাঁহারা বিশেষ ব্যবস্থা ও কর্মপন্থা গ্রহণ করিতেন। মুসলমানদের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ ছিল সর্বাধিক সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধভাবে সক্রিয়। সেই কারণে শত্রুদের অধিকাংশ গোপন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা তাঁহারা পূর্বাহ্ণেই জানিতে পারিতেন।
রাজস্ব বিভাগ
হযরত উমর (রা)-এর খিলাফত কাল হইতে রাজস্ব আদায়ের জন্য স্বতন্ত্র ও স্থানীয়ভাবে লোক নিয়োগ করা হইত। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উপর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সাধারণতঃ অর্পণ করা হইত না। আদায়কৃত রাজস্ব খলীফার নির্দেশ অনুসারে সৈনিকদের বেতন-ভাতা ও জনকল্যাণমূলক অন্যান্য সর্বজনীন কাজকর্মে ব্যয় করা হইত। উদ্ধৃত অর্থ কেন্দ্রীয় রাজধানীতে পাঠাইয়া দেওয়া হইত।
খিলাফত আমলে দুই প্রকারের রাজস্ব ধার্য করা হইতঃ(১)স্থায়ী ও (২)অস্থায়ী। স্থায়ী রাজস্বের মধ্যে যাকাত,উশর ও জিজিয়া উল্লেখযোগ্য। পক্ষান্তরে গনিমতের মাল ছিল অস্থায়ী রাজস্ব বা রাষ্ট্রীয় আয়।
খারাজ
সাধারনতঃযুদ্ধ-জয়ের ফলে অধিকৃত দেশের যাবতীয় চাষযোগ্য জমি উহার পূর্বতন মালিকদের নিকটই থাকিতে দেওয়া হইত। অবশ্য উৎপন্ন ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ রাজস্ব বাবদ আদায় করিয়া লওয়া হইত। ইহাকেই ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘খারাজ’। ইহাকে ভোগ্য জমির খাজনা মনে করা যাইতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার জমির পরিমাণ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মুদ্রা কর-বাবদ ধার্য করা হইত।
উশর
যেসব জমির মালিকগণ ইসলাম কবুল করিত অথবা বিজয়ী মুসলমানরা যেসব জমির মালিকদের নিকট হতে জিজিয়া আদায় করিতেন না, সেই জমিকে বলা হয় উশরী জমি এবং উহার ফসলের এক দশমাংশ কিংবা বিশ ভাগের এক ভাগ সরকারী ব্যবস্থাপনায় আদায় কর হইত। মুসলমানগণ বল প্রয়োগ বা যুদ্ধের পরিণতিতে যেসব জমি দখল করিতেন, তাহা ‘উশরী’ জমি নামে অভিহিত হইত এবং তাহা কেবলমাত্র মুসলমানদের মধ্য বণ্টন করিয়া দেওয়া হইত। ফলে তাহা মুসলমানদেরই দখলিভুক্ত হইয়া থাকিত।
হযরত উমর (রা)- এর খিলাফতকালে যখন সিরিয়া ও ইরাক অধিকৃত হয়, তখন তিনি বিজিত জমি সম্পর্কে উপদেষ্টাদের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন যে,উহার বিলি-ব্যবস্থা কি ভাবে কর হইবে? অধিকাংশ লোকই জমিগুলিকে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়ার পরামর্শ দিয়াছিলেন।
হযরত উমর (রা)বলিয়াছিলেনঃ ‘তাহা হইলে তো ভবিষত বংশধরদের হক নষ্ট করা হইবে। কেননা, বর্তমানে জমিসমূহ বণ্টন করিয়া দিলে অনাগত মানুষদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকিবে না’। উহাতে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ(রা)বলিলেনঃ জমি ও দাস-দাসী তাহারাই পাইবার অধিকারী, যাহারা নিজেদের বাহুবলে দেশ জয় করিয়াছে; অন্য লোকদের তাহাতে কি অধিকার থাকিতে পারে? ইহার উত্তরে খলীফা উমর ফারুক (রা) বলিলেনঃ ‘একথা ঠিক, কিন্তু মনে রাখিও আমার পর খুববেশী দেশ জয়ের সম্ভবনা থাকিবে না বলিয়া তখন মুসলমানদের পক্ষে অধিক পরিমাণ মাল-দৌলত ও জমি লাভ করা সম্ভব হইবে না। উত্তরকালে বরং অনেক দেশজয় কল্যাণের পরিবর্তে দুর্বহ বোঝার কাজই করিবে বেশী। ইরাক ও সিরিয়ার জমি উহার মালিকদের নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়া ও বিজিত লোকদেরকে ক্রীতদাস বানাইয়া বিজয়ী মুসলামানের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিলে সীমান্তের সংরক্ষণ ব্যবস্থা কিরূপে কার্যকর হইবে? কেননা মুসলামানগণ তো কৃষিকাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িবে। এতদ্ব্যতীত ইয়াতীম ও অসহায় বিধবাদের ভরণ-পোষণের কাজও অসমাপ্তিই থাকিয়া যাইবে’।
খলীফা উমর ফারুক(রা)-এর এই ভাষণ শ্রবণ করার পর সকলে একবাক্যে বলিয়া উঠিলেনঃ “আপনার মত বাস্তবিকই সঠিক ও নির্ভুল, তাহাতে সন্দেহ নাই। সীমান্তে ও শহরে যদি সৈন্যবাহিনী নিয়োজিত না থাকে, তাহা হইলে এইসব এলাকা সংরক্ষণ করার কোনই ব্যবস্থা থাকিবে না এবং ইসলামের দুশমনগণ পুনরায় এই শহরগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া বসিবে”।হযরত উমর বলিলেনঃ এই ব্যাপারটি তো পরিস্কার হইয়া গেল। এখন আমার এমন একটি লোকের প্রয়োজন, যিনি খারাজ নির্ধারণের জন্য সমগ্র ইরাকের জরীপ কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব গ্রহণ করিবেন’। অতঃপর উমরান ইবন হানীফকে এই কাজে নিযুক্ত করা হইল। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রম সহকারে এই কাজ সম্পন্ন করিলেন এবং হযরত উমর (রা)- এর শাহাদাত লাভের এক বৎসর পূর্বেই সওয়াদে কুফা হইতে আদায়কৃত খারাজের পরিমাণ এক কোটি মুদ্রা পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল।
সিরিয়া বিজয়ের পরও সৈনিকদের পক্ষ হইতে অধিকৃত জমি সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়ার দাবি উত্থাপিত হয়। কিন্তু তখনও হযরত ফারুকে আজম (রা) উক্তরুপ জওয়াব দিয়া সকলকে নিরস্ত করেন। ফলে ইরাকের ন্যায় সিরিয়ার ভূমি হইতেও বিপুল পরিমাণ খারাজ সরকারী খাজাঞ্জীতে সঞ্চিত হইতে থাকে।
বস্তুতঃ বিজিত এলাকার জমিক্ষেত বিজয়ীদের মধ্যে বণ্টন না করিয়া পুরাতন বাসিন্দাদের দখলে উহা থাকিতে দেওয়া এবং তাহাদিগকে উহার চাষাবাদ করার সুযোগ দিয়া তাহাদের নিকট হইতে খারাজ আদায় করা সম্পর্কে হযরত উমর ফারুক (রা)- এর অভিমত অত্যন্ত দূরদর্শীতার পরিচায়ক ছিল। তখন এইরূপ ফয়সালা গৃহীত না হইলে মুসলিম জাতি তাহার আসল দায়িত্ব ভুলিয়া গিয়া ক্ষেত-খামার লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িত এবং সামরিক দক্ষতা হারাইয়া ফেলিত।দ্বিতীয়তঃসেই এলাকার সংরক্ষণকারী ও অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলে যুদ্ধলিপ্ত ইসলামী সৈনিকদের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহেরও কোন ব্যবস্থা করা সম্ভব হইত না। আর ইহাই হইত সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ও অপূরনীয় ক্ষতি। কেননা, এই সুযোগে পারসিক ও রোমক সরদার যা নিজেদের দেশের উপর মুসলিম আধিপত্য স্থাপিত হওয়ায় দেশত্যাগ করিয়া অন্যত্র আশ্রয় লইয়াছিল তাহারা পুনরায় নিজেদের দেশ দখল করিয়া বসিতে পারিত ও মুসলমানদের উপর প্রবলভাবে আক্রমণ চালাইত।
জিযিয়া
ইসলামী খিলাফতে যিম্মিদের(অমুসলিম অনুগত নাগরিকদের) নিকট হইতে তাহাদের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু সংরক্ষণ ও উহার নিরাপত্তার বিনিময়ে যে অর্থ গ্রহণ করা হইত, ইসলামী পরিভাষায় উহাকে ‘জিযিয়া’ বলা হয়। ইহা কেবলমাত্র বয়স্ক ও সুস্থ-সবল পুরুষদের নিকট হইতেই আদায় করা হইত। নারী,শিশু, দরিদ্র ও পঙ্গুদের উপর ইহা ধার্য করা হইত না। হযরত উমর (রা) বহু দরিদ্র যিম্মীর জন্য বায়তুলমাল হইতে বৃত্তি মঞ্জুর করিয়াছিল। ‘জিযিয়া’ ধার্য হইত ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং উহার পরিমাণ ১২ দিরহামের কম ও ২৮ দিরহাম অপেক্ষা বেশী হইত না। হযরত উমর (রা) তাহার পরবর্তী খলিফাদিগকে যিম্মীদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন, নম্র আচরণ করা, প্রতিশ্রুতি পালন ও তাহাদের জান-মাল সংরক্ষণের জন্য লড়াই করা এবং তাহাদের উপর সামর্থ্যাপেক্ষা অধিক দায়িত্ব-ভার অর্পণ না করার জন্য বিশেষভাবে উপদেশ দান করিয়াছেন।
যাকাত
খিলাফতের আমলে মুসলমানদের সকল প্রকার সঞ্চিত ধন,গৃহপালিত পশু, নগদ সম্পদ ও জমির ফসলের উপর কুরআন ও সুন্নাহ মুতাবিক যাকাত ধার্য করা হইয়াছিল। এই যাকাত রীতিমত আদায় করা হইত এবং উহার প্রাপক আটটি শ্রেণীর মধ্যে উহা বণ্টন করা হইত।
শুল্ক
মুসলিম ব্যবসায়ীগণ যখন বিদেশে নিজেদের পণ্য রফতানি করিতেন, তখন তাঁহাদের নিকট হইতে সেই দেশ এক দশমাংশ শুল্ক বাবদ আদায় করা হইত।হযরত উমর (রা) যখন ইহা জানিতে পারিলেন, তখন তিনিও ইসলামী রাজ্যে আমদানিকৃত পণ্যের উপর অনুরূপ পরিমাণ শুল্ক ধার্য করার নির্দেশ দান করিলেন। এতদ্ব্যতীত যিম্মী ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে বিশভাগের একভাগ ও মুসলিম ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে সমগ্র সম্পদের চল্লিশভাগের একভাগ আদায় করা হইত। তবে দুইশত দিরহামের কম মূল্যের সম্পদের উপর কিছুই ধার্য করা হইত না।
মুদ্রা
আরবদেশের ইসলামের পূর্বে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইরানী ও রোমীয় মুদ্রা প্রচলিত ছিল। নবী করীম(স) ও হযরত আবূ বকরল (রা)-এর খিলাফত কালেও এই মুদ্রাই চালু ছিল। ইরান বিজয়ের পর হযরত উমর(রা) দিরহামের ওজন করিবার ইচ্ছা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। কেননা ইরানী মুদ্রায় ওজন বিভিন্ন প্রকারের হইত। মোট কথা খিলাফতে রাশেদার আমলে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ বর্তমান ও কার্যকর ছিল এবং উহা কোন দিক দিয়াই পশ্চাদবর্তী ছিল না।